বেঁচে আছি
আজ কিছুদিন হল যাকে বলে শরীরটা ঠিক ভাল যাচ্ছে না। ঠিক কী অসুবিধে কিংবা কী কতটা খারাপ ইঞ্জিনের কোন অংশটা গড়বড় করছে বুঝিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু এই সেদিন পর্যন্তও রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথের পাশের তেলেভাজা বিপণির তপ্ত মধুর গন্ধে মন কীরকম উদাসীন হয়ে উঠত। এই তো গত বছর সাড়ে বারো ইঞ্চি (একত্রিশ সেন্টিমিটার) বারিবর্ষণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পরমানন্দে ছত্রহীন খালি মাথায় ছয় ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ময়দানে ফুটবলের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ দেখেছি, তারপর বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কটুবাক্য সহযোগে আদা-চা খেয়ে চমৎকার চাঙ্গা হয়ে উঠেছি।
দুঃখের বিষয় এসবই গত বছরের গত যুগের গত জন্মের ঘটনা। সবাই বলছে অর্থাৎ যাদেরই কাছে দুঃখ করছি আগের মতো অনাচারে আর উৎসাহ পাচ্ছি না তারা সবাই বলছে বয়েস তো চল্লিশ হয়ে গেল এবার একটু বুঝেসুঝে চলো। সাবধানে থাকবে। ছেলে-বউ নিয়ে কষ্টের সংসার, গোঁয়ার্তুমি একদম করবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গেলাস চিরতার জল খাবে। পাতে কাঁচা নুন খাবে না। রাতে শোয়ার সময় মাথার কাছের জানলা বন্ধ করে শোবে।
সকলের সব উপদেশ মেনে চলছি অন্তত চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু চিরতা কোথায় পাওয়া যাবে? একজন বললেন–তরকারির বাজারের পিছন দিকে যেখানে গৃহস্থ বালিকা এবং বিধবারা কঁচা আনাজ বেচে তাদের কাছে পাওয়া যাবে। গেলাম সেখানে কিন্তু চিরতা কোথায়। মধ্য থেকে এক সরল-দর্শনা গ্রাম্য কিশোরী আমাকে অপর্যাপ্ত মূর্খ ধরে নিয়ে একটি বল্লমের মতো সুতীক্ষ এবং সুদীর্ঘ চিচিঙ্গা গছানোর চেষ্টা করল। চিচিঙ্গা কিনলাম না কিন্তু চিরতাও পেলাম না। বিফল মনোরথ। হয়ে ফিরে এলাম।
সব শুনে পরদিন অফিসে একজন বললেন–তুমি চিরতা জানো না, তুমি তো একেবারে বুরবক হে! চিরতা কি শাক যে কাঁচা তরকারির বাজারে খুঁজতে গিয়েছিলে? বড় দেখে মুদির দোকানে খোঁজ করো, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে।
গেলাম মুদির দোকানে। সবসুদ্ধ সতেরোটি দোকানে গিয়েছিলাম। সাতজন দোকানদার কোনও উত্তর দিলেন না। চিরতা আছে কিনা? আমার এই স্পষ্ট ও অতি সরল প্রশ্নটির উত্তরে তারা যা করছিলেন, অর্থাৎ তেল কিংবা পেঁয়াজ ওজন কিংবা মুখে মুখে একটি বাইশপদী জটিল যোগ অঙ্ক, তাই করে যেতে লাগলেন, আমাকে হাবেভাবে বুঝে নিতে হল চিরতা নেই।
একজন দোকানদার কেন যেন ধরে নিলেন চিরতা কোনও একটা নতুন বেরোনো সাবান বা ব্লেডের নাম। প্রথমে একটি তাকের সমস্ত সাবানগুলির নাম পাঠ করে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং প্রত্যেকবার আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, কী নাম বললেন, চিরতা? এবং আমার উত্তর বা ব্যাখ্যার জন্যে অপেক্ষা না করেই পনেরো মিনিট গবেষণা করলেন। সাবান শেষ হয়ে গেলে ব্লেড। নিয়ে অনুরূপ ভাবে আরও দশ মিনিট ব্যয় করলেন। তারপর দুঃখের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন, চিরতা নামটা খুব চেনাচেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই জিনিসটাকে লোকেট করতে পারছি না!
সে যা হোক আর চারজন মুদিওলা আমার চাহিদা বাক্য প্রায় না শুনেই বললেন-এখন হবে। আমার অসুস্থ মুখমণ্ডলে কতটা দীনতার ভাব ছিল ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু এঁরা বোধহয় আমাকে ভিখারি-টিখারি কিংবা সাহায্যপ্রার্থী বেকার গ্র্যাজুয়েট সদ্বংশজাত ভদ্রলোক ঠাউরে নিয়েছিলেন। সময়, শরীর বা মনের অবস্থা ঠিক কোনওটাই ভাল নয়, তাই আর ঝগড়ার মধ্যে, অযথা বাদবিতণ্ডার মধ্যে এগোলাম না।
সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার অন্য একটা দোকানে। দোকানটা বেশ বড়। দুজন দোকানদার, দুজনই প্রায় একই রকম দেখতে। বোধহয় যমজ ভাই। আমি চিরতার কথা বলতেই দুজনে খুব খুশি হয়ে কী আলোচনা করতে লাগলেন। আলোচনার ছোট ছোট অংশ অল্প অল্প কানে এল।
তাতে বুঝতে পারলাম এঁদের মামার বাড়ি ময়ূরভঞ্জ না মজঃফরপুর কোথায় যেন, সেখানে সুজিকে বলে চিরতা। অনেকদিন পরে মামার বাড়ির দেশের একটা পুরনো শব্দ শুনে দুজনেই খুব পুলকিত এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলেন আমি ওঁদের মামার বাড়ির দেশের লোক কিনা? তদুপরি তারা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে যতটা চাই সুজি সংগ্রহ করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন।
বহু কষ্টে এই মাতুলালয়বিলাসী ভ্রাতৃযুগলের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু এর পরেও কোনও মুদির দোকানেই চিরতা পেলাম না, সবাই শুষ্ক কণ্ঠে কিংবা মাথা নেড়ে জবাব দিলেন, না, নেই।সুখের কথা সতেরোতম মুদি মহোদয় অতি মহানুভব, তিনি বললেন, চিরতা মুদির দোকানে পাবেন না। দশকর্মা ভাণ্ডারে খোঁজ করুন।
অত্যন্ত সন্দিগ্ধ চিত্তে দশকর্মা ভাণ্ডারে গেলাম। চিরকাল জানি এই সব ভাণ্ডারে বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা পুজোর সামগ্রী পাওয়া যায়, চিরতার মতো তিক্ত জিনিস ওইসব মধুর অনুষ্ঠানের সামগ্রীর সঙ্গে কেন বিক্রি হবে এইসব কঠিন প্রশ্ন ভাল করে ভাবার আগেই প্রথম দশকর্মা ভাণ্ডারেই চিরতা পেয়ে গেলাম।
প্রয়োজনীয় কোনও বস্তু পেলে তা যদি তিতাও হয় তবু মানুষ যে কত খুশি হতে পারে আমার চোখ-মুখ দেখলে সেটা বোঝা যেত। একবারে অনেকটা চিরতা কিনে ফেললাম দোকানদারদের পরামর্শ নিয়ে, পুরো ছয় মাসের খোরাক।
কিন্তু বাড়ি ফিরে বিপত্তি হল। আমাদের প্রাচীনা পরিচারিকা ভূয়োদর্শিনী মহিলা, তিনি চিরতার ঠোঙা খুলে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে রায় দিলেন, এটা চিরতাই বটে কিন্তু আসল চিরতা নয়, রামচিরতা। এতে ঝঝ তেজ অনেক কম। বাবুকে সরল প্রকৃতির মানুষ দেখে দোকানদাররা ঠকিয়ে দিয়েছে।
তা ঠকাক, ঝাঁঝ-তেজে আমার দরকার নেই, চিরতা হলেই হল। সকালবেলা ভিজিয়ে খেতে পারলেই হল। প্রথমদিন এক গেলাস চিরতার জল খেয়ে ভোরবেলায় লম্বালম্বি কাটা কলাগাছের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে। এই যদি কম তেজ হয়, রামচিরতাই যদি এরকম বঁঝালো হয়, কে জানে প্রকৃত চিরতা কীরকম! প্রকৃত চিরতা যে রকমই হোক আমার এই রামচিরতার জল এক গেলাস খাওয়ার পরে এক গেলাস নিমের পাতার রস শরবতের মতো মনে। হবে। প্রথমদিন জ্ঞান ফিরে আসার পর জিবের অসহ্য তিতা ভাব কাটানোর জন্যে একটা কাঁচা উচ্ছে চিবিয়ে খেলাম, মনে হল বাতাসা খাচ্ছি।
এইভাবে সপ্তাহ তিনেক চলে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই সাংঘাতিক পানীয় এক গেলাস খেয়ে গুম মেরে পড়ে থাকি। শুভানুধ্যায়ীরা যে যা পরামর্শ দিয়েছিল সব মেনে চলি। পাতে কাঁচা নুন খাই না, রাতে শোয়ার সময় বহুকালের অভ্যাস পালটিয়ে মাথার কাছের জানলাটা বন্ধ করে শুই। কিন্তু শরীর ও মনে সেই পালিশ করা জুতোর মতো ঝকঝকে ভাবটা কিছুতেই ফিরে আসছে না।
এর মধ্যে আমাদের দেশের এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে সকালবেলা দেখা করতে এলেন। তিনি আমাদের পরিবারকে তিন পুরুষ ধরে চেনেন। তিনি যখন এলেন তখন তরল চিরতা পান করে যথারীতি কুঁদ হয়ে বসে আছি। আমি বহু কষ্টে তার সম্মুখীন হলাম। সেই স্বদেশি ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে হায়-হায় করে করে উঠলেন। প্রথমে তার অহেতুক সন্দেহ হল, আমি বোধহয় গতরাতে খুব নেশা করেছি, এই ভরসকালে এখনও সেই ঘোরে আছি। কিন্তু কিছু পরে আমাকে ভালভাবে অবলোকন করে পারিবারিক মাদকবিরোধী ঐতিহ্য স্মরণ করে এবং সর্বোপরি আমার কথা শুনে তিনি বুঝলেন কোনও মাদক নয়, ওষুধ পান করেই আমার এ অবস্থা। তার উপরে তিনি যখন শুনলেন আমি খালি পেটে চিরতার জল খাচ্ছি, রীতিমতো আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। আমাকে জানালেন আমাদের পরিবারে এ ঘটনা আগেও ঘটেছে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। আশি বছর বয়সে আমার ঠাকুরদা যে হার্টফেল করে লোকান্তরিত হয়েছিলেন সেও ওই খালি পেটে চিরতার জুল খাওয়ার জন্যে। পরামর্শ দিলেন চিরতার জলে তত আপত্তি নেই, তবে খালি পেটে নয়, সঙ্গে দু ছটাক মিছরি খেতে হবে।
এখন আর দু ছটাক কোনও জিনিস পাওয়া যায় না। দৈনিক একশো গ্রাম করে মিছরি খেতে লাগলাম। মানে ষাট পয়সা দিনে, মাসে আঠারো টাকা খরচ বেড়ে গেল।
কিন্তু তেমন কোনও উপকার হল না। সেই চনমনে ঝকঝকে ভাবটা কিছুতেই ফিরে আসছে না। বাল্যকালে পরশুরামের চিকিৎসা সংকট গল্পটি পড়েছিলাম সেটা মনে করে খুব বেশি ডাক্তার বৈদ্যের কাছে যেতে ভরসা হল না।
কিন্তু একদিন একটা বোকামি করে বসলাম। কথায় কথায় পুরনো এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম, ভিয়েনা থেকে এক সদ্য-প্রত্যাগত ডাক্তার শারীরিক ও মানসিক দুর্দশার চমৎকার আধুনিক চিকিৎসা করেন। পার্ক স্ট্রিটের একটা বড় বাড়িতে ঠিকানা, ফি মাত্র কুড়ি টাকা।
পরের দিন সন্ধ্যায় ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পার্ক স্ট্রিটের সেই বাড়িতে পৌঁছলাম। প্রাগৈতিহাসিক বাড়ি, বিশাল অন্ধকার অট্টালিকা। সাততলা বাড়ির ছয়তলায় ডাক্তার সাহেব বসেন, সিঁড়িতে আলো নেই। একটি মোগল আমলের লিফটে কাগজের নোটিশ লাগানো, লিফট আউট অফ অর্ডার। এই নোটিশটিও বহুদিনের পুরনো, কাগজ মলিন হয়ে গেছে, সিপাহি যুদ্ধের বা তারও আগের কালের বলে মনে হয়।
বহু কষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে ছয়তলায় উঠলাম। উঠেই সামনে ডাক্তার সাহেবের ঘরে আলো জ্বলছে, পর্দা তুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম, দেখে ঠিক ডাক্তারের ঘর মনে হয় না। সেক্রেটারিয়েট টেবিলে এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক চশমা চোখে বসে রয়েছেন। আমি ঢুকতেই বললেন–বলুন আপনার কী অসুবিধে?
আমি আমার অসুখের আদ্যোপান্ত বলে গেলাম গড়গড় করে। ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা নামিয়ে কেমন গম্ভীর হয়ে সব শুনলেন। আমার বলা শেষ করে আমি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কী হয়েছে মনে হয় আপনার?
ভদ্রলোক তার টেবিলের উপর চশমাটা পর পর তিনবার ঠুকলেন, তারপর বললেন,–আপনি অত্যন্ত মোটা, কুৎসিত ভুড়ি হয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে কুকুরের মতো জিব বার করে হাফাচ্ছেন, তা ছাড়া আপনার গলার স্বর অতি বদখৎ, গাঁজা না খেলে মানুষের এত হেঁড়ে গলার স্বর হয় না।
তিনি আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, আমি হতভম্ব হয়ে প্রতিবাদ করলাম, আপনি কী রকম ডাক্তার, আমি অনেক উন্মাদ, রাগী দুর্দান্ত ডাক্তারের কথা শুনেছি, কিন্তু এ কী?
আমার অভিযোগ শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রলোক বললে গেট আউট। অন্ধ কানা চোখে দেখতে পাও না, আমি হলাম ইনকাম ট্যাক্সের উকিল, বোকা বাইরে নেমপ্লেট না দেখে ঢুকে পড়েছ! যাও বেরোও, তোমার ডাক্তার ওই সিঁড়ির শেষ মাথায়, এই বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বের করতে করতে গজগজ করতে লাগলেন! কত কষ্ট করে দুবেলা ছতলায় উঠে বসে থাকি, তা মক্কেলের পাত্তা। নেই, রোগীর পর রোগী, এ এক আচ্ছা ঝামেলা বেধেছে!
অকারণে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে এসে একটু এগিয়েই ডাক্তারের ঘর পেলাম। বাইরে স্পষ্ট নেমপ্লেট লাগানো রয়েছে, আমারই ভুল হয়েছে, প্রথমেই দেখে ঢোকা উচিত ছিল।
যা হোক, ডাক্তারের ঘরে গেলাম। দেখি বেশ কয়েকজন রোগী-রোগিণী বসে। ঘণ্টা দেড়েক পরে আমার ডাক এল। ডাক্তারসাহেব আমার সব কথা মন দিয়ে শুনলেন, নাড়ি দেখলেন, পেট টিপলেন, গলাখাঁকারি দিতে বললেন, অনেক গোপন কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন, আপনার কিছু হয়নি, রাতে ঘুম একটু হালকা হচ্ছে তাই সারাদিন ক্লান্ত লাগছে। রাতে শোয়ার আগে এক গেলাস গরম দুধ আর দুটো বিস্কুট খেয়ে শোবেন। ওষুধ-টষুধ লাগবে বলে মনে হয় না।
খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
এসব প্রায় চার মাস আগেকার কথা। ডাক্তারসাহেবের পরামর্শ অনুসরণ করে মোটামুটি ভালই ছিলাম। কিন্তু আজ কিছুদিন হল আবার ক্লান্ত অবসন্ন বোধ করছি। একদিন হাঁটতে হাঁটতে অফিস ফেরত আবার চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিটের সেই ডাক্তারসাহেবের চেম্বারে। আবার সেই লিফট আউট অফ অর্ডার, আবার পায়ে হেঁটে হাঁফাতে হাঁফাতে ছয়তলা। তবে এবার আর আয়করের উকিলের কাছে গিয়ে। অপমানিত হলাম না, ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না, কারণ দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে।
সোজা চলে গেলাম ডাক্তারের ঘরে গিয়ে দেখি সেই ঘর, সেই পরিবেশ, রোগী-রোগিণীও রয়েছে যেমন আগে দেখেছিলাম। আগের বারের মতোই ঠিক দেড় ঘণ্টা পরে আমার ডাক পড়ল। কিন্তু চেম্বারের ভিতরে গিয়ে দেখলাম ডাক্তারের আসনে যিনি বসে আছেন, তিনি আগের ব্যক্তি নন। আমি দ্বিধাগ্রস্ত বললাম, আমি তো আপনার রোগী নই, যাঁকে দেখিয়েছিলাম তিনি কোথায়?
নতুন ডাক্তারসাহেব জানালেন আগের জন আবার ভিয়েনায় গিয়েছেন আর উনি সদ্য ভিয়েনা থেকে এসেছেন। উনি যখন যান ইনি আসেন, ইনি যখন যান তখন উনি আসেন। তিন মাস পর পর এই বাঁধাধরা রুটিন। কোনও অসুবিধে নেই, উনির মতো ইনিও সদ্য ভিয়েনা ফেরত আধুনিক চিকিৎসক, ওঁকে দেখানো আর এঁকে দেখানো আসলে একই কথা।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে এঁকেও আমার বৃত্তান্ত বললাম। ইনিও সব কথা মন দিয়ে শুনলেন, নাড়ি দেখলেন, পেট টিপলেন, গলাখাঁকারি দিতে বললেন, অনেক গোপন কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে বললেন, আপনার কিছু হয়নি, রাতে ঘুম একটু কম হচ্ছে তাই সারাদিন ক্লান্ত লাগছে। রাতে শোয়ার আগে দু গেলাস জল খেয়ে শোবেন, ওষুধ-টষুধ লাগবে মনে হয় না।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ঠিক চার মাস আগে আপনার পূর্বসূরি, আগের ডাক্তারসাহেব এক গেলাস গরম দুধ আর দুটো বিস্কুট খেয়ে শুতে বলেছিলেন। আর আপনি বলছেন শুধু দু গেলাস জল খেতে!
আমার কথা শুনে নতুন ডাক্তারসাহেব একবিন্দুও বিচলিত হলেন না। বললেন, জানেন তো আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান প্রতিদিন এগোচ্ছে, এই চার মাসে আগাগোড়া বদলে গেছে, বলে একটু মুচকিয়ে হেসে যেন খুব গোপন কথা বলছেন এইভাবে গলা নামিয়ে বললেন, এই জন্যেই তো প্রতি তিন মাস অন্তর আমরা বিদেশে গিয়ে নতুন খবর নিয়ে আসি, সেইভাবে চিকিৎসা করি।
আমি বিশ টাকা ভিজিট দিয়ে আস্তে আস্তে ছয়তলা ভেঙে নীচে এলাম।