বেড়ালের কথা
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছিলাম আস্তাবলের মধ্যে বাবার কালো টাট্টুঘোড়া আর আস্তাবলের পাশে জালের খাঁচায় গোটাদশেক মুরগি ছাড়া, শখ করে কোনও জানোয়ার পুষতে হয় না। কারণ তারা বড় নোংরা হয়, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গায়ে গন্ধ ইত্যাদি। আশ্চর্য হয়ে দেখতাম এরাও নোংরামিতে কম যেত না। আস্তাবল সাফের জন্য মস্ত কোদাল কেনা হল। আস্তাবলের পাশে একটা ছোট-খাটো পুকুর খোঁড়া হল এবং দেখতে দেখতে সেটি ভরে গিয়ে মাটি চাপা হল। তারপর তার পাশে আরেকটা খোঁড়া হল। আর মুরগির ঘরের কথা কিছু না বলাই ভাল। ডিমের খোঁজে সেখান থেকে একবারটি ঘুরে ঘরে এলেই, বড়রা সবাই নাকে কাপড় চেপে বলতেন, ‘উঁ—উঁ! বাইরে যা, বাইরে যা।’
তবে টাট্টুঘোড়া চেপে বাবা পাহাড়ে বনে জরিপের কাজ করতেন আর মুরগিরা ডিম তো দিতই, উপরন্তু ভোর থেকে মোরগরা কুঁড়েদের ঘুম ভাঙাত। কাজেই তাদের কথা আলাদা। বাকি সব জানোয়ার বাতিল। এদিকে একটা ছাই রঙের উটকো বেড়াল, রোজ রাতে স্কাইলাইট দিয়ে ঘরে ঢুকে আমার পায়ের কাছে কম্বলের তলায় ঘুমনো ধরল। গোড়ায় খুশিই হয়েছিলাম, আমার পাদুটো গরম থাকত।
তারপর একদিন রান্নাঘরের শিকে থেকে দু’দিনের মাছভাজা যেদিন অদৃশ্য হল, আমারও চৈতন্য হল। স্কাইলাইট বন্ধ করলাম। তারপর কত বছর কেটে গেল, ছাই বেড়ালের কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। কিন্তু নিজের ঘর-সংসার হয়ে অবধি বুঝলাম, অবাধে যার কাছে মনের সব কথা বলা যায়, অথচ যে কোনও মন্তব্য না করে, এমন সঙ্গী সব মেয়েদেরই দরকার। একজন কয়েকটা খলসে-মাছ পাঠিয়েছিল। মনের মধ্যে একটা পুরনো পিপাসা ছিল, তাই তাদের মধ্যে থেকে সব চাইতে বড় আর সব চাইতে সুন্দর দুটিকে পুষলাম। প্রথম প্রথম তাদের গা থেকে রামধনু রং ছিটোত। কিছুদিন পরে সেসব বন্ধ হল। বড় একটা মুখ-খোলা (অর্থাৎ ঢাকনি ভাঙা) কাচের বোয়মে রাখতাম, ভাতটাত খেতে দিতাম, তাজা সবুজ শাকপাতা জলে ফেলে রাখতাম, দুটো সুন্দর নুড়িও জলের নীচে শোভা পেত, কত যে যত্ন করতাম তার ঠিক নেই।
এত আদরে খুব সুখে শান্তিতে ওদের দিন কাটা উচিত ছিল। কিন্তু তা না, কেবল কামড়াকামড়ি করত। প্রায়ই এ ওর পাখনার, কিংবা কানকোর টুকরো খুবলে আনত। তারপর যখন একটা মিছিমিছি মরে গেল আর অন্যটাকে রাতারাতি কিছুতে জানলা দিয়ে ঢুকে, বোয়ম উলটে ফেলে খেয়ে গেল, তখন সত্যি কথা বলতে কী, খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। উলটে পড়ে বোয়মটাও ভাঙল।
এর কিছুদিন বাদে একটা চার ইঞ্চি মাপের কচ্ছপ পুষেছিলাম। ওই একই নিয়মে চ্যাপটা ফুলদানিতে রাখলাম। ভাল নিয়ম, ছাড়তে হয় না। বেশ শান্তিতেই থাকা গেছিল। খালি একদিন ওকে সাবান মাখিয়ে স্নান করাবার চেষ্টা করতেই, খ্যাঁক করে কামড়াতে এসেছিল। ভাগ্যিস সময় থাকতে হাত সরিয়ে নিয়েছিলাম, নইলে আর দেখতে হত না। সেটাও একদিন রাতারাতি উধাও হল, তবে বেড়ালের সাহায্যে কি না বলতে পারলাম না। এরপর বহু বছর আর জন্তুজানোয়ার পুষিনি।
এদিকে থাকতাম মধ্য কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে। নীচের তলায় ছিল খাবার জিনিসের এক মস্ত দোকান। তাদের বড় বড় ভাঁড়ার ছিল। সেখানকার হিমঘরে নানারকম গন্ধওয়ালা চিজ, শুকনো মাছ, নোনা মাংস ইত্যাদি রাখা হত। তার মধুগন্ধে হাজার হাজার নেংটি ইঁদুর এসে জুটত। যে একবার আসত, সে আর কখনও ফিরে যেত না। দেখতে দেখতে তারা বাড়ির বত্রিশটি ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে পড়ল। টেকা দায় হয়ে উঠল।
এইসময় যে কারণেই হোক, একটা আধাবয়সি হুলো বেড়াল এসে আমাদের বাড়িতে উঠল। উঠল তো উঠল, আর গেল না। প্রথমটা তাকে তাড়াবার চেষ্টা করলেও, কিছুদিনের মধ্যে আমাদের ঘরগুলো যখন ইঁদুরশূন্য হয়ে গেল, লোকে আমাদের হিংসে করতে লাগল। হুলোর নাম দেওয়া হল নেপোলিয়ন, ওরফে নেপো।
নেপো সারাদিন শুধু খেত আর ঘুমোত। এত খেত যে কখনও ইঁদুর ধরতে দেখা যেত না। কিন্তু বোধহয় ওর গায়ের গন্ধেই সব ইঁদুর পালিয়েছিল।
সারাদিন আরাম করত আর সারা রাত টহল দিয়ে বেড়াত। মাঝে মাঝে গলিতে-টলিতে বিচিত্র বেড়ালীয় রাগিণী শুনে স্পষ্টই বোঝা যেত যে ওদের একটা ক্লাব আছে এবং সম্ভবত নেপোই তার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। একবার সদস্যদের বারো-চোদ্দোজনকে দেখেওছিলাম, পাশের বাড়ির পেছনের কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে, চিনে হোটেলের রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে বসে আছে। ভোরে নেপো যখন বাড়ি ফিরত, বিজয়গর্বে ফিরত। সারা গায়ে আঁচড়-কামড়ের দাগ নিয়ে। আমরা আর্নিকা লাগাতাম।
এমনিতে বেশ ভালমানুষ সেজে থাকত, কিন্তু অন্য কোনও বেড়াল— মনে হত ওদের ক্লাবের বেড়াল হলেও— আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে এলেই, লোম ফুলিয়ে তিনগুণ বড় হয়ে, ফ্যাঁশ-ফ্যাঁশ শব্দ করতে করতে তাদের তাড়া করত। বাড়ির পাঁচিলে কাক বসলে, তার ল্যাজের পালক খুলে নিত, চড়াই এলে খেয়ে ফেলত। টিকটিকি মাকড়সা ইত্যাদি ছাদ থেকে নীচে নামত না।
আমাদের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও আমাদের বিছানায় উঠে শুত। তাই প্রতি রবিবার ওকে ধরে জীবাণুনিবারক সাবান মাখিয়ে, গরম জলে স্নান করানো হত। ও কিছু বলত না, মনে হত আরাম লাগছে।
চেহারার কথা আর কী বলব। প্রায় একটা পাঁঠার ছানার মতো বড়, পোড়া-হাঁড়িপানা মুখ, কান দুটো চিবোনো ধরনের। তাতে কী? এই নিয়েই ম্যাও-ম্যাও করে বাড়িময় ঘুরে বেড়াত। কখনও চুরি করে খেত না। হয়তো সবসময় পেট ভরে থাকত বলে। আদর নেবার বা আদর দেবার কোনও চেষ্টাই ছিল না। পেট ভরে খেতে আর কারও একটা আরামের বিছানা পেলে, নেপো আর কিছু চাইত না।
এই নেপো আমাদের বাড়িতে প্রায় দশ বছর ছিল। শেষটা যখন বুড়ো হল, সারাক্ষণ রান্নাঘরে পড়ে থাকত। মনে হত বোধহয় গেঁটেবাতে ধরেছে, চলতে-ফিরতে কষ্ট হচ্ছে। কানে হয়তো শোনে না, চোখেও ভাল দেখে না। মুখের কাছে যা ধরে দেওয়া যেত, সোনাহেন মুখ করে চেটেপুটে খেয়ে নিত। তবু ওর গায়ের গন্ধে বাড়িতে একটাও নেংটি ইঁদুর ছিল না।
সে যাই হোক, সারাদিন চুপচাপ পড়ে থাকত, সন্ধে হলেই একবার শরীরটাকে টেনে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এক পাক ঘুরে আসত। ফিরে এসে আমাদের ফ্ল্যাটের পেছনের দরজার তলার দিকে, ইঁদুররা একসময় যে ফুটো করেছিল, তার মধ্যে দিয়ে থাবা ঢুকিয়ে দরজায় আঁচড়াত আর ম্যাও-ম্যাও করে ডাকত। অমনি কেউ না কেউ ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিত। দেখা যেত নতুন নতুন আঁচড়-কামড়! আমাদের সে কী দুঃখ!
আগে যারা ওর ভয়ে আমাদের বাড়ির ধারেকাছে ঘেঁষত না, আজকাল তারা কার্নিশে— পাঁচিলে বসে মজা দেখে। আমরা ঠেঙা নিয়ে তাদের তাড়াতাম। তারাই বোধহয় নেপোকে নীচে একা পেয়ে তার শোধ তুলছে! নেপোকে কোলে নিয়ে, রক্ত ধুয়ে আর্নিকা লাগানো হত।
তারপর একদিন বিকেলে আমি গাড়ি করে বেরোচ্ছি, দেখি একতলার পাঁচিলের ওপর দিয়ে, একটার পেছনে একটা, দশটা হুলো বেড়াল আকাশের দিকে ল্যাজ খাড়া করে চলেছে। তাদের সবার আগে নেপো!! রামভূজের যত ভাবনা, ‘দেখলেন, মা? বেচারি চোখে দেখে না, কানে শোনে না, হাঁটতে পারে না! এখুনি কী বিপদে পড়বে। ওকে বরং বাড়িতে রেখে আসি।’
এই বলে রামভূজ হাত বাড়িয়ে নেপোর ঠ্যাং ধরে এক টান দিল। খান কুড়ি বাঁকা নখ বের করে, নেপো বলল, ‘ফ্যাঁচ্!’ এই বলে এক লাফে ১০নং ফ্ল্যাটের মেমের রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ওর পেছন পেছন বাকি ন-টাও ঢুকল। দুমদাম ঝনঝন শব্দ, চিৎকার, দৌড়োদৗড়ি।
রামভূজ বলল, ‘আমরা বরং রওনা দিই।’