বেয়ারা
বাংলা ভাষায় প্রায় এই একই উচ্চারণে দুটি শব্দ আছে। প্রথমটি ‘ড়’ দিয়ে, বেয়াড়া। অভিধানে এই শব্দের অর্থ বিকট, বেঢপ, বিশ্রী। বদ, মন্দ।
আমরা কথায় কথায় বলি লোকটা খুব বেয়াড়া কিংবা অত্যন্ত বেয়াড়া সময় যাচ্ছে। অনেকে অবশ্য এই বেয়াড়াতেও ‘র’ ব্যবহার করেন, আজকাল বিকট বা বদ বোঝাতে বেয়ারা শব্দটি বেশ চালু আছে।
আমরা কিন্তু অনুভব করি বেয়াড়া মানে বদ, মন্দ যাই হোক বেয়াড়াপনার মধ্যে একটা অনর্থক একগুঁয়েমি আছে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় অবশ্য একটু আলাদা। এই বেয়াড়া নিয়ে ব্যাকরণবিদ এবং আভিধানিক মাথা ঘামাতে থাকুন আমরা আসল বেয়ারায় যাচ্ছি।
প্রথমেই বলে নিই, এ বেয়ারা সে বেয়াড়া নয়। ‘র’ দিয়ে যে বেয়ারার বানান সেটা এসেছে ইংরেজি থেকে। Bearer এই ইংরেজি শব্দটি থেকে বেয়ারা। ইংরেজি বেয়ারার-এর খুব ভাল উদাহরণ বেয়ারার চেক। এখানে বেয়ারার মানে বাহক, চেক যে বহন করে নিয়ে যাবে ব্যাঙ্ক তাকেই টাকা দেবে।
আমরা এখন যে বেয়ারা নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা অনুযায়ী সেই বেয়ারা শব্দের মানে বাহক, পিয়ন, চাকর।
কিন্তু সাদা বাংলায় এখন বেয়ারা শব্দটির একটিই মানে হোটেল-রেস্তোরাঁর বেয়ারা। ইনি হলেন সেই ব্যক্তি সারা জীবনে যাঁর সঙ্গে সহস্র বার আমাকে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। সমস্ত জীবনে অদ্যাবধি মাত্র একবার সে যুদ্ধে জয়ী হয়েছি।
তখনও আমার পৌরুষ ছিল। তেজস্বিতা ছিল। ক্রোধ ছিল। হুঙ্কার ছিল। বান্ধবী ছিল। বান্ধবীর জন্যে প্রতীক্ষা ছিল। পার্ক স্ট্রিটের এক তথাকথিত পশ রেস্তোরাঁয় সুন্দরীর জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে অপেক্ষা করছিলাম। তিনি জানেন, তিনি যত দেরি করবেন তাঁর মূল্য তত বাড়বে।
এদিকে রেস্তোরাঁয় বিনা অর্ডারে কতক্ষণ বসা যায়। বাধ্য হয়ে আমি এক কাপ কফির অর্ডার দিলাম। এক পেয়ালা কফি এল, দুধ দেওয়া কফি সঙ্গে নকল রুপোর বাটিতে সুগার কিউব। বান্ধবী না আসার শোকে পরপর তিনটে সুগার কিউব কফিতে মেশালাম, তারপর চুমুক দিতে যাচ্ছি, দেখি একটা মাছি ভাসছে। বেয়ারাকে ডেকে মাছিটা দেখালাম। খুবই বেয়াড়া বেয়ারা। যেন কিছুই নয় এমনভাবে সে মাছিটা দেখল। প্রায় ফিরে যাচ্ছিল, তার হাতে কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এটা পালটে নিয়ে এসো।’
একটু পরে সে কাপটা পালটিয়ে আনল, সে রেখে ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় চায়ে চুমুক দিতেই বুঝতে পারলাম, অতিরিক্ত চিনির স্বাদে, এটা সেই আগের চা-টাই। আমি সে কথা বলতে সে প্রায় তেড়ে এল। কিন্তু যখন তাকে বললাম, ‘চায়ে চিনি কে মেশালো’, সে বোকা সেজে দাঁড়িয়ে রইল। জীবনে মাত্র সেই একবার বেয়ারাকে জব্দ করতে পেরেছিলাম।
তবে বেয়ারারা সবাই হৃদয়হীন হয় না। অনেকদিন আগে পাকিস্তানি ঢাকা শহরে ‘নিউইয়র্ক হোটেল’ নামে একটি ভাতের হোটেল ছিল। সেই হোটেলের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল এখানে আড়াই টাকায় গোস্তভাত পাওয়া যায়। সেটা সেই আট-আনা সের চালের যুগ, আড়াই টাকায় পাঁচ সের চাল হত। এখনকার একশো টাকার সমান।
তা সেই গোস্তভাত অর্থাৎ মাংসভাত খেতে গিয়ে দেখি একদম পচা, মুখে তোলা যায় না, খেলে অসুখ অনিবার্য। বেয়ারাকে আর কী বলব, তাকে ডেকে বললাম, ‘মালিককে ডাকো। এ মাংস কে খাবে?’
সেই দয়াবান বেয়ারা হাতজোড় করে বলল, ‘হুজুর, আপনে জোয়ান লোক আপনেই খাইতে সাহস পান না, মালিক বুড়া মানুষ, উনি এই মাংস খাইলে কি বাঁচবেন?’
এই গল্পটি অন্য খোলসে সম্প্রতি আরেকবার বলেছি। আরেকটা পুরনো গল্পে ফিরে আসছি। তা না হলে বেয়ারা-কাহিনী অপূর্ণ থাকবে।
কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলের একটি রেস্তোরাঁ। একগাল না কামানো দাড়ি, অবিন্যস্ত কেশরাজি, হলুদের ছোপ লাগা ময়লা সাদা কোট—বেয়ারা আমার টেবিলের পাশে। এক কাপ চায়ের জন্যে ঢুকেছি, কিন্তু সে সাপের মন্ত্রের মতো গুনগুন করে বলে যাচ্ছে, …ফিশ কাটলেট, ডেভিল, ভেজিটেবিল চপ…; এমন সময় আমি দেখলাম, লোকটির হাতের পাতায় চাকা-চাকা, লাল কী সব ঘায়ের মতো।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কি একজিমা আছে?’ সে বলল, ‘না, হুজুর ফিশ ফ্রাই হবে, কবিরাজি হবে, একজিমা হবে না।’