বেদবতী
অশৌচের দিনগুলোয় বেদবতী ফল মিষ্টি নিয়ে প্রায়ই যান। সেজবউদি বলছিল— কী নোলাই হয়েছিল শেষটা ঠাকরুনের। মাংসের স্টু করছি। গন্ধ ছেড়েছে। নাক উঁচু উঁচু করে শুঁকছে— বউমা কী রাঁধছ? আমাকে দিয়ো তো! শোনো কথা। পঞ্চাশ বছর বেওয়া, মাছ-মাংস ছেড়ে মুশুর ডাল সুদ্ধুমুখে তোলেনি, সে খাবে মাংস।
বেদবতী শক্ত কথা বলতে পারেন না, তবু সাহস করে বললেন এবার— তোমাকে কিন্তু কিছুই বারণ করেননি মা। বরাবর মাছের হেঁশেলে।
সেজবউদি কথাটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন— আমার কথা যদি বলো, তোমার সেজদা গিয়ে অব্দি মাংস ছুঁইনি বেদো। মা অত বড় দিব্যিটা তোমার মাথার ওপর দিলে। কী করি বলো, একটু মাছমুখ করতুম। একাদশী, পুন্নিমে— সব বাদ দিয়ে কিন্তু।
বেদবতী বললেন— শেষকালটায় যা ইচ্ছে হয় মহাপ্রাণীর, দিতে হয়। কী-ই বা খাবে!
—মাথা খারাপ! ওদিকে নরক যদি না-ও হয়! এদিকে? ছেরাবে। কিছু মনে কোরো না ভাই। শয্যাগত এইরকম উলুধাবড়ি রুগির সেবা করা ভয়ানক কর্ম। চারটি এরকম কথা বেরিয়েই যায়।
নিশ্বাস ফেলে বেদবতী বললেন— মনে আর কী করব! এসব তো আমার মায়ের গায়ে লাগছে না। তিনি তো আর নিজেতে নিজে ছিলেন না। যিনি ছিলেন তিনি সর্বমঙ্গলা দেবী নন।
—তবে কি ভূতে ধরেছিল?
বেদবতীর মেয়ে রঞ্জা বলল— সে আবার কী মাইমা, তুমি সেনিলিটি জানো না? এত বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচলে, শরীরের অন্য যন্ত্র ঠিকঠাক, কিন্তু মস্তিষ্কটা কাজ করছে না ঠিক— এরকম অবস্থা তোমার আমার সবার হতে পারে!
—বাপরে! ভাবলে ভয়ে কাঁটা দেয়। ভগবান করুন যেন হাত-পা থাকতে থাকতে যাই।
আজ সেই সর্বমঙ্গলা ঠাকরুনের শ্রাদ্ধবাসর। যে ছবিটি দানসাগরের হরেক সামগ্রীর মধ্যে খাটবিছানার ওপর রাখা হয়েছে, সেটি অন্তত বছর কুড়ি আগেকার। বেশি তো কম নয়। ইতিমধ্যে ছবি বিশেষ তোলা হয়নি। যে কটি গ্রুপ ফটোয় পাওয়া গেল, বেদবতীর পছন্দ হয়নি। তাঁর সংগ্রহে মায়ের যে সবচেয়ে সুন্দর ছবিটি ছিল সেটিই চমৎকার করে বাঁধিয়ে চন্দন-মালা পরিয়ে শ্রাদ্ধবাসরে রাখা হয়েছে। শুভ্রবসনা। মুখে মায়ের হাসি। চুলগুলি যে পাকা তারও একটা মাধুর্য আছে। যেন মহিমায় মহিমা যোগ করছে। কপালে একটি চন্দনের ফোঁটা পরতেন উনি। বানপ্রস্থের জপমালাটি অবশ্য নেই। যতই গুরুপুত্রকে প্রণাম করুন, দীক্ষা নিন, রাধাগোবিন্দর পুজো করুন, এত উপবাস করুন, সর্বমঙ্গলা জপে বসেছেন এ দৃশ্য কেউ কখনও দেখেনি। বললে বলতেন— ওই তো জল বাতাসা দিলুম রাধাগোবিন্দকে, পাশে লক্ষ্মী রয়েছেন, সিদ্ধিদাতা গণেশ, আমার গুরুদেব বালানন্দজি। সব নিজেদের মধ্যে ভাগযোগ করে নেবেন এখন। ওঁরা তোদের মতো বেআক্কিলে নয়। যেদিকে না যাব সেদিকেই সব ছত্রাকার, যেটি না দেখব সেটি হবে না। বলি ও সেজবউ, বাচ্চাগুলোর শিঙিমাছের ঝোল, আলুভাজা হল? এখনও হয়নি? আর হয়েছে। শাউড়ির তো খুব নিন্দে হয়, বলি আর একটু কাজে মন দিলে হত না? তোমার নিজের ছোটটাই তো আপসাচ্ছে।
সে যাই হোক— ছবিটিতে তাঁকে বেশ গুরুমা গুরুমা লাগছে। যেন ঈশ্বরের সঙ্গে সদাসর্বদাই দেখা হচ্ছে। বন্ধুর সম্পর্ক। তিনি নিজেও যেন সব কাজের কাজি, সবার আশ্রয়স্থল। মা বলে একবার হত্যে দিয়ে পড়লে জগতের সর্ববিধ সমস্যার সমাধান করে দেবেন।
অভ্যাগতরা অনেকেই ছবিটির প্রশংসা করছিলেন।
—বয়সকালে রূপে জগদ্ধাত্রী ছিলেন বোঝাই যায়— একজন বললেন, জোড় হাতে নমস্কার করলেন ভক্তিভরে।
রঞ্জার মনে হল— জগদ্ধাত্রী যদি না থাকতেন বয়সকালে তো কী হত! শ্রাদ্ধবাসরে ভক্তি শ্রদ্ধার ঝুড়ি কি খালি যেত? কী যে এদের ভ্যালুজ! সেই একঘেয়ে তুলনা— লক্ষ্মীস্বরূপা লক্ষ্মীশ্রী, স্বয়ং দুর্গা, জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ, আর কী কী! সীতার মতো চরিত্র, সাবিত্রী সমান হও, এক কথা, এক কথা। লক্ষবার শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল।
বেদবতী কথা বলতে চাইছিলেন না। তাঁর মন পড়ে ছিল সেই কোন কালের ছোটবেলায়। তখন ভাইবোনেরা, মা বাবা… সেসব কি স্বপ্নে দেখেছিলেন? যেন কোনও রিয়্যালিটি নেই সেই ছোটবেলার। একেবারে অবাস্তব! কে এই তিনি? আয়নায় মুখ দেখে সাত আট বছরের সেই এক্কা-দোক্কা খেলা বালিকাকে তো চিনতে পারেন না। অথচ সে-ই সত্যি। এই পলিত কেশ আশি বছুরে বৃদ্ধা নয়। অনেক চেষ্টা করে একটা আবছা ছবির মতো মনে পড়ল ডুরে শাড়ি পরা যুবতী মাকে। মুখখানা এত আবছা যে মানুষটা যেন স্কন্ধকাটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওদিকে কীর্তনের ও-ও-ও-ও হুংকার উঠেছে। মাথুর গাইছেন একটি দল। তাঁদের ছোটবেলার সেই সব ময়না ডাল-টাল জাতীয় কিছু আর নেই। এখন বেশির ভাগ বাড়িতেই একজন কোনও শিল্পীকে ডাকা হয়, কীর্তনও গান, আবার নানারকম ভক্তিমূলক গান তাঁরা। রঞ্জার পিসি মারা গেলেন, তখন রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন কয়েকজন বিখ্যাত গাইয়ে। চার জেনারেশন বাস করছে এ বাড়িতে, এখনও ছোটকনে বেঁচে। এখানে এসব হবার জো নেই। কিন্তু সবাই এদিকে ওদিক দল বেঁধে গল্প করছে। গানে কারও মন নেই। গানের হা-হুতাশও কাউকে স্পর্শ করছে না। চা আসছে, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংক। কেউ কেউ উঠে গিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছেন। মূল গায়েনও উঠে গেলেন এবার। রঞ্জা বলল— সিগারেট ব্রেক মা।
রঞ্জা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, চতুর্দিকে খালি বৃদ্ধ বৃদ্ধা। এত বুড়োবুড়ি সে যেন আগে একসঙ্গে কখনও দেখেনি। সাদা পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়া ও ধুতি পরা বৃদ্ধ, থান, ধুতি, চওড়া পাড় পরা বৃদ্ধা। অনেকের পাকা চুলের মাঝে বিন্যস্ত সিঁদুর, মাথাময় ছড়িয়ে গেছে। একজন বিধবা বহু দিন জ্বলবার ও জ্বালাবার পর মারা গেছেন। তিনিও জুড়িয়েছেন, বাড়ির লোকও জুড়িয়েছে। তাই তাঁরা তাঁদের সধবা-গৌরব ঘোষণা করতে এসেছেন চওড়া লাল জরিপাড় শাড়ি ও বিসদৃশ সিঁদুরে। অনেক অল্পবয়সি বধূ ও গিন্নিও রীতিমতো গয়না পরে এসেছেন। বৃদ্ধদের মুখগুলি কেমন উদ্ভ্রান্ত মতো। অন্তত রঞ্জার তাই মনে হল। আত্মস্থ নয় যেন। এত দিন তাঁদের চেয়েও বয়সে বড় কেউ বেঁচে ছিলেন, এখন তিনি চলে যাওয়ায় সে আড়াল সরে গেল। এক্সপোজড্ হয়ে গেছেন শেষের সে দিনের সামনে। অনেকরকম কথা কানে এল। কেউ বলছেন— বড় ভাল ছিলেন দিদি/বউদি। আগের বার আমাকে চিনতে পেরেছিলেন। বললেন হরি না? অথচ দেখ এরা বলে নিজের লোকেদের পর্যন্ত নাকি কখনও-কখনও চিনতে পারতেন না।
একজন বললেন— তুমি তা হলে আপনজনের বাড়া ছিলে হরিদা…। কী জানো। বুড়ো হয়ে গেলে কেউ আর পোঁছে না। বাড়ির লোকেদের থেকে বাইরের অতিথিকে তাই আপন মনে হয়।
—সেনিলিটির সাইকোলজি বোঝা অত সোজা নয়। একজন শক্তপোক্ত বৃদ্ধ বললেন, তা হলে জেরন্টোসাইকোলজিস্ট হতে হয়।
একজন হেসে বললেন— তোমার ওই বোম্বাই কথাটার কোনও মানে নেই শম্ভু। এরা যে বৃদ্ধদের বাঁচাবার জন্যে এত চেষ্টা কেন করছে আমার বোধগম্য হয় না, তা যদি বলো। ষাট বছরে বিদায় দিবি, ফিজিক্যাল অ্যাজিলিটি আর মেন্টাল অ্যালার্টনেস নেই বলে। স্বল্প সঞ্চয়ের সুদ দিনে দিনে কমিয়ে দিবি যাতে বুড়োটা দুধ-মাছ-ফল খেতে না পারে। কোনওক্রমে ডাল ভাত, তো এত ওষুধ-বিষুধ কেন? সর্ব বউঠানের বোধহয় চুরানব্বুই পঁচানব্বুই হয়েছিল। আমার শ্বশুর গেলেন নব্বুইয়ে। তাঁকে টানা দশ দিন লাইফ-সাপোর্টিং-এ রেখে দিলে! আরে সে লোকটা দশ দিন আগে মারা গেছে! কেন বলো তো! লাখ-লাখ টাকা পার্টির হাত থেকে আদায় করবে। তোরা, তোদের জেনারেশন উচ্ছন্নে গেছিস, মানুষের প্রাণ নিয়ে বেচাকেনা করিস তো আবার জেরন্টো-টেরন্টো কেন শম্ভু? হরি, তুমিও বলো।
একজন বললেন— আমার কী মনে হয় জানেন, বৃদ্ধরা এক ধরনের গিনিপিগের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে কোনও সময়ে পুনর্যৌবনের কি অক্ষয় যৌবনের ওষুধ বার করবে বলে বুড়োদের বাঁচিয়ে রাখছে। নানা এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে।
একজন পদস্থ বৃদ্ধ কোঁচানো ধুতি ও গিলে পাঞ্জাবি পরে হাতে রুপো বাঁধাই লাঠি নিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। আর পারলেন না। এঁদের দিকে তির্যক তাকিয়ে উঠে পড়লেন। সার সার ভুজ্যি উৎসর্গ করছেন সর্বমঙ্গলার নাতবউরা। ছোটমামার মেয়ে গীতালি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল— দাদু, আপনি চলে যাচ্ছেন? একটা থেকেই খাওয়া শুরু হয়ে যাবে।
কাষ্ঠ হেসে ভদ্রলোক বললেন— দাদুদের কি আর ব্রাহ্মণভোজনের জন্যে বসে থাকা মানায়? আমি উঠি। …না না ঠাট্টা করছিলুম। উঁহু, আমার ওসব চলে না, স্রেফ সেদ্ধ ভাত উইদাউট মাখন অর ঘি।
নিজেদের অবস্থানের বিষাদ ও বিরক্তিতে একজন বৃদ্ধ উঠে যাবার দৃশ্যটা কেউ লক্ষ করল না।
শম্ভু নামের ভদ্রলোক বললেন— আজকাল বলছে লাইফ স্টার্টস অ্যাট সিক্সটি। লাইফ স্টার্টের বয়সটি ক্রমে উঠছে। একসময়ে বলত ফর্টি, তারপর বলল ফিফটি, ইদানীং সিক্সটি। তা সিক্সটির আগে কি সব প্রস্তাবনায় ছিল। বই শুরুই হয়নি! —হাসলেন কয়েকজন, বললেন— বই-ই বটে!
একজন বললেন— দেখবে রিঙ্কলফ্রি ক্রিমের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। মাথার চুল কালো করে দেবে, চোখের তলার থলে অপারেশন করে দেবে। ক্রিম মাখিয়ে রিঙ্কল তুলে দেবে, লেজার ট্রিটমেন্ট করে ঝোলা চামড়া টান করে দেবে। আর কী চাই?
—চাই টাকা! আর কী! সুদের দরুন যে আট পার্সেন্ট পাচ্ছ, তাই দিয়ে খাবে? না রিঙ্কল মাখবে? এত যখন সুবিধে তখন দে টাকা। সুদটা বাড়িয়ে আগের মতো টুয়েলভ পার্সেন্ট করে দে! কী সর্বনেশে, চশমখোর গভমেন্ট বাবা। সারাজীবন সার্ভিস নিলে। চোখে কানে দেখতে পেলুম না। হঠাৎ বলে, ওঠ বুড়ো তুই বাড়ি যা। পেনশন? পাবি না, কাগজপত্তর তৈরি হতে হতে টেঁসে যাবি আশা করছি।
এ বাড়ির একটা সুবিধে আছে। দাদাদের ছেলে-বউ-মেয়ের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু তারা কেউ বাইরে সেটল করেনি। তারাই কাজকর্ম করছে। জীবিত ভাইদের মধ্যে কনেভাই ভবানীপ্রসাদ আর ছোটভাই শিবানীপ্রসাদ। দু’জনেই বেদবতীর থেকে ছোট। সেজবউদি তাঁর বয়সি। রাঙাবউদিও ছোট। তবে সবারই ৬৭/৬৮ থেকে ৭৮/৭৯-র মধ্যে বয়স। ছোটবউ ললিতা বলল— কত দিন পরে বলো ঠাকুরঝি? দেখাসাক্ষাৎ-ই নেই। আমার বিয়ে হল, তখন রঞ্জিত তোমার কোলে। কী ফুটফুটেই ছিল। ক’দ্দিন দেখি না। ভাল আছে তো সব?
বেদবতী অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন— রঞ্জিতই একমাত্র সাগরপার এবং সঞ্জু আর নেই। কিন্তু অন্য ছেলেরাও একেক ভাই একেক ঠাঁই। যে কোনও বেলা সে ছোটবেলাই হোক আর যৌবনবেলাই হোক বৃদ্ধের দৃষ্টিতে দেখলে কত অন্যরকম। একেবারে অবাস্তব। রঞ্জিত মুড়ির মোয়া খাচ্ছে, তিনি গলদা চিংড়ির হাঁড়ি কাবাব রান্না করছেন। মঞ্জু পাশে বসে বসে শিখছে। সঞ্জয়ের কাছে কানমলা খেয়ে রঞ্জা হাসছে। টাস্ক্ করেনি। কত ছোট ছোট দৃশ্য।
দুই ভাইবোনের একসঙ্গে জলবসন্ত হল— এক মশারিতে দুজনে শুয়ে। যতক্ষণ না মা আসবে উশখুশ উশখুশ। নিমের ডাল নিয়ে খেলা। সেই প্রথম শুনলেন চিকেন-পক্স-এ মাছমাংস অর্থাৎ প্রোটিন অবশ্যই খেতে হয়। জ্বর কমে গেলেই ছেলেরা ফল দুধ মাছমাংস সবই খেল। সেরে যাবার পর না রইল কোনও দুর্বলতা, না রইল কোনও দাগ। উনিই বললেন এসে— ভাল চারা পোনা এনেছি। লাফাচ্ছিল, আর মুরগি। ব্যস খাবে আর লাফিয়ে উঠবে।
—চারা মাছ খাব না।
—সে কী রে? চারা মাছের চারা নেই। নির্মল ডাক্তারবাবু ভীষণ রেগে যাবেন। দু’চার দিন খা বাবা, তারপর আবার বড় মাছ আনব। পেঁপে দিয়ে ঝোল করে দিয়ে বুঝলে?
—পেঁপে? হোয়াক থুঃ…
—বলিস কী রে পেঁপে, পাপায়া! যে খাবে তার পাপ নাশ হয়ে যাবে, জানিস না?
উনি ওইরকম মজা করে কথা বলতেন। ফুর্তিবাজ মানুষ।
—এসব কি স্বপ্নে দেখেছেন, না কোনও বইয়ে পড়েছেন? এসব অভিজ্ঞতার কিছুই যেন তাঁর আশি বছুরে সাদা কুঁচকোনো শরীরের কোথাও নেই।
—দিদিমা আমার জলবসন্তর বেলায় এসেছিলেন আমার কাছে। মনে আছে মা তোমার? রঞ্জার কথায় শ্রাদ্ধবাসরে ফিরলেন বেদবতী।
—হ্যাঁ মায়ের সেবাটা খুব ছিল— ছোটবউ বলল, কনেবউ সায় দিল। কটাক্ষে একবার সেজর দিকে তাকাল, নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
বেদবতীর মনে পড়ে গেল রাঙাদার বিয়ের সময়ে সর্বমঙ্গলা এক কাণ্ড করেছিলেন। প্রত্যেক বিয়েতেই অবশ্য কাণ্ড হত। শয়ে শয়ে মেয়ে দেখা, মেয়েদের চুল খুলিয়ে, হাঁটিয়ে দেখা। অত্যন্ত লজ্জাকর। বেদবতীর সেসব জায়গায় যেতে ইচ্ছে হত না। কিন্তু কী করবেন মায়ের জেদ। খুকি নইলে ‘আজকালকার’ পছন্দ অপছন্দ কে বুঝবে!
—তুমি বড়বউদিকে নিয়ে যাও, মেজবউদিও তো রয়েছে।
—ওরা তো যাবেই, তুইও যাবি। খালি সেজকে নেব না। কী বলতে কী বলবে!— নিজে যেন খুব ভাল কথা বলতেন।
খোঁপাটা একটু খোলো তো মা! ভেতরে আবার গুছিটুছি কিছু আছে। নাকি! গুছি বেরোল। বললেন— অতখানি খোঁপা চাই না। খোঁপা নিয়ে কি আমরা ধুয়ে খাব মা! মাথা সাজানো চুল হলেই হল। নকল দিয়ে কী হবে? মুখে কি পেন্টও করেছ, আজকাল সব হয়েছে কতরকম।
বেদবতী বললেন— আঃ মা!
—আঃ কেন? আমার এক কথা। শোনো মা, আমার ডানাকাটা পরি, কেশবতী মেমসায়েব চাই না। সাধারণ মেয়ে, ছিরিছাঁদ থাকবে। এই পর্যন্ত। নম্র, বিনয়ী, সংসারের কাজকর্ম জানবে, গুরুজনকে সম্মান করবে, ছেলেমানুষকে স্নেহ করবে— ব্যস।
অরুণা অর্থাৎ রাঙাবউদি লাল মুখে বলেছিল— সাজগোজ করেই তো দেখতে চান সবাই। সাজগোজ করতে হলে একটু স্নো পাউডারও মাখতে হয় মাসিমা। এমনি দেখতে হলে রান্নাঘরে এসে দেখুন না, কে বারণ করেছে!
বলে আবার একটু ফিক করে হেসেছিল।
মা হেসে বললেন— ঠিক কথা। একশোবার ঠিক। তুমি তোমার দিক থেকে একবারে খাঁটি কথাটি বললে। তা আজ মাসিমা বললে, কাল মা বলতে পারবে তো?
অবিনয়ী, মুখরা বলে অরুণাকে বরবাদ করেননি মা। রাঙাবউদি মায়ের খুব প্রিয়ও ছিল। মাঝে মাঝে বলতেন— সে আমায় জব্দ করেছিল একজন। পাউডার মেখে ফরসা হয়ে, চুলের ভেতর গুছি দিয়ে মস্ত খোঁপা করে, জরিপাড় জর্জেট শাড়ি পরে পরিটি হয়ে বার হলেন। যে-ই না খোঁচা দিয়েছি অমনি পরির মধ্যে থেকে বুদ্ধিশুদ্ধিঅলা গোটাগুটি একটা মানুষ বার হয়ে এল, বলল সর্ব দেখ, কী অন্যাই কথা বলেছিস। শুধরে নে। শুধরে নে।
শুধরে অবশ্য নেননি সর্বমঙ্গলা। ন’ বউদির বেলা তত্ত্ব পছন্দ হল না। ফেরত দিলেন। মায়ের ছেলেরা ছাড়া সবাইকার লজ্জার একশেষ। ছেলেরা মায়ের সিদ্ধান্তের ওপর কথাটি বলত না।
কেন অপছন্দ? —বেনারসি জ্যালজেলে, দু’খানা না দিয়ে একখানা ভাল দিলেই তো হত! নমস্কারি সব সস্তার ফরাশডাঙা দিয়েছে।
—আচ্ছা মা। বেদবতী বলেন— বেনারসি তো তুমি পরবে না, পরবে বউদি, তোমার কী? ও সব নমস্কারি পরবে পাঁচজনে। তোমাকে তো গরদ দিয়েছে!
—আহা হা হা, একটা দেখনাই আছে না! লোকে এসে তত্ত্ব দেখবে। পাঁচজনে যদি বলে কুটুমের নজর ছোট তো কার মাথা কাটা যায়?
—কারও না। সেজবউদি হেঁকে উঠল— আমার বিয়েতে তো সাতখানা বেনারসি এসেছিল, দামি দামি, তার মধ্যে চারখানাই তো অন্য বউদের দিয়ে হাপিস করে দিলেন। কী, না ওদের নেই। তা এগুলোও হাপিস করে দিন, অন্য বউদের আলমারি থেকে নিয়ে কনেবউকে দিয়ে দিল দেখান। তা না, তত্ত্ব ফেরত দিচ্ছেন। কী অপমান! কী অপমান!
কিছুতেই টলেননি সর্বমঙ্গলা। তত্ত্ব ফেরত গেল। সেই বেলার মধ্যেই ভদ্রলোকের ভাল নমস্কারি জোগাড় করতে হল। সর্বমঙ্গলার হাতে-পায়ে ধরলেন— বেনারসি তো আমার মেয়ে পরবে দিদি, ছেড়ে দিন, আর পারব না। মিষ্টির তত্ত্ব, ফলের তত্ত্ব কীরকম করেছি, দেখুন! পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সব কিছু একেবারে ফার্স্টক্লাস। সত্যিই রেকাবির মতো ক্ষীরমোহন, বিরাট সাইজের শিঙাড়া, টেনিস বলের মতো খাস্তার কচুরি, প্রচুর মাছ এল সাত সেরি। ফলের ঝুড়িতে শীতের দিনের সব ফল। তরিতরকারি। সেই ক্ষীরমোহনই সেজবউদি খপ করে তুলে নিয়ে খেয়েছিল।
আহা! ভদ্রলোকের প্রচুর দেনা হয়েছিল। কালো মেয়ের বিয়ে দিতে ডুবে গিয়েছিলেন একেবারে। কিন্তু এ বউদিরও খুব বুদ্ধি। তাঁকে চুপিচুপি বলেছিল— বুঝলে ঠাকুরঝি, তোমার ভাই খুব বুঝদার। অনেক ভাগ্যে এমন স্বামী পেয়েছি। বাবার ধার শোধ দিচ্ছে মাস মাস। কাউকে বলবে না তো!
—ছিঃ, কাকে আবার বলতে যাচ্ছি!
প্রথমটা তাঁর খটকা লেগেছিল, এ আবার কী! সবে বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরের দেনা শোধ করছে! কাউকে বলেননি। খটকাটা সমানে খচখচ করছে। কনেভাইয়ের একটু পরে বিয়ে হয়েছে। তাই কি এখন থেকেই বউয়ের ভেড়ু। শ্বশুরবাড়ির পোষা হয়ে গেল? ছি ছি। কাউকেই বলেননি— বউদি বিশ্বাস করে তাঁকে বলেছে। বউদি লোক চেনে। বুদ্ধিমতী তো? তারপর ভুলে গেছেন কবে। পণপ্রথা নিয়ে যখন কথা চালাচালি হতে লাগল, খবরের কাগজে, মানুষের মুখে মুখে… তাঁর স্বামী বললেন— টাকা নিচ্ছে, মানে ছেলেকে বেচে দিচ্ছে ধর্মত। তো তাই দাও! ছেলেও রইল ঘরে বাঁধা, মায়ের জন্যে দাসীও এল, তো টাকা কেন? দাসীতে কি টাকা আনে? আনে রানি জাতীয়রা। তবে তাকে রানির মতো রাখো। তাঁবে থাকো। হুকুম পালন করো। এ এক আচ্ছা গোলমেলে সমাজ তৈরি হয়েছে! একটা প্রিন্সিপলে চল। ডাবল, ট্রিপল হয়ে যাচ্ছে যে! প্রত্যেকটা সেলফ কনট্র্যাডিকটরি।
স্বামীর বন্ধু সচ্চিদা বললেন— পেছনে যুক্তি নেই বলছ! ছেলেকে যে এত কাঠখড় পুড়িয়ে পয়সা খরচ করে বড় করলুম, সে উশুল করতে হবে না! ছেলে দামি নয়!
হা হা করে হাসছেন কিরণময়— ভাল বললে। তুমি জন্ম দিলে, পয়সা খরচ করে উপার্জনক্ষম করা তোমার কর্তব্য, তাই করেছ! তো? সে উপার্জন করে তোমাকে বুড়ো বয়সে দেখবে, এর মধ্যে মানুষ করার খরচ-খরচা উশুল করার কথা আসছে কোত্থেকে? ছেলেই উশুল করবে বাপকে দেখে— এই তো সোজা হিসেব। ছেলের বউয়ের বাবার থেকে কী সুবাদে টাকা নিচ্ছ? সেও তো তার মেয়েটিকে খাইয়ে-পরিয়ে, শিখিয়ে-পড়িয়ে বড় করেছে। উশুল তো পাচ্ছেই না, বরং উশুল করবার সময়ে পরের ঘরে সংসার করতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দিচ্ছে তো? তা তার ওপর পণের টাকা, একশো চল্লিশখানা নমস্কারি, এসব কী! মেয়েটিকে নিলে বলে টাকা বরং তুমি কিছু গুনে দাও! যদিও কন্যাপণও ছোটলোকি কারবার। মানুষ কেনাবেচা যায় না। তা করলেই দাস-ব্যাবসা হয়ে গেল। বুঝলে ভায়া?
ভায়া কতটা শুনলেন বা বুঝলেন কে জানে। কেননা সংস্কার, অভ্যাস বা ঐতিহ্য, বিশেষত তার সঙ্গে যখন স্বার্থ জড়িত আছে, তা ত্যাগ করা খুব শক্ত। যুক্তি, বুদ্ধি সেখানে কাজে লাগে না। অনেকবার দাদা বা ভাইদের বিয়ের সময় ‘ঘরখরচা’ কথাটা শুনেছেন বেদবতী। ‘ঘরখরচা’ হাজার দুই তো দিতেই হবে, যত বেশি দেবেন তত জাঁক করতে পারব। —কে বলছেন? —বাবা, আড়-লম্বা, দোহারা চেহারা, এইসা ঝোড়ো ভুরু আর গোঁফ। খট করে লাগত কানে। বউদির বাবা টাকা দেবেন, সেই টাকাতে পোলাও-মাংস দিয়ে জাঁক হবে। তাঁদের বাড়িতে? কেমন যেন বিসদৃশ, অসংলগ্ন। তবু তেমন করে প্রশ্ন করেননি মৃদু স্বভাবের মানুষটি। বাবা গত হবার পর মা যখন সেই ভূমিকাটাই নিলেন, আরও খারাপ লাগল সেজবউদির বেলাতেই আপত্তি করেছিলেন। —মা, এগুলো কি না চাইলেই নয়? নিজেদের কেমন খেলো লাগে না?
—তুই থাম, বেদবতী বিদ্যেবতী। এগুলো আমাদের পাওনা। তা ছাড়া তারা নিজে থেকে দিতে চাইছে। একটা দর কষাকষি হচ্ছে, কিন্তু যা চাইব, অন্যায্য তো চাইব না। রাজি হয়ে যাবে। হাঘরে-হাবাতে তো আর নয়, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের সম্পন্ন গেরস্থ। বহু জমিজমা, চালকলে গমকলে টাকা খাটছে। মেয়ে বলতে একটি।
—আমিও তো তোমার একমাত্র মেয়ে। দিয়েছিলে? কত দিয়েছিলে মা?
—সে তখন তো কর্তা বেঁচে। তিনি কী দিয়েছেন আমি জানি না।— মা স্পষ্টই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন।
—তোমার জামাই আপত্তি করেননি?
—কিরণ? সে তো তখন বছর বিশের ছোকরা। সবে পাসের পরীক্ষা দিচ্ছে, সে জানতই না, জানবার কথাই না।
নিজের ভেতরের সত্তা যেই বলে দিচ্ছে এটা ঠিক নয়, তখনই বেদবতীর কান খাড়া হয়ে গেছে— কে কী বলছে। স্বামীকে তাঁর নানা ত্রুটি ও অবিবেচনা সত্ত্বেও খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। মানুষটি ছিলেন দরাজ-স্বভাবের। ভাল উপার্জন করতেন, কিন্তু যত্র আয় তত্র ব্যয়। তিনিই মাঝে মাঝে টেনে রাখতেন। তা হলে পণ স্বামী ভাল মনে করেন না? তাঁর বিয়েতে তাঁর বাবা পণ নিয়েছিলেন— জানেন না! কিরণময়ের নিজের জীবনে সংস্কার না শুভবুদ্ধি, কোনটা সত্য হয় জানবার জন্য তাঁকে বড়ছেলের বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
—এসব কথা উচ্চারণও করবেন না মিত্ৰমশায়।
—তবু ঘরখরচা বলে তো কিছু… সব মেয়ের বেলাই দিয়েছি।
—মেয়েকে দিন, তার নামে তার কাছে দিন, শেয়ার-টেয়ার কেনা থাকুক। কিন্তু আমার ছেলের বিয়েতে আমি যেমন পারব তেমন খাওয়াব। তার জন্যে আপনার কাছে ভিক্ষে নেবার মতো আহাম্মক, বেহায়া আমি নই।
উঃ শান্তি। বড় শান্তি। বড় শান্তি। একসময়ে মৃদু হেসে স্বামীকে বলেছিলেন, তোমার বিয়েতে কিন্তু আমার বাবা পণ দিয়েছিলেন।
একটু চমকে উঠলেন, তারপরে বললেন— সেই জন্যেই তো তোমায় রানির মতো রেখেছি। রাখিনি?
—নইলে রাখতে না?
তারপর কার্তার হাসির বহর দেখতে হয়।
মা, তোমার বড্ড দোষ। একে ছুঁতে না, ওঁকে ছুঁতে না। দেশ থেকে বিধুখুড়ো এলেন, তাঁকে খাওয়ানো-দাওয়ানো হল— কাঁসার থালা বাটি গেলাস মেজে-ধুয়ে তুলে রাখা হল। তাতে আর কেউ খাবে না। বিধুখুড়োর মতো ছোট জাতের কেউ এলেই খাবে। তার জন্য তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা খাতির-আদরের তফাত হত না। ভেবে দেখতে গেলে সে তো উঁচু জাতের বেলায়ও হত। কুলগুরু নারায়ণ ভট্টাচার্য মশাই আর তাঁর অকালকুষ্মাণ্ড পুত্রটি এলেও আলাদা পাথরের বাসন বার হত। ভট্টাচার্য মশাই বোধহয় চক্ষুলজ্জায় নিরমিষ্যি ছাড়া খেতেন না। কিন্তু তাঁর পুত্রটি পাথরের থালায় দিব্যি পাঁচ রকমের মাছ, পরমান্ন স—ব খেত। সেসব বাসনও তোলা থাকত। তাতে আর কেউ খাবে না।
মা, তোমার শরীরে এত স্নেহ, দয়া-মায়া, কাজের লোক ভুবনকে পর্যন্ত নিজে সেবা করেছ, জলপটি, পাখার বাতাস, খল-নুড়িতে কোবরেজের ওষুধ মেড়ে খাওয়ানো। তবু তুমি কেন প্রশ্ন করতে না? এই সব জাতপাত, ব্রাহ্মণ শূদ্র, পণ দেওয়া-নেওয়া। তুমি কেন এত অন্ধ ছিলে! চোখবাঁধা অবস্থায়ও গান্ধারী নিজের স্বামী ও ছেলেদের সমস্ত অনাচার অন্যায় বুঝতেন, প্রতিবাদ করতেন, তুমি চক্ষুষ্মতী, স্নেহময়ী হয়েও সংসার ও সমাজের কূটকচালে নিয়মকানুনের সামনে চোখে পটি বেঁধে, কেমন হাঁটু গেড়ে রইলে!
…আজ তোমার সেই ভুলে ভরা জীবন, শুচিবায়ুতে অশুচি দেহমন নিয়ে তুমি চলে যাচ্ছ। যাও মা অগ্নিশুদ্ধ হও। ওঁ অগ্নয়ে স্বাহা, ওঁ অগ্নয়ে মাতা। অগ্নিতে সমর্পণ করছি সব। আজিকে হয়েছে শান্তি জীবনের ভুল ভ্রান্তি সব গেছে চুকে/ রাত্রিদিন ধুকধুক তরঙ্গিত দুঃখসুখ/ থামিয়াছে বুকে। যত কিছু ভাল মন্দ যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছু আর নাই!/ বলো শান্তি, বলো শান্তি দেহ সাথে সব ক্লান্তি হয়ে যাক ছাই।