যত বেড়াল আছে পৃথিবীতে, সবারই পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষই ‘নিয়ারইস্টার্ন ওয়াইল্ডক্যাট’ বা নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল। বেড়ালদের ডিএনএ নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল ছাড়া অন্য চার রকম যে বনবেড়াল আছে– ইওরোপীয় বনবেড়াল, দক্ষিণ আফ্রিকার বনবেড়াল, মধ্য এশীয় বনবেড়াল, চীন-মরুভূমির বনবেড়াল—ওদের ডিএনএ-র সঙ্গে মেলে না। মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ঢুকে যাওয়া অথবা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সেঁটে থাকা নিকটপ্রাচ্যের দেশগুলো একেকজনের সংজ্ঞায় একেকরকম। তবে যে দেশগুলোকে নিকটপ্রাচ্যের মধ্যে মোটামুটি ফেলা যায়, সেগুলো বাহরাইন, সাইপ্রাস, মিশর, ইরান, ইরাক, ইজরাইল, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, ওমান, কাতার, সৌদী আরব, সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, আরব আমিরাত, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন।
আমরা এতকাল জানতাম চার হাজার বছর আগে জঙ্গল থেকে বনবেড়াল প্রথম ঢুকেছিল মিশরের লোকালয়ে। কিন্তু আমাদের এতকালের ওই জানাটা ভুল ছিল। বেড়াল জঙ্গল থেকে লোকালয়ে এসেছে আরও আগে। নানা রকম প্রমাণ জড়ো করে এখন অবধি যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা হল, নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়ালদের মধ্যে কেউ কেউ, সম্ভবত হায়েনা আর বাঘ ভালুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য, মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল, দশ বা বারো হাজার বছর আগে, কোনও নিকটপ্রাচ্যদেশে। আজ তারই বংশধর আমাদের রাস্তা ঘাটে, অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়ানো আর বাসা বাড়িতে বাস করা বেড়াল। ১৯৮৩ সালে সাইপ্রাসে প্রথম পাওয়া গেছে আট হাজার বছর পুরোনো বেড়ালের চোয়ালের হাড়। তারপর বছর দশ আগে যেটা পাওয়া গেছে, সেটা চোয়ালের হাড়-টাড় নয়, রীতিমত কঙ্কাল। আস্ত একটা মানুষের সঙ্গে আট-মাস বয়সী আস্ত একটা বেড়ালকে কবর দেওয়া হয়েছিল, কবরটা সাড়ে ন’হাজার বছর পুরোনো। কবরটা দেখেই বোঝা গেছে, ওই এলাকায় বেড়ালরা মানুষের সঙ্গে বসবাস শুরু করেছে বেশ অনেক আগেই। দীর্ঘকালের সম্পর্ক না হলে অত আদর করে কেউ কোনও বেড়ালকে নিয়ে কবরে শুতো না। সাইপ্রাসে তুরস্কের চাষীরা বাসা বেঁধেছিল। তারাই সম্ভবত তুরস্ক থেকে পোষা বেড়াল নিয়ে আসে। তুরস্ক থেকেই, তা না হলে আর কোথাও থেকে বেড়াল জোটার কোনও সম্ভাবনা ছিল না সাইপ্রাসে। সাইপ্রাসের আশে পাশের কোনও জঙ্গলে বনবেড়াল ছিল না।
সারা পৃথিবীতে এখন বেড়ালের সংখ্যা ষাট কোটি। বিবর্তনের মজা এখানেই। ঘর গেরস্থের বেড়ালগুলোই টিকে আছে। বনের বেড়ালগুলো বরং নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। চোখ কান খোলা রাখতে হয়, ভালো ভাবে বাঁচা যাবে এমন কিছুর গন্ধ পেলে পুরোনা জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় তড়িঘড়ি চলে যেতে হয়। মানুষ তার জীবনের শুরু থেকেই জায়গা বদলাচ্ছে। ক্রমশ ভালোর দিকে যাচ্ছে। জায়গা বদলেছে বলে হোমো সেপিয়েন্স নামের মানুষ প্রজাতি টিকে আছে, নিয়ানডার্থাল নামের মানুষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মানুষ যখন মূলত শিকারী ছিল, তখন কুকুরকে সঙ্গে রাখতো। যখন থিতু হলো, কৃষিকাজ শুরু করলো, তখন কুকুরের বদলে বেড়াল হলো বিশ্বস্ত সঙ্গী। বেড়াল শস্য খেতে আসা ইঁদুর মারতো, ও খেয়েই দিব্যি মনের সুখে খামারে বাস করতো। আর মানুষও খুশি ছিল বেড়ালের ওপর, বেড়ালকে দিয়ে ইঁদুর মারার কাজ চলতো বলে, শস্যের অভাব হতো না বলে। প্রাচীন মিশরীয়রা বেড়ালের পুজো করতো। বেড়াল দেবীর নাম ছিল বাস্ট। বেড়াল পুজো করার মন্দিরও ছিল মিশরে। মিশরীয় আইনে মানুষের চেয়েও বেশি মর্যাদা পেতো বেড়াল। কোনও বাড়িতে আগুন ধরলে, আগে মানুষকে নয়, আগে বেড়ালকে বাঁচানোর নিয়ম ছিল। শুধু মিশরের রাজা বাদশাহর মমি বানানো হতো তা নয়, বেড়ালেরও মমি বানানো হতো, বেড়ালের এক কবরখানায় তিন লক্ষ বেড়ালের মমি পাওয়া গেছে। কেউ কোনও বেড়ালকে প্রাণে মেরে ফেললে জেল-হাজত-জরিমানা নয়, যাবজ্জীবনও নয়, রীতিমত মৃত্যুদণ্ড হত। প্রাচীন রোমও অনেকটা এরকমই ছিল। বেড়ালকে স্বাধীনতার প্রতীক বলে ভাবা হত। দূরপ্রাচ্যে বেড়ালের মর্যাদা আবার অন্য কারণে বেশি ছিল। বেড়ালরা নথিপত্র পাণ্ডুলিপি এসব ইঁদুরের দাঁত থেকে রক্ষা করত বলে।
চারদিকে বেড়ালকে যখন মানুষ ঈশ্বরের বা প্রায়-ঈশ্বরের সম্মান দিচ্ছে, তখন মধ্যযুগে, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, বেড়ালকে অশুভ প্রতীক, ডাইনির সঙ্গী, শয়তানের দূত বলে ভাবতে শুরু করলো ইওরোপীয়রা। প্লেগের জন্য দায়ী বেড়াল, এমনও অভিযোগ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেড়াল নিয়ে এখনও কুসংস্কার চূড়ান্ত। কালো বেড়াল পথে পড়লে গাড়ি থামিয়ে দেয় লোকে। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কালো বেড়াল রাস্তা পার হচ্ছে মানে কী?’ ‘এর মানে’, বলেছিলাম, ‘কালো বেড়ালটা কোথাও যাচ্ছে’। কুসংস্কার যারা বোঝে, তারা কৌতুক বোঝে না।
যে প্রাণীটি লোকে সবচেয়ে বেশি পোষে, তা গরু নয়, ঘোড়া নয়, কুকুর নয়, পাখি নয়, তা বেড়াল। ইওরোপ আমেরিকার প্রায় ঘরে ঘরে বেড়াল। এক যুক্তরাষ্ট্রেই পোষা বেড়ালের সংখ্যা ন’কোটি। যে প্রাণীটি কোনও দুধ দেয় না, বোঝা বইতে পারে না, যার চামড়া দিয়ে কোনও কিছু বানাবার উপায় নেই, যে মানুষের কোনও উপকারে আসে না আজকাল, সেই প্রাণীকেই সবচেয়ে বেশি পুষছে মানুষ, ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। এক বন্ধু বলেছিল, ‘বেড়াল জল এড়িয়ে চলে, আর তাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার কি না মাছ’! বিবর্তন দুনিয়ার কত কিছু যে পাল্টে দেয়। আমার বেড়ালটার কথাই বলি, নাম মিনু। নিজের মাছটাও নিজে খেতে জানে না। কাঁটা বেছে দিলে তবে খাবে। দেখে একবার আমার এক বন্ধু বলেছিলো, ‘কী ব্যাপার, তুমি তো বেড়ালটাকে কাঁটা বেছে মাছ খেতে দিচ্ছ। আমি তো এতকাল জানতাম বেড়ালরা কাঁটা খায়। কাঁটা বেছে বেড়ালকে মাছ খেতে দেওয়ার মানে বেড়ালের বেড়ালত্ব কিছু আর অবশিষ্ট নেই, মনুষ্যত্ব ডেভেলপ করেছে’।
তা ঠিক, মিনুকে দেখলে যে কেউ বলবে মিনুর ভেতরে বেড়ালত্ব কিছু আর নেই, যা আছে, তা মনুষ্যত্ব। আজ ন’বছর মিনু আমার সঙ্গে। গড়িয়াহাটের মাছের বাজারে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা ছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, আজ তার জীবন অনেকটা রানির মতো বা দেবীর মতো। কত রকম সরকারী নির্যাতন গেল আমার ওপর, সবাই চলে গেলো, সব বন্ধু, সব অনুরাগী, শুধু মিনু রয়ে গেলো। ও আর যাবে কোথায়! রাস্তার জীবনে ও আর অভ্যস্ত নয়, শিকার করেও খেতে পারবে না, চুরি করেও না। ওসব ও অনেককাল ভুলে গেছে অথবা শেখেইনি কোনওদিন। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি ঘোড়া কুকুর মানুষের হাতে নির্ঘাত মরবে। তার চেয়ে নিরাপদ ঘরে ঘুমোবে খেলবে, সুস্বাদু খাবার দেওয়া হবে, বিদেশি কোম্পানির ট্রিটস,রয়েল ক্যানিন ফুড, কখনও নাক সিঁটকাবে, অভিমান করবে, রাগ করবে, খেতে পীড়াপীড়ি করলে ‘খাবো না’ বলে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকবে, হাতে পায়ে ধরেও মুখ খোলানো যাবে না, কখনও মর্জি হলে তবেই মুখে খাবার তুলবে। বাড়ি ভর্তি তার খেলনা, পুরো বিকেল জুড়ে তার সঙ্গে খেলতে হবে। আবদারের অন্ত নেই। গরমে তার এসি চাই, শীতে তার পশমী কম্বল চাই, উলের জ্যাকেট চাই, হিটার চাই। কেউ বিশ্বাস করুক না করুক, তার আলাদা শোওয়ারঘর, আলাদা বিছানা, আলাদা টয়লেট। টয়লেট কখনও অপরিস্কার পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। আগে তার টয়লেট পরিস্কার চাই, পরে অন্য কথা। শুধু যে নিজের কথাই ভাবে, তা নয়। সেদিন জ্বর হয়েছিল আমার, যতক্ষণ না জ্বর না সারলো, শিয়র থেকে নড়লো না। এই হলো আমার পালিতা কন্যা মিনু।
মিনু আর এখন বেড়ালের মতো কাঁদে না। কাঁদে মানুষের মতো। হাসেও হয়তো মানুষের মতো। এই মিনুরই পূর্বনারীরা জঙ্গল থেকে মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল এককালে, ইঁদুর শিকার করার কাজ পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। আজ সেই বনবেড়ালের বংশধর ঘরের জীবন যাপনে এমনই অভ্যস্ত হয়েছে যে ইঁদুর দেখলে ভয় পায়। খেলনা ইঁদুরের ঘাড়ে বেশ ছুটে এসে কামড় দেয়, কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর দেখে দৌড়ে পালায়। পোষা বেড়ালগুলোর স্বভাব চরিত্র এত পাল্টে যাচ্ছে যে বেড়ালের বদলে অন্য কোনও নামে হয়তো এদের ডাকতে হবে। কী নামে!