বোলতার হুল
হঠাৎ মাথার কাছে টিপয়ের ওপর রাখা ফোনটা বেজে উঠল। একবার, দুবার। তারপরই পারিজাত বক্সীর ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে নিয়ে ঘুম-জড়ানো গলায় বললেন, হ্যালো। তারের ওপার থেকে নারীকণ্ঠ।
মিস্টার বক্সী আছেন?
কথা বলছি।
আমি রমা বসাক কথা বলছি।
পারিজাত বক্সীর দু-ভ্রূ-র মাঝখানে সরু কয়েকটা আঁচড়। নামটা চেনবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না।
সেই কথাই বললেন। ঠিক চিনতে পারলাম না।
ওপারে কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা, তারপর গলা শোনা গেল। সেই যে গত বছর দার্জিলিঙে দেখা হয়েছিল। আমার মেয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে, আপনি—
পারিজাত বক্সীর মনে পড়ে গেল।
ম্যালে ঘোড়ার পিঠ থেকে একটি মেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পারিজাত বক্সী পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি মেয়েটাকে ধরে ফেলেছিলেন। মেয়েটির মা-বাবা কাছেই ছিল। তারা ছুটে এসে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। তাদের হোটেলে একদিন চায়ের নিমন্ত্রণও করেছিল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মিসেস বসাক, মনে পড়েছে। কী ব্যাপার এত রাত্রে—কথার সঙ্গে সঙ্গে পারিজাত বক্সী আড়চোখে একবার রেডিয়াম ঘড়ির দিকে নজর দিলেন। রাত এগারোটা দশ। রমা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি খুব বিপদে পড়েছি মিস্টার বক্সী।
অবশ্য বিপদে না পড়লে কেউ পারিজাত বক্সীকে স্মরণ করে না। বিশেষ করে এই রাতে।
পারিজাত বক্সী কী চিন্তা করলেন।
কী বিপদ!
আমার মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কত বয়স মেয়েটির?
এই ন-বছরে পড়েছে।
যে মেয়েটি ঘোড়ার পিঠ থেকে—
হ্যাঁ, আমার ওই একটিই মেয়ে।
কবে থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?
আজ সকালে স্কুলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি।
মিস্টার বসাক কোথায়?
তিনি হাসপাতালে হাসপাতালে খোঁজ নিতে গেছেন, এখনও ফেরেননি। আমার আপনার কথা মনে পড়ে গেল, তাই এত রাত্রে বিরক্ত করলাম।
পারিজাত বক্সী দু-এক মুহূর্ত কী ভাবলেন! তারপর বললেন, এত রাতে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।
কাল সকালে যাব।
আমাদের ঠিকানাটা—
ঠিকানা দার্জিলিঙে দিয়েছিলেন, আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। রমার কাতর অনুনয় শোনা গেল—দয়া করে আসবেন কিন্তু। আমাদের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। মেয়েকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব। পারিজাত বক্সী ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
ঘুমের দফা শেষ। কোনও চিন্তা মাথায় ঢুকলে আর ঘুম হয় না। বেড সুইচটা টিপে নীল বাতিটা জ্বালালেন। বাইরে ম্লান চাঁদের আলো। এলোমেলো বাতাস বইছে। নিশাচর এক পাখি কর্কশকণ্ঠে ডেকে চলেছে।
পারিজাত বক্সী ভাবতে শুরু করলেন।
মাসখানেক ধরে খবরের কাগজে মেয়ে হারানোর সংবাদ বের হচ্ছে। বেশির ভাগ মেয়েই স্কুল থেকে আর বাড়ি ফিরছে না।
এইসব অল্প বয়সের মেয়েদের দুটো উদ্দেশ্যে চুরি করা হয়ে থাকে। এক তাদের অভিভাবকদের কাছে চিঠি লিখে মুক্তিপণ দাবি করা। এসব বিশেষ করে বড়োলোকদের মেয়েদের বেলায় হয়ে থাকে। যাদের মোটা টাকা দেবার সামর্থ্য আছে।
আর দুই, মেয়েদের ভিন্ন প্রদেশে বিক্রি করে দেওয়া। সেখানে তাদের দিয়ে ঝি কিংবা মজুরানির কাজ করানো হয়। কলকারখানায় কিংবা চা অথবা কফি বাগানে এইসব হয় গরিব অভিভাবকদের বেলায়, যাদের টাকা দেবার শক্তি নেই। আজকাল কিছু মেয়েকে সাগরের ওপারেও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিরাট একটা পাপচক্র এই দেশের বুকে কাজ করে চলেছে। এদের উচ্ছেদ করা খুব দরকার। তা না হলে বহু বাড়িতেই শোকের ছায়া নামবে।
চেহারায়, পোশাকে বসাকদের উচ্চমধ্যবিত্তই মনে হচ্ছিল। কাজেই কিছুদিন পরে অপহরণকারীদের কাছ থেকে টাকা দাবি করে সম্ভবত একটা চিঠি আসবে। পারিজাত বক্সী চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। নীল বাতিটা নেভানো হয়নি।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন বেশ বেলা হয়েছে, বাইরে চড়া রোদ। দরজা খুলে বের হয়ে দেখলেন, বাইরে বেড-টি নিয়ে বাহাদুর দাঁড়িয়ে।
বেচারা কতবার এসে ফিরে গেছে কে জানে।
পারিজাত বক্সী বললেন, বেড-টি থাক বাহাদুর—তুমি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করো। আমি এখনই বের হব।
পারিজাত বক্সীর মোটর যখন বালিগঞ্জের অভিজাত পাড়ায় লাল দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল, তখন বেলা দশটা প্রায় বাজে।
মোটর থেকে নামতেই রমা ছুটে এসে সামনে দাঁড়াল। মনে হল, বোধহয় বাগানেই অপেক্ষা করছিল। ক্লান্ত দুটি চোখ। সারারাত নিশ্চয় ঘুমায়নি।
কোনো খবর পেয়েছেন?
পারিজাত বক্সীর এ প্রশ্নের উত্তরে রমা মাথা নাড়ল, না।
মিস্টার বসাক কোথায়?
রমা হাত দিয়ে বারান্দার দিকে দেখাল।
বেতের চেয়ারে মিস্টার বসাক বসে। দুটি চোখ নিমীলিত। রমার পিছন পিছন পারিজাত বক্সী বারান্দার দিয়ে এগিয়ে গেলেন। জুতোর শব্দে বসাক চোখ খুলল, তারপর পারিজাত বক্সীকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। আসুন। আসুন। আমাদের বড়ো বিপদ।
সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে পারিজাত বক্সী বললেন, সব ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন তো, শুনি। বসাক চেয়ারে বসে রুমাল দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে বলতে শুরু করল।
রমার কাছে তো শুনেছেন, লালি মানে ললিতা আমাদের একমাত্র সন্তান। সে মিশনারি স্কুল গ্রিন কটেজে পড়ত। স্কুলটা খুব কাছে। রাস্তার ওপর।
ললিতা কীসে যেত? পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন।
হেঁটেই যেত। বড়োজার মিনিট পনেরো লাগত।
একলাই যেত?
না। এ এলাকার একটি মেয়ে তনু লালিকে ডেকে নিয়ে যেত। ফিরত একসঙ্গে।
তনুর কাছে খোঁজ করা হয়েছে? এবার রমা কথা বলল। আমি কালই তনুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তনু লালির সঙ্গে যাবার সময় গেছে, কিন্তু দুপুরের দিকে তার শরীর খারাপ হওয়ায় রিকশায় ফিরে এসেছিল।
তনুর শরীর খারাপ দেখলেন?
হ্যাঁ, তার খুব জ্বর। বিছানায় শুয়ে ছিল।
তারপর?
সাড়ে চারটের মধ্যে লালি বাড়ি ফিরে আসে, কিন্তু ছ-টার মধ্যে না-ফেরাতে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। স্কুলে খোঁজ করলাম। হেডমিস্ট্রেস বললেন, স্কুল রোজকার মতন চারটের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলে আর মেয়ে নেই। তারপর আমি তনুদের বাড়ি যাই। সেখান থেকে ফিরে এসে ওঁকে ফোন করি।
রমা হাত দিয়ে বসাককে দেখিয়ে দিল।
পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কী অফিস?
বসাক মৃদুস্বরে বলল, আমার ছোটো একটা ফ্যাক্টরি আছে, মেশিন পার্টস তৈরি করে। দরকার হলে সাতটা-আটটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। খবরটা শুনে আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। তখনই অফিস থেকে বের হয়ে বালিগঞ্জ থানায় গিয়েছিলাম। ও.সি.-র সঙ্গে আগেই আমার একটু আলাপ ছিল। ও.সি. আমাকে একটা লিখিত রিপোর্ট দিতে বললেন। দেবার পর লালির ইদানীং তোলা একটা ফোটো চাইলেন। বাড়ি থেকে ফোটোটা নিয়ে কালই আমি দিয়ে এসেছিলাম।
আপনি আর কোথাও মেয়ের খোঁজ করেছিলেন?
আমাদের এ শহরে আত্মীয়ের সংখ্যা কম। মোটে চার ঘর। সেখানে লালির যাবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।
তবু আমি সেসব জায়গায় খোঁজ করেছি। শেষকালে বড়ো বড়ো হাসপাতালেও গিয়েছি, কিন্তু লালিকে পাইনি। কথার শেষে বসাক কান্নায় ভেঙে পড়ল।
পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর বসাক একটু স্থির হতে বললেন, লালির একটা ফোটো আমায় দিতে পারেন?
বসাক রমাকে ইঙ্গিত করতে রমা ওপরে উঠে গিয়ে একটা ফোটো এনে পারিজাত বক্সীর হাতে দিল।
বছরখানেক আগে পারিজাত বক্সী লালিকে দেখেছিলেন দার্জিলিঙে। এখন লালি যেন আরও একটু মোটাসোটা, আরও হাসিখুশি হয়েছে। লাবণ্যময়ী এই মেয়েটিকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। ফোটোটা পকেটে ফেলে পারিজাত বক্সী বললেন, ফোটোটা আমি রাখলাম। আজ উঠি, পরে আবার আসব। ইতিমধ্যে কোনও খবর থাকলে জানাবেন।
বসাক নিজের দু-হাতে পারিজাত বক্সীর একটা হাত জাপটে ধরে বলল, মিস্টার বক্সী, মেয়েকে জীবন্ত ফিরে পাব তো? লালির কিছু হলে আমরা কেউ বাঁচব না।
রমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল।
পারিজাত বক্সী আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে বললেন, এত উতলা হবেন না। এভাবে কাঁদলে কি মেয়ে ফিরে আসবে! একটা কথা আপনাদের বলতে পারি, যারা এভাবে মেয়ে চুরি করে, তারা সচরাচর মেরে ফেলে না। তাতে তাদের কোনও লাভ নেই। তারা হয়তো টাকা চেয়ে আপনাদের চিঠি দিতে পারে।
টাকা চেয়ে? বসাক টান হয়ে বসল—তা টাকা তারা চাক, আমি দরকার হলে ফ্যাক্টরি, বাড়ি সব বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দেব। লালির চেয়ে প্রিয় আমাদের কিছু নেই।
এবার পারিজাত বক্সী একটু কঠিন কণ্ঠে বললেন, আপনারা কী চান, আপনাদের কেসটা আমি হাতে নিই, তাহলে আপনাদের আমার কথামতো চলতে হবে।
বলুন কী করতে হবে?
এ ধরনের টাকা চেয়ে কোনও চিঠি পেলে আমাকে না জানিয়ে কিছু করতে পারবেন না।
বেশ, তা-ই হবে।
পারিজাত বক্সী উঠে পড়লেন।
বাড়ি যাবার পথে বালিগঞ্জ থানায় একবার নামবেন। ও.সি. সুকান্ত হালদার তাঁর খুবই চেনা। এর আগে গোটা তিনেক কাজে তিনি সুকান্তকে সাহায্য করেছিলেন। তাই পারিজাত বক্সীকে দেখে সুকান্ত লাফিয়ে উঠল। আরে বক্সী সাহেব, কী মনে করে? মেজাজ শরিফ তো?
পারিজাত বক্সী হেসে বললেন, সুকান্ত, তোমার কাছে একটা খবরের জন্য এসেছি।
বলুন, বলুন।
মিস্টার বসাকের মেয়ে ললিতার নিখোঁজ হবার ব্যাপারে কোনও খবর আছে?
সুকান্ত মাথা নাড়ল, না, কোনও খবর নেই, এসব কেস নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছি। আমার এলাকা থেকে এই মাসেই চারটে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে।
চারটে? একটারও কিনারা হয়নি?
একটা হয়েছে। আভা পাল বলে একটা মেয়ে বম্বে স্টেশন থেকে ধরা পড়েছে। সে কিন্তু লাইনে ঢুকবে বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।
ললিতার কেসটা এ ধরনের নয় বলেই মনে হচ্ছে।
না, না, সুকান্ত সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল, লালি তো নেহাত ছেলেমানুষ। খোঁজ নিয়েছি স্কুলের রেকর্ডও ভালো। আমার মনে হয় এটা মেয়ে চুরি করে মা-বাপের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা।
খুব সম্ভব। কেসটা নিশ্চয় লালবাজারে পাঠিয়ে দিয়েছ।
হ্যাঁ। লালির ফোটো, ওর বাবার রিপোর্ট সব পাঠিয়ে দিয়েছি। রেডিয়োতে যাতে প্রচার হয়, তার ব্যবস্থাও করেছি। কেসটা কি আপনি হাতে নিয়েছেন?
মিস্টার বসাক আমার পূর্বপরিচিত। তার খুব ইচ্ছা, কেসটা আমি তদারক করি।
খুবই ভালো কথা। এ ব্যাপারে পুলিশ থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
ধন্যবাদ, আজ চলি।
পারিজাত বক্সী মোটরে এসে বসলেন।
তাঁর মুখ খুবই চিন্তিত। লালির কিছু হবে না। এরকম একটা আশ্বাসবাণী বসাকদের দিয়ে এলেন বটে, কিন্তু এসব দুর্বৃত্তদের অসাধ্য কাজ নেই।
যদি দেখে লালিকে নিয়ে কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে, বা তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা, তাহলে লালিকে শেষ করে দিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করবে না।
দিন দুই পরে বসাকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পারিজাত বক্সী তনুদের বাড়ি এসে হাজির।
তনুর ভালো নাম অণিমা, সে প্রায় লালিরই বয়সি। হয়তো কয়েক মাসের বড়ো হবে। লালি আর তনু এক ক্লাসে পড়ত বটে, কিন্তু এক সেকশনে নয়।
তনুর বাবা অবনী পাকড়াশি, ভারত সরকারের এক অফিসের মাঝারি অফিসার।
তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। দু-মেয়ে কলেজে পড়ে। তনু স্কুলে। ছেলেটি এখনও লেখাপড়া শুরু করেনি। তনু জ্বর থেকে উঠে পথ্য করেছে।
নিজের পরিচয় দিয়ে পারিজাত বক্সী তনুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। তনুকে তাঁর সামনে আনা হল। মেয়েটির রং ময়লা। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, ডাগর দুটি চোখ।
পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সঙ্গে লালির খুব বন্ধুত্ব ছিল?
হ্যাঁ।
তুমি জানো লালিকে পাওয়া যাচ্ছে না?
হ্যাঁ, বাবার কাছে শুনেছি।
স্কুলে কেউ কিছু বলেনি?
জানি না। তারপর আমি আর স্কুলে যাইনি। আমার জ্বর হয়েছিল।
আচ্ছা, তোমরা তো একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে?
হ্যাঁ।
রাস্তায় কেউ তোমাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে?
রাস্তায়? কই না তো! বলেই চেঁচিয়ে উঠল, একজন মাঝে মাঝে বলত।
কে সে?
একজন বুড়ি।
বুড়ি? কী বলত?
আমাদের বাবারা কী কাজ করে, মোটর আছে কি না, ভাড়াবাড়ি না নিজের বাড়ি। এইসব।
সেই বুড়ি কি তোমাদের আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাড়িতে থাকত? না, রাস্তায় এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকত?
পারিজাত বক্সী আর জিজ্ঞাসা করলেন না। বুঝতে পারলেন, সে বুড়িকে আর ধারেকাছে কোথাও পাওয়া যাবে না। তার কাজ শেষ করে সে সরে পড়েছে। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। যারা লালিকে নিয়ে গেছে তারা তাকে প্রাণে মারবে না। তাকে আটকে রেখে তার বাবার কাছে টাকা দাবি করবে।
তনুদের বাড়ি থেকে পারিজাত বক্সী সোজা গেলেন লালবাজারেই। এখানে হারিয়ে- যাওয়া লোকদের খুঁজে বের করার জন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে।
ডেপুটি কমিশনার অলক দাস এই বিভাগের চার্জে। দাসের সঙ্গে পারিজাত বক্সীর বিশেষ আলাপ নেই। আগে বোধহয় একবার দেখা হয়েছিল।
তিনি দাসের সঙ্গে দেখা করলেন।
পারিজাত বক্সী আশা করেছিলেন, দাস তাঁকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না।
দাস তাঁর দিকে চোখ রেখে বলল, বলুন কী করতে পারি?
পারিজাত বক্সী আস্তে বললেন, আমার নামের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে কি না জানি না।
দাস টেবিলের ওপর রাখা একটা ফাইলের ফিতা খুলতে খুলতে উত্তর দিল, নামটা শোনা বলেই মনে হচ্ছে। আপনি তো শখের গোয়েন্দা?
পারিজাত বক্সী হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কাজের জন্য টাকা যখন নিই তখন নিজেকে আর শখের গোয়েন্দা বলি কী করে?
দাস এ কথায় বিশেষ কর্ণপাত না করে বলল, দরকারটা কী বলুন? একটু পরেই আমাকে একটা জরুরি মিটিং-এ যেতে হবে।
বালিগঞ্জ এলাকা থেকে ললিতা বসাক বলে একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। সে বিষয়ে কোনও খবর আছে আপনার কাছে? মেয়েটি স্কুল থেকে আর বাড়ি ফেরেনি।
স্কুলে খবর নিয়েছেন? পরীক্ষায় ফেল করেনি তো?
না, মেয়েটির স্কুলের রেকর্ড খুব ভালো।
বয়স কত?
বছর আট-নয়।
আপনার কী ধারণা, কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে?
জানি না। তবে মেয়েটি খুব অবস্থাপন্ন ঘরের। সেরকম কিছু হলেও আশ্চর্য হব না।
আচ্ছা, আপনি দিন দশেক পরে একবার খবর নেবেন। আমি মেয়েটির নামধাম লিখে রাখছি।
পারিজাত বক্সী উঠে পড়লেন।
বাড়ি ফিরতেই বাহাদুর সামনে এসে দাঁড়াল।
আপনার ফোন এসেছিল।
কার কাছ থেকে?
মিস্টার বসাক।
বসাক। পারিজাত বক্সী ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, কী বললেন?
আপনার খোঁজ করলেন, নেই শুনে বললেন, ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফোন করবেন।
পারিজাত বক্সী জামাকাপড় বদলে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন ফোন এল।
বসাকের গলা।
একটা চিঠি এসেছে।
কী চিঠি?
সাত দিনের মধ্যে যদি আমি দশ হাজার টাকা না দিই তাহলে ললিতার ছিন্নমুণ্ড পার্সেল করে আমাকে পাঠানো হবে।
পারিজাত বক্সী বললেন, আপনি চিঠিটা নিয়ে এখনই আমার কাছে চলে আসুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার ঠিকানাটা লিখে নিন।
পারিজাত বক্সী ঠিকানাটা বললেন।
আধ ঘণ্টার মধ্যে বসাক এসে গেল।
উসকোখুসকো চুল। পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা। মনে হল, বাড়িতে যে অবস্থায় ছিল, সেইভাবেই চলে এসেছে। চিঠিটা নিয়ে পারিজাত বক্সী পড়লেন।
.
মহাশয়,
আপনার মেয়ে আমাদের হেপাজতে ভালোই আছে। তবে আজ থেকে সাত দিনের মধ্যে যদি আপনি দশ হাজার টাকা না পাঠান, তাহলে আপনার আদরের মেয়ের ছিন্নমুণ্ড পার্সেল করে উপহার পাঠানো হবে। টাকাটা একশো টাকার নোটে লেকের পশ্চিম পাড়ে প্রথম বনচাঁড়াল গাছের নীচে রেখে দেবেন।
ইতি—
বোলতা
.
চিঠিটা লাল কালিতে লেখা। পরিষ্কার হস্তাক্ষর।
এ চিঠিটা আপনি কীভাবে পেলেন?
অফিসে যাবার জন্য মোটরে উঠতে গিয়ে দেখি বনেটের ওপর পাথর-চাপা এই চিঠিটা।
হুঁ। রোজ সকালে আপনি কি লেকে বেড়াতে যেতেন?
ওয়েদার ভালো থাকলে রোজই যেতাম। বোলতা সেটা জানে, তাই লেকে বনচাঁড়ালের নীচে টাকাটা রেখে দিতে বলেছে।
বসাক হঠাৎ বলল, আমি টাকাটা কালই দিতে চাই। আজই ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলব।
পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বসাকের দিকে চেয়ে রইলেন। এরকম একটা কাজ করা খুবই স্বাভাবিক। যেখানে মেয়ের জীবন বিপন্ন হবার ষোলোআনা সম্ভাবনা। যেখানে যার টাকা দেবার সংগতি আছে, তার পক্ষে এ ছাড়া আর কিছু করার নেই।
তবু পারিজাত বক্সী বললেন, এখনও সময় আছে, আর দু-একদিন অপেক্ষা করুন।
বসাক কিছু বলতে যাবার আগেই ফোন বেজে উঠল।
পারিজাত বক্সী ফোন তুললেন, মিনিট দুয়েক, তার বেশি নয়, পারিজাত বক্সীর সারা মুখ লালচে হয়ে গেল। দুটো চোখ জ্বলে উঠল।
স্কাউন্ড্রেল!
বসাক জিজ্ঞাসা করল, কে?
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি যখন আমার এখানে আসেন, তখন কোনও গাড়ি ফলো করছিল?
লক্ষ করিনি। কেন বলুন তো?
এইমাত্র ফোনে বোলতা আমায় শাসাল, যদি আপনার ব্যাপারে আমি নাক গলাই, তাহলে আমার সমূহ বিপদ।
তাহলে?
পারিজাত বক্সী বললেন, এরকম শাসানি ফোনে-চিঠিতে আমি অনেকবার পেয়েছি। কেউ কিছু করতে পারেনি। আপনি আমার জন্য চিন্তিত হবেন না।
আমি ভাবছি, টাকাটা দিয়েই দেব।
পারিজাত বক্সী কী ভাবলেন, তারপর বললেন, ঠিক আছে। টাকাটা আপনি তুলুন, তারপর কী করতে হবে আপনাকে বলব।
ঠিক সন্ধ্যা ছ-টা নাগাদ বসাকের বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে থামল।
ট্যাক্সি থেকে একজন মাঝবয়সি মারোয়াড়ি নামল। পরনে পাতলা ধুতি, লম্বা কোট, হাতে মোষের শিঙের ছড়ি। চাকরের হাতে একটা কার্ড পাঠিয়ে দিল। কার্ডে লেখা, মনোয়ারিলাল সুরেখা। আয়রন মার্চেন্ট।
একটু পরেই বসাক নেমে এল। কুণ্ঠিত গলায় বলল, মাপ করবেন, এখন ব্যাবসা সম্বন্ধে কথা বলবার মতন মনের অবস্থা আমার নেই। দয়া করে আপনি অন্যদিন আসবেন, ফোনে যোগাযোগ করে।
মারোয়াড়ি একটু হেসে বলল, মিস্টার বসাক, আমি পারিজাত বক্সী।
সে কী! এই পোশাকে?
বোলতা যেভাবে পিছনে লেগেছে তা ছাড়া উপায় আর নেই। আমার মনে হয়, বোলতার লোক সর্বক্ষণ আপনার বাড়ির ওপর নজর রেখেছে। কাজের কথাটা বলে নিই। টাকাটা তুলেছেন তো?
হ্যাঁ।
কাল কখন লেকে যাবেন?
সাধারণত ছ-টা-সাড়ে ছ-টার মধ্যে আমি যাই।
ঠিক আছে, টাকাটা গাছের নীচে রেখে আর কিন্তু আপনি অপেক্ষা করবেন না। তাহলেই বিপদ হবে।
আচ্ছা।
বসাককে একটু যেন উৎফুল্লই মনে হল। টাকাটা রাখলেই মেয়েকে ফিরে পাব।
আচ্ছা আমি চলি।
পারিজাত বক্সী বেরিয়ে পড়লেন।
ট্যাক্সিটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল, তাতে গিয়ে উঠলেন।
পরের দিন সকালে বসাক যথারীতি মোটর নিয়ে বের হল। রাস্তায় মোটর রেখে বসাক লেকের মধ্যে ঢুকল। জমাট কুয়াশা। একহাত দূরের কিছু দেখার উপায় নেই। কোটের ভিতরের পকেটে নোটের বান্ডিল। অনেকদিন ধরেই বসাক লেকে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বনচাঁড়াল গাছটা ঠিক জানা নেই। সারি সারি সোঁদাল গাছ দেখেছে। পশ্চিম পাড়ে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। একটা অচেনা গাছ রয়েছে। শুধু ডালসর্বস্ব। একটি পাতাও নেই। সম্ভবত এটাই বনচাঁড়াল গাছ। বসাক এদিক-ওদিক তাকাল। কাছেপিঠে কেউ নেই। গাছের নীচে একটা গর্ত। কেউ বোধহয় মাটি কেটে নিয়ে গেছে।
আর-একবার এদিক-ওদিক দেখে বসাক নোটের বান্ডিলটা গর্তের মধ্যে রেখে দিল। তারপর কোনওদিকে না চেয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল। মোটরের কাছ বরাবর গিয়েই বসাক থমকে দাঁড়াল। আবার বনেটের ওপর একটা কাগজ।
বসাক কাগজটা তুলে নিয়ে পড়ল।
.
মহাশয়,
আপনি নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে এনেছেন। এরপর যা হবে তার জন্য সারাজীবন আপশোস করতে হবে। আজ টাকা নিয়ে এসেছিলেন বটে। কিন্তু গাছের ওপর টিকটিকি পাহারায় ছিল। টাকাটা আমরা নিতে পারিনি। যদি ভালো চান তো পুলিশ টিকটিকির সাহায্য নিতে যাবেন না। তাহলে মেয়েকে হারাবেন।
ইতি—
বোলতা
.
চিঠি পড়তে পড়তে বসাক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠল। টিকটিকি মানে পারিজাত বক্সী গাছের ওপর বসে ছিল, তাই বোলতার দল টাকা নিতে আসতে পারেনি। এই বসাকের প্রথম মনে হল, পারিজাত বক্সীর সঙ্গে যোগাযোগ না করলেই ভালো হত। তাহলে হয়তো ললিতা এতদিনে ফিরে আসত। পারিজাত বক্সীর কথা বসাকের মনেও ছিল না। রমাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। তখন তাদের ডুবন্ত মানুষের মতো অবস্থা। একটা কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে মন চায়।
বসাক আবার লেকের মধ্যে ঢুকল। অতগুলো টাকা ওভাবে পড়ে থাকাটা ঠিক নয়। একটু বেলা হলে যে কেউ তুলে নিতে পারে।
বনচাঁড়াল গাছটার তলায় গিয়ে বসাক থমকে দাঁড়াল, একটা হলদে কাগজের প্যাকেটের মধ্যে নোটগুলো রাখা ছিল। হলদে কাগজটা রয়েছে নোট উধাও। সর্বনাশ, কী হবে! ইতিমধ্যে লোক চলাচল বেড়ে গেছে। কুয়াশাও আর নেই। কে নিল টাকার বান্ডিল!
বসাক কাছাকাছি ডালগুলোর ওপর নজর দিল। কেউ নেই। তাহলে কি বোলতার লোকেরা টাকা নিয়ে গিয়ে মিছে কথা বলছে? চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে আরও টাকা আদায় করার জন্য—কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রথমেই বসাকের যাঁর কথা মনে হল, তিনি পারিজাত বক্সী। সত্যিই তিনি গাছের ডালে অপেক্ষা করছিলেন কি না, সেটাও জানা যেতে পারে।
তা ছাড়া এ অবস্থায় বসাকের কী করা উচিত, সে বিষয়েও আলোচনা করা যেতে পারে।
কিন্তু বসাক সেসব কিছু করল না। বোলতার লোক তাকে চোখে চোখে রেখেছে। পারিজাত বক্সীর কাছে গেলে এরা খেপে উঠবে। এমন নৃশংস কাজ নেই, এরা করতে পারে না। সত্যিই হয়তো পার্সেলে লালির মুণ্ডটা পাঠিয়ে দেবে। কথাটা মনে হতেই বসাক শিউরে উঠল। তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো।
বোলতা নিশ্চয় আবার চিঠি দেবে। তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করলেই হবে।
এদিকে গাছের ডালে পাতার আড়ালে পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে। অবশ্য তাকে পারিজাত বক্সী বলে চিনতে পারা সম্ভব নয়। গায়ে আধময়লা ছেঁড়া গেঞ্জি, চেককাটা লুঙ্গি। দেখলে মনে হয়, বস্তির কোনও লোক ডাল ভাঙতে গাছে উঠেছে। পারিজাত বক্সী বসে বসে দেখলেন। বসাক একটা প্যাকেট গাছের তলায় রেখে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কাছে এল না। কী ব্যাপার, একটু পরেই এখানে লোক আসবে। ততক্ষণ পর্যন্ত বোলতার দল নিশ্চয় অপেক্ষা করবে না। পারিজাত বক্সী নেমে এলেন। তারপর টাকার বান্ডিলটা তুলে নিয়ে গেঞ্জির মধ্যে রেখে এগিয়ে গেলেন। মেনকা সিনেমার সামনে তাঁর গাড়িটা রাখা আছে। সেটাতে গিয়ে উঠলেন। ঠিক করলেন, সন্ধ্যা নাগাদ বসাকদের বাড়ি গিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে আসবেন। অবশ্য ছদ্মবেশেই যেতে হবে। নতুন কোনও ছদ্মবেশে, যাতে বোলতার লোক সন্দেহ না করতে পারে। তখনও বিকাল হয়নি। দুপুরের শেষ।
বসাককে একটা ফোন করবেন, বসে বসে পারিজাত বক্সী ভাবছেন, এমন সময় বাহাদুর একটা কার্ড এনে তার সামনে ধরল। কার্ডটা হাতে নিয়ে পারিজাত বক্সী পড়লেন। অমলবিকাশ মণ্ডল। নয়নগড় এস্টেটের ম্যানেজার। নীচে বসা, আমি আসছি।
একটু পরেই পারিজাত বক্সী বসবার ঘরে নেমে এলেন। একটা কোচে একটি ভদ্রলোক বসে। রং খুব কালো, কিন্তু স্বাস্থ্যবান। ঠোঁটের ওপর পাকানো বিরাট গোঁফ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির ওপর বাসন্তী রঙের বিরাট চাদর, কোঁচা মেঝের ওপর লোটাচ্ছে। দু-হাতের আঙুলে গোটা ছয়েক আংটি।
পারিজাত বক্সী ঘরে ঢুকতেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াল, তারপর আচমকা নিচু হয়ে পারিজাত বক্সীর পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, আমার নাম অমলবিকাশ মণ্ডল। আমি নয়নগড় এস্টেটের ম্যানেজার। রানিমা একবারে আপনাকে স্মরণ করেছেন। মহিষাদলের কাছাকাছি নয়নগড়। জমিদারি প্রথা বিলোপ হবার আগে খুব বিরাট জমিদারি ছিল। এখনও অবশ্য ছিটেফোঁটা যা আছে, তাও কম নয়। পদ্মাবতীর উপাধি রানি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রানির ডাকে বছর পাঁচেক আগে একবার পারিজাত বক্সী নয়নগড়ে গিয়েছিলেন। রানির হিরার হার চুরি গিয়েছিল। পারিজাত বক্সী হারের কিনারা করেছিলেন। রানি দক্ষিণা যা দিয়েছিলেন পারিজাত বক্সীর আশাতিরিক্ত। ম্যানেজারের কথায় পারিজাত বক্সী বললেন, আমার পক্ষে এখন কলকাতা ছাড়া সম্ভব নয়।
আজ্ঞে, আপনাকে কলকাতা ছাড়তে তো হবে না।
তাহলে?
রানিমা এখানে পার্ক হোটেলে উঠেছেন, আপনাকে একবার দয়া করে সেখানে পায়ের ধুলো দিতে হবে।
কী ব্যাপার? এবার আবার কী চুরি গেল?
আজ্ঞে আমি কিছু বলতে পারব না। এসব নিয়ে রানিমা আমাদের সঙ্গে তো আলোচনা করেন না। আপনি দয়া করে চলুন। রানিমা বলেছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে রেখে যাব। সঙ্গে গাড়ি আছে।
পারিজাত বক্সী জানলা দিয়ে বাইরে দেখলেন। গেটের সামনে বিরাট একটা আমেরিকান গাড়ি। উর্দি-পরা ড্রাইভার বসে আছে।
ম্যানেজার আবার বলল, দয়া করে আর দেরি করবেন না। রানিমা আজ রাতেই নয়নগড় ফিরে যাবেন।
ঠিক আছে। একটু বসুন, আমি পোশাকটা পালটে আসি।
মিনিট কুড়ির মধ্যে পারিজাত বক্সী তৈরি হয়ে এলেন। পরনে চোস্ত আর প্রিন্সকোট।
প্রথমে পারিজাত বক্সী, তার পাশে ম্যানেজার। ড্রাইভার দরজা বন্ধ করতে ম্যানেজার বলল, পার্ক হোটেল—একটু জোরে চালাও। মোটর যেন উড়ে চলল।
পারিজাত বক্সীর মন কিন্তু বসাকদের ব্যাপারে। টাকাটা ফেরত দিতে হবে, যেমন করে হোক উদ্ধার করতে হবে ললিতাকে।
স্যার কি পান খান? ভালো কিমাম-দেওয়া পান?
পারিজাত বক্সী মাথা নাড়লেন, না।
তারপরই অঘটন ঘটল।
চোখের সামনে পুঞ্জীভূত অন্ধকার। নিশ্বাসের কষ্ট হল। তাঁর নাকের ওপর ম্যানেজারের একটা রুমাল চেপে ধরেছে। পারিজাত বক্সীর যখন জ্ঞান হল, দেখলেন একটা তক্তপোশের ওপর শুয়ে আছেন। অন্ধকার ঘর। কোনও জানলা নেই। অনেক ওপরে একটা ঘুলঘুলি। তার মধ্য দিয়ে অল্প আলো আসছে।
পারিজাত বক্সী উঠে বসলেন, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, চোখ খুলতে পারছেন না। পকেটে হাত দিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পকেটে রাখা ছোটো পিস্তলটা নেই। তার মানে, যারা তাঁকে এখানে এনেছে, তারাই পিস্তলটা সরিয়ে রেখেছে।
আস্তে আস্তে পারিজাত বক্সী দাঁড়ালেন। এত অন্ধকার যে ভালো করে কিছু দেখবার উপায় নেই। হাতড়ে দরজার কাছে গেলেন। ঠেলে দেখলেন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
আবার পারিজাত বক্সী ফিরে তক্তপোশের ওপর বসলেন। নয়নগড়ের রানিমার ব্যাপারটা সব সাজানো।
পারিজাত বক্সীর একটা ভুল হয়ে গেছে। তাঁর উচিত ছিল পোশাক পালটাবার জন্য ওপরে আসার সময় একবার পার্ক হোটেলে রানিমাকে ফোন করা।
বলা যায় না, সাজানো রানিমাও বোধহয় কেউ থাকত।
হঠাৎ দরজা খুলে গেল।
কালো মোটা একটা লোক ঘরে ঢুকল। চুল ছোটো করে ছাঁটা। ঠিক কুস্তিগিরের মতো চেহারা।
নমস্কার বক্সী সায়েব, কী খাবেন, চা না কফি?
সে কথার উত্তর না দিয়ে পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন, আমাকে আপনারা ধরে আনলেন কেন?
লোকটা জিভ কামড়ালেন, ছি, ছি, ওভাবে বলবেন না।
আপনি নিজে ধরা না দিলে আমাদের সাধ্য কী আপনাকে আমরা ধরি।
একটু থেমে লোকটা আবার বলল, মনে করুন, টিকটিকি পোষা আমাদের শখ।
কতদিন আমাকে এভাবে আটকে রাখবেন?
ওই টাকার ব্যাপারে একটা ফয়সালা হলেই ছেড়ে দেব।
ললিতা কোথায়?
একটু চুপ করে লোকটা বলল, আছে কোথাও। তবে একটা কথা বলছি আপনাকে, খুব ভালোই আছে। টাকাটা হাতে এলেই তাকে তার বাপের বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেব।
আমার পিস্তলটা কী হল?
সেটাও ভালো জায়গায় রাখা আছে। ওসব মারাত্মক জিনিস কি ওভাবে রাখতে আছে, কখন কী বিপদ ঘটায়, বলা যায়?
পারিজাত বক্সী বুঝতে পারলেন, তিনি খুব শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছেন।
কোনও কথা বের করতে পারবেন না। তিনি চুপ করে রইলেন।
একটু পরে দরজা দিয়ে আর-একটা লোক ঢুকল। একেবারে একরকম দেখতে—যেন যমজ ভাই। তার হাতে একটা ট্রে। ট্রে-র ওপর চায়ের কাপ। প্লেটে দুটো টোস্ট। কোণ থেকে একট টিপয় টেনে এনে পারিজাত বক্সীর সামনে রাখল। তার ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রেখে বলল, নিন স্যার, কাল থেকে না খেয়ে আছেন।
তার মানে, পারিজাত বক্সী চমকে উঠলেন। একটা রাত কেটে গেছে এখানে? কাল বিকালে মোটরে উঠেছিলেন। এতক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন?
নিন স্যার, কিছু মুখে দিন। লোকটা আবার তাগাদা দিল।
পারিজাত বক্সী দু-এক মুহূর্ত ভাবলেন। চায়ে অথবা টোস্টে তো কিছু মেশানো নেই? খেলে তারপর যদি বেহুঁশ হয়ে পড়েন!
প্রথম লোকটা যেন তাঁর মনের কথাটা বুঝতে পারল।
হাসতে হাসতে বলল, আপনি মিথ্যা সন্দেহ করছেন। খাবারে কিছু মেশানো নেই। অবশ্য আপনার মতন লোককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলে আমাদের কারবারের খুবই উপকার হয়। নির্ঝঞ্ঝাটে আমরা ব্যাবসা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেরকম কোনও উদ্দেশ্য এখন আমাদের নেই।
এতক্ষণ পারিজাত বক্সী কিছু বোধ করেননি, কিন্তু খাবার সামনে আসতে বুঝতে পারলেন, পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। বেশ খিদে পেয়েছে।
তিনি টোস্ট আর চায়ের কাপ তুলে নিলেন। খাওয়া শেষ হবার আগেই প্রথম লোকটা বেরিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় লোকটা বসে ছিল মেঝের ওপর! পারিজাত বক্সী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ক-টা বেজেছে ভাই?
লোকটা হেসে উঠল, সে কী স্যার, নিজের কবজিতে ঘড়ি বাঁধা, আর আমাকে সময় জিজ্ঞাসা করছেন!
পারিজাত বক্সীর খেয়াল হল। তা-ই তো, পিস্তল এরা সরিয়ে রেখেছে, কিন্তু হাতের ঘড়ি তো খুলে নেয়নি। এরা ছিঁচকে চোর নয়। রুই-কাতলার কারবারি। ঘড়িতে সময় দেখলেন। সাড়ে আটটা।
আবার লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ জায়গাটার নাম কী ভাই?
লোকটা ট্রে-টা উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, সাড়ে দশটা নাগাদ আপনার ভাত নিয়ে আসব।
কিন্তু আমার কথার তো উত্তর দিলে না।
লোকটা একটা চোখ বন্ধ করে বিশ্রীভাবে হাসল, আমরা মাঝে মাঝে কালা হয়ে যাই স্যার। সব কথা শুনতে পাই না।
লোকটা যখন দরজার কাছ বরাবর গেছে, তখন পারিজাত বক্সী ডাকলেন, শোনো।
লোকটা ফিরে দাঁড়াল।
আমার স্নান করার কী হবে?
ওই যে স্যার, সব বন্দোবস্ত আছে, আপনার আগে অনেক বড়ো বড়ো অতিথি এখানে কাটিয়ে গেছেন। লোকটা একদিকের একটা দরজা খুলে দিল।
পারিজাত বক্সী উঁকি দিয়ে দেখলেন। তাকের ওপর তেল, সাবান, তোয়ালে। মেঝের ওপর বিরাট চৌবাচ্চা ভরতি জল। কল নেই।
লোকটা চলে যেতে পারিজাত বক্সী ভাবতে বসলেন। কল নেই। তার মানে কলকাতা থেকে বোধহয় বেশ দূরের কোনও জায়গা। তাঁকে বোধহয় অনেক দূরে নিয়ে আসা হয়েছে।
লালিও কি ধারেকাছে কোথাও আছে? বলা শক্ত। কোনওরকমে বাইরে বের হতে পারলে খোঁজ করা যায়। কিন্তু বাইরে বের হবার কোনও পথ নেই, উপায়ও নেই।
বাড়তি কাপড়জামা নেই, কাজেই তোয়ালে জড়িয়ে স্নান করতে হল। স্নান সারা হতেই দরজা খুলে গেল। আগের সেই দ্বিতীয় লোকটি এসে ঢুকল। হাতে ফতুয়া আর লুঙ্গি। নিন স্যার, একটু ভুল হয়ে গেছে। এগুলো পরে নিন। একেবারে আনকোরা।
পারিজাত বক্সীর একটু আশ্চর্যই লাগল।
এরা তো ভালোভাবে জানে পারিজাত বক্সী এদের এক নম্বরের শত্রু। তাও যে তাঁকে এত আদরযত্ন করছে!
দুপুরের ভাত খাওয়ার পর পারিজাত বক্সী বিছানার ওপর শুয়ে পড়লেন। ঘুমোলেন না। ঘুমোনো সম্ভব নয়। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।
তাঁর বাড়ির লোক নিশ্চয় রীতিমতো উদবিগ্ন হয়ে পড়েছে। লালবাজারেও সম্ভবত যোগাযোগ করেছে। বসাকরা যদি ফোন করে থাকে, তারাও চিন্তিত হয়ে পড়বে। পারিজাত বক্সী কোথায় এ খবর কেউ দিতে পারবে না।
এপাশ-ওপাশ করে সারাটা দুপুর কাটাল। পারিজাত বক্সী এটুকু বুঝতে পেরেছেন, এরা তাঁর চরম ক্ষতি করবে না। তিনি না থাকলে বসাক টাকাটা দিয়েই দেবে। সে তো এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। টাকাটা পেয়ে গেলে এরা লালিকেও ফেরত দেবে আর পারিজাত বক্সীকে ছেড়ে দেবে।
কিন্তু কী লজ্জা। পারিজাত বক্সীকে হার স্বীকার করতে হবে। পুলিশমহল হয়তো বিদ্রুপ করবে। ভবিষ্যতে কেউ তাঁর ওপর নির্ভর করবে না।
খুট করে একটা শব্দ। পারিজাত বক্সী চমকে চোখ খুললেন।
দরজার একটা পাল্লা খুলে গেল। তার ফাঁক দিয়ে বাঁক কাঁধে জল নিয়ে একটা লোক ঢুকল। পারিজাত বক্সী বুঝতে পারলেন, লোকটার কাজ চৌবাচ্চা ভরতি করা।
দ্বিতীয়বার লোকটা বাঁক কাঁধে নিয়ে ঢুকতেই—পারিজাত বক্সী উঠে পড়লেন।
পা টিপে টিপে বাথরুমে ঢুকে পিছন থেকে সজোরে লোকটার গলাটা টিপে ধরলেন।
লোকটার গলা থেকে একটুও শব্দ বের হল না। সটান মেঝের ওপর পড়ে গেল। কিন্তু পড়বার আগেই পারিজাত বক্সী তাকে জাপটে ধরলেন। তারপর নিজের ফতুয়া আর লুঙ্গি লোকটাকে পরিয়ে লোকটার পোশাক নিজে পরে নিলেন। এমনকী মাথার পাগড়িও।
লোকটাকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, বাঁক কাঁধে করে নিজে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। দরজার কাছে টুলের ওপর একটা লোক বসে। চারদিকে অন্ধকার। লোকটা কিছু বুঝতেই পারল না। খালি দুটো টিনে পারিজাত বক্সী নিজের পোশাক ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
সোজা হেঁটে তিনি রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালেন। রাস্তা মানে পায়ে-চলা পথ।
একটু দূরে একটা ইঁদারা দেখা গেল। এখান থেকেই বোধহয় লোকটা জল ভরেছিল।
পারিজাত বক্সী ইঁদারার পাশে একটু দাঁড়ালেন। টুলের ওপর বসা লোকটার অস্পষ্ট কাঠামো দেখা গেল।
টিনের মধ্যে থেকে পোশাকটা বের করে পারিজাত বক্সী টিন আর বাঁক ইঁদারার পাশে রেখে দিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন।
পারিজাত বক্সীর বরাত ভালো। কৃষ্ণপক্ষের রাত। কাছের জিনিস দেখবার উপায় নেই। তবু সাবধানের মার নেই। তিনি পথের পাশের জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন।
একটু পরেই আকাশে চাঁদ দিল। ম্লান আলো। অন্ধকারই ভালো ছিল। পারিজাত বক্সীকে দেখতে পাবার সম্ভাবনা কম ছিল। তিনি জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকে পড়লেন। অনেকটা পথ হাঁটার পর একটু দাঁড়ালেন। পরিশ্রমে, উত্তেজনায় পোশাক ভিজে গিয়েছিল। পোশাক ছেড়ে নিজের শার্ট-প্যান্ট পরে নিলেন। একবার জানতে পারলেই চারদিকে তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে। ধরতে পারলে তাঁর কী হাল হবে, ভাবতেও তিনি শিউরে উঠলেন।
হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটা লণ্ঠনের আলো দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
কোনও লোক হয়তো তাঁরই খোঁজে বেরিয়ে আসছে। পারিজাত বক্সী মোটা একটা গুঁড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়লেন। আলোটা কাছে আসতে দেখতে পেলেন মন্থর গতিতে একটা গোরুর গাড়ি এগিয়ে চলেছে। গাড়ির লণ্ঠন ঝুলছে।
এই সুযোগে গাড়িতে উঠতে পারলে খুব সুবিধা হয়। কিন্তু গাড়িটা যদি শত্রুপক্ষের হয়!
আরও কাছে আসতে পারিজাত বক্সী দেখতে পেলেন তরিতরকারি-বোঝাই, বোধহয় হাটে চলেছে। বরাতে যা আছে হবে, ভেবে পারিজাত বক্সী দ্রুতপায়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দুটো হাত তুলে দাঁড়ালেন।
গাড়োয়ান গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলছিল; জঙ্গলের মাঝখানে আচমকা একটা লোক দেখে আঁতকে উঠল।
ভয় নেই, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। অনেকক্ষণ ধরে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি। তুমি কোথায় যাবে?
গাড়োয়ান ভালো করে দেখল। বোধহয় বুঝতে পারল লোকটা চোরছ্যাঁচড় নয়। বিশ্বাস করা যেতে পারে।
বলল, আমি ঝাড়গ্রাম ইস্টিশনে যাব। ওদিকপানে গেলে তবু সুবিধা হবে?
উচ্চারণ শুনে মনে হল, লোকটা এখানকার আদিবাসী।
পারিজাত বক্সী এগিয়ে এসে বললেন, খুব সুবিধা হয় ভাই। তুমি আমাকে নিয়ে চলো।
আয়। গাড়োয়ান একটু সরে বসল।
পিছনে বসা সম্ভব নয়। তরিতরকারিতে গাড়ি বোঝাই। পারিজাত বক্সী সামনে গাড়োয়ানের পাশে বসলেন।
কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললেন, আমি সরকারের লোক। এখানে শাল গাছ জরিপ করতে এসেছিলাম। সঙ্গের লোকটা যে কোথায় গেল, বুঝতে পারলাম না। আমিও পথ হারিয়ে ফেললাম।
গাড়োয়ান খুব বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলল, ইসব অপদেবতার কাণ্ড বাবু। তবু বরাত ভালো। প্রাণে বেঁচেছিস। অপদেবতা তোর ঘাড় মুটকে রক্ত চুষে খেয়ে নিত।
পারিজাত বক্সী আর কিছু বললেন না।
গোরুর গাড়ি যখন ঝাড়গ্রাম স্টেশনে পৌঁছাল, তখন ভোর হয়ে গেছে, তরকারি -বোঝাই অনেক গোরুর গাড়ি স্টেশনের বাইরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে।
পকেটে হাত দিয়ে পারিজাত বক্সী ব্যাগটা বের করলেন। একমাত্র পিস্তল ছাড়া, লোকগুলো আর কিছু সরায়নি। একটা দশ টাকার নোট বের করে গাড়োয়ানের দিকে এগিয়ে দিলেন। নাও।
গাড়োয়ান হাত জোড় করল, না বাবু, ইসব আমি নিতে পারব নাই। আমার তো বাড়তি কোনও মেহনত হয় নাই। অনেক বলা সত্ত্বেও গাড়োয়ান কিছু নিল না।
পারিজাত বক্সী সোজা স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
ভিতরে ঢুকে দেখলেন একটি লোক দুটো টেবিল জড়ো করে একটা চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই লোকটাই বোধহয় স্টেশন মাস্টার।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পারিজাত বক্সী বসলেন। আধ ঘণ্টা, একটু একটু করে প্ল্যাটফর্মে ভিড় বাড়ছে। বেশির ভাগই কুলির দল। তরিতরকারির বোঝা নিয়ে আসছে। একটু পরেই ঘুমন্ত লোকটা চাদর সরিয়ে উঠে বসল। সামনে বসা পারিজাত বক্সীকে দেখেই চমকে উঠল, কে?
কোনও কথা না বলে পারিজাত বক্সী পকেট থেকে নিজের কার্ডটা বের করে তার সামনে ধরলেন।
ঘুম-চোখে কার্ডটা পড়েই লোকটা হাউমাউ করে উঠল।
কী ব্যাপার? গোয়েন্দা কেন? আমি কী অপরাধ করলাম?
পারিজাত বক্সী তাকে আশ্বস্ত করলেন।
না, না, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। একটা মেয়ে চুরির ব্যাপারে আমি এখানে এসেছি। পুলিশের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন?
নিশ্চয় পারি স্যার। আসুন।
লোকটাই স্টেশন মাস্টার। থানায় ফোন করে পারিজাত বক্সীকে বলল, নিন স্যার, কথা বলুন।
পারিজাত বক্সী নিজের পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে ঘটনাটা বললেন।
পারিজাত বক্সীর নাম ও.সি.-র পরিচিত।
আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমরা আসছি।
মিনিট কুড়ির মধ্যে জিপ এসে হাজির।
ও.সি.-র সঙ্গে দুজন কনস্টেবল।
গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান তখনও ছিল। তার কাছ থেকে জানা গেল, যেখান থেকে পারিজাত বক্সী গাড়িতে উঠেছিলেন, সে জায়গাটার নাম কুর্মিটোলা।
জিপ কুর্মিটোলার দিকে ছুটল।
জঙ্গলের কাছাকাছি যেতে পারিজাত বক্সী কিছুটা চিনতে পারলেন। এক জায়গায় তাঁর ছাড়া পোশাক পড়ে রয়েছে। জঙ্গলটা ছাড়াতেই ইঁদারা দেখা গেল। তার পাশেই লম্বা একখানা বাড়ি।
পারিজাত বক্সী বললেন, এই বাড়ি।
সবাই নেমে পড়ল। পুলিশরা বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে গেল।
পাকা দেয়াল। টিনের ছাদ।
তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। সব পরিষ্কার। কেউ কোথাও নেই। এমনকী বাথরুমে রাখা সাবান, তেল, তোয়ালে সব উধাও।
শুধু দেয়ালে একটা কাগজ আটকানো। তাতে লাল কালিতে বড়ো বড়ো করে লেখা—
.
বক্সী সায়েব
প্রথম রাউন্ডে আপনি জিতলেন, কিন্তু এটাই শেষ রাউন্ড নয়। আবার দেখা হবে। যদি ললিতা বসাকের ব্যাপারে নাক গলান, তাহলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে। সাবধান।
ইতি—
বোলতা
কলকাতায় ফিরে গিয়েই পারিজাত বক্সী বসাককে ফোন করলেন।
বসাক ছিল না। রমা ফোন ধরল!
আপনি কোথায় ছিলেন?
বিশেষ কাজে দু-দিন কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম।
এদিকে কী খবর?
ভালো নয়। আপনি বিকালে একবার আসতে পারবেন?
আসব। মিস্টার বসাককে থাকতে বলবেন।
বিকালে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে পারিজাত বক্সী হাঁটতে হাঁটতে বসাকদের বাড়ি ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে কাবুলিওয়ালার পোশাক। একেবারে নিখুঁত ছদ্মবেশ। চেনা দুষ্কর।
বসাকদের চাকর কিছুতেই তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
চিৎকার শুনে বসাক এসে দাঁড়াল।
বসাকের চেহারা দেখে পারিজাত বক্সী অবাক। এই কদিনেই বয়স যেন বেড়ে গেছে। ক্লান্ত দুটি চোখ। ঠোঁটের দু-পাশ ঝুলে পড়েছে।
তার কাছে গিয়ে পারিজাত বক্সী ফিসফিস করে নিজের পরিচয় দিলেন।
বসাক অবাক হয়ে গেল। তাঁকে নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকল, ঢুকেই বলল, মিঃ বক্সী, আপনার সাহায্যের আমার আর দরকার নেই।
কী ব্যাপার?
ব্যাপার দেখবেন? বসাক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পারিজাত বক্সীর সামনে রাখল।
পারিজাত বক্সী পড়লেন।
.
মহাশয়,
আমরা দশ হাজার টাকাতেই আপনার মেয়েকে ছাড়তে রাজি ছিলাম। কিন্তু আপনি আমাদের পিছনে টিকটিকি লেলিয়ে দেওয়ায় কুড়ি হাজার টাকার কমে তাকে ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না।
আগামী পনেরো তারিখে বেলা দু-টার মধ্যে চিড়িয়াখানার সাদা বাঘের খাঁচার সামনে একটা প্যাকেটে রেখে দেবেন। অপেক্ষা করবেন না। তাহলে বিপদ হবে। টিকটিকির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবেন না।
ইতি—
বোলতা
.
পারিজাত বক্সী চিঠিটা ফেরত দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, বেশ, আপনার যা ইচ্ছা। তিনি তাঁর কাছে থাকা বসাকের দশ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।
বসাক বলল, চিঠির এ পিঠটা দেখেছেন?
পারিজাত বক্সী চিঠিটা হাতে নিলেন।
.
বাবা ও মা,
টাকাটা দিয়ে দিয়ো, না হলে আমাকে জীবন্ত দেখতে পাবে না।
ইতি—
লালি
.
এটা কি আপনার মেয়ের হাতের লেখা?
হ্যাঁ, ওটা লালির লেখা।
অবশ্য এ লেখার কোনও দাম নেই, লালি চাপে পড়ে এটা লিখেছে।
পারিজাত বক্সী উঠে দাঁড়ালেন।
আপনি তাহলে টাকাটা দিয়ে দেওয়া ঠিক করলেন?
হ্যাঁ, এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই।
ঠিক আছে, চলি। আমি খুব দুঃখিত মিস্টার বসাক। আপনার কোনও কাজে লাগতে পারলাম না।
পারিজাত বক্সী রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন।
রাস্তার ওপাশের দিকে নজর গেল। আসবার সময় লক্ষ করেছিলেন, একটি লোক মোটর সাইকেলের ওপর বসে রয়েছে। যাবার সময় দেখলেন লোকটি একইভাবে বসে রয়েছে।
দৃষ্টি বসাকদের বাড়ির ওপর।
পারিজাত বক্সী রাস্তা পার হয়ে লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাবু, দেশলাই আছে?
লোকটি পকেটে হাত দিয়ে দেশলাই বের করে বলল, নাও খাঁ সাহেব।
সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ওপর পারিজাত বক্সীর বিরাট ওজনের একটা ঘুসি এসে পড়ল। লোকটা মোটর সাইকেল থেকে ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ে গেল।
পথচারী দু-একজন থমকে দাঁড়াল। কয়েকজন ছুটে এল। অনেকেই ভাবল, টাকা ধার করার ব্যাপারে কাবলিওয়ালারা বুঝি জুলুম করছে।
কেয়া হুয়া, বাবুকে কাহে মারা?
কোনও উত্তর না দিয়ে পারিজাত বক্সী নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেললেন, তারপর পকেট থেকে কার্ড বের করে লোকেদের দেখালেন।
একেবারে যারা কাছে দাঁড়িয়েছিল তাদের বললেন, আপনারা দয়া করে একটু সাহায্য করুন। এ লোকটাকে আমি সার্চ করব।
সার্চ করে লোকটার কাছ থেকে দুটো জিনিস পাওয়া গেল। একটা রিভলভার, অন্যটা পারিজাত বক্সীর ছবি।
নিশ্চয় পারিজাত বক্সীর ওপর নজর রাখবার জন্য এ ছবিটা একে দেওয়া হয়েছে।
গোলমাল শুনে বসাকও রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। সে পারিজাত বক্সীকে আস্তে আস্তে বলল, আবার একটা হাঙ্গামা বাধালেন তো? এসব চোট আমার ওপর দিয়ে পড়বে।
এ কথার উত্তর না দিয়ে পারিজাত বক্সী এক ডাক্তারখানা থেকে বালিগঞ্জ থানায় সব ঘটনা বলে ফোন করে দিলেন।
মিনিট পনেরোর মধ্যে জিপ এসে দাঁড়াল। ভিতরে ও.সি.। লোকটা তখনও বেহুঁশ। চোয়ালের কাছটা রক্ত জমে নীল হয়ে রয়েছে।
ধরাধরি করে জিপে তোলবার সময় লোকটা যন্ত্রণায় উঃ করে উঠল। কিন্তু চোখ খুলল না।
জিপ একেবারে লালবাজার গিয়ে থামল। নামবার সময় লোকটা চোখ খুলে দেখল। ঘোলাটে দৃষ্টি যেন ঠিক কিছু বুঝতে পারল না।
লক-আপে পুরে লোকটার মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দেবার পর সে উঠে বসল।
কী, ললিতাকে কোথায় রেখেছ?
লোকটা অবাক হবার ভান করল।
ললিতা—সে আবার কে হুজুর? এক কাবুলিওয়ালা মিছামিছি আমাকে ঘুসি মেরেছে, তার নামে কেস করব।
পুলিশ অফিসার পারিজাত বক্সীর ছবিটা দেখিয়ে বলল, এটা কার ছবি জানো?
লোকটা গদগদকণ্ঠে বলল, তা আর জানি না, ওটা বিখ্যাত গোয়েন্দা পারিজাত বক্সীর ছবি। আমি ওঁকে খুব ভক্তি করি হুজুর। সব সময় ওঁর ছবি কাছে কাছে রাখি।
এটা কার রিভলভার?
আজ্ঞে আমার।
লাইসেন্স আছে?
কী বলছেন, রিভলভার আছে, আর লাইসেন্স থাকবে না! আমার বাড়িতে চলুন। লাইসেন্স দেখিয়ে দেব।
বাড়ির ঠিকানা কী?
সতেরোর বি শিবপ্রসাদ ন্যায়রত্ন লেন। শ্যামবাজার।
ঠিকানাটা পুলিশ অফিসার লিখে নিল।
রাত আটটা নাগাদ লালবাজার থেকে পারিজাত বক্সীর কাছে ফোন এল।
পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে ছিলেন। মনের অবস্থা খুবই খারাপ। এ পর্যন্ত কোনও কেসে পরাজয় স্বীকার করতে হয়নি। এমনকী পুলিশের বাঘা বাঘা অফিসাররাও তাঁর সাহায্য নিয়েছে। কিন্তু বসাক আজ স্পষ্টই বলে দিল, পারিজাত বক্সীর সাহায্য নিতে গিয়ে তার ক্ষতিই হয়েছে।
বসাককে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। মেয়ে নিখোঁজ! দেরি করলে যেখানে মেয়েকে হারাবার আশঙ্কা, সেখানে বাপের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
অবশ্য সাধারণের জানবার কথা নয়। এইসব দুর্বৃত্তদের বিরাট জাল পাতা থাকে। দেশের বাইরেও ওদের লোক থাকে। এদের ধরা মোটেই সহজ নয়।
ফোনের কথা শুনে পারিজাত বক্সী আরও হতাশ হলেন। এক ডি.সি. জানালেন, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে লোকটিকে পারিজাত বক্সী ঘায়েল করে লালবাজারে এনেছিলেন, তার দেওয়া ঠিকানা ঠিকই। সেখানে তার বড়োছেলে আছে। লোকটা একটা মোটর সারানোর কারখানায় কাজ করে।
তাহলে এখন কী করবেন?
লোকটাকে ছেড়ে দেব। তাকে আটকে রাখার কোনও কারণ থাকতে পারে না।
একটু ভেবে নিয়ে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটাকে কখন ছাড়বেন?
খাতাপত্র ঠিক করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আশা করছি, ন-টার সময় ছেড়ে দিতে পারব।
ঠিক আছে।
ফোন ছেড়ে দিয়ে পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আর-একটা দুঃসংবাদ।
লোকটা ছাড়া পেয়ে তাঁর ওপর কেসও করতে পারে। অহেতুক মারার জন্য।
হঠাৎ পারিজাত বক্সী এক হাত দিয়ে মাথার চুল মুঠো করে ধরলেন। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন।
মিনিট পনেরো পর পারিজাত বক্সী ট্যাক্সিতে উঠলেন, তখন তাঁকে চেনা দায়। পরনে স্পোর্টিং গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট, টকটকে লাল। বিদেশি কোনও ট্যুরিস্ট। যেন রাতের কলকাতা দেখতে বেরিয়েছেন।
ট্যাক্সিতে উঠেই তিনি ড্রাইভারের হাতে দুটো দশ টাকার নোট তুলে দিয়ে বললেন, চলো লালবাজার!
লালবাজারে ঢুকলেন না। বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মিনিট কুড়ি পরেই মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেল, লোকটা মোটর সাইকেলে বেরিয়ে গেল।
পারিজাত বক্সী সামনে ঝুঁকে পড়ে ড্রাইভারকে বললেন, এই মোটর সাইকেলকে ফলো করো।
ট্যাক্সি মোটর সাইকেলের পিছনে ছুটল। মোটর সাইকেল সোজা বেলেঘাটার দিকে গেল। আলোছায়া সিনেমার পাশ দিয়ে ঘুরে নজরুল অ্যাভিনিউ ধরল। সল্ট লেক পার হয়ে লেকটাউনের কাছে একটা বাড়ির সামনে নামল।
পারিজাত বক্সীর নির্দেশে ট্যাক্সিটা একটু দূরে থামল।
পারিজাত বক্সী আর-একটা দশ টাকার নোট ড্রাইভারের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আপনি গাড়িটা রাস্তা থেকে সরিয়ে ঢালু জমিতে রাখুন। আমি এখনই আসছি।
সায়েবের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে ড্রাইভার অবাক হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর সাহেবের কাণ্ডকারখানা সে কিছু বুঝতে পারছিল না।
কিন্তু টাকা যখন হাতে আসছে তখন চুপচাপ থাকাই ভালো।
দোতলা বাড়ি। ওপরের ঘরে কমজোর একটা বাতি জ্বলছে। চারিদিকে নিচু পাঁচিল।
লোকটা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
পারিজাত বক্সী পাশের পাঁচিল ডিঙিয়ে বাগানে লাফিয়ে পড়লেন। ওপরে ওঠার একমাত্র পথ জলের পাইপ। তিনি পাইপ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেন। খুব অসুবিধা হল না। দোতলার কাচের জানলা বন্ধ। বাইরে চোখ রেখে ভিতরে সবই দেখা গেল। একটা চেয়ারে কালোমতন লোক বসে। লোকটাকে পারিজাত বক্সী আগেই দেখেছিলেন কুর্মিটোলায়। তার সামনে মোটর সাইকেলের লোকটা দাঁড়িয়ে। এদিকে নজর পড়তেই পারিজাত বক্সী চমকে উঠলেন।
ছোটো একটা খাট। তার ওপর একটি মেয়ে শুয়ে। মেয়েটির মুখ বাঁধা। দেখে মনে হল, মেয়েটি ঘুমোচ্ছে।
এমন তো হতে পারে, মেয়েটিকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
কালো লোকটি বলল, টিকটিকি ব্যাটা আমার তাইলে পিছনে লেগেছে। পানিওয়ালাটাকে ঘায়েল করে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। এবার কড়া দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে কেউ ফলো করেনি তো?
বোধহয় না, লোকটা বলল।
কয়েকটা গাড়ি-ট্যাক্সি লক্ষ করলাম। তারা বোধহয় দমদম এয়ারপোর্টে যাচ্ছে।
তুমি দিনকতক কলকাতার বাইরে গা-ঢাকা দিয়ে থাকো। আমি এদিকের ব্যবস্থা করছি।
এই পর্যন্ত শুনেই পারিজাত বক্সী পাইপ বেয়ে নামতে শুরু করলেন। এমন সুযোগ জীবনে বার বার আসে না। পুলিশের সাহায্য নিয়ে আজকেই কিছু একটা করে ফেলতে হবে।
একেবারে মাটির কাছে এসে পারিজাত বক্সীর পা-টা পিছলে গেল। তিনি পড়ে গেলেন।
ঘাসের ওপর পড়ার জন্য আঘাত লাগেনি, শুধু ধুপ করে একটা শব্দ হল।
পারিজাত বক্সী উঁকি মেরে পাঁচিল পার হয়ে ট্যাক্সির দিকে এগোলেন।
ট্যাক্সিতে ঢুকেই বললেন, তাড়াতাড়ি চলুন। লেকটাউন পুলিশ স্টেশন। আধ ঘণ্টার একটু কম সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন। সঙ্গে ও.সি. আর দুজন পুলিশ।
মোটর সাইকেল নেই। দরজায় বিরাট তালা। তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকা হল।
বাড়ি খালি। পাখি উড়ে গেছে। খাটটা এককোণে রাখা। ও.সি. জিজ্ঞাসা করলেন, মিস্টার বক্সী, আপনি দেখেছিলেন তো?
পারিজাত বক্সী কোনও উত্তর না দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন।
প্রায় উলটোদিকে একটা বস্তি। রাস্তার আলোর তলায় মাদুর বিছিয়ে চারজন লোক তাস খেলছে।
পুলিশ নিয়ে পারিজাত বক্সী গিয়ে দাঁড়াতেই লোকগুলো বিব্রত হয়ে উঠে দাঁড়াল। একজন বলল, বিশ্বাস করুন স্যার, আমরা পয়সা দিয়ে খেলছি না। এমনিই খেলছি।
সে কথায় কান না দিয়ে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, এখান দিয়ে কোনও মোটর সাইকেল যেতে দেখেছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটু আগে গেল। দুটি লোক, মাঝখানে একটা বাচ্চা। এইজন্যই অ্যাক্সিডেন্ট হয় স্যার। এত লোক একসঙ্গে চাপবে।
কোনদিকে গেছে?
কলকাতার দিকে।
পারিজাত বক্সী সরে এলেন। তাঁর একটামাত্র সান্ত্বনা, ও.সি. বিশ্বাস করবে এ বাড়িতে লোক ছিল। তিনি ভুল দেখেননি।
ও.সি. আর দুজন পুলিশকে লেকটাউন থানায় নামিয়ে পারিজাত বক্সী আবার লালবাজারে ডি.সি.-র সঙ্গে সব ব্যাপারটা আলোচনা করে একজন ও.সি.-কে সঙ্গে নিয়ে, শিবপ্রসাদ ন্যায়রত্ন লেনে এসে উপস্থিত হলেন।
এখানেও এক ব্যবস্থা। দরজায় বিরাট তালা।
পাশের বাড়ির লোকেরা বলল, মহিমবাবুরা বম্বে চলে গেছেন। কীসে গেছেন, কবে ফিরবেন, কিছুই তাদের জানা নেই।
পারিজাত বক্সী জানতে চাইলেন, বাড়িওয়ালা কোথায় থাকেন?
উত্তর পেলেন—দেওঘরে। মাসে মাসে ভাড়া আদায় করতে একজন আসেন।
অগত্যা পারিজাত বক্সীকে চলে আসতে হল।
তাঁর আক্ষেপের শেষ নেই। পাখি বার বার মুঠোর মধ্যে এসেও পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।
পারিজাত বক্সি ট্যাক্সিতে বাড়ির কাছ বরাবর এসেই অবাক হলেন। তাঁর বাড়ির সামনে প্রচুর লোকের ভিড়।
ট্যাক্সি থেকে নেমে পারিজাত বক্সী এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে সবাই ঘিরে ধরল।
এই যে মিস্টার বক্সী, আপনি বাইরে ছিলেন!
খুব ফাঁড়া গিয়েছে, ওই দেখুন আপনার বাড়ির ব্যবস্থা।
পারিজাত বক্সী মুখ তুলে দেখলেন। বারান্দার কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। বসবার ঘরের একটা জানলা ভেঙে ঝুলে রয়েছে। কেউ রাস্তা থেকে খুব শক্তিশালী বোমা ছুড়েছে।
সিঁড়ির কাছেই বাহাদুরের সঙ্গে দেখা হল।
সে বেচারির মুখ শুকনো। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
এটা কখন হল?
আধ ঘণ্টা আগে। আমি রসুইঘরে ছিলাম, কী আওয়াজ, সমস্ত বাড়িটা কেঁপে উঠল। বারান্দা ভেঙে পড়েছে।
পারিজাত বক্সী পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ভাবতে লাগলেন, প্রতিপক্ষ খুব দুর্দান্ত। তাঁকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
ফোনটার কোনও ক্ষতি হয়নি। সেটা ভিতরের ঘরে ছিল। ফোন তুলে থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই খবর পেলেন, ও.সি. খবর পেয়ে গেছে। এদিকেই আসছে। একটু পরেই অফিসার এল। সব দেখে ভ্রূ কোঁচকাল। বলল, আপনার বাড়িতে একদল পুলিশ পোস্ট করে দিচ্ছি। আমার মনে হয়, বদমায়েশগুলো আবার চেষ্টা করবে। আপনি সাবধানে থাকবেন।
পুলিশ অফিসার বলে যাবার পর পারিজাত বক্সী গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। দীর্ঘদিন পুলিশের থাকা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া কেউ যদি মোটর থেকে বোমা ছুড়ে খুব জোরে বেরিয়ে যায়, পুলিশ তার কী করতে পারে? অনেক ভেবে পারিজাত বক্সী পার্ক স্ট্রিটের এলাকার এক হোটেলে ফোন করে একটা ঘর ঠিক করলেন। আজ রাত থেকেই।
বাহাদুরকে সঙ্গে নিয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে পারিজাত বক্সী মোটরে বেরিয়ে পড়লেন।
হোটেলের সামনে পৌঁছে বাহাদুরকে বিদায় দিলেন। বললেন, তুমি দেশে চলে যাও বাহাদুর। তোমার দেশের ঠিকানা আমার জানা। যখন দরকার হবে, চিঠি দেব। চলে এসো।
বাহাদুর সেলাম করে চলে গেল।
পারিজাত বক্সী হোটেলের খাতায় নাম লিখলেন—অলক ঘোষাল। ব্যাবসার জন্যে এসেছেন।
বাড়ি থেকেই তিনি চেহারা পালটে এসেছিলেন। ঝোলা গোঁফ, গাল ভরতি জুলপি, নাকের পাশে বড়ো লাল রঙের আঁচিল।
বাহাদুর বিস্মিত হয়নি। কারণ পারিজাত বক্সীর নানারকম ছদ্মবেশ দেখতে সে অভ্যস্ত।
দু-দিন পারিজাত বক্সী হোটেল থেকে বের হলেন না। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইলেন। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, ভবিষ্যতে কী করবেন। কোন পথ নেবেন।
পরাজয় স্বীকার করতে তিনি রাজি নন। বসাক যদি তাঁর সাহায্য না-ও চায় তাহলেও তিনি ললিতার হরণকারীদের ধরবার চেষ্টা করবেন। এটা তাঁর সামাজিক কর্তব্য।
একবার শুধু ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে ফোন করে তাঁর বাড়িটা মেরামত করবার নির্দেশ দিলেন। দু-দিন পরে পারিজাত বক্সী লালবাজারে গিয়ে হাজির। নিজের গাড়িতে নয়, ট্যাক্সিতে।
একজন চেনা ও.সি.-কে বললেন, তোমাদের একটা অ্যালবাম আছে না, যারা ছেলে-মেয়ে চুরি করে তাদের ফোটো থাকে তাতে।
হ্যাঁ আছে।— কী ব্যাপার মিস্টার বক্সী?
বিশেষ কিছু নয়। মহাপুরুষদের চেহারাগুলো একবার দেখে রাখব। কী জানি, কখন কার সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যায়।
অ্যালবাম নিয়ে আসা হল।
গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে পাতা ওলটাতে ওলটাতে পারিজাত বক্সী একটা ফোটোর ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
সেই কালো মোটা লোকটাকে বার দুয়েক দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে। তলায় নাম দেখলেন—ঘনশ্যাম দাস।
ইনি এখন কোথায়?
ও.সি. একবার উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, ইনি বোধহয় ভারতের বাইরে। বছরকয়েক আগে ছেলে চুরির ব্যাপারে ধরা পড়ে বছর তিনেক জেল খেটেছিলেন, আমাদের খবর, ইনি এখন হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরে।
পারিজাত বক্সী আর কিছু বললেন না। অ্যালবাম ফেরত দিয়ে বেরিয়ে এলেন। লোকটার নাম তাহলে ঘনশ্যাম দাস। অবশ্য এসব মহাপুরুষের অনেক নাম থাকে। এক-একবার ধরা পড়লে এক-একটা নাম বলে। পারিজাত বক্সীর কোনও সন্দেহ নেই এই লোকটাকেই তিনি দেখেছিলেন। অপরাধ করে ধরা না পড়লে পুলিশের নজরে আসে না। কী আশ্চর্য, দিন সাতেক পরেই দেখা হয়ে গেল। রাত্রে ডিনার খেয়ে পারিজাত বক্সী বেরিয়ে আসছেন, হঠাৎ দেখলেন কোণের একটা টেবিলে ঘনশ্যাম দাস। কোটে একটা লাল গোলাপ। ঘনশ্যাম কি তাঁরই খোঁজে এই হোটেলে এসেছে, সন্দেহ করেছে পারিজাত বক্সী এখানেই আছেন?
পারিজাত বক্সী দুঃসাহসিক কাজ করলেন। সোজা ঘনশ্যামের সামনে গিয়ে বললেন, মাপ করবেন, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। ক-টা বেজেছে বলতে পারেন।
পারিজাত বক্সী ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছিলেন, ঘনশ্যাম উত্তর দিল বাংলায়, ন-টা বেজে দশ।
ধন্যবাদ।
পারিজাত বক্সী বেরিয়ে এলেন, নিজের রুমে ফিরলেন না। বেতের একটা চেয়ার পেতে লনের ওপর বসলেন।
মিনিট দশেক পরেই ঘনশ্যাম বের হল। একলা নয়, সঙ্গে একজন চীনা ভদ্রলোক।
পায়ে পায়ে পারিজাত বক্সী এগিয়ে গেলেন। দুজনে সবুজ একটা গাড়িতে উঠে চলে গেল।
পারিজাত বক্সী একবার ভাবলেন, ট্যাক্সি নিয়ে অনুসরণ করবেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন তাতে কোনও ফল হবে না। নতুন করে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা হল না। এবার ধরা পড়লে ঘনশ্যামের দলের হাতে তাঁর প্রাণ যাবার সম্ভাবনা।
তবে এক ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হলেন, ঘনশ্যাম তাঁর জন্যে হোটেলে আসেনি। নিজের কোনও কাজে এসেছিল। এসব লোকের অনেক রকমের কাজ থাকে।
নিজের রুমে ফিরে গিয়ে পারিজাত বক্সী একটা বই নিয়ে বসলেন, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলেন বইতে একদম মন নেই। ললিতার কথাটা মনে হল। মেয়েটাকে ভিন্ন কোনও প্রদেশে চালান করে দেয়নি তো? অনেক সময় পুলিশ পিছনে লাগলে তা-ই করে।
তবে এক্ষেত্রে তা না-ও করতে পারে। বসাকের টাকা আছে, সে খোঁজ এরা পেয়েছে। সেইজন্যেই দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে বিশ হাজার টাকা করেছে। অনেক সময় এরকমও হয়েছে—টাকাটা নিয়েছে কিন্তু ছেলে-মেয়ে ফেরত দেয়নি। সেসব সাধারণত ছিঁচকে চোরের দল করে। খানদানিরা কথার খেলাপ করে না।
বসাক তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করছে না। করলে হয়তো কিছু একটা উপায় বের করা যেত। বই রেখে পারিজাত বক্সী বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পুরোনো বাড়িতে আর কোনও উৎখাত হয়নি। হলে তাঁর ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু নিশ্চয় জানাত। তার মানে ঘনশ্যামের দল বুঝতে পেরেছে তিনি আর ও ঠিকানায় নেই।
রাস্তার দিকে দেখতে দেখতে পারিজাত বক্সী চমকে উঠলেন। সেই সবুজ গাড়িটা এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে চীনা ভদ্রলোক নেমে দাঁড়াল। ভিতর থেকে ঘনশ্যাম তার পিঠে হাত রেখে কী যেন বলল। গাড়ি চলে গেল।
পারিজাত বক্সী তাড়াতাড়ি রুমের দরজা বন্ধ করে নেমে এলেন। লিফট নীচে আসতেই দেখলেন, চীনা ভদ্রলোক লিফটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। পারিজাত বক্সী লিফট থেকে নামলেন না। চীনা ভদ্রলোক উঠতে বললেন, আপনি কোন তলায় যাবেন?
তিনতলা।
স্বয়ংক্রিয় লিফট, লিফটম্যান নেই। নিজেদেরই চালাতে হয়।
পারিজাত বক্সী বোতাম টিপলেন। লিফট ওপরে উঠল।
পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাছে আমার একটু দরকার আছে।
কী দরকার বলুন?
যদি আপনার রুমে যাবার অনুমতি দেন, সেখানেই বলব।
চীনা ভদ্রলোক পারিজাত বক্সীকে আপাদমস্তক আড়চোখে দেখল, তারপর বলল, আসুন।
পারিজাত বক্সীর রুমও তিনতলায়, তবে সামনের দিকে। নম্বর তেত্রিশ। চীনা ভদ্রলোকের রুম পিছনদিকে। নম্বর একচল্লিশ। বিশেষ জিনিসপত্র নেই। দুটো ফোমের স্যুটকেস। গোটা তিনেক হ্যান্ডব্যাগ।
পারিজাত বক্সী তীক্ষ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে সারা ঘরটা দেখে নিলেন।
কী আপনার কথা, বলুন মিস্টার।
আমি ঘোষাল। অলক ঘোষাল।
বলুন, কী আপনার কথা, মিস্টার ঘোষাল।
পারিজাত বক্সী বললেন আমি একজন ছোটোখাটো ব্যবসায়ী। একটা ট্রেড ডেলিগেশনের সঙ্গে সামনের মাসে চায়না যাবার কথা। এর আগে আর আমার চায়না যাবার সৌভাগ্য হয়নি। তাই যাবার আগে সে দেশ সম্বন্ধে একটু জানতে চাই।
পারিজাত বক্সীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চীনা ভদ্রলোক খুব জোরে হেসে উঠল। হাসি থামতে বলল, আমি আপনাকে চায়না সম্বন্ধে বলব কী মিস্টার ঘোষাল। আমি নিজেই সে দেশে কোনওদিন যাইনি। আমার কলকাতায় জন্ম। আজকাল কোচিনে থাকি। চামড়ার ব্যাবসা, সেই সূত্রেই মাঝে মাঝে এখানে আসতে হয়।
পারিজাত বক্সী মুখের একটা অপ্রস্তুত ভাব করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমাকে মাপ করবেন।
চীনা ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আপনার লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ নেই মিস্টার ঘোষাল। আমি আপনাকে সাহায্য করতে না-পারার জন্য লজ্জিত। এরপর পারিজাত বক্সীর বেরিয়ে আসা ছাড়া আর পথ ছিল না। তিনি বের হয়ে পড়লেন।
চীনা ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করে দিল।
এগোতে গিয়েও পারিজাত বক্সী দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভিতর থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। চীনা ভদ্রলোক খুব জোরে হাসছে। হঠাৎ হাসির কী এত কারণ ঘটল? একটু দাঁড়িয়ে থেকে পারিজাত বক্সী নিজের রুমে ফিরে এলেন।
চীনা ভদ্রলোকের নামটা জানা হল না। সে অবশ্য হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা যায়, কিন্তু জেনেই বা কী লাভ? হোটেলের খাতায় তিনি যেমন অলক ঘোষাল, তেমনই লোকটার একটা ছদ্মনামই থাকবে। আর কী করা যায়।
লোকটার অনুপস্থিতিতে পুলিশের সাহায্য নিয়ে তার রুম সার্চ করা যায়। যদি কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে পারিজাত বক্সীর ছদ্মবেশও খুলে পড়বে। ঘনশ্যামের দল তাঁকে চিনে ফেলবে।
যদি আফিম কিংবা নিষিদ্ধ কোনও জিনিস পাওয়া যায়, তাহলেই বা তাঁর কী? এসব পুলিশের কাজ। তাঁর নয়। এসব ধরবার জন্য কেউ তাঁকে নিয়োগ করেনি। তবু লোকটাকে চোখে চোখে রাখা ভালো। ঘনশ্যামের সঙ্গে তার কীসের এত অন্তরঙ্গতা?
পরের দিন সকালে চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আবার দেখা হয়ে গেল। চায়ের কাপ সঙ্গে নিয়ে লোকটা বসে আছে।
মনে হল, কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
পাশ কাটাতে গিয়ে পারিজাত বক্সী ধরা পড়ে গেলেন।
আসুন মিস্টার ঘোষাল, কোথাও বের হচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ, চা খেয়ে একটু বের হব ভাবছি।
এই টেবিলেই বসুন।
অগত্যা পারিজাত বক্সীকে বসতে হল।
সকাল আর বিকালের চা অনেকেই নিজের নিজের রুমে খায়। সেইজন্য ডাইনিং রুমে ভিড় নেই।
পারিজাত বক্সীর চা আসতে চীনা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করল, আপনি কবে নাগাদ চায়না যাবেন?
এখনও দিন ঠিক হয়নি। সামনের মাসের শেষ সপ্তাহে।
কাল আপনি চলে যাবার পরই আমার মনে পড়ে গেল। এখানে আমার পরিচিত একটি চীনা ভদ্রলোক আছেন, তিনি বছরে বার তিনেক যান। তাঁর কাছে আপনি ওদের সম্বন্ধে সব জানতে পারবেন।
পারিজাত বক্সী কৃতার্থ হবার ভান করলেন।
তাহলে খুব ভালোই হয়। সরকারি রাস্তায় দেশটার সব খবর ঠিক পাওয়া যায় না। নিয়মমাফিকভাবে যেটুকু দেখানো প্রয়োজন, সেটুকুই দেখাবে। সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করার সুযোগই হয়তো দেবে না।
তা ঠিক।
আপনি কত নম্বর রুমে আছেন?
তেত্রিশ।
ঠিক আছে, ভদ্রলোক এলে আপনার কাছে খবর দেব। চীনা ভদ্রলোক আরও কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ গেটের কাছে মোটরের হর্ন বাজতেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
চলি, আমাকে একটু বের হতে হবে।
পারিজাত বক্সী উঁকি দিয়ে দেখলেন, গেটের কাছে সেই সবুজ গাড়ি, ভিতরে কেউ নেই, শুধু ড্রাইভার বসে।
চীনা ভদ্রলোক উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
বসে বসে পারিজাত বক্সী ভাবতে লাগলেন, তিনি যেমন লোকটিকে সন্দেহ করছেন, লোকটিও হয়তো তাঁর সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করছে। কায়দা করে তাঁর রুমের নম্বরও জেনে নিল।
ছদ্মবেশে তাঁকে পারিজাত বক্সী হিসাবে হয়তো চিনতে পারেনি। কিন্তু পুলিশের কোনও চর ভাবা অস্বাভাবিক নয়।
চীনা ভদ্রলোক কিছু করার আগে তাঁরই কাজ শুরু করা উচিত। কিন্তু কীভাবে?
পারিজাত বক্সী লালবাজারে গিয়ে যে ও.সি. অ্যালবাম দেখিয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা করলেন। বললেন, আপনাদের ঘনশ্যাম দাস কিন্তু এ শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তা-ই নাকি?
আমি বার দুয়েক দেখেছি। এ ব্যাপারে কিছু করা যায় না?
কী করা যেতে পারে বলুন? আইনের ব্যাপার আপনাকে আর কী বোঝাব, মিঃ বক্সী?
কেউ কোনও অপরাধ না-করা পর্যন্ত আমরা তাকে ছুঁতে পারি না। তবে আপনি যদি চান, লোকটাকে চোখে চোখে রাখতে পারি।
পারিজাত বক্সী অন্য কথা পাড়লেন, একটা রুম যদি সার্চ করার প্রয়োজন হয়, করবেন?
অযথা সার্চ করার অসুবিধা আছে, তবে এটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
ঠিক আছে। প্রয়োজন হলে জানাব।
পারিজাত বক্সী উঠে পড়লেন। কোনওদিকেই বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না।
এর চেয়ে অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছেন, কিন্তু এ কেসের আসামি হাতের কাছে এসেও পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন চায়ের টেবিলে আবার দেখা হয়ে গেল।
পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আজ দুপুরে আপনার কোনও কাজ আছে?
চীনা ভদ্রলোক বলল, কেন বলুন তো?
আমার সঙ্গে যদি লাঞ্চ খান, খুব খুশি হব।
মাপ করবেন মিস্টার ঘোষাল, আজ আমার ফিরতে রাত হয়ে যাবে। লাঞ্চ আর ডিনার দুইই আমি বাইরে খেয়ে নেব। ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমরা দুজনেই তো এখানে আছি এখন। পরে একদিন আপনার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা যাবে।
পারিজাত বক্সী আর কিছু বললেন না।
দুপুরবেলা হোটেল নিস্তব্ধ। সবাই যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে। হোটেলের পরিচারকও বিশ্রাম নিচ্ছে।
পারিজাত বক্সী নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
দু-হাতে দস্তানা। খুব সন্তর্পণে এগিয়ে একচল্লিশ নম্বর রুমের সামনে দাঁড়ালেন।
এদিক-ওদিক দেখে পকেট থেকে মাস্টার কি বের করে দরজা খুলে ফেললেন।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।
ফোমের স্যুটকেস দুটো খোলা। সাবধানে পারিজাত বক্সী দেখলেন, জামাকাপড় ছাড়া কিছু নেই। হ্যান্ডব্যাগে কয়েকটা টান করা চামড়া। টেবিলের ওপর ছোটো একটা ডায়েরি। পাতাগুলি খালি। কিছুই লেখা হয়নি। সব কষ্ট বৃথা হল।
পারিজাত বক্সী আবার পাতাগুলো ওলটালেন।
একটা পাতায় শুধু একটা লেখা—
পনেরোই এপ্রিল।
এ তারিখের তাৎপর্য পারিজাত বক্সী ঠিক বুঝতে পারলেন না। সম্ভবত এই তারিখ চীনা ভদ্রলোকের কোনও ব্যাবসার ব্যাপারে দেখা করার কথা।
হতাশ মনে পারিজাত বক্সী দরজা বন্ধ করে, নিজের রুমে ফিরে এলেন।
বিছানার ওপর টান হয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন, তিনি কি ভুল পথে চলেছেন? চীনা ভদ্রলোক হয়তো প্রকৃতই চামড়ার ব্যবসায়ী।
যাকে তিনি ঘনশ্যাম দাস ভাবছেন, সে হয়তো অন্য লোক। তবে লোক চেনার ব্যাপারে পারিজাত বক্সীর ভুল তো বিশেষ হয় না।
হঠাৎ পারিজাত বক্সী বিছানার ওপর উঠে বসলেন। তারিখটা পনেরোই এপ্রিল। নিছক একটা যোগাযোগ। না গভীর কিছু আছে?
বসাকের কাছে যে চিঠি এসেছিল তাতে লেখা ছিল পরের তারিখে চিড়িয়াখানার সাদা বাঘের খাঁচার সামনে টাকাটা রেখে দেবার জন্য।
পরের তারিখ মানে পনেরোই এপ্রিল। ঠিক আর এক সপ্তাহ পরে।
পারিজাত বক্সী ঠিক করলেন, একবার শেষ চেষ্টা করবেন। বসাক যদি সহযোগিতা না করে তাহলেও।
দু-দিন পরে আবার সেই চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা।
এবার আর সবুজ গাড়ি নয়। হোটেলের বেয়ারা একটা ট্যাক্সি ডেকে এনেছিল। লোকটি তাতেই উঠছিল।
পারিজাত বক্সী ফিরছিলেন লালবাজার থেকে।
তাঁকে দেখে চীনা ভদ্রলোক বলল, আমি খুব দুঃখিত মিঃ ঘোষাল। আমার সেই বন্ধুটি শহরে নেই। কবে আসবে তাও জানি না। তাই আপনার কাছে আনতে পারছি না।
পারিজাত বক্সী হাসলেন, আপনি কী করবেন? আমারই বরাত মন্দ। দুপুরবেলা চললেন কোথায়?
চীনা ভদ্রলোক বিরক্তকণ্ঠে বলল, আপনি তো নিজে ব্যবসায়ী। বুঝতেই পারেন আমাদের সময়-অসময় নেই। যখনই দরকার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আপনার মতন সৎ বন্ধু লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করেছেন। সময়ের অভাবে সে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত রাখতে পারছি না। আচ্ছা চলি, আবার দেখা হবে।
ট্যাক্সি চলে যাবার পর পারিজাত বক্সী অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
সৎ বন্ধু কথাটা কি লোকটা ঠাট্টা করে বলল? চীনাদের মুখ মুখোশের মতন, মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
পারিজাত বক্সীকে নিশ্চয় সন্দেহ করছে না। তার অনুপস্থিতিতে পারিজাত বক্সী যে তার রুম সার্চ করেছে, সেটা বোধহয় বুঝতে পারেনি। এত কাঁচা কাজ তিনি করেন না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পারিজাত বক্সীর মনে হল, আর-একটা ট্যাক্সি নিয়ে চীনে ভদ্রলোককে ফলো করলে হয়তো নতুন কিছু জানা যেত।
কিন্তু ঝুঁকি নিতে পারিজাত বক্সীর সাহস হল না। পনেরোই এপ্রিলের আগে নতুন কোনও বিপদে জড়িয়ে পড়া সমীচীন না।
লালবাজারে আজ সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
পুলিশ থেকে সবরকম সাহায্য পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। ললিতার নিখোঁজ হবার ঘটনা পুলিশের পক্ষেও একটা কলঙ্ক হয়ে রয়েছে। তার ওপর প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই শহরে একটা-দুটো ছেলে-মেয়ে চুরি যাবার রিপোর্ট আসছে। এক বা একাধিক দল কাজ করছে। তাদের ধরতে না পারলে পুলিশেরও শান্তি নেই। চৌদ্দই এপ্রিল ভোরবেলা পারিজাত বক্সী একচল্লিশ নম্বর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
অনেকবার বেল টেপার পরেও কোনও সাড়া পেলেন না। সেখান দিয়ে একটা বেয়ারা আসছিল। সে থেমে পড়ে বলল, সাব কাল রাত্রে হোটেলে ফেরেননি।
পারিজাত বক্সী নিজের রুমে ফিরে এলেন। কী ব্যাপার? পনেরোই এপ্রিলের আগে থেকেই চীনা ভদ্রলোক হোটেলে ফিরল না। এর সঙ্গে ললিতার ব্যাপারের কি কোনও যোগাযোগ আছে?
জোর করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সামান্য একটু সন্দেহ কিন্তু তার ওপর নির্ভর করেই পারিজাত বক্সীকে এগোতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
* * *
পনেরোই এপ্রিল।
পারিজাত বক্সী ভোরের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঠিক দুপুরবেলা। গরমও বেশ পড়েছে। চিড়িয়াখানা প্রায় খালি। এমনকী পাখিগুলো নিঝুম হয়ে বসে রয়েছে। জন্তুরা ক্লান্ত হয়ে ঝিমোচ্ছে।
সাদা বাঘের খাঁচার পাশে কামিনী ঝাড়ের পিছনে গোটা তিনেক দেহাতি লোক। দুজন পুরুষ, একজন স্ত্রীলোক।
চিড়িয়াখানা ঘুরে পরিশ্রান্ত হয়ে তারা গোল হয়ে বসেছে। সামনে একটা কাগজে ছাতু মাখা। পাশে একটা লোক। খেতে খেতে নিজেদের ভিতর গল্পগুজব করছে।
হঠাৎ দেখা গেল বসাক আর রমা এসে দাঁড়াল।
বসাকের কাঁধে কাপড়ের ঝোলা।
বসাক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখল। কামিনী ঝাড়ের জন্যে দেহাতিদের দেখা গেল না।
বসাক ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আবার চারদিক দেখল। তারপর ব্যাগ থেকে খাকি রঙের একটা প্যাকেট বের করে সাদা বাঘের খাঁচার সামনে একটা গাছের গোড়ায় রেখে দিয়ে রমাকে সঙ্গে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। মিনিট দশ-পনেরো, তার বেশি নয়, বাঁদিক থেকে একটি লোক এসে দাঁড়াল। পরনে এই গরমেও লম্বা কোট, পাজামা, মাথায় মুসলমানি টুপি। কাঁচা-পাকা দাড়ি। লোকটা মুখ তুলে চারপাশ দেখল, তারপর পকেট থেকে খাতা-পেনসিল বের করে খাঁচার কাছে এগিয়ে গিয়ে কী সব লিখল। লেখা শেষ হতে লোকটা ঘাসের ওপর বসল বসাকের রেখে-যাওয়া প্যাকেটটা ঘেঁষে। দেহাতিরা উঠে পড়ল। গেট পার হয়ে রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকল।
তারপর অপেক্ষো। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল বটে, কিন্তু চোখ রাখল গেটের দিকে।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর মুসলমান ভদ্রলোকটি বের হল। রাস্তার পাশে একটা স্কুটার দাঁড় করানো ছিল। সেটার ওপর বসে স্টার্ট দিল।
স্কুটার চলার সঙ্গে সঙ্গে মোটরও চলতে শুরু করল। তবে বেশ একটু ব্যবধান রেখে।
স্কুটার খিদিরপুরের দিকে বাঁক নিল। মোটরও।
বিরাট টিনের বস্তি। এখানে-ওখানে দল দল মুরগি চরছে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে। স্কুটার বস্তির মধ্যে ঢুকে গেল।
মোটরটা অল্প দূরে থামল। একজন দেহাতি মোটর থেকে নেমে দাঁড়াতেই মোটর তিরবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল। স্কুটারটা উঠোনে রেখে লোকটা দরজার শিকল ধরে নাড়ল।
ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় আওয়াজ হল, খোলা আছে। চলে এসো।
মুসলমান ভদ্রলোকটি ভিতরে ঢুকে গেল।
ততক্ষণে দেহাতি লোকটা বস্তির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও একটা জানলা নেই। টিনের ফাঁক আছে দু-এক জায়গায়। দেহাতি সেই ফাঁকে চোখ রাখল।
প্রথমে কিছু দেখতে পেল না। তারপর একটু একটু করে চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে টেবিলের ওপর একটা টর্চ আড়াআড়িভাবে রাখা। তারই ক্ষীণ আলোয় দেখা গেল দুজন লোক খাটিয়ার ওপর বসে নোটের তাড়া গুনছে। দেহাতি আস্তে আস্তে সামনের দিকে এসে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে দেখল। রাস্তার ওপর একটা মোটর, তার পিছনে একটা স্টেশন ওয়াগন।
স্টেশন ওয়াগন থেকে জনা পনেরো বন্দুক হাতে পুলিশ নামল। বস্তির অন্য লোকেরা ভিড় করে এসে দাঁড়াল। পুলিশ ঘিরে ফেলল বস্তি।
দরজার সামনে দাঁড়াল দেহাতি, তার ছদ্মবেশ খুলে ফেলতেই পারিজাত বক্সীকে চেনা গেল। তিনি দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, দরজা খোলো, না হলে আমরা দরজা ভেঙে ঢুকব।
কোনও শব্দ নেই। সব চুপচাপ।
হঠাৎ রিভলভারের আওয়াজ। পিছনের দিকে চেঁচামেচি। পারিজাত বক্সী পিছনের দিকে ছুটে গেলেন। পিছনের দিকে কয়েকটা টিন আলগা। সেই টিন খুলে ভিতরের দুটো লোক বেরিয়ে পড়েছিল। দুজন পুলিশ তাদের জাপটে ধরতে যেতেই একজন রিভলভার থেকে গুলি চালিয়েছিল। তাতে একটা পুলিশ ঘায়েল।
পুলিশটা হাত চেপে বসে পড়তেই, অন্য পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজনকে ধরে ফেলেছিল।
পারিজাত বক্সী যখন গিয়ে দাঁড়ালেন তখন দুজন আক্রোশে ফুলছে।
পারিজাত বক্সীকে দেখেই কালো মোটা লোকটা গর্জন করে উঠল।
টিকটিকি, তোকে আমরা ছাড়ব না। খতম করবই। একজন নিরীহ লোকের পিছনে লেগেছিস!
পারিজাত বক্সী কোনও উত্তর দিলেন না।
ও.সি.-কে সঙ্গে নিয়ে টিনের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লেন।
এখন বেশ আলো হয়েছে। কোণের দিকে কতকগুলো কাঠের টুকরো। সেগুলো সরাতেই নোটের বান্ডিল পাওয়া গেল।
কিন্তু ললিতা কই? যার জন্যে এত কাণ্ড তাকে কোথায় সরিয়ে রাখল?
পারিজাত বক্সীর ধারণা ছিল, এই ঘরের মধ্যেই কোথাও ললিতাকে রেখে দেওয়া হয়েছে।
ললিতাকে আবার কোথায় রাখল?
পারিজাত বক্সীর নির্দেশে পুলিশ সারাটা বস্তি ঘিরে ফেলল। কাউকে বাইরে যেতে দিল না। সব জায়গা তন্ন তন্ন করে সার্চ করতে হবে। বাইরেটা অনুসন্ধান করা হল। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে যেতেই লোকেরা বাধা দিল। বলল না, ভিতরে জেনানারা থাকে। সেখানে আমরা আপনাদের যেতে দেব না।
ও.সি. বলল, ঠিক আছে। আমাদের সঙ্গে মেয়ে পুলিশ আছে, তারাই ভিতরে সার্চ করবে।
গাড়ি থেকে গোটাকয়েক মেয়ে পুলিশ নামল। তার মধ্যে দেহাতি মেয়েছেলে ছিল।
সব বস্তিটা খোঁজা হল। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের জড়ো করে দেখা হল। ললিতা নেই।
একেবারে কোণের দিকে একটা টিনের চালা! মেয়ে পুলিশ সেদিকে যেতেই একটি পুরুষ বাধা দিল। ওখানে কোনও লোক থাকে না। ওটা গুদাম। খালি ড্রাম রাখা হয়।
পারিজাত বক্সীর কী মনে হল। বললেন, হ্যাঁ, ওখানেও দেখব। মেয়ে পুলিশরা ভিতরে ঢুকে গেল। একটু পরেই তাদের চিৎকার শোনা গেল।
পারিজাত বক্সী ওদিকে গিয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকলেন। বিরাট আকারের সব ড্রাম। মাঝখান দিয়ে সরু জায়গা। চিৎকারটা পিছন থেকে আসছে।
একেবারে কোণের দিকে একটা খাটিয়া, তার ওপর একটি মেয়ে। মুখ বাঁধা। হাত-পা-ও বাঁধা। ন্যাড়া মাথা, রোগা চেহারা। একটি মেয়ে পুলিশ তাকে কোলে করে বাইরে নিয়ে এল।
বস্তির সেই পুরুষটি বলল, ও তো আমার মেয়ে আমিনা।
মেয়ের মুখ-হাত-পা অমন করে বেঁধেছেন কেন?
বড়ো বদমাশ মেয়ে। ছুটে বাজার চলে যায়।
পারিজাত বক্সী মেয়েটির মুখ-হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে বললেন, তোমার নাম কী বলো তো মা? কোনও ভয় নেই।
মেয়েটি কেঁদে উঠে বলল, আমি লালি। ভালোনাম ললিতা।
পুরুষটি পায়ে পায়ে সরে পড়ার চেষ্টা করছিল।
পারিজাত বক্সীর ইঙ্গিতে দুজন পুলিশ জাপটে ধরে তার হাতে হাতকড়া বসিয়ে দিল।
কথা হল থানায় এসে। মুসলমান ভদ্রলোকটিকে পারিজাত বক্সী বললেন, কী, আমায় চিনতে পারছেন? আমি রুম নম্বর তেত্রিশের অলক ঘোষাল। আপনার ছদ্মবেশটা কিন্তু নিখুঁত হয়েছে। শুধু একটা ভুল। সামনের সোনা দিয়ে বাঁধানো দাঁতটা ঢাকতে পারেননি।
লোকটা মাথা তুলে রক্তচক্ষু মেলে পারিজাত বক্সীর দিকে দেখেই মাথা নামাল।
তারপর ঘনশ্যামবাবু, আমার পিস্তলটা আপনার কাছে আছে, ওটা ফেরত দেবেন।
কালো মোটা লোকটা চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে রইল।
মেয়েকে ফিরে পেয়ে বসাকরা আনন্দে আত্মহারা। পারিজাত বক্সীর দুটো হাত ধরে বলল, আপনার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারব না। কত অন্যায় কথা আপনাকে বলেছি, মাফ করবেন।
পারিজাত বক্সী এসবের উত্তর না দিয়ে বললেন, আপনার টাকাটা এখনই ফেরত পাবেন না। কেস শেষ হলে আপনাকে দিয়ে দেওয়া হবে। আর-একটা কথা, লালিকে নিয়ে মাসখানেকের জন্য কোনও স্বাস্থ্যকর জায়গায় চলে যান। আচ্ছা আসি, নমস্কার।
লালিকে আদর করে পারিজাত বক্সী নিজের মোটরে গিয়ে উঠলেন।