বেলুনে ঝন্টুমামা
এ কথা কারও বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, ঝন্টুমামার সময়টা খারাপ যাচ্ছে। পৃথিবীর দুর্গমতম স্থানে ক্ষুদ্রতম কীটের ছবি তোলা জাতীয় অভিযানে যিনি সিদ্ধহস্ত, তাঁর পক্ষে মাস ছয়েক ঘরে বসে কাটানো নিশ্চয় বিরাট শাস্তি!
বাড়ির সদর দরজার সামনে পৌঁছেই নিলয় বলল, দেখছিস তো?
নিলয় না বললেও চোখে পড়ত যে সেই পেটেন্ট বায়ুচালিত কলিং বেলের চিহ্ন নেই।
দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখা গেল ভোলাই আছে। ভেতরে পা দিয়ে মানুষজনের চিহ্ন চোখে পড়ে না। বাইরের ঘর থেকে ভেতরের উঠোনের সংলগ্ন বারান্দায় পা দিলাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই। চোর-জোচ্চোর জানতে পারলে বাড়ি ফাঁকা করে দেবে তো!
বাঁ-দিকের বারান্দায় প্রথম দুটো ঘর ঝন্টুমামার গবেষণাগার। খোলা জানলা দিয়ে উঁকি দিতেই বুঝলাম, চোরের আগে ঝন্টুমামা স্বয়ং ঘর সাফাইয়ের কাজ শেষ করে রেখেছেন।
-বুঝলি, ঝন্টুমামা নিশ্চয় ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য…
–কিন্তু এত বড় ক্রাইসিস সত্ত্বেও ঝন্টুমামা আমাদের কিছু জানালেন না…
–শুধু তা-ই নয়। যে গবেষণাগার ওঁর প্রাণ…
–কিন্তু ঝন্টুমামা কোথায়?
পাশের ঘরটায় উঁকি মেরে দেখি, ফোল্ডিং ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে একটা মোড়ার ওপর পা তুলে ঝন্টুমামা বই পড়ছেন। পেপারব্যাক বইটা মলাট সমেত ভাঁজ করে শুধু বাঁ হাতে ধরে রয়েছেন। ডান হাত ঘাড় আর ইজিচেয়ারের মাঝে তেকোনা ভাঁজ করা। স্ট্যান্ড ল্যাম্পের প্রাচীন ঘেরাটোপ থেকে মলিন আলো ফুট চারেকের এক বৃত্তের মধ্যেই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
ঝকমকে দুপুরে অন্ধকার ঘরে সেঁধিয়ে কী পড়ছেন ঝন্টুমামা?
দরজার পাল্লা খুলতেই ঝন্টুমামা মুখের সামনে থেকে বই সরিয়ে তাকালেন, তোরা? আয় আয়!
ঝন্টুমামা বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন, বুঝলি, এডগার অ্যালান পো পড়ছিলাম। সত্যি দুপচাঁই কারেক্ট–বুদ্ধিচর্চার পক্ষে অন্ধকারের জুড়ি নেই।
ভালো লাগল। গুড ওল্ড ঝন্টুমামা। ভাঙবে তবু মচকাবে না।
অবান্তর এ কথা-সে কথার ভদ্রলোকি ভূমিকার পর নিলয় খুব সন্তর্পণে প্রস্তাবটা পেশ করল। ঝন্টুমামার অভিমান বাঁচিয়ে।
-ভালো কথা ঝন্টুমামা। এক ভদ্রলোক খুব বিপদে পড়ে এসেছিলেন আমার কাছে। খুবই পরিচিত মানুষ। বিরাট এক বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের মালিক। বহু অ্যাপইনমেন্ট রয়েছে। অথচ ট্যালেন্টেড ফোটোগ্রাফার পাচ্ছেন না। আমি অবশ্য প্রথমেই বলে দিয়েছি যে, ঝন্টুমামাকে চাকরি অফার করার কথা পাড়াও একটা দুঃসাহসের ব্যাপার…।
দুঃসাহস? কেন? মোটেই তা নয়। ভালো চাকরির অফার নিশ্চয় আমি বিবেচনা করব। ঝন্টুমামা উঠে দাঁড়িয়ে যোগ করলেন, দাঁড়া, চায়ের ব্যবস্থাটা করে আসি।
এত সহজে চাকরি নিতে রাজি করানো যাবে, ভাবতেও অবিশ্বাস্য ঠেকে। নিলয়ের দিকে তাকাই। ওর মনের কথাটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। একদিক থেকে যেমন কিছুটা নিশ্চিন্ত, তেমনি সন্দেহেরও আর কোনও অবকাশ নেই যে, সত্যিই ঝন্টুমামা প্যাঁচে পড়েছেন।
ঝন্টুমামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বললেন, ল্যাবরেটরির পাট তুলে দিলাম, বুঝলি? লক্ষ করেছিস কি?
আমরা কোনও উত্তর দিলাম না।
–তোরা অমন করুণ চোখে তাকাচ্ছিস কেন? আরে না, ডার্করুম স্টুডিয়ো ওসব ঠিকই আছে। ভেবে দেখলাম, এ যুগে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার জোরে কোনও বিজ্ঞানী, তার যতই প্রতিভা থাকুক, কিছুই করতে পারবে না। নিউটন, আইনস্টাইন আর জন্মাবেন না। এখন সরকার বা মালটিন্যাশনালরাই পুষবে বিজ্ঞানী।
-তা সেটা তো আর নতুন কথা কিছু নয়…
-নতুন কথা নয়, কিন্তু নতুন করে উপলব্ধি করলাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণার বদলে বিজ্ঞাননির্ভর অনুসন্ধানের কাজ চালানোটাই ব্যক্তিগত সীমার মধ্যে সম্ভব এবং করণীয়।
–কিন্তু শুনলাম যে, কিছুদিন ধরে বাড়িতে বসে আছেন, কোথাও বেরচ্ছেন না…
খুব সত্যি। বেজায় একটা কাজে ফেঁসেছিলাম। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের কাজ আগেও করেছি, কিন্তু এবারে বিরাট ব্যাপার। এই কাল সব ছবি ছাপার কাজ শেষ হবে। আমাদের মুখের অবস্থা দেখেই বোধহয় ঝন্টুমামা ব্যাপারটা অনুমান করে নিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করেন। তোরা কি ভেবেছিস যে, টাকার অভাবে ল্যাবরেটরি তুলে দিলাম? ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের এই একটা অ্যাসাইনমেন্টেই দু-বছর বসে খেতে পারি। তবে এটা ঠিক যে, টানাটানি সত্যিই যাচ্ছিল। চাকরিও একটা তাই নিয়েছিলাম।
–আপনি চাকরি নিয়েছিলেন?
-তা বলতে পারিস। চাকরি নিয়েছি, ছেড়েছি এবং নেওয়া ও ছাড়ার মাঝখানেই এই বিরাট সুযোগটাও জুটে গেছে। তাই বলছিলাম, চাকরিমাত্রেই খারাপ নয়। সময়মতো ছাড়তে জানলে চাকরিতে ঢোকা বেশ লাভজনক।
চা আসার পর ঝন্টুমামা গল্প শুরু করলেন।
.
হঠাৎই এল অফারটা। অপরিচিত দুটো মুখ-কর্ড আর জিনের প্যান্ট–একজনের চেন অন্যজনের চোখে মেটালিক ফ্রেমের চশমা এবং দাড়ির সমাহার–বাড়িতে এসে হাজির।
আমার ফোটোগ্রাফিচর্চা সম্বন্ধে অনেক খবর রাখে দেখলাম। বিনয়ে বিগলিত। প্রশংসার আর শেষ নেই। নানা অলিগলি দিয়ে কথা ছুটিয়ে কাপের চা ফোরাতে শেষে আসল জায়গায় পৌঁছাল, আমরা এভরি হোয়্যার থেকে আসছি।
এভরি হোয়্যার শুনেই মনে পড়ে গেল। গত বছরের খবরের কাগজে প্রকাশিত সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দুটি নিউজ ফোটোগ্রাফের নিচে এই নাম দেখেছিলাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথা থেকে প্রচণ্ড ঝড়ে পরি খসে পড়েছে আর লিলুয়ার কাছে এই শতাব্দীর বৃহত্তম রেল দুর্ঘটনার চরম মুহূর্তের অবিশ্বাস্য ছবি। শুধু স্থিরচিত্র নয়, পরে টেলিভিশনেও দেখেছি। ওরা ভিডিয়ো ক্যামেরাতেও ছবি তুলেছিল।
সত্যি বলতে এই দুই দুর্ঘটনা রাতারাতি একেবারে নো হোয়ার থেকে এভরি হোয়ার বিজ্ঞাপন তথা সংস্থাকে একেবারে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। কাজেই এভরি হোয়্যার-এর নাম শুনেই একটু নড়েচড়ে বসলাম।
দুই তরুণ নিজেদের পরিচয় দিল। দু-জনেই কোম্পানির জুনিয়র পার্টনার। সাহা আর মুখার্জি।
জানতে চাইলাম, হঠাৎ আমাকে কেন?
–হঠাৎ! হঠাৎ বলবেন না। কোন এজেন্সি না আপনাকে পেতে চায় বলুন? কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই যে সংগতি থাকবে এমন তো নয়।
বুঝলাম, ওরা নিজেদের সংগতির কথাটা জানিয়ে দিল।
–আমরাও প্রথম দিন থেকেই স্বপ্ন দেখেছি, আপনাকে নিজেদের দলে পাব। এবার…
কিন্তু আপনাদের কি ফোটোগ্রাফারের অভাব আছে? তা ছাড়া আমি তো স্টিল ছাড়া…
সাহা চেয়ারের ডগায় এগিয়ে এসে নাটকীয়ভাবে বলল, প্লিজ! ও কথা বলবেন না। আমরা নাকি তাই দুটো সাংঘাতিক ঘটনার মুহূর্তে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু ছবির কোয়ালিটি কী হয়েছে, সে তো আমরা জানি। বলুন না, আপনি যদি ওই ছবি তোলার সুযোগ পেতেন…।
যুক্তিটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তাই চুপ করেই রইলাম।
মুখার্জি বলল, আমাদের পরিকল্পনাটা আগে শুনুন। তারপরে আপনার সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা একটুও জোর করব না।
সত্যিই ফ্যান্টাস্টিক পরিকল্পনা। আগামী বছর অর্থাৎ ১৯৯০-এ সাহেবি মতে কলকাতার তিনশো বছর পূর্ণ হবে। কলকাতাকে তার জন্মদিনে উপহার দেওয়ার জন্য ওরা তৈরি হচ্ছে। তিনটে বড় বড় কোম্পানি ঢালছে টাকা। ইন্ডিয়া এরোনটিক লিমিটেড ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে বিশাল এক স্বয়ংক্রিয় বেলুন। সেই বেলুনে চড়ে সাত দিন ধরে কলকাতার মাথায় টহল দিতে দিতে অবিরাম তোলা হবে ছবি–স্টিল এবং ভিডিয়ো দুই। এক অদ্ভুত অভিনব ফোটোগ্রাফিক অভিযান। শুনতে শুনতেই মনে পড়ল, অজন্তা গুহার ছবি তোলার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবার্ট গিল এইরকম বেলুনে আরোহণের ফন্দি এঁটেছিলেন।
আর কোনও কথা নয়। রাজি হয়ে গেলাম। এক বছরের কনট্রাক্ট। সঙ্গে সঙ্গে চেক বুক খুলে দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করে দিল। বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই খবর দেবে।
কিন্তু কয়েকদিনের জায়গায় প্রায় মাস ফোরাতে চলল, কারও কোনও পাত্তা নেই। একটু অবাক লাগল। এত টাকা খরচ করে শুধু বসিয়ে রাখবে? অবশ্য এজেন্সি লাইনে সেটাও অসম্ভব নয়। আমাকে যাতে অন্য কোম্পানি ব্যবহার করতে না পারে… কিন্তু সেরকম কোনও কাজ তো আমার হাতে ছিল না। বারবার মনে পড়তে লাগল, কনট্র্যাক্ট ফর্মে ক্যাপিটাল হরফে টাইপ করা ছিল–এই বছরের মধ্যে আমি আর অন্য কোনও কমার্শিয়াল কাজ করতে পারব না।
ঘুরতে ঘুরতে নিজেই একদিন চলে এলাম চৌরঙ্গি প্লেসে ওদের অফিসে। ছোট্ট অফিস, কিন্তু আধুনিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধা। ছোট ছোট কিউবিকল। এয়ারকন্ডিশন্ড ঝকঝকে চেহারা। এমনকী যে চা দিচ্ছে, সে-ও একেবারে ফিটফাট নিখুঁতভাবে দাড়ি-চাঁচা দিশি সাহেব।
আগন্তুকের স্লিপ পাঠাতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল সাহা আর মুখার্জি, আসুন! আসুন!
সটান নিয়ে এল ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরে। মিস্টার উপাধ্যায় টেবিল ছেড়ে উঠে এসে ঘরের এক কোণে নরম খয়েরি সোফায় আমাকে বসালেন। সাহা ও মুখার্জিও বসল। চা-কোল্ড ড্রিঙ্ক মামুলি কথাবার্তা। কাজের কথা তুলব তুলব ভাবছি, উপাধ্যায় গলার টাইয়ের নটটা একটু আলগা করে নিয়ে বাঁ-দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, মার্সিডিজটা এতক্ষণে ফিরে আসার কথা?
–এসে গেছে। আধ ঘণ্টা হল।
–ও! তাহলে তো আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।
আমার দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ঘণ্টা দুয়েক সময় দিতে পারবেন? ইন ফ্যাক্ট, আজই আমাদের বেলুনটা ইন্সপেক্ট করতে যাওয়ার কথা। অবশ্য হ্যান্ডওভার হতে আরও দিনদশেক বাকি। ভেবেছিলাম, সব রেডি হলে আপনাকে জানাব। কিন্তু এসেই যখন পড়েছেন…
এয়ারকন্ডিশন্ড মার্সিডিজ ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে এল ব্যারাকপুরে। ঢেউ-টিন ঘেরা বিরাট একটা চত্বরে ঢুকে পড়েছি। তিনজন সিকিয়োরিটি গার্ডের অভিবাদন পেরিয়ে একটা কারখানার শেডের দরজায় এসে দাঁড়াল গাড়ি। বন্ধ জানলার কাছে চোখ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছি দেখে ইতিমধ্যে উপাধ্যায় বলেছেন, সরি মিস্টার সেন। আমারই ভুল। বেলুন দেখানোর কথা বলাটা ঠিক হয়নি। বেলুন তো এখনও গ্যাস ভরাই হয়নি, পাট করে রাখা আছে। আসলে আমরা গন্ডোলাটা দেখতে এসেছি।
গন্ডোলা শুনে মনে মনে দুর্গাপুজোর সময়ে ছাড়া গ্যাস বেলুনের তলায় শুধু একটা বেতের ঝুড়ি গোছের এঁটে দিয়েছিলাম। আসল জিনিসটা দেখে তাজ্জব। এটাকে আকাশে ভাসিয়ে তুলবে বেলুনে করে? কত বড় বেলুন ভাবতে ভাবতেই ঢুকে পড়েছি প্রায় পটোলের আকৃতি গন্ডোলার মধ্যে। দু-ধারে টানা কাচের শার্সি-আঁটা বারান্দা মুখ বা লেজের দিকে আবার এরোপ্লেনের মতো প্রপেলার। উপাধ্যায় বুঝিয়ে বলেন, বেলুনটাকে ইচ্ছেমতো পরিচালিত করার যান্ত্রিক ব্যবস্থাও আছে। শুধু হাওয়ার মর্জিমাফিক চলতে হবে না আমাদের।
–তা এত কাণ্ড না করে তো একটা হেলিকপ্টার ভাড়া নিলেই হত।
উপাধ্যায় হেসে বললেন, সে কথা কি আর ভাবিনি? প্রথমত, সামরিক বিভাগ পারমিশন দেয়নি। দ্বিতীয়ত, যেসব কোম্পানি আমাদের অর্থসাহায্য করছে, তাদের নাম-লেখা বেলুনে চড়ে উড়ে বেড়ালে তাদের প্রচারের উদ্দেশ্য বেশি সফল হবে।
বেলুন থেকে দিনে বা রাতে ছবি তোলার সুবিধা করার জন্য দেখলাম আয়োজনের কোনও অভাব নেই। আরও বুঝলাম, দিন সাতেক এই বেলুনেই খাওয়াদাওয়া-শোয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। ইঞ্জিন রুমটায় শুধু ঢুকতে দিল না। বাকি সব দেখে বেরিয়ে এলাম।
গন্ডোলা পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসার পর আবার দু-মাস ওপাশে সব চুপচাপ। ফের সকালে একদিন হাজির হলাম আমার চাকুরিদাতার অফিসে। আবার উপাধ্যায়ের ঘর। দু-চারটে কথার পর একটা ফোন এল, উপাধ্যায় আমাকে একটু বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে এধার-ওধার চোখ বোলচ্ছি, হঠাৎ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর কাচের ঢাকনা দেওয়া সুন্দর কয়েকটা প্ল্যাস্টারের মডেল চোখে পড়ল। উঠে গিয়ে দেখি কলকাতার বিখ্যাত সব বাড়ি বা অট্টালিকা কি সৌধের ছোট ছোট মডেল। নিখুঁত হাতের কাজ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ল, টাউন হল, মনুমেন্ট। কাচের ঢাকনা সমেত মনুমেন্টের মডেলটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে গেছি, অমনি সেটা একেবারে দু-টুকরো। চটপট সেটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে আবার সোফায় যথাস্থানে এসে বসে পড়লাম। ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলেনি! কয়েক মিনিটের মধ্যেই উপাধ্যায় ফিরে এলেন। আমাদের যাত্রার দিনক্ষণ ও কাজের আলোচনা সেরে ঘন্টাদুয়েক বাদে বেরিয়ে এলাম।
বেলুনে চড়ে আকাশে ওড়ার জমজমাট অনুষ্ঠানের কথা তো সবাই জানে। খবরের কাগজে ফলাও করে তার বিবরণও ছাপা হয়েছিল ছবি সমেত। তোমরাও পড়েছ নিশ্চয়। কিন্তু বেলুনের আরোহীদের মধ্যে আমি ছিলাম, জানতে না। আর জানতে না–কেউই প্রায় জানে না কেন হঠাৎ অভিযান পরিত্যক্ত হল। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা খবরের কাগজে লিখেছে বটে কিন্তু সেটা ধাপ্পা দেওয়ার জন্য।
প্রথম দিন শুধু টহল। কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। দিনে এবং রাতে। ছবি তোলার হিসেবনিকেশ। পরিকল্পনা। অদ্ভুত লাগছিল। চেনা শহরেরই অচেনা রূপ। অভিনব দৃষ্টিকোণের মজা। রাত আটটায় নেমে এলাম আমরা। আবার পরের দিন ভোর পাঁচটায় কলকাতার মাথায় চড়ব।
ভোর থেকেই ছবি তোলা শুরু। দুপুরে এসে পৌঁছালাম মনুমেন্টের কাছে। বেলুনটা এবার নেমে এল তার মাথা ঘেঁষে। ভিডিয়ো ক্যামেরাম্যান রায় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, দেখুন দেখুন, কত ইঁদুর। সত্যিই তো, মনুমেন্টের পাদদেশে ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর অনবরত গর্তে সেঁধাচ্ছে আর বেরচ্ছে। ক্যামেরার টেলি লেন্সে চোখ দিয়েই বেশ বুঝতে পারছি। বহু লোক জমেছে, তাদের রীতিমতো খাতির করে খাওয়াচ্ছেও। কার্জন পার্ক ছেড়ে এরা আবার এখানে ডেরা বাঁধল কবে!
ইঁদুর নিয়ে রায়ের এত মাথাব্যথার কারণ বুঝিনি তখন। এদিক-ওদিক চরকি মেরে সন্ধেবেলা ফের বেলুন এসে দাঁড়াল মনুমেন্টের মাথায়। রায় এখনও চালিয়ে যাচ্ছে ইঁদুর পর্যবেক্ষণ।
সেদিনের মতো কাজ সেরে ব্যারাকপুরের মাঠে অবতরণের পর গন্ডোলা ছেড়ে তখন সবাই নেমে গেছে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলেছি। ভাবলাম এই সুযোগ। রায়ের ভিডিয়ো ক্যাসেটটা দেখতে ভারী অদ্ভুত। মুখে বলেওছিলাম একবার, কিন্তু আমাকে ঘেঁষতে দেয়নি। সবে ক্যামেরার লেন্সটার কাছে চোখ নিয়ে গেছি, পেছন থেকে এক গম্ভীর গলা চমকে দিল, চলে আসুন মিস্টার সেন!
পরের দিনও আবার যথারীতি শুরু হল অভিযান। হাওড়া ব্রিজকে বাদ দিয়ে (প্রতিরক্ষার খাতিরে) হুগলি নদীর বহু ছবি তুলে আবার দুপুরে ফিরে এলাম আমরা সেই মনুমেন্টের কাছে। রায় হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, মাই গড! এ কী!
রায়, মুখার্জি ও আমি সকলেই উদগ্রীব। রায় ক্যামেরাতে চোখ লাগিয়েই বলল, ওই নীল ডোরাকাটা জামা গায়ে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন। মারাত্মক ক্রিমিনাল–আতঙ্কবাদী। ইঁদুরের গর্তের মধ্যে কী যেন করছে। নিশ্চয় মতলব খারাপ। ওহ হো…
–সামথিং ইজ গোয়িং টু হ্যাঁপেন। শিগগির মিস্টার সেন–তৈরি হয়ে থাকুন–মুখার্জি চাপা গলায় বলে উঠল। তারপরই পেছন ফিরে বলল, আমাকে এক্ষুনি ওয়্যারলেসে খবর পাঠাতে হবে লালবাজারে।
গন্ডোলার ভেতরে ইঞ্জিন রুমে জেনারেটরের ধরধর আওয়াজ এখানেও ভেসে আসছে। আর দেরি নয়। টেলিলেন্স থেকে চোখ না সরিয়েই বাঁ পা দিয়ে বার পাঁচেক ঠোক্কর কষিয়ে সব কটা সানগানের আলোর সুইচ অন করে দিলাম। হ্যাঁ, তখন দুপুরবেলা, তবু সুইচ টিপলাম। এবং সুইচ টিপতেও আলো জ্বলল না।
রায়ের আতঙ্কবাদী তখন ইঁদুরের সঙ্গে খেলা শেষ করে গুটিগুটি পায়ে প্রস্থান করছে। রায় তার ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাক করে রয়েছে মনুমেন্টের দিকে।
দৌড়ে বেরিয়ে এল মুখার্জি। রায় অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, কী হল? ব্যাপারটা কী?
নিচু গলায় মুখার্জি বলল, ফুল পাওয়ার অন করেছি, কিন্তু হচ্ছে না… মেকানিক্যাল ট্রাল। তার কণ্ঠস্বরে চরম হতাশা।–ট্রাই এগেন ইউ ফুল!
মুখার্জি আবার ছুটে চলে গেল।
সেদিনের অভিযান আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পরিত্যক্ত। শুনলাম, জেনারেটরের যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে আবার কাল আমরা অভিযানে বেরব।
ব্যারাকপুর থেকে মার্সিডিজে করে ফেরার পথে বললাম, মিস্টার রায়, আমি না সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। ইঁদুরের গর্তে ডিনামাইট স্টিক পুরে পুরো মনুমেন্টটাকেও বোধহয় উড়িয়ে দেবে ভেবেছিলাম। কেলেঙ্কারির একশেষ।
রায় কোনও উত্তর দিল না।
আমি আবার বললাম, যা-ই হোক, আপনার ওয়্যারলেসে লালবাজারকে নিশ্চয় সতর্ক করে দিয়েছেন?
কোনও উত্তর নেই।
এসপ্ল্যানেডেই নেমে পড়লাম চাংওয়াতে খেয়ে বাড়ি ফেরার অজুহাতে। তারপর ওয়্যারলেস সংবাদের ওপর ভরসা না করে নিজেই চলে এলাম লালবাজারে।
পরের দিন ভোরের আলো না ফুটতেই আবার অভিযান। তবে এবার আর বেলুনে চড়ে নয়। পুলিশের এ বি সি ডি ইত্যাদি যাবতীয় কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে ব্যারাকপুর ফিল্ডে। রায়, মুখার্জি ও উপাধ্যায়–মার্সিডিজ থেকে নামার আগেই গ্রেপ্তার। সাহাকে পেলাম গন্ডোলায়।
তারপর আর মিনিট পনেরোর কাজ। রায়ের ভিডিয়ো ক্যামেরাটা যে ছবি তোলার জন্য নয়, সেটা বোঝাতে আর কতক্ষণ লাগে! ওটা আসলে একটা বিশেষ যন্ত্র, যার সাহায্যে উচ্চশক্তিসম্পন্ন আলট্রাসনিক তরঙ্গ নিক্ষেপ করা যায়। জেনারেটরটা গড়বড় না করলে মনুমেন্টকে কালই ওরা দু-টুকরো করে আছড়ে ফেলে আশ্চর্য সব ছবি তোলার সুযোগ নিতে পারত। ভিক্টোরিয়ার পরি নিপাত বা ওই রেলওয়ে অ্যাক্সিডেন্টও আসলে দুর্ঘটনা নয় –ঘটানো হয়েছিল। এবারও ঠিক তা-ই হত আর দোষ পড়ত আতঙ্কবাদীদের ওপর। হ্যাঁ, ইঁদুরের গর্তে কিছু বিস্ফোরক ভরা হয়েছিল ঠিকই। মনুমেন্ট ভেঙে পড়ার মুহূর্তে মাটিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হত একটা। কিন্তু সে শুধু চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য। মাটির নিচে ডিনামাইট ফাটিয়ে মনুমেন্টকে উপড়ে ফেলার চেয়ে সেটা মাঝখান থেকে দু-টুকরো হয়ে যাচ্ছে–ফোটোগ্রাফির চোখে ব্যাপারটা আরও শিল্পসম্মত হত। ঠিক যেমনটি দেখেছিলাম উপাধ্যায়ের ছোট্ট মডেলটায়, সেটা ভাঙাই ছিল। জোড়ে জোড় মিলিয়ে রাখা।
গল্প শেষ করে ঝন্টুমামা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, যা-ই হোক, আমি চাকুরিদাতাদের কাছে দুটো ব্যাপারে কৃতজ্ঞ–দশ হাজার টাকা আর বেলুনে চড়ে ছবি তোলার সুযোগ। ওই ছবিগুলোই ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকে…
নিলয় বলল, কিন্তু ওদের জেনারেটরটা যদি ঠিক সময়মতো বিগড়ে না যেত তাহলে তো…
ঝন্টুমামা ভুরু কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বললেন, নাও, ঠেলা সামলাও। তাহলে এতক্ষণ শুনলে কী? জেনারেটর বিগড়ে যাবে কেন? বললাম না, আমি পায়ে সুইচ টিপে সব সানগান জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম? তাতে আলো একটাও জ্বলেনি, কিন্তু আগেই এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম যে, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক রোধ–রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি হয়। একটাই জেনারেটর গন্ডোলার সব বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটাত, ফলে আলট্রাসনিক তরঙ্গ সৃষ্টির যন্ত্রাংশ শক্তির অভাবে চালু হতে পারেনি!
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮৮ পূজাবার্ষিকী]