বৈষ্ণব মতবাদ ও বাঙলা সাহিত্য
আর্যপূর্ব যুগে ভারতে দ্রাবিড়গণই বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল। তারা সংখ্যায় যেমন অধিক ছিল, দণ্ডশক্তি এবং সংস্কৃতিতেও তেমনি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই মনে করা যেতে পারে আর্যপূর্ব যুগে ভারতে যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিরাজ করত তা বাহ্যত এবং প্রধানত দ্রাবিড় সভ্যতা।
দ্রাবিড়গণ সেমিটিক গোত্রীয় হলেও, ভারতের আবহাওয়ায় তাদের মন ও মননের পরিবর্তন হয়েছিল। কায়ার চেয়ে ছায়ার মায়ায় ক্রমশ অভিভূত হয়ে পড়েছিল তারা। জীবনবাদের চেয়ে জীবনুক্তিই সাধ্য-সাধনার মুখ্য লক্ষ্য হয়ে উঠল। ভোগবাদ যেখানে বৈরাগ্যের নিকট পরাজিত হয়, সেখানে অলস-নিষ্ক্রিয়তা তথা ভাবপ্রবণতা ছাড়া আর কী আশা করা যায়! বাহ্যজগতের প্রতি বিরাগ ও মনোজগতের প্রতি অনুরাগই তাই তাদের বড় দার্শনিক করে তুলল বটে, কিন্তু নির্বোধ বিষয়ী করে রাখল। দৃশ্যজগৎকে তুচ্ছ করে, অদৃশ্যজগৎকে উচ্চ করে তার সাধনায় যখন দ্রাবিড়গণ বিভোর, তখন ভারতে এল আত্মপ্রত্যয়শীল, সগ্রামী, জীবনবাদী যাযাবর আর্য। বাধা দেবার মতো দণ্ডশক্তি দ্রাবিড়দের ছিল না। উৎপীড়ন যখন অসহ্য হয়, তখন নিতান্ত নিরীহ এবং দুর্বলও মরণ কামড় দিতে চেষ্টা করে। দ্রাবিড়গণ সেরূপ বাধা দিয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা দাক্ষিণাত্যে ও পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে বাঁচল। অভিজাত অনার্যেরা আর্যসমাজে মিশে গেল। তবু বহু অনার্য আর্য-খপ্পরে পড়ে গেল এবং আর্যসমাজে তারা নিগ্রহ ভোগ করতে থাকল।
আর্যগণ দ্রাবিড়দের মাথার অধিকার পেল বটে, কিন্তু মনের কাছে হার মানল। দ্রাবিড়দের যুগান্তরের ভাবচিন্তা কি ব্যর্থ হবে? তাই এদের মানস-সংস্কৃতির কাছে বাহুবলে বলীয়ান আর্যগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। যেমন পরবর্তীকালে রোমকগণ করেছিল গ্রীকদের কাছে, আরবগণ করেছিল ইরানীদের নিকট। বাহুবল বাক্যবলের কাছে হার মানল। মাংসপিণ্ড থেকে মন যে অনেক বড়, তা স্বীকৃতি পেল। ক্রিয়াকাণ্ড ও. যাগ-যজ্ঞপ্রধান আর্যধর্মের উপর পড়ল দ্রাবিড় প্রভাব। আচারসর্বস্ব আর্যধর্মে প্রবিষ্ট হল ভাববাদ। জীবনবাদী,জীবনধর্মী আর্যদের তৃতীয়নেত্র উন্মীলিত হল, মায়াবাদ প্রাণধর্মী আমানসের সরস সতেজ ক্ষেত্রে বইয়ে দিল উদাস হাওয়া।
দিন যায়। দ্রাবিড় প্রভাবে আর্য ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রূপান্তরিত ও পুষ্ট হতে থাকে। আর্য দ্রাবিড়ে নতুন শক্তি গড়ে উঠে। কিন্তু বিষয়বুদ্ধি-নিপুণ দণ্ডশক্তি মায়াবাদকে আত্মস্বার্থ সিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্ণাশ্রম নিপীড়নের ঘূপকাষ্ঠরূপে দেখা দিল। সদুদ্দেশ্য নিয়ে যা প্রতিষ্ঠিত, অসদুদ্দেশ্য সিদ্ধির তাই বাহন হয়ে দাঁড়াল।
অত্যাচার, উৎপীড়ন যখন চরম আকার ধারণ করল, তখন ধীরে ধীরে সমাজমনে দেখা দিল অসন্তোষ। এই অসন্তোষই পুষ্ট হয়ে একসময় প্রবল বিদ্রোহ ও সর্বাত্মক বিপ্লবে পরিণত হল। এর সার্থকনাম নেতা হচ্ছেন বর্ধমান মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ। এঁদের আগে তেইশজন তীর্থঙ্কর ও বহু বৌধিসত্ত্ব এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই মায়াবাদ এদেরও মূলধন। এই বিপ্লবের বন্যায় যুগসঞ্চিত কলুষ-জীর্ণ প্রাচীন যত সব-কিছুই ভেসে গেল–বেদ গেল, ব্রাহ্মণ গেল, দেবভাষাও মর্যাদাচ্যুত হল, বর্ণাশ্রম গেল। স্বর্গ-নরক-দেবতা কারুর অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেল না। সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা, জীবে-দয়া, জাতিভেদের অসারতা প্রভৃতি প্রচারিত হল। সর্ব বন্ধনকে দলিত করে বিঘোষিত হল মনুষ্যত্বের জয়। আর্য-অনার্যের বিভেদ ঘুচে গেল। গণতন্ত্র হল না সত্য, কিন্তু গণমানস স্বীকৃতি পেল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম জনসাধারণের আচরণসাধ্য ছিল না, শাস্ত্রে ছিল না অধিকার, নিজের মনের কথা স্বমুখের বুলিতে দেবতার কাছে নিবেদন করবার উপায় ছিল না। পুরোহিতের মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে যে কৃত্রিম সম্পর্ক ছিল, তাতে সংস্কারের দৃঢ় বন্ধন ছিল না। তাই বুদ্ধ ও মহাবীরের ডাকে বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল সহজেই।
ধর্মদর্শন হিসেবে মায়াবাদই ছিল বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের পুঁজি। মায়াবাদ যতই শ্রোত্ররসায়ন হোক না কেন, (একে অবসর সময়ে ভাবপ্রবণ দুর্বলচিত্তে প্রশ্রয় দিতে বেশ লাগে সত্য) কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কারণ, জৈবসাধনা হচ্ছে ধন-জন-মানের সাধনা। এটা প্রাকৃতিক বা প্ৰাবৃত্তিক। সুতরাং প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা যখন চলে গেল, তখন বোঝা গেল জৈবধর্মের প্রতিকূল এ বৈরাগ্যবাদ– এ জীবন-মুক্তির সাধনা প্রাত্যহিক জীবনে আচরণ-সাধ্য নয়। তাই বৌদ্ধ-জৈন ধর্মে বিকৃতি ও সমাজ-জীবনে বিকার অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দিল। শঙ্কর প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এ বিকৃতি ও শৈথিল্যের সুযোগ গ্রহণ করলেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদীদেরও এ ব্যাপারে প্রধান পুঁজি মায়াবাদ। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হল বলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই প্রথম বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদকে স্বীকৃতি দিল অর্থাৎ মায়াবাদকে ভাঁওতা হিসেবে নয়, জীবনে সাধ্য ধর্ম-দর্শনরূপেই গ্রহণ করল তারা। এর ফলে জীবনে চতুরাশ্রম গ্রহণ একরূপ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। এইরূপে হয়তো এই প্রথম দ্রাবিড়-আর্যের ধর্মসমন্বয় পূর্ণতা পেল। এমনি করে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিমার্গের সমান আদর ও কদর প্রতিষ্ঠিত হল। আর্যের ব্ৰহ্মবাদ, দ্রাবিড়ের মায়াবাদ এবং উভয়ের সমন্বয় ও সংমিশ্রণজাত ভক্তিবাদ সচ্চিদানন্দ শক্তি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রসার লাভ করল। এতেও মূলত দ্রাবিড় সংস্কৃতি প্রাধান্য পেল। ভারতে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিবর্তন ও রূপান্তরের ধারা ছিল এরূপই।
মুসলমানদের কোরআনের মধ্যেই সূফীতত্ত্ব নিহিত ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। ভাবপ্রবণ হৃদয়বান ইরাকীদেরকে প্রথমে তা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মূলত কোরআন থেকেই সূফীমতের সমর্থন পাওয়া গেলেও এর পুষ্টি ও প্রসার ঘটে ভারতীয় বেদান্তের পরোক্ষ এবং নিউল্ল্যাটনিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। দেখতে দেখতে ইরাকে-ইরানে মরমীয়াদের সংখ্যা আশাতীতরূপে বেড়ে গেল। হাফেজ, রুমী, জামী, নিযামী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ কবির সৃষ্টির মাধ্যমে তা ইরানের সীমা অতিক্রম করে গোটা মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, সূফীদের আল্লাহ আর সচ্চিদানন্দে দৃশ্যত পার্থক্য কিছুই নেই।
মুসলমান অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন তাঁরা সবাই সূফী দরবেশ ছিলেন। এই মরমীদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে সাধারণ লোকের পক্ষে ধর্মাচরণ দু:সাধ্য। সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক সাধনা বাহ্যানুষ্ঠান ও আচরণের মাধ্যমেই চলে। ফলত, পীর দরবেশ-আউলিয়া প্রচারিত ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ভারতের প্রথম যুগের মুসলমানগণ মুসলিম সংস্কৃতি পুরোপরি গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পীর-পূজা প্রচলিত হয়। এইভাবে। এতে কোনো হিন্দুপ্রভাব নেই। তবে এই পীরবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দুর গুরুবাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে।
সূফীদের মূলবক্তব্য হচ্ছে : সৃষ্টিটা স্রষ্টার আনন্দজাত। আনন্দিত স্রষ্টা বললেন: কুফায়াকুন (Be it so, and it is so) অর্থাৎ সৃষ্টিটা কারো অনুরোধে বা গরজে হয়নি। স্রষ্টা তার খেয়াল খুশির খাতিরে আনন্দ-সহচর হিসাবেই তা করেছেন। এ তাঁর লীলা। অসমানে প্রণয় হয় না। নিদ্বন্দ্ব, নির্বিঘ্ন ও অকৃত্রিম আনন্দ পেতে হলে বন্ধুর সাহচর্যই কাম্য। কারণ, হৃদয়ের অসংকোচ প্রকাশ একমাত্র প্রণয়ের সম্পর্কেই সম্ভব। সুতরাং স্রষ্টা যেখানে আত্মোপভোগের জন্যেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে সৃষ্টি-সেরা মানুষের সঙ্গে তাঁর বান্দা-মনিব-সম্পর্ক হতে পারে না। তাহলে যে সৃষ্টির সার্থকতা থাকে না–স্রষ্টার উদ্দেশ্যই যে ব্যর্থ হয়। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক,–কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলের বাধা সেখানে অবাঞ্ছিত নয় শুধু, অসম্ভবও। কাজেই আল্লাহর সঙ্গে যেখানে মানুষের প্রণয়ের সম্পর্ক সেখানে বান্দা-মনিবের, পিতা-পুত্রের বা ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ক কল্পনা করাও বাতুলতা। কাজেই নামাজ, রোজা বা ইত্যাকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ৎ সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহ বোধে উপলব্ধি এবং মিলনে এর সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে–প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এ প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। বিন্দু বিন্দু বারি নিয়ে সমুদ্র। কিন্তু বিন্দুর একক শক্তি কতটুকু! তাই তার অস্তিত্ব রক্ষার গরজেই সমুদ্রের জন্যে তার আকুলতা। নইলে যে তার অপমৃত্যু সুনিশ্চিত! বিন্দুস্বরূপ জীবাত্মার তাই পরমাত্মার জন্যে এত আকুলতা। গরজ জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক–তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে–যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে–এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না-জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনলহক বা সোহম। এই অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ বা বাকাবিল্লাহ, বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। (তু. চৈতন্যদেব মুই সেই, মুই সেই)–এ দুটো কথায় সূক্ষ্ম-দার্শনিক অর্থে মারপ্যাঁচ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায়টা মূলত একই।
কুনফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে, একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদনির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে, পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াসে। সুফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের প্রেমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সুফী বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর কথায়–
দানা চু অন্দর জমিন পেন্হা শওয়াদ।
বাদ আঁজা সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।
জীবাত্মা তখন বংশীর ন্যায়–বশোনা আজয়ে ফুঁ হেকায়েত মি কুনদ…..এজন্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন :
বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
তাই সূফী গজলে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলন-পিপাসু বিরহী-আত্মার করুণ ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই। সূফী-গজল ও বৈষ্ণবপদসাহিত্য মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-র সুর ও বাণী বহন করছে। না-পাওয়ার বেদনা আর পেয়ে হারানোর শঙ্কা–কোটার চেয়ে কোন্টা কম! তাই চিরকাল হিয়ার পরশ লাগি হিয়া যেমন কাঁদে এবং লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখলেও হিয়া, জুড়ায় না, তেমনি দুহু ক্রোড়ে দুহঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া। এর শেষ নেই–সমাধান নেই। এ সাধনাও বড় কঠিন সাধনা। ঘৃণা-লজ্জা-ভয়–এ তিন থাকতে কিছু হয় না। ধন-জন-মানের আকাঙ ক্ষা ত্যাগ করলে, তবে ঘৃণা-লজ্জা-ভয় ঘুচে যায়। এজন্যেই এতে সবার অধিকার নেই। সূফী বৈষ্ণবেরা তাই পণ্ডিত ও ধর্মধ্বজীদের উপহাস করেন। হাফেজ বলেন :
ঢালো সুরা সখি, সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়।
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়
চণ্ডীদাস বলেন,
মরম না জানে ধরম বাখানে এমন আছ যারা,
কাজ নাই সখি, তাদের কথায় বাহিরে রহুন তারা।
মুসলমানদের ভারত অধিকার ভারতবর্ষের সামাজিক ও কৃষ্টির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিপূর্বে শক-হুঁনদল এসেছিল; ভারতবাসীরা অনায়াসে তাদের গ্রহণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বহিরাগত তুর্কী মুসলিমকে এদেশীয় সমাজ আত্মস্থ করতে পারে নি। তার কারণ, মুসলমানেরা শুধু বিশেষ আকৃতি, প্রকৃতি ও বাহুবল সম্বল করে আসে নি, এনেছিল যুক্তি নির্ভর এবং প্রত্যয়-দৃঢ় ধর্ম, সমাজ, আচার আর রাষ্ট্রাদর্শ যার সামাজিক ও পারমার্থিক প্রভাব ছিল অসাধারণ। এত অসাধারণ যে, তা আজকের দিনের বলশেভিকবাদের চেয়েও সর্বগ্রাসী এবং আণবিক বোমার চেয়েও বিস্ময়কর। ফলে, মুসলমানদের একদেহে লীন করা কোনো মতেই সম্ভব হয় নি। কিন্তু আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ্য-ধর্মও পর্যদস্ত হবার নয়। এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এই নবশক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার যোগ্য ছিল। ফলত, ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম না হল ইসলামে বিলীন, না পারল মুসলমানদের বিলীন করতে। বিজেতা ও বিজিতের তথা শাসক ও শাসিতদের মধ্যেকার এ স্নায়বিক দ্বন্দ্ব বড় তীব্র হয়ে দেখা দিল। কেউ কাকেও না পারে গ্রহণ করতে, না পারে গ্রহণ করাতে। অবস্থাটা যেন কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। উভয় পক্ষই বুঝল এ অবস্থা অসহ্য, এর আশু সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু এসব অভিজাত হিন্দুর কথা।
এদিকে বর্ণাশ্রম কণ্টকিত অনুদার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে নিপীড়িত শূদ্রগণ ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্বের চুম্বকার্ষণে এতই বিচলিত হয়েছিল যে, স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। আগ্রহ প্রবল হলেও মন যা চায় তা পাওয়া অধিকাংশের পক্ষেই সহজ ছিল না। নবধর্ম গ্রহণে বাধা ছিল ত্রিবিধ : প্রথমত, প্রাচীন সংস্কারের মোহ ও ভয় : দ্বিতীয়, হিন্দু-সমাজপতির কোপ-দৃষ্টি, তৃতীয়, ইসলাম সম্বন্ধে অনিশ্চিত জ্ঞান। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার-বঞ্চিত নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুগণ ইসলামের উদার সমাজ-ব্যবস্থা ও সাম্য দর্শনেই প্রলুব্ধ হয়েছিল এবং আজন্ম পোষিত মায়াবাদের সঙ্গে বহুশ্রুত সূফীতত্ত্বের অপূর্ব সামঞ্জস্য দর্শনে কিছুটা আশ্চর্যও হয়েছিল। এভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুগণের ঘরের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, পথে নামল, কিন্তু ইসলামের আশ্রয় নিতে পূর্বোক্ত কারণে ছিল প্রচুর শঙ্কা। দাদুর ভাষায়–হিংদু তুরুক ন হোইবা সাহিব সেতী কাজ। অতএব নির্ভে নিৰ্পৰ্থ হোই। তাই ঘরেও নয়, গন্তব্যেও নয়, পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস দেখা দিল। হিন্দুর মায়াবাদ ও মুসলমানদের সূফীতত্ত্বের সমন্বয়ে নবদর্শন আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ নতুন ধর্ম সৃষ্টি হল। সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু। বা উপনিষদের তং বেদ্যং পুরুষৎ বেদ মা বো মৃত্যু পরিব্যথা। এই হল নবধর্মের মূল দর্শন বা মন্ত্র। ধর্ম সাধনার উদ্দেশ্য যখন মনের মানুষকে পাওয়া, তাহলে হিন্দুয়ানী বা মুসলমানীর বেড়াজালে আটকে পড়ার দরকার কী? শঙ্করাচার্যের দর্শন তখনও আলোচিত তত্ত্ব এবং ফারসি-সাহিত্যের মারফত হাফেজ, জামী, রুমী, আত্তার, খৈয়ামের বাণী মুখে মুখে উচ্চারিত সত্য। কাজেই এ আন্দোলনের ইন্ধন ছিল হাতের কাছেই।
এরূপে ভারতের দিকে দিকে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ভাস্কর, মাধব, রামানন্দ, নানক, কবীর, একলব্য, দাদু, চৈতন্য, রামদাস, নিস্বার্ক, বল্লভ প্রমুখ বহু সাধক-প্রচারকের আবির্ভাব ঘটল। শাস্ত্রাধিকার, সামাজিক সত্তা ও জীবনে নিরাপত্তাবোধের অবচেতন প্রেরণা থেকেই হয়তো এসব ধর্মান্দোলন শুরু হয়, কিন্তু অনতিকাল মধ্যে এগুলো ইসলাম ও দণ্ডধর মুসলিম শক্তিকে বাধা দেবার বা বিতাড়িত করবার সচেতন প্রয়াস হিসেবে প্রকট হয়ে উঠে। শিখ ও বৈষ্ণবান্দোলনে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল– তার বহু প্রমাণ রয়েছে। রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে বাদশাহ আকবর থেকে গান্ধীর কাল পর্যন্তও সমন্বয়-সাধনা অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর রামধুন সংগীত ও নজরুলের কয়েকটি কবিতাকে শেষ প্রয়াস বলে ধরে নেয়া চলে। এসব সংগীত সূফী কবির দিওয়ান, গজল ও রুবাইর অনুকরণে রচিত হয়েছে। চর্যাগীতিও দোহার আমল থেকেই গণভাষায় রচিত পদ ও দোহা ধর্মমত ও তত্ত্ব প্রচারের বাহনরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এদের উদ্দেশ্য ও সাধনা সার্থক হয়েছিল। ইসলাম সত্য সত্যই বড় বাধা পেল। এর গতি চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ইসলাম আর প্রচার বা প্রসার লাভ করল না। এর আগে মদিনা থেকে পশ্চিম পাঞ্জাব অবধি ইসলামে দীক্ষা অপ্রতিহত ছিল। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান তাঁদের মতে দীক্ষিতও হল– বিশেষত শিখ ও বৈষ্ণব ধর্মে। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আওতায়ও এরা রইল না। এগুলো হিন্দু-মুসলিম ধর্মদর্শনের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম। কিন্তু প্রচারকগণ নামত হিন্দু বিধায় এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রাধা, কৃষ্ণ, রাম, সীতা, দেরতা প্রভৃতি নামসার হিন্দুয়ানীর রেশ থাকাতে, এরা জাতি অর্থে হিন্দুই রয়ে গেল। তাতে উত্তরকালে রাজনীতিক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা হয়। সুতরাং এরা নামগত জাতিতে হিন্দু এবং ধর্মগত জাতিতে আলাহিদা। যেমন রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মে হিন্দুয়ানীর চেয়ে খ্রীস্টানী ও মুসলমানী কম নয়, তবু ব্রাহ্মবাদের ঐতিহ্যবোধে এবং রামমোহন নামের মাহাত্মে ব্রাহ্মগণ নিজেদের ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের শাখানুসারী বলে মনে করে। ফলত এরা জাতি হিসেবে হিন্দুই রয়ে গেল। বস্তুত, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম সচেতনভাবে খ্রীস্টধর্মের প্রসার রোধকল্পে প্রবর্তিত হয়েছিল ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল।
উক্ত সব সাধকের মধ্যে জোলা শ্রেণীর কবীর ও ধূনকর সম্প্রদায়ের দাদু ও রজ্জব মুসলমান ছিলেন। মুসলমান হয়েও তারা ধর্মান্দোলন শুরু করেছিলেন তার কারণ, এরা নিম্নশ্রেণীর উৎপীড়িত হিন্দু-সমাজ থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সূফীদের হাতে। শরিয়তী ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের অভাব, পূর্ব-সংস্কারগত মায়াবাদের প্রভাব এবং সূফীতত্ত্বের উদার আবহাওয়া এদেরকে ভাবরসে বা প্রেমসাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈচিত্র্য ও বিভেদের মধ্যেও যে আত্মার স্বরূপ এক ও অবিকৃত, এই সমন্বয়পন্থিগণ তা-ই প্রচার করেছেন। এসব ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ প্রথা ও শাস্ত্রে অনধিকার রহিতকরণ এবং মনুষ্যসত্তার মর্যাদা দান। তা পুরোপুরি সফল হল। তাই ইসলাম আর প্রসার লাভ করেনি। ইসলামের প্রভাবই সমাজ সংস্কারে প্রয়োজনীয় ফল দান করল। যেমন, য়ুরোপে ইসলামের অনুকরণে Protestant মত প্রচারই নবযুগ সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
বাঙলাদেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে চণ্ডীদাসও এরূপ একজন সাধক ছিলেন। সূফীপ্রভাবে তিনিও প্রেমধর্ম প্রচার করেন এবং বর্ণভেদের বিরুদ্ধে তিনিও বলে উঠেন: শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এর পরে মাধবেন্দ্রপুরী এবং তার পরে শ্রীচৈতন্য।
ভাগবতে ভক্তিবাদের উল্লেখ ছিল। কিন্তু তা মুসলিম বিজয়ের পূর্বে প্রসার লাভ করে নি। গীতগোবিন্দে আধ্যাত্মিকতা নেই, বিদ্যাপতিতেও না। গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতির পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণধামালী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ), শিবশিবানীর ছড়া বা গাথা প্রভৃতি আদিরসাত্মক রচনা সমাজ-জীবনের বিকৃতির এবং রাজনৈতিক নিবর্ষিতার যুগে নৈতিকতা শিথিল গণমনের রস-পিপাসা মিটাবার জন্যে রচিত হয়েছিল। ইত্যাকার আদিরসাত্মক রচনা সম্বন্ধে হুমায়ুন কবীর যথার্থই বলেছেন: সমাজ জীবনে যখন মন্দা পড়েছে, বিলাসের আড়ম্বরে জাতির চরিত্রতেজ ও শৌর্য যখন ম্লান, তখনই বিদ্যাসুন্দরের এবং এ ধরনের কাহিনীর প্রাদুর্ভাব। পাঠান রাজত্বের অবসানের যুগে শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর, মোগলশক্তির আসন্ন ভাঙনের দিনে কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দর এবং নবাবী আমলের অবসানে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের আবির্ভাবে এ-কথার সাক্ষ্য মেলে। রাজশক্তির পতনের দিনে ঐশ্বর্য ও বিলাসের আড়ম্বর সমস্ত দেশেই দেখা দেয়, বাঙলা দেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি; তাই অবনতিপ্রবণ সমাজের বিকৃত রুচির প্রতিচ্ছায়া হিসাবে বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়ও বারে বারে অশুচিরূপে ফুটে উঠেছে।… রাজসভার কৃত্রিমতায় সে কাহিনী যত পঙ্কিল হয়ে উঠেছে ধর্মপ্রেরণার অবান্তর আগ্রহে তাকে সজীব করবার চেষ্টাও হয়েছে তত বেশি। ভারতচন্দ্র তাই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতীক–জীবনের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মন্দার দিকে তার আবির্ভাব স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
বিপরীতধর্মী দুই সংস্কৃতির মোকাবিলায় নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুসমাজ-মনে, তার ধর্মবিশ্বাস ও জীবনদর্শনে যে সাড়া জাগল, তারই ফলে বাঙলায় বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদের উদ্ভব ও পরিণতি। অবশ্য দক্ষিণ ভারতেই এর প্রথম বিকাশ। এখানে ভক্তিবাদে যে মনোবৃত্তির প্রকাশ তাতে দ্রাবিড়সুলভ ভাবাবেগের প্রাচুর্য ছিল, আর ছিল তীব্র প্রাণময়তা। দ্রাবিড়রক্তের উত্তরাধিকারী বাঙলায়ও বৈষ্ণব ভক্তিবাদ একইরূপ উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার সৃষ্টি করল। এমনিতে বাঙালি চিরকাল ভাবপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। সামান্য কারণেই উচ্ছ্বসিত, উত্তেজিত, উন্মত্ত বা অভিভূত হয়ে পড়ে। এজন্যেই এরা যখন সাহিত্য সৃষ্টি করে তখন তা গীতিকবিতা হয়ে উঠে, সামাজিক আন্দোলনে সাময়িক ঝড় উঠে। রাজনীতিতে ভয়ংকর বিপ্লব ঘটায়, এজন্যেই এরা তর্ক করে যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়ানুভূতিগোচর না হলে আচরণ করে না।
বৈষ্ণব মত ও সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। এদের প্রভাবও বিশেষভাবে পড়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। তার কারণ, হুমায়ুন কবীরের ভাষায় : পশ্চিম বাঙলায় শালবন আর কাঁকরের পথ–দিগন্ত-প্রান্তর দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে আসে। শীর্ণ জলধারার গভীর রেখা কাটে দীর্ঘ সংখ্যাহীন স্রোতস্বিনী। বাতাসে তীব্রতার আভাস, তপ্তরৌদ্রে কাঠিন্য, দিনের তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট দীপ্তির পর অকস্মাৎ সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকারে সমস্ত মিলিয়ে যায়। রাত্রিদিনের অনন্ত অন্তরালে মনের দিগন্তে নতুন জগতের ইঙ্গিত নিয়ে আসে, তপ্ত রৌদ্রোলোকে মূর্ধাহত ধরণী অন্তরকে উদাস করে তোলে। পশ্চিম বাঙলার প্রকৃতি তাই বাঙালির কবিমানসকে যে রূপ দিয়েছে, তার মধ্যে। রয়েছে লোেকাতীত রহস্যের আভাস, অনির্বচনীয়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী জীবনের প্রতিদিনের সগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণে। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় এতবড় ধর্ম ও সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব যে পড়েনি তা নয়, তবে তা যেন কতকটা প্রথা রক্ষার তাগিদে কৃত্রিম চর্চা। পূর্ববঙ্গে মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাই ছিল বেশি, তাই লক্ষ্য তার প্রায়ই ভূমির দিখে। কৃচিৎ ভূমার দিকে তা ধাবিত হয়েছে। ফলে এখানে প্রাত্যহিক জীবনের সুখ দুখ-দ্বন্দ্ব ও প্রেম-স্নেহ-বিরহ-মিলনের গান-গাথা এবং দেবদ্রোহী, বীর্যমান, মর্যাদাবান, মানবতার প্রতীক চাঁদ সদাগর চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। কারণ পূর্ববঙ্গের নিসর্গ হৃদয়কে ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাসী করে নি। দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চললীলা। পদ্মা-যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতোধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস। প্রকৃতির বিপুল শক্তি নিয়তই উদ্যত হয়ে রয়েছে, কখন আঘাত করবে তার ঠিকানা নেই।… সেই জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার মধ্যে সংগ্রামশীল মানুষ প্রকৃতির সে ঔদার্য, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সেই ভয়ঙ্কর শক্তি ভোলবার অবসর কই? চরের মানুষ নদীর সাথে লড়াই করে, জলের ঐশ্বর্যকে লুটে জীবনের উপাদান আনে। তাই লোকাতীতের মহত্ত্ব হৃদয়কে সেখানেও স্পর্শ করে, কিন্তু মনের দিগন্তকে প্রসারিত করেই তার সমাপ্তি, প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণের সেখানে অবকাশ কই?… পূর্ববাঙলার প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও মহিমা সত্ত্বেও নিসর্গের সঙ্গে সগ্রামশীল মানুষ মুহূর্তের জন্যও নিজের সত্তা ভুলে থাকতে পারেনি। বৌদ্ধ বিপ্লবে যে সাম্যবাদ পূর্ব বাঙলার মজ্জাগত, মুসলিম বিজয়ে তা আরো প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করল এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠল নতুন আত্মপ্রত্যয়, নতুন ব্যক্তিত্ববোধ এবং স্বাধিকারের জ্ঞান। এভাবে পূর্ব বাঙলার ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্রোহ-ধর্মী মন সহজেই ইসলামের সংসারমুখী সন্ন্যাস-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে নিল। (বাঙলার কাব্য)।
স্মার্ত রঘুনন্দন ও রঘুনাথ শিরোমণির ব্রাহ্মণ্য আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিয়ে বৈষ্ণব বিপ্লবের যে প্লাবন এল তাতে পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু সবাই চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হয়নি বা রাধাকৃষ্ণের রূপকে ভক্তি বা বৈরাগ্য সাধনা করে নি। হয়তো চৈতন্যদেবের উপর অভিমান, অথবা রাধা-কৃষ্ণ রূপক থেকে প্রেরণার অভাব। তাই একদল লোক ভিন্ন পথে একই সাধনা করে চলল, এরা বাঙলার বাউল। বাউল আর বৈষ্ণবে সাধনাগত মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পরিণামে তারা। একই গন্তব্যে পৌঁছে। একদল মুসলমান হিন্দুয়ানীর প্রতি অবজ্ঞাবশত পীর-মুর্শিদের রূপকে সাধনা করেছে। আর একদল হিন্দুর যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির সমন্বয়ে এক তত্ত্ব-দর্শন খাড়া করেছে। ফলত, বাঙলায় চতুর্বিধ শাখার সাহিত্য আমরা পাচ্ছি: ১. বৈষ্ণবপদ সাহিত্য ২. বাউল সাহিত্য, ৩. মুরশিদা ও ৪. মারফৎ সাহিত্য। এ সবকটির মূল উৎস মায়াবাদ আর মুসলমানের সূফীতত্ত্ব। মায়াবাদও সূফীমতের সংমিশ্রণে ও সমন্বয়ে উদ্ভূত। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে, সংগীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মিলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কিরূপ নিত তা হয়তো কল্পনা করা সম্ভব–কিন্তু নিরর্থক। কারণ, মধ্যপথে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারতের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যমুখী করে দিল। অপরপক্ষে ফরাজেয়ী-ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে শরীয়তের প্রতি অত্যধিক অনুরাগ মুসলমানগণকেও রক্ষণশীল এবং আরব-ইরানী তমদুনের পূজারী করে তুলল। ফলে, বাঙলার সংস্কৃতি সম্ভাব্য পরিণতি লাভ করতে পারল না।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনেক কবি বৈষ্ণবপদ-সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। তাদের কেউ করেছেন নেশার ঝেকে আর কেউ করেছেন পেশা হিসেবে। নেশার ঝেকে করার দারণ দুটো :১. সূফী মতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল, ২. জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতূহল প্রভৃতি মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান-প্ৰয়াসজাত যে অভিব্যক্তি তাতে দেশী বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ রূপকের ব্যবহার। বৈষ্ণবদের নামকীর্তন, জীবে দয়া, বর্ণভেদ প্রথার বিলোপ সাধন, বিনয়, নামে রুচি, দশা, সখীভাব, ঐশ্বর্য প্রদর্শন, রাগানুগ্লাভক্তি, তালাক প্রথা, পুনর্বিবাহ প্রভৃতি সূফীদের যিকর, খিদমত, সামা, হাল, সদাসোহাগ, কেরামতি, তরিকত, হকিকত, মারফত প্রভৃতির অনুকরণ মাত্র। ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহও রাধাকৃষ্ণের অভেদতত্ত্ব বা যুগল রূপ পরিকল্পনার উৎস স্বরূপ। এমনকি অদ্বৈতবাদী হিন্দুর দ্বৈতাদ্বৈতবাদও সূফীর দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত। অবশ্য বেদান্ত প্রভাবে পরে সূফীদের কেউ কেউ দ্বৈতাদ্বৈতবাদী হয়েছিলেন। সুতরাং সুফী মতাসক্ত বাঙালি মুসলমানদেরকে বৈষ্ণব সাধনা অনুপ্রাণিত করবে তাতে আশ্চর্য কী? এজন্যেই সাধক নূর কুতুবে আলম এবং সৈয়দ মর্তুজা ফারসি গজল যেমন লিখেছেন, বাঙলা রাধাকৃষ্ণপদও তেমনি রচনা করেছেন। তারা দুই তত্ত্ব অভিন্নরূপে দেখেছেন। রাধাকৃষ্ণ যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা, দেহ ও প্রাণ এবং ভক্ত ও ভগবানের পরিভাষারূপে পাক-ভারতের সর্বত্র গৃহীত হয়েছিল, এঁদের এবং পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষায় মুসলিম রচিত পদ ও দোহাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তা ছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে চিরজিজ্ঞাসু–সেই অনাদিকাল থেকে মানুষ নানাভাবে এ প্রশ্নের সদুত্তর সন্ধান করেছে। আজও তার অবসান হয়নি। কারণ, আজো সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান মেলেনি। এই চিরন্তন জিজ্ঞাসার রূপ মানুষ অবিশেষে একই, কাজেই চিন্তাধারাও কমবেশি একই রূপ। কেননা, সবারই যে চিত্তকাড়া কালার বাঁশী লাগিছে অন্তরে। ইরানী ভাষা ও সাহিত্যে অপটু বাঙালি মুসলমান তাই রাধাকৃষ্ণের দেশী রূপকে জগৎ, জীবন আত্মপরমাত্মায় রহস্য উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছে। শুধু বাঙালি মুসলমানই বা বলি কেন; দাদু, কবীর, রজব, তাজ প্রভৃতি অবাঙালি মুসলমানও রাম সীতা ও রাধা-কৃষ্ণকে বাদ দিতে পারেননি। রাধাকৃষ্ণ রূপক তাঁদের মনন-প্রকাশের বাহনরূপে কাজ করেছে। সতেরো শতকের দরিয়া সাহেব বলেন:
আদি অংত মেরা হৈ রাম।
উন বিন ঔর সকল বেকাম ॥
কহা করা যে মান বড়াই।
রাম বিনা সরহী দুখ দাঈ ॥
কবি শেখ বলেন :
চরণ কমল হী কী।
লোচনর্মে লোচ ধরী
রোচন হরৈ রাচ্যো
সোচধাম ধনকৌ।
সোক নেস নেক হু।
কলেস কৌ ন লেস রহ্যো।
সুমরি শ্রীগোকলেস
গো কলেস মনকৌ।
মইজুদ্দিন বলেন :
বৃংদাবনকী কুংজ গলিন মে
টুংটত টুংটত হারী
দৈহৌ দরস মোহি আপনি।
মৌজ সে এহো কৃষ্ণ মুরারী
পিয়া মোহি আস তিহারী।
আফসোস বলেন :
নিশিদিন কৃষ্ণ মিলন কো সখিয়া
আস লগায়ে ঠাড়ি রহত হৈ।
আফসোস পিয়াকী নেহ-সুরতিয়া।
নিরখত নর ঔনারী রহত হৈঁ।
কবি কাইম বলেন :
হরি হেরত মৈ কিরতা বাবরী
নৈননি সেঁ কব আবৈ
হরি কো লখি কাইম সখিয়া সে
কাহে ন ধূম মচাবৈ।
সাধক এয়ারী বলেন :
হৌ তো খেলৌ পিয়া সংগ হোরী,
জবতে দৃষ্টি পরৌ অবিনাসী
লাগী রূপ ঠগৌরী।
কহ য়ারী যদি কর হরিকী
কোই কহৈ কো কহৌরি
দরিয়াও বলেন :
মুরলী কৌন বজ রৈ হো।
গগন মংডল কে বীচ?
যা মুরলীকে ধুন সে
সহজ রচা বৈরাট।
যা মুরলী কী টেরহি সুন সুন
রহী গোপিকা মোহী।
সব্দ ধুন মিরদংগ বজত হৈ
বারহ মাস বসংত।
অমহদ ধ্যান অখংড আতুর রে
ধ্যায়ত সব হী সংত।
কানুহ গোপী করত নৃত্যহি
চরণ বপু হি বিনা।
নৈন বিন দরিয়ার দেখে
আনংদ রূপ ঘনা।
একেতো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানগণ ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর; তাদের রক্ত-সংস্কারে ভারতীয় প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা-সুফী মতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে, সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভারতীয় ভক্তিবাদ তাদেরকে সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধাকৃষ্ণ রূপক গ্রহণের সংগত কারণ খুঁজে পাই :
সৈয়দ শাহনূরে কয় রাধা কানু চিন হয়
রাধাকানু আপনার তনেরে।
আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ তন রাধা মন কানু শাহনূরে বলে।
অথবা :
সৈয়দ শাহনূরে কয়, ভব কূলে আসি
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী?
অথবা, ওসমানের কথায় :
রাধাকানু একঘরে কেহ নহে ভিন
রাধার নামে বাদাম দিয়ে চালায় রাত্রিদিন,
কানুরাধা একঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।
সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :
আনন্দমোহন মওলা খেলএ ধামালী।
আপে মন আপে তন আপে মন হরি
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারী।
সৈয়দ মর্তুজা কহে সখি, মওলা গোপতের চিন।
পুরান পিরীত খানি ভাবিলে নবীন।
এর সঙ্গে তুলনীয় :
রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যোন্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি। (চৈতন্যচরিতামৃত)।
বিকৃত বৈষ্ণব সাধক–বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপ-সম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদপ্রয়াসী। শুধু তাই নয়, আধুনিক উর্দু কবি হাফিজ জলন্ধরী থেকে বাঙলা কবি নজরুল, জসীমউদ্দীন প্রভৃতি অনেককেই এ রাধাকৃষ্ণ কাব্য-প্রেরণা দান করেছেন।
ফলত, বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মননের ক্ষেত্রে বৈষ্ণব-মতের প্রভাব ও প্রেরণা ছিল গভীর ও ব্যাপক। এজন্যে ষোলো শতককে বাঙলার রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ও বাঙালির মানবতাবোধ বৈষ্ণবান্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল। বাঙলা গীতিকবিতায় প্রেমের অনন্য অনুভূতির অনুপম বিকাশ, চরিত সাহিত্য সৃষ্টি, তত্ত্বালোচনার সূত্রপাত, কীর্তনের বিভিন্ন সুরের আবিষ্কার, সর্বোপরি মানুষের মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি–জীবে ব্ৰহ্ম ও নরে নারায়ণ দর্শন এবং প্রীতিতত্ত্বে দীক্ষা বাঙলাভাষা ও বাঙালির প্রতি চৈতন্য মতবাদের অমূল্য অবদান।