বেসাতি
ঘোষবাড়ি আজ জমাট। অবশ্য দীনবন্ধু ঘোষের নাম এই অঞ্চলের সবাই জানে। পাতিপুকুর বাজার—ঘোড়ার মাঠ, মায় যশোর রোড—ওদিকে নাগেরবাজার আর এদিকে বেলগাছিয়া তক দীনু ঘোষকে সবাই চিনত। খালের ধারে বিশাল গুদাম। তখন বেলগাছিয়ার খাল ছিল চালু জলপথ। যশোর, খুলনা, পূর্ব বাংলা থেকে বড় বড় মহাজনী নৌকা বোঝাই হয়ে খুলনা; বরিশালের সোনা রঙের আঁশওয়ালা পাট, বস্তা বস্তা বালাম চাল, সুপারি-ধান-গুড় নানা কিছু মালপত্র আসত আর দীনু ঘোষের গুদামে উঠত। এই দিগরের নাম করা মহাজন।
দীনু ঘোষের ব্যবসা তখন রমরমিয়ে চলছে। তখন উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া পার হলেই দেখা যেত জলা, হোগলা বন, মাঝে মাঝে দু-একটা বাগানবাড়ি। যশোর রোডের পাশ দিয়ে তখন বসিরহাট যাওয়ার ছোট রেলগাড়ি যেত। ওই রেলগাড়িই ছিল যোগাযোগের পথ।
দীনবন্ধু ঘোষ তখন বেলগাছিয়া ছাড়িয়ে একটু আগে যশোর রোডের ওদিকে একটা বাগানবাড়ি কেনে। বেশ কিছু আম-কাঁঠাল-লিচু গাছও রয়েছে। আশেপাশে দু-চারজন বাসিন্দা আছে।
দীনু ঘোষ তখন ওই বাড়িটা কিনে চাল-পাটের আড়ত করেছিল।
সে এখন অতীতের কথা। এখন দীনবন্ধুর ছেলেরাও গত হয়েছে। দুই ছেলে মারা যাওয়ার পর বিষয়-পত্রও ভাগ হয়ে গিয়েছে। আর বেলগাছিয়ার খাল এখন বন্ধ। পূর্ববাংলা এখন ভিন্ন রাজ্য। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তবু দীনু ঘোষের নামটাই রয়েছে মাত্র। ছোট তরফের ভাগে পড়েছিল ওই বাগানবাড়িটা। এখন দীনু ঘোষের তিন নাতি আর এক নাতনীর দখলে ওই বাড়িটা।
ঘোষবাড়ির হাঁক-ডাক ছোটবাবু নরেন ঘোষ বেঁচে থাকা অবধি ছিল।
নরেনবাবু দীনু ঘোষের ছোট ছেলে। দীনু ঘোষ কষ্ট করে ব্যবসা করে সম্পত্তি কিনেছে, আর ছোট ছেলে নরেন ভোগই করেছে।
বাবা মারা যাওয়ার পর ভারত দু’টুকরো হয়ে গেল। বদলে গেল কলকাতার হাল। বড় ছেলে ব্যবসা সামলাবার চেষ্টা করেও পারেনি। ফলে ব্যবসাও উঠে গেল। দুই ভাই দু’দিকে।
নরেন ঘোষ এসব ভাবে না। তার ভাবার দরকারও নেই। ব্যবসা-দোকান-গুদাম বিক্রী করে ভাগে বেশ কিছু টাকা পেয়ে সে পাতিপুকুরের এই বাড়িতে উঠে এসেছে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
ক’বছরেই এদিকের চেহারাটা বদলে গিয়েছে। দেশ বিভাগের পর পূর্ববাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে কলকাতার আশেপাশে যে যেখানে পেরেছে বসত গড়েছে। ফলে আশেপাশের সব জায়গার দামও বেড়েছে চড় চড় করে। আর, জলা, নীচু জমি বুজিয়ে চারিদিকে বাড়ি আর বাড়ি উঠেছে। যে ভাবেই হোক একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই। ফলে সারা অঞ্চলে এখন বাড়ি আর মানুষ।
নরেন ঘোষ গানের চর্চা নিয়েই থাকে। ক্রমশ বয়স হচ্ছে—কলসীর জমা জল গড়াতে গড়াতে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
ছেলেরা কোনমতে স্কুল কলেজের গণ্ডী টপকে এবার চাকরির সন্ধানে ঘুরছে। তারাও বুঝেছে তাদের জন্যে পিতৃদেব এমন কিছু রেখে যাবেন না যা দিয়ে সংসার নামক নৌকাটাকে জীবনের স্রোতে তারা বাইতে পারে।
বড় ছেলে দীপক তবু বাবার সংসারে কিছুটা সুদিন দেখেছে। সে স্কুল পার হয়ে কলেজের বেড়া টপকে এখানে ওখানে চাকরির চেষ্টা করেছে। শেষে কলকাতায় হালে পানি না পেয়ে কোনও এক ভদ্রলোকের দয়ায় রাঁচিতে একটা কারখানাতে চাকরি পেয়েছে।
তাই সে কলকাতা ছেড়ে রাঁচিতেই থাকে। দীপকের মেজ ভাই প্রদীপ কোনমতে বি-এ পাশ করে কলকাতার এক সওদাগরি অফিসে কাজ করে।
মেয়ে দীপার বিয়ে-থা দিয়েছিল নরেনবাবু কোনওমতে কিছু টাকা সংগ্রহ করে, স্ত্রীর গহনাও কিছু গেছে সেই বিয়েতে। কিন্তু বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই দীপার স্বামী মারা যায়। বেলেঘাটার শ্বশুরবাড়িতে দীপার থাকার জায়গাও হয়নি। কারণ শ্বশুর-শাশুড়ি সকলেই বিশ্বাস করে যে বৌয়ের জন্যেই মারা গিয়েছে তাদের সন্তান। তাই চোটটা পড়ে দীপার ওপরই। ফলে দীপার আর সেখানে থাকা হয়ে ওঠেনি। এই বাড়িতে বাবা মায়ের কাছেই ফিরে আসে দীপা।
মেজ ভাই প্রদীপের তখন বিয়ে-থা হয়েছে। মিতা এসেছে এই ঘোষবাড়ির বৌ হয়ে। ক্রমশ দেখে মিতা এ বাড়ি সম্বন্ধে মিথ্যা একটা ধারণাই দিয়েছিলেন তার বাবাকে।
বেশ বড় বাগান ঘেরা বাড়ি। বনেদী আমলের বাড়ি। গেটে এখন আর দারোয়ান নেই। অতীতে থাকত। এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাগানের ওদিকে বাড়িটা। এখনও তার আভিজাত্য অনেকেরই নজরে পড়ে।
সেই বড় বাড়ির বৌ হয়ে এসে মিতা দেখেছে এদের সংসারের অবস্থাটা। গাছের আম-নারকেল-কাঁঠাল বিক্রী করে দিন চালাতে হয়।
স্বামী প্রদীপের রোজগারে এত বড় সংসার চলে না। বড় ছেলে দীপক এখন রাঁচিতেই ঘর বেঁধেছে। তারও সংসার বড় হয়েছে ফলে বাবা মাকে টাকাও তেমন পাঠাতে পারে না।
ছোট ছেলে প্রবীর স্কুলের গণ্ডীতেই আটকে পড়েছে। বার তিনেক এক ক্লাশে গড়ান দিয়ে এখন পড়া ছেড়ে রেল-লাইনের ওদিকে রাতের অন্ধকারে এই এলাকার কিছু উঠতি মস্তানদের সঙ্গে আড্ডা মারে।
তার বাড়ি ফেরার কোনও সময় নেই। কোনও দিন রাতে বের হয়ে যায় ফেরে মধ্য রাত্রে। এই এলাকার চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে মাঝে মাঝে ওয়াগন লুট হয়। ট্রাক ট্রাক মাল পাচার হয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। মাঝে মাঝে বোমা-গুলি-গোলার শব্দ ওঠে। অন্ধকারে ছায়ামূর্তির দল এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করে। পুলিশের ভারি বুটের শব্দ, বাঁশীর শব্দ ছাপিয়ে গুলির তীক্ষ্ণ আওয়াজও কানে আসে।
মিতা চুপ করে শোনে। প্রদীপ বলে—এই এলাকা এখন ওয়াগন ব্রেকার আর চোরাচালানিদের রাজ্যি হয়ে উঠেছে।
দিনের বেলাতেও দেখা যায় লোকাল ট্রেন, দূরপাল্লার নামী-দামী ট্রেনগুলোও দাঁড়িয়ে যায় কোনও অদৃশ্য ইঙ্গিতে। লাইনের ধারে দুমদাম করে চালের বস্তা পড়তে থাকে। আর নিচেও লোকজন তৈরি থাকে। দেখতে দেখতে পাহাড় প্রমাণ চালের বস্তা—অন্য জিনিস-পত্রও তুলে নিয়ে যায় তারা। আবার ট্রেন ছাড়ে।
প্রবীরকে দেখা যায় দামী জিনস-জ্যাকেট পড়ে পাড়ায় ঘুরতে। একটা লালরঙের মোটরবাইক হাঁকায়। পাড়ার দোকানদার, বেলগাছিয়ার মাছের আড়তদার, ফড়েরাও সমীহ করে চলে। ভোটের সময় প্রবীরের সময় থাকে না। এই এলাকার এম-এল-এ সাহেবের জিপের আগে তার লাল মোটরবাইক এগিয়ে যায় তাতে দলের পতাকা ওড়ে।
পাড়ার অন্যত্র মিটিং-এ প্রবীরের দলই শান্তি বজায় রাখার জন্যে মোতায়েন থাকে। প্রবীরের দলের সামনে প্রতিপক্ষের সমর্থকরাও মুখ খুলতে সাহস করে না। কারণ ওদের দু-একজন মাতব্বরকে অন্ধকারে ভোজালি-চেম্বার দেখিয়ে শাসায়—লাশ গিরিয়ে দেব।
ওদের মিটিংও হতে পারে না। মুড়ি মুড়কির মতো বোমা বৃষ্টি হয়। দু-চারজন জখম হয়। থানা অফিসাররাও কোন বিশেষ কারণে প্রবীরকে কিছু বলে না। সময়মত তাদেরই লোক এসে খবর দিয়ে যায়—আর প্রবীরও সরে পড়ে।
দীপা দেখছে প্রবীরের এই কাণ্ড। বাড়ির বাইরের ঘরে পাড়ার ওর দলের অনেকেই আসে।
ওদিকে এসে এখন বাড়ি করেছে ভূতনাথ সাহা। বাজারে একটা দোকানও কিনেছে। আর ভূতনাথের ছেলে ভবনাথ প্রবীরের বন্ধু। ছেলেটা বেশ চালু।
এর মধ্যেই ভবনাথ বাবার দোকান বাড়িয়েছে আর নেতাকে ধরে রেশনের ডিলারশিপও পেয়েছে। ওই এলাকার একটা চালাঘর জবরদখল করে সেখানে আটা-চাকি বসাবার চেষ্টা করছে। তাই সেই নেতার ভোটে ভবনাথও জোর প্রচার চালায়। প্রবীরদের বাড়িতে আসে।
প্রবীরকে এখন বাড়িতেও সমীহ করে। নরেন ঘোষের শরীর ভেঙে পড়েছে। হাঁপানীর রোগী, টান উঠলে মনে হয় যে কোনও মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হয় না। পুঁটিমাছের প্রাণ—সামান্য জলেও ছটফট করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
মেজ ছেলে প্রদীপ মাস গেলে সামান্য মাইনেটাই সংসারে ধরে দেয় মাকে।
দীপা এ বাড়ির পোষ্য। সে বলে, মেজদা, দুখানা সাদা খোলের শাড়ি দিবি? সব ছিঁড়ে গেছে।
মিতা এই বাড়ির বৌ হয়ে এসে দেখছে পদে পদে তাকে বঞ্চনাই সইতে হয়। স্বামীর রোজগারে তার কোনও অধিকার নেই। ওই নরেন ঘোষ আর তার বিধবা মেয়ে সবাই যেন ভাগ বসাবার জন্যে ওত পেতে থাকে।
মিতারও নিজের ছেলে-মেয়ে হয়েছে। তার ছেলে সুবীর এখন ক্লাশ টুতে পড়ে। মিতার সাধ ছেলেমেয়েকে ভালভাবে রাখবে। কিন্তু পদে পদে অনুভব করে এখানে থাকলে সেটা কোনও মতেই সম্ভব নয়। তাই বলে মিতা প্রদীপকে—এই বাড়িতে কেন পড়ে আছ? বড়দা কেমন বাইরে শান্তিতে আছে।
প্রবীর বলে, কিন্তু বাবা মাকে ছেড়ে এই সংসার ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে যাই কোথায়?
এই বাড়িটাকে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে প্রদীপের ছেলে সুবীরের। ছোট ছেলেটা বাড়ির বাগানে ঘোরে। চারিদিকে এখন ঘিঞ্জি, বাড়ি দোকান বস্তি সব যেন জায়গাটাকে ভরিয়ে দিয়েছে। তার মাঝে তাদের পাঁচিল ঘেরা এই সবুজ বাগান—শিশু সুবীরের কাছে এক সুন্দর জগৎ বলে মনে হয়।
আমগাছে মুকুল আসে, বাতাসে ওঠে মিষ্টি গন্ধ। মৌমাছির গুনগুন শব্দ শোনে সে কান পেতে। কাঁঠালিচাঁপা ফুলের মিষ্টি সুবাস তার কাছে বিচিত্র এক অনুভূতি আনে। সকালে উঠে বাগানে আসে—পাখিদের কলরব ওঠে এখানে। চাঁপাগাছের হলুদ ফুলের সমারোহ, রঙিন ডানা মেলে ওড়া প্রজাপতির দল—সুবীর যেন রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যায়।
এই তার জগৎ—এখানে যেন নীলপরীরা ভেসে আসবে। তাকে নিয়ে যাবে কোনও এক স্বপ্নরাজ্যে। ছোট সুবীর মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে আসে বাগানে।
নরেন ঘোষ এতদিন ভুগে ভুগে হঠাৎ সেদিন হার্টফেল করে মারা যায়। যেন বেঁচেই যায় সে। আর নরেনবাবুর স্ত্রী, এবাড়ির গিন্নীও কমাস পরই জ্বরে পড়ে। বেঘোর জ্বর। হুঁশ নেই।
প্রদীপ কি করবে ভেবে পায় না। বাবার কাজের জন্যে বড়দাকে লিখেছিল কিছু টাকা আনতে। বড় ভাই দীপক এসেছিল তার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। কিন্তু টাকার কথায় সে বলে, এ বাড়ির আয় পয় কিছুই নিই না। বাবারও কিছু জমা টাকা ছিল। তার থেকেই শ্রাদ্ধ কর। আমার দেওয়ার মতো অবস্থা নেই।
মিতা শোনে কথাগুলো। ছোট ভাই প্রবীর কিছুদিন বেপাত্তা। রেললাইনের ধারে কে যেন খুন হয়েছিল। সেই ব্যাপারে নাকি পুলিশ প্রবীরকে খুঁজছে।
প্রদীপই ধার দেনা করে কোনও মতে ঘোষবংশের দ্বিতীয় পুরুষের সৎকার শেষ করে। তার কয়েক মাস পরই মা অসুখে পড়ে।
দীপাও দেখে সংসারের হাল। প্রবীর বাড়িতে নেই। সেও বোঝে দাদার অবস্থা। তার মনে হয় কিছু করা দরকার। আজকাল মেয়েরাও কাজকর্ম করছে। কিন্তু দীপা লেখাপড়া তেমন শেখেনি। বিয়ে-থার পর নিজের সংসারে গিয়েছিল। সেখানেও ঠাঁই হয়নি তার—সব আশা আশ্বাস, নির্ভরতা হারিয়ে গিয়েছে।
বাবা মায়ের ভরসাতেই মেয়েরা বাপের বাড়িতে থাকে। ভাই-ভাইয়ের বৌরা তাদের মেনে নিতে পারে না। বোঝা বলেই ভাবে। পদে পদে দীপা দেখে ওদের ব্যবহারে সেই ভাবটাই ফুটে উঠছে।
ভবনাথ অবশ্য মাঝে মাঝে আসে। প্রবীরের গোপন আস্তানার খবর সে-ই জানে। ভবনাথ এখন মনে হয় ভালই আছে। প্রবীর সেই নেতাদের হয়ে গোপনে লড়াই করে। ভোটের সময় দলবল নিয়ে বুথে ভিড় জমায়। ওর দল বুথ দখল করে নেতার ভোটের বাক্স ভরিয়ে দেয়। বাধা দিলে বোমাও ছোড়ে।
আর ভবনাথ দাদার দলের হয়ে মিটিং করে, মিছিল করে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। এখন আটা-চাকি করেছে। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তেলকলও বসাচ্ছে।
দীপা সেদিন ভবনাথকে বলে, মায়ের অসুখ। কিছু টাকার দরকার।
বাগানে তখন বৈকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। পাখিদের কলরব শোনা যায়।
দীপা ক্রমশ জেনেছে প্রবীরের বন্ধুদের মধ্যে ভবনাথকেই বিশ্বাস করা যায়। এর আগেও ভবনাথ দীপাকে এটা সেটা এনে দিয়েছে। শাড়িও দেয়। দীপা প্রথমে অনুযোগ করত, এসব কেন আনো?
ভবনাথ বলে, দিতে মন চায়, তুমি নেবে না?
দীপা চুপ করে যায়। দেখছে ভবনাথই একমাত্র মানুষ যে তার জন্যে ভাবে, কিছু করার চেষ্টা করে। প্রথমে দীপার এটা ভাবতেও সংস্কারে বাধত। কিন্তু ক্রমশ ভেবেছে দীপা। তার কোনও অপরাধ নেই। স্বামী মারা যেতে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হল। এখানেও আজ তার পাশে কেউ নেই। অথচ তার বাঁচতে হবে—একটা অবলম্বন চাই। ভবনাথকেই মনে হয় সেই নির্ভর।
দীপা আজও বলে, কি হবে ভব। প্রদীপ আর কত দেবে? ছোটনেরও খবর নেই।
ভবনাথের তখন ব্যবসায় কাঁচাপয়সা আসছে। সেও ব্যবসাদার। হিসেব করেই চলে। ভবনাথ বলে, আমি তো আছি। ভবনাথই টাকা দেয়।
মিতাও দেখেছে ব্যাপারটা। বাড়ির বাগানে মিতা দেখেছে ভবনাথ আর দীপাকে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে।
প্রদীপকে বলে মিতা, ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে, তারাও এই প্রেমের নাটক দেখছে। তোমার বিধবা বোনকে একটু বুঝে শুনে চলতে বল। এসব আমার ভাল ঠেকছে না।
প্রদীপ জানে সব। দীপা মাঝে মাঝে তাকে গোপনে কিছু টাকা দেয়। আর সেই টাকা কি ভাবে কোথা থেকে আসে তাও জানে প্রদীপ। বোনের সম্মান, এই ঘোষবাড়ির সম্মানের থেকেও আজ তার কাছে টাকাটাই বড়। তাই সব জেনেও প্রদীপ কিছু বলেনি, বলতে পারেনি।
আজও তাই স্ত্রীর কথায় প্রদীপ একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে সে, এসব কি বলছ?
মিতা বলে, ঠিকই বলছি। সব ব্যাপারটাই আমার চোখে পড়েছে। সাবধান না হলে বিশ্রী কাণ্ড একটা ঘটে যাবে। তখন আর করার কিছুই থাকবে না।
প্রদীপ বলে, দেখছি। এ সময় প্রবীরও নেই। সারা সংসারের দায় যেন আমারই।
মিতা বলে, এখানে থাকলে সব তো ঘাড়ে চাপবেই। চলে যেতে পারো না এখান থেকে?
কথাটা প্রদীপও ভেবেছে। কিন্তু প্রথমত, বাড়ি ঘর ভাড়া পাওয়াই এখন কঠিন সমস্যা হয়ে উঠেছে। মানুষজনই বেড়েছে সেই তুলনায় বাড়ি-ঘর তো বাড়েনি। ফলে বাড়ি-ঘরের চাহিদা যত বেড়েছে ভাড়াও বেড়েছে, তার ওপর রয়েছে সেলামী। তার পরিমাণও কম নয়। তাই বাড়িভাড়ার কথা ভাবতেও পারে না প্রদীপ।
মিতা বলে, তাহলে পড়ে পড়ে মারই খাও। এক ভাই তো দেশান্তরী হয়ে গেছে, অন্যজনের পাত্তা নেই, আর এক বোন শাঁখা সিঁদুর মুছে ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ শুরু করেছে। ভাল চলছে যা হোক।
প্রদীপের মা ছিল একটা সমস্যা—বাবা আগেই গিয়েছেন—এবার মা-ও ক’দিন জ্বরে ভোগবার পর চলে গেল। মা বাবাই সংসারকে কিছুটা বেঁধে রাখে, ভাই বোনদের একটা সুরে বাঁধার চেষ্টা চালায় যত দিন পারা যায়। তারপর নানা কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, এক সংসার তখন পাঁচ সংসারে বিভক্ত হয়ে যায়।
প্রদীপও দেখে এবার সে যেন দায়মুক্ত। কিন্তু দীপা রয়েছে। মিতা বুঝেছে ওই বিধবা মেয়েটা এখন তাদেরই বোঝা। আজীবন সেই বোঝা টানতে হবে। তাই তার মনও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আর সেই ভাবটাও প্রকাশ পায় কথাবার্তায়।
প্রদীপের ছেলে সুবীর আর মেয়ে পিয়া অবশ্য এইসবের খবর রাখে না। ছেলে মেয়ে দুটোকে ছোট থেকে দীপাই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মিতা সংসারের কাজে ব্যস্ত। তাদের নাওয়ানো-খাওয়ানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া ফিরিয়ে আনা—এসবই করে দীপাই। তার শূন্য জীবনে ওই শিশুদুটোই যেন অবলম্বন।
বৌদি ঠারে-ঠোরে বলে, হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে। বদলোকের অভাব নেই।
অর্থাৎ ভবনাথ সম্বন্ধেই মন্তব্যটা করে। কখনও বলে মিতা—একজনের রোজগারে পাঁচজন আজকাল চলে না। নিজেদেরও হাত-পা বের করতে হয়।
দীপা বোঝে এসবের অর্থ। তবুও মুখে কিছু বলে না। ধারালো কথার খোঁচাগুলো নীরবে হজম করে।
দীপা বাগানে ঘোরে সুবীর-পিয়াকে নিয়ে। ছায়া মাখা স্নিগ্ধ পরিবেশ। রোদের তীব্রতা এখানে নেই। বাতাসে ওঠে কাঁঠালিচাপা, বেলফুলের সুবাস। পাখিডাকা শান্ত জগৎ। গাছের নিচে বসে দীপা কোনদিন রাজপুত্র তেপান্তরের মাঠের গল্প বলে। শিশুমনের কল্পনায় ফুটে ওঠে পঙ্খীরাজের ছবি। সুবীর বলে, পিসি, রাজপুত্র খুব বড়লোক, না?
সে খবরটা দীপাও জানে না। তার চোখে এক রাজপুত্রের ছবি ভেসে ওঠে—সে ওই ভবনাথ। ওই ভবনাথকে কেন্দ্র করে দীপার বঞ্চিত মনও স্বপ্ন দেখে।
ছোট ভাই প্রবীর হঠাৎ ফিরে আসে। এখন তার চেহারাতে এসেছে একটা উদ্ধত ভাব। সে দেখেছে জীবনকে নানা পটভূমিকায়। দেখেছে টাকা-প্রতিপত্তিটাই বড় কথা। এখন বাড়িতে আসে, তবে আলাদাই থাকে। তার আসা-যাওয়ারও ঠিক-ঠিকানা নেই। কখন খায় কি খায় কোথায় খায় তাও জানা যায় না।
দীপা বলে, ছোড়দা, কি করিস তুই? কাজকর্ম দ্যাখ কিছু।
প্রবীর ওদিককার ঘরে থাকে। দরজাটা বন্ধই থাকে—ওপাশ দিয়ে তার যাতায়াতের পথ। প্রবীর বলে, আমার জন্যে কাউকে ভাবতে হবে না। আর আমিও কারোর জন্য ভাবি না। সে সব টাইম আমার নেই।
মাঝে মাঝে পাড়ার গোপেশবাবুর জিপ এখানে আসে। কি সব মালপত্র নামায়। না হয় তুলে নিয়ে চলে যায়। গোপেশবাবুই এখন এই এলাকার অলিখিত সম্রাট। বড় রাস্তার ওদিকে বিস্তীর্ণ জলা বুজিয়ে তার হাউসিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠছে। ইদানীং এদিকেও ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে যত্রতত্র। আর পড়তে পাচ্ছে না। আড়াই তিন চারলাখ টাকাতেই বিক্রী হয়ে যাচ্ছে শুয়োর খুপরীর মতো দু’ঘরের ফ্ল্যাট।
প্রবীর এখন গোপেশদার কাছের মানুষ। আর এই এলাকার উঠতি মস্তানদের নিয়ে প্রায়ই ঘোরাফেরা করে।
দীপাকে সেদিন প্রবীর বলে, ওই ভবা ব্যাটার সঙ্গে শুনি বেশ মেলামেশা করছিস?
দীপা কথা বলে না। ওই উদ্ধত প্রবীরকে সে পাত্তাই দিতে চায় না।
প্রবীর বলে, ও ব্যাটা আজকাল ধরণীর দলে মিশছে। গোপেশদা বিশুদাকে লেঙ্গি মারতে গেলে ওকেই ফুটিয়ে দেব।
এইসব অন্ধকারের রাজনীতি বোঝে না দীপা। তবু বলে, এই গোপেশদাই কি সাধু?
প্রবীর দেখে বোনকে। চটে ওঠে সে গোপেশদার নিন্দায়। বেশ জানে ধরণীবাবুর দল এবার এখানে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারা এলে প্রবীরের মস্তানি-তোলা আদায় বন্ধ হয়ে যাবে। তাই প্রবীর ভবনাথকে সহ্য করতে পারে না। প্রবীর বলে, ওই ধরণীর চেয়ে অনেক সৎ। ভবনাথের মতো ধান্দাবাজ নয়।
এর ক’দিন পরই কাণ্ডটা ঘটে যায়। অবশ্য এর প্রস্তুতি চলছিল আগে থেকেই। দীপা সেদিন ভোররাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বেলা অবধিও ফেরে না। সুবীর পিয়াকে স্কুলে পাঠানো যায় না। দীপা নেই। গেল কোথায় সে?
মিতা বলে, দ্যাখ কি সর্বনাশ করে গেল মুখপুড়ি। বার বার বলেছিলাম— সাবধান হও। এবার হল তো?
প্রদীপ প্রবীরকে ডাকে। প্রবীর বেলা অবধি ঘুমোয়, কারণ রাতে তার ফেরার ঠিক নেই। তার বেশির ভাগ কাজ হয় রাতের অন্ধকারে। সেদিন দাদার ডাকে ধড়মড় করে ওঠে। অভ্যাসবশতঃ বালিশের নিচে থেকে চেম্বারটা তুলে নেয়। কারণ সে যে সব কাজ করে শত্রুর অভাব নেই। সে চেম্বারটা তুলে লাফ দিয়ে ওঠে।
—কে!
প্রদীপ ভাইয়ের হাতে অস্ত্রটা দেখে ঘাবড়ে যায়। ভাই সম্বন্ধে তার বেশ কিছু ধারণাই ছিল। কিন্তু সে রিভলবার নিয়ে ঘোরে তা জানতো না। প্রদীপ বলে, ওসব রাখ। দীপাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
—সে কি!
প্রবীর কি ভেবে বের হয়ে যায়। তার মনে হয় এ ভবনাথেরই কাজ। তাই ওর বাড়িতেই সটান গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু ভবনাথও বাড়িতে নেই। কোথায় যেন বেড়াতে চলে গেছে কাল রাতে। প্রবীর ফেরে। বাড়িতে এসে বলে, ওই ব্যাটার সঙ্গেই কেটেছে। ব্যাটাকে পেলে লাশ গিরিয়ে দিতাম।
ক্রমশ প্রবীরও বুঝেছে ধরণীবাবুর দলও তৈরি। তাকেও সাবধান হতে হবে।
প্রবীর ভবনাথের ভাইকেই শাসায়, কোথায় ভবা? বল—না হলে ভাল হবে না।
পরদিন সন্ধ্যাতে প্রবীরের ওপরই একটা বোমা পড়েছিল—নেহাৎ বরাত জোরেই বেঁচে গেছে। প্রবীরের দলের গোপেশদাও ব্যস্ত ওঠে। বলে, ধরণীদের দেখে নেব।
ভয় হয় মিতারও। তাদের বাড়ির সামনেই বোমা পড়েছে। ভীত মিতা বলে, এখান থেকে চল যেখানে হোক, এই ডাকাত গুণ্ডার রাজ্য থেকে চল। মেয়েটাও গেছে। একা দুটো বাচ্চাকে নিয়ে পড়ে থাকি এই বনপুরীতে।
কথাটা ভাবছে প্রদীপও।
এমন দিনে প্রবীরই বলে, এত বড় বাড়ি বাগান এ সব রাখা যাবে না। বিক্রী করলে ভাল দামই দেবে গোপেশদা। সেই টাকার কিছু দিয়ে বাড়ি না হয় ফ্ল্যাট কিনে বাকীটা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদও আসবে।
কথাটা মনে ধরে প্রদীপের। এই ভূতের রাজ্য থেকে অন্যত্রই চলে যাবে সে। সিঁথির দিকে দুলাখের মধ্যে দুই কামরা ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে।
গোপেশবাবু ওত পেতেই ছিল। প্রায় বার বিঘে জায়গায় বাড়ি-বাগান। উঁচু জমি। রাস্তার ধারেই।
মিতা বলে, সেই ভাল। চল, এখান থেকে। কোনদিন বোমা গুলিতেই না- হলে প্রাণ যাবে।
বড় ভাই দীপকও এসেছে রাঁচী থেকে। তার স্ত্রী ছেলে টুকাই বুবাইদেরও এনেছে। শেষ বারের মতো পৈত্রিক ভিটে এই সবুজ বাগান দেখাতে।
প্রবীরও ব্যস্ত। কাগজপত্র করতে হবে।
প্রদীপ এর মধ্যে একটা ফ্ল্যাটের জন্যে বায়নাও করেছে। তবে ফ্ল্যাট তৈরি হতে দেরী হবে তাই ওই সিঁথি অঞ্চলে বেশি টাকা কবুল করে একতলার দু’খানা এঁদো ঘরই নিয়েছে। কল পায়খানাও কমন। মিতা ওই দিয়েই আপাতত চালাতে চায়। বলে—যা করার তাড়াতাড়ি কর, না হলে দীপা ফিরে এলে তাকেও টাকার সমান ভাগ দিতে হবে।
তাই ওরা তাড়াতাড়িই লেখাপড়া শেষ করে এখানে থেকে চলে যেতে চায়।
সুবীর-পিয়া এখন খুব খুশি। বুবাই-টুকাইদের সঙ্গে বাগানে ঘোরে।
আমগুলো পাকছে। সুবীর বলে, ওটা হিমসাগর। আর লাল মতো ওটা দাদুর হাতে লাগানো গোলাপখাশ। ওইটা বোম্বাই—খুব মিষ্টি। ওদিকে টিয়াপাখির বাসা আছে—আর এই চাঁপা ফুলের গাছ—হলুদ ফুলে ভরে যাবে বৃষ্টি পড়লেই। কি মিষ্টি গন্ধ! কোকিল ডাকছে। পিয়া বলে, কি মিষ্টি ডাকে!
রাতে অনেক পাখি থাকে এখানে। ডিম দেয়—
বুবাইকে সুবীর তার স্বপ্নজগৎ দেখায়। বাগানেই বেলা কেটে যায় তাদের।
সেদিন দলিলপত্র হয়ে যায়। যে যার টাকাও বুঝে নিয়েছে। এবার ঘোষবাড়ির আনন্দের হাট ভেঙে যায়। বুবাই টুকাইদের নিয়ে দীপক কলকাতার ঠিকানা চিরকালের জন্যে মুছে দিয়ে চলে গেল। আর কোনদিন এখানে আসবে না সে।
তার পরদিন সকালে ট্রাকে মালপত্র উঠছে। সুবীর-পিয়া বাগানে। আমগুলোও সব পাড়া হয়ে গিয়েছে। যেন বাগানটাকে কারা লুট করেছে। ছড়িয়ে আছে পাতা-ডাল। একটা ফলও নেই গাছে।
তবু কোকিলটা ডাকে। বলে পিয়া, আমরা এখানে থেকে চলে যাচ্ছি রে। কোকিলটার সঙ্গে আর দেখা হবে না। শালিখগুলোকেও দেখতে পাবি না। দোয়েলের গানও শোনা যাবে না। চাঁপাফুল ফুটবে, আর বকুল ফুলও কুড়ানো যাবে না।
সুবীর ভাবতেই পারে না। বলে সে, ধ্যাৎ! সিঁথিতে মাসীর বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি আমরা। ফিরে আসব এখানেই।
ট্রাকে মাল তোলার পর ওদের নিয়ে বের হয়ে এল প্রদীপ। মিতা বলে, চল শীগগির।
দীপক চলে গেছে। প্রবীরও নেই। সাতসকালে সেও চলে গেছে দমদমে তার কোনও বন্ধুর বাড়িতে। এই বাড়ি ছেড়ে শেষজন বের হল। প্রদীপ ঘোষ, বাড়ির অন্যতম বংশধর।
সিঁথির এঁদো গলির মধ্যে এসে মালপত্র বোঝাই করে মিতা এবার নতুন সংসার পাতে। এতদিন পর সে এসেছে নিজের সংসারে।
কিন্তু সুবীরের সারা মনে হাহাকার। এই এঁদো অন্ধকার ঘরে সকালের আলো আসে না। আসে না আমের বোল, বাতাবি ফুলের সুবাস, শোনা যায় না কোকিলের ডাক। ঘোরার জায়গাও নেই। ক’দিন ধরেই যেন কোকিলের ডাক শুনছে। মনে পড়ে পিসীর কথা, সেই সবুজ জগতের সুর।
বেশ দূর পথই। সুবীর তবু হেঁটে হেঁটেই আসে এখানে। তাদের সেই পুরোনো বাড়িতে। কাছে এসে চমকে ওঠে। চোখ ফেটে জল আসে। তাদের বাগানের সব গাছ কেটে ফেলেছে কারা। সেখানে এর মধ্যে বিশাল গর্ত করে লোহার রড দিয়ে ঢালাই হচ্ছে। তাদের পুরোনো বাড়িটাও নেই। নেই কোনও সবুজের স্পর্শ। চাঁপা, বকুল, আমগাছ সব সাফ—কোকিলটাকেও আর দেখা যায় না।
সুবীরের জীবন থেকে আর সব সুর বর্ণ সৌরভ বিদায় নিয়েছে। চোখ দিয়ে জল নামে। সরে এল ছোট ছেলেটা। তার সব সম্পদকে বিক্রী করে দিয়েছে ওরা।
—