বৃষ্টি মহল – ১.৫

নড়ে উঠতেই অমৃতার ডান পা টা সটান গিয়ে লাগল আকাশের মাথায় আকাশ গোঙানির মতো শব্দ করে ঘুমকাতুরে গলায় বলল, ‘লাথি মারলি কেন?’ 

‘দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে তুই আমার পায়ে আইসা পড়ছস, লাথি মারব না তো কি আদর করব?’ অমৃতা ওঠে বসতে বসতে বলল। 

আকাশ দাঁত কিড়মিড় করল, ‘কেউ তোর পায়ে পড়ে নাই।’ 

কার্পেটের ওপর লেপটে বসে সোফার গদিতে মাথা হেঁট করে ঘুমিয়ে পড়েছিল আকাশ। অমৃতা শুয়ে ছিল সোফার ওপর লম্বা হয়ে। সুতরাং আকাশের মাথাটা ছিল অমৃতার দু পা থেকে তিন ইঞ্চি দূরত্বে। তাই অমৃতা নড়ে উঠতেই ঠশ করে লেগে গেল আকাশের দুক্রর মধ্যিখানের কপালে। 

‘ঘুম ভাঙার পর দেখি তুই আমার পা ধইরা মাফ চাইতাছস, এখন আবার মিথ্যা কথা বলে।’ 

আকাশ ওর রক্তবর্ণ চক্ষু দুটো মেলে অমৃতার দিকে চাইল, বিষাক্ত কণ্ঠে বলল, ‘দূর হ এখান থেকে!’ 

অমৃতা ঘড়ি দেখল। সাড়ে পাঁচটা বাজে। ঘরের ভেতরে এখনও অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। রাতে আড্ডা দিতে গিয়ে অনেক বেজে গিয়েছিল। মেয়েদের জন্য পাশের ঘরটা বরাদ্দ থাকলেও গল্প করতে করতে রুদ্রর ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে সব। হৃদি আর বিভা বিছানায়। অমৃতা সোফায়। সামি, রুদ্র কার্পেটে। আর আকাশটাতো আধশোয়া অবস্থায়ই কাটিয়ে দিলো পুরো রাত। 

অমৃতা উঠে পড়তেই আকাশ চটপট সোফাটা দখল করল। কুশন বুকে নিয়ে ভারি আরামের ভঙ্গিতে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করল সে। 

অমৃতা আকাশের পেটে একটা গুঁতা দিয়ে বলল, ‘এই আকাশ! উঠে যা। রেডি হতে হবে।’ 

‘বিরক্ত করিস না।’ ঘুমকাতুরে গলায় বলে আকাশ। 

‘শেষে কিন্তু তোকে ফেলে রেখে চলে যাব।’ 

‘জাহান্নামে যা!’ 

‘জাহান্নামে না, কক্সবাজার যাব।’ 

‘দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।’

‘আজিব কারবার!’ 

আকাশের কাছে ব্যর্থ হয়ে হাঁড়িপানা মুখ নিয়ে এবার অমৃতা আসল হৃদি আর বিভার বিছানায়। বালিশের কাছটায় বসে আলতোভাবে ডাকল হৃদিকে। 

‘ওঠে যা, ভোর হয়ে গেছে। 

হৃদি ঘুমো চোখে একবার তাকাল অমৃতার দিকে। হাত প্রসারিত করে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরল অমৃতার হাঁটু দুটো। মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। পরমুহূর্তেই আবার ঘুমে কাদা। 

অমৃতা হৃদির বাহুবেষ্টনি থেকে নিজের হাঁটু উদ্ধারের চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘আর ঘুমাবি না, ওঠ বলছি!’ 

হৃদি আবার মুখ দিয়ে একই রকম শব্দ করল। 

অমৃতা হৃদির পাশে শুয়ে থাকা বিভাকে একটা ধাক্কা দিয়ে অধৈর্য হয়ে বলল, ‘এই তোরা যাবি না কক্সবাজার?’ 

‘উফ! গুল্লি মারি কক্সবাজারের! ঘুমাইতে দে!’ বিভা বলল ধমকের সুরে। 

হতাশ অমৃতা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হৃদির বাহুবেষ্টনি থেকে নিজের হাঁটুদ্বয় মুক্ত করল। হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাওয়া ঠাণ্ডা। একটু আগে আজান পড়েছে। রুদ্রদের উঠানের সামনেই পাহাড় কাটা সরু রাস্তা। রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে মিশেছে বড় রাস্তার সাথে। বড় রাস্তার মোড়ে মসজিদ। মসজিদে ধীরে ধীরে মুসল্লিরা ভিড় করছে ফজরের জামাত ধরবে বলে। রাস্তার দুধারের পাহাড়ে আগাছা আর ঝোপঝাড়। ঘোলা কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে অন্ধকার এখনো মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে ঝোপঝাড়ের ভেতর। পুবের আকাশে ছোপ ছোপ লাল নকশা। এক টুকরো মেঘের ওপর নতুন সূর্যের আলো এসে পড়েছে। মেঘটার রং এখন সোনালি। অমৃতা সোনাবরণ মেঘটার দিকে বেশ খানিকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। আচ্ছা! মেঘ ছুঁতে কেমন লাগে? সে জীবনে কখনো মেঘ ছোঁয়নি! 

পকেটে রাখা সেলফোনটা বিপবিপ করে শব্দ করে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল আম্মি মেসেজ পাঠিয়েছে। লিখেছে, ‘কক্সবাজার থেকে আচার নিয়ে আসিস আর দীপা বলেছে ওর জন্য চন্দন সাবান নিয়ে আসতে।’ 

অমৃতার মুখে একটা চিলতে হাসির রেখা ফুটল। দীপা ওর ছোট বোন। রূপচর্চাই ওর জীবনের সব। অমৃতা জীবনে কখনো মুখে পাউডারটা পর্যন্ত লাগায়নি। অন্য কোনো রকম সাজসজ্জা তো দূরের কথা। মুখ ধোবার জন্য লাক্স সাবানই তার জন্য যথেষ্ট। আর দীপা হয়েছে ঠিক তার উল্টো। ভীষণ ফ্যাশনেবল, স্টাইলিশ এবং রূপসচেতন। একদমই বাস্তববাদী নয়। 

অমৃতা রিপ্লাইতে লিখল, আচ্ছা আম্মি, তোমরা ভালো থেক। আমরা এখনো রুদ্রর বাসায়। আপডেট দিব তোমাকে 

পেছনে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। অমৃতা ঘুরে তাকিয়ে দেখল, রুদ্র। ওর ঘাড় ছোঁয়া চুলগুলো এলোমেলো কাকের বাসা হয়ে আছে। গালভর্তি লম্বা লম্বা দাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে জট পাকিয়ে গেছে। অমৃতার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাই তুলতে তুলতে সে বলল, ‘ওঠে গেছিস?’ 

অমৃতা রুদ্রকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে বলল, ‘তোরে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

রুদ্র দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে উদাস গলায় বলল, ‘কেমন দেখাচ্ছে?’

‘কোন একটা জন্তুর মতো যেন লাগছে, এ মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না।

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকাল অমৃতার দিকে, চোখাভাবে বলল, ‘মজা নেও?’

‘মজা নিব কেন সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠে? পেটে নাস্তা পানি কিছু পড়ে নাই এখনও, এখন কি মজা নেওনের মুড আছে?’ 

‘তাইলে কী কইলি এইমাত্র?’ 

‘কইলাম তোরে একটা জন্তুর মতো লাগতেছে দেখতে।’ এটুকু বলে একটু থেমে অমৃতা আবার বলল, ‘তোকে দেখাচ্ছে রিয়েল বিস্টের মতো, বিউটি এন্ড দ্যা বিস্ট এর বিস্ট না, রিয়েল বিস্ট, ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালে একবার সত্যিকারের বিস্ট পাওয়া গিয়েছিল, এ বিষয়ে একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম তোকে ঠিক সেরকম দেখাচ্ছে।’ 

রুদ্র দুহাত দিয়ে আউলা চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল, ‘অন্য কাউকে কিছু বলার আগে নিজের চেহারাটা আয়নায় গিয়ে দেইখা আয়। চুলটুল কাইট্টা এরকম চোর সাজছস ক্যান তুই? তোরে দেইখা মনে হইতাছে রাস্তার টোকাই। মাথা ন্যাড়া টোকাই চোর।’ 

‘আমারে ঠিকই লাগতেছে। শোন দোস্ত প্লিজ আগে, শেভ কইরা আয়।’ 

রুদ্র করুণ গলায় বলল, ‘কেন?’ 

‘খুব খারাপ দেখাচ্ছে। এ দাড়ি আর চুলের জঙ্গলের পেছনে যে একটা সুন্দর চেহারা আছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না।’ 

‘আচ্ছা দেখি, তুই এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন?’ 

‘তো কী করব? নাস্তা পানি কিছু পাওয়া যাবে? 

‘আম্মা তো ঘুমে এখনও, কাজের মানুষগুলোও ওঠে নাই। দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না। 

‘থাক তোর কিছু করা লাগবে না, আমি দেখছি।’ 

অমৃতা রান্নাঘরে আসলো। ফ্রিজে পাউরুটি, ডিম আর বিফ সালামি পাওয়া গেল। বেশ কয়েকটা রুটি টোস্টারে গরম করে নিল চটপট। চারটা ডিমের ওমলেট করল। টমেটো, শশা কেটে পাউরুটির ভেতরে দিয়ে ডিম আর সালামির স্যান্ডউইচ বানাল সে। চুলায় বসিয়ে দিলো চায়ের পানি। রুদ্র আর বিভা চা খায় না। ওদের জন্য গ্রাইন্ডারে গ্রাইন্ড করে নিল কমলার রস। 

জানালা খুলে দিতেই ঝপ করে লাফ দিয়ে এসে মেঝেতে পড়ল ভোরের নরম আলো। সাথে শীতের ভারি বাতাস, কাকের কা-কা, আর চড়ুইয়ের কিচিরমিচির। অমৃতা কফি রঙের টিশার্টের ওপর একটা সাদা হাতাকাটা সোয়েটার পরেছিল। শীতল বাতাসটা তাই পাতলা সোয়েটার ভেদ করে ধারালো ছুরির মতো গিয়ে বিঁধল শরীরে। ঠাণ্ডায় সামান্য কাঁপলো সে। 

রুদ্র হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালে হাতে ডাইনিংয়ে এসে মুগ্ধ হয়ে গেল।

‘বাব্বা! ব্রেকফাস্ট রেডি?’ 

‘হুম রেডি, কুম্ভকর্ণগুলা এখনো ওঠে নাই না? 

‘না’ 

রুদ্র একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, ‘উঠুক ওরা ওদের সময়মতো। আমি খাই। আই এম ফ্রিকিং হাঙরি’ 

‘দেরি করলেই দেরি হয়ে যাবে বুঝছিস? চিটাগাঙে এমনি যানজটের অবস্থা কেমন?’ 

‘ভালো না। সন্ধ্যার দিকে খুব ভিড় হয় আজকাল, কয়েকটা জায়গা আছে যেগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকে। মানুষ বাড়ছে তো। তবে ঢাকা থেকে কম এখনো।’ স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রুদ্র। 

অমৃতা রুদ্রর জন্য গ্লাসে কমলার জুস ঢালতে ঢালতে বলল, ‘হুম, লাস্ট ইয়ার আমি আসছিলাম আব্বুর সাথে ফ্লাইটে। আমাদের প্লেন ল্যান্ড করছে তোর ইশে… ছয়টার দিকে, বুঝছস? এরপর আমার ফুপুর বাসায় পৌঁছেছি কখন জানোস? রাত দশটায়। মানে সে রকম ট্রাফিক ডিজাস্টার। পতেঙ্গার ওইখানটায় মনে কর বইসা ছিলাম দুই ঘণ্টার মতো।’ 

‘সেটাই, পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মন চায় কী জানিস, ইউরোপের কোনো একটা দেশে গিয়া সেটেল হই!’ 

‘আরে না, যত যাই বলিস নিজের দেশের চেয়ে শান্তি আর কোথাও নাই।’ 

রোজ সকালে চোখ খুলেই একবার ফেসবুকের পাতায় চোখ বুলানোটা বিভার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন কমপক্ষে একটা ছবি আপলোড করা তার চাইই চাই। গতকাল রাতে ঘুমাবার আগে সব বন্ধুদের সাথে তোলা একটা গ্রুপ ফটো আপলোড করেছিল। ক্যাপশন দিয়েছিল, ‘ফুল নাইট মাস্তি উইড ফ্রেন্ডস’ এরপর একটা হাসির ইমো। আজ ভোরে ফেসবুকের পাতায় প্রথম নজরটা দিতেই দেখা গেল প্রায় পঞ্চাশটার মতো লাইক পড়ে গেছে। অনেকেই এটা-সেটা কমেন্ট করেছে। এরমাঝে আকাশের কমেন্টটা সবচেয়ে নজর কাড়ল। আকাশ লেখেছে, 

‘মাস্তি জিনিসটা কী? এটা কোন দেশি শব্দ? এসব খ্যাত মার্কা ক্যাপশনে আমারে ট্যাগ মারবি না।’ 

মেজাজটা বিগড়ে গেল। কপাল কুঁচকে মুখটাকে ছুঁচোর মতো বানিয়ে সে আশেপাশে আকাশকে খুঁজতে লাগল। ওইযে শুয়ে আছে তিনকোণা হয়ে সোফার ওপর। গলা দিয়ে ঘড় ঘড় করে একটা আওয়াজ বের হচ্ছে ওর। রাগের চোটে ইচ্ছে হলো ওর পাছায় একটা লাথি মারে। সত্যি সত্যি আকাশকে মারার জন্য বিছানা ছাড়তে যাচ্ছিল সে। কিন্তু তার আগেই চোখে পড়ল রুদ্রর পোস্টটা। রুদ্রর ফোনে তোলা সেলফি। রুদ্রর পাশে অমৃতা। সামনে খাবার টেবিলের ওপর রাখা স্যান্ডউইচ আর অরেঞ্জ জুস। রুদ্র ক্যাপশন দিয়েছে, ‘ব্রেকফাস্ট: মেড বাই অমৃতা। ইটস ডিলিশাস!’ খুব দাঁত কেলিয়ে হাসছে দুজন। মেজাজটা আরো খিঁচড়ে গেল। রেগে মেগে কমেন্ট করল সে, ‘অমৃতা চুন্নি আর রুদ্র রাক্ষস! খা খা, আরো খা! পাশের ঘরে আমি ক্ষুধায় মইরা যাই আর তোরা ডিলিশাস খানা খাস! পেট খারাপ হবে অভিশাপ দিলাম!’ 

সেকেন্ডের ভেতরেই অমৃতার রিপ্লাই আসলো, ‘কেন তুমি তো কক্সবাজারকে গুল্লি মাইরে ঘুম দিলা, ইট ওয়াজ ইওর কল বেবি! কতবার ডাকলাম, আমাকে কুত্তার মতো তাড়ায় দিয়ে এখন আবার খুব হিংসা হচ্ছে, তাই না? 

হঠাৎ সামি ধড়ফড় করে শোয়া থেকে ওঠে বসল। তার চোখে ঘুম। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ছুঁয়েছে। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘বিভা! তুই ঠিক আছিস?’ 

বিভা পানসে মুখে উত্তর দিলো, ‘না ঠিক নাই। সকাল থেকে আমার বন্ধুরা আমারে বাঁশ দিতাছে। শালা তোরা বন্ধু নামের কলঙ্ক।’ 

সামি কিছু বলল না, মুখ হা করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকল। 

বিভা অবাক গলায় বলল, ‘তর কী হইছে? তুই অমন কাতল মাছের মতো হাঁসফাঁস করতেছিস কেন?’ 

‘নাইট মেয়ার!’ 

‘কী দেখছিস?’ 

‘দেখলাম আমি আর তুই, আমরা দুজন সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি, চারপাশে প্রবল ঝড়। বড় বড় ঢেউ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’ 

বিভা নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলল, ‘দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে আমারে নিয়াই কেন তোর স্বপ্নে পানিতে ডুইবা মরতে হইল বল তো? অমৃতা চুন্নি আর রুদ্র রাক্ষসটারে নিলে তো পারতি। চুন্নি আর রাক্ষস দুইজন মিল্লা খুব ব্রেকফাস্ট বিলাস করতাছে।’ 

সামি কিছুটা বিরক্তি আর কিছুটা হতাশার গলায় বলল, ‘দূর, তোর মতো ডুশব্যাকের সাথে কথা বলা আর না বলা একই কথা।’ 

গায়ের ওপরের কম্বলটা হাত দিয়ে তুলে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সামি ওঠে পড়ল শোয়া থেকে। 

‘না, অসম্ভব, আমার এখনো বিয়া হয় নাই। মরতে রাজি না।’ অমৃতাকে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসতে দেখে সামি বলে উঠল। 

রুদ্রদের গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা সব। তখন সূর্যদেব মাঘ মাসের সকাল আটটার নির্মেঘ আকাশ থেকে নিশ্চিন্তে স্বর্ণালি কিরণ ছড়াচ্ছে। রোদ ঝকঝকে চমৎকার একটি দিন। 

বিভা সুর মিলিয়ে বলল, ‘আমারও বিয়া হয় নাই, আমিও মরতে রাজি না!’

‘তোদের কথা শুইনা তো মনে হইতাছে তগো জীবনের একটাই এম্বিশান, বিয়া। আমি বললে বলব, আমার এখনো স্পেসে যাওয়া হয় নাই, চাঁদে যাওয়া হয় নাই, মঙ্গলে গিয়ে নাচা হয় নাই। সুতরাং আমি মরতে চাই না।’ রুদ্র বলল। 

‘এগুলো হইল ঢং’ 

‘ঢঙের কী আছে? আমি তো চাঁদে যাব হানিমুন করতে, জানোস না?’ 

‘চন্দ্রে যাবি হানিমুন করতে, কোন দুঃখে? রোমান্সও তো করতে পারবি না।’

‘রোমান্স করুম না খালি ভাসমু। ভাইসা ভাইসা চাঁদ থেকে পৃথিবী দেখমু। এইটা কি কম রোমান্টিক?’ 

‘সাইকো’ 

আকাশ গাড়ির জানালার কাচে নাক ঠেকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘সত্য সত্যই তুই গাড়ি চালাবি?’ 

অমৃতা গাড়ি থেকে নেমে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘শোনো সবাই, আমি গাড়ি চালাব, তোমাদের কোনো সমস্যা আছে?’ 

বন্ধুরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হৃদি মিনমিন করে বলল, ‘না মানে তোকে তো এর আগে কখনো গাড়ি চালাতে দেখিনি তাই আরকি আমরা একটু ভয় পাচ্ছি।’ 

‘কীসের ভয়?’ 

আকাশ ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘মৃত্যু ভয়।’ 

‘কেন মৃত্যুকে এত ভয়ের কী আছে? কয় দিন আগেই না মাঝরাতে ফোন দিয়া কইতাছিলি দোস্ত মইরা যামু কিছু ভাল্লাগে না! এখন যদি আমি গাড়ি চালানোর উছিলায় ফ্রিতে মইরা যাস তাইলে তো সোনায় সোহাগা। আপত্তি কীসের?’ 

‘আহা তখন তো মন মেজাজ ভালো ছিল না, লাইফের ট্র্যাজিডি পার্টে ছিলাম। এখন তো আছি লাইফের ভালো জায়গায়, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আমোদ করতে যাইতেছি, এখন মরমু ক্যান?’ 

অমৃতা আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে ওঠে স্টার্ট দিলো, বলল, 

‘আমি চললাম, তোরা চাইলে আসতে পারিস।’ 

সবাই বাধ্য হয়ে ওঠে বসল গাড়িতে। পেছনে চারজন চাপাচাপি করে বসতে হলো। আসলেই কষ্ট হয়ে গেল খুব। রুদ্র আর বিভা মাঝখানে আর আকাশ আর হৃদি জানালার দু পাশে বসল। রুদ্র হাসফাঁস করতে করতে বলল, ‘ও আল্লাহ্! এত মোটকা কেন তোরা? আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!’ 

অমৃতা গাড়ি ব্যাকে নিয়ে চমৎকার পাশ কাটিয়ে বের হয়ে আসলো রুদ্রদের গ্যারেজ থেকে। তারপর দেবপাহাড়ের ঢালু গলি পার হয়ে চলে আসলো বড় রাস্তায়। তার আগ পর্যন্ত সবগুলা কাঠ হয়ে বসে ছিল। কারো মুখে কোনো কথা ছিল না। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল রোলার কোস্টারে উঠেছে। বড় রাস্তায় নামতেই আকাশ বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘যাক, এ যাত্রায় মনে হয় বাইচা যামু। আলহামদুলিল্লাহ।’ 

রুদ্র অমৃতাকে প্রশ্ন করল, ‘গাড়ি চালানো শিখলি কবে?’

‘এইতো মাস দুয়েক হবে।’ অমৃতা উত্তর দিলো।

‘আংকেল গাড়ি কিনছেন?’ 

‘না প্ল্যান করতেছে, কিনবে এইতো কিছুদিনের মধ্যেই।’

‘লাইসেন্স আছে তো?’ 

‘তোর কি ধারণা আমি আইনজীবী হয়ে নিজেই আইন ভঙ্গ করব?’

‘ও আচ্ছা ভুলে গেছিলাম। তুই তো আবার লায়ার।’ 

‘লায়ার নয়, ল’ইয়ার। 

ওই একই।’ 

‘লাখি খাবি রুদ্র।’ 

‘লাখিমাথি সব পরে হবে, এখন তুমি মন দিয়া গাড়ি চালাও।’ 

আকাশের বুক পকেটে মোবাইলটা বাজছিল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ অসম্ভব ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করল, ‘বাবা তুমি কোথায়?’ 

প্রশ্নটা শুনে আকাশ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তার সটান ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হলো। মুখে ফুটে উঠল বিরক্তির এক স্পষ্ট ছাপ। কয়েক সেকেন্ড পর সে গম গম করে বলল, ‘কেন জানতে চাইছেন?’ 

ধারাল প্রশ্ন শুনে নারীকণ্ঠটি একটু হোঁচট খেল বোধহয় কিন্তু পরমুহূর্তেই চমৎকার সামলে নিয়ে বলল, ‘না, তোমার আব্বা দুশ্চিন্তা করছিলেন তো তাই।’ 

‘আব্বাকে বলবেন আমি বন্ধুদের সাথে আছি, ভালো আছি। চিন্তার কিছু নেই।’ বলে আকাশ লাইন কেটে দিলো। 

রাতে ভালোমতো ঘুম হয়নি বলে বিভার এখন একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। আকাশের কথা শুনে এক চোখ খুলে সে জড়ানো গলায় বলল, ‘কার সাথে কথা বলিস অমন ক্যাট ক্যাট করে?’ 

‘কার সাথে আবার, আমার বাপের মিস্ট্রেসের সাথে। বিরক্তিকর।’

‘ছি, দোস্ত এভাবে বলে না।’ 

আকাশ পাশ কাটানো গলায় একবার ‘হুম’ বলে চুপ করে গেল। 

মহিলার ধৈর্য দেখে অবাক না হয়ে পারে না আকাশ। কাটল তো বেশ কয়েকটা বছর। এ এতগুলো বছর ধরে তার মায়ের জায়গাটা নেবার জন্য কী নিরলস চেষ্টাটাই না করে যাচ্ছে। সে প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত নানাভাবে নানা ভঙ্গিতে সে বুঝিয়ে দিয়ে আসছে যে মা কেন, কোনোভাবে একরত্তি জায়গাও তার জীবনে ওই মহিলার জন্য নেই। আর কী উপায়ে বোঝাবে আকাশ? মা মারা যাবার পর বছর না ঘুরতেই বাবা যে রাতে বউ করে এ মহিলাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল সে রাত থেকেই আকাশ তাকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিল। বাবা নামক মানুষটার ছবিও সেদিন তার চোখের সামনে চকিতে পালটে গিয়েছিল। বাবা থেকে সেদিন সে রূপান্তরিত হয়েছিল শুধুমাত্র একজন মানুষে। রক্তমাংসের দলা পাকানো মাথামোটা বিবেকহীন এক সাধারণ মানুষ। আজকাল অবশ্য লোকটাকে মানুষ ভাবতেও কষ্ট হয় তার। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় মানুষরূপী এক ভয়ংকর জন্তু। 

মা মারা যাবার পর আকাশ একা হয়ে গেল। মা নেই, ভাইবোন নেই, বাবা থেকেও নেই। মায়ের জায়গায়, মায়ের রান্নাঘরে, শোবার ঘরে, যে সমস্ত জায়গায় তার মায়ের হাতের ছোঁয়া জড়ানো, স্মৃতি জড়ানো, সে সব জায়গায় সর্বক্ষণ অন্য এক মহিলার উপস্থিতি! কী অসহ্য! কী করে পেরেছিল লোকটা বছর না ঘুরতেই তার মায়ের জায়গায় অন্য একজনকে বসিয়ে দিতে? এতই সোজা? লোকটা জীবনে শুধুমাত্র দুটা বিয়ে করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। কন্ট্রাক্টরির ব্যবসা করত এক সময়। বার তিনেক মূলধন হারিয়ে পথে বসেছে। এখন শেয়ার ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারবে না, আকাশ জানে। 

আকাশ তার কাছ থেকে কোনো হাত খরচ নেয় না। মায়ের বাপের বাড়ির দিক থেকে একটা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পেরেছিল সে উত্তরাধিকার সূত্রে, সে ফ্ল্যাটের ভাড়ার টাকা দিয়েই তার দিন চলে। চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা ক্রিকেটটাও ছেড়ে দিয়েছে। কই চাকরি তো আজও পেল না মন মতো। 

রোদের তেজ বাড়ছে। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে রোদ তাতানো রাস্তা দেখতে দেখতে ক্রমশ জীবনের থিকথিকে কাদাওয়ালা অংশগুলোর দিকে হেলে যাচ্ছিল আকাশ। ঘোর ভাঙলো হৃদির গলার স্বরে। হৃদি ফোনে কথা বলছে। তার গলার স্বর অদ্ভুত অন্যরকম শোনাচ্ছে। অনেকটা বিড়ালের মিউমিউ শব্দের মতো, ‘হ্যালো জান! কী করো তুমি?’ 

জান নামক ব্যক্তি ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল তাই শুনে হৃদি আহ্লাদে গলে গিয়ে বলল, ‘কী যে বলো জান, আমি খুব মিস করতেছি তোমাকে।’ 

আকাশ বিস্মিত হয়ে বিভাকে বলল, ‘ওর কী হইছে? জ্বীন পরির আছর লাগছে নাকি?’ 

বিভা হাসল, ফিসফিস করে বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড!’ 

সামনে থেকে অমৃতা বলল, ‘সে একজন লায়িকা, লায়িকারা এমনে কথা কয়, জানোস না?’ 

হৃদি তখন মিউমিউ করে বলছিল, ‘বেবি প্লিজ রাগ করে না, ডিসিশনটা হঠাৎ করে নেয়া হয়ে গেসে বুঝেছ? তোমাকে বলার চান্সই পাই নাই’ 

সামি ধমকে উঠল, ‘ন্যাকামি করবি না, একটা থাবড়া লাগাব!’ 

হৃদি ফোনের লাইন কেটে দিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, 

‘এ রকম করতেছিস কেন তোরা? আমাকে একটু শান্তিতে প্রেমও করতে দিবি না?’ 

‘প্রেম করবি তো কর না, ন্যাকামি করতেছিস কেন?’ সামি বলল। 

‘কোনো ন্যাকামি করি নাই, আমার বয়ফ্রেন্ডের রাগ ভাঙাইতেছিলাম। বেচারা মন খারাপ করছে ওরে ফেলায় চিটাগাং চলে আসছি তাই, তোরা কী বুঝবি পাষণ্ড কতকগুলো!’ 

‘ইস আমার গার্লফ্রেন্ড যদি এমন সিনেমার নায়িকাদের মতো ঢং করে কথা বলত তো সাথে সাথে ব্রেকআপ।’ 

‘ঢং করে কথা বলতে পারলে তো বলবে, সবাই কি পারে নাকি?’ 

‘ভাগ্যিস পারে না!’ 

রুদ্র বলল, ‘তুই এইরকম বিড়াল স্বরে কথা বলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিস কোত্থেকে? কে শেখাল? 

হৃদি উত্তর দেবার আগে অমৃতা বলল, ‘আমাদের হৃদি জন্ম থেকেই নাইকা, আমার মনে আছে স্কুলে ক্লাস ডাইরির ওপরে নিজের নাম লেখার পরিবর্তে ও লিখে রাখত, মিসেস সালমান খান।’ 

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। হৃদি তেড়েমেড়ে বলল, ‘অত হাসির কী আছে আমি সালমানের ফ্যান ছিলাম তাই অমন লেখতাম, আর তুই যে লিওনার্দোর পোস্টারে সকাল বিকাল চুম্মা দিতি সেইটা কি ভুইলা গেছি মনে করছস?’ 

অমৃতা লাল হলো একটু, ‘ওয়েল… আমি ছোট ছিলাম!’ 

‘হ মামা বুঝছি, কৃষ্ণ করলে লীলাখেলা আমি করলে পাপ!’ হৃদি বলল। 

রিমঝিম হলদে দুপুরের বুক চিরে লাল গাড়িটা ছুটছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঁকাবাঁকা জিকজ্যাক রাস্তায়। ওরা প্রায় গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সবাই ক্লান্ত। রাত্রি জাগরণের ষোলো আনা শোধ তুলে নিচ্ছে শরীর। কারও মুখে কোনো কথা নেই। 

সেরকম একটা ঘুম ঢুলু ঢুলু পরিবেশে রুদ্র হঠাৎ ভাবালু গলায় বলে উঠল, ‘লইট্টা শুঁটকির ঝাল ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত খাব’। 

কথাটা প্রথমে কেউ খুব একটা পাত্তা দিল না বিধায় সে দ্বিতীয়বার বলল। বিভা একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘প্লিজ না!’ 

‘কেন, না কেন? খাবই খাব। দৃঢ় চিত্তে বুক ফুলিয়ে বলল রুদ্র। 

‘না না! তোর গা থেকে এমনিতেই কেমন যেন শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ পাচ্ছি সকাল থেকে। তোরা চিটাগাইংগারা সারাদিন খালি শুঁটকি খাস তাই না?’ নাক কুঁচকে বিভা বলল। 

রুদ্র কিছু বলল না। আগুনচোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল একবার বিভার দিকে। বিভা ওর একদম গা ঘেঁষেই বসে আছে। চোরাভাবে রুদ্রর আগুনচোখটা দেখল সে। তারপর বলল, ‘ডিওড্রেন্ট ইউজ করিস না? এমন শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ কেন?’ 

‘শোন বিভা, সব সময় ফালতু প্যাঁচাল করবি না। ঠিক আছে? ফালতু প্যাঁচালেরও একটা সময় আছে।’ 

‘সত্য কথাই বললাম। সত্য সইতে না পারলে আমার কী করা।’ উদাস গলায় বলল বিভা। 

আকাশ ফোড়ন কাটল, ‘আরে বিভার বাচ্চি মজা নিতেছে, তুই চেতিস না।’ 

হোটেল সি প্যালেসে দুটো ঘর ভাড়া করা হয়েছে। সামি আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছিল। দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর। দুটো ঘরের সাথেই লাগোয়া বারান্দা আছে। বারান্দায় দাঁড়ালেই সামনে সাগর সৈকত। দূরে চোখ রাখলে দেখা যায় নীল আকাশ আর নীলচে সমুদ্রের মিলন রেখাটি। 

দুটো ঘর ভাগাভাগি করে নিল ওরা। একটা ছেলেরা, অপরটা মেয়েরা। ঘরে একটি ডাবল খাট। খাটের পাশের টেবিলে চমৎকার ল্যাম্বশেড। একটি ক্যাবিনেট। ড্রেসিং টেবিল আর টেলিভিশন। ব্যস আর কী চাই? 

হৃদি আর বিভা ঘরে ঢুকেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। জুতাটাও পর্যন্ত খুলল না। অমৃতা তাড়া দিয়ে ওঠে বেশ মা মা গলায় বলল, ‘এই যে মহারানিরা শুয়ে পড়লে হবে না। হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নে, এখুনি বেরিয়ে পড়ব।’ 

হৃদি পাশ ফিরে শুয়ে বিভার গায়ের ওপর একটা হাত তুলে দিলো। চোখ বুজে ঝিমানো গলায় বলল, ‘কোথাও যাব না, আমরা এখন ঘুমাব।’ 

‘ঘুমাইতে আইছস কক্সবাজারে? নিজের বাসায় ঘুমাইলেই তো পারতি। এত দূরে আসার কী দরকার ছিল?’ 

‘সেটা তুই বুঝবি না, কক্সবাজারে আইসা, হোটেল সি প্যালেসের ২১৪ নম্বর রুমে মটকা মাইরা ঘুমানোর একটা বিশেষ মহত্ত্ব আছে।’ 

অমৃতা আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। বিভা হাসিমুখে বলল, ‘জানিস হৃদি আমার জীবনের বেস্ট বার্থডে এটা। এত জোস একটা বার্থডে হবে এবার আমি কল্পনাও করতে পারিনি।’ 

‘হুম, ভালো তো পঁচিশ বছর বয়সের জন্মদিনটা সারা জীবন মনে থাকবে তোর।’ 

‘আমার না খুব ভালো লাগছে! একটু বেশিই ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে সারাটা জীবন যদি আমরা শুধু এভাবেই ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারতাম!’ 

ওয়াশরুম থেকে অমৃতার গলার স্বর ভেসে আসলো, সে প্রায় চিৎকার করে বলছে, ‘ওই ছেমড়িরা! আমারে তো খুব ঘুমের বাহানা দিয়া তাড়ায় দিলা, এখন তো খুব ইটিশ পিটিশ গল্প হচ্ছে।’ বিভা আর হৃদি খিলখিল করে হেসে উঠল। 

হৃদি বলল, ‘দ্যাখ না কাণ্ড, ওয়াশরুম থেইকে লুকায় লুকায় কান পাইতা আমাদের কথা শুনতেছে। চোর কোথাকার!’ 

বিভা বলল, ‘দোস্ত তুই মানুষ নাকি ভ্যাম্পায়ার? আমি যতটুকু জানি ভ্যাম্পায়াররা দূর দূরান্ত থেকে কথা শুনতে পায়।’ 

‘আমি ভ্যাম্পায়ার!’ 

‘তাই? আমার না অনেকদিনের শখ যে একটা ভ্যাম্পায়ারের সাথে প্রেম করব। আমার শখটা পূরণ করবি দোস্ত?’ 

‘আচ্ছা করবনে, আগে পুরাপুরি ভ্যাম্পায়ার হয়ে নেই, এখন ট্রানজিশন চলছে।’ 

দরজায় ধুপধাপ ধাক্কা পড়ছে। বিভা শুয়ে থেকেই হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে এএএএ?’ 

উত্তর নেই, কিন্তু ক্রমাগত চলছে কাঠের দরজায় আঘাত। বিভা আবার চেঁচাল, ‘কে?’ 

এবার ওপাশ থেকে আকাশের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘আমরা!’ 

‘কী চাই তোমাদের?’ 

‘আরে দরজা খোল!’ 

‘এখন দরজা খোলা যাবে না।’ 

‘কেন?’ 

‘গোপন কাজ চলিতেছে’ 

‘ছি, লেসবিয়ান নাকি তোরা?’ 

‘লেসবিয়ান এখনও হই নাই তবে অমৃতা ফুল ভ্যাম্পায়ার হয়ে গেলেই লেসবিয়ান হইয়া যামু আমি। ঠিক করলাম। কারণ ভ্যাম্পায়ারের সাথে প্রেম করা আমার অনেক দিনের শখ।’ 

‘আজাইরা কথা বাদ দে, তাড়াতাড়ি বাইর হ, পেটের মধ্যে ক্ষুধায় বোমা ফুটতেছে, খাইতে যাব।’ আকাশ বলল, দুর্বল গলায়। 

হৃদি আর বিভাকে নড়তে দেখা গেল না। আঠার মতো লেগে রইল বিছানার সাথে। অমৃতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এক হাতে তোয়ালে ধরে অন্য হাতে দরজা খুলল। তার পরনে একটা বেগুনি রঙের টি শার্ট। যার বুকে আঁকা একটা ছোট টিংকার বেল। সচরাচর যেমন ঢিলাঢালা পোশাক সে পরে এটা ঠিক ততটা ঢিলাঢালা নয়। একটু আঁটসাঁট হয়ে লেগে ছিল শরীরের সাথে। ওর ফরসা গায়ে চমৎকার ফুটেছে রংটা। আকাশ ওকে এর আগে কখনো এমন আঁটসাঁট পোশাকে দেখেনি। আজকে দেখে তো ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। 

অমৃতা দরজাটা খুলে সোজাসাপটা প্রশ্ন করল, ‘কী চাই?’ 

আকাশের চোখ আটকে গেল টিশার্টের টিংকার বেলের ছবির ওপর। কয়েক সেকেন্ড গাড়লের মতো সেদিকে চেয়ে থাকল সে। 

অমৃতা ধমকে উঠে বলল, ‘হারামি, নজর ঠিক কর! 

আকাশ হকচকানো গলায় বলল, ‘টিংকারবেল দেখছিলাম, নো অফেন্স!’ বলেই মুখ লুকাতে ঘুরে দাঁড়ালো সে। একটু দূরে রুদ্র আর সামি দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গলা উঁচিয়ে অমৃতাকে বলল, ‘তোরা প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি কর, খুব খিদে পেয়েছে।’ 

অমৃতা গায়ে লেদারের জ্যাকেট জড়িয়ে মিনিট পাঁচেকের ভেতর বের হয়ে আসলেও হৃদি আর বিভা আরো পাক্কা আধটা ঘণ্টা সময় বরবাদ করল তৈরি হতে গিয়ে। 

হৃদি একটা জারদৌসি কাজের খয়েরি স্যালোয়ার কামিজ পরেছে। চুলগুলো খোঁপা করে বেঁধেছে উঁচু করে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে সামি চোখ কপালে তুলে তাকে বলল, ‘বিয়া বাড়ির সাজ দিছস কেন?’ 

‘এইটা তোর কাছে বিয়া বাড়ির সাজ লাগে? বিয়া বাড়িতে কখনো যাসনি? দেখিসনি মেয়েরা কীভাবে সাজে?’ 

‘হ দেখছি তো, আলিফ লায়লার মতো কইরা সাজে। দেখলেই মনে মনে বাজনাটা বাজতে থাকে।’ এটুকু বলে সামি সুর করে গাইতে থাকল, ‘আলিফ ল্যায়লা! আলিফ ল্যায়লা!’ 

হৃদির মুখখানা অপমানে থমথম করে উঠল, ‘এটার মানে কী? আমাকে এখন আলিফ লায়লা লাগছে?’ 

‘তোকে লাগছে মালিকা হামিরার মতো, মনে আছে হাতে মাকড়সা নিয়া আকরাম আকরাম করত? মনে হচ্ছে এখনই তুই আমার মুখের সামনে এসে হাতে মাকড়সা নিয়ে বলবি আকরাম! ব্যস ম্যাজিক হয়ে যাবে।’ 

হৃদি নাক মুখ কুঁচকে বলল, ‘মাঝে মাঝে না, তোর সাথে কথা বলতে আমার অসহ্য লাগে’ 

সামি হেসে ফেলল, চেতলি নাকি? দুষ্টুমি করলাম। তোকে আলিফ লায়লা লাগছে না। তবে মাথার ওপরে পাহাড়ের মতো কী একটা বানাইছস এইটাও ভালো লাগতেছে না।’ বলে সামি নিজেই হাত দিয়ে হৃদির খোঁপা করা চুল খুলে দিলো। সারা পিঠময় ঝরঝর করে ছড়িয়ে পড়ল ঢেউ খেলানো চুলগুলো। 

‘এখন ঠিক আছে।’ বলে হাসল সামি। হাসির উত্তরে মুখ ভেংচি কাটল হৃদি। এর মানে প্রশংসাটা মন মতো হয়নি। মন মতো কিছু না হলে ভেংচি কাটা হৃদির স্বভাব। 

দুপুরে ওরা ভাত খেল হোটেল ঝাউবনে। সাদা ভাত, আলুর ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা, মুরগির ঝোল আর ডাল। আকাশের এত ঝাল খেয়ে অভ্যাস নেই। খেতে খেতে তার নাক চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। হু হা শব্দ করতে করতে সে বলে উঠল, ‘এত ঝাল মানুষ খায়? এ তো সুইসাইড এটেম্পট। 

‘হ মানুষই খায়, কাকপক্ষীতে ঝাল খায় বলে আমার জানা নাই।’ অমৃতা বলল। 

বিভা বলল, ‘আরো খাও তোমরা শুঁটকির ভর্তা? বলছিলাম তো এসব ভর্তা জাতীয় পচা খাবার না খেতে। এখন কাঁদো কেন? খাও আরো খাও।’ 

রুদ্রর পকেটে একটা কিটক্যাট চকলেট ছিল। ওটা বের করে আকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে চকলেট খা, ভালো লাগবে।’ 

আকাশ ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে করতে বলল, ‘কোনো লাভ নাই, কোনো লাভ নাই।’ তার দুই চোখ তখন রক্ত লাল। 

সে মুখ হা করে জিব বের করা অবস্থায় বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। 

বিভা চিন্তিত গলায় বলল, ‘অমন কুত্তার মতো জিব বাইর কইরা আছস ক্যান?’ 

আকাশ উত্তর দিলো না, ঠাণ্ডা পানি ঢকঢক করে গিলে খেতে লাগল। 

রুদ্র হঠাৎ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে উত্তেজিত গলায় আকাশকে বলল, ‘দোস্ত, ঠিক হ, জাস্ট চিল! পিছনের টেবিলের একটা হট মেয়ে তোর দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকায় আছে। ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবি।’ 

আকাশ চোখ ছোট করে মনোযোগ দিয়ে রুদ্রর কথাটা শুনল। তারপর সেকেন্ড না ঘুরতেই একদম পরিপাটি মানুষটি হয়ে গেল। চকিতে হাত দিয়ে চোখ আর নাকের পানি মুছে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। 

দুটো মধ্য বয়স্ক পুরুষ আয়েশ করে ঝোল দিয়ে মেখে ভাত খাচ্ছে। ধোঁকাটা বুঝতে পেরে জ্বলন্ত চোখে সে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র দাঁত বত্রিশটা বের করে হেসে বলল, ‘বিংগো!’ 

সব্বাই হেসে উঠল হো হো শব্দ করে। অমৃতা বলল, ‘কী মামা? ঠাণ্ডা পানিতে কাজ হয় না, চকলেটে লাভ হয় না, হট মাইয়ার কথা শুইনাতো সেকেন্ডে সব ঠিক, হ্যাঁ?’ 

আকাশও হেসে ফেলল। 

উষ্ণ বালুতটে চিকচিক করছে রুপালি রোদ্দুর। হাওয়া বইছে প্রবল বেগে। জোয়ারের টানে সমুদ্র উত্তাল। পাহাড়ের মতো বড় আর ভয়ংকর ঢেউ গর্জে এসে আছড়ে পড়ছে সাগর পারে। 

বছরের এ সময়টায় পর্যটকদের প্রচুর ভিড় হয়। সকাল, দুপুর, রাত চব্বিশ ঘণ্টা নানা বয়সী মানুষে গিজ গিজ করে সাগর সৈকত। আজকের দুপুরটাও সেরকমই এক লোক লোকারণ্য ভরা দুপুর। কেউ কেউ নেমে গেছে জলে। কেউ বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত, কেউ আরাম করে শুয়ে আছে বাংলালিংকের ছাউনির তলায়। পর্যটকদের পাশাপাশি 

পাশাপাশি নানা বয়সী ফেরিওয়ালাদেরও বড্ড ভিড় সৈকত জুড়ে। চারপাশে একটা উৎসব উৎসব ভাব। জীবন এখানে বড্ড বেশি জীবন্ত, প্রকৃতির মতোই মনোরম আর সুন্দর। 

ভিড়ের মাঝে আমাদের হৃদিতা বিনতে জামিলকে দেখা গেল। কোমরে হাত দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের তেজে চোখ মেলতে পারছে না সে পুরোপুরি। 

‘এমন তেলাপোকার মতো চোখ বানাইছিস কেন? ঠিকমতো তাকা।’ ডিএসএলআর ক্যামেরা হাতে নিয়ে অমৃতা বলল। 

‘সম্ভব না, রোদ অনেক, তাকানো যাচ্ছে না।’ কপাল আর চোখ কুঁচকে হৃদি বলল। 

এ মুহূর্তে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তাকে কোনো কঠিন অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ সকাল থেকে ফটোসেশন করার জন্য অস্থির হয়ে ছিল সে। 

রুদ্র অমৃতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘তর কি বাথরুম আসছে? মুখ এরকম করে আছিস কেন?’ 

হৃদি কিছু বলল না। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। অমৃতা ওর ওই শক্ত, থমথমে মুখটার কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল চটপট। 

আকাশকে দেখা গেল মেটে রঙের মোটামুটি বড়সড় একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে। তার মুখে স্ফীত হাসি। সে হাসির আভা ছড়িয়ে পড়েছে দুচোখে। মনে হচ্ছে তার চোখদুটোও হাসছে। শিরদাঁড়া সোজা। বসার ভঙ্গিতে বেশ রাজা রাজা ভাব। কাছাকাছি আসতেই ঘোড়া দেখে এক লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল হৃদি। অমৃতার ক্যামেরা সে মুহূর্তটা চমৎকারভাবে বন্দি করে ফেলল ছবির ফ্রেমে। হৃদি লাফ দিয়ে সরতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে বালুর ওপর পড়ে গিয়েছিল। আকাশ ঘোড়ার পিঠে বসে থেকেই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আবেগে গলে গিয়ে বলল, ‘হে রাজকন্যে! আমি এক রাজ্যবিহীন রাজপুত্র, তুমি যাবে কি আমার সনে?’ 

হৃদি কিছু বলার আগেই রুদ্র হড়বড় করে বলে উঠল, ‘রাজকন্যের বাথরুম পাইছে, যাইব না তর লগে, বাথরুমে যাইব।’ 

হৃদি কাপড়ে লাগা বালি হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘মোটেও আমার বাথরুম পায় নাই, কিন্তু ঘোড়া আমার ভয় লাগে, আমি ঘোড়ায় চড়ব না। আর তাছাড়া রাজ্যবিহীন রাজপুত্রের প্রতি কোনো আগ্রহ আমার নাই, রাজপুত্রবিহীন রাজ্য হলেও প্রবলেম আছিল না।’ 

আকাশ ‘তাহলে আর কী করা রাজকন্যার সখীকেই নিলাম সাথে’ বলে অমৃতার কোমর জড়িয়ে ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে নিল ঘোড়ার পিঠে। অমৃতার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ক্যামেরা। 

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘোড়া চিঁহি চিঁহি শব্দ তুলে ছুট দিলো। বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছিল অমৃতা ঘোড়ার পিঠ থেকে। আকাশ ধরে ফেলল তাকে, তারপর দুহাত বাড়িয়ে ঘোড়ার রাশ ধরল। আকাশের দুবাহুর মধ্যিখানে বন্দি হলো অমৃতা। ঘটনার আকস্মিকতায় কথা হারিয়ে ফেলেছিল সে। নিজেকে যখন নিজের মাঝে ফিরে পেল তখন দেখল আকাশ মুখে রাজ্যজয়ের হাসি নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে। রেগে গিয়ে খুব খারাপ কিছু একটা বলে ফেলতে যাচ্ছিল সে। হুট করে এমন লঙ্কা কাণ্ড বাঁধানোর কোনো মানে হয়? তার সাধের ডিএসএলআর ক্যামেরাটা পড়ে গেল হাত থেকে, ওটার যদি কিছু হয় তো আকাশকে সে জ্যান্ত কবর দেবে। 

কিন্তু মুখ খুলতে গিয়ে কেমন একটা বোবায় ধরল তাকে। আকাশের ওই হাসি হাসি চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। আকাশ হাসলে সত্যি ভালো দেখায়। চোখের আয়নায় ওর সাদামাটা হৃদয়টা ঝিকমিক করে। 

ঘোড়া ছুটতে লাগল টগবগিয়ে সাঁই সাঁই বাতাস কেটে, ভেজা বালুর পথটি ধরে। একপাশে বিস্তৃত নীল সমুদ্র আর অন্যপাশে সবুজ পাহাড়। কানের কাছে সমুদ্রের গর্জন। প্রকৃতির তৈরি এত সব শব্দের মাঝে ডুবে থেকে ওরা আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সময়টি কথা বলার জন্য নয়, এ সময় শুধু চুপ করে থেকে মনের ভেতরের মনটাকে অনুভব করার! 

‘খাইছে দোস্ত! প্রিন্স চার্মিং তো প্রিন্সেসরে উঠায় নিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়া’ রুদ্র বলল ওর ক্যাটস আই চোখগুলোকে গোল গোল বোতামের মতো বানিয়ে। ‘হ তাই তো দেখলাম, ক্যামেরা-ট্যামেরা সব ফিটকা মাইরা ফালায় দিয়া দিলো দৌড়! সেইরাম তো!’ 

‘হুম, একদম!’ 

একটা বারো তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে হাতে ট্রে নিয়ে কড়ির মালা বিক্রি করছে। রুদ্রর হাত ধরে একটা টান দিয়ে বাচ্চাটা বলল, ‘বাইজান, বাবীর জন্য একটা মালা খিনেন! 

বাচ্চাটার কথায় কক্সবাজারের আঞ্চলিক টান। রুদ্র ঠিক ওর সুরটাই নকল করে বলল, ‘না খিনব না যে!’ 

ত্যাঁদড় পিচ্চি রুদ্রর ফাজলামো বুঝতে পেরে দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘খেনো? বাবীকে যে সোন্দর লাগবে! একটা খিনেন না’ 

হৃদি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বলল, ‘বাবী জিনিসটা কী?’

রুদ্র ফিচেল হেসে বলল, ‘ভাবী!’ 

হৃদি বাচ্চাটাকে ধমকে ওঠে বলল, ‘ওই ছ্যাড়া! এইডা আমার বন্ধু।’

পিচ্চি আবার হাসে দাঁত বের করে, বলে, ‘বুশচি তো বয়ফ্রেন্ড আরখি!’ 

রুদ্র হো হো করে হেসে উঠল। হৃদি তো হাসলোই না উপরন্তু মুখটাকে ভয়াবহ রকমের গম্ভীর বানিয়ে ফেলল। যেন তাকে নিয়ে এইমাত্র কোনো মারাত্মক রসিকতা করে ফেলা হয়েছে। 

‘মোটেও বয়ফ্রেন্ড না, ফ্রেন্ড, আমার ভাইয়ের মতো। তুমি যাও এখান থিকা, তোমারে আর পাকনামো করতে হবে না।’ 

‘আচ্ছা যাব আর খি, একটা মালা খিনেন না, তারপর ছলে ঝাচ্ছি।’ 

‘না কিনব না, তোমার কথাবার্তা পছন্দ হয় নাই।’

রুদ্র একটা কড়ির মালা কিনল। পাঁচ টাকা দাম। হৃদির মাথায় মালাটা বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, তোর ভাইয়ের মতো বন্ধু তোকে কড়ির মালা উপহার দিলো, এখন চোখ-মুখ স্বাভাবিক করে সাগরপাড়ে পোজ মাইরা দাঁড়া, ছবি তুলি, সকাল থেকে মুখটাকে এমন তেলাপোকার মতো বানায় রাখছস কেন?’ 

 ‘মানুষের মুখ কখনো তেলাপোকার মতো হয় না বুঝছিস? ফাউ কথা বলবি না।’

‘আয়নায় নিজের চেহারাটা এ মুহূর্তে দেখলেই বুঝতে পারতি যে মানুষের মুখও হঠাৎ হঠাৎ তেলাপোকার মতো হয়ে যায়।’ 

রোদ একটু পড়ে যাওয়ায় হৃদি এবার চোখ মেলে চাইতে পারল। পেছনে ফেনিল সমুদ্র নিয়ে, মাথায় টিয়ারার মতো সাদা কড়ির মালাটি পরে চমৎকার ভঙ্গিতে দাঁড়াল সে। তারপর রুদ্রর হাতের ক্যামেরায় ক্লিক পড়তে থাকল একটার পর একটা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *