বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
“ওঁ বাঙ্ মে মনসি প্রতিষ্ঠিতা,
মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্।”
ঋগ্বেদের ঋষির প্রার্থনা। সেই অরণ্যের কালে, যজ্ঞধূমে পবিত্র তপোবনে, অতি শান্ত পরিবেশে উদ্গীত এই প্রার্থনা। আমার বাক্য মনে প্রতিষ্ঠিত হোক, আমার মন বাক্যে প্রতিষ্ঠিত হোক। মন আর মুখ এক হোক–ঋষি এই প্ৰাৰ্থনা রাখছেন। মন? মন তো সদাসর্বদাই আহত হচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় আসুরিক চিন্তায় সদা বিব্রত। যার মন, সে তো তার হদিস পায় না। মন শুদ্ধ মনের কাছে ফিরে এলে শুদ্ধ মন প্রশ্ন করে, ছিলে কোথায়? অপরাধীর মাথা হেঁট। ‘কোথায় না ছিলুম!’’আবার চললে কোথায়?” “যেখানে নিয়ে যাবে।’ ছান্দ্যোগ্য উপনিষদের ঋষি বলছেন, মনের কথা শোন, এই যে তুমি–মনযুক্ত মানুষ!
“অথ হ মন উদ্গীথমুপাসাঞ্চক্রিরে তদ্ধাসুরাঃ পানা বিবিধুস্তস্মাত্তেনোভয়ং সঙ্কল্পয়তে সঙ্কল্পনীয়ঞ্চাসঙ্কল্পনীয়ঞ্চ পাদ্মনা হ্যেতদ্বিদ্ধম্।।” (১।২।৬)
‘উদ্গীথম্’! উদীথ কাকে বলে? উদ্গীথই তো ঋষির প্রথম উপাস্য। সামবেদের একটি অংশ। সামগানের একটি অবয়ব। সমন্বয়ের তত্ত্ব প্ৰকাশ করছেন ঋষি। বাক্ হলো ঋক্। প্রাণ হলো সাম। আর উদ্গীথ হলো ‘ওম্’–এই অক্ষর। এটি হলো যুগল, অসাধারণ একটি ‘মিথুন’। ‘ওম্’ অক্ষর-এর স্বরূপ এই মিথুন। “তদেতন্মিথুনমোমিত্যে-তস্মিন্নক্ষরে সংসৃজ্যতে যদা বৈ মিথুনৌ সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্।” (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ১।১/৬) এই অন্যান্য মিথুনে জাত হলো ‘ওম্’। সমস্ত মিথুনের দান হলো পরস্পরের কামনা-বাসনার পূর্তি অথবা তৃপ্তি। জগদুৎপত্তির মূলে এই ওঙ্কার। আট প্রকার রসের উল্লেখ আছে, যেমন—সৃষ্টি-রস। অর্থাৎ বিষয়। অথবা ভূত। পৃথিবী হলো এই বিষয়সমূহের রস। পর্যায়ক্রমে—পৃথিবীর রস হলো জল। জলের রস ওষধিসমূহ। পুরুষের রস বাক্য। বাক্যের রস ঋগ্বেদ। সামবেদ ঋগ্বেদের রস। আর এই উদ্গীথ হলো সামবেদের রস। সব রসের শ্রেষ্ঠ রস এই উদ্গীথ। এইটিই পরম স্থান—ধাম। এইটি হলো অষ্টম স্থান। পৃথিবী, জল, ওষধি, পুরুষ, বাক্, ঋক্, সাম–এই সাতের পর অষ্টম স্থানে ওঙ্কার। অক্ষর পুরুষ।
দেখা যাক, উপনিষদের ঋষি কোথায় নিয়ে যান! ‘ঋষি’ শব্দের অর্থ—যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা। মন্ত্রকে যিনি দর্শন করেছেন। মন্ত্র কি? ‘মন্ত্র’ হলো মননলব্ধ জ্ঞান। দেবতা আর অসুর—দুটি স্বভাবের নাম। একই প্রজাপতির দুই সন্তান— পরস্পরবিরোধী। পরস্পরের সংগ্রাম কালের নিয়তি। চলবেই, চলবেই। এদিকে কেবলই পরাজয়ের চিত্র। দেবতাদের একমাত্র অস্ত্র এই উদ্গীথ। এই অস্ত্রভাণ্ডারের প্রথম অস্ত্র—’নাসিকার প্রাণশক্তি’, শ্বাস-প্রশ্বাসরূপে যার প্রকাশ। ঘ্রাণশক্তির উপাসনা শুরু হলো। পরাজিত হোক বিধ্বংসী আসুরিক ভাবসমূহ। অসুররা অতি হেলায় এই শক্তিকে পাপবিদ্ধ করে দিল। দুর্বল হলো শক্তি। সুগন্ধ, দুর্গন্ধ দুইই আসতে লাগল ঘ্রাণে; কারণ পাপবিদ্ধ হয়েছে যে!
এত অপূর্ব এই ব্যাখ্যা, এই দর্শন, এত বাস্তব যে অবাক হতে হয়! ব্ৰহ্ম নয়, মানুষ এবং তার শারীরতত্ত্বের জীবধর্মের অবলোকন। আমাদের কোন্ ক্রিয়াটি শুদ্ধ! অপাপবিদ্ধ! ঘ্রাণেন্দ্রিয় শুদ্ধ নয়। আচ্ছা, বাগেন্দ্রিয়ের কি অবস্থা? একই অবস্থা। অসুররা হেলায় তাকে পাপবিদ্ধ করেছে। সত্যবাক্যের প্রতিশ্রুতি তার পক্ষে রাখা সম্ভব হলো না। মিথ্যা ঢুকে গেল। মানুষ সত্য বলে মিথ্যাও বলে। সময় সময় সত্যমিথ্যার ভেদ বোঝে না।
দর্শন ইন্দ্রিয়েরও একই হাল। যা দেখা উচিত নয়, যাবতীয় পাপ-দৃশ্য দেখার জন্য উদগ্রীব। প্রলুব্ধ। “পশ্যতি দর্শনীয়ঞ্চাদর্শনীয়ঞ্চ।” (ঐ, ১।২।৪) বাকি রইল কর্ণ—শ্রোত্রেন্দ্রিয়। সেটিকেও অবহেলায় অসুররা অশুদ্ধ করে দিলে। আমাদের কান প্রিয়-অপ্রিয়, শ্রবণীয়-অশ্রবণীয় দুইই শুনে থাকে। এটা শুনব, ওটা শুনব না—এমন নয়।
মহাত্মা গান্ধী একটি ছবি ব্যবহার করতেন। পাশাপাশি তিনটি বাঁদর। একজনের দুটি চোখ হাত দিয়ে চাপা। আরেকটি দুটি কান আঙুলে দিয়ে বন্ধ করে বসে আছে। আরেকজন হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে। খারাপ কিছু দেখব না, শুনব না, বলব না। অসম্ভব! পাপবিদ্ধ এই তিন ‘উদ্গীথ’ই নষ্ট, ভ্রষ্ট। দুর্বল, অনায়াত্ত। ঋগ্বেদের একান্ত প্রার্থনা—প্রার্থনাই। অর্জন করা যাবে কিনা, সংশয়।
“ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবাঃ
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।” (১।৮৯।৮)
এইবার দেখা যাক, ‘মন’ কি করতে পারে! আমাদের মন! দেবতারা মনকে ‘উদ্গীথ’-রূপে উপাসনা করলেন। ভাবলেন, এবার আর কে আমাদের পরাভূত করবে! অসুররা হাসল। মনের জোর? আমরা যারা ‘মন যুক্ত’ বলে মানুষ, আমরা জানি মনের চেয়ে চঞ্চল আর কি আছে! অসুররা এই শেষ অস্ত্রটিকেও পাপবিদ্ধ করেছে—
“তদ্ধাসুরাঃ পাদ্মনা বিবিধস্তস্মাত্তেনোভয়ং সঙ্কল্পয়তে সঙ্কল্পনীয়ঞ্চাসঙ্কল্পনীয়ঞ্চ পাদ্মনা হ্যেতদ্বিদ্ধম্।।” (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ১।২৬)
মন চঞ্চল, সঙ্কল্পে কোনমতেই স্থির থাকতে পারে না। সাধু চিন্তার সঙ্গে অসাধু চিন্তা মনকে বিশৃঙ্খল করে তুলল। সেই মনেরই উত্তরাধিকার প্রবাহিত। তাহলে রইলটা কি? কিসের জোরে মানুষ সেই প্রার্থনাকে সফল করবে?—
“অসতো মা সদ্গগময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মাঽমৃতং গময়।।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্, ১।৩।২৮)
অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে, মৃত্যু থেকে অমৃতত্বে কে নিয়ে যাবে? দেবতাদের উপাসিত হলেন ‘মুখ্যপ্রাণ’। প্রাণের ব্যাখ্যা? পঞ্চপ্রাণ আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের যাবতীয় শক্তি। পঞ্চবায়ু-প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান। এই পঞ্চপ্রাণের সমাহারই ‘মুখ্যপ্রাণ’। দেবতাগণ উদ্গীথরূপে এই মুখ্যপ্রাণকে উপাসনা করলেন অবশেষে। এই অক্ষয় অব্যয় প্রাণশক্তিকে। অসুররা এই প্রাণকে পাপবিদ্ধ করতে গিয়ে শুধু ব্যর্থই হলো না, নিজেরাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। ঋষি বিশেষিত করছেন এই প্রাণকে ‘আখণ’ বলে, কঠিন ‘অশ্মা’। “যথাহশ্মানমাখণমৃতা বিধ্বংসতে এবং হৈব স বিধ্বংসতে।” (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ১।২।৮) পাথরের মতো। পাথরকে আঘাত করতে গেলে পাথরের কিছু হয় না, আঘাতের বস্তুটিই বিনষ্ট হয়। মুখ্যপ্রাণ হলো জ্ঞান।
এইবার আসল কথা। এই বেদান্তের ভূমিতেই শ্রীরামকৃষ্ণের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি বেদ—জীবন্ত। ঠাকুর বলছেন, জ্ঞান। কোন্ জ্ঞান? শাস্ত্রজ্ঞান? অবশ্যই নয়। আহৃত জ্ঞান নয়, উদিত জ্ঞান। সেই জ্ঞান সূর্যের মতো উদিত হবে। কিভাবে? বললেই হবে? না। মেঘ সরাতে হবে। বিষয়-মেঘ, আসক্তির মেঘ, অহঙ্কারের মেঘ। সেই মেঘ সরাবার জন্য কোন্ ঝাড়ু ব্যবহার করতে হবে? ফুলঝাড়ু না ঝুলঝাড়ু! ব্যবহার করতে হবে বিচারের ছুরি। সেই ছুরির শান হবে শাস্ত্রের সনাতন পাথরে। মহাপুরুষের সংশ্রয়ে। সেই বিচার শেখাবে নিত্য আর অনিত্যের প্রভেদ। আমি এসেছি, অনেকটা চ্যুত নক্ষত্রের মতো। যে দেবসভা, যার জ্যোতির নাম ব্রহ্ম, এই ‘আমি’কে ফিরে যেতে হবে সেই বিরাটে। ফিরে যেতে হবে উৎসে। ‘শীকর’ বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ বাতাসে চালিত জলকণা। সমুদ্রের ঢেউ অবিরত আছড়ে পড়ছে তটে। শীকরে সিক্ত হচ্ছে তটের মানুষ। জীব সৃষ্টিসমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ-শীকর। আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। ঠাকুর বলছেন, সমুদ্রের ঢেউ, ঢেউয়ের সমুদ্র নয়। জলের বুদ্, বুদবুদের জল নয়। আমি তুমির ভেদ মনের রচনা। আর এই রচনার প্রতিভা হলো অজ্ঞান। আর অজ্ঞান হলো মায়াদেবীর শাড়ির আঁচল। আমরা সেই আঁচলে চাপা পড়ে আছি। শুধুমাত্র শাস্ত্র পড়লে, গোটাকতক মন্ত্র তারস্বরে পাঠ করলে মায়ামুক্ত হওয়া যাবে না। প্রার্থনা, ঐকান্তিক প্রার্থনাই একমাত্র পথ। কৃপা কর। ঠাকুর এই সত্য সহজ করে প্রকাশ করছেন ঋগ্বেদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে- “নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।” (১০।১২৯।১) – সেকালে যা নেই, তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবীও ছিল না, অতিদূর আকাশও ছিল না।
কিছুই তো ছিল না। তাহলে এই অস্তিভ্রম কেন? ঐ যে যাদু-দণ্ড! যার নাম ‘মায়া’। ভ্রমকে মনে হচ্ছে সত্য, সত্যকে মনে হচ্ছে ভ্রম! অঘটন-ঘটন পটিয়সী মায়া। “কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্রবোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।” (ঋগ্বেদ, ১০।১২৯।৬) কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে? আর কোথা থেকে এসকল সৃষ্ট হলো?
সৃষ্টির উপাদান, নিমিত্তাকরণ কে জানে! জীবে কি জানতে পারে! “কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।” কালীই তো মায়া। আদ্যাশক্তি মহামায়া! ভক্ত প্রশ্ন করছেন : “ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথা পেলি!” ঠাকুর জানেন, মা প্রলয়কালে সৃষ্টির বীজ তুলে রেখেছিলেন ছোট ছোট পুঁটলিতে। গিন্নির ন্যাতা-কাতার হাঁড়ি। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়। মৃত্যু আছেই। প্রলয়ের সময় সব ধ্বংস হয়ে যাবে, কিছুই থাকবে না। মা কেবল সৃষ্টির বীজগুলি কুড়িয়ে রেখে দেবেন! আবার নতুন সৃষ্টির সময় সেই বীজগুলি বের করবেন। গিন্নিদের যেমন ন্যাতা-কাতার হাঁড়ি থাকে। তাতে শশাবিচি, সমুদ্রের ফেনা, নীলবড়ি ছোট ছোট পুঁটলিতে বাঁধা থাকে। মায়াকে চিনতে পারাটাই জ্ঞান।
ঋগ্বেদের ঋষি ‘কে জানে, কে জানে’ বলে রহস্যটাকে রহস্যেই রেখেছেন। ঠাকুর এলেন রহস্যের পর্দাটি সরাতে। বললেন, ব্রহ্ম আর মায়া এক। ব্রহ্মেরই মায়া। চাঁদ আর চাঁদের আলো। চাঁদ ছাড়া চাঁদের আলো হয় না। আবার চাঁদের আলো না থাকলে চাঁদ চাঁদই নয়। ঠাকুর ন্যায়ের এই সূত্রকে আরো প্রসারিত করলেন—গার্ডসাহেবের আলো, তিনি সকলের মুখ দেখছেন, তাঁর মুখ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কৃপা করে আলোটা মুখে ফেললে দেখতে পাওয়া যাবে। তুমি না দেখালে আমার দেখার উপায় নেই। ঠাকুর বলছেন, এগোও। শিকলে বাঁধা কড়িকাঠ গঙ্গার গর্ভে ডুবানো আছে—শিকলের আরেকদিক তীরে বাঁধা আছে। শিকলের এক-একটি পাব ধরে ধরে গিয়ে ক্রমে ডুব মেরে শিকল ধরে ধরে যেতে যেতে ঐ কড়িকাঠ স্পর্শ করা যায়। ঠিক সেইরূপ জপ করতে করতে মগ্ন হয়ে গেলে ভগবানের দর্শন। হয় রূপ, না হয় অরূপ। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মের মায়া দুটিই সত্য। রূপ এবং অরূপ উভয়ই সত্য। “তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।/তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।” (ঈশ উপনিষদ্, ৫) তিনি চলেন, আবার চলেন না। তিনি বহুদূরেও আছেন, আবার খুব কাছেও আছেন। সন্নাপি, ভিন্নাপি, অভিন্নাপি। এই সৃষ্টির সমস্ত কিছুর ভিতরেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। ঠাকুর বলছেন, ঈশ্বরের চৈতন্যে সব জরে আছে।
ঠাকুর বলছেন, হুঁশ। হুঁশ মানে জ্ঞান। মানুষ নয়, মানহুঁশ হও। জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হও। গীতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে ঠাকুর এইকথা বলছেন—
“তদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ।
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননিৰ্ধতকল্মষাঃ।।” (৫/১৭)
যাঁদের বুদ্ধি জ্ঞাননিষ্ঠায় ব্রহ্মে লগ্ন, যাঁদের ব্রহ্মে আত্মভাব এসেছে, ব্রহ্মে যাঁদের নিষ্ঠা বা চিত্তের স্থিতি, ব্রহ্ম যাঁদের পরম আশ্রয়, জ্ঞানধৌত পাপ হয়ে তাঁরা মোক্ষলাভ করেন। এই জীবনেই তাঁদের শেষজীবন অতিবাহিত হয়।
কাঁচা হাঁড়ি আর পাকা হাঁড়ির উপমা। কাঁচা আমি, পাকা আমি। “কুমোরেরা হাঁড়ি রৌদ্রে শুকুতে দেয়। দেখ নাই, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, কাঁচা হাঁড়িও আছে? গরু-টরু চলে গেলে হাঁড়ি কতক কতক ভেঙে যায়। পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলিকে ফেলে দেয়, তার দ্বারা আর কোন কাজ হয় না। কাঁচা হাঁড়ি ভাঙলে কুমোর তাদের আবার লয়; নিয়ে চাকেতে তাল পাকিয়ে দেয়, নূতন হাঁড়ি তৈয়ার হয়। তাই যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন হয় নাই, ততক্ষণ কুমোরের হাতে যেতে হবে, অর্থাৎ এই সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হবে। সিদ্ধ ধান পুঁতলে কি হবে? গাছ আর হয় না। মানুষ জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ হলে তার দ্বারা আর নূতন সৃষ্টি হয় না। সে মুক্ত হয়ে যায়।”
ঠাকুর হাসতে হাসতে প্রশ্ন করছেন—বাবু, তুমি কি সত্যিই মুক্তি চাও? ঈশ্বর চাও? মায়ার পারে যেতে চাও, সংসার দহনের বাইরে, অমৃতসদনে? তাহলে সাধন-পদ্ধতিটি শুনে রাখ—মন-মুখ এক করাই হচ্ছে প্রকৃত সাধন। মুখে বলছ, ‘হে ভগবান! তুমি আমার সর্বস্ব ধন’, অথচ মনে বিষয়কেই সর্বস্ব জেনে বসে রয়েছ। এমন লোকের সকল সাধনাই বিফল। সত্যকথা কলির তপস্যা। সত্যাশ্রয়ী হওয়া। মন আর মুখ এক করা।