দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

বৈশাখ হে, মৌনী তাপস

বৈশাখ হে, মৌনী তাপস

মঙ্গলঘট, আমপাতা আর শোলার কদম ফুল গাঁথা মালা, একটি কচি কলা গাছ, দুটি কচি ডাব, খাঁ খাঁ রোদ ঝিলমিল আকাশ, হাঁসফাঁস গরম, নববর্ষের শুরুটা বড় সাত্বিক। এটা এই বয়সের বোধ; যে বয়সে মানুষ ধাক্কা খেতে-খেতে, সংসারের আগুনে পোড় খেতে-খেতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নি:সঙ্গ হয়ে যায়। ধরার মতো কারোকে না পেয়ে ঈশ্বরকেই ধরে। মানুষের সঙ্গ ছেড়ে প্রকৃতির সঙ্গ করে। গাছপালা, জীবজন্তুকে বন্ধু করে। আপন মনে বকতে থাকে নিজের সঙ্গে। শৈশবে এই বোধ ছিল না। তখন ছিল মজা। পয়লা বৈশাখ মানে সকাল থেকেই এক মহা উৎসব। অল্প একটু কষ্ট ছাড়া দায়দায়িত্বহীন ঘুরে বেড়ানো। আমি ঘুরছি, আমার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছে লোভী ছাগল, সাদা ধবধবে গরু। তাদের নজর দোকানের দু-পাশে রাখা স্নিগ্ধ দুটি কলাগাছ। ঘটের ডাবটাকে এক ঝটকায় তুলে আনতে পারলে মন্দ হয় না। জীবজগৎ আর শিশুর জগৎ প্রায় একই আবর্তে ঘোরে। লোভ। সে যে উৎসবই হোক পেটে ভালোমন্দ কিছু পড়া চাই।

তখন জনসংখ্যা অ্যাতো বাড়েনি। পাড়ায়-পাড়ায় অ্যাতো ঘিচিমিচি বাড়ি হয়নি। দেশলাই-খোপের মতো। মাঠ ময়দান ছিল। রোদ আর বাতাস শিশুর মতো খেলার সুযোগ পেত। ভরা পুকুর, মজা পুকুর, ডোবা, নালা নর্দমা ছিল। প্রতিটি পাড়ায় নামকরা, শ্রদ্ধেয় একটি করে ষাঁড় থাকত। ছাগলের অভাব ছিল না। বাবুরা বেড়া ঘিরে শখের বাগান করতেন। আর নিত্য গরু ছাগলের সঙ্গে চুলোচুলি। যার যেমন স্বভাব। মানুষ ফুলের শোভা দেখে, গন্ধ নেয়, ছাগল চোখ বুজিয়ে চর্বণ করে আনন্দ পায়। কতদিন দেখেছি, তাড়া খেয়ে, গলায় বেড়া পরে ছাগল ছুটছে। পালাবার প্রবল আবেগে বেড়ার সিকি অংশ গলায় হারের মতো পরে বেরিয়ে এসেছে। মুখে ঝুলছে লাউগাছের ফুট খানেক লতা। সেকালের মানুষ তেমন খুনে ছিল না। ওই তাড়াতুড়ি দিয়ে, দু-চারটে গালাগাল ছুঁড়ে শান্ত হয়ে যেত। একাল হলে প্রথমে ছাগলটিকে ফালা করে কাবাব তৈরি করত। তারপর ছুটত ছাগলের মালিকের লাশ ফেলতে।

মানুষ উদার না হলে উৎসব জমে না। পয়সা নয়, জীবনে একটা সুখের ভাব থাকা চাই। একা-একা বই পড়া যায়, দুশ্চিন্তা কি কুচিন্তা করা যায়, উৎসব করা যায় না। উৎসব বড় গণতান্ত্রিক মেজাজের। সকলকে সাদরে ডাকতে হবে। সেকালের তুলনায় একালের মানুষের হাতে অনেক পয়সা। কিন্তু মন মরে গেছে, ফলে নববর্ষের সেই মজাটা আর নেই। মানুষে-মানুষে মেলামেশা কোথায়! কারোর বাড়িতে যাবার আগে অনেক কিছু ভাবতে হয়। কে কী অবস্থায় আছে! আগে পাঁজি দেখে মানুষ যাত্রা করত; এখন পয়লা দেখতে হয় টিভিতে কী আছে! সাংঘাতিক কিছু থাকলে না যাওয়াই ভালো। ব্যাজার মুখে কর্তা বলবেন—কী ব্যাপার হঠাৎ এই সময়ে! গিন্নি ভেতর থেকে মৃদু সুরেই বলবেন, কিন্তু শোনা যাবে, আসার আর সময় পেলে না। তখন সেই সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা, ভেতরে ঢুকব না পত্রপাঠ বিদায় নেবো। যদি লজ্জার মাথা খেয়ে ঢুকি, কেউ কোনও কথা বলবে না। একজন একটা অশ্রদ্ধার চেয়ার এগিয়ে দেবে। ভুলে কথা বলে ফেলে সঙ্গে-সঙ্গে দাবড়ানি, আ:, এখন কোনো কথা নয়। টিভি ছাড়াও একালের সংসারে আরও অনেক ব্যাপার আছে। হঠাৎ গৃহস্বামী বললেন, ‘আপনি বসুন, গল্পগুজব করুন, আমি একটু আসছি।’ তার অর্থ কর্তা-গিন্নিতে চুলোচুলি হয়ে গেছে। কর্তা সাময়িক গৃহত্যাগ করলেন। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘মা কোথায় রে?’ছেলে ফ্যালফ্যালে মুখে বললে, ‘মা! মায়ের মাথা ধরেছে, শুয়ে আছে!’ আমি তাহলে আসি বাবা, দরজাটা দিয়ে যাও।’ বাধ্য ছেলে, সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম তামিলের জন্য এগিয়ে এল। অনেক সময় গৃহস্বামী অতিথিকে গৃহে তোলেন না। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওই দ্বারপথে খাড়া হয়েই প্রথামত কুশল বিনিময়। তিন কথার পর, ‘আচ্ছা আসি!’ বললে, মুখে খুশির উদ্ভাস। কাজ নেই, কর্ম নেই, ব্যাটা সাতসকালে কাজ ভন্ডুল করার তালে এসেছিল। আজকাল কেউ যখন বলেন, ‘সপরিবারে একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে,’ তখন কিন্তু মনে-মনে বলেন, ‘সত্যি যেন এস না।’ দোষ নেই। মানুষের হাতে সময় কোথায়! ছেলেমেয়ের লেখাপড়া। সংসারের হরেক কাজ। লক্ষ রকমের ধান্দা। সমাজ আছে। সামাজিক মনটা গেছে হারিয়ে।

মন খোয়া গেলে মানুষের আর রইলোটা কী! বহিরঙ্গে উৎসব আসে। উৎসব চলে যায়। আত্মিক লাভের হিসেবে জমা পড়ে শূন্য। দেহ ঘিরে নামে ক্লান্তি। দিশাহারা মানুষ খানিক তান্ডবে মাতে। কোনও পরিচ্ছন্নতা থাকে না। অনর্গল ফিল্মি গান। সকাল হতে না হতেই হট্টগোলে প্রায় বধির হবার অবস্থা। মেড ইজির যুগে আমরা সব কিছু সহজ করে নিয়েছি। ঢাউস স্পিকার। একই ধরনের খলবলে গান। এই হল আমাদের তিথি পালনের, মহাপুরুষের জন্মদিন পালনের সহজ রীতি। আজকাল আবার গানের চোঙা রাজপথে পাশবালিশের মতো শুয়ে থাকে। জমিতে সারের মতো হিন্দি গান স্প্রে করা হয়। সংস্কৃতির মাটি এভাবেই সুফলা হবে হয় তো। শত-শত মাল আর গুরুতে দেশ ছেয়ে গেল। বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সির স্টিয়ারিং-এ আড় হয়ে আছেন ডজন-ডজন মিঠুন। কোমর দোলাচ্ছেন ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বা আর কেউ। শ্রীদেবীদের দেখলেই সম্ভ্রম ভুলে সিটি। রুচিবান মানুষ ঘরে বসে হায়-হায় করছেন আর ক্যালেন্ডার দেখছেন। পঁচানব্বই গেল। ছিয়ানব্বই পড়ল। বয়েসে যোগ হল আরও এক। এবার ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা, আলোয় আলোয় চলে যাই। জাতির গাড়ির স্টিয়ারিং-এর টাইরড কেটে গেছে। কোথায় গিয়ে ধাক্কা মারে কে জানে!

নববর্ষের দায়দায়িত্ব এখন ব্যবসাদারদের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। হিসাব ইংরেজি মাস অনুসারে রাখা হলেও সংস্কারের সূক্ষ্ম একটা ভয়ের ফেঁসো লেগে আছে এখনও শহরের এ প্রান্তে ও-প্রান্তে দুটি পীঠস্থান—কালিঘাট, দক্ষিণেশ্বর। প্রথামতো লাল একটি খেরোর খাতায় স্বস্তিকা এঁকে মায়ের মন্দিরে একটু পুজো আচ্চা নিয়ে না গেলে, মা যদি রুষ্টা হন। কোন খাতা তা কে জানে! এক নম্বর, না দু-নম্বর! তারপর তেলে ভেজাল ঢেলে মানুষ অচল করো, কি ওষুধ থেকে ওষুধ তুলে নিয়ে খোল আর খোলসটা রাখা। এটা অবশ্য ধর্মেরই উচ্চ দিক। মায়াবাদ। ব্রহ্মাণ্ড একটি অশ্বান্ড। যাবজ্জন্মং তাবৎ মরণং। জন্মেছো বাবা মরতে তো হবেই। কিম্বা বেদান্ত, জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। ব্রহ্মের স্বপ্নে জীবসকল বুদবুদের মতো ফুটছে আর ফাটছে। অত হায় হায়, হ্যাঁকোচ প্যাঁকোচ করার কী আছে! এ তো স্বপ্ন! দাঁড়াও মাকে সন্তুষ্ট করে গাড়ি করি বাড়ি করি। তোশকে ছোবড়ার বদলে কারেনসি নোট ভরি।

মন্দিরে বিশাল লাইন। এক একজন পুজো শেষ হলেই ঘণ্টার ঝোলা দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারছেন। ঠ্যাং শব্দে মা চমকে উঠছেন। ওই লাইনে গৃহীরাও আছেন। দেখো মা ছিয়ানব্বইটা যেন তালগোলে পার করে দিতে পারি মা।

আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনও সঙ্গতি নেই, ছেলের পড়া, মেয়ের বিয়ে। রক্তে শর্করা। উচ্চচাপ। গৃহিণীর বাত। চোখে চালসে। যাদুদণ্ডটা ঘোরাও মা। সংসার আমার কোমর ভেঙে দিয়েছে। প্রতি বছর লোক লৌকিকতার ধাক্কায় চোখে সরষে ফুল। এই সময়টার আগে মধ্যবিত্তকে খাদের দিকে আরও খানিকটা ঠেলে দেবার জন্যে বাজেট আসে। আমাদের চিঁহি রব আরও বাড়ে। তোমার কাছে চাইছি মা কৃপাময়ী। দেখো! তুমি আবার শুধুই শুদ্ধাভক্তি দিয়ে ছেড়ে দিও না মা। যেমন অনেকে বিয়ের উপহার আনে এক গুচ্ছ গোলাপ, কী নীলে চোবানো রজনীগন্ধার ছড়া। তুমি ‘সলিড’ কিছু ছাড়ো মা। ছেড়ে দেখো ভক্তিটা কেমন আসে! ভক্ত হরিদাস হয়ে যাব। সংসার তো দেওয়া-নেওয়ার জায়গা মা। ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। তুমি আমাকে একটা ফ্ল্যাট দাও, আমি তোমার চরণতলে ফ্ল্যাট হয়ে যাব। খুচ করে একটা প্রমোশন দাও মা, শ পাঁচেক টাকা মাইনে বাড়ুক, তাহলে রাতে এককাপ দুধ খাই। গৃহিণীকে একটু সুমতি দাও মা, যেন মাইনের টাকায় মাস চালাতে পারে। আমার পাওনাদারদের একটু অমায়িক, ভদ্র করে দাও মা। ধার শোধের জন্যে যেন রুদ্রমূর্তি না ধরে মা। বড় বিপাকে পড়েছি মধুসূদন। তুমি তো ইচ্ছে করলেই আমার ওপরঅলাকে স্বপ্ন দিতে পারো। ভোরের স্বপ্ন। যেন জেগে উঠলেও মনে থাকে তাঁর। প্রাোমোশন দে, নয় তো দেখেছিস আমার হাতের খাঁড়া। রোজ যেন মা বাসে, ট্রামে, ট্রেনে একটু বসতে পাই মা। বেশ। কিছু না পারো একটা লটারি পাইয়ে দাও। আমি নগর সংকীর্তন বের করব। সামনেটায় টাক পড়েছে মা, কয়েকগাছা চুল গজিয়ে দাও। আমি রাতে চিকেন খাবো মা। রুটি আলুর দমে পাগল করে দিচ্ছে মা। লাইনের চেয়েও বড় হয়ে যায় চাওয়ার ফিরিস্তি। হাতে একটা মিষ্টির চুবড়ি। কানে লটকানো লাল জবা। এক পাঁজা ধুপ গলগল ধোঁয়া ছাড়ছে। চড়া রোদে শরীর ঝলসাচ্ছে। লাইন এগোচ্ছে গুটি গুটি। কষ্ট না করলে কেষ্ট কি মেলে! কেষ্ট আমার অজুর্নসখা কৃষ্ণ নন। কেষ্ট হলেন আমার যাবতীয় চাওয়া। সারা জীবন শুধুই চেয়ে যাওয়া। যে কোনও অছিলায় দেহি, দেহি। অথচ দুনিয়া এমন কৃপণ, আঙুল গলে এক ফোঁটা জলও কি ঝরে!

কোথায় সেই বৈশাখী শৈশব! একটি নতুন জামা, একটি নতুন হাফপ্যান্ট। তাও কত সাধ্যসাধনা করে। সেকালের পিতারা ছিলেন বড় কঠিন, কঠোর। রুদ্র-মুষ্টিতে ধরে থাকতেন সংসার। ছেলেমেয়েদের নিয়ে পানপ্যানে আদিখ্যেতা ছিল না কোনও। পরিবারের কথায় ওঠ-বোস করতেন না। বরং তাঁর কথাতেই পরিবার তটস্থ। ধারদেনার ঘোরতর বিরোধী। সর্ব অর্থে তাঁরা ছিলেন সংযমী, আদর্শবাদী। মানতেন, একটু দু:খকষ্টে না রাখলে ছেলেপুলে বিগড়ে যায়। মধ্যবিত্তের সন্তান কাপ্তেনী করার জন্যে পৃথিবীতে আসে না। আসে আদর্শের সাধনা করতে। পথ! মহাপুরুষের পথ। সে পথে হেঁটে গেছেন শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, বিজয়কৃষ্ণ, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। সেই শৈশবে রবীন্দ্র জীবন ছিল বিশাল এক প্রভাব। শুধু সংগীত নয়, নৃত্যনাট্য নয়। যেন উপনিষদের ঋষি তিনি। শান্তিনিকেতন থেকে উদগত হচ্ছে অনুকরণীয় আদর্শ। তুচ্ছতা থেকে বেরিয়ে এস। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। বৈশাখ সেই বহ্নিজ্বালা তাপস। সারা প্রকৃতি যেন হোমানল জ্বেলে সাধনায় বসেছেন, বিরাটের সাধনা। ‘বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন অতলের বাণী/এমন কোথায় খুঁজে পেলে।’ এই প্রশ্নেই উত্তর আসে, ‘রুদ্রতপের সিদ্ধি এ কি ওই যে তোমার বক্ষে দেখি, /ওরই লাগি তোমার আসন পাতো হোম হুতাশন জ্বেলে।।’ শৈশবের সেই নববর্ষে অদ্ভুত একটা পবিত্রতা, আধ্যাত্মিকতা ছিল। গোটা পল্লীটা হয়ে উঠত একটা মন্দিরের মতো। এখন আমাদের জীবন আষ্ঠেপৃষ্ঠে মিছিলে বাঁধা। নেশার মতো মানুষের সারি চলেছে অপরাহ্নবেলায় হেলে দুলে—চলছে-এ চলবে-এ। প্রভাতফেরি কিন্তু বেরোয় না ‘কণ্ঠে লয়ে গান’, কারণ তাতে তো দৈহিক রাজনীতি নেই।

প্রণামই ছিল সেই নববর্ষের শ্রেষ্ঠ আরাধনা। গৃহস্থ গুরুজন, গৃহদেবতা, মহাপুরুষের পট, পল্লীর প্রবীণজন, শিক্ষককে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে শুরু হত নববর্ষ। ‘শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান।’ তখন গাঁক-গাঁক করে লাউডস্পিকার মানুষমারা, শান্তিমারা তেল ছিটতো না। শাঁখের শব্দ, ঘণ্টার টিংটিতে আসত অতিথি সাল। উদ্বেগ ছিল না কোনও; কারণ সেকালের সংসার ছিল স্নেহের সংসার, ভালোবাসার সংসার, নির্ভরতার সংসার। জাগতিক কী পাওয়া গেল, না গেল সে হিসেবে মানুষ তেমন উতলা হিংস্র হয়ে উঠত না। তখন আশীর্বাদ ছিল জ্ঞাণী হও, মানুষ হও। একালের আর্শীবাদ হল চালু হও, ধুরন্ধর হও।

ধীরে-ধীরে নেমে আসত সন্ধ্যা। কোথায় জ্বলে উঠল হ্যাজাক, কোথায় বিজলী বাতি। দোকানে-দোকানে পাতা হয়েছে সাদা, ধবধবে ফরাস। বাইরে সার-সার কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। দিনের উত্তাপ তখনও কমেনি। বাতাস থমকে আছে। তাল, সুপুরির পাতা কখনও একটু নড়ে ওঠে তারই প্রতীক্ষা। গহনার দোকানের মালিক গিলে করা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি পরে ক্রমাগত ঘেমে চলেছেন। উত্তপ্ত পথে জল ছিটানো হচ্ছে। গরম একটা ভাপ উঠছে। রজনীগন্ধা সেকালে সুবাস ছড়াতো। ভিজে বস্তার ওপর বরফের চাংড়া ফেলে কাঠের মুগুর দিয়ে পেটানো হচ্ছে। কচি কাচ ভাঙার মতো মুচমুচ শব্দ হচ্ছে। গোলাপী বরফ-ভাসা ঘোলের সরবৎ গেলাসে-গেলাসে টাল খাচ্ছে। প্রবীণরা আসছেন শিশুটির হাত ধরে। কুশল বিনিময়, একটু হাসি। বিদায়ের কালে হাতে একটি প্যাকেট, গোল করে মোড়া বাংলা কালেন্ডার। দোকান থেকে দোকানে পরিক্রমা শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর। এক আকাশ তারার চাঁদোয়ার তলায় বৈশাখের প্রথম দিনটি নিদ্রা গেল সুখে। জমিদার বাড়ির পেটা ঘড়ি বাজছে, এক, দুই, তিন, বারো। কোরাসে ডাকছে দক্ষিণপাড়ার তিনটে কুকুর। নতুন জামাটা মা খুলে নিয়েছেন। ইজের আর কাঁধ কাটা গেঞ্জি পরে শিশুটি শুয়ে আছে অকাতর ঘুমে। কেউ যায়, কেউ আসে—এই তো দুনিয়ার নিয়ম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *