৩৫
বেলা একটার সময় অমৃতা, আকাশ আর হৃদিতা সামির বাড়ি আসলো। রুদ্রকে পাওয়া গেল না তার ঘরে। এর মানে বাড়িতে নেই সে। সামির বেডরুমের দরজা বন্ধ। দারোয়ানের কাছে খবর পাওয়া গেল সে বাড়িতেই আছে, তবে ঘুমুচ্ছে এখনও।
তিন ডাকাত দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়ল সামির শোবার ঘরের দরজায়। একটা মাঝারি গোছের হইহল্লা লাগিয়ে দিলো ওরা দুপুর বেলার অলস বাড়িতে। হইচই শুনে প্রায় মিনিট পাঁচেক পর সামি দরজা খুলল। তার পরনে হাফ প্যান্ট। গা উদোম। চোখ দুটো ঘুমের ভারে ছোট হয়ে আছে। চুল পাগলের মতো এলোমেলো। সে চিড়িয়াখানার চিড়িয়া দেখার মতো বিস্মিত নয়নে তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হইছে তোদের? প্রবলেমটা কী মামা?’
তিন মূর্তি সংকুচিত হলো। তাদের মুখমণ্ডলে এতক্ষণ যে মেঘাছন্ন ছায়াটি বিরাজমান ছিল তা মুহূর্তের মধ্যে তীব্র এক অস্বস্তিতে রূপান্তরিত হলো।
সামি বিরক্ত গলায় বলল, ‘দূর বাল, ঘুমাইতেসিলাম একটু, ঘুমটা ভাঙায় দিয়া এখন জোকারের মতো দাঁড়ায় আছে সবগুলা, হইছে কী বলবি তো!’
অমৃতাই কথা বলল প্রথম, ‘ভেতরে আসতে দে!’
‘ও হ্যাঁ, আয়।’ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সামি।
ওরা তিনজন ঘরের ভেতরে ঢুকল।
ঘরের ভেতরটায় কাঁপন ধরা শীত ঘাপটি মেরে বসে আছে। এয়ার কন্ডিশন চলছে বলে বারান্দার দরজা, জানালার গ্লাস সব আটকানো। ভারী পর্দা টানানো জানালায়। এক রত্তি আলো ঢোকার উপায় নেই। সামি জানালার পর্দা সরাল। বেলা দ্বিপ্রহরের ঝকঝকে সূর্য কিরণ ঝাঁপ দিয়ে পড়ল জানালার কাচে।
সামি গায়ে টি শার্ট চড়াল। এলোমেলো চুলগুলোয় চিরুনির মতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘এখন বল, কী হইছে?’
আকাশ বলল, ‘নাহ, তেমন কিছু না।’
সামি সন্দিহান হয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না মানে কী? এমনি এমনিই আমার সাধের ঘুমটা বানচাল করলি?’
হৃদি পরিস্থিতি সামলানোর ঢঙে বলল, ‘হুম এমনিই, তোকে…. তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।’
অমৃতা তখন মনে মনে গালাগাল দিচ্ছিল নিজেকে। কোন দুঃখে সাতপাঁচ কিছু চিন্তা না করেই সামির কাছে চলে এলো ওরা? একটু সময় নিয়ে বুঝেশুনে আসা উচিত ছিল। অবশ্য সত্যটা তো তাকে জানতেই হবে। আজ অথবা কাল। লুকোচুরি করে লাভটা কী হবে? সবাই মিলে একত্রে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে। সামি তো এখানে একা নয়। সামিকে ওরা ভেঙে পড়তে দেবে না। শক্ত খুঁটি হয়ে সামির পাশে দাঁড়াবে ওরা চারজন।
অমৃতা সামির মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখ রাখল সরাসরি ওর চোখে।
‘সামি, বিভা ফোন করেছিল একটু আগে। আমার ফোনে। বলল আজ সন্ধ্যায় ওর বিয়ে।’
সামি অবাক গলায় বলল, ‘বিয়ে মানে? কার সাথে বিয়ে?’
‘অভিজিতের সাথে।’
সামি স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে বলল, ‘কেন? বিয়েটা তো ভেঙে গিয়েছিল।’
অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে যেন সাহস সঞ্চয় করল। তারপর বলল, ‘ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তোর আব্বা কী করে যেন সমস্ত ঘটনা জেনে গিয়েছিলেন এবং বিভার বাবাকে ফোন করে সব বলে দিয়েছেন, অতএব আমরা যে প্ল্যানটা করেছিলাম বিয়েটা নাকচ হবে অভিজিতের পক্ষ থেকে এবং নাকচ হবার কারণ বিভার বাবা-মা জানতে পারবে না, বিয়ে ভাঙার সম্পূর্ণ দায় চাপবে অভিজিতের ওপর, সেই প্ল্যানটা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে।’
‘ওয়েট ওয়েট, এর মানে আমার আর বিভার ব্যাপারটা তোরাই জানিয়েছিলি অভিজিৎ কে?’
‘ঠিক তাই, আমরা জানিয়েছিলাম এবং রিকোয়েস্ট করেছিলাম বিভার বাসায় যেন তোদের দুজনের সম্পর্কের বিষয়ে কিছু না বলে। সে কথা রেখেছিল, কিছু বলেনি। কিন্তু তোর আব্বা ফোন দিয়ে সব জানিয়ে দিয়েছেন, এর পরপরই বিভার আব্বা অসুস্থ হয়ে গেছে। তুই তো জানিস আংকেলের হার্টের প্রবলেম আছে।’
এ কথায় কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল সামি। অবিশ্বাস ভরা চোখে অমৃতার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। পাশে রাখা চেয়ারের হাতল চেপে ধরল শক্ত করে। মনে হলো যেন তার দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।
এরপর আর একটা কথাও না বলে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
৩৬
দরজা খুলল মনীষা। খুলেই খুব জরুরি গলায় বলল, ‘ওহ রুদ্র! আমি তো ভুলেই গেছি তোমাকে ফোন করার কথা, রাইয়ান বাড়িতে নেই।’
‘বাড়িতে নেই মানে? কোথায় গেছে?’ রুদ্র অবাক।
‘তুমি বসো, একটু জিরিয়ে নাও, ভর দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে এসেছ। ভারি সেজেগুজে এসেছ আজ? অন্য কোথাও যাচ্ছ নাকি?’
কথাগুলো বলতে বলতে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল মনীষা। রুদ্র একটু লাজুক হাসল। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো রিবন দিয়ে ঝুঁটি বাঁধা। গালের জংলা দাড়িগুলোও শেভ করেছে আজ। হেসে বলল, ‘আজ শুক্রবার তো, জুম্মার নামাজ ছিল। তাই পাঞ্জাবি পরেছি।’
‘ওহ তাই বলো, তুমি একটু বসো, আমি আসছি, কী খাবে বলো? চা নাকি ঠাণ্ডা কিছু?’
‘চা খাব, সাথে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিয়েন।
‘নিশ্চয়ই’ বলে খাবার ঘরের দরজার ওপাশে অদৃশ্য হলো মনীষা।
রুদ্র সোফায় বসল। রাইয়ানের গুনে গুনে আর মাত্র দশদিন পরে এ লেভেল পরীক্ষা। সময়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে রুদ্র রাত জাগার ক্লান্তি উপেক্ষা করে পড়াতে এসেছে। এসে দেখা গেল ছাত্রই নেই। এহেন ফাঁকিবাজির কোনো মানে হয়? মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। রাতে এক ফোটা ঘুম হয়নি। সকাল আটটা থেকে নটা নাগাদ এক ঘণ্টা বিছানায় গা এলিয়েছিল শুধু। শরীর এখন কড়ায়গণ্ডায় রাত জাগার প্রতিশোধ নিচ্ছে। মনীষা ফোন করে আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ক্যানসেল করে দিলে এখন হয়তো সে বাড়ি বসে আরামসে ঘুমাতে পারত। এ ভাবনার পাশাপাশি মনে একটা অদ্ভুত খেয়াল আসলো। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে মনীষা ওকে আসতে বারণ করেনি আর করেনি বলেই রুদ্র আজ এ নির্জন দুপুরে মনীষাকে একটু একলা পেল। আচ্ছা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল না করার পেছনে কি অন্য কোনো কারণ আছে? কোনো গোপন সুপ্ত অভিলাষ?
ছি, রুদ্র ভীষণ খারাপ হচ্ছে কিন্তু! নিজেকে নিজে শাসায় সে।
মনীষা আসে হাতে চায়ের কাপের ট্রে নিয়ে। সাথে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি তাকে রোজকার মতই সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা ক্রিম রঙের সুতির শাড়ি তার পরনে। মুখে কোনো প্রসাধন নেই তবুও কী স্নিগ্ধ তার রূপ!
রুদ্র গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেল ঢকঢক করে। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছল। তারপর বলল, ‘কোথায় গেছে রাইয়ান? বিকেলে গেলেও তো পারত।’
‘ওর বাবার কাছে গেছে।’
রুদ্র ভারি অবাক গলায় অকপট প্রশ্ন করল, ‘বাবার কাছে গেছে মানে?’
এ প্রশ্নে মনীষা একটু অপ্রতিভ হলো, সংকুচিত গলায় বলল, ‘না মানে ওর বাবা তো সেন্ট্রাল রোডে থাকে, একটা দরকারে ডেকে নিয়েছে আজ। একটু জরুরি।’
রুদ্র বেআক্কেলের মতো তাকিয়ে থাকল। সে জানে না এ ধরনের একটা পরিস্থিতির বর্ণনা শোনার পর আসলে ঠিক কী বলা উচিত। রাইয়ানের বাবাকে সে এ ফ্ল্যাটে একদিনও দেখেনি। ভেবেছে কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকেন তাই রুদ্রর সাথে টাইম মেলে না। কিন্তু ভদ্রলোক যে স্ত্রী-পুত্রকে ফেলে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বাসস্থান গড়তে পারেন এ ভাবনাটা ঘুণাক্ষরেও তার মনে আসেনি।
কিছু বলার না পেয়ে রুদ্র একটু কোণঠাসা হয়ে রইল।
‘অবাক হয়েছ?’ মনীষার প্রশ্ন।
‘না না, অবাক হওয়ার কী আছে?’ অস্বস্তি নিয়ে বলে রুদ্র।
‘চা টা খেয়ে নাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
রুদ্র চায়ের কাপ হাতে নিল। তার মনের ভেতরের আরেকটা মনে এখন অনেক অনেক প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আঁকুপাঁকু করছে। মনীষা কি তবে সিঙ্গেল মাদার? ডিভোর্সড? কী সমস্যা হয়েছিল রাইয়ানের বাবার সাথে?
মনীষা ওর সাগরের মতো গভীর চোখ দুটো মেলে রুদ্রকেই দেখছিল, আর মিটিমিটি হাসছিল।
‘কখন আসবে রাইয়ান?’ অনেকক্ষণ পরে কথা খুঁজে পেল রুদ্র।
‘আজ রাতটা থাকবে ওখানে, কাল দুপুরের মধ্যে চলে আসবে। তুমি কি কাল বিকেলে আসতে পারবে একবার?’
‘কাল বিকেলে… জি পারব মনে হয়।’
‘ছেলেটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়, আচ্ছা ওর লেখাপড়ার কী অবস্থা? ইম্প্রুভ হচ্ছে কোনো? তোমার কী মনে হয়?’
রাইয়ানের পড়ালেখার খুব বেশি খারাপ অবস্থা বলে কখনোই মনে হয়নি রুদ্রর। একেবারে ফার্স্টক্লাস গোছের ছাত্র না হলেও সে মোটামুটি ভালো ছাত্র। তবুও মায়ের মন বলে কথা। দুশ্চিন্তা তো হবেই।
রুদ্র খানিক সময় কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘ওর ব্রেইন ভালো, কিন্তু প্রবলেমটা হচ্ছে পড়তেই চায় না। আরেকটু মনোযোগী হয়ে উঠলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমি চাই এ লেভেলে ওর এ গ্রেড থাকুক।’
‘থাকবে ইনশাআল্লাহ্, আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন ও যেন নিয়ম করে একটু পড়তে বসে।
‘আসলে ওর বাবা আর আমার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর থেকে ছেলেটা একটু কেমন অমনোযোগী হয়ে গেছে। আগে কিন্তু ও এমন ছিল না।’
রুদ্র হাবার মতো চেয়ে থাকে। কী বলবে খুঁজে পায় না।
মনীষা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তোমার খবর বলো, কেমন আছ?’
‘ভালো, খুব ভালো।’ বলল রুদ্র। হালকা একটু আড়ষ্টতা কাজ করছে তার ভেতর।
‘খুব ভালো?’ বলে মনীষা চোখ নাচায়। খানিকটা ফিচেল গলায় আবার বলে, ‘খুব ভালো থাকার মতো কোনো খুব ভালো সংবাদ আছে নাকি?’
রুদ্র হাসে, ‘আছে বৈকি, আমার দুই বন্ধুর মধ্যে গতকাল ফাইনালি প্যাঁচআপ হয়ে গেছে।
‘কেন ঝগড়া চলছিল নাকি?’
‘ঠিক ঝগড়া না, আসলে ওদের ভেতর প্রেম ছিল কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারছিল না, অবশেষে বলতে পারল এবং আরো মজার ব্যাপার হলো আমার বান্ধবীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্য জায়গায়, সে বিয়েটাও ভেঙে গেছে। এখন ওদের লাভ লাইফ মোটামুটি স্যাটেলড।’
‘চমৎকার! তুমি তোমার বন্ধুদের খুব ভালোবাসো তাই না?’
এ প্রশ্নটা লোকে আজকাল প্রায়ই করে। কারণটা সঠিক জানে না রুদ্র। বন্ধুদের প্রসঙ্গ উঠলেই লোকে ইনিয়ে-বিনিয়ে সুযোগ বুঝে প্রশ্নটা করে বসে। মনীষাও ব্যতিক্রম হলো না।
রুদ্র মনীষার দিকে সরাসরি তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘ভালোবাসি কি না জানি না, তবে ওদেরকে ছাড়া আমি লাইফের একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না। আসলে আমার জীবনটা এখন ওদেরকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে।’
‘বাহ! তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলো!’
রুদ্র মৃদু হেসে বলল, ‘হঠাৎ হঠাৎ বলি, কিন্তু বন্ধুদের সাথে থাকলে আমি ভীষণ বাজে ভাষায় কথা বলি। ওসব শুনলে আপনি খুব রেগে যাবেন। আর এই মাত্র করা প্রশংসাটা ফিরিয়ে নিতে চাইবেন।
‘অসম্ভব! মিছে কথা, তুমি বাজে ভাষায় কথা বলতেই পার না! তুমি অত্যন্ত সুইট এবং ভদ্র একটা ছেলে।’ কথাটা বলে মনীষা প্রশ্রয়ের হাসি হাসল।
প্রশংসা শুনে কানের ডগা লাল হয়ে গেল রুদ্রর। মাথা নামিয়ে আস্তে করে সে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ! ‘
মনীষার যেন হঠাৎ মনে পড়ল, ‘এই যা, দুপুর প্রায় একটা বেজে গেল, এসো তুমি আজকে আমার সাথে খাবে।
‘না না! আমি বাসায় গিয়ে খাব।’
মনীষা একটু নিভলো, ‘কেন? বাসায় কেউ অপেক্ষা করছে বুঝি?’
‘আরে নাহ, সেরকম কিছুই না। আমার বাবা-মা চিটাগাং থাকেন। এখানে থাকছি বন্ধুর বাসায়। বাড়িতে খাবার নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করার মতো আসলে এখানে কেউ নেই।’
‘তাহলে মানা করলে কেন?’
‘না এমনি, ভাবলাম আপনার আবার ঝামেলা হবে।’
‘কীসের ঝামেলা! আসলে আজ তো ছুটির দিন, সবসময় ছুটির দিনগুলোয় আমি আর রাইয়ান একসাথে লাঞ্চ করি। সপ্তাহের অন্যদিনগুলো আমার অফিস আর রাইয়ানের প্রাইভেট এসব নিয়েই কেটে যায়। তাই আজ একা একা খেতে খুব খারাপ লাগবে।’
রুদ্র হেসে বলল, ‘ওহ এই কথা? নিশ্চয়ই আমি জয়েন করব আপনার সাথে, ইট উইল বি এন অনার।’
রুদ্র ভেতরে ভেতরে উড়ছিল। মুখের হাসিতে সে উড়ন্ত মনের ছায়া পড়ল খানিকটা।
মনীষা রুদ্রর উচ্ছল বিড়াল চোখদুটো থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ!’
কিছুক্ষণের মাঝেই টেবিল সাজানো হয়ে গেল। সাদা ভাত, মুগের ডাল, ফুলকপির তরকারি আর কৈ মাছ ভাজা। খাবার টেবিলে বসার পর মনীষা বলল, ‘খাবারের আইটেম কিন্তু একেবারেই কম, তুমি প্লিজ মাইন্ড করো না।’
‘কী যে বলেন, মাইন্ড করার প্রশ্নই আসে না, আমি এমনিতেও তেমন পেটুক নই। এক পদ তরকারি দিয়েই ভাত খাওয়া হয়ে যায় আমার।’
‘বাড়িতে তোমার কে কে আছে?’ প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করল মনীষা।
‘বাবা, মা, আর বড় বোন। বোনের অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি খুব কাছে হওয়ায় রোজ একবার করে চলে আসে আম্মার কাছে।’
‘মেয়েরা মায়ের কাছাকাছি থাকাটাই ভালো।’
‘আপনি কোথায় জব করছেন?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। ভালোই দেয় ওরা, আমার আর রাইয়ানের মোটামুটি চলে যায়।’
ঠিক সে সময় রুদ্রর মোবাইলটা বাজল।
অমৃতার কল।
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে অনেকগুলো কথা বলে ফেলল অমৃতা। রুদ্রর হাসিমাখা মুখটায় চকিতে একটা গাঢ় ছায়া পড়ল। ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল তার।
মনীষা সবেমাত্র প্লেটে ভাত, তরকারি নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করেছে। রুদ্রর দিকে চোখ পড়তেই একটু আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার সব ঠিক আছে তো?’
রুদ্র ফোন কাটল। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র তার মাথার ওপর থেকে ছাদ উড়ে গেছে।
মনীষা আবার প্রশ্ন করল, ‘ইজ এভরি থিং অলরাইট?’
রুদ্র খুব ভারী একটা নিশ্বাস ফেলে অস্থির গলায় বলল, ‘আই এম সরি মনীষা! আমাকে উঠতে হবে।’
‘খারাপ কোনো সংবাদ?’
‘আমার বান্ধবীটার বিয়ে ভাঙার কথা ছিল কিন্তু ভাঙেনি, আজ সন্ধ্যায় ওর বিয়ে হচ্ছে পরিবারের পছন্দের ছেলের সাথে। হঠাৎ কী করে যে সব পাল্টে গেল কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আর এদিকে আমার যে বন্ধুর সাথে ওর প্রেম ছিল সে বন্ধুটি একদম পাগলা কিসিমের। যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে। আমার এক্ষুনি যেতে হবে ওর কাছে। আই হ্যাভ টু গো।’
‘ওহ! তাহলে তো খুব ঝামেলার কথা!’ বিষণ্ণ শোনাল মনীষার গলা। ‘আমি কথা দিচ্ছি, আরেকদিন আপনার সাথে অবশ্যই লাঞ্চ করব অথবা ডিনার। আজকে আমায় মাফ করে দিন!
৩৭
হক সাহেব ইলেকশনে জেতার পর বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেছে। ছুটির দিনগুলোতেও এখন বাড়িতে নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটে। নিচতলার বৈঠকখানায় বিকেলের পর থেকেই চলতে থাকে মিটিং, সে সাথে পাল্লা দিয়ে চা নাশতার মহড়া। ভৃত্যরা কাপের পর কাপ চা বানাতে গিয়ে হিমশিম খায়। কোনো কোনো ছুটির বিকেলে আবার সবাইকে চমকে দিয়ে হাজির হয় মিডিয়া।
এসব হই হট্টগোলের বিন্দু মাত্র রেশও সামির কাছে পৌঁছে না। সে তার তিনতলার নির্জন কক্ষটিতে ভারি নির্বিঘ্নে দিন যাপন করে। কোনোদিন ভুলেও উঁকি মেরে দেখতে আসে না নিচতলায় কী এমন ঈদ উদযাপিত হচ্ছে।
আজ ব্যতিক্রম এক ঘটনা ঘটল। বিকেলের একটু আগেই বৈঠকখানা লোকজনে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। সামি ঝড়ের বেগে অনেকটা দৌড়ে এসে বৈঠকখানার দরজাটা খুলল। ঘরের ভেতর জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা। এসি চলছে। জানালার পর্দা সরানো বলে কাচের ভেতর দিয়ে সূর্যরশ্মি ঢুকে ঘর আলোকিত করে রেখেছে। প্রায় আট দশজন মানুষের ভেতর মধ্যমণি হয়ে বসে কথা বলছেন হক সাহেব। সামির ঝটিকা আগমন তাঁর মুখের কথা কেঁড়ে নিল। কুঞ্চিত কপাল নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তিনি চাইলেন তার একমাত্র আদরের পুত্রটির দিকে।
‘আব্বা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
‘বলো!’
ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মুখে কোনো কথা নেই। সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামির দিকে।
সামি তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। প্রায় বেহেড। আক্রোশে ফেটে পড়ে সে কৈফিয়ত চাইবার ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি বিভার বাসায় ফোন দিছিলা?’
এ প্রশ্নে হক সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। ছেলের কাণ্ডজ্ঞানের এহেন অভাব দেখে যথেষ্ট বিরক্তও হলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না। স্থির গলায় বললেন, ‘তুমি বাইরে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।’
খানিক বাদে তিনি এসে বসলেন লিভিং রুমের সোফায়। চাকর-বাকরের মাধ্যমে সামির আম্মাও খবর পেয়ে গেছেন। তিনি শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছেন নিচে। এসেই হইহই শুরু করে দিলেন, ‘আমার বাচ্চাটার কী হয়েছে?
সামি ধমকে উঠল, ‘আম্মা প্লিজ চুপ করো! জরুরি কথা বলতেছি!’
আম্মা বেচারি চুপ করে গেলেন। পিতা-পুত্রের বাকবিতণ্ডার মাঝে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে লাগলেন।
হক সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘বলো, কী জানতে চাও?’
তুমি বিভার বাবাকে ফোন দিয়েছিলে?’
‘বিভা কে? ওই হিন্দু মেয়েটা?’
প্রশ্নের ধরনটা গায়ে জ্বালা ধরাল সামির। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ ওই হিন্দু মেয়েটা আমার বন্ধু, এ খবরটা তো তোমার জানার কথা ছিল।’
‘জানা ছিল, কিন্তু বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু হবার মনোবাসনা সে নিজের ভিতরে লালন করছে এ খবরটা জানতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।’
সামি ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘তুমি কি আমার পিছনে স্পাই লাগিয়েছ?’
হক সাহেব চুপ করে রইলেন। উত্তর দিলেন না। তার এই মৌনতা সম্মতির দিকেই ইঙ্গিত করল।
‘কবে থেকে?’
‘যেদিন থেকে প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে।’
‘আশ্চর্য! আমার কি পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছু নাই?’
‘অবশ্যই আছে!’
‘এটা কেমন পার্সোনাল লাইফ? আমি আমার বন্ধুদের সাথে কী করলাম কী বললাম সে খবর তোমার কাছে যায় কেমনে?’
‘খবরটা আমার কাছে আসা জরুরি ছিল, তাই এসেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তোমার জানার প্রয়োজন নেই।’
‘তুমি কি আমার বেডরুমে হিডেন ক্যামেরা লাগাইসো?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘এই বাড়িতে আমার লোকজন সর্বদাই সজাগ থাকে। তাদের ওপর কান খাড়া করে রাখার নির্দেশ আছে। তারা আদেশ পালন করেছে শুধু। ঘটনা এতটুকুই।’
সামির মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। কয়েকটা সেকেন্ড অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল সে তার বাবার দিকে, তারপর অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেন এমন করলে তুমি?’
‘প্রয়োজন ছিল।’
‘প্রয়োজনটাই বড় হয়ে গেল তোমার কাছে? আমার কথা একবারও ভাবলে না?’
তোমার কথা ভেবেই কাজটা করা হয়েছে। আর তাছাড়া মেয়েটার জন্যও এ বিয়ে খুব জরুরি ছিল। শুধু শুধু তুমি একটা মেয়েকে ঝুলিয়ে রাখবে কেন? বিয়ে তো করতে পারতে না কোনোদিন, ওর পরিবার রাজি হতো কি না কখনো এদিকটা একবারও ভেবে দেখেছ? এখন ভালোয় ভালোয় মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাক, আর এদিকে তুমি তোমার নিজের জীবনে, নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দাও।’
এটুকু বলে হক সাহেব ওঠে পড়লেন, জরুরি গলায় বললেন, ‘আমার সময় নেই, মিটিং চলছে।’
আম্মা এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘সামি শোনো, বাবা আমার! তোমার আব্বা যা করেছেন তোমার ভালোর জন্যই করেছেন। তোমার আব্বা ওই ভদ্রলোককে ঘটনাটা না জানালেও আজ বাদে কাল ওঁর কানে যেতই সত্যটা। তখন আরো অনেক বেশি ঝামেলা হতো। বরং এখন ভালো হলো যে মেয়েটার বিয়েটা ভাঙল না। মেয়েটা সেটেল হয়ে গেল।’
‘ও! তুমিও তাহলে এ ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলে, বাহ চমৎকার!’ একটা গভীর হতাশার নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো সামির বুক থেকে।
‘ষড়যন্ত্র নয়, আমরা যা করেছি বুঝেশুনেই করেছি।’
‘এত বেশি বুঝতে গেলে কেন তোমরা?’
হক সাহেব একটু উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, তা বোঝার মতো জ্ঞান বুদ্ধি তোমার এখনও হয়ে ওঠেনি। বাপের হোটেলে খাও বলে টের পাওনা কত ধানে কত চাল। বাইরের দুনিয়াটা শ্বাপদসংকুল। তোমাকে আমার সমস্তটা দিয়ে আগলে রেখেছি। লাট সাহেবের জীবনযাপন করছ। তোমার বয়সে থাকতে আমরা এসব কিচ্ছু পাইনি।’
সামি কেমন অদ্ভুত বিষাদ মাখা গলায় বলে উঠল, ‘লাগবে না আমার লাটসাহেবের এ জীবন!’
‘কী বলতে চাও তুমি?’
সামি এবার বাবার চোখে চোখে তাকাল, দৃঢ় গলায় বলল, ‘এমন প্যারাসাইট লাইফ আমার লাগবে না। আমার ইচ্ছা, মূল্যবোধ, মতামতের যেখানে কোনো দাম নেই, সে জীবন যতই বিলাসবহুল হোক না কেন আমার কাছে লোভনীয় নয়।
‘পেয়ে গেছ তো তাই দাম দিতে জানছ না, তোমার বয়সে থাকতে আমরা এমন একটা জীবনের জন্য তড়পাতাম। তোমার বন্ধুরাও তড়পায়, তোমার প্রাণের অধিক প্রিয় বন্ধুরা।’
সামি বিকারগ্রস্থ গলায় আলুথালুভাবে বলল, ‘সবচেয়ে বড় কথা আমার কোনো প্রাইভেসি নেই। এভাবে আমি থাকতে পারব না।
‘কী করতে চাও?’
‘আমি চলে যাচ্ছি।’
আম্মা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় যাবি তুই?’
‘জানি না।’ ঘোর লাগা গলায় বলে সামি।
হক সাহেবের মুখের ভঙ্গিতে একটি বিহবল ভাব ফুটে উঠল। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কিছুটা সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘যেতে চাইলে যেতে পার, কিন্তু জেনে রেখ, এ বাড়িতে না থাকলে তোমার পেছনে আর একটা কানা কড়িও খরচ করা হবে না। তোমার জীবনের দায়ভার সম্পূর্ণ তোমার নিজের।’
‘তাই হবে।’ বলল সামি
আম্মা উদ্ভ্রান্তের মতো চিৎকার করে বললেন, ‘এসব কী বলছিস তোরা?’ এটুকু বলে হক সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে জ্বলতে বললেন, ‘তুমি এসব কী বলছ? আমার ছেলেকে বের করে দিচ্ছ তুমি?’
সামির আব্বা চুপ। তার চোয়াল শক্ত। চক্ষুদ্বয় স্থির।
‘একটা কানা কড়িও তোমার আর খরচ করতে হবে না আমার জন্য। টাকার বিনিময়ে তুমি আমার স্বাধীনতা কিনে নিয়েছ।
হক সাহেবের চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ব্যথিত হয়ে উঠল। তিনি প্রস্তরীভূত হলেন।
‘আমি যাচ্ছি।’
আম্মা দৌড়ে আসলেন, ‘কী সব আজেবাজে কথা বলছিস তুই এসব হ্যাঁ? যাচ্ছিস মানে? কোথায় যাচ্ছিস?’
হক সাহেব বরফ শীতল গলায় বললেন, ‘সামির আম্মা! ওকে যেতে দাও, কয়েকদিন বাইরের দুনিয়াটা দেখে আসুক, তারপর সুড়সুড় করে বনের পাখি বনে ফেরত আসবে। পেটে খাবার না পড়লে প্রেম ভালোবাসা লেজ তুলে পালাবে।’
‘বাবা হয়ে তুমি এমন কথা বলতে পারলে? এত নিষ্ঠুর তুমি কী করে হলে? আমার একটা মাত্র ছেলে!’
‘তোমার একটা মাত্র ছেলের যদি তোমাকে প্রয়োজন হয় তাহলে ঠিকঠিক তোমার কাছেই ফেরত আসবে। একটু শান্ত হও।’
কথাগুলো বলে একটু থামলেন তিনি তারপর সামির দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘আর হাঁ আজকের পর থেকে তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার নিজের। তোমার গায়ের কাপড়, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ সমস্ত কিছু আমার টাকায় কেনা। মনে রেখ।’
সামি পকেট থেকে তার আই ফোন সেভেন প্লাস বের করে রাখল বুক শেঙ্কের ওপর। তারপর বের করল মানিব্যাগ। এমনকি হাতের ঘড়িটাও খুলে নিল। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি ভারি অস্থির। জিনিসগুলো বুকশেক্ষের ওপর একটু বেশি সময় নিয়েই রাখল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলি!’
আম্মার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকল।
সামি বেরিয়ে যাবার পর হক সাহেব সোফার ওপর বসে পড়লেন ধপ করে। স্ত্রীকে বললেন, ‘সামির মা, তোমার ছেলে বাইরের দুনিয়ায় আমার সাপোর্ট ছাড়া চব্বিশ ঘণ্টাও টিকতে পারবে না। দুদিনের মধ্যেই ফেরত চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না। এ শিক্ষাটা ওর দরকার ছিল। একটু বুঝুক যে সোনার চামচ মুখে নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে, সে সোনার চামচটা আকাশ থেকে আচমকা পড়েনি, সেটা গড়ে উঠেছে তার পিতার বহুদিনের রক্ত পানি করা শ্রম দিয়ে।’
.
বাড়ির সদর দরজার সামনে বন্ধুরা অপেক্ষা করছিল। ততক্ষণে রুদ্রও চলে এসেছে।
লিভিং রুম থেকে মাথা হেঁট করে সামি বেরিয়ে আসতেই ওরা সবাই সামিকে ঘিরে ধরল। কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলল না।
সামি কারো চোখে চোখে চাইলো না, মাথা নত অবস্থাতেই শক্ত গলায় বলল, ‘চল!’
হেঁটে বেরিয়ে আসলো ওরা, মাঝ দুপুরের তেজি রোদ মাথায় নিয়ে। পোর্টিকোতে একলা পড়ে রইল সামির লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ। রাস্তায় নামার পর অমৃতাই প্রথম কথা বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি এখন আমরা?’
সবাই সামির মুখের দিকে তাকাল। তার মুখটা এখন ভারি মেঘলা, প্রবল কালবৈশাখী ঝড়ের আগে আকাশ যেমন কালো মেঘে মেঘে থমথমে হয়ে থাকে, ঠিক সেরকম।
হৃদি সামিকে প্রশ্ন করল, ‘তোর গাড়ি নিলি না কেন?’
সামি এ প্রশ্নের উত্তরে একটু হাসার চেষ্টা করল। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ওটা আমার গাড়ি না, আমার বাপের গাড়ি।’
রুদ্র বলল, ‘তুই কি ঝগড়া করছিস আংকেলের সাথে?’
‘বাদ দে, চল বিভার বাসায় যাই।’
‘বিভার বাসায় যাওয়াটা কি এখন ঠিক হবে?’ আপনাআপনি কথাগুলো বেরিয়ে আসলো হৃদির মুখ থেকে।
অমৃতা বলল, ‘বিভার বিয়েতে আমাদের যাওয়া নিয়ে রেস্ট্রিকশন আছে। ওর আব্বা বলেছেন বিয়ে পড়ানোর পর আমরা বিভার সাথে মিট করতে পারব। তার আগে না।’
‘আমি কি বিয়া খাইতে যাব নাকি? আমি যাব ওই হালার পুতরে পিটাইতে। তোরা কেউ যাবি আমার সাথে?’
আকাশ সামির পিঠে একটা হাত রেখে বলল, ‘দোস্ত শোন, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর।’
সামি আকাশের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো, ‘মাথা ঠাণ্ডাই আছে, তোরা কেউ আমার সাথে যাবি নাকি বল।’
আকাশ থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
রুদ্র বলল, ‘কী করতে চাস তুই?’
‘ওই হারামজাদারে পিডায়া শোয়ায় দিব। আর বিভারে উঠায় নিয়া আসব।’
হৃদি শ্লেষের একটা হাসি হেসে বলে উঠল, ‘অসম প্ল্যান!’
সামি আগুন লাগা চোখে তাকাল ওর দিকে, ধমকে ওঠে বলল, ‘তোর কাছে কি কথাটা ফাইজলামি মনে হইলো?’
হৃদি ধমক খেয়ে মিইয়ে গেল, চিঁচিঁ করে বলল, ‘না ফাইজলামি মনে হবে কেন?’
সামি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে সিংহের মতো গর্জে ওঠে বলল, ‘তোরা কি আমার লগে আছস? নাকি নাই?’
বন্ধুরা কয়েকটা সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু।
এক সময় রুদ্র বলল, ‘আমরা অবশ্যই আছি তোর সাথে।’ সে যে যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে তা তার গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল।
সামি হুঙ্কার দিলো, ‘তাহলে চল!’
কেউ কোনো বাক্য ব্যয় না করে সামির পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। পাগলটা কোথায় যাচ্ছে, কী অনর্থ করতে যাচ্ছে তা আল্লাহ মালুম!
৩৮
বিকেল চারটায় নিকেতনে বিভাদের ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছলো ওরা। এসে দেখা গেল বিয়ে বাড়ির গেট সাজানো হচ্ছে। নানা লোকজনে ভরে আছে জায়গাটা।
ওরা এসেছে দুটা সিএনজি নিয়ে। সামির বাসে অথবা রিকশায় চড়ার অভ্যাস নেই, তাই বন্ধুরা সবাই মিলেই ডিসিশন নিয়েছে টাকা একটু বেশি খরচ করে হলেও আজকে তারা সামিকে কোনো রকমের উটকো কষ্ট দেবে না।
সিএনজি থেকে নেমে এপার্টমেন্টের উল্টা পাশের ফুটপাতে জড়ো হয়ে দাঁড়াল ওরা পাঁচজন। বৈশাখী সূর্য তখনও জ্বলছে। গরমটাও মারাত্মক। ঘেমে- টেমে একদম গোসল করে ফেলার মতো অবস্থা।
এখান থেকে চারতলার ফ্ল্যাটের বিভার ঘরের জানালা দেখা যায়। বন্ধুরা এসে প্রথমেই জানালাটির দিকে নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, বিভাকে এক নজর দেখার আশায়। এর আগে কোনো দিন এমন চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারতে হয়নি তাদের। তাদের বন্ধুত্বের মাঝে কখনো কোনো দেয়াল ছিল না, ছিল না কোনো তৃতীয় পক্ষ। অথচ আজ বিভার জীবনের একটি বিশেষ দিনে এসে তারা কতটাই না পর আর অবাঞ্ছিত হয়ে উঠল। ভাবতে অবাক লাগে।
বিভার ছায়াও দেখা গেল না জানালার আশেপাশে। সামি আদেশ দিলো, ‘ফোন লাগা ওরে!
‘কারে?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘আমার শ্বশুররে! গর্দভ কোথাকার কারে আর ফোন দিবি, বিভারে ফোন দে।’
আদেশ পালন করা হলো। প্রায় তিন চারবার বিভার ফোনে ডায়াল করা হলো। জানা গেল যন্ত্রটা বন্ধ। সংযোগ হচ্ছে না।
অস্থির সামি রাস্তা পার হয়ে এপার্টমেন্টের সামনে চলে আসলো। পেছন পেছন আসলো বাকিরা।
গেইটের সামনে বিভার পিসতুতো দাদা তাপস দাঁড়িয়ে ছিল। সামিকে ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসতে দেখে সে পথ আটকে দাঁড়াল। সামিকে যে সে চেনে না তা নয়, খুব ভালো করেই চেনে। একবার তাদের কোম্পানির লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিল কাজে সামির আব্বার সাহায্যও নিয়েছিল সে, সামির মনে আছে। এরপর থেকেই তাপস সামিকে দেখলে তেলতেলে হাসি দিত। খাতির জমানো আলাপ করত। কিন্তু আজকে তার মুখের চাউনি অন্য কথা বলছে। মনে হচ্ছে তার সামনে দাঁড়ানো সামিকে সে চেনেই না। উটকো ফালতু লোক বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করলে লোকে যেমন করে পথ আটকে দাঁড়ায়, তাপসের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও আজ ঠিক সেরকম।
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
সামি কিন্তু তাপসের প্রশ্নটার দিকে কর্ণপাতও করল না। তাপসকে পাশ কাটিয়ে সে কলাপ্সেবল গেইটের ভেতরে ঢুকে গেল।
অঘটনটা ঘটল তখনই। হইহই করে তিন চার জন হোঁৎকা গোছের লোক এগিয়ে এসে সামিকে রীতিমতো ছেঁকে ধরল। বোঝা গেল লোকগুলোকে তাপসই ইশারা করেছে।
একজন ক্ষুব্ধ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী চাই?’
‘ওপরে যাব।’ সামি উত্তর দিলো গমগম করে।
‘যাওয়া যাবে না, নিষেধ আছে।
‘হু দা হেল আর ইউ?’
‘ইংরেজি মাড়াবেন না, আপনাকে ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ আছে আমাদের ওপর।’ এ লোকটার কথায় স্পষ্ট কলকাতার টান।
মুহূর্তও গড়াল না, রাগে রি রি করতে করতে সামি সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
বাকি দুজন ঝড়ের গতিতে এসে সামির দু হাত দু দিক দিয়ে চেপে ধরল।
আকাশ সাথেসাথে পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘কী ব্যাপার হচ্ছেটা কী? হাত লাগাবেন না বলে দিলাম, ছাড়ন বলছি!’
‘দাদা হাত কে লাগিয়েছে আগে সে প্রশ্নটা করুন? উনিই তো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন প্রণব বাবুকে।
সামি সাপের মতো ফুঁসছিল।
অমৃতা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনারা ছাড়ুন ওকে, হাত ছেড়ে দিন।’
হৃদি বেশ ঘাবড়ে গেছে। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাপসকে বলল, ‘তাপসদা প্লিজ, ওই লোকগুলোকে থামতে বলুন, আমরা বিভার কত দিনের বন্ধু! আমাদের সাথে ওর বিয়ের দিন এমন আচরণ করা কি ঠিক হচ্ছে?’
তাপস হৃদির কথা খুব একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। যেমন দাপুটে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে রইল হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে।
আর অন্য তিন বন্ধুর মাথায় তখন রক্ত ওঠে গেছে। রুদ্র আর আকাশ তেড়েমেড়ে লোক দুটোর হাত থেকে সামিকে মুক্ত করতে গেল।
‘ওই ব্যাটা কথা কানে যায় না? হাত না লাগাইতে কইলাম।’ চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র।
দুটো দলের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। অমৃতাও বাদ থাকল না। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা চোয়াড়ে চেহারার এক লোকের ভুড়িতে সে ঘুসি বসিয়ে দিলো।
এমন সময় সিঁড়িঘরের দিক থেকে একটা পরিচিত গলার স্বর ভেসে আসলো, ‘এই থামো তোমরা, সবাই থামো বলছি!’
বিভার আব্বা নেমে এসেছে নিচে।
‘কী হচ্ছে এখানে? বলি কী হচ্ছে এসব? এটা ভদ্রলোকের বাড়ি!’
প্রণব নামের লোকটা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে সামির দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠল, ‘কাকাবাবু, এই তো সে ছেলে যার ওপর আপনি নজর রাখতে বলেছিলেন। এই ছেলে জোর করে ওপরে ওঠে যেতে চাইছিল।’
সামি বিভার আব্বার চোখে চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, ‘আমি একবার বিভার সাথে দেখা করব।
বিভার আব্বার মুখে হঠাৎ করেই একটি ক্রূর ভাব চলে আসলো।
‘তুমি এ মুহূর্তে বিদেয় হও, গেট লস্ট!’ এটুকু বলে অমৃতাদের দিকে চোখ দিয়ে বলল, ‘তোমরাও! দয়া করে এখান থেকে বিদেয় হও।’
অমৃতা এ কথা শুনে সাথে সাথে বন্ধুদের আদেশ করল, ‘চল বের হই।’ সামি গোঁ ধরা গলায় বলল, ‘আমি যাব না, বিভার সাথে একবার দেখা না করে আমি কোথাও যাব না।’
বিভার আব্বা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘এ মুহূর্তে যদি তোমরা এখান থেকে বিদেয় না হও তো আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব!’
বন্ধুরা সামির হাত ধরে টানতে টানতে গেটের বাইরে নিয়ে আসলো। হৃদি বলতে লাগল, ‘এত অপমানের পর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। চলে আয়।’
বাইরে এসে ফুটপাতের ওপর ধপ করে বসে পড়ল সামি। তার মুখখানা দেখাচ্ছে পাণ্ডুর। চোখ দুটোতে দুরূহ হতাশা।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভারি মায়া হলো হৃদিতার।
বুকের ভেতর থেকে একটা দলা পাকানো কান্না হুড়মুড়িয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল গলা বেয়ে। মুখে ওড়না দিয়ে সে কান্না চাপানোর চেষ্টা করল। পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
অমৃতা ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আরে বোকা কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বলল বটে, কিন্তু তাকেও দেখাচ্ছে ভারি বিবর্ণ।
আকাশ অনেকটা ক্ষীণ গলায় অমৃতাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কি জানিস বিয়েটা কোথায় হচ্ছে? বাড়িতেই? নাকি কোনো কমিউনিটি সেন্টারে।
‘জানি না রে, কমিউনিটি সেন্টারেই তো হওয়ার কথা ছিল। প্ল্যান কি চেঞ্জ হয়েছে কি না কে জানে!
ঠিক সে সময় সামি হঠাৎ কাতর স্বরে বলে উঠল, ‘আচ্ছা বিভাকে কি শুধু একবার দেখার কোনো উপায় আছে? শুধু একবার?’
৩৯
বিভাকে সাজানোর জন্য তিনজন বিউটিশিয়ান এসেছে।
একজন হেয়ার ডো করছে, একজন হাতে মেহেদি পরাচ্ছে এবং তৃতীয়জন মুখ সাজাচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলছে এই সাজুগুজুর পালা। ঘর ভর্তি আত্মীয়স্বজন গিজগিজ করছে। মাছির মতো ভনভন করে একটানা কথা বলে যাচ্ছে সবাই।
বিভার মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছিল। তার চায়ের নেশা মারাত্মক। এ মুহূর্তে প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে চায়ের। মনে হচ্ছে এক কাপ চা এক নিমেষে অবসান ঘটাতে পারে সমস্ত যন্ত্রণার। চেয়ারের গদিতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বিভা তখন ঘোরলাগা চোখে শুধু একটা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ দেখছিল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খরশান হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কয়েক মণ ওজনের এক বোঝা জোর করে সেখানে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। শুধু হুহু করে উড়ে বেড়াচ্ছে এক রক্ত পানি করা হিম হিম খরশান হাওয়া।
সাজগোজের দিকে বরাবরই তার ঝোঁক ছিল মাত্রারিক্ত। নিজেকে যত্ন করে সময় নিয়ে সাজানোর মাঝে সে আবিষ্কারের আনন্দ খুঁজে পেত। গত একটা বছর ধরে তার ঝোঁকটা একটু একটু করে ব্রাইডাল মেকআপের দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। ফেসবুকে অনেকগুলো ব্রাইডাল মেকআপের গ্রুপও ফলো করে রেখেছিল সে। কার কাছে সাজবে, কীভাবে সাজবে, কোন ধরনের মেকওভার হবে সমস্ত কিছু তার প্ল্যান করা ছিল। এমনকি কোন ফটোগ্রাফারকে বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তোলার জন্য ঠিক করা হবে এ নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছিল। এর মানে এই না যে বিভা বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিল। তার শুধু একবার মন মতো বউ সাজার খুব শখ ছিল।
কিন্তু এ কথাতো ঠিক আজ খুব ভোরে, সামির বাসায় বন্ধুরা সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার পর, ভোরের সোনাবরণ আলো যখন প্রথম জানালায় এসে টোকা দিলো, তখন একটি ভারি সুন্দর পবিত্র স্বপ্নের জন্ম হলো। স্বপ্নটি পায়রার মতো উড়ে উড়ে মনের বদ্ধ কপাট খুলে দিলো। বিভা চোখ চেয়ে দেখল সামির সাথে তার বিয়ে হওয়ার দিনটি।
তার বিয়ের শাড়ির রংটি কেমন হবে? কাতান শাড়ি পরবে? নাকি মসলিন? নাকি লেহেঙ্গা পরবে? সামির শেওয়ানির রংটা কী হলে ভালো হয়? হৃদি অমৃতা ওরাই বা কীভাবে সাজবে বিয়ের দিন? অমৃতাটা কি সেদিনও শাড়ি টারি কিছু পরবে না? সে ঠিক করল তার বিয়ের দিন সে অমৃতাকে শাড়ি পরতে বাধ্য করবে। হৃদি বলেছিল বিভার বিয়েতে ওরা নাচবে। মনে মনে ঠিক করল সে নিজেই সে নাচের কোরিওগ্রাফার হবে।
তারপর….
বিয়ের পর এ বাড়িতে সামির সাথে তার নতুন জীবনের শুরু। বিভাকে দূরে যেতে হবে না। ছেড়ে যেতে হবে না এই দেশ আর প্রাণের শহরটাকে। বাবা-মা কাছে থাকবে। কাছে থাকবে বন্ধুরা। কাছে থাকবে সর্বক্ষণ ভালোবাসার মানুষটা।
ইস, এত সুখ এ জীবনে ধরবে তো?
না ধরল না। সাদা রঙের স্বপ্নের সে পায়রা কপাট বন্ধ করে দিয়ে উড়াল দিলো দূর অজানার দেশে। আর ফিরবে না সে। বিভা জানে।
বিভার চোখের কোণ বারেবারে ভিজে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আই মেকআপ।
বিউটিশিয়ান মেয়েটি এবার একটু ধমকের সুরেই বলল, ‘এভাবে কান্নাকাটি করলে তো আপু আপনার মেকআপ এখনই নষ্ট হয়ে যাবে। রাত পর্যন্ত থাকবেন কী করে?’
কোনো এক আত্মীয়ের মুখ থেকে শোনা গেল, জামাই রওয়ানা দিয়েছে কিছুক্ষণের মাঝেই পৌঁছে যাবে। বিভার বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেল।
অবশেষে অভিজিৎ রাজি হয়েছিল। শেষমেশ ভেঙে যাওয়া বিয়েটা আবার জোড়া লাগল।
অভিজিৎ তার মায়ের সামনে বিভার এহেন লজ্জাহীন মিনতি দেখে একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলেছিল, ‘কী বলতে চান, এদিকে আসুন’ বলে সে ভেতর দিককার একটা ঘরে নিয়ে গেল বিভাকে।
বিভা বলল, ‘অভিজিৎ দা প্লিজ এই বিয়েতে আপনি না করবেন না।’
অভিজিৎ ভ্রুকুটি করে সন্দিহান চোখে তাকাল বিভার দিকে
‘কিন্তু কেন? আপনি তো অন্য একজনকে ভালোবাসেন।’
বিভা চোখ নামাল, বোকার মতো স্বীকারোক্তি করল, তার সাথে আমাকে বিয়ে দেবে না আমার পরিবার! ‘
অভিজিৎ শ্লেষের হাসি হেসে বলল, ‘ভারি স্বার্থপর তো আপনি, আপনার ফ্যামিলি আপনার প্রেম মেনে নিচ্ছে না বলে আমার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইছেন? আমি কী দোষ করেছি বলুন তো? আমি কেন জেনেশুনে এমন একটা দাম্পত্য সম্পর্কের দায় মাথা পেতে নেব? যে দাম্পত্য জীবন আমাকে কোনো দিন সুখী করবে না?’
বিভার মাথায় তখন কোনো যুক্তি খেলছে না। একটা অজানা, অদেখা বিপদের আশঙ্কা তার সারা শরীরকে তীরের মতো বিদ্ধ করে চলেছে। কেন তা সঠিক জানে না বিভা, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল অভিজিৎ তাকে বিয়ে না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সে কাঁপা অন্তর নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলে উঠল, ‘এই বিয়ে না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
অভিজিৎ বিভার প্রতিমার মতো কাজলটানা জল টলমল চোখদুটোর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে, ‘সর্বনাশ? কীসের সর্বনাশ?’
বিভা অস্ফুটে বলে, ‘জানি না। সঠিক জানি না কিন্তু আমার মন বলছে, বিয়েটা হওয়া খুব জরুরি।
হঠাৎ মাসতুতো বোন সেতুর গলার স্বর বিভার ভাবনার ঘরের দরজায় হালকা করাঘাত করল। সেতু ডাকছে, ‘বিভাদি! ও বিভাদি!’
বিভা ঘোর ভাঙা গলায় আস্তে করে উত্তর দিলো, ‘উঁ?’
সেতু এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা ভালোভাবে একবার পর্যবেক্ষণ করল। তারপর মুখ নামিয়ে আনল বিভার কানের কাছে, খুব নিচু গলায় বলল, ‘বিভাদি তোমার বন্ধুরা নিচে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি একটাবার বারান্দায় যাও।’
কেঁপে উঠল বিভা। নড়ে গেল হাত এবং চোখের পাতা। আরও একবার নষ্ট হলো চোখের সাজ।
সেতু লেজ গুটিয়ে পালাল জায়গাটা থেকে।
এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ওঠে দাঁড়াল সে। মেয়েগুলোকে বলল, ‘তোমরা একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।’
নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ে আসলো ঘরের পাশের লাগোয়া ঝুল বারান্দায়। তখন শেষ বিকেলের আকাশে পলকা পলকা মেঘ। গেটের পাশের কড়ই গাছের ডালে হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ। গ্রিলের কাছে এসে দেখল রাস্তার ওপারে ভিখিরির মতো শুকনো চোখমুখ নিয়ে অবনয়নে দাঁড়িয়ে আছে তার পাঁচ বন্ধু।
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওরা কতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে? দুপুরে কিছু খেয়েছে কি খায়নি? সবাইকে অমন জীর্ণ আর খরাগ্রস্ত দেখাচ্ছে কেন?
ওরা মুখ তুলে এদিকটাই দেখছিল। বিভাকে দেখা মাত্র বিদ্যুৎ চমকানোর মতো পাল্টে গেল তাদের মুখশ্রী। ক্লান্ত মুখগুলোয় ভোরের উদ্ভাসিত আলোর মতো ভেসে উঠল প্রশান্তির হাসি। হৃদির চোখজোড়া দেখেই বুঝে ফেলল বিভা, এতক্ষণ কেঁদেছে পাগলিটা। অমৃতার দুচোখ দিয়ে এখনও আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বেরোচ্ছে। বিভাকে যেন বলছে ওই চোখের ভাষা, তুই ভয় পাস না, সব ঠিক আছে, ঠিক থাকবে।
আকাশ হাসছে, সাথে হাসছে ওর চোখ জোড়া।
রুদ্র হাত পা নেড়ে কী যেন হড়বড় করে বলল। ট্রাফিকের শব্দ আর মানুষের কোলাহল কেটে শব্দগুলো বিভার কান পর্যন্ত আসতে পারল না।
সামি দলটা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তার হাতদুটো প্যান্টের পকেটে ঢোকানো, চোখে রোদ চশমা। বিভা চিনে ফেলল এটা সামির সানগ্লাস না, গ্লাসটা সে ধার করেছে হৃদির কাছ থেকে। নিজেকে আড়াল করার জন্য রোদ চশমার আশ্রয় নিয়েছে গাধাটা। বিভার চোখ বাষ্পান্বিত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে 1 কাচের দেওয়ালের মতো ভাঙছে চারপাশ। সামি কেন সানগ্লাস পরে আছে? ওই চোখদুটো কি বিভা আর কোনোদিন দেখতে পাবে না?
বিভা অশ্রুরুদ্ধ গলায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘সামি চশমা খোল, আমার চোখে চোখে একবার তাকা, শেষবারের মতো একবার তাকা, প্লিজ, তোর পায়ে পড়ি!’
সামি বুঝি শুনতে পেল বিভার আকুতি। হঠাৎ চোখ থেকে গ্লাসটা খুলে নিল। চাইল বিভার চোখে চোখে। সে চোখের ভেতর দিয়ে বিভা ওর সমস্ত হৃদয় দেখে ফেলল। থরথর করে কেঁপে উঠল তাঁর ঠোঁট দুটো। বুক ভেঙে নামল দুকূল ছাপানো কান্না।