বেদের গরল বেদে অমৃত
দুটো ভিন্ন ধরনের ভুল ধারণার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। প্রথমটি প্রায়ই শোনা যায়— বেদের যুগে নারীর স্থান বেশ ভাল ছিল, তখন পুরুষের আধিপত্য থেকে মুক্ত ছিল নারী। এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। ঋগ্বেদের এক জায়গায়, মাত্র এক চরণে আছে ‘স্বয়ং সা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ’— সমাজে নারী নিজে তার বন্ধু (বা সঙ্গী) নির্বাচন করে। কিংবা গৌণ ব্যাখ্যায় পাই অন্য একটি চরণে বধূর স্থান: ‘উষো যাতি স্বসরস্য পত্নী’ সূর্যের পত্নী ঊষা যাচ্ছে, কোথায়? সূর্যের আগে আগে। কিন্তু নারীর এই সম অবস্থানের দিন ঋগ্বেদেই ফুরিয়ে গেছে। তার শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়কার আশীর্বাদ: তুমি শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ সকলের সম্রাজ্ঞী হয়ো। বলা বাহুল্য, এ প্রার্থনা ইচ্ছাপূরক। অথর্ববেদ বলে: সূর্যোদয়ে প্রেতরা তেমন করেই পালায় যেমন পালায় শ্বশুরের সামনে থেকে পুত্রবধূ; এ কোনও সম্রাজ্ঞীর আচরণ নয়। পরবর্তী সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে নারীর স্থান নীচে এবং অপমানের। বেদ বলছে, ‘খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে’। বলছে, ‘নারীর নিজের দেহ ও সম্পত্তির ওপরে কোনও অধিকার নেই’, ‘শিক্ষিত বা বিত্তবতী নারী পুরুষের সমান’ ‘একজন পুরুষের জন্যে অন্তত দু’টি নারী অত্যাবশ্যক, কিন্তু একটি নারীর পক্ষে একটি পুরুষই যথেষ্ট’, ‘নারীকে দান করা হয় ‘কুল’ (বৃহৎ যৌথ পরিবারের কাছে। কাজেই সকলেই তাদের অধিকারভুক্ত নারীটিকে নির্যাতন করতে পারে)’; ‘নারীর স্থান পুরুষের অধীনে’ ইত্যাকার আরও বহু শাস্ত্রোক্তিতে স্পষ্ট করে, নারীর অবনমনের নির্দেশ রয়েছে। উপনয়ন হত না বলে (বেদপাঠে তখনকার দিনে তা-ই ছিল শিক্ষা) তার অধিকার ছিল না, ব্যতিক্রম দিয়ে আইনটিই প্রমাণিত হয়। এই তো নারীর স্থান বৈদিক যুগে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবীতেই তখন নারীর স্থান এমনই ছিল, শুধু ভারতবর্ষে নয়, তবু কথাটা উঠছে এই জন্যে যে, আমরা স্ফীতকণ্ঠে দাবি করে থাকি, ভারতবর্ষ নারীকে দেবীর আসনে রেখেছে চিরদিন, কোনওদিন অবমাননা করেনি।
২
দ্বিতীয় যে ভ্রান্ত ধারণার বিস্তার জনমানসে, তা হল: ভারতবর্ষে বিজাতীয় মুসলমানের আগমনে যত অনাসৃষ্টির সূত্রপাত; ওরা বিধর্মী, পর, দূরের, ওদের দূরে রাখাই হিন্দুর ধর্মীয় আত্মরক্ষার পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। ভারতবর্ষে প্রথম বিজাতীয়, বিধর্মী আগন্তুক হল আর্যরা, প্রাগার্যদের পরাভূত করে মিশ্র বিবাহে ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিল আর্যরা, সৃষ্টি হয়েছিল একটি মিশ্র জনগোষ্ঠীর, তখনও বৈদিক যুগেও ছোট বড় গোষ্ঠী আসছিল, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে যবন, পারদ, পহ্লব, মুতিব, কুষাণ, শক, হূণ বহু জনগোষ্ঠীর আগমন এবং আক্রমণ ঘটে। এদের সম্বন্ধে বেদ কী বলে? আক্ষরিক অনুবাদে বলছি। ঋগ্বেদের শেষ সূক্তে পড়ি, ‘প্রাচীনেরা যেমন ভোগ্যসমূহের সমবণ্টন করেছিলেন, আমরাও যেন তেমন করতে পারি। বাক্যে এবং চিত্তে আমরা যেন সমভাবাপন্ন হই। আমাদের মন্ত্র, আমাদের চলাফেরা যেন ঐক্যবোধযুক্ত হয়; আমাদের হৃদয় এবং বুদ্ধি যেন এদের সঙ্গে ঐক্যে সংহত হয়। আমাদের কামনা, বাসনা, হৃদয় ও সত্তা যেন একীভূত হয়। আমরা যেন তোমাদের প্রতি সহিষ্ণুতায় সৌম্য হয়ে উঠতে পারি।’ আরও আছে, ‘আমরা যেন একতালে চলি, একসুরে কথা বলি, আমাদের হৃদয় যেন এক হয়।’ বিখ্যাত শিবসংকল্প সূক্তে শুনি, ‘যেমন ভীষণ আদিত্যগণ মরুৎ ও বসুগণের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে মিলিত হয়েছিলেন, সেই ভাবে আমাদের হৃদয় ও চিত্ত যেন দ্বেষ-হিংসা-রহিত হয়ে এই সব মানুষগুলির সঙ্গে মিশে যায়। দূরস্থিত, নবাগত, অভ্যাগত সকল মানুষকে আমরা যেন দেবতার মতো শ্রদ্ধা করি।’
যজুর্বেদের একটি সূক্তে বৈদিক সমাজের সমস্যাগুলির রূপ স্পষ্ট বুঝতে পারি: ‘জন্মসূত্রে বা পরিচয়সূত্রে যাঁরা আমাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন, যাঁরা আমাদের থেকে ভিন্নমতের, আমরা যেন তাঁদের সানুগ্রহে বরণ করি এবং তাঁদের সঙ্গে যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করতে পারি।’
অথর্ববেদ এই কামনাটি বলিষ্ঠ ভাবে ব্যক্ত করেছে, ‘স্বজনবর্গের প্রতি যেমন, বিদেশি ও বহিরাগতের প্রতিও যেন আমরা সমান দাক্ষিণ্য বহন করি। আমাদের মানসে যেন তাঁদের প্রতি কোনও বৈরিতা পোষণ না করি, আমরা যেন তাঁদের সঙ্গে সহমত হই।’
এ সব প্রার্থনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা সারাজীবন একাগ্রচিত্তে সাধনাও করেছিলেন এ প্রার্থনাগুলিকে বাস্তবে পরিণত করতে এবং তাঁদের এ প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছিল। বহু বিদেশি আগন্তুক, বহু আক্রমণকারী ভিন্ন ধরনের চিন্তা ও আচরণ নিয়ে এসেছিলেন আর্যাবর্তে। বর্ণবিভক্ত সমাজে তাঁদেরকে মিলিয়ে নেওয়াটা সহজ ছিল না। ধর্মে আচরণে, বিশ্বাসে তাঁরা প্রত্যেকে একে অপরের থেকে এবং সকলেই আর্যদের থেকে নানা ভাবে পৃথক, কখনও বা বিপরীতও ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য সাধনায়, কী কঠোর ব্রতযাপনে এ দেশের মানুষ বিধর্মী বিদেশিকে আপন করে নিল। এমন ভাবেই নিল যে, আজ আঙুল তুলে ভারতবর্ষের কোনও মানুষের দিকে নির্দেশ করে বলতে পারব না যে, এর পূর্বপুরুষ পারদ বা কুষাণ বা শক ছিল। এতগুলি বিভিন্ন মতাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে এমন নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন করে মিশিয়ে নিতে পেরেছিল সে দিনের ভারতবর্ষ, এমন একান্ত আত্মীয়তায় তাদের কাছে টেনে নিতে পেরেছিল।
৩
এই-ই চলছিল চারশের বছর আগে পর্যন্ত। সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনকালের কয়েক শতকের মধ্যে আরব, পারস্য থেকে বহু কবি, গায়ক, স্থপতি, ভাস্কর, চিত্রকর এসেছেন; তাজমহল, জামা মসজিদ, সেকেন্দ্রা বহু স্থাপত্যের অমূল্য নিদর্শন সৃষ্টি হয়েছে, সৌধগাত্রে অদ্ভুত সুরুচিসম্ভূত ভাস্কর্য। নির্মিত হয়েছে মিঞা কি মল্হার, দরবারি কানাড়া, ইমনকল্যাণ, বিলাবল— নানা আশ্চর্য অপার্থিব সুরতরঙ্গ। গ্রন্থচিত্রণ থেকে মুঘল চিত্রশালার বহুতর ছবি এখনও প্রমাণ দেয় অপূর্ব চিত্রকলার। কত কবি কবিতা লিখেছেন এ দেশেই আরবি ফারসি উর্দুতে। কিন্তু এ বৃহৎ কালপর্বে ভারতবর্ষ থেকে একটি নয়া পয়সা আরবে বা পারস্যে যায়নি। এই দীর্ঘ সহাবস্থানের যুগে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈনরা পাশাপাশি শান্তি ও সৌহার্দ্যে বাস করেছে, ওপরতলায় কখনও কিছু সংঘাত ধর্মান্তরণ হলেও বৃহৎ জনসমাজে এতটুকু চিড় ধরেনি কোথাও।
এর পর ইংরেজ রাজত্ব। ভারতবর্ষ এ আমলে পেয়েছে অনেক, দিয়েছেও কিছু কম নয়। ইংরেজ কখনও ভারতীয়দের কাছে মানুষ হয়ে ওঠেনি, রাজকীয় দূরত্ব রেখে চলেছে চিরকাল।
ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট দ্য ইয়ঙ্গার (Pitt the Younger) প্রকাশ্য পার্লামেন্টে উচ্চারণ করেন, ‘ভারত একটি দুগ্ধবতী গাভী’ (India is a milch cow)। শোষক শোষিতের সম্বন্ধে এই যেখানে মনোভাব, সেখানে আত্মীয়তার কথাই ওঠে না। অথচ এই আগন্তুক এবং চিরপ্রবাসী ইংরেজদের পদলেহন করতে ভারতীয়দের বাধেনি। দুগ্ধবতী ভারতের দোহন বিশেষ ভাবে হত অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ রাজপুরুষ যখন দেশে ফিরত তখন, তাদেরই করা নিয়ম অনুসারে তাদের বাকি জীবন ইংল্যাণ্ডে দুধে-ঘিয়ে রাখবার জন্যে আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি টাকা বছরের পর বছর এই গরিব দেশ থেকে পাঠানো হত।
যে দেশ অব্রাহ্মণকে বেদ পড়তে বা শুনতে দেয়নি, কেউ ভুল করে পড়লে বা শুনলে যেখানে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর শাস্তি হত, সেই দেশে ম্লেচ্ছ ম্যাক্স ম্যুলার সাহেবের কানে বেদ দেওয়ার অপরাধের কোনও ব্রাহ্মরের শাস্তি হয়নি, নগদ অর্থলাভ হয়েছিল প্রচুর। এই সাহেবদের প্রসাদ পাবার জন্যে কী আপ্রাণ সাধনা ছিল ভারতীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের। যাদের দম্ভ অহমিকার উপযুক্ত জবাব হত ঔদাসীন্য, তাদের জন্যে সতৃষ্ণ লোলুপতা ছিল। কিন্তু যে মুসলমান আত্মীয়কল্প হয়ে মিশে ছিল হিন্দুর সঙ্গে তাকেই পর এবং শত্রুজ্ঞানে দূরে ঠেকিয়ে রাখল ‘হিন্দু’। আজ বৈদিক সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য পদদলিত করে মুসলমানকে দূরে ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে অভারতীয়, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে।
অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবার ভারতীয় ঐতিহ্যে যা গর্ব করবার ছিল তা ধূলিসাৎ করে নিজেকে কল্পিত শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে গিয়ে দীর্ঘকালের পরমাত্মীয়তুল্য প্রতিবেশীকে ধনে প্রাণে বিনষ্ট করবার সাধনায় ব্রতী। সাধারণ ভারতীয় তো জানে ভারতের পূর্বসাধনা ভেদের মধ্যে সংহতির, ঐক্যের, মৈত্রীর; তারা কি আজকের দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে না, ‘স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুক্ত’। শুভবুদ্ধির বিকাশে ও সহজ প্রকাশে এই ধ্বংসলীলাকে ঠেকাবেই সংহতিকামী ভারতবাসী।