আমার ছোটবেলার ময়মনসিংহে রথ আর উল্টোরথের মেলা হত। স্বদেশি বাজারের ফুটপাথে অষ্টমীর মেলা। বাবা আমাকে অষ্টমীর মেলায় নিয়ে যেতেন। বাবার আঙুল ধরে সারা মেলা অগাধ সুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।
বিন্নিধানের খই আর চিনির খেলনা কিনে দিতেন বাবা। আবদার করে মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশি আর রঙিন রঙিন হাতি-ঘোড়া কিনতাম। সে যে কী উত্তেজনা তখন, সেই মেলায়, সেই বেলায়, ছোটবেলায়!
কিশোর বয়সে যখন কবিতা লেখায় প্রাণ সঁপেছি, তখন রূপকথার গল্প শোনার মতো বইমেলার গল্প শুনতাম। ময়মনসিংহের ঘরবন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে লাল-নীল বাতি জ্বলা ঢাকা শহরের বইমেলা দেখতে যাওয়া, সত্যি বলতে কী, স্বপ্নেরও অতীত ছিল। ‘স্বপ্নের অতীত’ ব্যাপারটি কবে যে কখন ‘স্বপ্ন’ হয়ে ঘাপটি মেরে হৃদয় জুড়ে বসে রইল!
দীর্ঘ দীর্ঘ বছর সাধনার পর এক দিন আমার এই বেয়াদপ, বেশরম স্বপ্নটি সত্যি সত্যিই সত্যি হল, আমার বইমেলা দেখা হল। সেই থেকে বইমেলা। বইয়ের সুগন্ধের মধ্যে ডুবে থাকার বেলা। চৈত্র থেকে মাঘ পার করি ফাল্গুনের অপেক্ষায়। এগারো মাস দুঃখ সই একটি মাস আনন্দ করব বলে।
স্বর্গের যত সুখের কথা শুনেছি, মনে হয়নি কোনও সুখই একুশের বইমেলার সুখের কাছে দাঁড়াতে পারে। প্রতি বছর বইমেলায় বই বেরোচ্ছে আমার, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময়, মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পাঠ, তুমুল সেই দিনগুলোর মধ্যে হঠাৎ বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমির বিজ্ঞ, বিদগ্ধ বইমেলা কমিটির ফতোয়া— বইমেলায় আমার প্রবেশ নিষেধ। মেলায় আমার বই পোড়ানো হয় বলে, আমার ওপর হামলা হয় বলে মেলার পরিবেশ নাকি নষ্ট হয়— সেই কারণেই নিষেধ জারি। বছর আসে, বছর যায়, জাঁক করে বইমেলা হয়, বন্ধুরা মেলার উৎসবে মেতে থাকে, কেবল আমিই বসে থাকি ঘরবন্দি, একা। মন পড়ে থাকে মেলায়। এর পর মেলা দেখেছি অনেক। বিদেশের বইমেলা। কোনও মেলাতেই আমি নিষিদ্ধ নই, বরং আমন্ত্রিত।
যে-প্রাণটি আমি পৃথিবীর অন্য কোনও বইমেলায় খুঁজে পাইনি। পৃথিবীর তাবৎ ধনী দেশের ধনী মেলা দেখে এসে দরিদ্র দেশের দরিদ্র দেখতে মেলাকেই পৃথিবীর সব চেয়ে ধনী মেলা বলে মনে হয়েছে আমার। এই মেলাকে এত ভালবাসি, এর সঙ্গে আমার শৈশব-কৈশোরের প্রেম বলেই নয় শুধু, এই মেলার আলাদা একটি গন্ধ আছে বলে। যে-গন্ধটি আমাকে বলে দেয় আমি কে, কী আমার পরিচয়। গন্ধটি মাটির গন্ধ। মাটির কাছাকাছি না থাকতে থাকতে আমরা ভুলে বসে থাকি মাটির কাছে আমাদের ঋণ কতটুকু। বিদেশের বড় কোনও বইমেলাই তো মাঠে বা মাটিতে হয় না, হয় চার দেওয়ালের ভেতর। ওখানে চাইলেই আকাশ দেখা যায় না। বইমেলার উদ্দেশ্য বই কেনা-বেচা, উদ্দেশ্য বাণিজ্য। লেখক প্রকাশক— দু’তরফই টাকা-পয়সার হিসেব কষেন।
কিন্তু, বাংলার মেলায় আমি বাণিজ্যের গন্ধ পাই না, টাকা-পয়সার তুচ্ছ হিসেব-নিকেশের বাইরে যে বড় জিনিসটি আমি পাই, যা আমাকে চিরকালই মুগ্ধ করে, তা হল প্রেম, সাহিত্যের সঙ্গে মানুষের সত্যিকারের প্রেম। বছরভর পরিশ্রমের পর কোনও নতুন লেখকের একটি বই এসেছে, সেই লেখকের আনন্দ আর উত্তেজনার গন্ধ ভাসতে থাকে মেলায়। সেই গন্ধ আমি পাই।
হাজার হাজার মানুষের ভিড় এই মেলায়। বই কেনার সামর্থ্য না থাক, অন্তত বই দেখার, বই ছোঁয়ার, বই শোঁকার আনন্দ পেতে আসা মানুষ, মেলা থেকে বই কিনবে বলে সারা বছর মাটির ব্যাঙ্কে পয়সা জমানো মানুষ, দূর দূরান্ত থেকে বাসে চড়ে, ট্রেনে চড়ে, পায়ে হেঁটে আসা মানুষ— সেই মানুষের মুখ দেখি মেলায়। বইমেলা কেবল তো আর বইয়ের জন্য মেলা নয়, এ আরও অন্য কিছুর মেলা। পুরো বাংলা সংস্কৃতিকে যেন এক মাঠের মধ্যেই এক বিকেলে পাওয়া হয়ে যায়। এ আমাদের মিলন মেলা। বিজাতীয় সংস্কৃতি যখন গ্রাস করে ফেলে আমাদের নিজস্ব যা আছে তা, আমাদের গৌরবের সব চেয়ে বড় জায়গাটি, তখন আমরা যে ভাবে, যে ভালবাসায়, যে আদরে আঁকড়ে ধরি আমাদের হারিয়ে যেতে থাকা অস্তিত্বকে, তেমন করে এই মেলাকে আমরা বেঁধেছি প্রাণে। এই মেলার উচ্ছলতা আমাদের বুঝিয়ে দেয় আমরা আছি, খুব প্রচণ্ড বেঁচে আছি। কেবল বাঙালিত্বই কি সব? জাগতিক জাগরণের মেলাও তো এই মেলা। খোলা আকাশের নীচে খোলা হাওয়ায় হৃদয় খুলে কথা বলার স্বাধীনতার, মুক্ত চিন্তার মেলা।
যেহেতু বাংলাদেশের দরজা আমার জন্য বন্ধ, ঢাকার বইমেলায় আমি শত চাইলেও যেতে পারি না। এখন পশ্চিমবঙ্গই আমার স্বদেশ। কলকাতার মেলাই আমার মেলা। আমি বিশ্বাস করি না যে, দুটো-তিনটে মল্লিকা বিষম ক্রোধে আমাকে লাথি দিচ্ছে বলে সহস্র শাশ্বতী নেই ভালবেসে আমাকে আলিঙ্গন করার। ফতোয়া দেওয়া হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না এই মেলায় কেউ আমার মুখে কালি মাখাতে বা আমার মুণ্ডটি কেটে নিতে আসবে। কেন আসবে? আমি তো কোনও অপরাধ করিনি! ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি যে কারণে নিষিদ্ধ হল, যে দুটি পাতার কারণে, সে দুটি পাতায় আমি বানিয়ে কোনও গল্প লিখিনি। যা লিখেছি, ইসলামের ইতিহাসই লিখেছি। আমার মত যদি অন্যের মতের মতো না হয়, তাতে কী? ভিন্ন মত কি থাকতে পারে না? না কি থাকা উচিত নয়?
চোদ্দশো বছর আগে রচিত এই ধর্মটি নিয়ে আজকের যুগেও টুঁ শব্দটি করা যাবে না, করলে গর্দান যাবে, দাঙ্গা বাধাবে মুসলমানরা, এমনতরো কথা সাম্প্রদায়িকরাই বলে, এমনতরো কথা গোঁড়া মৌলবাদীরাই বলে— যারা মনে করে হিন্দুরা সভ্য শিক্ষিত সহিষ্ণু বলে নিজ ধর্মের সমালোচনা সইতে পারে, কিন্তু মুসলমানরা সইতে পারে না, কারণ তারা অজ্ঞ, অশিক্ষিত, অসহিষ্ণু। জগতের তাবৎ ধর্মের সমালোচনা সম্ভব, কেবল ইসলাম ধর্মেরই সম্ভব নয়— এ নিয়মটি যাঁরাই করেছেন, তাঁরা কিন্তু আর যারই মঙ্গল করছেন, মুসলমান সমাজের কোনও মঙ্গল করছেন না। মুসলমান নারীর মুক্তির পথেও তাঁরা বিষকাঁটা বিছিয়ে রাখছেন। অন্ধকারের দিকে যে-আলোটি ফেলা দরকার, সেই আলোটি তাঁরা ফেলতে দিচ্ছেন না, বরং কেউ আলো জ্বালাতে চাইলে ছলে বলে কৌশলে নিবিয়ে দিচ্ছেন।
আজ হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটির দুটো পাতা পড়লে মুসলমানরা নাকি দাঙ্গা বাধাবেন— এই ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের যে চরম অপমান করেছেন, এই অপমানের বিরুদ্ধে কী ভালই না হবে যদি মুসলমানরাই রুখে দাঁড়ান, যদি তাঁরাই হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ করে ‘দ্বিখণ্ডিত’-কে মুক্ত করে এনে দেখান যে, তাঁদের যেমন হীনম্মন্য ভাবা হয়, তাঁরা মোটেও তা নন।
জীবনে আমার সব চেয়ে বড় দুঃখ এই যে, যে-শহরটিকে আমি সব চেয়ে বেশি ভালবাসি, যে-শহরটি থেকে আমি সব চেয়ে বেশি ভালবাসা পাই, সেই শহরে আমাকে পুলিশ-বেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়। আমার যেমন ইচ্ছে, তেমন করে শহর জুড়ে ঘুরে বেড়াতে পারি না। একা একা, পায়ে হেঁটে, মানুষের ভিড়ে হারাতে চাই আমি, পারি না। ভারত সরকার আমাকে ভারত প্রবেশের অনুমতিই দেন এই শর্তে যে, আমার সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি থাকবে, থাকতেই হবে। গাড়ির প্যাঁ-পুঁ শব্দের যন্ত্রণা আমাকে সইতেই হবে। আবেদন করেছি এই বলে যে, আমার নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, তখন আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, বেশ ভাল কথা, তবে তোমার ভারত যাওয়ারও প্রয়োজন নেই।
অনেক দিন এই কলকাতায় আমি অবাধ্য হয়েছি, নিরাপত্তা প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওইটুকু মুক্তিতেই কত যে আনন্দ! আমি অতি সাধারণ এক মানুষ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাধারণ ভাবে মিশতে চাই। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে চাই। তাদের কথা লিখতে চাই। তা ছাড়া, আমার জন্য আমি চাই না, একটি মানুষও ব্যস্ত হোক বা একটি পয়সাও সরকারি তহবিল থেকে খরচ হোক।
নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে আমি কলকাতায় আসি। দীর্ঘ দিন পথ হারিয়ে এ দেশে ও দেশে ঘুরে ঘুরে অবসন্ন শরীর আর মন নিয়ে মানুষ যেমন ঘরে ফেরে, তেমন করে কলকাতায় ফিরি আমি। কলকাতার শীতল স্বচ্ছ জল সঞ্জীবনী সুধার মতো আমি প্রাণ ভরে পান করি। জীবন ফিরে পাই।
বড় স্বপ্ন ছিল কলকাতায় বাস করব। শহরের এক কোণে ছোট একটি ঘর থাকবে আমার। সে হল না। আমি নাকি ‘বিদেশি’, সে কারণে পাকাপাকি ভাবে একটি ঘরের বাসিন্দা হওয়া আমার সম্ভব নয়। বছর ধরে অনুমতি নেওয়ার কাজ চলছে, এখনও কোনও অনুমতি আমার ভাগ্যে জোটেনি।
আমার একটি ‘স্বপ্ন’ আছে, স্বপ্নটি কলকাতায় পা দেওয়ার পর থেকেই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই কলকাতায় আমি যেন আর দশটি সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করার স্বাধীনতা পেতে পারি, যে কেউ চাইলেই যেন আমার কাছে পৌঁছতে পারে, আমাকে স্পর্শ করতে পারে, আমি যেন দুর্লভ কিছু, দূরের কিছু না হই, আমি যে সবারই স্বজন, সবারই যে আত্মীয় আমি, তা যেন বোঝাতে পারি। আমার এই হাতদুটো, দুটো কাঁধ এক জন দুঃখিতারও দুঃখ মোচন করে যেন ধন্য হতে পারে।
এই প্রাণের প্রিয় কলকাতা শহরে কোনও প্যাঁ-পুঁ শব্দের গাড়ি নিয়ে যেন পথ চলার লজ্জা আমাকে আর পেতে না হয়, বইমেলার মাঠে যেন যে কোনও দর্শকের মতো অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারি, আমার সীমানা যেন মেপে দেওয়া না হয়, আমার নিরাপত্তার জন্য যেন কোনও প্রহরীর প্রয়োজন না হয়। মানুষের ভালবাসাই যেন আমার নিরাপত্তা হয়।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭ মাঘ ১৪১০ রবিবার ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪