বোমা
আর সাড়ে পাঁচ মিনিট! আর মাত্র সাড়ে পাঁচ মিনিট আছে তাঁর হাতে৷ তারপরই বিস্ফোরণ! সব শেষ৷ দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার উপশম! যে জ্বালায় এতদিন ধরে ধিকিধিকি জ্বলে এসেছেন; তার পরিসমাপ্তি ঘটবে আজই! ঠিক আর সাড়ে পাঁচ মিনিট পরে!
মেজর রবার্ট ডিমেলো বসেছিলেন তাঁর আরামদায়ক ইম্পোর্টেড সোফায়৷ উল্টোদিকে স্যাভিয়েল ও শ্যারন৷ সামনে কাচের সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা আছে ধোঁয়া-ওঠা ফিশফিঙ্গার, রেশমি কাবাব, স্যালাড ও নানারকমের ভাজাভুজি৷ তার সঙ্গে শোভা পাচ্ছে দামি কাচের গ্লাসে তরল৷ আজকের প্রস্তুতির সবটা নিজেই করেছে শ্যারন৷ বড় সযত্নে, নিজের হাতে করেছে৷ সে একাধারে ভালো প্রেমিকা, ভালো স্ত্রী, ভালো রাঁধুনি, ভালো গৃহিণী, ভালো মা, আবার অন্যদিকে শহরের রীতিমতো নামকরা হেয়ার স্টাইলিস্টও বটে৷ পার্কস্ট্রিটের এক বিরাট অভিজাত স্যালোঁ-র মালকিন৷ ব্যবসাটাও খুব ভালো বোঝে৷ সংসার, সন্তান ও ব্যবসা সে সমান দক্ষতায় দশভূজার মতো সামলায়৷ কিন্তু আর সাড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার এই দায়িত্বপূর্ণ ব্যস্ত জীবনেও যবনিকা পড়ে যাবে চিরদিনের জন্য! ছুটি পেয়ে যাবে শ্যারন৷
‘রবার্ট? তুমি আরেকটু স্ন্যাকস নেবে?’
শ্যারনের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পেলেন মেজর ডিমেলো৷ তাঁর পিঙ্গল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘কী হয়েছে রবার্ট? এনি প্রবলেম?’
মুহূর্তের মধ্যে সতর্ক হয়ে গিয়েছেন তিনি৷ বুঝতে দেওয়া যাবে না! কিছুতেই ওদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে এই মুহূর্তে কী পরিমাণ স্নায়বিক চাপে আছেন রবার্ট৷ একটু একটু করে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, আর প্রহর গুনছেন সেই অন্তিম মুহূর্তের৷
‘সুন্দরী, তুমি হাতে করে বিষ দিলেও খেতে পারি! এমনকি আমার রাইফেল থেকে গোটা দুয়েক গুলি মেরেও দেখতে পারো৷ চুপচাপ বিনা প্রতিবাদে খেয়ে নেব!’ রবার্ট হেসে উঠলেন, ‘স্ন্যাকস তো কোন ছার!’
শ্যারনের আইভরির মতো ফর্সা গালে লজ্জারুণ আভা উঠে এল! মাথা নীচু করে মৃদু স্বরে বলল, ‘ফ্লার্টমাস্টার!’
রবার্ট এবার আরও জোরে হেসে উঠেছেন, ‘আরে, অমন পরস্ত্রীর মতো লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি তো তোমার হাজব্যান্ড! তোমার সঙ্গে ফ্লার্ট করব না তো কি ও পাড়ার বিশের পিসির সঙ্গে করব?’
বলতে বলতেই রবার্ট ফের অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন৷ পরিকল্পনামাফিক চলছে সবটাই৷ ওঁদের একমাত্র মেয়ে ন্যান্সি তার এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টিতে গিয়েছে৷ ফিরতে রাত হবে৷ যদিও রবার্ট জানেন বেশিক্ষণ পার্টি এনজয় করতে পারবে না ন্যান্সি৷ দুর্ঘটনার খবর শুনে তাকে চলে আসতেই হবে৷ তবু প্রাণটা বেঁচে যাবে ওর! একটিও নিরপরাধ প্রাণী এই বিস্ফোরণে মারা যাক, তা চাননি রবার্ট৷ তাই ন্যান্সি রয়েছে নিরাপদ জায়গায়৷
‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য নাইস ইভনিং!’ রবার্টের উলটো দিকের সোফায় বসে থাকা আজকের বিশেষ অতিথি, স্যাভিয়েল নেশাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ফিশফিঙ্গারটা ভীষণ ভালো হয়েছে৷ কাবাব তো মাইন্ডব্লোইং! আপনি খুব লাকি স্যার, যে এমন হাতের রান্না রোজই খেয়ে থাকেন! আমাদের তো স্রেফ শুকনো ব্রেড, কিংবা কয়েক টুকরো সসেজ খেয়েই দিন চালাতে হয়! ব্যাচেলর্স ডেন, এ আর কী পাওয়া যাবে?’
রবার্ট মুচকি হাসলেন, ‘তাহলে একটা বিয়ে করে ফেল! দেখবে আর কোনও প্রবলেম থাকছে না! রোজ ভালো-মন্দ খেতে পাচ্ছ!’
‘বিয়ে!’ স্যাভিয়েল চোখ কপালে তুলে ফেলল, ‘পাগল! সবাই কি আর শ্যারনের মতন? আজকালকার মেয়েদের আপনি চেনেন না স্যার! তারপর দেখা যাবে আমাকেই হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হচ্ছে, আর আমার বৌ ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে খাচ্ছে!’
রবার্ট সজোরে হেসে উঠলেন, ‘না না! মেয়েরা অত ভয়ংকর প্রাণীও নয়! অবশ্য একথা মানছি যে শ্যারনের মতোন স্ত্রী লাখে একটা মেলে! কিন্তু তবু বাজি রেখে বলতে পারি, বিবাহিত জীবন অতি মধুর৷’
স্যাভিয়েল মিষ্টি হাসে, ‘এই পাইকারি হারে ডিভোর্সের সময় আপনার মুখে ম্যারেড লাইফের প্রশস্তি শুনতে বড় ভালো লাগছে স্যার!’
‘তার কারণ আমি খুব লাকি৷’ রবার্ট শ্যারনের হাত ধরলেন, ‘আমার জীবন-সঙ্গিনী আমায় খুব ভালোবাসে৷ ভালোবাসা যে কী জিনিস, তা শুধু সে-ই জানে, যে পেয়েছে!’
শ্যারন মুখ নীচু করে সলজ্জ হাসল৷ স্যাভিয়েলের মুখের হাসিটা কেমন যেন ব্যঙ্গ বঙ্কিম ঠেকল রবার্টের! ওর সকৌতুক দৃষ্টি যেন বলতে চায়, ‘তাই বুঝি? সত্যিই কি তুমি ভালোবাসা পেয়েছ? গোটাটাই প্রতারণা নয়তো?’
হ্যাঁ৷ প্রতারণাই তো! স্যাভিয়েল আর শ্যারন তো মাসের পর মাস ধরে তাঁকে প্রতারণা করে চলেছে! ওরা কী ভাবে! মেজর ডিমেলো একটা আকাট মূর্খ! কিছুই বুঝতে পারবেন না? বিগত ছ’মাস ধরে শ্যারন তাঁকে ঠকাচ্ছে! ওর চলনে, বলনে পরিবর্তন এতটাই সুস্পষ্ট যে একজন অন্ধও বুঝতে পারবে৷ আর মেজর ডিমেলো তো একজন রীতিমতো চক্ষুষ্মান, সতর্ক ব্যক্তি! শ্যারন কী করে ভাবল যে স্যাভিয়েলের সঙ্গে তার গুপ্ত প্রেম ওঁর চোখে পড়বে না!
মেজর ডিমেলো স্যাভিয়েল আর শ্যারণের দিকে তাকিয়েছিলেন৷ আজ, এই সন্ধ্যাটা তো ওদের জন্যই বেছে নিয়েছেন তিনি৷ এই জন্যই তো স্যাভিয়েলকে নিমন্ত্রণ করেছেন৷ অনেক ভেবে-চিন্তে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন৷ যখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, তখন মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল৷ ভেবেছিলেন রাইফেলটা বের করে দুজনকেই গুলি করে মারবেন! কিন্তু পারেননি৷ যতবার ভেবেছিলেন, ততবার তাঁর হাত কেঁপেছিল! শ্যারন! ওঁর দীর্ঘ কুড়ি বছরের সঙ্গিনী! ন্যান্সির মা! ওঁর জীবনের একমাত্র প্রেম! একটা মানুষ সারাজীবনে যতখানি ভালোবাসতে পারে, তার চেয়েও বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন উনি শ্যারনকে! সেই শ্যারনকে কীভাবে নিজের হাতে গুলি করবেন! অসম্ভব! তাছাড়া ন্যান্সি কী জানবে? যে বাবা-মায়ের অতলান্তিক প্রেমের নিদর্শন সে দেখে এসেছে, সেখানে তাকে জানতে হবে যে তার মা একজন বিশ্বাসঘাতিনী! ওর বাবা একজন খুনি!
অগত্যা পরিকল্পনা বাতিল করতে হল৷ রোজ সকালে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছেন, শ্যারন সুন্দর করে সেজেগুজে বেরোচ্ছে! রোজ রাতে অস্থির চিত্তে দেখেছেন, একটা গাড়ি চুপিসারে এসে নামিয়ে দিয়ে গেল ওকে৷ গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল স্যাভিয়েল৷ নিবিড় আলিঙ্গন করে আলতো চুম্বন এঁকে দিল শ্যারণের কপালে৷ তারপর গাড়ি নিয়ে হুশ করে চলে গেল!
মেজরের বুকের ভেতর তখন টিপটিপে রক্তক্ষরণ! কে এই স্যাভিয়েল! শ্যারন বলেছিল, স্যাভিয়েল ওর কলেজের বন্ধু৷ বহুবছরের বন্ধুত্ব ওদের৷ কিন্তু বিয়ের পরে আর যোগাযোগ ছিল না৷ হঠাৎ একদিন পার্কস্ট্রিটের স্যালোঁ-তে আবার দুজনের দেখা হয়ে যায়৷ স্যাভিয়েল চুল স্টাইল করতে এসেছিল৷ সেখানেই ফের যোগাযোগ৷ কিন্তু সম্পর্কটা আর ক্লায়েন্টের সীমার মধ্যে রইল না! স্যাভিয়েলের সঙ্গে প্রায়ই কফিশপে যেতে শুরু করল শ্যারন৷ কখনও রেস্টোরেন্টে, কখনও পাবে! না, এগুলোর কোনওটাই মেজর নেহাতই কল্পনা করেননি৷ তাঁর পরিচিত দু-একজন ওদের দেখে ফেলেছিল৷ তারাই এসে বলেছে ওঁকে!
মেজর প্রথমে বিশ্বাস করেননি৷ কিন্তু এরপর একদিন স্বচক্ষে দেখলেন! শ্যারণের সঙ্গে দেখা করতে স্যালোঁয় গিয়েছিলেন! শ্যারনকে কিছুই বলেননি৷ ইচ্ছে ছিল ওকে চমকে দেওয়ার!
কিন্তু যা দেখলেন, তাতে নিজেই চমকে গেলেন! ওঁর চোখের সামনে স্যালোঁর গেট খুলে বেরিয়ে এল শ্যারন আর স্যাভিয়েল৷ হাত ধরাধরি করে! ঠিক যেন সদ্য প্রেমে পড়া দুই যুবক-যুবতী! রাস্তার ওপরে দুজন নির্লজ্জভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ শ্যারন স্যাভিয়েলের চুল আদর করে ঘেঁটে দিচ্ছে৷ আর স্যাভিয়েলও ছদ্মরাগে সেটা উপভোগ করছে! মেজরের মনে হচ্ছিল, ওঁর গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! পড়পড় করে পুড়ে যাচ্ছে হৃদয়! চোখদুটো বুঝি এখনই জ্বলে পুড়ে গলে বেরিয়ে আসবে…! মনে হচ্ছিল, এখনই তিনি একটা বোমার মতোন ফেটে পড়বেন! বিস্ফোরণে উড়ে যাক সবকিছু! সমস্ত দুনিয়া, সমস্ত মানুষ জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাক এই মানববোমায়…!
কিন্তু সেদিন তিনি ফেটে পড়েননি৷ বরং নিশ্চুপে চলে এসেছিলেন বাড়িতে৷ কিন্তু আজকে ফাটবেন! মেজর ঘড়ি দেখলেন! আর মাত্র তিন মিনিট! স্যাভিয়েল আর শ্যারন তখন হাসিমুখে নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা চালাচ্ছে৷ স্যাভিয়েলের নেশা বেশ চড়েছে৷ দামি হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে ঘনঘন! মেজরের হাসি পেল৷ ওরা জানেও না যে সামনে বসে থাকা মানুষটির কোটের ভেতরে, বুকের একদম কাছে টিকটিক করছে একটা বম্ব! আর ঠিক তিন মিনিট পরেই বোমাটা ফাটবে! ছাই হয়ে যাবেন মেজর! ছাই হয়ে যাবে শ্যারন এবং স্যাভিয়েলও! ছাই হয়ে যাবে ওদের প্রেম! নিজে তো মরবেনই, ওদেরও মারবেন৷ মিলিটারিতে থাকাকালীন অনেক জঙ্গিদলের নেতাদের মেরেছেন তিনি৷ তাই সকলেই ভেবে নেবে যে কোনও জঙ্গি সংগঠনই প্রতিশোধ নিতে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে৷ ন্যান্সিও তাই ভাববে৷ স্বপ্নেও সে কল্পনা করতে পারবে না যে এই ষড়যন্ত্র স্বয়ং তার বাবারই করা! কারোর নামে কোনও কলঙ্ক লাগবে না!
পরিকল্পনাটা জবরদস্ত৷ তবে কঠিন ছিল বোমাটা জোগাড় করা! এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় বোমাবাজ বিল্লার কাছে যেতে হয়েছিল তাঁকে৷ বিল্লা কয়েকবছর আগেও বম্ব-এক্সপার্ট ছিল৷ তার তৈরি বম্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিফিউজ করা যেত না৷ বম্ব স্কোয়াডকে সে রীতিমতো হিমশিম খাইয়ে ছাড়ত! কিন্তু এরকমই একদিন বম্ব তৈরি করার সময় তার অসতর্কতাবশত একটা বিস্ফোরণ ঘটে৷ কপালজোরে বিল্লা প্রাণে বেঁচে গেলেও ওর গোটা মুখটা গিয়েছিল পুড়ে৷ পা দুটোও উড়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণে৷ তারপর থেকে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে আর কখনও বোমা বানাবে না৷ কিন্তু মেজর অনেক ভেবেচিন্তে তারই শরণাপন্ন হলেন৷ কোনও ভূমিকা না করেই বললেন, ‘বিল্লা, আমার একটা মারাত্মক টাইমার বম্ব চাই৷ তুই যত টাকা চাইবি, দেব৷ কিন্তু বম্বটা ডিফিউজ করার সাধ্য যেন কারোর বাপেরও না থাকে!’
বিল্লার পোড়া মুখে আতঙ্কের ছায়া পড়ে, ‘কী বলছেন স্যার! আমি তো বম্ব আর তৈরি করি না৷ আমার বৌ মাথার দিব্যি দিয়েছে! এ ক’বছর আমি একটা বোমাও তৈরি করিনি!’
‘তাহলে দিন কাটে কী করে?’ মেজর ডিমেলো জানতে চেয়েছেন, ‘খাস কী?’
বিল্লা উদাস দৃষ্টিতে ওর ক্রাচদুটোর দিকে তাকায়, ‘কী আর করব স্যার! বলতে লজ্জা করে৷ তবে এখন আমি ভিক্ষা করি৷’
‘হুম৷’ মেজর কিছুক্ষণ ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘শোন বিল্লা, আমার জন্য তোকে একটা বম্ব তৈরি করতেই হবে! যদি না করিস তবে আমি মিথ্যে মামলায় তোকে ফাঁসাব৷ পুলিশের কাছে মিথ্যে বয়ান দেব যে তুই আমার বাড়িতে বম্ব প্ল্যান্ট করে আমায় মারার হুমকি দিয়েছিস৷ তারপর কী হবে তা তুই ভালোই জানিস৷’
বিল্লা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়৷ মেজর স্থির দৃষ্টিতে তাকে কিছুক্ষণ মাপলেন৷ সে ভয় পেয়েছে বুঝে খানিকটা আশ্বস্তও হলেন৷ তারপর বললেন, ‘আর যদি তুই বম্বটা তৈরি করে দিস, তবে এত টাকা পাবি যে তোকে জীবনেও আর ভিক্ষা করতে হবে না৷ নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে শান্তিতে, আয়েশ-আরাম করে জীবন কাটাবি৷’
বিল্লা শুকনো ঠোঁট চাটল৷ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমার নাম আসবে না তো?’
‘আসবে না৷’ একতাড়া নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন মেজর, ‘এই নে, এতে দশ লাখ টাকা আছে৷ অ্যাডভান্স৷ বাকি দশ লাখ মাল ডেলিভারির সময় পাবি৷’
বিল্লা আর আপত্তি করেনি৷ বরং মেজরের কথামতনই সে একটা টাইমার বম্ব তৈরি করে আজ সকালেই টাইমার সেট করে ডেলিভারী দিয়েছে৷ জিনিসটা দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন মেজর৷ বিল্লার হাতে জাদু আছে! এই চকচকে বম্বটাকে ডিফিউজ করার সাধ্য কারোর নেই৷ কেউ পারবে না এই ভয়ংকর মারণাস্ত্রকে বিফল করতে!
এই মুহূর্তে মেজরের ঠিক বুকের কাছে উষ্ণ স্পর্শ ছড়াচ্ছে সেই টাইমার বম্ব! তাঁর হৃৎস্পন্দনের তালে তালে টিকটিক করছে! মৃত্যুভয় তাঁর মনের মধ্যে একমুহূর্তের জন্যও থাবা বসাতে পারেনি৷ তাঁর ইস্পাত-কঠিন সঙ্কল্পে সামান্যতমও দুর্বলতা আনতে পারেনি৷ যেদিন শ্যারণের সঙ্গে স্যাভিয়েলকে দেখেছিলেন, সেদিনই তো মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল মেজর রবার্ট ডিমেলোর! আজ নেহাতই তাঁর আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর দিন! তাই আজ ওঁর মস্তিষ্ক বরফের মতো ঠান্ডা! যা করছেন, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ কিংবা অনুতাপ নেই৷
‘রবার্ট!’ শ্যারন ডেকে ওঠে, ‘কী ভাবছ তখন থেকে বলো তো? স্যাভি তোমার কানের কাছে বকবক করে মরছে! কিন্তু তুমি শুনছই না!’
মেজর আবার সতর্ক হয়ে ওঠেন৷ মুচকি হেসে বলেন, ‘না তো, সবই তো শুনছি৷’
আর মাত্র একমিনিট! স্যাভিয়েলের ততক্ষণে নেশা চড়ে গিয়েছে৷ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ও আর হুঁশে নেই৷ সে স্খলিত স্বরে বকবক করে চলেছিল৷ এতক্ষণ ধরে কী বলছে তা খেয়াল করেননি মেজর৷ এবার খেয়াল করলেন৷ স্যাভিয়েল তখন বলে চলেছে, ‘আপনি সত্যিই ভাগ্যবান স্যার৷ শ্যারণের মতো স্ত্রী পেয়েছেন৷ ভালোবাসা পেয়েছেন! আমার জীবনে কোনওদিন ভালোবাসা জুটল না৷ কোনওদিন জুটবেও না! ওহ গড! আই অ্যাম সো লোনলি!’
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেছে সে৷ আড়চোখে ওর দিকে তাকালেন মেজর! ন্যাকা! পরের স্ত্রীকে নিয়ে খেলায় মেতেছ! আমার শ্যারনকে ছিনিয়ে নিয়েছ আমার কাছ থেকে! আর এখন বলছ, তুমি একা! ন্যাকামি হচ্ছে!
‘আই অ্যাম কার্সড স্যার! আই অ্যাম কার্সড! আমি অভিশপ্ত!’ হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল স্যাভিয়েল, ‘আমার সব বয়ফ্রেন্ড আমায় ধোঁকা দিয়ে চলে যায়! সব প্রেমিক আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে! আই অ্যাম সো লোনলি! সো লোনলি…!’
নেশার ঝোঁকে কী সব যা তা বকছে ছেলেটা! মেজর বিরক্ত হলেন৷ গার্লফ্রেন্ডকে বয়ফ্রেন্ড বলছে৷ তিনি শুধরে দিলেন, ‘স্যাভিয়েল, বয়ফ্রেন্ড নয়; গার্লফ্রেন্ড! প্রেমিক নয়, প্রেমিকা!’
‘নো নো স্যার!’ সজোরে চেঁচিয়ে ওঠে সে, ‘অ্যান এম্ফ্যাটিক নো! আমি কোনও মেয়েতে ইন্টারেস্টেড নই! আমি পুরুষে আসক্ত! সেজন্যই তো বলছি; আই অ্যাম কার্সড! আই অ্যাম…আই অ্যাম…আই অ্যাম…!’ কোনওমতে তোতলাতে তোতলাতে স্যাভিয়েল শেষ করল বাক্যটা, ‘আই অ্যাম আ গে!’
আর কুড়ি সেকেন্ড! বোঁ করে ঘুরে গেল মেজরের মাথাটা! কী বলছে স্যাভিয়েল! ও সমকামী! মেয়েদের প্রতি ওর কোনও আসক্তি নেই! তবে শ্যারন…?
‘শ্যারন আমার খুব ভালো বন্ধু স্যার!’ স্যাভিয়েল বলল, ‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷ একমাত্র ও-ই জানে যে আমি কী! আমার মা, আমার পরিবার, কেউ কিছু জানে না! তাই সব কিছুই ওর সঙ্গে শেয়ার করি আমি৷ আমার দুঃখটা একমাত্র ও-ই বোঝে!’
আর দশ সেকেন্ড! তারপরেই হবে বিস্ফোরণ! মেজর হতবুদ্ধির মতো বসে আছেন৷ কী করবেন বুঝতে পারছেন না! একবার তাকালেন শ্যারণের দিকে৷ শ্যারণ বিষণ্ণ মুখে মাথা ঝাঁকায়৷ অর্থাৎ স্যাভিয়েল যা বলছে তা সত্যি! ওদিকে বুকের কাছে টিকটিক করছে টাইমার বম্ব! কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে! দশ…নয়… আট…সাত…ছয়… পাঁচ… চার …তিন…দুই…! কী মর্মান্তিক ভুল! কী মর্মান্তিক…!
তিনি চোখ বুঁজে ফেললেন! তাঁর বুকের মধ্যে প্রবল আন্দোলন৷ বুক কাঁপিয়ে একটা অসহ্য ব্যথা টের পেলেন! তার সঙ্গে এও টের পেলেন যে তিনি আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যাচ্ছেন! নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে…!
আর কিছু বোঝার আগেই সোফা থেকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মেজর ডিমেলো!
এর ঠিক ঘণ্টাখানেক আগের কথা৷
বিল্লা বেরোনোর সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে৷ মেজরের দেওয়া টাকার বান্ডিলগুলো ব্যাগে ভরছে দ্রুত৷ হাতের কাছে যা পেল শশব্যস্তে গুছিয়ে নিল দুটো বাক্সে৷ তার কাজ করার ধরনেই স্পষ্ট যে সে পালাচ্ছে!
‘গোমতী! তাড়াতাড়ি কর৷ হাতে একদম সময় নেই!’ সে গলার স্বর চড়িয়ে স্ত্রীকে ডাকে৷
তার স্ত্রী গোমতী তৈরি হচ্ছিল৷ স্বামীর তাড়া খেয়ে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘এত তাড়া দিচ্ছ কেন? আর তা ছাড়া আমরা যাচ্ছিই বা কোথায়?’
‘তোর বাপের বাড়িতে৷’
‘কিন্তু কেন?’
‘আঃ!’ সে বিরক্ত হয়, ‘অত বলার সময় নেই৷ পথে যেতে যেতে সব বলব৷ এখন চল৷’
গোমতী তার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘চলো, আমি তৈরি৷’
তাড়াতাড়ি ক্রাচদুটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিল্লা! সঙ্গে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে গোমতী৷ মেজর ডিমেলো ওর হদিশ আর কখনও পাবেন না! ভাবতেই ভীষণ হাসি পেল তার! মেজর এখনও জানেন না কী নিয়ে গিয়েছেন৷ তবে অচিরেই জানবেন! গোমতীকে ছুঁয়ে ও প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে আর কোনওদিন বম্ব বানাবে না! কিন্তু মেজরের শাসানিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল! তা ছাড়া অতগুলো টাকার লোভও ছাড়তে পারেনি৷ তবু গোমতীকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার মান রেখেছে! এমন বোমা বানিয়েছে যা দেখতে অবিকল টাইমার বম্বের মতোন৷ টাইমারও আছে! কিন্তু আর কিছু নেই৷ ও বোমা জীবনে ফাটবে না! কারণ ওর ভেতরে কিছুই নেই৷ টাইমার টিকটিকিয়ে একসময় থেমে যাবে৷ আর কিচ্ছু হবে না!
ভাবতেই একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে! আর কোনওদিন ও শহরে ফিরবে না৷ ওর কাছে এখন কড়কড়ে কুড়ি লাখ টাকা৷ তাই দিয়েই গ্রামে জমি কিনবে৷ চাষবাস করবে৷
কিন্তু আর কোনওদিন বোমা তৈরি করবে না! কোনওদিনও না!
—