কার্তিক মাসে শীত করার কথা নয়। কিন্তু বিনোদকুমারের আজকাল শীত করে। তাই সে বিকেলে গায়ে একটা আলোয়ান চাপিয়ে বেরিয়েছে। সঙ্গে ছোট মেয়ে বিম্ববতী। সামান্য সবজিবাজার, তাও আজকাল বইতে পারে না বিনোদকুমার। শরীরটা যে গেছে তা আজকাল বেশ মালুম হচ্ছে। তার নাম ছিল বিনোদবিহারী। পিতৃদত্ত নাম। যাত্রা-থিয়েটার যখন করত তখনই বিহারী ছেড়ে কুমার করে নিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল শিশির ভাদুড়ি, উত্তমকুমারের লাইনে নিজেকে তুলে ধরবে। সংসার-টংসারে মোটে মন ছিল না। বউটা ঘর আগলে পড়ে থাকত আর বিনোদকুমার ইচ্ছে-ঘুড়ি ওড়াতে বেরিয়ে পড়ত। আকাশে মই লাগানোর বৃথা চেষ্টায় জীবনটাই পড়ে গেল হাওলাতে। টাকাপয়সা যে কোন গাছের পাখি সেটা আজ অবধি বুঝতে পারল না সে, তার সঙ্গে চিরকাল ফেরেব্বাজি করে গেল ওই শালার টাকাপয়সা। জুয়োর লাক তার কিছু খারাপ ছিল না, শখ করে তাসে বসলে এক সময়ে বিশ-পঞ্চাশ টাকা আসত। কিন্তু যেই বরাত ফেরাতে কোমর বেঁধে বসল সেদিন থেকেই বরাতও বেইমানি শুরু করে দিয়েছিল।
—ফের বিড়বিড় করছ বাবা?
থতমত খেয়ে বিনোদকুমার বলল, কই? এই তো চুপ করেই আছি।
—ওম্মা গো; পষ্ট শুনলুম যে!
বিনোদকুমার আজকাল প্রায় সবাইকেই ভয় পায়। এমনকী এই এগারো বছরের মেয়ে বিম্ববতীকেও। মেয়েটা কটকটি আছে। তাকানোর মধ্যে মায়াদয়া নেই।
বিনোদকুমার বলল, বিড়বিড় নয়, ডায়ালগ বলছিলুম রে।
—কীসের ডায়ালগ?
—কত নাটকের ডায়ালগ আজও মুখস্থ আছে। সেই সব মনে পড়ে তো, তাই।
—মুখ চেপে বন্ধ করে রাখো। লোকে পাগল ভাববে।
—তা ভাববে কেন? আমি কি পাগল? সবাই চেনে আমাকে।
—চেনে বলেই তো মুশকিল। জোরে হাঁটো তো।
বিনোদকুমার এককালে পরগনার মাঠঘাট তো কম ঠ্যাঙায়নি। লম্বা লম্বা হাঁটাপথ পেরোতে হয়েছে। কখনও জলকাদা ভেঙেছে। কিন্তু এখন শরীরের মধ্যে একটা শীত ঘনিয়ে উঠেছে। হাত পা যেন সিঁটিয়ে থাকে। তাতে জোরবল সবই খামতি পড়েছে।
—তুই এগিয়ে হাঁট না। আমি ঠিক গিয়ে তোকে ধরে ফেলব।
—না, তুমি ফের গিয়ে আড্ডায় বসে যাবে।
—আড্ডা? না, না, সে আর কোথায়? গিরি মল্লিক মরে গিয়ে অবধি আর একটাও ঠেক নেই। বুঝলি? আড্ডা সব উঠে গেছে।
—তোমাকে বিশ্বাস নেই। এসো আমার সঙ্গে সঙ্গে।
তার বউ মালতী মেয়েকে একা ছাড়বে না বলে সঙ্গে তাকে আসতে হয়। নিয়মমাফিক। বাজার করার টাকাগুলো পর্যন্ত তার হাতে দেয় না মালতী। সেটাও বিম্ববতীর কাছে। তাকে কেউ এখন আর বিশ্বাস করে না।
ফুটু না থাকলে বিনোদ সন্নিসি হয়ে যেত। একমাত্র ওই ছেলেটাই যা একটু মায়া করে তাকে। কিন্তু বিনোদ হাড়ে হাড়ে জানে, এই মায়াটুকু সে অর্জন করেনি, ওটুকু তার ছেলেরই গুণ। একেবারে বাতিল মানুষটাকেও বুঝি ভগবান একটু কিছু দেন, ওই মায়াটুকু।
উড়নচণ্ডী মানুষের এই এক অসুবিধে। ঘরদোর ভাল লাগে না। সংসারের নিত্যদিনের দিন গুজরান বড্ড আলুনি লাগে। সকাল হল তো মশারি খোলো, বিছানা ঝাড়ো, ভাত বসাও, কুটনো কোটো, ফাঁকে ফাঁকে ক্যাট ক্যাট করে শতেক কাজ-অকাজের কথা শোনো আর চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরপাক খাও। ঘর, উঠোন, বাগান ব্যস। তার পর সংসারের সীমানা শেষ। এই যে বাইরের দুনিয়াটার খোলামেলা সীমানাহীনতা এতেই বিনোদ আজও বড় স্বস্তি বোধ করে। তবে বয়স আর শরীরের অক্ষমতা তার একটা সীমানা বেঁধে দিয়েছে। লম্বা দড়ি পরানো আছে গলায়, খুঁটো টেনে রাখে।
—হাঁফ ধরছে কেন রে?
—কার হাঁফ ধরছে? তোমার?
—জোরে হাঁটতে বলিস, আমি কি পারি?
—একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নাও। বাজার তো এসে গেছে।
—হাঁটুতে জোর নেই মোটে। শচীর দোকানে বরং একটু বসি।
—ওমা! ও তো সেলুন। কুচি কুচি চুল উড়ছে সব সময়ে।
—আমিও বরং খেউড়িটা হয়ে নিই। গালে দাড়ি বিজবিজ করছে। ততক্ষণ একটু বসাও হবে।
—তা হলে যাও, হলে দিদির কাছে গিয়ে দোকানে বসে থাকো। যাওয়ার সময় তোমাকে ডেকে নিয়ে যাব।
ওটা ভাঁওতাবাজি। সবজি বাজারের মতো ভ্যাতভ্যাতে জিনিস আর নেই। কাল শনিবার। তার বউ মালতী শনিবারটা হেঁসেলে মাছ ঢুকতে দেয় না। নিরামিষ কি গলা দিয়ে নামে বাপ? শনিবার এলেই তার মনটা নেতিয়ে পড়ে।
খদ্দের ছিল বলে একটু বসতে হল। তা হোক, বসাই তো চায় বিনোদ। বাজারে তার বিস্তর চেনা মানুষ। বয়সের মানুষরা অবশ্য আর গুনতিতে বেশি নেই। ফিফটি পারসেন্ট টেঁসে গেছে। যারা আছে তাদেরও অনেকেই খাড়া নেই। কেউ শয্যাশায়ী, কেউ বা মরো-মরো। দু’চার জন যা আছে, ঘোরাফেরা করে তাদের সঙ্গে এই জায়গাতেই যা দেখা হয়ে যায়।
বসে একটা সিগারেট ধরাল বিনোদ। পাশে বসা লুঙ্গি-পরা একটা হাড়গিলে লোক বিড়ি খাচ্ছিল। কাঁচা-পাকা চুল, গালে পাতলা দাড়ি, নাকের নীচে ভুঁড়ো গোঁফ। কয়েক বার তেরছা চোখে চেয়ে দেখল তাকে। তার পর হঠাৎ বলল, বিনোদ না?
বিনোদ একটু অবাক হয়। নাম ধরে ডাকে কে রে বাবা? বয়সের একটা সম্মান নেই?
—কে হে তুমি?
—আমি রজব আলি। বীরশিবপুর। মনে পড়ে?
তাই তো! রজবের সঙ্গে এক সময়ে বেশ মাখামাখি ছিল তার। আলকাপের দল ছিল রজবের। গলা দরাজ। কত আসর মাত্ করেছে।
বিনোদ বলে ওঠে, দিব্যি তরতাজা আছ তো! বুড়ো হওনি কেন?
—আমাদের কি বুড়ো হলে চলে! খেটেখুটে খেতে হয়।
—তবে আমি বুড়ো হলাম যে?
—তাই নাকি? তোমার আমার তো একই বয়স। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। তা তুমি আগ বাড়িয়ে বুড়ো হতে গেলে কেন? কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?
—বড় চিন্তায় ফেলে দিলে মিঞা।
—কেন চিন্তাটা কীসের তোমার?
—চিন্তা হবে না? ঘরে বসে বসে কেবল ভাবি, বুড়ো হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। আর ভাবতে ভাবতে হাতে-পায়ে বুড়োটে ভাবও এসে গেল। এই যে হঠাৎ তোমাকে দেখছি, দিব্যি তরতাজা আছ। তাই মনের মধ্যে একটা টানা-হ্যাচড়া পড়ে গেল।
—ওরে বাপু, বুড়ো তো আমারই আগে হওয়ার কথা। ছেলেগুলো মানুষ হল না তেমন। বড়টা বোকাসোকা, মেজো জন ভ্যান চালায়, পরেরটা কী করে বেড়ায় আল্লা জানে, ছোট জন ওর মধ্যেই একটু ভাল। মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে যায়। আর তোমার দেখ, ছেলেখানা জব্বর দাঁড়িয়েছে। ফুটুর কথা সবাই বলাবলি করে। তোমার চিন্তা কীসের হে?
—তাই ভাবছি। সব ওলট-পালট করে দিলে হে। এখন আবার ফিরে সব হিসেব-নিকেশ করতে হবে।
—ওই দেখ। এতে আবার হিসেব নিকেশের কী?
—এই বয়স-কাল, অবস্থা-ব্যবস্থা। নিজেকে জরিপ করা বড় শক্ত কাজ হে, রজবভাই।
দাড়িটা আর কামানো হল না। গালে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে পড়ল বিনোদ।
—চললে কোথায় হে?
—একটু দেখি, মেয়েটা কোথায় গেল। বাচ্চা মেয়ে দেখে দোকানিরা কী গছিয়ে দেয় কে জানে।
আসলে বিনোদের এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। একটু আগে যেন গা থেকে একটা ভেজা কম্বল সরিয়ে নিয়েছে কেউ। এখন আর শীত করছে না তেমন। গায়ের আলোয়ানটা খুলে ভাঁজ করে কাঁধে ফেলল সে।
ভিড়ের ভিতরে একটা রোগা ছেলে আর যুবতী মেয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা বলে উঠল, ওই দেখ দিদি, ফুটুদার বাবা। মেয়েটা ভারী অবাক চোখে তাকাল বিনোদের দিকে। তাকানোটা ভারী ভাল লাগল বিনোদের। আজকাল তো আর কেউ তাকায় না। উচ্ছিষ্টের মতো পড়ে আছে এক ধারে। না, দিনটা আজ ভালই গেল।