বোরকার আড়ালে নিঃশব্দ পদযাত্রা
মধ্যরাত। আফগানিস্তানের উদ্দেশে অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করব। আর ২৪ ঘন্টাও বাকি নেই। শেষবারের মতো বাবা-মা, কয়েকজন বন্ধু ও প্রিয় ডেইজিকে ফোন করলাম। ডেইজিকে অনেক ভালোবাসি জানালে ও লাইনের অপর প্রান্ত থেকেই একটা দীর্ঘ মেহের চুম্বন এঁকে দেয়।
‘সব সময় মনে রাখবে, আমাকে যখনই দরকার পড়বে তখনই চোখ বন্ধ করবে এবং আমি হাজির হয়ে যাব। মনে থাকবে তো মামণি? মা আমার, আজকের কথাগুলো খুব ভালো করে শোনো এবং সারা জীবন এসব কথা মনে রাখবে। শক্ত থাকার চেষ্টা করবে।’
আশ্চর্য, বালিকার কণ্ঠ ভেসে এল, যা-ই হোক, মাম্মি, আসছে বুধবার আমার জন্মদিন। তোমার মনে আছে তো, মা? বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, খেলতে যাই।’
এরপর নিঃশব্দে লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সারা রাত অস্থিরচিত্তে পায়চারি করলাম। এক ফোটা ঘুম এল না চোখে। যখন এমন কোনো দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু ঘটে থাকে, তখনই শরীর আর ভার সইতে পারে না। চাইলেই আমি এখানে থেমে যেতে পারি। যদি একটুও মনের ভেতর খচখচানি থাকত, তাহলে আমি ফিরে আসতাম।
পরদিন সকালে নিচে গেলাম নাশতা সেরে নিতে। খাবার টেবিলে এক প্রাণবন্ত আমেরিকান চিত্রগ্রাহকের সঙ্গে কথা হলো। মেয়েটা নিউ ইয়র্কের এক এজেন্সির হয়ে এশিয়ায় ছবি তোলে। মেয়েটা ছিল দুরন্ত ও মারমুখী এবং খুবই শক্ত মনের। ওকে আর ঘাটালাম না। কোথায় যাচ্ছি তা-ও জানালাম না। পাছে আবার আমার লেজ ধরে বসে। আগেও বলেছি, একা কাজ করাটাই আমার বিশেষ পছন্দের। মেয়ের দুরন্ত সাহস। এখনো সে হাজার হাজার মানুষের মিছিলের ছবি তুলে বেড়াচ্ছে।
চিরাচরিত ডিমভাজা ও তরকারি দিয়ে নাশতা সেরে হোটেলের বিজনেস সেন্টারে গেলাম। কয়েক লাইনে লিখে দিলাম জিম মুরেকে।
বেশ, আমার সর্বাত্মক প্রস্তুতি সম্পন্ন। দুঃসাহসী অভিযানের জন্য আমি পুরোপুরি তৈরি। ভালোয় ভালোয় শেষ হলে পিঠে চাপড় মেরে প্রশংসা করা হবে। নয়তো দুঃসাহস, অপরিপক্কতা ও বোকামির গালি জুটবে কপালে।
দুনিয়ার কোনো জায়গাই আর নিরাপদ নয়। নিউ ইয়র্কের হাজার হাজার অধিবাসী ১১ সেপ্টেম্বর তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। যা-ই হোক, আফগানিস্তানের অন্ধকারে কোনো পশ্চিমা সাংবাদিকের আস্তানা নেই। ভেতরে কী হচ্ছে, তা আমাদের জানতে হবে। এমনকি যদি তা কেবল একটি মাত্র ছবিও হয়।
ব্যক্তিজীবনে আমি কিছুটা রক্ষণশীল ও চিন্তাভাবনায় ইতিবাচক। অনেক মানুষের জীবন এখনো বিপদের সম্মুখীন। তাই এই লড়াইয়ে আমি একা নই। আমার গাইডের নাম মুসকিন। সে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের বাসিন্দা।
একটা প্রাচীন পরিচিত পথ ধরে চার চাকার পাহাড়ে চলার উপযোগী বিশেষ জিপে করে রওনা হব। এ পথে গেলে পাকিস্তান সীমান্ত বাহিনীর পাহারাচৌকি এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। সেখান থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সোজা জালালাবাদ। এখানে বিন লাদেনের একটা ঘাঁটি রয়েছে। প্রশস্ত উপত্যকায় তা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এখানেই বিশ্রামের জন্য বিরতি দেওয়া হবে। এরপর কোনো এক অচেনা পাহাড়ি গ্রামে রাতযাপনের পরে ফিরতি পথে রওনা হব। শুক্রবার রাতেই আশা করি লিখতে পারব রুদ্ধশ্বাস অভিযানের উপাখ্যান।
চলার পথে যত দূর সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। পরিধানে থাকবে আফগান রমণীদের ব্যবহৃত পুরোনো কাপড়চোপড়। চুল ও গায়ের চামড়ায় লাগিয়েছি ছদ্মবেশী রং। মুসকিনের বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে ওর স্ত্রীসমেত দেশত্যাগ করছি, এই হবে আমার পরিচয়।
আমি (মুসকিনের স্ত্রী) বধির। সঙ্গে থাকবে সেমি অটোমেটিক রাইফেলের পাহারা। কোথাও কোথাও সশস্ত্র দল আমাদের এগিয়ে দেবে। সব পরিচয়পত্র সীমান্তেই পাশার কাছে রেখে যাব।
আমি পরিচিতজনদের কাছে চিঠি লিখতে চাইলেও কলম এগোয়নি। তাই কাউকেই কিছু বলা হলো না। যত দ্রুত সম্ভব ফেরত এসে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হবে। কাউকে দুই হাজার ডলার চাহিবামাত্র পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই মূল্যেই নির্ধারিত হয়েছে আমার নিরাপত্তা। ওদের বলা হয়েছে, ইসলামাবাদে নিরাপদে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এক পয়সাও পাবে না তারা।
পেশোয়ারের কিছু ধূর্ত লোক ১ হাজার ২০০ ডলারের বিনিময়ে বিদেশি সাংবাদিকদের আফগান সীমান্তে পা রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে, কিন্তু এর কোনো মূল্য নেই। চলার পথে কারও সঙ্গে সংঘাত হলে আশা করি একমাত্রই হেরেফোন্দের লোকজনই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, তালেবান যোদ্ধাদের মুখোমুখি হলে এর শেষ পরিণতি আমার জানা নেই।
একটা ভালো ভ্রমণকাহিনি ও প্রতিবেদন তৈরির আশা করছি। সবার প্রতি শুভাশীষ রইল।
পরে কোয়েটায় কর্মরত ডেইলি এক্সপ্রেস-এর কর্মী ডেভিডকে একটা ফোন দিই। ও আমার পরবর্তী গন্তব্য জানতে চাইলে আমি এসব প্রশ্ন করতে নিষেধ করে দিই। অনর্থক কথায় দুই প্রান্তেই বিল বাড়তে থাকে। ডেভিড আমার পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে এটা মুরের বুদ্ধি কি না জানতে চায়।
আমি হেসে দিলাম। ওকে জানাই, বরং জিম অন্য কিছু ভাবছে। এটা একান্তই ব্যক্তিগত আমার দুঃসাহস।
কোয়েটায় যাওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। দক্ষিণাঞ্চলে শরণার্থী সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ও জানায়, বাতাসে বারুদের তীব্র গন্ধ। উত্তেজনার পারদ চড়ছে দ্রুত। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, বিদেশি সাংবাদিকেরা যেসব হোটেলে অবস্থান করছেন, সেখানে বসেছে সশস্ত্র পাহারা। আমি ভাবলাম, এখনই যদি এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে বোমা নিক্ষেপের পর পরিস্থিতি কোথায় যাবে? ডেভিডকে সাবধানে থাকতে বলে আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে জানিয়ে বিদায় বলি।
ডেভিডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিম শিপম্যান ওকে চোখে চোখে রাখতে অনুরোধ করেছে আমাকে। এটাই ওর প্রথম বড়সড় কাজ। অথচ সে কোনো সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেনি। ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেলেও বাইরে ও নিজেকে যথেষ্ট শক্ত ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে একজন চমৎকার গাইডও জুটিয়ে নিয়েছে।
হোটেলে খানিক পায়চারি করতে করতে হোয়াইট হলে অবস্থানরত মানুষটাকে খুদে বার্তা প্রেরণ করি। আমি উন্মাদ এবং সাবধানতা অবলম্বন করার জবাব আসে। রাগের চোটে আমার সাবধানতার চেয়ে উৎসাহ বেশি দরকার বলে ওকে মেইল করি। এবার ও যথেষ্ট সমর্থনসূচক বাক্য ব্যবহার করে। বন্ধু সামরিক উপদেষ্টা পল বিভারের সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার দরকার ছিল। ফোনে না পেয়ে দ্রুত আমার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটা বার্তা পাঠাই।
সন্ধ্যায় আমাকে পাশার নিয়ে যাওয়ার কথা। ওর গাড়িটা আজ মেরামত করাচ্ছে। সবকিছু ঠিক আছে কি না জানতে চেয়ে ওকে ফোন করলে আমাকে আশ্বস্ত করে।
বিজনেস সেন্টারে গিয়ে তালেবানদের ওপর একটা বই পড়তে শুরু করি। কিছু তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা বিষয় পরিষ্কার হলাম। সবচেয়ে কট্টর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তালেবানদের লক্ষ্য। এবং সামান্য ভুলের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছিল ওদের কাছে ডাল-ভাত।
ধর্মীয় ছদ্মাবরণের বাইরে যেকোনো বিনোদনের মাধ্যমের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখানে কোনো টেলিভিশন নেই, গান গায় না কেউ, বড় পর্দায় সিনেমার দৃশ্য ভেসে ওঠে না। হাততালি দেওয়া যায় না, নাচ-গানের মতো আনন্দের বিষয়গুলো একদম নিষিদ্ধ।
নিউক্যাসল ইউনাইটেড ফুটবল দলের একজন পাঁড় সমর্থক আমি। সেন্ট মার্টিনের মাঠে গান-বাজনা, হইহুল্লোড় ছাড়া এক মিনিট টিকে থাকাই কষ্টকর। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যদিও এর জন্য আফগানিস্তানে গর্দান যাওয়ার সুযোেগ থাকে। তবে আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান) বলার সুযোগ আছে।
আমি নিষিদ্ধ তালিকাটায় চোখ বুলাতে থাকলাম। ধূমপান করা যাবে না, শূকরের মাংস নেই, ব্যবহৃত পুরোনো কোরআনের পাতা ফেলে রাখা যাবে না।
এমনকি পুরোনো কোরআনের পাতা দিয়ে তৈরি হতে পারে, এই আশঙ্কায় কাগজের থলে ব্যবহারের অনুমতি নেই। ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগ নেই। ইসলাম ধর্ম বদলে ধর্মান্তরিত হওয়ার সুযোগ নেই এবং অবশ্যই ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
ভালো, ছোট নাইকন ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, যদি কখনো সুযোেগ হয় এই আশায়। এটাই আমার একমাত্র অস্ত্র।
ইন্টারনেটের দুনিয়া ঘেঁটে অবগত হলাম, কিছু আইন শুধু পুরুষদের জন্য। ইন্টারনেটের ব্যবহারও নিষিদ্ধ। এমনকি দাড়ি রাখা নিয়েও আইন রয়েছে।
দাড়ি মুণ্ডানো অথবা খোঁচা খোঁচা দাড়ি প্রদর্শন আত্মহত্যার সমান। এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি বড় রাখা আবশ্যক।
যথেষ্ট পরিমাণ বড় দাড়ি না থাকলে লোকদের ধরে ধরে জেলখানায়। নিয়ে যাওয়া হয়, যত দিন না তাদের দাড়ি প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যে বড় না হচ্ছে। সব সময় মাথায় টুপি পরে থাকতে হয়। কোনো বাচ্চাছেলের মাথায় টুপি না থাকলে তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না।
নারীদের জন্য প্রযোজ্য হাস্যকর আইনের তালিকাটা ১০ গুণ দীর্ঘ। বাড়ির বাইরে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কাজ করা নিষিদ্ধ। স্বল্প পরিসরে হাসপাতাল অথবা নারী বন্দিশালায় তাদের কাজের অনুমতি ছিল। সমগ্র শরীর আবৃত করে বোরকা না পরে ও পুরুষ আত্মীয় ছাড়া দরজার চৌকাঠ অতিক্রম করা যাবে না। পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত দোকান থেকে কিছু ক্রয় অথবা ব্যবসা করা যাবে না।
নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ। যদিও শুনেছি কিছু সাহসী নারী রয়েছেন, যাঁরা অতি গোপনে অনেক মেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।
য়েছে কিছু আজব, উদ্ভট, ভয়ংকর আইনের অস্তিত্ব। নারীদের প্রকাশ্যে নারীদের পায়ের গোড়ালি প্রদর্শন করা যাবে না। পুরুষ চিকিৎসকের জন্য মহিলা রোগী দেখা নিষিদ্ধ করে কিছু ভয়ংকর আইন রয়েছে।
প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার স্বভাবতই নিষিদ্ধ। নারীরা উচ্চস্বরে হাসাহাসি করতে পারবে না। কথা বলতে হবে অত্যন্ত নিচু গলায়, যাতে অপরিচিত কেউ কণ্ঠস্বর শুনতে না পায়। উচু হিলের জুতা অথবা হাঁটতে গেলে ঠকঠক শব্দ হয়, এমন কোনো জুতা পরিধান নিষিদ্ধ। আমার কাছে সাদা মোজা নিষিদ্ধ করে করা আইনটাকেই একমাত্র যৌক্তিক মনে হলো। কিন্তু এটা পুরুষদের জন্যও হওয়া উচিত ছিল।
তবে সাদা মোজা নিষিদ্ধ হওয়ার যুক্তি আরও হাস্যকর। সাদা মোজা যৌন আবেদন তৈরি করে। এ ছাড়া সাদা রং পবিত্রতার প্রতীক। তালেবানদের পতাকায় সাদা রঙের আধিক্য রয়েছে।
চিন্তা করে দেখলাম, সীমান্তে আমাকে খুব সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে। কারণ, সীমান্ত অতিক্রমের ১০ মিনিটের মধ্যে আমি সব আইন ভেঙে ফেলতে পারি। বোঝাই যাচ্ছে, কেন পশ্চিমাদের মধ্যে তালেবানদের নিয়ে নেতিবাচক কথা প্রচলিত আছে। কারণ, তালেবানদের নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো নারীদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যের উপাদানে ভরপুর।
তালেবানদের উৎস ও সংগঠন সম্পর্কে জানতে আরেকটি তথ্য ঘেঁটে দেখি। এক গবেষণাপত্রে, যা অনেক লেখক সত্য বলে মন্তব্য করেছেন, লেখা আছে, ১৯৯৩ সালের দিকে প্রথম তালেবান গঠিত হয়। এর পরের বছরই তারা আধিপত্য বিস্তার করে। তালেবান গঠনের পেছনের মানুষটি হলেন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর আখন্দ, যিনি ছিলেন একজন ধর্মীর পণ্ডিত। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৩।
কান্দাহার শহরের কাছে এক গ্রামে তিনি ৩০ থেকে ৪০ জন ধর্মীয় ছাত্রকে নিয়ে একটি সংঘ গড়ে তোলেন। তালেবান শব্দের অর্থ ছাত্র।
এশিয়াউইক-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে তালেবান সংগঠনের প্রথম দিকে পাকিস্তানের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসা ও শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দারাই এতে যোগ দেন। পশতুনের চতুর্দিকে, সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ও বেলুচিস্তানজুড়ে এসব শিবির অবস্থিত।
তবে পশতুনের দক্ষিণের দুররানি উপজাতীয়রাই তালেবানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈন্য।
মুজাহিদিনদের শাসনামলে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। এশিয়াউইক-এর প্রতিবেদন অনুসারে এই ক্ষোভ থেকেই মোল্লা সাহেব তালেবান গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। সে সময় প্রতিদিন মহাসড়কে ডাকাতি হতো। ধর্ষণ, রাহাজানি ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে কান্দাহার মিলিশিয়া বাহিনীর এক নেতা তিনটি মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করেন। এই ঘটনায় শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ।
ওমর ও তালেবানের বিচার ছিল খুব দ্রুত। তারা ধর্ষক নেতাকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলায়। হতভাগা মেয়েগুলোর বাবা তালেবানদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তালেবানদের দল ভারী হতে থাকে তখন থেকেই। ধীরে ধীরে একটা শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তারা।
বোঝাই যাচ্ছে, ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত হলেও তালেবানদের শেষ দিকে গতিধারা বদলে যেতে শুরু করে। কোনো তালিবের সঙ্গে কথা বলা, সাক্ষাতের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না আমার। আফগান অসহায় মানুষের জীবনের গল্প তুলে আনতে চেয়েছিলাম। একটাই ভয় ছিল, যেন ধরা না পড়ে যাই। জানতাম, একবার ধরা পড়লে চলে যেতে পারে আমার প্রাণটাই। তবে ধরা পড়ার বিরাট আশঙ্কা ছিল।
সেদিন সন্ধ্যাতেই মোল্লা ওমর নতুন এক আইন জারি করেন। বিদেশিদের কোনো ধরনের সহায়তা বা তথ্য প্রদানের শাস্তি মৃত্যদণ্ড। ব্যাটা নিশ্চয়ই প্রতিদিনই নতুন নতুন আইন প্রণয়নের চিন্তা করে।
পেটের পেশিগুলো ক্ষুধা জানান দিচ্ছিল। সোজা হোটেলের বুফেতে চলে যাই। এখানকার প্রতিটি খাবারই চেখে দেখার মতো। ওই রাতটা ভালোই কেটেছিল। পরের বেলা কোথায় খাব? হোটেল ব্যবস্থাপককে এ কথা বলতেই সে হেসে দেয়। ও আমাকে আরও একবার পেটভরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানায়। জাতিসংঘের এক পাকিস্তানি চিকিৎসকের সঙ্গে অর্ধেক খাবার বিনিময় করি। দ্রলোক খুব হাসিখুশি প্রকৃতির। তিনি জানান, তাঁকে কাবুল থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। এখানের ফেলে আসা হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি ও অফিসের অনিশ্চিত পরিণতি নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। সাধারণ মানুষের পরিণতি নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ উদ্বিগ্ন।
চিকিৎসক সাহেবকে বেশ আপন মনে হলো। উনাকে আমার গোপন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিই। তিনি এতে বেশ উৎসাহী হয়ে আমাকে সমর্থন জানান। বোরকা পরার কারণে আমার ছদ্মবেশ ধারণ সহজ হবে। তাকে আমার চুল রং করার কথা জানাই। রং করা চুল ঢেকে রাখতেই ওই দিন রাতে বেসবল ক্যাপ পরে ছিলাম। ওনার সঙ্গে রোববার একত্রে ভোজনবিলাসের দিন ঠিক করি। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও গাড়িতে করে যেতে যেতে একত্রে গল্প করা যাবে। উনি আমাকে পাকিস্তানের আনাচ-কানাচ দেখাবেন আর আমি শোনাব দুঃসাহসী অভিযানের রক্ত হিম করা গল্প।
রুমে এসে সিএনএনের সংবাদ শোনার জন্য টেলিভিশন চালু করি। নকল যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। বিশেষজ্ঞরা অনাগত যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে কথার ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছিলেন। আমার ঘুম পাচ্ছিল। যুদ্ধ সব সময় অনিশ্চিত বিষয়। এ নিয়ে একেকজন একেক কথা বললেও বড় আকারের মানবিক বিপর্যয় হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তারা সবাই একমত। পশ্চিমারা এ নিয়ে সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করছিল।
বিরক্তিকর আলোচনা বাদ দিয়ে অন্যান্য চ্যানেলে কী চলছে তা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হিন্দি, উর্দু অথবা আরবি ভাষা না জানলে খোদ ইসলামাবাদে বধির হয়ে থাকতে হবে।
চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ডেইজির প্রিয় অনুষ্ঠান সাবরিনা, বাচ্চা ভূত সামনে চলে আসে। মুহূর্তের মধ্যে ডেইজির জন্য বুকটা কেঁদে ওঠে। তবে আমেরিকান অভিনেতাদের অভিনয়ের সঙ্গে উর্দু সংলাপ শুনে ব্যাপক মজা লাগছিল।
এক মিনিট পরই আবার চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে একটা আরবি অনুষ্ঠানে চোখ আটকে যায়। কে হতে চায় কোটিপতির আরবি সংস্করণ। একজন সৌদি উপস্থাপকের সঙ্গে এক আরবি মেয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। মেয়েটির সম্পূর্ণ শরীর কালো বোরকায় আবৃত। শুধু তার চোখ দুটো দেখা যাছিল। লক্ষ করলাম, মেয়েটা ভালোই করছে। মেয়েরা এগিয়ে যাও।
আমি অফিসে ফোন করে জানতে পারি, জিম ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অ্যালেক্সের সঙ্গে ব্যস্ত। আমার ভ্রমণের খরচাপাতি ও বিমা-সংক্রান্ত কোনো বিষয়। অফিসের সহকর্মী কেইথ পেরি ফোনটা ধরে। আমরা এর আগে একসঙ্গে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ কাজ করেছি। জগটা খুব ছোট। জিম ও সম্পাদকের সঙ্গে আগেই বিস্তারিত কাটাছেড়া করেছি। তাই জানিয়ে রাখলাম আমার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হলো খুদে বার্তা।
বিমার কথায় মনে ভয় ঢুকে গেল। ফোনটা বন্ধ করে দিই। কী হবে, যদি অ্যালেক্স ফোন করে জানায় যে আমার ভ্রমণের বিমা হয়নি, অর্থাৎ আমার যাওয়া হচ্ছে না। নিজেকে প্রশ্ন করি, এই অভিযানের জন্য আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন আর পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই।
ফোনটা পুনরায় চালু করে ভাতিজিদের খুদে বার্তা পাঠাই। জানিয়ে দিই ওদের দাদির সঙ্গে কাল সকালে কথা হবে। আজ ফোন করলে ওনার ফোন ব্যস্ত ছিল। মানুষকে ভুল বোঝাননা আমার পছন্দ নয়। তবে মায়ের চোখে আমি কপট মিথ্যাবাদী হয়ে থাকতে চাই না। উনি খুব চতুর মানুষ এবং সব সময় আমার কণ্ঠস্বর শুনেই সব আঁচ করে ফেলেন। এই মহিলা আমাকে আমার থেকেও বেশি চেনেন এবং আমি দারুণ ভয় পাই।
পাশা সকাল আটটায় চলে আসে। গাড়িতে করে শহরের বাইরে এক বাসায় যাই। ওখানে ওর চমৎকার স্ত্রী, দুই সন্তান ও কিছু আত্মীয় আমার অপেক্ষায় ছিলেন। ভালো ইংরেজি বলতে না পারলেও আমার উর্দুর চেয়ে ওদের ইংরেজি কথোপকথন ভালো ছিল।
পাশা জানায় আমার বেশভূষা পাল্টে নিয়ে সম্পূর্ণ একজন সাধারণ পাকিস্তানি মহিলা হতে হবে। উপজাতীয় এলাকা দিয়েই আমার গন্তব্যে পৌছাতে হবে। এসব এলাকায় একজন পশ্চিমা নারীর উপস্থিতি কাম্য নয়। যাত্রাপথে কোনো সমস্যা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না।
পাশার স্ত্রী আমার প্রথম ছদ্মবেশের পোশাক দিলেন। একটা কমলা রঙের সালোয়ার, ফিরোজা রঙের জামা ও একটা বাদামি শাল, যেটা দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে নিলাম। চুলে রং করা ছাড়াও জেল দিয়ে পেছন দিকে আঁচড়ে নিয়েছি। গাঢ় রং মেখেছি হাত ও পায়ে।
পাশার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন। পাশা বলল, ওর বউ আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত এবং ওদের পরিবারের সবাই আমার নিরাপদ ভ্রমণের জন্য প্রার্থনা করছে। আমি ওদের ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম।
গাইড মুসকিনের সঙ্গে দেখা হলো। বাকি পথটুকু ও গাড়ি চালিয়ে গেল। ছেলেটা ভয়ংকরভাবে গাড়ি চালায়। মনে হলো, এ যাত্রা নিরাপদে গাড়ি থেকে বের হওয়ার সৌভাগ্য হলে আফগানিস্তান যাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়।
পেশোয়ারে পথে পুলিশ চেকপোস্টে বেশ কয়েকবার আমাদের গাড়ি থামানো হয়। পুলিশের দল গাড়ি তল্লাশির ভান করলেও ওদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য কিছু। টাকা। এখানে এরা এত কম বেতন পায় যে রাস্তায় ওদের অনির্ধারিত চাঁদা প্রদান করতে হয়। পথিমধ্যে আমার ছদ্মবেশ সন্দেহের উদ্রেক করেনি।
এক পুলিশ সদস্যকে মুসকিন কিছু রুপি দিতে চাইলে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। লোকটা বোধ হয় আরও বেশি কিছু চাইছিল। কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলার একপর্যায়ে মুসকিন ঝটকা মেরে টাকাগুলো ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত বেগে পাশ কাটিয়ে যায়। গাড়ির সবাই জোরে জোরে হাসতে থাকে। পাশা বলল, লোকটা লোভের কারণে সামান্য অর্থও হাতছাড়া করল। পাশা হাসিতে ফেটে পড়ে।
আমি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম। এটা তালেবানদের ভূমিতে নিষিদ্ধ। শেষবারের মতো কয়েক শলাকা পুড়িয়ে নেব। বোরকার নেকাব অনাবৃত অবস্থায় বাকি পথটুকু পাড়ি দিচ্ছিলাম।
ধূমপান আমার অত্যন্ত পছন্দনীয় একটা কাজ। পাকিস্তানে আমি এখনো বেঁচে আছি কারণ, এখানে গলগল করে ঘণ্টার পর ঘন্টা ধোঁয়া ছাড়া যায়। কেউ কিছু বলবে না। লন্ডনে বেনসন অ্যান্ড হেজেসের শলাকায় আগুন ধরানোর চাইতে লুকিয়ে কোকেন বহন করা সহজ কাজ। অফিস ধূমপানমুক্ত। বাইরে গিয়ে অন্য ধূমপায়ীদের সঙ্গে একত্রে ধূমপান আমার ধাতে সয় না। আরাম করে বসে ধোঁয়া ছাড়তে হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ধোঁয়া টানব আর পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির লোেক বাঁকা চোখে তাকাবে, তা হবে না। অধিকাংশ কালো ক্যাবে ধূমপান নিষিদ্ধের প্রতীক। থাকে। আইনত অবৈধ না হলেও বিবেকবোধ থেকেই গাড়িতে ধূমপান করতে মন চায় না। মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে স্ট্যামফোর্ডের পানশালায় যেতে যেতেই ধূমপান করতে না পেরে দম আটকে আসে।
অবশ্য আমার মা-বাবাও বিষয়টা ঘৃণা করেন। মনে আছে, এক অনুষ্ঠানে মা-বাবার সামনে ধূমপান করেছিলাম। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান। প্রয়াত চাচি ফ্লোরেন্স, যিনি নিজেও প্রচুর ধূমপান করতেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভাবলাম, এটাই সিগারেট বের করার উপযুক্ত সময়। এমনকি বাবাও আমার সঙ্গে এক চুমুক টান দিতে পারেন। তবে ঘটল উল্টোটা। সিগারেটটা দেখেই বাবা জোরে একটা ধমক দিলেন, তখনই সেটা বাইরে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ এল। আমি কখনোই ফ্লোরেন্স চাচিকে এত দ্রুত বেগে দৌড়ে গিয়ে হাতের জ্বলন্ত সিগারেট বাইরে ফেলতে দেখিনি। চাচা টম একবার আমার দিকে তাকান তো একবার তার স্ত্রীর ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকান। বাবা আমাদের বকছেন বুঝতে পেরে বাকি সবাই জোরে হেসে ওঠে। এবার বাবাও হাসি দিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে আমি আরেকটা শলাকা বের করি।
উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের দিকে যাত্রাপথে আরও দুজন লোক আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারাও সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। পাশাকে বললাম, সবকিছু যতটা স্বাভাবিক রাখা যায়। পাশা জানাল, চিন্তার কোনো কারণ নেই। বরং ও ইংরেজিভাষী জান নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি তার নাম শুনতে আগ্রহ দেখালাম না। এখন সবকিছুই প্রয়োজনমাফিক করতে হবে। ওই ব্যাটার নাম জানার কোনো দরকার এই মুহূর্তে নেই।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে আমরা একটা গ্রামে প্রবেশ করি। গাড়িটা ঘুরে গিয়ে একটা ছোট গলিতে ঢুকে পড়ে। একটা কুকুর বিশ্রী স্বরে ডাকছিল।
পাকিস্তানের কুকুরগুলো হাড় জিরজিরে, নোংরা ও খ্যাপাটে স্বভাবের হয়। খানিক ভয় পেয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর একটা বাতি জ্বলতে দেখে ভয়টা কেটে গেল। ৬০ বছরের এক বৃদ্ধ নারী এসে দরজা খুলে দিলেন।
তিনি একরকম নিঃশব্দে খুব সন্তর্পণে আমাদের ভেতরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন। আমাকে দেখেই অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখলেন। এদের মন খুব নরম ও দয়ালু প্রকৃতির। দ্রমহিলা সারাক্ষণই বিনয় দেখিয়ে কথা বলেন। ভালো ইংরেজি বলতে না পারলেও তার ইশারা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না।
ছেলেরা বাইরে গিয়ে তাঁবুর খাটের ওপর বসল। আকাশটা খুব পরিষ্কার এবং ভরা জোছনার আলো উপচে পড়ছে। গরম গরম চা আর ধূমপানের সঙ্গে তাদের গল্পের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমারও খুব ইচ্ছে হলো ওদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার। কিন্তু সম্ভব ছিল না সেটা। অগত্যা একটা রুমে গিয়ে আরও আটজন নারীর সঙ্গে শুয়ে পড়লাম। সবাই তখন গভীর ঘুমে মগ্ন।
মাথার ওপর শোঁ শোঁ শব্দে একটা ফ্যান ঘুরছিল। এই দম আটকানো গরম কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। প্রিয় একটা ছবির কথা মনে পড়ে গেল। একটা মিরকা পরিবারের জংলি জীবনের গল্প। মিরকারা আমার অসম্ভব প্রিয়। দলবদ্ধভাবে কাজে ওদের জুড়ি নেই। সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ব্যাপারটা দারুণ। দিন শেষে সবাই আবার একসঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
আমাকে আলাদা একটা খাট দেওয়া হলো। শক্ত পাথরের মতো বালিশের বিলাসিতা করারও সুযোগ পেলাম। কিছুক্ষণের জন্য এই পালক পরিবারের সঙ্গে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কোথায় আছি, কেন এসেছি কিছুই মনে পড়ছে না। খানিক বাদে স্মরণ হলো, নির্জন সীমান্তের কাছে এক গ্রামে এক পরিবারের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি।
চারপাশের সবাই তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। মৃদু হেসে দিতেই আবার মিরকাদের কথা মনে পড়ে গেল। ডেইজি থাকলে ও খুব মজা পেত। এমনিতে ও খুব ন্যাওটা বাচ্চা। যেখানেই থাকি না কেন, রুমে অনেকগুলো বিছানা থাকলেও ও হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছেই চলে আসে সব সময়।
ভেনিসের প্রথম রাতে ডেইজি লাফ দিয়ে আমার খাটে চলে আসে। আর কত দিন এভাবে মায়ের বুকে লুকিয়ে ঘুমাবে? ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে ও জবাব দেয়, সম্ভবত ৩০ বছর পর্যন্ত। আমি আর কিছু না বলে ওকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করি।
বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২৭, ভোর পাঁচটার দিকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করি। বিখ্যাত পর্বতমালা হিন্দুকুশের সুউচ্চ পর্বতগুলোর ছায়ায় আমাদের যাত্রা শুরু হয় সীমান্তের উদ্দেশে। পাশার মাধ্যমে মুসকিন আমাকে জানায়, এসব রাস্তায় ডাকাতের দল ওত পেতে থাকে। তাই দিনের আলো পরিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে চলাচল মোটেও নিরাপদ নয়।
সীমান্তের কাছাকাছি এক খামারবাড়িতে এসে যাত্রাবিরতি দিলাম। তখনো পাকিস্তানের সীমারেখার মধ্যেই আছি। বাড়ির সামনে বিশাল এক উঠান। চল্লিশের কাছাকাছি এক নারী এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। উঠানের পরেই বিস্তৃত সবুজ খেত। বাড়ির পুরুষেরা কোথাও গিয়েছে। মেয়েরা আমাকে এক কক্ষে নিয়ে গেল। একটা পাথরের বিছানায় শুইয়ে দিলে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
আবারও দ্রিাদেবীর কোলে ঢলে পড়ি। চরম আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে হঠাৎ জেগে উঠি। কেউ একজন আমার আঙুলে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। একটা মুরগির বাচ্চা খামার থেকে পথ ভুলে ঘরে ঢুকে আমার আঙুলে ঠোকরাচ্ছিল। আমার আঙুলটাকে কি সুস্বাদু দানা মনে করেছিল? নাকি তা ছিল আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নাশতা খাওয়ার আহ্বান? বলতে পারি না।
ওই নারী আবার রুমে এসে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। একটা চিরাচরিত আফগান পোশাক ও রেশমি নীল বোরকা এগিয়ে দিলে আমি পোশাক পাল্টে নিই।
নতুন পোশাকে সবার আচরণে যে পরিবর্তনটা দেখতে পেলাম, তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমনকি পাশাও অন্যভাবে কথা বলছিল।
কেউ যেন আমাকে গ্রাহ্যই করছিল না। হঠাৎ করেই আমি একটা অভিযানের কান্ডারি থেকে গুরুত্বহীন আফগান নারীতে রূপান্তরিত হলাম। আমি পাশাকে নিয়ে অভিযানের ব্যাপারে পুনরায় কথা বলতে চাইলাম। কারণ, আমাদের সঙ্গে কয়েকজন অপরিচিত লোকও ছিল। কিন্তু পাশা আমাকে গাড়িতে উঠতে বলল।
আমরা আবার খাইবার পাসের সড়ক ধরে এগিয়ে গেলাম। আরও একবার চোখে পড়ল বড় করে লেখা বিদেশিদের প্রবেশাধিকার নিষেধ।
আগেরবার বৈধভাবে এলেও এবার আমার সঙ্গে কিছুই নেই। এমনকি পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি।
এবার আমাদের সঙ্গে আরও একটা গাড়ি যোগ দিয়েছে। এক জায়গায় থেমে একজন নারী, দুই সন্তান ও স্বামীসমেত এক পরিবারও আমার সঙ্গে যোগ দেয়। এরা ইংরেজি জানে না তাই বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে। একটা জায়গায় এসে ছেলেরা সবাই রাস্তার ধারে এক ক্যাফেতে চলে গেল। আমি আর ওই নারী গাড়ির পেছনের সিটে বসে রইলাম। এতক্ষণে আমি গুরুত্বহীন ও অদৃশ্য হয়ে গেছি।
জানালাগুলো বন্ধ। ভারী বোরকার ছোট একটা নেকাবের আড়াল থেকে আমি কিছুই দেখছিলাম না। জ্বলন্ত উনুনের গরম গায়ে এসে লাগছিল। মেজাজ চড়তে লাগল। মাথার ঘাম পিঠ বেয়ে পড়তে লাগল একসময়।
ইংল্যান্ডে যদি আমি একটা কুত্তাও হতাম, এতক্ষণে কেউ একজন জরুরি সংস্থায় ফোন করত অথবা ইট দিয়ে জানালা ভেঙে আমাকে উদ্ধার করত। নিশ্বাস নিতে নিতে অভিশাপ দিচ্ছিলাম এবং ইচ্ছামতো খিস্তি শোনাচ্ছিলাম। আধা ঘন্টা ধরে আমাদের জঘন্য গাড়িটাতে আটকে রাখা হয়। ইচ্ছে করছিল ধড়াম করে বের হয়ে লোকগুলোর কলার চেপে ধরে কী ঘটছে তা জানতে চাই। কিন্তু এটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। ছদ্মবেশ একদম প্রকাশিত হয়ে যাবে। মনে পড়ল, তালেবানদের কঠোর আইন, গলার স্বর কিছুতেই উঁচু করা যাবে না।
এমন সময় লোকগুলো ফিরে এলে আমরা চলতে শুরু করি। আমি দাঁতে দাঁত চেপে পাশার কাছে জানতে চাই, আস্ত একটা ভন ট্র্যাপ পরিবার কেন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে? আর এসব কী হচ্ছে?
পাশা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার শুনতে চাইল, কী বলছি। ভন ট্র্যাপ, সুইস পরিবার রবিনসন, ওয়ালটন যা ইচ্ছা ভাববা, কিন্তু সবকিছু সহজ-সরল, নিঝঞাট রাখার প্রতিজ্ঞার কী হলো?
ও শুধু আমাকে চিন্তা করতে না করল। আমি এখন এক বিয়েবাড়ির সদস্য। আফগানিস্তান যাচ্ছি।
আর কিছু বলার আগেই গাড়িগুলো থেমে যায়। কী কারণে যেন চালকেরা আসন বদল করে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই জায়গাটায় চলে এলাম, যেখানে আমি খাইবার রাইফেলসের ডজনখানেক সদস্যকে অসাবধানতাবশত গুলি করতে যাচ্ছিলাম। ১০ মিনিট অতিক্রান্ত না হতেই আমরা একদম তোরখাম সীমান্তের কাছে চলে এলাম।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে আসি। পাশার দিকে এগিয়ে বোরকাটা একটু উঁচু করে মুখটা বের করে বলতে থাকলাম, এসব পছন্দ হচ্ছে না। এভাবে যাওয়ার পরিকল্পনা তো ছিল না। পাশা তীক্ষ স্বরে ধমক দিয়ে আমাকে এগোতে নিষেধ করে চুপ করতে বলে। একজন তালিব এদিকেই আসছিল।
ভয়ে একদম জমে গেলাম। আমার সঙ্গের নারীটি একটা বাচ্চাকে এগিয়ে দিলে তাকে কোলে নিয়ে নিই। ওই নারী আমাকে ধরে ধরে সীমান্ত পার করাচ্ছিলেন। আমার হাত-পায়ের শক্তি কমে পাথর হয়ে যাচ্ছিল। দুজন লোক, একজন নারী, দুটি বাচ্চাসহ তালেবানদের ফাঁড়ি অতিক্রম করার সময় হঠাৎ এক লোক পশতু ভাষায় আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে।
এখনো আফগানিস্তানেই পৌছাইনি, আর এর মধ্যেই ওদের সন্দেহের জালে আটকা পড়ে গেলাম। আস্তে করে ঘুরে তাকাই। জাতিসংঘের একটা মেডিকেল চেক পয়েন্ট। আফগানিস্তানে প্রবেশের আগে বাচ্চাদের টিকা দেওয়া হয়। স্মল পক্স বা এ জাতীয় রোগের প্রতিষেধক।
সৌভাগ্যবশত আমার সঙ্গের নারী এগিয়ে এলেন। আমি তার পিছু পিছু যাই। চিকিৎসক পশতু ভাষায় কিছু বললে আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়াই। বাচ্চাটার মুখে কয়েক ফোঁটা ড্রপ ঢেলে দিলেন। প্রথম পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেলাম। কিন্তু তখনো আমার ভয় কাটেনি।
গল্পের দৃশ্যটা বদলে গেছে তাহলে, মুসকিন আমার সঙ্গে নেই। আমি তখনো শামীম নামীয় এক বধির এবং এক বিয়েতে যাচ্ছি। আমার করার কী আছে? যদি আমি বোরকা খুলে বেরিয়ে আসি, সে ক্ষেত্রে সেমি অটোমেটিক অথবা কালাশনিকভধারী তালেবানরা আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করবে অথবা আরও ভয়ংকর কিছু।
আমি ইভন রিডলি, দুই দেশের মধ্যবর্তী অদৃশ্য সীমানা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। প্রতিটা পদে অনিশ্চয়তা। উত্তেজনায় দেহের মধ্যে অ্যাড্রেনালিনের জোয়ার বইছে। আমি সত্যি চিৎকার করতে চাইছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, পাশার কাছাকাছি গিয়ে হাঁটি। কিন্তু একজন আফগান নারীকে তার কণ্ঠস্বর উঁচু করার জন্য জীবন দেওয়া লাগতে পারে। এক নীরব জগতের বন্দিনী আমি।
এলাকাটা ফলের দোকানে ভরপুর। মাঝেমধ্যে দু-একটা দোকানে গাড়ির তেল অথবা বিভিন্ন সরঞ্জাম সাজানো দেখা যায়। হলুদ ও কালো ট্যাক্সির সারি। দুই পাশে যাত্রীদের উদ্দেশে চালকেরা হাঁক ছাড়ছে। ধুলো মলিন হেঁড়াবেড়া পোশাক পরিহিত ক্ষুধার্ত বাচ্চারা ঘুরছে চারপাশে। জুতা পলিশ থেকে শুরু করে গাড়ি মোছা পর্যন্ত সব রকম কাজের জন্য এরা তৈরি। ক্ষুধার জ্বালা।
অল্প কিছু শরণার্থী ছিল। তবে সেদিন পাকিস্তানগামী মানুষের চেয়ে অধিক মানুষ ফিরে আসছিল। শক্ত চোয়ালের একদল যুবক। তোরখাম সীমান্ত থেকে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এরা দৃঢ়সংকল্প। এরা কোথা থেকে আসছিল? তালেবানরা পবিত্র যুদ্ধ বা জিহাদের জন্য বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কোনো ইউরোপিয়ান মুসলমান কি জিহাদে যোগ দিয়েছে?
গাইড দুজনের পেছন পেছন নিঃশব্দে হাঁটতে থাকি। কিন্তু বোরকা পরে হাঁটা কষ্টকর। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। ভয় লাগছিল, কখন জানি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলি। আফগান নারীর চরিত্র থেকে বেরিয়ে সন্দেহজনক কিছু করে না আবার ধরা পড়ে যাই।
ছোট মেয়েটা শক্ত ধরে আমার হাত চেপে ধরে। যাত্রাপথের সঙ্গী নারী বা তার দুটি সন্তানের ভারবহনের কোনো প্রয়োজন অথবা দায়িত্ব কোনোটাই আমার নয়। বিপদের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে গেছে। অথচ আমি কী উকট ঝামেলার মধ্যেই না পড়েছি। বুঝে আসছিল না মুসকিন কেন এভাবে রং বদলে নিল? প্রথম দিকে ওকে বেশ উৎসাহী ও আগ্রহী মনে হচ্ছিল।
আমার ছদ্মনাম ও ওর স্ত্রীর পরিচয় ধারণের বুদ্ধিটা তারই। এমনকি ওর ১১ বছরের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চাইলেও আমি না করি। অথচ উল্টো এখন দুটি সন্তান ও তাদের মায়ের ভার বহন করতে হচ্ছে। গাইডদ্বয় জালালাবাদ পর্যন্ত একটা গাড়ি ঠিক করলে আমরা সবাই তাতে চড়ে বসি। এখানে রাস্তার বিবরণটা দিয়ে নিলে ভালো হবে। পুরো রাস্তা অসংখ্য খানাখন্দে ভরা। কোথাও পিচঢালা দীর্ঘ পথ নেই। পেছনের সিটে বসে এদিক-সেদিক ছিটকে যাচ্ছিলাম। বারবার জানালার পাশের এক হাতলে বাড়ি লাগছিল এবং মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়।
চালক হঠাৎ খেপে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল। পেছনের আয়নায় তাকিয়ে কিছু একটা বললে সঙ্গের লোক দুজন নেমে পড়ে। পেছনের চাকা ফেটে গেছে। সবাই মিলে চাকা বদলাতে লেগে গেল। ১০ মিনিটের মাথায় গাড়ি আবার চলা শুরু করে। এত দ্রুত ওদের চাকা বদল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। গাড়িটা সড়ক থেকে পাশের ধূলিময় প্রান্তরে ছিটকে গেল। জায়গাটা ভর্তি নুড়ি পাথর। আরেকটা চাকা ফেটে গেছে। দুর্ভাগ্য আজ ভালোমতোই পিছু নিয়েছে। পুনরায় চাকা বদলে নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে।
আমি ভাবছিলাম, কতগুলো অতিরিক্ত চাকাসমেত গাড়িটা যাত্রা শুরু করেছে? চালকের দক্ষতায় মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। কীভাবে বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়াই দু-দুটি চাকা ফেটে যাওয়া পরিস্থিতি সামলে নিল। তারপরও পাঁচ মিনিটের মাথায় দুটি চাকা ফাটার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। ভাগ্যদেবী আজ আমার যাত্রাপথে বারবার বাগড়া দিচ্ছে। হিন্দুকুশ পর্বতের উঁচু ভূমি পেরিয়ে এলে সামনে বিশাল প্রান্তর। দুদিকে ভুট্টা আর আখের খেতে মাথা দোলাচ্ছে গাছের শিষ।
স্কাড মিসাইল যেগুলো পাকিস্তানের দিকে মুখ করে তাক করে রাখার কথা, তার কোনো চিহ্নই নেই। এমনকি চারপাশে কোনো সামরিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ল না। অদ্ভুত ব্যাপার। একটা দেশ অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সমরাস্ত্রের আঘাতের মুখে পড়তে যাচ্ছে আর তাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেবল সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় একটা বহুমুখী রকেট লঞ্চার চোখে পড়েছিল।
গাড়িটা জালালাবাদগামী ৫০ কিলোমিটার সড়ক ধরে লাফাচ্ছিল, ঝাকাচ্ছিল এবং মাঝেমধ্যেই এদিক-সেদিক কাত হয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনটা শান্ত হয়ে এল। চুপ করে বসে থাকার চেষ্টা করলাম। বড্ড ক্লান্তি এসে ভর করেছে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর অ্যাড্রেনালিনের চাপে বোধ হয়। মাথায় তীব্রভাবে হাতলের বাড়ি লেগে জেগে উঠলাম। আমরা জালালাবাদের উপকণ্ঠ ধরে যাচ্ছি। ভয়ে আঁতকে উঠলাম, যদি চোখে আঘাত লাগত। পরক্ষণেই পরনের আপাদমস্তক আবৃত বোরকার কথা স্মরণে এল।
দেড় ঘণ্টা আগে সীমান্তের তালেবানদের চেক পয়েন্ট পাড়ি দেওয়ার সময় আমার হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করে কাঁপছিল। জালালাবাদ পৌছে আবার হৃৎপিণ্ডের লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষই সশস্ত্র এবং তাদের সবাইকেই তালিব মনে হচ্ছিল।
ব্যস্ত শহরটাতে জীবন অনেক অস্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক মনে হলো। গাড়ি থেকে নেমে ওই নারীকে অনুসরণ করে বাজারে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নারীটি আস্তে করে নুইয়ে গিয়ে পায়ের ওপর ভর দিয়ে মার্জিত ভঙ্গিতে বসে পড়ল। জান আমার কাঁধে মৃদু টোকা দিয়ে আস্তে করে বলল বসে পড়তে। অন্যত্র হলে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতাম। আজ আর কোনো টু শব্দ না করে চুপচাপ বসে পড়ি। কিন্তু আমি আলুর বস্তার মতো ধড়াম করে মাটিতে বসে যাই।
সৌভাগ্যবশত কেউই আমার এই অদ্ভুত বসার ভঙ্গি লক্ষ করেনি। আমি চিন্তা করতে থাকি, মানুষের নজর এড়ানোর জন্য কী কী করতে হবে? মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। মাটিতে বসে পড়ায় একদম অদৃশ্য হয়ে গেলাম। নিচু অবস্থান থেকে বাজারের চারদিকে দেখতে লাগলাম।
চারদিকে পাকা আপেল, ডালিমসহ আরও অনেক পাকা ফলের ম-ম গন্ধ। আমি মায়ের যন্ত্রণা সত্ত্বেও ফল খেতে খুব একটা ভালোবাসি না। কিন্তু এখানে দৃশ্যটা দেখতে ভালোই লাগছে। বাজি ধরে বলতে পারি, এর সবই প্রাকৃতিক। সারবিহীন নিরাপদ। মোল্লী ওমর নিশ্চয়ই সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে চাষাবাদ নিষিদ্ধ করেছেন। কেউ নির্দেশ অমান্য করলে তাকে পাথর মারা হবে। আমার হাসি পেলেও অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করি। সামান্য একটু শব্দও আমার জীবন কেড়ে নিতে পারে।
হাতের মাংসপেশিতে ব্যথা অনুভব করছি। পাশের নারীর দিকে তাকিয়ে কেমন নিষ্প্রভ ও ভাবলেশহীন মনে হলো। উচিত ছিল এখানে আসার আগে বিশেষ ধরনের ব্যায়াম পিলাটি শিখে আসা। বন্ধু ড্যাফন রমনি নিয়মিত এসব করে। এর ফলে শরীরের সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ওকে সবাই ড্যাফার নামে ডাকে। পেশায় লন্ডনের বিখ্যাত ব্যয়বহুল আইনজীবী। পিলাটি প্রশিক্ষক মাইকের কাছ থেকে হাতে-কলমে অনুশীলন করতেও প্রচুর খরচ করে।
ওর ব্যায়ামের ফিরিস্তি শুনতে গেলে ঘুম আসে। আমিও এক-দুবার গিয়েছিলাম। কিন্তু বারবার একই অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি আর ট্রেডমিলে স্থিতিশীল দৌড় প্রচণ্ড বিরক্তিকর। এই জালালাবাদের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ড্যাফার দিনভর খুশিমনে স্কোয়াটিং করতে পারবে। গাইড দুজনকে ফিরতে দেখে মনে স্বস্তি পেলাম। কয়েক রকম খাবার ও চাল নিয়ে ফিরছে ওরা।
তারা দুজন সোজা পথ ধরে হেঁটে গেল, একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে। হায়রে বোরকার ভেতর জড়সড় হয়ে বসে থাকা আর মুখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার। একটা মাংসের দোকান অতিক্রম করলাম ওদের পিছু পিছু। চারপাশে অসংখ্য মাছি ভনভন করছিল। একটা কাঠের হাতলে মাত্র এক টুকরা বড় রান ঝোলানো। ভারী নেকাবের ভেতর থেকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বুঝলাম, একদিকে মাংস টুকরা করে কাটা হচ্ছে।
চারপাশে খুব বেশি নারীর উপস্থিতি নেই। যারাও সাহস করে ঘর থেকে বেরিয়েছে, তাদের গায়ে লম্বা বোরকা চাপানো। বিভিন্ন কফির দোকানে বসে ছেলেরা কফি পান করছে। এখানকার চিনিতে প্রচুর পরিমাণ সবুজ চিনি দেওয়া হয়। কয়েকজনের হাতে কোকের বোতলও দেখতে পেলাম।
অধিকাংশ মানুষের মুখে সবুজ তামাকজাতীয় কিছু জিনিস। কিছুক্ষণ চিবুনোর পর সেটা এখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। চিবুনোর সময় গলা দিয়ে অসহ্যকর একটা শব্দ বের হয়।
মনে হলো, এটা খাটগাছের পাতা। এর মধ্যে নেশাকর উপাদান রয়েছে। এ গাছটা আমি চিনি। ওয়েলস অন সানডেতে থাকাকালে কার্ডিফের ইয়েমেনি অধিবাসীদের ওপর একটা প্রতিবেদন করেছিলাম। সেখানকার এক মুদি দোকানে প্রতি বুধবার খাটের পাতা বিক্রি হতো। নির্ধারিত দিনে সকাল থেকেই দেখা যেত বিশাল লম্বা লাইন। তখন পর্যন্ত এর পাতা চিবুননাতে কোনো আইনি বেড়াজাল ছিল না। রাস্তার পাশের এক খুপরি থেকে একটা সাধারণ বাজার চোখে পড়ল। সঙ্গের গাইড দুজন একরকম আমাকে পরিত্যক্ত করে রেখেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাপসা গরমের মাত্রা। বেড়ে চলেছে। বদ্ধ বোরকার ভেতর বসে একটু খোলা বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছিলাম। আমাকে নিয়ে যে গাইডরা এসেছে, ওদের আচরণে মনেই হচ্ছে না তারা আমাদের চেনে। তারা দিব্যি বাজারে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে। বিভিন্ন দোকানে লেনদেন করছে।
অবশেষে তাদের আসার সময় হলো। আমি মুখে রাগের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখলেও কেউই খেয়াল করল না। বোরকার আড়াল থেকে আর আমার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শহরের ভেতর দিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। তবে এবার আমাদের বাহন হলো রংচঙে তিন চাকার মোটরচালিত রিকশা।
কোন এক অদ্ভুত কারণে শহরভর্তি শুধু ওষুধ আর গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান। একটাও কাপড়ের দোকান চোখে পড়েনি। পরে জানতে পারি, আসন্ন জিহাদের কারণে মোল্লা ওমর নারীদের নতুন কাপড় কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ড্যাফারের নতুন কাপড় কেনার ভয়াবহ বাতিক আছে। এমন জায়গায় এলে ও টিকতে পারত না। নির্ঘাত নিজের মাথায় নিজেই পাথর দিয়ে আঘাত করত।
কিছুক্ষণ পর আমাদের হলুদ সাদা রঙের বাহন জালালাবাদ শহরের তিন মাইল পূর্ব দিয়ে চলা শুরু করল। মাঝ রাস্তায় রিকশা থেমে গেলে আমরা নেমে পড়ি। বধিরের অভিনয় করা সত্ত্বেও জোরে চিল্কার করতে ইচ্ছা করছিল। কেউ কি আমাকে কিছু বলবে, কী ঘটছে? সঙ্গের নারীটি সামনের দিকে এগিয়ে গেল। অথচ কেউই এখন পর্যন্ত আমার দিকে নজর দিল না।
খানিক বাদে বুঝতে পারি, কামা নামের একটা ছোট গ্রাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। এটা একটা ছোট অবহেলিত স্থান।
তখনো ধারণা ছিল না, জায়গাটা আমার জীবনে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সঞ্চার করবে।
মাঠভর্তি আখ আর ভুট্টাগাছ। গাছগুলো কেমন তরতাজা আর মোটাসোটা। তোরখাম সীমান্তের কাছের খেতগুলোর চাইতে এখানে ফসলের উৎপাদন অনেক বেশি মনে হলো। মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা ধরে আমরা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চললাম। আমি হাঁটছিলাম সবার শেষে। ভারী বোরকার ঢাকনার ভেতর দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। সামনের রাস্তা দেখার জন্য আমাকে বারবার কুঁকতে হচ্ছিল।
আমি জানি, এখানেই আশপাশে কোথাও বিন লাদেনের একটা ঘাঁটি আছে। কিন্তু রাস্তা খুঁজে নিতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, আশপাশে তাকানোর সুযোগ পেলাম না। এ ধরনের আচরণ সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি।
যত দূর মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিটা আশপাশেই কোথাও আছেন। তিনি আমার থেকে কয়েক ফুট দূরে থাকলেও আমার পক্ষে তাকে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না।
পথিমধ্যে নালার ওপর দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা সরু সাঁকো পার হলাম। কিছু দূর যেতেই কামা গ্রামটা ভেসে উঠল। মাটি দিয়ে লেপানো অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর। একদম সাদামাটা আফগান গ্রাম।
এক নারী প্রায় দৌড়ে এসে আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানান। এমনকি তিনি আমাকেও অভিবাদন জানান। যদিও আমরা ঠিক ওই মুহূর্তে এসে পৌছাব, এটা তিনি কী করে জানতেন, তা আমার বোধগম্য হয়নি। তিনি আমাকে কী ভেবেছিলেন, জানি না। মনে হচ্ছিল, আমি যেন কত দিনের পরিচিত স্বজন। বাচ্চা দুটো পাশের বিশাল খোলা মাঠে খেলায় মত্ত অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে যোগ দিতে দৌড় দিল।
উঠানের এক পাশে ঘরের দেয়াল ঘেঁষে খড়ের গাদার মতো একটা ছাউনি। এর নিচে রান্নাবান্না করা হয়। একদিকে কিছু হাঁড়িপাতিল ও থালাবাসন রোদে শুকাতে দেওয়া। একটা হস্তচালিত পানির পাম্পও চোখে পড়ল।
আমার সঙ্গী নারী হাত ধরে টেনে একটা বড় হলঘরে প্রবেশ করলেন। মেঝেতে আফগানের প্রচলিত পশমের চাদর বিছানো। চারদিকের দেয়ালে অসংখ্য কুশন ও বালিশ। ওই নারী এক পাশের বিছানায় লুটিয়ে পড়েন। আমি এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে বোরকাটা কোনো রকমে উঁচু করে বিছানায় ঢলে পড়ি ঘুমানোর জন্য। ক্লান্তি তাড়ানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। ঘুমাতে ভালোবাসে না, এমন কারও জন্য আদর্শ জায়গা এটা নয়। স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে আসছিল। দীর্ঘ পথ হাঁটা, ভ্যাপসা গরম অথবা টানা দুই নিঘুম রাতের জন্য এমন লাগছিল বোধ করি।
বাইরে তখন পারিবারিক পুনর্মিলনী চলছে। সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। কথা আর চিকার থামার কোনো লক্ষণ নেই। এর মধ্যেই আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘন্টাখানেক বাদে এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে আমার ঘুম ভাঙল। দেখলাম, এক লোক হাঁটু গেড়ে বসে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ডাকছে। ভয়ে নীল হয়ে গেলাম, কারণ লোকটা ইংরেজিতে কথা বলছে।
আমি বোরকাটা মুখের ওপর দিয়ে বসে পড়ি। লোকটা আমাকে শান্ত থাকতে বলে। সে বলতে থাকে, জনি আমার কথা বলেছে। আমি একজন মহতী ভালো মানুষ। পরে সে আমাকে বোরকা খুলে আরাম করে বসতে বলে।
এরপরও আমি চুপ করে বসে থাকি। আমি কে বা কোথা থেকে এসেছি, এসব সে কী করে জানল, তা ভাবতে ভাবতে জান রুমে প্রবেশ করে। জান আমার কথা ওদের বলেছে বলে জানায়। তার মতে, এখানে কথা বললে অসুবিধার কিছু নেই।
বধির প্রতিবন্ধীর ছদ্মবেশ হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ লাগল। অগত্যা আমি বোরকাটা খুলে ফেলে মাথায় একটা স্কার্ফ জড়িয়ে জানের ওপর চোখ রাঙাই।
অস্থির হবেন না। জায়গাটা নিরাপদ এবং আপনার কথা গোপন থাকবে। জান অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে। বয়স ২৫, লম্বা হ্যাংলা গড়নের জানের ভালোমানুষি চেহারাটা মুখভর্তি উষ্কখুষ্কর আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে।
এর মাঝেই আরেকজন গাইড, জানের চাচা, জোরে পা ফেলে রুমে প্রবেশ করলেন। আমার লোকটাকে পছন্দ হচ্ছিল না। কোনো যৌক্তিক কারণ না থাকলেও একটা কারণ অবশ্যই যে তাঁর ভাষা বোঝার সাধ্য নেই। লোকটা লম্বা গড়নের, পাতলা মুখ, মুখভর্তি অবিন্যস্ত দাড়ি। বয়সে জানের চেয়ে ১০ বছরের বড় হবেন।
আপনি কেন এসেছেন? লোকটার প্রথম কথা ছিল এটা। আপনি জানেন, এটা বড় বিপজ্জনক জায়গা।
আট ঘণ্টার মধ্যে এই প্রথমবারের মতো আমি একটু নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ পেলাম। আমি একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক। তোমাদের মতে আফগান অধিবাসীদের ওপর একটা প্রতিবেদন করতে চাই। বাক্যগুলো আওড়াতে আমার বেশ ভালো লাগল। তোমাদের আশা, ভয়, জীবনের লক্ষ্য জানার ইচ্ছে পোষণ করি। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের ঘটনা নিয়ে কী ভাবছ তোমরা? আমেরিকার প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্প জানার পর এখানকার অধিবাসীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে?
এমন সময় ৩০ থেকে ৪০ জন লোককে পাশের একটা কক্ষে জড়ো হতে দেখি। লোকটা আমার কথা তাদের নিজস্ব ভাষায় এই জমায়েতকে জানায়। ছোট একটা মেয়ে আমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে খড়ের তৈরি একটা পাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে থাকে।
আমি একটা ছবি ওঠাতে চেয়ে ক্যামেরাটা বের করি। তালেবানরা ছবি তোলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, লোকটা বেশ দৃঢ়ভাবে এই কথাটা বললে আমি ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলি। আমি জানতে চাই, তালেবানরা আর কী কী অপছন্দ করে? ২৫ বছরের একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানায়, তাদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো অনুমতি নেই।
মেয়েটার কথা অনুবাদ করে ইংরেজিভাষী লোকটা জানায়, মেয়েটা চিকিৎসক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করেই শিক্ষার সব সুযোগ বাতিল করে দেওয়া হয়।
বিষাদ আর কষ্টের নিচে মেয়েটার দৃঢ়তা যেন ঢাকা পড়ে আছে। আফগানে মেয়েদের কোনো অস্তিত্বই যেন নেই। শিক্ষার আলো কঠোর আইনে নিভে গেছে। মেয়েটার প্রতি সহমর্মিতা দেখালে তাকে একটু খুশি মনে হলো। দুজন নারী, ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি। আমার সঙ্গে মেয়েটার সাদৃশ্য আর পার্থক্যগুলো সামনে ভেসে উঠল।
অবাক লাগল, এমন পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে বেঁচে থাকতাম? এরা বেঁচে থাকে না, শুধু টিকে থাকে। কামা গ্রামের অধিবাসীরা খুব দয়ালু প্রকৃতির এবং মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। লক্ষ করলাম, শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা করলেও আসন্ন হামলার ব্যাপারে এরা খুব একটা ভীত নয়। তবে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে যুদ্ধের জন্য সব সময় প্রস্তুত এরা।
বোরকা পরা আফগান রমণীরা আধুনিক দাসত্বের প্রতীক। কিন্তু কামার নারীরা খুব শক্ত ধরনের, ইতিবাচক ও প্রাণোচ্ছল। একটা মেয়ের ছিল বাদামি গাঢ় বর্ণের চোখ, প্রশস্ত গাল। আমার একটা মাত্র বাচ্চা শুনে মেয়েটা মুখ টিপে হেসে আমাকে খোচা দেয়।
বাচ্চা বহনের একটা সুন্দর ঝুড়িতে হাত রেখে মেয়েটা অবাক হয়, মাত্র একটা বাচ্চা। তোমরা আমেরিকান আর ব্রিটিশ নারীদের মাত্র একটা বা দুটা বাচ্চা হয়। আর আমরা ১৫টা পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখি। তোমাদের সৈন্যসামন্ত কমে গেলেও আমাদের তখনো যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোর জন্য যথেষ্ট ছেলে মজুত থাকবে। আমাদের ছেলেরা হাতে অস্ত্র নিয়ে জন্মায়। এরা যুদ্ধ করতে করতে বড় হয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে আমিও যেমন অস্ত্র হাতে তুলে নেব, তেমনি ইনিও অস্ত্র ধরবেন। এই বলে মেয়েটা এক বৃদ্ধ নারীর দিকে ইঙ্গিত, যার ভাঁজ পড়া চেহারা ও ফোকলা হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে গভীর প্রজ্ঞার ছায়া।
আমাকে বলা হলো, বৃদ্ধার জন্ম এক শতাব্দী আগে। তিনি অনেক যুদ্ধ দেখেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতেই সবাই হেসে দিল। তিনি বলছিলেন আমেরিকান সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। আফগানদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এসব দেখে আমার একটা কথাই মনে পড়ে গেল, আফগানদের ভাড়া করা যায় কি তাদের ক্রয় করা সম্ভব নয়।
এর মধ্যেই গাঢ় বাদামি চোখের মেয়েটা জমায়েতের কেন্দ্রে চলে এল। তরুণ দোভাষীর সহায়তায় সে বলতে লাগল, নিউ ইয়র্কে হামলার ঘটনায় আমরা দুঃখিত। এতে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি মারা গেছে। এখানে বোমা নিক্ষেপের আগে আমেরিকা যেন দ্বিতীয়বারের মতো চিন্তা করে। যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা কেউই ভীত নই।
মেয়েটার আবেগ-অনুভূতি এখানকার অন্য সবার মতোই। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত দৃশ্য যা টেলিভিশনে সমগ্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে, তা দেখার সুযোগ থাকলে এরা কেউই সহজভাবে মেনে নিত না। আফগানিস্তানে টেলিভিশন নিষিদ্ধ। সংবাদ প্রচারের মাধ্যম হলো মুখে মুখে অথবা রেডিওতে। ফলে যেসব ছবি আমাদের জীবনকে শঙ্কার মুখে ঠেলে দিয়েছে, হৃদয়কে ব্যথিত করেছে, তার ছিটেফোঁটাও এরা চাক্ষুষ করেনি।
অধিকাংশ আফগান জনগণ মাথার ওপর একটা ছাদের অস্তিত্বেই খুশি থাকে। এখানকার সব বাড়িই একতলা। তাই এদের পক্ষে ১০০ তলা দীর্ঘ একটা দালানের কথা কল্পনা করা সহজ নয়।
বয়স্ক লোকেরা আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করে। কিন্তু দোভাষী ছেলেটা বলতেই থাকে। দারিদ্র্যের কশাঘাত তাদের জীবনের লক্ষ্যকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় তাদের জানা নেই। এখানের অধিবাসীদের কোনো স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই। তার শেষ বাক্যটা আমাকে আঘাত করল।
প্রত্যেক মানুষের জীবনের একটা লক্ষ্য থাকতে হয়। দিতে হয় এগিয়ে চলার প্রেরণা। তালেবানরা কেন এদের জীবনকে সহজ করে নিঃশ্বাস নিতে দিচেছ না? অবশ্যই আন্দোলনের শুরুটা ছিল মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এরা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
নারীদের চরিত্রের দৃঢ়তা সত্যিই দেখার মতো। এত দিন পর্যন্ত আফগান নারীদের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। বোরকার নিচে কি আগুন চাপা পড়ে আছে। আমার মতো ওরাও আমাকে ওদের মধ্যে পেয়ে উচ্ছ্বসিত। বোরকাটা খুলে ফেলার সময় খেয়াল করি, চেহারায় চুলের রং লেপ্টে আছে। ভালো পরিস্থিতিতে নিশ্চয় এমন হতো না। তীব্র গরম, দম বন্ধ করা বোরকা আর মাথার ঘাম সব মিলে চুলের রং নষ্ট হয়ে গেছে। তবে মাথার স্কার্ফটায় সব আবার ঢেকে দিই।
বাচ্চা উৎপাদনের মেশিন মেয়েটা আমাকে হ্যাচকা টানে বাইরে নিয়ে এল কিছু খাওয়ানোর জন্য। এদের আতিথেয়তার কোনো তুলনা নেই। এদের খুব বেশি সম্পদ নেই। যৎসামান্য যা-ই রয়েছে, তা-ই আমার জন্য ব্যয় করতে উদগ্রীব।
ভাত, ঝোল আর রুটি খেতে কষ্ট হচ্ছিল। এসবের জন্য প্রয়োজন দক্ষ আঙুল চালনা। মেয়েটা আমার হাতে সুস্বাদু একটা ভুট্টা তুলে দেয়। এত গরম ছিল যে আমি চিৎকার দিয়ে তা ফেলে দিই। সবাই জোরে জোরে হাসতে থাকে। মেয়েটা আরেকবার আমাকে টিপ্পনী কাটে এবং উপস্থিত সবাইকে বলতে থাকে পশ্চিমা মেয়েরা খুব নরম প্রকৃতির হয়। তার বলার ভঙ্গি দেখেই আমি বুঝতে পারি।
আমার হাতে দেওয়ার আগে মেয়েটা ময়লা মেঝে থেকে ভুট্টাটা তুলে নিয়ে পরিষ্কার করতে লেগে যায়। দ্বিতীয়বার কোনো কিছু ফিরিয়ে দিলে মেজবানকে অপমান করা হয়। তাই আমি খুশিমনেই এবার হাতে নিয়ে ভুট্টা চিবুতে থাকি। ঘি মাখানো ভুট্টা সত্যিই মজার ছিল। এরপর আমাকে একটা আখ চিবুতে দেওয়া হয়। আখ চিবুতে চিবুতে ক্লান্তি কেটে গেল। আমি দেখলাম, সবাই আখ চিবুচ্ছে এবং শুকনো অংশটা ফেলে দিচ্ছে, যা আমি গিলে ফেলার চেষ্টা করছিলাম। তাদের দয়া ও আতিথেয়তায় নিজেকে অনেক সম্মানিত মনে হচ্ছিল।
১২ বছরের একটা মেয়ে ময়লা বাসনকোসন ধোয়ার জন্য উঠানের এক প্রান্তে একটা নলকূপ চাপতে চলে গেল। একজন প্রতিবেশী দেয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন এখানে কী হচ্ছে? এখানে অনেক জোরে কথা, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব হচ্ছিল; যার কোনোটাই তালেবানদের পছন্দ নয়। প্রতিবেশী নারীকে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠলাম। আমাকে দেখত পেয়ে তিনি আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন না। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
এমন সময় এক তরুণ উঠানে এসে আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। সমস্বরে একটা না ধ্বনি শোনা যায়। জান জানতে চায়, আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতে চাই কি না। আমাদের দ্রুত চলে যাওয়া উচিত বলে তাড়া দিই।
আমার থাকতে ভালোই লাগছিল। অন্ততপক্ষে বিরক্তিকর দমবন্ধ করা পোশাকটা পরতে হচ্ছে না। কিন্তু মন বলছিল এক মুহূর্ত এখানে থাকা উচিত হবে না। এখন পর্যন্ত একবারও আমার গাইডদের সঙ্গে ঝগড়া করার সুযোেগ পাই না। ওদের অবহেলার জন্য উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
ছয়জনের একটা দল নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে ধুলোমর রাস্তায় চলে এলাম। একটা তিন ফুট উঁচু দরজা দিয়ে বের হতে হলো। সম্ভবত প্রতিবেশীদের চোখ এড়িয়ে অথবা বাড়িতে কেউ এলে চুপিসারে বেরিয়ে যেতে এটা ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হলো ৪০ মিনিট। আমি জানি না, চালক কীভাবে জানত আমরা এখানে থাকব। নাকি সে এমনিতেই যাত্রীর আশায় চালিয়ে যাচ্ছিল। জান ও তার চাচা রাস্তা পেরিয়ে পরিচিত একজনের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমার কাঁধে আঘাত করে বসতে বলল।
মাটিতে বসে পড়া সহজ কাজ নয়। এবং আরেকবার আমি এখানকার মেয়েদের অভ্যাসবহির্ভূতভাবে ধড়াম করে বসে পড়ি। একটা বাদামি রঙের প্রাণী রাস্তার অপর পাশের ভুট্টাখেত দেখে বারবার বেরিয়ে যাচ্ছে আর প্রবেশ করছে। ভোঁদড় হবে হয়তো। একটা বিড়ালের সমান প্রাণীটা। লেজটা মোটা, লম্বা ও ঝোলানো।
গাড়িতে ওঠার পর মনে শান্তি ফিরে এল। দ্রুত ফিরে যেতে চাই পাকিস্তানে। সফর সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে। গ্রামের ঘটনার জন্য মনে ভয় ঢুকে গেছে। যদিও ধারণার চাইতে বেশি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছি। পরিকল্পনাটা ছিল এ রকম, মুসকিন আমার চোখ, কান হয়ে থাকবে জালালাবাদে। দুই দিন পর পাকিস্তান ফিরে গিয়ে ও পাশাকে সব জানাবে। আমি পাশার কাছ থেকে জেনে নিয়ে তাতে রং মাখিয়ে একটা সুন্দর প্রতিবেদন তৈরি করব।
নাশতা খেতে খেতে সকালের পত্রিকায় পাঠকেরা যেসব সংবাদ পড়ে থাকেন, এর পেছনে থাকে অক্লান্ত পরিশ্রম আর হাড়ভাঙা খাটুনি। সংবাদ পাঠকদের কাছে এর গুরুত্ব কতখানি? অধিকাংশ ক্ষেত্রের খবরের পেছনের খবরটাই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এই রাস্তা ভ্রমণ শুরু হলো কষ্টের মধ্য দিয়ে। গাড়ির ভেতর আমরা শুধু এদিক-সেদিক ছিটকে পড়ছিলাম। একটা বাচ্চামেয়ে কাঁদতে শুরু করে। আরেকটা বাচ্চা কী করে এত ঝাকুনির মধ্যেও ঘুমিয়ে পড়ল, তা আমার বোঝে আসেনি।
আমি একবার বাথরুমে যেতে চাইলাম। পরক্ষণে মনে হলো, এর জন্য পুনরায় সে গ্রামে ফিরে যেতে হবে।
দুঃসাহসী অভিযানের প্রতিটা দৃশ্য সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তোরখাম সীমান্তের দিকে গাড়ি ছুটে চলেছে। আমাকে বলা হয়েছিল, একবার গেলে আর ফেরত আসা সম্ভব হবে না আফগানিস্তান থেকে। এখানকার মানুষেরা সত্যিই অসাধারণ। প্রকৃতপক্ষে এরা ভীষণ অমায়িক। কিন্তু দেশটা আমার জন্য কিছুই করেনি।
তোরখামে যখন পৌছাই, তখন সন্ধ্যা। কয়টা বাজে আন্দাজ করতে পারছিলাম না। কারণ, ঘড়িটা হোটেলকক্ষে ফেলে এসেছি। মূল্যবান কিছুই সঙ্গে নিয়ে আসিনি। কানের দুল, হাতঘড়ি, টাকাপয়সা এমনকি আমার পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি। উপজাতীয় ডাকাতদলের হাতে ধরা পড়ার ভয় পদে পদে। আমার পাসপোর্ট পেয়ে ওরা আমাকে বন্দী হিসেবে মুক্তিপণ চাইবে, তা আমি হতে দিতে পারি না।
তালেবানদের হাতে ধরা পড়লে গর্দান নিশ্চিত। কিন্তু আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলে আমি বলতে পারব, ইসলামাবাদের দূতাবাসে জমা দেওয়া ভিসার আবেদন ফরমের সঙ্গে পাসপোর্টের একটা কপি জমা দেওয়া আছে। এখন এসব চিন্তাভাবনা অবান্তর। কারণ, আমরা একদম সীমান্তের খুব কাছে পৌছে গেছি।
হঠাৎ জান আমার কাঁধে টোকা দিয়ে রাস্তার এক দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে মৃদু স্বরে বসে পড়তে বলে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম, এই বদমাশটাকে আমি দেখে ছাড়ব একবার সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পরে। এমনকি আমি ক্ষোভে বোরকা পোড়াও আন্দোলন গড়ে তোলার চিন্তাও করে ফেলি। যেমন ষাটের দশকে নারীরা অন্তর্বাস পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
আমি নারী সঙ্গীর সঙ্গে নুইয়ে বসে পড়ি। আমরা ঝুঁকে বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে যাই। চারজন হতভাগী একসঙ্গে। আধা ঘন্টা পরে আমাদের গাইডদ্বয় ফিরে এল। চেহারায় ভয়ার্ত ছাপ, একদম নিখুপ। আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেই সঙ্গের নারী উঠে একদিকে হাঁটতে শুরু করে। আমাদের এক পানশালা ধরনের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে । মদ সরবরাহ করা হয় না। অনেক মানুষ একত্রে পায়চারি করছিল এবং শ্লোগান দিচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে সেখানে। ভারী বোরকার। কালো পর্দার আড়াল থেকে আমি মনোেযোগ দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের ছয়জনকে একটা বদ্ধ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ছিল না কোনো জানালা, কোনো ফ্যান। মেঝেতে একটা কার্পেট বিছানো।
ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙে গেল। আমি বোরকার নিকাব এক ঝটকায় খুলে ফেলে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে জানকে ধমকাতে শুরু করি। কী ঘটছে আমাকে খুলে বললা? এটা আমার অভিযান। তোমরা দুজন আমাকে অনুসরণ করবে। আমি যদি লাফ দিতে নির্দেশ দিই, তাহলে তোমরা জানতে চাইবে কতটা উঁচু থেকে? তোমরা যদি একটা পয়সাও আশা করো, তাহলে এখন থেকেই আমাকে কিছু সম্মান দেখাতে শুরু করো। এখন তোমার সঙ্গীকে বুঝিয়ে দাও। এই বলে জানের চাচার দিকে নির্দেশ করলাম।
ধমকে কাজ হলো। জান যে আমার কথা ভালোভাবেই ভাষান্তর করেছে, তা ব্যাটার চাহনি দেখেই বুঝতে পারলাম। মুখটা কেমন পাথরের মতো শুকিয়ে গেছে। আমার দিকে শুকনা মুখে তাকাচ্ছিল।
জান আমার দিকে ঘুরে আস্তে কথা বলতে ইশারা করল। লোকজন সন্দেহ করতে পারে। পাকিস্তান থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভ্রমণের কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও এখন সীমান্ত পাড়ি দেওয়া সম্ভব হবে না। কালকে সকালে চোরাকারবারিদের ব্যবহৃত একটা পথ দিয়ে পাকিস্তানে ঢোকার চেষ্টা করা হবে। বিকেল নাগাদ আমরা ইসলামাবাদে পৌছে যাব।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে জান।
ভয় আর আতঙ্ক মনে চেপে বসল। শুধু আমি নয়, অন্য লোকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। এতক্ষণে কেন আমাকে জানানো হচ্ছে? আগে কেন সতর্ক করেনি ওরা? আমি পরিকল্পনা বদলে ফেলতে বললাম। আমরা আলাদা হয়ে যাব। তালেবানরা এখনো আমার হদিস না পেলেও সকাল নাগাদ আমাকে খুঁজতে অভিযানে নামবে। গ্রামের কেউ না কেউ অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
জানকে এবার আমার ব্যাপারে যত্নশীল মনে হচ্ছে। আমাকে উদ্বিগ্ন দেখে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছিল। চিন্তার কোনো কারণ নেই। গ্রামের কেউই নিমকহারামি করবে না। তা ছাড়া এই অঞ্চলে রাতে কেন, দিনের বেলাতেও কোনো নারী একাকী পথ চলে না।
আমি দ্রুত ওদের থামিয়ে দিই। এখন পরিস্থিতি অনেক সঙিন। তালেবানদের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে যে কেউই আমাদের কথা ফাঁস করে দিতে পারে। আমাদের খোজে বের হলে তারা দুজন নারী, দুটি বাচ্চা আর দুজন পুরুষ মানুষের সন্ধান করবে। পরিবারটাকে বিদায় দিয়ে আমাদের উচিত হবে আলাদা হয়ে যাওয়া। মুসকিন আর আমি আলাদা যাত্রা করব। এভাবে আমাদের নিরাপদ থাকার সম্ভাবনাও বাড়বে।
এরপর সে অপর গাইডের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল। কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলতে থাকল। উভয়েই আমাদের একা রেখে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওরা এভাবে আমাদের একা রেখে বাইরে চলে যাবে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় হোটেলকক্ষে দম আটকে পড়েছিলাম। কিছুই করার ছিল না। অভিযান পরিচালনা করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে বলে দিলেও তারা আমার কোনো কথা কানেই তোলেনি, এমনকি আগের মতোই অবহেলা করতে থাকল। হাঁটু ভেঙে এক কোনায় বসে রইলাম। বোরকাটা মাথার ওপর দিয়ে উঠিয়ে রাখি।
আমি ওই নারী ও বাচ্চাদের দিকে একনজর তাকাই। তার বয়স সাকল্যে ৩০ হবে। কিন্তু আফগান নারীদের কঠিন জীবন চেহারার জৌলুশ কেড়ে নিয়েছে। তারপরও চেহারার কমনীয়তা ঠিকই নজর কাড়ে। মুখে সর্বদা একটা মিষ্টি হাসি লেগেই আছে, যে হাসি প্রশান্তি আর উষ্ণতা ছড়ায়। খোদাই জানেন, এই গোবেচারা লোকটার সঙ্গে কীভাবে থাকছে, ভালোবাসা গভীরভাবে অন্ধ হয়। আমার জীবনেও আমি কত এ-ঘাট ও-ঘাট করলাম।
অবশেষে নায়কের দল কিছু খাবার হাতে ফিরে এল। আমি খেতে অস্বীকৃতি জানালাম। মনে পড়ল সারা দিনে একবারও টয়লেটে যাইনি। জানকে বলতেই ও বাইরে অন্ধকারের দিকে কোথায় জানি দেখাল। একটু পর দেখি, টয়লেটে যেতে আমাকে এই গভীর রাতে একটা দড়ির মই বেয়ে নিচে নামতে হবে।
এত নিয়ন্ত্রণ কোথা থেকে সেদিন এসেছিল জানি না কিন্তু আমি টয়লেট যেতে অস্বীকৃতি জানাই। আফগানিস্তানে ভয়ংকর সাপ আর স্কর্পিয়নের অভাব নেই। এত রাতে অকালে ওদের কামড় খাওয়ার কোনো শখ আমার নেই।
আমি ফিরে যেতে চাইলে জান আমাকে আস্তে আস্তে ওকে অনুসরণ করতে বলে। আমি ঠায় এক কোনায় গাদাগাদি করে বসে রইলাম। ভুলে যাচ্ছিলাম, আমি একজন আফগান নারী। হাতের একটা অংশ উন্মুক্ত হয়ে ছিল। সেখানে মশার দল একের পর এক কামড় দিয়েই যাচ্ছিল। রাতটা যেন কাটছিল না আর। আমি ঘুমাতে চেষ্টা করলেও একটা অজানা আতঙ্ক দুই চোখের পাতা এক হতে দিল না। মনে হাজারো ভাবনা উকিঝুঁকি দিচ্ছিল। অফিসের সবাই কেমন আছে? আফগানিস্তানে আমার এই সাময়িক মুসাফিরনামা নিয়ে কেউ কি আদৌ চিন্তিত? আমার ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছে? সর্বশেষ কথা হয়েছিল কেইথ পেরির সঙ্গে।
জিমের প্রার্থনা, তুমি যেন ভালোয় ভালোয় ফিরে আসো। ভালোবাসা, কেথ।
আমার ফোনটা পাশার কাছে রেখে এসেছি। মা কি এরই মধ্যে একবারও ফোন দিয়েছে? বুঝতে পেরেছে কি দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়েছি? সময়টা কীভাবে প্রতিকূল হয়ে আসছে? আমার অবশ্যই ভদ্রমহিলাকে সব বলতে হবে। জানাতে হবে কীভাবে গিয়েছি। প্রতি রোববারের পত্রিকা উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। আমার প্রতিবেদন পড়লে সহজেই বুঝে ফেলবেন কী ঘটেছিল। তিনি শুধু হতাশায় একবার চোখ উল্টাবেন। অশেষ শুকরিয়া যে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি টের পাননি। তখন পুরোনো প্যাচাল শুরু হয়ে যেত। তোমার একটা ছোট মেয়ে আছে। ওর কী হবে তোমার কিছু হয়ে গেলে? আমি আর তোমার বাবা আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পক্ষে ডেইজির দেখাশোনা করা সম্ভব নয়।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি যে একবারও ভাবিনি, তা নয়। গত বছর আমি ডেইজির নামে বিমা করিয়েছি, যাতে আঠারো পর্যন্ত ওর পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চলে। আমি খিটখিটে নারী নই, যথেষ্ট বাস্তববাদী।
পরের সপ্তাহের কর্মপরিকল্পনার কথা মাথায় চলে এল। একবার কান্দাহারে যাওয়া যায়। তবে অবশ্যই এই দুজনের কাউকেই নেব না। এরা অতিশয় রুক্ষ, আদবকেতার ক খ জানে না। গুছিয়ে কাজ করার ক্ষমতা কম। মনে হয় কোনো দিন শোনেনি যে গাছের ডালে বসে ডাল কাটতে হয় না।
হয়তো মুসকিন এবার নিজেই যেতে চাইবে অথবা পাশা অন্য কাউকে খুঁজে দেবে। যদি এই পরিকল্পনা সম্ভব না হয়, তাহলে মূল পরিকল্পনা অনুসারে আমি কাশ্মিরের সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোর একটা পরিদর্শনে যাব।
অবশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে লিখে শেষ করা যাবে না। বদ্ধ কক্ষে মাথায় হাজার হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং আমি এপাশ ওপাশ করছিলাম। কিসের ভিত্তিতে এটা হোটেল, মাথায় এল না। কোনো রুম সার্ভিস নেই, গোসলখানা নেই এমনকি টয়লেট পর্যন্ত নেই।
আনুমানিক পাঁচটার দিকে সবাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। একটা গাড়িতে উঠে বসি। গন্তব্য সোজা হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশ ধরে। কোনো সড়ক নেই, কেবল গাড়ি চলার জন্য পাথরের মাঝ দিয়ে জায়গা করে দেওয়া। চালক যত দূর যাওয়া যায় সেই চেষ্টায় মত্ত। একটা পাহাড়ের কিনারায় পাথরের রাস্তার ঢালে এসে গাড়ি থামল।
গাইড দুজন প্রার্থনা করতে বসে গেল । আমি সঙ্গে নারীর কাছে গিয়ে টয়লেটে যাওয়ার কথা বললাম। পুরো একটা দিন একবারও যাওয়া হয়নি। মূত্রথলি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। মহিলা কিছু পাথরের দিকে দেখিয়ে দিল। বোরকা পরা অবস্থাতেই আমি পরনের পোশাক খুলতে শুরু করলাম।
চাপ কমাতেই দ্রুত শরীরের অবসাদ কেটে গেল। গায়ে এসে লাগল পাহাড়ি বাতাস। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ছুটন্ত তারা চোখে পড়ল। একটাই প্রার্থনা করলাম, নিরাপদে যেন এখান থেকে বের হতে পারি। তারাটার চলে যাওয়া দেখতে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এটা অদৃশ্য হলো না। বোরকার নেকাব তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
একটা উপগ্রহ নিচের ছবি তুলছে। হায় হায়, প্রস্রাব করা অবস্থায় আমার একটা ছবি উঠে গেছে। কিছু কিছু উপগ্রহ নিচের এক মিটার থেকেও ছবি তুলতে সক্ষম। কিন্তু আমি বোরকা পরিহিত। তাই আলাদা করে চেনা সম্ভব নয় আমি কে, সামরিক অথবা বাণিজ্যিক যা-ই হোক না কেন, এটা কোনো তারা নয়। একটা উপগ্রহ মাত্র।
চেহারার ওপর দিয়ে বোরকা টেনে দিয়ে সরতে গিয়েই দেখি কী কাণ্ড। উপগ্রহ দেখতে গিয়ে পাজামার ফিতা আটকাতে ভুলে গেছি। ঠিকঠাক করে নিয়ে সড়কের অপর পাশে চলে এলাম। আমার সঙ্গের নারীটি তার মুখের নেকাব সরিয়ে ফেলেছে। জোরে জোরে হাসছে। নিঃশব্দে হলেও তার মুখে হাসি ফুটেছে। এত পথ একসঙ্গে চলার পর অবশেষে মহিলার গোমড়া মুখের বিপরীত একটা চেহারা দেখতে পেলাম।
কয়েক মিনিট পর ব্যথায় চোখে পানি চলে এল। একটা খাড়া সংকীর্ণ পাহাড়ি পথ দিয়ে উঠতে গিয়ে শক্ত প্লাস্টিকের জুতাটা যেন রাগান্বিত হয়ে পায়ের চামড়ায় আঘাত করছে। পায়ের তালুতে একটা ফোসকা পড়েছিল, যেটা ততক্ষণে ফেটে গিয়ে ব্যথা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, সবারই একই দশা। কিন্তু সবাই কেমন চুপ এবং কোনো অভিযোগ করছে না।
পাকিস্তানের ১ হাজার ৪০০ মাইল বিস্তৃত কাটাছেড়া সীমান্তে কম করে হলেও ৪০০ অবৈধ পথ রয়েছে। সূর্যের আলো পরিষ্কার হয়ে এলে দেখতে পেলাম হিন্দুকুশ পর্বতের বিশাল ঢালু পথগুলো কীভাবে পাহাড়ি উপজাতিদের আপন করে নিয়েছে। এসব ক্ষিপ্রগতির চটপটে সাহসী লোকেরা কী নির্বিঘ্নেই না সীমান্ত পাড়ি দেয়। গজলা হরিণের কল্যাণে তারা খাড়া ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে সমতলের অধিবাসীদের আলস্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
দাউর বাবা পৌছে গেলাম। অল্প কয়েকজন নারী ও পুরুষ হাঁটাচলা করছিল। সারিবদ্ধভাবে উট ও গাধার সারির পিঠে চোরাই মাল, জিনিসপত্র ও মানুষ সীমান্ত পার হওয়ার অপেক্ষায়। শরণার্থীদের দেখা মিলল না। কয়েক দিন আগেও তোরখামে যে হাজার হাজার শরণার্থী ভিড় করেছিল, তাদের কী দশা হলো? কয়েকটি দল হয়তো দক্ষিণে কোয়েটার দিকে ঘুরে গেছে।
জান আরও একবার আমার কাঁধে টোকা দিলে আমি আবারও বসে পড়ি। জান আমার দিকে তাকিয়ে একটা মায়াভরা হাসি দিল। এ হাসির জন্য ওর বিগত সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া যায়।
কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বলতে থাকে, ইভন, এখন তুমি অনেকটাই নিরাপদ। চাইলে বোরকা খুলে ফেললা। তবে মাথায় একটা ঘোমটা জড়িয়ে নিলে ভালো। কাল রাতের ঘটনার জন্য আমি অতিশয় দুঃখিত। গরমে তোমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এখন দুর্ভোগের সময় শেষ। চাইলে এখন ছবিও তুলতে পারো, ২০ মিনিট পরই পাকিস্তানের সীমান্ত। যাত্রা হবে গাধার পিঠে চড়ে।
কথাগুলো শুনে আমি বেশ সময় নিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলি। গতকালকের শক্ত জুতোটা আরেকবার পায়ে গলাননা সম্ভব নয়। আমি চুপ করে বসেই রইলাম। বোরকাটা একটু তুলে নেওয়ায় মুখে একটা ফুরফুরে হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে।
সঙ্গের নারীটি তার বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে। একটা ছবি তুলতে চাইলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকেও কয়েকবার ক্যামেরা তাক করি। ব্যস্ত আর হইচইয়ের বাজারে চোরাকারবারি। ব্যবসায়ী, শরণার্থী আর। উপজাতিদের ভিড়। রঙিন ফিল্মে এই ব্যস্ততাও আটকে রাখার চেষ্টা করলাম।
জান আমাকে গাধার কাছে নিয়ে গেল। একটা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে গাধাটার পিঠে চড়ে বসি। চড়তে গিয়ে পরনের ট্রাউজারটার একটা পায়ের অংশ ওপরে উঠে গোড়ালি অনাবৃত হয়ে পড়ে। ভাগ্য ভালো, বাবার মোজাটা পরে নিয়েছিলাম। আমি কাপড় আর বোরাটা ঠিকঠাক করতে করতে গাধাটা হঠাৎ জোরে দৌড় দিল।
ফ্লেমিং নোরা, উত্তরাঞ্চলের ইংরেজি গালি আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল। বিগত দুই দিনে জনসম্মুখে এটাই আমার মুখ থেকে উচ্চারিত প্রথম শব্দ। আশপাশের সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। যদিও আমি যে ইংরেজিতে খিস্তি আওড়েছি, তা ধরতে পারেনি। তবে বোরকা পরিহিত একজন নারী উচ্চস্বরে কথা বলছে, এটাই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আফগান মেয়েদের প্রকাশ্যে কণ্ঠস্বর নেই। তাদের দাসের মতো অন্ধ অনুসরণ করতে হয়।
অধিকাংশ মানুষ যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমিও ঠিকমতো গাধার পিঠে বসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। সামনের দিকে ঝুঁকে লাগাম ধরতে গেলে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা গলায় ঝোলানো আমার ক্যামেরাটা বাইরে বেরিয়ে এসে। ব্যস, এক তালেবান সৈন্যের চোখ পড়ে ক্যামেরার দিকে। চিৎকার করে আমার দিকে আসতে আসতে আমাকে গাধার পিঠ থেকে নেমে আসতে নির্দেশ দেয়।
সৈন্যটির চেহারা আমি কোনো দিন ভুলব না। আমাকে গ্রেপ্তার অথবা হত্যার উদ্দেশ্য ছিল, এ জন্য নয়। তার চোখটা ছিল সবুজাভ পান্নার মতো। এমন চোখের মণি আমি কোনো দিন দেখিনি। অদ্ভুত মনে হতে পারে। সৈন্যটির ব্যক্তিত্বে আমি কিছুক্ষণের জন্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম।
আমাকে গাধার পিঠ থেকে নামিয়ে এনে ক্যামেরাটা ফেরত দেওয়ার কঠিন নির্দেশ দেয়। আমি দ্রুত ক্যামেরাটা দিয়ে দিই। সৈন্যটা গাধার মালিকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কিছু বললে মালিক জানের চাচার দিকে নির্দেশ করে। জানের চাচাকে কিছু প্রশ্ন করা হয়। এরপর সৈন্যটা তার মুখে জোরে এক ঘুষি মারে যে নাক দিয়ে রক্ত এসে যায়।
জান তার চাচাকে বাঁচানোর চেষ্টায় এগিয়ে যায়। সৈন্যটা তখনো চেঁচাচ্ছিল এবং চিৎকার করছিল। কিছু একটা বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছিল জান। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে চারপাশে প্রায় ২০০ কৌতূহলী জনতা ভিড় করে। সবার চেহারায় তখন প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনের আকাঙ্ক্ষা। আমি এক পা দুই পা করে পেছাতে থাকি। ধীরস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে এক সেকেন্ডের জন্য চিন্তা করলাম, সোজা সীমান্তের দিকে হাঁটা দিই। তালিবরা গাইডের দিকে বেশি নজর দিচ্ছিল। বোরকা গায়ে জড়ানো থাকায় আমি সহজেই ভিড়ের মধ্যে মিশে যাব। আমাকে তখন আলাদা করা সহজ হবে না।
সিদ্ধান্তটা বেশ কঠিন। আমি গাইডদ্বয়কে ছেড়ে যেতে পারি না। সঙ্গের নারীকে দেখলাম আস্তে করে সরে গিয়ে ভিড়ে মিশে যেতে। হট্টগোলের মধ্যে ঢুকে পড়ে সৈন্যটাকে আমার ক্যামেরাটা ফেরত দিতে বললাম।
সবুজ চোখের সৈন্যটার চোখে কেমন সন্দেহ আর অবিশ্বাস। লোকটা নিশ্চিত আমার কথা ভুলে গিয়েছিল আর এখন আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে অপরিচিত এক বাচনভঙ্গিতে কথা বলছি। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন তালেবান ঘটনাস্থলে চলে এল। একজন পশ্চিমা নারীকে দেখে তাদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, জনতা ইতিমধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেছে। সোনালি চুলের এক তালিব আমাকে ধরে একটা গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। ক্যামেরা ততক্ষণে তাদের হস্তগত।