বেলেঘাটার ‘হায়দার-ই-মঞ্জিল’-এ গান্ধীজীর ছাব্বিশ দিন – অশোকা গুপ্ত

বেলেঘাটার ‘হায়দার-ই-মঞ্জিল’-এ গান্ধীজীর ছাব্বিশ দিন – অশোকা গুপ্ত

১৯৪৭ সালের বারোই আগস্ট গান্ধীজী যে বাড়িটিতে এসে ছাব্বিশ দিন বাস করেছিলেন, আজ সেটির নাম গান্ধীভবন। তখন নাম ছিল ‘হায়দার—ই—মঞ্জিল’। পূর্বে ঢাকার নবাব হবিবুল্লার ছিল, পরে হাত বদল হয়ে যে পরিবারের হাতে গেল, তাঁরা বেলেঘাটায় অশান্ত পরিবেশে থাকতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। প্রকাণ্ড বাড়ি, গান্ধীজীর সদলবলে ওখানে থাকার কোনও স্থানাভাব হয়নি। কিন্তু ওখানেই কেন এলেন? তাঁর যাত্রার পথ ছিল নোয়াখালি, পথে সোদপুর আশ্রমে দুদিন থাকবেন। কিন্তু যখন দশই আগস্ট গান্ধীজী কলকাতায় এসে পৌঁছলেন, তখন শহরে প্রচণ্ড অশান্তি। খুনোখুনি লুঠতরাজ এক এক প্রান্তে বেড়েই চলেছিল। সবচেয়ে বেশি হচ্ছিল বেলেঘাটা, মুচিপাড়া থানা ও শিবপুর এলাকায়। গান্ধীজী স্থির করে নিলেন সবচেয়ে অশান্ত ও বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত স্থানে থেকে শান্তি মিশন পরিচালনা করবেন। স্থির হল ”হায়দার—ই—মঞ্জিল” নামে বেলেঘাটায় অবস্থিত মুসলমান পরিবারের পরিত্যক্ত একটি গৃহে তিনি থাকবেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার বাকি কেবল তিন দিন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলে গান্ধীজীর শান্তি অভিযান শুরু হল। হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিবাদে শান্তির মৌনব্রত অবলম্বন করলেন গান্ধীজী। পাশে ছিলেন তাঁর অনুগতেরা—গান্ধীজীর সচিব নির্মল বসু, আভা গান্ধী, মানু গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরি, কলকাতা জেলা মুসলিম লিগের সিক্রেটারি ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এম এম ওসমান এবং আর নামী—অনামী নেতৃবৃন্দ। গান্ধীজী এই গৃহ থেকেই কলকাতার রাজাবাজার, পাইকপাড়া, বেলগাছিয়া ট্যাংরা, মানিকতলা, চিৎপুর, এন্টালির দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় ঘুরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবেদন জানালেন। ১৪ আগস্ট পর্যন্ত উভয় বঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী শহীদ—সুরাবার্দীর সঙ্গে এসে থাকতে চাইলেন।

ইতিমধ্যে সাতই আগস্টই জানা গিয়েছিল মুসলিম লিগের নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। শহীদ সুরাবর্দী পরাজিত হয়েছেন। তবে নিয়মানুসারে তিনি তখনও উভয়বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে একই অফিসে দুই মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের দায়িত্বভার পালন করছেন। সুরাবর্দী বুঝতে পারলেন কলকাতায় হামলা হলে তিনি বিপন্ন হতে পারেন। তাই তিনি দারুণ আতঙ্কিত ও নিজের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে গান্ধীজীর আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কী মিটিং—মিছিলে, কী বেলেঘাটায় সর্বত্রই তাঁকে গান্ধীজীর সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে এবং থাকতে দেখা গেল। কারণ তিনিই তো ”লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” আওয়াজ তুলে ১৬ই আগস্ট থেকে ১৮ই আগস্ট ১৯৪৬ পর্যন্ত Great Calcutta Killing-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাজেই ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক কেননা এঁর এই ”প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” সম্পর্ক প্রত্যক্ষদর্শী ও খবরের কাগজের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বসেই যা জেনেছিলাম তার প্রত্যাঘাত সুদূর নোয়াখালির গ্রামে গঞ্জে কীভাবে নিরীহ মানুষকে নির্মম অত্যাচারের মুখে ফেলে দিয়েছিল সে আমার নিজের চোখে দেখা। এটা বোঝা গিয়েছিল যে হিংসা ও বিদ্বেষ প্রচার মানুষের শুভবুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে এবং খুনোখুনির রাজনীতি সাধারণ মানুষকে এমনভাবে উত্তেজিত করে যার প্রশমন সহজে হয় না। শহীদ সুরাবর্দী কাজেই প্রাণভয়ে ভীত হয়েছিলেন এবং অহিংসার পূজারি গান্ধীজীর কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এদিকে চোদ্দই আগস্ট দাঙ্গা চরমে পৌঁছল সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে গান্ধীজীর সঙ্গে আমাদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও দেখা করা সম্ভব ছিল না। বেলেঘাটায় হায়দার—ই—মঞ্জিলে গিয়ে হঠাৎ শোনা গেল চোদ্দই আগস্ট মধ্যরাতে দলে দলে মুসলমান ট্রাকে উঠে হিন্দুদের সঙ্গে আতর ও গোলাপজল ছিটিয়ে কোলাকুলি করেছে। পাকিস্তান পাওয়ার আনন্দেই বোধ হয় এই অভিব্যক্তি। আমরা ভাবলাম এবার হয়তো মানুষের মনের পরিবর্তন হবে, তাই কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ঠিক করলাম ষোলই আগস্ট গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করব। যাইহোক আমরা ষোলই আগস্ট গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁর কাছে তখন মুসলিম লিগের ও কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ও অন্যান্য অনেক নেতৃবর্গ দিল্লি থেকে আসছেন। সাধারণ মানুষ দেখা করবার সুযোগ কমই পাচ্ছেন। গান্ধীজীকে অত্যন্ত ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। তিনি দেশভাগ চাননি। বাধ্য হয়ে তাঁকে মেনে নিতে হয়েছে। সেদিনই দেখলাম গুণ্ডারা দলে দলে এসে গান্ধীজীর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করছে, কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করছে। তারা জানাচ্ছে দাঙ্গা আর হবে না।

আমাদের দেখে গান্ধীজী মহিলাদের সঙ্গে শান্তি মিছিল গড়া নিয়ে আলোচনায় বসবেন জানালেন। তাই আমরা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে মহিলাদের বিরাট সমাবেশের আয়োজন করলাম। গান্ধীজী সুরাবর্দীকে নিয়ে মহিলা সভায় এলেন। সুরাবর্দীকে তাঁর সঙ্গে দেখে সভার সকলে অত্যন্ত বিচলিত ও বিরক্ত হলেন, তাঁদের ক্ষোভ গোপন রইল না। কেউ কেউ প্রশ্ন করলেন ‘উনি কেন এসেছেন?’ সুরাবর্দীকে ধিক্কার দিয়ে তাঁরা স্লোগান দিলেন, গান্ধীজীর ভাষণ কিছুই শোনা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টার পর গান্ধীজীর কথা দু’চার মিনিট শোনাবার ব্যবস্থা হল। গান্ধীজী বলেছিলেন, তিনি আবার নোয়াখালিতে ফিরে যাবার জন্যই এসেছেন। তবে তার আগে তিনি চান যে মহিলা সংগঠনগুলি যে শান্তি মিছিল করে মহল্লা মহল্লায় ও সভাসমিতিতে শান্তির বাণী প্রচারে আয়োজন করে এবং দুর্গত মানুষদের মধ্যে আত্মবিশ্বস জাগিয়ে দেয়। আরও বললেন, যাতে দেশ ছেড়ে কেউ যেন না যায়। শান্তি ফিরবেই। যদিও তখন বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়ে যাবার সবই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ। কিন্তু তিনি নোয়াখালিতেই ফিরে যেতে চান। যাই হোক শান্তি মিছিলের প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু শুরু হল বিভক্ত প্রদেশ পাঞ্জাবে রক্তাক্ত দাঙ্গা হাঙ্গামা। তবুও চলতে লাগল তাঁর নির্দেশমতো শান্তি মিছিল। বহু প্রতিষ্ঠান ও শক্তিকামী স্বেচ্ছাসেবক দলে দলে বেরোলেন, বিভিন্ন এলাকায় শান্তি মিছিল করে পরিক্রমা করতে। অনেকেই, এই শান্তিমিছিল নিয়ে এলাকায় এলাকায় ঘুরছেন। ষোলই আগস্ট থেকে পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোটামুটি শান্ত অবস্থা ছিল। শহীদ শচীন মিত্রও পয়লা সেপ্টেম্বর তিনজন সঙ্গী সহ শান্তিমিছিল নিয়ে নাখোদা মসজিদের দিকে গেলেন। সেখানে আকস্মিকভাবে তাঁর পেটে এমন ছুরিকাঘাত করা হল যাতে তৎক্ষণাৎ তাঁকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে হল। কলকাতায় সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে আবার রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সূত্রপাত হল। আমি খবর পেয়েই ৩রা তাঁকে দেখতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি। দোতলায় উঠে দেখতে পেলাম শচীন মিত্রের স্ত্রী, অংশুরানী মিত্র, আমার কলেজের সহপাঠিনী একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই বলল ‘তুমি খবর পেয়ে এলে বুঝি? উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, উনি এখন কেমন আছেন? অংশুরানী সঙ্গে সঙ্গে বলল ‘ও, তুমি জান না, উনি তো নেই। এই মাত্র চলে গেলেন।’ মনটা এত খারাপ হয়ে গেল—বুঝতে পারলাম, এত মিছিল, এত শান্তির প্রচার সব শুধু ভাসা ভাসা। মানুষের মনের মধ্যেকার আক্রোশ রয়েই গেছে। শচীন মিত্রের নিষ্ঠুর হত্যার ঘটনায় সেটাই প্রমাণিত হল। এই খবর যখন গান্ধীজীর কাছে পৌঁছল তখন গান্ধীজী অত্যন্ত বিচলিত হলেন, বোধহয় বুঝতে পারলেন যে শান্তি মিছিলে গুণ্ডা শ্রেণীর লোকেরা সহজে দমিত হবে না। শুরু হল তাঁর অনশন ওই বেলেঘাটার বাড়িতেই। দিল্লি থেকে, কলকাতা থেকে ও নানান প্রান্ত থেকে তাঁর অনশন বন্ধের জন্য প্রয়াস চলতে লাগল। সে ইতিহাসের কথা। পাঞ্জাবের অবস্থা জেনে আর তাঁর নোয়াখালি ফেরা হল না একথা সকলেই জানেন।

আজ বারবার মন ভারাক্রান্ত হয় এই ভেবে যে, কত কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার পরিণতি কি এই! এই উৎসব এত আয়োজন করেও কি আমরা কোন সুফল পেতে পারি? ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রদেশের মানুষ দেশভাগের যন্ত্রণা তেমনভাবে অনুভব করেন না যেমন পাঞ্জাব ও বাংলাদেশের মানুষকে করতে হয়েছে। এখনও অনেক মানুষ বিশেষত বাঙালি, তাঁদের শিকড়ের সন্ধান পাননি।

ভোলা যায় না এমন কিছু ঘটনার স্মৃতি। রোমন্থন করলে মনে পড়ে আমাদের নোয়াখালি গান্ধী শান্তি মিশন ছেড়ে চলে আসবার শেষের কয়েকটি দিনের কথা। যখন আমরা তেত্রিশটি শিবিরে সারা রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর থানা জুড়ে শান্তি শিবিরে পুনর্বাসনের কাজ করে চলেছি। মে মাসের শেষ। হঠাৎ খবর এল যে চট্টগ্রাম থেকে আমার স্বামীর পার্টিশন কমিটিতে যোগ দিতে কলকাতাতে বদলির আদশে এসেছে। ছেলেমেয়ে চট্টগ্রামের বিশাল বাড়িতে একা। কাজেই আমাকে নোয়াখালি ছেড়ে চলে যেতেই হবে। সুচেতা কৃপালনী আর কোনও স্থায়ী কর্মী এসে সমস্ত ক্যাম্পের কর্তব্যভার যদি নিতে পারেন তবেই আমার পক্ষে ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়া সহজ হয়। আমি তাই সুচেতা কৃপালিনীকে নোয়াখালি আসবার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলাম। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মনেই ক্যাম্পের কাজ গোটানো ও অন্যান গোছগাছ চলতে লাগল। সুচেতা কৃপালিনী এসে আমাকে রিলিভ করলে নোয়াখালি ছেড়ে চট্টগ্রামে এলাম। আমার স্বামীও কলকাতা চলে গেলেন। আগস্টের এক তারিখের মধ্যে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল। আমার স্বামী এসে ৫ আগস্ট কলকাতায় নিয়ে গেলেন। মানসিক উদ্বেগ নিয়ে সকলেই যারা বদলি হয়েছে তখন চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসছে।

গান্ধীজী আশা করেছিলেন, আমাদের বিশ্বাস করে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা আমরা পালন করব আর নোয়াখালির ওই পরিস্থিতিতে কাজ ছেড়ে যাব না। আমাদের মতো আরও কর্মী যারা গান্ধীজীর ভালবাসা ও শান্তির বার্তা বুঝিয়ে বলবার জন্য নোয়াখালিতে ছিলাম এবং গৃহহারা দুর্গতদের পুনর্বাসনের কাজে লিপ্ত ছিলাম তাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হল। গান্ধীজীর সঙ্গে থেকে কাজ করাটা সহজ ছিল কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে ওই কাজ আমাদের পক্ষে বড়ই এক গুরুদায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল। যাইহোক নোয়াখালিতে গান্ধীজীর ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট উৎসাহ যুগিয়েছিল।

কিন্তু বিহারে আবার শান্তি ফিরে এলে পাঞ্জাবে পর পর দাঙ্গা দেখা দিল। দেশ দখন চরম সঙ্কটের সম্মুখীন। গান্ধীজী বিহার থেকে দিল্লিতে ফিরলেন। প্রার্থনা সভার বাণীতে কেউ মনোযোগ দিল না। অন্তরের পরিবর্তন সাধনের জন্য তাঁর একক আবেদনে এই দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চলের কেউ সেদিন কর্ণপাত করেনি।

আমরাও প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি। দেশভাগের জন্য আমাদের মন প্রস্তুত ছিল না। আর গান্ধীজীর যে আশা ছিল মনের পরিবর্তন হবে সে পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে এখনও ধর্ম নির্বিশেষে কারুরই হয়নি। ক্রমশ আমরা দেখছি অহিংসার বাণীতে কেউ কর্ণপাত করছে না।

১৯৪৭—এর ৫ সেপ্টেম্বর গান্ধীজী মানু গান্ধীর হাতে লেবুর রস খেয়ে অনশনভঙ্গ করলেন, তারপর দিল্লির নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ৭ সেপ্টেম্বর ‘হায়দার—ই—মঞ্জিল’ ছেড়ে দিল্লির দিকে রওনা হলেন। প্রার্থনা সভায় তাঁর শান্তির বাণী শুনতে আসা জনতার সামনেই তাঁকে প্রাণ দিতে হল ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *