বেঁচে থাকার বিশেষ উপায়
খরচ হয়ে যাওয়া টাকা এক বিশেষ উপায়ে বাঁচায় মানিক সরকার। প্রতিটি টাকাই তার কাছে মূল্যবান। যে রাস্তা বাসে পঞ্চাশ পয়সায় যাওয়া যায়—সেই রাস্তাই উর্মিলা ট্যাক্সি না হলে যাবে না বলে মানিকের ওপর চাপ দেয়। বলে—বাসের পাদানি উঁচু—আমার বয়স হয়েছে—ওই কেঠো বাসের ঝক্কর ঝক্কর আমার সহ্য হয় না।
তখন মানিক তার বউ ঊর্মিলাকে বলে, তাহলে মিনিবাসে চল। আশি পয়সা করে পড়বে মাথাপিছু।
উহু। মিনিবাস ভীষণ দোলে। আমার ভয় করে। অটোতে চল তাহলে। ট্যাক্সির অর্ধেক পয়সায় হয়ে যাবে। অটো নির্ঘাত উল্টোবে। আমি বাপু পারব না। গাড়ি বেচে দিলে কেন? একসময় নিজের গাড়ি ছিল মানিক সরকারের। টানা এগারাে বছর।
মানিক সরকার হাল ছেড়ে বলে, গাড়ি মানেই তাে টেনশন। চলন্ত চালাঘরে বসে সারা পৃথিবী থেকে ডিসকানেকটেড হয়ে যাওয়া। এই ভালাে আছি বেশ।
তা তাে বলবেই। বাসে ট্রামে ভিড়ের ভেতর গুঁতােগুতি না করলে তােমার মন ভরে না।
আমার তাে ব্যায়াম করা হয় না আলাদা করে। এটাই ধর ব্যায়াম। দৌড়ে গিয়ে ওঠা। পেছনে ঝুঁকে নেমে পড়া। হ্যান্ডেল ধরে দুলতে দুলতে যাওয়া—এটাই আমার কসরত। এতেই তাে ব্লাড সুগার কমিয়ে এনেছি একশাে পঁয়তাল্লিশে—
বাসে উঠলেই আমার কোমরের ব্যথাটা ফিরে আসে। বসে থাকতে কষ্ট
হয়।
অগত্যা ট্যাক্সি নেয় মানিক সরকার। উর্মিলার কোমরের এক্সরে ছবি তােলা আছে ঘরে। একখানা হাড়ে ঘুণ ধরে তা বেঁকে পেছনের মাংসে ধনুক হয়ে মুখ গুজড়ে আছে। দেখালে ডাক্তার বলে, শুকনাে জায়গা থেকে ঘুরিয়ে আনুন। এখন আর কাটাছেঁড়ায় যাবেন না।
কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই রােগটার নাম বলে না। বলে, এই বয়সে অপারেশন নাও সাকসেসফুল হতে পারে। আর তাে ক-টা বছর। মেরে এনেছেন প্রায়। জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দিন। আপনার ওয়াইফের তাে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে?
ফিফটি ফাইভ চলছে।
তবে! জীবনের অনেকটাই তাে বেঁচে থেকে ফুরিয়ে ফেলেছেন। এখন বাকি ক-টা বছর ওকে শান্তিতে থাকতে দিন। টাকার শ্রাদ্ধ করেও তাে ফেইলিওর হতে পারে। কী বলেন? | তা তাে বটেই—বলে মানিক ভাবে, মানুষ কতদিন বাঁচে। মানে ঠিক কতদিন তার বাঁচা উচিত। তার নিজের এখন ঊনষাট চলছে। উর্মিলার ব্যথা হয় মাঝে মাঝে। তখন ক্যালসিয়াম ইঞ্জেকশন নেয়। আর ম্যাকেলভিট সিরাপ খায়। ফের চাঙ্গা। কোমরের নীচে পেছন দিকটায় ব্যথা তখন উবে যায়।
বাসে পঞ্চাশ পয়সার রাস্তা ট্যাক্সি নিল আট টাকা। ভাড়া দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানিক সরকার হিসেব কষে। বাসের ষােলােগুণ ভাড়া পড়ল। মানে সাড়ে সাত টাকা বেশি। এভাবে কতবার সে ষােলােগুণ ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে নানাভাবে—সবটাই উর্মিলার জন্যে নয়—কখনাে কখনাে নিজের জন্যেও—তা এই সুদীর্ঘ জীবনের প্রায় গােড়া থেকেই সে হিসেব কষতে চায়। কিন্তু খুব নিকট অতীত ছাড়া কিছুই তার মনে পড়ে না। সবটা একসঙ্গে মনে করতে না পেরে অযথা খরচ হয়ে যাওয়া টাকাগুলাের জন্যে বিরাট এক বিষাদ তার মনে থানা গেড়ে বসে। তখনাে সে অতি নিকটের অযথা খরচা হয়ে যাওয়া সাড়ে সাত টাকা একা একা এইভাবে বাঁচাতে লাগল আর ভাবতে লাগল—না জানি সারা জীবনে আমি কত লক্ষ টাকা এভাবে ট্যাক্সিকে ভাড়া হিসেবে, বাড়ির কাছের মুদিকে মাসকাবারিতে, জুতাের দোকানিকে স্যান্ডেলের দামে, দর্জিকে প্যান্ট সেলাইয়ের জন্যে বাড়তি দিয়ে এসেছি—যে টাকা আর কোনােদিন উদ্ধার করতে পারব না। বড়বাজারে মাসকাবারি, কলেজ স্ট্রিটে স্যান্ডেল, মেটিয়াবুরুজে প্যান্ট করলে কতই না বাঁচানাে যেত।
মানিক সরকার একজন মাননীয় ভদ্রলােক। তাদের একটি টেলিফোনও আছে। সে এই শীতে গত শীতের আলােয়ানের সুখস্পর্শ মনে করার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়। অফিস তাকে রিটায়ারের পরেও অন্তত এক বছর এক্সটেনশন দিতে পারে। রিপাবলিক ডে-র প্যারেড দেখতে সে নেমন্তন্ন পায়। নীচের পাটির একটি কষের দাঁত সে সম্প্রতি তুলেছে। খুব আবেগ হলে গােপনে সে একটু-আধটু কেঁদেও থাকে।
রাজাবাজার-আলিপুর মিনিবাসে টিকিট চাইতে সে মাথা নাড়ল। মানে হয়ে গেছে। খুব গম্ভীরভাবে নােনাপুকুরে নামল। অফিসের পর ছােটোমেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে ২৩৪-এ উঠল! নামল সিঁথিতে। এখানেও টিকিট কাটল না। দু-দফায় আশি পয়সা আর পঁয়ষট্টি পয়সা বাঁচল। ট্যাক্সির অযথা খরচটা তাহলে প্রায় ছ-টাকায় নেমে এল। আঃ! বুক ভরে আনন্দ আর আরামের একটা নিশ্বাস নিল মানিক সরকার। পৃথিবীটা কখনাে কখনাে বড়াে সুখের জায়গা। এখানে একটু চেষ্টা করলেই খরচ হয়ে যাওয়া টাকা এই বিশেষ উপায়ে বাঁচানাে যায়। সিঁথি মােড় থেকে কাশীপুরে মেয়ের বাড়ি রিকশায় দু-টাকা। পথটা হেঁটে মেরে দিয়ে মানিক সরকার দেখল—মন আর শরীর দুই-ই একসঙ্গে তার বেশ ভালাে বােধ হচ্ছে। খরচ হয়ে যাওয়া সাড়ে সাত টাকা একটু চেষ্টাতেই চার টাকায় নেমে এসেছে। আরেকটু অধ্যবসায়—আর একটু পরিশ্রম করলেই—ব্যস।
ফলে এইভাবে সে রােজ নানা পথে বাড়তি খরচ হয়ে যাওয়া টাকাগুলাে স্মৃতির কান ধরে টেনে তােলার চেষ্টা করে। আর তা বাঁচিয়ে তােলার বিশেষ উপায় হিসাবে নানা পথ বেছে নিতে থাকে। খানিকটা বাঁচিয়ে তুলতে পেরে মানিক সরকারের মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে। তার মনে হয়—সে সফল।
বেহালা থেকে মিনিতে উঠে সে আশি পয়সার টিকিট কেটে নােনাপুকুরে নামল। নামার সময় কন্ডাক্টর বলল, আপনি কোত্থেকে উঠেছেন ?
কেন? কালীঘাট—
কন্ডাক্টর সংশয়াচ্ছন্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। এইসব সময় চোখের পলক ফেলতে নেই। মানিক সরকার নির্বিকার মুখে গটগট করে নেমে পড়ল নােনাপুকুরে।
সিগারেট কিনতে গিয়ে দশ টাকার নােট ভাঙানির ভেতর একখানা ছেড়া নােট দিয়েছে দোকানি। সেই নােটখানা অফিসের ক্যাশে দিয়ে মানিক সরকার বলল, অজিতবাবু, এই নােটখানা এসে গেছে মাইনের ভেতর—
তাই নাকি। দিন—পাল্টে দিচ্ছি।
বত্রিশ বছরের যে অফিস থেকে মানিক সরকার পুরােনাে তেঁতুলের গন্ধ পায় সেখানে তার মনটা ছােটো দোয়েল হয়ে উড়তে লাগল। পাঁচ টাকার নােটখানা সিগারেটের দোকানে নিয়ে গেলে কিছুতেই ফেরত নিত না।
টাকাকে ইদানীং তার মনে হয় জেলের জালে পড়া কিছু চকচকে মাছ। এদের সংরক্ষণের জন্যে চাই ব্যাঙ্ক আর মিতব্যয়িতার মতাে যুগল বরফ।
নয়তাে টাকা পচে গিয়ে খরচাই হতে থাকে শুধু। কিংবা খরচা মানেই টাকা পচে যাওয়া। আর বাড়তি খরচ তাে জাল গলে যাওয়া সেইসব মাছ, যারা অন্য মাছদের গিয়ে বলে দেবে—ওদিক যাসনে, জাল ফেলছে মানিক সরকার। নিজেকে তার ইদানীং টাকা ধরার একজন ধীবর বলেই মনে হয়।
উর্মিলা পঞ্চাশ পেরােতে পেরােতে মানিক সরকারের সাংসারিক সব কাজকর্ম—দায়দায়িত্ব মিটে আসে। মেয়েদের বিয়ে—ছেলেদের পড়ানাে—শেষ বয়সে দেখবে বলে দুটো ইনসিওর করানাে—সবই তার সাজিয়ে-গুছিয়ে করা সারা।
শুধু একটা জিনিসই সে বুঝে উঠতে পারছে না। ঠিক কোন সময়ে মরা উচিত। টাকা আছে—আয়ুও আছে তাে ঠিক আছে। কিন্তু আয়ু থাকতে থাকতেই যদি টাকা ফুরিয়ে যায়? যে কেউ তাে পারে। কেননা, কোনাে মানুষই বেঁচে থাকার সবটা জুড়েই আয় করতে পারে না। বয়স, অসুখ-বিসুখ, ক্লান্তি এবং বার্ধক্য তাে আছেই।
উপরন্তু ঊর্মিলার কোমরের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে তাকে যদি আগে তুলে নেয় তাে মানিককে কে দেখবে? কিংবা মানিকই যদি আগে পটল তােলে তাে উর্মিলাকে কে দেখবে?
যদিও এসব কথায় ঊর্মিলা বেশ ঝঙ্কার দিয়েই বলে, কেন? টাকা থাকলে লােক রাখব। নার্স থাকবে।
মানিক সরকার ঊর্মিলাকে ঘাঁটায় না। মনে মনে বলে, ছেলেমানুষ। টাকাও তাে সবটা সব সময় দেখতে পারে না। টাকার দেখাশুনােতেও লােক লাগে।
সে তখন আবারও বিরাট ধাঁধাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। তা হল—ঠিক কোন সময়ে মরা উচিত? ধাঁধাটার কোনাে সমাধান না পেয়ে মানিক সরকার খরচ হয়ে যাওয়া টাকাগুলােকে তার নিজস্ব উপায়ে পড়িমরি করে বাঁচাতে থাকে।
বাসে টিকিট কাটে না। মিনিবাসে মাথা নাড়ে। কাটলেও শর্ট ডিসট্যান্সের টিকিট কেটে লং ডিসট্যান্স পাড়ি দেয়। মাসকাবারি মশলাপাতি কেনে বড়বাজারের কাছাকাছি পুরােনাে টাকশালের ফুটপাথে। জুতাে কেশব সেন স্ট্রিটে দুপুরের নিলাম থেকে।
একদিকে তার মন একা একা যােগ দিতে থাকে। অন্যদিকে বাঁচানাে যেত এমন খরচ হয়ে যাওয়া চকচকে টাকাগুলাের কথা সে খতিয়ে দেখতে থাকে। এই যােগবিয়ােগ আর দেখাদেখিতে সে শেষ পর্যন্ত খেই হারিয়ে ফেলে। কেননা খরচ হয়ে যাওয়া টাকাগুলাে তার মনের সামনে জাল গলে বেরিয়ে—
যাওয়া মাছ হয়ে দাঁড়ায়। আসলে মনে মনে হিসেব করতে গিয়ে মনেই অনেক কিছু হারিয়ে যায়। তখন বিষাদ এসে দাঁড়ায়। ভারী কালাে পর্দার মতাে।
অথচ কয়েক বছর আগেও সে কোনােদিন এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। সে খরচ হয়ে যাওয়া টাকা ফের বাঁচিয়ে তােলার কথা আগে কখনাে ভাবেনি। যা যেত তার দিকে সে কোনােদিন ফিরেও তাকায়নি। বরঞ্চ গতকালের টাকা ছিল তার কাছে পুরনাে টাকা। আজকের টাকা তার কাছে নতুন টাকা। যা কিনা আগামীকালই পুরনাে হয়ে যাবে। উর্মিলা তখন সাংসারিক কোনাে প্রয়ােজনের কথা বললে মানিক সরকার বলেছে—নতুন টাকা আসুক—এলে পর কিনে এনাে। আগামীকালের মতাে তখন টাকাও ছিল নতুন। কেন? কেন এমন মনে হত তখন? | অনেক ভেবে ভেবে সে উত্তরটা পেয়েছে। তখন ছেলেমেয়ে বড়াে করার ছিল। সামনে ছিল অফিসে দু-একটা প্রােমােশন। মানে ভবিষ্যৎ বলে একটা কিছু ছিল। তাই নিত্যদিনের টাকাও তার কাছে নতুন হয়ে আসত—এসে হাতে পড়ে পুরনাে হয়ে যেত। মানিক সরকারও তখন তাদের ভুলেও যেত। তাদের বিলি-ব্যবস্থাও তখন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ত। কেননা, উর্মিলার সারা মাথা তখনাে বেশ কালাে।
আসলে এখন তার কোনাে ভবিষ্যৎ নেই। তাই টাকারও সে কোনাে উনিশ-বিশ দেখতে পায় না। খরচ হয়ে যাওয়া সব টাকাই এখন তাই তার কাছে বাঁচিয়ে তােলার জিনিস।
পঞ্চাশ পেরিয়ে উর্মিলা তার কাছে মাসে একশাে টাকা হাত-খরচ পায়। কেননা, সব টাকা হাতে দিলে সে খরচ-খরচার গােলমাল পাকিয়ে বসে।
একশাের ওপর আরও সত্তর টাকা দিয়েও যখন মানিক সরকার শুনল, দশটা টাকা দাও তাে—তখন সে বলে বসল—কেন?
তােমার ভাইয়ের বউয়েরা তাে সব টাকা নিজেরাই খরচা করে। কোনাে কৈফিয়ত দেয় না কাউকে— | ওদের আয় বেশি। আমার তাে মাপা টাকা ঊর্মি। চাকরিও আছে মােটে অল্পদিন।
শুনে রাখাে। আমিও আর বেশিদিন নেই। আর বড়ােজোর পাঁচ ছ-বছর আছি।
ভেতরে ভেতরে চমকে গেল মানিক সরকার। উর্মিলা তাহলে ওর মৃত্যুর সময়টা জানতে পেরেছে। আশ্চর্য। আমি যে আমারটা কখন—তার কিছুই জানতে পারিনি।
সন্ধেবেলা অফিস ফেরত বাড়ি না ফিরে বাহান্ন বছরের ছােটোভাইয়ের বাড়ি গেল। ছােটোভাই বাড়ির লনে বসে বরফ সােড়া দিয়ে হুইস্কি খাচ্ছিল। দাদাকে দেখে বলল, খাবে?
দে— ওকি? এক তেঁাকে খেয়ে ফেললে? নাঃ! তােমার সঙ্গে খাওয়া যায়
না।
এক টোকে খেলেই তাে কিক পাই। তাই বলে? মানিক সরকার তার পরের দু গ্লাসও খেয়ে ফেলল। তবে এক টোকে নয়। আবার তারিয়ে তারিয়েও নয়। খেয়ে বলল, উঠি রে—
যাবে কীসে? কেন? এত বাস, মিনিবাস চলছে। ট্যাক্সি নাও একটা। ড্রাইভার যে গাড়ি তুলে দিয়ে চলে গেছে।
দিব্যি চলে যাব।—বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল মানিক সরকার। বেশি রাতের ঠান্ডা বাতাস কপালে লেগে তার নেশাটা গাঢ় হয়ে এল। তখন তার মনে পড়ল—আমার তাে কোনাে বন্ধু নেই। আমার কোনাে লক্ষ্যও নেই। হাতে এই যে ঘড়ি আছে—তা থাকা না থাকারই সমান। কেননা, দিন রাত্রি সবই সমান আমার কাছে।
মিনিবাস এসে দাঁড়াতেই মানিক সরকার লাফিয়ে উঠে গেল। ভেতরটা আলােয় উজ্জ্বল। বসার সিট নেই। কিন্তু লােক নেমে যাচ্ছে বলে ভালােভাবেই সে দাঁড়াল। হাতল ধরেই তার নেশাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, একি? আমিও উঠলাম—আপনারাও সবাই নেমে যাচ্ছেন—
যারা বসেছিল তারা ভাবল, কোনাে ক্যানভাসার হবে। ধূপকাঠি কিংবা লজেন্সের। নতুন কায়দায় বক্তৃতা শুরু করবে লােকটা এখন।
দুনিয়া গুলিয়ে ওঠা নেশার ঘূর্ণিতে মানিক সরকার তখনাে বলে চলেছে—এমা! কোনাে দোষ করলাম না তাে? সবাই নেমে যাচ্ছেন যে— | যাদের নামার তারা নামতেই মিনিবাস স্টার্ট নিল। কন্ডাক্টর দেখল, লােকটা তাে ক্যানভাসার নয়। সে বলল, টিকিট?
মানিক সরকার একগাল হেসে বলল, রােজ টিকিট! ভালাে খেলা বের করেছ তাে। ভেবেছ বুঝি না কিছু? আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি—
কন্ডাক্টর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল, মানে? যারা বসেছিল—তারা কেউ কেউ হেসে উঠল। কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিল। একজন বলল, পথেঘাটে আজকাল সর্বত্র মাতাল—
মানিক সরকারের নেশা তখন ঝাঁ ঝাঁ করে ধরে উঠেছে। সে প্যাসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, কেউ ওর ফাঁদে পা দেবেন না। কেউ যেন ভুলেও
টিকিট কাটে। রােজ ভুজুং দিয়ে আমাদের দিয়ে টিকিট কাটায়—ভেবেছ বুঝি না কিছু—
অল্পবয়সি কন্ডাক্টর বলল, টিকিট দিন। মানিস সরকারও হাসি হাসি মুখে বলে, অত বােকা পাওনি আমাদের ভাই! সে গুড়ে বালি।
মিনিবাস ছুটছে। থামছে। আবার ছুটছে। কেউ উঠল। কেউ নামল। দিন দিন—টিকিট দিন। যতই বল—আমরা ভুলছি না ভাই! আজ তুমি ধরা পড়ে গেছ।
সারাটা মিনিবাস হাসির হররায় ফেটে পড়ল। আলাের ভেতর প্যাসেঞ্জারেরা দিব্যি মজা পাচ্ছিল। শুধু একজন বলল, নামিয়ে দিন দাদা। আজ একটু বেশি হয়ে গেছে।
মিনিবাসের পাইলট স্পিড কমিয়ে দিয়ে বলল, থানায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি গাড়ি—তখন সুড়সুড় করে টিকিট দিতে হবে।
প্যাসেঞ্জাররা আপত্তি করল। থানায় যাবেন না। গাড়ি ছাড়তে দেরি করবে। এক মহিলা বলল, নামিয়ে দিন না।
খচ করে মিনিবাস ব্রেক কষেই থামল। থামার ঝেকে টালমাটাল মানিক সরকার দোরগােড়ায় এসে পড়ল।
নামুন। নামুন! আগে নামার জায়গা আসুক
নামুন বলছি—বলে কন্ডাক্টর প্রায় ঝাকুনি দিয়ে মানিক সরকারকে নামিয়ে দিতেই মিনিবাসটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।
অন্ধকারে, আবছামতাে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একবার মানিকের মনে হল, একটা মিনিবাসে যতটা অপমান ধরানাে যায়—তার সবটাই এখন তার পিঠে চাপিয়ে দিয়ে মিনিবাসটা চলে গেছে। একবার এও মনে হল—অপমানের ওজন তাহলে এ-রকম। সে যেন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
কিন্তু এসব ভাবনা কয়েক সেকেন্ড মাত্র থাকল। তার সবটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। অন্ধকারে মনে হল কোথায় যেন ফুল ফুটেছে। তারই গন্ধ আসছে। এক টাকা দশ পয়সা বাঁচানাে গেছে।
কিন্তু এ ভাবও বেশিক্ষণ থাকল না। কেননা, আবছা অন্ধকারে এ জায়গাটা সে চিনতেই পারল না ভালাে করে। মাঝে মাঝে ভিড়ে বােঝাই বাস ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম নেই। ট্যাক্সিও ঊর্ধ্বশ্বাসে। টিমটিম করে রিকশা এগিয়ে আসে—পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় তা অটো হয়ে যায়। হাত তুললেও দাঁড়ায় না।
সদ্য সদ্য এক টাকা দশ পয়সা বাঁচানাের আনন্দ মাঠে মারা যায় যায়। সে একটা টিমটিমে আলাে দেখে ডুবন্ত লােকের মতাে আগাম হাত তুলে চেঁচাতে লাগল, অটোদা–ও অটোদা—
যে করেই হােক তাকে চেনা পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। একটা অটো দাঁড়াতেই সে তার পেছন দিককার অন্ধকারে ঢুকে বসল। বসেই বুঝল, দুজন। মেয়েলােক বসে আছে। মানিক সরকার দেখল, রাস্তার দুধারের দোকানপাট বন্ধ। তাহলে রাত কত এখন? রাস্তায় লােক নেই শীতের জন্যেই বােধহয়।
এইসব ভাবতে ভাবতেই মানিক সরকার টলটল করে উঠল। খােলা অটোয় হু হু করে হাওয়া ঢুকছিল। তখনই তার মনে হল—সে তার দুপাশের আবছা দোকানপাট, পেট্রলপাম্প, দুধের কুঠি একটু একটু চিনতে পারছে।
পাশে তাকিয়ে বুঝল, এত রাতে অটোতে যে দুই মেয়েলােক বসে তারা হয় চালউলি, নয়তাে বাজারে সবজি বেচে ফিরছে। ওদের ব্যবসাপত্তর নিয়ে কথা বলার খুব ইচ্ছে হল মানিক সরকারের। বিশেষ করে ওরা যদি সবজির | লােক হয়ে থাকে তাে সে এখনই লাউয়ের কেজি কত জেনে নেবে। কতদিন লাউ খাওয়া হয় না।
নিজেকে একটু ঘন করে নিয়ে মানিক সরকার বলল, ও মেয়ে ওরা জবাবই দিল না। অটোর আওয়াজে তার গলা ঢাকা পড়ে গেল। তখন মানিক তার একটা আঙুল পেন্সিল করে একজন মেয়ের পিঠে ফোটাল। অ-মেয়ে-এ
কী বেহায়া পুরুষ গাে। অ ড্রাইবর। থামাও—থামাও—
সব বুঝতে পারল না মানিক। অটো থেমে যেতে মেয়েলােক দুজন সামনে গিয়ে বসল। আর ড্রাইভার পেছন ফিরে ধমকে উঠল তাকে, নেমে যান—নেমে যান বলছি—
কেন অটোদা? আমি একটা কথা কইবাে বলে— নামুন বলছি। অসভ্য কোথাকার—
মানিক সরকার নেমে দাঁড়াতেই হুস করে অটো চলে গেল। ভালাে করে তাকিয়ে দেখে—এ যে তাদেরই চেনা রথতলার মােড়। যেখানে নামার কথা
সেখানেই তাকে নামিয়ে দিয়েছে অটোদা। অথচ ভাড়াটা নেয়নি রাগে রাগে। কী যে সুখের সবকিছু ঘটে যাচ্ছে পর পর। ভেবে পায় না মানিক সরকার। দেড়টা টাকা বাঁচিয়ে তােলা গেল এমনিতেই। আদিগঙ্গার একেবারে ঘাড়ের ওপর আস্ত একখানা চাদ। একেই কি বলে নেশা? চাদ এত কাছে?
এখন পায়ে হাঁটলে পনেরাে মিনিট—তবে বাড়ি। রিকশায় লাগে মিনিট তিন-চার। কিন্তু একখানাও রিকশা নেই। পানের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় শুধু কুকুর। কাঠের পুলটা কুয়াশা আর চাঁদের আলােয় এখন ছাই ছাই সিমেন্টের মনে হল মানিকের।
হাঁটতে শুরু করবে মানিক-এমন সময় রিকশাভ্যান এসে মােড় নিল। এগুলােকে এদিকে বাজার গাড়ি বলে। ফুলকপি যায়। ডাবের সময় ডাব।
নেবে ভাই আমায়? একটুখানি যাব— আসুন।
মানিক সরকার পা ঝুলিয়ে বসে বলল, আমি একটা টাকা দিতে পারব। মেটে মসজিদ এলেই নেমে যাব ভাই—
টাকা লাগবে না। বেহালায় ট্রিপ দে আলাম। কী নিয়ে গিয়েছিলে ? লাউ বাবু। টং করে উঠল মানিকের মাথার ভেতরে। কচি ছিল ? কেজি কত করে? আমরা পাইকারি জানি বাবু। খদ্দেরের খুচরাে দর তাে জানিনে— থামাও ভাই। এসে গেছি। থামাও
রিকশাভ্যান থেকে নেমে বাড়ি মানে কয়েক পা। সেটুকুও ফুর্তিতে শিস দিতে দিতে ঘরে ঢুকল মানিক সরকার। ঢুকে দেখল, উর্মিলা কার সঙ্গে হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। কান ফোনে। ঊর্মিলার চোখ তারই দিকে। হাতে রিসিভার চেপে ঊর্মিলা গম্ভীরমুখে জানতে চাইল, এত ফুর্তি? আজও নিশ্চয় ভাড়া দাওনি বাসে?
বাস, মিনিবাস—এমনকি অটোতেও লাগেনি! ছিঃ! ছিঃ! যাতায়াতের দুপিঠ কোথাও ভাড়া দিইনি! ছিঃ ! বেশ কয়েক টাকা বাঁচিয়ে তােলা গেল।
কথা বােলাে না আর কার সঙ্গে কথা বলছ এত রাতে?
ফোনে ওপাশে কাকে হুঁ হ্যা—এসব বলে আবারও উর্মিলা রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে বলল, বেয়ান।—বলেই উর্মিলা কুলকুল করে হেসে উঠল, শুনে অবাক হবে—তােমার ছােটোমেয়ের দিদিশাশুড়ির ফের এই বয়সে দাঁত উঠছে—
বেয়ানের শাশুড়ির? তিনি বেঁচে আছেন নাকি?
তবে বলছি কী! আবারও ছেলেবেলা ফিরে এসেছে বুড়ির। বয়সের গাছ-পাথর নেই। নব্বই-পঁচানব্বই হবে। অনেকদিন হল দাঁত পড়ে গিয়েছিল সব। আবার দাঁত দেখা দিয়েছে কচি কচি তাই নাকি?
ঊর্মিলা গম্ভীর হয়ে বলল, বয়সের চাপে ছােটো হয়ে গেছে বুড়ি। অথচ মৃত্যুর দেখা নেই। কবেই মরে যাওয়া উচিত ছিল। অথচ মরছে না। কে দেখবে
ওকে এখন ? কেউ দেখার নেই। ফের ছেলেবেলা ফিরে এল বুঝি!
মানিক সরকারের নেশা কোত্থেকে বেমালুম মুছে গেল। সারাদিনে বাঁচিয়ে তােলা টাকাগুলাের জন্যে যা কিছু ফুর্তি সব ঝপ করে নিভে গেল। সে বুঝতে চাইল, মানুষের ঠিক কখন মরে যাওয়া উচিত। ঘরের ঠিক মাঝখানে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
উর্মিলা তখনাে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে।