বেলুন-রহস্য
এক
প্যারাডাইস সিনেমা হল থেকে বেরোনোর সময়ই টের পেলাম, পার্স পকেটে নেই। হলের ভেতর থেকে তখন গলগল করে লোক বেরিয়ে আসছে। ওই ভিড়ের মাঝে পকেটমার খুঁজতে যাওয়া বৃথা। হতভম্ব হয়ে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালাম।
এ নিয়ে তৃতীয়বার। ওই পার্সটাই খোয়ালাম। টাকা খুব বেশি ছিল না। শ’ তিনেকের মতো। তার জন্য আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আফসোস প্রেসকার্ড আর কয়েকটা জরুরি কাগজের জন্য। এসপ্ল্যানেডের এই অঞ্চলটা অসামাজিক লোকজনে ভর্তি। চোর—ছ্যাঁচোড়, পকেটমার আর গুন্ডাদের মুক্তাঞ্চল। আমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বহু বছর ধরে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছি। কখনও কিছু হয়নি। আজ কপালটাই খারাপ।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু রাগই হল। প্রেসকার্ড হারিয়ে যাওয়া মানে অনেক ভোগান্তি। পুলিশে ডায়েরি, ফের পি আই বি—তে দৌড়োদৌড়ি। অযথা সময় নষ্ট। পকেটমারের আর কী। টাকাটা বের করে নিয়ে পার্স যে—কোনও জায়গায় ফেলে কেটে পড়বে। তারপর আমার অত সুন্দর পার্স কর্পোরেশনের জঞ্জাল—গাড়িতে চালান হয়ে যাবে ধাপার মাঠে। পকেটমারটাকে হাতের সামনে পেলে হাতের সুখ করে নিতাম।
আর তখনই আমার সুদীশের কথা মনে পড়ল। সুদীশ নাগ। ওর কথা বেশ কয়েকবার আনন্দমেলায় লিখেছি। আমার খুব বন্ধু। কলকাতা পুলিশের দুঁদে অফিসার। সুদীশকে এখনই পকেটমারির কথা জানালে কাজ হতে পারে। কলকাতার কোন অঞ্চলে কোন পকেটমার ঘোরাফেরা করে, সে—সব ওদের নখদর্পণে। অনেকদিন আগে ও একবার বলেছিল, ”কলকাতা শহরে কোথাও পকেটমারি বা ছিনতাই হলে, সেই খবর যদি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের কাছে আসে, তা হলে চোখ বুজে হারানো জিনিস ফেরত আনতে পারি।”
মোবাইল ফোনটা অফিসে ফেলে এসেছি। পাশের একটা এস টি ডি বুথ থেকে সুদীশকে ফোন করলাম। লালবাজারে পি বি এক্স—এ ফোন পাওয়া এক—এক সময় খুব কঠিন হয়ে যায়। রিং হচ্ছে তো হচ্ছেই। অনেকক্ষণ পর কেউ একজন রিসিভার তুলে ক্যাটকেটে গলায় বললেন, ”হ্যালো, লালবাজার।” ফোন তুলতেই যেন অসীম বিরক্তি। অন্য সরকারি অফিসের মতো লালবাজারেও আজকাল সব বাংলায় চলছে। সি পি অর্থাৎ ক্যালকাটা পুলিশ এখন হয়ে গেছে ক পু। গোয়েন্দা দফতর আগে ছিল ডি ডি। এখন গো. দ। সেজন্যই বোধ হয় নড়তে—চড়তে এত সময় নেয়।
গো. দ অফিসার বলেছিলাম সুদীশকে একদিন। চটে না গিয়ে ও খুব হেসেছিল। তারপর বলেছিল, ”ঠিকই বলেছিস কালকেতু। গোদের মাঝে আমি বিষফোড়া।” বিষফোড়াই বটে। ও এমন সব বেপরোয়া কাজকর্ম করে, এক—এক সময় লালবাজারের অনেকেই অস্বস্তিতে পড়ে যান।
সুদীশের লাইনটা পেলাম বটে, কিন্তু অপারেটর বললেন, ”উনি এখন ডিপার্টমেন্টে নেই।” বাধ্য হয়ে ওর মোবাইল নাম্বারে ফোন করলাম। তাগিদটা আমার। সুদীশের সঙ্গে এখনই কথা বলতে না পারলে আমার পার্স হাত চালাচালি হয়ে আর নাও পাওয়া যেতে পারে। দু’তিনবার মোবাইলে রিং হতেই ও—প্রান্ত থেকে একজন বলল, ”হ্যালো, কাকে চাই?”
না, সুদীশের গলা তো এটা নয়! বললাম, ”সুদীশ আছে?”
”না বাপ, তোমার সুদীশ ভ্যানিশ হয়ে গেছে।”
লোকটা এমনভাবে বলল, আমার মনে হল প্রকৃতিস্থ নেই। কার হাতে পড়ল সুদীশের ফোন? আশ্চর্য তো। নিশ্চয়ই ও কোথাও মোবাইল সেটটা ফেলে রেখে এসেছে। এবং সেটা কোনও ফালতু লোকের হাতে পড়েছে। ধারণাটা মেলানোর জন্যই বললাম, ”আপনি কে বলছেন?”
”সুদীশের দাদু। তুমি কে বাপ?”
সুদীশের দাদু আছেন বলে কোনওদিন শুনিনি। লোকটা নিশ্চয়ই মজা করছে। কথা বলে বাগে আনা দরকার। বললাম, ”দাদু, নমস্কার। একটা বিশেষ দরকারে সুদীশকে ফোন করেছি। ওকে কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারেন?”
”না, বাপ। বলতে পারব না।”
”আজ কি আপিসে গেছে?”
”জানি না।”
”সুদীশের পার্ক স্ট্রিটের আপিসে ফোন করেছিলাম। ওরা বলল, বড়বাজারে গেছে। আপনাদের ফোন করলে বলবেন, ডোমজুড় থেকে কালকেতু যোগাযোগ করেছিল। টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য।”
”টাকা? কত টাকা বাপ?”
”দশ হাজার। সুদীশ ধার দিয়েছিল। আজই ফেরত দেওয়ার কথা ছিল আমার। কী করব, বুঝতে পারছি না।”
ও প্রান্তে লোকটা চুপ করে আছে। বোধ হয় টোপটা খেয়ে গেছে। তাই ফের বললাম, ”টাকাটা আমি ফেরত নিয়ে যেতে চাই না। বুঝতেই পারছেন, দিন—কাল খুব খারাপ। বেলা পাঁচটা পর্যন্ত আমি কলকাতায় আছি। এর মধ্যে ও যদি নিজে আসতে না পারে, কাউকে যেন পাঠিয়ে দেয়।”
লোকটা বলল, ”ঠিক আছে বাপ। বলে দেব। তুমি এখন আছ কোথায়? সুদীশ জানে?”
”জানে। মেট্রোর পাশে কাফে—ডি—মোনিকোয়। ঠিক পাঁচটায় আমি কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকব। সুদীশ যদি অন্য কাউকে পাঠায় বলবেন, সে যেন ম্যানেজারের কাছে গিয়ে আমার নাম করে। আমার নাম কালকেতু নন্দী। আচ্ছা, ছাড়ি তা হলে?”
”হ্যাঁ, বাপ।”
ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই খুব হাসি পেল। লোকটা ঘোড়েল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে টাকা নিতে নিজে আসবে কি না, সন্দেহ। অন্য কোনও লোককে পাঠিয়ে দিতে পারে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সুদীশের মোবাইল সেটটা হারিয়ে গেছে। ও ভুলো মনের লোক নয়। এমনও হতে পারে, কোথাও গিয়ে হয়তো সেটটা রেখেছিল। সুযোগ পেয়ে কেউ হাতিয়েছে। সে নিশ্চয়ই জানে না, সেটটা একজন দুঁদে পুলিশ অফিসারের। জানলে, এমনভাবে নিশ্চয়ই মজা করত না।
সুদীশের মোবাইল সেট চুরির কথাটা মাথা থেকে সরে যাওয়ার পরই পুরনো শোক উথলে উঠল। আমার পার্স? কীভাবে ফেরত পাব ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। এর আগেও দু’বার ওই পার্সটা খোয়া গেছিল। দু’বারই আশ্চর্যজনকভাবে ফেরত পাই। পার্সটা বছর তিনেক আগে আমি কিনি কাঠমান্ডু থেকে। আর পাঁচটা পার্সের মতো নয়। গোরক্ষনাথের মন্দিরে পুজো দিয়ে একদিন ফেরার সময় মন্দিরেরই চাতালে একটা দোকানে হঠাৎই চোখে পড়ে গেছিল।
তখন কাঠমান্ডুতে সাফ গেমস চলছিল। কয়েকজন রিপোর্টার মিলে আমরা সেদিন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। দোকান থেকে একটা বুদ্ধমূর্তি কিনে টাকা দেওয়ার সময় পকেট থেকে পার্স বের করতেই দোকানের থুত্থুড়ে বুড়িটা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলেছিল, ”অ্যাই বাবু, তুই তো রাজা মানুষ আছিস। এইরকম একটা মানিব্যাগ নিয়ে ঘুরিস কেন? আমার কাছে খুব ভাল মানিব্যাগ আছে। নিয়ে যা।”
আর তখনই পার্সগুলো চোখ পড়েছিল। পার্সের সঙ্গে লোহার সরু একটা শেকল। বেল্টের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা যায়। কেউ চট করে তুলে নিতে পারবে না। পার্সটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে যাই। তারপর বুড়ি ঘ্যানঘ্যান শুরু করে, ”নে না বাবু। এই পার্স কোনওদিন খালি হবে না, দেখিস। আর কোনওদিন হারাবে না। হারিয়ে গেলেও ফিরে পাবি। সত্যি বলছি। এই পার্স বাবা গোরক্ষনাথের মন্দির থেকে কিনছিস। দেখবি, তোর খুব ভাল হবে।”
আমার পাশেই তখন দাঁড়িয়ে দিল্লির টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টার জয়দীপ বাসু। ও হাসতে হাসতে বলেছিল, ”নিয়ে নাও কালকেতুদা। বুড়ি যা বলছে, এর পর থেকে তোমার চাকরি না করলেও চলবে।”
ঝোঁকের মাথায় পার্সটা কিনে ফেলেছিলাম। আশ্চর্য, পরে মিলিয়ে দেখেছি মন্দিরের বুড়ি যা বলেছিল, অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। প্রথমবার পার্সটা হারাই সোদপুর থেকে আসার সময় ট্রেনে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়েই টের পেয়েছিলাম, হিপ পকেটে পার্সটা নেই। মন খারাপ হয়ে গেছিল। রাত আটটা নাগাদ অফিসে বসে কাজ করছি, এমন সময় ফোন, ”আচ্ছা, কালকেতু নন্দী আছেন?”
”কে বলছেন?”
”আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি নৈহাটিতে থাকি। নাম সমীর সাহা। আচ্ছা, আপনার পার্স কি আজ হারিয়ে গেছে?”
”হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”
”ওটা আমার হেফাজতে আছে। পার্সের ভেতর আপনার নেমকার্ড পেয়েছি। তাই ফোন করলাম। আচ্ছা, আপনি কি সেই কালকেতু নন্দী যিনি আনন্দমেলার পুজো সংখ্যায় রামপলের অন্তর্ধান—রহস্য গল্পটা লিখেছিলেন? সত্যি বলবেন কিন্তু।”
”হ্যাঁ।” বলেই প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম, ”আচ্ছা ভাই, আপনি আমার পার্সটা ঠিক কোথায় পেয়েছেন, বলবেন?”
”ট্রেনের কামরায়। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। শেয়ালদা থেকে নৈহাটির ট্রেনে উঠেই সিটের তলায় আপনার পার্সটা পেয়েছি। কাল দুপুরে আপনাকে ফেরত দিতে চাই। অফিসে কখন থাকবেন?”
”বেলা বারোটা—সাড়ে বারোটার মধ্যেই আমি অফিসে পৌঁছে যাই। চলে আসুন। কথা বলা যাবে।”
পরদিন বেলা একটা নাগাদ অফিসে এসে সমীর পার্সটা ফেরত দিয়ে গেছিল। টাকা—পয়সা ছিল না। কিন্তু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম প্রেসকার্ডসহ বাকি কাগজপত্তরগুলো অক্ষত ছিল দেখে। সমীর ছেলেটাকে পরে আমি টেস্ট ম্যাচের টিকিট পুরস্কার দিয়েছিলাম। এখনও মাঝে—মধ্যে ফোনে ছেলেটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
পার্সটা দ্বিতীয়বার হারায় মোহনবাগান মাঠে। লিগের ম্যাচ কভার করতে গেছিলাম। স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে প্রেসবক্সে ওঠার সময়ই বোধ হয় নীচে পড়ে গেছিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রেসবক্সে কানাকানি। একটা পার্স পাওয়া গেছে। প্রমাণ দিয়ে সেটা ফেরত নিতে হবে। শুধু প্রমাণ নয়, সেদিন শ’খানেক টাকাও গচ্চা দিতে হয়েছিল। সবাইকে ঘুঘনি আর টোস্ট খাইয়ে। ভাগ্যিস, নীচে পার্সটা কুড়িয়ে পেয়েছিল সরোজ চক্রবর্তী। সেজন্য টাকাটা খোয়া যায়নি।
তৃতীয়বার, পার্সটা ফেরত পাব, এমন ভরসা নেই। তাই এস টি ডি বুথ থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাদের আনন্দবাজার অফিসটা খুব কাছেই। মিনিট তিনেক হাঁটলেই পৌঁছে যাব। হাতঘড়িতে দেখলাম, বেলা দুটো। বিকেল পাঁচটার মধ্যে ফের মেট্রো সিনেমার কাছে কাফে—ডি—মোনিকোয় আসতে হবে। হাতে ঘণ্টা তিনেক সময় আছে। অফিসের দিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। আজ প্যারাডাইস সিনেমায় আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু পরমানন্দ ঝা এমন পীড়াপীড়ি করল, বাধ্য হয়ে এসেছি। আসলে ‘কিক অফ’ বলে একটা কার্টুন ফিল্ম ও আনিয়েছে লন্ডন থেকে। ফুটবলের ওপর এই প্রথম কার্টুন ফিল্ম তৈরি হয়েছে। সেটা আমাকে দেখানোর জন্যই পরমানন্দ সকালে ফোনের পর ফোন, ”তোমাকে না দেখালে ভাই, আমি শান্তি পাব না। প্লিজ এসো।” ফিল্মটা দেখে সত্যিই ভাল লাগল। ফুটবল নিয়ে ইংরেজরা কত ভাবনা—চিন্তা করে। ওদের কাছে ফুটবলটা তো আর নিছক খেলা নয়। একটা শিল্প। নানাভাবে ওরা ব্যবসা করছে। আমরা এই জিনিসটাই বুঝলাম না।
অফিসে এসে বসতেই কৌশিক বলল, ”কালকেতুদা, মানসদা ফোন করেছিল। আজ আসতে পারবে না।”
মানসদা, মানে মানস চক্রবর্তী। চৌখস রিপোর্টার। আজ দুপুরে ওর রেসকোর্সে যাওয়ার কথা ছিল। সুরজমল কঙ্কারিয়া নামে এক ভদ্রলোক ইলাহাবাদ থেকে বেলুনে চেপে কলকাতায় এসেছেন। বেলুন অভিযানকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে। আজ তিনি পটনার দিকে রওনা হবেন। সেজন্যই সাংবাদিকদের ডেকেছেন। ভদ্রলোকের ধারণা, নিজের চোখে বেলুন—অভিযান নিয়ে যদি আমরা কাগজে লিখি, তা হলে কলকাতার তরুণ—তরুণীরা আগ্রহী হয়ে উঠবে। বেলুন—অভিযান নিয়ে লেখার জন্য মানসকে রেসকোর্সে যেতে বলেছিলাম।
কৌশিককে জিজ্ঞেস করলাম, ”মানস কেন আসতে পারবে না, কিছু বলেছে?”
”মনে হয়, ভাইরাল ফিভার।”
”তা হলে তো রেসকোর্সে আমাকেই যেতে হবে।”
কথাটা বলেই চট করে উঠে দাঁড়ালাম। আর তখনই ফের মনে পড়ল, আমার পকেটমারি হয়েছে। ট্রেনে প্রথমবার পার্স খোয়ানোর পর থেকে আমি কিছু টাকা অফিসের ড্রয়ারে রেখে দিই। চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে দুটো একশো টাকার নোট বের করে নিলাম। গাড়িটা আজ আনিনি। ফুল্লরা, আমার স্ত্রী আজ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে যাবে। ওদের কী একটা মিটিং আছে। রেসকোর্সে যাওয়ার জন্য আমাকে ট্যাক্সি ধরতে হবে। কী ভেবে শেষ মুহূর্তে মোবাইল ফোনটা সঙ্গে নিলাম। ওটা ইচ্ছে করেই অফিসে রেখে গেছিলাম। সিনেমা হলে বেজে উঠলে অনেকে বিরক্ত হয় বলে।
মিনিট পঁচিশের মধ্যে রেসকোর্সে পৌঁছে দেখি, ভেতরে বেশ ভিড়। খবরের কাগজের লোকজন ছাড়াও হাজির প্রচুর অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে। কলকাতা হল হুজুগের শহর। একটা কিছু পেলেই হল। ছেলেবেলায় যখন কালাকার স্ট্রিট অঞ্চলে থাকতাম, তখন দেওয়ালির দিন অবাঙালিদের ফানুস ওড়াতে দেখতাম। নানা আকারের রঙিন ফানুস। তবে সুরজমল কঙ্কারিয়ার বেলুন আকারে অনেক বড়। প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান। গ্যাস ভরে বেলুনটাকে ফোলানো হচ্ছে। দূর থেকে মনে হল, প্যারাসুটের কাপড় দিয়ে তৈরি। সাতরঙের। দেখতে বেশ সুন্দর।
কঙ্কারিয়ার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ ছোটাছুটি করছেন। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বললেন, ”মিঃ নন্দী, আপনি এসেছেন! কী সৌভাগ্য।”
বললাম, ”আপনি রেডি?”
কঙ্কারিয়া একটু দমে গিয়ে বললেন, ”আজ তো পটনা যাওয়া হচ্ছে না। আপনাকে কেউ বলেনি?”
”না। কেন?”
”ওদিকে খুব ঝড়—জল হচ্ছে। যাওয়াটা রিস্কি হয়ে যাবে। তাই ঠিক করলাম কলকাতার আকাশে এক চক্কর মেরে নেমে আসব। কাল সকালে ওয়েদার ভাল থাকবে। কালই ভাবছি যাব।”
অফিস থেকে এত তাড়াহুড়ো করে এলাম। আসাটাই বৃথা। কঙ্কারিয়া কার সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেলেন। সেই ফাঁকে ভিড়ের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলাম। রেসকোর্সের ভেতরের মাঠে আগে মাত্র একবারই এসেছিলাম। পোলো খেলার উদ্বোধনে। এই মাঠেই ফুটবল স্টেডিয়াম হওয়ার কথা উঠেছিল একবার। সেই পঞ্চাশের দশকে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে। পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। রেসকোর্সে যদি স্টেডিয়ামটা হত, তা হলে কষ্ট করে ফুটবলপ্রেমীদের আর সল্ট লেকে যেতে হত না। এতবড় জায়গা, স্বচ্ছন্দে এক লাখ লোকের স্টেডিয়াম করা যেত।
দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছি, এমন সময় ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। সুদীশ! আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। মুখ থেকে প্রশ্নটা ছিটকে বেরোল। ”তুই এখানে?”
সুদীশ বলল, ”ডিউটি। লালবাজারে ফোন করেছিলি কেন, বল।”
”তুই জানলি কেমন করে?”
”ভেরি সিম্পল। অফিসে ফোন করেছিলাম। অপারেটর তোর কথা বলল। তোর গলা এখন সবাই চেনে।”
”তোর মোবাইল সেটটা কি চুরি গেছে?”
”ঠিক চুরি যায়নি। খোয়া গেছে। কাল বিকেলে মেটিয়াবুরুজে একজন ড্রাগ সাপ্লায়ারকে ধরতে গেছিলাম। ওখানেই কোথাও ফেলে এসেছি। যে ব্যাটা পেয়েছে, আমি ফোন করলেই, সে সুইচ অফ করে দিচ্ছে। পেলে এমন হাতের সুখ করব, বুঝতে পারবে।”
”সেটটা যদি ফেরত পেতে চাস, তা হলে আমার সঙ্গে চল।”
”কোথায়?”
”কাছেই। মেট্রো সিনেমার পাশে।”
”কালকেতু, তুই কি অফিসের গাড়ি এনেছিস?”
”না রে। কেন?”
”চল তা হলে। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।”
কথা বলতে—বলতে দু’জনে রেসকোর্স থেকে বেরিয়ে এলাম। অন্য সময় দেখা হলেই সুদীশ ফুটবল আর ইস্টবেঙ্গলের কথা তোলে। কিছুদিন হল দেখছি, ইস্টবেঙ্গলের প্রতি সেই প্রেম আর নেই। অভিমানের কারণটা কী, জিজ্ঞেস করিনি। আজ গাড়িতে উঠেই বললাম, ”টিভি—তে ইউরো কাপের খেলা দেখছিস?”
সুদীশ উদাসীন হয়ে বলল, ”সময় পাচ্ছি না রে।”
”পর্তুগালের লুই ফিগোর খেলা দেখিসনি?”
”না। কেমন খেলছে?”
”রোনাল্ডোর চেয়েও ভাল।” বলেই চুপ করে গেলাম। ফ্রান্স বিশ্বকাপ থেকে আমি ফেরার পর এই সুদীশই আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ”হ্যাঁ রে কালকেতু, আমাদের ইস্টবেঙ্গল যদি রোনাল্ডোকে আনতে চায়, তা হলে ও কত টাকা নেবে রে?” টাকার অঙ্কটা শুনে ও অবশ্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। ”বলিস কী? দেড়শো কোটি?” সেই সুদীশ আজ ফুটবলবিমুখ হয়ে গেছে, ভাবতেই কেমন লাগল।
প্রশ্নটা সরাসরিই করলাম, ”বাঙালদের টিম নিয়ে ইদানীং তোর পাগলামো কমেছে বলে মনে হচ্ছে।”
”দূর দূর। চারবার ন্যাশনাল লিগ হয়ে গেল। একবারও পেল না। আমি আর ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কোনও কথাই বলব না।”
অভিমানের কারণটা এবার স্পষ্ট হয়ে গেল। মনে—মনে হাসতে লাগলাম। ঘটি—বাঙালের ছাপটা কি চট করে মুছে ফেলা যায়?
কথা বলতে বলতেই এসপ্ল্যানেডে এসে গেলাম। কাফে—ডি—মোনিকোর উলটো দিকের ফুটপাথে আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে রইলাম। মেট্রো সিনেমার তলায় হকারদের ভিড়। এই সময়ে জায়গাটা জমজমাট থাকে। একশো গজ দূর থেকে নজরদারি করা কঠিন। কাফে—তে টাকা নিতে লোকটার আসার কথা ঠিক পাঁচটায়। এখনও মিনিট দশেক বাকি। তাই রাস্তা পেরিয়ে মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ির গায়ে এসে দাঁড়ালাম। কাফে—ডি—মোনিকোর ম্যানেজার রতন ছেলেটা আমাদের খুব পরিচিত। তা সত্ত্বেও, টুক করে একবার ওকে মুখটা দেখিয়ে বলে এলাম, ”কেউ যদি খোঁজ করতে আসে, বসিয়ে রেখো।”
লোকটার জন্য অপেক্ষা করার সময় হঠাৎ সুদীশ বলল, ”ওপরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ কালকেতু। তোদের বেলুন—অভিযাত্রী কলকাতার আকাশে চক্কর মারছে।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই সুরজমল কঙ্কারিয়া তাঁর বেলুন নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে যাচ্ছেন। কত উঁচু হবে? হাজার দেড়েক ফুট। বেলুনের তলার দিকে চৌকো ঝুড়ির মতো। তাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন লোক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকে হাঁ করে বেলুনটা দেখছে। গাড়ি থেকে অনেকে নেমে পড়েছে। বাস দাঁড়িয়ে গেছে। মেট্রোর আশপাশে হইহই কাণ্ড। বেলুনটা রাজভবনের ওপর দিয়ে আরও উত্তর দিকে চলে গেল। আর দেখতে পেলাম না। তখনই সুদীশ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ”এরকম একটা বেলুন কিনতে কত পড়বে রে?”
শুনে আমি হেসে বললাম, ”কেন, তুই কিনবি?”
সুদীশ বলল, ”আমার জন্য নয়। কলকাতা পুলিশের জন্য। বিদেশি ফিল্মে দেখি, পুলিশরা হেলিকপ্টার করে টহল দিচ্ছে। দামটা যদি কম হয়, তা হলে আমাদের জন্য বেলুন, মন্দ কী!”
খানিকক্ষণ পর দু’জনে মিলে কাফে—ডি—মোনিকোয় ঢুকলাম। মোবাইল সেট চোর লোকটা কেমন দেখতে জানি না। তবে কথায়—কথায় যেমন ‘বাপ—বাপ’ করছিল, তাতে খুব একটা ভদ্র—সভ্য হবে বলে মনে হল না। লোকটা ফোনে কথাও বলছিল কৃত্রিম গলায়। বয়স তিরিশ—বত্রিশের বেশি না হওয়াই স্বাভাবিক। লোকটা ধরা পড়লে, সুদীশ ওর জান কয়লা করে দেবে। আমি জানি, ওর হাত নিশপিশ করছে। লালবাজারে নিয়ে গিয়ে ও লোকটাকে রামধোলাই দেবে।
কাফে—ডি—মোনিকোয় একটা সিটও খালি নেই। ম্যানেজার রতন আমাকে দেখে বলল, ”কালকেতুদা, এক মিনিট দাঁড়ান। কোণের দুটো ছেলেকে তুলে দিচ্ছি। দুপুর থেকে সিট দুটো অকুপাই করে আছে।”
ফিসফিস করে বললাম, ”কেউ এসেছিল?”
”না। এলে দাঁড় করিয়ে রাখতাম।”
রেস্তরাঁর ঘড়িতে দেখলাম, পাঁচটা পনেরো। তা হলে কি লোকটাকে যত বোকা ভেবেছিলাম, ততটা নয়? আমার চালটা বুঝতে পেরে গেছে? হবে হয়তো। দু’কাপ কফির অর্ডার দিয়ে লোকজনকে লক্ষ করতে লাগলাম। এই রেস্তরাঁটায় আঁতেলদের ভিড়। অফিস ফেরত আড্ডা মারার জায়গা। আগে গড়ের মাঠ ফেরত লোকজনরা এসে বসতেন। ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান নিয়ে ঝড় তুলতেন। বহুদিন পর আজ এই রেস্তরাঁয় ঢুকে টের পেলাম, ময়দান থেকে ফুটবল সরে গেছে।
সুদীশ গুম হয়ে আছে। কেন এই রেস্তরাঁয় নিয়ে এসেছি, ওকে বলিনি। মোবাইল সেটটা ওর হাতে তুলে দিয়ে চমকে দেব, এই মতলবে ছিলাম। মনে হল, প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল। আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও কেউ এল না দেখে নিজেই বিরক্ত হয়ে গেলাম। সারাটা দুপুর অফিসে ছিলাম না। এমনিতেই কাজ জমে আছে। আজ ঠিক সময়ে পাতা প্রেসে পাঠাতে পারব কি না সন্দেহ।
সুদীশকে চুপ করে থাকতে দেখে হঠাৎ বললাম, ”তোর কী হয়েছে রে? আপসেট মনে হচ্ছে।”
”না, তেমন কিছু নয়। একটা কেস নিয়ে ঝামেলায় আছি। সেই কথাই চিন্তা করছিলাম।”
”আমাকে বলা যায়?”
”স্বচ্ছন্দে। কয়েকদিন আগে লালবাজারে এসে এক ভদ্রলোক একটা কমপ্লেন করে গেছেন। আমাদের ডি সি—র কাছে।”
”খুন—ডাকাতির হুমকি—টুমকি?”
”না, না। একটা অ্যান্টিক ছবি চুরি যেতে পারে, এইরকম একটা কমপ্লেন। খুব মূল্যবান ছবি। ডি সি কেসটা আমার হাতে দিয়েছেন। কিন্তু বোধ হয় খবরটা লিক হয়ে গেছে। ফোনে দু—তিনদিন ধরে অন্য একটা লোক আমাকে টিজ করছে, ছবিটা তেসরা জুলাই চুরি হবে। পারলে আটকাস।”
”লোকটার সাহস আছে তো। তেসরা জুলাই, মানে তো পরশু। কী করবি?”
”আটকানোর চেষ্টা করব। কিন্তু তুই তো জানিস, আমাদের ফোর্সটা এখন বাজে লোকে ভর্তি হয়ে গেছে। ব্ল্যাক শিপে ভর্তি। ছবিটা আটকাতে না পারলে ডি সি—র কাছে বেইজ্জত হয়ে যাব।”
কথাগুলো বলেই সুদীশ চুপ করে গেল। আমার কাছে কোনও কেস এলে ওকে যখন ডাকি, সুদীশ চলে আসে। আমাকে নানাভাবে সাহায্য করে। এবার উলটোটা ঘটল। ভাবলাম, খুলে সব বলবে। কিন্তু বলল না। আমিও জিজ্ঞেস করলাম না। সুদীশ হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”চল রে। আমাকে লালবাজার যেতে হবে। তোর লোক বোধ হয় আর এল না।”
ওর ব্যস্ততা দেখে বুঝলাম, আর আটকানো যাবে না। হঠাৎই মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। পকেট থেকে আমার মোবাইল সেটটা বের করে সুদীশের মোবাইল নম্বরে একটা ফোন করলাম। লোকটা যদি এখানে কোথাও ঘুপটি মেরে থাকে, তা হলে ধরা পড়ে যাবে।
আশ্চর্য, সেটাই ঘটল। ম্যানেজারের ঠিক পাশের টেবিলে—বসা একজনের ফোন হঠাৎই বেজে উঠল। গপ করে তার হাতটা চেপে ধরে বললাম, ”সুদীশ, ধরেছি। দ্যাখ তো, সেটটা তোর কি না?”
লোকটা ভাবতেই পারেনি ধরা পড়ে যাবে। আমতা—আমতা করে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুদীশের বিরাশি সিক্কার একটা চড় খেয়ে বসে পড়ল। গাঁট্টাগোঁট্টা শরীর। দেখেই বোঝা যায় অপরাধ জগতের লোক। সুদীশ ওর চুলের গোছ ধরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ”কাল থেকে মজা করছিলি, তাই না? চল লালবাজারে। তোর ছাল—চামড়া আজ তুলে নেব। কার হয়ে কাজ করিস বল। রামপিয়ারি, না মন্টা?”
রেস্তরাঁয়—বসা অন্য সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। মোবাইল সেটটা বুকপকেটে চালান করে দিয়ে সুদীশ আমাকে বলল, ”চলি রে কালকেতু। থ্যাঙ্কস। রাতে ফোন করব।” কথাটা বলে লোকটাকে মারতে মারতে সুদীশ উলটো দিকের ফুটপাথে নিয়ে গেল।
মিনিট দশেক পর অফিসে পৌঁছতেই দেখি, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিদ্ধার্থ। অফিসের পাশে খানা—পিনা বলে একটা রেস্তরাঁ আছে, তার বেয়ারা। মাঝে—মধ্যে ফুটবল ম্যাচের টিকিট চাইতে আসে। আমাদের সবার খুব চেনা। আমাকে দেখে বলল, ”কালকেতুদা, আশ্চর্য ব্যাপার। আপনার পার্স, কে যেন আমাদের রেস্টুরেন্টে ফেলে গেছে।”
শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পার্সটা তা হলে ফের ফেরত এল। তাড়াতাড়ি বললাম, ”কই, দেখি।”
পার্সটা বাড়িয়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ বলল, ”টাকা—পয়সা নেয়নি। খুলে দেখেছি, সব আছে। প্রেসকার্ডটা পড়েই বুঝলাম, আপনার।”
”থ্যাঙ্কস সিদ্ধার্থ। আমার অনেক উপকার করলে ভাই।”
পার্সটা পকেটে চালান করে ওপরে উঠে এলাম। শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে কথাটা? তিনবার হারিয়ে, তিনবারই ফেরত পেলাম পার্সটা? টাকা—পয়সা নেয়নি। তার মানে, লোকটা পকেটমার নয়। নিশ্চয়ই অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল তার। কথাটা মনে হতেই পকেট থেকে ফের পার্সটা বের করে আনলাম। কাগজপত্রে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ দেখি, একটা খাঁজে ভাঁজ করা গোলাপি রঙের চিরকুট।
চিরকুট বের করে ভাঁজ খুলতেই দেখি একটা ছড়া লেখা। কৌতূহলে তা পড়তে শুরু করলাম।
”কালকেতু নন্দী
আমার অভিসন্ধি
জানবি দু’দিন পর।
আমি টু রেড ফ্রেন্ড
নিবাস সাউথ এন্ড
পারলে খুঁজে বের কর।”
ছড়াটা তিন—চারবার পড়ে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
দুই
সকালবেলায় জিমনাসিয়াম যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় সুকুমার মল্লিকের ফোন, ”কালকেতু, তুই কি এখন বাড়িতে আছিস? আমি এখনই আসছি।”
সুকুমার আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে সিটি জুবিলি স্কুলে পড়েছি। মল্লিকবাড়ির ছেলে বলে তখন আমরা ওকে একটু অন্যরকম চোখে দেখতাম। মাঝে ও আমেরিকায় চলে গেছিল। বছর দু’য়েক আগে কলকাতায় ফিরে এসেছে। একটা বিদেশি ব্যাঙ্কের বড় কর্তা হয়ে। মাঝে—মধ্যে ও যোগাযোগ রাখে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে আমি যে রহস্যভেদের কাজও করি, সে খবর রাখে। দু’—একবার ও আমার বেহালার বাড়িতে এলেও গলফ গ্রিনের বাড়িতে কখনও আসেনি। তাই বললাম, ”চলে আয়। আমি আছি।”
সুকুমার বলল, ”একটা বিপদে পড়েছি ভাই। তোর মদত দরকার। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছি।”
”কী ব্যাপার রে?”
”গিয়ে বলব। ফোনে বলা যাবে না।” বলেই লাইনটা কেটে দিল সুকুমার। জিমনাসিয়ামে যাওয়া লাটে উঠল। ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। সেন্টার টেবিলে খবরের কাগজগুলো পড়ে আছে। অন্যদিন শরীরচর্চা করে সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে এসে তারপর খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বসি। আজ আগেই কাগজ পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বেলুন অভিযানের ছবি কলকাতার সব কাগজেই বড় করে বেরিয়েছে। কঙ্কারিয়া বেশ ভাল প্রচার পেয়ে গেলেন। ‘দর্পণ’ কাগজে দেখলাম, একটা খবর বেরিয়েছে। কঙ্কারিয়ার শাস্তি হতে পারে। খবরটা আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বেলুন অভিযানের জন্য কঙ্কারিয়া নাকি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে কিছুই জানাননি। এই খবরটা কাল আমরা পাইনি। পড়ে মনে হল, একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
ফুল্লরার এক পিসতুতো ভাই সুপ্রতিম এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলে চাকরি করে। তাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। টেলিফোনের ডায়েরিটা বের করে ওর টেলিফোন নম্বরটা খুঁজে বের করলাম। ডায়াল করতেই ও—প্রান্ত থেকে সুপ্রতিম বলল, ”আরে কালকেতুদা? হঠাৎ কী মনে করে?”
প্রয়োজনটা বললাম। সব শুনে সুপ্রতিম বলল, ”কাগজে ঠিকই লিখেছে কালকেতুদা। কাল ওই ব্যাপারটা নিয়ে খুব হইচই হয়েছে আমাদের অফিসে। হঠাৎ আমাদের রাডারে কঙ্কারিয়ার বেলুনটা ধরা পড়ে। আর তখনই খোঁজ নেওয়া শুরু হয়। কঙ্কারিয়া আমাদের পারমিশান নেয়নি জানার পর কর্তারা খেপে লাল।”
”কেন, তোদের পারমিশন নিতে হবে কেন?”
”এটা সরকারি নিয়ম। আমাদের না জানিয়ে কোনও ফ্লাইং অবজেক্ট যদি আকাশে ঘোরাফেরা করে, তা হলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে। ধরো, সেই সময় কোনও একটা প্লেন ফ্লাই করছে। তার সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে। তা হলে অবধারিত ক্র্যাশ। বিশেষ করে, রাতের দিকে। কেন, তুমি এয়ারলাইন্স কাপ ফুটবলের সময় সেই ঘটনাটার কথা শোনোনি?”
”না। কী ঘটনা রে?”
”গত বছর কাগজে ঘটনাটার কথা অবশ্য বেরোয়নি। হলদিয়ার এয়ারলাইন্স কাপের সময় স্পনসররা একটা বেলুন উড়িয়ে, তার গায়ে বিজ্ঞাপন লাগিয়েছিল। স্টেডিয়ামেই একটা খুঁটিতে সেই বেলুনটা আটকানো ছিল। ফাইনালের দিন কেউ লক্ষ করেনি। বিকেলে ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বদমাইশি করে দড়িটা কেটে দেয়। বেলুনটা আকাশে উড়ে যায়। দমদমে বসে হঠাৎ আমরা রাডারে দেখি, ওই বেলুনটাকে। রাতের দিকে সে কী অবস্থা!”
”তারপর কী হল?”
”স্পনসরদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম, বেলুনে যা গ্যাস ভরা আছে, তাতে দু’দিন আকাশে থাকবে। ওই দু’দিন কন্টিনিউয়াস বেলুনটাকে চোখে—চোখে রাখা হল। আমরা প্লেনের রুট সামান্য বদলে দিতে থাকলাম। মাঝে বেলুন উড়িয়ে বিজ্ঞাপন করার একটা হিড়িক উঠেছিল। এখন খুব নামী কোম্পানি ছাড়া পারমিশন দেওয়া হচ্ছে না। তাও আবার কন্ডিশন রাখা হচ্ছে। দিনের বেলায় ওড়াও। সন্ধের পরই বেলুনটা নামিয়ে আনতে হবে। অবশ্য হাওয়া অফিসের ক্ষেত্রে নিয়মটা আলাদা।”
”হাওয়া অফিস থেকে বেলুন ওড়ানো হয় নাকি?”
”প্রতিদিন। ভোরবেলা আর বিকেলবেলায়। আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে। আবহাওয়ার খবর নেওয়ার জন্য। তবে ওই বেলুনগুলো এমন মেমব্রেন দিয়ে তৈরি, ওপরে বাতাসের চাপে কয়েক ঘণ্টা পরই ফেটে যায়। আকাশে থাকে না।
কলকাতায় এখন একটাই বিজ্ঞাপনের বেলুন তুমি দেখতে পাবে। পার্ক স্ট্রিটে, একটা বিদেশি ব্যাঙ্কের। তাও ওদের লাইসেন্স আর রিনিউ করা হবে না।”
সুপ্রতিমের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। ”ঠিক আছে, ছাড়ি” বলে লাইনটা কেটে দিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, সুকুমার মল্লিক। পাক্কা সাহেবদের মতো চেহারা। পোশাকটাও সে রকম। ওকে দেখে মনে হল না, কোনও বিপদের মধ্যে রয়েছে। ”আয়, আয়” বলে ওকে ভেতরে এনে বসালাম।
স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এখনও একধরনের উচ্ছ্বাস অনুভব করি। তখন পুরনো দিনের নানা কথা ওঠে। সুকুমারটা বরাবরই ভিতু। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডানপিটে ছিল বাচ্চু মিত্তির। স্কুলের দিনগুলোতে ও যেমন আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলত, তেমনই উদ্ধারও করত। শুনেছি, বাচ্চু নাকি এখন আবহাওয়া দফতরে চাকরি করে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মাঝে—মধ্যে সুকুমারের কাছে গিয়ে আড্ডা মারে। সুকুমার একদিন গল্পচ্ছলে আমাকে বলেছিল, ”তুই ফেলুদার মতো রহস্যভেদ করিস শুনে বাচ্চুর সে কী হাসি। বলে কি না, কালকেতু যদি শার্লক হোমস হয়, তা হলে আমিও দেখবি একদিন বার্নার্ড শ হব।”
যাক, সেসব পুরনো কথা। সুকুমারকে বললাম, ”হঠাৎ কী ব্যাপারে রে? তোর কী হয়েছে?”
সুকুমার বলল, ”আর বলিস না। চাকরিটা বোধ হয় গেল।”
”কেন?”
”সে অনেক ব্যাপার। কোত্থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারছি না।” বলেই রুমাল দিয়ে মুখ মুছল সুকুমার। ”এক গ্লাস ঠান্ডা জল হবে রে?”
গোপা বলে একটা বাচ্চা মেয়েকে টুকটাক কাজ করার জন্য রেখেছে ফুল্লরা। তাকে জল এনে দিতে বললাম। আসল কথাটা সুকুমারের মুখ থেকে কতক্ষণ পর শুনতে পাব, কে জানে? এত নার্ভাস একটা ছেলে এতবড় পোস্টে চাকরি করে কীভাবে? ও আর বদলাল না। ছোটবেলায় আদরে মানুষ হওয়ার কুফল। স্কুলে টিফিনের সময় আমরা যখন ঢাকাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে জিলিপি খেয়ে পেট ভরাতাম, তখন মল্লিকবাড়ি থেকে সুকুমারের জন্য আসত ছানা, বড় তালশাঁস সন্দেশ আর ঠান্ডা শরবত। মাঝে—মধ্যে আমরাও ভাগ পেতাম।
এক চুমুকে জল খেয়ে,রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সুকুমার বলল, ”আমাকে তুই বাঁচা কালকেতু ভাই। টেনশনে রাতে ঘুম হচ্ছে না।”
”কী বিপদ, সেটা আগে বল তো।”
”মহারাজা নন্দকুমারের নাম শুনেছিস?”
”কেন শুনব না? তুই বলে যা।”
”বলছি। মহারাজা নন্দকুমারের ব্যক্তিগত কালেকশনে একটা দুষ্প্রাপ্য ছবি ছিল। বিপদ ওই ছবিটাকে নিয়ে।”
”চুরি গেছে? তোদের ব্যাঙ্কে রাখা ছিল বুঝি?”
প্রশ্নটা শুনে সুকুমার চমকে উঠল। তারপর বলল, ”তুই জানলি কী করে?”
কথাটায় পাত্তা না দিয়ে বললাম, ”সে—কথা পরে হবে। ছবিটা চুরি গেছে কি না, আগে বল।”
”না। এখনও চুরি হয়নি। তবে চুরি যাওয়ার আশঙ্কা আছে।”
ফট করে সুদীশের কথাটা মনে পড়ে গেল। কাল কাফে—ডি—মোনিকোয় বসে সুদীশ একটা ছবি চুরি আটকানোর কথা বলেছিল। এটা সেই ছবিটাই কি না, বাজিয়ে দেখার জন্য বললাম, ”তুই লালবাজারে ডি সি ডি ডি—কে ধরেছিলি। কিন্তু পুলিশের ওপর এখন ভরসা রাখতে পারছিস না। তাই আমার কথা মনে হয়েছে। ঠিক কি না?”
সুকুমারের চোখ বড়—বড় হয়ে যাচ্ছে। দম ফেলে ও বলল, ”তুই তো দেখছি, সবই জানিস। এখন আমার কী করা উচিত, বল।”
”দাঁড়া, দাঁড়া। ছবিটার ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দে তো। আগে বল, ওই ছবিটার এখনকার মালিক কে?”
”গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলে এক ভদ্রলোক। শুনেছি, মহারাজা নন্দকুমারের উত্তরাধিকারী কারও একজনের কাছ থেকে ওই ভদ্রলোকের বাবা ছবিটা সামান্য টাকায় কেনেন। তখন ওঁরা থাকতেন মুর্শিদাবাদে। মাসছয়েক আগে গৌরীশঙ্করবাবু ছবিটা আমাদের ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্টে রেখে যান।”
”ছবিটার এখনকার ভ্যালুয়েশন কত জানিস?”
”শুনেছি, তিন কোটি টাকার মতো। ছবিটার বিশেষত্ব হল, এক পিসই আছে পৃথিবীতে।”
কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ”তার মানে?”
নীচে রাখা অ্যাটাচি কেসটা খুলে সুকুমার বলল, ”না দেখালে তুই ঠিক বুঝতে পারবি না, ছবিটার কেন এত দাম। দাঁড়া, আমার কাছে একটা ফোটো তোলা আছে। তোকে দেখাচ্ছি।”
অ্যাটাচি কেস থেকে একটা রঙিন ছবি বের করে সুকুমার আমার হাতে দিয়ে বলল, ”ছবিটা চৈতন্যদেবের। উনি যখন পুরীতে যান, তখন ওড়িশার রাজা একজন আর্টিস্টকে দিয়ে এই ছবিটা আঁকিয়েছিলেন। চৈতন্যদেবকে সামনাসামনি দেখে আঁকা, এটাই একমাত্র ছবি। সেজন্যই এত দাম।”
ছবিটা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখতে লাগলাম। জীবনের শেষ দিকে চৈতন্যদেব নীলাচলে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে একদিন সাক্ষাৎ করতে যান ওড়িশার মহারাজা গজপতি প্রতাপরুদ্র। মহারাজা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন চৈতন্যদেবকে। ছবিতে আরও অনেকেই আছেন। তাঁদের কাউকে চিনতে পারলাম না। পাঁচশো বছরেরও পুরনো ছবি। কী মাধ্যম সেই চিত্রশিল্পী ব্যবহার করেন তখন, সেটা জানার খুব কৌতূহল হল। তখন কি তেলরঙের প্রচলন ছিল? মনে হয়, না। আসল ছবিটা দেখতে পেলে একটা অভিজ্ঞতা হত।
ফোটো কপিটা সুকুমারের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ”সত্যিই দুষ্প্রাপ্য ছবি। একটা কথা বল তো। তুই কি জানিস, এই ছবিটা গৌরীশঙ্করবাবুর কাছ থেকে কে কিনতে চেয়েছে?”
সুকুমার বলল, ”সবার কথা জানি না। গৌরীশঙ্করবাবু কথায়—কথায় একদিন বলেছিলেন, হংকং—এর এক এজেন্ট এই ছবিটার তিন কোটি টাকা দর দিয়েছে। আসল ক্রেতা কে, তা জানায়নি। তবে হাবভাবে ওঁর মনে হয়েছিল, আমেরিকার কেউ।”
এত দর ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আজকাল চৈতন্য—ভাবনা নিয়ে বিশ্বের বহু দেশে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও হংকংয়ে ফুটবল ম্যাচ কভার করতে গিয়ে দেখেছি, রাস্তায় খোল—করতাল বাজিয়ে একদল চিনে চৈতন্যদেবের ছবি নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছেন। বহু দেশে বহু সংস্থাও গড়ে উঠেছে। তাদেরই কেউ এই ছবিটা কিনতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু চৈতন্যদেবের এই ছবিটা যে সুকুমারদের ব্যাঙ্কে আছে, তা বাইরের লোক জানল কী করে?
মনে প্রশ্নটা জাগতেই বললাম, ”ছবিটা যে তোদের ব্যাঙ্কে আছে, সেটা তুই ছাড়া আর কে জানে?”
”খুব বেশি লোক জানে না। ব্যাঙ্কের দু’তিনজন ডিরেক্টর ছাড়া আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জানে। অবশ্য জানার কথা নয়। কুণাল, মানে আমাদের ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে গৌরীশঙ্করবাবু নিজেই একদিন বলে ফেলেছিলেন।”
”তোদের সেফ ডিপোজিট ভল্টের দায়িত্বে আছে বুঝি ছেলেটা?”
”তুই জানলি কী করে?”
”আন্দাজ করে বললাম। তা, তোদের ভল্ট খোলার সিস্টেমটা কী বল তো?’
”মাস্টার—কি আছে কুণালের কাছে। দু’নম্বর চাবিটা থাকে গৌরীশঙ্করবাবুর হেফাজতে। মাস্টার—কি দিয়ে কুণাল ভল্ট অর্ধেক খোলার পরই দ্বিতীয় চাবিটা ঘুরিয়ে গৌরীশঙ্করবাবু পুরোটা ওপেন করতে পারবেন।”
”তা হলে চুরি যাওয়ার ভয় পাচ্ছিস কেন?”
”আসল ছবিটা ভল্টের মধ্যে আদৌ আছে কি না, তা তো জানি না। দিনকয়েক আগে গৌরীশঙ্করবাবু আমার কাছে গিয়ে বললেন, তেসরা জুলাই ছবিটা তিনি বিক্রি করবেন। তিন কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করতে চান। ব্যাঙ্কে বসেই পার্টির সঙ্গে লেনদেন হবে। ওইদিন সন্ধেবেলায় একটা উড়ো ফোন পেলাম, চৈতন্যদেবের ছবিটা বিক্রি হওয়ার আগেই আমরা হাপিস করে দেব। পারেন তো আটকান। তারপর থেকে বার তিনেক ফোন পেয়েছি। আমি যে লালবাজারে গেছি, সে খবরটাও ওরা জানে।”
”তোর অফিসটা ঠিক কোথায় রে?”
”পার্ক স্ট্রিটে। চেনা খুব সহজ। ৪৮ এফ, পার্ক স্ট্রিট। দেখবি, বাড়িটার ছাদে একটা হলুদ রঙের বেলুন উড়ছে। তার গায়ে আমাদের ব্যাঙ্কের নাম লেখা আছে। বহু দূর থেকে বেলুনটা দেখা যায়।”
”পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে রে?”
”সুদীশ নাগ বলে একজন অফিসার রেগুলার যাতায়াত করছে। ভদ্রলোক খুব এফিশিয়েন্ট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবুও আমি ঠিক ভরসা রাখতে পারছি না।”
কথাটা বলে সুকুমার হাতঘড়িতে চোখ বোলাল। ওর অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আটকে রাখা ঠিক না। ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যই শেষ প্রশ্নটা করলাম, ”এই গৌরীশঙ্করবাবু কোথায় থাকেন, জানিস?”
সুকুমার বলল, ”তোর বাড়ির খুব কাছেই। এই গল্ফ গার্ডেন্সে। উনি একবার আমাকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করেছিলেন।”
”ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত।”
”চল তা হলে। তুই বেরোতে পারবি?”
”চল। তুই এত ঘাবড়ে গেছিস যে, তোর এই কেসটায় মাথা দেওয়া দরকার।”
মিনিটখানেকের মধ্যেই সুকুমারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার গল্ফগ্রিনের বাড়ি থেকে মিনিট চারেকের পথ গৌরীশঙ্করবাবুর বাড়ি। সুকুমারের গাড়িতে চট করে পৌঁছেও গেলাম। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে একজন ওয়াচারকে দেখে বুঝতে পারলাম, সুদীশ কাজে নেমেছে। একেবারে বাড়ি থেকেই নজরে রেখেছে গৌরীশঙ্করবাবুকে।
সুকুমারের নাম শুনেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন ভদ্রলোক। প্রথম দর্শনেই খুব ভাল লেগে গেল গৌরীশঙ্করবাবুকে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। দেখে বোঝা যায়, খুব অভিজাত বংশের। সুকুমারকে দেখে বললেন, ”কী ব্যাপার মিঃ মল্লিক, আপনি?”
সুকুমার আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ”কালকেতু আপনার কাছে কয়েকটা কথা জানতে চায় বলে নিয়ে এলাম।”
”আসুন ভাই।” বলে গৌরীশঙ্করবাবু ভেতরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে আমাদের বসালেন। ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলাম। খুব সুন্দর করে সাজানো। দেওয়াল জুড়ে বেশ কয়েকটা বড়—বড় অয়েল পেন্টিং। ছোট—বড় নানা ধরনের মূর্তি মেঝেতে দাঁড় করানো। পুরো মেঝেটা কাশ্মীরি কার্পেটে মোড়া। সবচেয়ে নজর টানল পুরনো দিনের বর্মাটিকের কিছু আসবাবপত্র। মনে হল, মুর্শিদাবাদের কোনও নবাববাড়ি থেকে জিনিসপত্রগুলো তুলে এনে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু টাকা থাকলেই হয় না। রুচি দরকার। যা গৌরীশঙ্করবাবুর আছে।
সোফায় বসে ভদ্রলোক বললেন, ”খুব টেনশনের মধ্যে আছি ভাই। কাল ছবি বিক্রির ব্যাপারটা ভালয়—ভালয় মিটে গেলে বাঁচি। সুকুমারবাবু, কাল রাতেও টেলিফোনে লোকটা হুমকি দিয়েছে, ‘যত চেষ্টাই করুন, ছবি চুরি আপনি আটকাতে পারবেন না।’
জিজ্ঞেস করলাম, ”ছবিটা কে কিনছে আপনার কাছ থেকে?”
”ওয়াই টং বলে এক ভদ্রলোক। হংকংয়ে থাকেন। ওখানকার চৈতন্য উন্মেষ সমিতির প্রেসিডেন্ট। আজ দুপুরেই উনি আসছেন ক্যাথে প্যাসিফিক ফ্লাইটে। কাল বিকেল তিনটেয় আমার সঙ্গে দেখা করবেন।”
”টংয়ের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হল কীভাবে?”
”আসলে ইস্কনের লোকেরা অনেকদিন ধরেই ছবিটা কিনতে চাইছিল। চৈতন্যদেবের পাঁচশোতম জন্মবার্ষিকীর দিন আপনাদের কাগজে আমার একটা ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল। এই দুর্মূল্য ছবিটার সম্পর্কে আমি কয়েকটা কথা বলেছিলাম। তখনই ইস্কনের লোকেরা আমার সঙ্গে এসে কথা বলে। সম্ভবত ইস্কনের কারও কাছ থেকে ওয়াই টং ছবিটার ব্যাপারে সব জেনে থাকবে। ও প্রথম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্টারনেটে। মাসখানেক ধরেই নেগোসিয়েশনটা চলছে।”
”ইস্কনের কাছে ছবিটা বিক্রি করলেন না কেন?”
”দামে পোষাল না।”
”ছবিটা কিনে টং কী করবে, কিছু বলেছে?”
”কাওলুনে ওরা একটা চৈতন্যমন্দির তৈরি করছে। তাতে রেখে দেবে।”
”ছবিটা কি বিমা করা আছে?”
”অবশ্যই। এক কোটি টাকায়। বছর দশেক আগে ইনশিওর করে রেখেছি। আসলে কী জানেন, ছবিটা রাখা ছিল আমাদের পৈতৃক বাড়ির সিন্দুকে। বাবা মারা যাওয়ার সময়ই জানতে পারি, ছবিটা দুষ্প্রাপ্য। তখনই সিন্দুকে ফেলে না রেখে ইনশিওর করে ব্যাঙ্কে রেখে দিই।”
”ছবিটা কারা চুরি করতে চায়, আন্দাজ করতে পারেন?”
”না। খুব ক্লোজ সার্কেলের দু’চারজন ছাড়া এই ছবিটার কথা কেউ জানে না। আমার একটাই ছেলে। সে আমেরিকায় সেটেলড। আমার আত্মীয়স্বজনও তেমন কেউ নেই যে, ছবিটা চুরি করতে আগ্রহ দেখাবে। আমার মনে হয়, কোনও পাকা মাথার প্ল্যান। বুঝতেই তো পারছেন, আগাম হুমকি দিয়ে যে লোকটা ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে নির্দিষ্ট দিনে ছবি চুরির প্ল্যান করতে পারে, সে অর্ডিনারি লোক নয়। লোকটা এমন কেউ, সুকুমারবাবুদের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে। না হলে সবদিক থেকে এত খবর আগাম জানতে পারত না।”
মনে—মনে গৌরীশঙ্করবাবুর প্রশংসা করলাম। ভদ্রলোক ঠিকই বলছেন। আমার কিছুটা কাজ কমিয়ে দিলেন। একবার যখন নাক গলিয়েছি, চুরি আমি আটকে দেবই। এ—বিশ্বাস আমার আছে। সুকুমারের ব্যাঙ্কে গিয়ে একবার সব দেখে এলে ভাল হত। ভল্টটা ঠিক কোথায়, দেখা দরকার। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, সুকুমারের সঙ্গে ওর অফিসে যাব।
গৌরীশঙ্করবাবু বোধ হয় কথা বলার লোক পান না। সুকুমার একবার উঠতে চাইলে, বললেন,”আরে, বসুন না!”
কথাটা শেষ হতে না হতেই দেখি, ডান দিকের দরজা দিয়ে একজন কাজের লোক বড় একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। পরদার ফাঁক দিয়ে ডান দিকের ঘরে চোখ যেতেই আমি অবাক। কাচের শো—কেসে প্রচুর বই সাজানো। ভদ্রলোকের তা হলে বই পড়ার নেশা আছে। বইয়ের প্রতি আমারও অসম্ভব টান। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, অন্য একদিন গৌরীশঙ্করবাবুর কাছে এসে ভাল করে আলাপ করে যেতে হবে।
ট্রে—তে চা—জলখাবার দেখে সুকুমার বলল, ”আমি হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। আমি কিন্তু কিচ্ছু খেতে পারব না।”
গৌরীশঙ্করবাবু বললেন, ”আপনি এত টেনশনের মধ্যে রয়েছেন কেন? কে একজন ফাঁকা হুমকি দিয়েছে, তাতেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখুন তো, কেমন নির্লিপ্ত থেকে গেছি। আমার ছবিটা চুরি করলেও, চোরের কোনও লাভ হবে না সুকুমারবাবু।”
জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন?”
”এক, এই ছবি বিক্রি করা কঠিন হবে। ইন্টারনেটে ছবিটার বিবরণসহ মালিক হিসেবে আমার নাম রয়েছে। চৈতন্যদেবের ভক্তদের মধ্যে কেউ যদি কিনতে চান, তা হলে চোরাই পথে তিনি কিনবেন না। দুই, ছবিটার গুরুত্ব সাধারণ লোকের কাছে যতটা, চৈতন্য ভক্তদের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি। তাঁরা পাবলিকলি ডিসপ্লে করার জন্যই কিনতে চাইবেন। চোরাই পথে কিনলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন। ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীটা এখন এমন ছোট হয়ে গেছে, জানাজানি হয়ে ছবিটার কথা আমার কানে চলে আসবেই।”
সুকুমার বলল, ”হয়তো আপনার কথা ঠিক। কিন্তু আমি ব্যাঙ্কের সুনাম নষ্ট হওয়ার কথা ভাবছি।”
ছবি চুরির হুমকিটা, মনে হল গৌরীশঙ্করবাবু খুব হালকাভাবে নিয়েছেন। ভদ্রলোক বোধ হয় অপরাধ জগতের খোঁজখবর বিশেষ রাখেন না। রাখলে, জানতে পারতেন, টাকার থলি নিয়ে এমন অনেক লোক বসে আছেন, যাঁরা শুধু তাঁদের ড্রয়িং রুমের শোভা বাড়ানোর জন্যই পাঁচশো বছরের পুরনো এই ছবিটা কিনতে রাজি আছেন। এই আত্মগরিমার জন্য তাঁরা লাখ লাখ ডলার খরচ করতেও পিছপা হবেন না। গৌরীশঙ্করবাবুকে এসব কথা বলে, অযথা উদ্বেগের মধ্যে ফেলতে মন সায় দিল না। তাই চুপ করে রইলাম।
পরদা সরিয়ে কাজের লোকটি ফের ডান দিকের ঘরে ঢুকে গেল। পলকের মধ্যেই চোখে পড়ল, ঘরে কাঠের স্ট্যান্ডে ক্যানভাস বসানো। পাশেই টেবিলে প্যালেট, রঙের টিউব আর তুলি। ক্যানভাসে ছবিটা এখনও শেষ হয়নি। গৌরীশঙ্করবাবুর কি ছবি আঁকারও নেশা আছে? হতে পারে। এই ধরনের বিত্তবান আর রুচিশীল মানুষের, তা থাকা সম্ভব। বই পড়েন, ছবি আঁকেন। ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেল। পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হল। কিন্তু প্রথম দিনের আলাপে এই ইচ্ছেটা ব্যক্ত করা যায় না।
সুকুমার উসখুস করছে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। সামান্য দু’—একটা কথা বলে গলফ গার্ডেন্স থেকে আমরা দু’জন যখন বেরিয়ে এলাম, তখন প্রায় সাড়ে দশটা। গাড়িতে উঠে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সুকুমার বলল, ”গৌরীশঙ্করবাবুকে কেমন মনে হল রে কালকেতু?”
”ভালই। একটা কথা বল তো। ভদ্রলোক শেষ কবে তোদের ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন?”
”দিন পনেরো আগে। তবে তখন আমি অফিসে ছিলাম না। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কুণালের সঙ্গে কথা বলে উনি চলে আসেন।”
”ব্যাঙ্কে কেন গেছিলেন, জানিস?”
”তা জানি না।”
প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে আমার বাড়ির সামনে এসে সুকুমার বলল, ”তোর প্রোগ্রাম কী?”
ভেবেছিলাম পার্ক স্ট্রিটে ওদের ব্যাঙ্কে গিয়ে সেফ ডিপোজিট ভল্টের জায়গাটা ভাল করে দেখে আসব। কিন্তু বাড়ির কাছে এসে আর ইচ্ছে করল না।
গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বাড়িতে বসে এখনই ইন্টারনেটে কিছু তথ্য বের করা দরকার। হংকংয়ে ওয়াই টং লোকটার চৈতন্য উন্মেষ সমিতি আদৌ আছে কি না, আগে তা জানতে হবে। ইন্টারনেট হল অসীম জ্ঞানভাণ্ডার। এমন কোনও বিষয় নেই, যা জানা যায় না। চৈতন্যদেবের ছবিটা বিক্রির জন্য গৌরীশঙ্করবাবু কি ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? ই—কমার্সের যুগে কোনও কিছুই এখন অসম্ভব নয়। ওই বিজ্ঞাপনটা পেলে গৌরীশঙ্করবাবুর ই—মেল ঠিকানাটাও তা হলে পাওয়া যাবে।
বাড়িতে ঢুকতেই ফুল্লরা বলল, ”সুদীশদা তোমাকে ফোন করেছিল।”
জিজ্ঞেস করলাম, ”কিছু বলল?”
”তেমন কিছু নয়। তুমি কখন বেরিয়েছ, জানতে চাইল।”
”ঠিক আছে।” বলে পোশাক বদলে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লাম। রোজ স্নান করতে যাওয়ার আগে আমার ইন্টারনেট খোলার অভ্যেস। চট করে দু’—তিনটে ওয়েবসাইট খুলে দিনের খবরগুলোতে আগে চোখ বুলিয়ে নিই। এর ফলে অফিস যাওয়ার আগেই জেনে যাই, ওইদিন বড় খবর কী হতে যাচ্ছে। স্টার নিউজ খুললে অবশ্য খবরগুলো, জানা যায়। তা সত্ত্বেও ইন্টারনেটের আকর্ষণই আলাদা।
আজ ওয়েবসাইট খুলতেই দেখি, বড় খবর। দেশের চল্লিশটা জায়গায় একসঙ্গে আয়কর দফতরের কর্তারা হানা দিয়েছেন ক্রিকেটার আর ক্রিকেট কর্তাদের বাড়ি ও অফিসে। খবরটা দেখেই মাথাটা অন্যদিকে চলে গেল। এই খবর প্রথম পাতায় বড়—বড় করে ছাপা হবে। পুরো দিনটাই চলে যাবে নানাভাবে খবরটা সাজাতে। কৌশিক আর সব্যসাচীকে ফোন করে বলে দিলাম, ”তোমরা খবরটার পেছনে লেগে থাক। আমি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে অফিসে পৌঁছে যাচ্ছি।”
ইন্টারনেটের যোগাযোগ কেটে দেওয়ার আগে হঠাৎই মনে হল, হংকংয়ের চৈতন্য উন্মেষ সমিতির একটা খোঁজ নেওয়া যাক। ওয়েবসাইটে খোঁজা শুরু করে প্রথমে হংকংয়ে, তারপরে ওই দেশের ধর্মীয় সংস্থাগুলো সার্চ করতে করতে হঠাৎই চৈতন্য উন্মেষ সমিতির সন্ধান পেয়ে গেলাম। মাত্র তিরিশজন এই সমিতির সদস্য। কাওলুনে এঁরা একটা মন্দির তৈরি করেছেন। প্রত্যেকেই বিত্তবান। জীবনে শান্তিলাভের আশায় এখন কৃষ্ণনাম সংকীর্তন করে চরম আনন্দে রয়েছেন। সমিতির প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখলাম, ওয়াই টংয়ের নাম আছে। জাহাজ ব্যবসায়ী। এখন ছেলের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে সমিতির কাজে ব্যস্ত। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। নাঃ, টংকে সন্দেহ তালিকা থেকে স্বচ্ছন্দে বাদ দেওয়া যায়।
রাতে অফিস থেকে ফিরে ছবি চুরি নিয়ে ভাবা যাবে। এখন ক্রিকেটারদের বাড়িতে আয়কর কর্তাদের অভিযান নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার। কথাটা মনে হওয়া মাত্রই কম্পিউটার বন্ধ করে দিলাম।
তিন
গভীর কোনও সমস্যায় পড়লে আমার মাথাটা খুব দ্রুত কাজ করে। রহস্যের জট তাড়াতাড়ি খুলে যায়। এটা বরাবর লক্ষ করেছি। দু’দিন আগে হারিয়ে ফেরত পাওয়া পর্যন্ত পার্সের ভেতর একটা রহস্যজনক ছড়া পেয়েছিলাম। কাল সারাদিনে সেই ছড়াটার কথা মনে পড়েনি। একটা চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার সুর আছে তাতে। ”আমার অভিসন্ধি, বুঝবি দু’দিন পর।” কিসের অভিসন্ধি? আমাকে বুঝিয়েই বা কী লাভ লোকটার? ছড়ার পরের দু’টি লাইন হল, ”আমি টু রেড ফ্রেন্ড, নিবাস সাউথ এন্ড।” রেড ফ্রেন্ড মানে, লাল বন্ধু। টু রেড ফ্রেন্ড কথাটার অর্থ তা হলে দাঁড়াল লাল বন্ধুর প্রতি। লোকটার বাড়ি সাউথ এন্ড নামে কোনও অঞ্চলে। কিন্তু কলকাতায় এ—নামের কোনও জায়গার কথা আমি অন্তত শুনিনি।
ছড়াটা কয়েকবার পড়ে মুখস্থ করে নিলাম। চলতে—ফিরতে মনে পড়লে হঠাৎ মানে পরিষ্কার হয়ে যাবে। বরাবরই আমার ক্ষেত্রে এটা হয়। শেষ লাইনটাতেই স্পষ্ট অহমিকার সুর। ”পারিস তো আমায় ধর।” লোকটা যে—ই হোক, আমাকে জানান দিয়ে একটা অপরাধ করবে। এবং সেটা আমাকে ধরতে হবে। লোকটা তা হলে আমাকে চেনে। কে হতে পারে, বুঝতেই পারলাম না।
কাল আয়কর কর্তাদের হানা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, গৌরীশঙ্করবাবুর ছবি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই পাইনি। আজ তাই কম্পিউটার নিয়ে বসলাম। অনেক তথ্য জানা দরকার। সাতসকালেই সুকুমারের একটা ফোন পেয়েছিলাম। সেই এক কথা, ”যদি কিছু ঘটে, আমায় বাঁচাস। পুলিশের ওপর আমি ভরসা রাখতে পারছি না।”
জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”কেন তোর এ—কথা মনে হচ্ছে? সিকিউরিটির ব্যবস্থা ওরা করেনি?”
”করেছে। আজই লালবাজার থেকে সুদীশ নাগ বলে একজন অফিসার এসেছিলেন। বাড়াবাড়ি রকমের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে গেছেন। আমার নর্মাল কাজ কী করে চলবে, বুঝতে পারছি না।”
বললাম, ”কিছু ভাবিস না। সুদীশকে আমি চিনি। খুব দক্ষ অফিসার। ওর চোখে ফাঁকি দিয়ে ছবিটা চুরি করা মুশকিল।”
”জানি না বাবা, দিনটা ভালয়—ভালয় কাটলে বাঁচি!”
সুকুমারকে আশ্বাস দিয়ে ফোনটা তখন ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে একটাই খটকা লাগছিল, সুদীশ আমাকে কেন কিছু জানাল না? ও অবশ্য জানে না, চুরির হুমকি নিয়ে আমিও মাথা ঘামাচ্ছি। সুকুমারের সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্ব আছে, তা জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, আজ দুপুরেই ব্যাঙ্কে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তখন ও সত্যিই লজ্জায় পড়ে যাবে।
ইন্টারনেটে কানেকশন পাওয়ার পরই আমি ছবিটা সম্পর্কে তথ্য বের করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গৌরীশঙ্করবাবু নিশ্চয়ই ছবিটা বিক্রি করার জন্য ইন্টারনেটে তথ্য দিয়েছেন। মুশকিল হল, কোন ওয়েবসাইটে সেই তথ্যটা আছে, তা জানা দরকার। আন্দাজে সার্চ শুরু করলাম। কাজটা কঠিন, আর কঠিন বলেই আমি বেশি মনঃসংযোগ করতে পারি। এই সময়টায় কেউ এলে বিরক্ত হই। ফোন পেলেও কথা বলতে চাই না। ফুল্লরা তখন সামাল দেয়।
ঘণ্টা দেড়েক খোঁজার পর কয়েকটা তথ্য পেয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মন বলল, ছবিটা আজ চুরি হবেই। সুদীশ আটকাতে পারবে না। কৌশিককে ফোন করে বলে দিলাম, ”আমার অফিস যেতে একটু দেরি হতে পারে। ইনকাম ট্যাক্স রেইড নিয়ে সব খবর তোরা তৈরি করে রাখিস।” অন্য দিন বেলা বারোটা—সাড়ে বারোটার মধ্যেই আমি অফিসে বেরিয়ে যাই। আজ বোধ হয় একটু আগেই বেরোতে হবে।
আমাকে কম্পিউটার বন্ধ করতে দেখে ফুল্লরা ঘরে ঢুকে বলল, ”এই, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। তোমার ছেলেবেলার এক বন্ধু কাল সন্ধেবেলায় তোমায় ফোন করেছিল।”
”নামটা কী গো?”
”দুলাল মিত্র। বলল, ‘আপনি আমায় চিনবেন না। কালকেতুর সঙ্গে আমি একই স্কুলে পড়তাম। মাঝে বহুদিন চাকরির জন্য ইলাহাবাদে ছিলাম। মাস ছয়েক আগে কলকাতার অফিসে বদলি হয়ে এসেছি। এখনও অফিস থেকে ফেরেনি?’ আমি বললাম, ‘ফিরতে—ফিরতে ওর রাত এগারোটা হয়ে যাবে।’ তখন ভদ্রলোক বললেন, ‘কালকেতুকে বলবেন, রোববার আপনাদের বাড়িতে দেখা হবে।’ কে গো ভদ্রলোক? আগে তো কখনও নাম শুনিনি।”
”দুলাল আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। খুব ডেয়ারডেভিল টাইপের ছিল। ওর অনেক কীর্তি। সংস্কৃত সারের টিকি কেটে, ও একবার সেই টিকি খামে পুরে সারেরই বাড়িতে পোস্টে পাঠিয়েছিল।”
কথাটা শুনে ফুল্লরা হাসতে লাগল। উঠে গিয়ে আমি কয়েকটা জায়গায় ফোন সেরে নিলাম।
…যেমনটা আশা করেছিলাম, সুকুমারের ফোনটা এল বেলা বারোটা নাগাদ। ”সর্বনাশ হয়ে গেছে রে কালকেতু। ছবিটা চুরি গেছে।”
হালকাভাবেই বললাম, ”জানতাম। কখন হল?”
”একটু আগে গৌরীশঙ্করবাবু ভল্ট খুলে যখন ছবিটা নিয়ে আমার কাছে আসছিলেন, তখনই লিফটে ছিনতাই হয়ে যায়।”
”তোর ঘর থেকে ভল্ট কত দূরে?”
”আমার ঘরটা দোতলায়। আর ভল্ট তিনতলায়।”
”লিফটে তখন কেউ ছিল না? পুলিশের কেউ?”
”পুলিশের কেউ ছিল না। তবে তিনতলায় একটা অ্যাড এজেন্সির অফিস আছে। তাদের দু—তিনজন তখন গৌরীশঙ্কবাবুর সঙ্গেই নামছিলেন। লিফটের বাইরে পা দিয়েই গৌরীশঙ্করবাবু চিৎকার করে ওঠেন, ‘থামান, লিফট থামান।’ তখনই উনি বলেন, ছবিটা ছিনতাই হয়েছে।”
”অর্থাৎ যে লোকটা ছিনতাই করেছে, সে তখন লিফটের ভেতরে ছিল।”
”লোকটা তো ছিলই, তা ছাড়া অন্য কেউ ছিল কি না গৌরীশঙ্করবাবু তা মনে করতে পারছেন না। বেলা তিনটের সময় হংকংয়ের সেই পার্টি ছবিটা নিতে আসবে। কী হবে?”
”গৌরীশঙ্করবাবু এখন কোথায়?”
”আমার ঘরে। খুব মুষড়ে পড়েছেন। কথা বলবি?”
”থাক। তোদের ব্যাঙ্কে আমি যাচ্ছি। ওখানে গিয়েই কথা বলব।”
ফোনটা ছেড়ে চটপট নীচে নেমে এলাম। ছবি চুরি তো নয়, আসলে এটা হয়ে দাঁড়াল ছবি ছিনতাইয়ের ঘটনা। সুদীশ তা হলে কী সিকিউরিটির ব্যবস্থা করল? গৌরীশঙ্করবাবু যখন দোতলায় ভল্ট খুলতে যান, তখন সঙ্গে অবশ্যই একজন পুলিশ থাকা উচিত ছিল। ভল্টের কাছাকাছি বাইরের কাউকে নিয়ে যাওয়ায় হয়তো আপত্তি থাকতে পারে। তাই বলে লিফটের সামনে সিকিউরিটির লোকজন থাকবে না? বিশেষ করে, এত ঢাক—ঢোল পিটিয়ে যে লোকটা ছবি চুরি করতে আসছে, তাকে খাটো চোখে দেখা মোটেই সুদীশের উচিত হয়নি।
পার্ক স্ট্রিটের দিকে গাড়ি চালাতে—চালাতে মনে হল, ছবিটা পাওয়া না গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এক, গৌরীশঙ্করবাবু নিজে। বিক্রির তিন কোটি টাকা উনি পাবেন না—সেইসঙ্গে দুষ্প্রাপ্য একটা পারিবারিক সম্পত্তি উনি হারাবেন। দুই, সুকুমারের বদনাম হয়ে যাবে। অফিসে হয়তো কেউ ওর প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। যে ওর ভাল চাইছে না। তিন, ছবি—চোর ছড়া কেটে আমাকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। ফলে রহস্যভেদী হিসেবে আমার যে নামটাম হয়েছে, তাতে খানিকটা কালি পড়বে। চার, সুদীশ নাগ অপদস্থ হবে। অর্থাৎ কি না, ছবিটা এমন কেউ হাতিয়েছে, যে আমাদের সবাইকে চেনে। পারস্পরিক সম্পর্কটা জানে। সে বাইরের কেউ নয়। সুকুমারের ব্যাঙ্কে মাঝে—মধ্যে যাতায়াতও করে। ছবি চুরি করে সে আর্থিক লাভ করতে চায় কি না, জানি না। তবে আমাদের মতো দু—তিনজনকে অবশ্যই হেনস্থা করতে চায়। লোকটা তা হলে পকেটমারি করার সাহস রাখে। আবার ছবি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধও করতে পারে?
এসব চিন্তা করতে—করতেই সুকুমারের আপিসে পৌঁছে গেলাম। পার্ক স্ট্রিটের এই বাড়িটায় আগেও বারদুয়েক এসেছি। ফুটবলার জামশিদ নাসিরি বিরাট এই ম্যানসনের অন্য ব্লকে থাকতেন। ছ’—ছ’টা গেট। এমন বাড়িতে কেউ লুকিয়ে থাকলে, তাকে ধরা শক্ত। এক গেট দিয়ে ছাদে উঠে, স্বচ্ছন্দে সে অন্য গেট দিয়ে নেমে পালিয়ে যেতে পারে। মনে হয়, ছবি—চোর লিফটে করে ছাদে উঠে অন্য গেট দিয়ে নেমে গেছে।
সুকুমারের অফিসে ঢুকতেই দেখি, ব্যাঙ্কের কাজকর্ম যথারীতি চলছে। ঝকঝকে তকতকে হলঘর। নানা ধরনের কিউবিকিলস। কাচের ঘর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই সুকুমার উঠে এল। গৌরীশঙ্করবাবু ছাড়াও ওর ঘরে বসে আছেন আরও দু’জন। একজনকে চিনতে পারলাম, কুন্তল। লালবাজারে দেখেছি। তা হলে তদন্তের ব্যাপারে সুদীশ ওকে নিয়ে এসেছে। আমাকে দেখেই কুন্তল বলল, ”সুদীশদা এইমাত্তর মল্লিকবাজারে গেল। পাঁচ মিনিট আগে এলে দেখা পেতেন।”
শুনে মনে—মনে হাসলাম। সুদীশের হয়তো ধারণা হয়েছে, মল্লিকবাজারে গিয়ে এ—অঞ্চলের দাগি অপরাধীদের তুলে আনলেই ছবির খোঁজ পেয়ে যাবে। অযথা সময় নষ্ট। অপরাধী বাইরের কেউ নয়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ঘরে বসেই গৌরীশঙ্করবাবুর মুখে পুরো ঘটনাটা ফের শুনে নিলাম। ছিনতাইকারী লিফটের ভেতর ওত পেতেই ছিল। গৌরীশঙ্করবাবু লিফটের বাইরে পা রাখা মাত্তর ছবিটা সে ছিনতাই করে। ঘুরে তাকাতেই গৌরীশঙ্করবাবু দেখেন লিফট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে ভালভাবে দেখার সুযোগ পাননি। তাঁর বর্ণনাও দিতে পারলেন না। কথা শুনে কেন জানি না, আমার মনে হল, গৌরীশঙ্করবাবু কিছু চেপে যাচ্ছেন। হয়তো ভয় পেয়েছেন। হতে পারে।
ঘটনাস্থল দেখার জন্য সুকুমারকে নিয়ে তিনতলায় উঠে এলাম। লিফট চলে পাঁচতলা পর্যন্ত। তারপর ছাদ। তিনতলায় লিফটের কাছাকাছি জায়গাটা দেখলাম, একেবারে ফাঁকা। ডান পাশে কাচের সুইংডোর। ওপাশে অফিসের কাজকর্ম চলছে। হঠাৎ দরজা খুলে কেউ বেরিয়ে না এলে, টেরও পাওয়া সম্ভব নয়, লিফটের সামনে কী হচ্ছে। মনে—মনে ছক কষে নিলাম, ছবি ছিনতাইকারী হয় লিফটে করে একতলায় নেমে বাইরে বেরিয়ে গেছে। নয়তো পাঁচতলার ছাদে উঠে অন্য কোনও গেট দিয়ে পালিয়েছে। দ্বিতীয় রাস্তাটাই তার পক্ষে নেওয়া স্বাভাবিক। কেননা, ছিনতাইকারী জানে, দোতলা ও একতলার গেটে সাধারণ পোশাকে পুলিশ ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে।
কী ভেবে সুকুমারকে নিয়ে ছাদে উঠে এলাম। বাইরে থেকে যত আধুনিকই মনে হোক না কেন, বাড়িটা সত্তর—আশি বছরের পুরনো। ছাদে সারি সারি জলের ট্যাঙ্ক। আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকলে ধরা অসাধ্য। ছাদময় পাথরের নুড়ি। মুখ তুলে আশপাশে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পশ্চিমদিকে শহিদ মিনার এবং আরও দূরে দু’দিকে হাওড়া ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গঙ্গার ওপর দুটো সেতু দেখার সৌভাগ্য আগে কখনও আমার হয়নি। এরও সঙ্গে ময়দানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সবুজের সমারোহ দেখে হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ”বাহ।”
কাল কথায় কথায় সুকুমার আমাকে বলেছিল, এই বাড়িটা চিনতে কারও অসুবিধে হয় না। পার্ক স্ট্রিটে এই একটা বাড়িরই ছাদে একটা বিজ্ঞাপন—বেলুন আছে। সে—কথা মনে পড়তেই সুকুমারকে জিজ্ঞেস করলাম, ”হ্যাঁ রে, বেলুনটাকে তো দেখছি না। ওটা এখন নেই?”
সুকুমার চমকে উঠে বলল, ”অদ্ভুত ব্যাপার তো! আজ সকালেও অফিসে ঢোকার সময় দেখেছি। এই তো, এই হুকটার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।”
কংক্রিটের একটা স্ল্যাবে হুক দেখাল সুকুমার। নাইলনের মোটা দড়ির গিঁট এখনও হুকের সঙ্গে রয়ে গেছে। সেইসঙ্গে দড়ির একটা অংশও। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, দড়ি কেটে বেলুনটা কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। হুকের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ছবি—চুরির জট বোধ হয় খুলতে লাগল। সুকুমারকে জিজ্ঞেস করলাম, ”তুই অফিসে আসার পর থেকে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য এমন কি কেউ এসেছিল, যার সঙ্গে ব্যাঙ্কের কোনও লেনদেন নেই?”
সুকুমার একটু চিন্তা করে বলল, ”এরকম একজনই এসেছিল, বাচ্চু। আমাদের সেই সিটি জুবিলি স্কুলের। এখানে অত পুলিশ—টুলিশের ঝামেলা দেখে, দু’—চার কথা বলেই উঠে যায়। বাচ্চু ছাড়া আর তো কেউ আসেনি, ব্যাঙ্কে যার কোনও কাজ নেই।”
”ও কোথায় থাকে তুই জানিস?”
”গড়িয়ার দিকে। ওর অফিস আর বাড়ি—দু’জায়গারই ফোন নম্বর আমার কাছে আছে। তোর চাই?”
”না। এখন দরকার নেই।” বলে আমি নীচে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
লিফটে নামার সময়ই দ্রুত ছকে নিলাম, অতঃপর কী করতে হবে। ছবি চুরির ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। এখনই বাইরে গিয়ে চার—পাঁচটা ফোন করা দরকার। প্রথমটা এয়ারপোর্টে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে। দ্বিতীয় ফোনটা তাজবেঙ্গলে। তৃতীয়টা আলিপুরের আবহাওয়া দফতরে। এই তিনটে জায়গা থেকে যা খবর পাব, তারই ভিত্তিতে আরও দুটো জায়গায় কথা বলতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। এক—একটা মিনিট এখন আমার কাছে মহামূল্যবান। ভাগ্যিস, ছাদে উঠেছিলাম। না হলে আন্দাজই করতে পারতাম না, বেচারা সুকুমারকে কীরকম বোকা বানানো হয়েছে।
একতলায় নেমে সুকুমারকে বললাম, ”আমি ঘণ্টা দু’—আড়াইয়ের মধ্যে ঘুরে আসছি। তুই একটা কাজ করতে পারবি?”
”কী, বল।”
”বিকেল চারটের সময় গৌরীশঙ্করবাবুকে তোর এখানে ফের আসতে বলবি। মনে হচ্ছে, ছবি—রহস্যটা তারই মধ্যে ভেদ করা যাবে।”
কথাটা বলেই আমি আর দাঁড়ালাম না। পার্কিং স্পেসের দিকে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগলাম।
বিকেল পৌনে চারটের সময় ফের যখন সুকুমারের অফিসে ঢুকলাম, তখন দেখি যাদের চাইছিলাম, সবাই হাজির। গৌরীশঙ্করবাবু, আমাদের স্কুলের বন্ধু বাচ্চু মিত্তির, ব্যারাকপুর থানার ও সি সুবিনয় মণ্ডল ছাড়াও সুদীশ। ঘরে ঢুকেই সুকুমারকে আমি বললাম, ”আমাকে সফট ড্রিঙ্কস খাওয়াতে পারিস? ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।”
কথাটা শুনে সুকুমার নিজেই উঠে গেল সফট ড্রিঙ্কস জোগাড় করতে। তার মানে এখনও টেনশনে আছে। গৌরীশঙ্করবাবু কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। সুদীশের মুখটা থমথমে। বাচ্চু মিটিমিটি হাসছে। প্রায় কুড়ি বছর পর ওর সঙ্গে দেখা। চোখাচোখি হতেই আমি এড়িয়ে গেলাম। দুপুরে পাক্কা তিনটে ঘণ্টা আমার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। সারাটা দিন অফিসে একটা ফোন করারও সময় পাইনি। ক্রিকেটারদের কী হল, কে জানে? সুকুমারের মুখ চেয়েই আমি এতটা সময় আজ খরচ করলাম। না হলে সামান্য এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথাই ঘামাতাম না।
সফট ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে সুকুমার ফিরে আসার পরই আমি সুবিনয় মণ্ডলকে বললাম, ”ছবিটা আমাকে দিন তো। সুকুমারের টেনশন আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
পলিথিনের প্যাকেটে রাখা একটা ছবি সুবিনয়বাবু আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। প্যাকেটের ভেতর থেকে ছবিটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে আমি বললাম, ”গৌরীশঙ্করবাবু, দেখুন তো এটা আপনার আসল ছবি কি না?”
ছবিটা কাছে টেনে গৌরীশঙ্করবাবু বললেন, ”এই তো সেই ছবি। পেলেন কোথায়?”
”আপনি কিন্তু আমার কথার উত্তর দেননি।”
”মানে? কোন কথার?”
”ওই যে বললাম, এটা আপনার আসল ছবি কি না?”
গৌরীশঙ্করবাবু একটু থতমত খেয়েই উত্তর দিলেন, ”আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
”ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু বলতে চাইছেন না। এটা আপনার সেই দুষ্প্রাপ্য ছবিটা নয়। এটা নকল ছবি। আপনি এঁকেছেন। বলুন, সত্যি কি না?”
সুকুমার অবাক হয়ে বলল, ”তুই কী বলছিস কালকেতু? এই ছবিটা যদি আসল না হয়, তা হলে আসল ছবিটা কোথায়?”
ঘরের ভেতর সূচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে, এমন নৈঃশব্দ্য। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। নাটক করার জন্য আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ”আসল ছবিটা এখন বোধ হয় সুরজমল কঙ্কারিয়ার বাড়িতে। যতদূর খবর পেয়েছি, এতক্ষণে উনি ইলাহাবাদে পৌঁছেও গেছেন।”
সুদীশ বলল, ”কঙ্করিয়া, মানে যে ভদ্রলোক বেলুন অভিযানে এসেছিলেন?”
হ্যাঁ, উনিই। কোটি কোটি টাকার মালিক সুরজমল কঙ্কারিয়া। ওঁর একটা নিজস্ব টিভি চ্যানেল আছে। ভদ্রলোকের নেশা ঐতিহাসিক এবং দুষ্প্রাপ্য সব জিনিস কেনা। কাল বিকেলেই তাজবেঙ্গলে বসে উনি গৌরীশঙ্করবাবুর কাছ থেকে এক কোটি টাকায় ওই ছবিটা কিনে নিয়েছেন। এই খবরটা আমি পেলাম ইন্টারনেটেই। গৌরীশঙ্করবাবু তা জানিয়ে দিয়েছেন। আজ দুপুরে যা হল, তা নাটক। আগে থেকে সব তৈরি করা। কী রে বাচ্চু, যা বলছি সব ঠিক তো?”
বাচ্চু নির্লিপ্তভাবে বলল, ”বলে যা। আগে তোর কথা শুনি। তারপর আমি যা বলার বলব।”
সুকুমার তাজ্জব হয়ে বলল, ”এত হেঁয়ালি করছিস কেন কালকেতু? গৌরীশঙ্করবাবুর ছবি চুরির সঙ্গে বাচ্চুর সম্পর্কটা কোথায়?”
”আছে। তা হলে পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে বলি। তুই আর আমি যেদিন গৌরীশঙ্করবাবুর বাড়িতে যাই, সেদিন একটা জিনিস তুই হয়তো লক্ষ করিসনি, দেখে আমার খুব খটকা লেগেছিল। অত দামি একটা ছবি খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও, গৌরীশঙ্করবাবুর মধ্যে আমি কোনও টেনশন দেখিনি। সেদিন উনি ওয়াই টংয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। হংকংয়ের ওই ভদ্রলোক নাকি ওঁর ছবিটা কেনার জন্য কলকাতায় আসছেন। পরে খোঁজ করে জানলাম, ওয়াই টং নামে এক ভদ্রলোক একটা সময় সত্যই ছবিটা কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে যান।
ইনটারনেটের যুগে এখন কোনও তথ্যই অজানা থাকে না আজকাল। গত দু’দিন ধরে কম্পিউটারের সামনে বসে খুঁজতে খুঁজতে ওয়াই টংয়ের ই—মেল অ্যাড্রেসটা পেয়ে যাই। প্রাচীন ছবি বা মূর্তি যাঁরা কেনেন, তাঁরা আজকাল ই—মেলে তাঁদের যোগাযোগের ঠিকানা দিয়ে রাখেন। তা, আমি ওয়াই টংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, চৈতন্যদেবের ছবিটা সম্পর্কে উৎসাহ উনি হারিয়ে ফেলেছেন। কলকাতায় যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই তাঁর নেই।
তবুও ওয়াই টংয়ের কথা আমি তখন পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। ভাবলাম, হয়তো আমার কাছে উনি লুকিয়ে যাচ্ছেন। তাই তাজবেঙ্গলসহ বড়—বড় কয়েকটা হোটেলে চেক করলাম, গতকাল বা আজ ওয়াই টংয়ের নামে কোনও ঘর বুকিং করা হয়েছে কি না? সব হোটেল থেকে আমাকে বলল , ‘না, ওই নামে কোনও বুকিং নেই।’ তখনই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, ছবিটা আর যে—ই কিনুন, ওয়াই টং কিনছেন না। তা হলে কে কিনছেন?
গৌরীশঙ্করবাবুর ওপর সন্দেহটা আরও বাড়ল। সুকুমার, তোকে বলিনি, গত পরশু আমার পকেটমার হয়েছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য। পার্সটা আমি ফেরত পাই অফিসে গিয়ে। পকেটমার বেশ রসিক মানুষ। পার্সের ভেতর একটা ছড়া লিখে রেখেছিল, যাতে আমাকে চ্যালেঞ্জ করার একটা সুর ছিল। এই যে আমি মাঝে—মধ্যে রহস্যভেদের নেশায় মাতি, সেটা পকেটমারের জানা। তাই সে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, একটা অপরাধ সে করতে যাচ্ছে। সে দেখতে চায়, আমি তাকে ধরে ফেলতে পারি কি না?
ছড়ায় সেই পকেটমার কায়দা করে তার নামধাম সম্পর্কে একটা আন্দাজ দিয়েছিল। নাম টু রেড ফ্রেন্ড। আর ধাম সাউথ এন্ড। ছড়াটা পড়েই মনে হয়েছিল, লোকটা অ্যামেচার। এবং আমার সঙ্গে সুকুমারের যে বন্ধুত্ব আছে, সে সেটা জানে। অর্থাৎ কিনা, সুকুমার সমস্যায় পড়লে যে আমার কাছে আসবেই, সে সম্পর্কে লোকটা নিশ্চিত। এই লোকটা সুকুমার—তোর আপিসের কেউ হতে পারে না। কেননা, তোর এখানকার কেউ আমাকে চেনে না। তা হলে লোকটা এমন কেউ, যে আমাদের দু’জনের খুব কাছের।
কিন্তু কাছের লোক হলেই যে তোর ব্যাঙ্কে রাখা চৈতন্যদেবের ছবিটার কথা জানতে পারবে, তার কোনও মানে নেই। তখনই মনে মনে ধরে নিলাম, লোকটা নিয়মিত তোর এখানে যাতায়াত করে। তুই হয়তো কোনওদিন গল্পচ্ছলে ছবিটার কথা বলে ফেলেছিস। অথবা গৌরীশঙ্করবাবুর সঙ্গে কোনও সূত্রে তার আলাপ আছে। ছবিটার কথা সে জানে। ছবি চুরি নয়, আসল লক্ষ্য তো তার, আমাকে অপদস্থ করা। নাটকটা তাই সে তৈরি করল। লোকটা জানে, সুকুমার নার্ভাস টাইপের মানুষ। ছবি চুরির হুমকিটা সে প্রথমে সুকুমারকেই দিল। লোকটা যা—যা আশা করেছিল, ঘটনা পরপর সেভাবেই ঘটতে শুরু করল। সুকুমার আমার কাছে এল। আমিও আগ্রহ দেখালাম। আবহটা এমন তৈরি হল, মারাত্মক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।”
সুকুমার এই সময় আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ”এই যে লোকটার কথা তুই বলছিস, সে তা হলে কে?”
”তার পরিচয়টা দিচ্ছি। আগে নকল ছবিটার কথা বলি। গৌরীশঙ্করবাবু যখন এই নাটকে ঢোকেন, তখন একটাই আপত্তি করেছিলেন। আসল ছবিটা নিয়ে কোনও খেলা তিনি খেলতে যাবেন না। উনি নিজেই একজন আর্টিস্ট। ভাল ছবি আঁকেন। ওঁর লাইব্রেরি রুমে আঁকার সরঞ্জাম আমি সেদিনই দেখে এসেছি। গৌরীশঙ্করবাবু চৈতন্যদেবের ওই ছবিটা দেখে হুবহু একটা ছবি নিজে আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হয়তো লক্ষ করেননি, আসলে ছবিতে যে জায়গায় মহাপ্রভুর খড়মটা ছিল, নকল ছবিতে ঠিক সেই জায়গায় সেইভাবে নেই। সুকুমার, তুই আমাকে আসল ছবির একটা ফোটোকপি দেখিয়েছিলি, মনে আছে? ওটা বের করে, পাশাপাশি ফেলে দ্যাখ, যা বলছি সত্যি কি না?”
অ্যাটাচি কেস থেকে সুকুমার ফোটোকপিটা বের করতেই দু’তিনজন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, আমার কথা মিলিয়ে দেখার জন্য। দেখি, গৌরীশঙ্করবাবুও উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওঁর চোখে বিস্ময়! প্রথমদিন ভদ্রলোককে দেখে সংস্কৃতিমনস্ক, রুচিশীল মানুষ বলে মনে হয়েছিল। উলটে উনি বোধ হয় আমার সম্পর্কে সঠিক আন্দাজ করেননি। একটু খাটো চোখেই আমাকে দেখেছিলেন। এখন আমার কথাবার্তা শুনে ধারণা বদলাচ্ছেন। আমি যে একটু পরেই একটা বোমা ফাটাব, গৌরীশঙ্করবাবু সেটা এখনও টের পাননি।
ছবি থেকে চোখ তুলে এই সময় সুকুমার বলল, ”তার মানে এতদিন এই নকল ছবিটাই সেফ ডিপোজিট ভল্টে ছিল?”
”ঠিক তাই। গৌরীশঙ্করবাবু আসল ছবিটা বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি নিয়ে যান। রেজিস্টার খুললেই, সুকুমার তুই বুঝতে পারবি। তখন অবশ্য নাটক শুরু হয়নি। ওয়াই টংয়ের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। কলকাতায় এসে ছবিটা দেখবেন বলে প্রোগ্রাম করেও তিনি পিছিয়ে যান। ঠিক সেই সময়টায় গৌরীশঙ্করবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয় পকেটমার—কাম—ছবিচোর—কাম—তোর—আমার পরিচিত সেই লোকটার। আসল ছবিটা এক কোটি টাকায় বিমা করিয়ে রেখেছিলেন গৌরীশঙ্করবাবু। বিমা কোম্পানির এক মহিলা কর্মী মাঝে—মাঝে এসে প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে যেতেন। এই মহিলা কর্মীর স্বামীই হলেন নাটের গুরু। স্ত্রী—র সূত্রে গৌরীশঙ্করবাবুর সঙ্গে আলাপ। পরে সেটা ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে দাঁড়ায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে লোকটা গৌরীশঙ্করবাবুর মতো ভদ্রলোককে বুঝিয়ে ফেলে বিমা কোম্পানিকে ঠকিয়ে এক কোটি টাকা পাওয়া সম্ভব। এই যে ফোন করে তোকে চমকানো, সুদীশকেও হুমকি দেওয়া—এসব ওই ছকেরই অন্তর্গত। বিমা কোম্পানির কাছে যাতে পুরো ঘটনাটা গুরুত্ব পায়।”
সুদীশ চোয়াল শক্ত করে বলল, ”কে রে সেই লোকটা?”
বললাম, ”এই ঘরের মধ্যেই সে বসে আছে। তোর ডান দিকে। বাচ্চু মিত্তির ওরফে দুলাল মিত্র। আমার ‘টু রেড ফ্রেন্ড’। ব্যারাকপুরে থানার ওসি সুবিনয়বাবুর সঙ্গে সুড়সুড় করে চলে এসেছে।”
সুকুমার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”বাচ্চু তুই?”
বললাম, ”দাঁড়া, দাঁড়া। এখনই উত্তেজিত হোস না। আমাকেও টেস্ট করতে চেয়েছিল। পুরো ছকটা তোদের জানিয়ে দেওয়া দরকার। একজন সত্যান্বেষীর চোখে কোনও কিছুই লুকনো যায় না। তোর মুখে আজ দুপুরে যখনই শুনলাম, বাচ্চু ব্যাঙ্কে এসেছিল, তখনই সন্দেহটা হয়। তারপর ওই বেলুন—রহস্য। ছাদে উঠে আমরা দু’জন দেখলাম, বেলুনটা নেই। নাইলনের দড়ি কেটে কেউ বেলুনটাকে উড়িয়ে দিয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগল, বেলুনটা উড়িয়ে দেওয়ার পেছনে কার কী স্বার্থ থাকতে পারে? লিফটে করে নামার সময় হঠাৎই মাথায় খেলে যায়, চোরের পক্ষে বেলুন মারফত ছবিটা পাচার করা সম্ভব। দোতলা থেকে নীচে নেমে ছবিটা নিয়ে পুলিশের নজর এড়িয়ে বাইরে চলে যাওয়ার থেকে, ছাদে উঠে বেলুনের সঙ্গে ছবিটা বেঁধে দিয়ে পাচার করা অনেক সহজ।”
সুদীশ বলল, ”তা হয় নাকি? বেলুনটা উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে পড়বে, চোর সেটা জানবে কী করে?”
”এই প্রশ্নটা আমার মনেও তখন জেগেছিল। কিন্তু চোর যদি আবহাওয়া দফতরের লোক হয়, আগে থেকে বাতাসের গতিপ্রকৃতি জেনে থাকে, তা হলে মোটামুটি তার পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব, বেলুনটা কোনদিকে এবং কতদূরে গিয়ে নেমে আসতে পারে। সুকুমার, তোদের এই বাড়ির ছাদ থেকে নেমেই সঙ্গে—সঙ্গে আমি দমদমের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে ফোন করি। ওখানে আমার এক আত্মীয় আছে, সুপ্রতিম। তাকে বেলুনটার কথা জানালাম। মিনিট পাঁচেক পরই ও বলল, রেডারে একটা বেলুন ধরা পড়েছে। সেটা ব্যারাকপুরের দিকে যাচ্ছে। বেলুনটা অনেক নীচে নেমে এসেছে। সম্ভবত কাছাকাছি কোথাও পড়বে। বেলুনটা নিয়ে কেন আমি এত আগ্রহী, সেটা ওকে জানাতেই সুপ্রতিম বলল, চিন্তা করার কিছু নেই। আশপাশের কয়েকটা থানায় খবর দিয়ে রাখছি। পুলিশই নজরে রাখবে। বেলুনসহ ছবিটা ফেরত পাওয়া যাবে।
”এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না আমার। রোজ সকালে ও বিকেলে দমদম থেকেই আবহাওয়া দফতরের লোকেরা একটা করে বেলুন ছাড়ে। আবহাওয়ার খবর নেওয়ার জন্য। সেই বেলুন অবশ্য অনেক ওপরে উঠে ফেটে যায়। ওর মধ্যে যেসব যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়, সেগুলো নীচে এসে পড়লে, পুলিশই তা উদ্ধার করে দমদমে আবহাওয়া অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এই সিস্টেমের জন্য সুপ্রতিমদের সঙ্গে বিভিন্ন থানার যোগাযোগ আছে। ঘণ্টাখানেক পর ও—ই মোবাইলে ধরে আমাকে বলল, বেলুনসহ ছবিটা পাওয়া গেছে। ব্যারাকপুর থানার পুলিশ একটা লোককে ধরেও এনেছে। নাম, দুলাল মিত্তির। সেই লোকটা নাকি বেলুনটাকে ফলো করে ব্যারাকপুর পর্যন্ত যায়। ছবি খুলে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল। আবহাওয়া অফিসের নির্দেশে লোকটাকে পুলিশ আটকে রেখেছে। তখনই থানায় ফোন করে ওসি সুবিনয় মণ্ডলকে আমি অনুরোধ করি, দুলালকে এখানে নিয়ে আসার জন্য।”
আমাকে থামতে দেখে সুকুমার বলল, ”ছিঃ বাচ্চু, তুই এইসব মতলবে আমার এখানে আসতিস?”
ওকে চটে উঠতে দেখে বললাম, ”না, আরও একটা কারণ ছিল। তোর সঙ্গে হঠাৎ ঘনিষ্ঠতার কারণ, পাঁচটা ভাল লোকের সান্নিধ্যে আসা। যাঁরা ওর স্ত্রীর সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট হতে পারেন।”
সুকুমার বলল, ”তুই ঠিক বলছিস কালকেতু। আমি ওর বউকে অনেক সাহায্য করেছি।”
এতক্ষণ পর বাচ্চুকে আমি বললাম, ”তুই আর বদলালি না রে! স্কুল লাইফে হেডসারের পকেট মেরে একবার তুই সারকেই পার্সটা ফেরত দিয়ে বলেছিলি, কুড়িয়ে পেয়েছি। মনে আছে? সেদিন আমরা তোর সাহসের খুব তারিফ করেছিলাম। সেটা ছিল ছেলেবেলার দুষ্টুমি। বড় হয়ে এখন যা তুই করছিস, সেটা অপরাধ। আজই তোর সম্পর্কে আমি তোর আবহাওয়া দফতরের অফিসে অনেক খোঁজখবর নিয়েছি। দু’জনকে চাকরি করে দেওয়ার নাম করে তুই টাকা হাতিয়ে ফ্রড করেছিস। গৌরীশঙ্করবাবুকে টাকার লোভ দেখিয়ে বেআইনি কাজে নামিয়েছিস। সুকুমারের মতো একটা ভাল ছেলেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিস। পুলিশকে অযথা হ্যারাস করেছিস। কেন এসব ফালতু কাজ করতে গেলি বল তো?”
সুদীশ লাফিয়ে উঠে বাচ্চুর কলার ধরে বলল, ”চল, লালবাজারে চল। ওখানে তোমার ব্যবস্থা হবে।”
মিনিট দশেক পর ঘর ফাঁকা হলে গৌরীশঙ্করবাবু বললেন, ”আমার খুব খারাপ লাগছে কালকেতুবাবু। আমার মতিভ্রম হয়েছিল। ছেলেটা এমনভাবে আমাকে কনভিনসড করল, আমি সায় দিয়ে ফেললাম। বলল, আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। বিমা কোম্পানি থেকে যে টাকা পাবেন, তার টেন পার্সেন্ট আমায় দেবেন। ওদের লোকজনকে টাকা দিতে হবে।”
সুকুমার বলল, ”একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না কালকেতু। বাচ্চু নকল ছবিটা উদ্ধার করতে গেল কেন?”
আমি কিছু বলার আগেই গৌরীশঙ্করবাবু বললেন, ”ছবিটা আমার কাছে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।”
সুকুমারের অফিস থেকে উঠে আসার আগে হঠাৎই চোখে পড়ল, মোবাইল ফোনের একটা সেট টেবিলের ওপর পড়ে আছে। দেখেই চিনলাম, সুদীশের সেট। তুলে বুকপকেটে চালান করার ফাঁকে ঠিক করলাম, সুদীশের ঘাড় ভেঙে একটা লাঞ্চ খেতে হবে।