বেজিল জেহারফ : লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাধিপ্রস্তর হল তাঁর স্মৃতিসৌধ
জেহারফ হল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ও রহস্যময় এবং চরম ঘৃণিত এক ব্যক্তির নাম। এক সময় ঘোষণা করা হয়েছিল, যে কেউ এই জোহারফকে হত্যা করতে পারবে তাকে একলাখ ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। তার অসংখ্য ঘটনাবহুল জীবনীসংবলিত বই লেখা হয়েছে।
তিনি ভয়াবহ দারিদ্র্যের কোলে জন্মগ্রহণ করেও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ব্যক্তি হতে পেরেছিলেন। আর সম্পদশালী হয়েছিলেন ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র যেমন-বন্দুক, মেশিনগান, কামান আর বিস্ফোরক দ্রব্য বিক্রি করে। তাঁর জীবনীগ্রন্থের শুরুতে এ কথাগুলো লেখা ছিল, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাধি প্রস্তর হবে তার স্মৃতিসৌধ–আর তাদের মৃত্যুকালীন যন্ত্রণা হবে তাঁর স্মৃতিফলকের গাঁথা।‘
।বয়স যখন আটাশ বছর তখন সাপ্তাহিক পঁচিশ ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র বিক্রির একটা চাকরি পান। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, বন্দুক বেচার সবচে প্রধান উপায় হল বন্দুকের জন্য চাহিদা সৃষ্টি করা। এই ভেবে তিনি গ্রামবাসীদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করতে লাগলেন। তাদের বললেন যে রক্তপিপাসু শত্রুদ্বারা তারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছে।
সুতরাং মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হলে তাদের অবশ্যই অস্ত্রসংগ্রহ করা উচিত। তাঁর প্ররোচনায় সমস্ত দেশের ওপর দিয়ে উত্তেজনা তরঙ্গায়িত হতে থাকল, পতাকা আন্দোলিত হল। গ্রিস বাহিনী সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে জেহারফের কাছে থেকে বন্দুক কিনল, একটা ডুবো জাহাজ কিনল। এভাবে নিজের চতুরতা বুদ্ধি বিবেক দ্বারা লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করে গ্রিস ছেড়ে তুরস্কের পানে ছুটলেন এবং তাদেরও উত্তেজিত করার কাজে কোমর বেঁধে নামলেন। তাদের বললেন, “তোমরা দেখ, গ্রিসের লোকেরা পৃথিবী থেকে তোমাদের নাম মুছে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।” এতেই কাজ হল। তুর্কিরা জাহাজ কিনল দুটো আর তাদের মধ্যে অস্ত্র কেনার একটা প্রতিযোগিতা লেগে গেল। এতে অল্পকাল পরেই জেহারফের ভাগ্যে তিরিশ কোটি ডলার আয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়-যার সম্পূর্ণটা ছিল শোণিত সিক্ত। জেহার বিভিন্ন দেশের জাতীয় রীতিকে পুঁজি করে, পুরুষানুক্রমে শত্রুকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করে এবং যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে নিজের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইটালিতে অস্ত্র কারখানার মালিক হয়ে গেলেন। অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি তার গতিবিধিকে অত্যন্ত গোপনীয়তায় আচ্ছাদিত করে শিকারী বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ইউরোপের যুদ্ধ-শিবিরগুলোতে যাতায়াত করেছেন।
জনশ্রুতি আছে যে, তিনি তার সহকর্মী হিসেবে দুজনকে খুঁজে বের করেছেন যারা দেখতে তার মতো ছিল। তাদের কাজ হল বিভিন্ন দেশ ও শহরে জনসমক্ষে ইতস্তত ঘোরাফেরা করা, এই সুযোগে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ শিবিরে গোপন পাঁয়তারা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি কখনো স্বেচ্ছায় ছবি তোলেন নি, কাউকে তার সাক্ষাতের অনুমতি দেন নি, কখনো কোনো কাজের ব্যাখ্যা দেন নি এমনকি তার সম্বন্ধে যত দুর্নাম ও নিন্দা বর্ষণ করা হত, তিনি তার কোনো উত্তর করতেন না। ছাব্বিশ বছর বয়সে একবার গ্রিস থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথে রেলগাড়িতে সতের বছরের এক তরুণীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, কিন্তু মহিলাটি ছিল এক আধপাগলা ও আইবুড়ো ডিউকের স্ত্রী।
জেহারফ এই মহিলার স্মৃতি বক্ষে ধারণ করে অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতীক্ষা করলেন। অবশেষে ১৯২৩ সালে মহিলার স্বামী এক পাগলাগারদে মারা গেলে জেহার তাকে বিয়ে করেছিলেন। তখন মহিলার বয়স পঁয়ষট্টি আর জোহারফের চুয়াত্তর। অবশ্য তাদের বিবাহিত জীবন মাত্র আঠারো মাস স্থায়ী ছিল। শেষ বয়সে তিনি প্যারিসের অদূরে এক প্রকাণ্ড বাগানবাড়িতে কাটাতেন অথচ তার জন্ম হয়েছিল তুরস্কের জানলাবিহীন একটি মাটির ঘরে। ছোটবেলায় তিনি নোংরা মেঝেতে শুতেন, প্রায়ই তাকে অনাহারে কাটাতে হত। তিনি মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে যান কিন্তু তিনি চোদ্দটা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অব সিভিল ল’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। তিনি যখন লন্ডনে যান, তাকে চোর বলে জেলখানায় ঢোকানো হয়েছিল কিন্তু ত্রিশ বছর পর ইংল্যান্ডের রাজা তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি অর্ধশতাব্দী ধরে ডায়েরি লিখেছিলেন। তার গোপন ডায়েরিগুলো মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।