খানিকটা দৌড়তে হল শেষ দিকে। নইলে, মেচেদা লোকালটা ধরা যেত না। কিন্তু ট্রেনে উঠেই বুকটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মণিরামের। বাঁ বুকটা চেপে ধরে মণিরাম কঁকিয়ে উঠল— গেছে রে প্রীতম!
প্রীতম গায়ে- পায়ে মানুষ। অত বড় দুটো ভারী ব্যাগ দু’হাতে নিয়ে মণিরামকে সাত হাত পিছনে ফেলে শেষের দু’নম্বর বগিতে উঠে পড়েছে। মেচেদা লোকালে তেমন ভিড় নেই। সিটে বসে প্রীতম পাশে জায়গা রেখেছে তবু। বলল— কী গেল?
—মানিব্যাগটা। তেইশ বছরে এই প্রথম পকেটমারি! বুঝলি?
—বউনি হল তা হলে! তা গেল কত?
—টাকাটাই কি বড় কথা রে? গুমোর ভেঙে দিল যে।
—টাকাটা কি ফ্যালনা নাকি?
—তা ধর, সুখরামের গদিতে দেড় হাজার ঝেড়ে এলাম। কেশববাবুর তিনশো চল্লিশ। আগাম দিতে হল ধানুরামকে। নেই নেই করেও একুশ টাকা ছিল।
—তাই বল। চোরেরও কি মুখরক্ষা হল? ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ!
মণিরাম ধপ করে বসে পড়ল পাশে। বুকপকেটের কাছটা এখনও ডান হাতে চেপে ধরে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না যেন।
—কখন নিল বলতে পারিস? ভোজবাজির মতো উবে গেল যে!
—ও সব না শিখে কি আর লাইনে নেমেছে গো! টেরই যদি পাবে, তা হলে সে আর পকেটমার কীসের? তবে আহাম্মক বটে। ফিরতি পথে মাল গস্ত করে করেও পকেটে পয়সা থাকে?
গাড়ি ছেড়েছে। কার্তিকের শেষ, এখন চলন্ত ট্রেনের হাওয়ায় গা শিরশির করে। আজ একটু মেঘলাও আছে বলে হাওয়াটা ঠাণ্ডা।
—জানালাটা নামিয়ে দিবি নাকি?
—আমার মাল টেনে ঘাম হচ্ছে। একটু শুকোতে দাও, তার পর নামিয়ে দেবখ’ন।
—একুশটা টাকাই তো নয়, মেলা কুচো কাগজ ছিল। বগলামায়ের একখানা ছবি, পাঁচ- ছ’টা ঠিকানা, গোটা কয়েক ফোন নম্বর। বড় গুমোর ছিল। কোনও দিন পকেটমারি হয়নি আমার। প্রায় নিত্যি যাতায়াত এই তেইশ বছরে।
—ও সব ভেবে খামোখা হা- হুতাশ করো কেন? টাকাই যখন তেমন যায়নি তখন দুঃখ কীসের? অল্পের ওপর দিয়ে বউনিটা হয়ে গেল। বরাবর তোমার বরাতের জোর তো দেখছি!
—তোর নজরে নজরেই আমার এ সব হয়েছে। বরাতের দেখলিটা কী রে শালা! মরছি নিজের জ্বালায়। বাজারে দেনা কত জানিস? প্রীতম জানালাটা নামিয়ে দিয়ে বলল, ঠাণ্ডা হয়ে বোসো তো! দেনার কথা কাকে বলছ? মায়ের কাছে মাসির গপ্পো? দেনায় তোমার হাঁটুজল হলে আমার ডুবজল। বছর ঘুরতে কারবারটা যদি না দাঁড়ায়, তা হলে হাজতবাস কপালে আছে।
মণিরাম প্রীতমের অবস্থাটা জানে। রা কাড়ল না। ছোঁড়া পরিবার নিয়ে হয়রান হয়ে গেল। বাপ বিনোদকুমার একটা জীবন জুয়ো খেলে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করে এখন জবুথবু হয়ে বসে বসে বিড়বিড় করে।
মণিরামের বউ দীপির আবার প্রীতমকে ভারী পছন্দ। ননদ ফুলির জন্য দেগে রেখেছে। ফুলির ভাবগতিক অবশ্য বোঝা যায় না। লেখাপড়া নিয়ে ভারী ব্যস্ত। বিয়ের কথা বলতে গেলেই ঝেঁঝে ওঠে।
প্রীতম তার ভগ্নিপোত হলে মণিরামের ব্যাপারটা অপছন্দের হবে না। ছোকরা লড়িয়ে আছে বটে। বাপের এক পয়সার মুরোদ ছিল না। চারটে ভাইবোন যে কী কষ্ট করে বড় হয়েছে তা না দেখলে প্রত্যয় হয় না। শাকের ঝোল আর ভাত। কিংবা কখনও শুধু শাকের ঝোল, কখনও মেটে আলু, কচু- ঘেঁচু খেয়ে বড় হয়েছে। বাড়ি- জমি সব বেহাত হয়েছে। দেনায় বিনোদকুমার ভুরু অবধি ডুবে ছিল। প্রীতম মাধ্যমিকটা ডিঙিয়েই কাজে নেমে পড়ল। মণিরাম নিজে ব্যবসাদার বলে জানে, হ্যাপা কত। আর কত লোকের বায়নাক্কা বুঝে চলতে হয়। প্রীতম শুরু করেছিল চাল বেচে। এখন গঙ্গারামপুরে দু’দুখানা দোকান। ধারকর্জ আছে বটে, কিন্তু বুকের পাটা আর রোখ আছে বলে সব কাটিয়ে ভেসে উঠবে ঠিক।
মানিব্যাগটার কথা খানিক ভুল পড়ল লেবু-চা খেয়ে। প্রীতমই খাওয়াল। বলল, মুখটা অমন আঁশটে করে রেখো না তো। পিছনের দিকে যত চাইবে তত এগোতে ঢিলে পড়বে।
—ওরে, পকেটমারিটা বড় কথা নয়, আহাম্মকির কথাটাই ভাবছি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি হুঁশিয়ার মানুষ। ট্রেনটা ধরতে দৌড়তে না হলে
—এ বার থেকে গোঁজ করে নাও। অবিশ্যি যখন যাওয়ার তখন গোঁজও যাবে।
চেনা- জানা দু’চার জন উঠে পড়ল কামরায়। রাধাপুরের সুধীর হাজরা, বীরশিবপুরের কানাই মণ্ডল, আরও দু’তিন জন এ দিক- ও দিককার চেনা লোক। সুধীর পাশের ফাঁকা সিটে বসে বিড়ি ধরিয়ে তার শালার বিয়ের গল্প ফেঁদে বসল। কথায় কথায় পথটা কেটেও গেল, যেমন রোজই যায়।
উলুবেড়েতে নেমে কুতুবের দোকান থেকে দু’জনে জমা রাখা সাইকেল বের করল। ক্যারিয়ারে একখানা ব্যাগ নাইলনের দড়িতে বেঁধে, আর একখানা ব্যাগ হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে প্রীতম বলল, তুমি এগিয়ে পড়ো মণিরামদা। আমাকে সাইকেল ঠেলেই যেতে হবে। এ গন্ধমাদন নিয়ে তো সাইকেলে চাপার উপায় নেই।
—চাপবখ’ন। একটু হাঁটি চল তোর সঙ্গে। একখানা ব্যাগ আমার সাইকেলে চাপিয়ে দে না।
—না গো মণিরামদা। তুমি হলে আয়েসি মানুষ। জীবনে মালপত্র বয়েছ কখনও?
—ছেলেবেলায় বয়েছি। তখন তো বাবার এত ফাঁদালো কারবার ছিল না। তখন বাপ- ব্যাটায় বিস্তর বয়েছি।
—তোমার হল আদরের শরীর। গদিতে পয়সা ফেলে চলে এলে। তারা মালপত্র ট্রাকে পাঠিয়ে দেবে। আমার তো তা নয়।
গঙ্গারামপুর অনেকটা রাস্তা। হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবতেই মণিরামের গায়ে জ্বর আসে। কথাটা ঠিক, তার বেশি কষ্ট করার স্বভাব নয়। বাপের বড় কারবার থাকলে এইটে সুবিধে।
প্রীতম আগে আগে, কয়েক পা পিছিয়ে মণিরাম। ও দু’খানা ব্যাগের ওজন মণিরাম জানে। সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়াও সহজ নয়। মণিরাম পেরে উঠত না। একটু ঝুঁকে ওই গন্ধমাদন ঠেলাওলার মতো নিয়ে চলেছে প্রীতম। একটা ভ্যান ভাড়া করতে পারত। কিন্তু ও তা করবে না। বরাবর নিজের মাল নিজেই বয়ে আসছে। পিছন থেকে দৃশ্যটা দেখে হিংসে হয় মণিরামের। কী পুরুষালি, শক্ত সমর্থ শরীর প্রীতমের! তার নিজের বড় বাবু শরীর। এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তার একটু চর্বি জমেছে শরীরে, দৌড়ঝাঁপেও কমছে না। দীপি আজকাল বলে, কেমন ন্যাদস মার্কা হয়ে যাচ্ছ, কেন গো?
—তুমি সাইকেলে চেপে এগিয়ে পড়ো মণিরামদা। আমার সঙ্গে ভদ্রতা কীসের?
—একা একা এতটা পথ যাবি?
—দোকা পাব কোথায়? নিত্যিদিন যাচ্ছি। রোজ তো আর তুমি থাকো না।
—তা বটে। ফেরার সময় আজ আবার বিপিন ডাক্তারের বাড়ি হয়ে যেতে হবে। তোর বউদির ব্যথাটা কমছে না।
—হ্যাঁ হ্যাঁ যাও।
—দেখে বুঝে যাস। সন্ধের পর দেখা হবেখ’ন।
মণিরাম সাইকেলে চেপে বসল।
বয়সে পাঁচ- সাত বছরের বড় এই মণিরামদাদাকে প্রীতম পছন্দই করে। বহু বার মণিরাম তাকে ব্যবসার জন্য টাকা হাওলাত দিতে চেয়েছে। অভাবের দিনে সাহায্য করতে চেয়েছে। প্রীতম নেয়নি। নেওয়া জিনিসটার একটা অসুবিধে হল, লোকটার মুখোমুখি হলেই কেমন যেন অসোয়াস্তি হতে থাকে, যেন সমান সমান মনে হয় না। দুর্বল আর ছোট লাগে নিজেকে। তবে হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের লোনটা পাইয়ে দিতে মণিরামদা জামিন না হলে মুশকিল ছিল। সেই লোন প্রাণপাত করে শুধতে হচ্ছে। আধাআধি হয়ে এসেছে এখন। বিকিকিনি একটু একটু করে বাড়ছে। রাতারাতি, শর্টকাটে যে কিছু হওয়ার নয়, তা প্রীতম ভালই জানে। শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়েই না তার বাপটা ডুবে গেল।
না, বাপের ওপর রাগ নেই তার। সব লোক কি সমান হয়? অপদার্থ হোক, জুয়াড়ি হোক, এই বাপটা তো তাকে বরাবর বুক দিয়ে ভালবেসেও এসেছে। ভাতে টান পড়লে ‘বাইরে খেয়ে এসেছি’ বলে ছেলেমেয়েদের মুখে গ্রাস তুলে দিত। মা যদিও দু’বেলা ঘর- বসা লোকটাকে উঠতে- বসতে উস্তম- কুস্তম অপমান করে, কিন্তু প্রীতমের বড্ড মায়া হয়। বাপটা খারাপ ছিল না তার, তবে বড্ড বোকা আর অদূরদর্শী। এখন মনস্তাপে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ভেউ ভেউ করে কাঁদে। বাপকে দেখে দেখে ছেলেবেলা থেকেই তার রোখ চেপেছিল, কিছুতেই বাপের মতো হবে না সে। সংসারকে বাঁচাতে হবে। মাধ্যমিকটা পাস করার পরই সে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে রোজগারের জন্য হন্যে হয়ে উঠল। তখন ওই মণিরামদাদা পাশে না থাকলে গাড্ডায় পড়ে যেত সে। তেজেনবাবু চানাচুরের কারখানা খুলেছিলেন। প্রথমে সেটাই বাকিতে নিয়ে দোকানে দোকানে দিত সে। বিক্রি ভাল ছিল না। তার পরে বেকারির বিস্কুট সাপ্লাই দিতে লাগল। সেটাও ফেল মারল। কাঁচা সবজিও চলল না তেমন। বাজারের একটেরে গলির মধ্যে হীরু দাসের মনোহারী দোকান ছিল। সেটা মোটেই চলত না। হীরু দাস মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সুধীর দোকানটা বেচে দিল। কিনল মণিরামদাদার বাবা সফলরাম। কিন্তু তার গোটা পাঁচেক দোকান, তার ওপর হোলসেল। হীরু দাসের দোকানটা কিনেও ফেলেই রাখতে হচ্ছিল। মণিরামদাদা তখন তার বাপকে বলে দোকানটা বন্দোবস্ত দিল প্রীতমকে। সফলরাম ছেলের মতো নয়। মায়াদয়া দেখানোর লোক নয়। পরিষ্কার বলে দিল,
—দানখয়রাত করতে পারব না বাপু, তবে তোর কাছ থেকে লাভও তেমন নিচ্ছি না। পাঁচ পারসেন্টে ছেড়ে দিচ্ছি। তবে তিন মাসের মধ্যে ডাউন পেমেন্ট।
ব্যাঙ্কের টাকাটা পেয়ে ধার শোধ করে দোকানটা নিয়ে ফেলেছিল সে। গলির দোকান চলে না হয়তো। কিন্তু, দোকানি যদি ভাল হয় তবে তেপান্তরে দোকান দিলেও খদ্দের খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির হয়। প্রীতম দাঁতে দাঁত চেপে তার গরিব দোকানটার পিছনে পড়ে রইল। বাছাই জিনিস, কম লাভ আর মিষ্টি কথা। এই সবই ছিল তার মূলধন। লোককে ঠকায় না, নিজেও না ঠকবার চেষ্টা করে।