ব্যক্তিসত্তার সমস্যা

ব্যক্তিসত্তার সমস্যা

আমার অস্তিত্বের এক মেরুতে আমি গাছের গুঁড়ি ও পাথরের সঙ্গে এক। সেখানে আমাকে বিশ্বজনীন নিয়মের শাসন স্বীকার করতে হয়। অর্থাৎ সেখানে গভীর অতলে আমার অস্তিত্বের ভিত নিহিত। সমগ্র জগতের দৃঢ়মুষ্টিতে আবদ্ধ থাকার মধ্যে, ও সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পূর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে এর শক্তি।

কিন্তু আমার অস্তিত্বের অন্য মেরুতে আমি সকলের থেকে স্বতন্ত্র। সেখানে আমি সমতার বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এসেছি ও একজন ব্যক্তিরূপে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমি সম্পূর্ণ অদ্বিতীয়, আমি আমি, আমি অতুলনীয়। আমার এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে বিশ্বের সমগ্র ভার চূর্ণ করতে পারে না। সমস্ত কিছুর ভয়ঙ্কর আকর্ষণ সত্ত্বেও আমি একে রক্ষা করি। এ দেখতে ক্ষুদ্র হলেও বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে সমস্ত শক্তি এর বৈশিষ্ট্য কেড়ে নিতে পারে ও ধূলিকণার সঙ্গে একে এক ক’রে দিতে পারে তাদের বিরুদ্ধে এ নিজেকে ধরে রাখতে পারে।

ব্যক্তিসত্তার এই অতিবিন্যাস অনির্ধারিত গভীর ও অন্ধকারময় ভিত্তি থেকে প্রকাশ্যে উঠে আসে, নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সে গর্বিত, সমগ্র বিশ্বে যার কোনো প্রতিরূপ নেই নির্মাতার এমন এক ভাবকে রূপ দেওয়ার জন্য সে গর্বিত। এই স্বাতন্ত্র্য যদি ভেঙে দেওয়া হয়, তা হলে যদিও বস্তুগত কিছু হারিয়ে যাবে না, একটি পরমাণুও বিনষ্ট হবে না, শুধু তার মধ্যে সৃষ্টির যে নিবিড় আনন্দ রয়েছে তা চলে যাবে। আমরা সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যাব যদি যাকে আমরা একমাত্র নিজস্ব বলতে পারি সেই বৈশিষ্ট্য, সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই; এবং এ যদি হারিয়ে যায়, তা হলে সমস্ত জগতেরও ক্ষতি। এ সর্বাধিক মূল্যবান কারণ এ সার্বজনীন নয়। আর সেইজন্য নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন না থেকে বিশ্বের বুকে শুয়ে থাকলে যা পেতাম তার থেকে বেশী সত্যরূপে একমাত্র এর মধ্যে দিয়েই আমরা জগৎকে পাই। বিশ্বজনীনতা চিরকাল স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে তার পরিপূর্ণতার সন্ধান ক’রে চলেছে। এবং আমাদের এই স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার ইচ্ছা বস্তুত বিশ্বেরই ইচ্ছা আমাদের মধ্যে দিয়ে কাজ ক’রে চলেছে। আমাদের মধ্যে অসীমের যে আনন্দ রয়েছে সেই আনন্দ আমাদের নিয়েই আমাদের আনন্দ দেয়।

ব্যক্তিসত্তার এই স্বাতন্ত্র্যকে মানুষ যে সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ মনে করে তা প্রমাণিত হয়, এর জন্য যে দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে সে যায় এবং এর জন্য যে পাপ সে করে তার থেকে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতনতা এসেছে জ্ঞানের ফল খাওয়া থেকে। মানুষকে সে লজ্জা, অপরাধ ও মৃত্যুর দিকে চালিত করেছে; তা সত্ত্বেও সে মানুষের কাছে যে-কোনো স্বর্গের থেকে অনেক বেশী প্রিয়, যেখানে ব্যক্তিসত্তা সম্পূর্ণ সরলতায় প্রকৃতির মাতৃজঠরে নিরাপদে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে।

আমাদের এই সত্তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার জন্য আমাদের নিরন্তর চেষ্টা ও কষ্টভোগ থাকে এবং বাস্তবিক এই কষ্টভোগই এর মূল্য নির্ধারণ করে। মূল্যের একদিকে রয়েছে ত্যাগ, যা তার জন্য কত দাম দিতে হয়েছে তা প্রকাশ করে। অন্যদিকে রয়েছে সাফল্য, যা কত প্রাপ্তি হয়েছে তা প্রকাশ করে। কষ্টভোগ ও ত্যাগ ছাড়া আমাদের কাছে সত্তার যদি আর কোনো অর্থ না থাকতো, তা হলে আমাদের কাছে তার মূল্য থাকতো না, এবং কোনো কারণেই স্বেচ্ছায় আমরা এই রকম ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যেতাম না। এমন অবস্থায় নিঃসন্দেহে মানবতার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হতো সত্তার বিলোপ।

কিন্তু অনুরূপ ভাবে যদি সাফল্য থাকে, যদি তা শূন্যে পরিসমাপ্ত না হয়ে পূর্ণতায় হয়, তা হলে পরিষ্কার হয় যে এর নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলি, এর সমস্ত কষ্টভোগ ও ত্যাগ, একে আরো বেশী মূল্যবান ক’রে তোলে। এমন যে হয় তা প্রমাণিত হয়েছে যাঁরা সত্তার ইতিবাচক গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন, এর সমস্ত দায়িত্ব সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন, এবং নির্ভয়ে সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তাঁদের মাধ্যমে।

এই পর্যন্ত দেওয়া ভূমিকায় আমার পক্ষে আমার এক শ্রোতার জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হয়ে যাবে যে, ভারতবর্ষে কি সত্তার বিলোপকে মনুষ্যত্বের চরম লক্ষ্য ব’লে ধরা হয়নি?

প্রথমতঃ, আমাদের এই তথ্য মনে রাখতে হবে যে নিতান্ত সাধারণ বিষয় ছাড়া মানুষ কখনোই আক্ষরিক ভাবে তার ধারণা প্রকাশ করে না। প্রায়ই মানুষের শব্দ একেবারেই কোনো ভাষা হয় না, বরং বোবার কণ্ঠোচ্চারিত ইশারা মাত্র হয়। তারা ইঙ্গিত দিতে পারে, কিন্তু তার চিন্তা প্রকাশ করে না। তার চিন্তা যত গভীর হয় তত তার শব্দগুলিকে তার জীবন অনুসারে ব্যাখ্যা করতে হয়। যাঁরা শব্দকোষের সাহায্যে তার অর্থ জানতে চান তাঁরা শুধু কৌশলগত ভাবে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছান, কারণ বাইরের দেওয়াল তাঁদের থামিয়ে দেয়, বড় ঘরে প্রবেশের কোনো পথ তাঁরা পান না। এই কারণেই আমাদের শ্রেষ্ঠ ঋষিদের শিক্ষা যখন আমরা নিজেদের জীবনে উপলব্ধি না ক’রে শুধুমাত্র তাদের শব্দ অনুসরণে তাদের বুঝতে চেষ্টা করি, তখন তারা অন্তহীন বাদানুবাদের সৃষ্টি করে। যে সমস্ত ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থ গ্রহণের মানসিকতার সহজাত গুণে অভিশপ্ত সেই ভাগ্যহীনেরা সব সময় মাছ ধরাকে অবহেলা ক’রে মাছের জাল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

শুধু বৌদ্ধ এবং ভারতীয় ধর্মসমূহে নয়, খ্রীষ্ট ধর্মেও, নিঃস্বার্থতার আদর্শ যত্ন সহকারে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। শেষোক্ত মতে যে জীবন সত্য নয় তার থেকে মানুষের মুক্তির ধারণা প্রকাশের জন্য মৃত্যুর প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রদীপ নির্বাপণের প্রতীক, নির্বাণের সঙ্গে এই ধারণা এক।

ভারতীয় চিন্তার বৈশিষ্ট্যে ধরা হয় যে মানুষের যথার্থ মুক্তি হলো “অবিদ্যার” থেকে, অজ্ঞানের থেকে মুক্তি। এ কোনো সদর্থক ও বাস্তব কিছুর বিনাশে নেই, কারণ তা সম্ভব নয়, বরং রয়েছে নঞর্থক যা কিছু আমাদের সত্য দর্শনে বাধা দেয়, তার বিনাশে। যখন অজ্ঞানের এই প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয়, কেবল তখনই আমাদের দৃষ্টি উন্মীলিত হয় অথচ চোখের কোনো ক্ষতি হয় না।

আমাদের অবিদ্যা আমাদের চিন্তা করতে শেখায় যে আমাদের সত্তা, সত্তা রূপে সত্য, তার সম্পূর্ণ অর্থ রয়েছে তার নিজের মধ্যে। যখন আমরা সত্তা সম্বন্ধে এই ভ্রান্ত মত গ্রহণ করি, তখন এমন ভাবে জীবন যাপন করার চেষ্টা করি যাতে আমাদের সত্তা আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্যে পরিণত হয়। তখন নিরাশায় আমাদের সর্বনাশ হয়; যেমন ক’রে কোনো ব্যক্তি পথের ধুলোকে আঁকড়ে ধরে লক্ষ্যে পৌঁছাবার চেষ্টা করলে হয়। আমাদের ধরে রাখার কোনো উপায় আমাদের সত্তার নেই, কারণ অগ্রসর হওয়া এর নিজের স্বভাব; আর এই সত্তার সুতোকে আঁকড়ে ধরে থাকলেও যেহেতু জীবনের তাঁতের মধ্যে দিয়ে সে অগ্রসর হয়ে যায় সেহেতু যে কাপড়ের জন্য তাকে বোনা হচ্ছে তাকে দিয়ে সেই অভীষ্ট সাধন হয় না। কোনো ব্যক্তি যখন বিশেষ যত্ন সহকারে নিজের ভোগের ব্যবস্থা করেন, তখন তিনি আগুন জ্বালেন কিন্তু নিজের জন্য রুটি বানানোর মাখা ময়দা তাঁর কাছে থাকে না; আগুন জ্বলে ওঠে আর নিজেকে ক্ষয় ক’রে নিঃশেষ হয়ে যায়, ঠিক যেমন ক’রে অস্বাভাবিক কোনো জন্তু নিজের শাবক নিজেই খেয়ে ফেলে ও মরে যায়।

কোনো অজানা ভাষায় শব্দের অত্যাচার প্রকট। তারা আমাদের থামিয়ে দেয় কিন্তু কিছু বলে না। শব্দের এই বন্ধন থেকে উদ্ধার পেতে হলে, আমাদের অবিদ্যা, আমাদের অজ্ঞান থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে, আর তা হলে আমাদের মন অন্তরতর ভাবের মধ্যে নিজের স্বাধীনতা খুঁজে পাবে। কিন্তু এ কথা বলা বিচারবুদ্ধিহীন হবে যে ভাষা সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা শব্দের বিনাশে দূর হতে পারে। তা নয়, যখন যথার্থ জ্ঞানের উদয় হয়, তখন প্রতিটি শব্দ স্বস্থানে থাকে, শুধুমাত্র তাদের সঙ্গে আমাদের আবদ্ধ করে না, বরং তাদের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে দেয়, আর মুক্তির ধারণার দিকে চালিত করে।

এই ভাবে একমাত্র অবিদ্যা আমাদের সত্তাকে আমাদের বন্ধনে পরিণত ক’রে আমাদের ভাবতে শেখায় যে নিজের মধ্যে নিজের সত্তার পরিসমাপ্তি এবং বুঝতে দেয় না যে তার নিজের মধ্যেই নিজের সীমা অতিক্রম করার ধারণা রয়েছে। এইজন্য জ্ঞানী ব্যক্তি আসেন ও বলেন, “অবিদ্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করো; নিজের যথার্থ স্বরূপ জানো আর সত্তার যে দৃঢ়মুষ্টি তোমাকে বন্দী ক’রে রেখেছে, তার থেকে নিজেকে রক্ষা করো।” আমরা মুক্তি লাভ করি যখন আমাদের যথার্থ স্বরূপে পৌঁছাতে পারি। একজন শিল্পী যখন তাঁর শিল্পের আদর্শ খুঁজে পান তখন তিনি শিল্পীর স্বাধীনতা লাভ করেন। তখন তিনি অনুকরণের শ্রমসাধ্য চেষ্টা থেকে, প্রচলিত অনুমোদনের অঙ্কুশ থেকে মুক্ত হন। ধর্মের কাজ আমাদের স্বরূপকে বিনাশ না ক’রে পরিপূর্ণ করা।

সংস্কৃত শব্দ “ধর্ম” ইংরেজিতে যা সাধারণতঃ “রিলিজিয়ন” শব্দে অনুবাদ করা হয় আমাদের ভাষায় তার অর্থ আরো গভীর। ধর্ম সবকিছুর অন্তরতম স্বরূপ, মূল উপাদান, অন্তর্নিহিত সত্য। আমাদের সত্তায় যে চরম উদ্দেশ্য কাজ ক’রে চলেছে, তাই ধর্ম। যখন কোনো অন্যায় করা হয় আমরা বলি ধর্ম লঙ্ঘিত হয়েছে, তার অর্থ আমাদের সত্য স্বরূপে মিথ্যা আরোপিত হয়েছে।

কিন্তু এই ধর্ম, যা আমাদের কাছে সত্য, তা আপাতপ্রতীয়মান নয়, কারণ তা সহজাত। এতখানি যে, ধরে নেওয়া হয় পাপ আচরণ মানুষের স্বভাব, আর শুধুমাত্র ঈশ্বরের বিশেষ করুণায় ব্যক্তিবিশেষ পরিত্রাণ পেতে পারেন। যেমন বলা হয় যে বীজের স্বভাব তার খোলার মধ্যে ঢাকা থাকা, আর কেবল মাত্র বিশেষ কোনো অলৌকিক ঘটনায় তা গাছে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আমরা কি জানি না যে বীজের বাহ্য রূপ তার প্রকৃত স্বরূপের বিপরীত? যখন তুমি তাকে রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য দাখিল করো, তখন তার মধ্যে কার্বন, প্রোটিন এবং আরো অনেক অন্য উপাদান পেতে পারো, কিন্তু ডালপালা মেলা গাছের ধারণা পাবে না। শুধু যখন গাছ নির্দিষ্ট আকার নিতে শুরু করে তখন তুমি তার “ধর্ম” দেখতে পাও, আর তখন তুমি নিঃসন্দেহে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারো, যে বীজ নষ্ট হয়েছে আর যাকে মাটিতে পচে যেতে দেওয়া হয়েছে, সে তার “ধর্মে”, তার প্রকৃত স্বরূপের সার্থকতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। মানব ইতিহাসে আমরা জেনেছি যে আমাদের প্রাণবন্ত বীজের কণা পল্লবিত হয়। আমরা দেখেছি মহামানবদের জীবনে আমাদের মহৎ উদ্দেশ্য রূপ গ্রহণ করে আর আমরা নিশ্চিত ভাবে অনুভব করেছি যে যদিও অসংখ্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ব্যর্থ ব’লে মনে হয়, তবুও তাদের ধর্ম বিফলে যায় না; বরং তাদের করণীয় হয় আবরণ ভেঙে ফেলা, ও প্রাণশক্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিকতার অঙ্কুরে নিজেদের রূপান্তরিত করা, আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ও সব দিকে বিস্তার লাভ করা।

বীজের মুক্তি তার ধর্ম, তার স্বরূপ লাভ করাতে, এবং তার লক্ষ্য গাছে পরিণত হওয়াতে; তা অসম্পূর্ণ থাকাই তার কারাবাস। যে আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে কোনো কিছু পূর্ণতা লাভ করে, সেই আত্মত্যাগের পরিণতি মৃত্যু নয়; এ হলো বন্ধন প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে দিয়ে মুক্তি অর্জন করা।

আমরা যখন কোনো ব্যক্তির মুক্তির চরম আদর্শ জানি, তখন তার ধর্ম, তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য, তার সত্তার প্রকৃত অর্থ জানি। প্রাথমিক ভাবে মনে হয় মানুষ তাকেই মুক্তি ব’লে গণ্য করে যাতে আত্মতুষ্টি ও নিজেকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখবার অবাধ সুযোগ পায়। কিন্তু অবশ্যই ইতিহাস তা সমর্থন করে না। যাঁরা আত্মত্যাগের জীবন যাপন করেছেন, চিরকাল তাঁরাই আমাদের ঋষি (প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি)। মানুষের উন্নত প্রকৃতি সর্বদা এমন কিছুর অনুসন্ধান করছে যা তাকে অতিক্রম ক’রে থাকে এবং তৎসত্ত্বেও যা নিগূঢ় সত্য; যা তার সমস্ত ত্যাগ দাবী করে, তৎসত্ত্বেও এই ত্যাগকেই নিজের ক্ষতিপূরণ ক’রে তোলে। এই হলো মানুষের ধর্ম, এবং মানবাত্মা হলো এই ত্যাগকে পূজাবেদীতে নিয়ে যাওয়ার তরণী।

আমরা আমাদের সত্তাকে দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি। একটি সত্তা নিজেকে প্রদর্শন করে, আরেকটি সত্তা নিজের সীমা ছাড়িয়ে যায় ও তার ফলে নিজের প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে। নিজেকে প্রদর্শন করার জন্য সে বড় হ’তে চেষ্টা করে, নিজের স্তূপীকৃত সম্পদের বেদীর উপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, এবং সব কিছু নিজের অধিকারে রাখার চেষ্টা করে। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সে নিজের যা কিছু আছে দিয়ে দেয়, আর এই ভাবে কুঁড়ি থেকে ফুটে ওঠা ফুলের মতো পূর্ণ হয়ে নিজের সৌন্দর্যের পেয়ালা থেকে সমস্ত মাধুর্য উজাড় ক’রে দেয়।

প্রদীপ তেল ধরে রাখে, তার শক্ত মুঠিতে নিরাপদে তাকে আটকে রাখে আর লেশমাত্র অপচয় থেকে রক্ষা করে। এই ভাবে সে অন্য সবকিছুর থেকে আলাদা হয়ে কৃপণের মতো থাকে। কিন্তু যখন প্রজ্জ্বলিত হয় তৎক্ষণাৎ নিজের অর্থ বুঝতে পারে; দূরের ও কাছের সবকিছুর সঙ্গে তার সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, আলোর শিখাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে নিজের তেলের ভাণ্ডার অবাধে দান ক’রে দেয়।

আমাদের সত্তা এই প্রদীপের মতো। যতক্ষণ সে তার সম্পত্তি জমা করে, ততক্ষণ সে নিজেকে অন্ধকারে রাখে, তার আচরণ তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের বিরোধী হয়। যখন সে আলো খুঁজে পায় তখন মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে ভুলে যায়, আলোকে ঊর্দ্ধ্বে তোলে, ও নিজের যা কিছু আছে, সব দিয়ে তার পরিচর্যা করে; কারণ সেখানেই তার প্রকাশ। এই প্রকাশকে বুদ্ধদেব মুক্তি ব’লে প্রচার করেছিলেন। তিনি প্রদীপকে তার তেল দান করতে বলেছিলেন। কিন্তু উদ্দেশ্যহীন পরিত্যাগ দীনতার আরও গভীর অন্ধকার তিনি অবশ্যই তা বোঝাতে চাননি। আলোর জন্য প্রদীপকে তার তেল দিতে হবে এবং এই ভাবে তার জমা ক’রে রাখার উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। এরই নাম মুক্তি। বুদ্ধদেব যে পথ নির্দেশ করেছিলেন তা শুধুমাত্র আত্ম ত্যাগের অভ্যাস নয়, তা প্রেমের বিস্তার। এর মধ্যেই বুদ্ধদেবের উপদেশের প্রকৃত তাৎপর্য রয়েছে।

আমরা যখন দেখি বুদ্ধদেব যে নির্বাণের উপদেশ দিয়েছিলেন তা প্রেমের মধ্যে দিয়ে আসে, তখন নিশ্চিত ভাবে জানি নির্বাণ হলো প্রেমের চরম উৎকর্ষ। কারণ প্রেম নিজেই নিজের পরিণাম। বাকি সবকিছু সম্বন্ধে আমাদের মনে প্রশ্ন হয় “কেন?” এবং তার জন্য আমাদের যুক্তি দরকার। কিন্তু যখন আমরা বলি “আমি ভালবাসি” তখন সেখানে “কেন”র কোনো স্থান থাকে না; এই হলো নিজের মধ্যে তার নিজের শেষ উত্তর।

নিঃসন্দেহে, স্বার্থপরতাও মানুষকে ত্যাগে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু স্বার্থপর ব্যক্তি বাধ্য হয়ে তা করে। এ যেন না পাকতে ফল পেড়ে ফেলা; তোমাকে গাছ থেকে তা ছিঁড়ে নিতে হবে, আর ডাল ভাঙতে হবে। কিন্তু মানুষ যখন ভালবাসে, দেওয়া তখন তার কাছে গাছের পাকা ফল সমর্পণের মতো আনন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের স্বার্থপর বাসনার অবিরাম আকর্ষণে আমাদের যা কিছু রয়েছে সব ভারী হয়ে ওঠে; আমাদের কাছ থেকে সহজে তাদের আমরা দূরে নিক্ষেপ করতে পারি না। মনে হয় তারা আমাদের স্বরূপে রয়েছে, আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় গায়ের চাম়ড়ার মতো লিপ্ত হয়ে আছে; আর তাদের আলাদা করলে আমাদের রক্ত ক্ষরণ হয়। কিন্তু প্রেম যখন আমাদের অধিকার করে তখন তার শক্তি বিপরীত দিকে কাজ করে। অন্তরঙ্গ ভাবে আমাদের সঙ্গে যা কিছু লিপ্ত ছিল সেগুলি তাদের অন্তরঙ্গতা ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, এবং আমরা দেখি যে সেগুলি আমাদের নয়। তাদের পরিত্যাগ করার মধ্যে ক্ষতির বদলে আমরা দেখি আমাদের স্বরূপের পরিপূর্ণতা।

এইভাবে পরিপূর্ণ প্রেমের মধ্যে আমরা আমাদের সত্তার মুক্তি দেখতে পাই। যত কষ্টের কারণই হোক না কেন একমাত্র প্রেমের জন্য যা করা হয় তাই স্বাধীন ভাবে করা হয়। কাজেই প্রেমের জন্য কিছু করা হলো কর্মে মুক্তি। গীতার নিষ্কাম কর্মের শিক্ষার এই অর্থ।

গীতায় বলা হয়েছে আমাদের কর্ম অবশ্যই থাকবে, কারণ একমাত্র কর্মেই আমাদের স্বরূপের প্রকাশ। কিন্তু এই প্রকাশ পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না আমাদের কর্ম স্বাধীন হয়। বস্তুতঃ, বাসনা বা ভয়ের বাধ্যবাধকতায় কর্ম করলে আমাদের স্বরূপ অস্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের সন্তানদের সেবায় মা নিজেকে প্রকাশ করেন, সেই রকম আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা কর্মের থেকে মুক্তিতে নয়, কর্মের মধ্যে মুক্তিতে, একমাত্র প্রেমের কর্মে তা লাভ করা যায়।

ঈশ্বরের প্রকাশ তাঁর সৃষ্টি-কর্মে, আর উপনিষদে বলা হয়েছে, “জ্ঞান, শক্তি ও কর্ম তাঁর স্বরূপ”; বাইরে থেকে তাঁর ওপর এরা আরোপিত হয়নি। এইজন্য তাঁর কর্মই তাঁর স্বাধীনতা, এবং নিজের সৃষ্টির মধ্যেই তিনি নিজেকে উপলব্ধি করেন। এই কথাই অন্যভাবে অন্যত্র বলা হয়েছে: “আনন্দের থেকে এই ভূত সকল উৎপন্ন হয়, আনন্দের মধ্যেই জীবিত থাকে, এবং প্রলয়কালে আনন্দের প্রতি গমন করে ও আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করে।” এর অর্থ ঈশ্বরের সৃষ্টির মূলে কোনো প্রয়োজন নেই; পরিপূর্ণ আনন্দের থেকে এ এসেছে; তাঁর প্রেমই সৃষ্টি করে; এইজন্য সৃষ্টিতে তাঁর নিজেরই প্রকাশ।

নিজের শিল্প ধারণার পরিপূর্ণতায় যে শিল্পীর আনন্দ রয়েছে তিনি সেই ধারণার বাস্তব রূপ দেন আর এই ভাবে নিজের থেকে দূরে রেখে আরো সম্পূর্ণ ভাবে তাকে লাভ করেন। এই আনন্দ নিজেদের কাছ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে, তারপর আরো সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আপন করার জন্য প্রেমের সৃষ্টিতে তাকে বাস্তব রূপ দেয়। কাজেই এই বিচ্ছেদ অবশ্যই থাকবে, এ বিকর্ষণের বিচ্ছেদ নয় কিন্তু এ প্রেমের বিচ্ছেদ। বিকর্ষণের একমাত্র উপাদান তীব্রতা। কিন্তু প্রেমের উপাদান দুইটি একটি তীব্রতা, বাইরের প্রকাশ মাত্র, আরেকটি মিলন, যা পরম সত্য। ঠিক যেমন পিতা নিজের সন্তানকে যখন নিজের হাত থেকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেন, তখন আপাতদৃষ্টিতে তা প্রত্যাখ্যান ব’লে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃত সত্য ঠিক বিপরীত।

কাজেই আমাদের জানতে হবে আমাদের সত্তার অর্থ ঈশ্বর ও অন্য সকলের থেকে বিচ্ছেদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় যোগ বা ঐক্যের নিরবচ্ছিন্ন উপলব্ধিতে; চিত্রপটের যে দিকটা ফাঁকা সেদিকে নয়, যে দিকে ছবি আঁকা চলেছে সেই দিকে।

এই হলো যুক্তি, কেন আমাদের দার্শনিকেরা মায়া ব’লে, মিথ্যা ব’লে আমাদের সত্তার বিচ্ছিন্নতাকে বর্ণনা করেছেন, কারণ মায়া নিজে কোনো অপরিহার্য সত্তা নয়। মনে হয় সে বিপজ্জনক; নিজের স্বাতন্ত্র্যকে সে বেপরোয়া উচ্চতায় তোলে ও অস্তিত্বের উজ্জ্বল রূপের উপরে সে কালো ছায়া ফেলে; বাইরে থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে বিদ্রোহী ও সংহারক; সংহতিনাশের একটা দিক তার আছে; সে অহংকারী, উদ্ধত ও স্বেচ্ছাচারী, তার এক মুহূর্তের কামনা চরিতার্থ করার জন্য বিশ্বের সমস্ত ঐশ্বর্য হরণ করতে সে প্রস্তুত; একদিনের জন্য নিজের অসুন্দর রূপ সাজিয়ে দিতে সৌন্দর্যের দেবোপম পাখির সমস্ত পালক বেপরোয়া নিষ্ঠুর হাতে তুলে ফেলতে সে প্রস্তুত; প্রকৃত পক্ষে লোককাহিনীতে আছে মানুষ তার ললাটে চিরকালের জন্য অবাধ্যতার কালো ছাপ বয়ে নিয়ে চলেছে; তবুও সবই মায়া, অবিদ্যার আবরণ; এ কুয়াশা, সূর্য নয়; এ কালো ধোঁয়া যা প্রেমের আগুনের পূর্ব লক্ষণ প্রকাশ করে।

কল্পনা করো কোনো আদিম মানুষ, তার অজ্ঞতায় মনে করে যে ব্যাঙ্কের ঋণ স্বীকারের কাগজের মধ্যে জাদু আছে, যার শক্তিতে এর অধিকারী যা চায় তাই পায়। সে কাগজগুলি স্তূপীকৃত করে, তাদের লুকিয়ে রাখে, নানারকম অদ্ভুত উপায়ে তাদের নাড়াচাড়া করে, তারপর শেষে নিজের সব চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে, এই দুঃখজনক সিদ্ধান্তে আসে যে তারা একেবারে মূল্যহীন, একমাত্র আগুনে ফেলার যোগ্য। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন ব্যাঙ্কের ঋণ স্বীকারের কাগজের সবটাই মায়া, আর যতক্ষণ ব্যাঙ্কে না দেওয়া হয়, ততক্ষণ নিষ্ফল। একমাত্র অবিদ্যা, আমাদের অজ্ঞান, বিশ্বাস করায় যে ব্যাঙ্কের ঋণ স্বীকারের কাগজের মতো আমাদের সত্তার স্বাতন্ত্র্য নিজেই মূল্যবান, আর এই বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে আমাদের সত্তা মূল্যহীন হয়ে যায়। একমাত্র অবিদ্যা যখন দূর হয়, তখন এই সত্তাই আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ নিয়ে আসে। কারণ তিনি নিজেকে অমৃত রূপে, আনন্দ রূপে প্রকাশ করেন। এই সমস্ত রূপ তাঁর থেকে ভিন্ন, আর একমাত্র তাঁরই আনন্দ এই সমস্ত রূপের মূল্য দিয়েছে। আমরা যখন এই রূপকে সেই মূল আনন্দে, প্রেমে ফিরিয়ে দিই, তখন আমরা তাদের ব্যাঙ্কে ভাঙাতে পারি আর তাদের সত্য খুঁজে পাই।

যখন শুধুমাত্র প্রয়োজন মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে তখন তা আকস্মিক ও অনিশ্চিত আকার নেয়, তা শুধু অস্থায়ী ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়; প্রয়োজন যখন তার গতি পরিবর্তন করে, তখন কাজটি পরিত্যক্ত হয় ও ধ্বংসের মধ্যে পড়ে থাকে। কিন্তু যখন তার কর্ম আনন্দের থেকে উদ্ভূত হয়, তখন যে আকার সে নেয় তাতে অমরত্বের উপকরণ থাকে। মানুষের অমরত্ব এই কর্মে তার নিজের স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্য এনে দেয়।

আমাদের সত্তা, ঈশ্বরের আনন্দরূপ হওয়ায় অমর। কারণ তাঁর আনন্দ হলো “অমৃতম্”, শাশ্বত। সে আমাদের মধ্যে থাকায়, যখন মৃত্যুর বাস্তবিকতায় সন্দেহ করা যায় না, তখনও মৃত্যু সম্বন্ধে সে আমাদের সন্দেহবাদী ক’রে তোলে। আমাদের ভিতরের এই বিরুদ্ধতার সমন্বয় সাধন থেকে আমরা এই সত্যে উপনীত হয়ে থাকি যে মৃত্যু ও জীবনের দ্বৈতভাবের মধ্যে এক সামঞ্জস্য আছে। আমরা জানি যে অভিব্যক্তিতে সসীম ও তাত্ত্বিক ভাবে অসীম আধ্যাত্মিক জীবনকে অসীমের উপলব্ধির যাত্রায় মৃত্যুর দ্বার অবশ্যই অতিক্রম ক’রে যেতে হয়। এই মৃত্যুর কোনো দ্বিতীয় নেই, এর মধ্যে কোনো জীবন নেই। কিন্তু জীবনের দ্বৈতরূপ রয়েছে; বাহ্যরূপ রয়েছে, ও রয়েছে সত্যরূপ; আর মৃত্যু হলো সেই বাহ্যরূপ, সেই মায়া, জীবনের যা অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। জীবিত অবস্থায় আমাদের সত্তাকে অবিরাম রূপের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, একে একই সময়ে জন্ম ও মৃত্যুর অবিরাম প্রবাহ বলা যেতে পারে। যখন আমরা মৃত্যুকে মেনে নিতে অস্বীকার করি; যখন আমাদের সত্তাকে কোনো নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় রূপ দিতে চাই; যখন সত্তা এমন কোনো আবেগ অনুভব করে না যা নিজেকে অতিক্রম করতে অনুপ্রাণিত করে; যখন সে নিজের সসীমতাকে চরম লক্ষ্য ধরে এবং সেই মতো আচরণ করে, বস্তুতঃ তখনই আমরা মৃত্যুকে বরণ করি। সেই সময় এই মৃত্যুতে মৃত্যুর জন্য আমাদের গুরুর আহ্বান আসে; এ সম্পূর্ণ ধ্বংসের নয় বরং এ শাশ্বত জীবনের আহ্বান। এ ভোরের আলোয় প্রদীপ নিভানো, সূর্যের বিলোপ নয়। আমাদের স্বরূপের গভীরে যে অন্তরতম ইচ্ছা রয়েছে তাকে সচেতন ভাবে রূপায়িত করার জন্য বাস্তবিক আমাদের কাছে এই আদেশ।

আমাদের অস্তিত্বে দুই ধরনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করা আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া দরকার। আমাদের দৈহিক প্রকৃতির ক্ষেত্রে যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা তার সম্বন্ধে আমরা সব সময় সচেতন। আমরা আহার ও পানীয় উপভোগ করতে চাই, আমরা দৈহিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অত্যন্ত লালায়িত থাকি। এই আকাঙ্ক্ষাগুলি আত্মকেন্দ্রিক; তারা শুধুমাত্র নিজেদের আবেগ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। আমাদের জিভের স্বাদ যা চায় তা অনেক সময় আমাদের পাকস্থলীর অনুমোদনের বিপরীতে যায়।

কিন্তু আমাদের আরেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা আমাদের সামগ্রিক দৈহিক পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত, এ সম্বন্ধে আমরা সাধারণত সচেতন নই। এ হলো সুস্বাস্থ্যের জন্য ইচ্ছা। এ সর্বদা নিজের কাজ ক’রে, পরিপূরণ করে ও মেরামত করে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নতুন ক’রে সমন্বয় করে, আর কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনে। আমাদের তাৎক্ষণিক দৈহিক সুখের ইচ্ছা পূরণের জন্য এর কোনো উদ্বেগ নেই, কিন্তু এ বর্তমান কালকে ছাড়িয়ে যায়। এ আমাদের সমগ্র দেহের মূল সত্য, এ আমাদের জীবনকে অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করে আর নিজের অংশগুলির মধ্যে ঐক্য বজায় রাখে। যিনি জ্ঞানী তিনি তা জানেন, ও অন্য সকল দৈহিক ইচ্ছাকে এর সঙ্গে সমন্বিত করেন।

এর থেকে আরও বড় আমাদের এক দেহ রয়েছে, তা সামাজিক দেহ। সমাজ এক সর্বাঙ্গ যুক্ত প্রতিষ্ঠান, তার অংশ রূপে আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা রয়েছে। আমরা নিজেদের সুখ ও স্বাধীনতা চাই। অন্যের থেকে অল্প দাম দিতে চাই ও বেশী লাভ করতে চাই। এই হলো কাড়াকাড়ি ও মারামারির কারণ। কিন্তু সামাজিক অস্তিত্বের গভীরে কাজ করে এমন অন্য এক ইচ্ছাও আমাদের আছে। এই ইচ্ছা সমাজের হিত সাধন করে। এ বর্তমানের সীমা ও ব্যক্তিগত সীমা অতিক্রম করে। এ অসীমের দিকে থাকে।

যিনি জ্ঞানী তিনি আত্মতৃপ্তির ইচ্ছার সঙ্গে সামাজিক মঙ্গল সাধনের ইচ্ছার সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা করেন, এবং একমাত্র এই ভাবেই নিজের উন্নততর সত্তার উপলব্ধি করতে পারেন।

সসীম রূপে ব্যক্তিসত্তা নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন থাকে, ও নির্দয় ভাবে সেখানে অন্যের থেকে অনেক বেশী সম্মান লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু অসীম রূপে শুধুমাত্র পদবৃদ্ধির দিকে নয় যা পূর্ণতার দিকে নিয়ে যায় এমন সামঞ্জস্য অর্জনের ইচ্ছা তার থাকে।

আমাদের দৈহিক প্রকৃতির বন্ধন-মুক্তি হয় স্বাস্থ্য লাভে, আমাদের সামাজিক সত্তার বন্ধন-মুক্তি হয় মঙ্গলে, আর আমাদের ব্যক্তিসত্তার মুক্তি হয় প্রেমে। এই শেষেরটিকে বুদ্ধদেব বলেছেন নির্বাণ— স্বার্থপরতার বিলোপ। প্রেমের কাজই এই, সে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায় না, বরং আলোর দিকে নিয়ে যায়। এই হলো বোধিলাভ, বা যথার্থ জাগরণ; এই হলো প্রেমের আলোকে আমাদের মধ্যে অপরিসীম আনন্দের প্রকাশ।

স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার মধ্যে দিয়ে আমাদের সত্তার উত্তরণ যে অভীষ্ট লাভে হয় তা সমন্বিত আত্মা। বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে এই সমন্বয়ে কখনো পৌঁছানো যায় না। কাজেই, ক্রমবিকাশের ইতিহাসে আমাদের ইচ্ছাকে পরম পূর্ণতার জন্য স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়। সদর্থক মুক্তি, যাকে বলা হয় প্রেম তা লাভ করার আগে, মুক্তির নঞর্থক রূপ, যাকে বলা হয় উচ্ছৃঙ্খলতা, তার সম্ভাবনা আমাদের মধ্যে অবশ্যই থাকে।

এই নঞর্থক মুক্তি, ব্যক্তিগত ইচ্ছার মুক্তি, চরম উপলব্ধি থেকে পিছন ফিরে থাকতে পারে কিন্তু নিজেকে তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে পারে না, কারণ তা হলে সে নিজের অর্থ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার স্বাধীনতা কিছু দূর পর্যন্ত থাকে; সেই পথ থেকে সরে আসা কি তা সে জানতে পারে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে পারে না। কারণ আমাদের নঞর্থক দিকে আমরা সীমাবদ্ধ। বিরুদ্ধ পথে অগ্রগতিতে, আমাদের অশুভ কাজের সমাপ্তি অবশ্যই করতে হয়। কারণ অশুভ অসীম নয়, এবং বিরুদ্ধতা নিজেই নিজের শেষ পরিণাম হতে পারে না। তার প্রকৃত গতি যে মঙ্গল ও প্রেমের দিকে তা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে। কারণ মঙ্গল ও প্রেম অসীম, এবং একমাত্র অসীমের মধ্যেই মুক্তির যথার্থ উপলব্ধি সম্ভব। সুতরাং আমাদের ইচ্ছার মুক্তি হতে পারে ব্যক্তিসত্তার সীমাবদ্ধতার দিকে যাওয়ায় নয়, যেখানে সে মায়া ও অভাব সেখানে নয়, বরং অসীমের দিকে যাওয়ায়, যেখানে রয়েছে সত্য ও প্রেম। মুক্তির নিজস্ব মৌলিক নিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তি যেতে পারে না ও সেইসঙ্গে মুক্ত থাকতে পারে না; সে আত্মহত্যা করতে পারে না ও সেইসঙ্গে জীবিত থাকতে পারে না। আমরা বলতে পারি না যে নিজেদের আবদ্ধ করতে আমাদের সীমাহীন স্বাধীনতা থাকা উচিত, কারণ বন্ধন স্বাধীনতার পরিসমাপ্তি ঘটায়।

সুতরাং আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতায় আপাত প্রতীয়মান ও সত্যের সেই একই দ্বৈতভাব আমাদের থাকে— আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা স্বাধীনতার আপাত প্রতীয়মান রূপ, আর প্রেমই সত্য। যখন আমরা এই আপাত প্রতীয়মানকে সত্যের থেকে আলাদা করে তোলার চেষ্টা করি, তখন আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দুঃখ নিয়ে আসে ও পরিণামে নিজের তুচ্ছতা প্রমাণ করে। সব কিছুতেই মায়া ও ‘সত্যম্’, আপাত প্রতীয়মান ও সত্যের দ্বৈতভাব আছে। শব্দ সকল যেখানে ধ্বনিমাত্র, সেখানে তারা মায়া ও সীমাবদ্ধ আর যেখানে তারা ধারণা, সেখানে তারা ‘সত্যম্’ ও অসীম। আমাদের সত্তা যেখানে ব্যক্তিমাত্র ও সসীম, যেখানে সে তার স্বাতন্ত্র্যকে চরম বলে মনে করে, সেখানে সে মায়া; আর যেখানে বিশ্বজনীনতার মধ্যে ও অসীমের মধ্যে, ঈশ্বরের মধ্যে, ‘পরমাত্মনে’র মধ্যে তার স্বরূপের প্রত্যভিজ্ঞা হয়, সেখানে সে ‘সত্যম্’। যিশুখ্রীষ্ট যখন বলেছিলেন, “আব্রাহামের আগে থেকে আমি আছি” তখন তিনি এই কথাই বুঝিয়েছিলেন। এ সেই শাশ্বত “আমি”, আমার মধ্যে যে “আমি” রয়েছেন, তাঁর মধ্যে দিয়ে যিনি কথা বলেন। ব্যক্তি আমি তার পরিপূর্ণতা লাভ করে যখন সে অনন্ত “আমি”র মধ্যে ঐক্যের স্বাধীনতা উপলব্ধি করে। তখনই মায়ার দাসত্ব বন্ধন থেকে তার পরিত্রাণ, অবিদ্যার থেকে, অজ্ঞানের থেকে উদ্ভূত আপাত প্রতীয়মানতার থেকে তার মুক্তি; “শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতম্”-এর মধ্যে তার মুক্তি: সত্যের মধ্যে পরিপূর্ণ শান্তিতে, মঙ্গলের মধ্যে উৎকৃষ্ট কর্মে, ও প্রেমের সম্পূর্ণ মিলনে এই মুক্তি।

শুধুমাত্র আমাদের সত্তায় নয়, প্রকৃতিতেও ঈশ্বরের থেকে স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। আমাদের দার্শনিকেরা একে মায়া বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ স্বাতন্ত্র্য নিজে নিজে থাকতে পারে না, সে ঈশ্বরের অসীমতাকে বাইরে থেকে সীমিত করতে পারে না। তার নিজের ইচ্ছা তার উপর সসীমতা আরোপ করেছে, ঠিক যেমন একজন দাবা-খেলোয়াড় দাবার ঘুঁটির চাল বিবেচনা ক’রে নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রিত করে। খেলোয়াড় প্রতিটি বিশেষ ঘুঁটির সঙ্গে স্বেচ্ছায় নিশ্চিত সম্বন্ধ স্থাপন করে ও এই নিয়ন্ত্রণের দ্বারা তার ক্ষমতায় আনন্দ উপলব্ধি করে। এমন নয় যে সে ইচ্ছা মতো দাবার ঘুঁটির চাল দিতে পারে না, কিন্তু যদি তা করে, তা হলে খেলা হতে পারে না। ঈশ্বর যদি তাঁর সর্বশক্তিমানের ভূমিকা গ্রহণ করেন, তা হলে তাঁর সৃষ্টি শেষ হয়ে যায়, আর তাঁর শক্তি সমস্ত অর্থ হারিয়ে ফেলে। কারণ শক্তিকে শক্তি হয়ে থাকতে হলে সীমার মধ্যে কর্ম করতে হয়। ঈশ্বরের জলকে জলই হতে হয়, তাঁর পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। যে নীতিতে তারা জল ও পৃথিবী হয়েছে, সে তাঁর নিজের নীতি, এর দ্বারা তিনি খেলাকে খেলোয়াড়ের থেকে আলাদা করেছেন; কারণ এতেই রয়েছে খেলোয়াড়ের আনন্দ।

নিয়মের সীমাবদ্ধতায় যেমন প্রকৃতি ঈশ্বরের থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেই রকম অহংকারের সীমাবদ্ধতাও ব্যক্তিসত্তাকে তাঁর থেকে আলাদা করে। স্বেচ্ছায় তিনি তাঁর ইচ্ছার সীমা নির্দিষ্ট করেছেন, এবং আমাদের ছোট্ট জগতের উপর আমাদের নিজেদের আধিপত্য দিয়েছেন। পিতা যেমন পুত্রকে কিছু বৃত্তি দিলে সীমার মধ্যে ইচ্ছামতো কিছু করার স্বাধীনতা তার থাকে, এও সেইরকম। যদিও তা পিতার নিজস্ব সম্পত্তির অংশ, তবুও তিনি নিজের ইচ্ছার প্রয়োগ থেকে তাকে মুক্ত রাখেন। এর যুক্তি হলো ইচ্ছা আসলে প্রেমের ইচ্ছা, আর তাই সে মুক্ত, আরেকটি স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে মিলনেই তার একমাত্র আনন্দ। যে অত্যাচারীর অবশ্যই ক্রীতদাস থাকে, সে তার প্রয়োজন সাধনের যন্ত্র রূপে তাদের দেখে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন সম্বন্ধে সচেতনতা অন্যদের ইচ্ছাকে নিংড়িয়ে বার ক’রে তার স্বার্থ সম্পূর্ণ রক্ষিত রাখে। এই স্বার্থ অন্যদের সামান্যতম স্বাধীনতাও সহ্য করতে পারে না, কারণ সে নিজেই স্বাধীন নয়। অত্যাচারী আসলে নিজের ক্রীতদাসদের উপরেই নির্ভরশীল, আর এই কারণে সে নিজের ইচ্ছার অধীন ক’রে তাদের পুরোপুরি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একজন প্রেমিকের নিজের প্রেম উপলব্ধির জন্য দুইটি ইচ্ছা অবশ্যই থাকে, কারণ প্রেমের পরম উৎকর্ষ আসে মিলনে, স্বাধীনতার সঙ্গে স্বাধীনতার মিলনে। সুতরাং যে ঈশ্বর-প্রেম থেকে আমাদের সত্তা মূর্ত হয়েছে, সেই প্রেমই ঈশ্বরের থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে; এবং সেই ঈশ্বর-প্রেমই আবার সমন্বয় স্থাপন করে ও বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে আমাদের সত্তার সঙ্গে ঈশ্বরকে মিলিত করে। সেইজন্য আমাদের সত্তাকে অবিরাম পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এর কারণ বিচ্ছিন্নতা দিয়ে তার অগ্রগতি চিরকাল চলতে পারে না। বিচ্ছিন্নতা সসীম বলে বারবার মূলের অসীমতায় ফিরে আসতে বাধা পায়। অবিনশ্বর যৌবন উপলব্ধি করার জন্য আমাদের সত্তাকে অবিরাম বার্ধক্য ত্যাগ করতে হয়, বারবার বিস্মৃতি ও মৃত্যুর সীমা ছাড়িয়ে যেতে হয়। কালে কালে তার ব্যক্তিত্বকে অবশ্যই নিখিল সৃষ্টির মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হতে হয়, বস্তুতঃ তার ব্যক্তি জীবনকে নিত্য নতুন ক’রে তোলার জন্য প্রতি মুহূর্তে এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাকে অবশ্যই শাশ্বত ছন্দ অনুসরণ করতে হয়, ও প্রতি পদক্ষেপে মূলগত ঐক্য স্পর্শ করতে হয়, এবং এইভাবে সৌন্দর্য ও শক্তির সমতায় তার বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হয়।

সর্বত্রই আমরা জীবন মৃত্যুর খেলা দেখতে পাই— এ হলো পুরাতনের নূতনে রূপান্তর। প্রতি সকালে আমাদের কাছে উন্মুক্ত ও শুভ্র ফুলের মতো সতেজ হয়ে দিন আসে। কিন্তু আমরা জানি যে সে পুরাতন। এ স্বয়ং কাল। এ সেই সুপ্রাচীন দিন, যে সদ্যোজাত পৃথিবীকে দু’হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিল, নিজের শুভ্র আলোর আবরণে তাকে মুড়ে দিয়েছিল, আর তারাদের সঙ্গে তাকে তীর্থ যাত্রায় পাঠিয়েছিল।

তৎসত্ত্বেও তার পা দুইটি অক্লান্ত এবং তার চোখ দুইটি সমুজ্জ্বল। চিরতরুণ অনন্ত কালের সোনার কবচ রয়েছে তার সঙ্গে, যার স্পর্শে সৃষ্টির ললাট থেকে সমস্ত কুঞ্চন অদৃশ্য হয়ে যায়। পৃথিবীর অন্তরের অন্তরতম স্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে মৃত্যুহীন যৌবন। মৃত্যু ও ক্ষয় তার মুখের উপর ক্ষণিকের ছায়া ফেলে ও এগিয়ে যায়; কোনো পদচিহ্ন তারা রেখে যায় না— আর সত্য সজীব ও তরুণ থেকে যায়।

আমাদের পৃথিবীর এই অতি পুরাতন দিন প্রতি সকালে বার-বার জন্ম নেয়। তার গানের মূল সুরে সে ফিরে ফিরে আসে। তার এগিয়ে চলা যদি এক অন্তহীন সোজা পথে এগিয়ে চলা হতো, অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর বিরতি যদি না থাকতো এবং অন্তহীন সূচনার মধ্যে যদি তাকে বার-বার জন্মাতে না হতো, তা হলে সে ক্রমে তার ধুলো দিয়ে সত্যের উপর দাগ ফেলতো আর তাকে চাপা দিতো এবং তার ভারী পদক্ষেপে পৃথিবীর উপরে অবিরাম ব্যথা বেদনা ছড়িয়ে দিতো। তখন প্রত্যেক মুহূর্ত তার ক্লান্তির বোঝা পিছনে ফেলে যেতো, আর তার চিরদিনের ধূলিমলিন সিংহাসনে ধ্বংসের শেষ অবস্থা চরম আধিপত্য বিস্তার করতো।

কিন্তু প্রতি সকালে সদ্য ফোটা ফুলের মধ্যে দিনের পুনর্জন্ম হয় একই বার্তার পুনরাবৃত্তি ক’রে ও একই আশ্বাস নতুন ক’রে দিয়ে মৃত্যু চিরকাল মৃত্যুবরণ করে, আলোড়নের ঢেউ উপরের স্তরে থাকে, আর শান্তির পারাবার থাকে অতলে। রাতের যবনিকা পাশে সরে যায় আর বেশভূষায় কণামাত্র ধূলি ছাড়া সত্য প্রকাশিত হয়, তার অঙ্গরেখায় বার্ধক্যের লেশমাত্র কুঞ্চন থাকে না।

আমরা দেখি যে সমস্ত কিছুর সামনে যিনি রয়েছেন, তিনি আজও একই আছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে সৃষ্টির সংগীতের প্রতিটি সুর নতুন হয়ে আসে। বিশ্বজগৎ প্রতিধ্বনি মাত্র নয়, গৃহহীন ভবঘুরের মতো আকাশে আকাশে প্রতিহত হয়ে চলে না— সবকিছুর অস্ফুট আরম্ভে একবারের জন্য গাওয়া ও তারপর অনাথ শিশুর মতো পরিত্যক্ত পুরনো গানের প্রতিধ্বনি নয়। প্রতি মুহূর্তে সে প্রভুর অন্তর থেকে আসে, তাঁর নিশ্বাসে নিশ্বাস নেয়।

আর এই কারণেই সে সারা আকাশে ছড়িয়ে যায় যেমন ক’রে একটি চিন্তা যখন কোনও কবিতায় রূপ নেয়, আর কখনোই নিজের পুঞ্জীভূত ওজনের ভারে তাকে টুকরো টুকরো হতে হয় না। এই জন্য অন্তহীন বৈচিত্র্যের বিস্ময়, বেহিসাবীর আবির্ভাব, ব্যক্তি মানুষের বিরামহীন শোভাযাত্রা, এরা প্রত্যেকেই সৃষ্টিতে অতুলনীয় হয়। শুরুতে যেমন শেষেও তেমনি, আরম্ভের কোনো শেষ নেই— এই জগৎ চির পুরাতন ও চির নবীন।

আমাদের সত্তাকে জানতে হয় যে জীবনের প্রতি মুহূর্তে তাকে অবশ্যই নতুন ক’রে জন্মাতে হবে। তাকে সমস্ত মায়া ভেদ করতে হবে যা তাকে বৃদ্ধ দেখানোর জন্য কঠিন আবরণে আবৃত করে, তার উপরে মৃত্যুর বোঝা চাপিয়ে দেয়।

কারণ জীবন মৃত্যুহীন তরুণ, আর যে বার্ধক্য তার গতিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাকে সে ঘৃণা করে— বার্ধক্য প্রকৃত অর্থে জীবনে থাকে না, কিন্তু ছায়া যেমন প্রদীপকে অনুসরণ করে সেও তেমন জীবনকে অনুসরণ করে।

নদীর মতো আমাদের জীবন তীরে আঘাত করে নিজেকে তীরে আবদ্ধ দেখার জন্য নয়, বরং সমুদ্রের দিকে তার অন্তহীন পথ যে খোলা রয়েছে প্রতি মুহূর্তে নতুন ক’রে তা উপলব্ধি করার জন্য। এ কবিতার মতো প্রতি পদে যে ছন্দের পথ ধরে যায়, তার কঠিন নিয়মে স্তব্ধ হওয়ার জন্য নয়, বরং প্রতি মুহূর্তে তার সমন্বয়ের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা প্রকাশ করার জন্য।

আমাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চতুঃসীমার দেওয়াল এক দিকে যেমন আমাদের জোরে ধাক্কা দিয়ে সীমার মধ্যে ফিরিয়ে দেয়, অন্যদিকে তেমন অসীমের দিকে এগিয়ে দেয়। শুধু যখন আমরা এইসব সীমাকে অসীমে পরিণত করতে চাই তখনই অসম্ভব বৈপরীত্যের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকি আর যৎপরনাস্তি দুঃখদায়ক ব্যর্থতা ডেকে আনি।

এই হলো কারণ যা মানব ইতিহাসে মহান বিপ্লবের পথ প্রদর্শন করে। কোনো ব্যষ্টি যখনই সমষ্টিকে অবজ্ঞা ভরে প্রত্যাখ্যান ক’রে এক নিজস্ব ধারা চালানোর চেষ্টা করে, তখন সমষ্টি তাকে প্রচণ্ড জোরে টানে, তাকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়, ও তাকে ধূলায় মিশিয়ে দেয়। যখনই কোনো ব্যক্তি বিশ্বশক্তির সদা প্রবহমান স্রোতকে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করে ও তার বিশেষ ব্যবহারের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করতে চায়, তখনই সে বিপর্যয় নিয়ে আসে। কোনো রাজা যত শক্তিমানই হোন না কেন, তিনি কখনোই শক্তির অনন্ত উৎস, যে ঐক্য তার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের ধ্বজা উঁচু করতে পারেন না, ও তৎসত্ত্বেও শক্তিমান হয়ে থাকতে পারেন।

এ কথা বলা হয় যে অধর্ম দিয়ে মানুষ ঐশ্বর্যবান হয়, যা চায় সব পায়, শত্রুদের পরাজিত করে, কিন্তু পরিশেষে সমূলে বিনষ্ট হয়। ব্যক্তিত্বের মহত্ত্ব লাভ করতে হলে আমাদের মূলকে বিশ্বজনীনতার গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

সেই ঐক্যের অনুসন্ধান করাই আমাদের সত্তার চরম লক্ষ্য। প্রেমে ও নম্রতায় তাকে মাথা নত করতে হবে এবং যেখানে উচ্চ নীচ সকলে মিলিত হয়, সেখানে নিজের স্থান ক’রে নিতে হবে। নিজের ক্ষতির মধ্যে দিয়ে তাকে লাভ করতে হবে, ও আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে তাকে উন্নত হতে হবে। সব খেলাই শিশুর কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠবে, যদি মায়ের কাছে সে ফিরে আসতে না পারে। আর আত্মাভিমান আমাদের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠবে যদি আমরা তাকে প্রেমে বিসর্জন দিতে না পারি। আমাদের জানতে হবে যে, আমাদের মধ্যে অসীমের প্রকাশই চির নূতন ও চির সুন্দর, এবং সেই একমাত্র আমাদের সত্তার প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে।

তথ্যসূত্র

১. স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ।

২. আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে—

৩. আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।

৪. অধর্মেনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।

ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলমস্তু বিনশ্যতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *