ভলিউম ১৩ – বেগুনী জলদস্যু – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর ১৯৯১
০১.
ঘড়ির অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। চোখ মেলে গুঙিয়ে উঠলো সে। গরমের ছুটির দ্বিতীয় সপ্তাহ সবে শুরু হয়েছে। এরই মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠেছে কাজ করতে করতে। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন। ইস, কেন যে। পড়শীদের বাগান সাফ করার দায়িত্বটা নিলো! না নিয়েও অবশ্য উপায় ছিলো না। রবিন আর কিশোরের সঙ্গে ডিজনিল্যাণ্ডে যাবার কথা, অথচ তিন গোয়েন্দার ফাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। ডিজনিল্যাণ্ডে যাওয়ার খরচই নেই, তার ওপর পড়ে আছে লম্বা ছুটিটা। টাকা খুব দরকার। অন্য দুজনও বসে নেই। রবিন লাইব্রেরিতে ওভারটাইম করছে। কিশোর খাটছে ওদের ইয়ার্ডে, বাড়তি সময়।
আরেকবার গুঙিয়ে উঠে বিছানা থেকে নামলো মুসা। তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরে নিচে রান্নাঘরে এসে দেখলো টেবিলে বসে গেছেন তার বাবা মিস্টার আমান।
কিরে, এতো তাড়াতাড়ি? হেসে জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
আর কি! বাগান সাফ! গোঁ গোঁ করে বলে রেফ্রিজারেটরের দিকে এগোলো মুসা, কমলার রস বের করবে।
টাকার দরকার, না? সহজ একটা উপায় বাতলে দিতে পারি। হলদে একটা কাগজ টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলেন মিস্টার আমান। গতরাতে মেলবক্সে ফেলে গেছে এটা।
চেয়ারে বসলো মুসা। কমলার রস খেতে খেতে চোখ বোলালো কাগজের লেখায়। একধরনের বিজ্ঞাপন। স্থানীয় বিজ্ঞাপন কোম্পানি বাড়ি বাড়ি দিয়ে যায়। পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে উঠলো মুসা। লেখা রয়েছেঃ
আপনি কি অভিযানপ্রিয়? ঐতিহাসিক?
বইয়ের পোকা? জলদস্যুদের বংশধর? তাহলে
আপনার জন্যে সুখবর আছে!
ডাকাত, জলদস্যু, ছিনতাইকারী, ঠগ, চোর,
এদের ব্যাপারে কি কোনো গল্প জানা আছে আপনার?
সত্যি ঘটনা? তাহলে আসুন আমাদের কাছে।
প্রতিটি গল্পের জন্যে ২৫ (পঁচিশ) ডলার। করে পাবেন।
তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার কাহিনী বলতে
হবে, আর কোনো জায়গার হলে চলবে না। এবং
এই গল্প নেয়া হবে জুন ১৮ থেকে ২২ তারিখ,
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ ১৩১২ ডি লা ভিনা স্ট্রীট।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। টাকা দিয়ে ভরে ফেলা যাবে! অনেক গল্প জানি আমরা। বিশেষ করে কিশোর আর রবিন। এখুনি যাচ্ছি, দেখাতে। আজ আঠারো, আটটা বেজে গেছে।
আরে বসো, বসো, হাত তুললেন মিস্টার আমান। কোটিপতি পরেও হতে পারবে। নাস্তাটা আগে শেষ করো।
বাবা, অনেক কাজ! আগে লনে পানি দিতে হবে
পেট খালি থাকলে কোনো কাজই করা যায় না। শেষ করো। তোমাকে তো খাওয়ার কথা এতো বলতে হয় না…
কিন্তু বাবা…, থেমে গেল মুসা। হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে।
বাবার ঠেলে দেয়া ভাজা গরুর মাংসের প্লেটটা টেনে নিলো সে। দ্রুতহাতে রুটি কেটে খাওয়া শুরু করলো। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেললো পুরো প্লেট। এরপর ডিম ভাজি। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল চারটে ডিম। একটা ফুটকেকের অর্ধেকটা শেষ করে ঢকঢক করে পানি খেলো এক গেলাস। উঠে দাঁড়িয়ে ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিতে নিতে বললো, হয়েছে তো?
মা কাজ করছেন রান্নাঘরে। খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। সেদিকে একবার তাকালো মুসা। এখন পালাতে পারলে বাঁচে। বেরিয়ে এসে যদি আবার কোনো কাজ চাপিয়ে দেন?
মুচকি হাসলেন মিস্টার আমান। হ্যাঁ, চলবে। দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারবে।
বিজ্ঞাপনটা হাতে নিয়ে প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরোলো মুসা। পাশের বাড়ির লনে পানি দিলো। অধৈর্য হাতে সাফ করলো মরা পাতা আর শুকনো ডাল। তারপর সাইকেল নিয়ে চললো কিশোরদের বাড়িতে, অর্থাৎ স্যালভিজ ইয়ার্ডে। সবুজ ফটক এক দিয়ে ঢুকলো ভেতরে, কিশোরের ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপে আরও দুটো সাইকেল দেখা গেল, তার মানে রবিন আর কিশোর আছে। ওগুলোর পাশে নিজেরটাও রেখে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো সে। হাতের কাগজটা নেড়ে চেঁচিয়ে বললো, এই দেখো, কি এনেছি!
বলেই চুপ হয়ে গেল। ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। রবিন হেলান দিয়ে রয়েছে একটা ফাইলিং কেবিনেটে। দুজনের কাছেই দুটো হলদে কাগজ, একই রকম।
পাঁচ মিনিট আগে এসেছি আমি, সেকেণ্ড, রবিন বললো। তোমার মতোই। সাংঘাতিক খবর নিয়ে!
আমি সকালেই পেয়েছি, কিশোর জানালো, ডাকবাক্সে। মনে হচ্ছে টাকা, কামানোর আগ্রহ আমাদের তিনজনের একই রকম।
একটা আর্মচেয়ারে প্রায় এলিয়ে পড়লো মুসা। আল্লাহ কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছি।
সত্যি সত্যি কাজ করলে কখনও বিরক্তি আসে না কারও, শুধরে দিলো কিশোর। চেয়ারে বসলো। বড়জোর ক্লান্তি আসে। সেটাই হয়েছে আমাদের। বুঝতে পারছি, জলদস্যুরা উদ্ধার করবে এবার।
সহজ পথে টাকা উপার্জন, বিড়বিড় করলো রবিন।
কাদের গল্প বলবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
কেন, অনেকেই তো আছে, জবাব দিলো কিশোর। ফরাসী জলদস্যু ডা বুচার্ডের কথা বলা যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে সে।
মাথা দোলালো মুসা। হ্যাঁ। এল ডিয়াবলোর কথাও বলতে পারি আমরা।
পারি, একমত হলো রবিন। এরপর আছে ডন সেবাসটিয়ান অ্যালভারো।
বিখ্যাত আরেকজন আছে, কিশোর বললো। ডা বুচার্ডের পর উদয় হয়েছিলো। উইলিয়াম ইভানস, বেগুনী জলদস্যু নামেই বেশি পরিচিত। মেরামত করে চালানো পুরনো গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। তবে এসব গল্প এখানকার অনেকেরই জানা। বলতে হলে তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমাদের। কেউ বলে ফেলার আগে।
আবার ওয়ার্কশপে বেরিয়ে এলো ওরা। বেরিয়েই শুনলো ডাক, কিশোর, ও কিশোর, কোথায় গেলি?
মেরিচাচী! আঁতকে উঠলো রবিন।
নিশ্চয় অনেক কাজ জমিয়েছে! চেঁচাতে গিয়েও কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেললো মুসা।
ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কিশোরের মুখ। আজ আর কিছু করতে পারবো না! জলদি পালাও! মেরিচাচী ওয়ার্কশপে ঢোকার আগেই সবুজ ফটক এক দিয়ে। বেরিয়ে পড়লো তিনজনে।
সাইকেল চালাতে চালাতে রবিন বললো, চিনি জায়গাটা। পুরনো স্প্যানিশ স্টাইলের চত্বর ঘিরে ইটের দেয়াল। একধারে কয়েকটা দোকান আছে। বেশির ভাগই এখন খালি।
সেজন্যেই হয়তো জায়গাটা বেছে নিয়েছে ওরা, বিজ্ঞাপন দিয়েছে যারা তাদের কথা বললো কিশোর। সস্তায় পাবে। তাছাড়া ভিড়টিড়ও কম। আরামে ইন্টারভিউ নিতে পারবে।
ডি লা ভিনা স্ট্রীটে উঠলো ওরা। ১৩০০ নম্বর ব্লকের কাছে থাকতেই চোখে পড়লো জনতার ভিড়। প্রতি মিনিটে বাড়ছে। রবিন যে দেয়ালটার কথা বলেছে, তার ভেতরে ঢোকার কাঠের গেটটা বন্ধ। দেয়ালে বড় করে নম্বর লেখা রয়েছেঃ ১৩১২।
চিন্তিত ভঙ্গিতে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে কিশোর বললো, বড় মানুষ খুব কমই আছে। আজ কাজের দিন, অফিস-আদালত সব ভোলা। আসবে ওরাও, ছুটি হলে। আমাদের জন্যে এই সময়টাই সুবিধে।,
পথের পাশের একটা লোহার রেলিঙে শেকল ঢুকিয়ে সাইকেলে তালা দিলো তিনজনে। খুলে গেল কাঠের দরজা। বেরিয়ে এলেন একজন চটপটে মানুষ। শাদা চুল। পুরু গোঁফ দেখলে মনে হয় নাকের নিচে ছোটখাটো দুটো ঝোঁপ ঝুলে রয়েছে, মানুষটার ছোট্ট শরীরের তুলনায় বেঢপ আকার। গায়ে টুইডের জ্যাকেট, পরনে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী পাজামা, পায়ে বুট, গলায় বাঁধা সিল্কের রুমাল, হাতে একটা বেত-ঘোড়া চালানোর সময় প্রয়োজন হয়। সব কিছু দেখে মনে হয়। প্রাচীন অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সৈনিক জ্যান্ত হয়ে উঠে এসেছে। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে চাবুকটা তুললেন তিনি, চুপ করার নির্দেশ।
আমার নাম মেজর নিরেক। পাইরেটস সোসাইটি অভ জাস্টিসে আসার জন্যে স্বাগত জানাচ্ছি সবাইকে। সবার কথাই শুনবো আমরা। তবে আজ এতো বেশি চলে এসেছো, শুনে শেষ করতে পারবো না একদিনে। যারা কাছে থেকে এসেছে, তারা ফিরে যাও। আরেক দিন এসো। রকি বীচের বাইরে থেকে যারা এসেছে, তারা শুধু থাকো।
হতাশার তীব্র গুঞ্জন বয়ে গেল জনতার মাঝে। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। দরজার কাছে পিছিয়ে গিয়ে পাল্লাটা লাগিয়ে দিলেন মেজর নিরেক। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু। কেউ শুনতে চাইলো না। ভীষণ হৈ-হট্টগোলে চাপা পড়ে গেল তার কথা।
নানারকম প্রতিবাদঃ
ইয়ার্কি পেয়েছো?
আসতে বলে এখন চলে যাওয়ার কথা!
শয়তানি ঘুচিয়ে দেবো, বেশি বেশি করলে!
এসেছি ফিরে যাওয়ার জন্যে?
আরও নানারকম কথা, গালাগাল হজম করতে হলো মেজরকে। সতেরো আঠারো বছরের ছেলেগুলোই বাড়াবাড়ি করছে। তাদের দিকে বেত তুলে চেঁচিয়ে। উঠলেন তিনি, এই ভাগো, ফাজিলের দল!
আরও রেগে গেল ওরা। একটা ছেলে এসে টান দিয়ে বেতটা কেড়ে নিতে চাইলো। আরও কয়েকজন এগিয়ে এলো তিনদিক থেকে, মেজরকে মারার জন্যে। রক্ত সরে গেল তার মুখ থেকে। চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন, বাঁচাও, রিগো, বাঁচাও!
দেয়ালের ভেতর থেকে কেউ বেরোলো না।
তিনদিক থেকে চেপে আসছে রেগে যাওয়া, উত্তেজিত জনতা।
.
০২.
বাঁচাও! আবার চিৎকার করলেন মেজর। এগিয়ে আসছে জনতা। রিগো, বাঁচাও?
কিশোরের দিকে তাকালো মুসা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মেজরকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া দরকার! বলেই আর দাঁড়ালো না সে। ছুটে গিয়ে একলাফে চড়লো পার্ক করে রাখা একটা গাড়ির ছাতে। চেঁচিয়ে বললো, পুলিস। পুলিস আসছে!
ঝট করে ফিরে তাকালো গেটের কাছে চলে যাওয়া কয়েকটা ছেলে। কিশোর। আর রবিন ততোক্ষণে প্রায় পৌঁছে গেছে মেজরের কাছে।
চলো, ভাগি! বলেই ছাত থেকে লাফিয়ে নেমে রাস্তার দিকে দৌড় দিলো। মুসা। কয়েকটা ছেলে ছুটলো তার পেছনে, বাকিরা দাঁড়িয়ে রইলো, দ্বিধা করছে। ধাক্কা দিয়ে কাঠের গেটটা ফাঁক করে ফেললো রবিন।
আসুন, স্যার, বলে ঠেলে মেজরকে সেই ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো কিশোর।
মেজরকে নিয়ে চত্বরে ঢুকে পড়লো দুজনে। খানিক পরেই সেখানে এসে হাজির হলো মুসা। আর কেউ ঢুকে পড়ার আগেই ঠেলে বন্ধ করে দিলো, ভারি গেটটা। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন নিরেক।
রিগো! গর্জে উঠলেন তিনি। গেল কোথায় শয়তানটা!
অনেক কাল আগে বড় বড় পাথর বসিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো এই চত্বর। মাঝে মাঝে ফাঁক, সেখানে লাগানো হয়েছিলো পিপুল আর জ্যাকারাণ্ডা গাছের চারা, সেগুলো বড় হয়েছে এখন। ফুলের ঝড়ে প্রায় ঢাকা পড়েছে উঁচু দেয়াল। উজ্জ্বল রঙের ফুল ফুটেছে। চত্বরের দূর প্রান্তে একসারি দোকান। সবগুলোই খালি এ মনে হচ্ছে। নিঃসঙ্গ, ছোট একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে ওগুলোর সামনে।
জ্যাকেটের পকেট থেকে লাল একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন মেজর। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। পুলিসও চলে এসেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে এখন গারদে ভরবে ব্যাটাদের।
হাসলো মুসা। পুলিস আসেনি, স্যার। ফাঁকি দিয়েছি ওদের। ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যে।
তাই নাকি? সাংঘাতিক চালাক ছেলে তো তুমি! ভালো। তোমার গল্পই আগে শুনি। যেখানেই থাকো না কেন। রিগো! গেল কোথায় গাধাটা! এই রিগো, শুনে যাও!
ওদের গল্প শুনতে রাজি হওয়ায় তাকে ধন্যবাদ দিলো রবিন আর মুসা।
কিন্তু কিশোর তেমন খুশি হতে পারলো না। ভুরু কুঁচকে বললো, বাইরের ওরা খুশি হবে না একথা শুনলে।
না হলে না হোক। কয়েকটা বাচ্চার ভয়ে কাবু হয়ে যাবে? অসম্ভব! রিগো! বলদটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! কোথায় গেল?
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা দোকানের দরজা। বেরিয়ে এলো বিশালদেহী এক লোক, যেন একটা ছোটখাটো হাতির বাচ্চা। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এলো মেজরের দিকে। শোফারের পোশাক পরনে, লাগেনি ঠিকমতো, ছোট হয়েছে। গোল মুখটা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। লালচে ঘন চুলের ওপর। বসানো শোফারের টুপিটাও ঠিকমতো লাগেনি, যেন অসহায় ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরে আছে চুল, পড়ে যাওয়ার ভয়ে। নীল চোখে ভয়। স-স-সরি, মে-মে-মেজর!
এই গরু, ছিলে কোথায়? আরেকটু হলেই তো মেরে ফেলেছিলো আমাকে!
ছিলাম না…মানে এখানে ছিলাম না! কাজ করছিলাম! টেপ রেকর্ডারটা ঠিক করে রাখছিলাম। অযথা গালাগাল করছিলো টনি। আপনার ডাক শুনতে পাইনি…
তা শুনবে কেন! খেঁকিয়ে উঠলেন মেজর। এখন যাও। গিয়ে বলো ওদেরকে, দশ মিনিটের মধ্যেই গেট খুলছি। লাইন দিয়ে দাঁড়াতে বলো। ভালো করে বুঝিয়ে বলে দেবে, শহর এলাকার মধ্যে থাকে এমন কারো ইন্টারভিউ নেয়া হবে না আজ। শুধু শহরের সীমানার বাইরের…
বাধ্য ছেলের মতো হেলেদুলে গেটের দিকে এগোলো রিগো। দরজা খুলতেই হৈ হৈ করে উঠলো জনতা। মেজর আবার বেরোচ্ছেন ভেবে ছুটে আসতে যাচ্ছিলো, কিন্তু রিগোকে দেখে থমকে গেল। হাসলেন নিরেক। ওকে দেখলেই অনেক গোলমাল থেমে যায়।
থামবেই, বললো রবিন।
আমার তো মনে হয়, ট্যাংক থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, মুসা বললো।
তা বোধহয় পারে, নাক দিয়ে খোতখোত করলেন মেজর। এসো আমার সঙ্গে।
মাঝখানের একটা দোকানের কাছে ওদেরকে নিয়ে এলেন তিনি। বাইরের। খালি ঘরের পেছনে ছোট আরেকটা ঘর। জানালা দিয়ে পেছনের চত্বর চোখে পড়ে, জংলা হয়ে আছে, তার ওপাশে উঁচু দেয়াল। সব কটা জানালাই বন্ধ, কাঁচ লাগানো। একটা জানালার নিচে বসানো এয়ার কনডিশনার মৃদু ঝিরঝির করছে। একটা ডেস্ক,আর কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই ঘরে। ডেস্কের ওপর রাখা একটা টেলিফোন। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে ব্যস্ত একজন লোক। মাথায় কালো চুল। পরনে শ্রমিকের পোশাক।
দেরি আছে? জিজ্ঞেস করলেন মেজর।
মুখ না তুলেই মাথা ঝাঁকালো শুধু লোকটা।
ও ওটা ঠিক করুক, নিরেক বললেন, এসো ততোক্ষণ গল্প করি আমরা। আমাদের পাইরেটস সোসাইটির কথা শুনবে? বেশ। ডেস্কের এক কোণে উঠে বসলেন তিনি। টেবিলে বুকলেন বেতটা। এই সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার এক দাদা, আমার আপন দাদার ভাই। মস্ত ধনী ছিলেন তিনি। মূল লক্ষ্য, জলদস্যুদের নিয়ে গবেষণা করা, তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের পরিবারের উন্নতি করা। আমাদের এক পূর্ব পুরুষ হামফ্রে নিরেকের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়েই এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে জাগে তাঁর মনে। হামফ্রের নাম দিয়েছিলো লোকে টাইগার নিরেক। প্রাইভেটিয়ার ছিলেন তিনি। ঔপনিবেশিক আমলে জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। প্রাইভেটিয়ার কাদেরকে বলে জানো তো?
জানি, মাথা ঝাঁকালো রবিন। বেসরকারী লোক, তবে সরকারী ভাবে অনুমতি দেয়া হতো যাদেরকে, শত্রু জাহাজ লুট করার জন্যে। তা, টাইগার নিরেকের নাম কিন্তু কখনও শুনিনি।
আমিও না, বিড়বিড় করলো কিশোর। কোনো কিছু জানে না বলতে খুব। খারাপ লাগে তার। ওই এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত একজনের নামই জানি আমি, জেনারেল জঁ ল্যাফিটি।
টাইগার নিরেকও তারচেয়ে কম বিখ্যাত নন। মেজর নিরেক বললেন, ল্যাফিটির মতোই দেশপ্রেমিক। আঠারোশো বারো সালে রেভলুশনারি ওঅরে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখেনি তার কথা। দুজনেই প্রাইভেটিয়ার ছিলেন। নিরেক ইংরেজ জাহাজকে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ কেড়ে নিয়ে গিয়ে জমা করতেন বিদ্রোহীদের ভাঁড়ারে। আর জেনারেল হামলা চালাতেন স্প্যানিশ জাহাজের ওপর। অ্যানড্র জ্যাকসনের দলে থেকে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন তিনি। নিরেক বা ল্যাফিটি, কেউই কম ছিলেন না, অথচ একজনের কথা লোকে মনে রাখলো, আরেকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেল। ইতিহাস যে কেন এই গোলমালটা করে, বুঝি না! এই ব্যাপারটাই খারাপ লেগেছিলো আমার দাদার। লাখ লাখ ডলার খরচ করে এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। করলেন। বই, পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। সেসব বইতে লেখালেন সেই সব লোকদের কথা, যাদেরকে এড়িয়ে গেছে ইতিহাস।
কিন্তু… শুরু করতে যাচ্ছিলো কিশোর। তার কণ্ঠে সন্দেহের সুর।
থামিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, শুনলে অবাক হবে, ইয়াং ম্যান, বছরের পর। বছর আমার দাদা সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন ওরকম মানুষের খোঁজে। তাদেরকে অনেক বড় করে তুলে ধরেছেন। তার সেই অসমাপ্ত কাজটাই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আমি বুঝেছি, ক্যালিফোর্নিয়ায় ওরকম হিরো অনেক আছে, দেশের জন্যে যারা ডাকাত হয়েছে।…এই টনি, হলো? মাথা। ঝাঁকালো লোকটা। মেজর বললেন, কে আগে শোনাবে?
আমি! মুসা বললো। ডাকাত এল ডিয়াবলোর গল্প বলবো আমি।
আগে বলার ইচ্ছে ছিলো কিশোরের, থেমে গেল। বসে পড়লো রবিনের পাশের চেয়ারটায়। মুসার মুখে আরেকবার শুনতে লাগলো মেকসিকান দস্যু ডিয়াবলোর বীরগাথা, মেকসিকান যুদ্ধের সময় কি করে আমেরিকান অনুপ্রবেশ কারীদের বাধা দিয়েছিলো। কিন্তু মুসা অর্ধেকও বলে সারতে পারলো না, তাকে থামিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, ভালো। আমাদের সোসাইটির জন্যে চমৎকার সিলেকশন। কাজে লাগবে এল ডিয়াবলো, তাকে তুলে ধরা উচিত। এরপর কে বলবে?
শুরু করে দিলো কিশোর, আমি দুজনের কথা বলবো। একজন, ফরাসী প্রাইভেটিয়ার হিপোলাইট ডা বুচারড। আরেকজন তার চাকর উইলিয়াম ইভানস, পরে যার ডাক নাম হয়ে যায় বেগুনী জলদস্যু। ফরাসী জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ডা বুচার্ড, পরে আরজেনটিনা সরকারের চাকরি নিয়ে নেন। আঠারোশো আঠারো। সালে যুদ্ধে নেমেছিলো দেশটা। তার জাহাজের নাম ছিলো সান্তা রোজা, মাঝিমাল্লা আর যোদ্ধা মিলিয়ে লোক ছিলো দুশো পঁচাশিজন। দশটা দেশ থেকে যোগাড় করেছিলেন ওদেরকে। স্প্যানিশ জাহাজ আর ঔপনিবেশিকদের ওপর হামলা চালাতে পাঠানো হয়েছিলো তাঁকে। আলটা ক্যালিফোর্নিয়ার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন তিনি। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেন মনটিরে অঞ্চল, পাবলো সোলার গভর্নরকে পরাজিত করেন, তারপর আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে হামলা চালাতে…
গুড! ভেরি গুড! হাততালি দিলেন মেজর। রবিনের দিকে ফিরে বললেন, তুমি কিছু বলবে?
হঠাৎ বাধা পেয়ে থমকে গেল কিশোর। চোখ মিটমিট করছে। মেজরের এই আচরণে খুবই অবাক হয়েছে সে। মুসার দিকে তাকালো। সে-ও তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ডন স্যাবাসটিয়ান অ্যালভারোর গল্প আরম্ভ করলো রবিন। কিন্তু মাঝপথে আসার অনেক আগেই হাত তুললেন মেজর। দারুণ! চমৎকার! ভালো ভালো গল্প নিয়ে এসেছে তোমরা। টেপে রেকর্ড করে রেখেছে নিক। পরে আবার বাজিয়ে শুনবো আমরা। তারপর যোগাযোগ করবো তোমাদের সঙ্গে।
যোগাযোগ করবেন? ভুরু কোঁচকালো মুসা।
কিন্তু বিজ্ঞাপনে লিখেছেন…
হেসে কিশোরকে থামিয়ে দিলেন মেজর। আমরা ওটুকু শুনেই ঠিক করবো, কার গল্প নেয়া যায়। তারপর পুরোটা শোনার জন্যে ডেকে পাঠাবো। এক ঘন্টার জন্যে পঁচিশ ডলার, কম তো না। ভালোমতো না শুনে দিই কি করে, তোমরাই বলো? ও হ্যাঁ, যাওয়ার সময় রিগোকে বলো পরেরজনকে পাঠিয়ে দিতে, প্লীজ।
মেজরের ব্যবহারে থ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। গেটের বাইরে বেরিয়ে রিগোকে জানালো তার মনিবের নির্দেশ। সারি দিয়ে অপেক্ষা করছে গল্প বলিয়েরা, তাদের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগোলো ওরা। সাইকেলগুলো ঠিকমতোই রয়েছে।
প্রথমে মুখ খুললো মুসা, বিষ ঝাড়লো, আমাদেরকে ঠকিয়েছে!
জ্বলে উঠলো রবিন, বিজ্ঞাপনে বলেছে অন্য কথা! যে কেউ গল্প শোনালেই টাকা দেবে বলেছে!
হুম! আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর। ভাবছে কিছু।
প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো! রবিন বললো।
শুরু করেছিলাম তো, বললো মুসা। পাত্তাই দিলো না!
হ্যাঁ। বড়দেরকে এভাবে ঠকাতে পারতো না। আমরা ছেলেমানুষ বলেই…
বড়দেরকে টাকা দিলে তখন গিয়ে ধরবো মেজরকে! দুই সহকারীর মুখোমুখি হলো গোয়েন্দাপ্রধান। চলো, মেজরের ওপর নজর রাখবো।
.
০৩.
সাইকেলগুলো যেখানে আছে সেখানেই রেখে, দৌড়ে দেয়াল ঘুরে চত্বরের পেছনে চলে এলো তিন গোয়েন্দা। দেয়ালে চড়ে বসলো। দোকানগুলোর পেছনে। পুরনো একটা ওক আর একটা জ্যাকারাণ্ডা ডালপালা ছড়িয়েছে, ওসবের আড়ালে মোটামুটি লুকিয়ে থেকে দৃষ্টি দিলে মেজরের ঘরে। আরেকটা ছেলের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। জানালা বন্ধ, তার ওপর এয়ারকুলারের গুঞ্জন, ভেতরের কথা কিছুই। শুনতে পেলো না গোয়েন্দারা। তবে কি ঘটছে, আন্দাজ করতে একটুও অসুবিধে হলো না।
দেখো! নিচু গলায় বললো মুসা।
তিনজনেই দেখলো, ঘরের ছেলেটার চোখে হঠাৎ বিস্ময় দেখা দিয়েছে। তর্ক শুরু করলো। একরকম জোর করেই তাকে ঠেলে বের করে দিলেন মেজর।
হু, মাথা দোলালো রবিন, শুধু আমাদের সঙ্গেই এরকম করেনি।
কিশোর বললো, এই, টনির ওপর চোখ রাখো!
রাখছিই তো, মুসা বললো। আর কি দেখবো?
দেখোই না কি করে।
পনেরো-ষোল বছরের একটা ছেলে ঘরে ঢুকলো। কথা বলতে আরম্ভ করলো। কয়েক মিনিট শুনেই তাকে বের করে দিলেন মেজর। ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই টেপ রেকর্ডারের একটা বোতাম টিপলো টনি। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার আরেকটা বোতাম টিপে মাইক্রোফোনটা রেডি করলো। পরের ছেলেটা যখন এলো, আবার ঘুরতে শুরু করেছে মেশিনের টেপ।
রিওয়াইন্ড করে নিয়ে আবার রেকর্ড করছে, মুসা বললো ধীরে ধীরে। কি দেখতে বললে বুঝলাম না…
বুঝেছি! বলে উঠলো রবিন। বার বার একই কাজ করছে। একটা। ফিতাকেই টেনে টেনে বার বার তাতে রেকর্ড করছে!
এবং, যোগ করলো কিশোর, আগের বার যেটা রেকর্ড করছে, পরের বারই সেটা মুছে ফেলছে।
মুছে ফেলছে? হাঁ হয়ে গেছে মুসা। তারমানে আমরা যা বলে এসেছি, সেসবও মুছে ফেলেছে?
কারো কথাই রাখছে না, সেকেণ্ড, সব মুছে ফেলছে।
তাহলে আবার ডাকবে কিভাবে?
ডাকবে না, জবাব দিলো রবিন।
ভালো প্রশ্ন করেছো, কিশোর বললো। কেন…, সতর্ক হয়ে গেল সে। এই একজন বড় মানুষ! দেখা যাক, এবার নতুন কিছু করে কিনা?
একই ভঙ্গিতে, একই হাসি দিয়ে লোকটাকে স্বাগত জানালেন মেজর। টেপ রিওয়াইও করেছে টনি। লোকটাও বেশিক্ষণ গল্প বলতে পারলো না, ছেলেদের মতোই বের করে দেয়া হলো তাকেও।
আসলে, মেজর যে মিছে কথা বলছেন কেউই বুঝতে পারছে না, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। সবাই ভাবছে, আবার ডাকা হবে তাদেরকে।
তার মানে ফাঁকিবাজি, রবিন বললো। কিন্তু কেন?
মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। বিজ্ঞাপন করে ডেকে নিয়ে আসা হলো সবাইকে। টেপে কথা তুলে আবার মুছে ফেলছে! অবাক কাণ্ড! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে লাগলো সে।
একসাথে দুজন ঢুকলো মেজরের ঘরে। একজন লম্বা, রোগা, দাড়ি আছে। পরনে জাহাজ ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম। ছোট একটা ছেলের হাত ধরে ঢুকেছেন। হতিনি। ওঁদেরকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলেন মেজর, হঠাৎ যেন বড় বেশি আগ্রহী। মনে হলো তাকে। ক্যাপ্টেনের সাথে হাত মেলালেন তিনি, বাচ্চাটার গাল টিপে আদর করলেন। দুজনকেই আদর করে এনে বসালেন চেয়ারে। মাইক্রোফোন মুখের কাছে এনে যখন কথা বলতে লাগলেন ক্যাপ্টেন, উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন মেজর।
নবাগতদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন বলে উঠলো, ছেলেটাকে চিনতে পেরেছো? আমাদের ইস্কুলে পড়ে, নিচের ক্লাসে। ক্যাপ্টেন নিশ্চয় তার বাবা।
জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হচ্ছে? মুসা বললো।
অনেকটা তা-ই। পাইরেটস কোভে বেগুনী জলদস্যুর আড্ডার নাম শুনেছো?
শুনেছি, ডিজনিল্যাণ্ডের মতোই অনেকটা। তবে খুব সামান্য ব্যাপার। জাহাজে করে যেতে হয়, জলদস্যুদের কি কি সব দেখায়, ব্যস।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমিও শুনেছি। কবছর হলো খুলেছে। এখনও। তেমন পরিচিত হয়নি।
ব্যবসাও হচ্ছে না, রবিন বললো। বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ বলা হয়। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে। একবার আমাদের ইস্কুলে লাইব্রেরীতে একটা ছোটখাট লেকচার দিয়েছিলেন তার ওপরে, তোমরা সেদিন ছিল না।
আরে, মেজর বেরিয়ে যাচ্ছে! মুসা বললো।
মাইক্রোফোনের সামনে বসে তখনও গল্প বলে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। পাশে বসে আছে তার ছেলে পিটার। মিনিটখানেক পরে রাস্তার দিক থেকে শোনা গেল সম্মিলিত চিৎকার। আবার কোনো কারণে রেগেছে গল্প বলিয়েরা। দেয়াল। থেকে নেমে পড়লো মুসা। ঝোঁপের আড়ালে থেকে দেয়াল ঘেঁষে এগোলো কি হয়েছে দেখে আসার জন্যে। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলো উত্তেজিত হয়ে।
সবাইকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন মেজর। গেটের ওপর নো মোর ইন্টারভিউ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে রিগো। আজ আর কোনো সাক্ষাৎকার নেয়া হবে না। আবার ফাঁকি দেয়া হলো গল্প বলিয়েদের। ফিরে এলেন মেজর। পেছন পেছন এলো হাতির বাচ্চা রিগো–অন্তত মুসার কাছে লোকটাকে সেরকমই লাগছে। ইশারায় তাকে কথা বলতে মানা করলেন। নিরেক।
খাইছে! ক্যাপ্টেনের গল্প ঠিকই রেকর্ড করা হচ্ছে! পুরোপুরি!
বুঝেছি! আচমকা চেঁচিয়ে উঠেই কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেললো রবিন। কেউ শুনে ফেললো কিনা তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে। ক্যাপ্টেন ফিলিপ বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ। নিরেক শুধু বেগুনী জলদস্যুর গল্পই চান, সেজন্যে আর সবাইকে ভাগিয়ে দিয়েছেন।
না। মনে করিয়ে দিলো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর গল্প আমিও বলতে চেয়েছিলাম। শোনেননি।
হয়তো খেয়ালই করেননি, মুসা যুক্তি দেখালো।
কিংবা গুরুত্ব দেননি, বললো রবিন। কারণ মেজর জানেন, ক্যাপ্টেন ফিলিপ বললে অনেক বেশি বলতে পারবেন। তাকেই তার দরকার ছিলো।
তাহলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কেন বললেন না, যে গল্প শুনতে চাই? কিশোরের জিজ্ঞাসা। কেন এতোসব ঝামেলা করতে গেলেন?
কি জানি…, গাল চুলকালো রবিন।
টাকা বাঁচানোর জন্যে, কিশোর, মুসা বললো। বাবা বলে, যদি শস্তায় কিছু। পেতে চাও, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও। অনেকে হাজির হবে, দামদর করার সুযোগ পাবে। রবিনের কথাই ঠিক, ক্যাপ্টেনের মুখেই গল্পটা শুনতে চেয়েছেন নিরেক। কায়দা করে ডেকে এনেছেন পুরো গল্পটা শোনার জন্যে, কম পয়সায়।
এটা অবশ্য হতে পারে। এই যুক্তিটাও তেমন জোরালো মনে হলো না কিশোরের।
সাক্ষাৎকার ওদিকে চলছে। সাড়ে এগারোটায় ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন। তাকে আবার বসিয়ে দিলেন নিরেক। পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। নিতে আপত্তি করলেন ফিলিপ। জোর করেই তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন মেজর। বার বার হাত ধরে ঝাঁকালেন। পিটারের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এগিয়ে দিতে গেলেন দুজনকে।
টপাটপ লাফিয়ে দেয়াল থেকে নেমে পড়লো তিন গোয়েন্দা। ঝোঁপের। আড়ালে আড়ালে ছুটলো চত্বরের সামনের দিকে।
গেটের ফাঁক দিয়ে দেখলো, রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা পুরনো একটা পিকআপ ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ফিলিপ আর পিটার। গাড়িটার রঙ বেগুনী। পাশে সোনালি অক্ষরে বড় করে লেখা রয়েছেঃ
বেগুনী জলদস্যুর আড়া
একদিনের জন্যে জলদস্যু হোন!
গেটের কাছে দাঁড়ানো মেজরের দিকে ফিরে বললেন ফিলিপ, তাহলে রাতে। দেখা হচ্ছে। নটায়।
বেগুনী পিকআপে করে চলে গেলেন ফিলিপ আর পিটার।
আজ রাতে? ফিসফিস করে বললো মুসা।
নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর সমস্ত গল্পটা শুনতে চান মেজর, অনুমান করলো রবিন।
কিন্তু…, থেমে গেল কিশোর।
চত্বরে দাঁড়ানো একটা ছোট ট্রাকের এঞ্জিন গর্জে উঠেছে। চালিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল উনি। গেটটা লাগিয়ে দিয়ে দোকানের পেছনের ঘরে ফিরে এলেন মেজর আর রিগো।
ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে আবার আগের জায়গায় চলে এলো তিন গোয়েন্দা। দেখলো, টেবিলে কি যেন রেখে ঝুঁকে দেখছেন মেজর আর রিগো।
দলিল, না ছবি? মুসার প্রশ্ন।
নকশা-টকশা হতে পারে, রবিন বললো।
আরো কাছে থেকে দেখতে যাবে ছেলেরা, এই সময় চত্বরে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ হলো। নতুন আরেকজন লোক এসে ঢুকলো দোকানে। খাটো, মোটা, মাথায় একটা রোয়াও নেই, পুরোপুরি টাক। নাকের নিচে মস্ত, বেমানান গোফ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে মেজরের পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে টেবিলে রাখা জিনিসটা দেখাতে লাগলো। খানিক পরেই হাসতে শুরু করলো। তাতে যোগ দিলেন মেজর। রিগোকেও খুশি দেখাচ্ছে।
বন্ধ জানালার কারণে এবারেও ভেতরের কথা শুনতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। এগিয়ে গিয়ে বোতাম টিপে টেপ রেকর্ডারে লাগানো ক্যাসেটের ফিতা রিওয়াইও করতে লাগলেন মেজর।
কিশোর? মুসা বললো। এটাতেই রেকর্ড করেছিলো না ক্যাপ্টেনের কথা?
মুসার মুখের দিকে তাকালো একবার কিশোর আর রবিন, পরক্ষণেই মাথা ঘোরালো টেপ রেকর্ডারের দিকে। রিওয়াইণ্ডিং চলছে এখনো।
ওটাই হবে! রবিন বললো উত্তেজিত কণ্ঠে। টনি ক্যাসেটটা বের করেনি, আমি খেয়াল রেখেছি। ক্যাপ্টেনের সাথে সাথে তিনজনেই বেরিয়ে গিয়েছিলো, ঘরে আর কেউ ছিলো না। মেজর আর রিগো ফিরে এসেও মেশিনটার কাছে যায়নি। চোখ মিটমিট করলো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে। ক্যাপ্টেনের কথাও মুছে ফেলছে!
তারমানে, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর কাহিনীও চায় না ওরা।
কিন্তু ক্যাপ্টেনের গল্প তো শুনলো, মুসা বললো।
তার কথা শোনার জন্যে ভাগিয়ে দিলো সবাইকে, বললো রবিন।
এমনকি টাকাও দিলো, কিশোর বললো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, সেটার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের সম্পর্ক আছে।
কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?
ঘটছেই বা কী? রবিনের সুরে সুর মেলালো মুসা।
সেটাই, কিশোর বললো, জানার চেষ্টা করবো আমরা। চলো, বাড়ি যাই। খিদে পেয়েছে। বিকেলে আবার আসবো, নজর রাখবো মেজর আর তার। লোকজনের ওপর। ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গেও কথা বলবো। হাসি ফুটলো তার মুখে। মনে হচ্ছে, নতুন আরেকটা কেস পেয়ে গেল তিন গোয়েন্দা!
.
০৪.
সেদিন আর মেজরের ওখানে যেতে পারলো না তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডে ফিরতেই রাশেদ পাশা বললেন, তাঁর সঙ্গে যেতে হবে কিশোরকে। স্যান লুইস। অবিসপোতে অনেক পুরনো মাল দেখে রেখে এসেছেন। সেগুলো কিনবেন। রবিনকেও আটকে দিলেন লাইব্রেরিয়ান, যেখানে সে পার্টটাইম চাকরি করে। একজন কর্মচারি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়তি কাজ করতে হলো রবিনকে। মুসাকে আটকালেন তার মা। গ্যারেজ আর তার আশপাশটা পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন। লাগিয়ে দিলেন সেই কাজে। দুই দিন পর রেহাই পেলো তিনজনেই ওরা। সকাল এগারোটায় এসে মিলিত হলো হেডকোয়ার্টারে। মেজর নিরেকের বেঅদ্ভুত আচরণের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে।
কাল রাতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিশোর জানালো। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের কথা রেকর্ড করছেন মেজর।
দ্রুত আলোচনায় ঠিক হলো, সাইকেল নিয়ে পাইরেটস কোভে যাবে কিশোর আর মুসা। আর তিন গোয়েন্দার নতুন, আজব আবিষ্কারটা বয়ে নেবে রবিন।
এটা একটা অদৃশ্য অনুসরণের যন্ত্র, বললো কিশোর। যাকে চাই, সে চোখের আড়ালে থাকলেও খুঁজে বের করে ফেলতে পারবো।
ছোট্ট যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো মুসা। একটা পকেট রেডিওর সমান। ভেতরে একটা ধাতব পাত্র রয়েছে, তাতে ঘন এক ধরনের তরল পদার্থ ভরা। নিচের দিকে একটা সরু টিউব, চোখে ওষুধ দেয়ার ড্রপারের মতো জিনিস। ড্রপারের ভেতরে একটা খুদে ভালভ আছে। বাক্সের একপাশে একটা শক্তিশালী। চুম্বক লাগানো।
কি করে কাজ করে এটা, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
অদৃশ্য চিহ্ন রেখে যাবে এটা, বুঝিয়ে বললো কিশোর। আমাদের ছাড়া আর কারও চোখে পড়বে না। যে কোনো যানবাহনের ধাতব বডিতে চুম্বকের সাহায্যে আটকে দিতে পারবো যন্ত্রটা। ভেতরের তরল কেমিক্যাল সাধারণ ভাবে দেখা যায় না, অতিবেগুনী আলো ফেলতে হয়। আলট্রাভায়োলেট লাইট যাকে বলে। ড্রপারের মাথার কাছে লাগানো ভালভটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সরে গিয়ে একফোঁটা করে কেমিক্যাল ছেড়ে দেবে বাইরে। মাটিতে পড়বে জিনিসটা, আর সুন্দর একসারি চিহ্ন রেখে যাবে। হাতে আলট্রাভায়োলেট টর্চ থাকলে ওই চিহ্ন ধরে অনুসরণ করে যাওয়া খুবই সহজ।
তারমানে আলট্রাভায়োলেট টর্চও আছে আমাদের কাছে?
নিশ্চয়ই, হেসে বললো কিশোর। ছোট একটা টর্চ বের করে দিলো রবিনের হাতে। সাধারণ টর্চের মতোই দেখতে, শুধু বা অদ্ভুত।
এটা থেকেই বেরোবে আলট্রাভায়োলেট লাইট? উসখুস করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো মুসা, ওটা কি ধরনের আলো, কিশোর? ক্লাসে নিশ্চয় পড়িয়েছে, আমি বোধহয় অ্যাবসেন্ট ছিলাম।
সাধারণ আলোর চেয়ে এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খাটো, ব্যাখ্যা করলো রবিন। ব্ল্যাক লাইট বা কৃষ্ণ আলোকও বলা হয় একে। অন্ধকারে কোনো কিছুর ওপর এই আলো ফেললে একধরনের বিচিত্র আভা দেখা যায়, নামটা হয়েছে সে-কারণেই। আরেকটা ব্যাপার, যে জিনিসের ওপর ফেলবে, সেই জিনিসটা দেখা যাবে, কিন্তু আলোক রশ্মি দেখা যাবে না।
ইনফ্রারেড লাইটের মতো, তাই না? তবে ওটা শুধু রাতে কাজ করে। আলট্রাভায়োলেট কি দিনেও কাজ করবে, মানে দেখা যাবে এটা দিয়ে?
যাবে, তবে রাতের মতো অতো উজ্জ্বল হবে না চিহ্নগুলো, স্পষ্ট হবে না। এতে বরং সুবিধেই। আশপাশে কেউ থাকলে তার চোখ এড়ানো সহজ হবে। রবিন, মেজরের গাড়িতে যন্ত্রটা লাগিয়ে দেবে। তারপর সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করবে চিহ্ন। যন্ত্রের কনটেইনারে লিকুইড কেমিক্যাল যা ভরা আছে, তাতে অন্তত দুঘন্টা চলবে। তার মানে বহুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করতে পারবে গাড়িটাকে।
বসে আছি কেন তাহলে?
হ্যাঁ, চলো।
যন্ত্র আর টর্চ একটা ব্যাকপ্যাকে ভরে ব্যাগটা পিঠে বেঁধে নিলো রবিন। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলো তিনজনে। সাইকেল রাখা আছে ওয়ার্কশপে। নিয়ে। বেরিয়ে পড়লো ওরা। রবিন রওনা হয়ে গেল শহরের দিকে। কিশোর আর মুসা চললো উত্তরে, শহরের প্রান্তসীমার দিকে, সাগরের সীমানাও শুরু হয়েছে ওখান থেকেই।
মনের ভাবনাটা মুসার কাছে প্রকাশ করে ফেললো কিশোর, ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে আমার কাছে, বুঝলে। শহরের ভেতরের কারো গল্প শুনতে চাইলেন না মেজর, শুধু শহর এলাকার বাইরে…
আরেকটা সেটআপ। চালাকি। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে ধরার জন্যে। ঠিক না?
হতে পারে।
.
রকি বীচের কয়েক মাইল উত্তরে উপকূলরেখা বরাবর একটা ছোট খাড়ির নাম। পাইরেটস কোভ। ছোট্ট একটা গ্রাম আছে ওখানে, অল্প কয়েকটা ঘর আর দোকানপাট আছে। কিছু মাছধরা নৌকা আর জাহাজ আছে। আর আছে একটা এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস। সাইকেল চালিয়ে সাগরের তীরে চলে এলো কিশোর আর মুসা। খাড়ির কাছাকাছি আসতে চোখে পড়লো কাঁচাহাতে আঁকা একটা সাইনবোর্ডঃ
বেগুনী জলদস্যুর আড্ডা
ছোট-বড় সবার জন্যেই চমৎকার অ্যাডভেঞ্চার।
একটা কারখানা বাড়ির পরেই এই টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। আড্ডাটা গড়ে তোলা হয়েছে খাড়ির মাঝের একটা ছোট উপদ্বীপে। মূল ভূখণ্ডের দিকটায় কাঠের পুরনো বেড়া। বেড়ার বাইরে দুটো জায়গায় গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে পথ ধরে চলেছে কিশোররা, তার ডানে ঘন গাছের একটুকরো জঙ্গল, তার ওপাশেও বেড়া।
দুটো পার্কিং লটেই প্রচুর ধুলো। অল্প কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এই সকাল বেলা। গেটের বাইরে টিকেট বুদের কাছাকাছি বসে সোডা খাচ্ছে কয়েক জোড়া দম্পতি। তাদের বেয়াড়া বাচ্চাগুলো চেঁচামেচি করছে,মারামারি করছে। দুটো ছেলে একে অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বুদের ওপরে একটা কাঠের সাইনবোর্ডে পাইরেট শো-এর সময় লেখা রয়েছেঃ
ব্লাক ভালচার-এর যাত্রার সময়
প্রতিদিন ১২টা, ১টা, ২টা, ৩টা, ৪টা।
বুদের ভেতরে বসে আছে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক। অনবরত বাতাসের মধ্যে কাটিয়ে মুখের চামড়ার এমন অবস্থা হয়েছে, দেখে আর এখন বোঝার উপায়। নেই বয়েস কতো। ডোরাকাটা একটা নাবিকদের শার্ট পরেছে সে। চোখে লাগিয়েছে কালো কাপড়, অন্ধরা যেমন লাগায়। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে চলেছে, ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, দর্শকবৃন্দ। কল্পনাই করতে পারবেন না কতোখানি রোমাঞ্চকর এই অভিযান। নিশ্চয় লিখে মুখস্থ করে নিয়েছে এই বক্তৃতা, ভাবলো কিশোর। লোকটা বলছে, বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় এসে একদিনের জন্যে জলদস্যু হয়ে যান সবাই। জাহাজে পাল তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পাইরেটস কোভে। মাথার ওপর দুলবে কালো পতাকা, তাতে মড়ার খুলির নিচে হাড়ের ক্রস আঁকা। অদ্ভুত দেখতে একটা স্কোয়ার-রিগার টাইপের জাহাজ। জলদস্যুরা যেরকম পছন্দ করতো। আবার তার নামেরই বা কি বাহার দেখুন, ব্ল্যাক ভালচার। কালো শকুন। কেমন গা ছমছম করে না? দ্বীপে দ্বীপে দেখবেন লড়াই চলছে। বারুদের গন্ধ ভাসে বাতাসে, আপনিও পাবেন সেই গন্ধ। নিজের চোখে দেখবেন কি করে আক্রমণ করে জলদস্যুরা। আর মাত্র কয়েকটা টিকেট বাকি। বিশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে ব্ল্যাক ভালচার। পেছনে পড়ে থাকবেন না। হেলায় সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন না। আসুন, জলদি আসুন।
অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালো দম্পতিরা, এতো টিকেট কারা কিনে ফেললো যে মাত্র অল্প কয়েকটা বাকি আছে? কাউকেই চোখে পড়লো না, শুধু ওর ছাড়া। তবে দেরিও করলো না। উঠে গিয়ে লাইন দিলো টিকেট কাউন্টারে সামনে। দলে গিয়ে দাঁড়ালো কিশোর আর মুসা। যখন কিশোরের পালা এলো। জানালার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো সে, ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গে দেখা করতে চাই, ভাই, খুব জরুরী।
লোকটার একটামাত্র চোখ তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। শো-এর সম ক্যাপ্টেন কারো সঙ্গে দেখা করেন না।
কিন্তু, তর্ক শুরু করলো কিশোর, শো তো এখনও…
ক্যাপ্টেন এখন জাহাজে। মারিয়া!
উঠে পড়লো কানা নাবিক। চলে গেল বুদের পেছনের ঘরে। প্রায় দৌড় এসে তার জায়গায় বসলো আঠারো-উনিশ বছরের একটা মেয়ে। জলপাই রঙের চামড়া মুখের। কালো চুল, বেণি করেছে।
কটা? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো মারিয়া। কথায় স্প্যানিশ টান।
ক্যাপ্টেন ফিলিপকে দরকার, মিস। এখুনি।
বুঝলাম না। কটা টিকেট? দুটো? কেমন যেন অনিশ্চিত শোনালো মেয়েটার কণ্ঠ।
ওভাবে বলে হবে না, কিশোর, পেছন থেকে বললো মুসা। কি করবে?
আর কি করবো? টিকেটই কাটতে হবে। জাহাজে উঠে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে আরকি।
.
টিকেট কেটে, চওড়া একটা গেটের দিকে এগোলো দুজনে। কাঠের ফ্রেমে কাঁটাতারের বুনন দিয়ে তৈরি হয়েছে পাল্লা। দুটো পাকা নিচু বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পথ, একেবারে ডক পর্যন্ত। ডকে বাঁধা রয়েছে জাহাজটা, ব্ল্যাক ভালচার। কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রীদের জন্যে। দুই মাস্তুলের। পালতোলা প্রাচীন স্কোয়ার-রিগার জাহাজের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। কালো রঙ। প্রধান মাস্তুলে উড়ছে কালো জলি রোজার পতাকা, তাতে জলদস্যুদের কুখ্যাত চিহ্ন আঁকা রয়েছেঃ মড়ার খুলি আর হাড়ের ক্রস।
গেটের অন্যপাশে চলে এলো দুই গোয়েন্দা। নিচু বাড়িগুলো বোধহয় আস্তাবল ছিলো একসময়, পরে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বাঁয়ের বাড়িটায় এখন তিনটে দোকান। একটাতে আইস ক্রীম আর কোল্ড ড্রিংকস বিক্রি হয়। আরেকটায় ভনির। আর তৃতীয়টাতে বিক্রি হয় কফি আর হট ডগ। ডানের বাড়ির সামনেটা পুরো খোলা। মিউজিয়ম করা হয়েছে। তাতে জাহাজী আর জলদস্যুদের ব্যবহৃত নানা জিনিসের প্রদর্শনী চলছে। দুটো বাড়ির মাথায়ই জলি। রোজার পতাকা উড়ছে। তৃতীয় আরেকটা উড়ছে গেটের ওপর। সব কিছুই কেমন। মলিন। ঠিকমতো রঙ করা হয়নি। পুরনো, ক্ষয়া চেহারা।
ডানে, মিউজিয়মের পেছনে অনেকগুলো ওকগাছের পেছনে দেখা গেল বোটহাউস। তারও পরে পাথরের একটা টাওয়ার। ওদিকে পানির একটু পর থেকেই শুরু হয়েছে একসারি দ্বীপ, মোট চারটে। এতোই ছোট, ঘর বানিয়ে মানুষ বাসেরও অনুপযুক্ত। দ্বীপ ছাড়িয়ে, খাড়ির অপর পারে দেখা গেল এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা প্লেন উঠে গেল রানওয়ে থেকে।
আহামরি কোনো জায়গা নয়, আনমনে বললো কিশোর। দেখার তেমন কিছু নেই।
রবিন তো বললোই, ব্যবসায় সুবিধে করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন ফিলিপ, মুসা বললো। হয়তো এই দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়ে কিছু করতে চাইছেন মেজর নিরেক।
তা হতে পারে।
দুটো বিল্ডিঙের মাঝের চওড়া প্রমেনাড় ধরে হেঁটে চললো ওরা। ডানের মিউজিয়মের দিকে তাকালো। ধুলোয় ঢাকা তলোয়ার, মরচে পরা কামান-বন্দুক, মোমে তৈরি জলদস্যু আর নাবিকদের মূর্তি, আর জাহাজীদের নানা-রকমের পোশাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোও তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করে না দর্শকদের, বুঝতে পারলো কিশোর। ডকের কাছে পৌঁছে একটা ছেলেকে দেখতে পেলো। ঢলঢলে শার্ট গায়ে, পরনে ঢেলা, ফোলা প্যান্ট, জলদস্যুরা যেরকম পরতো।
পিটার ফিলিপ! বলে উঠলো মুসা।
বেশ জোরেই বলেছে সে, কিন্তু ছেলেটা শুনলো বলে মনে হলো না। দ্রুত এগিয়ে গেল ব্ল্যাক ভালচারের সিঁড়ির দিকে। জাহাজের পেছনের কোয়ার্টারডেকে পায়চারি করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। কালো, লম্বা ঝুলওয়ালা কোট গায়ে। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুট পরেছেন। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, তাতে ঝুলছে ভোজালি। ছেলের মতোই তিনিও একটা ট্রাইকর্ন হ্যাট মাথায় দিয়েছেন, তাতে লাল পালক গোঁজা। বাঁ হাতের তালু আর আঙুল যেখানে থাকার কথা, সেখানে দেখা গেল বাঁকা একটা স্টীলের হুক। লাগিয়ে নিয়েছেন জলদস্যুর ভয়ংকরতা বোঝানোর জন্যে। টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম! জলদি করো, জলদি করো, উঠে এসো! ব্যবসায়ীদের একটা জাহাজ দেখতে পাচ্ছি! স্রোতও চমৎকার! এখুনি নোঙর তুলে তাড়া করবো ওটাকে!
এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন ক্যাপ্টেন, মুসার মনে হলো এটা অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি। রোমাঞ্চিত হলো সে। নীরবে জাহাজে উঠে গেল দুই গোয়েন্দা। হঠাৎ গান গেয়ে উঠলো একদল জলদস্যু, বুনো চিৎকারে ঝালাপালা করে দিলো কান। চমকে ওপর দিকে তাকালো মুসা। লাউডস্পীকারে বাজছে ওসব। ঝট করে ডেকের দুই পাশে লাফিয়ে উঠলো অনেক জলদস্যু, কানা চোখে কালো পট্টি লাগানো, দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ছুরি, যেন অন্য জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। কার্ডবোর্ডে তৈরি ওগুলো। সামনের মাস্তুলে পতপত করছে একটা পাল। ঢিলে ভাবে। চলতে আরম্ভ করলো ব্ল্যাক ভালচার। বাতাসের সঙ্গে ওটার যাত্রাপথের কোনো সম্পর্ক নেই। এঞ্জিনে চলছে।
দূর, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো মুসা, মজাটাই নষ্ট করে দিলো ওই লাউডস্পীকার আর এই এঞ্জিন! বেশি মেকি হয়ে গেল।
দর্শক বেশি না। বিষণ্ণ চোখে দেখছে ওরা পাল আর হার্ডবোর্ডের মানুষগুলোকে। হঠাৎ ঝড়ো বাতাস আর উত্তাল ঢেউয়ের ভারি শব্দ যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো লাউডস্পীকার থেকে। জলদস্যুদের গান আর চেঁচামেচি বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে এঞ্জিনের ভটভট-ভটভট আওয়াজটা ভারি বেমানান। পাইরেটস কোভের দিকে এগিয়ে চলেছে জাহাজ।
বাজে। আবার বিরক্তি প্রকাশ করলো মুসা। একেবারেই বাজে! কিন্তু এ জিনিসের ওপর এতো আগ্রহ কেন মেজর নিরেকের?
জানি না, কিশোর বললো। দেখে যাও।
.
০৫.
ডি লা ভিনা স্ট্রীটের দেয়ালে ঘেরা চত্বরের কাছে এসে পৌঁছলো রবিন। কাঠের উঁচু গেট বন্ধ। ঘুরে পেছন দিকে চলে এলো সে, আগের বার যেখানে উঠে বসেছিলো তিন গোয়েন্দা, সেখানে উঠলো। দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে তাকালো। কেউ নেই। অপেক্ষা করতে লাগলো সে।
পনেরো মিনিট পর কিচকিচ করে খুলে গেল গেটের ভারি পাল্লা। চত্বরে ঢুকলো একটা গাড়ি। দোকানের পেছনের ঘরটায় এসে ঢুকলেন মেজর। হাতে একটা প্রাস্টিকের ব্যাগ। মনে হয় একাই এসেছেন। ব্যাগ থকে কফির সরঞ্জাম বের করে খেতে বসলেন তিনি। খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে খুলে বিছালেন টেবিলের ওপর।
ছোট একটা রুলার বের করে কাগজটার ওপর রেখে মাপজোক করলেন। সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। ছোট একটা নোটবুকে কিছু লিখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার জন্যে কান পাতলেন। রবিনও শুনতে পেলো শব্দটা। আরেকটা গাড়ি ঢুকলো চত্বরে। দোকানের সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর। ডালপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দেখছে রবিন। গেট দিয়ে ঢুকছে আরও একটা মোটরযান, বড় ট্রাক।
এটাতে করেই দুদিন আগে চলে গিয়েছিলো টনি।
মোট তিনটে ট্রাক এখন চত্বরে। একটা, টনির ট্রাক। দ্বিতীয়টা একটা আইস ক্রীম ভ্যান। আর তৃতীয়টা বিরাট এক লরি, পেছনে প্ল্যাটফর্ম লাগানো রয়েছে ইচ্ছেমতো নামানো যায়, ওঠানোও৷ যায়। পাশে বড় করে লেখা রয়েছেঃ হ্যারিসনস ট্রী সার্ভিস। দুজন ট্রাক ড্রাইভারের একজনের পরনে আইস ক্রীম বিক্রেতার শাদা ইউনিফর্ম। আরেকজনের পরনে মালির পোশাক। কোমরের ভারি বেল্ট থেকে ঝুলছে নানারকম যন্ত্রপাতি। রবিনের দিকে পেছন করে রয়েছে ওরা। মেজর নিচু গলায় কথা বলছেন ওদের সঙ্গে। দুটো লোককেই চেনা চেনা লাগছে। রবিনের। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে। কথা শেষ করে যার যার ট্রাকে গিয়ে উঠলো ওরা। বেরিয়ে গেল। ভোলাই রইলো। গেটটা।
আবার আগের ঘরে ফিরে এলেন মেজর নিরেক।
দেয়াল থেকে নেমে পড়লো রবিন। গুঁড়ি মেরে চলে এলো দোকানের সামনের দিকে। কানে এলো মেজরের কথা, হ্যাঁ, বুঝেছি, গাধা কোথাকার! দশ মিনিট সময় দিলাম! খটাস করে রিসিভার আছড়ে রাখলেন ক্রেডলে।
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কিশোরের দেয়া যন্ত্রটা বের করে চত্বরে দাঁড়ানো ট্রাকটার দিকে চললো রবিন। নিচের ইস্পাতের ফ্রেমে এমন ভাবে লাগালো ওটা, যাতে ড্রপারের মুখটা নিচের দিকে থাকে। লাগিয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না, এক দৌড়ে এসে ঢুকলো ঝোঁপের ভেতর।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন মেজর। গেটের বাইরে ট্রাকটা বের করে থামালেন। নেমে এসে লাগিয়ে দিলেন গেটটা।
ট্রাকটা চলে যাওয়ার শব্দ শুনলো রবিন। দৌড়ে এলো দেয়ালের কাছে। দেয়াল টপকে ওপাশে নেমে চলে এলো একটা টেলিফোন পোস্টের কাছে, যেটাতে সাইকেল বেঁধে রেখে গিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি খুলে নিয়ে তাতে চড়ে এলো গেটের কাছে। আলট্রাভায়োলেট টর্চ বের করলো।
সহজেই খুঁজে বের করলো চিহ্ন। অতিবেগুনী রশ্মি পড়ে জ্বলজ্বল করছে। বেগুনী ফোঁটাগুলো। আপনমনেই হাসলো রবিন। এগিয়ে চললো ওই ফোঁটা অনুসরণ করে।
প্রথমে সাগরের দিকে গেছে চিহ্নগুলো, তারপর গিয়ে উঠেছে হাইওয়েতে। উদ্বিগ্ন হলো রবিন। গাড়িতে করে গেছেন মেজর। এই খোলাপথে গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেলে করে অনুসরণ করা অসম্ভব। খানিক দূর এগিয়ে আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। চিহ্নগুলো হাইওয়ে থেকে আরেক দিকে মোড় নিয়েছে, চলে গেছে বড় একটা শপিং সেন্টারের দিকে।
অনেক গাড়ি পার্ক করা রয়েছে বাজারের পার্কিং লটে। ওগুলোর ভেতর দিয়ে চললো রবিন। চোখ খুঁজছে ভ্যানটাকে। এই দিনের আলোয় মাটির দিকে আলো জ্বালার ভঙ্গিতে টর্চ ধরে রাখতে সঙ্কোচ লাগছে তার, বোকা ভাবতে পারে লোকে। তবে বাইরে লোকজন তেমন নেই, বেশির ভাগই ভেতরে, কেনাকাটায় ব্যস্ত।
ভ্যানটা চোখে পড়লো না। টর্চ দিয়ে না খুঁজে উপায় নেই। যে যা খুশি ভাবুকগে, বলে মন থেকে জোর করে অস্বস্তি দূর করে দিলো রবিন। চিহ্ন ধরে ধরে এগোলো আবার। একটা হার্ডওয়্যারের দোকানের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ফোঁটাগুলো।
সাইকেল থেকে নেমে সাবধানে দোকানটার কোণায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো সে। দোকানের পাশের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্যানটা। পেছনের দরজা খোলা। একটু পরেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন মেজর। পেছনে হস্তীদেহী রিগো। হাতে কয়েকটা বস্তা, আলুর বস্তার মতো।
বস্তাগুলো ভ্যানে তুললো সে। আবার দুজনে গিয়ে ঢুকলো দোকানে। ভ্যানের ভেতরে উঁকি দেয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে ঠেকালো রবিন। বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে। যাবে। যে-কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারেন মেজর আর রিগো। এবং তা-ই করলো ওরা। এবারও আগে আগে বেরোলেন মেজর। পেছনে রিগো বেরোলো হাতে কতগুলো ব্যাটারির মতো জিনিস নিয়ে। ওগুলোও ভ্যানের পেছনে। তুলে দরজা লাগিয়ে দিলো।
এত ঢিলা, ছাগল! ধমক লাগালেন মেজর। জলদি ওঠো। আমার খিদে পেয়েছে।
ভ্যানের সামনের সীটে উঠলো দুজনে।
চট করে সরে গেল রবিন। মেজরের চোখে পড়তে চায় না।
বেগুনী ফোঁটা ধরে ধরে আবার ভ্যানটাকে অনুসরণ করলো সে। এতো জোরে চলেছে, পার্কিং লটের মোড় ঘুরে আরেকটু হলেই গিয়ে পড়েছিলো ভ্যানটার গায়ে। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। কাঁচের দরজার ওপাশে মেজর আর রিগোকে দেখতে পেলো সে। খেতে গেছে, বেরোতে সময় লাগবে। এটাই সুযোগ!
ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে তাকালো রবিন। আলুর বস্তাগুলো দেখলো। ব্যাটারিগুলো দেখলো। আরও জিনিস পড়ে আছে মেঝেতে। কতগুলো বেলচা আর গাইতি। মাটি লেগে আছে ওগুলোতে। সদ্য খোঁড়া মাটি!
০৬.
ভটভট-ভটভট করে পাইরেটস কোবের দিকে চলেছে ব্ল্যাক ভালচার। বাতাস, ঢেউয়ের গর্জন, আর জলদস্যুদের কোলাহল ছাপিয়ে লাউডস্পীকারে গম গম করে উঠলো ক্যাপ্টেন ফিলিপের কণ্ঠ, বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় স্বাগতম। উত্তর লস। অ্যাঞ্জেলেসের সব চেয়ে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এসেছেন। আপনারা। কুখ্যাত বেগুনী জলদস্যু আর তার ভয়ংকর সহকারীদের নিষ্ঠুর। কাণ্ডকারখানা দেখবেন আপনারা পাইরেটস কোভে। তবে তার আগে ওই দসর্দারের কথা কিছু জানা থাকা দরকার আপনাদের, আমি মনে করি। কাহিনীর শুরু আঠারোশো আঠারো সালে, যেদিন আলটা ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে এসে নোঙর ফেলেছিলো দুটো কালো জাহাজ। একটা থারটি এইট-গান ফ্রিগেট, নাম আরজেনটিনা। কমাণ্ডার ছিলেন একজন ফ্রেঞ্চ প্রাইভেটিয়ার, ক্যাপ্টেন হিপোলাইট ডা বুচার্ড। দ্বিতীয় জাহাজটা টোয়েন্টি সিক্স-গান, ওটার কমাণ্ডার একজন জলদস্যু, পেড্রো কনডে। তার প্রধান সহকারী ছিলো লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস। জাহাজের সেকেন্ড ইন কমাণ্ড।
জাহাজটায় দুশো পঁচাশি জন লোক ছিলো। আরজেনটিনার পতাকা। আঠারোশো আঠারো সালে স্পেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলো আরজেনটিনা। কুখ্যাত সব ডাকাতদের ভাড়া করেছিলো স্প্যানিশ জাহাজ আর শহর আক্রমণ করার জন্যে। কালিফোর্নিয়া তখন স্পেনের দখলে। আঠারোশো আঠারো সালের। একুশে নভেম্বর মনটিরে শহরের ওপর কামানের গোলা ফেলতে আরম্ভ করেছিলো জাহাজ দুটো। ওখানকার গভর্নর ছিলেন তখন সোলা।
বুম্মম্! করে কামান গর্জে উঠলো।
খাইছে! বলে লাফিয়ে একহাত শূন্যে উঠলো মুসা। তার পাশেই রয়েছে। কামানটা। একঝলক কালো ধোঁয়া বেরোলো ওটার মুখ দিয়ে। ছড়িয়ে পড়লো ডেকের ওপর। হাঁচি দিলো কয়েকজন, কাশতে লাগলো অনেকে।
কামানের গোলার জবাব এলো তীর থেকে, গল্পের খেই ধরলেন আবার ক্যাপ্টেন।
সত্যিই এলো জবাব।
কামানের গোলা ফাটলে আর পানিতে পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, তেমন। শব্দ হতে লাগলো লাউডস্পীকারে।
চারটে দ্বীপের প্রথমটার দিকে এগিয়ে চলেছে ব্র্যাক ভালচার। সরু পথ দিয়ে। দ্বীপগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা এবং মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দ্বীপটার পাশ দিয়ে জাহাজ যাওয়ার সময় ঝোঁপের ভেতর থেকে চারটে কার্ডবোর্ডের মূর্তি লাফিয়ে উঠলো। যান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থা রয়েছে ওগুলোকে ভোলা এবং নামানোর জন্যে। পুরনো কালের স্প্যানিশ সৈনিকের মূর্তি। ছোট একটা পুরনো কামান, চাকায় গড়িয়ে বেরিয়ে এলো পাথরের আড়াল থেকে। জাহাজ লক্ষ্য করে গোলা ফেললো।
চললো ভয়াবহ লড়াই! বললেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।
বুম করে ধোয়া উদগীরণ করলো আবার জাহাজের কামান। জবাব দিলো। তীরের কামানটা।
শীঘ্রি ডা বুচার্ডের সৈন্যরা তীরে নামলো, বলছেন ক্যাপ্টেন। হটিয়ে দিলো। গভর্নর সোলার সৈন্যদের।
ধীরে এগোচ্ছে ব্ল্যাক ভালচার। গলুইয়ের কাছ থেকে দড়িতে ঝুলে দ্বীপে। নামলো দুজন জলদস্যু, দাঁতে কামড়ে রেখেছে কাঠের ছুরি। ডাঙায় পা দিয়েই কোমর থেকে একটানে ভোজালি বের করে, গালি দিয়ে উঠে কার্ডবোর্ডের সৈন্যগুলোকে আক্রমণ করলো ওরা। ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল ওগুলো। দুজন। দস্যুই চেনা কিশোর আর মুসার। একজন সেই টিকেট বিক্রেতা, যার বয়েস। আন্দাজ করা যায় না, আরেকজন পিটার ফিলিপ।
কেন ব্যবসা করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন, মুসা বললো, বুঝতে পারছি।
আমিও পারছি, শুকনো গলায় বললো, কিশোর।
লাউডস্পীকারে গমগম করছে কণ্ঠ, মনটিরের সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দস্যুরা, শুধু মিশনারি আর কাস্টোম হাউসটা বাদে। তারপর জাহাজ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হলো ওরা। পৌঁছলো গিয়ে রিফোজিও কোভ আর ওরটেগা সিয়েনড়ায়। সমস্ত ধনরত্ন একটা ট্রাংকে ভরে রিফোজিও পাস দিয়ে পালালো ওরটেগারা, সান্তা। ইনেস মিশনে আশ্রয় নেয়ার জন্যে।
দ্বিতীয় দ্বীপটায় পৌঁছলো ব্ল্যাক ভালচার। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো দুজন। মানুষ, মাথায় কাউবয় হ্যাট, পরনে পুরনো ছাঁটের স্যুট। পিটার আর সেই টিকেট বিক্রেতা। প্রথম দ্বীপটা থেকে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে এখানে, পোশাক বদলে। নিয়েছে। স্প্যানিশ জমিদার সেজেছে ওরা এখন। ছোট একটা টিলার ওপর দিয়ে একটা ট্রাংক বয়ে নিয়ে চলেছে। লাউডস্পীকারে শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত অশ্বারোহী বাহিনী আর জলদস্যুদের চেঁচামেচি।
ঝাঁকে ঝাঁকে জলদস্যু গিয়ে নামলো তীরে, বললেন ক্যাপ্টেন। আগুন। লাগিয়ে দিলো পুরো ওটেগা হাসিয়েনড়ায়।
ঝোঁপের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলো, আবার জলদস্যুর পোশাক পরে বেরিয়ে এলো পিটার আর টিকেট বিক্রেতা। হাতে মশাল। আসল মশাল নয়, তৈরি করা। হয়েছে ঝাড়ুর ডাণ্ডায় লাল প্ল্যাস্টিকের গোলক বসিয়ে। গোলকের ভেতরে ব্যাটারির সাহায্যে ছোট বাল্ব জ্বলছে। একটা স্মোক বম্ব ফাটলো, ছড়িয়ে দিলো ঘন ধোয়া। কার্ডবোর্ড দিয়ে র্যাঞ্চ হাউস বানানো হয়েছে। দেয়ালে লাল রঙ করে বোঝাতে চাইছে, আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে সেই আগুনের চারপাশে নাচানাচি শুরু করলো দুই জলদস্যু।
উপকূল ধরে এগিয়ে চললো দুটো জাহাজ, বললেন ক্যাপ্টেন। পথে বাড়িঘর যা চোখে পড়লো, সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। পৌঁছলো। তৎকালীন বুয়েনাভিস্তা কোভে। এখানকার বড় বড় স্প্যানিশ জমিদারেরা শেষ। চেষ্টা করলো লস অ্যাঞ্জেলেস আর স্যান ডিয়েগোর শহরগুলোকে বাঁচানোর।
খাঁড়ির সব চেয়ে বড় দ্বীপটার দিকে এগোচ্ছে জাহাজ। কার্ডবোর্ডের অসংখ্য মূর্তি উঠে দাঁড়াচ্ছে ঝোঁপের ভেতর থেকে। রঙ দিয়ে পোশাক একে বোঝানো হয়েছে কোনটা কোন ধরনের মানুষ। কাঁচা হাতে রঙ করা হয়েছে। বেশির ভাগই রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মূর্তি ভেঙে গেছে কয়েক জায়গায়। প্রথমে পাহাড়ের। গোড়ায় দেখা দিলো একসারি মূর্তি, আরেক সারি মূর্তি লাফিয়ে উঠলো পানির কিনারে। লাউডস্পীকারে বাজতে লাগলো প্রচণ্ড লড়াইয়ের শব্দ-কামানের গর্জন, জলদস্যু আর স্প্যানিশ সৈন্যদের চিৎকার, তলোয়ারের ঝনঝন। এতো কিছু ঘটছে, কিন্তু দর্শকদের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে, যেন পুরো ব্যাপারটাই হাস্যকর আর একঘেয়ে লাগছে তাদের কাছে।
উত্তেজিত করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। প্রাণপণে যুদ্ধ করলো স্প্যানিশরা, কিন্তু জলদস্যুরাই জিতলো। এখন আমরা যে খাড়িটায় রয়েছি, এটারই নাম ছিলো তখন বুয়েনাভিস্তা কোভ। জলদস্যুরা জেতার পর থেকেই এর নাম হয়ে গেল পাইরেটস কোভ। ডা বুচার্ড আর তার সহযোগীরা ধ্বংস করে দিলো সমস্ত হাসিয়েনড়া, লুটপাট করলো ইচ্ছেমতো। রওনা হলো আরও দক্ষিণে। একের পর এক শহর ধ্বংস করে দিয়ে কেবল এগিয়েই গেল ওরা, ফিরলো না আর কোনোদিনই। তবে পাইরেটস কোভের নাম আর ধ্বংসস্তূপই শুধু ফেলে যায়নি, মূর্তিমান একটা মারণাস্ত্রও ফেলে গিয়েছিলো। তার নাম বেগুনী জলদস্য!
নাটকীয় ভঙ্গিতে শেষ দ্বীপটার দিকে হাত তুললেন ক্যাপ্টেন। সিমেন্টের একটা বেদির ওপর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি, হাতের ভোজালিটা কোপ মারার ভঙ্গিতে তুলে রেখেছে। মোটা, খাটো এক লোকের মূর্তি। হ্যাট থেকে শুরু করে পায়ের জুতো পর্যন্ত, সব কিছুর রঙ বেগুনী। ঢোলা বেগুনী আলখেল্লার কিনারে সোনালি কাজ করা। ঢোলা প্যান্টের রঙ বেগুনী। মুখের নাক-ঢাকা বেগুনী মুখোশের নিচে ইয়াবড় পাকানো গোঁফ। বিকট করে তুলেছে চেহারাটাকে। কোমরের বেগুনী বেল্টে ঝুলছে পুরনো ধাচের পিস্তলের খাপ। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুটের ভেতরে ঢোকানো বড় ছুরি।
লেফেটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস, বলে চলেছেন ক্যাপ্টেন, সান্তা রোসার। সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। ডা বুচার্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহ করেছিলো, খুন করেছিলো পেড্রো কোনডেকে। জাহাজে করে চলে এসেছিলো পাইরেটস কোভে। এখানে জলদস্যুদের একটা ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো সে, নিজের জাহাজ করেছিলো, নাম দিয়েছিলো ব্ল্যাক ভালচার। উপকূলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিলো। বহু বছর ধরে। সব সময় বেগুনী রঙের পোশাক পরে থাকতো সে, যাতে নাম হয়ে যায়। বিখ্যাত হতে পারেনি, সত্যি, তবে ভীষণ কুখ্যাত যে হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জলে, স্থলে, সবখানে ছিলো তার জয় জয়কার। তার বিরুদ্ধে পাঠানো কোনো সেনাবাহিনীই জিততে পারেনি বহু বছর ধরে। তবে মাঝে মাঝে কোণঠাসা যে হতো না, তা নয়। কোণঠাসা হলেই এসে ঢুকতো তার পাথরের দুর্গে। শক্তি সঞ্চয় করে আবার বেরোতো। পরাজিত করে ছাড়তো হামলাকারীদের। তবে একদিন তার দুর্গ বেগুনী জলদস্যুর আড়ায় ঢুকে আর বেরোলো না সে। সেটা আঠারোশো চল্লিশ সালে। বাইরের সৈন্যরা ভাবলো, আটকে ফেলেছে, এবার ধরতে পারবে। কিন্তু পারলো না। দুর্গের ভেতর থেকেই। গায়েব হয়ে গেল সে। তারপর আর কেউ কোনোদিন দেখেনি তাকে। তার বংশধররাই এখনও এই উপদ্বীপ আর টাওয়ারের মালিক।
ক্যাপ্টেনের কাহিনী শেষ হলো। মুখ ঘোরালো ব্ল্যাক ভালচার, দ্বীপগুলোর। পাশ দিয়ে ফিরে চললো। চার তলা পাথরের দুর্গটা দেখালেন ক্যাপ্টেন। নির্জন, শূন্য লাগছে বাড়িটা।
ফিরে এলো টিকেট বিক্রেতা আর পিটার। শশা শেষ হয়েছে। দর্শকদের মনে কোনোই দাগ কাটতে পারলো না জলদস্যুদের নাটক। শুধু বেগুনী জলদস্যুর কাহিনী যা-ও বা একটু কেটেছে, তা-ও নষ্ট করে দিলো এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের। একটা বিমানের গর্জন।
লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, ক্যাপ্টেন বললেন, আমাদের অভিযান শেষ। হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত বেগুনী জলদস্যুর ইতিহাস জানলেন আপনারা। ডকে ফিরে যাচ্ছি আমরা। খিদে পেলে খেতে পারেন ওখানে, ব্যবস্থা আছে। সুভনির কিনতে পারে। যতো সময় ইচ্ছে কাটাতে পারবেন ওখানে, কেউ মানা। করবে না। আবার যদি আসতে চান, তা-ও পারেন। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আবার শো শুরু হবে।
হেসে উঠলো কয়েকজন, কয়েকজন বিড়বিড় করলো। একটা ব্যাপার। পরিষ্কার হয়ে গেল, দ্বিতীয়বার আর এই ছেলেমানুষী দেখার ইচ্ছে কারো নেই। জাহাজ তীরে ভিড়তেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো সবাই। সুভনিরের দোকানের সামনে থামলো কয়েকজন। হংকং থেকে আমদানী করা প্ল্যাস্টিকের জাহাজের মডেল, ছুরি, খুদে ভোজালি আর আরও নানারকম জিনিস রয়েছে, জলদস্যুরা যেসব জিনিস ব্যবহার করতো, তার নকল। কেউই তেমন আগ্রহ দেখালো না ওগুলোর প্রতি। মারিয়া, সেই মেকসিকান মেয়েটা টিকেট বিক্রি বন্ধ রেখে এসে এখন খাবারের দোকান চালাচ্ছে। কয়েকটা ছেলে মা-বাবার কাছে বায়না ধরলো। কোক আর হটডগ কিনে দেয়ার জন্যে। কিশোর আর মুসা এসে দাঁড়ালো। ওখানটায়। ক্যাপ্টেন ফিলিপের আসার অপেক্ষায়। কিন্তু তিনি এলেন না। এমনকি তার ছেলে পিটারও না।
আসবে না, মুসা বললো।
তাই মনে হচ্ছে, একমত হলো কিশোর। কিন্তু অন্য সময় থাকে কোথায়? বাড়িটাড়ি নিশ্চয় আছে।
মিউজিয়মের পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলো ওরা। কোনো বাড়িঘর চোখে পড়লো না, শুধু ওক গাছের জটলার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের টাওয়ারটা। তবে খাবারের দোকান আর স্যুভনির স্ট্যাণ্ডের পেছনে বড় একটা হাউস ট্রেলার দেখতে পেলো ওরা। দ্রুত গিয়ে দাঁড়ালো ওটার কাছে। দরজায় লাগানো একটা মলাটের টুকরোর ওপর নাম লেখা রয়েছেঃ ক্যাপ্টেন রোজার ফিলিপ।
পাওয়ার আশা নেই, তবু এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো কিশোর। সাড়া মিললো না।
জাহাজ থেকেই নামেননি হয়তো, আন্দাজে বললো মুসা।
আমার তা মনে হয় না। হয়তো ভেতরেই আছেন। টোকা শুনতে পাননি।
ট্রেলারের সামনের দিকে জানালাগুলোয় ভারি পর্দা টানা। পেছনটা ফেরানো রয়েছে খাড়ির দিকে, লম্বা পিয়ার আর কারখানাটা রয়েছে যেদিকে। ওদিকের একটা জানালা খোলা দেখা গেল। উঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে দেখতে গেল। কিশোর।
কি-কি-কিশোর! তোতলাতে লাগলো মুসা।
ঝট করে মাথা ঘোরালো কিশোর। জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনী জলদস্যু। মুখে মুখোশ। হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠে ভোজালি উঁচিয়ে ছুটে এলো সে।
.
০৭.
ভোজালিটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো মুসা। কিশোর চুপ।
দিনে দুপুরে চুরি করতে এসেছো, না! চিৎকার করে বললো বেগুনী জলদস্যুরূপী টিকেট বিক্রেতা।
আ-আ-আমরা ক্যাপ্টেন ফিলিপকে খুঁজছিলাম, মুসা বললো। চো-চো
চুপ! আবার মিছে কথা! জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মানুষ খুঁজছিলে! দাঁতে দাঁত ঘষলো লোকটা। দিনেও আসে, রাতেও!
রাতে? কথাটা ধরলো কিশোর। প্রায়ই আসে নাকি?
আসে কিনা জানো না?
এই সময় ট্রেলারের কোণ ঘুরে বেরিয়ে এলো পিটার ফিলিপ। অবাক হয়ে তাকাতে লাগলো তিনজনের দিকে। কিশোর আর মুসাকে চিনতে পারলো। আরি, তোমরা?
তাড়াতাড়ি বললো মুসা, তোমার আব্বাকে খুঁজতে এসেছিলাম, পিটার।
ওদের চেনো? সন্দেহ যায়নি টিকেট বিক্রেতার।
চিনি, জেসন আংকেল। আমাদের ইস্কুলে পড়ে। ওটা নামান।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভোজালিটা খাপে ভরে রাখলো জেসন। মুখোশ খুললো। গত দুরাত ধরে চোরের আনাগোনা বড্ড বেড়েছে!
জেসন আংকেলেরও দোষ নেই, কৈফিয়তের সুরে বললো পিটার। সন্দেহ হবেই। ইদানীং বড় বেশি চোর আসে। …আংকেল, ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান। ওদেরকে বললো, ইনি আব্বার হেলপার; জেসন গিলবার্ট। ডাক। নাম নোনতা জেসন।
নোনতা? বিড়বিড় করলো কিশোর। তারমানে জাহাজে কাজ করেছেন? নাবিক ছিলেন?
নেভিতে বিশ বছর চাকরি করেছি, জেসন বললো।
পাইরেটস কোভে এই প্রথম এসেছি আমরা। ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিলো। মেজর নিরেকের কথা কিছু জিজ্ঞেস করতাম।
কফি মেশিনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, পিটার বললো। সেটা দেখছে আব্বা। এসো।
কফি স্ট্যাণ্ডেই পাওয়া গেল ক্যাপ্টেনকে। রেগে যাওয়া বেঁটে এক টুরিস্টকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
ঠকানো হয়েছে আমাদের! ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো লোকটা। পাইরেট শো না ছাই! টাকা ফেরত দিন!
আপনার ভালো লাগেনি, সেজন্যে আমরা দুঃখিত, স্যার, শান্ত কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়া যাবে না। সব জিনিসই সবার কাছে ভালো লাগবে, এমন কোনো কথা নেই। অমন যে বিখ্যাত ডিজনিল্যাণ্ড, সেটাও তো ভালো লাগে না অনেকের কাছে। তারা কি টাকা ফেরত পায়?
জ্বলে উঠলো লোকটার চোখ। ওরা আপনাদের মতো মিথ্যে কথা বলে না! আপনারা স্রেফ ঠকিয়েছেন। বেশ, দেখে নেবো আমি। বেটার বিজনেস বুরোতে নালিশ করবো!
কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা আর ছেলেকে ইশারায় সঙ্গে যেতে বলে পার্কিং লটের দিকে এগোলো সে। বেগুনী একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম। মুছলেন ফিলিপ। পিটারের দিকে চোখ পড়তে আফসোস করে বললেন, আর কদ্দিন এভাবে চলবে বুঝতে পারছি না! টাকাও পাচ্ছি না, ঠিকমতো চালাতেও পারছি না সব!
বন্ধই করে দিন, ক্যাপ্টেন, হাত নেড়ে হতাশ কণ্ঠে বললো নোনতা জেসন। হবে না যখন, হবেই না। খালি খালি কষ্ট করে, লোকের কথা শুনে লাভ আছে?
কথাটা পছন্দ হলো না পিটারের। কড়া চোখে একবার জেসনের দিকে তাকিয়ে বাবার দিকে ফিরলো। হবে। চেষ্টা করলেই হবে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ক্যাপ্টেন। হয়তো হবে। ঘন্টায় পঁচিশ ডলারে যদি গল্প জোগাড় করতে পারে মেজর, আর দিতে থাকে আমাদের, দর্শক ধরে রাখা হয়তো যাবে।
আমি জানি, আব্বা, মেজর পারবে।
স্যার, গলা পরিষ্কার করলো কিশোর। এই ব্যাপারেই আলোচনা করতে এসেছিলাম আমরা।
আলোচনা? কিশোর আর মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন। কে তোমরা?
আমাদের ইস্কুলেই পড়ে। পরিচয় করিয়ে দিলো পিটার। মেজর নিরেকের ব্যাপারে কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে।
কি কথা? ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন।
মেজর কি করছেন? বলে উঠলো মুসা।
তাকে সন্দেহ হয় আমাদের, বললো কিশোর।
সন্দেহ! কিশোরের কথার প্রতিধ্বনি করলেন যেন বেগুনী জলদস্যুর আড্ডার মালিক। মেজর নিরেককে সন্দেহ! আশ্চর্য! দিন দিন মানুষগুলো যে সব কি হয়ে যাচ্ছে! নিজের চরকায় তেল দেয়া যেন বন্ধ করে দিয়েছে সবাই!
.
মেজর নিরেক আর রিগোর বেরোনোর অপেক্ষায় রইলো রবিন। বেরোলো ওরা। ভ্যান নিয়ে রওনা হলো। পেছনে চিহ্ন দেখে দেখে অনুসরণ করলো সে।
পাইরেটস, কোভে চলে গেছে চিহ্নগুলো। পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়ে ঢুকেছে বেগুনী জলদস্যুর আড়ার ভেতরে। হাতে গোনা কয়েকটা গাড়ি দেখা গেল লটে। মাত্র দুজন দর্শক দাঁড়িয়ে রয়েছে আইস ক্রীম ভ্যানটার সামনে। ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে চিহ্ন। ঢুকে গেছে ছোট বনের ভেতরে। হ্যারিসনস ট্রী সার্ভিসের একজন শ্রমিক ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে একটা গাছের যেন কি করছে। এদিক ওদিক তাকালো রবিন। ভ্যানটাও চোখে পড়লো না, মেজর কিংবা রিগোকেও দেখলো না। একটা রাস্তা ধরে উত্তরে চলে গেছে চিহ্ন।
ভাবছে রবিন। আইস ক্রীম ভ্যান! ট্রী-সার্ভিস ট্রাক! এসব গাড়ি নিয়ে মেজরের চত্বরে ঢুকেছিলো দুজন ড্রাইভার, তারপর বেরিয়ে গেছে। ওরাই এসেছে এখানে,পাইরেটস কোভে চিহ্ন যখন রয়েছে, মেজরও এসেছেন। কেন? লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলে চলে গেছেন আবার?
সাইকেলটা ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে রেখে পা টিপে টিপে ট্রী-সার্ভিসট্রাকটার কাছে চলে এলো রবিন। লোকটাকে দেখলো ভালোমতো। চিনতে পারলো। টনি! কি মনে হতে ফিরে তাকালো আইস ক্রীম বিক্রেতার দিকে। চিনতে পারলো তাকেও। খাটো, মোটা, টাকমাথা লোকটা, যার নাকের নিচে বেমানান গোঁফ।
তার মানে ছদ্মবেশী ওরা সবাই! কেন এসেছে? নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর হআড়ার ওপর চোখ রাখতে। চব্বিশ ঘন্টাই চোখ রাখার ব্যবস্থা করেছে ওরা।
ট্রাকের পেছনে বসানো লম্বা লিফটটা তুলে নিলো টনি। ওপরে উঠে গেল। তারপর বিনকিউলার বের করে দেখতে লাগলো। কি দেখছে, বুঝতে পারলো না। রবিন। বেড়া আর গাছপালার জন্যে দেখতে পাচ্ছে না সে। দ্রুত মনস্থির করে নিলো। নিরেক আর রিগো কোথায় গেছে, পরেও দেখা যাবে। আপাতত টনি কি দেখছে সেটা জানা দরকার।
গাছপালার ভেতর দিয়ে সরে চলে এলো রবিন, আড্ডার উল্টোদিকে। ফিরে তাকালো। ডানে নজর লোকটার। কারো দিকে না তাকিয়ে হেঁটে চললো রবিন। আইস ক্রীম ওয়ালার পাশ কাটালো। টিকেট বুঁদ বন্ধ হয়ে গেছে, তবে গেট খোলা। ঢুকে পড়লো সে। হঠাৎ মোড় নিয়ে ঢুকে গেল ওকের জঙ্গলের মধ্যে, যেগুলোর অন্যপাশে রয়েছে পাথরের টাওয়ারটা।
টাওয়ারের কাছে এসে থামলো সে। চারতলা পুরনো বাড়ি। উপদ্বীপের উত্তরে, পানির ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের বেড়া দেয়া আছে, রাস্তা থেকে সরাসরি যাতে কেউ ঢুকতে না পারে এখানে। গাছপালার পরে, টাওয়ারের লাগোয়া আর কিছু নেই, শুধু লন, আর বালিতে ঢাকা চত্বর। পুরনো একটা বোটহাউস রয়েছে, ধসে পড়েছে এখন। কি দেখছে টনি? টাওয়ার? না ওই ভাঙা বোট-হাউস? বোট হাউসের ভেতরেই প্রথমে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো রবিন।
কালচে হয়ে গেছে বোটহাউসের তক্তাগুলো। ক্ষয়া। সামনের দিকে একটামাত্র জানালা। বড় দরজাটা বন্ধ। বাঁয়ে কাত হয়ে রয়েছে ঘরটা, বেশ কিছু তক্তা খসে গেছে। বেগুনী জলদস্যুর আমল থেকেই বোধহয় আছে ওটা ওখানে।
জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো সে। চোখে পড়লো শুধু কালো পানি। দরজায় ঠেলা দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো।
আচমকা শক্ত কি যেন লাগলো পিঠে। ঠেসে ধরা হয়েছে।
ঘোরো, খোকা, আদেশ দিলো একটা ভারি কণ্ঠ। খুব ধীরে।
ঘুরে দাঁড়ালো রবিন। চওড়া কাঁধ, মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে শাদা ট্রাউজার, পায়ে দড়ির স্যাণ্ডাল, গায়ে নীল টি-শার্ট। হাতের। পিস্তলটা ধরে রেখেছে রবিনের পেট বরাবর।
.
০৮.
ক্যাপ্টেন ফিলিপ এভাবে নিরাশ করবেন, ভাবেনি কিশোর আর মুসা। যাওয়ার জন্যে ঘুরলো।
পিটার বলে উঠলো, আব্বা, ওদেরকে আমি চিনি। কি বলতে এসেছে, অন্তত শোনো তো?
আরে দূর! কি আবার বলবে? গোলমাল পাকাতে এসেছে, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো যেন নোনতা জেসন। যাক, বেরিয়ে যাক।
অতোটা রুক্ষ ব্যবহার করলেন না ক্যাপ্টেন। আমার কাজ আছে। ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। জেসন, টিকেট বুদে যাও। এই, তোমরা এসো আমার সঙ্গে।
দুই গোয়েন্দাকে ট্রেলারে নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। কাউচ দেখিয়ে ওদেরকে বসার ইঙ্গিত করলেন। পিটার বসলো একটা চেয়ারের হাতলে।
বলে ফেলো, ফিলিপ বললেন।
দুদিন আগের সাক্ষাৎকারের কথা সংক্ষেপে বললো কিশোর। কি করে ঠকিয়েছেন মেজর, সে কথাও জানালো।
ঠকালো কোথায়? প্রশ্ন তুললেন ক্যাপ্টেন। গল্প পছন্দ হয়নি, টাকা দেয়নি, ব্যস। মুছে ফেলেছে। পছন্দ না হলে টাকা কেন দেবে?
বিজ্ঞাপনে তো সেকথা বলেনি, মুসা বললো। বলেছে, যে-ই গল্প শোনাবে, তাকেই দেবে।
এটা হতে পারে না। যে যা খুশি শুনিয়ে আসবে, তার জন্যেই টাকা দিতে হবে নাকি? বিজ্ঞাপনটা লেখা হয়নি ঠিকমতো।
বেশ, ধরে নিলাম লেখা হয়নি। কিন্তু গল্প পুরোটা না শুনেই কি করে বুঝলেন। উনি, ভালো না মন্দ? শুরু করতে না করতেই তো থামিয়ে দিয়েছেন অনেককে। কিশোর বললো।
যে বোঝার সে অল্প শুনেই বুঝতে পারে। তাছাড়া পয়লা দিন অনেক বেশি লোক চলে এসেছিলো। কি করে শুনবে এতো লোকের গল্প? বরং বুদ্ধিটা ভালোই। বের করেছিলো, শহরের বাইরে থেকে যারা এসেছিলো তাদের গল্প শুনবে।
তাহলে ওকথাও বিজ্ঞাপনে লিখে দিতে পারতো, পিটার বললো। শহরের ভেতরের কারো গল্প যদি না-ই শুনবে তাহলে ঢালাও ঘোষণা দেয়া কেন? অবিচার করা হলো না? ডেকে এনে ফিরিয়ে দেয়া? আমি হলে সোজা গিয়ে পুলিশকে রিপোর্ট করে দিতাম। ..
ছেলের কথার জবাব দিতে পারলেন না ক্যাপ্টেন। দ্বিধা করলেন। ইয়ে…
চাপটা বাড়ালো কিশোর, লোকের বাড়ি বাড়ি সার্কুলার দিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো? সাক্ষাঙ্কারই যদি না নেবে, কেন এই অহেতুক হয়রানী?
তা ঠিক, গাল চুলকালেন ক্যাপ্টেন। তবে মনে হয় আমার আর পিটারের গল্পই শুধু শুনতে চেয়েছে।
তাহলে শুধু আপনাকে ডেকে নিয়ে গেলেই পারতেন। আর তা-ই বা কি করে বলবেন? আপনার বলে আসা গল্পও তো মুছে ফেলেছেন মেজর।
আমারটাও মুছেছেন!
নিজের চোখে দেখেছি! জোর পেয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
অসম্ভব! তোমরা কি জন্যে এসেছো…
আব্বা, বাধা দিয়ে বললো পিটার, ঘাপলা একটা আছে। মুসা আর কিশোর– খুব ভালো গোয়েন্দা। আমার মনে হয় না ওরা ভুল করছে।
ডিটেকটিভ? এই বয়েসে অনেক ছেলেই গোয়েন্দা সাজতে চায়। এক ধরনের খেলা।
মোটেও খেলা নয়, স্যার। গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। পকেট থেকে প্রথমে তিন গোয়েন্দার কার্ড, তারপর পুলিস ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসাপত্র বের করে দিলো।
পড়লেন ফিলিপ। মাথা দোলালেন। হু, পুলিসের একজন চীফ ফালতু কথা বলবেন না। তোমাদের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা তার। কিন্তু কিশোর, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আমার বিশ্বাস, মেজরের ব্যাপারেও তোমরা ভুল করছে।
আগে বলো তাহলে, চেপে ধরলো পিটার, তোমার গল্প মুছলো কেন?
হতে পারে, টেকনিক্যাল কোনো কারণ ছিলো। কিংবা পরে বিশেষ টেপে। রেকর্ড করার কথা ভেবেছিলো। দুদিন ধরেই তো আমাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। ওগুলো নিশ্চয় মুছছে না।
জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, স্যার, পরামর্শ দিলো কিশোর।
ভ্রূকুটি করলেন ক্যাপ্টেন। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বক্তব্যটা কি, বলে ফেলো তো?
আমার ধারণা, পুরো ঘটনাটাই ঘটিয়েছেন মেজর, আপনাকে আর পিটারকে হাতে পাওয়ার জন্যে।
কিন্তু আগে কখনও পরিচয় ছিলো না মেজরের সঙ্গে! কখনও তার নামও শুনিনি। আমাদের কাছে কি চায়? টাকা নেই, পয়সা নেই, কিচ্ছু নেই আমাদের। এই শো বিজনেস চালিয়ে কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে আছি। তা-ও যায় যায় অবস্থা।
কিন্তু বিরাট এলাকা আপনার, মুসা বললো। অনেক জমি। হয়তো ওগুলো চায়?
আমার জমি নয় এটা, মুসা। ইভান পরিবারের কাছ থেকে লীজ নিয়েছি।
ইভান পরিবার? চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। হ্যাঁ। পুরনো সেই জলদস্যুর বংশধর। এই কোভের মালিক এখনও ওরাই।
আপনি না বললেন ইভান গায়েব হয়ে গেছে? মুসার প্রশ্ন।
হাসলেন ক্যাপ্টেন। গিয়েছিলো। তারপর আবার ফিরে এসেছে। নতুন বেশে। তবে সেকথা বলি না শো-এর সময়। অযথা নাটকটা নষ্ট করে লাভ কি? স্রেফ গায়েব হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার থাকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করলো, রাতে নাকি এখানে চোর আসে?
চোর কিনা বলতে পারবো না। রাতে ঘুরতেও বেরোয় অনেক মানুষ, নির্জন। জায়গা দেখলে বেড়াতে চলে আসে। তাছাড়া কাছে দিয়েই গেছে রেললাইন। কাজেই দুচারটে ভবঘুরে যে নেমে না পড়ে তা নয়। আমাদের বড়িঘরগুলোকে ঘুমানোর জায়গা হিসেবে বেছে নেয়। কিশোরের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। দেখো, মেজরের ব্যাপারে ভুল করছো তোমরা। এমন কিছু নেই আমাদের কাছে, যার জন্যে আমরা তার কাছে দামী হয়ে যাবো।
আব্বা, শেষ চেষ্টা করলো পিটার, কিছু না হোক, তিন গোয়েন্দাকে কাজ করতে দিতে অসুবিধে কি আমাদের? কিছু বেরিয়েও তো যেতে পারে?
না, দরকার নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। অযথা ভালো মানুষকে হয়রানী করা আমার পছন্দ নয়। তাছাড়া ভালো টাকা দিচ্ছে আমাদেরকে মেজর। এক ঘন্টা গল্প বলার জন্যে কে পঁচিশ ডলার করে দেবে? আমি সেটা হারাতে চাই না। তোমরা ওকে খোঁচাতে যাবে না, ঠিক আছে?
কিশোর কিংবা মুসা জবাব দেয়ার আগেই বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল, ফিলিপ! দরজা খুলুন! বলেছিলাম না, চোর আসে!
.
০৯.
ভিকটর ইভানস! উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন ক্যাপ্টেন।
নীল টি-শার্ট পরা মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ ট্রেলারে ঢুকলো। মুখ রাগে। লাল। এই ফিলিপ, বলেছিলাম না খেয়াল রাখতে? টাওয়ারে লোক যায় কেন? একটা ছেলে বোটহাউসে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, বললো গোয়েন্দা। ইহ! আপনার কাজ নাকি করছে।
রবিন! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো কিশোর আর মুসা।
কী? দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ভিকটর। এই ছেলে, এসো, ঢোকো। রবিন ট্রেলারে ঢুকলে তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটাকে চেনো, ফিলিপ? চোর-টোর না তো?
না! গরম হয়ে বললো মুসা। চোর আমরা কেউই নই।
চোখ পাকিয়ে মুসার দিকে তাকালো আগন্তুক। তোমার সঙ্গে কথা বলে কে? ফিলিপ, এটাকে ওরা চেনে কি করে?
সরি, ভিকটর, ক্যাপ্টেন বললেন, আপনাকে বিরক্ত করেছে। ওদের হয়ে আমি মাপ চাইছি। ওরা পিটারের বন্ধু। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে…।
তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর কাহিনী শুনতে, স্যার। ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখবো। ওর নাম রবিন, গবেষণার কাজগুলো সে-ই করে। তিনজনে একসাথে কাজ করি আমরা। জায়গাটা ভালোমতো দেখতে গিয়েছিলো, বর্ণনা দেয়ার জন্যে। আপনাকে বিরক্ত করার, কিংবা আপনার জায়গার ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। টাওয়ারে তাহলে আপনিই থাকেন। ভিকটর ইভানস, তার মানে কি বেগুনী জলদস্যু উইলিয়াম ইভানসের বংশধর আপনি?
মোরগের মতো ঘাড় কাত করে কিশোরের দিকে তাকালো ভিকটর। খুব। চালাক মনে হচ্ছে? ম্যাগাজিনে লেখ বা জাহান্নামে লেখ, সেটা তোমাদের ব্যাপার। খবরদার, আমার এলাকার ধারেকাছে আসবে না! ওকের সারিটার দিকে আর যাবে না, মনে থাকে যেন। ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে বললো, এবার ছেড়ে দিলাম। আপনাকেও বলে দিচ্ছি, টুরিস্ট হোক আর যে-ই হোক, আমার সীমানায় যেন না ঢোকে।
ঢুকবে না, কথা দিলেন ফিলিপ।
না ঢুকলেই ভালো। বেরিয়ে গেল ভিকটর। দড়াম করে লাগিয়ে দিয়ে গেল ট্রেলারের দরজা।
লোকটা বেরিয়ে যেতেই কিশোরের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। আসল কথা ভিকটরকে বললে না কেন?
কথা গোপন রাখতে হয় গোয়েন্দাদের। যাকেতাকে সব বলে দেয়া উচিত না। মিস্টার ইভানসকে চিনি না, কি কাজ করে তা-ও জানি না। অচেনা একজন মানুষকে পেটের কথা কেন বলবো?
তা বটে, আনমনে ঘাড় দোলালেন ক্যাপ্টেন।
চোরের ওপর খুব রেগে আছে মনে হয়?
চোরকে কে পছন্দ করে? তাছাড়া বিনা অনুমতিতে কেউ ওর এলাকায় ঢুকলে রাগ তো করবেই।
আচ্ছা, মুসা বললো, জলদস্যু আবার সম্পত্তির মালিক হয় কি করে? সেটা। আবার বংশধরদের জন্যে রেখেও যায়? মানে, নিজেই তো একটা অপরাধী। রাষ্ট্র। কি স্বীকৃতি দেয়?
ক্যাপ্টেন হাসলেন। উইলিয়াম ইভানস খুব চালাক মানুষ ছিলো, মুসা। শুনেছো, কখনও ধরা পড়েনি সে। ১৮৪০ সালের সেই দিনে টাওয়ার থেকে গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের রেখে যায়। আঠারোশো আটচল্লিশ সালে আবার এসে হাজির হয় একদিন, আমেরিকান সৈনিকের বেশে, মেকসিকানদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে তখন। আমেরিকা জিতলো, ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে গেল। ইউনাইটেড স্টেটসের অংশ। যুদ্ধে জেতার পুরস্কার হিসেবে আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে তার জায়গা ফেরত পায় ইভানস। কারণ, কেউ প্রমাণ। করতে পারেনি যে সে-ই বেগুনী জলদস্যু। তখন আঙুলের ছাপ দেখে অপরাধী। ধরার উপায় জানা ছিলো না কারো। বেগুনী জলদস্যু কখনও ধরাও পড়েনি কারো। হাতে। তার কোনো ছবি ছিলো না, যা দেখে বলবে বেগুনী জলদস্যু আর উইলিয়াম ইভানস একই লোক। কাজেই সৈনিক হিসেবে জায়গাটা সরকারের কাছ থেকে নিতে কোনো অসুবিধে হলো না তার। তার পর অনেক বছর গেল। তার বংশধরেরা জায়গা বিক্রি করে করে ছোট করে ফেললো। বাকি রইলো শুধু ওই টাওয়ার আর উপদ্বীপটা। ভিকটরও কোথায় চলে গিয়েছিলো। বহু বছর পরে আবার ফিরে এসেছে।
কতো দিন আগে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
এই বছর খানেক।
এতো দিন! হতাশই মনে হলো কিশোরকে।
ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। এহূহে, পরের শো-এর সময় হয়ে গেছে।
তুমি যাও, আব্বা, আমি আসছি। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে বেরোলো পিটার। বাইরে উজ্জ্বল রোদ, লুকোচুরি খেলছে যেন গাছপালার ফাঁকে। গেটের বাইরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন দর্শক।
সত্যি কি মেজর আমাদের সঙ্গে ফাঁকিবাজি করছে? পিটারের প্রশ্ন।
করছে, জবাব দিলো কিশোর। তাতে কোনো সন্দেহ নেই আমার।
যা দেখলাম আজ, রবিন বললো কিশোরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, তাতে সন্দেহ আমারও নেই।
ছদ্মবেশে এসে টনি আর আইসক্রীমওয়ালাকে কি করতে দেখেছে, খুলে বললো সে। আলুর বস্তা, ব্যাটারি আর মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতিগুলোর কথাও বললো।
শুনে পিটার বললো, চলো, আব্বাকে গিয়ে সব বলি!
মাথা নাড়লো কিশোর। লাভ হবে না এখন বলে। আমাদের কথা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। আরও জোরালো প্রমাণ জোগাড় করতে হবে আমাদের। জানার চেষ্টা করবো, মেজর আর তার চেলারা কিসের পেছনে লেগেছে। রবিন, বেগুনী জলদস্যুর কথা লোকাল হিস্টরি কি বলে, জানার চেষ্টা করো। মুসা, তুমি পাইরেটস কোভের ইতিহাস জানবে। আর আমি জানবো, ক্যাপ্টেন ফিলিপের অতীত কি বলে। পিটার, তুমি কি চাও এই রহস্যের সমাধান হোক?
নিশ্চয়ই চাই, আগ্রহের সঙ্গে বললো পিটার। আমাকে কি করতে হবে?
মাথা খাটাবে। তোমার বাবার অতীত জানার চেষ্টা করবে। মেজর নিরেক তার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন, বোঝা দরকার। তোমাদের শেষ শশা তো। চারটেয়। আমাদের স্যালভিজ ইয়ার্ডে কখন দেখা করতে পারবে?
সাড়ে পাঁচটায়?
গুড। তোমরা?
আমি পারবো, জবাব দিলো রবিন।
আমিও, বললো মুসা।
বেশ, কাজে নেমে পড়া যাক তাহলে। সাড়ে পাঁচটায় হেডকোয়ার্টারে দেখা করবো আমরা। আলোচনা করবো, এর পর কি করা যায়।
.
১০.
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকলো পিটার। জঞ্জালের স্কুপের কাছে দাঁড়িয়ে তাকালো এদিক ওদিক। তিন গোয়েন্দার ছায়াও চোখে পড়লো না।
এই ছেলে, কি চাও? কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন হলো।
চমকে ফিরে তাকালো পিটার। একজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তার পেছনে।
আমি…আমি কিশোর, রবিন আর মুসাকে…
ও। আমি কিশোরের মা, মারিয়া পাশা। বাইরের লোকের কাছে নিজেকে কিশোরের মা বলে পরিচয় দেন মেরিচাচী। ওদেরকে খুঁজছো? হেসে হাত নাড়লেন তিনি। গায়েব। সারাটা দিন দেখা নেই। খানিক আগে যা-ও বা ছায়াটা। দেখলাম, তারপরেই দেখি আবার গায়েব।
এখানে আছে?
ছিলো, পাঁচ মিনিট আগেও। জ্যান্ত রাডার একেকটা!.. আমি জানার আগেই কি করে জানি জেনে যায় কাজের জন্যে ডাকবো ওদের। নিজেদের ইচ্ছে হলে আমাকে কিছু বলতে হয় না, অসম্ভব খাটে। কিন্তু ইচ্ছে না। হলে.. বাক্যটা শেষ না করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন মেরিচাচী, ওরা কি করে। গত কদিন ধরে ভালোই ছিলো, কাজটাজ ঠিকমতো করছিলো। আজকেই বদলে গেছে। নিশ্চয় নতুন কেস পেয়েছে। তা কি নাম তোমার?
পিটার ফিলিপ।
ও। তো পিটার, তুমি বরং আজ চলেই যাও। আরেকদিন এসো। ওরা আজ আর বেরোবে বলে মনে হয় না। জমানো কাজ যতোক্ষণ না অন্যকে দিয়ে শেষ। করাচ্ছি, ওরা আর বেরোচ্ছে না…
কিন্তু আমাকে তো আসতে বলে দিয়েছে। আরেকটু থাকি?
থাকতে পারো। তোমার ইচ্ছে। ওই যে, ওটা কিশোরের ওয়ার্কশপ। ওখানে বেঞ্চ আছে, গিয়ে বসো। তবে ওদেরকে আজ আর পাবে বলে মনে হয় না। হেসে, ইয়ার্ডের অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন মেরিচাচী।
সব চেয়ে বড় জঞ্জালের স্তূপটার পাশে ওয়ার্কশপ, সহজেই খুঁজে পেলো। পিটার। সাইকেলটা বাইরে রেখে ঢুকলো ভেতরে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কানে এলো ডাক। ফিসফিসিয়ে ডাকলো তার নাম ধরে কেউ, পিটার!
কেমন যেন ফাঁপা শোনালো ডাকটা। ভীষণ চমকে গেল পিটার। চারপাশে। তাকিয়ে কিছুই চোখে পড়লো না।
আরে ওখানে না, এখানে!
পিটারের মনে হলো, বিশাল জঞ্জালের স্তূপের ভেতর থেকেই আসছে কথা।
মু-মু-মুসা! তোতলাতে শুরু করলো পিটার। কি-কি-কি-কিশোর!
শশশ! আবার শোনা গেল ফিসফিসানি। আস্তে বলো! মেরিচাচী শুনলেই ধরে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবে! কেসফেস সব শেষ হয়ে যাবে। তাহলে।
চারদিকে তাকালে আবার পিটার, ওপরে তাকালো, নিচে তাকালো। কাউকেই চোখে পড়লো না। বেগুনী জলদস্যু
হেসে উঠলো অদৃশ্য কণ্ঠটা। বাইরে গিয়ে দেখে এসো, মেরিচাচী আছে। কিনা। তারপর ঢুকে পড়ো এই পাইপটায়! জলদি করো!
মোটা পাইপটার দিকে তাকালো পিটার। জঞ্জালের নিচে হারিয়ে গেছে ওটা, শুধু মুখ বেরিয়ে রয়েছে। চট করে গিয়ে দেখে এলো কেউ আছে কিনা। তারপর হাত-পায়ের ওপর ভর দিয়ে উবু হয়ে উঁকি দিলো পাইপের ভেতরে। আবছা আলোয় দেখলো মুসার মুখ। উপুড় হয়ে পাইপের ভেতরে শুয়ে আছে সে। চোখাচোখি হতেই হাসলো।
এটার নাম দুই সুড়ঙ্গ, বললো মুসা। হেড-কোয়ার্টারে ঢোকার আরও পথ আছে। তবে এটাই বেশি ব্যবহার করি আমরা।
হেডকোয়ার্টার! ওই মালপত্রের তলায় বসে কথা বলো তোমরা?
বলি, হাসলো আবার মুসা। এসো।
ঢুকে পড়লো পিটার। মুসার পিছে পিছে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। মাথার ওপর দেখা গেল একটা চারকোণা ফোকর, আলো আসছে ওপথে। ওটা। ট্র্যাপোের, পরে বুঝলো সে। ওই পথে ঢুকলো একটা ঘরের মধ্যে। চেয়ার, টেবিল, ফাইলিং কেবিনেট আর আরও নানারকম জিনিস আর যন্ত্রপাতি রয়েছে ওই ঘরে। এমনকি একটা স্টাফ করা কাক পর্যন্ত সাজানো রয়েছে বুককেসের ওপর। তার দিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর আর রবিন।
আশ্চর্য! অবাক হয়ে দেখছে পিটার। এ-তো দেখি ঘর! আমি ভেবেছিলাম। জঞ্জালের তলায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়েছো বুঝি।
এটা একটা ট্রেলার। তোমাদেরটার মতোই, রবিন বললো। তবে ছোট।
আমরা এখানে থাকলে বাইরে কেউ দেখতে পায় না, মুসা বললো। কিন্তু আমরা দেখি, এই পেরিস্কোপটা দিয়ে। এটার নাম দিয়েছি আমরা সর্ব-দর্শন, বাংলা। নাম।
এখানে ঢুকে বসে থাকলে, কিশোর বললো, কারো পক্ষে খুঁজে বের করাও কঠিন।
এমনকি মেরিচাচীর কাছ থেকেও নিরাপদ, হেসে বললো মুসা। যেই দেখি। বেশি কাজ, পালিয়ে আসি এখানে। হাহ্ হাহ!
তার সঙ্গে যোগ দিয়ে সবাই হাসলো। একটা চেয়ার দেখিয়ে পিটারকে বসতে ইশারা করলো কিশোর। বললো, তারপর, পিটার, তোমার বাবার অতীত কিছু জানতে পারলে?
কিছু না। সারাটা বিকেল ভেবেছি। যতোদূর মনে পড়ে আমার, রকি বীচেই বাস করছি। কখনও কোনো গোলমালে জড়ায়নি আব্বা, অপরাধ করেনি। আগে। আমার আম্মাকে নিয়ে স্যান ফ্রানসিসকোয় থাকতো আব্বা, যখন নেভিতে চাকরি করতো। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে এখানে চলে এলো, তখনও আমি কিছু বুঝি না। একটা মাছধরা জাহাজ কিছুদিন ভাড়া নিয়েছে আব্বা। তারপর ইভানসদের জায়গাটা লীজ নিয়ে এই বেগুনী জলদস্যুর ব্যবসা খুলেছে।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। হ্যাঁ, ঠিক এসবই জেনেছি আমিও তোমার আব্বার সম্পর্কে। অস্বাভাবিক কিছুই নেই। রবিন, বেগুনী জলদস্যুর কথা তুমি কি জানলে?
বেশি কিছু না। প্রায় সবই তো তোমরা জেনেছো ক্যাপ্টেন ফিলিপের কাছে, শো-এর সময়। স্প্যানিশরা শিওর, উইলিয়াম ইভানসই বেগুনী জলদস্য, কিন্তু কোনোদিন প্রমাণ করতে পারেনি সেটা। কয়েকবার তার টাওয়ারে তাকে আটক করেছে, কিন্তু ধরতে পারেনি। চেহারাও দেখেনি। শেষ বার আটকানোর পর সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেল, ফিরে এলো একজন সম্মানিত আমেরিকান নাগরিক হয়ে।
মুসা বললো, পাইরেটস কোভের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি আমি। অনেক আর্টিক্যাল লেখা হয়েছে জায়গাটাকে নিয়ে, গোটা দুই আস্ত বইও আছে। বেগুনী। জলদস্যু ছাড়াও আরও অনেকে জায়গাটাকে তাদের আস্তানা বানিয়েছিলো বিভিন্ন সময়। সবাই ওরা অপরাধী। চোরাচালানী, চোর-ডাকাত, খুনী, এসব ধরনের লোক। যো রকমের অন্যায় কাজ হতে পারে, সব ঘটেছে ওখানে। তবে ফিলিপ কিংবা নিরেক নামের কেউ, এমনকি শুধু উইলিয়াম ইভানস ছাড়া ইভানস নামের আর কোনো অপরাধীও ছিলো না কখনো ওখানে।
ভ্রূকুটি করলো কিশোর। হু। বিশেষ কিছু জানা গেল না। সূত্র বলতে একটাই দেখতে পাচ্ছি, বেগুনী জলদস্যু। বুঝতে পারছি, মেজর নিরেক আর তাঁর চেলারা গিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছে কোনো কারণে। কিন্তু আঁড়ার ওপর কেন চোখ। রেখেছে বোঝা যাচ্ছে না। পিটারের আব্বার সঙ্গেই বা কেন দীর্ঘ সাক্ষাত্তারের ব্যবস্থা করেছে, সেটাও দুর্বোধ্য।
গুপ্তধন লুকানো নেই তো? মুসার প্রশ্ন। জলদস্যুদের গুপ্তধন? ক্যাপ্টেন। ফিলিপকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সরিয়ে রেখে হয়তো সেসব খুঁজছে ওরা।
যাতে নিরাপদে নিয়ে পালাতে পারে, মুসার কথার পিঠে বললো রবিন।
কথাটা ভেবে দেখলো কিশোর। অসম্ভব নয়। ক্যাপ্টেনের গল্প শোনার আরও কারণ থাকতে পারে। মেজর হয়তো ভেবেছেন, এমন কিছু জানেন ফিলিপ, যেটা জানা থাকলে ধনরত্ব খুঁজে বের করতে সুবিধে হবে।
তাহলে আব্বা খুঁজছে না কেন? পিটার প্রশ্ন তুললো।
হয়তো তিনি জানেনই না গুপ্তধনের কথা। কিন্তু মেজর জানেন। তোমার। আব্বার গল্প শুনে আন্দাজ করতে পারবেন হয়তো, কোথায় রয়েছে ওগুলো। হয়তো সূত্র পাবেন। কারণ বেগুনী জলদস্যুর সম্পর্কে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জানেন তোমার আব্বা।
তাহলে হয়তো ইতিমধ্যেই মেজর সব জেনে ফেলেছে।
মনে হয় না। তাহলে ওই সাক্ষাৎকার বন্ধ হয়ে যেতো, এখনও চলতো না। আড্ডার ওপর ওভাবে চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখারও ব্যবস্থা করতো না। জাস্ট তুলে নিয়ে চলে যেতো। সাক্ষাৎকারে কি কি বলেছেন ক্যাপ্টেন, সব আমাদের জানা দরকার।
পিটার বললো, আমি সাহায্য করতে পারি। ছোট একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে যেতে পারি সঙ্গে করে, আব্বা যা যা বলে তুলে আনতে পারি।
হ্যাঁ, তা পারো, পিটারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কাল রাতেও তোমার আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলে। সব সময়ই যাও।
হ্যাঁ, যাই, কিশোরের কথায় অবাক হয়েছে পিটার। মেজরই যেতে বলে আমাকে। প্রায় জোরই করে। বলে, বছরের পর বছর আমাকে জলদস্যুদের গল্প শুনিয়েছে আমার আব্বা, অনেক কিছুই মনে আছে। এমন কিছু হয়তো বলে ফেলতে পারবো, যা আব্বা ভুলে বলেনি। মনে করিয়ে দিতে পারবো।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের চোখ। সন্ধ্যায় যখন সাক্ষাৎকার দিতে যাও, তখন। কি মেজর থাকেন?
মাথা নাড়লো পিটার। কখনও না। অন্য লোক থাকে। কথা রেকর্ড করে নেয়।
নোনতা জেসন কোথায় থাকে ওই সময়টায়?
রকি বীচে ঘর ভাড়া নিয়েছে। রাতে ওখানেই থাকে।
তুমি আর তোমার আব্বা ছাড়া আর কেউ থাকে আড্ডায়?
না। শুধু ভিকটর ইভানস।
আরেকটা কথা। কতোক্ষণ ধরে সাক্ষাঙ্কার চলে?
নটা থেকে এগারোটা।
ঠিক আছে। আজ রাতেও তো সাক্ষাৎকার দিতে যাবে। ঘরের এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দেবে। যাতে লোকটা বুঝতে না পারে। আর একটা জানালা খুলে ফাঁক করে রাখবে। কি কি কথা হয়, শুনতে চাই।
চোখে বিস্ময় নিয়ে তিনজনেই তাকিয়ে রইলো গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে।
রহস্যটা বোধহয় আন্দাজ করে ফেলেছি, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার কিশোর। আশা করছি, আজ রাতেই সমাধান হয়ে যাবে।
১১.
সন্ধ্যা আটটায় আবার হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।
কি করতে হবে বললো কিশোর। বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে যাবে। পিটার। আমি যাবো ওখানে, ওদের কথা শুনতে। মুসা, তুমি গিয়ে আড্ডার ওপর নজর রাখবে। আমাদের নতুন ওয়াকি-টকির রেঞ্জ তিন মাইল। কিন্তু ডি লা ভিনা থেকে পাইরেটস কোভ পাঁচ মাইল। কাজেই মাঝামাঝি জায়গায় একজনকে থাকতে হবে। রবিন থাকবে। মুসার মেসেজ আমাকে দেবে, আমার মেসেজ মুসাকে। ঠিক আছে?
মাথা ঝাঁকালে দুই সহকারী গোয়েন্দা।
বেরিয়ে এলো ওরা। সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল যার যার জায়গার দিকে।
.
পাইরেটস কোভের পথে যখন নামলো মুসা, অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। সাইকেলের আলো জ্বেলে দিলো। আড্ডার গেটের কাছে এসে থামলো। আলো নিভিয়ে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ, চোখে অন্ধকার সইয়ে নেয়ার জন্যে।
আগের জায়গায়ই ট্রী-সার্ভিস ট্রাকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। সিগারেটের আগুন দেখেই বুঝতে পারলো, ড্রাইভিং সীটে বসে আছে কেউ। নিশ্চয়। নজর রাখছে।
ওয়াকি-টকি বের করলো মুসা। বললো, রবিন, কিশোরকে বলল, মেজরের ন্টসহকারী টনি এখনও চোখ রাখছে আড়ার ওপর।
প্রায় মাইল তিনেক দূরে, হাইওয়ের পাশে একটা ছোট টিলার ওপরে বসে আছে। রবিন। ওয়াকি-টকিটা মুখের কাছে তুলে আনলো। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে। বললো, কিশোর, মুসা জানিয়েছে, এখনও আড়ার ওপর চোখ রাখছে টনি।
ওর কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে, দোকানের জানালার নিচে একটা ঝোঁপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কিশোর। মেসেজের জবাব দিলো, মেজর নিরেক, রিগো, আর টাকমাথা লোকটা এখনও বসে আছে এখানে। কিছুই করছে না। মুসাকে বলো, কড়া নজর রাখতে। খুব সাবধান যেন থাকে।
হুঁশিয়ারির প্রয়োজন ছিলো না। মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে রয়েছে টনি। এই অবস্থায় সাবধান থাকতেই হবে, তা-ই রয়েছে মুসা। লুকিয়ে আছে গাছের ছায়ায়। এমন একটা জায়গায় গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে, যেখান থেকে পার্কিং লট, গেট, টাওয়ারের ওপরের দুটো তলা আরট্রী-সার্ভিসট্রাকটা দেখা যায়।
আড্ডায় ঢোকার মুখে একটা খুঁটিতে আলো জ্বলছে। এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো। গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে থামলো একটা ভ্যান। দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো পিটার। গেটটা লাগিয়ে দিয়ে এসে আবার গাড়িতে উঠলো।
চলে গেল ভ্যানটা। আবার ট্রাকের দিকে তাকালো মুসা। নড়লো না ওটা। বেগুনী জলদস্যু তেমনি ভাবে বসে বসে সিগারেট টানছে টনি।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার মেসেজ পাঠালো মুসা, ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটার বেরিয়ে গেছে। টনি আগের মতোই বসে আছে। নজর রাখছে।
মেসেজটা কিশোরের কাছে পাচার করলো রবিন। পথের দিকে চোখ। কয়েক মিনিট পরেই দেখতে পেলো, তার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে পিটারদের ভ্যানটা।
মেসেজ শুনলো কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে ঘরের দিকে। রবিনের কথা শেষ হতে না হতেই ঘড়ি দেখলেন মেজর। উঠে রওনা হলেন দরজার দিকে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিশালদেহী রিগো। লাফিয়ে লাফিয়ে চললো মেজরের পেছনে। একভাবে বসে রইলো টাকমাথা লোকটা।
দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে দোকানের পাশে চলে এলো কিশোর। চত্বরের দিকে তাকালো। দোকান থেকে বেরিয়ে ভ্যানে গিয়ে উঠলেন মেজর আর রিগো, যেটাতে খোঁড়ার যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে।
চলে গেল গাড়িটা।
খবরটা রবিনকে জানালো কিশোর। তারপর ফিরে এলো আবার আগের জায়গায়। টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট ভরছে টাকমাথা লোকটা। দুটো চেয়ার সাজিয়ে রাখলো ডেস্কের সামনে। চত্বরে আরেকটা ভ্যান ঢোকার শব্দ হলো। একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ, সঙ্গে পিটার। ঢুকেই জড়োসড়ো হয়ে গেল পিটার। এমন ভঙ্গি করতে লাগলো, যেন ভীষণ শীত করছে। এয়ারকুলার বন্ধ করে দিতে বললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে সুইচ অফ করে দিলো। লোকটা। মনে মনে হাসলো কিশোর, বুদ্ধি আছে ছেলেটার। শুধু তাই নয়, লোকটা যখন এয়ারকুলার বন্ধ করতে গেছে, সে এসে খুলে দিয়েছে জানালা। এক পলকের জন্যে কিশোরের মুখটা নজরে পড়েছে বোধহয়, কারণ হেসেছে এদিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে আবার, টাকমাথা কিছু সন্দেহ করার আগেই।
মিস্টার গুন, ক্যাপ্টেন বললেন, একদিন যা বলেছি, রেকর্ড তো করে। রেখেছেন। আবার শুনতে চাই। দরকার আছে।–
সরি, ক্যাপ্টেন, জবাব দিলো গুন, এখানে নেই ওগুলো। মেজর সব নিয়ে গেছেন।
কেন? জানতে চাইলো পিটার।
বোধ হয় এডিট করবেন। তারপর আরও কপি করে পাঠিয়ে দেবেন সোসাইটির ডিরেকটরদের কাছে।… আসুন, কাজ শুরু করা যাক।
রেকর্ডিঙের বোতাম টিপে যন্ত্রটা ক্যাপ্টেনের দিকে ঠেলে দিলো গুন। নিজে গিয়ে বসলো দরজার কাছে। ক্যাপ্টেন গল্প শুরু করলেন। সে চুপচাপ কমিক পড়তে লাগলো।
জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভাবছে, মেজর আর রিগো কোথায় গেল? টনিকে বসিয়ে এসেছে আড়া পাহারা দিতে। গুনকে রেখে গেছে ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে। পঁচিশ ডলার করে ঘন্টায়। ফিলিপের। টাকার টানাটানি চলছে। এই অবস্থায় এটা তার জন্যে লোভনীয় কাজ। আন্তরিক ভাবে গল্প বলে যাবেন, যততা গল্প তাঁর জানা আছে। কিন্তু কেন এই কাজ করাচ্ছেন। মেজর? আন্দাজ করতে পারছে গোয়েন্দাপ্রধান। আরও আন্দাজ করতে পারছে,। কোথায় গেছেন মেজর নিরেক রিগোকে নিয়ে।
.
আড্ডার বাইরে খুঁটিতে ওই একটামাত্র আলোই জ্বলছে।
টিকেট বুদ আর তালা দেয়া গেটটা দেখা যাচ্ছে সেই আলোয়। খুব সামান্যই গিয়ে পড়েছে পার্কিং লটে, তবে ওই ম্লান আলোতেই নড়াচড়াটা চোখ এড়ালো না। মুসার। ট্রাকের ভেতরে জ্বলছে সিগারেটের আগুন, একবার উজ্জ্বল হচ্ছে, টান। দেয়ার সময়। টান ছেড়ে দিলেই আবার কমে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পেছনের পথ। দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। মুসা আসার পর এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা বিমানও। উড়ে গেছে।
তারপর, রকি বীচের দিক থেকে এলো একটা ভ্যান। পাকিং লটে ঢুকলো। হেডলাইট নিভালো। গিয়ে থামলো বন্ধ গেটের সামনে। দরজা খুলে নেমে এলেন। মেজর নিরেক আর রিগো।
রবিন! নিচু গলায় মেসেজ পাঠালো মুসা, মেজর আর রিগো ব্যাটা এসে গেছে!
জানালার নিচে বসে মেসেজটা শুনলো কিশোর। উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো, এটাই আশা করেছিলাম, নথি। ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারকে সরিয়ে দেয়া। হয়েছে আড্ডা থেকে, যাতে নিরাপদে খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যেতে পারে মেজরের। চেলারা। ওরা জানে কিংবা অনুমান করেছে কিছু একটা লুকানো রয়েছে ওখানে।
ওয়াকি-টকির খুদে মাইক্রোফোনে কড়কড় করে উঠলো রবিনের কণ্ঠ, মুসা বলেছে, মেজর আর রিগো গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলো। টনি নেমে গেছে। ওদের কাছে। গেটের তালা খুলে দিয়েছে। ভ্যান নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেজর আর রিগো। যতোটা সম্ভব আস্তে আর নীরবে করেছে কাজটা। আলো জ্বালেনি। ওরা। ঢুকে যেতেই আবার তালা লাগিয়ে ট্রাকে ফিরে এসেছে টনি। ভ্যানটা আর দেখতে পাচ্ছে না মুসা।
নিচের ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। রবিন, মুসাকে বললো ভ্যানের পিছু নিতে। মেজর আর রিগো কি করছে জানা দরকার।
অন্ধকারে নিজে নিজেই মাথা নাড়লো মুসা। গেটের ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। এখন ট্রাকের হাইড্রলিক লিফটে চড়ে বসেছে টনি। আমি বেরোলেই আমাকে দেখে ফেলবে। বেড়ার কাছেও যেতে পারবো না, দেখে ফেলবে। আর গিয়ে লাভও নেই। এতো উঁচু বেড়া, ডিঙাতে পারবো না।
কিশোর বলেছে, যে ভাবেই হোক, ঢুকতে হবে তোমাকে। ওরা কি করছে, জানা দরকার। কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে। খোঁজো। ..
আরেকবার চোখ বোলালো মুসা। বললো, কারখানার ওদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে পারি। বেড়া ওখানেও আছে। ডিঙানোর চেষ্টা করবো। না পারলে আরও এগিয়ে চলে যাবো। পিয়ারের কাছে। পিয়ার পার হয়ে পানিতে নেমে সাঁতরে ঢুকবো আড্ডার ভেতরে। তাহলেই আর টনি দেখতে পাবে না।
রবিনের জবাবের অপেক্ষায় রইলো মুসা। কিশোরের সঙ্গে কথা বলবে রবিন, তারপর জবাব দেবে।
বেড়ার অন্যপাশে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কোনো শব্দ নেই ওখানে। আলো নেই।
অবশেষে জবাব দিলো রবিন, ঠিক আছে, মুসা, যাও। তবে খুব সাবধান!
.
১২.
কয়েকশো মিটার দূরে দৈত্যাকার ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রি-সার্ভিসট্রাকটা। সিগারেটের আগুন জানিয়ে দিচ্ছে এখনও হাইড্রলিক লিফটের ওপরে রয়েছে টনি।
পথটা দেখলো মুসা। পার্কিং লটের দিকে তাকালো। নির্জন। টনির দিকে আরেক বার তাকিয়ে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়লো সে। ছায়ায় ছায়ায় দৌড়ে চলে এলো কারখানার কাছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেণ্ড। বোঝার চেষ্টা করলো, কারো চোখে পড়ে গেল কিনা। বোধহয় পড়েনি। দেয়ালের ধার ধরে ধরে চলে এলো শেষ মাথায়, যেখানে খাড়ির সঙ্গে মিশেছে ওটা। দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা ইট আর কড়িকাঠ ধরে ওপরে উঠে পড়লো সে, তারপর দম বন্ধ করে লাফ দিলো। কাঠের পিয়ারে নিঃশব্দে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো। অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো আরও কিছুক্ষণ। কারো সাড়া নেই দেখে হাঁটতে আরম্ভ করলো। এগোলো কিছুদূর। খানিক দূরে চকচক করছে খুঁড়ির কালো পানি। মিটার দশেক দূরে আবছাভাবে চোখে পড়ছে ঘরবাড়ি।
পানিতে না নেমে ওখানে পৌঁছানোর আর কোনো উপায় নেই। পিয়ারের ওপর হাতড়ে হাতড়ে একটা নৌকা বাঁধার দড়ি পেয়ে গেল। টেনে দেখলো, একটা মাথা এখনও পিয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। ওটা ধরে ঝুলে পড়লো সে। নেমে এলো পানির কাছে। পা দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো। কনকনে ঠাণ্ডা পানি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো সে। তারপর হাত ছেড়ে দিলো।
পানি একেবারেই কম ওখানে, মাত্র গোড়ালি ডুবলো। দ্রুত একবার তাকালো। এদিক ওদিক, কেউ দেখছে কিনা দেখলো। তারপর হেঁটে চললো পানির মধ্যে দিয়ে। সাঁতরাতে হলো না বলে খুশি।
ট্রেলারটার কাছে উঠে এলো সে। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। সব কিছু চুপচাপ।
ডকে ভাসছে জাহাজটা, মাঝে মাঝে ঘষা লাগছে জেটির সঙ্গে, কচমচ আওয়াজ করছে। প্রমিনাডের দুপাশের ঘরগুলো সব বন্ধ। কফি স্ট্যাণ্ড, মিউজিয়ম, সব। মেজরের গাড়িটা চোখে পড়লো না।
ঘুরে মিউজিয়মের পেছনে চলে এলো সে। অন্ধকার আকাশের পটভূমিকায়। অনেক উঁচু লাগছে জাহাজের গলুইটা। সেদিকে একবার তাকিয়ে ওয়াকি-টকি তুলে আনলো মুখের কাছে। রবিন, ভেতরে ঢুকেছি। ট্রেলার, বাড়ি, জাহাজ, সব জায়গায় দেখলাম। মানুষজন চোখে পড়ছে না। মেজরের ভ্যানটাও না। কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল, আল্লাহ মালুম!
কিছুক্ষণ পর রবিনের কথা শোনা গেল, কিশোর বলছে, ওরা ওখানেই। কোথাও আছে। খুঁজতে বলেছে।
গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তবে তর্ক করলো না। ঘুরে রওনা হলো ওকের জঙ্গলের দিকে। ঘন গাছপালার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালো। কান পাতলো শব্দ শোনার আশায়। কিছুই কানে এলো না, শুধু তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎছল ছাড়া। আর আছে বাতাসের ফিসফাস কানাকানি। আড়র দিকে মুখ করে থাকা, টাওয়ারের একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।
নিচু গলায় ওয়াকি-টকিতে কথা বললো মুসা, ভিকটর ইভানসের টাওয়ারে আলো দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখতে যাচ্ছি আমি।
বনের ভেতর থেকে সরাসরি না বেরিয়ে বেড়ার কাছে চলে এলো মুসা। বেড়ার ধার ঘেঁষে এগোলো, যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে। টাওয়ারের কাছাকাছি এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো মাটিতে। বুকে হেঁটে এগোলো। আলো কিত জানালাটার কাছে এসে থেমে দম নিলো, তারপর আস্তে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালো।
ঘরের ভেতর ভিকটর একা। ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ছে। হঠাৎ কি মনে করে মাথা উঁচু করে কান পাতলো। যেন কোনো শব্দ কানে গেছে। সতর্ক হলো মুসা। সে কোনো আওয়াজ করে ফেললো না তো?
তাড়াতাড়ি জানালার কাছ থেকে সরে আসতে গেল সে। ফেলে দেয়া একটা খাবারের খালি টিনে পা বেধে ঠনঠন করে গড়িয়ে গেল ওটা। নীরব অন্ধকারে মুসার মনে হলো টিনের শব্দ তো না, যেন বোমা ফেটেছে।
চোখের পলকে মাটিতে শুয়ে স্থির হয়ে গেল সে।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ঘরের দরজা। এক ফালি আলো এসে পড়লো বাইরে। আলোর দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে ভিকটর। হাতে পিস্তল।
কেঁপে উঠলো মুসা। নেমে এলেই লোকটা তাকে দেখে ফেলবে…
মিআঁউউউ!।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ভিকটরের পায়ে গা ঘষতে আরম্ভ করলো একটা। কালো বেড়াল। হেসে পিস্তলটা নামিয়ে ফেললো সে। তুই। আমি ভেবেছিলাম না। জানি কে। আয়, ভেতরে আয়। _
বেড়ালটাকে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ভিকটর।
কপালের ঘাম মুছলো মুসা। বেড়ালটা সময়মতো না বেরোলে…আর ভাবতে পারলো না সে। বুকে হেঁটে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এলো আবার বেড়ার কাছে। উঠে একছুটে ঢুকে পড়লো ওকের জঙ্গলে।
জোরে জোরে দম নিলো কয়েকবার। তারপর ওয়াকি-টকি বের করে বললো, রবিন, কিশোরকে বলো, ঘরে রয়েছে ভিকটর। পড়ছে। মেজর নিরেক আর রিগোর চিহ্নও দেখলাম না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে!
.
দোকানের পেছনে ঝোঁপের মধ্যে বসে অন্ধকারেই ভুরু কোঁচকালো কিশোর। বললো, ভ্যানটা ওখানেই কোথাও আছে।
ঘড়ি দেখলো সে। এগারোটা প্রায় বাজে। রবিনের জবাব শোনা গেল, মুসা। বলছে, পুরনো আস্তাবলগুলোর সব কটার ডবল দরজা। সহজেই ভ্যান ঢোকানো যাবে। তবে ভেতরে ঢুকতে চাইছে না, মুসা, মেজরের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
এখনও আমরা কিছু জানতে পারিনি। ওরকম ঝুঁকি না নেয়াই ভালো। জিজ্ঞেস করো, আর কি করতে পারে সে?
দোকানের ভেতরে একটা প্যাকেট খুলে কেক বের করে ক্যাপ্টেন আর পিটারকে দিলো গুন। মুসার কাছ থেকে রবিনের মুখে জবাব এলো ওয়াকি টকিতে, একটা কাজই করতে পারে বলছে। গেটের কাছে লুকিয়ে থেকে দেখতে পারে, কোত্থেকে বেরোয় ভ্যানটা। _ আপনমনেই মাথা ঝাঁকালো কিশোর। এটাই একমাত্র বুদ্ধি..এই শোনো, ধরো, দেখি। মাথা আরেকটু তুললো সে। রেকর্ডিং শেষ হয়েছে মনে হচ্ছে।…হা, উঠে দাঁড়িয়েছেন ক্যাপ্টেন আর পিটার। এগারোটা বাজে। বেরিয়ে যাবেন।
সামনের গেটের কাছে, মিউজিয়মের কোনায় মাটিতে পেট দিয়ে শুয়ে আছে মসা। তাকিয়ে রয়েছে প্রমিনাডের দিকে। ব্ল্যাক ভালচারের দানবীয় ছায়া ছায়া শরীরটা চোখে পড়ছে। কানে আসছে শুধু বাতাসের ফিসফাস, ঢেউয়ের ছলছল, আর কাঠের জেটিতে জাহাজের ধাতব শরীর ঘষা লাগার বিচিত্র ক্যাচকোচ।
একভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে গেল মুসার। দুই চিবুকের ওপর। থুতনি রেখে চোখ মিটমিট করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো ওটা। ভ্যান! হেডলাইট নেভানো। এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনতে পায়নি সে। কোনদিক থেকে এলো, তা-ও বুঝতে পারেনি। ঘড়ি দেখলো সে। ঠিক ১১টা।
মাটিতে শরীর চেপে ধরলো মুসা, একেবারে মিশিয়ে ফেলতে চায় যেন। প্রায় নিঃশব্দে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেল ভ্যান। গেট খোলার জন্যে নামলো রিগো। খুলে দিতে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
খানিকটা এগিয়ে আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়ালো ভ্যান। ঝাঁকুনি লেগে হাঁ হয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। খুঁটির আলো গিয়ে পড়েছে ওটার গায়ে, ভেতরে কি আছে স্পষ্ট দেখতে পেলো মুসা। গাদা গাদা বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে, বোঝাই।
গাল দিয়ে উঠলেন ড্রাইভিং সীটে বসা মেজর, গাধা কোথাকার! তালা লাগায়নি! লাগিয়ে জলদি এসে ওঠো!
মেজরের নির্দেশ পালন করতে ছুটলো রিগো। দরজাটা লাগিয়েই থেমে গেল। ফিরে তাকালো মুসা যেখানটায় শুয়ে আছে সেদিকে। দেখে ফেললো নাকি! জমে গেল মুসা।
এই, কি হলো, বলদ! এতো দেরি কেন? ধমক দিলেন মেজর।
মাথা চুলকালো রিগো। দ্বিধা করলো একবার। তারপর গিয়ে উঠলো সামনের। সীটে। হেডলাইট জ্বালানো হলো এবার ভ্যানের। চলে গেল ওটা।
ওয়াকি-টকির ওপর কুঁকলো মুসা। রবিন, এইমাত্র বেরিয়ে গেল মেজর আর রিগো। কোথায় ছিলো ওরা, কোত্থেকে এলো, কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভ্যানের পেছনে কি আছে দেখেছি। অনেক বস্তা বোঝাই করা!
.
ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারকে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো কিশোর। ট্রাক চলে যাওয়ার শব্দ শুনলো। ওরা চলে যেতেই খোলা জানালাটা চোখে পড়লো গুনের। বিড়বিড় করে কি বলে এসে বন্ধ করে দিলো। এয়ারকুলার চালু করলো। তারপর গিয়ে বসলো টেপ রেকর্ডারের সামনে। টেপ রিওয়াইন্ড করে মুছে ফেলতে শুরু করলো ক্যাপ্টেনের কথা। অযথাই বকবক করে গেছেন যেন ফিলিপ, কোনো মানেই নেই ওসবের।
এই সময় এলো রবিনের মেসেজ। ভ্যানের পেছনে বোঝাই বস্তার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বোঝাই? যা-ই আছে, ওগুলোর জন্যেই গিয়েছিলো ওখানে ওরা! জিজ্ঞেস করো তো মুসাকে, কি আছে দেখতে পারবে কিনা?
পারবে না। ভ্যানটা চলে গেছে। এখনও পাহারা দিচ্ছে টনি। যে পথে ঢুকেছিলো সেপথেই ফিরে আসছে মুসা। হেডকোয়ার্টারে দেখা করবে, পরে।
ঠিক আছে, ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। তুমি জলদি চলে এসো এখানে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই একটা ভ্যানের শব্দ শুনলো কিশোর। চতুরে। থামলো। খানিক পরে ঘরে এসে ঢুকলেন মেজর আর রিগো। গুনের সঙ্গে কথা: বলতে লাগলেন তিনি, আর রিগো কেকের বাকিটা শেষ করায় মন দিলো। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। জানালার বাইরে। ঝোঁপের ভেতর গুটিয়ে গেল। কিশোর। কথা শেষ করে রিগোকে ইশারা করলো গুন। নেহায়েতই অনিচ্ছা নিয়ে যেন তার পিছে পিছে চললো হাতির বাচ্চা। নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় পাহারা বদল করতে যাচ্ছে, কিশোর ভাবলো।
দেয়ালের পেছনে একটা খসখস কানে এলো তার। অন্ধকারে ঘুরে তাকালো।
রবিন এসেছে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। ফিসফিস করে বললো, এসেছে। ভালো হয়েছে। আমার জায়গায় গিয়ে বসো। বস্তাগুলোয় কি আছে দেখতে যাচ্ছি আমি। আমাদের যন্ত্রটাও খুলে আনবো। মেজরকে বেরোতে দেখলেই আমাকে হুঁশিয়ার করবে।
তাড়াতাড়িই ফিরে এলো কিশোর।
দেখেছো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
দেখেছি। দশটা বস্তায়ই। যন্ত্রটাও খুলে নিয়ে এসেছি। চলো, বাড়ি যাবো।
কি আছে?
ততোক্ষণে চলতে আরম্ভ করেছে কিশোর। রবিনের কথার জবাব দিলো না। সাইকেল নিয়ে রওনা হলো দুজনে।
ওরা ইয়ার্ডে আসার কিছুক্ষণ পর এলো মুসা।
নষ্ট হয়ে যাওয়া ট্রেইলিং ডিভাইসটা টেবিলে ফেলে রেখেছে কিশোর। কিসের সঙ্গে যেন বাড়ি খেয়ে হয়েছে এই অবস্থা।
গেল! জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো রবিন। ওই জিনিস আরেকটা কেনার পয়সাও নেই এখন আমাদের।
যাক, হাত নাড়লো মুসা। পয়সা হলে কিনে নেবো আরেকটা। এই কিশোর, বস্তার ভেতর কি দেখলে?
মাটি।
মাটি! মুসা আর রবিন দুজনেই অবাক।
মাটি আর পাথর, আবার বললো কিশোর। দশ বস্তা বোঝাই খুব বাজে মাটি আর পাথর।
কিন্তু…কিছুই বুঝতে পারছি না! হাত ওল্টালো মুসা।
এটুকু বোঝা যাচ্ছে, কিশোর বললো, মাটি খুঁড়েছে জলদস্যুর আভজাতেই। কাল আবার যাবো আমরা। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে বলবো গল্প রেকর্ডিংটা স্রেফ একটা ধাপ্পাবাজি। তারপর খুঁজে বের করবো, কোন জায়গায় খুঁড়ছেন মেজর, এবং কেন।
.
১৩.
পরদিন সকালে হেডকোয়ার্টারে রবিন দেখলো, রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রাখছে কিশোর। মুসা আসছে না, জানালো সে। বাড়ি থেকে কাজ চাপানো হয়েছে ওর ওপর। ওকে রেখেই যেতে হচ্ছে আমাদের। যতো তাড়াতাড়ি পারে কাজ শেষ। করে আড্ডায় আমাদের সঙ্গে দেখা করবে বলেছে।
হাসলো ররিন। মায়ের ওপর রেগে নিশ্চয় ভোম হয়ে আছে।
যা-ই হোক, অন্তত খুশি মনে হলো না। চলো। তিনটে ওয়াকি-টকিই নিয়ে। নিচ্ছি। কাজে লাগতে পারে।
যন্ত্রগুলো ব্যাগে ভরে নিলো রবিন।
সবুজ ফটক এক দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোলো ওরা। চললো জলদস্যুর আড়ার দিকে। কুয়াশা পড়েছে। হাইওয়ে দিয়ে সাবধানে সাইকেল চালালো
পৌঁছে দেখলো নির্জন পাইরেটস কোভ-এর ওপরে নীরবে যেন ঝুলে রয়েছে। ভারি কুয়াশার চাদর।
পিটারকে ফোন করেছিলাম, কিশোর জানালো। সে বলেছে, তার আব্বাকে বলেকয়ে রাজি করিয়ে রাখবে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে।
গেটের কাছে পৌঁছে নিচু গলায় বললো রবিন, আইসক্রীমের ভ্যানটা আছে রিগো কোথায় লুকিয়েছে কে জানে। হয়তো গাছের আড়ালে।
রাস্তার দিকে তাকালো কিশোর। গাড়িটা দেখলো। গাছের জটলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। হ্যাঁ, আছে। অতোবড় হাতির মতো দেহ লুকানো কি আর সহজ?
গেটের ভেতরে ঢুকলো দুজনে। ট্রেলারের কাছে এসে বেল বাজালো।
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। পিটার বললো, এসো। তোমাদের জন্যেই বসে আছি।
রান্নাঘরে টেবিলের সামনে বসে আছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। সবে নাস্তা শেষ করেছেন। ছেলেদেরকে কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রতার সঙ্গে বললো। ওরা, খাবে না।
হাতের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন তিনি, মেজর নিরেককে বিরক্ত করতে মানা করেছিলাম তোমাদেরকে।
মনে আছে, স্বীকার করলো কিশোর। আমরা করিনি। তদন্ত যে করছি। বগুনী জলদস্যু জানেনই না মেজর।
তাহলেই ভালো। শুনলাম, রহস্যের কিনারা নাকি করে ফেলেছে। খুলে বল তো সব।
পিটার বোধহয় বাড়িয়ে বলেছে, নরম গলায় বললো কিশোর। রহস্যের সমাধান এখনও করতে পারিনি, তবে শিওর হয়ে গেছি, রহস্য একটা সত্যিই আছে। আগের দিন রাতে যা যা ঘটেছে বলতে লাগলো সে।
আরেক কাপ কফি ঢাললেন ক্যাপ্টেন। কিশোরের কথা শেষ হলে বললেন; তাহলে তোমার বিশ্বাস, পুরো ব্যাপারটাই একটা ফাঁকিবাজি। গল্প বলানোর ছুতোয় আমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছে মেজর, যাতে নিরাপদে মাটি খুঁড়তে পারে।
হ্যাঁ, স্যার।
কিন্তু কেন? আর এতো পাহারার ব্যবস্থাই বা কেন করেছে?
এখনও জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। বেগুনী জলদস্যুর গুপ্তধন। আছে হয়তো এখানে, আর সেটা জানা আছে মেজর আর তার চেলাদের। ম্যাপও আছে একটা। টেবিলে ম্যাপ বিছিয়ে যে দেখেছিলেন মেজর, সেকথা জানালো কিশোর।
সন্দেহ যাচ্ছে না ক্যাপ্টেনের। পাইরেটস কোভে গুপ্তধন আছে, একথা কারো কাছে শুনিনি। কোনো গুজব নেই। তবে উইলিয়াম ইভানস ফিরে এসে মারা। যাওয়ার পর লোকে ভাবতে শুরু করেছিলো, সে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে। খোঁজাখুঁজিও করেছে। কেউ কিছু পায়নি। তারপর আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কেউ।
গুপ্তধন না-ও হতে পারে। তবে মাটি যে খোঁড়া হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোন জায়গায় খুঁজছে, এখন গিয়ে সেটা বের করা দরকার।
পাওয়া যাবে! উত্তেজনায় চকচক করছে পিটারের চোখ। তিন দিন ধরে খুঁড়ছে, নিশ্চয় বেশ বড় গর্ত!
তাহলে পাওয়া সহজই হবে, ক্যাপ্টেন বললেন।
আমার তা মনে হয় না, সন্দেহ রয়েছে কিশোরের। মাটি খুঁড়ে বস্তায় ভরে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অতি সাবধানতা। যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে।
আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজতে বেরোই আমরা, কি বলো? রবিন বললো। তুমি ক্যাপ্টেনকে নিয়ে যাও। আমি আর পিটার যাচ্ছি। দুদিকে যাবো। দুজনেই এলাকা চেনেন, অসুবিধে হবে না।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর।
ঠিক হলো দুদিক থেকে খুঁজে এসে জাহাজটার কাছে মিলিত হবে ওরা।
কফি স্ট্যাণ্ডের পেছন দিকটায় খুঁজতে চললো কিশোর আর ক্যাপ্টেন। কুয়াশা। এখনও কাটেনি। মাথার ওপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে, হালকা মেঘের মতো।
এটা আর মিউজিয়ম করা হয়েছে যে বাড়িটায়, ক্যাপ্টেন বললেন, আগে আস্তাবল ছিলো। ওদিকে ওই গাছপালাগুলো দেখছো, ওখানে আরেকটা বাড়ি ছিলো। কোভ রোড তৈরি হওয়ার আগে।
ঘরের ভেতরেও মাটি খোঁড়া হয়ে থাকতে পারে, সন্দেহ করে একটা আস্তাবলের দরজা খুললেন তিনি। কোমল পানীয় আর টিনজাত খাবারের বাক্সে। ঘরটা বোঝাই। তবে ভ্যান রাখার জায়গা রয়েছে। মাটিতে টায়ারের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না, গর্তটৰ্তও খোঁড়া হয়নি। কিছুই পাওয়া গেল না। বাইরে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজলো কিছুদূর। তারপর নিরাশ হয়ে এসে দাঁড়ালো ব্ল্যাক ভালচারের কাছে।
রবিন আর পিটারও ফিরে এলো।
পাইনি, হতাশ কণ্ঠে জানালো রবিন। একটা ইঞ্চি জায়গাও বাদ দিইনি।
ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। শো-এর সময় হয়ে যাচ্ছে। নোনতা তো এখনও এলো না। আসেই কিনা কে জানে! মাঝে মাঝেই এরকম করে। একা মারিয়া। সামলাতে পারবে না। লোক যদি বেশি হয়ে যায়, তোমরা কি সাহায্য করতে পারবে?
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কিশোরের চোখ। নিশ্চয় পারবো, স্যার। অভিনয়ও করতাম একসময়। জলদস্যুর অভিনয় ভালোই পারবো। প্রয়োজন হলেই বলবেন। আমরা আছি।
এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে, প্রস্তাবটা রবিনেরও মনে ধরেছে। কাজও করবো, ওদিকে খোঁজাও হয়ে যাবে, গর্তটা। মিউজিয়মের চাবিটা দিন।
পকেট থেকে চাবি বের করে দিলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন, শো-এর জন্যে তৈরি হতে। তালা খুলে মিউজিয়মের ভেতরে ঢুকলো কিশোর আর রবিন।
কিশোর বললো, দেখ, মাটিতে চাকার দাগ আছে কিনা?
প্রথম ঘরটায় কোনো দাগ পাওয়া গেল না। মাটি খোঁড়ার চিহ্নও নেই। পরের ঘরটায়ও দাগটাগ মিললো না। বেরোনোর জন্যে পা বাড়িয়েই থেমে গেল রবিন। হাত তুলে হুঁশিয়ার করলো কিশোরকে।
বাইরে কুয়াশার মধ্যে নড়ছে কিছু। শব্দ শুনতে পেয়েছে সে।
দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা।
.
১৪.
কুইক! ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। দরজার পেছনে!
কিন্তু লুকানোর আগেই দরজায় দেখা দিলো একটা ছায়া। কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
অ, তুমি! আমরা তো ভেবেছিলাম কে জানি! মুসাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। ফেললো রবিন।
কি করে বুঝলে এখানে আছি? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। পিটারকে জিজ্ঞেস করেছো নাকি?
নাহ, দেখাই হয়নি। ভেতরে শব্দ শুনলাম, দরজাও খোলা। ভাবলাম, দেখি তো কে? কোথায় খুঁড়েছে দেখেছো?
মাথা নাড়লো কিশোর। না। তবে এ-বাড়ির একটা ঘর এখনও বাকি।
শেষ ঘরটারও তালা খুলে দেখলো ওরা। কিছু পেলো না।
বাইরে হালকা হয়ে এসেছে কুয়াশা। মিউজিয়ম বিল্ডিং আর ওকের জটলার মাঝের জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। কয়েকজন দর্শককে দেখতে পেলো, ব্ল্যাক ভালচারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কফি স্ট্যাণ্ডটা খোলা হয়েছে, কাউন্টারের পেছনে বসেছেন ক্যাপ্টেন। সাগরের কিনার, বেড়া আর ওকের সারির মাঝের জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো ছেলেরা।
খোঁড়ার কোনো লক্ষণই তো দেখছি না, রবিন বললো হতাশ কণ্ঠে।
হয়তো খুঁড়েছিলো, মুসা বললো। কালরাতে এসে আবার ভরে দিয়ে
তাহলে পরিষ্কার বোঝা যেতো, বললো কিশোর। সবখানেই, তো খুঁজলাম…
বাধা দিলো রবিন, না, সবখানে নয়! টাওয়ার আর বোটহাউসের ভেতরটা এখনও বাকি!
বাঁকাচোরা পুরনো ওকের ভেতর দিয়ে তাকালো ওরা টাওয়ারের দিকে। পানির কিনারে কাত হয়ে থাকা বোট-হাউসটা দেখলো। গাছপালার ভেতর দিয়ে ভ্যান চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে।
কিন্তু পাথরের টাওয়ারের ভেতরে খুঁড়বে কি করে? প্রশ্ন তুললো মুসা। বোটহাউসে পারা যাবে না। একটায় পাথর, আরেকটায় পানি।
তবে বোটহাউসে ভ্যান লুকানো সম্ভব, কিশোর বললো। রবিন ঠিকই বলেছে। দেখা দরকার।
দাঁড়াও, আবার বাধা দিলো রবিন। ভিকটর লোকটার মাথায় ছিট আছে। কাল আমাকে যেরকম করে ধরেছিলো! ক্যাপ্টেনকে নিয়ে আসা উচিত আমাদের।
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো কিশোর। তা-ও বটে।
ভিকটর এখন টাওয়ারে নেই, মুসা বললো। আমি ঢোকার সময় দেখলাম। পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
চলো তাহলে, তুড়ি বাজালো কিশোর। এটাই সুযোগ।
হালকা বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো ওরা, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন। ঘড়ি দেখলেন একবার। গেটের কাছে টিকেট বুদটা খোলা রেখেছে এখনও মারিয়া। প্রথমে বোটহাউসের দিকে এগোলো ওরা। ডাঙার দিকের দরজাটা বেশ বড়, তালা নেই। দরজার ঠিক ভেতরেই কাঠের মেঝে, ভ্যান রাখা সম্ভব ওখানে। তবে টায়ারের চিহ্ন কিংবা তেলটেল পড়ে নেই। কালো পানির ওপর যেন ঠেলে বেরিয়ে আছে ডক, নৌকা বাঁধার জায়গা রয়েছে দুপাশে। একটা নৌকাও নেই। শেষ মাথায় দরজা ছিলো একসময় নৌকা ঢোকানোর জন্যে, তবে এখন এমনভাবে বসে গেছে পানিতে, ঢোকানোর আর উপায় নেই। ডকের ওপরে ছাতের কাছে। পাল রাখার জায়গা। ওখানে এখনও বেশ কিছু পাল, মাস্তুল আর দড়ি রয়েছে। ডকের নিচে কাঠের গায়ে ঢেউ ভাঙছে। সব কিছুই খুব স্বাভাবিক, মাটি খোঁড়ার চিহ্নই নেই।
টাওয়ারে যাওয়ার পথেও কোথাও খোঁড়ার চিহ্ন দেখা গেল না।
মুসা, কিশোর বললো, বনের ভেতর গিয়ে পাহারা দাও। ওয়াকি-টকি বের করে দিলো। নাও। ভিকটরকে আসতে দেখলেই হুঁশিয়ার করবে। সারাক্ষণ অন করে রাখবো আমাদের যন্ত্র।
টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে কিশোর। একতলায় দুটো দরজা আর কয়েকটা জানালা। দোতলা-তিনতলায় একটা করে খুদে জানালা। আর চারতলার প্রায় পুরোটাই কাঁচের, লাইটহাউসের মতো। জানালার মাঝে দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে আছে ইটের ধাপ, মইয়ের মতো অনেকটা, উঠে গেছে একেবারে চ্যাপ্টা ছাত পর্যন্ত।
সামনের একটা দরজায় ঠেলা দিলো কিশোর। তালা নেই। খুলে গেল। ছোট একটা লিভিং রুম দেখা গেল, গোল, ছাতটা উঠে গেছে গম্বুজের মতো গোল হয়ে। ডানে ওই একই আকারের বেডরুম, বাঁয়ে রান্নাঘর। ওখান থেকে বেরোনোর। আরেকটা দরজা আছে, ভেতর থেকে ছিটকানি লাগানো। একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে মাটিরতলার ঘরে, এক পাশের দেয়ালে তার দরজা। আরেক পাশের দেয়ালে আরেকটা দরজা, সেখানে একটা মোটা পাইপের মতো দেখা গেল, সিমেন্টের তৈরি। ভেতর দিয়ে লোহার মই। উঠে গেছে ওটা।
আগে নিচে নামি, কিশোর বললো।
রবিন কিছু বললো না। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার সেলারে। হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ড বের করলো কিশোর।
একটা মাত্র বা ঝোলানো রয়েছে ছাতে, অল্প পাওয়ারের। আলো খুব। সামান্য। তবে তাতে দেখতে অসুবিধে হয় না। নিচু ছাতওয়ালা একটা ঘরে ঢুকেছে ওরা। পাথরের দেয়াল। মেঝেটা কাঁচা, কিন্তু সিমেন্টের মেঝের চেয়ে কম শক্ত না। মসৃণ। দেয়ালে ধুলো জমে রয়েছে কতো বছর ধরে, বলার জো নেই।
এখানেও কেউ খোড়েনি, রবিন বললো।
তাই তো মনে হচ্ছে। বার বার নিরাশ হতে ভালো লাগছে না কিশোরের।
দেয়ালের ওপাশে আরেকটা ঘর আছে। স্টোররুম। তাতে পড়ে আছে। জমকালো সব আসবাবপত্র, ধুলোয় মাখামাখি। জানে পাবে না, তবু ওগুলোর তলায় উঁকি দিয়ে দেখলো দুজনে, খোঁড়ার চিহ্ন আছে কিনা।
কেউ আসেনি এখানে, রবিন বললো।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
পেছনে বিকট চিৎকার শুনে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো দুজনে।
দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনী জলদস্যু। হাতে ভোজালি।
মিস্টার জেসন, রবিন বললো, আমরা।
কথা বললো না বেগুনী জলদস্যু। বেগুনী মুখোশের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে জ্বলন্ত চোখে। নাকের নিচে পুরু গোঁফ।
আপনি মিস্টার জেসন না? সন্দেহ হলো কিশোরের।
জবাবে ভোজালি উঁচিয়ে ছুটে এলো লোকটা। লাফ দিয়ে পাশের একটা মস্ত আলমারির ওপর গিয়ে পড়লো রবিন। কিশোর পড়লো কয়েকটা চেয়ারের ওপর। রবিনের পায়ে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে লম্বা এক টেবিলের ওপর গিয়ে পড়লো। জলদস্যু। পিছলে চলে গেল পেছনের দেয়ালের কাছে।
একটা মুহূর্ত নষ্ট করলো না দুই গোয়েন্দা। লাফ দিয়ে উঠে দিলো দৌড়। পেছনে তাকালো না একবারও, সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে এলো ওপরে। রান্নাঘরে ঢুকতেই কানে এলো মুসার কণ্ঠ, শুনছো! ভিকটর! এই শুনছো? ভিকটর এসেছে!
চোখের পলকে গিয়ে পেছনের দরজাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিশোর। দেখলো, ছিটকানি তো আছেই, তালাও লাগানো। নিচে সেলারে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। নিশ্চয় সিঁড়ির দিকে আসছে লোকটা। বাইরে, সামনে দিয়ে আসছে ভিকটর ইভানস।
আটকা পড়েছে দুই গোয়েন্দা। পালানোর পথ নেই।
.
১৫.
আরও হালকা হয়ে এসেছে কুয়াশা। বনের মধ্যে বসে আছে মুসা। ওয়াকি-টকি মুখের কাছে ধরা। আবার বললো সে, হুশিয়ার! ভিকটর আসছে! বেরিয়ে এসো!
জবাব এলো না।
ভিকটরের দিকে ফিরে তাকালো সে। গেট দিয়ে ঢুকে হেঁটে আসছে বনের দিকে। এখন না বেরোলে আর ভিকটরের চোখ এড়িয়ে বেরোতে পারবে না। কিশোর আর রবিন। করছে কি ওরা?
রবিন! কিশোর! হুঁশিয়ার! আবার সতর্ক করলো মুসা। জলদি বেরিয়ে এসো!
সামনের দরজাটা খুলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু কেউ বেরোলো না। চোখ মিটমিট করতে লাগলো মুসা। তাহলে আপনাআপনিই খুলেছে, বাতাসে? না, বাতাস নয়। দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে আসছে কালো একটা বেড়াল। বেরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসতে লাগলো। রবিন আর কিশোর বেরোলো না।
মরিয়া হয়ে উঠলো মুসা। প্রায় চেঁচাতে শুরু করলো, রবিন! কিশোর! ভিকটর…
এই, কি করেছে ভিকটর!
মুখ ফেরাতেই একেবারে লোকটার মুখোমুখি হয়ে গেল মুসা।
আবার ঢুকেছো চুরি করে! কার সঙ্গে কথা বলছো? ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
ঢোক গিললো মুসা। কোথায় খোঁড়া হয়েছে, বের করার চেষ্টা করছি আমরা, স্যার। আমাদের ধারণা, এখানে কোথাও গুপ্তধন লুকানো রয়েছে। রবিন আর কিশোর গেছে আপনার টাওয়ারের ভেতরে খুঁজতে। আমি…আমি…
চট করে খোলা দরজার দিকে তাকালো ভিকটর। কে খুঁড়ছে?
ওরা!
ওরা কারা?
যারা গুপ্তধন খুঁজছে।
কারা খুঁজছে, সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি! রেগে গেল ভিকটর।
মেজর নিরেক আর তার চেলারা। টনি, রিগো, গুন–সেই টাকমাথা লোকটা।
বিস্ময় ফুটলো ভিকটরের চোখে। আবার তাকালো টাওয়ারের দরজার দিকে। কোথায় খুঁড়ছে, দেখেছো?
না। সব জায়গায় খুঁজেছি আমরা, শুধু…
হঠাৎ যেন হাঁপাতে শুরু করলো মুসার ওয়াকি-টকি। এটা এক ধরনের সংকেত, কিশোর পাঠাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো, কি, কিশোর?
নিচু গলায় জবাব এলো, টাওয়ারে একটা লোক ঢুকেছে, মুসা। আমাদের হামলা করেছে। সেলার থেকে উঠে এসেছি আমরা, কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে পারছি না। পেছনের দরজায় তালা। সামনে দিয়ে বেরোতে গেলে ভিকটর দেখে ফেলবে। একটা কাজই করার আছে আমাদের, ওপরে চলে যাওয়া… থেমে গেল হঠাৎ কিশোর। পরক্ষণেই শোনা গেল তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, আসছে লোকটা! আমরা চলে যাই…
নীরব হয়ে গেল ওয়াকি-টকি।
.
টাওয়ারের দোতলায় উঠে গেছে কিশোর আর রবিন। রান্নাঘর থেকে মই বেয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে লোকটা।
জলদি, কিশোর বললো।
ছোট একটা জানালা দিয়ে ম্লান আলো আসছে। সেই আলোয় দেখে দেখে মই বেয়ে নিঃশব্দে তেতলায় উঠে এলো দুজনে। আলো এখানেও খুব কম। পুরনো কয়েকটা পিপা আর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, ধুলোয় মাখামাখি। দেখে মনে হয় বেগুনী জলদস্যু। শত বছর ধরে ওভাবেই আছে ওগুলো ওখানে। দুটো বাক্সের ওপর বসলো ওরা। নিচে, দোতলায় ভারি পায়ের শব্দ হচ্ছে, নিশ্চয় ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকটা।
ও কে, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বললো রবিন। নোনতা জেসন?
নোনতা জেসন আমাদের আক্রমণ করবে কেন?
তা-ও তো কথা।
কান পেতে শুনতে শুনতে হঠাৎ কিশোর বলে উঠলো, রবিন, আমার মনে হয় আমাদেরকে খুঁজছে ও! আমাদের পিছুও নেয়নি। অন্য কিছু খুঁজছে সে।
কিন্তু সেলারে তো হামলা চালালো?
চালিয়েছে। তবে আমাদের পিছু নিয়ে যায়নি। এখনও আমাদের পেছনে লাগেনি সে। ও হয়তো ভাবছেই না আমরা আছি এখানে। ভেবেছে, বেরিয়ে চলে গেছি।
মেজর নিরেক নয় তো?
মাথা নাড়লো কিশোর। না, মেজরের শরীর আরও ছোট। আর রিগো অনেক বড়। তবে অন্য দুজনের একজন হতে পারে, টনি কিংবা গুন আর ভিকটর ইভানস যে নয়, সে তো জানিই। কারণ সে বাইরে রয়েছে।
কিশোর! ওপরে আসছে!
মই বেয়ে চারতলায় উঠতে শুরু করলো দুজনে। মইটা শেষ হয়েছে একটা ট্র্যাপডোরের কাছে। ঠেলা দিতেই ওপরে উঠে গেল ওটা। ওরা বেরিয়ে এলো উজ্জ্বল রোদে। চারতলার এই ঘরটা ছোট, চারপাশে অসংখ্য জানালা। তাড়াতাড়ি ট্র্যাপডোর বন্ধ করে দিয়ে জানালার কাছে চলে এলো ওরা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খাড়িটা। ঘাটে বাঁধা রয়েছে ব্ল্যাক ভালচার। প্রথম শো শুরু হতে বেশি দেরি নেই।
কিশোর, এখানেও যদি আসে?
জানালার অনেক নিচে মাটি। টাওয়ার থেকে নেমে যাওয়ার আর কোনো পথও নেই। ঘরটায় আসবাব নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই।
কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। ভয় ফুটলো কিশোরের কণ্ঠে।
আসছে! ও আসছে!
.
বনের মধ্যে বসে টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর ভিকটর। ওয়াকি টকিতে কিশোরের মেসেজের অপেক্ষা করছে।
গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বললো।
নাম কি তোমার? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
মুসা। মুসা আমান।
মুসা, আমরা জানি না টাওয়ারে কে ঢুকেছে। কজন ঢুকেছে। গিয়ে হয়তো তোমার বন্ধুদেরকে আরও বিপদে ফেলে দেবো।
আ-আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। কিন্তু…
মুসা, টাওয়ারের দিকে হাত তুললো ভিকটর, ওই দেখো!
দেখলো মুসাও। টাওয়ারের ওপরতলার জানালা দিয়ে মুখ বের করেছে। কিশোর আর রবিন। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিতে গেল সে। খপ করে হাত চেপে ধরলো ভিকটর, টেনে থামালো। থামো! বিপদে ফেলে দেবে, ওদেরকে। তোমাকে দেখলেই বেস কিছু করে বসতে পারে ওরা।
বুঝলো মুসা। মাথা ঝাঁকালো। ঢোক গিললো। জানালা থেকে সরে গেছে। কিশোর আর রবিন। আবার জানালার দিকে হাত তুলে দেখালো ভিকটর, মুসাকে ছাড়েনি। মুসা দেখলো, জানালায় দেখা যাচ্ছে এখন বেগুনী জলদস্যুর মুখ। বেগুনী মুখোশ, কালো গোঁফ, পালক লাগানো বেগুনী হ্যাট, সোনালি কাজ করা বেগুনী কোট।
কো-কোথায় লুকালো ওরা! জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে যেন মুসা।
মাথা নাড়লো ভিকটর। কোথাও না, মুসা! ওখানে আলমারি-টালমারি কিচ্ছু নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই! আটকা পড়েছে ছেলে দুটো!
১৬.
নীরব টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। জানালা থেকে অদৃশ্য হয়েছে। বেগুনী জলদস্যুর মুখ। রোদ চমকাচ্ছে কাঁচের পাল্লায়।
নিশ্চয় ওদেরকে ধরে ফেলেছে! জোরে কথা ভিকটরও বলছে না।
বাঁচাতে হবে ওদের! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
আস্তে, আস্তে কথা বলো! বোকামি করে বিপদ বাড়াবে…
মুসা! লোকটা কি চলে গেছে? আচমকা ওয়াকি-টকিতে ভেসে এলো যেন বিদেহী কারো কণ্ঠস্বর, মুসার সে-রকমই মনে হলো। ওকে দেখেছো?
কিশোর! কোথায় তুমি?
টাওয়ারের ওপরে। কেন, দেখতে পাচ্ছো না?
ওপর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর ভিকটর। অবাক। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
কই, কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
হাসলো কিশোর। আরও ওপরে, মুসা। জানালার ওপরে।
এই বার দেখতে পেলো মুসা। রবিন আর কিশোর দুজনেই হাসছে। জানালার ওপরে বেরিয়ে থাকা কার্নিশে উঠে গেছে ওরা।
উঠলে কি করে ওখানে!
ভয় পেয়ে কতো কিছুই তো করে বসে মানুষ, কিশোর জবাব দিলো। কথা সেটা না। ওঠার সময় তো উঠেছি, এখন নামি কি করে?
মাটি থেকে চারতলা ওপরে, ছাতের কাছাকাছি উঠে আছে কিশোর আর রবিন। ওখান থেকে পড়লে—নিজের অজান্তেই একটা গোঙানি বেরিয়ে এলো মুসার মুখ থেকে।
মুসা, রবিনের কণ্ঠ, তোমার সঙ্গে আরেকজন কে?
মিস্টার ভিকটর ইভানস। তিনি ভালো মানুষ, ভয়ের কিছু নেই।
ওয়াকি-টকিতে জানালো ভিকটর, তোমরা কি করছো, সব বলেছে আমাকে মুসা। অবশ্যই আমি সাহায্য করবো তোমাদেরকে। লোকটা কি চলে গেছে?
তিনতলায় নামতে তো শুনলাম, রবিন বললো। একেবারে নিচে নামলো। কিনা বুঝতে পারছি না।
ঠিক আছে, দেখছি আমরা। তোমরা যেভাবে আছো, থাকো।
সাবধানে টাওয়ারের সামনের দরজার দিকে এগোলো ভিকটর আর মুসা। কোনো শব্দ নেই। পেছনের দরজাটা তেমনি ছিটকানি লাগানো রয়েছে। সামনের দরজা দিয়ে লোকটা বেরোলে ওদের চোখে পড়তোই। সেলার, দোতলা আর তিনতলায় খুঁজে দেখা হলো। নেই লোকটা। ওপর তলায় উঠে এসে দেখলো, পেছনের একটা জানালা বেয়ে সবে নেমেছে কিশোর আর রবিন। মুসাকে দেখে হাসলো।
উঠলে কি করে ওখানে? জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
আসুন, দেখাচ্ছি, ডেকে একটা জানালার কাছে তাকে নিয়ে গেল রবিন। জানালার বাইরেটা দেখিয়ে বললো, ওগুলো বেয়ে।
মুসা আর ভিকটর, দুজনেই গলা বাড়িয়ে দিলো। দেয়ালের গায়ে জানালার লাগোয়া কতগুলো পাথর এমনভাবে বের করা, মইয়ের মতো ওগুলো বেয়ে উঠে যাওয়া যায়।
নিশ্চয় ছাতে যাওয়ার পথ ওটা, কিশোর বললো। আপনার পূর্বপুরুষরা বানিয়ে রেখে গেছেন, ইচ্ছে করেই। যাতে সময়ে কাজে লাগে।
হুঁ, মাথা দোলালো ভিকটর, তোমাদের যেমন লাগলো।
যদি পড়ে যেতে! অনেক নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে এখনও ভয় পাচ্ছে। মুসা।
তখন কি আর অতো কথা মনে ছিলো, রবিন বললো। লোকটা উঠে আসছে। লুকানোর কোনো পথ দেখছি না। খুঁজতে খুঁজতে কিশোরের চোখে। পড়লো প্রথমে ওই মই। আর কি, উঠে গেলাম। ওই সময় তুমি হলেও পারতে।
তা ঠিক।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। খাড়ির দিকে চোখ। রওনা হয়ে। গেছে ব্ল্যাক ভালচার। প্রথম শো, কিন্তু শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে। অন্য দিনের চেয়ে আজ যাত্রী বেশি, তার কারণ বোধহয় দুটো শো-এর লোক একবারে উঠেছে। জেসন এসেছে। পিটার আর সে জলদস্যু সেজে আক্রমণের পাঁয়তারা করছে।
হঠাৎ ফিরে তাকালো সে। কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলে?
শুধু বেড়ালটাকে, মুসা জানালো।
সেজন্যেই আমাদের বেগুনী সাহেব ভেবেছেন, সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছি আমরা। বেরোতে দেখেনি তো, তাই। ভেবেছে, ভয়ে লেজ তুলে পালিয়েছি আমরা। এবং তাতেই সে খুশি।
শুধু কি আমাদের তাড়িয়েই সে খুশি? রবিনের প্রশ্ন।
তাছাড়া আর কি? মারতে নিশ্চয় চায়নি।
লোকটা কে, চিনেছো? জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
না, স্যার। মেজর নিরেক নয়। রিগোও নয়। গায়ে-গতরে আপনার সমান, কিন্তু আপনি তো ছিলেন মুসার সঙ্গে। তারমানে আপনিও নন। এটি
ভাগ্য ভালো, ছিলাম, হাসলো ভিকটর। নইলে আমাকেই সন্দেহ করে বসতে।
তা করতাম।
শুধু কি তোমাদের তাড়াতেই এসেছিলো সে?
মনে হয়, এসেছিলো অন্য উদ্দেশ্যে। আমাদের দেখে তাড়া করেছে আরকি। আমার ধারণা, কিছু লুকানো রয়েছে টাওয়ারে, সেটা খুঁজতেই এসেছিলো।
কি লুকানো আছে, কিশোর? রবিনের জিজ্ঞাসা। মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন খোঁজার কথা বলছিলে…
কি জিনিস, জানি না, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। তবে এখন মনে হচ্ছে, যা-ই থাকুক, মাটির তলায় নয় সেটা। লুকানো রয়েছে অন্য কোথাও।
তাহলে মাটি খুঁড়লো কেন? মুসার প্রশ্ন।
সেলারে গেলেই বোধহয় তার জবাব মিলবে। চলো, দেখিগে।
.
১৭.
বদ্ধ জায়গায় কাঠের সিঁড়িতে ওদের পায়ের শব্দ বড় বেশি হয়ে কানে বাজলো।
নথি, কিশোর বললো, লোকটার আসার শব্দ আমরা কখন পেয়েছি মনে আছে?,
নিশ্চয়ই। তখন স্টোররুমে ছিলাম। ঠিক পেছনেই গর্জে উঠলো লোকটা। মুখ ফিরিয়েই দেখি, প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়েছে।
ঠিক। তাহলে প্রথম আমরা শুনলাম গর্জন, স্টোররুমে, আমাদের পেছনে। এই যে এখন আমরা নামছি, কতো জোরে শব্দ হচ্ছে। অথচ লোকটার পায়ের। আওয়াজ কেন শুনতে পেলাম না?
হয়তো পা টিপে টিপে এসেছিলো।
অসম্ভব। ধাপগুলো নড়বড়ে, একটা চাপ লাগলেই কাঁচকাঁচ করে ওঠে। আরেকটা প্রশ্ন। মুসা, লোকটা যে ঢুকলো টাওয়ারে, কেন আমাদের হুঁশিয়ার করলে না?
দেখিইনি, সাবধান করবো কি?
ঠিক, আবার বললো কিশোর। তাহলে তুমি কাউকে টাওয়ারে ঢুকতে দেখোনি। আমি আর রবিন তার আসার শব্দ শুনিনি। রান্নাঘরের দরজা ভেতর থেকে ছিটকানি লাগানো।
তাতে কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
তাতে? লোকটা রান্নাঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে সেলারে নামেনি। টাওয়ারের সামনে-পেছনের কোনো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেনি।
কিন্তু সেলারে ঢোকার তো আর কোনো পথও নেই, রবিন বললো।
থাকতে বাধ্য, দৃঢ়কণ্ঠে যেন ঘোষণা করলো কিশোর। অন্তত এখন। ছিলো না বলেই মাটি খুঁড়তে হয়েছে মেজরের চেলাদেরকে।
সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকেছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।
না, সম্ভবত কাটেনি, পরিষ্কার করেছে, শুধরে দিলো কিশোর। অনেক বছর। আগে দুর্গ থেকে বার বার পালিয়েছে বেগুনী জলদস্যু, মনে নেই? কেউ টাওয়ার থেকে তাকে বেরোতে দেখেনি, নিশ্চয় গোপন কোনো পথে পালিয়েছে। এবং সেটা সুড়ঙ্গ ছাড়া আর কিছু না।
এতোক্ষণে মুখ খুললো ভিকটর, কিশোর ঠিকই বলেছে। পুরনো একটা সুড়ঙ্গ আছে টাওয়ার থেকে বেরোনোর। অনেক আগেই ধসে পড়েছিলো, হয়তো নতুন করে খুঁড়ে নেয়া হয়েছে। আমি শুনেছি, আছে, কিন্তু ঠিক কোথায়, জানি না।
খুঁজে বের করে ফেলা যাক, চঞ্চল হয়ে উঠলো মুসা। তাহলেই জেনে যাবো।
সেলারের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে আরম্ভ করলো চারজনে। স্টোররুমে পাইপ আর শিক পাওয়া গেল। ওগুলো দিয়ে দেয়ালে, মেঝেতে বাড়ি মেরে আর খুঁচিয়ে দেখতে লাগলো ওরা। আলগা পাথর কিংবা যা-ই পড়ে থাকতে দেখছে, সরিয়ে ফেলছে।
মেঝেতে পায়ের ছাপ খোজো, পরামর্শ দিলো কিশোর।
কিন্তু মেঝের মাটি এতো শক্ত, পায়ের ছাপ পড়েই না।
এই যে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ভিকটর।
হুড়াহুড়ি করে এলো ছেলেরা। শিক দিয়ে বাড়ি মারলো আবার সে। ফাপা। আওয়াজ বেরোলো দেয়ালের গা থেকে। কিছু পাথর পড়ে আছে জায়গাটার নিচে। সেলারের ম্লান আলোয় পরীক্ষা করে দেখলো কিশোর। কিন্তু দেয়ালে কোনো দরজা কিংবা আলগা পাথর বসানো দেখলো না।
সুড়ঙ্গটা গোপন রাখা হয়েছে, বললো সে, তারমানে মুখটাও গোপন। দরজা-টরজা যদি থাকে, এপাশ থেকে খোলার ব্যবস্থা থাকবে। এবং সেটা খুব : দ্রুত আর সহজে খুলবে, নইলে বেরোতে পারতো না বেগুনী জলদস্যু। রান্নাঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দ্রুত খুলেছে। সিঁড়িটার কাছে দেখা দরকার।
সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ, ওপর-নিচের জায়গা ভালো করে দেখা হলো। জিনিসটা প্রথমে চোখে পড়লো মুসার। অর্ধেক সিঁড়ি নিচে একটা ধাপের তলায় ছোট একটা লোহার আঙটা। ওটা ধরে টান দিতেই দেয়ালের গা থেকে খুলে এলো একটা চ্যাপ্টা পাথর। তার পেছনে দেখা গেল একটা লোহার লিভার, ভালোমতো তেল দেয়া। চাপ দিলো সে। নিঃশব্দে ফাঁক হয়ে গেল সিঁড়ির কাছে দেয়ালের একাংশ।
বাহ, চমৎকার, কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো ভিকটর। এখানে একেবারে। আমার নাকের ডগায় আলি-বাবার সিসেম ফাঁক রয়েছে, আর আমি গর্দভ কিছু জানি না!
স্টোররুম থেকে একটা টর্চ নিয়ে এলো সে। আগে আগে ঢুকে পড়লো। সুড়ঙ্গে। পেছনে চললো তিন গোয়েন্দা। যেমন সরু দেয়াল, তেমনি নিচু ছাত। ওদের মধ্যে মুসাই সব চেয়ে লম্বা, সে কোনোমতে সোজা হতে পারে। দুজন মানুষ। পাশাপাশি চলতে পারে না, শুধু একজনের জায়গা হয়। সুড়ঙ্গমুখের সামান্য ভেতরেই আরেকটা লিভার।
ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার জন্যে নিশ্চয়, কিশোর বললো।
সুড়ঙ্গর ছাত আর দেয়াল পাথরের, তবে পায়ের তলায় মাটি। সর্বত্র ছড়িয়ে। রয়েছে দেয়াল আর ছাত থেকে খসে পড়া পাথর। মিটার বিশেক পরেই ধসে পড়েছে সুড়ঙ্গটা।
বাবার কাছে শুনেছি, ভিকটর বললো, আমার জন্মের আগেই নাকি ভেঙেছে। ওটা। ভূমিকম্পে।
তবে ধসে পড়লেও এখন আর বন্ধ নয়, পথ করা হয়েছে। মোটা একজন। মানুষও ওই ফোকর গলে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারে। মাটি আর পাথর সরিয়ে পথটা করা হয়েছে। তাতে ঢুকে পড়লো চারজনেই, একজনের পেছনে একজন। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো অন্যপাশে। তারপর আবার উঠে দাঁড়ালো। পায়ের বেহলায় পাথরের ছড়াছড়ি। আরও মিটার বিশেক পরে শেষ হলো সুড়ঙ্গ। চারটে ভারি তক্তার ওপর লোহার দণ্ড আড়াআড়ি লাগিয়ে পাল্লামতো তৈরি করা হয়েছে। কজা লাগানো রয়েছে। ঠেলা দিতেই ঝটকা দিয়ে নেমে গেল পাল্লাটা। পুরোটা নামলো না, ঝুলে থাকলো মাঝপথে, দুপাশের দুটো শেকলের ওপর। হেঁটে ওটার ওপর উঠে এলো ওরা। নিচে দেখা যাচ্ছে কালো পানি। সামনে কাঠের দেয়াল, কাঠের ছাত।
বোটহাউসে ঢুকেছি আমরা! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। পিয়ারের নিচে!
ঠিকই বলেছো! ঘাড় নাড়লো ভিকটর।
ওপাশে যেতে হলে সাঁতরাতে হবে, রবিন আন্দাজ করলো।
না-ও লাগতে পারে, বললো মুসা। পিয়ারের নিচে রাতের বেলা পানিতে নামার কথা মনে পড়েছে তার। হয়তো খুব কম। তাহলে হেঁটেই যাওয়া যাবে।
মুসার কথাই ঠিক। নিচে পানি খুব কম। পাল্লাটা আবার আগের মতো করে সুড়ঙ্গের মুখে লাগিয়ে দুপাশের ফাঁকে দুটো কাঠের গোঁজ লাগিয়ে দেয়া হলো। লাগানো ছিলো ওভাবেই।
পানি মাড়িয়ে হেঁটে এসে পিয়ারের ওপর উঠলো ওরা। আলো বেশি নেই। একমাত্র ছোট জানালাটা আর তক্তার ফাঁক দিয়ে যা আলো আসছে। তাতে এতোবড় বোটহাউসের অন্ধকার কাটছে না।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো কিশোর। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, জানা না থাকলে বোটহাউসে ঢুকে ওই সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করা কঠিন। বোঝাই যায় না। মেজর নিরেকের নিশ্চয় জানা ছিলো।
দোকানে একটা নকশা দেখছিলো, মনে আছে? রবিন বললো। মনে হয় ওটাতেই রয়েছে সুড়ঙ্গের নির্দেশ।
হতে পারে, একমত হলো কিশোর।
বনের ভেতর দিয়ে জেটিতে চলে এলো ওরা। প্রথম অভিযান শেষ করে ফিরে এসেছে ব্ল্যাক ভালচার। যাত্রীরা নেমে গেছে, তবে ক্যাপ্টেন ফিলিপ, পিটার আর জেসন এখনও রয়েছে ডেকে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ভিকটরকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। বলে উঠলেন, এই, তোমাদেরকে না বলেছিলাম…
হেসে অভয় দিলো ভিকটর, হয়েছে হয়েছে, ধমকাতে হবে না। ওরা কি করছে, জানি আমি। এখন আমিও চাই রহস্যটার সমাধান হোক। কি যেন নাম বললে? মেজর… মেজর…
মেজর নিরেক, ধরিয়ে দিলো কিশোর। ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো, শো কখন শুরু করেছিলেন, স্যার?
পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে। মোনতা জেসনের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। দূরে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা। দেরিটা হলো ওর জন্যে। ওকে বাদ দিয়েই শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা। তবে শেষ মুহূর্তে এসে হাজির হলো, আমরা তখন প্রথম দ্বীপটার কাছে চলে গেছি।
খবরটা আর চেপে রাখতে পারলো না মুসা। কোথায় খোঁড়া হয়েছে, দেখে। ফেলেছি, স্যার আপনাকে আর পিটারকে কেন সরিয়ে রাখতে চেয়েছে, তা-ও বোঝা গেছে। বোটহাউস থেকে টাওয়ারে ঢোকার একটা সুড়ঙ্গ আছে। ওটার। ভেতরেই খুঁড়েছে ওরা, মাটি আর পাথর পরিষ্কার করেছে।
টাওয়ারে ঢোকার পর থেকে কি কি ঘটেছে খুলে বললো ছেলেরা।
জেসনের দিকে তাকালো কিশোর। আপনার এতো দেরি হলো যে আজ?
গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিলো, বলেই মুখ কালো করে কিশোরের মুখোমুখি হলো নোনতা জেসন। তাতে তোমার কি?
তার কথার জবাব না দিয়ে ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর পোশাকটা কোথায় রাখেন, স্যার?
দ্বীপে। একটা ছাউনিতে। কাজের সময় হাতের কাছে পেয়ে যায় ওরা।
তালা দেয়া থাকে?
নাহ।
তারমানে যে খুশি গিয়ে পরতে পারে?
পারে।
নিরাশ মনে হলো কিশোরকে। পরক্ষণেই উজ্জ্বল হলো আবার চেহারা। যা-ই। হোক, এখন আমরা জানি, কোথায় খুঁড়ছেন মেজর। কি খুঁজছেন জানি না। টাওয়ারে হয়তো লুকানো আছে কিছু। সুড়ঙ্গেও থাকতে পারে। মিস্টার ইভানস, আপনি কিছু জানেন?
শ্রাগ করলো ভিকটর। মুখ বাঁকালো। মাথা নেড়ে বললো, না।
আপনি? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
বেগুনী জলদস্যুর রেখে যাওয়া কোনো জিনিস হয়তো খুঁজছে। লোকে তো ঘাঁটাঘাঁটি কম করেনি একশো বছর আগে। উপদ্বীপের কোথাও খোঁজা বাদ রাখেনি।
তার রেখে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। পরে অবশ্য অনেক চোর-ডাকাত আস্তানা গেড়েছিলো এখানে। তারাও রেখে যেতে পারে কিছু।
রবিন বললো, যা-ই রেখে যাক, এখনও নিশ্চয় আছে। কারণ খোঁজাখুঁজি চলছেই।
হ্যাঁ, কিশোর বললো, কাল রাতেও এসেছিলেন মেজর। মুসা, দেখগে তো পাহারা এখনও চলছে কিনা?
মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুতপায়ে গেটের দিকে রওনা হয়ে গেল গোয়েন্দা সহকারী। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকালো ভিকটর। পাহারা? কিসের পাহারা?
পাহারা দেয়ার লোক রেখে গেছেন মেজর নিরেক, জানালো রবিন। দিন রাত পাহারা দেয় বেগুনী জলদস্যুর আড়া। কখনও একজন, কখনও দুজন, থাকেই। চোখ রাখে।
চোয়াল ডললো ভিকটর। সারাক্ষণই?
এই আরেকটা ব্যাপার, জবাব দিলো কিশোর, আমাকে অবাক করেছে। মেজরের যেন ভয়, এখান থেকে লুকানো জিনিস নিয়ে বেরিয়ে যাবে কেউ। হতে পারে, অন্য কেউও ওই জিনিসের পেছনে লেগেছে। ভয়টা হয়তো সেকারণেই পাচ্ছেন।
বেগুনী জলদস্যুর পোশাক পরা লোকটা না তো? রবিন বললো।
ফিরে এলো মুসা। আইসক্রীম ভ্যানটা আছে।
আজ রাতে আবার গল্প শোনাতে যাবেন, স্যার? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
নিশ্চয় যাবো, বাবার হয়ে আগ বাড়িয়ে জবাবটা দিলো পিটার।
তাহলে, বেশ জোর দিয়ে বললো কিশোর, আজ রাতে আবার আসতে হবে আমাদের। সারাটা রাতই জেগে থাকতে হতে পারে। বাড়ি গিয়ে এখন কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।
ভিকটর আর জেসনের দিকে তাকালো সে। আপনাদেরকে একটা অনুরোধ করবো। আজ রাতে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে আপনাদের। মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি। তখন সাহায্য লাগবে। একা হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারবো না আমরা।
.
১৮.
আবার বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় এসে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা। টর্চ আর ওয়াকি টকি নিয়ে এসেছে। ওরা এসে দেখলো, শেষ শো-এর দর্শকরা বেরিয়ে যাচ্ছে।
ঘন্টাখানেক পর নোনতা জেসন এসে ঢুকলো ট্রেলারে।
নির্দিষ্ট সময়ে গল্প রেকর্ড করার জন্যে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।
সময় হয়েছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।
ট্রেলার থেকে বেরিয়ে ছায়ায় ছায়ায় এগোলো ওরা। কালো কাপড় পরে। এসেছে, প্রহরীর চোখে পড়বে না সহজে।
বোটহাউসে এসে ঢুকলো চারজনে, তিন গোয়েন্দা আর নোনতা জেসন। মই বেয়ে পাল রাখার তাকে উঠে পড়লো রবিন, মুসা আর জেসন। কিশোর নেমে পড়লো পিয়ারের নিচের পানিতে। সুড়ঙ্গমুখের তক্তা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। দ্রুত চলে এলো শেষ মাথায়। লিভার চেপে গোপন দরজা খুলে ঢুকলো টাওয়ারের সেলারে। ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে ভিকটর ইভানস।
তাকের ওপরে ঘাপটি মেরে রয়েছে মুসা, রবিন আর জেসন। জুনের ঠাণ্ডা রাত। বাইরের রাস্তায় গাড়ি চলাচলের শব্দ হচ্ছে। গাঁয়ের ভেতরে একটা কুকুর। ডাকলো। পানির কিনারে দূরে কে যেন গান গাইছে চড়া বেসুরো গলায়। একটা বিমান উড়লো। একটা ভ্যানের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো। শব্দটা এলো। গেটের কাছ থেকে।
খানিক পরে শোনা গেল এঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন। স্নায়ু টানটান হয়ে গেল রবিন। আর মুসার। দম বন্ধ করে ফেললো ওরা। বোটহাউসের বাইরে থামলো গাড়িটা। দরজা খুলে দেয়া হলো, বোটহাউসের ভেতরে ঢুকে পড়লো ওটা। ওপরে নিথর হয়ে আছে তিনজনে। ওয়াকি-টকি নাকের কাছে এনে জোরে জোরে তিনবার। নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। কিশোরের জন্যে মেসেজ।
জবাবে তিনবার টোকার শব্দ হলো। নিজের ওয়াকি-টকির গায়ে টোকা দিয়েছে কিশোর।
দরজা খুলে ভ্যান থেকে নামলেন মেজর নিরেক আর রিগো। টর্চ জ্বেলে নেমে পড়লেন পানিতে। হেঁটে চললেন সুড়ঙ্গের দিকে।
হঠাৎ দড়াম করে গড়িয়ে পড়লো একটা মাস্তুল। এতো জোরে চমকে উঠলো। মুসা আর রবিন, মনে হলো ওদের কানের কাছে বোমা ফেটেছে। মুখ খিস্তি করে গাল দিয়ে উঠলো জেসন। বোধহয় সরতে গিয়েছিলো, নাড়া লেগে পড়ে গেছে মাস্তুলটা।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে টনি, তার টর্চের আলো এসে পড়লো সোজা রবিন আর মুসার ওপর। মেজর আর রিগোর টর্চও ঘুরে গেল এদিকে। একমুহূর্ত থেমে দাঁড়িয়ে দেখলো দুজনে চুপচাপ। তারপর আবার এসে উঠলো পিয়ারে।
নামো! টর্চের আলো নাচিয়ে আদেশ দিলো টনি।
নেমে এলো মুসা আর রবিন।
এই, কোথায় যেন দেখেছি তোমাদের? মেজর বললেন। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তোমরাই সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলে। গল্প শোনাতে এসেছিলে। এখানে কি করছো? আরেকটা ছেলে কই? তিনজন এসেছিলে, মনে আছে।
আ-আ-আমরা… তোতলাতে লাগলো রবিন।
ওপরে আর কেউ আছে কিনা দেখার জন্যে উঠে গিয়েছিলো রিগো, চেঁচিয়ে বললো, আর কেউ নেই, বস।
অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। জেসন গেল কোথায়?
গাধা কোথাকার! ধমক দিয়ে বললেন মেজর, ভালো করে দেখো। নিশ্চয়। আছে আরেকজন। মুসা আর রবিনের দিকে ফিরে বললেন, এবার বলো, এখানে কি করছো।
এমনি, জবাব দিলো রবিন। শো দেখতে এসেছিলাম। বোটহাউসটা চোখে পড়লো। কৌতূহল হওয়ায় দেখতে এসেছিলাম। ওই তাকে উঠেছি দেখার জন্যে। টায়ার্ড লাগছিলো। বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঠিক, তাড়াতাড়ি বললো মুসা, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মই বেয়ে নেমে আসছে রিগো। শেষ কয়েকটা ধাপ নামার আগেই হাত পিছলালো। পুরো বোটহাউসটা কাঁপিয়ে দিয়ে ধুড়ুম করে পড়লো হাত-পা ছড়িয়ে ধাক্কা লেগে চিত হয়ে পড়ে গেল মুসা।
এতোবড় অপদার্থ জীবনে দেখিনি! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন মেজর।
হাস্যকর ভঙ্গিতে উঠে বসলো রিগো। ঘাড় ফিরিয়ে মুসার দিকে তাকালো। সে এখনও উঠতে পারেনি। তাকে টেনে তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর চিৎকার করে বললো, বঅস, চিনেছি! বলেছিলাম না কাল। রাতে চোখ রেখেছিলো? এই ছেলেটাই!
তাই নাকি? চিন্তিত মনে হলো মেজরকে। পকেট-টকেট ঘেঁটে দেখো কি আছে?
বেরোলে তিন গোয়েন্দার কার্ড, টর্চ আর ওয়াকি-টকি। টনি বের করলো বেগুনী জলদস্যু ওগুলো।
কার্ডটা পড়লেন মেজর। গোয়েন্দা! হুমম! এ-জন্যেই আমাদের পেছনে লেগেছো। তোমাদের আরেক সঙ্গী কাছাকাছিই আছে, তোমাদের মেসেজের অপেক্ষায়। একটা ওয়াকি-টকি তুলে নিলো সে। মুখের কাছে এনে কিশোরের উদ্দেশ্যে বললো, যেখানেই থাকো, মন দিয়ে শোনো। তোমার দুই দোস্তকে ধরেছি। কোনো চালাকির চেষ্টা করবে না। আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাবে না। তাহলে তোমার বন্ধুরা মরবে, বিশ্বাস করো কথাটা-মরবে।
.
১৯.
লিভিং রুমে বসে ওয়াকি-টকিতে বোটহাউসের সমস্ত কথাই শুনলো কিশোর আর ভিকটর। পরিষ্কার দেখতে পেলো যেন দৃশ্যটা।
ওয়াকি-টকির সুইচ অফ করে দিয়ে কিশোর বললো, ধরে ফেললো!
শান্ত হও, ভিকটর বললো।
কিছু একটা করা দরকার।
কি করবো? হয়তো…
ঘন ঘন করাঘাতের শব্দ হলো সামনের দরজায়। একটানে পকেট থেকে পিস্তল বের করে সেদিকে এগোলো ভিকটর। হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেললো পাল্লা।
জেসন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পা ভেজা। দ্রুত এসে ঘরে ঢুকলো সে। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বন্ধ করে দিলো দরজাটা। বললো, মেজরের লোকেরা ধরে ফেলেছে ছেলেদুটোকে!
জানি। তুমি পালিয়ে এলে কি করে?
জানালার কাছে বসেছিলাম। তাক থেকে ওটা গলে বেরিয়ে পড়েছি, ব্যাটাদের চোখ এড়িয়ে। পানি ভেঙে পাড়ে উঠেছি।
কপাল ভালো তোমার। যাক, তুমি আসায় ভালোই হলো। একটা উপায় বোধহয় করতে পারবো।
কি করতে চাইছেন, স্যার? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
চলো, জলদি সেলারে চলো!
তাড়াহুড়ো করে সেলারে নেমে এলো ওরা। সিঁড়ির আড়ালে জেসনকে লুকিয়ে থাকতে বললো-ভিকটর।
আপনার প্ল্যানটা কি? জানতে চাইলো জেসন।
হ্যাঁ, কি করতে চান? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
একটা কথা বলা দরকার, ভিকটর বললো। স্বীকারই করে ফেলি। আমি…
গুপ্তধন পেয়ে গেছেন! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর।পাইরেটস কোভে এসেছেনই আপনি সেজন্যে! জানেন, আছে!
হ্যাঁ, কিশোর, জানতাম। ঠিকই বুঝেছো। সাতদিন আগেই বের করে ফেলেছি আমি।
তার মানে টাওয়ারেই ছিলো?
মাথা ঝাঁকালো ভিকটর। ছিলো। এই স্টোররুমেই। পুরনো একটা চীনা আলমারিতে। অনেক আগে বাবার মুখে শুনেছিলাম গল্পটা। বেগুনী জলদস্যু লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলো। এতোদিন নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম বিদেশে, এশিয়ায়। ওখান থেকে ফিরেই চলে এসেছি টাওয়ারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গত হপ্তায় পেয়েছি ওগুলো।
তাহলে কাউকে বললেন না কেন?
সত্যি বলতে কি, আমি এখনও জানি না, আইনত ওগুলো কার প্রাপ্য। যতোদিন সেটা না জানবো, গোপনই রাখতে চাই খবরটা।
এতোদিন পর যার হাতে পড়বে তারই হওয়ার কথা। আর আপনার তো বিশেষ অধিকার রয়েছে। জিনিসগুলো আপনার পূর্বপুরুষের।
চোর-ডাকাত যারই হাতে পড়বে, তার? জেসনের প্রশ্ন।
জানি না, ভিকটর বললো। সেজন্যেই আর কারও হাতে পড়তে দিতে চাই না। অন্তত মেজরের হাতে তো নয়ই।
এখুন প্ল্যানটা কি বলে ফেলুন, তাড়া দিলো কিশোর। সময় বেশি নেই।
সেলারেই ঢুকবে মেজর, কোনো সন্দেহ নেই। খালি হাতে নিশ্চয় আসেনি, পিস্তল-টিল থাকবে। এখানে এসে তোমাকে দেখলে অবাক হবে না। কিন্তু জেসন আছে, কল্পনাই করবে না। সেজন্যেই ওকে সিঁড়ির আড়ালে লুকাতে বলছি। মেজরকে বলবো আমি গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছি। সেগুলো বের করে দিতে বাধ্য করবে আমাকে সে। দেখাতে নিয়ে যাবো। ওই সময়টায় তোমার কথাও হয়তো ভুলে যাবে সে। ওই সুযোগে তুমি বেরিয়ে যাবে স্টোররুম থেকে। বাইরে, থেকে তুমি আর জেসন মিলে দরজাটা লাগিয়ে দেবে। আর তুমি যদি বেরোতে না। পারো, জেসন একাই লাগাবে।
কিন্তু আপনি তো ওদের সঙ্গে ভেতরে আটকা পড়বেন।
আমার কাছে পিস্তল আছে। স্টোররুম থেকে বিরাট একটা পুরনো তালা এনে। জেসনের হাতে দিলো ভিকটর। একেবারে তালা লাগিয়ে দেবে। আমার জন্যে ভেবো না। ওদেরকে ঠিকই আটক করতে পারবো আমি। আটকে রাখবো। তোমরা তখন গিয়ে মুসা আর রবিনকে মুক্ত করবে। ওরা গিয়ে পুলিস নিয়ে। আসবে।
ওই যে, আসছে, ফিসফিস করে বললো জেসন।
যাও, সিঁড়ির নিচে লুকাও গিয়ে। কিশোর, তুমি আমার পেছনে থাকো।
ঘরের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালো ভিকটর। খুলতে আরম্ভ করেছে সুড়ঙ্গের দরজা। বেগুনী জলদস্যু
পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকলেন মেজর আর টনি। ভিকটর আর কিশোরকে দেখেছেন।
তিন নম্বর গোয়েন্দা তাহলে এখানে, মেজর বললেন। গুড। মিস্টার ইভানসও আছেন। আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিলো আমার। যাকগে, খারাপ। হয়নি। মিস্টার ইভানস, কোনো চালাকি চাই না। মালগুলো আপনি পেয়ে গেছেন। জানি। নইলে আমি পেতাম। বলুন, কোথায় সরিয়েছেন?
শ্রাগ করলেন ভিকটর। যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, ঠিক আছে, কি আর করা! ছেলেগুলোর ক্ষতি হোক, এটা চাই না। স্টোররুমে পেছনের দেয়ালের কাছে একটা আলমারি আছে, তার মধ্যে।
উত্তেজনায় হুঁশ হারিয়ে ফেললো টনি। সোজা দৌড় দিলো আলমারির দিকে। বলতে না বলতেই যে এতো সহজে রাজি হয়ে গেছে ভিকটর, কেন হলো, ভাবলো না একবারও। পিস্তল ঢুকিয়ে ফেলেছে হোলস্টারে।
কিন্তু মেজরের মাথা এতোটা ফাঁকা নয়। টনি! বলে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি। মাঝপথে থমকে দাঁড়ালো টনি। ভিকটরের দিকে পিস্তল নাচালেন তিনি। আপনি আগে যান, মিস্টার ইভানস। হাঁটুন।
ঘুরে দাঁড়ালো ভিকটর। ঠিক পেছনেই রইলো টুনি আর মেজর। একবারের জন্যেও তার চওড়া কাঁধ থেকে চোখ সরালেন না মেজর। কিশোরের দিকে নজরই নেই দুজনের কারো।
নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে এলো কিশোর। সিঁড়ির আড়াল থেকে বেরোলো জেসন। দুজনে মিলে, ঠেলে বন্ধ করে দিলো ভারি পাল্লাটা। তালা লাগিয়ে দিলো।
দরজা যে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা বুঝতেও দেরি করে ফেললেন মেজর। তারপর শুরু হলো ভেতরে চেঁচামেচি, হট্টগোল। দরজায় জোর ধাক্কা পড়লো।
তার পর শোনা গেল ভিকট্টর ইভানসের কঠোর কণ্ঠ, খবরদার! পিস্তল ফেলো! নইলে খুলি ছাতু করে দেবো!
চলুন! জেসনকে বলেই আর দাঁড়ালো না কিশোর। সিঁড়ির দিকে ছুটলো।
.
২০.
ভ্যানের ভেতরে পড়ে রয়েছে রবিন আর মুসা। হাত-পা বাঁধা। ওদেরকে পাহারা। দিচ্ছে রিগো। সে নিজেই অস্বস্তিতে ভুগছে, বন্দি পাহারা দেবে কি। তার হাতের টর্চের কাঁপুনি দেখেই বোঝা যায়। মাঝে মাঝেই কিছু না করার জন্যে হুঁশিয়ার করছে বন্দিদের। শেষে একটা খচমচ আওয়াজ শুনে আর থাকতে না পেরে উঠে চলে গেল, বোটহাউসের বাইরে কেউ আছে কিনা দেখার জন্যে।
ফিসফিস করে উঠলো রবিনের ওয়াকি-টকি।
নথি, নিচু গলায় বললো মুসা, কিশোর! দেখো, সুইচটা অন করতে পারো। কিনা! তাহলে ট্রান্সমিট করতে পারবে।
হাত-পা বাঁধার আগে ওদের যার যার জিনিস আবার ফেরত দিয়েছে রিগো।
শরীর অনেক মুচড়ে-টুচড়ে, হাতের আঙুল কোনোমতে সুইচের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো রবিন। কাপড়ের ওপর দিয়েই সুইচ টিপে দিলো। বললো, রবিন বলছি!
রিগো আছে? ভেসে এলো কিশোরের কণ্ঠ।
বাইরে গেছে। কেউ আসছে কিনা দেখতে।
ওকে বলো, মেজর কথা বলতে চায়।
কিন্তু মেজরের কাছে তো ওয়াকি-টকি নেই। ও জানে।
বললো, আমারটা কেড়ে নিয়েছে।
মুসা ডাকলো, রিগো? মেজর ডাকছেন!
দুপদাপ করে ছুটে এসে ভ্যানে ঢুকলো হাতির বাচ্চা। কী?
মেজর আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান, রবিন বললো।
কথা? চারপাশে তাকালো রিগো। মেজরকে দেখতে পেলো না।
ওয়াকি-টকিতে বলবেন, মুসা বুঝিয়ে দিলো।
ওহ্! শরীর ঢিল করলো রিগো। কিন্তু তিনি ওয়াকিটকি পেলেন কোথায়?
আমাদের আরেক বন্ধু আছে না, তারটা কেড়ে নিয়েছেন। সে-ও ধরা পড়েছে। আমাদের মতোই।
ভালো হয়েছে…
হঠাৎ শোনা গেল ভারি কণ্ঠ, এই বলদ, এতো কথা বলছো কেন? কথা বলতে বলেছি, বলো?
অবাক হলো না মুসা আর রবিন। কিশোরের অভিনয় ক্ষমতার কথা জানা, আছে ওদের। তবে রিগো চমকে গেল। ব-ব্বলুন, বস্!
তোতলাচ্ছো কেন, রামছাগল! শোনো, ছেলেদুটোকে আরও শক্ত করে বাঁধো। ওদের ওয়াকি-টকিগুলো কেড়ে নিয়ে চলে এসো আমাদের কাছে, সুড়ঙ্গ দিয়ে। এখুনি। গাধামি করবে না।
না, বস। এখুনি আসছি, বলতে বলতেই রবিনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো রিগো।
তাড়াহুড়োয় রবিন আর মুসাকে আরও শক্ত করে বাঁধার কথাও ভুলে গেল সে। ওয়াকি-টকিদুটো বের করে নিয়েই বেরিয়ে গেল ভ্যান থেকে। মুহূর্ত পরেই পানিতে শোনা গেল তার ভারি পায়ের আওয়াজ।
রিগো বেরিয়ে যাওয়ার মিনিটখানেক পরেই খুলে গেল বোটহাউসের দরজা। ভ্যানে এসে ঢুকলো জেসন। মুসা আর রবিনের বাঁধন খুলে দিলো দ্রুতহাতে। হেসে জানালো, মেজর আর টনিকে কিভাবে স্টোররুমে আটক করেছে।
গুপ্তধন পেয়ে গেছেন মিস্টার ইভানস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
পেয়ে গেছেন। আমিও খোঁজা শুরু করার আগেই।
আপনিই তাহলে বেগুনী জলদস্যু সেজে এসেছিলেন সেদিন। আমাদের ভয় দেখিয়েছেন, মুসা বললো।
একটা জিনিস ফেলে গিয়েছিলাম, আরেক দিকে তাকিয়ে বললো জেসন। সেটা নিতে এসেছিলাম আড্ডায়, রাতের বেলা। বোটহাউস থেকে বেরোতে দেখলাম কয়েকজন লোককে। সন্দেহ হলো। খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। সুড়ঙ্গমুখটা খুঁজে বের করতে দুদিন লেগেছে। লুকিয়ে থেকে শুনে বুঝলাম, কোনো মূল্যবান। জিনিস খুঁজছে ওরা। আমিও ওই কাজে লেগে পড়লাম। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বিশ্বাস করো, কোনো ক্ষতি করতে চাইনি।
বাদ দিন ওসব কথা, রবিন বললো। তাড়াতাড়ি বেরোনো দরকার। রিগো ফিরে আসতে পারে।
টাওয়ারের কাছে অন্ধকারে অপেক্ষা করছে কিশোর। ওদেরকে আসতে দেখেই ওয়াকি-টকির ওপর কুঁকলো। এই গাধা, শুনছো?, বোটহাউসে ফিরে যাও। তোমার আসার আর দরকার নেই। গিয়ে পাহারা দাও ওদের। যদি ওরা পালায়, পিঠের ছাল তুলবো আমি তোমার! জলদি যাও! বলে আপনমনেই নীরবে হাসলো গোয়েন্দাপ্রধান।
কিশোরের কথা মুসার কানেও গেছে। কাছে এসে হাসলো সে। আহারে, বেচারার জন্যে কষ্টই লাগছে আমার!
এখন কি করবো? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
পুলিসের কাছে যেতে হবে, কিশোর জবাব দিলো।
.
পুলিস এসে আটক করলো মেজর নিরেক আর টনিকে। পাহারা দিচ্ছিলো আড্ডার বাইরে গুন, তাকেও ধরলো। কিন্তু রিগোকে ধরতে পারলো না। যেই এসে সে দেখেছে, মুসা আর রবিন নেই, আর দেরি করেনি। ভ্যান নিয়ে পালিয়েছে মেজরের ভয়ে। বোর্টহাউসের দরজা লাগানো ছিলো, সেটা খোলার প্রয়োজন মনে করেনি। গাড়ি দিয়ে গুতো মেরে দরজা ভেঙেই পালিয়েছে।
আলমারি থেকে কালো একটা বাক্স বের করলো ভিকটর। ডালার ওপরে তামার পাত বসিয়ে নাম লেখা রয়েছেঃ লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস। একটা টেবিলে বাক্সটা রেখে ডালা তুললো সে।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা।
গলা বাড়িয়ে এগিয়ে এলো পিটার, ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে।
সোনা আর রূপার নানারকম মূল্যবান অলংকার আর তৈজসপত্রে বাক্সটা। বোঝাই। ঝকঝক করছে ঘরের ম্লান আলোয়।
একটা আঙটি তুলে নিলো কিশোর। বাক্সের গায়ে আঙুল বুলিয়ে দেখলো।
কয়েক লাখ ডলারের জিনিস, বিড়বিড় করলো রবিন।
পুলিসের সঙ্গে ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারও এসেছেন। বললেন, আপনি যখন পেয়েছেন, আপনারই থাকবে জিনিসগুলো। হারানোর ভয় নেই। কারণ আপনি। উইলিয়াম ইভানসের বংশধর। তবে সেটা প্রমাণ করতে হবে আপনাকে কোর্টে। ভালো দেখে একজন উকিল রাখবেন, হয়ে যাবে।
আপনার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, বললো বটে ভিকটর, কিন্তু অস্বস্তি গেল না তার।
বন্দিদেরকে নিয়ে বেরিয়ে গেল পুলিস। ক্যাপ্টেন রইলেন শুধু। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আরেকটা রহস্যের সমাধান করলে। তোমাদের নিয়ে গর্বই হয় আমার। বাড়ি যাবার সময় হয়েছে নিশ্চয়। যাবে না? লিফট দিতে পারি।
আমার তরফ থেকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি ওদের, ভিকটর বললো। চোর গুলোকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে। কাল আসবে, নাকি তোমরা? আমাকে সাহায্য করতে? বাক্সটা সরিয়ে ফেলা দরকার। চোরগুলো জামিনে মুক্তি পেয়েই আবার এগুলো কেড়ে নিতে আসবে।
কাল দুপুরের আগে জামিন পাচ্ছে না ওরা, চীফ বললেন। ততক্ষণে বাক্সটা সরিয়ে ফেলতে পারবেন। কোনো ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে রেখে দিলেই হলো।
কিন্তু রিগো? সে তো ছাড়া রয়েছে। যদি আসে?
ও আসবে না। যা ভীতু লোক। আশা করছি, ওকেও খুব শীঘ্রি ধরে ফেলতে পারবো। আপনার ভয় নেই।
আমরা কি সাহায্য করতে পারি? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
জিনিসগুলোর একটা তালিকা করবো, ভিকটর বললো। তোমরা সাহায্য করলে তাড়াতাড়ি হবে।
তা করতে পারি।
আমিও করবো! বলে উঠলো পিটার। জলদস্যুর লুটের মাল! ঘটতেও ভালো লাগবে আমার!
পিটারের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো ভিকটর। বেশ, করবে। সাহায্য। আমার আপত্তি নেই। বেশি লোক পেলে বরং ভালোই হয়। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরলো সে। তোমাদেরকে একটা করে পুরস্কার দিতে চাই। নেবে তো? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই বাক্স থেকে একটা দামী আঙটি বের করে দিলো মুসাকে।
দ্বিধা করলো মুসা। এভাবে জিনিস নিতে ভালো লাগে না তার। কিশোরের দিকে তাকালো পরামর্শের আশায়। মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আঙটিটা নিলো মুসা। রবিন আর কিশোরকেও একটা করে আঙটি দিলো ভিকটর।
.
২১.
পরদিন সকাল আটটায় লাফিয়ে উঠে বসলো মুসা। কানে আসছে আঁচড়ানোর শব্দ। বিছানায় থেকেই ভালো করে চেয়ে দেখলো, জানালার কাঁচে ঘষা লাগছে হএকটা ডাল। হেসে আবার শুয়ে পড়লো। ঘুম যায়নি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার লাফ দিয়ে উঠলো। তার জানালার কাছে তো কোনো গাছ নেই! বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে এলো জানালার ধারে।
বাইরে ধূসর হয়ে আছে সকালটা। বিষণ। কুয়াশার জন্যে সূর্য উঠতে পারেনি। দেখলো, লম্বা একটা লাঠিতে ডালটা বেঁধে জানালার কাঁচে ঘষছে কিশোর। রবিন দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে। বুঝলো, এরকম কেন করছে। তাকে যেতে বলছে। তার আম্মা দেখে যদি কাজ করার জন্যে আবার তাকে আটকে দেন, সে-জন্যে ঘরে ঢোকেনি ওরা। টেলিফোন করারও সাহস পায়নি।
চুলোয় যাক কাজ! নাস্তা খাওয়ারও দরকার নেই বাড়িতে। বাইরে কোনোখানে খেয়ে নিলেই হবে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে জানালা খুললো মুসা। সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে মায়ের চোখে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। জানালা গলে। বেরিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে এলো মাটিতে।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলো সে।
কিশোর বলছে, ভিকটর ইভানসের কিছু হয়েছে, রবিন জবাব দিলো।
খাইছে! কি হয়েছে?
সাইকেল বের করে নিয়ে এসো, কিশোর বললো। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে ধরা পড়বে। চলো, ভাগি।
হাইওয়েতে ওঠার আগে কথা বললো না কিশোর। তারপর বললো, সকালে পিটার ফোন করলো। ভোরে উঠেই নাকি চলে গিয়েছিলো টাওয়ারে, ভিকটরের মালের তালিকা করতে। উত্তেজনায় সারারাত ঘুমায়নি সে। গিয়ে দেখে ভিকটর নেই। বাক্সটাও নেই। তার পর আমিও চেষ্টা করেছি, ফোনের জবাবই দিলো না কেউ টাওয়ার থেকে।
পালালো নাকি?
না গিয়ে বলতে পারবো না।
বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় পৌঁছে সাইকেল গেটের বাইরে রাখলো ওরা। পিটার ওদের অপেক্ষাতেই ছিলো। দেখেই দৌড়ে এলো। চারজনে মিলে চলে এলো টাওয়ারে। সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকলো কিশোর, মিস্টার ইভানস! মিস্টার ইভানস!
সাড়া এলো না।
এরপর মুসা ডাক দিলো। ঠেলা দিলো দরজায়। পাল্লা ফাঁক হতেই মিয়াও করে বেরিয়ে এলো কালো বেড়ালটা।
ভিকটর নেই ভেতরে, বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। কিশোর। চলো, ঢুকে দেখি।
সারা টাওয়ারে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। গুপ্তধনের বাক্সটাও উধাও।
পালিয়েছে! পিটার বললো।
কাল রাতেই সন্দেহ হয়েছিলো আমার, আনমনে বললো কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার। ভিকটরের স্টাডিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মাঝারি আকারের একটা ঘর। চারপাশে সাজানো বুককেসে অসংখ্য বই। ঘরের মাঝখানে বড় একটা কাউচ, বসে আরাম করে পড়ার জন্যে। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে একটা লেখার টেবিল। তাতে টেলিফোন আছে। এগিয়ে গেল। কিশোর। টেলিফোন সেটটার পাশেই পড়ে আছে একটা প্যাড। তাতে একটা বিচিত্র নকশা। সেটার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো সে। হঠাৎ বলে উঠলো, সী-প্লেন!
কি বললে! মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার! মুসা কিছু বুঝতে পারছে না।
এটা কি? প্যাডে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মনে তো হচ্ছে একটা সী-প্লেনের ছবি, পিটার বললো। নামার জন্যে পনটুন খুঁজছে, এরকম আঁকতে পারলে ভালো হতো।
ভালো আর্টিস্ট হলে সেটা পারতো। ভিকটর তা নয়।
কি বলতে চাইছো? রবিনও বুঝতে পারছে না কিশোরের কথা।
আমি শিওর, যাবার আগে টেলিফোন করেছিলো ভিকটর, কিশোর বুঝিয়ে দিলো। লাইন পেতে দেরি হয়েছিলো হয়তো, কিংবা অন্য কোনো কারণ ছিলো। যাই হোক, আঁকার যথেষ্ট সময় পেয়েছে সে।
এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ফোন করেছিলো ওখানেই! সে জন্যেই প্লেনের ছবি।
হ্যাঁ, নিশ্চয় প্লেনে করে পালিয়েছে ভিকটর। পিটার, তোমার আব্বা কোথায়?
ঘরেই।
জলদি চলো। কুইক!
এতো সকালে গোয়েন্দাদের দেখে অবাক হলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। ভিকটরের নিখোঁজ হওয়ার কথা পিটার তাকে কিছু বলেনি। নেই দেখেই সোজা কিশোরকে বে ফোন করেছে।
সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি।
এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস কটায় খোলে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
আটটা তিরিশে। কেন?
আটটা পঁয়তাল্লিশ বাজে! এখনও হয়তো সময় আছে। জলদি একটা ফোন করুন ওদেরকে। বলুন, ডেঞ্জারাস একটা ক্রিমিন্যাল ওদের প্লেনে করে পালাচ্ছে!
টেলিফোন বুক খুললেন ক্যাপ্টেন। নম্বর বের করে ফোন করলেন। বললেন, একটা সাংঘাতিক অপরাধী পালাচ্ছে। ভিকটরের চেহারার বর্ণনাও দিলেন।
লোকটা জানালো, হ্যাঁ, ওরকম চেহারার একজন লোক বিমান ভাড়া করেছে। নাম, ভিকটর ইভানস। প্লেনে উঠে পড়েছে।
জলদি ঠেকান ওকে! থামান! টেলিফোনেই চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। পাইলটকে বলুন, যাতে না ওড়ে।
দাঁড়ান দেখছি, জবাব এলো অন্যপাশ থেকে। কিছুক্ষণ পর লোকটা জানালো, জবাব দিচ্ছে না পাইলট। বোধহয় পিস্তল দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছে ভিকটর।
পুলিসকে ফোন করবে বলে লাইন কেটে দিলো ট্যাক্সি সার্ভিসের কর্মচারি।
একটা বিমানের শব্দ শেনা গেল। ডক থেকে ওড়ার পাঁয়তারা করছে বিমানটা। ট্রেলার থেকে ছুটে বেরোলো তিন গোয়েন্দা আর পিটার। পেছনে বেরোলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।
ওড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ছোট একটা সী-প্লেন।
আহহা, দেরি হয়ে গেল! হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর। আর ঠেকানো গেল না ওকে!
সেদিকে তাকিয়ে থেকে কি ভাবছেন ক্যাপ্টেন। তারপর বলে উঠলেন, পারবো! এসো! বলেই দৌড় দিলেন জেটির দিকে।
.
২২.
ব্ল্যাক ভালচারের হুইল ধরেছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। এগিয়ে চলেছে জাহাজ। জোর বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেছে পাতলা কুয়াশা। মাস্তুলের ওপরের ক্রো-নেস্টে উঠে বসেছে নোনতা জেসন। ওখান থেকে যা যা দেখবে, চেঁচিয়ে জানাবে। ক্যাপ্টেনকে। জাহাজের গলুইয়ের কাছে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েছে তিন গোয়েন্দা আর। পিটার।
বিমানটা কোন দিকে গেছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মেইন চ্যানেল ধরে সোজা চলে যাবে সাগরের দিকে, পিটার জানালো। ওই লাল আর কালো বয়াগুলোর মাঝ দিয়ে। সাগরের দিক থেকে আসা বাতাসকে কাজে লাগাবে।
ক্রো-নেস্ট থেকে চেঁচিয়ে উঠলো নোনতা জেসন, ডক ছেড়েছে, ক্যাপ্টেন! গতি বাড়িয়েছে!
দূরে দেখা যাচ্ছে সী-প্লেনটা। দমে গেল ছেলেরা। ধরার আশা কম।
পারবো না! নিরাশ হয়ে বললো মুসা। আমরা যাওয়ার আগেই উড়ে যাবে।
পারবো! রবিন বললো। এঞ্জিনের শক্তি বাড়াতে সময় লাগবে।
ধরা কঠিন হবে।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। ধরতে না পারলে আমাদের ওপর দিয়েই উড়ে যাবে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে!
এঞ্জিনের সমস্ত শক্তি নিংড়ে ছুটেছে জাহাজ। বয়ার লম্বা সারির মুখে চলে গেছে বিমানটা। একমাত্র প্রপেলারটা ঘুরতে আরম্ভ করেছে।
পাইলটকে দেখতে পাচ্ছি, কিশোর বললো। পাশের লোকটা::-ভিকটর, কোনো সন্দেহ নেই…।
প্রতি মুহূর্তে বিমানটার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে জাহাজ।
লাল বয়াগুলোর ভেতরে বিমান প্রবেশের মানে হচ্ছে ওড়ার জন্যে অর্ধেক। প্রস্তুত ওটা।
লাল বয়ার সারি পেরিয়ে কালোগুলোতে যখন ঢুকলো বিমান, জাহাজ ডুকে পড়লো চ্যানেলের মধ্যে।
জাহাজে সবাই দম বন্ধ করে ফেলেছে।
পাইলটের শাদা মুখ হাঁ হয়ে গেছে। জানালার কাছে ঝুঁকে রয়েছে ভিকটর, হাতে পিস্তল। জাহাজটা আরো এগিয়ে যেতেই এদিকে সই করে পিস্তল তুললো সে।
শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো সবাই! চিৎকার করে বললেন ক্যাপ্টেন।
গুলি করলো ভিকটর…একবার-দুবার
একটা মুহূর্তের জন্যে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সময়। কিন্তু জাহাজ থেমে নে এগিয়ে যাচ্ছে বিমানটার দিকে, যেন মুখোমুখি ধাক্কা লাগানোর ইচ্ছে।
হঠাৎ শাই করে একপাশে ঘুরে গেল বিমান, একটা কালো বয়ায় লেগে। ছিঁড়ে গেল একটা ডানা। কাত হয়ে গেল একপাশে।
পানিতে লাফিয়ে পড়েছে পাইলট। সাঁতরে সরে যেতে চায় যতো দ্রুত সম্ভব।
পানি ঢুকছে বিমানে। কাত হয়ে ভাসছে এখন। এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ওটার কাছাকাছি এসে গতি কমালো জাহাজ। দড়ি ছুঁড়ে দিলো পিটার। ওটা ধরলো পাইলট।
ভিকটরকে দেখা গেল আরেক দিকে সাঁতরাচ্ছে। দুটো লাইফ বেল্ট বেঁধে নিয়েছে। কালো বাক্সটা ঠেলে নিয়ে সাঁতরাচ্ছে।
দড়ি বেয়ে ডেকে উঠে ধপাস করে গড়িয়ে পড়লো পাইলট। পানি গড়াচ্ছে কাপড় থেকে। কয়েকবার জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, তোমরা আমার প্রাণ বাঁচালে! ওই পাগলটার কাছে পিস্তল আছে। প্লেন চালাতে বাধ্য করেছে ও আমাকে। ধাক্কা লেগে কাত হয়ে না পড়লে কি হতো জানি না! জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিমান চুরমার হয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে শিউরে উঠলো সে। কে লোকটা? ডাকাত-টাকাত?
ডাকাতই, পানির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো কিশোর। ভিকটরের দিকে এগোচ্ছে জাহাজ।
এখনও পালানোর চেষ্টা করছে ভিকটর। কিন্তু বাক্সটা বেশি ভারি। ওটা নিয়ে এগোতে পারছে না তেমন। জ্বলন্ত চোখে ফিরে তাকালো একবার জাহাজের দিকে। বুঝলো, বাক্সটা নিয়ে পালানো অসম্ভব। শেষে ওটা ছেড়ে দিয়ে সাঁতরাতে শুরু করলো।
কিন্তু জাহাজের সঙ্গে সাঁতরে আর কতক্ষণ? হাল তাকে ছাড়তেই হলো। ক্রো-নেস্ট থেকে নেমে এসেছে নোনতা জেসন। পানিতে ঝাঁপ দিতে তৈরি হচ্ছে। তার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসা। তারপর জেসন। শেষে একে একে রবিন, পিটার আর পাইলট। সবাই মিলে ধরে ফেললো ভিকটরকে।
দড়ি নামিয়ে দেয়া হলো। তাতে বাক্সটা বেঁধে দিলো মুসা। কিশোর আর ক্যাপ্টেন মিলে টেনে তুললেন ওটা ডেকে।
ভিকটরকেও তোলা হলো।
দেখাবো, মজা দেখাবো সব কটাকে! নিষ্ফল হুমকি দেয়া শুরু করলো সে।
পাত্তাই দিলো না তাকে কেউ। তবে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখলো, যাতে আবার গিয়ে পানিতে পড়তে না পারে।
জাহাজের মুখ ঘোরালেন ক্যাপ্টেন। বললেন, কিশোর, বলে ফেলো তো এবার সব। এই ভিকটর লোকটা আসলে কে?
আমার ধারণা, চোর, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর। মেজর নিরেকের দলের। লোক।
কি করে বুঝলে? পিটার অবাক।
গুপ্তধনগুলো জলদস্যুদের লুটের মাল নয়। আধুনিক চোরের চোরাই মাল।
কি বলছো? বিশ্বাস করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন।
ঠিকই বলছি। একটা ব্যাপার প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, আপনাকে আর পিটারকে সরিয়ে দেয়ার পরেও চব্বিশ ঘন্টা কেন আড়ার ওপর নজর রাখছিলো মেজরের লোক। এখন জানি। ভিকটরের ওপর নজর রাখা হচ্ছিলো।
ভিকটর! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। ভিকটরকে পাহারা দিচ্ছিলো?
হ্যাঁ, তাই। তবে ভিকটর আমাদেরকে মালগুলো দেখানোর আগে পর্যন্ত সেটা বুঝতে পারিনি।
পরে কি করে বুঝলে? জানতে চাইলো মুসা।
খুব সহজ। বাক্সটা দেখেই বুঝে ফেলেছি। ওটার ওপরে তামা দিয়ে লেখা রয়েছে নাম। অনেক পুরনো হলে ময়লা হয়ে যায় তামা, রঙ বদলে যায়, সবুজ দাগ পড়ে। অথচ এটা একেবারে নতুন, চকচক করছে। আর বাক্সটাও তৈরি হয়েছে প্লাইউড দিয়ে, আগের দিনের মতো ভারি কাঠ নয়। তার ওপর রঙ করেছে। বেশি কাঁচা কাজ করে বসেছে ভিকটর।
বাক্সটা নতুন বলেই যে মালও নতুন, তা কি করে বুঝলে? ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন। নতুন বাক্সে কি পুরনো মাল রাখা যায় না?
যায়। তবে এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আমাকে একটা আঙটি দিয়েছিলো ভিকটর। সেটা আমি জুয়েলারির দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। নতুন। মাত্র কয়েক বছর আগে বানানো হয়েছে। তাতেই বুঝলাম, ভেতরের সব মালই নতুন। জলদস্যুর গুপ্তধন নয়।
কিন্তু কিশোর, রবিন বললো, যদি ওরা জানেই ওগুলো গুপ্তধন নয়, তাহলে…
হ্যাঁ, রবিন, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো কিশোর, ঠিকই ধরেছো। কেন তাহলে বিনা প্রতিবাদে জেলে চলে গেল চোরের দল? পুলিসকে কিছুই বললো না? এই তো? কেন ভিকটরকে মাল নিয়ে পালাতে দিলো, এটাও নিশ্চয় তোমার প্রশ্ন। সহজ জবাব, চোরাই মাল। পুলিশে জেনে গেলেই সব খোয়াতে হতো। তাই চুপ করে গিয়েছিলো মেজর। আর তখনই পুরো সত্যটা বুঝে গেছি আমি।
ভিকটরের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই অবস্থায়ই ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল কিশোরের ওপর। তাকে যখন আটকে ফেলা হলো, গালাগাল করতে লাগলো। চেঁচিয়ে বললো, বিশ্বাস করো না ওর কথা! ওটা একটা মিথ্যুক! সব বানিয়ে বলছে!
কেউ কান দিলো না তার কথায়।
সত্যটা কি, কিশোর? জিজ্ঞেস করলো পিটার।
মেজর নিরেক আর তার চেলারা জানে যে মালগুলো চোরাই। কারণ ওরাই। চুরি করে জমিয়েছে ওগুলো। ভিকটরও জানে। কারণ সে-ও একই দলের লোক। মাল নিয়ে পালিয়েছিলো ভিকটর, সেগুলো খুঁজতেই এসেছে মেজুর আর তার চেলারা। আবার না ওগুলো বের করে নিয়ে ভিকটর পালিয়ে যায়, সেজন্যই দিন রাত তার ওপর চাখ রাখা হতো। আসলে, সমস্ত মাল হাতিয়ে নিয়ে টাওয়ারে এসে লুকিয়েছিলো সে। তার জানা ছিলো, লুকানোর চমৎকার জায়গা ওটা।
তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকে। দলবল নিয়ে পৌঁছে গেছেন তিনি।
সেদিকে তাকিয়ে আরেকবার নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসে উঠলো ভিকটর। চোখ পাকিয়ে কিশোরকে বললো, তোমাকে…তোমাকে দেখে নেবো আমি…
.
কয়েক দিন পর। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে এসেছে তিন গোয়েন্দা, বেগুনী জলদস্যুর কেসের রিপোর্ট নিয়ে।
মন দিয়ে ফাইলটা পড়লেন পরিচালক। তারপর মুখ তুললেন। বুঝলাম। তবে একটা কথা এখানে লেখোনি। কি দেখছিলো সেদিন মেজর? নকশা?
ম্যাপ, স্যার, জবাব দিলো কিশোর। পাইরেটস কোভের। ওতে অবশ্য সুড়ঙ্গটা দেখানো নেই।
কিন্তু রিপোর্টে বলেছে, জানা না থাকলে ওই সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মেজর নিরেক কি করে পেলো?
হাসলো কিশোর। কয়েক বছর আগে একথা ভিকটরই জানিয়েছিলো মেজরকে। পুলিসের ভয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করে আছে তখন ওরা। ভিকটর। অবশ্য তখনও জানতো না, সুড়ঙ্গটা ঠিক কোথায় আছে। গল্প করতে করতে এমনি বলেছিলো আরকি মেজরকে, পূর্বপুরুষের কাহিনী বলতে গিয়ে। তারপর একদিন। মাল হাতিয়ে নিয়ে পালালো ভিকটর। মেজর জানতো না, টাওয়ারটা কোথায়। তবে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেললো। অনেক দিন লেগেছে খুঁজে বের করতে। এসে দেখলো, সত্যি, টাওয়ারেই এসে উঠেছে ভিকটর। বুঝতে অসুবিধে হলো না, মালগুলো টাওয়ারেই লুকিয়েছে ভিকটর। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না মেজর। কারণ তাহলে অন্য জায়গায় মাল সরিয়ে ফেলতে পারে। বোটহাউসে ঢুকে বের। করলো সুড়ঙ্গমুখ। মাটি কেটে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে টাওয়ারে ঢোকার পথ করে। নিলো।
তারপর?
ওরা মালগুলো পাওয়ার আগেই টের পেয়ে গেল ভিকটর, জবাব দিলো এবার রবিন। সতর্ক হয়ে গেল। শেষে মাল নেয়ার জন্যে শেষবার যখন ঢুকলো মেজর আর নিরেক, তখন জেসন আর কিশোরকে নিয়ে তৈরি হয়ে আছে সে, বাধা। দেয়ার জন্যে।
মেজর আর রিগোকে ঠেকালো বটে ভিকটর, রবিনের কথার খেই ধরলো কিশোর, কিন্তু আমরা তখন জেনে গেছি। বুঝলো, শেষ রক্ষা করতে হলে একটাই উপায়, পুলিসের হাতে ধরা দেয়া। ভিকটরকে মালগুলো নিয়ে পালাতে দেয়া। তাহলে শেষমেষ ভাগ একটা পাবার আশা আছে। সেরকমই চুক্তি হয়েছে ওদের মধ্যে, স্টোররুমে।
ওই চুক্তির কোনো অর্থ নেই, মাথা নাড়লেন পরিচালক। ভিকটরকে বিশ্বাস। করা যায় না।
না, তা যায় না, এতোক্ষণে মুখ খুললো মুসা। তবে এছাড়া আর কিছু করারও ছিলো না ওদের। ভিকটর নিয়ে পালালে পাওয়ার কিছুটা অন্তত আশা আছে। কিন্তু পুলিসের হাতে পড়লে একেবারেই নেই। তাই ওই বুদ্ধি করেছিলো।
হু। একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। তাহলে বেগুনী। জলদস্যুর গুপ্তধন আসলেই নেই?
আপাতত তো পেলাম না, মুচকি হাসলো কিশোর। তবে তদন্ত আমরা চালিয়ে যাবো ভাবছি। বলা যায় না, কিছু বেরিয়েও যেতে পারে।