বৈষ্ণব সাহিত্যে ও মঙ্গল কাব্যে ‘আগ্রাসন’ প্রসঙ্গ – নিরুপম আচার্য

বৈষ্ণব সাহিত্যে ও মঙ্গল কাব্যে ‘আগ্রাসন’ প্রসঙ্গ – নিরুপম আচার্য

‘আগ্রাসন’ শব্দটির মধ্যে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য মিশে আছে। কোনো কিছু জোর করে কেড়ে নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়াই এর মূল কথা। আমরা নানারকম আগ্রাসনের কথা শুনে আসছি। যেমন রাজনৈতিক আগ্রাসন, সামাজিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদি। ভারতবর্ষ— তৃতীয় বিশ্বের এমন একটি দেশ যে উপরে উল্লিখিত সবগুলো আগ্রাসনেরই শিকার হয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।তার ফল বিচিত্র ও বহুমুখী একথা বলা যায়।

কথায় বলে শোষণ চিরন্তন। ভিন্ন ভিন্ন তার রূপ। “বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে পোহালে শর্বরী” তো তারই প্রমাণ। আমরা দেখেছি আর্যরা কিভাবে তার সংস্কৃতি, ধর্ম,ভাষা নিয়ে ভারতবর্ষের আদি নাগরিক অনার্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল।তারা যা যা করেছে তার মধ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যই প্রধান ছিল।ধর্ম কৃষ্টি সমস্ত দিকেই তারা অনার্যদের উপর Dominate করেছে।তারপর থেকে শক, হুণ মোঘল, পাঠান, ইংরেজদের দল পালা করে এসেছে আমাদের দেশে।এর প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নয় এরফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও কম হয়নি। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ায় তুর্কীরা যে আগ্রাসন নিয়ে এসেছিল তা সকলের স্মরণে আছে।

আমাদের আলোচনার মূল বিষয় বাংলা ভাষার আগ্রাসন প্রসংগটি। আমাদের আলচনার ক্ষেত্র মধ্যযুগে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গল কাব্য। বহুকাল আগে সৃষ্ট ভাষার দ্বারাই মনুষ্য জাতি তার উন্নত মেধা ও মননের পরিচয় রেখে এসেছে।তা সে শ্রুতির যুগেই হোক বা লিখন পদ্ধতি প্রচলিত হওয়ার যুগেই হোক। এই ভাষার নিজস্ব ঐতিহ্য,অবিমিশ্রতা বা মৌলিকতা সমালোচনা সাহিত্যের আলোচনার অন্যতম বিষয়। ঐতিহাসিক সমালোচনা বলতে গেলে আমরা যা বুঝি (Historical Criticism) তার বিশ্লষণে দেখা যায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে প্রচলিত ভাষাগুলি কিংবা কোনো এক দেশের ভাষা বাইরের দেশের ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ রূপ বদলে ফেলেছে। এই পরিবর্তন কোনদিন ঠেকানো সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। ভাষার নিজস্বতা রক্ষা করতে গেলে যে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার তা Globalization এর যুগে অসম্ভব একটা ব্যাপার।ভাষার এই বিমিশ্রতার বিষয়টি যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো ভাষার নিজস্বতা বা স্বতন্ত্রতা নষ্ট করা হয় তখন তা আগ্রাসনের নামান্তর ও দুঃখজনক ঘটনা। আবার অনেক সময় দেখা যায় প্রবহমান ভাষায় খুব স্বাভাবিক ছন্দে অন্য ভাষার উপাদান এসে মিশে যাচ্ছে ও এক নতুন ছন্দের দোলা দিচ্ছে তখন তা কোন এক ভাষার মুখ্য বৈশিষ্ট্য কে নষ্ট করলেও মেনে নিতে হয় স্বাভাবিক নিয়মে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ, উপমহাদেশ ও দেশের ভৌগোলিক সীমা যখন শীল্ করে দেওয়া হবে অর্থাৎ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে বা একই দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আটকে রেখে দেওয়া হবে তখন ভাষার কাঠামোগত, উপাদানগত, অন্বয়গত নিজস্বতা রক্ষা করা যাবে। কিন্তু এটি চলমান প্রক্রিয়া, একে কোন শৃংখলে বেঁধে রাখা যায় না।

বাংলা ভাষার জন্ম আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দে। মাগধি অপভ্রংশ অবহট্ট থেকে এর উদ্ভব। বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছর অতিক্রান্ত। লিখিত সাহিত্য ও তাই। লিখিত সাহিত্যের ধারায় আমরা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস জানতে পারি। ওটাই তো পাথুরে প্রমাণ। বাংলা ভাষার বিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করে থাকি আমরা। এর মধ্যে আমরা মধ্যম পর্যায়ের যে ইতিহাস যাকে মধ্য বাংলার ইতিহাস বলে থাকি তা সুবিস্তৃত কালপর্বে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের রচনাকাল ১৭৫২ খৃঃ বা ভারতচন্দ্রের মৃত্যু ১৭৬০ পর্যন্ত এই পর্বের বিস্তার বলে আমরা মনে করি। এই সময়কালে রচিত ও বহুধা বিস্তৃত যে সাহিত্য শাখা তা হলো বৈষ্ণব সাহিত্য ধারা। এই সাহিত্যধারার অন্তর্গত বৈষ্ণব পদাবলী ও চৈতন্য চরিত সাহিত্য উল্লেখের দাবী রাখে। বৈষ্ণব সাহিত্য ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে এবং চরিত সাহিত্য সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে। তুর্কী আক্রমনোত্তর কালে আরবী, ফারসী ভাষার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী। তাছাড়া এই যুগের সাহিত্য হিন্দি উপকরণে বিশেষভাবে পুষ্ট ছিল। এখন যেরূপ ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য ঔপনিবেশিকতার ফলে তথন তেমনি ছিল ‘বৃন্দাবনী’ ভাষার রাজত্ব। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব কালে বৃন্দাবন ছিল বড় তীর্থক্ষেত্র। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে শশীভূষণ দাশগুপ্ত এই বিষয়টি সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছেন “তখন বঙ্গের শিক্ষিত সমাজ ইহাকে ধরাতলে স্বর্গ বলিয়া গণ্য করিতেন। শ্যাম কুণ্ড কি রাধাকুণ্ড দর্শনার্থ তাঁহাদের যে উৎসাহপূর্ণ আগ্রহ ছিল, বিলাত যাইতে শিক্ষিতগণের তেমন ঐকান্তিক আগ্রহ নাই। এখন যে আমরা বাংলা কথার মধ্যে চারি আনা ইংরেজি মিশাইয়া বিদ্যা দেখাইয়া থাকি তখন সেই রূপ বৈষ্ণব বর্গের বাঙালা কথা চারি আনা বৃন্দাবনীয় মিশ্রণে সিদ্ধ হইত।”

কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত থেকে লক্ষ্য করা যাক। কথাবার্তা অংশে বৃন্দাবনী ভাষার বহুল প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।

যেমন:

“প্রয়াগ পর্যন্ত দুহেঁ তোমা সঙ্গে যাবো। তোমার চরণ সঙ্গ পুনঃ কাঁহাতক পাবো।।
ম্লেচ্ছদেশ কেহা কাঁহা করয়ে উৎপাত। ভট্টাচার্য্য পন্ডিত কহিতে না জানেন বাত।।”

এখানে বাত, কাঁহা, দুহেঁ ইত্যাদি শব্দ লক্ষণীয়।

নরোত্তম বিলাস থেকে:

“হইলু উদ্বিগ্ন বৃন্দাবিপিন দেখিতে
তাঁহা না হইল, গেলু অদ্বিতীয় গৃহেতে।।”

বৈষ্ণব সমাজের কথিত ভাষা তখন বৃন্দাবনীয় ভাষায় মিশ্রিত হয়েছিল। তাই সাহিত্যে তার প্রভাব লক্ষ্য করি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বৃন্দাবনে দীর্ঘদিন থাকায় তাঁর মাতৃভাষায় বৃন্দাবনী ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছিল। সংস্কৃতে তাঁর জ্ঞান ছিল তাই সংস্কৃত শব্দ অনায়াসে মিশে গেছে তাঁর লেখায়। বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত ছাড়া উর্দু পর্যন্ত কৃষ্ণ দাস ব্যবহার করেছেন। উর্দু যেমন- নানা, মামু, চাচা ইত্যাদি। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র আদিলীলায় পাই এইরকম শব্দ:

“ইবে তুমি শান্ত হইলে আমি মিলিলাম।
ভাগ্য মোর তুমি হেন অতিথি পাইলাম।।
গ্রাম সম্বন্ধে চক্রবর্তী হয় আমার চাচা।
দেহ সম্বন্ধ হইতেগ্রাম সম্বন্ধে সাঁচা।।
নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা।
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।।”

আমরা প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্যে ও উর্দু ভাষার প্রভাব দেখি। উর্দু নবাবী আমলের ভাষা। এর প্রভাব বাংলা ভাষায় স্বাভাবিকভাবে পড়েছিল।এই প্রসঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে বলেছেন “রাজধানী মুর্শিদাবাদের প্রভাবে বাঙ্গালা সাহিত্যে পারসী ও উর্দু প্রভাব প্রবেশ লাভ করে।এইসময় দোভাষী বাংলায় [ভারতচন্দ্রের মতে— যাহা ভাষা যাবনী মিশাল] অধিকাংশ মুসলমান কাব্যে রচনা করিতে থাকেন ইহাদিগকে পুঁথিসাহিত্য বলা হয়।”

হিন্দু লেখকেরাও এই দোভাষী ভাষা থেকে মুক্ত হতে পারেননি এর প্রমাণ দিয়েছি আর ও লক্ষ করা যাক-

‘রঙ্গিনী রণজয়ী দুন্দুভী বাজই
ঘনঘোর বাজই দামামা।
রযপুত মজপুত যৈছন যমদূত
সমযুত যুজে খানসামা।।
দাদালী দলবল মহীমাঝে মাতল
মানব মহীমে মহাদক্ষে।”

ঘনরামের লেখা কাব্যে ‘দামা’, মযবুত, খানসামা শব্দগুলো আরবী বা পারসী জাত।

আর একটি দৃষ্টান্ত অন্নদামঙ্গল কাব্য থেকে

“চলে রাজা মানসিংহ যশোর নগরে।
সাজ সাজ বলি ডঙ্কা হইল লস্করে। ।
ঘোড়া উট হাতী পিঠে নাগারা নিশান।
গাড়িতে কামান চলয়ে বাণ চক্রবাণ।।
হাতীর আমারী ঘরে বসিয়া আমীর।
আপন লস্কর লইয়ে হইল বাহির।।
আগে চলে লাল পোশ খাশবরদার।।
সিফাই সকল চলয়ে কাতার কাতার।
তবকী ধানুকী ঢালী রায়বেঁশে মাল।।
দফাদার জমাদার চলয়ে সদীয়াল।।
আগে পাছে হাজারির হাজার হাজার
নট নটী হরকরা উরদু বাঁজার।।”

আমরা এই উদ্ধৃত অংশে ভুরি ভুরি আরবী পারসীজাত শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করি।

সেই পর্বে বৃন্দাবন দাস, লোচন দাসের লেখায় এই দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যেতে পারে। অপ্রচলিত শব্দের দৃষ্টান্তও আছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে হরিষ, বরিষ, প্রসারিয়ে, ধর্ম, মগন, যতন এরকম প্রসারিত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা হিন্দি প্রভাব জাত বলে মনে করা হয়। এছাড়া চন্দ্রবিন্দু ও ‘ঙ’ ধ্বনির প্রভাব হিন্দি ভাষা থেকে এসেছে। বৌদ্ধ যুগের ভাষায় ব্যবহৃত যেমন পাষন্ডী, গোফা ইত্যাদি এই সময়ের সাহিত্য পাই।

বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে পাই
সকল শক্তি সঙ্গে আইলা গৌরচন্দ্র
পাষন্ডী কিছুইনা জানিবে।

এভাবেই বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা হারিয়েছে। এ এক দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। আমরা নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এর সূত্রপাত করলাম মাত্র। হ্যালহেড সাহেবের গ্রন্থ থেকে (১৭৭৮ খৃ) একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শেষ করবো—

‘’At present those persons are thought to speak this compound idiom and the most elegance who mix with pure Indian verbs the greatest number of Persion Arabic nouns’’

লেখক পরিচিতি: প্রবন্ধটির লেখক নিরুপম আচার্য, বর্তমান প্রস্তুত গ্রন্থটির সম্পাদক। পেশায় অধ্যাপক ড. আচার্য বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও কবি-প্রাবন্ধিক রূপে ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘দেশভাগের কথকতা’ গ্রন্থটি। এছাড়া কালিকলম: আধুনিকতার পর্বান্তর ও সমাজবীক্ষা, অধরা মাধুরী: চেতনায় রবীন্দ্রনাথ, গল্পের অন্দরমহল, নাটকের নানা কথা, ভাষা আর ভাষা, প্রসঙ্গ ভাষা তাঁর উল্লেখ্য গ্রন্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *