বোড়ালের সেই রাত

বোড়ালের সেই রাত

তিরিশ বছর আগেকার কথা। চব্বিশ পরগনা জেলার বোড়াল গ্রামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। তার নাম কমলেশ। কী একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে আমরা তিন বন্ধু গিয়েছিলাম কমলেশদের বাড়িতে। অজয়, সুশান্ত এবং আমি।

এখনকার বোড়াল গ্রামকে দেখে তখনকার সেই গ্রামের কথা কিন্তু কল্পনাও করতে পারবে না কেউ। সেই প্রবীণ মানুষদের যদি কেউ এখনও বেঁচে থাকেন, তা হলে তিনিই বলবেন, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। এই গ্রামের গাছপালা তখন এত ঘন ছিল যে, বাইরে থেকে দেখে এটাকে তখন কোনও গ্রাম নয়, একটা দুর্ভেদ্য জঙ্গল বলেই মনে হত।

যাই হোক, ওখানে গিয়ে বিকেলের দিকে গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াবার সময় হঠাৎ গ্রামের প্রান্তে একটি ভাঙা বাড়ি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী চমৎকার বাড়ি কোনও রাজা-মহারাজার ছিল বোধ হয়। কিন্তু এখন তার এমনই হতশ্রী চেহারা যে, দেখলে দুঃখ হয়। বসবাসের অযোগ্য তো বটেই, বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, এত জায়গা থাকতে এই গ্রামের ভেতর কবে কোন মান্ধাতার আমলে কে যে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন তা কে জানে? সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার এই যে, বাড়িটি পরিত্যক্ত এবং বসবাসের অযোগ্য হলেও এর কাঠামো এমন মজবুত যে, একে সারালে আবার এ তার পূর্ব রূপ ফিরে পাবে। ছাদের আলসের কার্নিস এখনও অক্ষত। অর্থাৎ, ভাঙা বাড়ি কিন্তু ধ্বংসস্তূপ নয়। পরিত্যক্ত বাড়ি, তবু ফেলে দেওয়ার নয়।

বাড়িটার দিকে কৌতূহলী চোখে চেয়ে থেকে পায়ে-পায়ে সেদিকে এগোতেই বাধা দিল কমলেশ। হাত ধরে বলল, “আর না বন্ধু। আর এগিয়ো না।”

“কেন?”

“বাড়িটার একটু বদনাম আছে।”

“সে তো সব বাড়িরই থাকে। যেখানে যত পোড়ো বাড়ি আছে সবেরই বদনাম। তাই বলে এমন চমৎকার বাড়িটাকে একবার ভেতরে ঢুকে দেখা যাবে না?”

“কেউ ঢোকে না ও-বাড়িতে।”

“কেন, ভূতের ভয়ে? ওই বাড়ির ভেতরে ঢুকলে ভূতে গলা টিপে মারবে?”

“ঠিক তাই। ভূতে এসে গলা টিপে মারবে কিনা জানি না, তবে ভূতের বাড়ি ওটা।”

“ভূতের বাড়ি!” আমরা হো-হো করে হেসে উঠলাম।

এর পর যা হয়ে থাকে সচরাচর, এক্ষেত্রেও তাই হল। অর্থাৎ কিনা আমরা নানারকম ঠাট্টা, তামাশা, বিদ্রূপ, এইসব করতে লাগলাম কমলেশকে।

কমলেশ একটুও উত্তেজিত হল না। বরং হেসে বলল, “দ্যাখ ভাই, আমরা গ্রামে থাকি। তোরা তো আমাদের মানুষের মর্যাদা দিস না। ভাবিস কুসংস্কারে আচ্ছন্ন কিছু দু’ পেয়ে জীব বুঝি ওগুলো। কিন্তু জেনে রাখ, যা বলছি তা মিথ্যে নয়। সাহস থাকলে পরীক্ষা করে  দেখিস। অবশ্য পরীক্ষা না করাটাই ভাল। কারণ তোদের মতো গোঁয়ার-গোবিন্দ যে দু-একজন পরীক্ষা করতে গেছে তারা এমন শিক্ষা পেয়েছে যে, আর এমুখো হয়নি।”

অজয় বলল, “তাই নাকি! তা হলে তো পরীক্ষা করতেই হচ্ছে। অবশ্য তোর কথা যে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি তা নয়, তবে কি জানিস, যেখানেই যাই, যে-গ্রামেই যাই, পোড়ো বাড়ি দেখলেই শুনি ভূতের উপদ্রবের কথা। মাঠের মাঝখানে বেলগাছ থাকলেই শুনি সে-গাছে নাকি ব্ৰহ্মদৈত্য আছে। আর মাছভর্তি পুকুর দেখলেই শুনতে পাই, এর পাড়ে রাতদুপুরে ভূত ঘোরে। যারা মাছ ধরে তাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে মাছ চায়। কাজেই এই ব্যাপারগুলোতে আর আমাদের আস্থা নেই। তাই ভাবছি, তোদের দেশের এই পোড়ো বাড়িতে এক রাত কাটিয়ে ভূত জিনিসটা আসলে কী, তা একবার দেখে যাই।”

কমলেশ বলল, “না। তোদের মতো অবিশ্বাসী ছেলেদের এদিকে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।”

আমি বললাম, “খুব রেগেছিস মনে হচ্ছে?”

“রাগের কী আছে?”

সুশান্ত বলল, “বেশ তো, আমরা কোনও পরীক্ষা চাই না। শুধু গোঁয়ার্তুমি করে এক রাত এই বাড়িতে থাকতে এসে উচিত শিক্ষা পেয়েছে এমন একজনের সঙ্গেই অন্তত আমাদের পরিচয় করিয়ে দে।”

কমলেশ এবারে আমতা-আমতা করতে লাগল।

সুশান্ত বলল, “তার মানে এমন কারও নামও তোদের জানা নেই, যে-লোকটা প্রত্যক্ষদর্শী, যে কিছু একটা বলতে পারে। অথচ অতবড় বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি আখ্যা দিয়ে চোর-ডাকাতের ঘাঁটি করে রেখেছিস তোরা। “

আমি বললাম, “আজ রাত্রেই এর রহস্য উন্মোচন করতে চাই আমরা।”

কমলেশ বলল, “দোহাই, আজ নয়। একটা কাজের বাড়িতে এসেছিস, খেয়েদেয়ে আনন্দ করে যা। পরে যখন হোক, যেদিন হোক, আসবি। কথা দিচ্ছি, আমি নিজে সাহায্য করব তোদের।”

“বেশ, তাই হবে। নতুন একটা অ্যাডভেঞ্চারের মনোভাব নিয়েই আর একবার এখানে আসব আমরা। তখন যা হয় হবে।”

বেলা গড়িয়ে আসছে তখন। আমরা আর ওই ভুতুড়ে বাড়ির দিকে না এগিয়ে অন্য পথ ধরলাম।

মাসখানেক পরে আবার একদিন কমলেশের সঙ্গে ওদের গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হলাম আমরা। ওর বাড়ির লোকেরা তো দারুণ আপত্তি করলেন আমাদের মতলব শুনে। সবাই অনেক করে বোঝালেন এই কাজের ঝুঁকি না নিতে। কিন্তু আমরা কারও কথাই কানে তুললাম না। যথারীতি ওদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর একটু বেলাবেলি তিন বন্ধুতে এসে হাজির হলাম সেই পোড়ো বাড়িতে। এল না শুধু কমলেশ। সে আগেই বলেছে, “দ্যাখ ভাই, আমি ওসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে নেই। ও বাড়ির ঘটনার কথা আমার অজানা নয়। কাজেই জেনেশুনে বিষপান আমি করব না। তবে তোরা যেতে চাইছিস, যা। কেউ যদি নিজের থেকে মরতে চায়, তা হলে কার কী ক্ষমতা যে, তাকে বাঁচাতে পারে?”

এই কথামতোই আমরা এলাম। ঠিক হল, এক রাত এই পোড়ো বাড়িতে থেকে পরদিন সকালে ফিরব। তবে আমাদের এই থাকাথাকিতে কোনও বাজিটাজির ব্যাপার ছিল না। শর্ত ছিল সততার। অর্থাৎ, আমরা অলৌকিক কিছু দেখলে সেটাকে অস্বীকার করব না। আবার সত্যিসত্যিই যদি রোমহর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হই, তা হলেও রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যেতে লজ্জাবোধ করব না। আসলে আমাদের এই থাকাথাকির ব্যাপারটা ঠিক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার নয়। স্রেফ সত্য যাচাই এবং কৌতূহল মেটানোর ব্যাপার।

আমাদের আগ্রহ দেখে স্থানীয় লোকরাও অনেকে বারণ করলেন। সবাই বললেন, দরকার ভাই, সুখে থাকতে ভূতে কিলোবার? ভূত না থাকুক, গুণ্ডা-বদমাশ তো আছে? অযথা গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে কেন বেঘোরে মরবেন? তার চেয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান। এই বাড়িতে সত্যিই ভূতের উপদ্রব না হলে মাঠের মাঝখানে বাড়িটা কখনও এমনই পড়ে থাকে?”

আমরা কিন্তু কারও কথাতেই কর্ণপাত করলাম না। যে যা বলল, তা কানখাড়া করে শুনে গেলাম। তাদের কথার গুরুত্ব দিয়ে ফিরে এলাম না। দিব্যি সেই পোড়ো বাড়ির ভেতর ঝিঁঝির ডাক শুনে, মশার কামড় খেয়ে রাতজাগা শুরু করলাম। মাঝে-মাঝে ভয় যে করছিল না, তা নয়। ভয় ছিল সাপের। হাজার হলেও বহুদিনের পোড়ো বাড়ি। তবু আমরা সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম। অর্থাৎ, বিকেলবেলা বাড়িতে ঢুকেই কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়েছিলাম চারদিকে। মুরগির মাংস, রুটি আর সন্দেশ ছিল রাতের খাদ্য-তালিকায়। আর ছিল চা তৈরির সরঞ্জাম। তখন গ্রামেঘরে এখনকার মতো এত ব্যাপকভাবে স্টোভের প্রচলন ছিল না। তাই প্রচুর শুকনো নারকোল পাতা এনে রেখেছিলাম।

আমরা চা খাচ্ছি। গল্প করছি আর ঘড়ি দেখছি—কখন সন্ধে হয়, কখন ভূত আসে। দেখতে-দেখতে সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক। আমরা অধীর আগ্রহে ভূতের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

রাত বারোটা। কোনও উপদ্রব নেই। ভয় নেই। ভূতেরা সাধারণত যা করে, অর্থাৎ গায়ের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলা, খ্যাল-খ্যাল করে হাসা, হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেওয়া, গায়ে ঘাস ছুড়ে মারা, কিছুই করল না। এমনকী হঠাৎ কোনও আর্তনাদ বা মড়াকান্নাও শুরু করল না কেউ। শুধু ভূত কেন, একটা শেয়াল-কুকুর পর্যন্ত ধারেকাছে এল না।

রাত তখন একটা। তখনও কারও কোনও অস্তিত্ব অনুভব করলাম না। ইতিমধ্যে দু’ রাউন্ড চা-পর্ব শেষ হয়েছে আমাদের। সময় কাটাবার জন্য এবং একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আবার আমরা নারকোল পাতা জ্বালিয়ে চা তৈরি করে খাচ্ছি এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ আধপাগলা একজন লোক এসে হাজির হল সেখানে। ওর হাতে একটি কলাইয়ের মগ। সেটা এগিয়ে বলল, “আমাকে একটু চা দেবেন দাদাবাবু?” আমি বললাম, “কে বাবা তুমি?”

লোকটি ফিক করে হেসে বলল, “আমি ভূত।”

“ভূত!”

“তবে আর বলছি কী? যাকে দেখবে বলে তোমরা এসেছ, আমিই সেই। কেমন দেখছ?”

“ভালই। তা বাবা ভূতই যদি তুমি হুবে তো এইরকম ছিরি কেন তোমার? হাতের জায়গায় পা থাকবে। পায়ের জায়গায় হাত থাকবে। মুখটা হবে উলটোমুখো। গায়ে কোনও মাংস থাকবে না। নয়তো অর্ধেক শরীর দেখা যাবে, অর্ধেক অদৃশ্য থাকবে। তবে তো?”

লোকটি হেসে অস্থির হয়ে বলল, “তবেই তোমরা ভূত দেখেছ। ও ভূত এখানে নেই বুঝলে? ও ভূত থাকে গল্পের বইতে। যাক, এখন আমাকে এক কাপ চা দাও দিকিনি।”

আমাদের চা তখন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই থেকেই একটু দিলাম ওকে। লোকটি বেশ আয়েস করে চা খেতে খেতে বলল, “মেজাজ এসে গেল। কতদিন যে এমন চা খাইনি। ভাগ্যিস তোমরা এসেছিলে।”

“আর একটু দেব?”

“নাঃ, থাক। যাচ্ছিলুম এই পথ দিয়ে, আলো জ্বলছে দেখে ঢুকে পড়লুম।”

“কিন্তু এত রাতে তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?”

“হাই দ্যাখো, ভূতেরা তো রাতবিরেতেই যায়-আসে গো। তা ছাড়া তাদের তো নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা থাকে না। তাদের কাজই হল ঘোরা।” বলে মগটি হাতে নিয়ে উঠে গেল লোকটি।

অজয় বলল, “এ কী! তুমি চলে যাচ্ছ?”

“যাব না তো কি বসে থাকব? আমার এখন অনেক কাজ।’

“বেশ মজার লোক তো তুমি। যেই গরম চা পেটে পড়ল অমনই কেটে পড়ছ? একটু বোসো। গল্পসল্প করি।”

“না রে ভাই, বসবার সময় নেই।”

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছ পর্যন্ত গেল।

অজয় বলল, “শোনো।”

লোকটি বলল, “আঃ! যাওয়ার সময় পিছু ডাকো”

কেন?” সুশান্ত বলল, “আরে শোনোই না, একটা কথা বলি।” লোকটি ফিরে এসে বলল, “নাও, কী বলবে বলো।”

“আমরা তো এ বাড়িতে এসেছি ভূত দেখতে। তা তুমি যখন বলছ তুমিই ভূত, তখন যাওয়ার আগে তোমার ভূতের খেলাটা একবার দেখিয়ে যাও না বাবা।”

লোকটি হেসে বলল, “কী ছেলেমানুষি করছ তোমরা রাতদুপুরে? যাও, ঘরের ছেলে ঘরে যাও। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে ভাল করে ঘুম দাও দিকিনি।” বলেই কোনওদিকে না তাকিয়ে হনহন করে চলে গেল লোকটি।

আমরা টর্চের আলোয় অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করলাম, লোকটি অন্ধকারে বাইরে গিয়েই হঠাৎ মিলিয়ে যায় কিনা। কিন্তু না। সে দিব্যি খোশমেজাজে, কখনও বা নাচতে নাচতে দূরের গ্রামের দিকে চলে গেল।

রাত দুটো। পাশের একটি বাদামগাছের ডাল থেকে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল শ-স–স। তারপর হঠাৎ প্যাঁচাটা দারুণ ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে ডানা ঝাপটে বারবার পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। তারপর আমাদের তাড়া খেয়ে আরও একপাক ঘুরে উড়ে গেল অন্ধকারে।

রাত তিনটে। আমরা আর একবার চা খেলাম।

ভোর পাঁচটা। সবে আলো ফুটি-ফুটি করছে। গাছের ডালে একটি-দুটি করে পাখি ডাকছে। কিন্তু কই? না এল কোনও ভূত, না কোনও জন্তু-জানোয়ার। আমরা নিজেরাই এবার দারুণ বিরক্তিতে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলাম, “শুধু-শুধু এই গেঁয়ো ভূতগুলোর কথা শুনে রাতের ঘুম নষ্ট করে ভূত দেখতে না এলেই হত! কী দেখলাম? কিছুই তো না। মাঝখান থেকে মশার কামড় খেলাম। ঘুম হল না। শরীরও খারাপ হল। যত্তসব।”

দেখতে-দেখতে ভোর হল। আমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পোড়ো বাড়ির বাইরে চলে এলাম। বেশ কিছুটা পথ আসবার পর দেখলাম কমলেশ এবং গ্রামের দু-চারজন লোক আমাদের অবস্থা দেখবার জন্য এইদিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে মুখোমুখি হতেই অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। এমনভাবে তাকাল, যেন আমাদের দেখেইনি কোনওদিন। ভয়, বিস্ময়, কী না ছিল ওদের চোখে? যেন আমরাই ভূত। তাই ভয়ে ভয়ে আমাদের ভূত দেখছে।

একজন জিজ্ঞেস করলেন, “রাত্রে আপনারা ভয়টয় পাননি তো?”

“না।”

“তেনাদের কোনও উপদ্রব হয়নি?”

“কিছু দেখেননি আপনারা?”

“হ্যাঁ, দেখেছি আমরা। একটা ঘোড়ার মাথা আর হাতির মুণ্ডু।”

“তা তো দেখবেনই বাবু। হাজার হলেও রাজারাজড়ার বাড়ি। হাতি-ঘোড়া কত কী ছেল।”

আর-একজন বলল, “আরে বুঝছ না কত্তা। বাবুরা আমাদের বিদ্রুপ করছেন।”

আমি রেগে বললাম, “করবই তো! শুধু শুধু তোমাদের বুজরুকিতে উত্তেজিত হয়ে এই যে একটা পোড়ো বাড়িতে ফালতু একটা রাত কাটালাম, এর খেসারত কে দেবে? এইভাবে মানুষকে ধাপ্পা দেওয়ার কোনও মানে হয়?”

আর-একজন বলল, “ধাপ্পা দেব কেন? যা আমরা বরাবর শুনে আসছি, তাই বলেছি। তা ছাড়া আমরা তো আপনাদের পায়ে ধরে সাধতে যাইনি ওই বাড়িতে রাত কাটাবার জন্য। বরং আপনাদের ভালর জন্য আমরা বারবার বারণই করেছিলাম। আপনারা তো শুনলেন না। আমরা লোকের মুখের শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে কেউ ঢুকি না ও বাড়িতে।”

আমি বললাম, “বেশ। এবার আমরা ওই বাড়িতে এক রাত থেকে তো প্রমাণ করে দিলাম যে, তোমাদের শোনা কথার কাহিনীগুলো কত ভুল। এবার থেকে নির্ভয়ে যাবে ও বাড়িতে। ভূত তোমাদের ভয়ও দেখাবে না, মেরে ফেলবে না, খেয়েও নেবে না।”

কমলেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবই তো হল। কিন্তু একটি রাতের ভুলের মাশুল যে তোদের কী কঠিন মূল্যে দিতে হল তা কি তোরা এখনও বুঝতে পারিসনি?” “কীরকম!”

“তোরা একবার খুব ভাল করে নিজেদের চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখ তো।”

কমলেশের কথা শুনে আমরা সবাই সবাইয়ের দিকে তাকালাম। সত্যিই তো! এ কী চেহারা হয়েছে আমাদের? আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অজয় ছিল অত্যন্ত রূপবান। কিন্তু তার সেই চাঁপাফুলের পাপড়ির মতো গায়ের রং হঠাৎ এত কালো হয়ে গেল কী করে? ওর বাঁশির মতো লম্বা নাকটা যেন টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বেঁকে গেছে। তা ছাড়া ওর দু’ কানে মাকড়ি, হাতে বালা কোত্থেকে এল? যেন অরণ্যবাসী এক ভিল যুবক। আর সুশান্ত? এই এক রাতে ওর মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। ঠিক যেন আশি বছরের বুড়ো। গায়ের চামড়াতেও কোঁচ পড়েছে। সামনের সারির কয়েকটা দাঁত নেই। না, না। এ হতে পারে না। এ নিশ্চয়ই কোনও ইন্দ্রজালের ব্যাপার। এই যদি ওদের অবস্থা হয় তা হলে আমার অবস্থা কী হয়েছে? সামনে একটা আয়না থাকলে অবশ্যই নিজেকে দেখতাম। কিন্তু এ কী! আমার হাতে এত রক্ত এল কী করে? ঠিক মনে হচ্ছে আমি যেন কাউকে খুন করে এসেছি। তা ছাড়া আমার সেই জামা-প্যান্ট, জুতো কিছুই তো নেই। তার বদলে এ কী! ময়লা চিরকুট ভুটানিদের মতো পোশাক। পায়ে ছেঁড়া নাগরার জুতো। যেন এইমাত্র কোনও চা-বাগান থেকে বেরিয়ে এসেছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার কোমরে একটা রং-চটা কলাইয়ের মগ ময়লা দড়ি দিয়ে বাঁধা। যে-মগটায় কাল রাতের সেই অদ্ভুত লোকটা চা খেয়ে সেটা হাতে নিয়েই চলে গিয়েছিল। এও কি সম্ভব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *