বেশি দূরে নয় – ০৪

প্রীতমের পর দুটো বোন, তার পর ভাই। তার ভাইটা এখনও বড্ড ছোট। বছর দশেক বয়স। তাই সদর রাস্তার দোকানটায় বাধ্য হয়ে পরের বোনটাকে বসায়। প্রথমে বাবা বিনোদকুমারকেই বসিয়েছিল। কিন্তু বাবা ব্যবসা করবে কী, লোক জুটিয়ে এমন আড্ডা বসাল যে, বিকিকিনি লাটে ওঠার জোগাড়। বাধ্য হয়ে সরস্বতীকে রাজি করাল। সে তো ভয়ে মরে, ও দাদা, আমি যে হিসেবে ভীষণ কাঁচা, কী করতে কী করে ফেলব।
প্রীতম বলল, ঠিক পারবি। শুধু লোকের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে যাবি না। পয়সা গুনতে পারিস তো, তা হলেই হবে।
—কেউ যদি বদমাইশি করে?
—মুখটা মনে রাখবি। তার পর আমাকে বলে দিবি।
এ তল্লাটে সবাই মোটামুটি প্রীতমকে সমঝে চলে। এক সময়ে সে এ ধারে নিজের শাসন কায়েম করেছিল। এখনও লোকে তাকে ঘাঁটায় না।
প্রীতমের পর দুটো বোন, তার পর ভাই। তার ভাইটা এখনও বড্ড ছোট। বছর দশেক বয়স। তাই সদর রাস্তার দোকানটায় বাধ্য হয়ে পরের বোনটাকে বসায়। প্রথমে বাবা বিনোদকুমারকেই বসিয়েছিল। কিন্তু বাবা ব্যবসা করবে কী, লোক জুটিয়ে এমন আড্ডা বসাল যে, বিকিকিনি লাটে ওঠার জোগাড়। বাধ্য হয়ে সরস্বতীকে রাজি করাল। সে তো ভয়ে মরে, ও দাদা, আমি যে হিসেবে ভীষণ কাঁচা, কী করতে কী করে ফেলব।
প্রীতম বলল, ঠিক পারবি। শুধু লোকের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে যাবি না। পয়সা গুনতে পারিস তো, তা হলেই হবে।
—কেউ যদি বদমাইশি করে?
—মুখটা মনে রাখবি। তার পর আমাকে বলে দিবি।
এ তল্লাটে সবাই মোটামুটি প্রীতমকে সমঝে চলে। এক সময়ে সে এ ধারে নিজের শাসন কায়েম করেছিল। এখনও লোকে তাকে ঘাঁটায় না।
ওই দাদা এল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় সরস্বতী। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ভারী ব্যাগ নামাচ্ছে প্রীতম। সরস্বতী তাড়াতাড়ি গিয়ে এক পাশটা ধরল।
প্রীতম বলল, ছাড়। মেয়েদের ভারী তুলতে নেই। প্রকাণ্ড এবং ভারী ব্যাগখানা দোকানে তুলে দিয়ে প্রীতম বলল, যতটা পারিস নামিয়ে সাজিয়ে রাখিস। বাকিটা আমি এক সময়ে সাজিয়ে দিয়ে যাব।
সরস্বতী ঘাড় কাত করে বলে, আচ্ছা।
তার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ আজ পর্যন্ত দাদা। কী সরল, শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ। পরিশ্রম ছাড়া কিছুই বোঝে না। নিজের পরিবারটি নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দাদার এই জান কবুল লড়াই দেখলে পাষণ্ডেরও চোখে জল আসবে। একখানা ভাল জামা-প্যান্ট নেই। ভাল জুতো নেই। আছে শুধু বাপ-মা আর ভাই-বোনকে আগলে থাকা।
দাদার প্রতি মায়ের মতোই গভীর এক ভালবাসা আছে সরস্বতীর। দাদার মতো মানুষ হয় না। এই যে তাদের বাবা বিনোদকুমার সারাটা জীবন পরিবারটাকে ধীরে ধীরে সর্বনাশে নিয়ে যাচ্ছিল, তার জন্যও কখনও বাবার ওপর রাগ করে না তার দাদা প্রীতম। মা তো দিনরাত বাবাকে উস্তমকুস্তম করে ছাড়ে। কিন্তু দাদা ঠিকই বাবার প্রিয় মাছ-তরকারি কিনে আনে। জামা-জুতো কিনে দেয়, সিগারেট-দেশলাইয়ের অভাব রাখে না। প্রীতম বলে, মানুষ যেমনই হোক আমি বিচার করার কে? জন্মদাতা বাপ বলে কথা; বাবা এক মস্ত জিনিস।
আপাত দৃষ্টিতে প্রীতমের শরীরে রাগ নেই। কিন্তু কখনও রাগলে যে সেই রাগ ভয়ংকর তাও সবাই জানে। ল্যাকপ্যাক একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে উঁকিঝুঁকি মারছিল।
—কে রে? কী চাস?
—ফুটুদা নেই?
—ফুটুদাকে কী দরকার তোর?
ছেলেটা বড় বড় দাঁত বার করে হাসছে। কেবল হাসছে।
—এমনি।
—তুই কোন বাড়ির ছেলে?
—ওই স্টেশনের দিকে। লক্ষ্মী রায়ের বাড়ি।
—কী চাস?
—এমনি। এলাম তো, তাই।
—দাদা যে এ দোকানে বসে না, তা জানিস না? মুদির দোকানে বসে। চিনিস? ওই বাঁ হাতে গলির ভিতরে।
ছেলেটা হেসেই যাচ্ছে।
—অমন হাসছিস কেন? নাম কী তোর?
—সীতানাথ। সীতু।
—কোন ক্লাসে পড়িস?
—থ্রি।
—অ্যাঁ! থ্রি কী রে?
—ক্লাস থ্রিতে পড়ি।
—এ বাবা, এত বয়সে মোটে থ্রি! বছর বছর ডাব্বা মারিস বুঝি?
—হ্যাঁ।
সরস্বতী হেসে ফেলল। এমন ভাবে হ্যাঁ বলল যেন গৌরবের ব্যাপার।
—ফুটুদার সঙ্গে তোর কীসের দরকার?
—এমনিই। দিদিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই ভাবলাম ফুটুদার সঙ্গে একটু গল্প করি।
—তাই বুঝি! তা তোর দিদি কে?
—শেফালি। ক্লাস নাইন।
—ও। তুই শেফালির সেই হাবা ভাইটা বুঝি?
—হ্যাঁ।
—হারাবে কোথায়? এইটুকু জায়গায় কি কেউ হারাতে পারে? ভাল করে খোঁজ। কোনও দোকানে বোধহয় কেনাকাটা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *