বোরিস পাস্তেরনাক

বোরিস পাস্তেরনাক

এমন সময় ছিল যখন পাস্তেরনাক বললে লোকে বুঝত প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী লেওনিদ পাস্তেরনাক। মস্কো কলাভবনের অধ্যাপক। টলস্টয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। রেজারকশন উপন্যাসের ছবিগুলি যাঁর আঁকা। যাঁর পত্নী রোজা কাউফমান বিবাহের পূর্বে পিয়ানো বাজিয়ে নাম করেছিলেন। যাঁর গৃহে টলস্টয় এসেছিলেন কন্যাদের নিয়ে পিয়ানো শুনতে।

এই শিল্পীদম্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র বোরিস পাস্তেরনাক আজন্ম ললিতকলায় লালিত। দুই চোখ ভরে দেখেছেন। দুই কান ভরে শুনেছেন। যত রাজ্যের গুণীদের পায়ের তলায় বসেছেন। তাঁর জীবনের গোড়া থেকে টলস্টয় রয়েছেন তাঁদের বাড়ির হাওয়ায়। বিশ বছর ধরে তিনি সেই মহাপুরুষের সংস্পর্শের হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়েছেন। একবার টলস্টয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এক বিদেশি যুবা। বোরিস পাস্তেরনাকের বয়স তখন দশ। রেলপথে মস্কো ফিরছেন সপরিবারে। সহযাত্রী ও সহযাত্রিণী হলেন একটি যুবক ও একটি মহিলা। তাঁদের নামিয়ে দেবার জন্য ট্রেন মাঝপথে থামল। টলস্টয়ের বাড়ি থেকে জুড়িগাড়ি এসে তাঁদের নিয়ে গেল। বালক পাস্তেরনাক তখন জানতেন না সহযাত্রীর নাম, জানতেন না তিনি একজন কবি। আরও দশ বছর পরে একদিন বইয়ের আলমারি সাজাতে গিয়ে দেখেন একখানা বই পড়ে গেছে মেজেতে। তুলে নিয়ে পড়েন। রিলকের কবিতা। লেওনিদ পাস্তেরনাককে উপহার। পরে একদিন ডাকে এল রিলকের আরেকখানি বই। এখানিও উপহার। কে এই রিলকে? পিতা বললেন ইনিই সেই সহযাত্রী।

সেকালের রাশিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কম্পোজার স্ক্রিয়াবিন একবার পাস্তেরনাকদের কাছাকাছি বাসা নেন এক পল্লিগ্রামে। বালক বোরিস তাঁর বাজনা শুনে এমন মুগ্ধ হলেন যে মনে মনে ঠিক করে ফেললেন বড়ো হয়ে তিনিও হবেন সংগীতের কম্পোজার। আরম্ভ হয়ে গেল একমনে সংগীতসাধনা—একলব্যের মতো দ্রোণের অগোচরে। আর কোনো পিতা-মাতা হলে ছেলের খেয়ালে বাধা দিতেন। কিন্তু বোরিসের পিতা-মাতা অন্য প্রকৃতির। কম্পোজার হয়ে জীবিকা অর্জনে তাঁদের আপত্তি নেই। ছ-বছর ধরে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে সংগীতসাধনার পর আবার স্ক্রিয়াবিনের সঙ্গে দেখা। নমুনা শুনে সংগীত-নায়ক ‘হাঁ-ও’ বলেন না; ‘না-ও’ বলেন না। শুধু পরামর্শ দেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন না পড়ে দর্শনশাস্ত্র পড়তে। উনিশ বছর বয়সে তরুণ পাস্তেরনাক তাঁর জীবনের প্রথম আঘাত পেলেন যখন বুঝতে পারলেন যে সংগীতে তাঁর ভবিষ্যৎ নেই। তাহলে আছে কীসে? আইনে? নেই। দর্শনে? কে জানে!

একবার আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেলে সহজে জোড়া লাগে না। পাস্তেরনাক হয়তো পথ খুঁজে পেতেন না। নিয়তি সহায় হল। পদ্মানদী যেমন একদিক ভাঙে তেমনি আরেক দিক গড়ে। তরুণদের একটি আড্ডায় তাঁকে ডাকা হত তিনি কবি বলে নয়, সংগীত ও চিত্রকলায় তাঁর প্রবেশ আছে বলে। সেখানে কবিরাও যেতেন। আলাপ হত। রিলকের কবিতা আবিষ্কার করার পর একদিন পাস্তেরনাক রিলকে পড়ে শোনালেন। তাঁর জীবনের সন্ধিক্ষণে রিলকের কবিতা যেন ঈশ্বরের দান। এরপরে আরও দু-বছর কেটে গেল। একদিন তাঁর মা তাঁর হাতে দুশো রুবল দিয়ে বললেন, এ আমার অনেক দিনের অনেক কষ্টের সঞ্চয়। যাও, বিদেশে বেড়িয়ে এসো। পাস্তেরনাকের কাছে এটা অপ্রত্যাশিত। জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় একেই তো প্রাচীন, তার ওপর তখনকার দিনে নব্য কান্টীয় দর্শনের প্রধান কেন্দ্র। পাস্তেরনাকের মনে সাধ ছিল সেখানে গিয়ে হার্মান কোহেনের কাছে পড়বেন। কিন্তু উপায় ছিল না। অর্থাভাব। দৈবাৎ এই টাকাটা পেয়ে তিনি ঠিক করে ফেললেন গ্রীষ্মাবকাশটা মারবুর্গে কাটাবেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পেলেন বিশ্ববিদ্যালয় সে-সময় খোলা থাকবে। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অন্যরকম।

মারবুর্গে গিয়ে ভালোই চলছিল। কোহেনের তাঁকে খুব পছন্দ। কিন্তু ঘটে গেল এক বিচিত্র ব্যাপার। এটিও অপ্রত্যাশিত। মস্কোতে তিনি এক বড়োলোকের মেয়েকে পড়াতেন। সে ও তার ছোটোবোন বিদেশে বেড়াতে গিয়ে মারবুর্গে হাজির। তাদের সঙ্গে গুরুজন নেই। পুরোনো প্রেম ঝালিয়ে নেবার এই তো সুযোগ। পাস্তেরনাক সাহসে বুক বেঁধে একদিন বলেই ফেললেন কথাটা। ‘ওগো, যাবার আগে বলে যাও আমার কপালে কী আছে।’ যতদূর সম্ভব বিনয়ের সঙ্গে প্রিয়া বললেন, ‘তোমার কোনো আশা নেই।’ পরের দিন পাস্তেরনাকের চোখে পৃথিবীর রূপ বদলে যায়। এ হল তাঁর জীবনের দ্বিতীয় গুরুতর আঘাত। উনিশ বছর বয়সে গেল সংগীত। বাইশ বছর বয়সে গেল প্রেম। কিন্তু কে জানে কেমন করে এল কবিতা। পাস্তেরনাক আবিষ্কার করলেন যে তিনি কবিতার পর কবিতা লিখে চলেছেন। বিদায় মারবুর্গ! বিদায় দর্শনশাস্ত্র! পকেটে সামান্য কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাই দিয়ে কোনোরকমে ভেনিস ও ফ্লোরেন্স দেখা হল। দেশে ফিরে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯১৩ সালে। সেই বছরই কাব্যে আত্মসমর্পণ করলেন।

পরের বছর প্রথম মহাযুদ্ধ। শাপে বর হল তাঁর খোঁড়া পা। সেই যে-বার পল্লিগ্রামে স্ক্রিয়াবিনের সঙ্গ পান সেই বছরই ঘোড়ার থেকে পড়ে পা ভাঙেন। সেরে ওঠার পর দেখা গেল এক-পা ছোটো, এক-পা বড়ো। এমন লোককে তো সৈন্যদলে ভরতি করা যায় না। সমবয়সিরা সবাই চলল যুদ্ধে লড়তে—কবিবন্ধুরাও। ইতিমধ্যে তিনি ফিউচারিস্টদের একটি উপদলে যোগ দিয়েছিলেন। উপদলটির নাম ‘সেন্ট্রিফিউগ’। আরেকটি উপদলের স্বনামধন্য কবি মায়াকোভস্কির সঙ্গে ইতিমধ্যেই তাঁর ভাব হয়। তখনকার দিনে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যটাকেই লোকে বড়ো করে দেখত। কবিরা নিজেরাও তাই একদল আরেক দলকে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে বাক্যবাণে জ্বালিয়ে মারত। ইমেজিস্ট বলে একটা দল ছিল। তারা দস্তুরমতো গুণ্ডামি করত। এসেনিন ছিলেন এই দলের সেরা কবি। যেমন গরমপন্থী ফিউচারিস্টদের মধ্যমণি ছিলেন মায়াকোভস্কি। পাস্তেরনাকের উপদলটা নরমপন্থী। বেশি বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করে অন্যের তুলনায় তিনি পেছিয়েই রয়েছিলেন।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব যখন ঘটে পাস্তেরনাক তখন মস্কো থেকে অনেক দূরে উরাল পর্বতের ধারে এক অস্ত্রশস্ত্রের কারখানায় কেরানিগিরি করছেন। সেখান থেকে নিকটতম ডাকঘর হল ১৭০ মাইল ব্যবধানে। খবরটা পেয়েই তিনি রওনা হলেন তিন ঘোড়ার বরফগাড়ি ট্রোইকায় চড়ে কাজান। কাজান থেকে রেলপথে মস্কো। সেই বছরই লেখা হয় তাঁর কবিতার বই, জীবন, বোন আমার। লেখা হয়, কিন্তু ছাপা হয় না। ছাপা হতে পাঁচ বছর দেরি হয়। কিন্তু যেদিন ছাপা হল সেইদিনই তাঁর আসন স্থির হয়ে গেল মায়াকোভস্কি ও এসেনিনের সঙ্গে বিপ্লবোত্তর গিরিশিখরে। ব্লক ততদিনে মৃত। সিম্বলিস্ট কবিদের দিন গেছে। অ্যাকমিইস্ট কবিদের নেতা গুমিলিওভ নিহত। তাঁর পত্নী আখমাতোভা জীবিত, কিন্তু তাঁদের দলটিরও দিন গেছে। শুধু ফিউচারিস্ট ও ইমোজিস্ট এই দুই দলেরই নামযশ। এঁরা বিপ্লবকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু মায়াকোভস্কি ও এসেনিন যেমন বিপ্লবের বাণীমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন পাস্তেরনাক তেমন নন। পাস্তেরনাক কোনোদিনই রাজনীতির মধ্যে ছিলেন না, রাজনীতি নিয়ে একেবারেই ভাবতেন না। তবে বিপ্লব যে একদিন হবেই এটা তিনি জানতেন সেই ১৯০৫ সাল থেকে, তাঁর বয়স যখন পনেরো বছর। এই বছরের ঘটনা অবলম্বন করে তাঁর একখানি কাব্যগ্রন্থ আছে। প্রকৃতির জগতে যেমন ঝড়ঝঞ্ঝা মানুষের জগতেও তেমনি যুদ্ধ আর বিপ্লব। যারই নাম ঝড়ঝঞ্ঝা তারই নাম যুদ্ধ আর বিপ্লব। এই তাঁর জীবনদর্শন।

পাস্তেরনাক যদি বিপ্লববিরোধী হতেন তাহলে তাঁকে রাশিয়ায় থাকতে হত না, থাকলে যেকোনো দিন প্রাণ যেত। একে একে তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন রাশিয়া থেকে সরে পড়েন। তাঁর মা-বাবা চলে যান ১৯২১ সালে। পাস্তেরনাককে চাকরি নিতে হয় লেখকদের বইয়ের দোকানে সেলসম্যানরূপে। জীবন, বোন আমার প্রকাশ করে পরের বছর তিনি যশস্বী হন। বিবাহ করেন। বধূকে নিয়ে বার্লিনে যান পিতা-মাতাকে প্রণাম করতে। বার্লিনে তিনি এক বছর কাটান। সেইখানেই তাঁর পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। সেখানে থাকতেই প্রকাশিত হয় তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ আস্থায়ী আর অন্তরা। বার্লিনে তথা মস্কোতে একই কালে। পাস্তেরনাক ইচ্ছা করলে জার্মানিতে থেকে যেতে পারতেন। জার্মান তাঁর কাছে মাতৃভাষার মতো সহজ। রাশিয়ায় ফিরতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। না ছিল সম্পত্তি, না বাড়িঘর, না চাকরি। কেন তবে তিনি ফিরতে গেলেন? যখন যে পারছে সে পালাচ্ছে। এর উত্তর, তিনি রুশ ভাষার কবি। কেবল রুশ ভাষার না, রুশ কথ্যভাষার। তিনি সারস্বত কথ্যভাষার জাদুকর। তা ছাড়া রুশ দেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগ ছিল। তিনি টলস্টয়পন্থী না হলেও টলস্টয়ের প্রভাবে মানুষ হয়েছিলেন। যেখানে জনগণ সেখানে তিনি। তা ছাড়া তিনি ইতিহাসের স্রোতে ওতপ্রোত হতেও ভালোবাসতেন। তিনি রুশ দেশের ইতিহাসের জলের মাছ। বিদেশে বাস করলে হবেন ডাঙার মাছ।

লেনিন তখনও বেঁচে। যদিও তিনি হাড়ে হাড়ে রাশিয়ান মুজিক তবু তিনি অন্তরে অন্তরে ইউরোপীয় ইন্টেলেকচুয়াল—মার্কস স্বয়ং যা ছিলেন। বিপ্লব ঘটে গেছে বলে রাশিয়ার চিন্তাশীলরা ইউরোপের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন এটা তাঁর কাম্য ছিল না। লেনিন দীর্ঘকাল পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে মূলস্রোতের মহিমা অনুভব করেছিলেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তিনি চিন্তা করতেন, তর্ক করতেন, লিখতেন। তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা কেউ অস্বীকার করেনি। স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবেই তিনি স্বেচ্ছায় মার্কসপন্থী হয়েছিলেন। সকলেই সেইভাবে মার্কসপন্থী হবেন এই ছিল তাঁর আশা ও বিশ্বাস। জোরজুলুম করে কাউকে তিনি ভজাতে চাননি। নিজের দেশের ইন্টেলেকচুয়ালদের উপর জোরজুলুম করা অবশ্য সহজ, কিন্তু পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক-কৃষক রাষ্ট্র যদি এরূপ কুদৃষ্টান্ত দেখায় তাহলে পশ্চিম ইউরোপের ইন্টেলেকচুয়ালরা তা দেখে বিগড়ে যাবেন। তাহলে বিপ্লব দিকে দিকে ছড়াবে না। একমাত্র রাশিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তা যদি হয় তবে রাশিয়াতেও দৃঢ়মূল হবে না। পশ্চিম ইউরোপেও বিপ্লব ঘটা চাই। তারজন্যে সেসব দেশের ইন্টেলেকচুয়ালদের আকর্ষণ করতে পারা চাই। তাদের আকর্ষণ করার সেরা উপায় হচ্ছে রুশ লেখকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

সাহিত্যিক ব্যাপারে লেনিনের পরামর্শদাতা ছিলেন গোর্কি। তিনিও লেনিনের মতো পাশ্চাত্য সংসর্গে ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আস্থাবান। তাই রুশ লেখকদের রকমারি ‘ইজম’ও গোষ্ঠী বিপ্লবের পূর্বে যেমন ছিল পরেও তেমনি রইল। বিপ্লববিরোধীরা আপনি সরে পড়েন। যাঁরা থাকেন বা ফিরে আসেন তাঁরা সকলে বিপ্লববাদী না হলেও বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতিশীল স্বাধীন লেখক। লেনিন ও গোর্কি এঁদের মর্যাদা স্বীকার করতেন। তাই পাস্তেরনাক নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে পেরেছিলেন। লেনিনের মহাপ্রস্থানের পরেও আরও কবিতা লিখেছিলেন, আরও গল্প, গদ্যে আত্মজীবনী, পদ্যে উপন্যাস। যদিও তিনি ভুলেও আর কারও মতো হবেন না তবু তাঁর অনন্যতাও জনপ্রিয় হয়। কিন্তু ক্রমেই দেশের আবহাওয়া বদলে যায়। প্রথমে আত্মহত্যা করেন এসেনিন ১৯২৫ সালে। তারপরে আত্মহত্যা করেন মায়াকোভস্কি ১৯৩০ সালে। তারপরে আপনা হতে অপসরণ করেন পাস্তেরনাক ১৯৩২ সালে। সেই যে তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করেন সে-ব্রত অল্প কিছুদিনের জন্যে ভঙ্গ করেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দেশ যখন আক্রান্ত। তারপরে আবার নীরব হন যুদ্ধজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘কসমোপলিটানিজম’-এর উপর কর্তৃপক্ষের ধর্ষণ লক্ষ্য করে। যুদ্ধকালে যারা মিত্র ছিল যুদ্ধের পরে তারাই হল শত্রু। সুতরাং তাদের সংস্কৃতিও হল বর্জনীয়। মাঝখানে খাটিয়ে দেওয়া হল লৌহ যবনিকা। রাশিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় সম্রাট পিটার প্রমুখ একদল যেমন রাশিয়াকে ইউরোপীয় বানানোর পক্ষে, ডস্টইয়েভস্কি প্রমুখ আরেক দল তেমনি ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিপক্ষে। লৌহ যবনিকা তারই রকমফের। পাস্তেরনাক মৌলিক রচনায় হাত না দিলেও কলম একেবারে বন্ধ করেননি। অনুবাদ করেছেন অপরের রচনার। জর্জিয়ান বন্ধুদের কবিতা, শেক্সপিয়ার, শেলি, গ্যেটে প্রমুখের নাটক ও কাব্য। এইসূত্রে তিনি ‘কসমোপলিটান’ অথবা ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন। দেশান্তরে পালিয়ে গিয়ে যেমন ডাঙার মাছ হননি, দেশে আটক থেকেও তেমনি কুয়োর ব্যাং হননি। তা বলে তিনি কারও চেয়ে কম রাশিয়ান নন। মূল তাঁর রাশিয়ার মাটিতেই। যদিও সর্বাঙ্গে তাঁর ইউরোপের মূলস্রোত। লেনিন ও গোর্কির রাশিয়ায় এটা নিন্দনীয় ছিল না। হল স্টালিন ও জদানভের রাশিয়ায়।

স্টালিনের দিক থেকেও যথেষ্ট বলবার আছে। লেনিন, ট্রটস্কি প্রমুখের বিশ্বাস ছিল যে, ইউরোপের অপরাপর দেশে বিপ্লব ঘটলেই তার ফলে রুশবিপ্লব দৃঢ়মূল হবে। কিন্তু আট-দশ বছর অপেক্ষা করেও দেখা গেল তার সম্ভাবনা নেই। তাহলে রুশবিপ্লব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় কী করে? একা রাশিয়া কতদূর যাবে? চারদিকেই যে শত্রু। ক্রেমলিনে তখন বড়োরকম একটা পরিবর্তন হয়। তার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। সবাইকে ও সব কিছুকে মোবিলাইজ করা হয়। জীবনের কোনো বিভাগকে, সমাজের কোনো অংশকে বাদ দেওয়া হয় না। কাব্যকেও না, কবিকেও না। বিপ্লবকে তো মেনে নিয়েছি, এই বলে নিস্তার পাবেন ভেবেছেন? ভবি ভোলবার নয়। লিখতে যখন জানেন তখন লিখতে হবে কলকারখানা, লোহালক্কড়, যন্ত্রপাতির উপর। তা আপনার ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক। তা আপনি বুঝুন আর না-ই বুঝুন। আপনি হয়তো হৃদয়প্রধান কবি কিংবা দর্শনেন্দ্রিয়প্রধান কিংবা শ্রবণেন্দ্রিয়প্রধান। আপনি হয়তো মস্তিষ্কচর্চা করেন না, পাছে আপনার কবিতা নীরস হয়। তা বলে আপনার ওজর-আপত্তি শুনব না। আপনাকে মার্কসীয় ডায়ালেকটিকস আয়ত্ত করতেই হবে। অন্তত কয়েকটা পড়ে পাওয়া বুকনি। আপনাকে মাফ করতে বলছেন? উঁহু। একজনকে মাফ করলে আরেক জনকে মাফ করতে হয়, এক এক করে সবাইকে মাফ করতে হয়। আপনি যিনিই হন-না কেন, যত বড়োই হন-না কেন, আপনার ছাড় নেই।

গোর্কি ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে অসহায় ও অসুখী। স্টিমরোলার তাঁকেও গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। অন্যে পরে কা কথা? কবিদের গোষ্ঠীগুলি একে একে ভেঙে যায়। রকমারি ‘ইজম’ গিয়ে একটিতে ঠেকে। কমিউনিজম। দল উপদল গিয়ে একটিতে বিলীন হয়। রাশিয়ান প্রোলিটারিয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন। পরে রাইটার্স ইউনিয়ন। কর্মকর্তাদের নেপথ্যে বড়োকর্তা। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। স্টালিন কিন্তু সত্যিই দয়ালু ছিলেন। পাস্তেরনাক যদিও লিখতে ভুলে গেছেন তবু তাঁকে ডেলিগেশনে প্রতিনিধির মর্যাদা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল প্যারিসে—অ্যান্টিফ্যাসিস্ট রাইটার্স কংগ্রেসে। মাথা গোঁজবার একটা ঠাঁইও দেওয়া হল মস্কোর অদূরে লেখকদের উপনিবেশে। কিন্তু পাস্তেরনাকও আরেক ভবি। ভবি ভোলবার নয়। মার্শাল তুখাচভস্কি প্রমুখের প্রাণদন্ডের সমর্থন করে এক ইস্তাহার সই করতে যখন পাস্তেরনাককে বলা হল তিনি সই করলেন না। সে-সময় অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে গোর্কিও বেঁচে নেই যে তাঁকে রক্ষা করবেন। সে-বছর আর তার পরের বছর বহু লোককে কোতল করা হয়। তাঁদের মধ্যে লেখকও ছিলেন বড়ো কম না—পাস্তেরনাকের বন্ধুও। বহু লেখক আত্মহত্যা করেন, বিলুপ্ত হয়ে যান।

যেখানে প্রাণে বেঁচে থাকাই দায় সেখানে আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখা আরও কত কঠিন! পাস্তেরনাক প্রাণেও বাঁচলেন, আত্মাকেও বাঁচালেন, আফিনোগেনোভ বলে একজন তরুণ নাট্যকারকে পক্ষপুটে আশ্রয়ও দিলেন। স্টালিন দয়ালু না হলে কি সম্ভব হত এসব? কিন্তু যাঁর প্রতি দয়ালু তিনি একজন সত্যাগ্রহী। শুধু তা-ই নয়, তিনি যে কত বড়ো একজন কবি তা ১৯২৯ সালে প্রকাশিত চতুর্দশ সংস্করণ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা খুললে প্রমাণ হবে। লিখেছেন প্রিন্স মিরস্কি—

Boris Pasternak (born-1891), unquestionably the greatest living Russian poet (principal book of lyrics, My Sister, Life, written 1917, published 1922) is externally connected with some aspects of Futurism, but in substance he is nearer to the traditions of Tyutchev and Fet. His poetry is marked by an absolute freshness of perception and combined with a tensity of lyrical emotion that is to sic found only in the greatest. His prose (Tales, 1925) is also of the highest order, and being concerned with the realities of the soul stands apart from that of his contemporaries. Russian Language and Literature, (Encyclopaedia Britannica, 14th Edition, Vol. 19, p. 757)

প্রিন্স মিরস্কি যখন এই নিবন্ধ লেখেন মায়াকোভস্কি তখনও জীবিত। মিরস্কি তাঁকে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান দেননি। দ্বিতীয় স্থান দিয়েছেন মারিনা স্বেতায়েভা (Marina Tsvetayeva)-কে।

পাস্তেরনাকের এই পোজিশন তাঁর স্বদেশের বিপ্লবী সমালোচক মহল মেনে নেননি। যে কবিতা প্রত্যক্ষভাবে সমাজের বা রাষ্ট্রের পরিবর্তন সাধনের কাজে লাগে না, যার ফিউচারিজম শুধুমাত্র সাহিত্যে নিবদ্ধ, তা নিয়ে তাঁরা করবেন কী? সত্যি, সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনের কথা ভেবে পাস্তেরনাক কবিতা লিখতেন না। তাঁর ভাবনা ব্যক্তির জন্যে, সত্যের জন্যে, রূপের জন্যে, রসের জন্যে, উক্তির জন্যে, জীবনের জন্যে, জীবনের তাৎপর্যের জন্যে। তাঁর ইতিহাসবোধ প্রখর। ইতিহাসকে তিনি অবহেলা করতে চান না। কিন্তু কাব্য যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তা নিয়ে তিনি করবেন কী? দেশের কর্তাদের সঙ্গে, সমালোচকদের সঙ্গে, সবাক সাধারণের সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর গুরুতর মতভেদ। বছর খানেক ইনসমনিয়ায় ভুগে তাঁর মানসিক অসুখের পূর্বলক্ষণ দেখা দেয় ১৯৩৫ সালে। তাঁর সতীর্থদের মধ্যে কত লোক যে আত্মহত্যা করেন, কত লোক নিহত বা বিলুপ্ত হন, কত লোক নির্বাসনে যান! প্রতিভাময়ী মহিলা কবি মারিনা স্বেতায়েভা ১৯২২ থেকে ১৯৩৯ অবধি বিদেশে ছিন্নমূল ছিলেন। দেশের মাটিতে মূল ফিরে পাবার আশায় যেই-না ফিরেছেন অমনি বেচারির স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে বধ করা হল পুরাতন প্রতিবিপ্লবী বলে। পুত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হল যুদ্ধক্ষেত্রে, সেখানে তারও প্রাণবিয়োগ হল। কন্যাকেও গ্রেপ্তার করে কোথায় চালান দেওয়া হল। মারিনাকে বলা হল এক মফসসল শহরে থাকতে, সেখানে তিনি একটা ঝি-গিরিও জোটাতে পারলেন না। অগত্যা উদ্বন্ধনে বিদায় নিলেন দেশের কাছ থেকে ১৯৪১ সালে।

যারা হেরে গেল, হারিয়ে গেল, বোবা হল, ভেঙে পড়ল, বেঁচে থেকেও মরে রইল তাদের কথা কি কেউ কোনোদিন শুনবে না? কে শোনাবে? কার কত সাহস? কন্ঠরুদ্ধের কন্ঠস্বর হবে কে? পাস্তেরনাক। আর তো কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তা হলে কি মৌনভঙ্গ করতে হবে? পাস্তেরনাক সময় নিলেন। গোটা চতুর্থ দশকটাই অতীত হল। ‘ডাক্তার জিভাগো’ শুরু করতে তাঁর ত্বরা ছিল না। তিনি কবি। উপন্যাস তো তাঁর মিডিয়াম নয়।

অথচ শুরু না করে তাঁর শান্তি ছিল না। ভিতরে অসহ্য যন্ত্রণা। বিশ বছর ধরে যা জমেছে তাকে ঢেলে দিতে হবে সাহিত্যের আধারে। সে-আধার কাব্য নয়, উপন্যাস। তাহলেই তাঁর বেদনামুক্তি। নইলে নয়। স্টালিন তখনও বেঁচে। আরও কতকাল বাঁচবেন কে জানে! প্রকাশের আশা নেই। তবু লিখতেই হবে। লেখাটাই প্রকাশ। বই লেখার মাঝখানে স্টালিনের মৃত্যু। সাহিত্যে ‘তুষারদ্রব’। বছর কয়েক পরে তার ফলে নতুন লেখক দুদিনতসোভের কেবল রুটি দিয়ে নয় বেরিয়ে গেল। পুরোনো লেখক পাস্তেরনাকের ডাক্তার জিভাগো বেরোবে না? পান্ডুলিপি পাঠানো হল নোভি মির পত্রিকায়। পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা সহজ হবে। তখন ১৯৫৬ সাল।

‘নোভি মির’ পান্ডুলিপি ফিরিয়ে দেন সংশোধনের জন্যে। কয়েকটি জায়গায় তাঁদের আপত্তি ছিল। আপত্তির পক্ষে তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন। পাস্তেরনাককে তাঁরা অশ্রদ্ধা দেখাননি। সরাসরি প্রত্যাখ্যান তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। এরপরেও পাস্তেরনাকের কবিতা তাঁরা প্রকাশ করেন। শত্রুতা থাকলে এটা সম্ভব হত না। বস্তুত ডাক্তার জিভাগো লিখতে গিয়ে লেখক হাতে রেখে বলেননি, রেখে ঢেকে বলেননি, মন রাখা কথা বলেননি। তা যদি করতেন তাহলে তাঁর বেদনামুক্তি ঘটত না, তিনি শান্তি পেতেন না। তাঁর জীবনের সত্য তিনি কতকাল গোপন রাখতেন! বয়স তো হল গিয়ে ছেষট্টি। আর কদ্দিন বাঁচবেন যে বুকে চেপে রাখবেন! পাস্তেরনাক বরাবর স্পষ্টবাদী। তার একটা পুরাতন নমুনা দিচ্ছি :

….In time to come, I tell them, we’ll be equal

 to any living now. If cripples, then

 no matter, we shall just have been run over

 by ‘New Man’ in the waggon of his ‘plan’.

 And when from death the tablet doesn’t save us,

 then time will hurry on more freely still

 to that far point, where ‘Five year plan’ the second

 prolongs the dissertations of the soul.

 Don’t kill yourselves, don’t grieve. I’ll still be with you

 that day; by all my weaknesses, I swear.

 And the strong men are promised their survival

 from the worst plagues that have subdued us here.

 (Second Birth translated by J.M. Cohen,

Pasternak, Prose and Poems, Benn, P. 310)

ডাক্তার জিভাগো একটি দুর্বল মানুষকে নিয়ে লেখা। কিন্তু লিখেছেন যিনি তিনি বলবান পুরুষ। কায়ে-মনে-আত্মায় তিনি মহামারি অতিক্রম করেছেন। কিছুতেই তাঁকে দুর্বল করতে পারেনি, দমাতে পারেনি। হতাশ করতেও পারেনি। তিক্ত করতেও না।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির হঠাৎ পরিবর্তন না হলে, ‘তুষারদ্রব’ বন্ধ না হলে রাশিয়াতেই হয়তো ডাক্তার জিভাগো প্রথম দিনের আলো দেখত। পাস্তেরনাক তো আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন, তিনি ইতিমধ্যে ইটালীয় সংস্করণের অনুমতি দিয়ে ফেলেছেন। ইটালীয় প্রকাশক তাঁর অধিকার ছাড়বেন কেন? রুশ কর্তাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে তিনি ও-বই প্রকাশ করলেন। অমনি ইউরোপে আমেরিকায় এশিয়ায় আফ্রিকায় অস্ট্রেলিয়ায় পাস্তেরনাকের অন্তর উদ্ঘাটিত হল। হল না কেবল তাঁর নিজের দেশে। টলস্টয়ের বরাতেও এরকম ঘটেছিল। তাঁর বই জারশাসিত রাশিয়ায় স্বভাষায় প্রকাশ করতে দেওয়া হল না। প্যারিসে ছাপা হল ফরাসি ভাষায়। জার কিন্তু তাঁর গায়ে হাত দিতে সাহস পাননি। আরও একবার এরকম ঘটে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। পিলনিয়াকের মেহগ্নি রাশিয়ায় প্রকাশ করা বারণ হল। তখন ছাপা হল বার্লিনে। তাঁকে রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়। আট বছর পরে ১৯৩৭ সালের ‘পার্জ’-এ তিনি বিলুপ্ত হন। শোনা যায় তাঁকে গুলি করা হয়।

ডাক্তার জিভাগো বিদেশে প্রকাশিত হওয়ায় পাস্তেরনাকের দশা হল শোচনীয়। দেশের লোক তো বিমুখ হলই, বিদেশের লোকও এমনভাবে তাঁকে মাথায় করে নাচতে লাগল যেন তিনি দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ। তা দেখে তিনি সম্ভবত ভগবানকে প্রার্থনা করতে লাগলেন, ‘হে প্রভু, আমার বন্ধুদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।’ এইসব অতি প্রশংসকদের মনোগত অভিপ্রায় পাস্তেরনাককে বড়ো করা নয়, সোভিয়েত রাশিয়াকে ছোটো করা। রুশবিরোধী প্রচারকার্যের হাতল হল পাস্তেরনাকের নামঞ্জুর উপন্যাস। যেন আর কোনো দেশে আর কোনো পত্রিকার দ্বারা আর কারও উপন্যাসাদি নামঞ্জুর হয়নি। জেমস জয়েসের ইউলিসিস, ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিস লাভার দূরের কথা, মহাত্মা গান্ধীর হিন্দ স্বরাজ ও রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি-র ইংরেজি সংস্করণ এককালে নিষিদ্ধ ছিল। শুনলে হাসি পাবে ফরস্টারের এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া ভারতে আসতে দেওয়া হত না গোড়ার দিকে। অপরপক্ষে সোভিয়েত রাশিয়ায় স্বয়ং ডস্টইয়েভস্কির অধিকাংশ গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ বন্ধ ছিল। এই সম্প্রতি তাঁর বরাত ফিরেছে। শোলোকোভের ১৯২৮ সালে প্রকাশিত ‘শান্ত বহে ডন’ উপন্যাসকেও পরে শোধন করা হয়। পাস্তেরনাকের বই নিয়ে যে কলরব চলল তাতে অদ্ভুত সব অত্যুক্তি ছিল। এ বই নাকি টলস্টয়ের সমর ও শান্তি-র সমপর্যায়ের ও একই ঐতিহ্যের। কিন্তু সবচেয়ে মজার কথা পাস্তেরনাককে মনে করা হল বিপ্লববিরোধী। তাই যদি তিনি হতেন তবে বুনিনের মতো, স্বেতায়েভার মতো দেশান্তরি হলেন না কেন? বরং বিপ্লবের দিনেই তাঁর কবিতার হাত খুলে গেছে। বিপ্লব না ঘটলে তাঁর জীবনও একঘেয়ে হত। তাঁর দৃষ্টিও কি খুলত! তা বলে বিপ্লবী বা বিপ্লববাদী তিনি ছিলেন না। তিনি ব্যক্তিত্ববাদী এবং সেই কারণে আজ্ঞাবহ লেখক হতে নারাজ। বিরোধটা পলিটিকাল নয়। তাঁর দেশের লোকও তাঁকে ভুল বুঝল। ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে তাঁর নিন্দাবাদ চলল। তাতেও তাঁর ক্ষতি হত না। কারণ তিনি চেনা বামুন। কিন্তু যাঁরা এতকাল তাঁকে নোবেল প্রাইজের উপযুক্ত বলে গণ্য করেননি, করেছেন বহু অখ্যাতনামাকে, তাঁরা অকস্মাৎ তাঁকে স্মরণ করলেন। আগুনে ঘি পড়লে যা হয়। পাস্তেরনাককে তো রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে বিতাড়ন করা হলই। বলা হল, ‘যান, যান, প্রাইজ নিন গিয়ে। কিন্তু আর ফিরে আসতে হবে না সোভিয়েত ইউনিয়নে।’

লেখক পুরস্কারের জন্যে বই লেখে না। লেখে অন্তরের সত্যকে বাইরে আনতে। কেউ যদি বিনা শর্তে পুরস্কার দেয় নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু যে-কালে ও যে-অনুষঙ্গে পাস্তেরনাককে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় সে-কালে ও সে-অনুষঙ্গে প্রাইজ নেওয়ার অর্থ হত পাস্তেরনাক তাঁর দেশের মুখে কালি মাখিয়েছেন বলেই তাঁকে পৌনে দু-লাখ টাকা বকশিশ দেওয়া হল। শত্রুরা তো অমন কথা বলতই, তথাকথিত মিত্ররাও বলত। কবি পাস্তেরনাকের অসামান্য কীর্তির খবর তারা রাখে না, রাখলে অনেক আগেই তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেবার কথা তুলত। তাহলে তাতে রাশিয়ারও সম্মান বাড়ত, শুধু পাস্তেরনাকের নয়। কিন্তু ঔপন্যাসিক পাস্তেরনাক আলো-ছায়া মিলিয়ে যে আলেখ্য এঁকেছেন তাঁর দরুন তাঁকে রাতারাতি এই যে সম্মান দেওয়া এটা তো সেই ছায়ার জন্যেই, যে ছায়া রাশিয়ার মুখে পড়েছে। তাই পাস্তেরনাকের সম্মান রাশিয়ার সম্মান নয়। পাস্তেরনাক পুরস্কৃত হলে রাশিয়া তিরস্কৃত হয়।

পাস্তেরনাক মৌন হতে হতে মুনি হয়ে গেছেন। শোলোকোভের ভাষায় ‘মুনি কর্কট’। তা ছাড়া পুরস্কার, নামডাক ও প্রকাশ্য আরতিকে পাস্তেরনাক চিরকাল পরিহার করে এসেছেন। তাঁর কবিতার বই যখন তাঁর স্বদেশে বার বার বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত হয়ে হাতে হাতে ঘুরছে তখন স্টালিন একবার ফতোয়া দেন যে বিপ্লবোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন ও রয়েছেন মায়াকোভস্কি। স্টালিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে ধন্যবাদ দেন পাস্তেরনাক। কেন? তাঁর আত্মপ্রসঙ্গ থেকে তুলে দিচ্ছি এর উত্তর :

…for it protected me from the inflation of my role; this began about the time of the Writers’ Congress in the middle ‘thirties’. I am satisfied with my life and fond of it. I like it as it is, without any extra gold leaf. Nothing is further from my mind than a life stripped of privacy and anonymity and displayed in the glass glitter of a showcase. (An Essay in Autobiography, tr. by Manya Harari, Collins and Harvill, p. 119).

এই প্রবন্ধ লেখা হয় ডাক্তার জিভাগো শেষ করে প্রস্তাবিত কাব্যসংকলনের ভূমিকারূপে। তখন কি তিনি জানতেন যে তাঁর উপন্যাস বিদেশে প্রকাশিত হয়ে নোবেল প্রাইজ টেনে আনবে, আর সেইসঙ্গে ‘অতিরিক্ত সোনার পাত’? ও-আপদ প্রত্যাখ্যান করেই তিনি তাঁর জীবনের প্রাইভেসি ও অজ্ঞাতনামীয়তা রক্ষা করলেন বা করতে চেষ্টা করলেন।

উক্ত প্রবন্ধে ডাক্তার জিভাগো-র উল্লেখ করে তিনি বলেছেন সারা জীবন ধরে তিনি যত কবিতা লিখেছেন সমস্তই তাঁর এই উপন্যাসটির অভিমুখে পদযাত্রা ও প্রস্তুতি। অনেকে মনে করেন উপন্যাসের নায়ক স্বয়ং পাস্তেরনাক। সেটা ভুল ধারণা। তাঁর জীবনের তথ্য তিনি যেটুকু খুলে দেখাবার সেটুকু খুলে দেখিয়েছেন উপরোক্ত প্রবন্ধে ও নিরাপদ অতিক্রমণ নামে পুরাতন আত্মজীবনীতে। এই উপন্যাসে বিধৃত সত্য তাঁর জীবনের তথ্য নয়, জীবনের সত্য। এও একখানি জীবন, বোন আমার। তারই সম্প্রসারিত, সমাপিত, সুপরিণত, সংস্কৃতরূপ।

 My sister, life’s in flood to-day, she’s broken

 her waves over us all in the spring rain,

 but people with cheap watchchains go on grumbling

 and, like snakes in the grass, politely sting.

 The older folk. of course, have got their reasons,

 but really your reason’s quite absurd,

 for in the thunder eyes and lawns are lilac

 and the horizon smells of reseda.

 For when it’s May, and in the railway carriage

 you read timetables on a local track,

 they are far grandeur than the holy scriptures

 or coachseats that the dust and storms made black…

(My sister, Life, tr. J M Cohen. Pasternak,

Prose and Poems, Benn, p. 260)

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অল্পকাল পরে লেখা কবিতায় বিপ্লবকে প্লাবনকে বিনা কারণেই বরণ করে নেওয়া হয়েছে। ঝড়কে, বিদ্যুৎকে সৌন্দর্যের সঙ্গে, সৌরভের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্রের চেয়ে বড়ো হয়েছে যাত্রাপথের টাইমটেবিল। পাস্তেরনাক প্রচারক নন, কবি। তাঁর লেখনী একইসঙ্গে ছবি আঁকে, গান করে; তাঁর উক্তিগুলি তির্যক ও প্রতীকময়। তাঁর কাব্যরচনার পদ্ধতি নিয়ে তাঁর নিজের মত তুলে দিচ্ছি :

…my concern has always been for meaning, and my dream that every peom should have content in itself—a new thought or a new image. And that the whole of it with all its individual character should be engraved so deeply into the book that it should speak from it with all the silence and all the colours of its colourless black print…I was concerned neither with myself nor with my readers nor with the theory of art. All I cared about was that one poem should contain the town of Venice, and the other the Brest…railway station.

(An Essay in Autobiography, ibid, p. 81)

পাস্তেরনাক অতি যত্নে তাঁর স্বধর্ম রক্ষা করে এসেছেন। বিপ্লবে, দুর্ভিক্ষে, পরিকল্পিত শিল্পায়নে, কালেকটিভাইজেশনে, মহাযুদ্ধে আর শীতল যুদ্ধে তিনি যেমন প্রকৃতির ওপর লক্ষ রেখেছেন, যেমন ইতিহাসের ওপর, তেমনি তাঁর স্বধর্মের ওপর। দেশান্তরি হবার কথা দুঃখের দিনেও ভাবেননি। পুরস্কার ও ঢক্কানিনাদের জন্যে দেশত্যাগ করবেন? যাদের তিনি কোনো অবস্থায় ছেড়ে যাননি সেইসব পরাজিত, দুর্বল, অসহায় মানুষকে ছেড়ে যাবেন প্রাইজের লোভে? কত লোক নৈতিক বল পাচ্ছে তাঁর নৈতিক বল থেকে। তাদের তিনি পথে বসিয়ে যাবেন? পাস্তেরনাক তা পারেন না। তাই নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করতে হল। অভদ্রতা? না। ত্যাগ। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ত্যাগ।

পাস্তেরনাকের জীবন ত্যাগে ত্যাগে জর্জর। সংগীত ত্যাগ, দর্শনশাস্ত্র ত্যাগ, মনের মতো জীবিকা ত্যাগ তাঁর প্রথম যৌবনেই ঘটে। কবিতাকে বরণ করে নেবার পর যখন মায়াকোভস্কির সঙ্গে আলাপ হয় তার বছর খানেক পরে তাঁর মনে হল তাঁর কবিপ্রতিভা নেই, যেমন মায়াকোভস্কির আছে। তখন সাহিত্য ত্যাগের কথাও তিনি ভাবেন। কিছু-একটা ছাড়তেই হবে, না ছেড়ে পরিত্রাণ নেই, তাঁকে পেয়ে বসে এই নেশায়। শেষে তিনি স্থির করেন রোমান্টিক ধারা ত্যাগ করবেন। নিরাপদ অতিক্রমণ নামে তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে লেখা আত্মজীবনী থেকে নীচেরটুকু উদ্ধৃত হল।

But a whole conception of life lay concealed under the Romantic manner which I was to deny myself from henceforth. This was the conception of life as the life of the poet. It had come down to us from the Symbolists and had been adapted by them from the Romantics principally the Germans. This conception had influenced Blok but only during a short period. It was incapable of satisfying him in the form in which it came naturally to him. He could either heighten it or abandon it altogether. He abandoned the conception. Mayakovsky and Esenin heightened it. In the poet who imagines himself the measure of life and pays for this with his life, the Romantic conception manifests itself brilliantly and irrefutably in his symbolism, that is in everything which touches upon Orphism and Christianity imaginatively. In this sense something inscrutable was incarnate both in the life of Mayakovsky and in the fate of Esenin, which defies all epithets, demanding self-destruction and passing into myth….When ‘My Sister, Life’ appeared, and was found to contain expressions not in the least contemporary as regards poetry, which were revealed to me during the summer of the Revolution, I became entirely indifferent as to the identity of the power which had brought the book into being because it was immeasurably greater than myself and than the poetical conceptions surrounding me. (Safe, Conduct, tr. by Beatrice Scott, Pasternak, Prose & Poems, Benn, p. 110)

এখন মনে হয় পাস্তেরনাক মায়াকোভস্কি ও এসেনিনের অনুসৃত পন্থা ত্যাগ করেছিলেন বলেই তাঁর নিয়তি অন্যরূপ হল। ত্যাগ যাকে বলা হয় সেও একপ্রকার মনোনয়ন। আপন নিয়তি মনোনয়ন। পাস্তেরনাক ত্যাগ করতে করতেই তাঁর নিয়তি মনোনয়ন করে নিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার ত্যাগও এইরকম এক নিয়তি মনোনয়ন।

অসাধারণ ত্যাগ ও বিজ্ঞতা ভিন্ন কেউ ঝড়ঝঞ্ঝা কাটিয়ে নিরাপদ অতিক্রমণ করতে পারে না। কোনোমতে প্রাণে বাঁচার জন্যে অবশ্য অত বড়ো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। আপোশ করলে, হুকুম মেনে চললে, পাখির মতো পড়লে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় না। কিন্তু আত্মা বাঁচে না। পাস্তেরনাকের মধ্যে রাশিয়ার আত্মা বেঁচে আছে।

বিপ্লবের পর থেকে এই কথাই আমার মনে হয়েছে যে সমগ্র রাশিয়ায় একটিমাত্র সুর আছে, সে-সুর শতকন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সুর নেই। টলস্টয়ের নদী মরুপথে ধারা হারিয়েছে। যেমন সে দেশের জীবনে তেমনি সেদেশের সাহিত্যে। পাস্তেরনাকের রচনা আমার সে-ভুল ভেঙে দিয়েছে। তিনি যে ঠিক টলস্টয়-ঐতিহ্যের অনুবর্তী এমন কথা বলব না। কবি পাস্তেরনাকের ওপর টলস্টয়ের প্রভাব পড়ার কথা নয়। মিরস্কি লক্ষ করেছেন ত্যুচভ ও ফেত নামক ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই পূর্ববর্তীর প্রভাব, অন্যেরা করেছেন রিলকের। দুই-ই যথার্থ। টলস্টয়ের প্রভাব পড়ে থাকতে পারে কবির ওপরে নয়, কাহিনিকারের ওপরে হয়তো, মানুষের ওপরে নিশ্চয়। মানুষ পাস্তেরনাক মানুষ টলস্টয়ের ধারাবাহী। সত্যনির্ণয়ের জন্যে, সত্যকথনের জন্যে, সত্য করে বাঁচার জন্যে, সত্যের দ্বারা বাঁচার জন্যে তাঁর মধ্যে ছিল টলস্টয়ের মতো ব্যাকুলতা। তাই তিনি কোনো ত্যাগকেই অত্যধিক মনে করেননি। সেই যে মৌনব্রত সেও কত বড়ো একটা ত্যাগ! কী বেদনাদায়ক!

পদ্মকান্ত ত্রিপাঠীকে পাস্তেরনাক বলেন, ‘তুমি হয়তো জান না যে, ৩৩ সনেও আমার কবিতা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল। রুশ ভাষার প্রফেসাররা আমাকে মহান কবি ভেবে বসেছিলেন এবং আমার এক-একটি কবিতার চার-চারটি মানে তাঁরা করতেন। কিন্তু অকস্মাৎ এই প্রফেসাররা ঘোষণা করলেন যে, আমি জনগণ থেকে দূরে সরে গেছি, আমি অহংবাদী, ‘আমি সিম্বলিস্ট’। বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব এখনও নাকি আমার ভিতরে বিদ্যমান। একটি কাগজ লিখল, আমি এমন কবিতা লিখি, যা শুধুমাত্র আমিই বুঝতে পারি। এবং তারপর….’

‘তারপর!’

‘এবং তারপর আমি আর কবি থাকলাম না। শুধু এটুকু নয়, আমি কখনো কবি ছিলামই না।’ (I no more remained poet, not only that, I never existed as a poet.)

‘তারপর আপনি কী করলেন?’

‘কিছুই করলাম না। লেখা ছেড়ে দিলাম। তারপর আমি লেখকই থাকলাম না। লেখক সংঘ (রাইটার্স ইউনিয়ন) আমাকে একটা খুব বড়ো কাজের দায়িত্ব দিলেন। বাকুর তৈল মজদুর সম্বন্ধ কিছু লেখার। এই কাজ করতে পারলাম না কেন? কারণ, আমি বাকুর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, মজদুরের সম্বন্ধেও জানতাম, কিন্তু লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি বললাম আমি লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। লেখকসংঘ কৃপাপূর্বক এটা মেনে নেয় এবং আমাকে পচা ডিমের মতো একদিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। মহান স্টালিন দয়ালু ছিলেন। তিনি আমাকে জেলে পাঠাননি….’

পাস্তেরনাক আবার যেন বিগত স্মৃতিতে ফিরে গেলেন। অনেকক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। আমি নতুন সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। অকস্মাৎ নিজেই বলে উঠলেন, ‘পঁচিশ বছর ধরে না লেখার অর্থ বোঝ? কখনো কখনো মনে হয় আমি একজন ফুটবল খেলোয়াড়। কিন্তু আমার ডান পা-র একটা নাড়ি ছিঁড়ে গেছে। ‘‘কিক’’ মারার জন্যে পা আর ওঠে না। পঁচিশ বছর ধরে আমি অন্যান্যদের খেলা দেখে আসছি। যে ছোটো ছোটো বাচ্চারা পা ওঠাতে জানত না, তারা নামকরা খেলোয়াড় হয়ে উঠল। যশ, অর্থ, রাজ্যাশ্রয়—সবই ছিল ওদের কাছে। তারপর আমার পা-ও ঠিক হয়ে উঠল, কিন্তু মাঠে আর নামতে পারলাম না।’

‘কেন?’

‘কারণ তখন খেলার নিয়মকানুন বদলে গেছে। এবং ওই নিয়মগুলো থাকতে আমি খেলোয়াড় থাকা পছন্দ করলাম না। যশ, অর্থ, গৌরব কিছুই পাব না জেনেও।’

(পাস্তেরনাকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, পদ্মকান্ত ত্রিপাঠী, দেশ ২৮ নভেম্বর ১৯৫৯)

কী করুণ! অথচ কী বীরত্বব্যঞ্জক! পাস্তেরনাক আত্মিক বলে বলীয়ান ছিলেন। নইলে খেলা ছেড়ে থাকতে পারতেন না। যেকোনো শর্তে খেলতেন। অন্তত লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতেন। তাও তিনি করবেন না। যখন বলেছেন যে তিনি লিখতে ভুলে গেছেন, লেখার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন, তখন তাঁকে মৌলিক রচনায় সত্য করে ক্ষান্তি দিতেই হবে। নইলে কথা উঠবে যে তিনি লিখতে জেনেও লিখছেন না, রাষ্ট্রের আদেশ লঙ্ঘন করেছেন। সোভিয়েট রাশিয়ায় কার ঘাড়ে দুটো মাথা যে ক্ষমতা থাকতে আদেশ অমান্য করবে! সুতরাং সত্যের খাতিরে তাঁকে অক্ষম হতে হল। অক্ষম সাজতে নয়, সত্যি সত্যি অক্ষম হতে।

কিন্তু এই তাঁর জীবনের মহত্তম ত্যাগ নয়। আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নেই, তবু আমার মনে হয় এর চাইতেও মহৎ, এর চাইতেও করুণ ত্যাগ ১৯২৩ সালে ঘটে। যখন তিনি বার্লিন থেকে মস্কো ফিরে আসেন। আত্মীয়স্বজন তো ফিরলেন না, ফিরবেনও না। বিপ্লবকে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। তাঁদের কাছে ওটা নিতান্তই একটা উৎপাত। পাস্তেরনাকের কাছে ওটা একটা নৈসর্গিক ঘটনা। আপনার লোকের সঙ্গে এই যে বিচ্ছেদ, এই যে বিচ্ছেদজাত নিঃসঙ্গতা, রাশিয়ায় ফিরে এর ক্ষতিপূরণ কি কোনোদিন হয়েছে? আমার ধারণা এই বিচ্ছেদই সাত-আট বছর পরে বিবাহবিচ্ছেদে পর্যবসিত হয়। মস্কো শহরে তাঁর দ্বিতীয় পত্নীর ও তাঁর মাথা রাখবার জায়গা থাকে না। অতিথি হতে হয় জর্জিয়ার রাজধানী তিফলিস শহরে গিয়ে য়াশাভিলি নামক কবিবন্ধুর। ইনি আত্মহত্যা করেন ১৯৩৭ সালে।

এই যে পারিবারিক বিচ্ছেদ জিভাগো এ যাতনা সইতে পারেনি। পরাজিত হয়েছে। পাস্তেরনাক সয়েছেন, তাই অপরাজিত রয়েছেন। ডাক্তার জিভাগো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, সব দেশে সব কালে ঝড়ঝঞ্ঝায় যে পাখির বাসা ভেঙে যায়, প্লাবনে যে পাখির আশ্রয়তরু ভেসে যায়, সেই পাখির ট্র্যাজেডি। সমস্তটাই সত্য। প্লাবনও সত্য, তরুও সত্য, পাখিও সত্য, সর্বনাশও সত্য। টলস্টয় ছিলেন সৈনিক তথা দ্রষ্টা। যুদ্ধ করেছেন এবং দেখেছেন। পাস্তেরনাক বিপ্লবী নন। বিপ্লবের সাক্ষী আর ভুক্তভোগী।

কিন্তু ঝড় যত বড়ো সত্য হোক-না কেন সে চিরকাল থাকে না। সে যখন চলে যায় তখন কী হয় তা নিয়ে পাস্তেরনাক তাঁর মৌনভঙ্গের পর একটি কবিতা লিখেছেন। সেটি রুশ ভাষায় অপ্রকাশিত। রঘুবংশীয় আমেরিকান অধ্যাপক ইউজিন কেডেন স্বয়ং পাস্তেরনাকের কাছ থেকে সেটি উপহার পেয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। পুরোটাই উদ্ধার করছি :

 The air is heavy with the passing storm.

 The earth lies calm and free and glad again.

 Through all its pores the flowering lilac bush

 Drinks deep the pure cool freshness of the plain.

 The world’s reborn, transfigured by the storm.

 The gutters shed a flood of rain. Now fair

 And vast the blue beyond the shrouded sky,

 And bright ranges of celestial air.

 But more exalted far the poet of power,

 Who washes clean the dust and grime away,

 When by his art emerge transformed the harsh

 Realities and truths of naked day.

 Then memories of decades with the storm

 Retreat. Free from the past of tutelage,

 Our century demands the time has come

 To clear a passage for the coming age.

 No swift upheaval swelling of itself

 Can make the way for our new life to be;

 Our hope—the message of a spirit kindled

 By truth revealed and magnanimity.

 (tr. Eugene M Kayden, New Statesman,

27 December 1958)

পাস্তেরনাক পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে এই প্রত্যয় আপনার ভিতর থেকে পেয়েছেন যে, মৃত্যু যেমন সত্য রিসারেকশনও তেমনি।

সেই অর্থে তিনি খ্রিস্টপন্থী। মৃত্যু আর রিসারেকশনের যে নিত্যলীলা চলেছে বিশ্বের বিশাল রঙ্গমঞ্চে, তাকেই তিনি প্রত্যক্ষ করে গেলেন ইতিহাসের প্রেক্ষাগারে। তাঁর সব দুঃখ-শোক গলে গিয়ে মিশে গেছে এই একটি রসে। অন্ধ যখন দৃষ্টি পাবে নামে কী-যেন এক নাটক লিখছিলেন। শেষ করে যেতে পেরেছেন কি না জানিনে। কিন্তু পাবে। পাবে। অন্ধ একদিন দৃষ্টি পাবে। সেদিন আপনি দেখবে, আপনি বুঝবে। আর স্মরণ করবে চক্ষুষ্মানকে। কবরে রেখে আসবে একগুচ্ছ লাইলাক। পাস্তেরনাকেরও রিসারেকশন হবে। তাঁর অন্য একটি কবিতার এই কয় ছত্র তাঁর এপিটাফ বলে গণ্য হবার যোগ্য।

 So that he’d master well his life in bondage,

 In famine, in defeat, without a fault,

 And thus abide a model through the ages,

 A man in sturdiness as plain as salt.

(tr. Eugene M Kayden, New Statesman

27 December 1958)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *