বেঁচে গেল কলকাতা

বেঁচে গেল কলকাতা

এফ এম চ্যানেলের অনুষ্ঠান যে লোকে এত শোনে, সে—সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠান হয়, ‘আজ রাতে’।

বিখ্যাত লেখক, গায়ক, অভিনেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে, তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শ্রোতাদের শোনানো হয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে এই অনুষ্ঠানে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমি বলতে এসেছি।

সদ্য শেষ হয়েছে ফ্রান্সে বিশ্বকাপ ফুটবল। ঘটনার তো শেষ নেই। খবরের কাগজে প্রতিদিন যা লিখেছি, তার বাইরেও অনেক কিছু জানতে আগ্রহী ফুটবলপ্রেমীরা। যাকে বলে ‘আনটোল্ড স্টোরি’। ”আপনি শুধু গল্প বলে যাবেন। যা প্রশ্ন করার আমি করব।” অনুষ্ঠানে নিয়ে আসার জন্য তখন আমাকে এইভাবেই বুঝিয়েছিল শর্মিষ্ঠা। অনুষ্ঠানটা ও—ই পরিচালনা করছে।

সত্যি বলতে কী, আগে কখনও এই ধরনের প্রোগ্রাম করিনি। এফ এম চ্যানেল যে খুব জনপ্রিয়, মাকে দেখে তা বুঝি। আমার স্ত্রী ফুল্লরা অবশ্য ভক্ত টেলিভিশনের। আমার আবার কোনওটাই খুব বেশি শোনা বা দেখার সুযোগ হয় না। খবরের কাগজের লোকদের সময় কোথায়? আমাদের দেশে এখনও, যত লোক খবরের কাগজ পড়েন, তার চেয়েও বেশি লোক টিভি দেখেন। আর যত লোক টিভি দেখেন, তার চেয়েও বেশি লোক রেডিও শোনেন। ‘আজ রাতে’ প্রোগ্রামটা শুরু হওয়ার পর বুঝতে পারলাম, রেডিওর কী মারাত্মক প্রভাব।

শর্মিষ্ঠা মেয়েটার বয়স চব্বিশ—পঁচিশ। চমৎকার কথা বলতে পারে। জীবনে ফুটবল—মাঠে যায়নি। কিন্তু খানিকক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, মেয়েটা বেশ হোমওয়ার্ক করে এসেছে। রেডিও স্টেশনে ঢোকার আগে চিন্তায় ছিলাম, দু’ঘণ্টা সময় কী করে কাটবে। কিন্তু শর্মিষ্ঠা এমন সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটা চালাচ্ছে, আড্ডার মেজাজে সময় কেটে যাচ্ছে।

এই ধরনের প্রোগ্রামে শ্রোতারা ইচ্ছে করলে, ফোনে অতিথিদের সরাসরি প্রশ্ন করতে পারেন। আমাকে কয়েকজন করলেনও। গড়িয়া থেকে একজন তো বলেই ফেললেন, ”কালকেতুবাবু, টিভি—তে বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ মিস করিনি। কিন্তু আপনার লেখাগুলো যেন ছবির মতো। চোখের সামনে যা কিছু, তা সব বুঝতে পারছিলাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

প্রশংসা শুনলে কার না ভালো লাগে? আমারও লাগছে। কথাবার্তার মাঝে একটা গান চালিয়ে শর্মিষ্ঠা ফিসফিস করে আমাকে বলল, ”কালকেতুদা, দুর্দান্ত হচ্ছে। চালিয়ে যান। বাড়ি থেকে আমার বাবা এইমাত্র ফোন করেছিল। আপনার সম্পর্কে বলল, ভদ্রলোকের লেখা পড়েছি। কথা শুনিনি। উনি তো দেখছি, দু’টোতেই সমান দক্ষ।” শর্মিষ্ঠার চোখ—মুখ আনন্দে ঝকমক করছে। অনুষ্ঠানটা ভাল হলে, ওরই সুনাম হবে। আজ স্টুডিওতে ঢোকার আগে ও একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। কে যেন তখন ওকে বলে, ”তোমার প্রোগ্রাম শোনার জন্য স্টেশন ডিরেক্টর রাত বারোটা পর্যন্ত অফিসে থাকবেন। দেখো, যেন ভুলভ্রান্তি কোরো না।” ওই কথা শোনার পর শর্মিষ্ঠা একটু নার্ভাস ছিল।

সামনের বোর্ডটায় লাল—সবুজ আলো জ্বলছে। তার মানে শ্রোতাদের কাছ থেকে ফের ফোন এসে গেছে। আলোটা দেখিয়ে শর্মিষ্ঠা আমাকে বলল, ”দেখছেন, কত ফোন আসছে। শনিবারের রাতে আজ এই প্রোগ্রামটা শুনছেন অন্তত লাখ তিরিশেক লোক। পরে প্রচুর চিঠি আসবে। দাঁড়ান দেখি, এই ফোনটা কে করেছেন।”

শ্রোতার সঙ্গে কথা বলার জন্য শর্মিষ্ঠা হেডফোনটা পরে নিল। চ্যানেলে এখন মান্না দে—র গান চলছে। অন্য কেউ শর্মিষ্ঠার গলা শুনতে পাবেন না। আমি আর অভিজিৎ ছাড়া। স্টুডিওতে আমি আর শর্মিষ্ঠা বাদে রয়েছে অভিজিৎ। আধঘণ্টা অন্তর ও বিজ্ঞাপনের ক্যাসেট চালাচ্ছে। এই ছেলেটা টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করে। গলাটা বেশ ভালো। ছেলেটা একফাঁকে আমাকে বলল, ”আপনাদের কী মজা, তাই না? কত দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, সামনের জন্মে যেন সাংবাদিক হতে পারি।”

এই কথাটা প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়। মনে মনে হাসি। বেড়ানো। একদম হয় না। কাজ নিয়ে আমাদের এমন ব্যস্ত থাকতে হয় যে, বিদেশে গিয়ে কোনও কিছু দেখার সুযোগ হয় না। এ কথাটা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটাই সত্যি। যেমন, দিল্লিতে আমি অন্তত বার পঁচিশ গেছি। তবু আজ পর্যন্ত লালকেল্লার ভেতরে ঢোকার সময় পাইনি। লোকে শুনলে হাসবে, আমেরিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল করে এলাম। নিউ ইয়র্কে রইলাম সাত—আটদিন। অথচ স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখিনি। শেষে নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন যাওয়ার পথে প্লেনের জানলা দিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে হল।

ফোনে কারো সঙ্গে কথা হচ্ছে শর্মিষ্ঠার। সাবধানী মেয়ে। আমাকে ফোন দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছে, প্রশ্নটা কী? শ্রোতা ভদ্রলোক বোধ হয় সরাসরি কথা বলতে চান আমার সঙ্গে। ভদ্রলোকের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু শর্মিষ্ঠার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক জেদ ধরে আছেন। মনে হল, উনি হুমকিও দিচ্ছেন, আমার সঙ্গে কথা না বলতে দিলে উনি ফোন ছাড়বেন না। লাইন জ্যাম করে দেবেন। তা হলে আর অন্য কেউ যোগাযোগ করতে পারবেন না। অগত্যা শর্মিষ্ঠা বলতে বাধ্য হল, ”ঠিক আছে, ধরে থাকুন। গান শেষ হলেই লাইন দিচ্ছি। তবে প্লিজ, কোনো এমব্যারাসিং প্রশ্ন করে আমাকে বিপদে ফেলবেন না।”

মান্না দে—র গান শেষ হতেই শর্মিষ্ঠা ফের নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তারপর বলল, ”শ্রোতা বন্ধুরা, বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে জমজমাট এই অনুষ্ঠানে আপনারা বিশিষ্ট সাংবাদিক কালকেতু নন্দীর মুখে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শুনছেন। আমাদের একজন শ্রোতা প্রশ্ন করতে চান। কই, আপনি কী জিজ্ঞেস করবেন, করুন।”

হেডফোনটা পরে নেওয়ার জন্য শর্মিষ্ঠা আমাকে ইঙ্গিত করল। এবার আমি শুনতে পাচ্ছি। ওদিক থেকে ভদ্রলোক বললেন, ”কালকেতুদা, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?”

”হ্যাঁ, পাচ্ছি। বলুন।”

”আপনার মাধ্যমে একটা কথা আমি সবাইকে জানাতে চাই। আমার নাম জ্যোতি জোয়ারদার। লোকে আমাকে জোজো বলে ডাকে। শোভারাম বসাক স্ট্রিট বলে একটা রাস্তা আছে, আপনি কি জানেন?”

”হ্যাঁ। উত্তর কলকাতায়। বড়বাজার অঞ্চলে।”

”গুড। আপনার কাছে এটাই আমি আশা করেছিলাম। আমি ওই পাড়ায় থাকি। আমার দাদুর নাম হয়তো আপনি শুনে থাকবেন। সুনীতি জোয়ারদার। পঞ্চাশের দশকে খেলতেন।”

”জানি। উনি এরিয়ান ক্লাব থেকে সরাসরি ইন্ডিয়া টিমে ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলেন। রহিমসাহেব ওঁকে খুব ভালোবাসতেন।”

”কালকেতুদা, পঞ্চাশ সালে ইন্ডিয়া টিম একবার ওয়ার্ল্ড কাপে যাবে বলে কিছুদিন কলকাতায় প্র্যাকটিস করেছিল।”

”জানি, রহিমসাহেব সেই ক্যাম্পেই আপনার দাদুকে ডাকেন। টিম যদি যেত, তা হলে অবশ্যই সুনীতি জোয়ারদার সেই টিমে থাকতেন।”

”আপনার মুখে এই কথাটা শুনে ভালো লাগল। যাকগে, যেজন্য ফোন করলাম, সেটা বলি। আমাদের পাড়ায়…বিশ্বকাপ চলার সময়…একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটেছে।”

কথা শুনে মনে হল, পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরের ছেলে। গলায় একটু অভিমানের ছাপ। ছেলেটা কী বলতে চায়, বুঝতে পারলাম না। শর্মিষ্ঠা বাধা দিয়ে বলল, ”বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন থাকে করুন। প্লিজ, অন্য কথা বলবেন না।”

অন্য প্রান্তে জোজো বলে ছেলেটা নাছোড়বান্দা। বলল, ”ঘটনাটা কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়েই। প্লিজ শর্মিষ্ঠাদি, আমাকে বলতে দিন। পাড়ায় আমাদের একটা ক্লাব আছে, ‘আমরা সবাই’। বিশ্বকাপের সময় ক্লাবঘরে আমরা একটা টিভি সেট লাগিয়েছিলাম। রোজ অনেক রাত্তির পর্যন্ত ম্যাচ দেখেছি। রোজই একটু—আধটু চেঁচামেচি হত। পাড়ার কয়েকজন লোক পুলিশের কাছে কমপ্লেন করে। পুলিশ আমাদের একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। ছেলেটা বোধ হয় তর্কাতর্কি করেছিল। তাই পুলিশ বেধড়ক মারে। তেরো—চোদ্দোদিন লক আপে রেখেছিল। একবার করে ছাড়াচ্ছি। আবার ধরছে। সেই ছেলেটা গতকাল লক আপে সুইসাইড করেছে।”

ঘটনাটা শুনে ভুলে গেলাম, কোথায় বসে আছি। পুলিশ লক আপে সুইসাইড, আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশই থার্ড ডিগ্রি দিয়ে মেরে ফেলে। তারপর বলে দেয়, সুইসাইড। কিন্তু সেসব তো দাগী অপরাধীদের ক্ষেত্রে ঘটে। বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা নিয়ে সামান্য ঘটনা থেকে একটা ছেলের মৃত্যু, এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো রহস্য আছে। এটা সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। সঙ্গে—সঙ্গে আমার সাংবাদিক সত্তাটা চাড়া দিয়ে উঠল।

মনে—মনে ঠিক করে নিলাম, কাল সকালে খোঁজ নিয়ে খবরটা বড়ো করে ছাপব। শোভারাম বসাক স্ট্রিট আমার খুব চেনা জায়গা। ছেলেবেলায় আমরা থাকতাম, কাছেই ঢাকাপট্টিতে। তারাসুন্দরী পার্কের গায়ে এখনও আমার এক বন্ধু থাকে। সুকুমার মল্লিক। গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ক্রিকেটার রামপলের অন্তর্ধান রহস্য উদ্ধারের সময় সুকুমার মল্লিকের বাড়িতে গিয়েওছিলাম। সুকুমার অবশ্য থাকে বস্টনে। তবে ওদের পরিবারের অন্যরা নিশ্চয়ই চিনবেন জোজো—কে। তেমন হলে কাল নিজেই চলে যাব শোভারাম বসাক স্ট্রিটে। পুলিশের অত্যচার সহ্য করতে না পেরে একজন ফুটবলপ্রেমী তরুণ আত্মহত্যা করেছে, এটা আমার কাছে বড়ো খবর।

লাইন তখনও ছাড়েনি জোজো। কী বলব, বুঝতে পারছি না। শর্মিষ্ঠা দেখলাম, বেশ অভিজ্ঞ। দরদমেশানো গলায় ও বলল, ”আপনার বন্ধুর মৃত্যু সত্যিই মর্মান্তিক, জোজো। অবশ্য যে—কোনও মৃত্যুই দুঃখের। ফুটবল—মাঠেও আমরা দেখি, মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এবারই যেমন প্যারিসে, ফাইনাল ম্যাচের দিন বিরাট এক অন্তর্ঘাতে শোকাবহ ঘটনা ঘটতে পারত। উগ্রপন্থীরা স্টেডিয়াম উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল। আচ্ছা কালকেতুদা, আপনি তো সেদিন স্টেডিয়ামে ছিলেন। ভয় পাননি?”

আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগে জোজো বলে উঠল, ”দাঁড়ান শর্মিষ্ঠাদি, আমার বক্তব্য এখনও শেষ হয়নি। পুলিশের এই অত্যাচারের বদলা আমরা নিতে চাই। কাল সকাল ন’টার মধ্যে যদি দোষী অফিসার শাস্তি না পান, পুলিশ কমিশনার যদি পাবলিকলি ক্ষমা না চান, তা হলে কলকাতার একাংশ আমরা উড়িয়ে দেব। শুনছেন, কলকাতার একটা অংশ আমরা ধ্বংস করে দেব।”

জোজো কথাটা এমনভাবে বলল যে, আমরা তিনজন চমকে উঠলাম। শর্মিষ্ঠা প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছে। ওর চোখ—মুখ দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। ম্যানেজ করার জন্য আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ”শর্মিষ্ঠা, তুমি যে প্রশ্নটা করলে তার উত্তর দিই। সত্যি বলতে কী সেদিন আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” বলেই আমি সবিস্তারে সেদিনের ঘটনা বলতে শুরু করলাম। পেছন থেকে উঠে এসে অভিজিৎ তাড়াতাড়ি ফোনের সুইচটা অফ করে দিল। আমি কথা বলতে—বলতেই দেখলাম, শর্মিষ্ঠা দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছে। জোজো ছেলেটা ওইরকম একটা হুমকি দেবে, ও ভাবতেও পারেনি। লাখ—লাখ শ্রোতা জোজোর কথা শুনে ফেললেন। অনেকে ভয় পেয়ে যাবেন। এফ এম চ্যানেল এমন একটা মাধ্যম, কলকাতায় এখন অনেকরকম সমস্যা দেখা দেবে।

ফাইনালের দিনের নানা ঘটনা বলে, আমি শর্মিষ্ঠাকে অনুরোধ করলাম, ”অনেকক্ষণ ফুটবল আর ফুটবল হচ্ছে। এবার একটা গান শোনানো যাক। কী বলো শর্মিষ্ঠা?”

নিজেকে চট করে সামলে নিল শর্মিষ্ঠা। দু’একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলে ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একটা রেকর্ড চালিয়ে, আমাকে ভাঙা গলায় বলল, ”খুব বাজে ব্যাপার হয়ে গেল কালকেতুদা, ওই ছেলেটার জন্য আমার কেরিয়ারে বড় একটা স্পট পড়ে গেল। আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে এজন্য।”

বললাম, ”যা হওয়ার হয়ে গেছে। মাথায় রেখো না। এসো, বাকি সময়টুকু আমরা জমিয়ে রাখি।”

দেওয়ালে বড়ো একটা ঘড়ি রয়েছে। তাকিয়ে দেখি, এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। শর্মিষ্ঠা এত মুষড়ে পড়েছে যে, বলেই ফেলল, ”এতদিন ধরে অনুষ্ঠান করছি, কোনোওদিন এরকম বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়িনি। আমার আরও কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিল।”

এই সময় পেছন থেকে অভিজিৎ বলল, ”গানটা শেষ হলেই আমি একবার ব্রেক নেব। তুই রেডি থাকিস শর্মি।”

কথাটা শুনে শর্মিষ্ঠা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ব্রেক মানে কমার্শিয়াল ব্রেক। বিজ্ঞাপন শোনানো হবে শ্রোতাদের। বারদুয়েক বিজ্ঞাপন শোনানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। পাশেই আর—একটা স্টুডিও। মাঝে কাচের দেওয়াল। সব দেখা যাচ্ছে। দেখলাম, দু’তিনজন ভদ্রলোক ওই স্টুডিও থেকে ইঙ্গিতে কী যেন বলছেন শর্মিষ্ঠাকে। ওদের দেখে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে উঠল।

শর্মিষ্ঠার অবস্থা আন্দাজ করতে পারছি। প্রতি অনুষ্ঠানের পর ওদের পারফরম্যান্স বিচার করে মার্কস দেওয়া হয়। সেই কথা ভেবেই ও দমে গেছে। জোজো রসিকতা করেছে না সত্যি সত্যি হুমকি দিয়েছে, সেটা জানা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কিন্তু পাশের স্টুডিওর লোকজনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, শর্মিষ্ঠা মাইনাস মার্কস পাবে। বেচারির খুব ক্ষতি হয়ে গেল। চোখাচোখি হতেই ও বলল, ”এর আগে ইন্দ্রাণীদির প্রোগ্রামে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল কালকেতুদা…সকালে ‘ভোরাই’ অনুষ্ঠানে। একটা মেয়ে ফোন করে বলল, ‘বেহালার ব্রাহ্মসমাজ রোড থেকে বলছি। আমাকে একটা লোক জোর করে আটকে রেখেছে। আমার বাড়ি সাউথ সিঁথি রোডে। ১৩৯ নম্বর। দিদি, আমাকে উদ্ধার করুন। যে লোকটা আটকে রেখেছে, সে মাদার ডেয়ারির ডিপো থেকে দুধ আনতে গেছে। ফাঁক পেয়ে আমি ফোন করছি।”

বাহ, খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। জিজ্ঞেস করলাম, ”তারপর কী হল?”

”ইন্দ্রাণীদি তো অনুষ্ঠান শেষ করেই ছুটল সাউথ সিঁথিতে। বাড়িটা খুঁজে বের করে দ্যাখে, সত্যি মেয়েটা কিডন্যাপড হয়েছে। তিন—চারদিন আগে। মেয়েটার বাবা—মাকে নিয়ে ইন্দ্রাণীদি তখন লালবাজারে যায়। সেদিন বিকেলেই মেয়েটাকে পুলিশ উদ্ধার করে। যাকগে, সেটা না হয় ভাল ঘটনা। কিন্তু আমার অনুষ্ঠানে যা হল, তাতে তো ট্রিমেন্ডাস প্যানিক হয়ে যাবে সারা শহরে।”

শর্মিষ্ঠাকে ভরসা দেওয়ার জন্য বললাম, ”কী বলছ তুমি? সত্যিই কি বিশ্বাস করো, কেউ কলকাতার একাংশ উড়িয়ে দিতে পারে! কলকাতার মতো শহরে সম্ভব?”

”কেন নয় কালকেতুদা? মুম্বই, দিল্লিতে হচ্ছে না? দাঁড়ান তো, দেখি ছেলেটা এখনও লাইনে আছে কি না। ওর চ্যাংড়ামি আমি বের করছি।”

বোর্ডে সুইচ টিপে ফের হেডফোনটা পরে নিল শর্মিষ্ঠা। আমি একটু কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। জোজো ছেলেটা লাইন ছাড়েনি। শর্মিষ্ঠা ওকে ধমক দিচ্ছে। দু’জনের মধ্যে কথা—কাটাকাটি হচ্ছে। এবার আমি হেডফোনটা কানে দিতেই দু’জনের কথা শুনতে পেলাম। সত্যি বলতে কী, ছেলেটার ওপর রাগ হয়ে গেল। শেষে বলে ফেললাম, ”এটা কী ধরনের অসভ্যতা হচ্ছে জোজো? লাইনটা প্লিজ ছেড়ে দাও।”

জোজো দু’তিন সেকেন্ডের জন্য চুপ হয়ে রইল। তারপর আহত গলায় বলল, ”এই কথাটা আপনার কাছে আশা করিনি কালকেতুদা। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। ভেবেছিলাম, আপনি অন্তত অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। জানেন, যে ছেলেটা সুইসাইড করেছে, সে ফ্যামিলির একমাত্র আর্নিং মেম্বার ছিল?”

”কী নাম ছেলেটার?”

”দীপঙ্কর বড়াল। ক্লাবের সেক্রেটারি।”

”ঠিক আছে। কাল আমি নিজে এ—ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজখবর করতে যাব। তুমি কোত্থেকে কথা বলছ জোজো?”

”এখন বলা সম্ভব না।”

”কেন?”

”কারণ আছে। আপনি বোধ হয় এখনও আমার কথায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কিন্তু আবার বলছি, কাল সকাল ন’টার মধ্যে যদি থানার ও সি সাসপেন্ড না হন, সি পি ক্ষমা না চান, তা হলে সত্যিই আমি চরম শিক্ষা দেব।”

জোজো যখন কথা বলছে, তখন ফোনের ভেতরেই আমি জাহাজের ভোঁয়ের মতো একটা আওয়াজ শুনলাম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ”তুমি কি খিদিরপুর অঞ্চল থেকে কথা বলছ?”

জোজো ফের দু’তিন সেকেন্ড চুপ। তারপর বলল, ”আপনার অনুমানশক্তির প্রশংসা করছি কালকেতুদা। ঠিকই ধরেছেন, খিদিরপুরের লাগোয়া একটা জায়গা থেকে কথা বলছি। বুঝতে পারছেন, কত ইম্পর্ট্যন্ট জায়গা এটা? পশ্চিমে সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ, উত্তরে ফোর্ট উইলিয়াম, ইডেন গার্ডেন্স, ইস্টবেঙ্গল— মোহনবাগান মাঠ, পুবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্রসদন, দক্ষিণে চিড়িয়াখানা…এসবের কোনো কিছুরই চিহ্ন থাকবে না কাল সকালের পর। সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে।”

”তুমি কী করতে চাও জোজো?”

”আমি একটা জায়গায় টাইম বোমা রেখে দিয়েছি। রিমোট কন্ট্রোল আমার হাতে। শুধু সুইচ টেপার অপেক্ষা। তারপর একের পর এক ব্লাস্ট হবে।”

জোজোর কথা এবার আমার বিশ্বাস হতে শুরু করল। ব্যাপারটা আর হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। ছেলেটা কথা বলছে খুব ঠান্ডা মাথায়। কোথায় থাকতে পারে ও? ময়দান চত্বরের কোথাও? এত জায়গার নাম বলল জোজো, অথচ রেসকোর্সের কথা উল্লেখ করল না। মনে হল, ও রেসকোর্স থেকে কথা বলছে। কিন্তু রাতে তো রেসকোর্সে সিকিউরিটি থাকে। ও ঢুকল কী করে? নিশ্চয়ই আর্মস দেখিয়ে ঢুকেছে। অসম্ভব কিছু না।

রোজ রাতের দিকে যখন রেসকোর্সের পাশ দিয়ে বাড়ির দিকে ফিরি, তখন দেখি, ওই অঞ্চলটা বেশ ফাঁকা থাকে। কদাচিৎ পুলিশের গাড়ি চোখে পড়ে। রেস কোর্সের উলটো দিকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল। সেই স্কুলের কাছেই একবার ছিনতাই হতে দেখেছি। খিদিরপুর পর্যন্ত রাস্তা একেবারে সুনসান থাকে রাতের দিকে। বিশেষ করে সেকেন্ড হুগলি ব্রিজের নীচে কাছাকাছি হেস্টিংস অঞ্চলটা। ওখানে কেউ কোনো অসামাজিক কাজকর্ম করলে পুলিশের পক্ষে তা খুঁজে বের করা অসম্ভব।

মনে মনে এসব ভাবছি। অভিজিৎ বিজ্ঞাপন শুনিয়ে শর্মিষ্ঠার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। জোজো লাইনে আছে। তবু হেডফোনটা খুলে রাখলাম। শর্মিষ্ঠা এবার প্রশ্ন করবে। অনুষ্ঠানে মন দিলাম। কিন্তু মনের ভেতরে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল। মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এটা ঘটতে দেওয়া উচিত নয়।

শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন করল রোনাল্ডো সম্পর্কে। আমি বলতে শুরু করলাম। অনেকেই রোনাল্ডোর পুরো নামটা জানেন না। আর এও জানেন না, যাকে আমরা রোনাল্ডো বলে জানি, তিনি আসলে হোনাল্ডো। ব্রাজিলের লোকেরা আর—এর উচ্চারণ করেন হ। যেমন, আগের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের যিনি অধিনায়ক ছিলেন, তিনি রাই নন, হাই। রোমারিও আসলে হোমারিও। আমি একজন ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিককে রোমারিওর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি এমনভাবে তাকালেন, যেন নামটা প্রথম শুনলেন। অনেকক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন আসলে আমি রোমারিওর কথা জানতে চাইছি।

এইসব গল্প বলে আমি চলে গেলাম রোনাল্ডোর সঙ্গে মারাদোনার তুলনায়। আর্জেন্টিনার একটা টিভি চ্যানেল আছে, ক্যানাল হান্ড্রেড। তার হয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে প্যারিসে এসেছিলেন মারাদোনা। আমরা অনেক চেষ্টা করেও মারাদোনার কাছে পৌঁছতে পারিনি। তবে আইফেল টাওয়ারে একদিন বেড়াতে গিয়ে মারাদোনার বাবার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। সে এক মজার কাণ্ড। বাবা আর ছেলে দু’জন একই রকম দেখতে। আমরা বাবাকেই ছেলে বলে ঘিরে ধরেছিলাম। টানা পনেরো মিনিট এইসব গল্প বলে অনুষ্ঠানটা জমিয়ে দিলাম।

শর্মিষ্ঠার মুখে হাসি ফিরে এল। ও একটা রেকর্ড চালিয়ে বোর্ডের দিকে তাকাল। লাল—সবুজ আলোটা জ্বলেই রয়েছে। তার মানে ফোনের জন্য কেউ অপেক্ষা করছে। সেদিকে তাকিয়ে শর্মিষ্ঠা বলল, ”কী ছেলে দেখুন, এখনও গোঁ ধরে রয়েছে।”

বললাম, ”লাইনটা আমায় দাও তো। কথা বলি।”

শর্মিষ্ঠা সুইচ টিপতেই আমি হেডফোন পরে নিলাম। তারপর বললাম, ”জোজো, লাইনটা আটকে রেখেছ কেন ভাই?”

”আপনি জানেন না?”

”বললাম তো, কাল সকালে খোঁজখবর নেব। আগে একটা কথা শোনো, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব?”

”লাইন ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবেন তো? ঠিক আছে, ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার এই প্রোগ্রামটা আমরা বেছে নিলাম কেন জানেন?”

”কেন?”

”জানতাম, প্রচুর লোক আপনার কথা শোনার জন্য রেডিওর সামনে বসে থাকবে। আমাদের দাবিটা অনেকের কানে পৌঁছে দিতে পারব। অলরেডি লালবাজারে হইচই পড়ে গেছে।”

”আমাদের বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?”

”মানে, আমরা ছ’জন। এক—একজন এক—একটা দায়িত্ব নিয়েছি। জানি, ব্লাস্ট হলে আমরা কেউ বাঁচব না। তবু প্রতিবাদ রাখছি। ভবিষ্যতে পুলিশের অত্যাচারের হাত থেকে তো লোকে বাঁচবে। সারা পৃথিবী জানুক, পুলিশ কত খারাপ।”

”জোজো তুমি হঠকারিতা করছ।”

”হবে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। কালকেতুদা, আমি ফের আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আপনার সঙ্গে তো সি পি—র খুব চেনাশোনা। ওঁকে বলুন, ক্ষমা চাইতে।”

”তুমি কি আমার ফোন নম্বর জানো?”

”জানি। মোবাইল নম্বরটাও জানি। ওকে, গুড নাইট।” বলেই লাইনটা ছেড়ে দিল জোজো। শর্মিষ্ঠা আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আর মিনিট পঁচিশ বাকি। এইটুকু সময় কাটিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। বাড়ি ফিরতে—ফিরতে রাত প্রায় পৌনে একটা বেজে যাবে। শুতে শুতে দেড়টা। কাল সকাল দশটায় আবার রবীন্দ্রসদনে একটা সেমিনার আছে। প্রদীপ ব্যানার্জি, অমল দত্তদের আমাকে সামলাতে হবে। ফ্রান্স থেকে ফেরার পর বিশ্রাম পাচ্ছি না। লোকে টানাটানি করছে। সবাই বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে শুনতে চায়। একটাই প্রশ্ন আমাদের দেশে ফুটবল এত জনপ্রিয়, সেখানে এমন টিম কেন হয় না, যা বিশ্বকাপে খেলতে পারে?

গান শেষ হতেই ফের প্রশ্নোত্তরের পালা। বিশ্বকাপের পর ছ’জন কোচ খারিজ হয়েছেন। পাঁচজন নিজে থেকে সরে গেছেন। দেশে ফেরার পর দু’জন প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। বিশ্বকাপ শেষ হয়েও, হয় না। তার রেশ চলতে থাকে। কোচদের সম্পর্কে শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন করতেই জিকো, জাগালো, পাসারেল্লাদের কথা বলতে শুরু করলাম। ফের আড্ডার মেজাজ তৈরি হয়ে গেল। আমি বললাম, জিপসি কোচদের সম্পর্কে গল্প বলতে শুরু করলে ভোর হয়ে যাবে। যেমন বোরা মিলুতিনোভিচ, কার্লোস আলবার্তো পাহিরা। এঁরা সব জিপসি কোচ। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে ঘুরে কোচিং করেন। একেবারে যাযাবরের মতো। মিনিটদশেক পর আমি থামতেই শর্মিষ্ঠা বলল, ”কালকেতুদা, প্রাক্তন ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি লাইনে রয়েছেন। ওঁর মুখেও আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে দু’—একটা কথা শুনব।”

হেডফোনটা মাথায় দিতে সুকুমারদার গলা শুনতে পেলাম। উনি ব্রাজিল টিমটার খুব প্রশংসা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ”আচ্ছা, একটু আগে এক ভদ্রলোক ভয় দেখালেন কলকাতার একটা অংশ উড়িয়ে দেবেন। এটা কি সত্যি?”

শর্মিষ্ঠা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”না, না। উনি রসিকতা করছিলেন।”

সুকুমারদা বললেন, ”তাই বলুন। আমরা তো একটু অবাকই হয়ে গেছি। আচ্ছা, ছাড়ি তা হলে। অনুষ্ঠানটা প্রথম থেকে শুনছি। খুবই ভাল লাগছে শুনতে।”

বোর্ডের সুইচ এদিক—ওদিক করে শর্মিষ্ঠা ফের গানের রেকর্ড চালিয়ে দিল। তারপর আমাকে বলল, ”প্রোগ্রাম শেষ হয়ে আসছে। আমি আর একটাই প্রশ্ন করব। ভারতের পক্ষে কি কোনোদিন বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব? কী বলবেন ভেবে রাখুন। মিনিট সাত—আট সময় পাবেন।”

আমি ঘাড় নাড়লাম। এই প্রশ্নটা প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়। দেশে তো বটেই, বিদেশেও। অনেক দেশের লোক জানেও না, ভারতে ফুটবল খেলা হয়। অনেকে জিজ্ঞেসও করে, আপনাদের দেশ তো ক্রিকেট আর হকি খেলে। কই, কোনোদিন তো শুনিনি, ফুটবল খেলে? তখন আমাকে বলতে হয়, ফুটবল কত জনপ্রিয়। এক—একটা ম্যাচ দেখার জন্য কলকাতায় লাখখানেক দর্শকও হয়। প্রোগ্রাম শেষ করার আগে শর্মিষ্ঠা প্রশ্নটা করতেই আমি এক, দুই, তিন করে বলে গেলাম, কীভাবে ভারতের পক্ষে বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব।

কাঁটায় কাঁটায় বারোটায় অনুষ্ঠান শেষ হতে, আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঝাড়া সওয়া দু’ঘণ্টা বসে আছি। শর্মিষ্ঠা আমাকে নড়তে দেয়নি। অভিজিৎ মাইকের সামনে বসে পরবর্তী অনুষ্ঠান সম্পর্কে কি যেন বলল। এফ এম চ্যানেল সারারাত ধরে চলবে। গানের রেকর্ডগুলো গুছিয়ে নিল শর্মিষ্ঠা। ও এখনও মুষড়ে রয়েছে। চোখ—মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। ওকে চাঙ্গা করা দরকার। তাই বললাম, ”চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।” শর্মিষ্ঠা থাকে নিউ আলিপুরে। ওকে নামিয়ে আমি বেহালায় চলে যাব।

অত রাতে আকাশবাণী ভবনে খুব বেশি লোক নেই। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে ডিউটি অফিসারের ঘরে এসে বসলাম। আমাকে দু’—একটা সই করতে হবে। ভদ্রলোকের মুখটা থমথমে। শর্মিষ্ঠা ভয়ে—ভয়েই তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ”প্রোগ্রাম কেমন হল সুবীরদা?”

”ভাল। তবে ডুবিয়ে দিয়েছে ওই ফোনটা। জানো, গত এক ঘণ্টায় অন্তত শ’দুয়েক ফোন পেয়েছি। সবাই জানতে চাইছে, কলকাতা নাকি উগ্রপন্থীদের দখলে চলে গেছে। কত লোক মারা গেছে বলুন তো? ডিরেক্টর তো রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন।”

কথাগুলো শুনে শর্মিষ্ঠার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাল। ডিউটি অফিসার আমাকে হঠাৎ বললেন, ”কালকেতুবাবু, আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে। সি পি অচ্যুতানন্দ মুখার্জি আপনাকে বারদুয়েক ফোন করেছিলেন।”

বললাম, ”তাই নাকি? কী বললেন?”

”আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছেন।”

কথা বলতে—বলতেই ডিউটি অফিসার একটা ফর্ম এগিয়ে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন। তারপর একটা চেক এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”আপনার এই প্রোগ্রামটা আমি রেকর্ড করেছি। ইচ্ছে করলে ক্যাসেটটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন।”

আকাশবাণী ভবন থেকে শর্মিষ্ঠা আর আমি যখন বেরিয়ে এলাম, রাত তখন পৌনে একটা। মারুতিতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের জিপ থেকে নেমে এলেন এক অফিসার। আমাকে বললেন, ”এক্সকিউজ মি, আপনি কি মিঃ নন্দী?”

”হ্যাঁ।”

”সি পি রিকোয়েস্ট করেছেন, আপনাকে একবার আমাদের সঙ্গে লালবাজারে যেতে হবে।”

”কিন্তু…এই ভদ্রমহিলাকে যে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।”

”ও নিয়ে ভাববেন না মিঃ নন্দী। আমরা এসকর্ট করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব ওঁকে। আগে লালবাজার চলুন।”

শর্মিষ্ঠার দিকে তাকালাম। ওর মতামত নেওয়া দরকার। আমি বাড়ি পৌঁছে দেব বলায় ও রেডিওর গাড়ি নেয়নি। বেচারির দেরি হয়ে যাবে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিল শর্মিষ্ঠা। বলল, ”আমাকে আপনার সঙ্গে নেবেন কালকেতুদা? আমি দেখতে চাই, জোজো—রহস্য কী করে আপনি সলভ করেন।”

।।২।।

লালবাজারে যাওয়ার পথেই ফোন পেলাম ফুল্লরার। ও জিজ্ঞেস করল, ”এত দেরি হচ্ছে তোমার ফিরতে? মা এখনও জেগে রয়েছেন।”

বললাম, ”ফিরতে আরো দেরি হবে। সি পি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মাকে বল শুয়ে পড়তে।”

”বুঝেছি। জোজো ছেলেটার ব্যাপারে বুঝি?”

”হ্যাঁ। প্রোগ্রাম কেমন লাগল?”

”ভাল। শর্মিষ্ঠা মেয়েটা তো ফুটবল নিয়ে বেশ খোঁজখবর রাখে!”

”ও আমার পাশেই বসে আছে। কথা বলো।”

মোবাইল ফোনটা শর্মিষ্ঠার হাতে দিলাম। ও ফুল্লরার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। এত রাতে অফিস পাড়ার দিকে আগে খুব কমই এসেছি। জি পি ও, কালেক্টরেট বিল্ডিংস মনে হল প্রেতপুরী। একেবারে নির্জন। এইসব বাড়ি ইংরেজদের আমলে তৈরি। মনে পড়ল বছর দু’য়েক আগে, বেটিং সিন্ডিকেটের নায়ক রাজকুমার কেডিয়ার ভাড়াটে গুন্ডা চার্লস আমাকে কিডন্যাপ করে এই রাস্তা দিয়েই বড়বাজারে নিয়ে গিয়েছিল। তার পরদিন ছিল ইডেনে ভারত—দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ম্যাচ। কেডিয়ার হাত থেকে কীভাবে ভারতীয় দলকে সেবার বাঁচিয়েছিলাম, সেই ঘটনা লিখেছি পরে আনন্দমেলায়।

মিনিট তিন—চারেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লালবাজারে। এখানে মাঝে—মধ্যেই আমাদের আসতে হয়। সি পি অচ্যুতানন্দ মুখার্জি খেলাধুলোয় খুব উৎসাহী। রাজ্য বাস্কেটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট। নিজে এখনও মাঝে—মধ্যে টেনিস খেলতে যান সাউথ ক্লাবে। প্রায়ই আমার সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। অন্যদিন লালবাজারে এলে সোজা দোতলায় ওঁর ঘরে চলে যাই। আজ অফিসার ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন কনফারেন্স রুমে। শর্মিষ্ঠা বসে রইল একতলায় রিসেপশনে।

কনফারেন্স রুমে দেখা হতেই সি পি বললেন, ”সরি কালকেতু। এভাবে নিয়ে আসার জন্য আশা করি তুমি কিছু মনে করোনি।”

বললাম, ”না, না। আপনি এত সঙ্কোচ করবেন না।”

”প্রথমে ভেবেছিলাম, পুরো ব্যাপারটা হোক্স। কিন্তু আমাদের ওয়াচাররা যা খবর দিয়েছে, তাতে দেখছি সিরিয়াস ব্যাপার।”

”আপনি জানলেন কী করে মিঃ মুখার্জি?”

”আরে, বাড়িতে বসে তোমার প্রোগ্রাম শুনছিলাম। তারপর কন্ট্রোল রুম থেকে খবর গেল, হেস্টিংস থানা এরিয়ায় কিছু ছেলেকে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”

”আপনার ওয়াচাররা কী খবর দিয়েছে?”

”পরে ব্রিফ করছি। হোম সেক্রেটারি আসছেন। আরও কয়েকজনকে ডেকেছি। খুব অ্যালার্মিং সিচুয়েশন।”

”রেডিও স্টেশন থেকে ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি দু’বার কথা বলেছি।”

”কী বলল?”

”পুলিশের ওপর রাগ।”

”কেন?”

আমি অল্প কথায় জোজোর ক্ষোভের কারণগুলো বললাম সি পি—কে।

সব শুনে উনি বললেন, ”আই সি।” তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে কাকে যেন নির্দেশ দিলেন, ”বড়বাজার থানার ও সি—কে দু”মিনিটের মধ্যে ধরে দিন।”

সি পি রিসিভার ক্রেডেলে রাখতেই ঘরে ঢুকলেন তিন—চারজন। কাউকেই চিনি না। বেশ লম্বা—চওড়া এক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন, ”স্যার, আমি ফায়ার ব্রিগেডের ডিরেক্টর মণিলাল সমাদ্দার।” বলেই তিনি হ্যান্ডশেক করলেন সি পি—র সঙ্গে। অন্য দু’জন অবশ্য হাত তুলে নমস্কার করলেন। একজন বললেন, ”আমি প্রফেসর দিবাকর চ্যাটার্জি। সায়েন্স কলেজে পড়াই। ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমোস্ফেয়ারিক সায়েন্স—এ।” কথাটা বলেই তিনি হাই তুললেন। দেখেই বুঝলাম, ভদ্রলোককে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে। এই ভদ্রলোকের লেখা আনন্দমেলায় পড়েছি। তেলের খনিতে বোমা বিস্ফোরণ নিয়ে একটা কভার স্টোরি লিখেছিলেন। সেই সময় আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল ইরাকের। আমেরিকান সৈন্যরা ইরাকের অয়েল রিজার্ভারেও ক্রমাগত বোমা ফেলে যাচ্ছিল তখন।

তৃতীয় ভদ্রলোক বেশ বয়স্ক। সি পি—কে বিড়বিড় করে কী যে তিনি বললেন, বুঝতে পারলাম না। সি পি তাঁকে খুব সম্মান দিয়ে বললেন, ”আপনি বসুন। আমার সৌভাগ্য আপনার সঙ্গে আজ পরিচয় হয়ে গেল।”

ওঁরা তিনজন চেয়ারে বসার পর টেলিফোনটা বেজে উঠল। সি পি রিসিভারটা তুলে কী শুনে বেশ রুক্ষ গলায় বললেন, ”ও সি নেই? ঠিক আছে। ডিউটি অফিসার যিনি আছেন, তাঁকে বলুন… রিসেন্টলি শোভারাম বসাক স্ট্রিটে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে যে টেনশন হয়েছিল, তার সব ফাইল নিয়ে আসতে। লালবাজারে এসে যেন ইমিডিয়েটলি আমার সঙ্গে দেখা করে।”

শুনেই বুঝতে পারলাম, বড়বাজার থানার সঙ্গে কথা বললেন সি পি। কনফারেন্স রুমে এসে পড়লেন হোম সেক্রেটারি অর্চিষ্মান সেন। সঙ্গে আরও এক ভদ্রলোক। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মিটিং শুরু করে দিলেন অর্চিষ্মানবাবু। সি পি জোজো ছেলেটার হুমকি এবং ওয়াচারদের কথা বলতে অর্চিস্মানবাবু খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ”জানি, ছেলেটা কোত্থেকে অপারেট করছে, সেটা বলুন।”

সি পি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ”ঠিক কোথায় আছে, তা এখনও জানা যায়নি সার। আমাদের মনে হয়, ময়দানের কোথাও থেকে।”

”কী করে জানলেন?”

”হেস্টিংস থানার ওয়াচাররা একটু আগে খবর দিয়েছে। সেকেন্ড হুগলি ব্রিজের কাছাকাছি অঞ্চলে কয়েকটা ছেলে আর্মস নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল রাত ন”টা নাগাদ। তারপর তারা গায়েব হয়ে যায়। থানা থেকে ফোর্স পাঠানো হয়েছিল। কোনো ট্রেস করা যায়নি।”

”সারপ্রাইজিং!”

”আসলে স্যার, ওই সময়টায় হঠাৎ খুব লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেকের জন্য। তখন কিছু কমপ্লেন আসে।”

”কী কমপ্লেন?”

”পেট্রোল ট্যাঙ্কারের কয়েকজন ড্রাইভার থানায় গিয়ে অভিযোগ করে… পাঁচ—ছ’জন ছেলে…অ্যাট দ্য গান পয়েন্ট, ট্যাঙ্কার থামিয়ে…মারধোর করে তাদের ভাগিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাগুলো ঘটেছে রেসকোর্সের আশেপাশে। তখনই ওয়াচারদের পাঠানো হয় স্যার।”

”অ্যাটাকটা পেট্রোল ট্যাঙ্কারের ওপর কেন?”

”সেই মোডাস অপারেন্ডি বোঝা যাচ্ছে না সার। আসলে রাতের দিকে রোজ ওই সময় প্রচুর ট্রাক আসে পেট্রোল নিয়ে। হলদিয়া থেকে উলুবেড়িয়া হয়ে।”

”ট্যাঙ্কারগুলো কোথায়?”

”লোকেট করার চেষ্টা চলছে সার।”

”কী বলছেন আপনি? অত বড়ো ট্যাঙ্কার এক—একটা…যাবে কোথায়?”

অর্চিষ্মানবাবুর গলায় বিরক্তির ছাপ। উত্তর দিতে না পেরে সি পি চুপ করে রইলেন। কনফারেন্স রুমে পিন পড়লে আওয়াজ পাওয়া যাবে, এমন নিস্তব্ধতায় আমি বললাম, ”এমনও হতে পারে, ট্যাঙ্কারগুলো ছিনতাই করা হয়েছে ব্লাস্ট করানোর জন্য।”

ঘরের মধ্যেই যেন বিস্ফোরণ হল। অর্চিষ্মানবাবু আর সি পি মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলেন। তারপর অর্চিষ্মানবাবুই বললেন, ”ইউ মে বি রাইট মিঃ নন্দী।”

বললাম, ”এক—একটা ট্যাঙ্কারে প্রায় দশ—বারো হাজার লিটার পেট্রোল থাকে। এরকম দশ—পনেরো ট্যাঙ্কার যদি একসঙ্গে কেউ ব্লাস্ট করিয়ে দেয়, তা হলে মারাত্মক ব্যাপার হবে।”

অর্চিষ্মানবাবু সি পি—কে জিজ্ঞেস করলেন, ”মোট ক’জন ড্রাইভার থানায় কমপ্লেন করেছে জানেন?”

”পনেরোজন হবে।”

”ঠিক সংখ্যাটা বলুন। এর ওপরই সব নির্ভর করছে।”

”বাইরে হেস্টিংস থানার ও সি অপেক্ষা করছেন। ডেকে নিচ্ছি সার। উনিই এগজ্যাক্ট ফিগারটা বলতে পারবেন।”

দরজার কাছে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। সি পি ইশারা করতেই তিনি বাইরে চলে গেলেন। আমি চোখ বুজে পুরো পরিস্থিতিটা ভাবতে লাগলাম। জোজো ছেলেটা ফাঁকা আওয়াজ দেয়নি। পরিকল্পনা করেই এগিয়েছে। ময়দান অঞ্চলটা এমনি—এমনি বাছেনি। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ওই অঞ্চলে সন্ত্রাস করা সম্ভব। পনেরো—ষোলোটা ফাঁকা মাঠ। ঘন অন্ধকার। বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঝখানে বসে যদি পাঁচ—ছ’টা ছেলে কিছু কু—মতলব আঁটে, তা হলে টহলদারি পুলিশের পক্ষে তাদের ধরা সহজ নয়। জোজো অবশ্য ফাঁকা মাঠ থেকে আমাকে ফোন করেনি। নিশ্চয়ই এমন কোথাও থেকে করেছে, যেখানে ফোন আছে। ময়দানের কোনও ক্লাবের তাঁবু থেকে করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে জাহাজের ভোঁ শোনা যাবে না। তা হলে কি রেসকোর্সের ভেতর থেকে? হতে পারে। ওখানে পেট্রোল ট্যাঙ্কার ঢুকিয়ে দিলে বাইরে থেকে তা চট করে দেখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, লোডশেডিংয়ের সময় তো নয়ই।

হেস্টিংস থানার ও সি বিপ্লবকেতন দাস ঘরে ঢুকে স্যালুট করলেন সি পি আর অর্চিষ্মানবাবুকে। খটাস করে শব্দ হওয়ায় চোখ খুললাম। ভদ্রলোককে আমি চিনি। প্রায়ই আসেন ফুটবল—মাঠে। বেশ দক্ষ অফিসার। সি পি জিজ্ঞেস করলেন, ”বিপ্লববাবু, ক’জন ট্যাঙ্কার—ড্রাইভার কমপ্লেন করেছে থানায়?”

”তেইশজন স্যার। এইমাত্র খবর পেলাম।”

”কারা এটা করছে জানেন? তারা কি লোকাল রাউডিজ?”

”না সার। আউটসাইডার। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার, ওরা কয়েকটা এল পি জি বাল্কও রেসকোর্সের ভেতরে নিয়ে গেছে। এই খবরটা পেলাম এক ড্রাইভারের মুখে।”

শুনে অর্চিষ্মানবাবু বললেন, ”মাই গড! একটা এল পি জি বাল্কে এক্সপ্লোশন হলে…ডিভাস্টেটিং ব্যাপার হবে।”

”হ্যাঁ স্যার। ওগুলো আসে উলুবেড়িয়ার একটা প্ল্যান্ট থেকে। সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ দিয়ে। ছেলেগুলো অ্যাপ্রোচ ব্রিজের নীচে দাঁড় করিয়ে, তারপর ছিনতাই করেছে।”

”আপনি শিওর, ওরা রেসকোর্সে আছে?”

”একশোভাগ শিওর স্যার।”

”আমাদের ফোর্স কি পাঠানো যাবে?”

”রিস্কি হয়ে যাবে স্যার। রেসকোর্সের চারদিকে চারটে ওয়াচ টাওয়ার আছে সার। প্রতিটি টাওয়ারে ওদের লোক আছে। নজর রাখছে। ওদের ওভার পাওয়ার করতে গেলে, আননেসেসারি এক্সপ্লোশন হতে পারে।”

”ঠিকই বলেছেন। দ্যাট উড কস্ট ডেথ অ্যান্ড ডিভাস্টেশন।”

”একটা কথা বলব সার? গ্যাং লিডার ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা দরকার।”

”কীভাবে?”

”রেসকোর্সে একটা ফোন করা যাবে?”

”দেখুন চেষ্টা করে।”

বিপ্লবকেতনবাবু ফোন তুলে চেষ্টা করতে লাগলেন। ঘরে অন্যরা সবাই চুপ করে আছেন। প্রোফেসর দিবাকর চ্যাটার্জি বললেন, ”মিঃ মুখার্জি, আমি একটা কথা বলতে চাই।”

”বলুন।”

”এতক্ষণ আপনাদের আলোচনা শুনলাম। আমার মনে হয়, ছেলেগুলো যা বলছে, তা যদি সত্যি—সত্যি করে, তা হলে কিন্তু বিধ্বংসী একটা ব্যাপার হবে। মারাত্মক হল এই এল পি গ্যাসের বাল্কগুলো। এক—একটাতে তেইশ মেট্রিক টন করে লিকুইড গ্যাস থাকে। অর্থাৎ কিনা তেইশ হাজার লিটার গ্যাস। একসঙ্গে যদি তা ব্লাস্ট করে, তা হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন? রান্নার জন্য আমরা যে সিলিন্ডার ব্যবহার করি, তাতে থাকে মাত্র এক লিটার গ্যাস। সেটা ব্লাস্ট করলে ছাদ ফুটো করে বেরিয়ে যায়। আর তেইশ হাজার লিটার গ্যাস…বুঝতে পারছেন, বাতাসে আগুন ছড়িয়ে যাবে। ছেলেটা সত্যিই বিপদে ফেলে দেবে আমাদের।”

প্রোফেসর চ্যাটার্জির কথার গুরুত্ব বুঝে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। সি পি বললেন, ”ব্লাস্ট হলে আমরা কীভাবে পরিস্থিতিটা সামলাতে পারব প্রফেসার চ্যাটার্জি?”

”আগে ব্লাস্ট হলে আরও কী হতে পারে তা দেখা যাক। তারপর ভাববেন সামলানোর কথা। এই যে এত পেট্রোল ট্যাঙ্কারের কথা শুনলাম, এক্সপ্লোশন হলে, যে স্মোক হবে, তাতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। অ্যাটম বোমার সেই ধোঁয়ার চেহারাটা মনে পড়ছে কি আপনাদের? ব্যাঙের ছাতার মতো সেই ধোঁয়া? আমরা যাকে বলি মাশরুম, তা আকাশে থেকে যাবে। কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড এবং আরো বিষাক্ত জিনিস আশপাশের বহু প্রাণীর জীবনহানি ঘটাবে। ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার কথা মনে আছে? সেই ঘটনাও নস্যি মনে হবে তখন।”

অর্চিষ্মানবাবু ঘামছেন। রুমালে নাকের ডগা মুছে উনি বললেন, ”সর্বনাশ! এসব আপনি কী বলছেন?”

”যা বলছি বা আন্দাজ করছি, তা খুব কম করে। স্ট্র্যাটেজিক্যালি ছেলেগুলো একটা দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছে অর্চিষ্মানবাবু। প্রথমত, ওরা ট্যাঙ্কার আর বাল্কগুলো ধীরে—ধীরে জড়ো করতে পেরেছে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে। দ্বিতীয়ত দেখুন, কত ইম্পর্ট্যন্ট জায়গা ওটা। এক—দেড় কিলোমিটার রেডিয়াসে কত কী আছে। কত দেখার জায়গা…কত হাসপাতাল। বিস্ফোরণ হলে এসবের কিন্তু অস্তিত্ব থাকবে না।”

”মাই গড!”

”আর—একটা বিপদের কথা তো বলিইনি। ওই মাশরুম স্মোকের কথা। তার বেড় হবে পশ্চিমে হাওড়া, পূর্বে ইস্টার্ন বাইপাস, উত্তরে শ্যামবাজার আর দক্ষিণে রাসবিহারী পর্যন্ত। ভাবুন, কত লাখ লোকের বাস এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। বিষাক্ত দূষণে প্রচুর লোক মারা যাবেন। শ্বাসকষ্টে ভুগবেন। কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।”

এবার দেখলাম, সি পি—ও রুমাল বের করে ঘাম মুছতে শুরু করলেন। ভদ্রলোকের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মাসদুয়েক আগে উনি পুলিশ কমিশনারের পদে এসেছেন, ওঁর আমলে এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটলে এই পদে থাকতে পারবেন কি না সন্দেহ। মুখ মুছে সি পি বললেন, ”আর কী হতে পারে প্রোফেসর চ্যাটার্জি?”

”আগুন কয়েক মাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। অক্সিজেন কমে যাবে বলে চারদিক থেকে বাতাসের ঝড় বইবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে দেখলে মনে হবে কাঠকয়লা দিয়ে তৈরি। ট্যাঙ্কারের অংশগুলো বোমার ইসপ্লিন্টার—এর মতো ছুটে গিয়ে আঘাত করবে আশপাশের বাড়িগুলোকে। একটা বাড়িও দাঁড়িয়ে থাকবে না। এমনও হতে পারে, প্রথম বিস্ফোরণটা হওয়ার পর ইমপ্যাক্টে কোনো একটা ট্যাঙ্কার শূন্যে উঠে গিয়ে সেখানে ব্লাস্ট করবে। তারপর কী যে হবে ভাবতেও পারছি না।”

প্রোফেসর চ্যাটার্জির মুখে এই সব কথা শুনে আমরা শিউরে উঠলাম। জোজো তা হলে ফালতু কথা বলেনি। বিপ্লবকেতনবাবু ওকে ফোনে ধরার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু ওঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, রেসকোর্সে কেউ ফোন ধরছে না।

এই সময় মুখ খুললেন দমকলের ডিরেক্টর মণিলাল সমাদ্দার, ”প্রোফেসর চ্যাটার্জি যা আন্দাজ দিলেন, তা যদি বাস্তবে ঘটে, তা হলে সেই আগুন নেভানোর ক্ষমতা কিন্তু আমাদের নেই। সারা কলকাতায় আমাদের যত এঞ্জিন আছে, তার সবকটা নিয়ে এসেও আমরা সামাল দিতে পারব না।”

মণিলালবাবুদের সঙ্গে আসা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতক্ষণ সবার কথা শুনছিলেন চুপচাপ। নিজে কোনো কথা বলেননি। এবার তিনি বললেন, ”আপনারা কেউ আর—একটা ভয়ানক পরিণতির কথা ভাবছেন না।”

অর্চিষ্মানবাবু বললেন, ”কী মিঃ খাসনবিশ?”

”আমি সেকেন্ড হুগলি ব্রিজের কথা বলছি। এই ধরনের এক্সপ্লোশন হলে ব্রিজ কিন্তু ভেঙে পড়বে। কয়েক হাজার কোটি টাকা জলে চলে যাবে। হুগলি নদীর ওয়াটার লেভেল কয়েক ফুট বেড়ে যাবে। ফলে হাওড়ার দিকে বন্যা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সেইসঙ্গে প্রচুর লোকের জীবনহানির আশঙ্কাও।”

এই ক”টা কথা বলেই ভদ্রলোক হাঁফাতে লাগলেন। ভদ্রলোক কে, তা জানি না। কিন্তু তাঁর কথা শুনে সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠল। সামান্য একটা ঘটনা…বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখার সময় পাড়ার ছেলেদের হুল্লোড়… তা থেকে যে এতবড়ো একটা বিপদ ডেকে আনবে, ভাবতেও পারা যায় না। শহরে এই মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ লোক নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন। রেসকোর্সের আশপাশের লোকেরা জানেনও না, কি বিপদ ওত পেতে রয়েছে তাঁদের জন্য। জোজো ছেলেটার একটা আঙুলের চাপে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরাকীর্তি আর আধুনিক স্থাপত্যের কিছু নমুনা এবং অসংখ্য জীবন।

ঘরের একটা টেলিফোন এই সময় বেজে উঠল। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। সি পি ফোনটা ধরেই অর্চিষ্মানবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”হোম মিনিস্টার ফোন করেছেন সার।”

ফোন ধরে অর্চিস্মানবাবু বললেন, ”সার বলুন।”

হোম মিনিস্টার শুদ্ধদেব দাশগুপ্তের গলা শুনতে পাচ্ছি। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ”কী ব্যাপার বলুন তো? কয়েকজন এক্সট্রিমিস্ট নাকি ময়দান এলাকাটা দখল করে নিয়েছে।”

”স্যার, সেই ব্যাপারেই আলোচনা করছি আমরা। এখানে কয়েকজন বিদগ্ধ লোক রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শও নিচ্ছি।”

”যা করার তাড়াতাড়ি করুন। বি বি সি থেকে এইমাত্র একজন ফোন করেছিল। আমি বলেছি, উড়ো খবর। একটু করে হয়তো আবার ওরা ফোন করবে। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, কলকাতায় এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের ডি ডি—র লোকগুলো কী করে তাহলে? ছেলেগুলো কারা জানতে পেরেছেন?”

”হ্যাঁ সার। ওদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

”দেখবেন, আমাকে বিপদে ফেলবেন না। পরশু থেকে বিধানসভার অধিবেশন শুরু হবে। খবরের কাগজের লোকেরা আমাকে ছেড়ে দেবে না।”

”আমরা চেষ্টা করছি সার।”

”চেষ্টা করছেন! তার মানে? ওরা অ্যানাউন্স করার পর তিনটে ঘণ্টা কেটে গেছে। এখনও কোনো অ্যাকশন নেননি? সারপ্রাইজিং। ওখানে কি চিফ সেক্রেটারি আছেন?”

”না সার।”

”তিনি কি ঘটনাটা জানেন?”

”ওঁকে জানানো হয়েছে স্যার।”

”আর উনি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন বোধ হয়। ঠিক আছে, ওঁর সঙ্গে আমি কথা বলছি। শুনুন, স্টেপ বাই স্টেপ আমাকে খবর দেবেন। আমি চাই আজ রাতের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটে যাক। না হলে শহরে প্যানিক হয়ে যাবে। লন্ডন থেকে আমার এক রিলেটিভ এইমাত্র ফোন করে জানতে চাইল, কলকাতায় কী হয়েছে। তার মানে বি বি সি ওদের খবরে বলেছে। এখনও লোকাল কাগজগুলো খবরটা পায়নি। ফেলে তো আমি বাড়িতে টিকতে পারব না মশাই। গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন?”

”হ্যাঁ সার।”

ওপাশে খুব বিচ্ছিরিভাবে লাইনটা কেটে দিলেন মন্ত্রী। অর্চিষ্মানবাবুর মুখ লাল হয়ে গেছে। কেননা ঘরে সবাই মন্ত্রীর কথাগুলো শুনতে পেয়েছেন। মন্ত্রী হওয়ার কী সুবিধে। যা ইচ্ছে তা বলে দেওয়া যায়। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন অর্চিষ্মানবাবু।

তারপর সি পি—র দিকে তাকিয়ে বললেন, ”মিনিস্টার ওই ছেলেগুলোর হোয়ার অ্যাবাউটস জানতে চাইছেন। আপনি শোভাবাজার বসাক স্ট্রিটে ফোর্স পাঠান।”

এতক্ষণ আমি কোনো কথা বলিনি। এবার বলতে বাধ্য হলাম, ”প্লিজ, এ কাজটা আপনারা করতে যাবেন না।”

অর্চিষ্মানবাবু খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ”কেন?”

”আমার মনে হয়, ওই ছেলেগুলোকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। এরা কেউ ক্রিমিন্যাল নয়। এদের মনস্তত্ত্ব আপনাদের বুঝতে হবে। আমার সন্দেহ আছে, এরা নিজেরাও ওয়াকিবহাল কি না, যা করতে যাচ্ছে, তার পরিণতি কী হতে পারে। সিনেমা, টিভি—তে যা দেখে, এরা তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়…”

”কিন্তু মিঃ নন্দী, এখন রাত দু’টো। আমরা এখনও কোনো অ্যাকশনে নামিনি। কাল সকাল ন’টা বাজতে আর সাত ঘণ্টা বাকি। যদি কোনো অঘটন ঘটে, তা হলে গভর্নমেন্ট ফল করে যাবে। এদিকে আপনারা কেউ ফোর্ট উইলিয়মের কথা ভাবছেন না। ওখানে কিছু ক্ষতি হলে ডিফেন্স পার্সোনেলদের মধ্যে মারাত্মক রিঅ্যাকশন হবে।”

হোম সেক্রেটারিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ”তবু আমি বলছি, ধৈর্য ধরা দরকার। এমন কিছু আমরা করব না, যাতে ছেলেগুলো হঠকারী কিছু করে বসে।”

আমার কথাগুলো পছন্দ হল না অর্চিষ্মানবাবুর। উনি কী বলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হওয়ায় উনি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকালেন। ঘরে ঢুকে এলেন এক অফিসার। দশাসই শরীর। কোমরে মোটা বেল্টও ভুঁড়ি বেঁধে রাখতে পারছে না। ভেতরে ঢুকেই জুতোয় খটাস শব্দ তুলে উনি স্যালুট করলেন। স্পষ্ট দেখলাম, সি পি—র চোখ—মুখ শক্ত হয়ে গেল। বললেন, ”গদাইবাবু, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?”

”রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম স্যার। পোস্তায় একটা ছেলে মার্ডার হয়েছে। সেখানে গিয়েছিলাম। ওয়ারলেসে খবর পেয়ে অ্যাজ কুইক অ্যাজ পসিবল এসেছি।”

”আপনি কি জানেন, কী গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছেন?”

”কী হয়েছে সার?”

ধমকে উঠলেন সি পি, ”কী হয়েছে সার? আপনাদের মতো অপদার্থ কিছু অফিসারের জন্যই পুলিশের এত বদনাম।”

ধমক খেয়ে গদাইবাবু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝলাম, ইনিই সেই বড়বাজার থানার ও সি গদাই রক্ষিত। সি পি জোজোদের প্রসঙ্গ তুলতেই ও সি বললেন, ”ওই ছেলেগুলোর কথা আর বলবেন না সার। এক—একটা ক্রিমিন্যাল। ওদের বিরুদ্ধে আমার কাছে প্রচুর কমপ্লেন আছে।”

”কী ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে ওদের সম্পর্কে?”

”ওই জোজো ছেলেটা গ্যাং লিডার সার। লেখাপড়া জানা ছেলে। শুনেছি এম. এসসি পাশ। কী নিয়ে রিসার্চ—টিসার্চও করে। আমার এরিয়ার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। সাটা কিং রাম অবতারের সঙ্গে ওর খুব দোস্তি। ছেলেটা থাকে মহেশ্বরী স্কুলের লাগোয়া গলিতে। বাবা নেই, মা, দাদা—বউদি নিয়ে ওদের ফ্যামিলি। দাদাটা নিরীহ গোছের। কোনো একটা ব্যাঙ্কে যেন চাকরি করে। আর কিছু জানতে চান সার?”

”আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন নিয়ে আর কী জানেন?”

”সার, সত্যি কথা বলতে কী, আমার এরিয়ার সব মস্তান ওকে ভয় পায়। সুরজভান, কানা ভাগালু, লক্ষ্মী কুণ্ডু—সবাই। আমাকে গ্রাহ্যই করে না। থানায় এসে দু”দিন ধমকি দিয়ে গেছে সার। এত স্পর্ধা। একবার কানা ভাগালুকে ওই ছেলেটা এমন পিটিয়েছিল, লোকটা ছ’মাস হসপিটালে ছিল। লেখাপড়া জানা ছেলে, ক্রিমিন্যাল হলে তাকে সামলানো কঠিন সার।”

”ছেলেটার পেছনে কি ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল কেউ আছে?”

”না সার। লোকাল কাউন্সিলার পর্যন্ত ওর ওপর চটা। খুব ডেঞ্জারাস টাইপের ছেলে।”

”বাকি ছেলেগুলো কারা?”

”সবাই পাড়ার ছেলে। রুদ্রাংশু বলে একটা ছেলে আছে সার, সে জোজো ছেলেটার ডান হাত। ক্যারাটেতে গোল্ড মেডেল—টেডেলও পেয়েছিল। গেলবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি নিয়ে ঝামেলা বেধেছিল। ওই রুদ্রাংশু ছেলেটা…. ওখানকার এক বিজনেসম্যান রাজকুমার কেডিয়ার লোকজনকে প্রচণ্ড মারধোর করে। তখন ছেলেটাকে তুলে আনি। কিন্তু পাড়ার মেয়েরা থানা ঘেরাও করে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। পেছন থেকে জোজোই সব অর্গানাইজ করেছিল।”

”যে ছেলেটা লক আপে সুইসাইড করেছে, তার নামটা কী?”

”দীপঙ্কর। আনফরচুনেট ব্যাপার, সার।”

”আপনারা কোনও গণ্ডগোল করেননি তো?”

”না সার, পরিষ্কার সুইসাইড।”

”ঠিক আছে যান। এবার মামলা—মোকদ্দমা ফেস করুন। হিউম্যান রাইটস কমিশনের লোকজনদের চেনেন? আপনাকে ঝুলিয়ে দেবে। আমি কোনও দায়িত্ব নিতে পারব না। কাল সকালেই সাসপেনশন লেটার পেয়ে যাবেন।””

গদাই রক্ষিতের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দুর্বলভাবে হাত তুলে উনি স্যালুট করলেন। এবার আর জুতোর আওয়াজ শুনতে পেলাম না। হাঁসফাঁস করতে করতে উনি বাইরে চলে গেলেন। ঘড়িতে দেখলাম, সওয়া দু’টো। জোজো শেষবার কথা বলেছিল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল, ও আর ফোন করল না। মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠলাম। অর্চিষ্মানবাবু ঠিকই বলেছেন। শোভারাম বসাক স্ট্রিটে একবার যাওয়া দরকার।

গদাই রক্ষিত যা বলে গেলেন, তার একবর্ণও বিশ্বাস হচ্ছে না। ছেলেগুলো যদি ক্রিমিন্যাল হত, তা হলে পাড়ার মহিলারা গিয়ে থানা ঘেরাও করতেন না। এটা একটা জটিল কেস। আমাকে সমাধান করতে দিলে, চেষ্টা করে দেখতাম। কেস যত জটিল হয়, আমার মাথা তত খোলে। দ্রুত সমাধান করার জন্য, মন খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। আগে যেসব জট ছাড়িয়েছি, তা বেসরকারি অনুরোধে। এই কেসটায় পুলিশের সম্মান জড়িয়ে। এঁরা কি ভরসা করে আমার ওপর দায়িত্ব দেবেন?

কথাটা মনে হতেই বললাম, ”অর্চিষ্মানবাবু, আমার একটা প্রস্তাব ছিল।”

”বলুন।”

”আমি এই কেসটা নিতে চাই।”

”আপনি একা পারবেন?”

”একা নই। আপনাদের এক অফিসার আছেন, সুদীশ নাগ। সঙ্গে তাঁকে নিতে চাই।”

অর্চিষ্মানবাবু সি পি—কে বললেন, ”কে এই সুদীশ নাগ?” সি পি বললেন, ”খুব এবল অফিসার সার। লাস্ট ইয়ার গভর্নর’স মেডেল পেয়েছেন। ডি ডি—তে আছেন।”

”আই সি। তাকে খবর দেওয়া যাবে?”

আমি বললাম, ”খবর দেওয়ার দরকার নেই। উনি থাকেন বিডন স্ট্রিটে। বড়বাজার যাওয়ার সময় ওঁকে আমি তুলে নেব।”

অর্চিষ্মানবাবু আমাকে ভাল করে চেনেন না। তাই বোধ হয় ভরসা রাখতে পারছেন না। মুখ ফুটে একবার উনি বলেও ফেললেন, ”এত বড় ব্যাপার, একা মিঃ নন্দীর হাতে দায়িত্ব দেওয়াটা কি ঠিক হবে?”

কথাটা শুনে সি পি একবার অপ্রস্তুত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর পাশ ফিরে অর্চিষ্মানবাবুকে ফিসফিস করে কী যেন বলতে লাগলেন। দু’ মিনিট মন দিয়ে শুনে অর্চিষ্মানবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ”দেন ইট’স অল রাইট।”

অর্চিস্মান উঠে দাঁড়াতেই মিটিং ভেঙে গেল। সবাই এক এক করে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাড়িতে ফুল্লরাকে একবার বলে দেওয়া দরকার। কখন ফিরতে পারব নিজেও জানি না। কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং। আমাকে সমাধান করতেই হবে। এদিকে, শর্মিষ্ঠা সঙ্গে রয়েছে। ওকে বড়বাজার নিয়ে যাওয়া যাবে না। পুলিশের গাড়িতেই না হয় ও বাড়ি ফিরে যাক। কথাটা সি পি—কে বলতে যাব, এমন সময় পকেটের ভেতরে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। নিশ্চয়ই ফুল্লরার। দেরি হচ্ছে দেখে হয়তো ফোন করেছে। ফোনটা কানে লাগিয়ে বললাম, ”হ্যালো, কালকেতু বলছি।”

ও—প্রান্তে থেকে উত্তর এল, ”কালকেতুদা, আমি জোজো।”

।।৩।।

শোভারাম বসাক স্ট্রিটের দিকে যাচ্ছি। আমার পাশে সুদীশ। একটু আগে ওকে বাড়ি থেকে তুলেছি। ডোর—বেল মাত্র একবার টিপতেই জানলা খুলে ও উঁকি মেরেছিল। আমাকে দেখে প্রচণ্ড অবাক। ”কী রে, এত রাতে তুই?”

”এখনও জেগে আছিস?”

”ব্রাজিলের একটা ম্যাচ দেখাচ্ছে ই এস পি এনে। ফার্স্ট রাউন্ডের ম্যাচ। বসে বসে দেখছিলাম। তা, তুই কী ব্যাপার?”

পুরো ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতেই সুদীশ দু’ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল। তারাসুন্দরী পার্কের কাছে সিটি জুবিলি স্কুলে সুদীশ আর আমি এক ক্লাসে পড়তাম। ওর ইচ্ছে ছিল, মতি নন্দীর মতো ক্রীড়া—সাংবাদিক হবে। আর আমার স্বপ্ন ছিল দেবী রায়ের মতো গোয়েন্দা হওয়ার। ভাগ্যের কী পরিহাস, আমি হয়ে গেলাম ক্রীড়া—সাংবাদিক। আর সুদীশ লালবাজারের গোয়েন্দা । বেশ নাম করেছে। মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে দেখা হয় লালবাজারে। সারা কলকাতা জুড়ে ওর সোর্স ছড়ানো আছে। আমার তো মনে হয়, এত সোর্স আর কোনো পুলিশ অফিসারের নেই।

এই সুদীশ ছেলেবেলা থেকেই পাঁড় ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। কত রাগিয়েছি ওকে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যেদিন হেরে যেত। এখনও ওর সেই ছেলেমানুষি যায়নি। ভিন রাজ্যে জাতীয় লিগে ইস্টবেঙ্গলের কোনো খেলা থাকলে ঠিক একবার না একবার আমাকে ও ফোন করবেই রেজাল্ট জানার জন্য। যত ব্যস্তই থাকুক না কেন। আমার মারুতিতে উঠে আজও প্রথমে জিজ্ঞেস করল, ”এই কালকেতু, আমাদের ক্লাব নাকি ন্যাশনাল লিগের আগে তিনজন ফরেন প্লেয়ার আনছে? কিছু খবর আছে তোর কাছে?”

প্রশ্নটা শুনে হাসি পেয়ে গেল। আমাদের ওপর একটা দায়িত্ব পড়েছে এত বড়। অথচ সুদীপের মাথায় এখনও ইস্টবেঙ্গলের চিন্তা। বললাম, ”আমিও শুনেছি রে।”

সুদীশ বল, ”তুই ওয়ার্ল্ড কাপ থেকে ঘুরে এলি। আমাদের ক্লাবের জন্য দু—চারটে প্লেয়ার কনট্যাক্ট করে আসতে পারলি না?”

গাড়িটা রবীন্দ্র কাননের বাঁ দিকে ঘুরিয়ে বললাম, ”হ্যাঁ, এটাই বাকি রয়ে গেল।”

”আচ্ছা, রোনাল্ডোকে যদি আমরা ইস্টবেঙ্গলে আনি, কত নেবে রে?”

”বেশি না। দেড়শো কোটি টাকা। তবে ইতালির ইন্টার মিলান যদি বিক্রি করে, তবেই ও আসতে পারবে।”

”মাই গড, এত?”

”কেন, কী এমন বেশি হল?”

”বেশি না? দে—ড়—শো কো—টি টাকা কম হল? কী বলছিস তুই?”

”ওকে আনতে পারলে কত রোজগার হবে বল তো ইস্টবেঙ্গলের?”

”কত হতে পারে?”

”হিসেব কর। ইস্টবেঙ্গলের কত সাপোর্টার আছে বল।”

”তা পাঁচ কোটি তো হবেই।”

”প্রত্যেকে যদি তিরিশ টাকা করে বাড়তি চাঁদা দেয়, তা হলেই তো দেড়শো কোটি টাকা হয়ে গেল। কারো গায়ে লাগবে না, আবার পুরো টাকাটাও উঠে আসবে রোনাল্ডোর জন্য। আবার দ্যাখ, রোনাল্ডো যদি তোদের ক্লাবের হয়ে খেলে, তা হলে রোজগারটা কী পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে। রোনাল্ডোর দশ নম্বর জার্সিটা তোরা বিক্রি করতে পারবি। ধর, এক—একটা জার্সির দাম করলি দুশো টাকা করে। এক লাখ জার্সি যদি বিক্রি করতে পারিস, তা হলে দু’ কোটি টাকা। এর পরও রোজগার আছে। বড় রোজগার। টিভি কোম্পানিগুলো থেকে। বিশ্বের সব দামি টিভি কোম্পানি ঝাঁপিয়ে পড়বে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে চুক্তি করতে। এক—একটা সিজনে চার—পাঁচ মিলিয়ন ডলার। কত টাকা জানিস, কুড়ি কোটি টাকা, এরপরও রোজগার আছে। স্পনসরশিপ…”

”দাঁড়া কালকেতু। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। এত টাকা রাখব কোথায়? তার থেকে রোনাল্ডোকে না আনাই ভাল।”

পেছনের সিটে বসে শর্মিষ্ঠা। সুদীশের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। ও বাড়ি ফিরে যায়নি। দেখতে চায়, জোজো—রহস্য কী করে আমি সমাধান করি। রাত জাগার বোধ হয় অভ্যাস নেই শর্মিষ্ঠার। এখন হাই তুলছে, দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ”ঘুম পাচ্ছে বোধ হয়, তাই না?”

”বিন্দুমাত্র না। জানেন কালকেতুদা, বহুদিন পর আজ আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল লালবাজারে।”

”তাই নাকি, কোথায়?”

”লালবাজারে রিসেপশনে। আপনারা তখন মিটিংয়ে। হঠাৎ দেখি জাহ্নবী। ও যে পুলিশে চাকরি নিয়েছে জানতাম না। আমরা কলেজ লাইফে খুব বন্ধু ছিলাম।”

”কোন কলেজে পড়াশুনো করেছ তুমি?”

”প্রেসিডেন্সিতে।”

কথা বলতে—বলতে আমরা তারাসুন্দরী পার্কের কাছে এসে পড়েছি। একটু এগিয়ে মোড়ে আমাদের এক বন্ধু সুকুমার মল্লিকদের বাড়ি। বাঁ দিকে কালাকার স্ট্রিট। দক্ষিণমুখো কয়েক গজ এগোলে, ডান দিকে শোভারাম বসাক স্ট্রিট। এসব জায়গা আমার খুব চেনা। ছেলেবেলায় এই রাস্তা দিয়ে রোজ স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে রামুদার দোকান থেকে ঘুড়ি কিনতাম। আগের গলিটা রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিট। গলির মুখে আইল্যান্ড। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুদীশ হঠাৎ বলল, ”এই, একটু দাঁড়া তো। এখানে আমার একজন সোর্স থাকে। দেখি, সে কিছু হিন্টস দিতে পারে কি না।”

বললাম, ”বাহ তা হলে তো খুব ভাল হয়।”

বাঁ দিকে একটা বাড়ির গা ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আমরা তিনজন নেমে পড়লাম। রাত প্রায় তিনটে। আশপাশের বাড়িতে লোক ঘুমোচ্ছে। কিন্তু গলির মুখে কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে। কাছেই আলুপোস্তা। আলুর গোডাউন। সকাল হলে আলুর বস্তা নামানো হবে ট্রাক থেকে। ছেলেবেলায় জোড়াবাগান পার্কে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে যাওয়ার সময় রোজ এই দৃশ্যটা দেখতাম।

গলির মুখে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুদীশ বলল, ”এই বাড়িটায় যাব। তোরা বাইরে দাঁড়া।” কথাটা বলেই দরজা দিয়ে অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেল সুদীশ।

অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। হাতে আর বেশি সময় নেই। মাত্র ছ’ ঘণ্টা। এর মধ্যে যা কিছু করার, আমাদের করতে হবে। রেসকোর্স এখান থেকে কতদূর? তা, মাইলচারেক তো হবেই। বড়বাজারের এই অঞ্চলে এখন অবাঙালি ভর্তি হয়ে গেছে। তাঁরা এফ এম চ্যানেলের বাংলা অনুষ্ঠান শুনেছেন বলে মনে হয় না। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। আমরা যদি জোজোকে থামাতে না পারি, তা হলে এঁরাও বিপদে পড়বেন।

জোজোর কথা মনে হতেই মনটা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। ছেলেটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। এখনও আমি ধাঁধায়, আমরা যে লালবাজারে মিটিং করছি, সেটা ও জানল কী করে? কনফারেন্স রুমে ও যখন বলল, ”কালকেতুদা, আমি জোজো” তখন সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম প্রশ্ন, ও আমার মোবাইল নম্বর জানল কী করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমি ছাড়াও সি পি যে আরও কয়েকজনকে মিটিংয়ে ডেকেছেন, সেই খবর পৌঁছল কী করে ওর কাছে?

কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন হোম সেক্রেটারি আর সি পি। ফোনটা আসতেই ওঁরা দু’জন দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। জোজোর প্রথম প্রশ্নটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ও জিজ্ঞেস করল, ”লালবাজারের মিটিংয়ে আপনারা শেষ পর্যন্ত কী ঠিক করলেন কালকেতুদা?”

বোকার মত একটা কথা বলে ফেললাম তখন, ”আমি যে লালবাজারে তুমি তা জানলে কী করে?”

”প্লিজ, এসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আগে বলুন, মিটিংয়ে কী ঠিক করলেন?”

জোজোর সঙ্গে চালাকি করে লাভ নেই। তাই পালটা জিজ্ঞেস করলাম, ”তুমি কি চাও বলো তো?”

”আমি তো আগেই বলেছি আপনাকে। বড়বাজার থানার ও সি—কে এখনই সাসপেন্ড করতে হবে। আর সি পি পাবলিকলি ক্ষমা চাইবেন কাল সকাল ন’টার মধ্যে।”

”এটা কী ধরনের আবদার জোজো! সি পি—র দোষটা কী?”

”ওঁর দোষ, একটা অযোগ্য লোককে এখনও ও সি পদে রেখেছেন। জানেন, গদাই রক্ষিত সি পি—র কত কাছের মানুষ? দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংস হচ্ছে, সেখানে সি পি—র জন্য একটা ফ্ল্যাট জোর করে বুক করিয়েছে গদাই রক্ষিত। দু’ হাজার স্কোয়ার ফুটের একটা ফ্ল্যাট। একটা পয়সাও এর জন্য খরচে করতে হয়নি সি পি—কে।”

”তোমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।”

”তাতে কোনও ক্ষতি নেই। প্রোমোটারের নামটা দিচ্ছি। নিজে গিয়ে কথা বলতে পারেন। এই সি পি—র আমলে অনেক খারাপ খারাপ ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বড় ঘটনাটা আমরা ঘটাব। যাতে কাল দুপুরেই সি পি—কে পদত্যাগ করতে হয়।”

”জোজো, গদাই রক্ষিত কাল সকালেই সাসপেন্ড হচ্ছেন।”

”লোকটাকে অ্যারেস্ট করা হবে কি?”

”কেন?”

”লক আপে যে সুইসাইডের কথা আগে বলেছি, সেটা আসলে মার্ডার। চালানো হচ্ছে সুইসাইড কেস বলে। লক আপের অন্য ক্রিমিন্যালরা বলেছে, দিপুকে মেরে তারপর জানলার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।”

”মোবাইল ফোনে তোমার টেলিফোন নম্বর পেলাম। এটা কি রেসকোর্সের নম্বর?”

”জানেনই তো সব। তা হলে কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

”জোজো, তুমি যা করতে যাচ্ছ, তা কি ঠিক?”

”জানি ঠিক নয়, তবুও প্রতিবাদটা এই ভাবেই করতে চাই। আপনারা গ্লাস হাউসের মধ্যে বসবাস করা লোক। ঠিক বুঝতে পারবেন না, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ লোকের কী ধারণা।”

”একটা কথা জিজ্ঞেস করব? এর মধ্যে আমাকে জড়িয়ে দিলে কেন?”

”ভাল প্রশ্ন। কালকেতুদা, আপনি এমন একজন লোক, যার অনেক ক্ষমতা। আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে ভাল করে চিনি। আপনারই এক সহকর্মী সায়েন্স কলেজে আমার সঙ্গে পড়ত।”

”কে বলো তো?”

”নামটা এখনই বলা যাবে না।”

কনফারেন্স রুমে হোম সেক্রেটারি আর সি পি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন। সি পি এক টুকরো কাগজে কী যেন লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আড়চোখে পড়ে নিলাম, ”আস্ক হিম, অ্যাবাউট দেয়ার প্ল্যানিং।” সঙ্গে—সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, ”তোমাদের প্ল্যানটা কী বলো তো?”

”আমার হাতের কাছে একটা রিমোট কন্ট্রোল আছে। তার বোতাম টিপব। প্রথম ব্লাস্টটা হলে লালবাজার পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। তিন—চার কিলোমিটার রেডিয়াসে কেউ বাঁচবে বলে মনে হয় না।”

”তুমি নিজেও তো মারা যাবে ভাই।”

”জানি। এভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী বলুন? এত পড়ালেখা শিখে আমি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলাম না। অথচ বড়বাজারে গিয়ে দেখুন, একটা ছোট গদিতে বসে কত টাকা লোকে কামাচ্ছে দু’নম্বরি করে।”

”তোমার সঙ্গে আর কে—কে আছে জোজো?”

”আরও পাঁচ—ছ’জন। আমাদের ক্লাবেরই।”

”তুমি কি সরাসরি সি পি—র সঙ্গে কথা বলতে চাও?”

”না। কাল সকালে আপনাদের কাগজে যখন খবরটা বেরোবে তখন উনি বুঝতে পারবেন, পদত্যাগ কখন করতে হবে।”

”সর্বনাশ! তুমি কি কাগজে দিয়েছ নাকি খবরটা?”

”অবশ্যই।”

”মাই গড! এটা তুমি ঠিক করোনি জোজো।”

”জানি না। আচ্ছা ছাড়ি তা হলে। দয়া করে মোবাইলের সুইচটা অফ করে রাখবেন না। আমি ঠিক এক ঘণ্টা পরে আপনাকে ফোন করব।”

”ঠিক আছে।”

…রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে জোজোর কথাগুলো ভাবছি, আর মনে হচ্ছে—ছেলেটাকে যে করেই হোক আটকানো দরকার। সুদীশ ওর সেই সোর্সের বাড়িতে সেই যে ঢুকেছে, মিনিট পনেরো ওর কোনো পাত্তা নেই। শর্মিষ্ঠা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এত রাতে মেয়েটাকে নিয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। অবশ্য বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। আমি জানি, আর আধঘণ্টা পরেই লোকজন উঠে পড়বে। মিনিট চারেক পশ্চিমদিকে হাঁটলে জগন্নাথ ঘাট। লোকে গঙ্গাস্নানে যাবে, নিম দাঁতন করতে করতে। কলকাতার অন্য অনেক অঞ্চল থেকে বড়বাজারে একটু আগেই ভোর হয়।

জোজো আমাদের কাগজে খবরটা সত্যিই দিয়েছে কিনা, জানার জন্য অফিসের ডিরেক্ট লাইনে ফোন করলাম। এত রাতে নাইট ডিউটির লোকেরাও জেগে থাকবে না। পাতা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। কাউকে পাওয়া কঠিন। তবুও ফোনটা ধরে থাকলাম কানের কাছে। আশ্চর্য, কয়েক সেকেন্ড পর ও—প্রান্ত থেকে একজন ঘুমজড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, ”হ্যালো কাকে চান?”

”কে বলছেন ভাই? আমি কালকেতু নন্দী।”

”ও কালকেতুদা? আমি অনিমেষ! কোনো খবর আছে? এখন তো আর ধরানো যাবে না।”

”না রে, অন্য একটা ব্যাপারে ফোন করেছি। আচ্ছা, আজ রাতে এমন কোনো খবর গেছে, একদল উগ্রপন্থী কলকাতার একটা অংশকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য থ্রেট করেছে?”

”না যায়নি। খবরটা রিপোর্টিং থেকে কেউ করেছিল। কম্পোজও হয়। কিন্তু নিজে এডিটর ছাপতে বারণ করে গেছেন শেষ মুহূর্তে। ওঁকে ফোন করেছিলেন সি পি।”

কথাটা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। খবরটা কে করেছিল, সেটা জানতে পারলে ভাল হত। কিন্তু অনিমেষের পক্ষে তা এখনই বলা সম্ভব না। তাই বললাম, ”ঠিক আছে রে। তোকে বিরক্ত করলাম।”

”না কালকেতুদা। ভালই করেছেন। বাড়ি যাওয়ার ফার্স্ট ট্রেনটা আজ ধরতে পারব।”

মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে শর্মিষ্ঠাকে বললাম, ”উফ, বাঁচা গেল। খবরটা বেরোলে কলকাতায় প্যানিক ছড়িয়ে যেত। গুজবের পর গুজব রটত। লোকে ভোর থেকে শহর ছেড়ে পালাত।”

শর্মিষ্ঠা হাসতে—হাসতে বলল, ”তা হলে ভাল হত কালকেতুদা। জানেন রেসকোর্সের উলটো দিকে একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংস আছে। টার্ফ ভিউ। তার টপ ফ্লোরে একজনের কাছে মাঝেমধ্যে আমি যাই। ওই ফ্ল্যাটটার ওপরে আমার খুব লোভ। ওই বাড়ির সবাই পালিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটটা দখল নিয়ে নিতাম।”

বললাম, ”ফ্ল্যাটটা তখন আস্ত থাকলে হয়!”

”থাকবে। আপনি যখন কেসটা নিয়েছেন, তখন থাকবে।”

কথা বলার সময়ই লক্ষ করলাম, সুদীশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে আর—একজন। পরনে পাজামা আর ময়লা পাঞ্জাবি। শীর্ণ চেহারা। এই ছেলেটাই তা হলে সুদীশের ইনফর্মার? কাছে এসে সুদীশ বলল, ”কালকেতু, এই জোজো বলে ছেলেটা তো খুব ভালো ছেলে ভাই। জগু যা বলছে তাতে তো উলটো পিকচার পাচ্ছি।”

ছেলেটার নাম তা হলে জগু? বললাম, ”এ চেনে?”

”খুব ভালমতো চেনে। জগু ওই জোজোর বাড়িটা চিনিয়ে দেবে। চল যাই।”

সবাই মিলে ফের গাড়িতে উঠে বসলাম। দুই রাস্তার মাঝখানে একটা সরু গলি। আগে এই গলির পাশে একটা বড় খাটাল ছিল। এখন নেই। ওই জায়গাটায় এখন একটা পার্ক। তার কাছে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে এসে দাঁড়ালাম একতলা একটা বাড়ির সামনে। টিনের চাল, কিন্তু ইটের দেওয়াল। সামনে খানিকটা ফাঁকা জমি। সেখানে দু—তিনটে কুকুর শুয়ে। পায়ের শব্দে ডেকে উঠল। কিন্তু দেখলাম জগু, অদ্ভুত শিস দিয়ে কুকুরগুলোকে চুপ করিয়ে দিল।

বাড়ির সামনে কাঠের দরজা খোলা। জগু ঠেলা মারতেই হাঁ হয়ে গেল। সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। তারপরই বারান্দা। দেখে অবাক হলাম, অত রাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। পায়ের শব্দ শুনে ভেতর থেকে এক মহিলা বলে উঠলেন, ”প্রবাল নাকি রে, ট্যাক্সি পেলি?”

উত্তরটা দিল সুদীশ, ”না মাসিমা। আমরা মারুতি নিয়ে এসেছি।”

”কাদের মারুতি?” বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এসে ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট দেখলাম আমাদের দেখামাত্রই ওঁর চোখ—মুখ একটু শক্ত হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পরনে সাদা থান। চোখে চশমা। দেখেই মনে হল, বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্না। আমরা কোনো কিছু বলার আগেই উনি বললেন, ”জোজো আজ বাড়িতে নেই বাবা।”

সুদীশ আমাকে দেখিয়ে বলল, ”এর নাম কালকেতু নন্দী। আনন্দবাজারের স্পোর্টস এডিটর। আর এই মেয়েটার নাম শর্মিষ্ঠা…শর্মিষ্ঠা গোস্বামী, রেডিওর অ্যানাউন্সার। আমি সুদীশ নাগ। মাসিমা, কাউকে কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?”

মনে মনে সুদীশের তারিফ করলাম। এ বাড়িতে কেউ নিশ্চয়ই অসুস্থ। না হলে ভদ্রমহিলা ট্যাক্সি ডাকতে পাঠাতেন না।

ভদ্রমহিলা কোনো কথা বলার আগেই ঘরের ভেতর থেকে ছাব্বিশ—সাতাশ বছর বয়সী একটা ছেলে বেরিয়ে এল। আমাদের দেখে ভ্রু—কুঁচকে খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে বলে, ”আপনারা?”

আমি বললাম, ”ভাই, বসে একটু কথা বলা যাবে?”

”আসুন। তবে বেশিক্ষণ নয়।”

জগু বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা বাকি তিনজন ঘরের ভেতর গিয়ে বসলাম। বসার ঘরটা বেশ সাজানো—গোছানো। তবে দেখেই বোঝা যায়, একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবার। দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কুড়ি—একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। সন্তানসম্ভবা। বুঝতে পারলাম, ট্যাক্সিটা এর জন্যই দরকার। মেয়েটা ভদ্রমহিলাকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ”মা, এরা কি থানা থেকে এসেছে?”

ভদ্রমহিলা সস্নেহে বললেন, ”তুই আবার কেন উঠে এলি?”

এবার ছেলেটা বেশ রুক্ষ গলায় আমাদের বলল, ”কী ব্যাপার, চটপট বলুন।”

সুদীশ অপ্রস্তুত হওয়ার লোক নয়। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, ”আপনারা তো দেখছি এই অঞ্চলের বেশ পুরনো বাসিন্দা। এই যে বেলজিয়াম কাচের আয়নাটা…দেড়শো বছরের পুরনো তো হবেই।”

আগে লক্ষ করিনি। সুদীশ বলার পর দেখলাম। তিন ভাঁজের আয়না। সাহেব আমলের জিনিস। সুকুমার মল্লিকদের বাড়িতেও দেখেছি। সুদীশের কথা শুনে ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, এত রাতে আমাদের আসাটা ও পছন্দ করেনি। খুব স্বাভাবিক। এমনও হতে পারে, থানা থেকে প্রায়ই রাতে এদের বিরক্ত করা হয়। সুদীশ এই সময় বলল, ”জোজো আপনার কে হয় ভাই?”

”ছোটো ভাই।”

”পুলিশ কি ওকে রোজই হ্যারাস করে?”

”হ্যারাস বললে কম বলা হয়।”

”কারণটা কী?”

”সে অনেক ব্যাপার। এত সময় নেই। আমার স্ত্রীকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

”আপনার নামটা কী?”

”পিন্টু।”

”আপনার স্ত্রীকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?”

”কোঠারি।”

”এতদূরের হাসপাতালে কেন? কোঠারি হাসপাতালটা তো সেই আলিপুরে।”

”আমার স্ত্রী—র এক কাকা ওই হাসপাতালের ডাক্তার।”

”পিন্টুভাই, আমাদের সঙ্গে মারুতি আছে। যদি চান, আমরা পৌঁছে দিতে পারি।”

”না, থ্যাঙ্কস। এখুনি ট্যাক্সি এসে যাবে।”

”এত রাতে পাবেন?”

”কাল রাতে বলে রেখেছি। গণেশ টকিজের পাশে একটা গ্যারাজে।”

”যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। জোজো এখন কোথায় জানেন?”

”না। আমাদের পাড়ার একটা ছেলেকে পুলিশ লক আপে, প্রচণ্ড মারধোর করে মেরে ফেলেছে। সকালে ওই ব্যাপারে সেই যে বেরিয়েছে, ভাই আর বাড়ি ফেরেনি।”

”কী করে জানলেন, পুলিশ মেরেছে?”

”খোঁজ নিয়ে জেনেছি। পুলিশ সব পারে।”

”পিন্টুভাই, আমি ডি ডি—র অফিসার। বড়বাজার থানার ও সির নামে একটা কমপ্লেন গেছে লালবাজারে। আমরা তারই তদন্তে এসেছি। আপনাদের সাহায্য চাই।”

”আপনাদের আইডেন্টিটি কার্ডগুলো দেখাবেন প্লিজ।”

সুদীশ সঙ্গে সঙ্গে কার্ড বের করে দেখাল। আমিও একটা নেমকার্ড বের করে দিলাম। খুঁটিয়ে তা দেখে, পিন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”কালকেতুদা, আমার ভাই আপনার খুব ফ্যান। ওর এক বন্ধু আছে আপনাদের অফিসে। সঞ্জয় সিকদার। ও এ—বাড়িতে এলেই, ভাই আপনার কথা খুব জিজ্ঞেস করে।”

জোজো ফোনে, আমাদের অফিসে ওর যে বন্ধুটার কথা বলেছিল, সে তা হলে সঞ্জয়। আমাদের চিফ রিপোর্টার। পিন্টু এবার একটু নরম হয়েছে। গলার স্বরে তা বোঝা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”পুলিশের সঙ্গে কী হয়েছে জোজোর?”

”আমাদের এখানে রাজকুমার কেডিয়া বলে একজন অ্যান্টিসোশাল আছে। জোজোর ঝামেলাটা আসলে তার সঙ্গে। এখানে রাজাকাটরা বলে একটা জায়গা আছে। এই অল্প দূরে। কেডিয়া লোকটা ওখানেই থাকে।”

কেডিয়ার নামটা শুনেই আমি সোজা হয়ে বসলাম। বেটিং সিন্ডিকেটের নায়ক। আমাকে কিডন্যাপ করে একবার ও ওর ডেরায় তুলেছিল। সেই ঘটনা ভুলিনি। ওর সঙ্গে আমারও হিসেব চুকনো বাকি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ”কেডিয়ার সঙ্গে প্রবলেমটা কী জোজোর?”

পিন্টু বলল, ”বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় কেডিয়া এই অঞ্চলে ইল্লিগাল বেটিং চালাচ্ছিল। টাকাপয়সা নিয়ে লোকজনের সঙ্গে চিটিংও করে। জোজো একবার গিয়ে ওকে ওয়ার্নিং দিয়ে আসে। সেই সময় কেডিয়ার দু—চারজন লোককে জোজোরা মারধোরও করে। কেডিয়ার সঙ্গে লোকাল থানার খুব ভাল সম্পর্ক। ও কমপ্লেন করে ভাইয়ের নামে। আমাদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলার দ্বারকা শর্মা আবার কেডিয়ার খুব বন্ধু লোক। এই পাড়াতেই থাকে। তাকে দিয়েও কেডিয়া থানায় চাপ দেয়। দ্বারকার সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক খুব খারাপ। দ্বারকা ওকে পার্টিতে টানতে চেয়েছিল। ভাই যায়নি। সেইজন্য ওর ওপর চাপা রাগ। আরও একটা কারণ আছে। দ্বারকার নজর আছে আমাদের এই বাড়িটার দিকে। কেনার প্রস্তাবও দিয়েছে কয়েকবার। ভাই ওকে ভাগিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা, ভাই বাড়িতে থাকতে পারছে না।”

সুদীশ খুব মন দিয়ে পিন্টুর কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, ”এই কেডিয়ার বাড়িতে এখন যাওয়া যাবে?”

পিন্টু বলল, ”যেতে পারেন। তবে রাজাকাটরার এই বাড়িতে ও আজ আছে কি না জানি না। কলকাতার তিন অঞ্চলে ওর তিনটে বাড়ি। কবে কোথায় থাকে, কেউ বলতে পারবে না।”

সুদীশ আমার দিকে ঘুরে বলল, ”আমি কেডিয়ার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। এদের নিয়ে তুই কোঠারিতে যা। ওখানেই দেখা হবে তোর সঙ্গে।”

সুদীশের মাথায় নিশ্চয়ই কোনো প্ল্যান আছে। তাই বাধা দিলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জগুকে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল। এ রাতে একা গেল, কোনো ভয়ডর নেই। সুদীশকে আমি চিনি। ওর মুখেই শুনেছি, কুমোরটুলিতে সমাজবিরোধীদের সঙ্গে ঝামেলার সময় একজন ওর দিকে বোমা ছুঁড়েছিল। ফাটলে মারাত্মক চোট পেত। সুদীশ সেই বোমা ডাইভ দিয়ে লুফে নেয়। তারপর পালটা ছোঁড়ে সেই বোমা অ্যান্টিসোশ্যালদের দিকে।

রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। জোজো বলেছিল, প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হয়ে গেছে, এখনও ও যোগাযোগ করল না।

পিন্টু পাশের ঘরে উঠে গেছে। বসার ঘরে শুধু আমি আর শর্মিষ্ঠা। পাশের ঘর থেকে মা আর ছেলের কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। পিন্টু একবার বলল, ”মা, তুমি গিয়ে কালকেতুবাবুর সঙ্গে কথা বল। আমি এদিকে দেখছি।”

মিনিটখানেক পরই ভদ্রমহিলা এলেন বসার ঘরে। হাতে একটা ট্রে। তাতে শরবতের গ্লাস। দেখেই আমার তেষ্টা পেয়ে গেল। গ্লাস দু’টো আমাদের দিয়ে উনি বললেন, ”কালকেতুবাবু, আমার ছোটো ছেলেটার কথা তো শুনলেন। ওকে পুলিশের হাত থেকে, প্লিজ বাঁচান।”

কথাটা উনি এমনভবে বললেন, শুনে খুব খারাপ লাগল। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে বা মেয়েরা সবসময়ই মায়ের খুব প্রিয় হয়। ভদ্রমহিলাও নিশ্চয়ই জোজোকে খুব ভালবাসেন। কিন্তু বোধ হয় এখনও জানেন না, জোজো কী মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছে। আর কয়েক ঘণ্টা পর এমন ঘটনাও ঘটতে পারে, যার পরিণতিতে মা আর ছেলের মধ্যে কোনোওদিন দেখা হবে না। ভদ্রমহিলা এমনিতেই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন এখন পিন্টুর স্ত্রীকে নিয়ে। জোজোর কথা বলা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারলাম না। শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললাম, ”মাসিমা, আমি নিশ্চয় চেষ্টা করব। তেমন হলে সি পি—র সঙ্গেও কথা বলব।”

উলটো দিকে একটা চেয়ারে বসে জোজোর মা বললেন, ”আমার এই ছেলেটা খুব ট্যালেন্টেড। কিন্তু তেমনভাবে সুযোগ দিতে পারলাম না। ওর বাবা যখন মারা যান, তখন জোজোর বয়স মাত্র পাঁচ। পিন্টুর সাত। খুব কষ্ট করে ছেলে দু’টোকে আমি মানুষ করেছি। আমার কাকা ছিলেন এডুকেশন মিনিস্টার। আমার অবস্থা দেখে তখন উনি, তারাসুন্দরী পার্কের কাছেই নারায়ণী শিক্ষালয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। খুব কষ্টে মানুষ করেছি ছেলেদের। এবার একটু সুখ—শান্তির মুখ দেখব তা নয়, রোজ রাতে বাড়িতে পুলিশের হামলা।”

জোজোর মা গল্প করতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে। জোজোর সম্পর্কে নানা কথা। শুনে মনে হল, ছেলেবেলা থেকেই ছেলেটা একটু ডেয়ার ডেভিল টাইপের। মাত্র দশ বছর বয়সে নাকি একবার জোজো সাঁতরে গঙ্গা পেরিয়েছিল। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগের দিন স্থানীয় এক মাস্তানকে এমন মার মেরেছিল যে, সেই ছেলেটি মরো—মরো হয়ে যায়। সেই মাস্তান ছেলেটা না কি তোলা তুলতে এসেছিল। সেদিন ওই ঘটনায় জড়িয়ে না পড়লে নাকি জোজো হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম দশজনের মধ্যে থাকত। তার বদলে এইটিনথ হয়। এইসব গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ বললাম, ”মাসিমা, জোজো সবচেয়ে কাকে বেশি ভালবাসে?”

”পুলিশ আমাদের পাড়ায় যে ছেলেটাকে লক আপে মেরে ফেলল, সেই দিপুর সঙ্গে জোজোর খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই ছেলেবেলা থেকে। ওরা একসঙ্গে স্কুল যেত, আমার এখানে একই থালায় ভাত খেত কোনো—কোনোদিন। জোজো খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। দিপুর ডেডবডিটা যখন পাড়ায় নিয়ে এল, তখন জোজো খুব কান্নাকাটি করেছিল। কোনোদিন ওকে কাঁদতে দেখিনি। ভয় হচ্ছে, মারাত্মক কিছু একটা ও না আবার করে বসে।”

”জোজোর আর কার ওপর সফট কর্নার আছে মাসিমা?”

”ওর বউদি। তাই একটু আগে পিন্টুকে বলছিলাম, এই সময় জোজো থাকলে আমার কোনো চিন্তাই হত না। বাড়িতে ট্যাক্সির লাইন লেগে যেত। আসলে জোজোর তো নিজের দিদি নেই। বউদিকেই দিদির মতো দ্যাখে। এক—এক সময়, আমাদের কারও কথা ও শোনে না। কিন্তু বউদি বললেই, চুপ। মেয়েটা যন্ত্রণায় এখন এত কষ্ট পাচ্ছে, দেখলে জোজো…।”

বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ হল। কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না জোজোর মা। ”বোধ হয় প্রবাল ট্যাক্সি নিয়ে এল” বলতে বলতে উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি আর শর্মিষ্ঠাও বাইরে বেরিয়ে এলাম। না, ট্যাক্সি নয়। পুলিশের জিপ। দেখেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তা হলে কি গদাই রক্ষিত? লালবাজারে ঝাড় খেয়ে, এদের ভয় দেখাতে এলেন? না, গদাই রক্ষিত নন। জিপ থেকে নেমে এল শর্মিষ্ঠার বয়সী একটা মেয়ে। পরনে সাদা শাড়ি, নীল পাড়।

মেয়েটাকে দেখেই শর্মিষ্ঠা বলে উঠল, ”জাহ্নবী তুই?”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, ”আরে, তুই এখানে?”

একটু আগে শর্মিষ্ঠা তা হলে এই মেয়েটার কথাই বলছিল। ওর সেই বান্ধবী, যে লালবাজারে চাকরি করে। এই জাহ্নবীই তা হলে জোজোকে খবর দিয়েছিল লালবাজারের মিটিং নিয়ে। যদি তাই হয়, জাহ্নবী নিশ্চয়ই জোজোর টেলিফোন নম্বরটা জানে। মনে মনে এই হিসেবটা করে একটু নিশ্চিন্ত হলাম। জট খুলছে। উঠোনে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর কথা শুনতে লাগলাম।

শর্মিষ্ঠা বলল, ”আমি কালকেতুদার সঙ্গে এসেছি। তুই?”

”এটা তো আমার দিদির বাড়ি। পিন্টুদার সঙ্গে কি তোর আলাপ হয়েছে? পিন্টুদা আমার জামাইবাবু।”

কথাটা বলার পরই আমার দিকে চোখ পড়ল জাহ্নবীর। সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

।।৪।।

পিন্টুর স্ত্রীকে ভর্তি করে আমরা যখন হাসপাতালের লাউঞ্জে এসে বসলাম, তখন রাত প্রায় চারটে। ঠিক তখনই মনটা হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। জোজো আর ফোন করেনি। কেন, কে জানে? এদিকে সুদীশেরও কোনো পাত্তা নেই। সেই যে ও জগু বলে ইনফর্মারটাকে নিয়ে রাজকুমার কেডিয়ার বাড়িতে গেল, তারপর ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। ওকে নিয়ে অবশ্য আমার কোনো চিন্তা নেই। কেডিয়া ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি জানি, কেডিয়াকে ও পাতাল থেকেও নিয়ে আসবে।

পিন্টুর মায়ের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছে জাহ্নবী। সোফায় ওর বাঁ পাশে বসে শর্মিষ্ঠা। পিন্টুর মায়ের চোখ—মুখে উদ্বেগ। এটাই স্বাভাবিক। হাসপাতালের মেট্রন খবর দিয়েছেন ডাক্তারকে। এখনই তাঁর আসার কথা। লাউঞ্জের একধারে ছোট্ট মন্দির। রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। একটু আগে পিন্টুর মাকে সেই মূর্তির সামনে কয়েক মিনিট চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ভদ্রমহিলা জানেন না, তাঁর ছোট ছেলে কী মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছে। কথাটা ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল।

জাহ্নবীর সঙ্গে আলাদা কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমাকে দেখার পর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। এড়িয়ে যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ওকে দেখার পর থেকে, কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে, জোজোর সম্পর্কে ও অনেক কিছু জানে। আমার কাজে লাগতে পারত। কোনো সন্দেহ নেই, লালবাজারে কী হচ্ছিল সেই খবর ও—ই জোজোকে দিয়ে যাচ্ছিল। ও বুঝতে পেরেছে, সে—কথা আমি জানি। একটু ফাঁক পেলেই জাহ্নবীকে আমি ধরব। পুলিশের লোক হয়ে, জোজোর এই পাগলামিতে ও শামিল না হলেই পারত।

হাসপাতাল চত্বরে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাই উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরানোর পরই দেখলাম, একটা মারুতি জেন এসে থামল। এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। সম্ভবত ডাক্তার। দেখে ভাল লাগল। সরকারি হাসপাতাল হলে এত রাতে ডাক্তার পাওয়া যেত না। কথাটা মনে হতে—না—হতেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। জোজো? সঙ্গে—সঙ্গে সুইচ টিপে ফোনটা কানে লাগালাম।

”কালকেতু, সুদীশ বলছি।”

”কোত্থেকে?”

”লালবাজার। কেডিয়াকে তুলে এনেছি।”

”তাই নাকি?”

”লোকটা তো বেশ খলিফা রে। অ্যাদ্দিন ধরে একটা নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমরা পুলিশের লোকেরা কিছু জানতাম না। লোকটা তো এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যবস্থা করে রেখেছে।”

”কী ব্যাপার?”

”তুই কি হাসপাতালে?”

”হ্যাঁ। গেটের কাছেই আছি।”

”আমি দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছচ্ছি। অনেক খবর আছে। সামনাসামনি না হলে বলা যাবে না।”

”ঠিক আছে, আয়।”

ওদিকে, লাইনটা কেটে দিল সুদীশ। ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিক থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে। তাই গেট থেকে সরে দাঁড়ালাম। একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে। দিনটা কেমন কাটবে কে জানে? মনে মনে একটু চঞ্চল হয়ে উঠলাম। জোজো সকাল সাতটা পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। আর পৌনে তিন ঘণ্টা বাকি। রাত্তিরটা অযথা ঘোরাঘুরি করলাম। কোনো কাজই এগোল না। সবচেয়ে বড়ো কথা, জোজো আর ফোন করল না। করলে ওর সঙ্গে কথা বলে আঁচ পাওয়া যেত, এখনও বিস্ফোরণের কথা ওর মাথায় আছে কি না। ও সি গদাই রক্ষিতের সাসপেনশনের কথা নিশ্চয়ই ও জেনে ফেলেছে। ওর একটা দাবি মানা হয়েছে। অন্য দাবি, সি পি—র ক্ষমা চাওয়া সম্ভব নয়।

সিগারেটটা শেষ করেই ভাবলাম, জাহ্নবীর সঙ্গে আলাদা কথা বলা দরকার। জোজো ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। একটু চাপ দিলে নিশ্চয়ই ওর কাছ থেকে জোজোর কনট্যাক্ট নম্বরটা পাওয়া যাবে। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। সুদীশ আসার আগে একবার জোজোর সঙ্গে কথা বলা দরকার। ও বলল, কেডিয়া এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যবস্থা করেছে। কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না। কেডিয়া লোকটার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব না। লোকটা পাক্কা শয়তান।

লাউঞ্জে এসে দেখি শর্মিষ্ঠা আর জাহ্নবী বসে গল্প করছে। পিন্টুর মা নেই। জাহ্নবী আমাকে দেখেই চুপ করে গেল। আমি গিয়ে ঠিক ওর উলটো দিকে বসলাম। শর্মিষ্ঠা আকাশবাণীর গল্প করছে। কীভাবে ও এফ এম চ্যানেলে ঢুকল, সেইসব কথা। জাহ্নবী হাঁ হুঁ করে যাচ্ছে। দু”হাত দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ওর মন অন্যদিকে। আমার সামনে থেকে ও উঠে যেতে পারলে বাঁচে। ঠিক ওই সময়েই আমি বললাম, ”শর্মিষ্ঠা, আমি জাহ্নবীর সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলতে চাই। তুমি একটু ওদিকে গিয়ে বসবে?”

আমার কথা শুনে শর্মিষ্ঠা ভয়ানক অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করে ও মন্দিরের দিকে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। জাহ্নবী মাথা নিচু করে আছে। সময় নষ্ট না করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”জাহ্নবী, তুমি কি জানো জোজো কী বিপদের মধ্যে পড়েছে?”

জাহ্নবী কোনো উত্তর দিল না। ফের বললাম, ”সব জেনেশুনেও কেন তুমি ওকে বারণ করলে না? তুমি না পুলিশের লোক?”

”ওকে আমি মানা করেছিলাম কালকেতুদা। ও এমন ছেলে, কারও কথা শোনে না।”

”তোমার দিদির কথাও না?”

”দিদির কথা শোনে। তবে দেখেছেনই তো দিদির কী অবস্থা। এই সময় দিদিকে সব কথা জানানো মানে…”

”তবু বলব, তুমি ঠিক করোনি জাহ্নবী। একটা অনুরোধ করব? এখনই আমি জোজোর সঙ্গে কথা বলতে চাই। একবার যোগাযোগ করিয়ে দেবে?”

”ও এখনই আপনাকে ফোন করবে।”

”তুমি কী করে জানলে?”

”এখানে আসার পর ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।”

”ও কি জানে, আমরা হাসপাতালে?”

”না। বলিনি। বললে ও ছুটে আসত।”

”আর—একটা ভুল, জাহ্নবী। সি পি—কে যদি আমি বলি, তুমি ওকে মদত দিচ্ছ, তা হলে কী হবে বুঝতে পারছ?”

”জানি। চাকরিটা যাবে, সেই সঙ্গে ক্রিমিন্যাল প্রসিডিংস আমার বিরুদ্ধে।”

”এই ঝুঁকিটা তুমি নিলে কেন? ব্লাস্ট হলে কত লোকের জীবনহানি হবে বল তো?”

”ব্লাস্ট ও তো করছে না। করছে কালুয়া।”

”সে কে?”

”এক অ্যান্টিসোশ্যাল। এখন ভাল হয়ে গেছে।”

”সে কি করে শামিল হল জোজোর সঙ্গে?”

”জানি না। কিছুদিন ধরেই লোকটা আসা—যাওয়া করছে জোজোর কাছে।”

”ওই লোকটা কি এখন জোজোর সঙ্গে রয়েছে?”

”না। ও একটা টাইম বোমা ফিট করে রেখেছে। ঠিক সকাল সাতটায় সেটা ফাটাবে।”

”আই সি। কালুয়া এখন কোথায়?”

”লালবাজারে।”

সুদীশের গলা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম পেছনে। কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। জিজ্ঞেস করলাম, ”লালবাজারে?”

”হ্যাঁ। কেডিয়ার সঙ্গে বসে ব্যাটাচ্ছেলে রামি খেলছিল। দুটোকেই তুলে এনে এতক্ষণ পেটালাম। তুই তো জানিস, থার্ড ডিগ্রি ট্রিটমেন্টে আমি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। মিনিট দশেকের মধ্যেই সব কথা বলে ফেলল।”

”কী বলল?”

”তোকে তো বললাম, কেডিয়া শয়তানটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কিছুদিন আগে কালুয়াকে ও টাকা—পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে। ও জানত, জোজোর সঙ্গে কালুয়ার সম্পর্কটা খুব ভাল। জোজো খুব বিশ্বাস করে কালুয়াকে। কেডিয়ার প্ল্যান ছিল, একদিন কোনো ছোটোখাটো কারণে একটা ঝামেলা বাধিয়ে, কালুয়ার লোকজনের হাত দিয়ে মার্ডার করিয়ে দেবে জোজোকে। বড়বাজার অঞ্চলে ওর বেটিং সিন্ডিকেট আর সাট্টা মার্কেট অবাধে চালাবে। কিন্তু সেটা করার দরকার হল না। ওর হাতে চমৎকার এই সুযোগটা এসে গেল।”

”কীরকম?”

”পাড়ার ছেলেটা পুলিশ লক আপে মারা যাওয়ার পর পেছন থেকে কেডিয়াই কালুয়া মারফত জোজোর মাথায় ঢোকাল রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য এমন কিছু করা দরকার, যাতে হইচই পড়ে যায়। পুলিশের ইমেজ খারাপ হয়ে যায়। এই কালুয়ার সঙ্গে ভিন রাজ্যের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগাযোগ আছে। আগে ওখানকার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একটা ব্লাস্ট হয়েছিল, তোর মনে আছে? সাতজন মারা যায়। সেই ঘটনার পেছনে ছিল এই কালুয়া। ওকে ভাড়া করে নিয়ে গেছিল ওখানকার একটা উগ্রপন্থী সংগঠন। এ ব্যাটা এসব ব্যাপারে দেখলাম এক্সপার্ট।”

”কালুয়া স্বীকার করল এসব কথা?”

”করবে না মানে? ও ধরা না পড়লে কী হত জানিস? ব্লাস্টে জোজো বেচারাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।”

”মাই গড! জোজো নিশ্চয়ই জানে না এসব কথা?”

”না, জানে না। ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য এখনই ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।”

আমি সঙ্গে—সঙ্গে তাকালাম জাহ্নবীর দিকে। ওর মুখ থেকে সব রং কে যেন শুষে নিয়েছে। আমাকে বলল, ”কালকেতুদা, আমি জানি ও কোথায় আছে। যাবেন?”

”চল। আর এক মিনিট নষ্ট করা ঠিক হবে না।”

সুদীশ আর জাহ্নবী কাচের সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে গেল। আমি শর্মিষ্ঠার কাছে গিয়ে বললাম, ”আমরা একটা জরুরি কাজে বেরোচ্ছি। তুমি এখানে থেকো।”

”আমাকেও নিয়ে চলুন না কালকেতুদা।”

”না। সম্ভব না।”

”কখন ফিরবেন আপনারা?”

”ধরো, আধঘণ্টা।”

”জোজোর কাছে যাচ্ছেন বোধহয়?”

ওর কথা শুনে এবার হাসি পেল। মেয়েটা বুদ্ধিমতী। বললাম, ”ঠিক ধরেছ। এবার থেকে প্রতিটা কেস—এ তোমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব।”

”ঠাট্টা করছেন?”

”আরে না। আমি সিরিয়াসলি কথাটা বললাম।”

আর কথা না বাড়িয়ে কাচে সুইং ডোর ঠেলে আমি বেরিয়ে এলাম। দূরে কোথাও ঘড়ির ঘণ্টা বাজল। ভোর পাঁচটা। আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। রাস্তায় লোক—চলাচল শুরু হয়ে গেছে। মনটা হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। এই একটা কেস, যেখানে আমি এখনও কিছু করে উঠতে পারলাম না। সুদীশ আমাকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেল। সি পি এত বিশ্বাস করে আমাকে দায়িত্ব দিলেন, অথচ এখনও ব্রেক থ্রু করতে পারলাম না।

বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, সুদীশ আর জাহ্নবী পুলিশের জিপে উঠে বসেছে, ওদের নেমে আসতে বললাম। পুলিশের জিপে যদি জোজোর কাছে যাই, তা হলে ফল খারাপ হতে পারে। এখন অবশ্য জোজোকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেননা, সুদীশ মারফত আমরা জেনে গেছি, বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য রিমোট কন্ট্রোল জোজোর হাতে নেই। রাতে ও আমাদের শুধু—শুধু ভয় দেখিয়েছিল। যাই ঘটুক, সকাল সাতটার আগে বিস্ফোরণ হচ্ছে না।

আমরা তিনজন মিলে মারুতিতে উঠে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট করতে যাব, এমন সময় পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি বের করে সুইচ টিপলাম।

”কালকেতুদা, জোজো বলছি।”

”বল। তোমার তো আরও আগে ফোন করার কথা ছিল।”

”কী লাভ হত বলুন?”

”এখনও লাভ—ক্ষতির কথা তুলছ জোজো? তুমি কি জানো কী বিপদের মধ্যে আছ?”

”আমার বিপদের কথা ছেড়ে দিন কালকেতুদা।”

”বি সেন্সেবল। আমরা আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমার ওখানে যাচ্ছি। জাহ্নবী আমাদের তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছে।”

”জাহ্নবী? ওকে আপনি পেলেন কোথায়?”

”ওর সঙ্গে কথা বলবে?”

”দিন।”

তাড়াতাড়ি ফোনটা এগিয়ে দিলাম জাহ্নবীর দিকে। ওর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় ও বলল, ”জোজো, চিড়িয়াখানার খুব কাছ থেকে বলছি। তুমি প্লিজ এখনই চলে এসো।”

ও—প্রান্ত থেকে জোজো বোধহয় কোনো প্রশ্ন করল। আমি আর সুদীশ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে। বোঝার চেষ্টা করছি, প্রশ্নটা কী হতে পারে। জাহ্নবী বলল, ”না, না। পাগলামি কোরো না। এরা কালুয়ার কথা সব জেনে গেছে। তুমি যা চেয়েছিলে, তা তো হয়েইছে। সি পি মারাত্মক খেপে গেছেন ও সি—র বিরুদ্ধে। সাসপেন্ড করেছেন।…লক্ষ্মীটি, তুমি আমার কথা শোনো…হ্যাঁ, কেডিয়াকেও এঁরা অ্যারেস্ট করেছেন, আমি যা বলছি বিশ্বাস করো…নিজের জীবনটা তুমি এভাবে নষ্ট কোরো না জোজো…”

এরপর জাহ্নবী ফোনটা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, ”নিন, আপনার সঙ্গে ও কথা বলতে চাইছে।”

ফোনটা কানে দিয়ে বললাম, ”কী ঠিক করলে জোজো, তুমি কি এ দিকে আসছ, না, আমরা তোমার ওখানে যাব?”

”আপনারা কি আমাকে অ্যারেস্ট করবেন?”

”নাও করতে পারি। তুমি যদি নিজে আসো, তা হলে সি পি—কে আমি নিজে তোমার জন্য রিকোয়েস্ট করব, যাতে উনি কোনো কড়া স্টেপ না নেন।”

”সি পি আপনার রিকোয়েস্ট রাখবেন?”

”রাখতেও পারেন। তুমি এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, তা সত্ত্বেও এত বড়ো একটা ঝুঁকি নিলে কেন জোজো?”

”কালকেতুদা আপনাকে তো আগেই সব বলেছি।”

”একটা ছেলের মৃত্যুর জন্য তুমি এত লোকের জীবনহানি ঘটাবে কেন জোজো? ব্লাস্ট হলে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিটা হবে কখনও ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছ? তোমার সবচেয়ে প্রিয় যে বউদি, তিনিও তো বাঁচবেন না। এত কাছে একটা হসপিটালে তিনি ভর্তি রয়েছেন।”

”কী বলছেন আপনি কালকেতুদা? বউদি হাসপাতালে?”

”বিশ্বাস না হয়, জাহ্নবীর সঙ্গে কথা বল। কয়েক ঘণ্টা আগে আমরা তোমার বউদিকে এখানে নিয়ে এসেছি। আসার পথে বারবার উনি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন।”

ও—প্রান্তে জোজো চুপ। আমি ফের বললাম, ”কেডিয়া বুদ্ধির খেলায় তোমাকে টেক্কা দিতে যাচ্ছিল জোজো। সাম হাউ, ক্লিক করল না। এখনও সময় আছে তুমি এসো।”

এবার জোজো ভেঙে—পড়া গলায় বলল, ”আমাকে পনেরোটা মিনিট সময় দিন কালকেতুদা। আমি ক্লাবের বাকি ক’জনের সঙ্গে কথা বলে দেখি।”

”তোমার জন্য তাহলে আমরা ওয়েট করছি।”

”থ্যাঙ্ক ইউ কালকেতুদা।”

ফোনের সুইচ অফ করতেই সুদীশ জিজ্ঞেস করল, ”কী বলল, আসবে?”

”ভাবার সময় নিল।”

”চল তা হলে কোথাও একটু চা খাওয়া যাক।”

জাহ্নবী হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল। আমরা দু’জন পশ্চিম দিকে হাঁটতে লাগলাম। সারারাত রাস্তায় ঘুরছি। ক্লান্ত লাগছে। একটু গলা ভিজিয়ে নিলে মন্দ হয় না। একবালপুরের মোড়ে নিশ্চয়ই চায়ের দোকান পাওয়া যাবে। রাস্তায় লোক—চলাচল শুরু হচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। হঠাৎই মনে পড়ল, আর কয়েক ঘণ্টা পর রবীন্দ্রসদনে যেতে হবে। ফুটবল নিয়ে সেই সেমিনার। মাঝে দু’তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোনোর সময় পাব না। তবে সবকিছু নির্ভর করছে জোজোর মর্জির ওপর। ও যদি গোঁ ধরে বসে থাকে, তা হলে কী হবে কে জানে?

এসব কথা ভাবতে—ভাবতে হাঁটছি, হঠাৎ শুনি, ”কালকেতুবাবু, কেমন আছেন?”

ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ল দৌড়দাদুকে। ভদ্রলোকের নাম প্রবোধ মান্না। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু সবাই ডাকেন দৌড়দাদু বলে। কাছাকাছি মোমিনপুরের দিকে থাকেন। জগতের কত লোকের কত রকম নেশা, দৌড়দাদুর নেশা হল দৌড়নো। কলকাতার পাঁচ মাইল, দশ মাইল দৌড়ের রেস প্রচুর হয়। সব জায়গায় দৌড়তে নামেন এই প্রবোধবাবু। জীবনে কখনও জেতেননি। তবু নামেন হাঁটুর বয়সী ছেলেদের সঙ্গে দৌড়তে। কবিতীর্থে এইরকম একটা রেসে আমি প্রাইজ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম দেখি দৌড়দাদুকে। খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আলাপ করে। এই বয়সে অন্য লোকেরা হার্ট, কিডনি, ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন। দৌড়দাদুর সেরকম কোনো সমস্যা নেই। ছিপছিপে শরীর, দিব্যি সুস্থ আছেন। সন্দীপকে দিয়ে একটা লেখা লিখিয়েছিলাম, আমাদের কাগজে দৌড়দাদু সম্পর্কে। সেই সময় ভদ্রলোক বলেছিলেন, গেজেটেড অফিসার ছিলেন।

দৌড়দাদু দরদর করে ঘামছেন। পরনে শর্টস আর হাফ হাতা গেঞ্জি। পায়ে কেডস। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বললাম, ”ভালো আছেন?”

”খুব ভালো। সকাল—বিকেল দৌড়চ্ছি। দেখবেন, কবিতীর্থের পাঁচ মাইল রেসটা এবার আমি জিতবই।”

”খুব ভোরে উঠে প্র্যাকটিস করেন বুঝি?”

”না হলে পাল্লা দেব কী করে ছোকরাগুলোর সঙ্গে। এই তো রেসের মাঠে চক্কর মেরে এলাম। ভাল টাইম দিচ্ছি। আচ্ছা একটা খবর দিতে পারেন? দিল্লিতে নাকি গুলাব সিংহ চৌহান বলে আমার বয়সী এক ভদ্রলোক এবার রথ ম্যারাথনে নেমেছিলেন? আমি ভাবছি, ম্যারাথনে একবার নেমে দেখলে হয়।”

বললাম, ”ঠিক শুনেছেন। গুলাব সিংহ চৌহান রথ ম্যারাথনে নেমেছিলেন। কিন্তু কমপ্লিট করতে পারেননি।”

”আমি পারব। দেখবেন, ঠিক পারব। আচ্ছা। রেসের মাঠটা যদি পঁচিশ চক্কর মারি, তা হলে কি ম্যারাথনের ডিসট্যান্স কভার করা যাবে?”

”তার চেয়েও বেশি।”

”ঠিক আছে, হাতে এখনও কিছু সময় আছে। এর মধ্যে তৈরি হতে পারব।”

”আপনি কি একা প্র্যাকটিস করেন?”

”আর কাউকে পাব কী করে বলুন। ওয়াইফকেও দৌড়ের নেশা ধরিয়েছি। ষাট বছর বয়সে। উনি এখন এখানে নেই। দিল্লিতে। মেয়ের কাছে গেছেন। নাতনির বিয়ে। তাই আজ একা দৌড়ে এলাম রেসের মাঠে। আজ লোকজন খুব কম। চলি তা হলে?”

”আসুন।”

প্রবোধবাবু জগিং করতে করতে একবালপুরের দিকে চলে যেতেই সুদীশ বলল, ”জগতে কতরকম লোক আছে, তাই না? এঁর বয়সে আমরা সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা করতে পারব কি না, সন্দেহ…”

সুদীশের শেষ কথাটা আমার কানেও গেল না। মাথায় একটা আলোর ঝিলিক মেরে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, ”এই সুদীশ ফিরে চল। এখন আর চা খেতে ইচ্ছে করছে না।”

…এক ঘণ্টা পর লালবাজারে সি পি—র ঘরে আমরা সাত—আট জন বসে। শর্মিষ্ঠাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যায়নি। হাসপাতাল থেকে আমাদের সঙ্গে এসেছে। জোজো—রহস্য কী করে সমাধান করলাম, শুনতে চায়। মারুতিতে যখন লালবাজারে আসছি, তখন একবার বলল, ”কালকেতুদা, আমার জীবনটা সার্থক হয়ে গেল। এই রাত্তিরটার কথা আমার মনে থাকবে। ভাবছি, এফ এম চ্যানেলে রহস্য উদ্ধার নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করলে কেমন হয়।”

জোজো মৃদু মৃদু হাসছে। ছেলেটাকে প্রথম দেখার পর থেকেই আমার খুব ভাল লেগে গেছে। ওকে বলেছি, জার্নালিজম পেশায় আসতে। এইরকম ডেয়ার ডেভিল টাইপের ছেলেই আমাদের পেশায় দরকার। ছেলেটা আমাকে টেক্কা মারতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেছে। মাঝখান থেকে একটা রাত্তির আমায় জাগতে হল। বাড়িতে ফুল্লরাও হয়তো জেগে বসে ছিল আমার জন্য।

সি পি প্রথম দিকটায় খুব রেগে ছিলেন। পরে আমি বোঝানোয় এখন স্বাভাবিক। ঘরে আর আছেন হোম সেক্রেটারি। পরে দেখা গেল, উনি জোজোর বাবাকে খুব চিনতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে নাকি একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। সুদীশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। জাহ্নবী ঘরে ঢোকার সাহসই পায়নি। মিনিট কয়েক আগে চিরকুট লিখে ও একটা খবর পাঠিয়েছে, জোজো সদ্য কাকা হয়েছে। পিন্টুর স্ত্রী হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।

চা—খাওয়ার ফাঁকে সি পি বললেন, ”জোজো, তুমি হঠাৎ পুলিশের ওপরে এত খেপে গেল কেন?”

জোজো বলল, ”সার, স্রেফ আপনার নজরে আনার জন্য। আপনি একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, থানায়—থানায় কী হয়।”

আমি বললাম, ”তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার ঘুমটা তুমি নষ্ট করলে কেন? তুমি কি পরীক্ষা নিচ্ছিলে আমি কত বড়ো গোয়েন্দা?”

জোজো হাসল। আমি বললাম, ”তোমার পুরো ব্যাপারটাই যে হোক্স… ভাঁওতা, তা ধরে ফেলি একবালপুরের রাস্তায় দৌড়দাদুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। ভদ্রলোক রেসের মাঠ থেকে দৌড়ে এলেন, অথচ একবারও বললেন না ওখানে প্রচুর পেট্রোল ট্যাঙ্কার দাঁড়িয়ে আছে। তখনই অঙ্কটা মেলাতে শুরু করি। এই যে হেস্টিংস থানায় গিয়ে ট্যাঙ্কার ছিনতাইয়ের অভিযোগ…এটা তো এমনি লোককে দিয়েও করানো যেতে পারে। এই কাজটায় নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করেছিল কালুয়া। আমি কি ঠিক বলছি জোজো?”

”হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”

”তারপর এফ এম চ্যানেলে আমাকে ফোন করে তোমার ক্ষোভ জানানো, এটার পেছনেও একটা উদ্দেশ্য ছিল। একটা প্যানিক সৃষ্টি করা। কেউ—না— কেউ রেডিওতে তা শুনবে এবং তা দ্রুত সি পি—র কানে পৌঁছে যাবে। এই কাজটাতেও তুমি সফল। তুমি জানতে অত রাতে ময়দান অঞ্চলে সত্যি—মিথ্যে বিচার করতে কেউ যাবেন না। পুলিশের লোক তো নয়ই। তুমি কয়েক ঘণ্টা সময় পাবে। কিন্তু একটা জিনিস জানতে চাইছি, কালুয়া এই প্লটটায় এল কীভাবে?”

জোজো বলল, ”আগে কালুয়ার সঙ্গে কেডিয়ার সম্পর্ক ছিল আদায়— কাঁচকলায়। তখন ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কিন্তু কিছুদিন আগে খবর পাই যে, পার্ক স্ট্রিটে কেডিয়ার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে কালুয়াকে। তখনই মনে সন্দেহ জাগে। আমি যে এত খবর রাখি, ও জানত না। তাই ও যখন এসে বলল, বিহার টাইপের এই অপারেশন করতে, তখন আমার সন্দেহটা গাঢ় হয়। ওর দলের লোকজন প্রায়ই হেস্টিংস থানার আশপাশে পেট্রোল ট্যাঙ্কারের ড্রাইভারদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে। ট্যাঙ্কার ছিনতাই করে ব্ল্যাকমেল করার প্ল্যানটা ও—ই দেয়। আমি রাজি হয়ে যাই। ও হরি সিংহ বলে একজন চেলাকে আমার কাছে পাঠায়। তাকে আমরা হাত—পা বেঁধে ক্লাবঘরে ফেলে রেখেছি। ওরই টাইম বোমা ফিট করার কথা ছিল। কালুয়া ভাবল, প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হয়েছে। ও চলে গেল কেডিয়ার ডেরায়। ভাবল, প্ল্যান অনুযায়ী কাজটা হলে আমি মারা পড়ব। কেডিয়ার পথের কাঁটা সাফ হয়ে যাবে। সেটা বুঝতে পেরেই ওকেই আমি ধোঁকা দিয়েছি। থানায় ট্যাঙ্কার ছিনতাইয়ের অভিযোগ গেছে। কিন্তু একটা ট্যাঙ্কারও ছিনতাই হয়নি। আসলে আমি এতক্ষণ ছিলাম টার্ফ ভিউ বাড়িটার একতলায় আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে। ওখান থেকেই হয়তো বাড়ি চলে যেতাম। কিন্তু বউদি হাসপাতালে ভর্তি হয়েই সব গণ্ডগোল করে দিল।”

বললাম, ”আমি জানতাম, তুমি হাসপাতালে ছুটে আসবে। তাই চা খেতে গিয়েও তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। না হলে তোমাকে ধরা যেত না। যাকগে, এসব ঠাট্টা আর করতে যেও না। দেখছ তো, বি বি সি পর্যন্ত এই খবরটা ব্রডকাস্ট করেছে।”

সি পি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও। ঘড়িতে সাতটার ঘণ্টা বাজতে লাগল। সেদিকে তাকিয়ে মনে—মনে হাসলাম। এই সময় বিস্ফোরণ হওয়ার কথা ছিল। হলে কী হত, ভাবতেই একসময় শিউরে উঠেছিলাম। তবে জোজো এই হুমকিটা দিয়ে একদিক থেকে পুলিশের খুব উপকারই করেছে। সি পি তো একটু আগেই বললেন, ”আমাদের ভিজিলেন্স কিন্তু আরও বাড়ানো দরকার। সেকেন্ড হুগলি ব্রিজের ওই অঞ্চলটা সত্যিই প্রোটেকটেড না।”

সি পি—র ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়িতে একটা খবর দিলাম। তারপর শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। হঠাৎই দেখি, দূর থেকে হাত তুলে সুদীশ দাঁড়াতে বলছে। কাছে এসে বলল, ”এই, তুই কোনদিকে যাবি?”

বললাম, ”সাউথ ক্যালকাটার দিকে।”

”চল, আমিও যাব। রাসবিহারীর দিকে আমার একটা কাজ আছে।”

গাড়িতে উঠে বসল সুদীশ। রেড রোডে কাছে পৌঁছতেই ও বলল, ”হ্যাঁ রে, কথাটা তোর মনে আছে?”

”কী কথা রে?”

”রোনাল্ডোর কথা। পারলে নিয়ে আয় না ইস্টবেঙ্গলে। ওয়ার্ল্ডে একটাই তো ক্লাব…রোনাল্ডো ধন্য হয়ে যাবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *