৩০
মাথার ওপর দিয়ে একটা নীলপেড়ে সুতির শাড়ির আঁচল বাতাস কেটে উড়ে গেল। আকাশ পড়ার টেবিল চেয়ারে বসে ল্যাপটপে লেকচার তৈরি করছিল। পরশু দিন তার চাকরির প্রথম দিন। শাড়ির আঁচল তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে পেছনে। তার বাপের বউ ঝুমকি ড্রেসিং টেবিলের ওপর গরম দুধ ভর্তি একটি গ্লাস রেখে বেশ কর্তৃত্ব ফলানোর গলায় বলল, ‘দুধটা খেয়ে নাও।’
এক নজর দেখে আবার ঘাড়টাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আকাশ বলল, ‘নিয়ে যান, খাব না।’
ঝুমকি হেঁটে এসে আকাশের পেছনে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখল আলতো ভাবে।
‘রোজ তোমার এ কেমন নকড়া? কিছু খেতে চাও না, শরীর খারাপ করবে তো!’
এসব অনর্থক ঢং আকাশের একদম ভালো লাগে না। কাঁধে মেয়েটার হাত পড়তেই আকাশ গায়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁক লাগার মতো চমকে ওঠে এক পাশে সরে গেল। তাকাল ঝুমকির দিকে, নিত্যকার মতো কঠিন গলায় বলল, ‘আপনাকে না বলেছি আমাকে খালি খালি বিরক্ত করবেন না?
কথাটা শুনে ঝুমকির গোলগাল, ফরসা, ধারহীন মুখমণ্ডলে একটি কেমন মেদুর ছায়া পড়ল। ঠোঁট দুটো অনেক কষ্টে নেড়ে বলল, ‘তুমি আমার সাথে এমন করো কেন সব সময়?’
‘উফ!’ আকাশের মুখ থেকে বিরক্তিসূচক শব্দটা অনায়াসে বেরিয়ে আসলো। এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক কীভাবে দেওয়া যায়? প্রায় বছর দশেকের মতো সময়কাল ধরে এ মেয়েটি তার বাপের বউ হয়ে সংসারের রানি সেজে বসে আছে। মায়ের মৃত্যুর ঠিক পঁয়ত্রিশ দিনের মাথায় তার পিতা যখন এ মানবীটিকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছিল সেদিন থেকে আপনাআপনিই আকাশ একে ঘেন্না করা শুরু করেছিল। পিতার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর বয়স ছিল বেশি হলে টেনেটুনে একুশ, আর আকাশের তখন পনেরো। বয়সে পাঁচ ছয় বছরের বড়, হ্যাংলা পাতলা, ফরসা বোকা বোকা চেহারার, পড়াশোনা কম জানা মেয়েটি কোনোদিক থেকেই তার মায়ের জায়গা নেবার যোগ্য ছিল না। কিন্তু ঠিক প্রথম দিনটি থেকে বোকা মেয়েটা আকাশের মা সাজার নিরবচ্ছিন্ন, নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। এ দশ বছরে কোনো দিন আকাশ এর সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি। চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বাক্যালাপ করাত দূরের কথা।
বছর পাঁচেক আগে এক রাতে তার ভয়ঙ্কর জ্বর আসল শরীর জুড়ে। বমি টমি করে একাকার অবস্থা। ঝুমকি সারা রাত জেগে আকাশের সেবা করল। জ্বর পট্টি লাগাল। মাথা টিপে দিল, মাথায় ঠাণ্ডা জল ঢালল। বলতে গেলে তার সেবাতেই আকাশ রাতারাতি সুস্থ হয়ে উঠল। ভোরের দিকে জ্বরে পোড়া চোখদুটো মেলে যখন সে দেখল তারই বিছানায় ঝুমকি বালিশে আলগাভাবে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, আকাশ তখন গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল। ঝুমকি রীতিমতন কেঁপে ওঠে ঘর ছেড়ে পালালো।
পিতার সাথে মায়ের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কটা হয়ে গেছে বরফের মতো শীতল। কথাবার্তা খুব একটা হয় না বললেই চলে। বছর দুয়েক আগ পর্যন্তও দু হাজার টাকা করে মাসোহারা পেত সে লোকটার কাছ থেকে। সে সুবাদে তাও যা একটু কথাবার্তা হতো বাপ-ব্যাটার মধ্যে। কিন্তু গেল বছর থেকে তাও বন্ধ। লোকটা এক রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আকাশকে ডাক পাঠিয়ে ঘোষণা দিলো, ‘এই দামড়া ছেলে কোথাকার! আর কতদিন বাপের পয়সা নয় ছয় করবি হ্যাঁ? আজকে থেকে তোর রাস্তা তুই দেখবি, আমি তোকে আর একটা কানাকড়িও দেবো না। বোঝা গেল?’
বস্তুত নয়-ছয় করার মতো বিস্তর টাকা পয়সা লোকটার কখনোই ছিল না। আকাশ অত্যন্ত স্বল্প আয়ের মধ্যে বড় হয়েছে। নিজের সবচাইতে কাছের এবং প্রাণের বন্ধুটির অস্বাভাবিক বিলাসবহুল জীবনযাত্রার নাচন চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেও হৃদয়ের চোখে পট্টি বেঁধে ঘুরেছে সে। তবুও বাবা নামের লোকটাকে কোনোদিন সাহস করে বলতে পারেনি, ‘আপনি একটা অপদার্থ! আপনার টাকার আমি…..
একদিন বলবে আকাশ। ঠিকঠিক বলবে।
আজকে ঝুমকির দিকে তাকিয়ে খুব কঠিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। তার আগেই টুং করে ডোরবেল বেজে উঠল। ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে দশটা। পিতৃবাহাদুর ব্যবসা না ছাইপাশ কী জানি করে তা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বাজে রাত এগারোটা। যেসব রাত্রি সুরাময় হয় সেসব রাত্রিতে বাড়ি ফেরে আরো পরে, বারোটার ঘর ছাড়িয়ে যায় ঘড়ির কাঁটা। অতএব এ সময়টা পিতৃবাহাদুরের ফেরার সময় না। তাহলে কে আসল এ অসময়ে?
দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে দুই ডাকাত ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ঝুমকি আকাশের পেছন পেছন হেঁটে এসেছিল। ঝুমকিকে দেখে রুদ্র হেসে সালাম দিলো। ঝুমকি উত্তর না দিয়ে গট গট করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল। একটু আগে আকাশের সাথে হয়ে যাওয়া বাকবিতণ্ডার ঝাঁঝাল রেশটা এ আগন্তুকদের সামনে দেখানোটা যেন বড্ড জরুরি ছিল।
ঝুমকি চলে যেতেই রুদ্র ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘উনার কী হইছে? রাক্ষুসীর মতো বড় বড় চোখ মেইলা তাকাইল কেন?’
আকাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘উনার যা ইচ্ছা হোক, তোদের কী হইছে? এত রাতে জ্বালাইতে আইছস ক্যান?’
সামি আর রুদ্র সোফার ওপর বসল। রুদ্র কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে ফেলল, ‘সামি আর বিভা ঠিক করেছে ওরা পালাবে।’
সামি শুধরে দিয়ে বলল, ‘সামি আর বিভা নয়, শুধু সামি। বিভা এখনো পালানোর ব্যাপারে কিছু জানে না।’
আকাশের চোখদুটো আপনাআপনি কপালে ওঠে গেল। মুখ হা করে কয়েক সেকেন্ড বেআক্কেলের মতো চেয়ে রইল সে দুই বন্ধুর দিকে। তারপর কোনো রকমে বলল, ‘এসবের মানে কী? পালাবে কেন ওরা? পুলিশে দৌড়াইছে নাকি ওদেরকে?’
‘রাম সাগলের বাচ্চা, পুলিশে দৌড়াইব ক্যান, পালায়া বিয়া করব ওরা?’ রুদ্রর বলা ছাগল শব্দটা শোনাল ‘সাগল’।
‘হোয়াট দ্যা ফাক! বিভার তো অভিজিতের সাথে বিয়ে!’
সামি বিরক্ত হয়ে গেল, ‘এত ত্যানা পেঁচাস ক্যান, বিভার সাথে আমার কথা হয়েছে। ও আমাকে পছন্দ করে, বুঝছিস?’
এবার আকাশের ঠোঁট জোড়া দুই পাশে প্রসারিত হয়ে উজ্জ্বল একটি হাসির রেখা তৈরি করল।
সাথে হাসল ওর চোখ। মিটমিটে গলায় বলল, ‘তোমরা তো মামা ঘাঘু পাবলিক হ্যাঁ? তলে তলে এতদূর?’
রুদ্র বলল, ‘সব কথা পরে হবে। আগে আমাদের একটা প্ল্যান করতে হবে বুঝছিস? তুই এক কাজ কর, অমৃতার বাসাত কাছেই, ওকে ডাক দে। আর হৃদিরে ভিডিও কল লাগা। সবাই একসাথে বসে প্ল্যান করি।
‘অমৃতার বাসায় গেলেই পারি আমরা। আমার পিতাবাহাদুর একটু পরেই বাড়ি আসবে। মদ টদ খেয়ে আসলে তোদেরকে রাম ধোলাই দিতে পারে, সো কেটে পড়াই ভালো।’ আকাশ বলল।
যেমন বলা তেমন কাজ। খানিকক্ষণের মাঝেই কেটে পড়ল ওরা।
রাত প্রায় এগারোটার সময় অমৃতার বাসার সদর দরজায় তিন মূর্তি এসে হাজির হলো। অমৃতার আম্মি দরজা খুলল। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘এত রাতে? কী ব্যাপার কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’
‘না আন্টি, ঝামেলা ঠিক না, তবে অমৃতাকে একটু দরকার ছিল।’ সামি বলল।
দরজার মুখ থেকে সরে দাঁড়িয়ে আম্মি ওদের ভেতরে আসার পথ করে দিলো। ড্রইংরুমে দীপা বসে ছিল ঠ্যাং তুলে সোফার ওপর। হাতে রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। তার পরনে একটি কালো থ্রি-কোয়ার্টার ট্রাউজার আর লাল টি শার্ট। থ্রি-কোয়ার্টার ট্রাউজারের নিচে চকচক করছে তার ফরসা পায়ের গোড়ালি। ঘরে ঢোকা মাত্র ওর ওই চকচক করা ফরসা পায়ের দিকে তিন মূর্তির চোখ গেল। তিনজনেই চোখ সরিয়ে নিল সাথে সাথে। দীপা কিন্তু একটুও অপ্রস্তুত হলো না। যেমনটা ছিল ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই অটল থেকে মুখে একটা দারুণ হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘হাই ভাইয়া বাহিনী! এত রাত্রে ডাকাতি করতে আসছ তোমরা?’
‘হুম ডাকাতিই করব বৈকী!’ আকাশ বলল একটু হালকা চালে।
‘কী ডাকাতি করবে শুনি?’ দীপার প্রশ্ন।
‘তোমাকে অন্তত নয়, এতটুকু নিশ্চিত থাকতে পার’ বলে আকাশ হাসল।
দীপা একটু নিভল মনে হয়। ততক্ষণে অমৃতা চলে এসেছে। এসেই সে দীপাকে দেখে একটা খ্যাক দিল, ‘ভিতরে যা! এখানে করছিস কী?’
‘আজিব বাত! কী করব আবার, টিভি দেখি।’ ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে ড্যাম কেয়ারভাবে বলল দীপা।
অমৃতা ওর দিকে একটা তীরের মতো চোখা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বন্ধুদের বলল, ‘ভিতরে আয়, আমার ঘরে।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতেই রুদ্র কেমন একটু ফ্যাকাশে গলায় আকাশকে বলল, ‘সিরিয়াসলি? তুই দীপার সাথে ফ্লার্ট করছিলি?’
রুদ্রর কিম্ভূতমার্কা প্রশ্নের ছুরির ফলা এখন বন্ধুদের কাছে ভোঁতা হয়ে গেছে। কেউ আর আজকাল ওর অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে চমকায় না, অপ্রস্তুত হয় না। কিন্তু আজকে আকাশ ওর প্রশ্নটি শুনে বেশ ভড়কাল।
চকিতে তাকাল অমৃতার দিকে। মনে মনে বলল, ‘শালা মদনের বাচ্চা, জংলি বেগুনের বাচ্চা, প্রশ্নটা করার আর টাইম পাইলি না হারামি!’
মুখে অবাক হবার ভান করে বলল, ‘ধ্যাৎ! কী বলিস!’
রুদ্র দমল না। অমৃতার কাছে নালিশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘এই হারামজাদা তোর বইনের লগে ফ্লার্ট করতেছিল, ট্রাস্ট মি!’
অমৃতা একটু সরু চোখে তাকাল আকাশের দিকে। আকাশ কুঁকড়ে গেল। মনে মনে রুদ্রর গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকল। রুদ্রর পেটে কথা থাকে না বলে তাকে জানানো হয়নি যে দীপা কয়েকদিন আগে আকাশের কাছে একরকম বলতে গেলে এপ্রোচই করেছে। সরাসরি ফোনে বলেছে যে আকাশকে তার ভালো লাগে। আকাশ ব্যাপারটা অনেক সূক্ষ্মভাবে হ্যান্ডেল করছে। অমৃতাকে কিচ্ছু জানতে দেয়নি এখনো। বন্ধুদের মধ্যে কেবল সামিই জানে ব্যাপারটা।
সামি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘এসব আজাইরা কথা রাখ, জরুরি কথা বল। রাত বাজে কয়টা খেয়াল আছে?’
অমৃতাকে ঘটনা খুলে বলার পর প্রথমেই সে বলে বসল, ‘দ্যাখ এ কাজে আমি তোদেরকে সাহায্য করতে পারব না। আমি বিভার ফ্যামিলিকে ছোটবেলা থেকে চিনি, ঠিক আছে? আমি একশ ভাগ চাই বিভা আমাদের সাথে থাকুক। কিন্তু ওর পরিবারের মানুষজনকে কষ্ট দিয়ে না। আংকেল আন্টি আমাকে অনেক বিশ্বাস করে। সরি দোস্ত, আই কান্ট হেল্প!
অমৃতাটা বেশি স্পষ্টবাদী। কাঠখোট্টা একদম। একেবারে পেশাদার উকিলের মতো করে বলল কথাগুলো। আকাশ আর রুদ্ররই সামির জন্য মায়া হতে থাকল, আর অমৃতাটা মেয়ে হয়েও অন্তরে কোনো মায়া-দয়া নেই।
‘তাহলে কী করতে বলিস, তুই আমাকে?’ সামি প্রশ্ন করল ভারি করুণ গলায়।
‘দ্যাখ তুই যদি বিভার ভালো চাস তো এখন এসব জিনিসপাতি নিয়ে আর ঘাঁটিস না, বন্ধুত্বটাকে বন্ধুত্বই রাখ। প্রেমটেম ভুলে যা।’
‘তুই তো কখনো এতটা ব্যাকডেটেড ছিলি না অমৃতা, হঠাৎ কী হলো তোর?’
‘এত কিছু জানি না। আমি জাস্ট আমার ফ্রেন্ডের ফ্যামিলির সাথে প্রতারণা করতে পারব না। তুই যদি ওর বাবা-মা আর তোর বাবা-মাকে জানিয়ে কাজটা করিস তাহলে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু তোকে পালায়ে বিয়ে করার মত দুই নাম্বার কাজে মদত দেওয়া ইজ ইম্পসিবল ফর মি।’
অমৃতাকে ভীষণ ডিটারমাইন্ড মনে হলো।
‘ওকে, হৃদিকে ফোন লাগা।’ সামি হুকুম করল আকাশকে।
হৃদিতা ভার হওয়া মন নিয়ে মায়ের পাশে শুয়ে ছিল। ছোট ভাই হৃদয়ও সাথে আছে। তিনজনে মিলে টুকটাক গল্প করতে করতে ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল। হাতে ধরা ছিল মোবাইল ফোন।
আকাশের ভিডিও কল মোবাইল ফোনটায় কম্পন তুলল। চমকে উঠল হৃদি। মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুমো ঘুমো আরামের রিমঝিম পরিবেশটা আকাশের বাচ্চা বরবাদ করে দিলো। হৃদি মহা বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসলো। ঝাঁপ দিয়ে বিছানায় পড়ে ভিডিও কল রিসিভ করল।
আকাশের ফোনে হৃদির অন্ধকার ঘরটা ভেসে উঠল। কিছু দেখা যাচ্ছে না
শুধু অন্ধকারে হাসছে হৃদির ডায়মন্ডের সাদা নাকফুল।
‘কী সমস্যা? এত রাতে কী চাই?’ হৃদির প্রশ্ন।
সামি আকাশের হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কোনো রকমের ইন্ট্রোডাকশন ছাড়াই বলল, ‘শোন আমি ঠিক করেছি বিভাকে নিয়ে পালাব, তারপর বিয়ে করব আমরা, তোর কী মতামত?’
‘এমন গুণ্ডার মতো কথা বলছিস কেন, সামি?’ চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল হৃদি। অন্ধকারেও ওর পাকানো চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল যেন কোটর থেকে।
সামি অবাক গলায় বলল, ‘কোনটা গুণ্ডার মতো কথা মনে হলো তোর কাছে?’
‘এই যে পালিয়ে যাব, বিয়ে করব, এগুলো কোন ধরনের মামদোবাজি হ্যাঁ? জীবনটা কি সিনেমা মনে হচ্ছে?’
‘এর মানে কি আমি ধরে নেব যে তুই আমার পাশে নাই?’
‘অফকোর্স আমি তোর পাশে নাই, আমাদের দেশে হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হয় না।’
‘কে বলেছে হয় না? কোর্ট ম্যারেজ হয়।’
‘মোটেও হয় না’
‘তুই কিছুই জানিস না, পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে।’ এটুকু বলে সামি অমৃতার দিকে ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তুই তো লইয়ার, তুই বল, হৃদি যা বলছে তা কি ঠিক? আইন কী বলে?’
‘বিয়ে হলেও হতে পারে স্পেশাল ম্যারেজ এক্টের আন্ডারে। আইন আছে, তবে প্রয়োগ কতখানি বলতে তো পারছি না। সঠিক ধারণা নেই আমার এ বিষয়ে।’
অমৃতার উত্তরে সামি সন্তুষ্ট হল বলে মনে হল না। জেদি গলায় বলল, ‘হোয়াটেভার। আই এম গোয়িং টু ম্যারি হার এনিওয়ে, পিরিয়ড।’
ঠিক সমান তালের জেদ গলায় ঢেলে হৃদি বলল, ‘না, তুই ওকে বিয়ে করবি না। এটা অসম্ভব।’
‘তুই জাহান্নামে যা!’ বলে সামি ভিডিও কল কাটল।
তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো, ‘তোরা কেউ আছিস আমার সাথে?’
অমৃতা ধারালোভাবে বলল, ‘আমার যা বলার আগেই বলে দিয়েছি।’
অমৃতার কথাটা কেমন যেন ছুরির মতো বিধলো গিয়ে মনে। ভেতরের ভাংচুরের একটা অস্ফুট ছায়া পড়ল সামির চোখে। রুদ্র আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোরা?’
আকাশ একটু ভড়কে গিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রও। দুজনের চোখে চোখে কয়েকটা নীরব বাক্য বিনিময় হয়ে গেল।
অধৈর্য সামি একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলে ঘরের দরজা খুলে পা বাড়াল। আকাশ লাফ দিয়ে পড়ে সামির কাঁধ চাপড়ে আহ্লাদি গলায় বলে উঠল, ‘আরে! আমি তো আছিই তোর পাশে, এটা আবার জিজ্ঞাসা করা লাগে নাকি?’
রুদ্রও লাফ দিয়ে সামির অন্য পাশে চলে আসলো, বলল, ‘আমার দোস্তো যদি চায় তো আমি হলিউড থেইকা জেনিফার লরেন্সরে তুইল্লা নিয়া আসমু, বিভা তো কোন ছাড়!’
৩১
মধ্য দুপুরের সূর্য উত্তপ্ত উনুনের মতো জ্বলছে। ভ্যাপসা গরম। অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে চিফ মেট্রো পলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে। তার গায়ে কালো কোট, হাতে ধরা কালো কুচকুচে গাউন। মানুষের তৈরি নিরবচ্ছিন্ন কোলাহল ভুভুজেলার মতো তীক্ষ্ণভাবে বেজে চলেছে কানে। ধুলো ভরা বাতাসে বিষাক্ত জীবাণুরা নেচে বেড়াচ্ছে মহা আনন্দে। চারপাশে নানা বয়সি লোকজন গিজগিজ করছে। এর মাঝে মহিলা এবং কোলের শিশুও আছে। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে কালো কোট আর কালো গাউন গায়ে দেওয়া দো পেয়ে উকিলদের। একটা পুলিশের জিপ দাঁড়ানো সামনে। তার পেছনে হাতকড়া পরানো আসামিদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। আসামিরা জিপ গাড়ির খাঁচার ভেতর থেকে বানরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে।
অমৃতা একজন মক্কেলের অপেক্ষা করছে। মক্কেলের আজ প্রথম শুনানির দিন। এন আই এক্টের মামলায় ফেঁসে যাওয়া মক্কেলটি নিতান্তই সহজ-সরল এবং বেকুব গোছের। কোর্টকাছারি এসেছে ঠিকই সময়মতো কিন্তু সিএমএম কোর্ট খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে শুনানির সময় দুপুর বারোটা। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা পঞ্চাশ বাজে। সিনিয়র তাই অমৃতাকে পাঠালেন বোকা মক্কেলটাকে খুঁজে বের করে কানে ধরে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু লোকটা এ মুহূর্তে ফোন ধরছে না। ফোন ধরলে অমৃতা লোকটার বর্তমান অবস্থানরত জায়গায় গিয়ে তাকে নিয়ে আসত। অমৃতা ফোনের পর ফোন দিতে থাকল লোকটার মোবাইলে।
১৩৭
জামান উকিলের সাথে দেখা হয়ে গেল। জামান উকিলের বয়স পঞ্চাশের ধারে কাছে। প্র্যাকটিস করছে অনেকদিন হলো। কিন্তু লোকে বলে সে আসলে উকিল নয়, দালাল। তার লাইসেন্সটি পর্যন্ত জাল। জাল লাইসেন্স নিয়ে সে বছরের পর বছর আইন চর্চা করে যাচ্ছে। লাইসেন্স জাল হওয়ার খবরটি ভুয়া নাকি সত্য অমৃতা তা জানে না, কিন্তু লোকটাকে সে সঙ্গত কারণেই দুই চক্ষে দেখতে পারে না। পান খেয়ে ঠোঁট থাকে সর্বদা লাল। কথা বললেই ভক ভক করে কড়া জর্দার গন্ধ উড়ে এসে নাকে লাগে। উপরন্তু এ লোকের নজর খারাপ। কথা বলার সময় সে মেয়েদের চোখের দিকে তাকায় না, তাকায় বুকের দিকে। কঠোর ব্যক্তিত্বের, পুরুষালি চলন বলনের অমৃতাও ওই বদ নজর থেকে রেহাই পায় না। অমৃতার গা ঘেন্নায় রি রি করে। কোনদিন যে সে ঠাস করে লোকটার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় তার কোনো ঠিক নেই।
অমৃতাকে দেখেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তেলতেলে হাসি দিয়ে পান খাওয়া ঠোঁট নেড়ে নেড়ে বলল, ‘লার্নেড! সালাম!’
অমৃতা পানসে মুখে সালামের উত্তর দিল।
‘কত নাম্বার কোর্টের মামলা?’ বলতে বলতে জামান উকিলের চোখ দুটো লেজার রশ্মির মতো ধপ করে গিয়ে পড়ল অমৃতার শরীরে। অমৃতা ক্রূর চোখে তাকাল জামান উকিলের দিকে। এ দুশ্চরিত্র লোকটার গালে চড় বসানোর সে বিশেষ দিনটি কি আজ? আজ মাথাটা আগে থেকেই ফুটন্ত তেলের কড়াই হয়ে আছে।
অমৃতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তাতে আপনার বাপের কী?’
জামান উকিল এহেন উত্তর আশা করেনি। তার মুখটা মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেল। বেশ হকচকিয়েও গেছে সে। কোনো মতে বলল, ‘না মানে, এমনি জানতে চাইছিলাম আর কী।’
‘শুনুন, আমার এখন আপনার এমনি প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় নেই। কাটুন তাড়াতাড়ি। কেটে পড়ুন।
‘এমনি’ শব্দটা বলার সময় অমৃতা দুই আঙুল নেড়ে বাতাসে কোটেশন মার্ক দেখাল।
আশেপাশে দাঁড়ানো আরও কয়েকজন পরিচিত উকিল দৃশ্যটি দেখল। জামান উকিল অপ্রস্তুত হয়ে জায়গাটা ছাড়ল ঠিকই কিন্তু যেতে যেতে একটা বিষ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে গেল অমৃতার দিকে। এ দৃষ্টির অর্থ হলো, যথাসময়ে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। অমৃতা জানে লোকটা যে কোনো উপায়ে প্রতিশোধ নেবে। অন্য কিছু করতে না পারলেও বদনাম রটাতে পিছপা হবে না। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে। অমৃতা ওসব সুনাম বদনামের ধার ধারে না।
এদিকে বোকা মক্কেলের খবর নেই। মরেছে নাকি লোকটা?
স্যার ফোন করছেন মোবাইলে। মেজাজটা যে কী ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ হয়ে গেল তা বলার মতো না।
ঠিক সে সময় চোখের সামনে একটা ভারি পরিচিত মুখ দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অমৃতা। আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে সানগ্লাস। মাথায় ক্যাপ।
‘তুই এখানে? কী চাই?’
‘একটা কথা বলতে এসেছি।’ শুকন গলায় বলল আকাশ।
‘আজিব বাত! কথা বলার জন্য তুমি পুরান ঢাকার কোর্ট কাছারি চইলা আসছো? কাহিনি কী? মোবাইল নাই তোমার? ফোন নাই?’
‘কথাটা সামনাসামনি বলতে চাই।’
অমৃতার ঠোঁট বিরক্তিতে বাঁকা হয়ে গেল, ‘তুই জানলি কেমনে আমি এই কোর্টে আছি?’
‘তোর চেম্বারে গিয়েছিলাম, পিয়ন ছেলেটা বলল তুই এখানে।’
‘দ্যাখ আকাশ রাইট নাও আমি খুবই ব্যস্ত।’
‘ব্যস্ত বলেই কথাটা এখন বলতে চাই। যাতে তুই রিয়্যাক্ট করার সময় না পাস।’
‘কী কথা? তাড়াতাড়ি বল!’ ধমকের সুরে বলল অমৃতা।
‘তোর ছোট বোন দীপার সাথে আমার কিছু একটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ নিশ্বাস বন্ধ করে আকাশ বলল।
‘কী হওয়ার সম্ভাবনা আছে? কিছুইতো বুঝতে পারছি না!
‘মানে নেক্সট উইকে ওর সাথে খুব সম্ভবত আমার একটা ডেট আছে।’ অমৃতার চেহারায় কোত্থেকে যেন একটা গাঢ় ছায়া এসে পড়ল, ‘মানে কী?’ আকাশ যন্ত্রের মতো হড়বড় করে বলল, ‘আমরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাত জেগে ফোনে কথা বলি।’
‘চমৎকার!’ শ্লেষের গলায় বলল অমৃতা।
‘সো আর ইউ ওকে উইথ দিজ? আফটার অল ও তোর আপন ছোট বোন।’
অমৃতা হতাশ গলায় বলল, ‘আমার কী সমস্যা? তোদের যা ইচ্ছে কর। দীপা একটা এডাল্ট মেয়ে। শি ক্যান মেক হার ওন ডিসিশন। আমার তো কিছু বলার নেই।’
ঠিক সে সময় মক্কেলটিকে দেখল অমৃতা। আকাশের পেছনে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অমৃতা আকাশকে বলল, ‘তোর যদি দীপাকে পছন্দ হয় তাহলে তুই ওর সাথে ডেট এ যেতেই পারিস। আই ডোন্ট মাইন্ড।’
বলল ঠিকই, কিন্তু সেদিন আর কোনো কাজে মন বসল না তার।
৩২
ছোট পিসিমা ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় শব্দ করে নাক ডাকছে। ধীর লয়ে ওঠানামা করছে তার ভুঁড়িওয়ালা পেট। বিভা তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ঘরের বাতি জ্বলছে, পাশের ঘর থেকে লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। এত হইচইয়ের মধ্যে একটা মানুষ কী করে অমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে?
আজ বিকেলে বিভার আশীর্বাদের অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নভাবেই সারা হয়ে গেছে। আগামীকাল বিয়ে। ওদের সতেরশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট এখন গিজগিজ করছে আত্মীয়স্বজনে। ফ্লোরিং করার পরেও শোবার জায়গায় টান পড়ে গেছে। অভিজিৎ উঠেছে কলাবাগানে তার এক বন্ধুর বাসায়। তার পরিবারের কেউ কেউ আবার হোটেল ভাড়া করেছে। কলকাতা থেকে আরো আত্মীয়স্বজন এসে পৌঁছুবে আগামী কাল।
‘কীরে তুই অমন হা করে কী দেখছিস?’ মা কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বিভা খেয়াল করেনি।
‘ঘুমোব কোথায় চিন্তা করছি।’
‘তুই আজকে আমার সাথে ঘুমা।’ বলে মা বিভার মাথায় আলতো করে হাত রাখল।
‘কেন? তোমার সাথে শুয়ে আর কী হবে? তোমরা তো আমাকে দেশ ছাড়াই করে দিচ্ছ। বের করে দিচ্ছ তোমাদের জীবন থেকে চিরতরে। এখন আর এসব ঢং করে তো কোনো লাভ নাই।’
মায়ের চোখ দুটো একটু জল টলমল করে উঠল বিভার কথা শুনে।
‘সব মেয়েকেই তো এক সময় বাপের ঘর ছেড়ে যেতে হয় রে।’
‘সে সময়টা একটু পরে আসলেও তো পারত মা? কেন এই তাড়াহুড়া?’
মা বিভার পাশে এসে বসল। একটু ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘হ্যারে, তোর অভিজিতকে পছন্দ হয়নি? এমন সোনার টুকরো ছেলে, কী অমায়িক আর ভদ্র ব্যবহার! এমন একটা ফার্স্ট ক্লাস ছেলেকে নিয়ে তোর এত কীসের সংশয়?
বিভা মায়ের দিকে করুণ চোখে তাকাল, বলতে চাইল, আমার তো অমন ফার্স্ট ক্লাস ভদ্র ছেলে সইবে না মা, আমার যে এক ভবঘুরে, বাউণ্ডুলে আর উচ্ছন্ন ছেলেকে পছন্দ! আমার যে মস্ত এক পাগল চাই সারাটা জীবনভর পাগলামো করার জন্য! ভদ্র, সভ্য মানুষ দিয়ে আমি কী করব?
ভাবল এক কথা আর বলল সম্পূর্ণ অন্য কথা, ‘সংশয় নেই, কীসের সংশয়?’
‘দেখবি, তুই খুব সুখী হবি ওর সাথে।’
‘তোমরা সুখী হলেই আমি সুখী।’
মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছে। আকাশের ফোন। বিভা সেলফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসলো।
হ্যালো বলতেই আকাশ ওপাশ থেকে অনেকটা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এই ডাইনি বুড়ি, তুই আমার ফ্রেন্ডের ওপর বানটান কিছু মারছস নাকি হ্যাঁ? সে তো তোর নামে বসে বসে মালা জপ করতেছে।’
‘এমনভাবে বলছিস যেন ওই তোর সব, আমি বুঝি কেউ না?’
‘আপাতত তুই আমার কেউ না, আপাতত আমি হলাম পাত্রপক্ষ। মানে বরপক্ষ। আর তুই হইলি আমার হবু ভাবি।’ কথাটা শেষ করেই আকাশ হো হো করে হেসে উঠল।
‘কী যা তা বলছিস!’
‘শোন, আমরা প্ল্যান করে ফেলছি।’
‘কীসের প্ল্যান?’
‘আজকে রাতে তোকে আমরা কিডন্যাপ করব!’ আকাশের গলায় আনন্দের হুড়োহুড়ি। উল্লাস যেন উপচে উপচে পড়ছে তার কণ্ঠ বেয়ে।
কী অসম্ভব এবং অবাস্তব একটা কথা! তবুও বিভা হেসে ফেলল। এতক্ষণের বুকচাপা হাহাকারটা মনের ঘুলঘুলির ফাঁক গলে ফুঁস করে বেরিয়ে গেল। এ পাগলগুলাকে ছাড়া সে থাকবে কী করে কলকাতা গিয়ে? কী করে কাটবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এদেরকে না দেখে, এদের কথা না শুনে? মনে হতেই বিভা একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিলো, বলল, ‘আবোল-তাবোল বকিস না।’
‘মোটেও আবোল-তাবোল না। এখন কটা বাজে ঘড়িতে দ্যাখ। সাড়ে এগারোটা। আমরা দেড়টার দিকে তোর বাসার নিচে আসছি। তুই সুযোগ বুঝে টুপ করে নেমে পড়বি নিচে। ততক্ষণে তোর বাসার সব লোকজন ঘুমিয়ে যাবে।’
‘কেউ ঘুমোবে না, সবাই বিয়ে বাড়িতে আমোদ করতে এসেছে, ঘুমোতে নয়।’
‘তুই তৈরি থাকিস, তোকে বের করার দায়িত্ব আমার।’
‘বের হয়ে হবেটা কী?’
‘কী আবার হবে, বের হওয়ার মানে হচ্ছে তুই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিস, এ বিয়ে তুই করবি না।’
‘কিন্তু আকাশ…
‘কোনো কিন্তু নয়, আমরা আসছি!’ আকাশ ফোন ছাড়ল।
বিভা টের পেল তার বুকের ভেতর কেউ দ্রিম দ্রিম শব্দে ড্রাম পেটাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তায় সে মরে যাবে। নির্ঘাৎ মরে যাবে!
তখন রাত দুপুর। বয়স্করা মোটামোটি ঘুমের কাছাকাছি চলে গেলেও ড্রইং রুমে বিভার কয়েকটা কমবয়সি কাজিন ফিসফিস করে চাপা স্বরে গল্প করছিল। আকাশ বলেছে দরজা না খুললে সে মাঝরাত্তিরে ডোর বেল বাজিয়ে সবার ঘুম ভেঙে দেবে। অতএব বিভা যতটা সম্ভব নিঃশব্দে পায়ে পায়ে এসে সদর দরজা খুলে রাখল ওরা এসে পৌঁছনোর একটু আগেই। ফ্লোরে শতরঞ্জি পেতে শুয়ে থাকা বছর পনেরোর এক কাজিন ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, ‘কে এসেছে দিদি? এত রাতে?’
‘কেউ না, তোরা ঘুমা, আমি একটু ছাদে যাচ্ছি, ঘুম আসছে না তাই।’
‘আমরাও যাব, আমাদেরও ঘুম আসছে না।
‘মরণ!’ এখন এদের ছাদে যাওয়ার বায়না নিয়ে করবে কী বিভা? ঠিক সে সময় দরজার সামনে আকাশ আর রুদ্রকে দেখা গেল। ডিম লাইটের আলোয় দুই ডাকাতের মুখের হাসি উপচে উপচে পড়ছে।
বিভার মেজাজটা এত বেশি খারাপ হয়ে গেল যে, রাগে দুঃখে সে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল।
‘কে এসেছে এত রাতে?’ ভীষণ ভয়ঙ্কর শোনাল মায়ের ভয় পাওয়া কণ্ঠস্বরটা বিভার কানে।
চমকে ওঠে তাকাল সে মায়ের দিকে। মা বসার ঘরের বাতি জ্বালালো। দুই আগন্তুককে দেখতে পেয়ে বলল, ‘ওমা, তোমরা এই অসময়ে? সব ঠিক আছে তো?’
রুদ্র একটু ভয় পেয়ে গেছে।
আকাশ একটুও বেসামাল না হয়ে রিহার্সাল দেওয়া লেকচার ছাড়ার মতো বলল, ‘কিচ্ছু ঠিক নেই আন্টি! বিভাকে আপনারা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন, দেশছাড়া করে দিচ্ছেন এটা কি কিছু ঠিক থাকার লক্ষণ?’
‘সব মেয়েকেই একদিন দূরে চলে যেতে হয়।’
এ বাক্যটা মায়ের এখন মুখস্ত হয়ে গেছে। কারণে অকারণে বারেবারে সুযোগ পেলেই সে ডায়লগটা ছাড়ছে। এখনো ফাঁক বুঝে ছেড়ে দিলো।
‘সে তো বুঝেছি আন্টি, কিন্তু বিভার শোকে তো আমাদের আরেক বান্ধবী প্রায় মরতে বসেছে।’
মা চমকে উঠল, ‘সে কী? কার কী হয়েছে?’
আকাশ অত্যন্ত করুণ গলায় বলল, ‘ওই যে হৃদি, হৃদি তো মাথা ঘুরে পড়ে গেছে বাথরুমে আধঘণ্টা আগে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু বিভার নাম ধরে ডাকছে।’
বান্দরটার অভিনয় দেখে বিভার হাসি পেয়ে গেল। দাঁত, ঠোঁট চেপে, মুখ খিঁচিয়ে অনেক কষ্টে হাসি চাপতে লাগল সে।
মা বলল, ‘সে কী কাণ্ড! এখন কেমন আছে হৃদি?’
‘বিভাকে এক নজর দেখতে না পেলে মনে হয় মরেই যাবে!’
আকাশের অবস্থা দেখে মনে হলো সে কেঁদে দেবে এক্ষুনি।
এবার রুদ্রও যোগ করল, ‘জি আন্টি, অবস্থা খুবই সিরিয়াস, বিভাকে যেতে হবে আমাদের সাথে।’
বিভার মা বিপন্ন গলায় বলল, ‘এত রাতে বিয়ের কনে ঘরের বাইরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’
‘জীবন মরণ প্রসঙ্গ আন্টি! আপনিই চিন্তা করেন, হৃদির যদি কিছু হয়…’
বিভা মায়ের দিকে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে বলল, ‘মা প্লিজ, তুমি আর বারণ করো না, আমি হৃদিকে একটু দেখে আসি।’
মা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ গলায় বলল, ‘এত রাতে…’
‘বারবার এত রাতে এত রাতে করছ কেন? মানুষের অসুখ-বিসুখ কি রাত দিন মেনে আসে?’
‘আচ্ছা যা, রাতে তাহলে আর ফেরার দরকার নাই, সকালে চলে আসিস সময় মতো। আমি হৃদির আম্মার সাথে ফোনে কথা বলে খবর নিচ্ছি, তুই যা। কীভাবে যাবি? গাড়ি আছে?’
‘জি আন্টি গাড়ি আছে আমাদের সাথে।’ রুদ্র বলল।
হৃদির আম্মাকে ফোন করার কথা শুনে বিভার গলা শুকিয়ে গেল। কিন্তু আকাশের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেল সেদিকেও সিস্টেম করতে ভোলেনি শয়তানগুলো। বিভা আর জামা পাল্টাল না। লং স্কার্ট, টপ আর স্কার্ফ পরা ছিল। হাতে ব্যাগ আর পায়ে চপ্পল লাগিয়ে বেরিয়ে আসলো বাসা থেকে।
ফিসফিস করে বলল, ‘হৃদির আম্মাকে ফোন করবে তো মা, ধরা পড়ে গেলে?
‘হৃদিকে বলা আছে, ও ওর মায়ের গলা নকল করতে পারে জানিস না? ফোন হৃদিই রিসিভ করবে। ওই ছেমড়ি তো কোনো হেল্পই করবে না, অনেক কষ্টে এটুকু করতে রাজি করিয়েছি।’
‘কেন? হেল্প করতে চায় না কেন?’ বিভার প্রশ্ন।
‘কী জানি! তোদের প্রেম দেখে মনে হয় হিংসে হচ্ছে।’ বলে হাসল আকাশ।
‘হ, আরো কিছু।’ বিভা উড়িয়ে দিলো কথাটা।
লিফট নিচে নামা পর্যন্ত কেউ আর কোনো কথা বলল না। যেন টু শব্দটি করলে ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। মাকে মিথ্যে বলায় বিভার মনটা একটু কেমন খচখচ করছিল। শান্তি পাচ্ছিল না একদম। কিন্তু মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে হলেও আর কিছু সময় অন্তত বন্ধুদের সান্নিধ্যে থাকার লোভটা সামলাতে পারল না সে।
নিচে নেমে মুক্ত বাতাসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আনন্দের চোটে তিনজনে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল। যেন এমন মুক্তির স্বাদ এ জীবনে এর আগে কখনো পায়নি ওরা। খুশির চোটে রুদ্র বিভাকে প্রায় শূন্যে তুলে ধরে একপাক ঘুরেও ফেলল।
লাল মার্সিডিস বেঞ্চের দরজা খুলে সামি বেরিয়ে আসলো। তিন বন্ধুর উল্লাস দেখতে গাড়িতে হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়াল সে।
বিভা তাকাল। চারটা চোখ অন্ধকারেও চুম্বকের মতো আটকাল নিমেষের মাঝে। দুজনের মাঝে দূরত্ব ছিল প্রায় দশ কদম। সেকেন্ডের ভেতরে ওই দূরত্বটুকু ঝড়ের বেগে অতিক্রম করল বিভা। সামি দু হাত প্রসারিত করে বিভাকে কাছে টেনে নিল, জড়িয়ে ধরে নিজের হৃদপিণ্ডের সাথে পিষে ফেলতে ফেলতে প্রগাঢ় গলায় বলল, ‘এবার তোকে আর ছাড়ছি না!’
বিভার সর্বাঙ্গে তখন সামির হৃদয়ের স্পন্দন। নিশ্বাস ভারী।
আবেগরুদ্ধ গলায় সে বলল, ‘আমিও যাচ্ছি না আর কোথাও। আমার আর কোথাও যাবার নেই।’
শেষের বাক্যটা সামির ভেতর বাহির সমস্তটা কেমন ওলটপালট করে দিলো। সত্যিই তো, বিভা আর কোথায় যাবে? পৃথিবীটা ঠিক মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গেলেও বিভা ঠিক এমনিভাবেই দৌড়ে এসে সামির বুকে পড়বে। বিভার জায়গা যে এই ধুলো মাটির পৃথিবীতে নয়। বিভার জায়গা তার বুকের মাঝে, হৃদয়ের মধ্যিখানে।
আকাশ আর রুদ্র রাস্তার ঘোলাটে ফ্লুরোসেন্ট আলোয় গাড়লের মতো কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল হা করে। যেন সিনেমা দেখছে।
কয়েকটা মুহূর্ত কাটার পর রুদ্র আকাশের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কান্না কান্না গলায় বলল, ‘দোস্ত! আয় আমার কাছে আয়, মিলন দেইখা আমার চক্ষে পানি চইলা আসছে, আমারে তো কেউ এমন কইরা বুকে টাইনা নিল না আজ পর্যন্ত, হায় কপাল!’
আকাশ রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘থাক দোস্ত, মন খারাপ করিস না, সবার কপালে কি আর সব হয়? আমি আছি তোর পাশে।’ এটুকু বলে আকাশ সামির দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে অবিকল সামির গলা নকল করে বলল, ‘এবার তোকে আর ছাড়ছি না।’
রুদ্রও ঠিক বিভার মতো মেয়েলি গলায় বলল, ‘আমিও যাচ্ছি না আর কোথথাও। আমার আর কোথাও যাবার নেই।’
সামি আর বিভা হেসে ফেলল ওদের নাটক দেখে। মনে মনে বুঝল ওরা, আজ থেকে শুরু করে বহু দিন পর্যন্ত এই উপহাসের ঠ্যালা সামলাতে হবে। বিচ্ছুগুলো যে ওই সময়টায় সামনে দণ্ডায়মান ছিল তা দুজনেই বেমালুম ভুলে বসেছিল।
গাড়ির ভেতর বিভার জন্য আরো মজার একটা চমক অপেক্ষা করছিল। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েই চমকটা দেখে একেবারে উল্লাসে ফেটে পড়ল সে। পেছনের সিটে হেলান দিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে নবাবি চালে বসে আছে তার দুই বান্ধবী, হৃদি আর অমৃতা। বিভাকে দেখে সুর করে দুজনে একসাথে বলে উঠল, ‘হ্যালো! মিসেস অভিজিৎ!’
বিভা ওদের দেখে খুশিতে আটখানা হলো ঠিকই, কিন্তু ‘মিসেস অভিজিৎ’ ডাকটা বড্ড বেশি কানে লাগল।
পেছনে চারজন গাদাগাদি করে বসল। অমৃতা, আকাশ, হৃদি আর বিভা। ড্রাইভিং সিটে সামি আর তার পাশে রুদ্র।
এমনি করে কতদিন কত পথ একসাথে চলেছে ওরা। এর আগে সামির ছিল একটা ছাই রঙের নোয়া গাড়ি। বছর দুয়েক আগে, সে গাড়িতে করে ওরা গিয়েছিল বান্দরবান। তারপর সে বছরই শীতে গেল সিলেট, অমৃতার দাদাবাড়ি। এ মানুষগুলোর গায়ে গা ঘেঁষে, মনে মন রেখে, কত কত সময় স্রোতের মতো কেটে গেছে। অভিজিতের সাথে কাল বিয়েটা যদি তার হয়ে যায়, তাহলে পরশু দিন নির্ঘাৎ উড়াল দিতে হবে কলকাতায়। তারপর… তারপর আবার কি কখনো এই মানুষগুলোর সাথে ঠিক এমনভাবে…। ভাবতে গিয়ে বিভার দম বন্ধ হয়ে আসলো।
সে আলগা একটা নিশ্বাস ফেলে পাশে বসে থাকা হৃদিকে অভিমানী গলায় বলল, ‘খুব যে ডাকলি আমায় মিসেস অভিজিৎ? আমি চলে গেলে আমাকে মিস করবি না বুঝি?’
হৃদি ঘাড়টা জানালার দিকে ফিরিয়ে বলল, ‘নাহ! মিস করব কেন? সবাইকেই নিজ নিজ জায়গায় সেটেল হতে হবে তাই না? ইমোশনকে প্রশ্রয় দিলেতো চলবে না!’
হৃদির কথা শুনে বিভার টানা টানা ডাগর চোখ দুটোতে জল টলমল করে উঠল। বাকি পথটায় কেউ আর কোনো কথা বলল না। সবাই কেমন নিজ নিজ ভাবনায় ডুব দিয়ে রইল।
রাত ঠিক দু’টায়, উত্তরা সামির বাড়ির সামনে এসে থামল ওরা। ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল বাড়ির সব মানুষ ঘুমে কুপোকাত। কাজের লোকগুলোও জেগে নেই।
ঘরে ঢোকা মাত্র রুদ্র, অমৃতা আর হৃদির দিকে তাকিয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ গলায় প্রশ্ন করল, আচ্ছা তোরা কি ‘আমার আর কোথাও যাবার নেই’ সিনেমাটা দেখেছিস?’
অমৃতা অবাক গলায় বলল, ‘নাতো!’
রুদ্র একগাল হাসল, ‘দাঁড়া এক্ষুনি দেখাচ্ছি।’
যে বলা সে কাজ। আকাশও যেন তৈরি ছিল। রুদ্র ‘অ্যাকশন’ শব্দটা উচ্চারণ করার সাথেসাথে আকাশ স্লো মোশনে রুদ্রর দিকে দৌড়ে আসতে থাকল। রুদ্র ‘লা লা লা’ করে মুখ দিয়ে মিউজিক ছাড়তে লাগল। আকাশের স্লো মোশন দৌড় দেখে হৃদি আর অমৃতা হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল। সামি ঘটনা বুঝতে পেরে বিরক্তিতে একবার তাকাল আকাশের দিকে, তারপর নিঃশব্দে হেঁটে বারান্দায় চলে গেল।
বিভার বুকে তখনও অভিমানের হালকা পালকটা সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। রুদ্র আর আকাশের কাণ্ড দেখে প্রথমে হেসে দিলেও সামি ঘর ছেড়ে যাবার পর একটু গম্ভীর হয়ে গেল সে।
আকাশ তখন দৌড়ে গিয়ে রুদ্রর বুকে পড়েছে। রুদ্র আকাশকে জড়িয়ে ধরে ড্রামাটিক গলায় বলছে, ‘এবার তোকে আর ছাড়ছি না!’
আকাশ বিভার গলার স্বর নকল করে বলছে, ‘আমিও আর কোথাও যাচ্ছি না, আমার আর কোথাও যাবার নেই!’
বিভা ঘরটা ছাড়ল। ছাড়ার সময় তার বন্ধুদের অট্টহাসির শব্দ কানে এসে লাগছিল। ওরা কৌতুক করতে ভালোবাসে সে জানে। কিন্তু আজ বিভার জীবনের এমন এক ঘোর টানাপোড়েনের সামনে দাঁড়িয়ে অমন উপহাসের হাসি না হাসলেও তো পারত!
বিভা ঘর থেকে বেরোনো মাত্র অমৃতার মুখের হাসি ভস করে পালাল। সে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ঘটনা কি সত্য? ওরা কি আসলেই সিরিয়াস?’
‘দে আর ড্যাম সিরিয়াস। আমার তো এখন ভয়ই লাগছে, মনে হচ্ছে এ দুইটার কপালে দুঃখ আছে!’ আকাশ বলল, চিন্তিত গলায়।
হৃদি বলল, চল আমরা ওদের দুজনকে বুঝিয়ে বলি, যে ওরা যা করছে ভুল করছে।’
‘বুঝিয়ে এখন কোনো লাভ নেই, এখন ওদের কিছু বোঝার স্টেজ না।’ রুদ্র বলল।
‘আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়, কোনো একভাবে অভিজিতের সাথে বিভার বিয়েটা বানচাল করে দেই। সামির সাথে কী হবে না হবে তা পরে দেখা যাবে।’ আকাশ বলল।
‘সেটা পারলেতো আর কথাই ছিল না। এ বিয়ার জন্য তো আমরাও বিভাকে হারাচ্ছি তাই না? কোত্থেকে কোন কোলকাইত্তা বাবু ধইরা নিয়ে আসছে, ক্যান বাংলাদেশে কি পোলা নাই? অমৃতা বলল ঝাঁঝাল গলায়।
‘আমরা এ বিয়ে ভেঙে দেই চল!’ বলল আকাশ।
‘কীভাবে?’ হৃদির প্রশ্ন।
‘ওর বাবা মাকে গিয়ে বলি অভিজিতের চরিত্র খারাপ।’ রুদ্রর অপিনিয়ন। বিদ্রুপের হাসি হাসল অমৃতা, ‘তুমি বললা আর উনারা তোমারে কোলে নিয়ে আদর কইরে বিশ্বাস করল। কত শখ!’
‘প্ৰমাণ দিব প্রয়োজনে!’
‘কী প্রমাণ?’
রুদ্র গালে হাত দিয়ে হুম হাম করে আকাশ-পাতাল ভাবল কয়েক সেকেন্ড, তারপর বলল, ‘হৃদি, শোন অভিজিৎকে ফুসলায়ে ফাসলায়ে একটা ইন্টিমেট ছবি তুলে ফেলতে পারবি না? ওই ছবি দেখাব বিভার ফ্যামিলিকে।’
হৃদি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ইয়া আল্লাহ্! কী বলে! আমার একটা বদনাম হয়ে যাবে না ওইরকম ছবি তুললে? পরে তো আমার বিয়ে হবে না!’
‘আরে তোর বিয়ে নিয়ে ভাবিস কেন? তুই কাউকে না পাইলে আমিতো আছিই।’
হৃদি একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওহ রুদ্র! ইউ আর আ লাইফ সেভার!’
আকাশ বলল, ‘জি না, আমি হৃদির ব্যাকআপ। ওর সাথে ডিল হয়ে গেছে, পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত যদি ও সিঙ্গেল থাকে, বর না পায়, তাহলে ও আমাকে বিয়ে করবে।
শুনে রুদ্রর ক্যাটস আই চোখ সংকুচিত হয়ে গোল মার্বেল হয়ে গেল। হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘কী? এত বড় প্রতারণা? হৃদি তুই তো ভয়ানক মিথ্যাবাদী? তুই আমাদের সাথে ডাবল প্লে করছিস?’
হৃদিকে দেখে মনে হলো সে জীবন মরণ সমস্যায় পড়ে গেছে। সে আঁকুপাঁকু হয়ে বলল, ‘আচ্ছা যা, তোরা দুইজনই আমার ব্যাকআপ।’
আকাশ সজোরে মাথা নাড়ল, ‘না না এসব মামদোবাজি চলবে না, তোর যে কোনো একজন কে চুজ করতে হবে।
‘একজন অমৃতাকে ব্যাকআপ বানা।’ নিরুপায় হয়ে বলল হৃদি।
অমৃতা ফোঁস করে উঠল, ‘আমি জীবনেও বিয়ে করব না, আমার সাথে এসব ফালতু কথা বইলা লাভ নাই। শুনলে গা জ্বালা করে।’
আকাশ চিমটি কাটল, ‘এবনরমাল লোকজনের নরমাল কথাবার্তা শুনলে ওরকম গা জ্বালা করে, এটা স্বাভাবিক।
‘এখন কী এসব ফালতু প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আসল আলোচনায় আসবা তোমরা?’ অমৃতা বলল, গলায় বিষ ঢেলে দিয়ে।
‘হুম আসল আলোচনা’ বলে আকাশ ঘরের ভেতর চিন্তিত মুখে পায়চারি করতে লাগল। অন্যরাও ভাবতে লাগল, কপালে ভাঁজ ফেলে, ভ্রু কুঁচকে গভীর ভাবনা।
.
বিভার বুকটা কেমন খালি খালি লাগছিল। বদ্ধ বাতাসের মতো একটা হাহাকার ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের ভেতর। লিভিংরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় সামি দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটের ওঠানামা।
‘কী ভাবছিস?’ সামির পেছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল বিভা।
সামি বিভার দিকে তাকাল। বাড়ির পেছনদিকে বলে বারান্দাটায় রাস্তার আলো আসে না। এ মুহূর্তে তাই চারপাশ ঘুটঘুটি অন্ধকার। মাঝরাতের হাওয়ায় হালকা স্বস্তির ছোঁয়া। দিনের বেলার আগুনের মতো গরমটা এখন আর অনুভূত হচ্ছে না।
‘তোকে ভাবছিলাম।’ সামি অকপট উত্তর দিলো।
বিভা একটু কাঁপল ভেতরে ভেতরে। তাদের ভেতরে ভালোবাসা থাকলেও প্রেম কখনো প্রকাশ্য ছিল না। অনেক অনেক রাত বিভা নির্ঘুম চোখে জাগনা থেকে সামির কথা ভেবেছে লুকিয়ে লুকিয়ে। সামিকে কখনো সেসব রাতের কথা বলতে পারবে এমন স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেত। আজ তার সে ভাবনা ঘরের গোপন দেবতাটি এমন নিঝুম রাত্তিরে একলা দাঁড়িয়ে গভীরভাবে তার কথা ভাবছে, এটা জানতে পেরে নিষিদ্ধ এক ভালোলাগায় তার সারা গা শিউরে উঠল।
সে মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘কী ভাবছিস আমার কথা?’
‘ভাবছি তোকে যে আমি ভালোবাসি, তোকে যে আমার চাই, এ সত্যটা উপলব্ধি করতে এত সময় লেগে গেল কেন? আরো আগে কেন জানলাম না? আগে থেকে জানলে তোর এসব বিয়েশাদির ঝক্কি ঝামেলা আসতই না। ফ্যামিলির মানুষজনকে আগেই জানিয়ে দিতাম।’
‘আমি তো জানতাম, অনেক অনেক দিন আগে থেকেই জানতাম।’
‘কী জানতি?’
বিভা সামির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে বলল, ‘জানতাম, তুই আমার!’
‘তাহলে আগে বলিসনি কেন কখনো?’
‘বলে লাভ নেই যে!’ বিভার গলার স্বরটা কেমন অন্যরকম শোনাচ্ছিল।
‘লাভ নেই মানে?’
‘আমার বাবা মা কোনোদিন তোকে মেনে নেবে না।’
‘কেন নেবে না? কী নেই আমার? তুই জানিস আমি কার ছেলে?’
বিভা শ্লেষের হাসি হাসল, ‘আমি জানি তুই অনেক ক্ষমতাবান বাবার ছেলে। আমার মতো একশটা বিভাকে তুই পয়সা দিয়ে কিনতে পারবি। কিন্তু সামি ঝামেলাটা যে অন্য জায়গায়। ঝামেলাটা হচ্ছে তুই মুসলমান আর আমি হিন্দু। আমার যদি তোর কাছে আসতে হয়, তাহলে আমার পরিবার, বংশ, ধর্ম সমস্ত কিছু ত্যাগ করে তারপর আসতে হবে।’
সামি হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অকস্মাৎ বিভার দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরল, ভূতগ্রস্থের মতো বলল, ‘পারবি না তুই? পারবি না সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে আসতে চিরতরে?’
‘তুই পারবি? নিজের বাবা মাকে ছেড়ে আমার সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে? এই চেনা পৃথিবী ছেড়ে, অনেক দূরে?’
সামি ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘সব পারব বিভা, তোর জন্য আমি সব পারব!’
সেলফোনটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেজে উঠল ঝনঝন করে।
সামি আর বিভা দুজনেই একটু চমকে উঠল। চমকালো বুঝি মাঝরাত্তিরের গুমোট হাওয়াটাও।
সামি পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল। আননোন নাম্বার। কয়েক সেকেন্ড একটু ইতস্তত করে শেষমেশ রিসিভ বাটন প্রেস করল। ওপাশ থেকে একটা ভরাট গলা বলল, ‘হ্যালো সামি বলছেন?’
‘বলছি।’
ও পাশের গলাটা একটু বিরতি নিল। নীরব বিরক্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত কাটল।
‘আমি অভিজিৎ বলছি।’
বিস্ময়ে সামির ঠোঁটদুটো ঈষৎ ফাঁকা হয়ে গেল।
‘সরি, বুঝতে পারিনি, কে বলছেন?’
‘অভিজিৎ রয়।’
সামি সন্তর্পণে তাকাল একবার বিভার দিকে। বিভার চোখে প্ৰশ্ন।
‘কী চাই?’ একটু রুড শোনাল সামির প্রশ্নটা।
‘বিভা কি আপনার সাথে?’
পরিস্থিতি সমঝে চলার ছেলে সামি কখনোই না। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। সে বুক চিতিয়ে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, আমার সাথে।’
আবার চুপ করে গেল অভিজিৎ। শুধু নিশ্বাসের শব্দ। অধৈর্য সামি প্রশ্ন করল, ‘কেন বলুন তো? ইজ এভরিথিং অলরাইট?’
‘এভরিথিং ওয়াজ এবসোলুটলি অলরাইট বাট সাডেনলি সামথিং কেইম আপ।’
‘কী হয়েছে?’ সামির গলায় উৎকণ্ঠা
‘দেখুন নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আমাদের সবার আছে। সিদ্ধান্তগুলো শুধু সময়মতো নিতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই সারা জীবনভর পস্তাতে হয়।
‘কী হয়েছে বলুনতো? হোয়াই দ্যা হেল আর ইউ লেকচারিং অন মি?’
বিভা এবার সচকিত হয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কার সাথে এমন ক্যাট ক্যাট করে কথা বলছিস?’
সামি হাত দেখিয়ে ইশারায় বিভাকে থামতে বলল। ততক্ষণে বারান্দায় বাকি বন্ধুরা এক এক করে এসে হাজির হচ্ছে। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে সামির দিকে।
অভিজিৎ বলল, ‘আপনার যে বিভার সাথে অ্যাফেয়ার আছে এ কথাটা সরাসরি আপনারা আমাকে বললেইতো পারতেন। লোক মারফত খবর পাঠানোর তো দরকার ছিল না।’
ভীষণ চমকাল সামি। মুখ দিয়ে বলার মতো তাৎক্ষণিক কোনো কথা খুঁজে পেল না। গোঙানির মতো শুধু একটা অস্ফুট শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘হ্যাঁ?’ অভিজিত বলে চলল, ‘বিভা যদি আমাকে প্রথম দিনই ব্যাপারটা বলে দিত, তবে তো ঘটনা এতদূর এগোত না। আমি জোরজার করে তো আর বিয়ে বসতে চাইতাম না, তাই না?’
‘কিন্তু আপনি… আপনি কী করে জানলেন?’
‘সে কথা না হয় থাক, আপনি কি ফোনটা একটু বিভাবরীকে দেবেন? কয়েকটা কথা ছিল।’
সামি যন্ত্রের মতো মোবাইলটা এগিয়ে দিলো বিভার দিকে। সে নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
বিভার হাত কাঁপছিল। কাঁপছিল গলা। সে ধারণা করতে পেরেছে ফোনটা কার। কোনো রকমে ‘হ্যালো’ বলল সে ফোনটা কানে নিয়ে।
‘আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই, এ কথাটা বললে একটা ভীষণ মিথ্যা বলা হবে। এ মুহূর্তে আপনার প্রতি আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কেন এমনিভাবে ছিনিমিনি খেললেন আপনি আমাকে নিয়ে আর আমার পরিবারকে নিয়ে? কেন এত বড় প্রতারণা করলেন?’
বিভা স্তম্ভিত, শঙ্কিত এবং পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক।
‘সে যাই হোক, শুনুন কাল সকালে আমি আপনার বাবাকে বলে দেবো যে বিয়েটা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সে বিষয়ে আমি মুখ খুলব না, যা বলার আপনিই বলবেন।
বিভাকে যেন বোবা ভূতে পেয়েছে। তার জিব নড়ছে না এক বিন্দুও। কথারা সব হরণ হয়ে গিয়েছে। বুকটায় বড্ড তোলপাড়।
‘আর জেনে রাখুন আমি আপনাকে কোনো দিন ক্ষমা করব না।’
ফোনের লাইন কেটে গেল। হৃদি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বিভার পিঠ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?’
‘অভিজিৎকে কে যেন বলে দিয়েছে আমার আর সামির কথা। সে বলেছে আমাকে বিয়ে করবে না।’ অদ্ভুত ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল বিভা।
কথাটা শুনল সবাই কিন্তু কেউ টু শব্দটি করল না। নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত নেই।
তারপর হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আকস্মিক এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, উচ্ছ্বাস ভরা গলায় রুদ্র বলে উঠল, ‘ইয়েস! ইয়েস! এর চেয়ে ভালো খবর আর হতেই পারে না!’
কথাটা যেন টনিকের মতো কাজ করল সবার ভেতরে। অজান্তেই বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে গেল সবার। আকাশ খুশিতে মাখামাখি গলায় বলল, ‘যাক, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ বিপদ কাটায় দিছে। বিভাকে এখন আর আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না।
বিভা তখনো একটা কেমন ঘোরের ভেতর ছিল। এই ধরাধামে তার দেহ আছে, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও।
সামি কিছুটা সন্দিহান হয়ে বলল, ‘কিন্তু অভিজিৎকে বিষয়টা জানাল কে? এটাইতো আমার মাথায় ঢুকছে না।’
রুদ্র বলল, ‘আরে দূর, কে জানিয়েছে কে জানায়নি এসব নিয়ে পরে চিন্তা করলেও হবে। এখনতো মামা পার্টি হবে! পার্টি!’
অমৃতাও সায় দিলো রুদ্রর কথায়, ‘একজেক্টলি, ওই ব্যাটা কেমনে জেনেছে সেই ইনভেস্টিগেশন আমরা পরে করব, এখন আনন্দ করার সময়, বিভাবরী ইজ ব্যাক!’
এরপর বিভা আর সামিকে টেনেটুনে ঘরের ভেতর নিয়ে আসলো ওরা।
কিছুক্ষণ বাদে, বন্ধুদের হইহই রইরই এর উত্তাপে বিভারও বুকটা একটু একটু হালকা লাগতে শুরু করল। মনে হলো যেন বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে। যদিও কিছুই স্পষ্টভাবে ভাবতে পারছে না সে আপাতত। অভিজিৎ যা বলল তা যদি সে ঠিকঠাক করে ফেলে তাহলে তাদের পরিবারের ওপর দিয়ে মোটামুটি একটা ঝড় বয়ে যাবে তা জানা কথা। তার বাবা হার্টের রোগী। বাবাকে নিয়েই যত ভয় তার। ধাক্কাটা বাবা সইতে পারবে তো? কিন্তু বিভা যদি আজ কাউকে কিছু না বলে সামির সাথে পালিয়ে যেত, আর কোনো দিন বাড়ি না ফিরত তাহলে তো বাবা মরেই যেত।
ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। বিভা অনেক্ষণ পর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
সামি চুপচাপ ছিল। চোরা চোখে বারবার দেখছিল বিভাকে। হুট করে কী যে হয়ে গেল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মনে মনে ঠিক এই জিনিসটাই সে ভীষণভাবে চাইছিল বিগত কয়েকটা দিন ধরে। কিন্তু আজ যখন বিজলি বাতির মতো নিমেষে পূরণ হয়ে গেল ইচ্ছেটি তখন ঠিক সামলে উঠতে পারল না সে। কেমন এলোমেলো আর নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল মনের ভেতরটা।
মাঝ রাতে ওরা সব সামিদের বাড়ির নিচতলার হলরুমে এসে জড়ো হলো। এ হলরুমটিতে বছর চারেক আগে একবার সামির জন্মদিন করা হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে। তারপর থেকে বলা যায় ঘরটা প্রায় ইউজলেসভাবে পড়ে আছে। রোজ ঝাড়ামোছা করা হয় বলে অবশ্য পরিত্যক্ত ভাবটা প্রকাশ্য নয়। লাল কার্পেট দিয়ে মোড়ানো মেঝে। কোনো আসবাব নেই। ঘরের এক কোণায় প্রায় তিন চার ফুট উচ্চতার দুটি পাতা বাহার সাজানো। সাদার ওপর নীল কাজ করা পোর্সেলিনের দামি টবে। পাতা বাহারের গায়ে স্ট্রিং লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা। বাতিগুলো জ্বালালে বেশ আলো আঁধারি তৈরি হয় ঘরের মাঝে। মনে হয় যেন এ ঘরটা পৃথিবীর অংশ নয়। মায়াবী অপার্থিব কোনো জায়গা বলে ভ্রম হয় হঠাৎ হঠাৎ।
রুদ্র প্রথমেই ধুমধারাক্কা গান বাজিয়ে দিলো। বিভার মিউজিক টিউজিক বিরক্ত লাগছিল, সে কপাল কুঁচকে বলল, ‘এসব বন্ধ কর তো, ভালো লাগতেছে না!’
রুদ্র বেঁকে বসল, ‘বন্ধ করব কেন? এখন পার্টি হবে পার্টি।’ বলে সে আর দেরি করল না। হাত পা ছুড়ে উজবুকের মতো নাচতে শুরু করল।
কার্পেটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসেছিল সামি, তার হাতে কোকের ক্যান। ক্যানে চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখ মুছে পানসে গলায় সে আকাশকে প্রশ্ন করল, ‘যা হলো, তা কি ঠিক হলো?’
আকাশ দৃঢ় গলায় বলল, ‘অবশ্যই ঠিক হলো, জোরজবরদস্তি বিয়ে দিয়ে একটা মেয়েকে দেশছাড়া করা হলো না, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?’
‘আর ইউ শিওর?’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর!’ এটুকু বলে সামির কাঁধে একটা হাত রাখল আকাশ, মৃদুভাবে বলল, ‘জাস্ট চিল! এভরিথিং ইজ মোর দ্যান পারফেক্ট!’
হৃদিতার হাতে চিপসের কৌটা ধরা ছিল। সে চিপস চিবোতে চিবোতে রুদ্রর পাশে গিয়ে হালকা চালে নাচ আরম্ভ করল। বাজছে একটা স্প্যানিশ গান, ‘লোকা লোকা লোকা।’
মিনিট দুয়েক বাদে ড্যান্সফ্লোরে সবাই চলে গেল শুধু সামি আর বিভা ছাড়া। সামি বসে রইল হাত পা ছড়িয়ে, আর বিভা হাঁটুতে মুখ গুঁজে।
বাকি চারজন মনোযোগ দিয়ে নাচছে। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, শুধুই নেচে যাচ্ছে।
ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামি বিভাকে প্রশ্ন করল, ‘লোকা মানে কি জানিস?’ গানের শব্দের জন্য একটু জোরে কথা বলতে হলো ওকে।
‘হ্যাঁ জানি, স্প্যানিশ শব্দ ওটা, অর্থ পাগল।
‘আসলেই একেকটা আস্ত পাগল এগুলো, লোকা পারফেক্টা!’ স্বগতোক্তির মতো বলল সামি। ওর বলার ভঙ্গিতে বিভা হেসে ফেলল। সে হাসি দুজনের মধ্যকার গুমোট বাতাসটা একটু বুঝি হালকা করল।
সামি তাকাল বিভার দিকে। স্ট্রিং লাইটের আবছা হলদে আলোয় সে দেখতে পেল বিভার মুখে এক টুকরো দুর্বোধ্য হাসি।
তখন সিডি প্লেয়ারে গানের ট্র্যাক পাল্টে গেছে। লোকা লোকা শেষ হয়ে আমেরিকান মাউথ ফ্লাইটলেস বার্ড চালু হয়েছে। নাচনে ওয়ালারা লাফঝাঁপের পর কার্পেটের ওপর বসে পড়েছে বিশ্রাম নিতে। রুদ্রর অবশ্য বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। সে দুলে দুলে তাল দিচ্ছে অনবরত।
বিভার মুখের হাসিটা তখনও অম্লান। তিন চার হাত দূরে বসে ছিল বিভা। সামি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে আলতো গলায় বলল, ‘নাচবি আমার সাথে?’
বিভা নড়েচড়ে বসল একটু। তারপর হাত বাড়িয়ে ধরল সামির হাত। হাত ধরে দুজন যখন ড্যান্স ফ্লোরে ওঠে আসলো রুদ্র তখন অভ্যাসবশত একটা সিটি বাজিয়ে ফেলল। বাকিরা পুরো দৃশ্যটা দেখেও না দেখার ভান করল।
Have I found you?
Flightless bird, jealous, weeping
Or lost you?
American mouth
Big pill looming
সামি বিভার হাত ধরে ঘুরিয়ে দিলো। লং স্কার্টে চমৎকার ঘূর্ণি তৈরি হলো। ওরা নাচতে নাচতে একটু দূরে চলে এসেছে অন্যদের থেকে। নাচের দমকে বিভার খোঁপা বাঁধা চুল খুলে ছড়িয়ে পড়েছে পিঠময়। স্ট্রিং লাইটের আবছা আলোয় তার রূপ তখন অপার্থিব। সামি ফিসফিস করে বিভার চোখে চোখে চেয়ে বলল, ‘তোকে কখনো বলেছি কি বিভা? তুই যে দেখতে অসম্ভব সুন্দর?’
গানের শব্দ মুখের কথা কেঁড়ে নিচ্ছে। বিভা নাচের তাল ঠিক রেখেই মুখটা সামির কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো, ‘না!’
সামি হাসে, সুরের তালে পা নাড়ায়, বলে, ‘তুই খুব সুন্দর, বিভাবরী!’ বিভার চোখে চাপা উল্লাস খেলা করে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে উত্তর দেয়, ‘তুইও…’
সামি হা হা করে হেসে ওঠে, ‘আমি? আমি সুন্দর?
‘হ্যাঁ, ইউ আর দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম ম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড, আই হ্যাভ এভার মেট!’
‘আসলেই?’
‘আসলেই!’
সামি বিভার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভালোবাসার চোখে অতি কুৎসিত ব্যক্তিও সুন্দর হয়ে ওঠে।’
‘মোটেই না, তুই আমার দেখা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুরুষ। শুধু ভালোবাসা নয়, ঘেন্নার চোখেও তোকে আমার কাছে সবসময় সুন্দর লাগবে।’
সম্মোহনের দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল সামি বিভার দিকে, আলো আঁধারির সে মায়াবী ক্ষণে। তারপর ধীরে ধীরে নত হলো। এক গভীর চুম্বনে তার ঠোঁট লগ্ন হলো বিভার ঠোঁটে।
৩৩
বিভা বাড়ি ফিরল সকাল আটটায়। সারা রাত এক ফোটা ঘুম হয়নি। চোখের কোল জুড়ে কালো দাগ। মুখের ত্বক রুক্ষ। রাতটা এক কথায় স্বর্গের মতো সুন্দর ছিল। কিন্তু কথায় আছে না? সুখের পরেই আসে দুঃখ আবার দুঃখের পরেই সুখ। বিভার এখন সুখ পার হয়ে দুঃখের পালা। দুঃখটাকে এক ঢোঁকে গিলে ফেলতে হবে। মনে মনে এখন সে প্রস্তুতিই নিচ্ছে সে। বিয়েতে না করার পর বাবা মা একটু চিল্লা ফাল্লা করবে, আত্মীয়স্বজনরা নানা কথা বলবে। কিন্তু কয়েকটা দিন কাটার পর সময় ঘটনার ওপর চমৎকার প্রলেপ এঁকে দেবে। এখন শুধু একটু ধৈর্য ধরে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপাতত।
দুরুদুরু বুক নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকল সে। বসার ঘরের ফ্লোরিং এখনো তোলা হয়নি। বাতি জ্বলেনি। পর্দা টানানো জানালায়। অল্পবয়সি কাজিনগুলা ভস ভস করে ঘুমাচ্ছে এখনো। বাইরে যে একটা কর্মব্যস্ত নিয়মমাফিক দিন শুরু হয়ে গেছে এ ফ্ল্যাটে ঢুকে তা বোঝার উপায় নেই। আধো আলোর ঘুম ঘুম আলসে ভোর ঘাপটি মেরে বসে আছে এখনো এখানে। ডাইনিংয়ে মায়ের মুখোমুখি পড়ে গেল বিভা। তাকাতেই মনে হলো মায়ের মুখখানা অত্যধিক শুকনো। বুকটা ধক করে উঠল।
মা বিভাকে দেখেই সচকিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘হৃদি কেমন আছে?’
কাল রাতে মাকে বলা মিথ্যে কথাটা মনে পড়ার সাথে সাথে একটা তেতো অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল ভেতরটায়। ইস একটা মিথ্যেকে ঢাকতে এখন কত্তগুলো মিথ্যে বলতে হচ্ছে। বিভা শুকনো গলায় বলল, ‘ভালো আছে মা, এখন ভালো আছে।’ এরপর মা এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে গোপন গলায় বলল, ‘শোন একটা কথা আছে, আমার পাশে এসে বয়।’
বিভা মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মা বড় অদ্ভুত চোখে তাকাল তার দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ মুখ নাক সব দেখতে লাগল। নিজের মেয়েকে যেন নিজে চেনে না। বিভা একটু সংকুচিত হলো। তার ঠোঁটে, গালে, কপালে তখনও সামির ঠোঁটের স্পর্শ লেগে আছে। মা কি কিছু টের পাচ্ছে? নইলে অমন কিম্ভূত চোখে তাকানো কেন? সে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ওমা, কী হল তোমার?’
মায়ের কণ্ঠে গোপন ভাবটা আবার ফিরে আসল, ‘শোন আজ খুব ভোরে অভিজিত ফোন করেছিল।’
বিভা টের পেল, হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। কম্পিত গলায় বলল, ‘কী বলেছে ফোন করে?’
‘বলল… বলল তার নাকি একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, আজ দুপুরেই কলকাতা ফিরতে হচ্ছে। আপাতত বিয়েটা হচ্ছে না।’
চাপা এক স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো বিভার বুক থেকে। যাক, ঝামেলা কাটল তাহলে!
‘খবরটা শোনার পর থেকে তোর বাবার শরীর খুব খারাপ করেছে। বুকে ব্যথা করছে। আমার তো খুব টেনশন হচ্ছে রে, যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়?’
মায়ের চোখে জল। কান্না চাপতে মুখে আঁচল দিলো মা।
‘কিছু হবে না বাবার। তুমি টেনশন করো না।’
‘আত্মীয়স্বজন সবাই জানে আজ তোর বিয়ে কোলকাতা থেকে গুষ্টিসুদ্ধ সব আত্মীয় চলে এসেছে বিয়ে খেতে, এখন এদের আমি মুখ দেখাব কী করে? এত বড় প্রতারণা করল এ ছোটলোকের পরিবারটা আমাদের সাথে?’ উত্তেজনায় মায়ের ঠোঁট কাঁপছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত।
বিভা ওঠে পড়ল। বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল বাবা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ। ডান হাতটা বুকের ওপর রাখা।
‘বাবা!’
বিভার ডাক শুনে বাবা ঘাড় বাঁকা করে তাকাল বিভার দিকে
বিভা এগিয়ে এসে বাবার হাত ধরে নরম গলায় বলল, ‘শরীর খারাপ লাগছে?’
বাবার হার্টে গত বছর রিং পরানো হয়েছে। দিনটা এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে, মনে থাকবে সারাটা জীবন। সেদিন খুব ভোরে হঠাৎ বাবার ঘর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসল। কানের ভেতর শব্দটা ঢোকা মাত্র ঘুম ছিটকে পালাল। ধড়ফড় করে ওঠে বসল বিভা। দৌড়ে গেল বাবার ঘরে। গিয়ে আবিষ্কার করল বাবা মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে বুকে হাত দিয়ে। মুখ যন্ত্রণায় কোঁকড়ানো। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে বিকট এক গগনবিদারী চিৎকার। মা তখন বাড়ি ছিল না। কুমিল্লায় নানাবাড়ি গিয়েছিল সপ্তাহখানেকের জন্য। একটা হিম হিম ভয়ের ঝাপটা এসে বিভার হাত পা জমিয়ে দিয়ে গেল। কী হচ্ছে এসব তার চোখের সামনে? যে লোকটার কখনো হালকা সর্দি জ্বরও হয় না, সে লোকটা হঠাৎ এই কাকডাকা ভোরে এমন ডাঙায় তোলা আধমরা মাছের মতো কাতরাচ্ছে কেন? তার বাবা কি মরে যাচ্ছে? থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সে মোবাইল হাতে নিয়ে অমৃতাকে ফোন করল প্রথমে। কেন জানে না জীবনে প্রথমবার সম্মুখীন হওয়া চরম বিপদের সময় ভগবানের পরপরই তার অমৃতার কথা মনে হয়েছিল। তারপর ফোন করল বড় কাকাবাবুকে। মিনিট পনেরোর মধ্যে কাকাবাবু চলে এলেন, আসলো অমৃতা। ধরাধরি করে বাবাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন হার্টে ব্লক পাওয়া গেছে। রিং পরাতে হবে। বেশ বড় অপারেশন। সে দিনগুলো নারকীয় ছিল। আজ বাবার এই কোঁকড়ানো চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বিভার এক বছর আগের সে ভয়ঙ্কর দিনটার কথা মনে পড়ল।
সে বাবার হাতটা ধরে আবারও প্রশ্ন করল, ‘ও বাবা, বল না, কেমন লাগছে তোমার? বুকে ব্যথা করছে?’
‘দরজাটা লক করে আয়, তোর সাথে কথা আছে, তোর মা যেন শুনতে না পায়।’
একটু অবাক হলো বিভা। কী এমন কথা যা মায়ের সামনে বলা যাবে না? দরজা ভেতর থেকে লক করে বিছানায় বাবার পাশে এসে বসল বিভা।
‘বলো’
কয়েকটা সেকেন্ড বাবা অসহায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল বিভার দিকে। তারপর ভারী গলায় বলল, ‘কাজটা কি তুই ঠিক করলি?’
‘মানে?’ মুখ দিয়ে অনায়াসে শব্দটা বেরিয়ে আসল।
‘ওই ছেলেটার বাবা ফোন করেছিল আমাকে।’
‘কোন ছেলে?’
বিস্ময়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল বিভা।
বাবা জিব দিয়ে শুকনো খড়খড়ে ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে একটা দম নিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
‘তোর বন্ধু।’
‘আমার বন্ধু? আমার বন্ধুর বাবা তোমাকে ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ উনি আমাকে সব বলেছেন। কাজটা কি তুই ঠিক করলি? এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেললি? কবে থেকে এত বেপরোয়া হয়ে গেলি তুই? ওই ছেলের জন্য তুই অভিজিৎকে না করে দিলি?’
বিভা কিছু বলতে পারল না। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল শুধু বাবার দিকে। সামির আব্বা কী করে জানল এ ঘটনা? কে জানাল? অভিজিৎই বা রহস্যজনকভাবে তার আর সামির মধ্যকার সম্পর্কের কথা জানতে পারল কী করে? কার হাত আছে এসব ভূতুড়ে কাণ্ডের পেছনে?
‘অভিজিৎকে না করেছিস কেন? তোর ওই বন্ধুকে বিয়ে করবি বলে? হিন্দুর মেয়ে হয়ে তুই যবন বিয়ে করবি?’ বাবার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে।
বিভা বিস্মিত, স্তম্ভিত, কুণ্ঠিত!
ক্ষীণ গলায় বলল, ‘সামির আব্বা তোমাকে কী বলেছেন?’
‘বলেছেন তুই উনার ছেলের গলায় ঝুলে পড়ার প্ল্যান করেছিস, গলায় ঝোলার জন্য নিজের বিয়ে ভেস্তে দিয়েছিস।’
‘তাই বলল?’ অনেক কষ্টে ঠোঁট দুটো নাড়াল বিভা। মনে হচ্ছে যেন বুকের ভেতর প্রবল গতিতে একটা ট্রেন ছুটছে বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে।
‘তাইতো বলল। তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? জ্ঞান বুদ্ধি কিছু নেই তোর? কীসের ভরসায় অভিজিতের মতো একটা এ গ্রেডের ছেলেকে হাতছাড়া করছিস? ওই বাউণ্ডুলে, বাপের ঘাড়ে চড়ে বেড়ানো ফাজিল ছেলেটার জন্য?
উত্তেজনায় বাবার বুকে ব্যথা বাড়ছে। ঘাম হচ্ছে তার। বিভা তড়িঘড়ি করে এক গ্লাস জল নিয়ে আসলো বাবার কাছে। বাবা এক ঢোক জল খেল, তারপর বলল, শেষমেশ আমার এই দুঃখ নিয়ে মরতে হবে যে আমার মেয়ে মুসলমানের ঘরের বউ হয়েছে, তুই কি ধর্মান্তরিত হবার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিস নাকি?’
বিভার চারপাশটা ঘোলা জলের মতো ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা বলেই চলেছে, ‘ছোটবেলা থেকে কখনো কোনোকিছুতে না করিনি তোকে। কলেজে ওঠে একগাদা বন্ধুবান্ধব জোটালি। মেয়ে বন্ধুর সাথে পাল্লা দিয়ে তোর ছেলে বন্ধুও বাড়তে থাকল, একদিন তোর মা আপত্তি করে উঠল, তুই বললি, ওরা তোর শুধুই বন্ধু, একদম আপন দাদার মতো সম্পর্ক তাদের সাথে, আজকে কোথায় গেল সে দাদাগিরি শুনি? বিশ্বাস করেছিলাম তোকে। এ মূল্য দিলি আমাদের বিশ্বাসের তুই?’
বিভার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকল।
মা দরজা ধাক্কাচ্ছে।
বাবা বলল, ‘যাও দরজা খুলে দাও, আর দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।’
টলমল পায়ে বেরিয়ে আসলো বিভা ঘর থেকে। বড় কাকাবাবু এসেছেন। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে এখন। বিয়ে ভাঙার খবরটা মা কাউকে দেয়নি এখনও। আপাতত বাবার অসুস্থতা নিয়েই সবাই চিন্তিত।
মা বিভাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুই কি অভিজিতের সাথে একটু কথা বলবি? হঠাৎ কী কারণে বিয়ে স্থগিত করল এ ব্যাপারটা জানা দরকার না? আমার তো ভয় হচ্ছে, টেনশনে যদি তোর বাবার কিছু হয়ে যায়?’
বিভার হঠাৎ মনে হলো, সত্যিই তো, তার বাবা যদি মরে যায়?
সে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রত্যয় নিয়ে বলল, ‘কিছু হবে না বাবার, তুমি বাবাকে গিয়ে বলো সব ঠিক আছে, অভিজিতের সাথে বিয়েটা আমার হচ্ছে, সঠিক সময়েই হচ্ছে ‘
মা হতবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু ওই ছেলে যে বলল…’ কথা শেষ করতে পারল না মা। বিভা বাধা দিয়ে বলল, ‘আহ, যাও তো যা করতে বললাম তাই করো, কথা বাড়িওনা।’
বিভা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। রিকশা নিয়ে ছুটল কলাবাগান, অভিজিতের বন্ধুর বাসায়।
অভিজিৎ বসে ছিল ডাইনিংয়ে। চায়ের কাপ হাতে। পাশে তার মা। আরো কিছু আত্মীয়স্বজন। কলকাতা থেকে এরা সবাই বিয়ে খেতে এসেছিল ঢাকায়। যেকোনো কারণেই হোক বিয়েটা এখন আর হচ্ছে না। এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও তার সামনে করা যাচ্ছে না। সে একবার জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করবে না, ব্যস করবে না। তাকে ঘাঁটানোর সাধ্য কারও নেই।
কী কারণে ছেলে বিয়েতে নাকচ করে দিলো তা হাজার চেষ্টা করেও জানতে পারলেন না অভিজিতের মা। মেয়েটিকে তার বড় ভালো লেগেছিল। বংশটিও বনেদি। ছেলের মতিভ্রমের কারণ জানার জন্য তিনি উদগ্রীব।
বিভা ঢুকল সাইক্লোনের মতো। তার চোখদুটো ফোলা। এলোমেলো হয়ে চুল পড়ে আছে পিঠময়। তাকে দেখাচ্ছে বিধ্বস্ত।
বিভার ঝটিকা আগমন সবার মাঝে একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করল। কেউ বিভাকে এমন বেশে এ মুহূর্তে আশা করেনি। অভিজিৎও না।
বিস্ময়ে স্থবির হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে বিভার দিকে। তারপর সন্দিহান হয়ে বলল, ‘তুমি এখানে?’
বিভার হাতদুটো আপনাপনি জোড় হয়ে বুকের কাছে ওঠে আসল। হাতজোড় করে অশ্রুরুদ্ধ গলায় সে বলল, ‘অভিজিৎদা প্লিজ! তুমি আমায় বিয়ে করো! প্লিজ!’
৩৪
ছুটির দিনগুলোর বিকেলে অমৃতা দৌড়োয়। একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় ধানমন্ডি লেকে। তারপর টানা পয়তাল্লিশ মিনিট ঘড়ি ধরে লেকের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত দৌড়োয়। গতির মাঝে এক অনাবিল মুক্তি খুঁজে পায় সে। দৌড়ের গতি বাড়ার সাথে সাথে গা দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। মনে হয় বুঝি এ ঘামের সাথে তার শরীর এবং মনের এ যাবৎ কালের সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে ঝরে যায়।
আজকেও একটা ছুটির দিন। জ্বলন্ত উনুনের মতো সারা দুপুর জ্বলেছে সূর্যটা। এখন এ বিকেলের কোলে এসে কিছুটা নিভু নিভু হয়েছে তার তেজ। একটুও বাতাস নেই। গাছের পাতাগুলো মূর্তির মতো স্থির।
অমৃতা দৌড়োচ্ছিল, ধানমন্ডি সাত নম্বর লেকের রাস্তা ধরে। তার গায়ে সাদা স্পোর্টস টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। পায়ে কালো কেডস। দু কানে গোঁজা হেডফোন। তাতে আর্টসেলের নতুন অ্যালবামের গান বাজছে। সে দৌড়াচ্ছে ঝড়ের বেগে। দৌড়োতে দৌড়োতেই খেয়াল হলো মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছে। পায়ের গতি একটুও না কমিয়ে পকেটে রাখা ফোনের এনসার বাটন প্রেস করল অমৃতা। ফোনের ওপাশ থেকে বিভা বলল, ‘হ্যালো অমৃতা, শুনতে পাচ্ছিস?’
দৌড়ের দমকে হেডফোনের ছিদ্র দিয়ে অমৃতার কানে শব্দগুলো একটু আবছা হয়ে প্রবেশ করল। হাঁপ ধরা গলায় অমৃতা বলল, ‘হ্যাঁ বল’
‘অমৃতা শোন, খুব জরুরি কথা আছে তোর সাথে।’
‘বলে ফ্যাল।’
‘তুই কোথায়? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
‘দৌড়াচ্ছি।’
‘থাম তুই, কথা আছে।’
‘আরে বল না, আমি শুনছিতো!’
‘অমৃতা প্লিজ! থাম তুই।’ প্রায় চিৎকার করে উঠল বিভা।
অমৃতার গতি শ্লথ হলো। তারপর ধীরে ধীরে থামল পা। উবু হয়ে দু হাত দিয়ে দু হাঁটু চেপে ধরে জোরে জোরে মুখ হা করে নিশ্বাস ফেলল সে বার কয়েক। তারপর সটান দাঁড়িয়ে বলল, ‘থেমেছি, এখন বল, কী এমন দুনিয়া উল্টানো ঘটনা ঘটল শুনি?’
‘অমৃতা, আমি অভিজিৎকে বিয়ে করছি, যেমনটা কথা ছিল।’
অমৃতা আঁতকে উঠল।
‘কী বলছিস?’
‘সত্যি বলছি।’
অমৃতা কয়েক মুহূর্ত স্থবির হয়ে রইল। তারপর জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটদুটো একবার ভিজিয়ে নিয়ে ধারালো গলায় বলল, ‘ইম্পসিবল! ইউ ক্যান্ট ডু দিস টু সামি। ও এটা নিতে পারবে না। এত কিছুর পরে তুই হুট করে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না বিভা।’
‘নিতে হচ্ছে।’
‘নিতে হলে আগে নিসনি কেন? গতকাল রাতে এত কাহিনি করার কী দরকার ছিল? কেন তুই সামির সামনে বিয়ে নাকচ করার অভিনয় করেছিলি?’
‘উফ অমৃতা তুই আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো কিছু না শুনেই আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছিস।’
‘কী হয়েছে খুলে বল’
‘সামির আব্বা কী করে যেন পুরো ঘটনা জেনে গেছেন। উনি ফোন দিয়েছিলেন আমার বাবাকে। বাবাকে বলেছেন যে আমি সামির জন্য আমার বিয়ে বাতিল করেছি। তুই বুঝতে পেরেছিস ঝড়টা কোন দিক থেকে এসেছে? তোরা যে প্ল্যানটা করেছিলি সেটা সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে। বাবা জেনে গেছেন যে অভিজিৎ নয় আমিই বিয়ে ভেঙেছি, তাও আবার একটা মুসলমান ছেলের জন্য। যার সাথে আমার বিয়ে হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
‘সামির আব্বা কী করে জানল?’
‘ওই লোকটা একটা ঘাঘু পাবলিক, আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না ওই ব্যাটাকে। ওই ব্যাটা ফোন দিয়ে আমার বাবাকে কী না কী বলেছে ভগবান জানে, এরপর থেকে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে।’ শেষটায় বিভার গলা রুদ্ধ হয়ে আসলো। অমৃতা টের পেল বিভা কাঁদছে।
‘আহ কাঁদিস না। তুই কোথায়?’
‘বাসায়।’
‘থাক তাহলে, আমি আসছি।’
‘না, অমৃতা না!’
বিভার মুখের ‘না’ শব্দটা আচমকা বহু দূর থেকে উড়ে আসা গতিময় এক ধারালো তীরের মতো বিঁধলো অমৃতার বুকে।
সে মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করল, ‘না মানে? কী বলতেছিস তুই?’
‘বাবা বলেছে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার কোনো বন্ধু আমার বাড়িতে আসতে পারবে না। অমৃতা, দোস্ত, বাবা মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন, অবস্থা বেশি ভালো না। এমন অবস্থায় আমি বাবার মুখের ওপর কিছু বলতে পারতেছি না, তুই বুঝতেছিস?’
অমৃতা নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। বিভা এই কথাগুলো বলতে পারল? বিভার বিয়ে হয়ে যাবে আর অমৃতারা কেউ তার বাসায় পর্যন্ত যেতে পারবে না? বিভাকে বউ সাজা অবস্থায় এক নজর দেখতে পাবে না? এটাও কি সম্ভব?
অমৃতা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, ‘ফাজলামো রাখ, আমি আসতেছি।’
‘দোস্ত প্লিজ! আমি চাই না আমার জন্য বাবার কোনো ক্ষতি হোক, আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না কোনোদিন।’
‘আর ইউ ফাকিং কিডিং মি?’ অস্ফুটে বলল অমৃতা।
‘আমি খুব সরি, দোস্ত আই এম সো সরি।’
বিভা এখন ডুকরে কাঁদছে। টের পাচ্ছে অমৃতা। হেডফোনের ছিদ্র ছিঁড়েফুঁড়ে ওর কান্নার বিলাপ কানের ভেতর প্রবেশ করে হৃদয় তোলপাড় করে দিচ্ছে।
দিশেহারা অমৃতা অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘তোর বিয়ে হবে আর আমরা তোর পাশে থাকব না? এটা কোন ধরনের ফাইজলামি?’
‘সামিকে দেখিস।’ বিভা বলল, কান্নার ঢোঁক গিলে।
অমৃতা কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। বিপবিপ শব্দে কানেকশন ছিন্ন হওয়ার পর অমৃতা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘বিভা হোল্ড অন! কথা শোন আমার!’
বিভা শুনল না। সাথে সাথেই আবার ডায়াল করল অমৃতা বিভার নম্বরে। অনেকক্ষণ রিং বাজার পর মেশিন কণ্ঠ বলে উঠল, ‘আপনি যে নম্বরে কল করেছেন তা এ মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
হতভম্ব অমৃতা মিনিট দুয়েক সময় শূন্য মাথা আর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ভর দুপুরের লেকের পারে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তার ভেতরটা কাঁপছে এক অজানা শঙ্কায়। বিভা তাহলে চলেই যাচ্ছে? এই দেশ ছেড়ে? তাদেরকে ছেড়ে?
অস্থির অমৃতা আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিল না। ভেঙে পড়া তার ধাতে নেই। তার ভেতরটা লোহার মতো শক্তপোক্ত। প্রবল ঝড়ের মাঝেও কী করে শক্ত হাতে খুঁটি ধরে রেখে সারভাইভ করতে হয় অমৃতার তা ভালো মতো জানা আছে। কোনো প্রকার দুর্বলতাকে সে প্রশ্রয় দেয় না।
কিন্তু আজ নিজের বুক থেকে ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সামিকে কী করে জানাবে সে এ খবরটা? গাধাটা যে বিভাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল! সইতে পারবে কি এ আঘাত?
অমৃতা হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতেই অন্য বন্ধুদের ফোন করল। সবাইকে বলল সামির বাসায় মিট করতে, এখনই।
.
বিভা মোবাইল সুইচড অফ করে দিয়ে হাঁটুতে মুখ রেখে কান্না চাপার বৃথা চেষ্টা করতে করতে ফোঁপাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে থেকে বাবা ডাকল, ‘বিভা মা, দরজা খোল।’
বিভা দৌড়ে ছুটে গেল বাথরুমে। বেসিনের কল ছেড়ে চোখ মুখে পানি ছিটাল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিল ভালো করে যেন কান্নার ছিটে ফোঁটা দাগও মুখে লেগে না থাকে।
দরজা খুলে দিতেই বাবা ঘরের ভেতর ঢুকল।
‘তোর মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?’
বিভা জোর করে মুখে একটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলল, ‘খাইনি তো
কিছু সকাল থেকে, আজ উপবাস যে!’
‘ও, তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলাম। শরীরটা কি খারাপ লাগছে মা?’
‘না হালকা একটু মাথাটা ঘুরাচ্ছে, ও ঠিক হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা করো না।’
‘তুই যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিস মা, এটা তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত, তুই খুব সুখী হবি।’
এ কথা শুনে বিভার চোখদুটো মুহূর্তে কেমন একটু ভাসা ভাসা হয়ে উঠল। ‘তাই যেন হয় বাবা, তাই যেন হয়!
‘আর মনে রাখিস, আমরা বাবা-মা যা করলাম তোর ভালোর জন্য করলাম।’
‘মনে রাখব বাবা, নিশ্চয়ই মনে রাখব।’
বাবা এগিয়ে এসে বিভার মাথায় হাত রাখল। বিভা হাতটা ধরে বলল, ‘তোমার বুক ব্যথা কমেছে বাবা?’
‘কিছুটা কম।’ বলে বাবা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, ‘আজকাল টেনশন একদম নিতে পারি না রে মা! হৃদপিণ্ডটা বেশি দিন টিকবে না, যে কোনো দিন কলাপ্স করে যাবে।’ কথাগুলো বলার সময় বাবার মুখখানা শিশুর মতো অসহায় দেখাল। ছ্যাঁৎ করে উঠল বিভার বুকটা।
‘অশুভ কথা বলো না বাবা, এসব বলতে নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তুই একটু চান করে নে, সারারাত ঘুমাসনি, চেহারাটা দেখতে খুব খারাপ লাগছে।
বিভা একটু ম্লান হাসল, ‘সমস্যা নেই, পার্লারের ভারি মেকআপ সব মলিনতা ঢেকে দেবে।
বাবার হাতটা আবার ধরল বিভা। বাবার হাতের চামড়া কেমন খসখসে হয়ে গেছে। ক্ষয়াটে চামড়ার ওপর দিয়ে ভেসে আছে নীল নীল রগ। দেখলেই কেমন রুগ্ন রুগ্ন লাগে। বিভা বাবার রুগ্ন হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝিম ধরা গলায় বলল, ‘বাবা, আমার বন্ধুরা আমার বিয়েতে আসতে চায়। বিয়েবাড়িতে ওদের উপস্থিতি নিষেধ জানতে পেরে খুব মন খারাপ করেছে ওরা।’
‘বিভা শোন, সারাটা জীবন তুই বন্ধু বন্ধু করে পাগলামো করেছিস। তোর বন্ধুদের ওপর কোনোদিন আমরা কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিনি। প্রতিদানে কী পেলাম? তোর সবকটা বন্ধু আমাদের ঠকাল। ওরা কেউ তোর ভালো চায় না।
‘বাবা প্লিজ!’
‘বিয়ে চলাকালীন সময়ে আমি কোনো ঝামেলা চাই না, ওই বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলেটা যদি মণ্ডপে এসে কোনো রকম অনর্থ করে? তাহলে আমাদের মান-সম্মানের কেমন বারোটা বাজবে তা আঁচ করতে পারছিস? আজ রাতে বিয়েটা হয়ে যাক। কাল সকালে ওদের আসতে বল।’
বাবা আর দাঁড়াল না।
বিকেলের মধ্যে বিভার পার্লারে চলে যাওয়ার কথা সাজগোজ করার জন্যে। মাসতুতো পিসতুতো বোনরা মিলে বিউটি পার্লারে যাবার দলটা বেশ বড়। প্রায় বারো তেরো জনের মতো হবে। সবাই মিলেঝুলে হই হুল্লোড় করে বাসা থেকে বের হতে যাবে ঠিক সে মুহূর্তেই বাবা ঘোষণা করল পার্লারে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, মায়ের একজন বাঁধা বিউটিশিয়ান আছে বাড়ি এসে এটা সেটা করে দেয় প্রায়ই, সে মেয়েটিকেই ডাকা হবে বউ সাজানোর জন্য।
বিভা স্তব্ধ হয়ে গিয়ে শুনল কথাটা, হজম করল। কিচ্ছুটি বলল না। এমনিতেও বউ সাজা নিয়ে তার মনের মাঝে এ মুহূর্তে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। জবরজং শাড়ি পরে, ভারী গয়না গলায় ঝুলিয়ে সং সাজতে হবে এটা ভাবতেই কেমন বিরক্ত লাগছে। পার্লারে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বাতিল হলো বলে তাই মনে মনে একটু বাঁচলোই বিভা। কিন্তু অবাক লাগছে বাবার মানসিক অবস্থা টের পেয়ে। এত ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে কি? এখনও কি বাবার মনে কোনো সংশয় আছে এ বিয়ে নিয়ে? তিনি কি ভেবেছেন যে বিভা পার্লারে যাবার নাম করে সামির সাথে পালিয়ে যাবে? আর ফিরবে না? কিংবা সামি বাড়ির সামনে ওত পেতে বসে আছে? বিভা বাড়ি থেকে বেরোলেই কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে? কথাগুলো মনে হতে আপন মনে হাসল বিভা। সত্যি যদি এমন কিছু করতে পারত সে! যদি পালিয়ে যেতে পারত সামির সাথে! যদি পারত বিভা!
ঠিক এ মুহূর্তে তার ইচ্ছে হচ্ছে দূর বহু দূর থেকে দৌড়ে গিয়ে সামির বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। লক্ষ্য চুম্বনে ভরিয়ে দিতে তার মুখ। আহা এ জন্মে তা আর হবে না। আজ হতে সামি পরপুরুষ। আর সে পরস্ত্রী। কী করে যে ছেলেটা বন্ধুত্বের খোলস ছাড়িয়ে হঠাৎ প্রেমিক হয়ে গেল। আবার প্রেমিক থেকে পরপুরুষ! রূপান্তরগুলো এত দ্রুত হলো যে বিভা ঠিক হিসাব মিলাতে পারছে না।
.
‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’ সৌদামিনী বলল। কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিভা খেয়ালই করেনি। সৌদামিনীর পিছে আরও কয়েকজন আছে।
‘কিছু হয়নি, মাথাটা খুব ধরেছে। একটু একা থাকতে দেবে আমাকে বৌদি?’
‘ওমা কেন দেবো না? এ কেমন কথা?’ বলে সৌদামিনী ঝটপট ঘরের কপাট দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার একটু বাদেই আবার মা আসলো। ভীষণ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তোর নাকি শরীর খারাপ লাগছে? কী হয়েছে?’
বিভার চোখ দুটো দেখে তখন মনে হচ্ছে চোখে আলতা পরেছে সে। গালদুটো ফোলা। চুল আউলা-ঝাউলা। মা কাছে আসতেই বিভা মাকে জড়িয়ে ধরল, কান্নার ঢোঁক গিলে বলল, ‘মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!’
‘কেন? কী হয়েছে? কী রকম লাগছে? বল না আমায়!’ মায়ের চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল।
বিভা কিছু বলল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।
বিভা কিছু না বললেও মায়ের মন বুঝি টের পেয়ে গেল। বরফ শীতল গলায় মা বলল, ‘তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস?’
এবার বাঁধভাঙা বন্যায় ভাসল বিভা, খুলে দিলো মনের আগল, ‘বাসি মা, অন্য একজনকে ভালোবাসি আমি, এত ভালোবাসি যে তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে মনে হচ্ছে আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।’
মা স্তম্ভিত হয়ে গেল। অস্ফুটে বলল, ‘কে সে?’
‘জানতে চেয়ো না মা, তুমি জানতে চেয়ো না।’