বোম্বাইকা ডাকু
কয়েকদিন আগে পুণার একটা হোটেলে দহিবড়া খেতে ঢুকেছিলাম, আচারিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রায় কুড়ি বছর পরে দেখা। বম্বে টকীজে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, তারপর আচারিয়া যখন নিজের ফিল্ম কোম্পানী খুললেন তখন আমি বছর দেড়েক তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি চিত্রনাট্য লিখতাম, তিনি ছবি পরিচালনা করতেন।
দু’জনেরই চেহারার বদল হয়েছে, কিন্তু চিনতে কষ্ট হল না। আচারিয়া গুজরাতি, কিন্তু শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন, পরিষ্কার বাংলা বলেন। দু’জনে দহিবড়া খেতে খেতে পুরনো কালের অনেক গল্প করলাম। অনেক পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলাম। নানা কথার মধ্যে এক সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নর্সিং ভাই, সেই ঘটনাটা মনে আছে?’ ঘটনার উল্লেখ করলাম, তিনি উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন।
যেদিন ঘটনাটি ঘটেছিল সেদিন কিন্তু হাসেননি। আজ সেই কথা বলি।
আচারিয়া তখন নিজের ফিল্ম কোম্পানী করেছেন। প্রথম ছবি শেষ হবার পর দ্বিতীয় ছবি আরম্ভ হয়েছে। গল্পটি প্রসিদ্ধ লেখক পান্নালাল প্যাটেলের লেখা, আমি চিত্রনাট্য তৈরি করেছি।
শুটিং চলছে, কখনো দিনে কখনো রাত্রে। দিনের বেলা শুটিং থাকলে আমি মাঝে মাঝে শুটিং দেখতে যাই, কিন্তু রাত্রে যাই না। আমি থাকি মালাডে, শুটিং হচ্ছে দাদরের একটা স্টুডিওতে, আন্দাজ বারো মাইলের তফাত। রাত্রে শুটিং দেখা পোষায় না।
একবার রাত্রে শুটিং পড়েছে। তারিখটা মনে আছে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিন। আমি সেদিন গৃহিণীকে নিয়ে দাদরে সিনেমা দেখতে গেছি; দাদরে মাঝে মাঝে বাংলা ছবি আসে। ছবি শেষ হল আন্দাজ সাড়ে আটটায়। ভাবলাম নিজেদের ছবির কেমন শুটিং চলছে দেখে যাই।
আমার তখন একটা ছোট অস্টিন গাড়ি ছিল; তাইতে স্টুডিওতে যাতায়াত করতাম। সে-রাত্রে স্টুডিওতে পৌঁছে দেখি শুটিংয়ের তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড উঁচু টিনের চালাঘরে সেট বসেছে—গ্রাম্য একটি কুটির। চারিদিকে ওপরে নীচে তীব্র শক্তির আলো সাজানো হচ্ছে। কুটিরের দোরের সামনে ক্যামেরা বসেছে। আচারিয়া তদারক করছেন। অভিনেতারা মেক-আপ করতে গেছে। ন’টার সময় শুটিং আরম্ভ হবে, ভোর পর্যন্ত চলবে।
আমাদের দেখে আচারিয়া এগিয়ে এলেন, ‘আপনারা এসেছেন। আজ খুব ভাল শুটিং আছে, হিরো হিরোইন দু’জনেই থাকবে। দেখে যান।’
গৃহিণী কিন্তু রাজী হলেন না। বম্বে টকীজে তিনি অনেক শুটিং দেখেছেন, দেখে দেখে অরুচি ধরে গেছে। উপরন্তু বাড়িতে ছেলেরা আছে, মা ফিরে না গেলে তারা খেতে পাবে না।
আচারিয়া তখন আমাকে বললেন, ‘উনি বাড়ি যান, আপনি থাকুন। আজকের শুটিং একটু কঠিন, আপনি থাকলে আমার সাহায্য হবে।’
শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল। গৃহিণী মোটরে ফিরে যাবেন, আমি সারারাত থাকব, তারপর সকালবেলা লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফিরব।
গৃহিণী চলে গেলেন। আচারিয়া আর আমি স্টুডিওর ক্যান্টিনে গিয়ে নৈশ আহার সম্পন্ন করলাম। খেতে খেতে আচারিয়া বললেন, ‘আজ বড় ভয়ে ভয়ে আছি।’
বললাম, ‘ভয় কিসের?’
তিনি বললেন, ‘আজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাঁদর দেখেছি।’
‘তাতে কী হয়?’
‘বাঁদর দেখা ভারি খারাপ, সব কাজ ভণ্ডুল হয়ে যায়। আজ দুপুরবেলা আমার গাড়ির অ্যাক্সেল ভেঙেছে।’
সিনেমার লোকদের অনেক রকম কুসংস্কার থাকে। অশোককুমারের সামনে দিয়ে যদি কালো বেড়াল রাস্তা ডিঙিয়ে যায় সে আর এগুবে না। এমনি আরো অনেক আছে। সন্দেহ হল আচারিয়া আমাকে বাঁদরের অ্যান্ডিডোট হিসেবে ধরে রেখেছেন। হেসে বললাম, ‘রাম নাম করুন, সব বিপদ কেটে যাবে।’
শুটিং শুরু করতে সাড়ে ন’টা বাজল।
ছবির হিরোইন তখনকার দিনের যশস্বিনী অভিনেত্রী সর্দার বেগম। তিনি কুটির প্রাঙ্গণে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন; ক্যামেরা চালু হয়েছে, ঠকাস শব্দে ক্ল্যাপস্টিক পড়েছে, সর্দার বেগম অভিনয় আরম্ভ করেছেন, এমন সময়—
ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেল।
সবাই ক্যামেরা ঘিরে দাঁড়াল। ক্যামেরাম্যান এবং তার সহযোগীরা নানাভাবে ফন্দি-ফিকির খাটিয়ে ক্যামেরা আবার চালু করবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ক্যামেরা অটল, নট্ নড়ন চড়ন, নট্ কিচ্ছু। মঞ্চে ভিড় জমে গেল, কর্মীরা ছাড়াও অনেক লোক জুটে গেল। আচারিয়া গলদঘর্ম হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলেন। একবার কাতরভাবে আমার দিকে তাকালেন; তাঁর দৃষ্টির অর্থ—বলেছিলাম কিনা। বাঁদর দেখা কখনো মিথ্যে হয়!
দেড় ঘন্টা ধস্তাধস্তি করেও যখন ক্যামেরা চালানো গেল না তখন একজন সহকারী ক্যামেরাম্যান ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করছি।’ এই বলে সে ছুটে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি তখন এগারোটা বেজে গেছে। সর্দার বেগম একটি ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন। আমরা হতাশ মনে ভাবছি এতরাত্রে কোথায় গেল লোকটা, এমন সময় সে ফিরে এল। হাতে একটি ছোবড়া-ছাড়ানো আস্ত নারকেল। সে নারকেলটি দু’হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে মেঝের ওপর সজোরে আছাড় মারল; নারকেল ভেঙে খানিকটা জল বেরুল। তখন সে বলল, ‘চালাও ক্যামেরা।’
আশ্চর্য ব্যাপার! সুইচ টিপতেই ক্যামেরা চলতে আরম্ভ করল। সকলে হৈ হৈ করে উঠল। আচারিয়া সহকারী ক্যামেরাম্যানের পিঠ ঠুকে দিয়ে বললেন, ‘সাবাস!’
আবার শুটিং চালু হল।
কিন্তু বাঁদরের বাঁদরামি তখনো শেষ হয়নি।
রাত্রি একটা পর্যন্ত বেশ শুটিং চলল; তারপর হঠাৎ হিরোইনের পায়ে পেরেক ফুটে গেল। সেট তৈরি করার সময় কেউ অসাবধানে পেরেক ফেলে রেখেছিল; হিরোইন গ্রাম্য-সুন্দরী, তাই সর্দার বেগম খালি পায়ে অভিনয় করছিলেন; পেরেকটা তাঁর পায়ের চেটোয় বিঁধে গেছে।
আবার হৈ হৈ কাণ্ড। শুটিং বন্ধ হয়ে গেল। দু’জন সহকারী ডিরেক্টর হিরোইনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল। এখনি এ. টি. এস. ইন্জেক্শন দিতে হবে, দেরি করলে ধনুষ্টঙ্কার হতে পারে।
আচারিয়া ক্ষুব্ধভাবে ঘড়ি দেখে বললেন, ‘আজ আর কিছু হবে না, দেড়টা বাজে। সর্দার বাঈ এখন বোধ হয় তিন-চার দিন সেটে আসতে পারবেন না, শুটিং ক্যানসেল করে দিতে হবে। দেখলেন তো বাঁদরের কাণ্ড!’
‘তা তো দেখলাম, কিন্তু আমি এখন যাই কোথায়! রাত্রি দেড়টার সময় লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে, আবার সেই ভোরবেলা চালু হবে। ততক্ষণ কি ইস্টিশানে বসে হাপু গাইব?’
আচারিয়া সমস্যার সমাধান করে দিলেন, বললেন, ‘চলুন আমার বাসায়। গিন্নী বাপের বাড়ি গেছেন, বাসায় কেউ নেই। দু’জনে আরামসে শুয়ে থাকা যাবে। সকালে চা খেয়ে আপনি বাড়ি চলে যাবেন।’
ধড়ে প্রাণ এল। বললাম, ‘চলুন।’
আচারিয়ার বাসা স্টুডিও থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা, হেঁটে যাওয়া যায়। চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় ছোট একটি ফ্ল্যাট। আমি আগে এসেছি, বাড়িটাতে গোটা আষ্টেক ফ্ল্যাট আছে।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখলাম দরজার কাছে একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। লরিতে মালপত্র চাপানো রয়েছে, লোকজন কাউকে দেখলাম না।
বাড়ির দরজাটা বেশ চওড়া, ভেতরে ঢুকেই সিঁড়ি আরম্ভ হয়েছে; মাথার ওপর টিম টিম করে ন্যাড়া বাল্ব জ্বলছে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে আরম্ভ করলাম।
দোতলা পর্যন্ত উঠেছি, দেখলাম ওপর দিক থেকে একজন লোক নেমে আসছে; তার মাথায় একটা প্রকাণ্ড হোলড্-অল, হাতে বেশ পুরুষ্টু গোছের একটা স্যুটকেস। একটু আশ্চর্য মনে হল। রাস্তায় লরি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশ্চর্য হইনি, এখন সপ্রশ্ন চক্ষে আচারিয়ার দিকে চাইলাম। এত রাত্রে কেউ কি ট্রেন ধরতে যাচ্ছে?
সিঁড়িতে জায়গা কম। আচারিয়া পাশের দিকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, লোকটি মোটঘাট নিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে নীচে গেল। আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম। আচারিয়া বললেন, ‘বোধ হয় কেউ বাসা বদল করছে। আজ তিরিশে সেপ্টেম্বর কাল নতুন মাস আরম্ভ হবে, তাই ভোর হবার আগেই বাসা ছেড়ে দিচ্ছে।’
‘তাই হবে।’
তেতলায় উঠে বাঁ দিকে আচারিয়ার ফ্ল্যাট। তিনি পকেট থেকে চাবি বার করে দোর খুলতে গিয়ে চমকে উঠলেন—এ কি! তালা খোলা!
এক ধাক্কায় দরজা খুলে তিনি ঘরে ঢুকলেন, দোরের পাশে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন, তারপর হতভম্ব হয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘরে কিছু নেই। খাট বিছানা চেয়ার টেবিল সব অদৃশ্য হয়েছে। পাশের ঘরটা ভাঁড়ার এবং রান্নাঘর, সেখানে হাঁড়িকুড়ি কিছু নেই। চোর যথাসর্বস্ব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।
এই সময়ে নীচে রাস্তা থেকে লরির ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। আমরা দু’জনেই ছুটে গিয়ে রাস্তার ধারের জানলায় দাঁড়ালাম। উঁকি মেরে দেখলাম মাল-বোঝাই লরিটা গুরুগম্ভীর শব্দ করে চলে গেল।
আচারিয়া সেই দিকে গলা বাড়িয়ে চেয়ে রইলেন, তারপর লরি যখন অদৃশ্য হয়ে গেল তখন আমার দিকে ফিরে পাংশু মুখে বললেন, ‘যাঃ! বেটা সব নিয়ে চলে গেল!’
বুঝতে বাকি রইল না, চোর লরি নিয়ে চুরি করতে এসেছিল, চোরের সঙ্গে সিঁড়িতে আমাদের দেখাও হয়েছিল, কিন্তু তার স্বরূপ চিনতে পারিনি। আচারিয়া নিজের হোলড্-অল এবং স্যুটকেস চিনতে পারেননি।
বাঁদর যে এমন সাংঘাতিক জীব তা কে জানত।
কিন্তু—অলমিতি বিস্তরেণ।
সে-রাত্রে মেঝের ওপর খবরের কাগজ পেতে আমরা শুয়েছিলাম।
৩০ মে ১৯৬৩