বৈরিগীর ভিটেয়

বৈরিগীর ভিটেয় 

ভীষণ শীত! বাহিরে বৃষ্টি আর বাতাসে মাতামাতি চলিতেছে। তারাপদ বলিয়া দিয়াছিল, চাকর একটা তোলা উনানে এক উনান আগুন রাখিয়া গেল; সকলে নিজের নিজের চেয়ার টানিয়া লইয়া আগুনটা ঘেরিয়া ফেলিল। যে-প্রসঙ্গটা শুরু হইয়াছিল তাহারই জেরটা ধরিয়া রাখিয়া সুধেন বলিল, অশ্বিনী বিশ্বাস না করো, নেই-নেই; তুমি কিন্তু এত রাত্রে ও-পথ দিয়ে আর বাড়ি যেও না, তারাপদ যেমন বলছে এইখানেই খেয়ে-দেয়ে রাতটা কাটিয়ে দাও। ভূত না থাক, এই রকম ভয়ংকর রাত্রের একটা নিজস্ব স্পিরিট আছে, অবস্থাগতিকে সেইটেই মানুষের প্রাণঘাতী হতে পারে। 

অম্বিকা বলিল, নটা থেকে আবার অমাবস্যা পড়েছে। 

অশ্বিনী উত্তর করিল, যাক, মানুষের স্পিরিট থেকে রাত্রির স্পিরিটে নেমে এসেছ; এইবার বলবে রাস্তার স্পিরিট, পুকুরের স্পিরিট! আর এতই যদি চারিদিকে স্পিরিটের হুড়োহুড়ি তো অক্ষয় তো থাকবেই আমার সঙ্গে.. 

অক্ষয় তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, মাফ করতে হচ্ছে, শর্মা আর আজ এ-ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না। এই রাত্রে দু-মাইল পথ ভেঙে যাওয়ার শখ আমার নেই, তাও আবার সিদ্ধেশ্বরীর শ্মশানঘাটের কাছ দিয়ে! তোমার মতো আমার নতুন বিয়ে নয় যে, জবাবদিহি দিতে হবে; বরং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ের কথাটা এত দিনে যে উঠেছে, তার জন্যে আমায় শত্তুরমুখে ছাই দিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। 

স্থানটা এদের দৈনিক তাসের আড্ডা—তারাপদর বাসা। মিল্-এরিয়াটা এইখানে প্রায় শেষ হইয়াছে। এর পরেই একটা প্রকাণ্ড মাঠ, তাহার একটা দিক গঙ্গা পর্যন্ত প্রসারিত। মুক্ত মাঠের উপর দিয়া এলোমেলো হাওয়া আসিয়া চারিদিক দিয়া ঘরটায় প্রবেশের চেষ্টা করিতেছে, দুয়ার-জানালার ছিদ্রপথে কখনও কান্না, কখনও অনুযোগ, হাওয়ার উগ্রতায় কখনও বা ভীত আর্তনাদের মতো শব্দ হইতেছে। একবার দুয়ারের ছিটকিনিটা পর্যন্ত এমন ঝঝনাইয়া দিল যে, সবাইকেই ফিরিয়া চাহিতে হইল; অম্বিকা একটু নিষ্প্রভ হাস্যের সহিত বলিল, সত্যিই ভেতরে আসতে চাইছেন নাকি ওঁদের কেউ? 

অক্ষয় বলিল, যদি চানই তো কিছু বিচিত্র নয়। এই যে প্রবল ধাক্কাটা লাগল দোরের গায়ে, এটা এই পাগলা হাওয়ার হাওয়ারই বেশি সম্ভাবনা,—– পনেরো আনা; কিন্তু বাকি এক আনার মধ্যে আর একটা মস্ত সম্ভাবনা আছে। সেটাকে শুধু গঞ্জিকা বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না, কেন-না, তাতে দর্শনশাস্ত্রের সিলমোহর আছে। ব্যাপারটা এই…তোমরা জানো দর্শনের একটা থিয়োরি হচ্ছে যে, আসলে সময়ের বিভাগ অর্থাৎ ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলে কোনও বস্তু নেই, ও ধারণাটা নিতান্ত আপেক্ষিক! প্রকৃত তথ্য এই যে There is one eternal ‘Now’—অর্থাৎ কাল সর্বব্যাপী একটা শাশ্বত সত্তা। এখন, তাই যদি ঠিক হয় তো জগতের যা কিছু ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে আর ঘটবে বলে আমরা মনে করি, সবই একই সময়ে উপস্থিত রয়েছে—শুধু time and space অর্থাৎ স্থান আর কালের বিভিন্ন স্তরে। তার মানে ঠিক এই স্থানে আমরা যাকে অতীত বলি, সেই সময় যদি কোনও ঘটনা ঘটে থাকে তো এখনও তা ঘটছে—শুধু আমাদের জ্ঞানের অন্তরালে। জ্ঞানের অন্তরালে এই জন্যে যে, যে-স্তরে তা ঘটছে সেই স্তরে আমরা এই স্থূল চেতনা নিয়ে পৌঁছোতে পারি না। অনেক সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূল হলে, বা অন্য কোনও অজ্ঞাত কারণে, আমরা হঠাৎ সেই ঘটনার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি। তার মানে… 

সুধেন বলিল, দোহাই তোমার, আর ‘তার মানে’ নয়, টীকা ক্রমেই মূলের চেয়ে জটিল হয়ে উঠছে। বরং প্রথমটা কিছু বুঝেছিলাম, এখন আর… 

অক্ষয় বলিল, বুঝিয়ে দিচ্ছি খুব স্থূল ভাবে,—ধরো, কোনও অতীতে ঠিক এই জায়গাতে একটা বাড়ি ছিল কারুর—এমনই এক দুর্যোগের রাত্রি,– সেদিনের সেই গৃহকর্তা বাড়ির অন্য কেউ–বা ধরো, কোনও অতিথি বহু দূর থেকে এসে এই বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়াল—শীতে, বৃষ্টিতে, পথের শ্রান্তিতে একেবারে বিপর্যস্ত। দ্রুত ঘা পড়ল বন্ধ দরজার ওপর; হয়তো কাপড়ের আড়ালে প্রদীপ নিয়ে গৃহিণী কিংবা বাড়ির অন্য কোনও বধু গিয়ে দরজা খুলে দিলে। কিংবা হয়তো আগন্তুক বাড়ির কেউ নয়—–কোনও পথিক মাত্র আশ্রয় ভিক্ষায় এসেছে। কপাটে আঘাত হওয়ায় সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ভেতর থেকে প্রশ্ন হল— 

—কে ধাক্কা দেয়?… 

তারাপদ, সুধেন, অক্ষয়, অম্বিকা, রমেন হঠাৎ চমকিয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল, অশ্বিনীও যেন বাদ গেল না। অক্ষয়ের কথার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বাহিরে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আওয়াজ হইল, কে? 

দুয়ারের পানে শঙ্কিত নেত্রে একবার চাহিয়া প্রায় সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করিয়া উঠিল, কে?—কে ধাক্কা দেয়? 

কিন্তু তখনই ঘরের পাশের ডোবাটায় একটা ব্যাঙের আওয়াজ পাইয়া কতকগুলা ব্যাং একসঙ্গে ‘কে-কেও’

‘কে-কেও’ করিয়া তারস্বরে আওয়াজ তুলিল।—সকলে লজ্জিত হইয়া আবার পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল। 

অশ্বিনী হাসিয়া বলিল, যাক অক্ষয়ের থিয়োরিটা, অনেকটা স্পষ্ট হল এই দিয়ে—যেমন এই বায়ুর স্তরে বায়ু হানা দিচ্ছে আর জলের স্তরে ব্যাং ‘কে-কেও’ আওয়াজ করছে—দুটো সময়-হিসেবে এক সঙ্গেই হচ্ছে, মাঝখান থেকে আমরা দুটো জুড়ে একটা জিনিস খাড়া করে দিয়ে আঁতকে উঠলাম।…কেমন হে অক্ষয়, এই তো? 

অক্ষয় একটু রাগিয়া বলিল, অত উড়িয়ে দেবার কথা নয় হে অশ্বিনীবাবু, ঠিক এই ধরনের ব্যাপার আমাদের গ্রামে একবার হয়ে গেছে, আর মজার কথা এই যে তুমিও স্বয়ং তার মধ্যে ছিলে। এমন কিছু বেশি দিনের কথাও নয়; অথচ এখন

অশ্বিনী স্মৃতিকে আলোড়ন করিবার চেষ্টা করিয়া অক্ষয়ের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ ঈষৎ হাস্যের সহিত বলিয়া উঠিল, ও!…তুমি বৈরাগীর ভিটের সেই সেদিনকার কাণ্ডটার কথা বলছ? 

তারাপদ, সুধেন, অম্বিকা, রমেন একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, কী, কী, ব্যাপারটা কী শুনি? 

অক্ষয় অশ্বিনীকে বলিল, বলো না অশ্বিনী, অবিশ্বাসীর মুখেই শোনা যাক ব্যাপারটা।

অশ্বিনী বলিল, তাতে জিনিসটার অমর্যাদা হবে। তুমিই বলো, আমি না হয় শেষ কালে টীকা করে দোবখন। যদি কারুর সন্দেহ থাকে তো পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

অক্ষয় বলিতে আরম্ভ করিল, তারাপদ, তুমি বৈরিগীর ভিটেটা দেখেছ, বলে দিলেই বুঝতে পারবে। সেদিন সন্ধেয় আমাদের বাড়ি যাবার সময় একটা উঁচুপানা জায়গায় একটা খেজুর গাছ দেখেছিলে মনে আছে? 

তারাপদ বলিল, আছে মনে। সেই লম্বা উঁচু হয়ে গিয়ে আবার ঘাড়ের কাছটায় মুচড়ে নেমে এসেছে—সেইটে তো? 

হ্যাঁ, সেইটে। তুমি বলেওছিলে—গাছটা বেয়াড়া দেখতে তো!…আমি বলেছিলাম— জায়গাটার ইতিহাস আছে একটা, বলব বাড়ি গিয়ে। তারপর তুমিও জিজ্ঞেস করোনি, আমিও বলতে ভুলে গেছি।…সেই উঁচু ঢিবিটা বৈরিগীর ভিটে। জায়গাটার একটা বিশেষত্ব এই যে, এক ওই কাঁধ-মোচড়ানো খেজুরগাছ ছাড়া সবুজ একটি ঘাসের কণা পর্যন্ত দেখতে পাবে না। কিছু হয় না ওটুকুতে। কলেজে দু-পাতা কেমিস্ট্রি পড়ে আর সব জায়গার মতো আমাদের গ্রামেও দু-একজন দিগ্‌গজ বৈজ্ঞানিক গজিয়েছেন, নাকে চশমা দিয়ে তাঁরা অবশ্য বলছেন—ঘরের দেয়াল পড়ে জায়গাটা বড্ড নোনা হয়ে গেছে, তাই কিছু হয় না; কিন্তু যারা জানে তারা ঠিকই জানে যে, সবুজ প্রাণবন্ত কিছু হবার জো নেই ও-ভিটেতে। ওর ওপর প্রাণের অভিশাপ আছে—-পাশের চারি দিকেই সবুজ লতা-আগাছার ঘন জঙ্গল—ছাগল চরছে, গোরু চরছে, ছেলেমেয়েরা বৈঁচি-আঁশফল সংগ্রহ করছে, শুধু বৈরিগীর ভিটেয় কিছু হবে না, জীবন্ত কারুর পায়ের দাগ পড়বে না। ওই একটি খেজুরগাছ,—সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাঙা কাঁধ আস্তে আস্তে দুলিয়ে দুলিয়ে পাহারা দিচ্ছে—অভিশাপের কোথাও ব্যতিক্রম ঘটল কি না। লোকে বলে নাকি, ওই গাছটার মাথায়ও কেউ কখনও একটা পাখি বসতে দেখেনি, অবশ্য সত্যি-মিথ্যে ভগবান জানেন। 

বৈরিগীর ভিটের ইতিহাস—সে এক সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার, আজকের যে ঘটনার কথা তুলেছি, তার সঙ্গে যেটুকু সম্বন্ধ আছে সেইটুকুর কথাই বলব, সবিস্তারে না হয় অন্য একদিন বলা যাবে। 

ওই খেজুরগাছের নিচে গোকুল বৈরিগীর বাড়ি ছিল। পরিবারের মধ্যে নিজে, স্ত্রী বিন্দু বোষ্টমি, গোকুলের প্রথম পক্ষের একটি মেয়ে আর সাধন। এই সাধন যে আসলে গোকুল বৈরিগীর কে ছিল কেউ জানে না। কেউ বলত, তার দূরসম্পর্কের এ ভাই, কেউ বলত প্রথম পক্ষের খুব দূরসম্পর্কের শালা, কেউ বলত গুরুভাই,— মোট কথা খুব নিকট-আত্মীয় কেউ না হয়েও সাধন গোকুলের বাড়িতে বহুদিন থেকেই ছিল। সাধন যাত্রার পালা বেশ বাঁধতে পারত; এদিকে ছিল পঙ্গু, তার ডান পা-টা জন্ম থেকেই শুকনো আর অসাড়। যখনই দেখ, শুকনো পা আর একটা মোটা খাতা কোলে করে সাধন পালা লিখে যাচ্ছে। উঠত খুব কম, কেউ এলে পালা নিয়ে কথাবার্তা হত, সন্ধের সময় গোকুল গাঁজার ছিলিম হাতে এসে বসত, দুটো সুখ—দুঃখের কথা হত। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক এক খাওয়া নিয়ে, সেটাও বেশি দিনই গোকুলের মেয়ে রেবতী দিয়ে যেত। 

এই রেবতী মেয়েটি যতই বড় হয়ে উঠতে লাগল, ততই বাইরে ভাত নিয়ে আসাটা তার কমে আসতে লাগল। সাধন লোকটার পা শুকনো ছিল বটে, কিন্তু মন শুকনো ছিল না—বুঝতেই পার, শুকনো মন নিয়ে কেউ কখন যাত্রার পালা বাঁধতে পারে না। যেদিন বাইরে ভাত না আসত, সেদিন সে বগলে ক্রাচ দিয়ে ভেতরে উপস্থিত হত, রেবতীর মার কাছে তার নতুন-বাঁধা পালার কথা সবিস্তারে পাড়ত এবং দোরের আড়ালে, কিংবা উঠোনের ও-পাশ রেবতীর উপর তার প্রভাব কী রকম হচ্ছে তার খোঁজ রাখত। লোকটার বয়েস খুব বেশি হয়নি—এত দিন পালা বাঁধা নিয়েই ছিল; বোঝা গেল, এবার তার মনে ঘর বাঁধার তাগিদ জেগেছে। অবশ্য সে নিজে ছাড়া ভালোভাবে কথাটা বুঝল রেবতীর মা, কিছু কিছু রেবতীও বোধহয় ক্রমে রেবতীর বাইরে আহার দিতে যাওয়া খুব কমে গেল, এবং সাধনের শুধু আহারের সময় ছাড়া অন্য সময়েও ভেতরে আসার নানান রকম প্রয়োজন হয়ে উঠতে লাগল! এই সময়ে রেবতীর মা হঠাৎ বিসূচিকায় মারা গেল এবং তার মাস—দুয়েক পরে গোকুল বিন্দু বোষ্টমির সঙ্গে মালা বদল করে তাকে বাড়িতে নিয়ে এল। 

গোকুল লোকটা ছিল, যাকে বলে ন্যালাখ্যাপা-গোছের। রেবতীর মায়ের সঙ্গে মালা বদল করে একটানা আঠারো বছর ঘর করে এসেছে, এর মধ্যে একটা মেয়ে হয়েছে—এই পর্যন্ত জানে; কিন্তু সে যে বড় হয়েছে এবং তার বড় হওয়ায় শুকনো—পা সাধনের বাড়িতে আসা বেড়েছে এসব তার চোখে পড়েনি। বিন্দুকে আনার পর ব্যাপারটা সম্বন্ধে তার হঠাৎ চৈতন্য হল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে চৈতন হল না। সাধন যে রেবতীর জন্যই শুকনো পায়ের উপর উপদ্রব করছে, এটা সে টের পেল না। তার মনে হল, বিন্দুর আসবার পর থেকেই সাধনের গতিবিধির মধ্যে এক পার্থক্যটুকু এসেছে। এই ভ্রান্তি থেকে জটিলতার আরম্ভ হল। 

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সাধনের বাড়িতে আসা অল্প অল্প করে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। বিন্দু বোষ্টমি হয়ে গেল ভীষণ রকম পর্দানশিন। শেষে এমন পর্যন্ত হল যে, গোকুল বাইরে গেলে বাড়ির দোরে শেকল উঠতে লাগল। … 

একদিন গোকুলের কাজ ছিল দূরে কোথায়। যথারীতি শেকলের ওপর সেদিন একটা তালাও ঝুলিয়ে গিয়েছিল দোরে, – সন্ধের সময় এসে তালা খুলতে যাবে, হঠাৎ খেজুরগাছের মাথায় একটা খস্থসে আওয়াজ শুনে নিচে গিয়ে দাঁড়াল, স্পষ্ট বুঝতে পারলে—ওপরে একজন লোক; ডাকলে, কে?… নেমে এস। 

সাধন আস্তে আস্তে নেমে এসে সামনে দাঁড়াল। গোকুল একটু মাত্রও বিস্মিত হল না। প্রশ্ন করলে, খেজুরগাছে কে, এই সন্ধেয়? 

সাধন একটু কাঁপা গলায় বললে, শিউলি আজ নতুন গাছ কেটেছে—দেখছিলাম রস হল কি না! 

গোকুল বললে, আমি আসল কথাটা বলব? তুমি অন্য জায়গায় রসের সন্ধান পেয়েছ। আজ সমস্ত দিন দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি, তাই এই সন্ধেয় গাছে চড়ে— 

সাধন ধরা পড়ে স্বীকার করে ফেললে। গোকুলের পায়ের ওপর প’ড়ে বললে, আমি পঙ্গু, কিন্তু একেবারে নির্গুণ নয়, গোকুলদা; তুমি দাও আমায় রেবতীকে, তাকে আমি সুখে রাখব। 

গোকুল হেসে উঠল; বললে, এখনও মিথ্যে বলছ রেবতীর কথা তুলে?—আমায় বোঝাতে চাও যে, তুমি রেবতীর টানেই—। সঙ্গে সঙ্গেই একটু কী ভেবে নিয়ে গলা নরম করে বললে, তা বেশ, খেজুরগাছের কাঁটাও যখন তোমার কাছে তুচ্ছ, তখন নিশ্চয় তুমি ভালোবাস আমার মেয়েকে। চলো, ভেতরে চলো, বিয়ের কথা খেজুর—গাছতলায় দাঁড়িয়ে হয় না। 

অক্ষয় একটু চুপ করিয়া বাহিরের দুর্যোগটা যেন ভালো করিয়া অনুভব করিয়া লইল; তাহার পর আরও একটু গুটাইয়া বসিয়া বলিল, ক্রমে বেড়েই চলেছে দেখছি যে! 

তারাপদ প্রশ্ন করিল, তার পর? 

অক্ষয় বলিল, তার পর আর কী! বৈরাগীর বাড়িটা একটেরেয় বলে সেদিন কেউ বুঝতে পারেনি, পরদিন সকালেই টের পাওয়া গেল—গোকুল বৈরাগী তিনটে খুন করে উধাও হয়েছে। অবশ্য ধরা পড়ে কিছুদিন পরেই।…সাধনের ঘাড়টা ছিল মচকানো, লোকশ্রুতি যে পরের দিনই একটা দমকা হাওয়া উঠে খেজুরগাছের মাথাটা ওই রকম করে মুচড়ে দিয়ে যায়। 

সুধেন খুব অন্যমনস্ক হইয়া গিয়াছিল, হঠাৎ যেন সংবিৎ পাইয়া প্রশ্ন করিল, রেবতীকেও খুন করলে? সে কী করেছিল? 

অক্ষয় হাসিয়া প্রশ্ন করিল, রেবতীর জন্যে তোমার প্রাণ কাঁদল বলে তাকে খুন করাই যে বেশি অন্যায় হয়েছিল এমন তো নয়; বিন্দুরই বা দোষ কি? সাধনেরই বা কি এমন অন্যায় হয়েছিল? 

সুধেন অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, না, সে কথা বলছি না। মানে…থাক তোমার বৈরিগীর ভিটের পরবর্তী কী ইতিহাস যেন বলতে যাচ্ছিলো, তাই বলো। 

অক্ষয় বলিতে লাগিল, বৈরিগীর ভিটেকে সেই থেকে সবাই এড়িয়ে চলে। পাড়ার জীবন্ত বাড়িগুলো থেকে দূরে, নিজের কাহিনি বুকে করে বৈরিগীর ভিটে পড়ে আছে, না-ঘাঁটাও কিছু বলবে না ঘাঁটাও এমন কিছু একটা অভিজ্ঞতা দেবে যা সহজে ভুলে উঠতে পারবে না। নানা প্রকার দেখে ঠেকে গ্রামের লোক ছেড়ে দিয়েছিল। এমন সময় সেবার গরমের ছুটিতে দেশে ফিরে এসে একদল তোমাদের আধুনিক ছেলে গ্রাম থেকে অন্ধ সংস্কার দূর করবার জন্যে একেবারে অন্ধভাবে মেতে উঠল। ঠিক করলে তারা ওই বৈরিগীর ভিটের বুকের ওপর স্টেজ খাটিয়ে থিয়েটার করবে। 

গ্রামের প্রাচীন অভিজ্ঞ লোকেরা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললে। বললে, অন্ধ সংস্কার বলো বা যা-ই বলো, লোকে চিরকালটা যা মেনে এসেছে—ভূত, প্রেত, উপদেবতা, হাঁচি, টিক্‌টিকি, বার, ক্ষণ—সবই মানা উচিত। দু-অক্ষর ইংরেজি পড়লেই সব মিথ্যে হয়ে যায় না। 

কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। বার-ক্ষণের কথায় ছেলেরা ঠিক করলে সামনের শনিবারটাতেই তারা প্লে-টা করবে, সেদিন অমাবস্যাও আছে; আর টিক্‌টিকি স্বাধীনচেতা জীব, তাদের উপর তো হুকুম চলবে না, তবে থিয়েটারের সিন তোলা, সিন ফেলা তারা করবে হাঁচির সাহায্যে, ঘণ্টা দিয়ে নয়; পাঁচ-ছ জন ছোকরা এই জন্যে নস্যি আর কাঠি নিয়ে তোয়ের থাকবে। এরও যথারীতি রিহার্সাল আরম্ভ হল। 

উপদেষ্টারা হাল ছেড়ে দিলে। 

শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত কিছু লোক এদের দিকেও ঝুঁকল :কয়েক জন পার্টের লোভে, কয়েকজন আবার আধুনিক হবার লোভে বোধহয়। কয়েক জন আবার এই জন্যে বোধহয় যে, ভালো রকম খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল,—শিঙাড়া, কচুরি, লুচি, সন্দেশ, আলুর দম, আর ঢালোয়া চা। একজন ময়রা ডাকিয়া বৈরিগীর ভিটের এক পাশেই এসব তৈরি করবার ব্যবস্থা হল। জন তিন-চার ছেলে এই দিকটা নিয়ে রইল,—জিনিসপত্র জোগাড় করা, তদারক করা—এই সবের জন্যে। 

অশ্বিনী বলিল, আমিও একজন ছিলাম তার মধ্যে। 

অক্ষয় বলিল, তাই তোমার অবিশ্বাসটা আরও বেশি। 

তারাপদ বলিল, ফাঁকা বাহাদুরিতে একটা আরাম আছে কিনা— 

অক্ষয় বলিতে লাগিল, দল যখন পুরু হয়ে উঠল, আরও কয়েক জন এল—. সাহসী বলবে লোকে এই লোভে। জানোই তো—ভিড়ের মধ্যে ভয় থাকে না। ঠিক হল দুটো প্লে হবে, বেশ বড় দেখে, অর্থাৎ সমস্ত রাত ধরে ভূতের ভিটেয় নৃত্য করতে হবে, ভূতেরা যেন না দুয়ো পাড়তে পারে যে, প্রথম রাত্রে একটু চেহারা দেখিয়ে সব পালাল। পালা ঠিক হল ‘চন্দ্রগুপ্ত’ আর ‘পাণ্ডবগৌরব’। 

শনিবার সন্ধে থেকে জায়গাটা বেশ গমগম করে উঠল। প্রথমে ভাবা গিয়েছিল, লোক হবে না, ভূতেদেরই দেখাতে হবে প্লে-টা; কিন্তু ক্রমে এক এক করে অনেক লোক জুটে গেল। হোগলা দিয়ে একটা অডিটোরিয়াম করা হয়েছিল, সেটা উপচে বাইরে পর্যন্ত লোক জমে উঠল। 

ঠিক নটার সময় একেবারে আট-দশটা ছেলের হাঁচির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে কন্‌সার্ট বেজে উঠল। বাইরের কয়েক জন ভূত-বিরোধী ছোকরা দর্শক তালি দিয়ে এদের অভিনন্দিত করতে যাবে, প্রবল একটা বাধা পড়ল;—কন্‌সার্ট বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটা জিনিস উঠল,—কোথাও কিচ্ছু নেই, একটা উৎকট রকমের দমকা হাওয়া। ঠিক কে যেন অডিটোরিয়াম আর স্টেজের ঝুঁটি ধরে একটা কড়া ঝাঁকানি দিয়ে বৈরিগীর ভিটের পুরোনো পাহারাদার সেই কাঁধ ভাঙা খেজুরগাছটাকে জাগিয়ে দিয়ে আকাশ বেয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। একটা রীতিমতো গোলমাল হল অডিটোরিয়ামে। যারা বুদ্ধিমান তারা ব্যাপার দেখে পাতলা হল। কিন্তু এদের বাহাদুরি দিতে হবে—কন্সার্ট একবারও থামল না— 

অশ্বিনী বলিল, তার কারণ সেটা ছিল গ্রামোফোনের রেকর্ড। 

অক্ষয় কথাটা কানে না তুলিয়া বলিল, কন্‌সার্ট থামিলে হাঁচির আরও একটা গুরুতর আওয়াজ হল, সঙ্গে সঙ্গে ড্রসিন উঠল। হাঁচিটা আরও গুরুতর করবার অর্থ—ভূতেরা যদি দমকা হাওয়া হয়ে দেখা দিয়ে থাকে তো যত পারে দিক, এরা পেছপা নয়।…এরা যে কাদের ঘাঁটাচ্ছে তখনও টের পায়নি। এবার আর ঝড় উঠল না, কিন্তু যা আরম্ভ হল কিছু দিন এখন মনে থাকবে বাছাধনদের।…ড্রসিন উঠল। তারাপদ, তোমার আলমারিতে চন্দ্রগুপ্ত’ আছে? দাও তা হলে ব্যাপারটা যেমন হয়েছিল সঠিক বর্ণনা করতে পারব। 

তারাপদ উঠিয়া আলমারি হইতে ডি. এল. রায়ের বাঁধানো গ্রন্থাবলি বাহির করিয়া আনিয়া অক্ষয়ের হাতে দিল। অক্ষয় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পালাটা খুলিয়া বাহির করিয়া বলিতে লাগিল, ড্রপ উঠতেই একটা নদীর দৃশ্য। সিন্ধু নদ। সূর্যাস্তের সময়। সিনে নদীর জলের কাছটায় একটু চিরে তার মধ্যে গোল লাল রঙের একটা কাগজ অর্ধেকটা সাঁদ করিয়ে দেওয়া হয়েছে,—মানে, সূর্য অর্ধেক অস্ত গেছে, বাকি কাগজটা টেনে দিলেই সূর্য একেবারে ডুবে যাওয়া হবে আর কী। 

সামনেই সেকান্দার, সেলুকাস আর হেলেন; হেলেন সেলুকাসের হাত ধ’রে দাঁড়িয়ে। তিন জনেই সূর্যাস্ত দেখছে। 

এই সময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল। সূর্যের দরুণ রাঙা কাগজটা যেই আস্তে আস্তে টেনে নেওয়া হল, স্টেজের কড়া গ্যাস-ল্যাম্পটা কয়েক বার দপ দপ করে হঠাৎ নিবে গেল। 

তোমরা বোধ হয় বলবে, ব্যাপারটা কাকতালীয়-ন্যায় গোছের একটা কোইন্সিডেন্স মাত্র, কিংবা গ্যাস-ল্যাম্পগুলোর একটা দোষই এই যে ঠিক সময় বুঝে নিবে বসে থাকে। পরে সেই নব্যদের মধ্যেও ধীরে সুস্থে সেই কথাই হয়েছিল; কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে অন্ধকারের ছায়া যেন সবার মুখ কালি করে দিলে। অডিটোরিয়ামে তো একটা ভীষণ হট্টগোল উঠলই, আর এদিকে স্টেজের ওপরও নব বীরপুঙ্গবদের একটু মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করতে হল। মুখ ফুটে না বললেও কারুর যেন সন্দেহ রইল না যে, প্রথমটা অর্থাৎ দমকা হাওয়াটা ছিল যেন কারুর হুমকি, তাতে ফল না হওয়ায় সে-ই আবার এই মোক্ষম ঠাট্টার অবতারণা করেছে।—বাতাসে যেন একটা হি-হি—হি করে বিদ্রুপ হাসির চাপা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।…বাঃ, সূর্যাস্ত হলে অন্ধকার হয়ে যাবে না? তবে আর তোমরা সিনারি দেখাচ্ছ কি? 

ড্রপসিন ফেলে আবার আলো জ্বালা হল। আর যাই হোক, হাঁচিটা যে ফললই এতে আর কারুর সন্দেহ রইল না। দ্বিতীয় বারও অবশ্য হাঁচি দিয়েই ড্রপসিন উঠল, তবে জোর অনেক কমে এসেছে। এদিকে অডিটোরিয়ামও অর্ধেকের বেশি খালি, যারা আছে তারা খুব গা ঘেঁষে ঘেঁষে ভয়ের নেশায় উৎসুক ভাবে বসে আছে। 

যাক, প্লে আরম্ভ হল। সেকান্দার বলে যাচ্ছে (অক্ষয় বইয়ের দিকে চাহিল), ‘সত্য সেলুকাস্! কী বিচিত্র এই দেশ! দিনে প্রচণ্ড সূর্য এর গাঢ় নীল আকাশ পুড়িয়ে দিয়ে যায়, আর রাত্রিকালে শুভ্র চন্দ্রমা এসে তাকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় স্নান করিয়ে দেয়। তামসী রাত্রে অগণ্য উজ্জ্বল জ্যোতিঃপুঞ্জে যখন এর আকাশ ঝলমল করে, আমি বিস্মিত আতঙ্কে চেয়ে থাকি।…’ 

 এই পর্যন্ত বলে সেকান্দার অডিটোরিয়ামের গ্যাস-ল্যাম্পের দিকে চেয়ে, চোখ মুখে যতটা সম্ভব আতঙ্কের ভাব ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল যেন সত্যিই কিছু একটা দেখেছে। প্রথম সবাই ভাবলে সেকান্দার জেশ্চার-পশ্চার দেখাচ্ছে। কেষ্টা, যে সেকান্দারের পার্ট নিয়েছে, তার আবার ওদিকে একটু বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল, কেষ্টার হিসাবেও বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রশ্টার তাগাদা দিতে লাগল, এবার বল—’প্রাবৃটে ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি… প্রাবৃটে ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি’–বল না কেষ্ট—’প্রাবৃটে ঘনকৃষ্ণ’–বল…হয়েছে তো পশ্চার, মস্ত বড় পশ্চারি তুই—শিশির ভাদুড়ী! 

প্রম্প্রটার ছাড়াও উইংয়ের দুই দিক থেকে ঘন ঘন তাগাদা দিতে লাগল; অডিটোরিয়ামেও তালি পড়ল; কিন্তু সেকান্দারের মাথায় যে কী ‘বিস্মিত আতঙ্ক’ ঢুকে গেছে, না চোখ ফেরায়, না পার্ট বলে। প্রশ্টার শেষকালে হেরে বললে, সেলুকাস, তা হলে তুমি বলো, ‘সত্য সম্রাট!’…ও পশ্চার দেখাক 

সেলুকাস এমন ভাবে ফ্যালফ্যালিয়ে ফিরে চাইলে যেন কথাটা বুঝতে পারেনি, তারপর হঠাৎ সামলে নিয়ে বললে, সত্য সম্রাট। 

এবার সেকান্দার বলল, “কোথাও দেখি তালীবন গর্বভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে’ বল না কেষ্টা, কী জ্বালা! 

কেষ্টার যেন হঠাৎ খেয়াল হল; প্রশ্টারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলে, কী বলব?

অডিটোরিয়ামে আবার তালি পড়ল। ‘ভূতে পেয়েছে, ড্রপ্ ফেলে দাও’ বলে একটা শোরগোল উঠল, এবং আরও এক দল দর্শক পৃষ্ঠভঙ্গ দেওয়ায় অডিটোরিয়ামটা যেন খাঁ-খাঁ করতে লাগল। প্রশ্টার ভেংচি কেটে বললে, কী বলব! কচি খোকা!…বল —কোথাও দেখি তালীবন গর্বভরে মাথা উঁচু করে…’ 

কেষ্টা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আবার প্রশ্ন করলে, কেন? 

আবার একচোট হাততালি। সেই গোলমালে প্রম্পটার প্রাণের আক্রোশ মিটিয়ে বললে, শখ করে থিয়েটার করতে এসেছ যে, তোমার গুষ্টির পিণ্ডি, আর কেন!

পাশ থেকে সেলুকাস বললে, বাঃ, আমরা থিয়েটার করছি যে বৈরিগীর ভিটেয়, মনে নেই তোর? উইংসের দুই পাশ থেকে দাবড়ি খেয়ে সে চুপ করে গেল।

কেষ্টার এবার যেন ঘুম ভাঙল, একটু নড়ে-চড়ে বললে, ও! বুঝেছি, বল্‌। 

গড়গড়িয়ে বেশ খানিকটা বলে গেল, প্রম্পটেরও বড় একটা অপেক্ষা করলে না। শেষকালে সেলুকাসের মুখের পানে চেয়ে দেখামাত্র প্রশ্ন করলে, ‘পুরুকে বন্দি করে আনি যখন—সে কি বললে জানো?’

সেলুকাসের অল্প আর্ট, তারই মধ্যে গোলমাল করে ফেলে বললে, কী বললে রে?

তারপর দাবড়ানি খেয়ে শুধরে নিলে, কী সম্রাট? 

কেষ্টা-সেকান্দার খানিকটা হাঁ করে রইল—প্রটিং যেন কানেই যাচ্ছে না। তার পর দুবার কপালে চিন্তিত ভাবে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, দাঁড়া, মনে পড়েছে—আমি জিজ্ঞাসা করলাম——আমার কাছে কীরূপ আচরণ প্রত্যাশা করো? সে নির্ভীক নিষ্কম্প স্বরে উত্তর দিলে, জামাইয়ের মতো…!’ 

‘ড্রপ্ ফ্যাল্, ড্রপ্ ফ্যাল্’ বলে চারদিক থেকে একটা রব উঠল। এবার স্টেজের মধ্যে থেকেও। 

খুব বেশি দরকারের সময় ড্রপসিন খুব বেশি বাগড়া দেয়—এটা তোমরা সবাই জানো; শূন্যে অনেক ওঠা-নামার পর শেষে পড়ল। তারপর স্টেজের ভেতরে যে নারকীয় গোলমালটা উঠল, তাতে স্বয়ং ভূতেদেরও লজ্জা পাবার কথা। কেষ্টা আর গজানন, যারা আলেকজান্ডার আর সেলুকাসের পার্ট নিয়েছিল, তাদের তো সবাই খুন করতে বাকি রাখলে। সে বেচারিরা মুখ চুন করে এক ধারটিতে গিয়ে বসে রইল। 

কয়েকজন বয়স্ক লোকও ভেতরে ঢুকে পড়ল। বললে, বাপু, সাধ মিটলে তো? এখন ভালোয় ভালোয় পাত্তাড়ি গুটিয়ে সব ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চলো। রাত্তিরে তাঁদের নাম করতে নেই, কিন্তু আগাগোড়া কোথা থেকে ব্যাপারটা হচ্ছে তা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে, তোমাদের মনে? শেষকালে পুরু যে বললে, ‘জামাইয়ের মতো ব্যবহার চাই’—বুঝতে পারছ না, ওটা গোকুলের মেয়ে রেবতীর সম্পর্কে সাধন বৈরিগীর মনের কথা, যা নিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা হল এই ভিটের ওপর তোমরা কি চাও আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবেন তোমাদের ওঁরা? তা ভিন্ন শোনাবে কাদের তোমরা বাপু? মুখ বাড়িয়ে একবার অডিটোরিয়ামটা দেখে এস তো! 

যজ্ঞের পাণ্ডা সতীনাথ ও আর কয়েকজন জিদ ধরে বসল, তারা করবেই থিয়েটার, দুজন আবোল-তাবোল বকেছে বলে কিছু ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়ে যায় না। সতীনাথ এগিয়ে এসে বুক ফুলিয়ে বললে, আর ভূত যদি থাকেই, আর তাদের বুকের পাটা থাকে তো তারা সামনে এসে যা করবার— 

ব্যস, এই পর্যন্ত বলেছে, এমন সময় এক ব্যাপার ঘটল যা কেউ স্বপ্নেও কখনও ভাবতে পারেনি। বিরূপাক্ষ চাণক্য সেজেছিল, হঠাৎ গ্রিনরুমের দিক থেকে এসে হাজির। সে কী উগ্র মূর্তি! চাণক্যের নেড়া-মাথার ওপর টিকিটা কেঁপে রয়েছে, গম্ভীর মুখ, রক্তজবার মতো চোখ দুটো গর্তের মধ্যে যেন জ্বলছে। সামনে দাঁড়িয়ে শিশির ভাদুড়ীর মতো মাথা নেড়ে টিকিতে তা দিতে লাগল। ঠিক যেন কোনও কিছুর ভর হরেছে, মূর্তির হাব-ভাব দেখে সবাই একটু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বয়স্কদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ হিসেবে এসেছিল নবীন হাজরা—ডাকসাইটে ভূতের ওঝা, চাণক্যের পানে চেয়ে কপালে হাতজোড় করে বললে, ঠান্ডা হও বৈরিগীবাবা, এরা ছেলেমানুষ, করে ফেলেছে একটা ভুল—! সতীনাথ কী বলতে যাচ্ছিল, বিরূপ ওদের দিকে চেয়ে একেবারে চিৎকার করে উঠল, নীচের আজ স্পর্ধা—ব্রাহ্মণ-বৈরিগীকে দেখে একটা শুষ্ক প্রণাম করতেও হাত ওঠে না? যাও, আমার ছায়া মাড়িও না, আমার নিশ্বাসে বিষ আছে, আমি দুর্ভিক্ষ, আমি মড়ক…এখনও গেলে না!…কাত্যায়ন!—কাত্যায়ন! নিয়ে এস তো রামদা-টা, আমি কোপাই সবগুলোকে, আর তুমি বাকিগুলোর ঘাড় মটকাতে থাক—ওই খেজুরগাছটার মতন করে।—কোথায় কাত্যায়ন?—আচ্ছা, দা না থাকে, স্টেজ-খোঁড়া ওই শাবলটাতেই হবে— 

ছুটে নিতে যাবে শাবলটা, সবাই তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ফেললে। তার মধ্যে থেকেই কী সে আস্সানি। জ্বলন্ত ভাটার মতো চোখ, পরচুলটা পিছলে গিয়ে টিকির গোছাটা মুখে এসে পড়েছে, গায়ে এসে পড়েছে এক অসুরের ক্ষমতা; ধরে কি রাখা যায়? আর মাঝে মাঝে সেই চিৎকার, কাত্যায়ন! কোথায় গেল কাত্যায়ন?—নিয়ে এস তো শাবলটা, আমি দেখি একবার এদের— 

এক উৎকট কাণ্ড, এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!… 

অক্ষয় চুপ করিল। বেশ বুঝা গেল, এই অস্বাভাবিক গল্প বলিতে তাহার স্নায়ুগুলা অতিরিক্ত উত্তেজিত হইয়া গিয়াছে। বাহিরে সেই দুর্যোগ; রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও মাতিয়া উঠিয়াছে। সব মিলাইয়া বৈরিগীর ভিটার তাণ্ডব-চিত্রটা যেন সবার চোখের সামনে স্পষ্ট করিয়া দিতেছে। ভিতরে সমস্ত ঘরটা থমথম করিতে লাগিল। দুয়ার-জানালার উপর একটা প্রচণ্ডতর আঘাত আসিয়া পড়ায় সবাই— এমন কি অশ্বিনী পর্যন্ত—চমকিয়া উঠিয়া একবার সেইদিকে চাইল; রমেন নিতান্ত অল্প কথার লোক। এতক্ষণ বালাপোশে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া শুধু নাক আর মুখটুকু বাহির করিয়া শুনিতেছিল, চমকিয়া উঠায় বোধহয় নিজের দুর্বলতাটা ঢাকিয়া লইবার জন্য ধীরে ধীরে টীকা করিল, গঞ্জিকা! 

গাঁজা?—বলিয়া অক্ষয় চটিয়া উঠিয়া আরও কী বলিতে যাইতেছিল, অশ্বিনী শান্তভাবে বলিল, তুমি চোটো না অক্ষয়, যে আসল ব্যাপারটা জানে সে কখনও ‘গঞ্জিকা’ বলবে না। 

অবিশ্বাসী অশ্বিনীর মুখে এ ধরনের কথা শুনিয়া সবাই বিস্মিত হইয়া তাহার পানে চাহিল, আরও নূতন কিছু শুনিবার জন্য। তারাপদ প্রশ্ন করিল, তুমি জানো নাকি আসল কথাটা? অর্থাৎ ঠিক কার বা কীসের প্রভাবে— 

অশ্বিনী গম্ভীরভাবে সিগারেট টানিতে টানিতে মাথা নাড়িয়া বলিল, হুঁ। সে শুনলে— 

সকলে একসঙ্গে প্রশ্ন করিয়া উঠিল, কী? কী বলো তো? 

অশ্বিনী সিগারেটে একটা দীর্ঘতর টান দিয়া, ধুঁয়া ছাড়িয়া বলিল, গঞ্জিকা নয়, সিদ্ধি। 

সবাই একটু থ হইয়া গেল, সে ভাবটা সামলাইয়া লইয়া অক্ষয় আবার উগ্রভাবে কী একটা বলিতে যাইতেছিল, অশ্বিনী শান্তভাব, হাত উঁচাইয়া তাহাকে বিরত করিয়া বলিল, থাম না ভাই, আমি নিজের হাতে কচুরির পুরের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলাম; ও জিনিস পেটে গেলে একবার যা ঝোঁক মাথায় ঠেলে উঠবে, তা থামায় কার সাধ্যি! না হয় একবার দেখই একদিন পরখ করে।…শুধু দুঃখ রয়ে গেল থিয়েটারটা শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল না ওরা,—চন্দ্রগুপ্ত, তার মা মুরা, ছায়া, অ্যান্টিগোনাস এরা সব তো বাকিই রয়ে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *