এক্ষণে আমরা অবশিষ্ট বৈদিক দেবতাদিগের কথা সংক্ষেপে বলিব। আমরা আকাশ ও সূর্য্যদেবতাদিগের কথা বলিয়াছি, এক্ষণে বায়ু-দেবতাদিগের কথা বলিব। বেশী বলিবার প্রয়োজন নাই। বায়ু দেবতা,-প্রথম বায়ু বা বাত, দ্বিতীয় মরুদ্গণ। বায়ুর বিশেষ পরিচয় কিছুই দিবার নাই। সূর্য্যের ন্যায় বায়ু আমাদিগের কাছে নিত্য পরিচিত। ইনি পৌরাণিক দেবতার মধ্যে স্থান পাইয়াছেন। পুরাণেতিহাসে ইন্দ্রাদির ন্যায় ইনি একজন দিক্পাল মধ্যে গণ্য। এবং বায়ু বা পবন নাম ধারণ করিয়াছেন। সুতরাং ইঁহাকে প্রচলিত দেবতাদের মধ্যে ধরিতে হয়।
মরুদ্গণ সেরূপ নহেন। ইঁহারা এক্ষণে অপ্রচলিত। বায়ু সাধারণ বাতাস, মরুদ্গণ ঝড়। নামটা কোথাও একবচন নাই ; সর্ব্বত্রই বহুবচন। কথিত আছে যে, মরুদ্গণ ত্রিগুণিত ষষ্টিসংখ্যক, একশত আশী। এ দেশে ঝড়ের যে দৌরাত্ম্য, তাহাতে এক লক্ষ আশী হাজার বলিলেও অত্যুক্তি হইত না। ইঁহাদিগকে কখন কখন রুদ্র বলা হইয়া থাকে। রুদ্ ধাতু চীৎকারার্থে রুদ্ ধাতু হইতে রোদন হইয়াছে। রুদ্ ধাতুর পর সেই “র” প্রত্যয় করিয়া রুদ্র শব্দ হইয়াছে। ঝড় বড় শব্দ করে, এই জন্য মরুদ্গণকে রুদ্র বলা হইয়াছে সন্দেহ নাই। কোথাও বা মরুদ্গণকে রুদ্রের সন্ততি বলা হইয়াছে।
তার পর অগ্নিদেবতা। অগ্নিও আমাদের নিকট এত সুপরিচিত যে, তাঁহারও কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই। কিছু পরিচয় দেওয়াই হইয়াছে।
ঋগ্বেদে আর একটি দেবতা আছেন, তাহাকে কখন বৃহস্পতি কখন ব্রহ্মণস্পতি বলা হইয়া থাকে। কেহ কেহ বলেন, ইনি অগ্নি, কেহ কেহ বলেন, ইনি ব্রহ্মণ্যদেব। সে যাহাই হউক। ব্রহ্মণস্পতির সঙ্গে আমাদের আর বড় সম্বন্ধ নাই। বৃহস্পতি এক্ষণে দেবগুরু অথবা আকাশের একটি তারা। অতএব তাঁহার সম্বন্ধে বড় বিশেষ বলিবার প্রয়োজন নাই।
সোমকে এক্ষণে চন্দ্র বলি, কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি চন্দ্র নহেন। ঋগ্বেদে তিনি সোমরসের দেবতা।
অশ্বীদ্বয় পুরাণেতিহাসে অশ্বিনীকুমার বলিয়া বিখ্যাত। কথিত আছে যে, তাঁহারা সূর্য্যের ঔরসে অশ্বিনীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই জন্য তাঁহাদিগের পৌরাণিক নাম অশ্বিনীকুমার। এমন বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে যে, তাঁহারা শেষরাত্রির দেবতা ; ঊষার পূর্ব্বগামী দেবতা।
আর একটি দেবতা ত্বষ্টা। পুরাণেতিহাসে বিশ্বকর্ম্মা যাহা, ঋগ্বেদে ত্বষ্টা তাহাই। অর্থাৎ দেবতাদিগের কারিগর।
যমও ঋগ্বেদে আছেন কিন্তু যমও আমাদিগের নিকট বিশেষ পরিচিত। যমদেবতার একটি গূঢ় তাৎপর্য্য আছে, তাহা সময়ান্তরে বুঝাইবার প্রয়োজন হইবে।
ত্রিত আপ্ত্য অজ একপাদ প্রভৃতি দুই একটি ক্ষুদ্র দেবতা আছেন, কখন কখন বেদে তাঁহাদিগের নামোল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু তাঁহাদের সম্বন্ধে এমন কিছুই কথা নাই যে, তাঁহাদের কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন করে।
বৈদিক দেবীদিগের মধ্যে অদিতি পৃথিবী এবং ঊষা এই তিনেরই কিঞ্চিৎ প্রাধান্য আছে। অদিতি ও পৃথিবীর কিঞ্চিৎ পরিচয় দিয়াছি। ঊষার পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই, কেন না, যাহার ঘুম একটু সকালে ভাঙ্গিয়াছে সেই তাহাকে চিনে। সরস্বতীও একটি বৈদিক দেবী। তিনি কখন নদী কখন বাগ্দেবী। গঙ্গা-সিন্ধু প্রভৃতি ঋগ্বেদে স্তুত হইয়াছেন। ফলতঃ ক্ষুদ্র বৈদিক দেবীদিগের সবিস্তার বর্ণনে কালহরণ করিয়া পাঠকদিগকে আর কষ্ট দিবার প্রয়োজন নাই। আমরা এইখানে বৈদিক দেবতাদিগের ব্যক্তিগত পরিচয় সমাপ্ত করিলাম। কিন্তু আমরা বৈদিক দেবতাতত্ত্ব সমাপ্ত করিলাম না। আমরা এখন বৈদিক দেবতাতত্ত্বের স্থূল মর্ম্ম বুঝিবার চেষ্টা করিব। তার পর বৈদিক ঈশ্বরতত্ত্বে প্রবৃত্ত হইবার চেষ্টা করি।-‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ২৬৬-৬৮।