বেদে
ঝাড়া বিয়াল্লিশ বছর মিশরে চাকরি করার পর ইংরেজ রাস্ল্ পাশা (পাশা খেতাবটি তিনি মিশরীয় সরকারের কাছ থেকে পান) একখানি প্রমাণিক গ্ৰন্থ লিখেছেন। সা’দ জগলাল পাশা থেকে আরম্ভ করে বহু বাঘ বহুৎ চিড়িয়ার সঙ্গে তার বিস্তর যোগাযোগের ফলে এই ‘ কেতাবখানি লেখা হয়েছে।
এমন কি বেদেরাও এ বইয়ে বাদ পড়ে নি। রাসূল পাশার মতে মিশরের বেদেরা আসলে ভারতীয়। শুধু তাই নয়, রাসূল পাশা পৃথিবীর আর সব পণ্ডিতদের সঙ্গে একমত হয়ে বলেছেন, পৃথিবীর সব বেদেরই ভাষা নাকি আসলে ভারতীয়—তা সে ইয়োরোপীয় বেদেই হোক আর চীনে বেদেই হোক।
পণ্ডিত নই, তাই চটু করে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না। ইয়োরোপীয় বেদেরা ফর্সায় প্রায় ইংরেজের শামিল, সিংহলের বেদে ঘনশ্যাম। আচার-ব্যবহারেও বিস্তর পার্থক্য, বহুৎ ফারাক। আরবিস্থানের বেদেরা কথায় কথায় ছোরা বের করে, জর্মনীর বেদেরা ঘুষি ওঁচায় বটে, কিন্তু শেষটায় বখেড়ার ফৈসালা হয় বিয়ারের বোতল টেনে। চীন দেশের বেদেরা নাকি রূপালি ঝরণাতলায় সোনালী চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুকুন্সচুকুস করে সবুজ চাচাখে।
তবু আজ স্বীকার করি গুণীরাই হক কথা বলেছেন।
***
আমার বয়স তখন পাঁচিশ-ছাব্বিশ। আজ যেখানে জর্মনীর রাজধানী, সেই সাদা-মাটা বন্ন (Bonn) শহরে আমি তখন কলেজ যাই। এগারোটার ঝোকে কলেজের পাশের কাফেতে বসে এক পত্র কফি খাই। ও সময়টায় বনের মত আধা-ঘুমন্ত পুরীর কাফেতে খন্দেরের ঝামেলা লাগে না। খদের বলতে নিতান্ত আমারই মত দু’একটি কফি-কাতর প্রাণী।
সেদিনও তাই। আমি এক কোণে কফি সাঙ্ক করে উঠি-উঠি করছি, এমন সময় অন্য কোণের কাউন্টারে, আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল এসে এক বেদেনী। গোলাপী স্কার্ট, বেগুনি ব্লাউজ, লাল-নীলে ডোরা-কাটা স্কার্য, মিশকালো খোঁপাবাঁধা চুল। কেক আর কফির গুড়ো কিনতে এসেছে।
সওদা শেষ হয়ে গেলে পর যখন সে ঘুরে দাঁড়াল তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ল আমার উপর। প্রথমটায় থ হয়ে তাকিয়ে রইল প্যাট প্যাট করে। তারপর কি এক বিজাতীয় ভাষায় চিৎকার করে সোল্লাসে এগিয়ে এল আমার দিকে। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় সর্বমুখ টমাটোর মত লাল করে অনর্গল বকে যেতে লাগল সেই ‘যাবনিক’ ভাষায়। সে ভাষা আমার চেনা-অচেনা কোনো ভাষারই চৌহদি মাড়ায় না, কিন্তু শোনালো—তারই মুখের মত–মিষ্টি।
আমি জর্মনে বললুম, ‘আমি তো আপনার ভাষা বুঝতে পারছি নে।’
মেয়েটি মুখ করল আরও লাল। বুঝলুম, চটেছে। ফের চলল। সেই তুবড়ি বাজী–সেই বিজাতীয় বুলিতে। কিছুতেই জর্মন বলতে রাজী হয় না।
আমি কাতর হয়ে কাফের মালিককে বললুম, ‘একে বুঝিয়ে বলুন না, আমি ভারতীয়। এর ভাষা বুঝতে পারছি নে!’
আমার সকরুণ নিবেদনটা শেষ হওয়ার পূর্বেই মেয়েটা হুঙ্কার দিয়ে কাফেওয়ালাকে পরিষ্কার জর্মনে বলল, ‘সেই কথাই তো হচ্ছে। আমরা বেদে, ভারতবর্ষ আমাদের আদিম ভূমি। এও ভারতীয়। আমার জাত-ভাই। ভদ্রলোক সেজেছে, তাই আমার সঙ্গে কথা কইতে চায় না।’
আমি আর কি বলব? পণ্ডিতেরাও তো এই মতই পোষণ করে। তবু বললুম, কিন্তু সত্যি বলছি, আমি আপনার ভাষা বুঝতে পারছি নে।’
চোখে-মুখে—এমন কি আমার মনে হল চুলে পর্যন্ত-ঘেন্না মেখে মেয়েটা গাঁটগট করে কাফে থেকে বেরিয়ে গেল। আমি বোকা বনে তাকিয়ে রইলুম।
দিয়ে ডাকছে। কফির দাম পূর্বেই চুকিয়ে দিয়েছিলুম-চুপ করে বেরিয়ে পড়ে তার মুখোমুখি হলুম।
ধবধবে দাঁতে হাসির ঝিলিক লাগিয়ে আমায় অভ্যর্থনা করে নিয়ে বললো-দুত্তোর ছাই আমার সেই বিজাতীয় ভাষায়-কি বললো, খোদায় মালুম। গড় গড় করে চোখে-মুখে হাসি মেখে, সুডৌল দুখানি বাহু দুলিয়ে, সর্বাঙ্গে সৌন্দর্যের ঢেউ তুলে।
আমি আবার জর্মনে বললাম, ‘সত্যি ফ্রলাইন (কুমারী), আমি তোমার ভাষা বুঝতে পারছি নে।’
কেউটে সাপের মতো ফণা তুলে যেন আমাকে ছোবল মারতে এল। আমি তড়াক করে তিন কদম পিছিয়ে গেলুম।
হঠাৎ মেয়েটা কি যেন ভেবে নিয়ে আবার হাসিমুখে বলল,–যাক বাঁচাল, এবার জর্মনে–সব মানুষেরই কিছু না-কিছু পাগলামি থাকে, তোমার বুঝি, মাতৃভাষায় কথা না বলার? তা আমি সেটা সয়ে নিলুম। কিন্তু কেন এ স্নবারি, আপন ভাষাকে অবহেলা, কাফের লোকের সামনে আপন জনকে অস্বীকার করা? তাই তো তোমাকে বাইরে ডেকে আনলুম।’
আমি বললুম, ‘তোমার আপনি জন হতে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমি তো তা নাই।’
ফের ফণা তুলতে গিয়ে নিজেকে চেপে নিয়ে বলল, ‘তোমার আপনি জন নই। আমি? দেখো দেখিনি তোমার রঙ আর আমার রঙ মিলিয়ে-একই বাদামী না? হাঁ, আমার একটু সোনালী বটে।–তা সে আমি রোদবৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি করি বলে। দেখো দিকিন চুলের রঙমিশকালো, ঢেউ খেলানো। নিজের চোখে দেখনি কখনো আয়না দিয়ে?–আমার চোখের রঙ তোমারই মত কালো। আর সব জর্মনদের দিকে তাকিয়ে দেখো, হাবা-গবার দল, শ্বেত কুষ্ঠের মত সাদা, মাগো!’
আমি চুপ।
বলল, ‘বুঝতে পেরেছি, বাপু, বুঝতে পেরেছি; বাপ তোমার দু’পয়সা রেখে গিয়েছে—হঠাৎ নবাব হয়েছ। এখন আর বেদে বলে পরিচয় দিতে চাও না-হাতে আবার খতাপত্র-কলেজ যাও বুঝি? ভদ্রলোক সাজার শখ চেপেছে, না?’
আমি বললুম, ফ্রলাইন, তুমি ভুল বুঝেছি। আমার সাতপুরুষ লেখাপড়া করেছে, আমিও তাই করছি। ভদ্রলোক সাজা-না-সাজার কোনো কথাই উঠছে না।’
মেয়েটি এমনভাবে তাকালো যার সোজা অর্থ ‘গাঁজা গুল’। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ভারতীয় নও?’
আমি বললুম, ‘আলবাৎ!’
আনন্দের হাসি হেসে বলল, ‘ভারতীয়েরা সব বেদে।’
আমি বললুম, ‘সুন্দরী, তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়েছ হাজার দু’হাজার বছর কিংবা তারও পূর্বে। বাদবাকি ভারতীয়রা এখনো গোরস্থলী করে।’
কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বলল, ‘তোমার সঙ্গে আর কাঁহাতক খামক তর্ক করি। তার চেয়ে চলো আমার সঙ্গে। আমাদের সার্কাসের গাড়ি শহরের বাইরে রেখে এসেছি। বাবা, মা সেখানে। তোমাকে পেলে ভারি খুশি হবেন। তাঁদের সঙ্গে তর্ক করো। তখন বুঝবে ঠ্যাল কারে কয়। বাবা সব জানে। কাচের গোলার দিকে তাকিয়ে তোমাকে সব বাৎলে দেবে।’
অনেকক্ষণ ধরে এ রকম ধারা কথা হয়েছিল। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না, আমি বেদে নই, মব নাই, সাদা-মাটা ভারতীয়।
***
এ-কথাটা কিন্তু সেদিন সাফ বুঝে গেলুম, দু’হাজার কিংবা তার বেশি বছর ধরে যাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি তারা যদি বিদেশ-বিভুঁইয়ে দেখামাত্র আমাদকে ডাক দিয়ে বলে, ‘তুমি আমাদের আপন জন’, তখন কি করে বুক ঠুকে বলি–যদিও জানি, আজ আমাদের ভাষা আলাদা, আচার-ব্যবহার আলাদা-যে ওরা ভারতীয় নয়?