২০
রুদ্র সুইমিং পুলের জলে পা ডুবিয়ে বসে ছিল। ঘড়িতে সকাল দশটা বাজে। একটু বাদে সে তার নতুন টিউশনের বাসায় যাবে। এ লেভেলের ছাত্র। ফিজিক্স পড়াবে সে। মাসে আট হাজার বেতন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে টিউশনিটা জোগাড় করেছে। ফোনের মাধ্যমে কথা পাকাপাকি করেছে। উত্তরাতেই বাসা। যাতায়াতের কোনো সমস্যা হবে না। ঢাকায় আপাতত রুদ্রর থাকার জায়গা হয়েছে সামিদের বাসায়। টানা সাত বছর ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করার পর এখন আর চট্টগ্রামে মন বসছে না। না, ঢাকা শহরে সেটেল করার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি সে। তার ইচ্ছে আছে আটলান্টিকের ওপারে পাড়ি জমানোর। কয়েক জায়গায় এপ্লাইও করে ফেলেছে এর মাঝে। এডমিশন হওয়া, স্কলারশিপ জোগাড় করা, কিছু মিলিয়ে আরো বছরখানেক সময় লেগে যেতে পারে। এর বেশিও লাগতে পারে। এ কয়েকটা দিন ঢাকা চিটাগাং মিলিয়েই থাকবে সে। ঢাকায় কিছুদিন থাকলে বাবা-মা আর বোনটার জন্য মন পোড়ে আবার চিটাগাং গিয়ে থেকে গেলে বন্ধুদের জন্য মন পোড়ে। এই এক অদ্ভুত দোটানা নিয়ে চলছে তার জীবন।
সামিদের উত্তরার এ তিনতলা অট্টালিকাটি তার খুব প্রিয়। এ বাড়িতে আসলে মনে হয় যেন চেনা-জানা বাস্তব জগৎ ছেড়ে রূপকথার এক কল্পরাজ্যে চলে এসেছে।
ঢাকা শহরের ফুটপাতের ধুলোবালি আর মধ্যবিত্ত নাগরিক টানাপোড়েনের ছিটেফোঁটাও এ বাড়িতে এসে পড়ে না। বাগান থেকে শুরু করে সুইমিংপুল, জিম, বিশাল লাইব্রেরি, কী নেই এ বাড়িতে? এমনকি যখন-তখন ইচ্ছেমতো গান বাজনা করার মতো একটা সাউন্ড প্রুফ প্র্যাকটিস প্যাড পর্যন্ত আছে। যেটা কি না রুদ্রর সব চাইতে পছন্দের অংশ। তাছাড়া সামির আব্বা ইলেকশনে জেতার পর জন সাধারণের কাছেও বাড়িটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সকাল রাত কড়া সিকিউরিটি থাকে বাড়ির বাইরে। ভাবসাবই আলাদা।
সামি কাছেই একটা চেয়ারে বসে আছে ওর সদ্য কেনা মাইক্রোসফট সারফেস বুকে নিয়ে। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে সে। তার মুখে খেলা করছে হালকা একটা দুশ্চিন্তার ছায়া।
‘কী রে কিছু হয়েছে নাকি? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘ড্যুড, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে!’ সামি বলল চিন্তিত গলায়।
‘কী ঝামেলা?’
‘তোরে বলছিলাম মনে আছে? আব্বার জোরাজুরিতে আমি যে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে সিভি ড্রপ করছিলাম?’
‘ওই যে বারিধারায় ক্যাম্পাস?’
‘হুম, ওই ভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর তো আব্বার বন্ধু বুঝছস? তো আব্বা তো আংকেলরে আমার কথা বলে দিছে আগেই।’
‘হুম তো ভালো তো, তোর চাকরি কনফার্ম। এটা তো খুশির খবর। মুখ কালা করছস কেন?’
‘আরে, আকাশও ওই ভার্সিটিতে এপ্লাই করছে দোস্ত! পরশুদিন ওরেও কল করছে। এইমাত্র মেসেঞ্জারে বলল। কিন্তু আমি যতটুকু জানি ওরা শুধুমাত্র একজনই নিবে। একটাই ভেকেন্সি আছে।’
‘ও’
সামি রুদ্রর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘দোস্ত আকাশের চাকরিটা দরকার।’
‘হুম’
ছোট করে বলল রুদ্র, তার ক্যাটস আই চোখদুটোতে হালকা একটু অস্বস্তি নাচলো। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক কী বলতে হয় তার জানা নেই।
‘শিট! আব্বা তো আমার নাম আংকেলকে জানায় দিসে এখন কী করব?’
‘থাক সমস্যা নাই। তুই এটা নিয়ে আকাশকে কিছু বলিস না। ওর অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
সামি কিছুক্ষণ রুদ্রর চোখের দিকে অপলক চেয়ে থেকে বলল, ‘নারে চাকরিটা আমার চাইতে বেশি আকাশের প্রয়োজন। তুই তো জানিস ও বাসা থেকে কোনো হাতখরচ পায় না। বেচারার দিনকাল কাটছে অনেক টানাটানিতে।’
‘হুম তাতো জানি।’
সামি চট করে ওঠে দাঁড়াল। হাতে ধরে থাকা সারফেসটা রুদ্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি যাই আব্বাকে গিয়ে বলি আমার নামের জায়গায় আংকেলকে যেন আকাশের নামটা দিয়ে দেয়।’
‘দোস্ত যা করবি ভেবে-চিন্তে করিস।’
‘আরে চিন্তা ভাবনার কী আছে, এ চাকরি আকাশ না পাইলে দুনিয়ার আর কেউ পাবে না।’
সামি দ্রুত পায়ে জায়গাটা ছাড়ল।
রুদ্রও উঠল। সাড়ে দশটার ভেতর স্টুডেন্টের বাসায় হাজির হওয়ার কথা। প্রথম দিনটা অন্তত সঠিক সময়ে পৌঁছুতে চায় সে।
.
দ্বিতীয়বার কলিংবেল বাজাতেই দরজাটা খুলে গেল। পনেরো কী ষোলো বছর বয়সী যে ছেলেটা দরজা খুলল তাকে দেখেই রুদ্র বুঝল এটাই তার ছাত্র।
ছেলেটা হেসে বলল, ‘আপনি কি রুদ্র ভাইয়া?’
‘হ্যাঁ, আমিই রুদ্র।’
‘আসুন, আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
রুদ্র বসার ঘরের সোফায় বসল। ছেলেটা ভেতরে চলে গেল। ফিরে আসলো মিনিট খানেকের মাঝেই বইপত্র হাতে নিয়ে। ভালো লাগল রুদ্রর। মনে হচ্ছে এ ছেলের পড়ালেখায় আগ্রহ আছে। ফাঁকিবাজ ধরনের হাবাগোবা ছাত্র রুদ্রর একদম পছন্দ না।
বইপত্রগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতেই ঘরের ভেতর চায়ের কাপের ট্রে হাতে নিয়ে একটি মেয়ে প্রবেশ করল। মেয়েটির পরনে একটি সাদা সুতির শাড়ি। ছিপছিপে দেহ। চুলগুলো খোঁপায় আঁটা। মেয়েটা চায়ের কাপের ট্রে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখল।
মেয়েটার চোখদুটো কেমন যেন অদ্ভুত। কেমন যেন… একটু বেশি গভীর! সাগরের মতো গভীর! রুদ্র তার জীবনে এই প্রথম কোনো সাগর চোখা মেয়ে দেখল। মেয়েটি হাসল। তার সাগরের মতো গভীর চোখ দুটোতে সে হাসি একটা মিষ্টি রেখাপাত করল।
রুদ্র একটু টলল ভেতরে ভেতরে। তার কানের ডগা ঈষৎ লাল হলো। মুখখানা কাঁচুমাচু করে স্বগতোক্তি করল, হে আল্লাহ্! কী বিপদে ফেলাইলা! টিউশনে এসেই কেন সুন্দরীর সাক্ষাৎ? অন্য জায়গায় ঘটতে পারত না ঘটনাটা? এ তোমার কেমন বিচার?
‘সব ঠিক আছে তো?’ মেয়েটির প্রশ্নে ভাবনার ঘোর থেকে ফিরল রুদ্র।
অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছি।’
মেয়েটি স্বচ্ছ দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘আপনার নাম রুদ্র?’
‘জি’
‘আমি মনীষা’
রুদ্রর বুকে আবার টলটলানি ফিরে আসলো। মেয়ে দেখতে যেমন সুন্দর নামও তেমন সুন্দর। মনীষা!
রুদ্র হাসল। অপ্রস্তুত হাসি। ঢেউ খেলা অবাধ্য চুল কপালে এসে পড়েছিল। হাত দিয়ে সে চুল সরাল। তারপর কিছু বলার খুঁজে না পেয়ে ফিজিক্স বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
‘রাইয়ান, ভাইয়াকে ভেতরের রুমে নিয়ে যাও, এখানে কেন?’ মনীষা বলল রুদ্রর ছাত্রকে।
ছাত্রর নাম রাইয়ান। এ খবরটাও জানা ছিল না। ধ্যাৎ সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে, মনীষা রাইয়ানের কী হয়? বড় বোন হবে নিশ্চয়ই।
রুদ্রর কেমন তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। ট্রের ওপর রাখা ঢাকনা দেওয়া পানির গ্লাসের ওপর থেকে ঢাকনা খুলে ঢক ঢক করে পানি গিলতে লাগল সে।
রাইয়ান মনীষার কথা শুনে বলে উঠল, ‘নিচ্ছি আম্মু! ভাইয়া আগে চা’টা শেষ করুক।’
আম্মু?? রাইয়ানের মাত্র বলা কথাগুলো যেন রুদ্রর কানের কাছে আগ্নেয়গিরি ঘটাল। গিলতে থাকা পানি নাকে মুখে ওঠে গেল। কাশতে কাশতে পানি ছিটকে বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে।
রাইয়ান আর মনীষা দুজনেরই আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল রুদ্রর কাণ্ড দেখে।
ছি, কী লজ্জা! কী লজ্জা! সামনে বসা মানবীটি পনেরো কি ষোলো বছর বয়সি এক আস্ত দামড়া ছেলের মা। আর সে কী সব আবোল-তাবোল ভাবছিল।
রুদ্রর কাশি আর থামছিলই না। তার ঘোলাটে ক্যাটস আই চোখ হয়ে গেল লালচে। নাক দিয়ে গড়াতে লাগল পানি। মনীষা দৌড়ে গিয়ে টিস্যুর বাক্স নিয়ে আসলো। একসাথে দশ বারোটা টিস্যু পেপার মুঠোবন্দি করে এগিয়ে দিলো রুদ্রর দিকে। মিনিট চারেক বাদে, রুদ্র একটু থিতু হলে মনীষা বলল, ‘আজকে পারবেন পড়াতে? নাকি থাকবে?’
‘পারব, অবশ্যই পারব, এখন ঠিক আছি আমি।’
মনীষা একটু দ্বিধাগ্রস্থ গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, তার আগে একটু বলে নেই, আমার ছেলের কিন্তু মাথা ভালো। তবে প্রবলেম হচ্ছে পড়াশোনা একদম করতে চায় না। আর একটু মুডি। কয়েকদিন পড়ালেই ওর ধাঁচটা বুঝে যাবেন আপনি।’
রুদ্র মরা গলায় বলল, ‘নো প্রবলেম। আপনি চিন্তা করবেন না একদম। ‘শুনে ভালো লাগল।’ মনীষা হাসল।
রাইয়ানের ঘরে এসে বসল রুদ্র। ঘরটা মাঝারি সাইজের। বিছানাপত্র সব পাট করে সাজানো। দেয়ালে একটা সোনালি কারুকাজের পুরোনো স্টাইলের ফটোফ্রেম। ছবিতে ছোটবেলার পাঁচ ছয় বছর বয়সের রাইয়ান আর তার পাশে মনীষা। মনীষা এখনো একই রকম আছে। বয়স যেন একটুও বাড়েনি!
কে বলবে দেখে যে ওই মেয়ে এত বড় এক ছেলের মা?
বুকের ভিতর জোর করে একটা নির্লিপ্ত ভাব আনার চেষ্টা করছিল রুদ্র। কিন্তু হচ্ছিল না। কেমন যেন তেতো লাগছিল চারপাশটা।
২১
শার্টের একটা বোতাম টুপ করে ওঠে আসলো আঙুলে। মেজাজটা বিগড়ে গেল অমৃতার। আজ এমনিতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। বেলা এগারোটার মধ্যে চেম্বারে থাকার কথা তার। নতুন ক্লায়েন্ট আসবেন। স্যার থাকবেন কোর্ট রুমে তাই প্রাথমিক আলাপ আলোচনা অমৃতারই সারতে হবে। অথচ এখনই ঘড়িতে বেজে গেছে দশটা। মোহাম্মদপুর থেকে পুরান ঢাকা পৌঁছুতে কম করে হলেও ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লেগে যাবে। লম্বা জ্যামে পড়লে তো আর কথাই নেই। এই তাড়াহুড়ার সময়টাতেই কেন বোতাম বাবাজির এমন বিদ্রোহ ঘোষণা করা লাগল? তাজ্জব ব্যাপার-স্যাপার।
সাদা শার্ট অমৃতার আরো দুটা আছে। শুধু কোর্টে পরার উদ্দেশ্যেই যেগুলো বানানো হয়েছে। অতএব এ শার্ট বদলে অন্য শার্ট পরে নিলেই আপাতত ঝামেলা চুকে যাবে। অমৃতা তাই করল। কিন্তু এই বাড়তি কাজটা করতে হচ্ছে বলে তার কপালে একটা ভাঁজ পড়ে রইল।
আজকে দীপার জন্মদিন। সে উপলক্ষে দীপার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। দীপার ঘোর আপত্তি ছিল প্রথমটায় কিন্তু শেষমেশ তাকে একরকম জোরজবরদস্তি করেই রাজি করিয়েছে অমৃতা। আম্মি গতরাতেই সব রান্নাবান্না সেরে ফেলেছেন। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে আজ কলেজ থেকে ফিরবেনও একটু তাড়াতাড়ি। এত কিছুর পরেও দীপার মুখ ভার। সকাল থেকেই মুখটাকে হাঁড়ির মতো বানিয়ে ঘুরছে সে। এ মেয়ের সন্তুষ্টি অর্জন করা ভারি কঠিন ব্যাপার।
ভাবছিল অমৃতা। ঠিক সে সময় ঘরের দরজা হালকা ফাঁক করে উঁকি দিলো দীপা। বলল, ‘আপুনি, আকাশ ভাইয়া আসছে। দীপার মুখটা এখন একটু হাসি হাসি।
‘আকাশ ভাইয়া আসছে’ এ খবরটা দেওয়ার মাঝে এমন আনন্দ উপচে পড়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না অমৃতা। মনে মনে বিরক্ত হলো, বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল, ‘ছেমড়ি, তোর জন্মদিনের আয়োজন করতে করতে মইরা যাইতাছি তখন তোর আমোদ হয় না আর এখন আকাশ ভাইয়া আসার সংবাদে তুই আনন্দে ভাইসা যাইতাছোস!’
আকাশদের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় প্রায়ই হুটহাট চলে আসে এখানটায়। এটা কোনো নতুন ঘটনা না। কিন্তু আজকে দীপার কাছ থেকে আকাশের আগমনের খবরটা পাওয়ার পর মনে হলো ঘটনা শুধু এটুকুই না। আরো কিছু আছে। দীপার খুশি ঝলমলে চেহারার দিকে তাকিয়ে অমৃতা প্রশ্ন করল, ‘আর কিছু বলবি? আমি চেঞ্জ করতেছি তো এরকম হাবলার মতো তাকায় থাকলে তো সমস্যা।’
দীপা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা দিলো। তার হাতে একটা গোলাপের তোড়া ধরা। সে আপ্লুত গলায় বলল, ‘আকাশ ভাইয়া দিলো, জন্মদিনের উপহার!’
বলে হাসল দীপা। তার মুখে এ প্রাণখোলা হাসিটি অনেকক্ষণ অনুপস্থিত ছিল।
অমৃতা যেন একটু থতমত খেল। বাব্বাহ! আকাশের তো আজকাল দিন তারিখ খুব মনে থাকছে দেখা যাচ্ছে! গেল বছর এ আকাশই কি না অমৃতার জন্মদিন ভুলে বসে ছিল। কাহিনি কী? পরমুহূর্তেই নিজেকে কড়া ধমক লাগল অমৃতা। সব কিছুতে গর্ত খুঁড়ে সাপ বের করতে যাওয়ার একটা বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আজকাল তার। দীপাকে আকাশ নিজের ছোট বোনের মতোই তো দেখে! ছোটবোনের জন্মদিনের তারিখ মনে রাখাটাই স্বাভাবিক।
বসার ঘরে এসে দেখা গেল আকাশ আব্বুর সাথে কথা বলছে। অমৃতাকে দেখে বলল, ‘কী উকিল সাহেবা, চললেন?’
‘হুম চললাম তো, তুই এত সকাল সকাল?’
বাড়িতে ভালো লাগছিল না। ঝামেলা চলছে। আজ বিকেলে একটা ইন্টারভিউ আছে। কিছু পড়াশোনা করা দরকার, তাই ভাবলাম তোদের এখানে চলে আসি।’
‘বাড়িতে কী হলো আবার?’
‘কী আর হবে, ঘুম থেকে ওঠে দেখি আমার মাতাল বাবা তার বউকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে।’
অকপট বলে ফেলল আকাশ কথাগুলো। কোনো সংকোচ নেই, রাখঢাক নেই। শুনে আব্বু একটু অস্বস্তিতে ছটফট করে উঠল। বলল, ‘তোমরা গল্প করো, আমি আসছি।
অমৃতা বলল, ‘না আব্বু তুমি বসো। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এক্ষুনি বের হতে হবে। আকাশকে খাবার-দাবার কিছু দাও, তারপর সে পড়াশোনা করুক। গাধাটা নিশ্চয়ই কিছু না খেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।’
আকাশ মাথা নিচু করল। অর্থাৎ অমৃতার বলা কথাটা সত্য সে সকাল থেকে কিছুই খায়নি।
অমৃতা বেরিয়ে যাচ্ছিল। বেরোবার মুখে হঠাৎ চোখে পড়ল দৃশ্যটা। দীপা আকাশের একদম গা ঘেঁষে বসে আছে। হাতে মোবাইল নিয়ে কিছু একটা দেখাচ্ছে। আকাশের মুখটা দীপার হাতে ধরা মোবাইলের দিকে ঝুঁকে আছে। দীপার মুখে এখনো সে উপচে পড়া খুশি। মনটা একটু কেমন খচখচ করে উঠল। দীপার মুখের হাসিটার হালচাল ভালো ঠেকছে না। ছি, এত সংশয়? আবার নিজেকে নিজে ধমক দিলো অমৃতা।
২২
হ্যালো রুদ্র? শোন আমার একটা জিনিস খুব দরকার, বুঝছিস?’ হৃদিতার কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ।
‘কী হইছে?’ রুদ্রর প্ৰশ্ন
‘আমার একটা বয়ফ্রেন্ড দরকার, আজকেই!’
হৃদিতা আদেশ করার ভঙ্গিতে বলল। যেন বয়ফ্রেন্ড এমন একটা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা বাজারে গেলেই কিনতে পাওয়া যায়।
রুদ্র মাত্র বেরিয়েছে মনীষাদের বাসা থেকে। মনের ভেতর তিতকুটে ভাবটা এখনো রয়ে গেছে। একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে ফিরছিল সে। বাসা বলতে সামির বাসা। আপাতত ওটাই তার বাসস্থান। মাথার ওপরে ভর দুপুরের ঝলসানো সূর্য। ঠিকমতো চোখ মেলা যায় না সে সূর্যের তেজি আলোয়। চোখ দুটো ছোট করে কপাল কুঁচকে সে প্রায় ধমকে ওঠে বলল, ‘তুমি মামা মামদোবাজি করার আর জায়গা পাওনা না? আমি তো বয়ফ্রেন্ড সাপ্লায়ার। তুমি বললা আর সাথে সাথে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাজির হব তোমার সামনে। বাহ!’
‘আমার দরকার! আজকেই দরকার!’ হৃদি কিন্তু ভীষণ সিরিয়াস I
‘মারা খা তুই, বয়ফ্রেন্ডের গুষ্টি কিলাই!’ বলে রুদ্র ফোন কেটে দিলো।
মিনিটও কাটল না। আবার ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই একটা আসমান-জমিন বিদীর্ণকারী চিৎকারে কান ফেটে যাবার জোগাড় হলো। হৃদি চিৎকার করছে। মনে হয় কাঁদছেও। মৃদু মৃদু কাঁপছে তার গলা।
‘ওই শিম্পাঞ্জির বাচ্চা! তুই মারা খা, তোর গুষ্টি কিলাই আমি…’
‘দ্যাখ যা বলবি আমাকে বল, বাপ মা তুলে গালি দিবি না।’ রুদ্র গমগম করে উঠল।
‘একশবার দিব, হাজারবার দিব! তোদের মতো ফ্রেন্ড থাকার চাইতে না থাকা ভালো। দূরে গিয়া মর তুই।’ হৃদি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
‘এই তোর ইদানীং এমন বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নার অভ্যাস হয়েছে কেন? কান্নাকাটি করার মতো তো কিছু হয় নাই এখানে।’
‘আমার একটা বয়ফ্রেন্ড লাগবে আজকেই!’
‘আচ্ছা বাপ, আমার বাপ! কান্না থামা, আমি দেখতেছি কী করা যায়। তুই কোথায় এখন?’
‘টিএসসি। ক্লাস ছিল আমার।’
‘ওকে থাক ওইখানে, আমি আসতেছি। সময় লাগবে একটু উত্তরা থেকে আসতে। অপেক্ষা কর।’
টিএসসি গিয়ে দেখা গেল বিভাও এসেছে। ওরা এ দুপুরবেলার রোদ মাথায় নিয়ে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে। হৃদির চোখদুটো ফোলা। রুদ্রকে দেখে সে নতুন উদ্যোগে কান্নার তোড়জোড় শুরু করল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, *আমার বয়ফ্রেন্ড লাগবে, আজকেই।’
রুদ্র দিশেহারা হয়ে বিভাকে বলল, ‘আচ্ছা কাহিনি কী কতো! সারাদিন ময়না পাখির শেখানো বুলির মতো একটা কথাই কইতে আছে বয়ফ্রেন্ড লাগবে, বয়ফ্রেন্ড লাগবে, হইছেটা কী?’
বিভা বলল, ‘রবিনের বাচ্চা কী করছে জানোস না? এ কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করে ফেলছে। আজকে কার্জন হলের সামনে হৃদিতার কাছে ধরা পড়ে গেছে। আবার হৃদির সাথে নতুন গার্লফ্রেন্ডের পরিচয়ও করায় দিছে।’
‘ও, এই কথা!’
বিভা বলল, ‘আর এ ঘটনার পর থেকে হৃদি বয়ফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড করতে করতে মইরা যাইতাসে।
‘হুম বুঝলাম।’
‘এমনিতেও আমার মনে হয় ওর একটা রিবাউন্ড দরকার’ বিভা বলল।
রুদ্র মাথা চুলকে চিন্তিত গলায় বলল, ‘হুম রিবাউন্ড, কারে যে পাই!’
‘কিছু একটা কর’ বিভা বলল হৃদিতার পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে।
‘রিবাউন্ড হিসেবে তোর আমাকে কেমন মনে হয়?’ ফট করে বলে ফেলল রুদ্র কথাটা।
বিভা আর হৃদি দুজনে একত্রে চক্ষু চড়ক গাছ বানিয়ে তাকাল তার দিকে। হৃদির দৃষ্টি দেখে মনে হলো এক্ষুনি সে দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবে রুদ্রকে। রুদ্র কুঁকড়ে গিয়ে মিনমিন করে বলল, ‘না মানে আজকে আমিও একটা বাঁশ খাইলাম তো, তাই ভাবলাম আমারও একটা রিবাউন্ড টাইপ কিছু লাগবে।
‘তোর আবার কী হয়েছে?’
রুদ্র সংক্ষেপে খুলে বলল ওদের আজ সকালের ঘটনা। মনীষার সাক্ষাৎ এবং তারপর সত্য উদঘাটন।
শুনে বিভা হো হো করে হেসে উঠল। ফোলা চোখ আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হৃদিতাও হেসে ফেলল।
‘তোরা হাসতেছিস? তোরা কি ফ্রেন্ড নাকি শত্রু?’
বিভা অনেক কষ্টে হাসি সামলে বলল, ‘একনজরে প্রেমে পড়ে গেলি আবার এক মিনিটের মাথায় ছ্যাক খাইলি, তোরা পারিসও!’
‘এজন্যই ভাবতেছিলাম আরকি হৃদিতা যদি… আই মিন আর কেউ যেহেতু আপাতত নাই আমারে দিয়া কি কাজ চালানো যাবে কি না।’ বলে রুদ্র চোরা চোখে দেখল হৃদিকে।
হৃদি হড়বড় করে বলে উঠল ‘আরে না, তুই হইলি ফ্রেন্ড, ভাইয়ের মতো’
রুদ্র খ্যাক করে ওঠে বলল, ‘তোরা মেয়েরা সবসময় সবাইরে ভাই বানানোর জন্য মুখায় থাকিস কেন? প্রবলেমটা কী?’
‘তুই আমার জন্য বয়ফ্রেন্ড জোগাড় কর, এত কথা বলিস না।’
‘কেউ তোমার রিবাউন্ড হবার জন্য বসে নাই বুঝছ? সবাই সিরিয়াস রিলেশনশিপ চায়, সিরিয়াস! এক আমিই আছি!’
বিভা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘তুই তো এমনিই আছিস সবসময়, ফ্রেন্ড হিসেবেই আছিস, বয়ফ্রেন্ড হওয়া লাগবে কেন তাতো বুঝলাম না।’
‘কারণ এ মুহূর্তে ওর একটা বয়ফ্রেন্ড চাই। তাই আমি ফ্রেন্ড থেকে বয়ফ্রেন্ডে রূপান্তরিত হলাম এ ফ্রেন্ড ইন নিড, এ ফ্রেন্ড ইনডিড’ নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলল রুদ্র।
বিভা বিরক্ত হয়ে বলল ‘এই বস্তা পচা ডায়লগটা ছাড়িস না তো! শোন আমার বাসায় পরশু রাতে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে, তোরা চলে আসিস।’
‘কীসের অনুষ্ঠান, তোর বিয়া নাকি?’
‘ওই যে কলকাতা থেকে মেহমান এসেছে না? ওদের অনারে খাওয়া- দাওয়ার আয়োজন করা হবে। তার সাথে হবে গানবাজনা। অভিজিৎদা আমার নাচ দেখতে চেয়েছেন।’
‘এ অভিজিৎদার কাহিনি কীরে? হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘মা-বাবা মনে হয় ওর ঘাড়ে আমাকে গছাতে চাইছেন। ভাবেসাবে তাই মনে হচ্ছে। না, এমনিতে সে মানুষ ভালো। হি ইজ ফান এন্ড ডেফিনিটলি আ গুড কোম্পানি। কিন্তু ম্যারেজ মেটেরিয়াল না। মানে বিয়ে আমি ওকে করব না। বাবা মা বলে দেখুক না কিছু, মুখের ওপর না করে দেবো।’
‘সে বুঝে-শুনে চিন্তা-ভাবনা করে করিস যা করার।’ হৃদিতা বলল।
‘তোরা দুপুরে কিছু খাইছিস?’
বিভা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নারে কিছু খাইনি, চল কিছু খাওয়া যাক।
.
আকাশের ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়েছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে চাকরিটা হয়ে যাবে। তার প্রতি ইন্টারভিউ বোর্ড ছিল বিস্ময়কর রকমের সন্তুষ্ট। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ক্যান্ডিডেট ছিল মাত্র তিনজন। তিনজন তিন ডিপার্টমেন্টের। অতএব বিবিএ ডিপার্টমেন্টে সে ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীই নেই। ব্যাপারটা অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো হয়ে গেল। তবুও খুশি খুশি লাগছে তার। মনের এপার-ওপার জুড়ে অনেকদিন পর খুশির বান বইছে। সামিকে আশা করেছিল আজ সে ওখানটায়। সামি বলেছিল ওরও ইন্টারভিউর ডাক পড়েছে। কিন্তু তার দেখা তো পাওয়া গেল না। আকাশ সামির ফোনে ডায়াল করল। ফোন ধরল সামির আম্মা।
‘স্লামালিকুম আন্টি, কেমন আছেন?’
‘এইতো ভালো, তোমার কী খবর বাবা?’
‘ভালো আন্টি, সামি কোথায়?’
‘আমার বাচ্চাটাতো গোসলে গেছে বাবা, সারা দিন ঘুমিয়েছে, এই একটু আগে উঠল। এভাবে কতদিন চলবে বলতো? বলি যে একটা চাকরি-বাকরি কিছু কর, নইলে নিজের বাবার বিজনেসটা অন্তত দেখ। কিন্তু না সে ছেলে তো আমার কোনো কথাই শুনবে না।’
আকাশ কী বলবে খুঁজে পেল না। আমতা আমতা করে বলল, ‘জি আন্টি।’
‘দুদিন আগে ওর বাবা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে মোটামুটি ওর জন্য একটা চাকরি ঠিকই করে ফেলেছিল, ওই ভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছে ওর আব্বার বন্ধু। সে চাকরিটাও সে নাকচ করে দিলো। নিজের নাম বাদ দিয়ে তোমার নামটা দিলো ঢুকিয়ে।’
কথাটা ঝাঁ করে লাগল কানে। মোবাইলটা পাঁচ আঙুল দিয়ে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে সে নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘মানে? ওর নাম বাদ দিয়ে আমার নাম দিলো মানে?’
‘মানে সে তার বাবাকে গিয়ে বলল, তার নাকি চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নাই, চাকরিটা যেন তোমাকে দেয়। তা আমার কথা হলো বন্ধুদের জন্য মায়া দেখাবি খুব ভালো কথা কিন্তু নিজেরটাও তো চিন্তা করতে হবে নাকি?’
ফুরফুরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা মনটা যেন ধুপ করে কর্দমাক্ত কাদা জলে পিছলে পড়ে গেল। খালি হয়ে গেল বুক।
কী ভাবে সামি নিজেকে? সে দাতা হাতেম তাই আর আকাশ রাস্তার ফকির? এ কথা সত্য তার মতো কোটিপতির ছেলে আকাশ নয়। কিন্তু তাই বলে ভিখিরির মতো সামির আব্বার কাছে চাকরি ভিক্ষা চাওয়ার মতো দুরবস্থা তো তার হয়নি। সামির কোনো অধিকার নেই কোনো তৃতীয়পক্ষের কাছে আকাশকে এভাবে ছোট করার।
একটা অন্ধ, বোবা রাগ ঝাঁঝাঁ করে সারা শরীরে জ্বলুনি ধরিয়ে দিলো।
‘ঠিক আছে আন্টি, আমি রাখি’ বলে ফোন কেটে দিলো সে।
২৩
‘সাজনি সাজনি রাধিকা লো
দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া’
বিভা নাচছে। একটি সবুজ কাতান শাড়ি তার পরনে। খোঁপায় জড়ানো রজনীগন্ধা ফুল। তার প্রতিমার মতো টানা চোখে গাঢ় কালো কাজল। কপালে বড় টিপ। সরু কোমরে একটি সোনালি বিছা। সিডি প্লেয়ারে বাজছে ভানুসিংহের পদাবলি।
‘তৃষিত নয়ন ভানুসিংহ
কুঞ্জপথম চাহিয়া
মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া’
বিভাদের লম্বাটে লিভিং রুমটায় কমপক্ষে জনাবিশেক মানুষ। বেশিরভাগই আত্মীয়স্বজন। সোফা, চেয়ার এবং কার্পেট মিলিয়ে গাদাগাদি করে বসেছে সবাই। লিভিংরুমের সাথেই একটা লাগোয়া চৌকো বারান্দা। বারান্দার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিভার চার বন্ধু। অমৃতা, সামি, রুদ্র আর হৃদিতা। এ জায়গা থেকে বিভাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিভা চমৎকার বাতাস কেটে, হাওয়ায় উড়ে নাচছে। তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম রুপোর মতো ঝিলিক দিচ্ছে। দর্শকের সারিতে অভিজিৎকে দেখা যাচ্ছে। চশমার ফ্রেমের আড়ালে থাকা চোখদুটোয় তার মুগ্ধতা আঁকা।
.
সামি হঠাৎ বিরক্ত গলায় বলে উঠল, ‘আমি বুঝলাম না, এরকম জবরজং সাজ সেজে, ধেই ধেই করে একগাদা লোকের সামনে নাইচা বেড়ানোর অর্থটা কী?
অমৃতা সামির পেটে একটা গুঁতা দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আস্তে বল শুনবে কেউ! ‘
‘শুনলে আমার কী?’
‘বিভাদের ফ্যামিলি অনেক সংস্কৃতিমনা। এটাতো জানিসই, এত অবাক হওয়ার তো কিছু নেই, আর গতবছর দুর্গাপূজাতেও বিভা নেচেছিল। সেবার ওদের বাড়ির ছাদে হয়েছিল অনুষ্ঠান। মনে নেই?’ হৃদি বলল।
সামি হৃদির কথা পাত্তা না দিয়ে অভিজিতের দিকে ইশারা করে বলল, ‘দ্যাখ না, ওই বোকাচোদাটা ক্যামনে তাকায় আছে। মনে হচ্ছে মুগ্ধতার ঠ্যালায় এখনই ফিট হয়ে যাবে।’
অমৃতা ধমক দিয়ে বলল, ‘শুধু শুধু একটা ভালো মানুষকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করিস না তো! ছেলেটা তোর কী ক্ষতি করেছে?’
‘আহা যা ভালো! ভালোর অত্যাচারে মরে যাচ্ছি!’ সামি বলল চোখে মুখে একটা অদ্ভুত মুদ্রা ফুটিয়ে তুলে।
বিভার নাচ শেষ হয়েছে। হাততালি পড়ছে খুব। নাচ শেষ করেই সে প্রথমে ছুটে আসলো বন্ধুদের কাছে। সামি বিভাকে দেখামাত্র অন্যদিকে তাকিয়ে সুর করে গাওয়া শুরু করল, ‘আলিফ ল্যায়লা, আলিফ ল্যায়লা, আলিফ ল্যায় লা’
বিভা ফোঁস করে ওঠে বলল, ‘তোদের এসব লুলামি আর ভাল্লাগে না বুঝছস? নতুন কিছু কর। এসব ফালতু জোক করা বন্ধ কর। এসবের ভাত নাই আর।’
রুদ্র আঁকুপাঁকু হয়ে বলে উঠল, ‘দোস্ত প্লিজ লাগে মুখটা ধুইয়া আয়, আর এই অদ্ভুত সাজসজ্জা পাল্টায় আয়।
‘অদ্ভুত হবে কেন? তুই জানিস অভিজিৎদা আমাকে কী বলেছে? বলেছে এ সাজে আমাকে পুরাই উর্বশী লাগছে।’
শুনে সামি খিকখিক করে ডাকাতের মতো হাসল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আকাশ হাজির হলো ওখানটায়। আকাশের মুখে সবসময় লেগে থাকা এক চিলতে হাসিটা গায়েব। চোখ জোড়ায় ভর করেছে ভয়াবহ বিষণ্ণতা। সে এসেই সামির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এই সামি তোর সাথে আমার একটু কথা আছে, বাইরে আয় তো!’
বিভা কলকল করে বলে উঠল, ‘দোস্ত তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমার নাচটা মিস করলি তো!’
আকাশ বিভার কথা পাত্তা দিলো না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামির দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে।
সামি বলল, ‘কী এত জরুরি কথা, আইলি মাত্র, জিরা একটু, চা টা খা, তারপর নাহয় বাইরে যামু।’
‘এত কথা কস কেন? যা বলি তা করতে পারোস না?’
বোঝা গেল আকাশের মুড ভালো নেই। বন্ধুরা সব একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল।
সামি একনজর আকাশকে ভালো মতো দেখে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা চল, যাইতাছি, চ্যাতোস ক্যান?’
ওরা ছাদে ওঠে আসল। এগারোতলার ছাদে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশে জ্বলছে একটা দুটা নীল নক্ষত্র।
ছাদে এসে সামির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আকাশ কঠিনভাবে বলল, ‘তুই নিজেরে কী ভাবিস?
‘মানে?’ সামি অবাক। বাকি পাঁচজনও অবাক।
‘তোর কাছে কি আমি চাকরি ভিক্ষা চাইছিলাম?’
সামির মুখে একটা গাঢ় ছায়া পড়ল কথাটা শোনা মাত্র। বাবাকে খুব ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিল সে, আকাশ যেন কোনোভাবেই জানতে না পারে যে চাকরিটা সামির রেফারেন্সে পাওয়া। বাবা তার কাছে প্রমিজও করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে, ফ্যাকাল্টিকেও জানানো আছে যে সামির আব্বা বিষয়ক কোনো প্রসঙ্গ যেন ইন্টারভিউতে তোলা না হয়। এত কিছুর পরেও আকাশ কী করে টের পেয়ে গেল কথাটা?
সামি আমতা আমতা করে বলল, ‘কী বলছিস বুঝতে পারলাম না।’
‘ঢং করিস না, সবই বুঝতে পারছিস তুই। নিজের পাওয়া চাকরিটা আমার জন্য স্যাক্রিফাইস করে খুব মহান হইতে চাইছিলি না? এটার দ্বারা কী প্রমাণ করলি তুই? যে আমি একটা ছাপোষা চাকরিও তোর বাপের সাহায্য ছাড়া আন করতে পারব না?’ আকাশের গলার আওয়াজ বেড়ে গেল।
বলতে কী বন্ধুমহলে সামির আব্বা-আম্মার খুব একটা সুনাম নেই। দুজনেই প্রচণ্ড নাক উঁচু এবং অহংকারী। সামিদের ডেইরি মিল্কের ফার্ম আছে। দুটা আইক্রিম ফ্যাক্টরি আছে। যেগুলো কি না দেশের প্রথম সারির স্থান দখল করে বসে আছে। উপরন্তু সামির আব্বা বর্তমানে সংসদ সদস্য। অতএব দাপটের মাত্রা এখন আকাশচুম্বী। একমাত্র পুত্রের বন্ধুদের তিনি যে খুব একটা সুনজরে দেখেন না তা তাঁর আচার-আচরণে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
তাই সামি তার আব্বার কাছে আকাশের চাকরির সুপারিশ করেছে শুনে সবাই ভেতরে ভেতরে একটু ক্ষেপে গেল।
.
সামি চোখ দুটো মেঝেতে নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। নির্বাক, নিথর।
আকাশ বলে চলল, ‘তোর কোনো রাইট নাই আমাকে এভাবে ছোট করার। করব না আমি এই বালের চাকরি। বইলা দিস তোর বাপেরে। তার দয়া আকাশের লাগব না।’
‘দোস্ত আব্বার তো এখানে কোনো ভূমিকা নাই। আমিই করেছি যা করার।’
‘উদ্ধার করছ বস তুমি আমারে, উদ্ধার করছ।’
‘দ্যাখ আমার মনে হচ্ছিল চাকরিটা তোর দরকার। তাই…’
আকাশ শ্লেষের হাসি হাসল, ‘তাই তুমি আমার পারমিশন না নিয়েই আমারে ভিক্ষুক বানায় দিলা। লিসেন সামি, আজকে তোরে একটা কথা বলি শুনে রাখ, তোর আব্বা আমাকে কী মনে করে জানিস? তোর আব্বা আমাকে মনে করে আমি একটা রাস্তার ফকির। উনার ধারণা আমি একটা বস্তির ছেলে। তাই দয়া করে তুমি উনার কাছে আমার জন্য কোনো সুপারিশ করতে যেয়ো না। প্লিজ!’
সামির মুখটা হঠাৎ একটা অদ্ভুত বিষণ্নতায় ভরে গেল।
‘কী বলিস এগুলো, আব্বা তোরে বস্তির ছেলে ভাববে কেন? আজব!’
‘ভাইরে, ঠিক আছে আমি আজব, সব দোষ আমার। তোমার এ দয়ার চাকরি আমার লাগবে না। আমি না খেয়ে থাকতে রাজি আছি, কিন্তু কারো দয়ার পাত্র হয়ে বাঁচতে রাজি না।’
‘ড্যুড! এ জবটা হাতছাড়া করিস না। অনেক কাহিনি করতে হয়েছে তোকে চাকরিটা পাওয়ানোর জন্য।’
‘তামাশা করো তুমি আমার লগে?।’
এরপর সামিরও গলা চড়ে গেল। বাকি বন্ধুরা ওদের ঝগড়া থামাতে ওঠেপড়ে লাগল।
.
খুব ভোরে সামি নিজের বাবার ঘরে প্রবেশ করল। গত রাতে প্রায় দুটা পর্যন্ত সে তার বাবার জন্য অপেক্ষা করেছে। বাবা বাইরে থেকে ফিরেছেন আরো গভীর রাতে। সামির তখন একটু ঘুমঘুম ভাব এসে গিয়েছিল।
হক সাহেবের ঘরে এয়ারকন্ডিশন চলছে। চৈত্র মাসের শেষের দিক। গরম পড়া শুরু হয়ে গেছে এর মাঝেই। তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন ফজরের নামাজ আদায়ের উদ্যেশ্যে। নামাজ পড়া শেষ, এখন জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছেন।
তাঁর স্ত্রী ঘুমোচ্ছে নাক ডেকে বিছানায়। ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি ইশারা দিয়ে বললেন সোফার ওপর বসতে। সামি বসল। হক সাহেব তসবিহ পড়া শেষ করলেন, মোনাজাত করলেন। তারপর জায়নামাজ গুটিয়ে নিতে নিতে প্রশ্ন করলেন, ‘রাতে ঘুমাওনি?’
সামি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলো, ‘না’
‘কেন? সব ঠিক আছে?’
‘কিছুই ঠিক নেই আব্বা!’ সামির কথাটা প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল।
‘কী হয়েছে?’ চকিতে প্রশ্ন করলেন হক সাহেব।
‘আব্বা আমি তো তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তাই না যে আকাশের চাকরিটা যে তোমার রেফারেন্সে হচ্ছে এটা যেন ও জানতে না পারে?’
‘জানার কথাও না!’
‘কিন্তু জেনে গেছে যে!’
‘কে বলল?’
‘তা তো জানি না!’
‘প্রশ্ন করোনি?’
‘না প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি, ও অনেক রেগে ছিল।’
‘এত রাগার মতো তো কিছু হয়নি, চাকরি পেয়ে গেছে এটাই কি যথেষ্ট নয়?
‘না আব্বা এটা যথেষ্ট নয়, ওর ইগো অনেক বেশি, এজন্য আমি তোমারে বলছিলাম ব্যাপারটা চাপায় যাইতে।’
‘আমার জানা মতে ফ্যাকাল্টির কেউ এ প্রসঙ্গে তোমার বন্ধুর সাথে কোনো কথা বলেনি। সে জানল কী করে এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার কিন্তু তার চাইতেও বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ঘটনাটিতে তোমার বন্ধুর প্রতিক্রিয়া। আজকাল জবটব এসব কোনো রেফারেন্স ছাড়া হয় নাকি? এ তো তার সাত জন্মের ভাগ্য যে এত বড় একটা রেফারেন্স পেয়ে গেছে সে। তার তো খুশি হয়ে তোমাকে কোলে নিয়ে লাফানোর কথা, তা না করে সে তোমার ওপর উল্টো রেগে গেছে। এটা তো অভাবনীয়!’
সামি অস্থির হয়ে বলল, ‘উফ আব্বা! তুমি ব্যাপারটা বুঝবে না, ইটস কমপ্লিকেটেড।’
‘বোঝাবোঝির দরকার নাই আমার, নিজের মুখ খরচ করেছি, অতএব আমার মুখের কথার যেন দাম থাকে। আমার কথামতো ওরা দুবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে, প্রথমে তোমার নাম দেওয়া হয়েছিল, এর পর তোমার নামের পরিবর্তে তোমার বন্ধুর নাম দেওয়া হয়েছে, আর কোনো রদবদল যেন না হয়।’
সামি ঢোঁক গিলল। কী করে বলবে আব্বাকে যে আকাশ অলরেডি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে চাকরিটা না করার? আব্বাকে তো সে আকাশের সাইকোলজি এখন বোঝাতে পারবে না।
সামি ওঠে দাঁড়াল।
হক সাহেব বললেন, ‘তুমি এবারে একটু নিজের কথা ভাবো, বন্ধু বন্ধু করে তো জীবনটা শেষ করে দিলে।’
‘হুম’ অন্যমনস্কভাবে বলল সামি।
‘ফ্রেন্ড সার্কেলটা একটু বদলালে তো পার’।
‘মানে?’
‘মানে তুমি যাদের সাথে মেলামেশা করো, এরা প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। এদের কারোরই তোমার স্ট্যাটাস বরাবর চলার মতো কোনো যোগ্যতা নেই।’
ঝাঁ করে তীরের মতো লাগল কথাটা একদম বুকে গিয়ে। সামি ব্যথাতুর নয়নে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হঠাৎ এ কথা?’
‘হঠাৎ নয়, অনেকদিন ধরেই ভাবছি কথাটা তোমাকে বলব, পুরো দলটাকে তো বলতে গেলে তুমি লালন-পালন করছ, এদের কি বাবা মা অথবা পরিবার বলে কিছু নেই? গেল মাসে কক্সবাজারে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে আসলে। ঘটনাটা আমার কাছ থেকে লুকিয়েছ তুমি কিন্তু আমার কানে সব খবরই আসে। আরেক বাউণ্ডুলে তো এখানে পার্মানেন্ট বসতি গেঁড়ে বসেছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর সারাদিন হইহই করে কীসব গান গায়। এসব হচ্ছেটা কী? বলি তোমার কি ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই? দয়া করে ফ্রেন্ড সার্কেলটা একটু চেঞ্জ করো।’
সামি যেন আকস্মিক এক অপ্রত্যাশিত আক্রমণে বিমূঢ় হয়ে গেল। তার মুখটা একটু হাঁ হলো ঠিক কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। মিনিট দুয়েক আব্বার সামনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে ঘরটা ছাড়ল।
বাইরে তখন আধফোটা ভোর। আব্বার ঘর থেকে বেরোতেই করিডরের বাম পাশে ঝুল বারান্দা। সামি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাওয়া পবিত্র। চাল ধোয়া ঘোলা পানির মতো একটা ঝাপসা আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
ফ্রেন্ড সার্কেল কি বদলানোর মতো কোনো জিনিস? এ যেন গায়ে পরা জামা জুতো, যখন ইচ্ছে পাল্টানো যায়। এইবন্ধুগুলো ছাড়া সামির আর কী আছে এ জীবনে? এ আড়ম্বরপূর্ণ জীবন তো কখনো চায়নি সে। কী চেয়েছিল জীবনের কাছে?
আজ এ আধফোটা ভোরের বিবাগী আলোয় সামির মনে হঠাৎ প্রশ্নটির উদয় হলো।
কী চেয়েছিল সে জীবনের কাছে?
কী চেয়েছিল?
কী পেয়েছে?
আর কী পায়নি?
না পাওয়া বলতে কোনো শব্দ যে তার ডিকশনারিতে নেই। না চাইতেই সিন্দবাদের ভূতের মতো ভাগ্য তার সামনে সমস্ত কিছু হাজির করে দিয়েছে। চাওয়া আর পাওয়া এ দুইয়ের মাঝে পার্থক্যটাই যে ধরতে পারল না সে আজ অবধি।
ঠিক সে সময় পকেটে থাকা মোবাইলটা বিপবিপ করে শব্দ করল। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল।
বিভা টেক্সট করেছে, ‘অভিজিৎদার বাবা-মা আসছেন কলকাতা থেকে বিয়ের কথা পাকা করতে, কালকে ফ্রি থাকলে মিট করিস।’
২৪
‘আমি বিয়ে করব না, পালিয়ে যাব।’ দৃঢ় গলায় বলল বিভা।
‘পালাবি মানে? কার সাথে পালাবি?’ অমৃতা অবাক।
বিভা অমৃতার প্রশ্ন শুনে নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। তারপর বিষণ্ণ গলায় উত্তর দিলো ‘সেটাই ভাবতেছি, কার সাথে যে পালানো যায়! একটা সাজেশন দে তো!’
রুদ্রর মুখে কাঁচা মরিচ সমেত আস্ত একটা ফুচকা ছিল। বিভার কথা শুনে তার চক্ষুদুটো গোল মার্বেলের মতো হয়ে গেল। ক্যাটস আই চোখের মণি দুটো মনে হলো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। সে ফুচকা চিবোতে চিবোতে মুখ দিয়ে অদ্ভুত কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করে কিছু বলতে চাইল।
কেউ তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না। বিভা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কী বলতে চাস ঠিকমতো বল, মুখের খাবার গিলে নিয়ে তারপর বল।’
রুদ্র বিভার কথামতো খাবার গিলল। কিন্তু ততক্ষণে কাঁচামরিচে কামড় পড়ে তার জিবে আগুন ধরে গেছে। সে পড়িমরি করে ওঠে ঠাণ্ডা সোডা কিনতে দৌড় দিলো। বিভা রুদ্রর সে দৌড় দেখে তিক্ততার গলায় বলল, ‘দিন দিন রুদ্রটা কেমন জোকার হয়ে যাচ্ছে!’
শেষ বিকেলের মরা আলো মাথায় নিয়ে সামির লাল মার্সিডিজবেঞ্চ টিএসসি চত্বরে এসে থামল। ঠিক একই সময় একটা ছাই রঙা ফুলহাতা শার্ট পরে আকাশকেও নামতে দেখা গেল রিকশা থেকে।
সামি গাড়ি পার্ক করছিল। আকাশই আগে এসে পৌঁছল। হৃদি আর অমৃতা ফুটপাতের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বিভা বসে আছে ফুতপাতের ওপর পেপার বিছিয়ে। তার হাতে চায়ের কাপ। আকাশ এসে প্রশ্ন করল, ‘আপডেট কী?’
বিভা ঝটপট উত্তর দিলো, ‘আমি পালাচ্ছি।’
‘কার সাথে?’
‘তোর সাথে, পালাবি দোস্ত আমার সাথে?’
‘দূর বাল, আজাইরা কথা ছাড়, কামের কথা ক’
‘কামের কথাই তো কইলাম। পালায়া যামু।’
আকাশ মুখ গোঁজ করে চুপ করে গেল। বোঝা গেল কথাটা তার খুব একটা পছন্দ হয়নি।
‘তোর বিয়ে কবে? সব ঠিকঠাক?’ মুখ গোঁজ করেই প্রশ্ন করল আবার।
‘আগামী সপ্তাহে।’
‘কেন, এত হুড়াহুড়ি লাগাইছে কেন তোর বাপ-মা?’
‘আমি কেমনে কমু, আমি কি ওদের মনের ভিতর ঢুকছি?’
রুদ্র ফিরে এসেছে হাতে একটা ঠাণ্ডা ফান্টার ক্যান হাতে নিয়ে। ঝাল মুখে তখনও হু হা করে যাচ্ছে। সামিও পৌঁছে গেল মিনিট দুয়েকের মধ্যেই। সামির চোখজোড়া লাল। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। দেখেই বোঝা গেল এ ছেলে সারারাত ঘুমায়নি।
সামি এসে দাঁড়াতেই আকাশের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুহূর্তে কোত্থেকে যেন একটা অস্বস্তি এসে জায়গা করে নিল দুজনের মাঝে। আকাশ চোখ সরিয়ে নিল।
‘কী অবস্থা?’
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো সামি দলের সবাইকে উদ্দেশ্য করে।
অমৃতা বলল, ‘বিভাবরীর তো বিয়ে, জানিস নাকি?’
‘হুম শুনলাম, হঠাৎ বিয়ে কেন?’ সামির প্রশ্নটা একটু ঝাঁঝওয়ালা হয়ে গেল।
হৃদি রাশভারি গলায় উত্তর দিলো, ‘মেয়ের বিয়ের বয়স হইছে, তাই।’
সামি গলায় সে ঝাঁঝওয়ালা ভাবটা বজায় রেখেই বলল, ‘ওই বোকাচোদাটাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম যে কোনো বদ মতলব আছে। আমার সন্দেহই সত্য হলো।’
রুদ্রর মুখে তখন জ্বালাপোড়া একটু কমেছে। সে বলল, ‘বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে। অভিজিৎকে করতে দোষ কোথায়?’
কথাটা পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই অমৃতা বলে উঠল, ‘ইয়েস আমারও এটাই কথা, অভিজিৎদাকে আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে। পাত্র হিসেবে ফার্স্টক্লাস।’
আকাশ কোনো মতামতো দিচ্ছিল না বলে অমৃতা আকাশের মাথায় একটা গাট্টা মেরে দলভারী করার উদ্যেশ্যে বলল, ‘কী বলিস?’
আকাশও মাথা নেড়ে সায় দিলো, বলল, ‘কথা ঠিক, বিয়ে যদি করতেই হয় তো অভিজিৎকে নয় কেন? সে ভালো ছেলে।’
অমৃতা বিশ্বজয়ের হাসি হেসে এবারে সামিকেও দলে টানার চেষ্টা করল। ‘সামি কী বলিস? অভিজিৎকে কি খারাপ ছেলে মনে হয়েছে তোর?’
সামির চোখে দোটানার ছাপ পড়ল। চুপ করে রইল কিছুটাক্ষণ। বিভার দিকে তাকাল। বিভার চোখদুটো একটু কেমন টলমল করছে। মনে হচ্ছে টোকা দিলে এক্ষুনি জল গড়িয়ে পড়বে। সামি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ঢোক গিলে চেপে নিয়ে বলল, ‘না, খারাপ হবে কেন? অভিজিৎ ছেলে ভালোই। তোর বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে করে ফ্যাল না, এত তামাশার কী আছে?’
বিভা ম্যাচের কাঠির মতো ভস করে জ্বলে উঠল, ‘ওহ তামাশা মনে হচ্ছে তোদের কাছে তাই না? ঠিক আছে, করব আমি এ বিয়ে। খুশি তোরা?’
‘দোস্ত দ্যাখ, আমরা তোর ভালো চাই, এরকম একটা প্রপোজাল কোনো কারণ ছাড়া নাকচ করে দেওয়াটা ভীষণ ভুল হবে।’ হৃদি বলল।
‘আ! জ্ঞান দিতে আসিস না তো!’ বিভা বলল বিরক্তিতে। তারপর চায়ের কাপটা ফুটপাতের ওপর রেখে দিয়েই ওঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবহেলায় বলল, ‘আমি যাই।’
‘আরে বয় না, এখনই যাবি কেন? মাত্র তো আসলি।’ রুদ্র বলে উঠল
বিভার কানে বোধহয় কথাটা পৌঁছল না। হনহন করে হাঁটতে লাগল। সামি হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে প্রায় দৌড়ে এসে বিভার হাতটা পেছন থেকে ধরে ফেলল, রগচটা গলায় বলল, ‘তুই যাইতাছিস কই? কথা তো শেষ হয় নাই!’
বিভা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘হাত ছাড়, আমার আর কোনো কথা নাই, কথা শেষ। তোদের যা বলার বলে দিয়েছিস।’
‘দ্যাখ মেজাজ মর্জি এমনিতেই ভালো না, ঠিক আছে? এসব নকরামি বাদ দে এখন। তোর যদি বিয়ে করতে ইচ্ছে না করে তাহলে বাসায় বলে দে যে বিয়ে এখন তুই করবি না।’
হৃদিতা হঠাৎ ওদের মাঝখানে এসে সামিকে প্রায় ধমকে বলে উঠল, ‘কেন করবে না বিয়ে? পরে যদি এত ভালো প্রস্তাব আর না আসে? তখন কী হবে? বিয়ের বাজারটা আজকাল কত চড়া তুই জানিস? আর তাছাড়া ওর ফ্যামিলির মানুষজনের কথাও তো ওর চিন্তা করতে হবে তাই না?’
সামি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এতই যদি ভালো প্রস্তাব হয় তো তুই কর না ওই শালারে বিয়া, ওরে কেন ঝুলাইতে চাইতেছিস?’
হৃদি আহত গলায় বলে উঠল, ‘সামি তুই কিন্তু ভীষণ অসভ্যের মতো কথা বলছিস।’
‘অসভ্যের মতো কথা বলছিস তুই, ভবিষ্যতে ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসবে না বলে এখন চোখ কান বন্ধ করে যাকে ভালো লাগে না তাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে। এটা কেমন কথা?’
‘ভালো তো একদিনে লাগবে না, ধীরে ধীরে ভালো লাগা তৈরি হবে। তুই জানিস বিভার বাবা-মা ওর বিয়ে নিয়ে কী ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে? অভিজিতের সাথে ওর গোত্র মিলে গেছে, কুণ্ডলী মিলে গেছে, এ সম্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে গেলে পরে আবার এসব হিসাব মিলাতে অনেক হিমশিম খেতে হবে। পরবর্তীতে যদি এমন প্রস্তাব আর না আসে তখন কে বিয়ে করবে ওকে? তুই করবি?’
হৃদিতার প্রলম্বিত বকবকানির শেষে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা সামিকে নাড়া দিয়ে গেল। সে চকিতে তাকাল বিভার দিকে।
‘করব, আমিই করব বিভাকে বিয়ে, কোনো সমস্যা?’
ভীষণ চমকে উঠল বিভা। অস্ফুটে মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো শব্দটা, ‘ছি সামি!’
কয়েকটা মুহূর্ত বিস্ময়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। সামিকে কেমন পাগল পাগল দেখাতে লাগল। তার চোখের দৃষ্টি স্থির নেই। নিশ্বাস নেই স্বাভাবিক।
এক সময় হৃদি বিস্ময় চাপা দিয়ে চাটুকারিতার গলায় বলে উঠল, ‘আমি জানতাম, আমি জানতাম যে তোর মনের ভেতরে এসব বদ চিন্তা চলতেছে। এ জন্যেই আমি প্রশ্নটা করেছিলাম। ধরা পড়েই গেলি শেষ পর্যন্ত।’
সামি কিন্তু একটুও বিব্রত হলো না, বরং ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘বেশ তো, তোর কৌশল সফল হয়েছে, কুডোস টু ইউ।’
বিভা চোখ দুটো নিচের দিকে নামিয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
সামি ওর দিকে চোখাভাবে তাকিয়ে অকপট বলল, ‘চুপ করে আছিস কেন? আমাকে বিয়ে করতে তোর আপত্তি আছে?’
বিভা বিব্রত হয়ে পড়ল, ‘আহ সামি! কী পাগলামো করছিস?’
ছয়জনের দলটা গোল হয়ে ফুটপাত দখল করে দাঁড়িয়ে ছিল। পথচারীরা কয়েকজন কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বিশেষ করে চায়ের দোকানদার মামার বিস্ময় এবং উত্তেজনা দুটোই উপচে পড়ছে। প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল এ দলটাকে সে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সে মোটামুটি আঁচ করতে পারে যে এদের বন্ধুত্ব ষোলো আনা খাঁটি। কিন্তু তলে তলে যে জল এতদূর গড়িয়ে গেছে তা তার চিন্তার বাইরে ছিল।
অমৃতা একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘আচ্ছা থাক, এখন এসব প্রসঙ্গ থাক, চল কোথাও বসি। আমার বাসায় চল, তারপর কথা বলা যাবে।’
সামি আগুন গলায় বলল, ‘কেন এখানে প্রবলেম কী হইতেছে? তোরা শালা সব কিছুতে এত পেজগি লাগাস ক্যান? একটা সিরিয়াস কথা বলতেছি, এর মধ্যে ঘ্যানর ঘ্যানর।
অমৃতা ভারি অবাক হয়ে চাইল সামির দিকে। এ সামিকে যেন সে চেনে না। এ ছন্নছাড়া, অভদ্র আর বেহেড জেদি ছেলেটা যে তার বন্ধু এটা তার এ মুহূর্তে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা শোন, মাথা গরম করিস না। বিভা কাকে বিয়ে করবে এটা সে বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুক। এখন হুট করে তো কোনো ডিসিশন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’
আকাশ কিছু না বলে চুপচাপ শুনছিল। সামির সাথে চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে বাগবিতণ্ডা হওয়ার পর থেকে আর ঠিকমতো কথা হয়নি বললেই চলে।
ভেবেছিল আজকে একটা বোঝাপড়া করে নেবে। কিন্তু এ ছেলের তো মাথায় আগ্নেয়গিরি ফুটছে। কোনো স্বাভাবিক কথা আজ এর সাথে বলা যাবে বলে মনে হয় না।
সামি কেটে কেটে বলল, ‘বিভা উত্তরটা আমার চাই!’
‘সামি, তুই পাগল!’ বলে বিভা সেকেন্ড না গড়াতেই ঘুরে দাঁড়াল। প্রায় দৌড়ে পার হয়ে গেল ঘিঞ্জি রাস্তাটা। নিমেষে অদৃশ্য হলো আসন্ন সন্ধ্যার বাদামি রঙের আলোর মাঝে, হরেক লোকের ভিড়ে। বোধহয় একটা রিকশাও পেয়ে গেল চট করে।
সামি অপলক তাকিয়ে ছিল বিভার ওই চলে যাওয়া পথটার দিকে। ঠিক সে সময় একটা অফ হোয়াইট কালারের সুতির ফতুয়া পরা ছিপছিপে মেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাই হিল জুতোর ঠুক ঠুক আওয়াজ করে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে আসছিল। ওরা পাঁচজন ফুটপাতের অনেকখানি দখল করে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটা জায়গা না পেয়ে বিনীত গলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, একটু জায়গা দেবেন?’
আকাশ মেয়েটার নরম গলার মিনতি শুনে গলে গিয়ে বলল, ‘শিওর!’
মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। রুদ্র একটা শিস বাজিয়ে ফেলল অভ্যাসবশত। মেয়েটা হেঁটে একটু দূরে যেতেই আকাশের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘ভালো ছিল মামা! যেই হাসিটা দিলো! উফ!’
আকাশের মুখে এফোঁড়-ওফোঁড় হাসি ফুটল।
সামি ওদের দিকে প্রচণ্ড ঘেন্নার চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। শীতল গলায় বলল, ‘চললাম’।
.
রিকশায় ওঠে হুড তুলে দিয়েছিল বিভা। নীলক্ষেতের মোড়ে রাজ্যের সব গাড়িঘোড়া এসে জড়ো হয়েছে। কালো বিষাক্ত ধোঁয়া সন্ধ্যের মায়াবী বাদামি রংটাকে ছাইবর্ণ করে তুলছে। বাতাস নেই একফোঁটা।
বিভা কিন্তু এ যানজটের কোলাহলময় শহর থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল। মন নামের টাইম মেশিনে পা দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল বছর সাতেক আগের এক ঝুম গ্রীষ্মের দুপুরে।
২০১০ সালের মে মাস ছিল ওটা। কলেজের নবীন বরণ। গ্রীষ্মের কড়া দাবদাহকে তোয়াক্কা না করে বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরেছিল সে। নেচেছিল তার প্রিয় গানে, ‘সজনি সজনি রাধিকা লো, দেখ আবহ চাহিয়া।’
নাচের পর স্টেজ থেকে নামার মুখে আকাশের সাথে দেখা। তখন ওরা তিন বান্ধবী আকাশ বলতে অজ্ঞান ছিল। আকাশের পাশে হ্যাংলা পাতলা গৌর বর্ণ এক ছেলে দাঁড়ানো। মাথা ভর্তি একরাশ কোঁকড়া কালো চুল। ঠোঁট দুটো ওই বয়সেই সিগারেট খেয়ে কালো কিন্তু একটু কেমন আদুরে ছাপ আছে ওই ঠোঁটে আকাশ বিভাকে বলল, ‘এ আমার বন্ধু সামি, আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড। তোমার নাচ দেখে মুগ্ধ। কথা বলতে চায় তোমার সাথে।’
বিভা সামির দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল, ‘হ্যালো আমি বিভা, বিভাবরী।’
সামি নামটা শুনে ফট করে বলে বসল, ‘বিভাবরী? তোমরা কি হিন্দু?’
‘হ্যাঁ, আমরা হিন্দু।’
‘শিট!’ আফসোসে শব্দটা আওড়ালো সামি।
‘কেন? এত আফসোস কেন?’
সামি নির্বিকারে বলল, ‘ভাবছিলাম প্রপোজ করব তোমাকে, পছন্দ হয়েছিল, আরেকটু হলেই প্রেমে পড়ে যেতাম। ভাগ্যিস পড়িনি! হিন্দু মেয়ের সাথে বাপ- মা বিয়ে দিবে না।’
বিভা ভীষণ অবাক হয়েছিল ছেলেটার অকপট স্বীকারোক্তি দেখে। ওইটুকু বয়সের কোনো ছেলে যে অত সাহসী হতে পারে তা ভাবাই যায় না। পরমুহূর্তেই সামি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘প্রেম না হয় নাই করলাম, বন্ধু তো হতে পারি?’
বিভা হাত মিলিয়েছিল। সেই ছিল প্রথম দেখা। কী সাধারণ ছিল শুরুটা সাধারণ অথচ কী নিদারুণ গভীর। এরপর দিনকে দিন সম্পর্কগুলো কত কাছের হয়ে গেল। বন্ধু কী করে হতে হয় বিভা তা জানে। ওর মনের ভেতর একটা বিশাল বড় ফাঁকা উদ্যান আছে। সে উদ্যানটা শুধু বন্ধুদের নামেই হিবা করা। বিভা মরে গেলেও সে উদ্যানটা ওর বন্ধুদেরই থাকবে। মনের মতো বন্ধু পেয়েছিল ভাগ্যিস এ জনমে। নইলে ওই ফাঁকা উদ্যানটা মনে হয় আজীবন ফাঁকাই থাকত। বন্ধুত্ব আর প্রেম যেন একই মোহনায় মিলিত দুটি নদীর নাম। যেকোনো সময় একজন আরেকজনের সাথে মিশে গিয়ে নিজ অস্তিত্ব বিলীন করতে পারে। তাই বুঝি সে গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ি ফেরার পর বিভা ওর ডাইরিতে লেখেছিল,
‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ!’