বেণী লস্করের মুন্ডু

বেণী লস্করের মুন্ডু

মুর্শিদাবাদ জেলায় চিংড়িপোতা নামে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। সেই গ্রামে সাত-আটটির বেশি পাকাবাড়ি নেই, ইস্কুল নেই, পোস্ট-অফিস নেই, শুধু প্রতি শনিবার একটা হাট বসে। অনেক দূর দূর থেকে মানুষ আসে। সেই গ্রামের মানুষ অধিকাংশই গরিব হিন্দু আর মুসলমান। কিছুই দেখার নেই গ্রামের। শুধু যেখানে হাট হয়, তার মাঝখানে সাদা পাথরের তৈরি একটি মানুষের মূর্তি বসানো আছে।

মূর্তিটি বেশ পুরোনো। একজন বুড়ো মতন বাঙালি ভদ্রলোকের মূর্তি, চোগা-চাপকান পরা, মুখখানা দুঃখী। মূর্তিটার পায়ের কাছে ইংরেজিতে কিছু লেখা ছিল—এখন এত অস্পষ্ট যে বোঝাই যায় না। হাটে যে-সমস্ত মানুষ আসে, তারা কেউ জানে না মূর্তিটা কার। পুরোনো দিনের কথা আমরা বড্ড তাড়াতাড়ি ভুলে যাই। গ্রামের যেসব ছেলেরা চায়ের দোকানে কিংবা নদীর ধারে আড্ডা মারে তাদের জিজ্ঞেস করলেও বিশেষ কিছু বলতে পারে না। দু-একজন ঠোঁট উলটে বলে, ‘শুনেছি, লোকটা নাকি উকিল ছিল।’ গ্রামের খুব বুড়ো কয়েকজন শুধু জানে ওই মূর্তিটার ইতিহাস।

আমি একসময় মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামে গ্রামে হেঁটে ঘুরেছিলাম। চিংড়িপোতা গ্রামের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খুব বৃষ্টি আসায় আমি দৌড়োতে দৌড়োতে গিয়ে একটা পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাড়ির মালিক আবদুল রব আমাকে খুবই খাতির যত্ন করেছিলেন, চমৎকার চমৎকার খাবার খাইয়েছিলেন। সে-রাত্তিরে আমাকে আর আসতে দেননি, তার বদলে অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। সেইখানেই আমি বেণীমাধব লস্করের গল্প শুনি।

সে অনেক দিন আগের কথা। তখন আমরা জন্মাইনি, আমাদের বাবারাও জন্মায়নি, আমাদের ঠাকুরদা দাদুরা তখন খুব ছেলেমানুষ। সে সময় আমাদের দেশে পুরোপুরি ইংরেজ রাজত্ব, আমরা তখন পরাধীন জাতি। রাস্তায় মাঠে সাহেবদের দেখলে এ দেশের মানুষ ভয়ে দূরে সরে যায়। আদালত-বিচারালয়ে বেশিরভাগ হাকিম আর বিচারকও ছিলেন সাহেব।

মুর্শিদাবাদের একটি মহকুমা শহরের আদালতে একজন সামান্য মোক্তার ছিলেন এই বেণীমাধব লস্কর। তখনকার দিনে ছোটো উকিলকে বলা হত মোক্তার—লোকে বলত বাংলা জানা উকিল। কেন-না, আদালতে উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট সবাইকেই তো তখন ইংরেজিতে কথা বলতে হত—মোক্তাররা বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নিত। মোক্তার কথাটা আরবি শব্দ, ইংরেজিতে বলা হত মুকটিয়ার।

যাইহোক, সেই আদালতে দু-তিন জন উকিল মোক্তার ছিল—তাদের মধ্যে বরদা রায় আর মোহন মোল্লার কাছেই বেশি মক্কেল আসত। বুড়ো বেণীমাধব লস্করের ভাগ্য ছিল খুবই খারাপ—সে একটু তোতলা ছিল বলে সে যখন উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যেত, তখন সবাই হেসে ফেলত। তাই মক্কেলরা কেউ তার কাছে সহজে আসে না। আদালতের সামনে একটা বটতলায় সে হ্যাংলার মতন বসে থাকে, আর লোকজন দেখলেই বলে ওঠে, ‘এই যে-এই যে! এখানে আসুন, ভা-ভা-লো মোক্তার।’

নেহাত গরিব লোক ছাড়া বিশেষ কেউ আসে না তার কাছে। খুব কম পয়সা দিয়ে কাজ সারে। সারাদিনে বেণীমাধব লস্করের আট আনা এক টাকার বেশি রোজগার হয় না।

বেণীমাধবের মুখে কেউ কখনো হাসি দেখেনি। সব সময় গোমড়া মুখ। সেটা তার রোজগার কম হয় বলেই নয়—তার খুব মাথা ধরার অসুখ। সব সময় তার ভীষণ মাথা ধরে থাকে। তখন তো আর এতরকম মাথা ধরার ওষুধ বেরোয়নি যে, টক করে দুটো বড়ি খেয়ে নিলেই সেরে যাবে। নানারকম কবিরাজি হাকিমি ওষুধ খেয়েও তার কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে তার যন্ত্রণা এত বাড়ে যে, সে দু-হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে ছটফট করে।

কিন্তু এই বেণীমাধব লস্করই একদিন সবার কাছে দারুণ কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। ব্যাপারটা শুরু হল এইভাবে।

একদিন আদালতের টিফিনের সময় বেণীমাধব লস্কর বাইরের সেই বটতলায় বসে আছে মক্কেলের আশায়। মাথার ব্যথাটা খুব বেড়েছে, দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে মাথা—এই সময় একজন জোয়ান চেহারার মুসলমান তার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘কর্তা, আমার একটা গোরু চুরির মামলা আছে।’

বেণীমাধব উৎসাহিত হয়ে উঠে বলল, ‘কী মা-মা-মামলা? বসো এখানে! ভা-ভালো করে বলো!’

লোকটি বলল, ‘আমার দুধেলা গাই মুঙলিকে পাচ্ছি না দু-দিন ধরে। তাহের আলি সেটাকে চুরি করেছে। নিজের গোয়ালে ঢুকিয়ে রেখেছে—গ্রামের আর পাঁচজন দেখেছে।’

বেণীমাধব খাতা পেনসিল বার করে কিছু লিখতে যাচ্ছিল, হঠাৎ লোকটির চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার মাথার মধ্যে যেন চিড়িক করে উঠল। মুখখানা শুকিয়ে গেল। ভয় পেয়ে বলল, ‘না বাপু, আমি তোমার মামলা নিতে পারব না।’

লোকটি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? আগে টাকা দিতে হবে? এই যে টাকা এনেছি।’

লোকটি তার কোমর থেকে একটা রুপোর টাকা বার করল। বেণীমাধব সেটা ছুঁয়েও দেখল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কি রজ্জব আলি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

… ‘কর্তা,আমার একটা গোরু চুরির মামলা আছে ।’

‘তোমার গাঁয়ের নাম কি পলাশধুবি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আমি বাপু তোমার মামলা নিতে পারব না। তুমি বাড়ি যাও—’

লোকটি রেগে উঠে বলল, ‘কেন? বাড়ি যাব কেন? অন্য উকিল মোক্তার নেই? ভীমরতি ধরেছে বুড়োর। আমার গোরু চুরি গেছে, তার জন্য মামলা করতে পারব না?’

বেণীমাধব বলল, ‘ভালো চাও তো বাড়ি যাও।’

লোকটি কী বুঝল কে জানে, আর কথা বাড়াল না। পেছন ফিরে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা দিয়ে চলে গেল। আশেপাশের দু-একজন উকিল-মোক্তার ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। তারা সবাই অবাক। বেণীমাধবের এমনিতেই মক্কেল জোটে না। আর চকচকে রুপোর টাকা দেখেও সে মক্কেল ফিরিয়ে দিল?

মোহন মোল্লা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হে বেণীমাধব, লোকটাকে একেবারে তাড়িয়ে দিলে! ব্যাপারটা কী?’

বেণীমাধব বলল, ‘লোকটা ভালো না।’

‘আগে থেকে চিনতে লোকটাকে?’

‘না।’

‘তাহলে? গোরু চুরির মামলা নিয়ে এসেছে—লোকটা ভালো কী খারাপ তা দেখার দরকার কী?’

‘না হে মোল্লা সাহেব, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। লোকটাকে আগে থেকে চিনতাম না। কে যেন আমার মধ্যে বলল পলাশধুবির রজ্জব আলি। ওর মামলা নিয়ো না।’

‘বটে, বটে? এ যে তাজ্জব কথা।’

‘শুধু তাই নয়, লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর একটা জিনিস দেখলাম। একখানা যেন ছবি। দেখলাম, এই রজ্জব আলি একখানা মস্ত বড়ো দা দিয়ে একটা সতেরো-আঠারো বছর বয়সের ছোকরার ঘাড়ে কোপ মারছে। মারতে মারতে তাকে মেরে ফেলল। এই লোকটা খুনি!’

মোহন মোল্লা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘আজকাল কী আফিং ধরেছ নাকি? না, গাঁজা-টাজা খাচ্ছ?’

বেণীমাধব অসহায়ভাবে বলল, ‘না, না, বি-বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যি দেখলাম।’

মোহন মোল্লা হাসতে হাসতে সবার কাছে এই গল্প করল। সবাই ভাবল, বুড়োর এবার মাথা খারাপ হয়েছে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে!

গল্পটা ছড়িয়ে পড়ল অনেকের মধ্যে। এখন বেণীমাধবকে দেখলেই লোকে হাসে।

কিন্তু দু-তিন দিন বাদে সত্যি সত্যি পলাশধুবির রজ্জব আলি মানুষ খুনের দায়ে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। সে তার প্রতিবেশীর সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেকে মেরে কচুরিপানার তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। লোকে একটু অবাক হল। কেউ কেউ ভাবল, ওই খুনের সময় নিশ্চয়ই বেণীমাধব কোনোক্রমে দেখে ফেলেছিল, সেই কথাটাই বলেছে অন্যভাবে।

এর দিন দশেক বাদে বেণীমাধব আর একটা আশ্চর্য কাজ করে ফেলল। সেদিন আদালতে একটা বড়ো মামলা চলছিল—অনেকেই সেটা দেখতে এসেছে। শশধর কুন্ডু বলে একটা লোক একসঙ্গে তিন-তিনজনকে খুন করেছে। আজ সেই শশধর কুন্ডুর বিচারের শেষ দিন। নির্ঘাত তার ফাঁসি হবে। অন্য অনেকের সঙ্গে বেণীমাধবও শুনছিল এক কোণে বসে। হাতে তার কোনো কাজ নেই। মাথার যন্ত্রণাটা তার আজকে আবার বেড়েছে।দু-হাত দিয়ে শক্ত করে মাথা চেপে ধরে আছে।

হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘শশধর কুন্ডু নির্দোষ। শশধর কুন্ডু নির্দোষ!’

সবাই চমকে উঠল। আদালত চলার সময় এইরকমভাবে চেঁচিয়ে ওঠা খুব বেআইনি। হাকিম হচ্ছেন চারলস উইলবারফোরস, ছোকরা বয়েস, ভীষণ রাগী। তিনি বললেন, ‘সাইলেন্স।’

বেণীমাধব তবু বলল, ‘শশধর কুন্ডু নির্দোষ। হুজুর ওকে ফাঁ-ফাঁ-ফাঁসি দেবেন না।’

হাকিম বললেন, ‘সাইলেন্স। এই মুকটিয়ারকো নিকাল দেও!’

বেণীমাধব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইয়োর অনার। আমাকে একদিন টাইম দিন। আমি জানি ও খুন করেনি। শশধর কুন্ডু নট গিলটি ইয়োর অনার।’

তারপর সে দৌড়ে আসামির কাছে এসে বলল, ‘তুমি আর একদিন সময় চাও। আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দেব। খুন করেছে পুলিন সরকার। কী ঠিক কি না?’

খুব হইহই হয়েছিল সেদিন। বেণীমাধব বলেছিল, ‘শশধর কুন্ডুর বন্ধু পুলিন সরকারই খুনগুলো করে বন্ধুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। পুলিন সরকারের বাড়ির উঠোনে গাঁদাফুল গাছতলায় মাটি খুঁড়লে রক্তমাখা ছুরি আর গয়নাপত্তর পাওয়া যাবে।’

সব মিলে গেল।

সেই মামলায় খুব নাম ছড়িয়ে গেল বেণীমাধবের। সবার মুখে তার কথা। বরদা রায় আর মোহন মোল্লার খুব হিংসে হল। লোকেরা এখন মামলার জন্য বেণীমাধব লস্করের কাছেই আসে।

কিন্তু বেণীমাধব সব মামলা নেয় না। আসামির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। দু-হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে, এদিক-ওদিক ঝাঁকায়। তারপর একসময় বলে, ‘না বাপু, তোমার মামলা আমি নিতে পারব না। তুমি অন্য রাস্তা দ্যাখো! কিংবা কারুকে আবার বলে, ‘তোমার মামলা আমি নেব—কোন হাকিমের সাধ্য, তোমাকে শাস্তি দেয়!’ সত্যি সত্যি তার কথা মিলে যায়। যে মামলা সে নেয় না—সেটা নির্ঘাত হার হয়। সে যে-ক-টা মামলা নেয়, প্রত্যেকটা জিতিয়ে দেয়।

তার নাম রটে গেল হারা মামলার ধন্বন্তরি হিসেবে। সে নিজেও বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল ওইরকম :

হারা মামলার ধন্বন্তরি

পছন্দমতো হারা মামলা

লইয়া থাকি।

সাফল্যের গ্যারান্টি ১০০%

ফিস চার টাকা প্রতিদিন,

দরদস্তুর নাই।

পরপর কয়েকটা মামলা প্রায় অলৌকিকভাবে জিতে যাবার ফলে বেণীমাধবের নামে সম্ভব-অসম্ভব অনেকরকম গল্প রটতে লাগল। বেণীমাধবের রোজগার অনেক বেড়ে গেলেও তার এই সৌভাগ্য যে বেশিদিন থাকবে না, তাও বোঝা যায়। তার মাথার মধ্যে সব সময় এখন অসম্ভব যন্ত্রণা। প্রতিটি মামলার পর সে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার আয়ু বেশিদিন নেই।

এর মধ্যেই স্থানীয় জমিদার নন্দ রায়ের ছেলে মধু একটা মামলায় জড়িয়ে পড়ল। প্রজাদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের সময় হঠাৎ গুলি চলে—চারজন গরিব প্রজা মারা যায়। জমিদারের ছেলে মধু রায়ই গুলি চালিয়েছে। কিন্তু জমিদার বলছেন, গন্ডগোলের সময় মধু তল্লাটে ছিলই না—সে ছিল বহরমপুরে, তার অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খুব কড়া—তিনি মধু রায়ের নামে সমন জারি করেছেন।

এইসব মামলায় বড়ো বড়ো উকিল, ব্যারিস্টার লাগে, কিন্তু জমিদারমশাই বেণীমাধব লস্করকে ডাকবার জন্য পালকি পাঠিয়ে দিলেন। বেণীমাধব তখন খুবই অসুস্থ, তবু জমিদারের ডাক এলে না গিয়ে উপায় নেই। পালকিতে যখন উঠতে যাচ্ছে, তখন একজন বৃদ্ধ চাষি হাউমাউ করে কেঁদে এসে বলল, ‘বাবুগো, তুমি এ মামলা নিয়ো না। দুশমনটা আমার ছেলেকে মেরেছে।’

বেণীমাধব বলল, ‘আমি ন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের পক্ষে যাবার ক্ষমতা আমার নেই—তাহলে আমি মরে যাব।’

জমিদারমশাই বেণীমাধবকে খাতির করে বসালেন। রুপোর গড়গড়ার নল তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, চিংড়িপোতা গাঁয়ের পঞ্চাশ বিঘে জমি আমি তোমার নামে লিখে দেব। শেষ বয়সে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে খেতে পারবে।’

বেণীমাধব জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর, আমায় কী করতে হবে?’

জমিদার বললেন, ‘শোনো, কতকগুলো গুন্ডাশ্রেণির লোক আমার পাইক-বরকন্দাজদের আক্রমণ করে। আমার পাইকরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায়। তা সে মামলা আমি পরে চালাব। কিন্তু ব্যাটারা আমার ছেলে মধুর নাম এর সঙ্গে জড়িয়েছে। মধু তখন ছিল বহরমপুরে। সেখানকার চোদ্দো জন লোক—তাদের মধ্যে দুজন উকিল, একজন পুলিশের লোকও আছে—তারা হলপ করে এর সাক্ষী দেবে। মধুর কোনোই হাত নেই এর মধ্যে— তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই নেই।’

বেণীমাধব বিনীতভাবে বলল, ‘তাহলে তো হুজুর যে-কোনো ভালো উকিলই এ মামলা জিতিয়ে দেবে—আমার মতন সামান্য মোক্তারকে ডেকেছেন কেন?’

জমিদার বললেন, ‘তোমার সুনাম আছে যে তুমি যে-সে মামলা নাও না। তুমি এই মামলা নিলে কেউ আর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার সাহস পাবে না। অন্য উকিলরাও তোমাকে ভয় পাবে।’

কিন্তু হুজুর, আসামিকে না দেখে আমি তো কিছু করতে পারি না।’

জমিদার রেগে উঠে বললেন, ‘আসামি বলছ কাকে? আমার একমাত্র ছেলে, সে আসামি? তাকে দেখার তো দরকার নেই—আমি নিজেই তো সব বলছি তোমাকে।’

‘তাকে না দেখলে আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারব না। সে ক্ষমতা আমার নেই।’

তখন জমিদারের ছেলেকে ডেকে আনা হল। তাকে দেখেই বেণীমাধব নিজের মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরল, তার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল! বেণীমাধব অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

ব্যস্ত হয়ে উঠে জমিদারের লোকজন তাড়াতাড়ি জল এনে তার মাথায় ঢালল। একজন স্মেলিং সল্ট-এর শিশি ধরল নাকের কাছে।

বেণীমাধব আস্তে আস্তে উঠে বসল। তার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হাতজোড় করে বলল, ‘হুজুর, আমাকে মাপ করুন। এ মামলা আমাকে নিতে বলবেন না।’

জমিদার চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘আমার ক্ষমতা নেই, আমি পারব না!’

‘তোমাকে আমি পাঁচশো টাকা দেব। পঞ্চাশ বিঘে জমি দেব।’

‘আমি পারব না।’

‘এক হাজার টাকা।’

‘হুজুর, আ-আ-আমাকে ছে-ছে-ছেড়ে দিন।’

জমিদার তখন দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো মোক্তার! এ মামলা তোমাকে নিতেই হবে। না হলে তোমার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব, তোমাকে আমি শেষ করে দেব!’

জমিদার এমন ভয় দেখাতে লাগলেন যে রাজি না হয়ে উপায় রইল না বেণীমাধবের। একতাড়া মোহর হাতে নিয়ে বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন রাত্তিরে একটা সাংঘাতিক কান্ড হল। ঘুমের মধ্যে বিছানায় ছটপট করতে লাগল বেণীমাধব। একবার এপাশ, আবার গড়িয়ে ওপাশ। কেউ যেন তাকে ধরতে চেষ্টা করছে—তাতে বেণীমাধব পালাতে চাইছে। বেণীমাধব সেই অবস্থায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে! ভুল করেছি। আর করব না!’

ছেলে, মেয়ে, বউ বেণীমাধবের বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়েছে! বেণীমাধব কোনোরকমে উঠে বসে ছেলেকে বলল, ‘শিগগির কাগজ কলম আন।’

ছেলে কাগজ আর খাগের কলম এনে দিল। বেণীমাধব তৎক্ষণাৎ জমিদারকে চিঠি লিখল যে, সে তাঁর ছেলের মামলা নিতে পারবে না। তার শরীর ভীষণ অসুস্থ। সে আর কোনোদিনই আদালতে যাবে না।

চিঠি লিখে বেণীমাধব ছেলেকে বলল, ‘ভোর হতে-না-হতেই এই চিঠি আর মোহরের থলি নিয়ে গিয়ে জমিদারকে দিয়ে আসবি। নইলে আমি আর প্রাণে বাঁচব না।’

সকালবেলা এক ছেলে চলে গেল জমিদার বাড়িতে। আর এক ছেলে আদালতে গিয়ে খবর দিল, বেণীমাধব মোক্তারি পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আজ থেকে সে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবে, ধর্মকর্ম করবে।

এরপর আবার অন্যরকম একটা ঘটনা শুরু হল। সেদিন সন্ধেবেলা চারলস উইলবারফোরস-এর পেয়াদা এসে খবর দিল যে হাকিম সাহেব বেণীমাধবকে ডেকে পাঠিয়েছেন। হাকিমের ডাক জমিদারের ডাকের চেয়েও বড়ো। বেণীমাধবের তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে—সেই অবস্থাতেই পালকি ভাড়া করে যেতে হল।

হাকিম সাহেবের বাংলোটি সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। সবাই জানে তিনি খুব কড়া মেজাজের মানুষ, কিন্তু বেণীমাধবের সঙ্গে সহজভাবেই কথা বলতে লাগলেন। হাকিম বেশ বাংলা শিখেছেন।

তিনি বললেন, ‘মুকটিয়ার, তুমি কাজ ছেড়ে দিচ্ছ কেন?’

বেণীমাধব বললেন, ‘হজুর, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। তাই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই।’

‘কী করে বুঝলে যে বাঁচবে না?’

‘সে আমি বুঝে গেছি। আমি জ্বরে ভুগছি।’

হাকিম সাহেব নিজে উঠে এসে বেমীমাধবের কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। তারপর দেরাজ থেকে কয়েকটা ওষুধ বার করে বললেন, ‘এগুলো তিন ঘণ্টা পরপর খেয়ে নিয়ো। জ্বর সেরে যাবে।’

বেণীমাধব বললেন, ‘জ্বর সেরে গেলেও আমি আর বাঁচব না।’

সাহেব এবার একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘মুকটিয়ার, একথা কি সত্যি যে তুমি মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারো যে সে দোষী না নির্দোষ?’

বেণীমাধব চুপ করে রইল।

সাহেব আবার বললেন, ‘আমার পেশকার আমাকে একথা বলেছে, মুনশি বলেছে, আরও অনেকেই এ কথা বলেছে। সমস্ত জেলার লোক এ কথা বিশ্বাস করে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত চিঠি লিখে আমার কাছে একথা জানতে চেয়েছে।’

‘হুজুর, আমি সামান্য লোক।’

‘আমি লক্ষ করেছি, যে ক-টা মামলা তুমি নাও, ঠিকঠিক জিতে যাও। এর রহস্য কী? সব খুলে বলো, তোমার কোনো ভয় নেই।’

‘হুজুর, সব বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। অনেক দিন ধরেই আমার মাথার মধ্যে খুব যন্ত্রণা হয়। ইদানীং কোনো মক্কেলের দিকে তাকালেই যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। একসময় মাথার মধ্যে চিড়িক করে ওঠে—আর কে যেন ফিসফিস করে বলে দেয়, সেই লোকটি দোষী না নির্দোষ!’

‘হাউ ইন্টারেস্টিং! এর ব্যাখ্যা কী?’

‘আমি জানি না, তবে আমার মনে হয়, মৃত মানুষরা আমার সঙ্গে কথা বলে। মানুষ যখন কারুকে খুন করে—তখন সেই মৃত লোকটির আত্মার একটি অংশ ওই হত্যাকারীর মধ্যে ঢুকে যায়। আত্মার অংশটুকুই হত্যাকারীকে আজীবন শাস্তি দেয়। তার চোখের মধ্যে ওই আত্মাটিই আমাকে বলে দেয়, এই-ই আসামি। আর যখন কোনো নির্দোষ লোককে দেখি, তখনও নিহত ব্যক্তিটি আমার চোখের সামনে এসে বলে দেয়—এ নয়, এ নয়! আসল লোককে দেখিয়ে দিচ্ছি! আপনার সেই শশধর কুন্ডুর কেসটা মনে আছে? আপনি তাকে ফাঁসি দিতে যাচ্ছিলেন। যে তিনজন খুন হয়েছিল, তাদের মধ্যে একটা বাচ্চা মেয়েও ছিল। আমি হঠাৎ দেখলাম, সেই বাচ্চা মেয়েটি আমার চোখের সামনে এসে বলছে, এ নয়! তুমি বলে দাও না। আমি আসল লোককে দেখিয়ে দিচ্ছি। তখনই আমি সব দেখতে পেলাম, তখন চেঁচিয়ে না উঠে আমার উপায় ছিল না।’

হাকিম বললেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক! এ কখনো হতে পারে?’

বেণীমাধব বলল, ‘বিশ্বাস করা না-করা আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমার এরকম হয়।’

‘আচ্ছা মুকটিয়ার, একটা কথা বলো তো। তুমি যখন অপরাধী কে—এ কথাটা বুঝতে পারো—তাহলে তো তুমি ইচ্ছে করলে সেই অপরাধীকে বাঁচিয়ে দিতে পারো ; তুমি যখন তার বিরুদ্ধে প্রমাণ-ট্রমাণ সবই জানো—তাহলে সেগুলি সরিয়ে দিলেই তো আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না।’

‘হুজুর, মাথার ওপরে ভগবান আছেন, তিনিই একমাত্র জানেন, আমি জেনেশুনে কোনোদিন অন্যায়ের পক্ষ নিইনি। তা যদি আমি করতাম—তাহলে যেসব মরা মানুষ আমার সঙ্গে এসে কথা বলে—তারা কী আমায় ছেড়ে দেবে, কালকেই তো—’

‘কালকে কী হয়েছে?’

বেণীমাধব একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, ‘হুজুর, আপনি হাকিম। আপনার সামনে নামধাম বলা উচিত হবে না, কাল এক জায়গায় যেতে হয়েছিল আমাকে। একজনের মামলা নিতে হবে। যেই আমি তার দিকে তাকিয়েছি, দেখলাম কী, চারজন গরিব চাষির মূর্তি সেই লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে—সবাই তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে,এ-ই খুনি! আমি আর সে মামলা নিতে রাজি হলাম না। কিন্তু সেই পক্ষ আমাকে ভয় দেখাল, জোর করে আমাকে সেই মামলা নিতে রাজি করাল। মাঝরাত্রে সেই চারজন মরা লোক ঘিরে ধরল আমাকে। ঘৃণার সঙ্গে বলতে লাগল—তুমি আমাদের খুনিকে বাঁচাবে? সেই জন্যই তো আমি মোক্তারি করাই আজ থেকে ছেড়ে দেব ঠিক করলাম।’

হাকিম সাহেব অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি বললে না যে, সব সময় তোমার মাথায় ব্যথা করে? এর জন্য চিকিৎসা করাওনি?’

‘অনেক করিয়েছি, কিছুতেই সারে না।’

হাকিম উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তিতভাবে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধ্যে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মুকটিয়ার, তোমার মুন্ডুটা আমার চাই।’

বেণীমাধব চমকে উঠে বলল, ‘কী বললেন?’

‘তোমার মুন্ডুটা আমার চাই!’

বেণীমাধব হাঁ করে তাকিয়ে রইল। হাকিম বললেন, ‘তুমি রোনালড রস-এর নাম শুনেছ? মস্তবড়ো ডাক্তার, কলকাতায় বসে বসে সে মশার পেট থেকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বার করেছে! সে আমার বন্ধু। তাকে আমি খবর পাঠাচ্ছি।’

‘আজ্ঞে, তিনি এসে কী করবেন?’

‘শোনো, আমরা খ্রিস্টান। আমরা মানুষের মৃত্যুর পর আত্মার ঘুরে বেড়ানো কিংবা মরা মানুষ এসে কথা বলে যাওয়ায় বিশ্বাস করি না। তোমার কেসটা খুব সম্ভবত প্যাথোলজিক্যাল—তোমার মাথার গড়নের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে—যেজন্যই তুমি এসব কল্পনা করো! সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তোমার মৃত্যুর পর তোমার মাথাটা কেটেছিঁড়ে দেখতে হবে।’

‘হু-হু-হুজুর, এ কী বলছেন?’

‘ভয় পাচ্ছ? তুমি মরে গেলে তো আর তোমার ব্যথা করবে না! ভয় কী?’

‘হুজুর, আমরা হিন্দু। মৃত্যুর পর আমাদের শব দাহ না করলে আত্মা—’

‘ওই তো, দেহটা পুড়িয়েই তো নষ্ট করবে! তার চেয়ে বিজ্ঞানের উপকারের জন্য দিয়ে দাও। এর থেকে বিজ্ঞানের কোনো রহস্য বেরিয়ে যেতে পারে। তোমাকে দিতেই হবে।’

বেণীমাধব সেদিন কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরল। এ কী সাংঘাতিক কথা, সাহেব তার মুন্ডু কেটে নিতে চায়। এই সাহেব যা গোঁয়ার, জ্যান্ত অবস্থাতেই কেটে নিয়ে যাবে কি না কে জানে! ভগবান, এ কী করলে!

সেদিন থেকে সাহেবের পেয়াদারা তার বাড়ি পাহারা দিতে লাগল, দু-দিন বাদেই বেণীমাধব একেবারে শয্যাশায়ী, মরো মরো অবস্থা। রাত্রির দিকে বেণীমাধবের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে গেল, খবর পেয়ে হাকিম সাহেবও দলবল নিয়ে হাজির হলেন। পাছে ওই মূল্যবান মাথাটা আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়!

এদিকে এ খবরও রটে গেছে যে, সাহেব বেণীমাধবের দেহ পোড়াতে দেবে না। ম্লেচ্ছ ডাক্তাররা শরীরটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে। স্থানীয় হিন্দুরা খুব রেগে গেল। এটা তাদের ধর্মের অপমান। লাঠিসোঁটা নিয়ে তারা এগিয়ে এল—কিছুতেই দেহ নিতে দেবে না। স্থানীয় মুসলমানরাও বলল, ‘এটা ভারি অন্যায়। সাহেবরা ধর্মে হাত দিচ্ছে।’

খুব গন্ডগোলের সম্ভাবনা দেখে জেলার ম্যাজিস্ট্রেটও এসে হাজির হলেন। সঙ্গে একজন ডাক্তার নিয়ে। সবাই মিলে ভিড় করে রইলেন বেণীমাধবের ঘরে।

বেণীমাধব চোখ বুঝে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। হাত দু-খানা বুকের ওপর জোড় করা। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। শোনা যায় না। একেবারে মুখের কাছে কান নিলে বোঝা যায় সে বলছে, ‘তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। আমি জমিদারের ছেলের মামলা নিইনি। আমি কখনো অন্যায়ের পক্ষ সমর্থন করিনি। ভগবান জানেন, কখনো করিনি।’

ডাক্তার নাড়ি ধরে বসেছিল। একসময় হতাশভাবে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘সব শেষ।’

হাকিম সাহেব ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব শেষ? ভালো করে দ্যাখো!’ ডাক্তার আবার পরীক্ষা করে বললেন, ‘দেহে প্রাণ নেই।’

হাকিম তখন বেণীমাধবের আত্মীয়স্বজনকে বললেন, ‘আপনাদের ধর্মীয় কাজ যা আছে সেরে নিন! আমি এই ডেড বডি নিয়ে যাব। বরফে ঢেকে রাখতে হবে।’

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, ‘চারলস, কাজটা কি ঠিক হবে?’

বেণীমাধবের ছেলে বললেন, ‘আমরা দেহ নিয়ে যেতে দেব না।’

হাকিম তেজের সঙ্গে বললেন, ‘আমি নিয়ে যাবই। মুকটিয়ারের সঙ্গে আমার এ সম্পর্কে কথা হয়েছিল। ওর আপত্তি ছিল না।’

ঘরের মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল। কারোর কথাই শোনা যায় না। মেয়েরা কান্নাকাটি করছে আর পুরুষরা চেঁচাচ্ছে।

এই সময় বেণীমাধবের আবার চোখ খুলে গেল। ঘরের সবাই আঁতকে উঠল। ডাক্তার বলল, ‘বাই জোভ! বাই জোভ!’

বেণীমাধব তীব্র চোখে তাকাল শুধু হাকিম সাহেবের দিকে। অন্যরকম গলার আওয়াজে বেশ জোরে বলে উঠল, ‘সাহেব, তুমি বাড়ি চলে যাও!’

ঘরের মধ্যে থেকে অনেকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল, একজন মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ল, কিন্তু হাকিম সাহেব একটুও ভয় পেলেন না। কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘মুকটিয়ার, তুমি বেঁচে আছ?’

বেণীমাধব বলল, ‘সাহেব, তুমি এক্ষুনি বাড়ি চলে যাও। একটুও দেরি কোরো না। তোমার বাড়ির দারোয়ান মারা গেছে। তোমার ছেলে আর বউ-এর খুব বিপদ—শিগগির যাও!’

হাকিম সাহেব আর একটুও দেরি করলেন না। দৌড়ে বাইরে চলে এলেন। তাঁর ঘোড়া দাঁড় করানোই ছিল, সেই গভীর রাত্রে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন বাড়ির দিকে—অন্যরাও গেল পেছন পেছন। একটু পরেই পরপর বন্দুকের শব্দ শোনা গেল। ততক্ষণে বেণীমাধব আবার মরে কাঠ। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা।

সেই রাত্তিরে হাকিম সাহেবের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ডাকাতরা বাড়ির দারোয়ানকে মেরে ফেলে বাংলোর ভেতরে ঢুকে পড়ে মেমসাহেবকে আক্রমণ করতে যায়। মেমসাহেব তার ছেলেকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছিল। ডাকাতরা দুমদাম দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে—সেই সময়ে হাকিম সাহেব এসে পড়লেন। আর একটু দেরি হলে বউ আর বাচ্চাকে বাঁচানো যেত না। একজন ডাকাত মরল, দুজন ধরা পড়ে গেল।

হাকিম সাহেব বেণীমাধবের দেহ কাটাছেঁড়া করে আর দেখতে চাননি। তার বদলে নিজের খরচে বেণীমাধবের একটা পাথরের মূর্তি তৈরি করিয়ে তার গ্রামে স্থাপন করে দিয়েছিলেন। তলায় লিখে দিয়েছিলেন শেক্সপিয়ারের একটা লাইন:

স্বর্গে, মর্ত্যে এমন অনেক ব্যাপার আছে,

হোরেশিও, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *