বৈষ্ণবকবিতা

    শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান! 
    পূর্বরাগ , অনুরাগ , মান-অভিমান , 
    অভিসার , প্রেমলীলা , বিরহ-মিলন , 
    বৃন্দাবনগাথা — এই প্রণয়-স্বপন 
    শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে , 
    চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে 
    শরমে সম্ভ্রমে — এ কি শুধু দেবতার! 
    এ সংগীতরসধারা নহে মিটাবার 
    দীন মর্তবাসী এই নরনারীদের 
    প্রতিরজনীর আর প্রতিদিবসের 
    তপ্ত প্রেমতৃষা ? 
  
  
                 এ গীত-উৎসব-মাঝে 
    শুধু তিনি আর ভক্ত নির্জনে বিরাজে ; 
    দাঁড়ায়ে বাহির-দ্বারে মোরা নরনারী 
    উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি যদি তারি 
    দুয়েকটি তান — দূর হতে তাই শুনে 
    তরুণ বসন্তে যদি নবীন ফাল্গুনে 
    অন্তর পুলকি উঠে , শুনি সেই সুর 
    সহসা দেখিতে পাই দ্বিগুণ মধুর 
    আমাদের ধরা — মধুময় হয়ে উঠে 
    আমাদের বনচ্ছায়ে যে নদীটি ছুটে , 
    মোদের কুটির-প্রান্তে যে-কদম্ব ফুটে 
    বরষার দিনে — সেই প্রেমাতুর তানে 
    যদি ফিরে চেয়ে দেখি মোর পার্শ্ব-পানে 
    ধরি মোর বাম বাহু রয়েছে দাঁড়ায়ে 
    ধরার সঙ্গিনী মোর , হৃদয় বাড়ায়ে 
    মোর দিকে , বহি নিজ মৌন ভালোবাসা , 
    ওই গানে যদি বা সে পায় নিজ ভাষা , 
    যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেমজ্যোতি — 
    তোমার কি তাঁর , বন্ধু , তাহে কার ক্ষতি ? 
  
  
    সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি , 
    কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি , 
    কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান 
    বিরহ-তাপিত । হেরি কাহার নয়ান , 
    রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে ? 
    বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে 
    কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে , 
    আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে 
    রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা — 
    রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা 
    চুরি করি লইয়াছ কার মুখ , কার 
    আঁখি হতে! আজ তার নাহি অধিকার 
    সে সংগীতে! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত 
    তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত 
    চিরদিন! 
  
                 আমাদেরি কুটির-কাননে 
    ফুটে পুষ্প , কেহ দেয় দেবতা-চরণে , 
    কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে — তাহে তাঁর 
    নাহি অসন্তোষ । এই প্রেমগীতি হার 
    গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায় , 
    কেহ দেয় তাঁরে , কেহ বঁধুর গলায় । 
    দেবতারে যাহা দিতে পারি , দিই তাই 
    প্রিয়জনে — প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই , 
    তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা! 
    দেবতারে প্রিয় করি , প্রিয়েরে দেবতা । 
  
    বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার 
    চলিয়াছে নিশিদিন কত ভারে ভার 
    বৈকুণ্ঠের পথে । মধ্যপথে নরনারী 
    অক্ষয় সে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি 
    লইতেছে আপনার প্রিয়গৃহতরে 
    যথাসাধ্য যে যাহার ; যুগে যুগান্তরে 
    চিরদিন পৃথিবীতে যুবকযুবতী — 
    নরনারী এমনি চঞ্চল মতিগতি । 
  
  
  দুই পক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা 
    অবোধ অজ্ঞান । সৌন্দর্যের দস্যু তারা 
    লুটেপুটে নিতে চায় সব । এত গীতি , 
    এত ছন্দ , এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি , 
    এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ দিয়া 
    বহে যায় — তাই তারা পড়েছে আসিয়া 
    সবে মিলি কলরবে সেই সুধাস্রোতে । 
    সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে 
    কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে 
    বিচার না করি কিছু , আপন কুটিরে 
    আপনার তরে । তুমি মিছে ধর দোষ , 
    সে সাধু পণ্ডিত , মিছে করিতেছ রোষ । 
    যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে 
    অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে । 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *