বেলতলাতে দু-দুবার
বার্লিন শহরে ‘হিন্দুস্থান হৌসে’র আড্ডা সেদিন জমিজমি করেও জমছিল না। নাৎসিদের প্রতাপ দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। আড্ডার তাতে কোনো আপত্তি নেই, বরঞ্চ খুশি হবারই কথা। নাৎসিরা যদি একদিন ইংরেজের পিঠে দু-চার ঘা লাগাতে পারে তাতে অদ্ভুত এ-আর কেউ বেজার হবে না। বেদনাটা সেখানে নয়, বেদনাটা হচ্ছে দু-একটা মুখ নাৎসিকে নিয়ে। ফর্সা ভারতীয়কে তারা মাঝে মাঝে ইহুদি ভেবে কড়া কথা বলে, আর এক নাক-বাঁকা নীল-চোখে কাশ্মীরীকে তারা নাকি দু-একটা ঘুষিঘাষাও মেরেছে।
আড্ডার চ্যাংড়া সদস্য গোলাম মৌলা এসব বাবদে নাৎসিদের চেয়েও অসহিষ্ণু। বলল, আমরা যে পরাধীন সে-কথা সবাই জানে। তবে কেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া? এক ব্যাটা নাৎসি সেদিন আমার সঙ্গে তর্কে হেরে গিয়ে চটেমটে বলল, ‘তোমরা তো পরাধীন, তোমরা এসব নিয়ে ফপরদালালি কর কেন?’ নাৎসিদের তর্ক করার কায়দা অদ্ভুত।।
পুলিন সরকার বলল, তা তুই বললি না কেন, পরাধীন বলেই তো বাওয়া ভারতবর্ষে কলকজা বেচে আর ইনশিওরেন্স কোম্পানি খুলে দু’পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। ভারতবর্ষের লোক তো আর হটেনটট নয় যে স্বরাজ পেলেও কলকজা বানাতে পারবে না! জানিস, সুইজারল্যান্ডে এখনও জাপানী ঘড়ি বিককিরি হয়।
বিয়ারের ভিতর থেকে সুয্যি রায় বললেন,
‘নাই তাই খাচ্ছো,
থাকলে কোথা পেতে?
কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে।’
কাটা ন্যাজের ঘা’তে যে মাছিগুলো পেট ভরে খেয়ে নিচ্ছিল তারাও তাই নিয়ে গরুটাকে কটুকাটব্য করেনি। নাৎসিদের বুদ্ধি ঐ রকমেরই। যে হাত খাবার দিচ্ছে সেইটেকেই কামড়ায়। নাৎসিদের তুলনায় ইংরেজ সম্বন্ধীরা ঘুঘু—ভারতবর্ষের পরাধীনতাটার সঙ্গে ব্যবহার করে যেন বাড়ির ছোট বউ। মাঝে মাঝে গলা খাঁকারি দেয় বটে, কিন্তু তিনি যে আছেন সেকথাটা কথাবার্তায় চালচলনে আকছারই অস্বীকার করে যায়।
চাচা গলাবন্ধ কোটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। তার ন্যাওটা ভক্ত গোঁসাই জিজ্ঞেস করল, চাচা যে রা কাড়ছেন না?’
চাচা চোখ না খুলেই বললেন, আমি ওসবেতে নেই। আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।
সবাই অবাক। গোঁসাই জিজ্ঞেস করল, সে কী কথা? নাৎসিরা তো দাবড়াতে আরম্ভ করেছে মাত্র সেদিন। এর মাঝে কিছু একটা হলে তো আমরা খবর পেতুম।
কথাটা সত্য। চাচার গলাবন্ধ কোট, শ্যামবর্ণ চেহারা, আর রবিঠাকুরী বাবরী বার্লিন শহরের হাইকোর্ট। যে দেখেনি তার বাড়ি পদ্মার হে-পারে। চাচার উপর চোটপাট হলে একটা আন্তর্জাতিক না হোক ‘আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি’ হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
চাচা বললেন, ‘তোরা তো দেখছিস নাৎসিদের দ্বিজত্ব। তাদের পয়লা জনম হয়েছিল মিউনিকে। আমি তখন
জব্বলপুরের শ্রীধর মুখুয্যে অভিমানভরে বলল, চাচা, আপনি কি আমাদের এতই বাঙাল ঠাওরালেন যে আমরা পুশের (Putsch) খবরটা পর্যন্ত জানিনে?
চাচা বললেন, এহ বাহ্য, আমি তারও আগেকার কথা বলছি। এই ভুলুণ্ডি সূয্যি রায় আর আমি তখন মিউনিকে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতুম। মিউনিক বললে ঠিক কথা বলা হল না। আমরা থাকতুম মিউনিক থেকে মাইল পনরো দূরে, ছোট্ট একটা গ্রামে—ডেলিপ্যাসেঞ্জরি করলে সব দেশেই পয়সা বাঁচে। আমি থাকতুম এক মুদির বাড়িতে। নিচের তলায় দোকান, উপরে তিন ছেলে, এক মেয়ে, আর আমাকে নিয়ে মুদির সংসার।
মুদির সংসারটির দুটি মহৎ গুণ ছিলকাচ্চা-বাচ্চা-বাপ-মা সকলেরই ঠাট্টা-মস্করার রসবোধ ছিল প্রচুর আর ওস্তাদী সঙ্গীতের নামে তারা অজ্ঞান। বড় ছেলে অস্কার বাজাতে বেয়ালা, মেয়ে করতাল-ঢোল, বাপ পিয়ানো আর মেজো ছেলে হুবের্ট চেলল্লা। কাজকর্ম সেরে দু’দণ্ড ফুরসৎ পেলেই কনসার্টকাজের ফাঁকে ফাঁকে ঠাট্টা-মস্করা।
কিন্তু এদের মধ্যে আসল গুণী ছিল অস্কার। তবে তার গুণের সন্ধান পেতে আমার বেশ কিছুদিন লেগে গিয়েছিল—কারণ অস্কারকে পাওয়া যেত দুই অবস্থায়। হয় টং মাতাল, নয় মাথায় ভিজে পট্টি বাঁধা। তখন সে প্রধানত আমাকে লক্ষ্য করেই বলত, ‘ডু ইন্ডার, ওরে ভারতবাসী কালা শয়তান, তোরা যে মদ খাসনে সেইটেই তোদের একমাত্র গুণ। তোর সঙ্গে থেকে থেকে আর কাল রাত্রির বাইশ গেলাশের পর
মেয়ে মারিয়া আমাকে বলল, বাইশ না বিয়াল্লিশ জানল কী করে? পনরোর পর তো ও আর হিসেব রাখতে পারে না।
মা বলল, তাই হবে। কাল রাত্রে চারটের সময় অস্কার বাড়ি ফিরে তো হড়হড় করে সব বিয়ার গলাতে আঙুল দিয়ে বের করে দিচ্ছিল। বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল মদওয়ালা যে বাইশ গ্লাসের দাম নিল তাতে কোনো ফাঁকি নেই তো! বমি করছিল বোধহয় মেপে দেখবার জন্য।
অস্কার বলল, ওসব কথায় কান দিয়ো না হে ইভার (ভারতীয়)। দরকারও আর নেই। আমি এই সর্বজনসমক্ষে মা-মেরির দিব্যি কেটে বললুম, আর কখনো মদ স্পর্শ করব না। মদ মানুষকে পরের দিন কী রকম বেকাবু করে ফেলে এই ভিজে পড়িই তার লেবেল। বাপ রে বাপ, মাথাটা যেন ফেটে যাচ্ছে।
ভিজে পট্টিতেও আর কুলোল না। অস্কার কল খুলে মাথাটি নিচে ধরল।
সেখান থেকেই জলের শব্দ ডুবিয়ে অস্কার হুঙ্কার দিয়ে বলল, কিন্তু আমাকে বিয়ারে ফাঁকি দিয়ে পয়সা মারবে কে শুনি? ইঃ! বক্সিং-এর পয়লা প্রাইজের কথা কি মদওয়ালা ভুলে গিয়েছে? তার হোটেলের বাগানেই তো বাবা ফাইনালটা হলো। ব্যাটার নাকটা এমনিতেই থ্যাবড়া, আমার বাঁ হাতের একখানা সরেস আন্ডারকাট খেলে সেনাক মিউনিক-বার্লিন সদর রাস্তার মতো ফেলেট হয়ে যাবে না?
কথাটা ঠিক। বিয়ারওয়ালা বরঞ্চ ইনকাম-টেক্স অফিসারকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতে পাবে—আভে মারিয়া মন্ত্র কমিয়েসমিয়ে ভগবানকে ফাঁকি প্রতি রবিবারে গির্জেঘরে সে দেয়ই, না হলে সময়মতো দোকান খুলবে কী করে—কিন্তু বিয়ার নিয়ে অস্কারের সঙ্গে মস্করা ফস করে কেউ করতে যাবে না।
ঢকঢক করে এক গেলাশ নেবুর সরবৎ খেয়ে অস্কার বলল, মাথার ভিতর যেন এ্যারোপ্লেনের প্রপেলার চলছে, চোখের সামনে দেখছি গোলাপি হাতি সারে সারে চলেছে, জিবখানা যেন তালুর সঙ্গে ইস্কু মারা হয়ে গিয়েছে, কানে শুনছি মা যেন বাবাকে ঠ্যাঙাচ্ছে।
মুদি বলল, ভাললা হোক মন্দ হোক, আমার তো একটা আছে, তুই তো তাও জোটাতে পারলিনে।
অস্কার কান না দিয়ে বলল, ‘কিন্তু আর বিয়ার না। মা-মেরি সাক্ষী, পীর রেমিগিয়ুস সাক্ষী, কালা শয়তান ইভার সাক্ষী, আর বিয়ার না।’
অস্কারকে সকালবেলা যে কোনো মদ্য-নিবারণী সভার বড়কর্তা বানিয়ে দেওয়া যায়। সন্ধ্যের সময় বিয়ারের জন্য সে আল কাঁপোনের ডাকাতদলের সর্দারী করতে প্রস্তুত। আমি পকেট-ডায়েরি খুলে পড়ে বললুম, অস্কার, এই নিয়ে তুমি সাতাশীবার মদ ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করেছ।
অস্কার বলল, ‘যাঃ! তুই সাতাশী পর্যন্ত গুনতেই পারিসনে। ভারতবর্ষে অশিক্ষিতের সংখ্যা শতকরা সাতাশী। তুই তো তাদের একজন। ওখানে পাঠশালা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে বলেই তো এদেশে এসেছিস। দুই সাতাশীতে ঘুলিয়ে ফেলেছিস।
মুদির মা বলল, অস্কার চাকরি পেয়েছে আঠারো বছর বয়সে। সেই থেকে প্রতি রাত্রেই বিয়ার, ফি সকাল মদ ছাড়ার শপথ। এখন তার বয়স বাইশ। সাতাশীবার ভুল বলা হল।
অস্কার বলল, ঐ যাঃ! বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম, আজ আমাদের কারখানার সালতামামী পরব—বিয়ার পার্টি। চাকরির কথায় মনে পড়ল। কিন্তু না, না, না, আর বিয়ার না। দেখো, ইন্ডার, আজ যদি পার্টির কোনো ব্যাটা আসে তবে তুমি ভারতীয় কায়দায় তাকে নরবলি দেবে।’
চাচা বললেন, আমি আজও বুঝতে পারিনে অস্কার এই পট্টিবাঁধা মাথা নিয়ে কী করে প্রেসিশন মেশিনারির কাজ করত। মদ খেলে তো লোকের হাত কাঁপে, চোখের সামনে গোলাপি হাতি দেখে। অস্কার এক ইঞ্চির হাজার ভাগের এক ভাগ তা হলে দেখতই বা কী করে আর বানাতেই বা কী কৌশলে? এত সূক্ষ্ম কাজ করতে পারত বলে তাকে মাত্র দু’ঘন্টা কারখানায় খাটতে হত। মাইনেও পেত কয়েক তাড়া নোট। তাই দিয়ে খেত বিয়ার আর করত দান-খয়রাত। দ্বিতীয়টা হরবকত। মৌজে থাকলে তো কথাই নেই, পট্টিবাঁধা অবস্থায় ও মোটরসাইকেল থেকে নেবে বুড়ি দেশলাইওয়ালীর কাছ থেকে একটা দেশলাই কিনে এক ডজনের পয়সা দিত।
অস্কার ছিল পাঁড় নাৎসি। আমাকে বলত, এ সব ভিখিরি আতুরকে কেন যে সরকার গুলি করে মারে না একথাটা এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনে। সমস্ত দেশের কপালে আছে তো কুল্লে তিন মুঠো গম। তারই অর্ধেক খেয়ে ফেললে এ বুড়ি, ও কানী, সে খোড়া। সোমখ জোয়ানরা খাবে কী, দেশ গড়বে কী দিয়ে? জেকে যখন নেকড়ে তাড়া করে তখন দুটো দুবলা বাচ্চা ফেলে দিয়ে বাঁচাতে হয় তিনটে তাগড়াকে। সব কটাকে বাঁচাতে গেলে একটাকেও বাঁচানো যায় না। কথাটা এত সোজা যে কেউ স্বীকার করবে না, পাছে লোকে ভাবে লোকটা যখন এত সোজা কথা কয় তখন সে নিশ্চয়ই হাবা।
আমি বললুম, তিনটেকে বাঁচাতে গিয়ে দুটোকে নেকড়ের মুখে দিয়ে যদি অমানুষ হতে হয় তবে নাই বাঁচল একটাও।
অস্কার যেন ভয়ঙ্কর বেদনা পেয়েছে সে রকম মুখ করে বললে, বললি? তুইও বললি? তুই না এসেছিস এদেশে পড়াশোনা করতে! এদেশের পণ্ডিতদের জুড়ি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই বলেই তুই এখানে এসেছিস। এ পণ্ডিতের জাতটা মরে যাক এই বুঝি তোর ইচ্ছে? বল দিকিনি বুকে হাত দিয়ে, এই জর্মন জাতটা মরে গেলে পৃথিবীটা চালাবে কে? পণ্ডিত, কবি, বীর এ জাতে যেমন জন্মেছে–’
আমি বললুম, ‘থাক থাক। তোমার ওসব লেকচার আমি ঢের ঢের শুনেছি।
অস্কার মটরসাইকেল থামিয়ে বলল, যা বলেছিস। তোকে এসব শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। তুই মুসলমান, তারা কখনো ধর্ম বদলাসনে, যা আছে তাই নিয়ে আঁকড়ে পড়ে থাকিস। চ, একটা বিয়ার খাবি?’
আমি পিনিয়ন থেকে নেমে বললুম, গুড বাই। আর দেখো, তুমি সোজা বাড়ি যেয়ো। আমি লোকাল ধরব।
অস্কার বলল, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। তোমাকে তো আর নিত্যি নিত্যি আমি লিফট দিতে পারিনে। কারখানায় পরীরা সব ভয়ঙ্কর চটে গিয়েছে আমার উপর, কাউকে লিফট দিইনে বলে। প্রেমট্রেম সব বন্ধ।
আমি রাগ করে বললুম, এ কথাটা এত দিন বললানি কেন? আমি তোমাকে পইপই করে বারণ করিনি আমার কখন ক্লাস শেষ হয় না হয় তার ঠিক নেই, তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে না।
অস্কার বলল, তোমার জন্য আমি আর অপেক্ষা করলুম কবে? সামনের শরাবখানায় ঢুকি এক গেলাস বিয়ারের তরে। জানলা দিয়ে যদি দেখা যায় তুমি বেরিয়ে আসছ তাহলে কি তোমার দিকে তাকানোটাও বারণ? বেড়ালটাও তো কাইজারের দিকে তাকায়, তাই বলে কি কাইজার তার গর্দান নেন নাকি?’
চাচা বললেন, অস্কারের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। আর ঐ ছিল তার অদ্ভুত পরোপকার করার পদ্ধতি। ভিখিরিটাকে তিনটে মার্ক দিলে কেন? অস্কার বলবে, ব্যাটা বেহেড মাতাল, তিন মার্কেটিং নেশা করে গাড়ি চাপা হয়ে মরবে এই আশায়। আমাকে নিত্যি নিত্যি লিফট দেবার জন্য তুমি অপেক্ষা করো কেন?’ ‘সে কি কথা? আমি তো বিয়ার খেতে শরাবখানায় ঢুকেছিলুম!’ ‘নাৎসি পার্টিতে টাকা ঢালছো কেন?’ ‘তাই দিয়ে বন্দুকপিস্তল কিনে বিদ্রোহ করবে, তারপর ফাঁসিতে ঝুলবে বলে।’ আমি একদিন বলেছিলুম, ‘মিশনরিরা যে আফ্রিকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে যায় সেটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’ অস্কার বলল, ‘তাহলে দুর্ভিক্ষের সময় বেচারী নিগ্রোরা খাবে কী? মিশনরির মাংস উপাদেয় খাদ্য।’
চাচা বললেন, কিন্তু এসব হাইজাম্প-লঙজাম্প শুধু মুখে মুখে। অস্কার নাৎসি আন্দোলনের বেশ বড় ধরনের কর্তা আর নাৎসিদের নিয়ে নিজে যতই রসিকতা করুক না কেন, আর কেউ কিছু বললে তাকে মারমার করে তাড়া লাগাত। আমার সঙ্গে এক বৎসর ধরে যে এত বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল সেইটি পর্যন্ত সে একদিন অকাতরে বিসর্জন দিল ঐ নালিদের সম্বন্ধে আমি আমার রায় জাহির করেছিলুম বলে।
রান্নাঘরে সকালবেলা সবাই জমায়েত। সেদিন ছিল রবিবার–সপ্তাহে ঐ একটিমাত্র দিন আমরা সবাই রান্নাঘরে বসে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেতুম, আর হদিন যে যার সুবিধে মতো।
মেয়ে মারিয়া পাঁচজনের উপকারার্থে চেঁচিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। অস্কার মাথায় ভিজে পট্টি বাঁধছিল আর আপনমনে মাথা নেড়ে নেড়ে নিজেকে বোঝাচ্ছিল, বিয়ার খাওয়া বড় খারাপ। মারিয়া হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ খবরটা মন দিয়ে শুনুন, হের ডক্টর।—পাটেনকির্ষেনে হৈ হৈ রৈ রৈ, নাৎসি গুণ্ডা কর্তৃক ইহুদিনী আক্রান্ত। প্রকাশ, ইহুদিনী রাস্তায় নাৎসি পতাকা দেখে ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে আপন বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। নাৎসিরা তখন তাকে ধরে নিয়ে এসে পতাকার সামনে মাথা নিচু করতে আদেশ করে। সে তখনো নারাজি প্রকাশ করাতে নাৎসিরা তাকে মার লাগায়। পুলিশ এসে পড়ায় নাৎসিরা পালিয়ে যায়। তদন্ত চলছে।’
চাচা বললেন, আমি বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, নাৎসি গুণ্ডারা কী করে না-করে আমার তাতে কী?
অস্কার আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, জাতির পতাকার সম্মান যারা বাঁচাতে চায় তারা গুণ্ডা?
আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো বাপ বলল, ওটা জাতির পতাকা হল কী করে? ওটা তো নাৎসি পার্টির পতাকা।
আমি বললুম, ঠিক, এবং জাতীয় পতাকাকে কেউ অবহেলা করলে তাকে সাজা দেবার জন্য পুলিশ রয়েছে, আইন-আদালত রয়েছে। বিশেষ করে একটা মেয়েকে ধরে যখন পাঁচটা ষাঁড়ে মিলে ঠ্যাঙায় তখন সেটা গুণ্ডামি না হলে গুণ্ডামি আর কাকে বলে?
অস্কার আমার দিকে ঘুরে হঠাৎ ‘আপনি’ বলে সম্বােধন করে বলল, আপনি তা হলে ইহুদিদের পক্ষে?
আমি বললুম, অস্কার অত সিরিয়স হচ্ছ কেন? আমি ইহুদিদের পক্ষে না বিপক্ষে সে প্রশ্ন তো অবান্তর।
অস্কার বলল, ‘প্রশ্নটা মোটেই অবান্তর নয়। ইহুদিরা যতদিন এদেশে থাকবে ততদিনই বর্ণসঙ্করের সম্ভাবনা থাকবে। জর্মনির নর্ডিক জাতের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখতে হবে।’
চাচা বললেন, এর পর আমার আর কোনো কথা না বললেও চলত। কিন্তু মানুষ তো আর সবসময় শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে ওঠা-বসা করে না, আর হয়তো অস্কার আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যে আমার মনে হয়েছিল, কোনো একটা যুৎসই উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। আমি বললুম, ভারতবর্ষেও তো আর্য জাতি রয়েছে এবং তারা জনদের চেয়ে ঢের বেশি খানদানী এবং কুলীন। আর্যদের প্রাচীনতম সৃষ্টি চতুর্বেদ ভারতবর্ষেই বেঁচে আছে। গ্রীস রোমে যা আছে তার বয়স বেদের হাঁটুর বয়সেরও কম।
জর্মনির-ফ্রান্সের তো কথাই ওঠে না—পরশু দিনের সব চ্যাংড়ার পাল। কিন্তু তার চেয়েও বড় তত্ত্বকথা হচ্ছে এই, ভারতবর্ষের যা কিছু প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে তোমরা-আমরা সবাই গর্ব করি সেটা গড়ে উঠেছে আর্য-অনার্য সভ্যতার সংমিশ্রণ অর্থাৎ বর্ণসঙ্করের ফলে। আমাদের দেশে বর্ণসঙ্কর সবচেয়ে কম হয়েছে কাশ্মীরে—আর ভারতীয় সভ্যতায় কাশ্মীরীদের দান ট্যাকে গুঁজে রাখা যায়। এবং আমার বিশ্বাস যে সব গুণী জর্মনিকে বড় করে তুলেছেন তাদের অনেকেই খাঁটি আর্য নন।
আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে অস্কার হুঙ্কার তুলে বলল, আপনি বলতে চান, আমাদের সুপারম্যানরা সব বাস্টার্ড?’
চাচা বললেন, আমি তো অবাক। কিন্তু ততক্ষণে আমার সবুদ্ধির উদয় হয়েছে। কিছু না বলে চুপ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলুম।
চাচা কফিতে চুমুক দিলেন। সেই অবসরে গোলাম মৌলা বলল, আমার সঙ্গেও ঠিক এইরকম ধারাই তর্ক হয়েছিল। কিন্তু আমি তো ভারতীয় সভ্যতার অতশত জানিনে, তাই ওরকম টায়টায় তুলনা দিয়ে তর্ক করতে পারিনি। কিন্তু নাৎসিরা রাগ দেখায় একই ধরনের।
চাচা বললেন, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী প্রয়োজন ছিল তর্ক করার? বিশেষ করে যখন জানি, যত বড় সত্য কথাই হোক মানুষ আপন কৌলীন্য বজায় রাখার জন্য সেটাকেও বিসর্জন দেয়। তার উপর অস্কার জানেই বা কী, বোঝেই বা কী? মানুষটা ভাললা, তর্ক করে আনাড়ির মতো, আর আগেও তো বলেছি তার হাইজাম্পলঙজাম্প তো শুধু মুখেই।
আমি আর অস্কার বাড়ির সক্কলের পয়লা ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরতুম। পরদিন খেতে বসে দেখি অস্কার নেই। যাঁকে তার বরসাতি আর হ্যাটও নেই। বুঝলুম আগেই বেরিয়ে গিয়েছে। মনে কী রকম খটকা লাগল। দুদিনের ভিতরই কিন্তু ব্যাপারটা খোলস হয়ে গেল—অস্কার আমাকে এড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শুনলুম মুদি আর তার মা আমার পক্ষ নিয়ে অস্কারকে ধমক দিয়েছেন। অস্কার কোনো উত্তর দেয়নি, কিন্তু আমি রান্নাঘরে থাকলে সেখানে আসে না।
মহা বিপদগ্রস্ত হলুম। বাড়ির বড় ছেলে আমার সঙ্গে মন কষাকষি করে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, আর-সবাই সে সম্বন্ধে সচেতন, অষ্টপ্রহর অস্বস্তিভাব, বুড়োবুড়ি আমার দিকে সব সময় কী রকম যেন মাপ-চাই ভাবে তাকান-মরুক গে, কী হবে এখানে থেকে!
বুড়োবুড়ি তো কেঁদেই ফেললেন। মারিয়া আমার কাছে ইংরিজি পড়ত। সে দেখি জিনিসপত্র প্যাক করছে। বলল, চললুম কিছুদিনের জন্য মাসির বাড়ি। দুসরা ছেলে হুবের্টও কথা কইত কম। আমাকে মুনিকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেবার সময় বলল, আশ্চর্য, অস্কারের মতো সহৃদয় লোক নাৎসিদের পাল্লায় পড়ে কী রকম অদ্ভুত হয়ে গেল দেখলেন? আমি আর কী বলব।’
চাচা বললেন, তারপর ছমাস কেটে গিয়েছে। বান্ধব বর্জন সব সময়ই পীড়াদায়ক সে বর্জন ইচ্ছায় করো আর অনিচ্ছায়ই ঘটুক। তার উপর বড় শহরে মানুষ যে রকম নিঃসঙ্গ অনুভব করে তার সঙ্গে গ্রামের নির্জনতার তুলনা হয় না। গ্রামের নিত্যিকার ডালভাত অরুচি এনে দেয় সত্যি, তবু সেটা শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর পাঁচজনের শেরিশ্যাম্পেন খাওয়া দেখার চেয়ে অনেক ভালো। দিনের ভিতর তাই অদ্ভুত পঞ্চাশবার ‘দুত্তোর ছাই’ বলতুম, আর বুড়োবুড়ির কাছে ফিরে যাওয়া যায় কি না ভাবতুম। কিন্তু জানো তো, বড় শহরে স্থান যোগাড় করা যেমন কঠিন, সেখান থেকে বেরনো তার চেয়েও কঠিন।
করে করে প্রায় এক বৎসর কেটে গিয়েছে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি বুড়োবুড়ি আর মারিয়া আমার বসার ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কী ব্যাপার? রোনডরে সাৎসরিক মেলা। আমাদের যেমন ঈদ-দুর্গোৎসবের সময় আত্মীয়স্বজন দেশের বাড়িতে জড়ো হয় এদের বাৎসরিক মেলার সময়ও ঐ রেওয়াজ। বুড়োবুড়ি, মারিয়া তাই আমাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছেন।
আমার মনের ভিতর কী খেলে গেল সেইটে যেন বুঝতে পেরেই মারিয়া বলল,’অস্কারের সঙ্গে এ কদিন আপনার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। ছুটি নিয়ে এ কদিন সে অষ্টপ্রহর বিয়ার খায়। আপনাকে দেখলে ও চিনতে পারবে না।’
বুড়ি বললেন, ‘অস্কারকে একটা সুযোগ দিন আপনার কাছে ক্ষমা চাইবার। মেলার সময় তাই তো আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়।
মেলার পরব সব দেশে একই রকম। তিন মিনিট নাগরদোলায় চকর খেয়ে নিলে, ঝপ করে দুটো পানের খিলি মুখে পুরলে (দেশভেদে চকলেট), দুটো সস্তা পুতুল কিনলে, গণৎকারের সামনে হাত পাতলে, না হয় ইয়ারদের সঙ্গে গোট পাকিয়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসলে (দেশভেদে ফষ্টিনষ্টি করলে)। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে যে ঘন ঘন পট পরিবর্তন সম্ভব হয় না সেইটে মেলার সময় সুদে-আসলে তুলে নেওয়া। যে মেলা যত বেশি মনের ভোল ফেরাবার পাঁচমেশালি দিতে পারে সে মেলার জৌলুশ তত বেশি। তাই বুঝতে পারছ, বড় শহরে কেন মেলা জমে না। যেখানে মানুষ বারো মাস মুখোস পরে থাকে সেখানে বহুরূপী কল্কে পাবে কেন?
তবে দেশের মেলার সঙ্গে এদেশের মেলার একটা বড় তফাত রয়েছে। রাত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেলা যখন ঝিমিয়ে আসে তখন দেশে শুরু হয় যাত্রা-গান কিম্বা কবির লড়াই। এদেশে শুরু হয় মদ আর নাচ। ছোটখাটো গ্রামে তো প্রায় অলঙ্ঘ্য রেওয়াজ প্রত্যেক মদের আড্ডায় অন্তত একবার ঢুকে এক গেলাশ বিয়ার খাওয়ার। কারো দোকান কট করা চলবে না, তা ততক্ষণে তুমি টং হয়ে গিয়ে থাকো আর নাই থাকো।
আমরা যেরকম উচ্ছৃঙ্খলতায় সুখ পাই, জর্মনরা তেমনি আইন মেনে সুখ পায়। মুদি-মুদিবউ তাই আমাকে নিয়ে এই নিয়ম প্রতিপালন করে করে শেষটায় ঢুকলেন তাদেরই বাড়ির পাশের গ্রামের সব চেয়ে বড় শরাবখানায়। রাত তখন এগারোটা হবে। ডান্স হলের যা সাইজ তাতে দু-পাঁচখানা চণ্ডীমণ্ডপ সেখানে অনায়াসে লুকোচুরি খেলতে পারে। আশপাশের দশখানা গ্রামের ছোড়াছুড়ি বুড়োবুড়ি ধেইধেই করে নাচছে, আর শ্যাম্পেন-ওয়াইন যা বইছে তাতে সমস্ত গ্রামখানাকে সম্বৎসর মজিয়ে রেখে আচার বানানো যায়। দেশলাই ঠুকতে ভয় হয় পাছে হাওয়ার অ্যালকহলে আগুন ধরে যায়, সিগার-সিগারেটের ধুয়ো দেখে মনে হয়, দেশের গোয়ালঘরের মশা তাড়ানো হচ্ছে।
বুড়োবুড়ি পাড়ার মুরুব্বি। কাজেই তাদের জন্য টেবিল রিজার্ভ করা ছিল। বুড়োবুড়ি আইন মেনে একচকর নেচে নিলেন। বয়স হয়েছে, অল্পেই হাঁপিয়ে পড়েন। বু পায়ের চিকণ কাজ থেকে অনায়াসে বুঝতে পারলুম, এঁদের যৌবনে এঁরা আজকের দিনের ছোড়াছুড়ির চেয়ে ঢের ভালো নেচেছেন। আর মারিয়ার তো পো’ বারো। সুন্দরী মেয়ে। তাকে নিয়ে যে লোফালুফি লেগে যাবে, সেকথা নাচের মজলিসে না এসেই বলা যায়।
ঘন্টাখানেক কেটে গিয়েছে। মজলিস গুলজার। সবাই মৌজে। তখনো লোকজন আসছে—এত লোকের যে কোথায় জায়গা হচ্ছে খোদায় মালুম, আল্লাই জানেন। এমন সময় একজোড়া কপোত-কপোতী আমাদেরই টেবিলের পাশে এসে জায়গার সন্ধানে চারদিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু তখন আর সত্যিই একখানা চেয়ারও খালি নেই। বুড়োবুড়ি তাদের ডেকে বললেন, আমরা বাড়ি যাচ্ছি। আপনারা আমাদের জায়গায় বসতে পারেন। আমি উঠে দাঁড়ালুম। বুড়ি বললেন, ‘সে কি কথা? আপনি থাকবেন।
হলে মারিয়াকে বাড়ি নিয়ে আসবে কে? আমার বাড়ি যাবার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু এরপর তো আর আপত্তি জানানো যায় না। জর্মনি মধ্যযুগের প্রায় সব বর্বরতা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, কিন্তু শক্তসমর্থ মেয়ের রাত্রে রাস্তায় একা বেরতে নেই এ বর্বরতাটা কেন ছাড়তে পারে না বুঝে ওঠা ভার।
কপোত-কপোতী চেয়ার দুটো পেয়ে বেঁচে গেল। কপোতীটি দেখতে ভালোই, মারিয়ার সঙ্গে বেশ যেন খাপ খেয়ে গেল। আমি তাদের মধ্যিখানে বসেছিলুম—আহা, যেন দুটি গোলাপের মাঝখানে কাটাটি।
চাচার কথায় বাধা দিয়ে গোঁসাই বললেন, ‘চাচা, আত্মনিন্দা করবেন না। বরঞ্চ বলুন, দুটো কাটার মাঝখানের গোলাপটি। আর কিছু না হোক, সেই অজপাড়াগাঁয়ে ইভার হিসেবে নিশ্চয়ই আপনাকে মাইডিয়ার-মাইডিয়ার দেখাচ্ছিল।
চাচা বললেন, ঠিক ধরেছিস। ঐ বিদেশী চেহারার যে চটক থাকে তাই নিয়ে বাঁধল ফ্যাসাদ।
নাচের মজলিসে, বিশেষ করে একই টেবিলে তো আর ব্যাকরণসম্মত পদ্ধতিতে ইনট্রডাকশন করে দেবার রেওয়াজ নেই। কপোতীটি বিনা আড়ম্বরে শুধালো, আপনি কোন দেশের লোক? উত্তর দিলুম। তারপর এটা ওটা সেটা এমনকি ফষ্টিটা-নষ্টিটা, অবশ্যি সন্তর্পণে, যেন ফুলদানির ফুলের ভিতর দিয়ে থু দ্য ফ্লাওয়ার্স।
ওদিকে দেখি কপোতটি এ জিনিসটা আদপেই পছন্দ করছে না।
আমি ভাবলুম, কাজ কী হাঙ্গামা বাড়িয়ে। দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দিলুম না, যেন শুনতে পাইনি। কিন্তু মারিয়াটা ঘড়েল মেয়ে। ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে চট করে, আর নষ্টামির ভূত চেপেছে তার ঘাড়ে, হয়তো শ্যাম্পেনও তার জন্য খানিকটা দায়ী। সে আরম্ভ করল মেয়েটাকে ওসকাতে। বলল, জানেন, ইনি আমার দাদা হন।
মেয়েটি বলল, তা কী করে হয়! ওঁর রঙ বাদামী, চুল কালো, উনি তো ইন্ডার।
মারিয়া গম্ভীর মুখে বলল, ঐ তো! উনি যখন জন্মান, মা-বাবা তখন কলকাতার জর্মন কনসুলেটে কর্ম করতেন। কলকাতার তোক বাঙলা ভাষায় কথা কয়। দাদাকে জিজ্ঞেস করুন উনি বাঙলা জানেন কি না।
মেয়েটি হেসে কুটিকুটি। বলল, হ্যাঁ, ওর জর্মন বলাতে কেমন যেন একটু বিদেশী গোলাপের খুশবাই রয়েছে। মেরেছে। বিদেশী ওঁচা এ্যাকসেন্ট হয়ে দাঁড়ালো গোলাপী খুশবাই’!
চাচা বললেন, আমি মারিয়াকে দিলুম ধমক দিয়ে করলুম ভুল। বোঝা উচিত ছিল মারিয়ার স্কন্ধে তখন শ্যাম্পেনের ভূত ড্যাংড্যাং করে নাচছে। শ্যাম্পেনকে ঝাঁকুনি দিলে তার বজবজ বাড়ে বই কমে না। মারিয়া মরমিয়া সুরে কপোতর কাছে মাথা নিয়ে গিয়ে বলল, ‘আর উনি এ্যাসা খাসা নাচতে পারেন। আমাদেরই ওয়ালটু নাচ—আর তার উপর থাকে ভারতীয় জরির কাজ। আইন, ৎসুয়াই, দ্রাই—আইন, ৎসুয়াই, ড্রাই—তার সঙ্গে ধা, ধিন, না; ধা, তিন না; ডাডরা-না?’
চাচা বললেন, ‘পাঁচপীরের কসম, আমার বাপ-ঠাকুর্দা চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনো নাচেনি। মুখে গরম আলু পড়াতে হয়তো নেচেছে, কিন্তু সে তো ওয়ালট নয়। মেয়েটাও বেহায়ার একশেষ। মারিয়াকে বলল, তা উনি যে নাচতে পারবেন তাতে আর বিচিত্র কী? কী রকম যেন সাপের মতো শরীর। বলে চোখ দিয়ে যেন আমার গায়ে এক দফা হাত বুলিয়ে নিল।
চাচা বললেন, ওঃ! এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। ওদিকে ছেলেটাও চটে উঠেছে। আর চটবে নাই বা কেন? বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে নাচের মজলিসে ফুর্তি করতে। সে যদি আরেকটা মদ্দার সঙ্গে জমে যায় তবে কার না রাগ হয়? কপোত দেখি বাজপাখির মূর্তি ধরতে আরম্ভ করছে। তখন তাকিয়ে দেখি তার কোটে লাগানো রয়েছে নাৎসি পার্টির মেম্বারশিপের নিশান। ভারি অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলুম।
মারিয়া তখন তার-সপ্তকের পঞ্চমে। শেষ বাণ হানলো, ‘একটু নাচুন না, হের ডক্টর।’
আমাদের দেশে যেমন বাচ্চা মেয়ের নাম ‘পেঁচির মা, ‘ঘেঁচির মা’ হয়, আপন বাচ্চা জন্মাবার বহু পূর্বে, মনিক অঞ্চলে তেমনি ডক্টরেট প্রসব করার পূর্বেই পোয়াতী অবস্থাতেই আত্মীয়স্বজন ডাকতে আরম্ভ করে, ‘হের ডক্টর। আমার তখনো ডক্টরেট পাওয়ার ঢের বাকি, কিন্তু আত্মজনের নেকনজরে আমি য়ুনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হার্ড-বয়লড ‘হের ডক্টর’ হয়ে গিয়েছিলুম। মারিয়ার অবিশ্যি এই বোেকায় ‘হের ডক্টর’ বলার উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটিকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া যে অজ পাড়াগাঁয়ের মেলাতে বসে থাকলেই মানুষ কিছু কামার-চামার হতে বাধ্য নয়—আমি রীতিমত খানদানী মনিষ্যি, ‘হের ডক্টর’—বাঙলা কথা।
মেয়েটি তখন কাতর হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে বলল, হে-র-ড-ক্–ট্–র!’
চাচা বললেন, আমি মনে মনে বললুম দুত্তোর ‘হের ডক্টর’, আর দুত্তোর এই মারিয়াটা! মুখে বললুম, মারিয়া, আমি এখখুনি আসছি। বলে, দিলুম চম্পট।
চাচা বললেন, ‘তোরা তো মুনিকে যাসনি, কাজেই জানিসনে মানুষ সেখানে কী পরিমাণ বিয়ার খায়। তাই সবাইকে যেতে হয় ঘনঘন বিশেষ স্থলে। আমি এসব জিনিস খাইনে, কিন্তু তাই নিয়ে তো মারিয়া আর তর্কাতর্কি জুড়তে পারে না।
চাচা বললেন, বাইরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। কষে ঠাণ্ডা বাতাস বুকের ভিতর নিয়ে সিগার-সিগারেটের ধুয়ো যতটা পারি ঝেটিয়ে বের করলুম। মারিয়াটা যে এত মিটমিটে শয়তান কী করে জানব বল। কিন্তু মারিয়ার কথায় মনে পড়ল, ওকে ফেলে তো বাড়ি যাওয়া যাবে না। বুড়োবুড়ি তাহলে সত্যিই দুঃখিত হবেন। ভাববেন, এই সামান্য দায়টুকু আমি এড়িয়ে গেলুম। কিন্তু ততক্ষণে একটা দাওয়াই বের করে ফেলেছি। শরাবখানার ঠিক মুখোমুখি ছিল আরেকটি ছোটা সে ছোটা বিয়ার ঘর। সেখানে কফিও পাওয়া যায়। অধিকাংশ খদ্দের ওখানে ঢুকে বারে দাঁড়িয়েই ঝপ করে একটা বিয়ার খেয়ে চলে যায়, আর যারা নিতান্ত নিরামিষ তারা বসে বসে কফিতে চুমুক দেয়। স্থির করলুম, সেখানে বসে কফি খাব, আর জানলা দিয়ে বাইরের দিকে নজর রাখব। যদি মারিয়া বেরোয় তবে তক্ষুণি তাকে কাক করে ধরে বাড়ি নিয়ে যাব। যদি না বেরোয় তবে ঘন্টাখানেক বাদে মারিয়ার তত্ত্বতালাশ করব। শ্যেনও ততক্ষণে ফের কবুতর হয়ে যাবে আশা করাটা অন্যায় নয়।
চাচা শিউরে উঠে বললেন, বাপস! কী মারাত্মক ভুলই না করেছিলুম সেই বিয়ারখানায় ঢুকে। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে দেখি সেই কপোতী শরাবখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর ঢুকল সেই বিয়ারখানাতে। আমার তখন আর লুকোবার বা পালাবার পথ নেই। আমাকে দেখে মেয়েটির মুখে বিদ্যুৎ-চমকানো-গোছ হাসি ঝিলিক মেরে উঠল। ঝুপ করে পাশের চেয়ারে বসে বলল, একটু দেরি হলো। কিছু মনে করোনি তো? বলে, দিল আমার হাতে হাত, পায়রার বাচ্চা যে রকম মায়ের বুকে মুখ গোঁজে।
বলে কী! ছন্ন না মাথা খারাপ? আপন মাথা ঠাণ্ডা করে বুঝলুম, এরকম ধরা চলে এসে অন্য জায়গায় বসাটা হচ্ছে এদেশের প্রচলিত সঙ্কেত। অর্থটা সপত্ন (অর্থাৎ পুংসতীন) ব্যাটাকে এড়িয়ে চলে এস বাইরে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তাই সে এসেছে।
মেয়েটা আমার হাতে হাত বুলোত বুলোতে বলল, কিন্তু, ভাই, তুমি কায়দাটা জানো ভালো। টেবিলে তো ভাবখানা দেখালে আমাকে যেন কেয়ারই করো না। বলে আমার গালে দিল একটি মিষ্টি ঠোনা।।
চাচা বললেন, আমি তখন মরমর। ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, আপনি ভুল করেছেন। আমায় মাপ করুন। মেয়েটা তখন একটু যেন বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার এই প্রাচ্যদেশীয় টানা-ঠ্যালা, টানা-ঠ্যালা কায়দা থামাও। আমার সময় নেই। হয়তো এতক্ষণে আমার বন্ধুর সন্দেহ হয়েছে আর হঠাৎ এখানে এসে পড়বে। তাহলে আর রক্ষে নেই। তোমার ফোন নম্বর কত বলল। আমি পরে কন্টাক্ট করবে। তখন তোমার সবরকম খেলার জন্য আমি তৈরি হয়ে থাকবা।
বাঁচালে! নম্বরটা দিলেই যদি মেয়েটা চলে যায় তাহলে আমিও নিষ্কৃতি পাই। পরের কথা পরে হবে। নম্বর বলতেই মেয়েটা দেশলাইয়ের পোড়াকাঠি দিয়ে চট করে সিগারেটের প্যাকেটে নম্বরটা টুকে নিল।
সঙ্গে সঙ্গে সেই দুশমন এসে ঘরে ঢুকল।
তার চেহারা তখন কপোতের মতো তো নয়ই, বাজপাখির মতোও নয়, মুখ দিয়ে আগুনের হা বেরহে, যেন চীনা ড্রাগন।
আর সে কী চিৎকার আর গালাগালি। আমি তার বান্ধবীকে বদমায়েশি করে, ধড়িবাজের ফেরেব্বাজি দিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে এসেছি। একই টেবিলে ওয়াইন খেয়ে, বন্ধুত্ব জমিয়ে এরকম ব্ল্যাকমেলিং, ব্যাকস্ট্যাবিং—আল্লা জানেন, আরো কতরকম কথা সে বলে যাচ্ছিল। সমস্ত বিয়ারখানার লোক তার চতুর্দিকে জড়ো হয়ে গিয়েছে। আমি হতভম্বের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। মেয়েটা তার আস্তিন ধরে টানাটানি করে বার বার বলছে, ‘হানস, হানস, চুপ করো। এখানে সীন করো না। ওঁর কোনো দোষ নেইআমিই
কনুই দিয়ে মেয়েটার পেটে দিল এক গুত্তা। চেঁচিয়ে বলল, ‘হটে যা মাগী’— অথবা তার চেয়েও অভদ্র কী একটা শব্দ ব্যবহার করেছিল আমার ঠিক মনে নেই। চটলে নাৎসিরা মেয়েদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করে সেটা না দেখলে বোঝবার উপায় নেই। হারেমে বুখারার আমীর তাদের তুলনায় কলসী কানার বোষ্টম। তঁতো খেয়ে মেয়েটা কোঁক করে, অদ্ভুত ধরনের শব্দ করে একটা চেয়ারে নেতিয়ে পড়ল।
‘এই বকাবকি আর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ড্রাগন আস্তিন গুটোয় আর বলে, ‘আয়, এর একটা রফারফি হওয়ার দরকার। বেরিয়ে আয় রাস্তায় বাইরে।’
চাচা বললেন, আমি তো মহা বিপদে পড়লুম। অসুরের মতো এই দুশমনের হাতে দুটো ঘুষি খেলেই তো আমি উসপার। ক্ষীণকণ্ঠে যতই প্রতিবাদ করে বোঝাবার চেষ্টা করি যে ফ্রলাইনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র অনুরাগ নেই, আমার মনে কোননারকম মতলব নেই, ছিল না, হওয়ার কথাও নয়, সে ততই চেঁচায় আর কাপুরুষ’ বলে গালাগাল দেয়।
আড্ডার চ্যাংড়া সদস্য গোলাম মৌলা শুধাল, আর কেউ মূখটাকে বোঝাবার চেষ্টা করল না যে আপনি নির্দোষ?
চাচা বললেন, তুই এদেশে নতুন এসেছিস তাই এসব ব্যাপারের মরাল অথবা ইমরাল কোডের খবর জানিসনে। এদেশে এসব বর্বরতাকে বলা হয়, অন্যলোকের ঘরোয়া মামলা’, personal matter। এরা আসলে থাকে বিনটিকিটে মজা দেখবে বলে।
চাচা বললেন, ততক্ষণে অসুরটা আবার নাৎসি বক্তৃতা জুড়ে দিয়েছে যত সব ইহুদি আর বাদ বাকি কালা-আদমি নেটিভরা এসে এদেশের মানইজ্জৎ নষ্ট করে ফেললো। এই করেই বর্ণসঙ্কর (অবশ্য একটা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেছিল) হয়, এই করেই দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে, অথচ জর্মনির আজ এমন দুরবস্থা যে এরকম অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বিশ্বাস করবে না, দু-একজন ততক্ষণে তার কথায় সায় দিতে আরম্ভ করেছে আর আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি দুনিয়ার সব চেয়ে মিটমিটে শয়তান, আর কাপুরুষস্য কাপুরুষ।
মাপ চেয়ে নিলে কী হতো বলতে পারিনে, কিন্তু মাপ চাইতে যাব কেন? আমি দোষ করিনি এক ফোঁটা, আর আমি চাইতে যাব মাপ? ভয় পাই আর নাই পাই, আমিও তো বাঙাল। আমার গায়ের রক্ত গরম হয় না? দুনিয়ার তাবৎ বাঙালদের মানইজ্জৎ বাঁচাবার ভার আমার উপর নয় জানি, কিন্তু এই বাঙালটাই বা এমন কী দোষ করল যে লোকে তাকে কাপুরুষ ভাববে?’
চাচা বললেন, আমি বললুম, এসো তবে, যখন নিতান্তই মারামারি করবে বলে মনস্থির করেছ, তবে তাই হোক! মনে মনে বললুম, দুটো ঘুষি সইতে পারলেই চলবে, তারপর তো নির্ঘাৎ অজ্ঞান হয়ে যাব।
এমন সময় হুঙ্কার শুনতে পেলুম, এই যে! সব ব্যাটা মাতাল এসে একত্তর হয়েছে হেথায়। এসো, এসো, আরেক পাত্তর হয়ে যাক, মেলার পরবে’।
চাচা বললেন, ‘তাকিয়ে দেখি অস্কার। একদম টং। এক বগলে খালি বোতল, আরেক বগলে ডানাকাটা পরী। পরীটিও যেন শ্যাম্পেনের বুদ্বুদে ভর করে উড়ে চলেছেন। সেই উৎকট সঙ্কটের মাঝখানেও না ভেবে থাকতে পারলুম না, মানিয়েছে ভালো।
অস্কারকে দুনিয়ার কুল্লে মাতাল চেনে। আমার কথা ভুলে গিয়ে সবাই তাকে উদ্বাহু হয়ে আসতে আজ্ঞা হোক, বার’-এ দাঁড়াতে আজ্ঞা হোক’ বলে অকৃপণ অভ্যর্থনা জানালো।
ওদিকে আমার মোযটা বাধা পড়ায় চটে গিয়ে আরো হুঙ্কার দিয়ে বলল, তবে আয় বেরিয়ে।
তখন অস্কারের নজর পড়ল আমার দিকে। আমাকে যে কী করে সে-অবস্থায় চিনতে পারল তার সন্ধান সুস্থ লোক দিতে পারবে না। পারবেন দিতে অস্কারের মতো সেই গুণী, যিনি মৌজের গৌরীশঙ্করে চড়ে জাগরণসুষুপ্তিস্বল্পতুরীয় ছেড়ে পঞ্চমে পৌঁছতে পারেন। কাইজারের জন্মদিনের কামানদাগার মতো আওয়াজ ছেড়ে বললে, ঐ রেঃ! ঐ ব্যাটা কালা ইভার, মিশ শয়তানও এসে জুটেছে। যেখানেই যাও, শয়তানের মতো সব জায়গায় উপস্থিত। বিয়ার ধরেছিস নাকি? এক পাত্তর হয়ে যাক। আজ তোকে খেতেই হবে। মেলার পরব।
ষাঁড় আবার হুঙ্কার ছেড়েছে। অস্কার তার দিকে তাকিয়ে, আর তার আস্তিন-টানা মারমুখো তসবির দেখে আমাকে শুধালো, ইনি কিনি বটেন?
আমি হামেহাল জেন্টিলম্যান। শাস্ত্রসম্মত কায়দায় পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু দুশমন অস্কারকে চেঁচিয়ে বললে, তুমি বাইরে থাকো ছোকরা। এর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।
অস্কার প্রথমটায় এরকম মোগলাই মেজাজ দেখে একটুখানি থতমত খেয়ে গেল। খালি বোতলটায় একটা টান দিয়ে অতি ধীরে ধীরে মিনিটে একটা শব্দ উচ্চারণ করে বলল, এরসঙ্গে—আমার—বোঝাপড়া—আছে? কেন বাবা, এত রাগ কিসের? এই পরবের বাজারে? তা ইন্ডারটা ঝগড়াটে বটে। হলেই বা। এস, বেবাক ভুলে যাও। খেয়ে নাও এক পাত্তর। মনে রঙ লাগবে, সব ঝগড়া কঞ্জুর হয়ে যাবে।
বলে জুড়ে দিল গান। অনেকটা রবিঠাকুরের ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’ গোছের।
দুশমন ততক্ষণে আমার দিকে ঘুষি বাগিয়ে তেড়ে এসেছে।
হাঁ হাঁ করো কী, করো কী?’ বলে অস্কার তাকে ঠেকালো। অস্কার আমার সপত্নের চেয়ে দুমাথা উঁচু। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? নাৎসিদের ফের গালাগাল দিয়েছিস বুঝি?
আমি যতটা পারি বোঝালুম। শেষ করলুম, কী মুশকিল! বলে।
অস্কার বলল, তা আমি কি তোর মুশকিল আসান নাকি, না তোর ফুরার? আর দেখছিস না ও আমার পার্টির লোক। আমি হাল ছেড়ে দিলুম।
কিন্তু অস্কারকে বোঝা ভার।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সেই ষাঁড়কে জিজ্ঞেস করল, ইন্ডারটা তোমার বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেছিল?
আমি বললুম, ছিঃ অস্কার।
সপত্ন বলল, ‘চোপ!
অস্কার শুধাল, চুমো খেয়েছিল?
আমি বললুম, অস্কার!
সপত্ন বলল, শাট আপ!
তখন অস্কার সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েটিকে দুহাত দিয়ে চেয়ার থেকে দাঁড় করাল। বললে, ‘খাসা মেয়ে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই তাকে জড়িয়ে ধরে কমশেলের মতো শব্দ করে খেল চুমো।
সবাই অবাক। আমিও। কারণ অস্কারকে ওরকম বেহেড মাতাল হতে আমিও কখনো দেখিনি।
কিন্তু আমারই ভুল।
আমাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ফেলে সে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল সেই ছোকরার। একদম সাদা গলায় বলল, ‘দেখো বাপু, আমার বন্ধু ইন্ডারটি তোমার বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেনি, চুমোও খায়নি। তবু তুমি অপমানিত বোধ করে তাকে ঠ্যাঙাতে যাচ্ছিলে। ও রোগা টিঙটিঙে কিনা। ওঃ, কী সাহস! কিন্তু আমি তোমার বান্ধবীকে চুমো খেয়েছি। এতে তোমার জরুর অপমান বোধ হওয়া উচিত। আমিও সেই মতলবেই চুমোটা খেলুম। তাই এসো, পয়লা আমাকে ঠ্যাঙাও, তারপর না হয় ইন্ডারটাকে দেখে নেবে।
হুলুস্থুল পড়ে গেল। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে কথা কয়, কিছু বোঝবার উপায় নেই। ছোকরা পড়ে গেল মহা বিপদে। অস্কারের সঙ্গে বক্সিং লড়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। গেল বছরই এ অঞ্চলের চেম্পিয়ন হয়েছে এ সামনের শরাবখানাতেই। হোকরা পালাতে পারলে বাঁচে, কিন্তু অস্কার নাছোড়বান্দা। আর পাঁচজনও কথা কয় না—এ রকম রগড় তো পয়সা দিয়েও কেনা যায় না। সব পার্সনাল ম্যাটার কি না!
কিন্তু আমি বাপু ইন্ডার, কালা আদমী। আমি ছুটে গিয়ে ডাকলুম পুলিশ। ফিরে দেখি ছোকরা মুখ বাঁচাবার জন্য মুখ চুন করে কোট খুলছে আর শার্টের আস্তিন গুটোচ্ছে।
অস্কার যেন খাসা ভোজের প্রত্যাশায় জিভ দিয়ে চ্যাটাম দ্যাটাস শব্দ করছে।
পুলিশ নিত অনিয় বাধা দিল। ট্যাক্সি ডেকে কপোত কপোতীকে বিদেয় করে দিল।
অস্কার বললে, ওরে কালা শয়তান, কোথায় গেলি? আমার বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
বান্ধবী সোহাগ ঢেলে শুধালেন, আপনি কোন দেশের লোক? পয়লা কপোতও ঠিক এই প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করেছিল।
আমি দিলুম চম্পট। অস্কার চেঁচিয়ে শুধালো, যাচ্ছিস কোথায়? আমি বললুম, আর
না বাবা! এক রাত্তিরে দু-দুবার না।