১৫
সামি ডাস্টার দিয়ে গাড়ির ধুলো ঝাড়ছিল। তার গায়ে একটি হালকা লেবু রঙের পাঞ্জাবি। চোখে সানগ্লাস। ফরসা গাল চিকচিক করছে রোদে। আজ শুক্রবার বলে এখানকার মসজিদেই জুম্মা ধরেছে ওরা। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পালাও শেষ। কিছুক্ষণের মাঝেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার ইচ্ছে আছে।
গাড়ির জানালার কাচে বিভাকে দেখা গেল। একটা ল্যাভেন্ডার রঙের চমৎকার ছাটের জামা তার পরনে। ঘের হয়ে ঝুলে আছে জামার লেইস হাঁটুর চারপাশে। তার নিচে কালো টাইটস। হাই হিল জুতো। বিভার বরাবরই সাজগোজের দিকে একটু ঝোঁক বেশি। আজকেও তার চোখে ল্যাভেন্ডার ব্লু আই শেডো। কাজল, ভারি মাসকারা। ঠোঁটে লিপগ্লস।
সামি চশমার আড়াল থেকে আগাগোড়া একবার দেখে নিল বিভাকে। কিন্তু ভাবটা এমন দেখাল যে বিভাকে সে লক্ষ্যই করেনি
বিকেলের আকাশে তখনও রোদ ঝিকোচ্ছে। শীত মাখানো হাওয়াটাও ফুরফুরে, চমৎকার একটি দিন }
‘ইয়ে, তোর সাথে একটু কথা ছিলরে।’ বিভাই কথা শুরু করল। আড়ষ্ট গলায়। চশমার নিচ থেকে তেরছা চোখে চাইলো সামি, বিভার দিকে।
আর এদিকে হোটেলের লবির সোফায় বসে চার বন্ধু ভারি মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটি দেখছিল। থাই অ্যালুমিনিয়াম গ্লাসের দরজার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি আর বাকি দুজনকে।
আকাশ বলল, ‘মনে হইতাছে ডায়লগবিহীন মুভি দেখতেছি, এইটা কিছু হইলো, ছবি দেখা যাবে কিন্তু ডায়লগ শোনা যাবে না?
‘ডায়লগ লাগবে না এক্সপ্রেশন দেখলেই বুঝবি কী ঘটতেছে।’ হৃদি বলল।
রুদ্র বলল, ‘আমার না, কেমন জানি লাগছে বুঝলি? প্রেম হবে না তো ওদের?’
হৃদি হেসে বলল, ‘হতেও পারে, চান্স আছে।’
অমৃতা অনেকটা ধমকের গলায় বলল, ‘ফালতু কথা বলিস না, বিভা যে শুধু বিভা না, বিভাবরী ভট্টাচার্য, এ বিষয়টা মাথায় রাখিস।
‘আরে এ যুগে ওইসব কোনো ব্যাপার না।’ রুদ্র বলল।
‘সেটা তুই আমি বললে তো হবে না, ওদের বাবা-মায়েরও বুঝতে হবে। আমি যতটুকু জানি, বিভার আব্বা-আম্মা যথেষ্ট কনজারভেটিভ। আর সামির আম্মাকে তো চিনিসই, হার্টফেল করবে।’ অমৃতা বলল।
‘হুম, অতএব সবাই মিলে দোয়া কর যেন প্রেমট্রেম না হয় ওদের মধ্যে, বন্ধু আছে, বন্ধুই থাক।’ হৃদি বলল।
‘আরে দূর, বন্ধুদের মধ্যে আবার কীসের প্রেম, ওইসব হবে না।’ আকাশ উড়িয়ে দিলো প্রসঙ্গটা।
সামি হিম হিম গলায় বলল, ‘কী কথা?’
‘ইস, আসলে দোস্ত গতকালকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব সরি।
‘কোন ব্যাপারটা?’ বুঝেও না বোঝার ভান করল সামি। যেন কোনোকিছুই মনে নেই তার। মনে রাখার মতো কোনো ঘটনাই যেন ঘটেনি।
‘মানে… তোকে থাপ্পড় মারাটা আমার উচিত হয়নি, আমি সরি।’
সামি ডাস্টারটা গাড়ির ব্যাকডালায় রাখতে রাখতে বলল, ‘সরি বললে তো হবে না, সবকিছুর একটা হিসেব আছে তাই না? চেক এন্ড ব্যালেন্স বলে একটা কথা আছে।’
‘এর মানে কী?’
‘মানে হচ্ছে তুই আমাকে থাপ্পড় মেরেছিস, সো আমিও তোকে থাপ্পড় মারব। তাহলেই ব্যালেন্স হবে।’
বিভা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তুই আমাকে থাপ্পড় মারতে চাইছিস?’
‘আমি চাইছি না কিন্তু এথিক্স তো এটাই করতে বলে, তাই না? কারণ দোষ তো আমি একা করিনি, তুইও করেছিস।’
‘তুই শুরু করেছিলি।’
‘তাতে কী? তুই থামাসনি কেন? তুই না চাইলে জোর তো আমি করতাম না, তাই না?’
এ কথার পর বিভা একটু কোণঠাসা হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘তুই থাপ্পড় মারতে চাস আমাকে? ঠিক আছে মার।’ বলে বিভা তার গাল এগিয়ে দিলো সামির দিকে। সামি সানগ্লাস খুলে হাতে নিল। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। কেমন একটু নিষ্ঠুরতাও মিশে আছে সে হাসির সাথে।
‘থাক বাদ দে। মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলি না।’ এটুকু বলে কিছু একটা চিন্তা করল সামি। তার চোখদুটোতে হালকা অস্বস্তি ভেসে উঠল, বলল, ‘আমিও দুঃখিত। যা করেছি সেটা আসলে… আসলেই ঠিক হয়নি ব্যাপারটা, আমি জিনিসটা মনে রাখতে চাই না বুঝেছিস? ভুলে যেতে চাই। যেটা হয়েছে সেটা খারাপ ছিল। খুবই বাজে ছিল। আর ভুল মানুষই করে, ভুল শোধরানোর সুযোগ তো একটা চাই তাই না?’
শেষের কথাগুলো খুব কানে লাগল। একটা হাহাকারে ভেসে গেল বুক। খারাপ ছিল? বাজে ছিল? কই বিভার কাছে তো অতটা খারাপ লাগেনি? এমনকি একটি বার ভোলারও চেষ্টা করেনি সে। যতবার মনের দরজায় ঘটনাটা এসে কড়া নেড়েছে ততবার কেমন এক অনাবিল সুখের শিহরণ বয়ে গেছে সারা শরীরে। ভুল ছিল এটা বিভা জানে কিন্তু ভুলটা ভালো লাগার ছিল, অন্তত তার কাছে ক্ষণিকের জন্যও ব্যাপারটাকে বাজে বলে মনে হয়নি। এ সত্যটা সামিকে কে বলবে?
এ মুহূর্তে সামির এ অকপট স্বীকারোক্তি শুনে নিজেকে ধিক্কার দিতে মন চাইছে তার। তার এতকালের মেয়েলি অহংকার, মান, মর্যাদা, সম্মান সব যেন ধুলায় মিশে গেল মুহূর্তে।
একটা বড় নিশ্বাস লুকাল বিভা। কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল, ‘ভুলে যেতেই হবে। এসব মনে রাখার কোনো মানে হয় না।’
সামির চোখে খেলতে থাকা অস্বস্তিটা এখন একটু নিভু নিভু। সে নরম গলায় বলল, ‘তাহলে বিভা, আমরা ঠিক আছি?’
‘ঠিক আছি।’ বিভা হাসে।
সামি হাত বাড়িয়ে দিলো বিভার দিকে, মুখে বলল, ‘ফ্রেন্ডস ফর এভার?’
বিভার চারপাশটা হঠাৎ কেমন ঝাপসা হতে শুরু করেছে। ব্যাগ থেকে চট করে রেব্যান বের করে চোখ ঢেকে ফেলল সে। তারপর সামির হাত ধরে বলল, ‘ফ্রেন্ডস ফর এভার’
কে জানে সামি টের পেল কি না যে কথা বলার সময় বিভার গলাটা হালকা হালকা কাঁপছিল!
১৬
মাস দুয়েক পরে, চৈত্রের এক ভোরে হঠাৎ আকাশের মোবাইল বেজে উঠল।
ঘেউ ঘেউ ঘেউ!
আকাশের ফোনে এ অদ্ভুত রিংটোনটা দেওয়া আছে গত চার পাঁচদিন ধরে। যখনই ফোন আসে মনে হয় ঘাড়ের কাছে কুকুর ডাকছে তারস্বরে। এই ভোর পাঁচটার সময় যেমন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই শুরু হয়ে গেল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ!
আকাশ ঘুমঘোরে ফোন রিসিভ করল। ভারী গলায় ‘হ্যালো’ বলল। ফোনের ওপাশে সামি।
‘দোস্ত কী করস, ঘুমাস?’
‘মজা নেও? ভোর রাইতে ঘুমাব না তো কী করব?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল আকাশ।
‘ভোর রাতে যে ঘুমাতেই হবে এমন কোনো কথা নাই, এই যে আমাকে দ্যাখ আমি তো ঘুমাচ্ছি না।’
‘তুই ঘুমাইতেছোস না ক্যান? পেটে কৃমি হইছে?’
‘আরে না কৃমি হওয়ার বয়স আছে নাকি?’
‘আচ্ছা রাখি, পরে…’ আকাশের গলা জড়িয়ে গেল।
‘শোন না!’
‘না শুনুম না, হারামি লাথি খাবি পাছায়! সকালে ইন্টারভিউ আছে কইলাম।’
‘আরে গুল্লি মার ইন্টারভিউ, আমার তো জীবন মরণ সমস্যা।’
‘হুম খুব ভালো, মইরা যা!’ বলে আকাশ ফোন কেটে দিলো।
আকাশ পুনরায় ঘুম দেবার প্রস্তুতি নিল। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে শব্দটা ভেসে আসলো। ভারী কোনো কাচের জিনিস ঝনঝন করে ভেঙে পড়ার শব্দ।
বুকটা ধক করে উঠল। যদিও ঘটনা কী হচ্ছে আকাশের তা পুরোদস্তুর জানা আছে। লোকটা নিশ্চয়ই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল মাত্র। বাড়ি ফেরার পর রোজ যে নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটে সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। গত একটা মাস ধরে এই তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে।
লোকটার মতিগতি কিছুই বোঝে না আকাশ। মা মারা যাওয়ার পর প্রথম বিশ পঁচিশ দিন ঠিক এরকম মাতলামো করত রাতের পর রাত। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সকলে ছি ছি করতে লাগল। বউ মরার চল্লিশ দিন পেরোতে না পেরোতেই এ কেমন বেলেল্লাপনা? কিন্তু লোকটা বেলেল্লাপনার শেষ দেখিয়ে ছাড়ল।
.
চল্লিশদিন পেরোনোর আগেই এক হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলো। বিয়ের পর বছর তিনেক চলল খুব খোশ মেজাজে। নিজের দামড়া পঁচিশ বছর বয়সি ছেলের সামনে নতুন বৌয়ের সাথে পিরিত করতেও বাধত না তার।
সবকিছু চোখ দিয়ে চেয়ে চেয়ে নীরবে সহ্য করেছে আকাশ। টু শব্দটি করেনি। কিন্তু এই একটা মাস ধরে শুরু হয়েছে সে পুরোনো নাটক। রোজ রাত করে বাড়ি ফেরা আর মাতলামো করা। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা।
মা বেঁচে থাকতে লোকটা যে একটু আধটু মদ খেত না তা না, খেত কিন্তু সীমা কখনো অতিক্রম করেনি। লোকটা গালি দেয় নিজের বৌকে। বর্তমান বউ এবং প্রয়াত বউ। দুই বউকেই সমান তালে গালাগালি করে। আকাশ সব শোনে। মাথার ভেতর একটা রাগী অন্ধ সাপ ছোবল দেয়ার জন্য ফোঁস ফোঁস করে ফণা তুলতে থাকে। আকাশ ফণাধারী সাপকে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চেপে ধরে বশে আনে।
কিন্তু সাপ বেশিদিন বশীভূত থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুদিনের মাঝেই ছোবল দেবে।
ঘুম কেটে গেল। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ঘড়ি দেখল আকাশ। ভোর পাঁচটা। ওপাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে অশ্রাব্য গালাগালির আওয়াজ।
‘তুই বেশ্যা, তোর চৌদ্দ গুষ্টি বেশ্যা তোর মারে আমি…’
বলতে নেই, মায়ের জায়গায় শেকড় গেড়ে বসতে চাওয়া মহিলাটিকে গালিগালাজ করা হলে আকাশ এক ধরনের চাপা স্বস্তি বোধ করে মনের ভেতরে। অমানুষ মনটা খল নায়কের মতো অট্টহাসি হাসে আর বলে, খুব তো এসেছিলি আমার মায়ের জায়গা চুরি করতে, এবার মজা বোঝ
আজ ঘটনার দৌড় গালাগালি ছাড়িয়ে মারামারি পর্যন্ত চলে গেল।
নারীকন্ঠের ক্রন্দনের আওয়াজ কেঁপে কেঁপে আসতে লাগল ইটের দেওয়াল ভেদ করে। খল নায়ক মনটা অট্টহাসি হাসল। কিন্তু একই সাথে মাথার ভেতর অন্ধ সাপটাও কিলবিল করে ফণা তুলল।
আকাশ ঝড়ের বেগে বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। পাশের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। ডাইনিংয়ে কাজের মেয়েটা ঘুমোয়। তার ঘুমও গেছে ভেঙে। সে কম্বলে গা মুড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে ভয়ার্ত চোখ নিয়ে।
ঘরের ভেতর ডিম লাইট জ্বলছে। আকাশ দেখল তার মাতাল বাবা বউয়ের চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসছে। ফণা তোলা সাপটা এবার ছোবল মারার জন্য পুরোপুরি তৈরি।
‘কী হচ্ছে এসব?’
আকাশের কথা কানে গেল না লোকটার। বউটার চুল ধরে টানছে তো টানছে। হুঁশ নাই কোনো। বউটা কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। তাতেও কোনো বিকার নাই লোকটার।
আকাশ দৌড়ে গিয়ে বৌটাকে বাঁচালো লোকটার শক্ত হাতের থাবা থেকে। লোকটা আকাশের দিকে কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে চেয়ে রইল। আকাশ দেখল তার চোখদুটো ভয়ঙ্কর লাল। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সাদা ফ্যানা।
বুক মোচড় দেয়।
এ তার জন্মদাতা পিতা?
ঘেন্না হয়। নিজের ওপর, এ অমানুষটার ওপর, পৃথিবীটার ওপর।
লোকটা টলতে টলতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বলতে লাগল, ‘সব শালা স্বার্থপর, সব…’
বউটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কখনো নিজ থেকে কথা বলেনি আকাশ এ মহিলার সাথে। আজ কী বলবে? কী বলার আছে তার? যে মানুষ নিজেই নিজের দুর্ভাগ্যের স্থপতি গড়ে তাকে আগ বাড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে যাবার তো কোনো মানে হয় না।
আকাশ বলতে পারলও না কিছু। প্রস্থান করল দ্রুত পায়ে। ঘরে এসে দেখল বন্ধ জানালার কাচের ভেতর দিয়ে নরম একটা হলুদ আলোক রশ্মি এসে শুয়েছে বিছানায়। ভোরের আলো ফুটছে।
মোবাইল নিয়ে সামির নম্বরে ডায়াল করল।
সামি ফোন ধরেই বলে উঠল, ‘কীরে স্লিপিহেড, ঘুম ভাঙল?’
‘হুম, কী হইছে তোর? কী সমস্যা?’
আকাশের গলা ভারী শোনাল।
‘তোর কী হয়েছে? গলাটা এমন লাগছে কেন? সব ঠিক আছেতো?’
‘তোর কী হয়েছে তা বল, আমার কথা বাদ দে’
‘দোস্ত আজকে আমার একটা ব্লাইন্ড ডেইট আছে!’
‘ব্লাইন্ড ডেইট?’
‘হুম, ব্লাইন্ড ডেইট।’
আকাশ দীর্ঘ নিশ্বাসটা চাপাতে গিয়েও চাপাতে পারল না। সামি আছে বেশ ভালোই। আজকে এর সাথে ডেট তো কালকে ওর সাথে ব্রেকআপ। তার নিজের জীবনটাও এমন সহজ একটা খেলার মতো হলে বেশ হতো। কিন্তু হলো না তো! সব খেলা তো সহজ হয় না। কোনো কোনো খেলা যমের মতো কঠিন হয়। কিংবা খেলোয়াড় হয় আনাড়ি। তাই হবে, আকাশ একজন আনাড়ি খেলোয়াড়। ধ্যাৎ, কক্সবাজার থেকে ফেরার পর হতেই আবার সে পুরোনো দার্শনিক মনটা ফেরত চলে এসেছে। বন্ধুদের সাথে থাকলে এ মনটা হাওয়া হয়ে যায়। কোথায় পালায় কে জানে!
‘কী করে জোগাড় করলি এ ব্লাইন্ড ডেইট?’
‘ফেসবুকে’
‘কবে থেকে?’
‘আরে হঠাৎ করেই পরশুদিন একটা অপরিচিত প্রোফাইল থেকে নক করল বুঝছিস? কোনো প্রোফাইল পিকটিক নাই। মেয়েটা আমার ইউনিভার্সিটিতেই পড়ছে। সেন্স অব হিউমার ভালো। কথা বইলা আমি চরম মজা পাইছি।’
‘ক্যামনে শিওর হইলি, হয়তো এইটা কোনো মাইয়া না, হয়তো পোলা।’
‘কস কী, যা!’
‘হতেই পারে!’
‘হলে ঠ্যাঙায়ে হাত পা ভাইঙা দিমু না? এত সোজা? যাবি আমার সাথে? পোলা হলে ধইরা মাইর দিব দুজন মিলা।’
‘আর পোলা না হইলে? যদি মাইয়া হয়?’
‘তাইলে ফিফটি ফিফটি দোস্ত, তোর ফিফটি আমার ফিফটি। শেয়ার করব।’
‘ডেইট হলো তোর সাথে, আমি কেমন করে শেয়ার করব?’
‘ব্যবস্থা হবে ডোন্ট ওয়ারি।
আকাশ হাসে, ‘সামি ত্যাঁদরের বাচ্চা, কখনো সিরিয়াস হবি না লাইফে?’
‘দূর, সিরিয়াস হয় ভোধাই পাবলিকরা, আমি কি ভোধাই নাকি?’
১৭
ভাবি রে,
কথা বলা বন্ধ,
হয়ে গেছে দ্বন্দ্ব!
কেন রে?
মুখে যে দাগ!
বিভার পিসতুতো দাদার বউ সৌদামিনী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। বিভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছিল। গালে হঠাৎ একটা ব্রণ চোখে পড়ায় অনেক দিন আগে বিটিভিতে দেখানো এ বিজ্ঞাপনটা মনে পড়ল তার।
‘ওরকম হাসলে হবে না, তোমার বলতে হবে, হেনোলাক্স স্পট ক্রিম আছে না?’
‘কী যে বলিস আবোল-তাবোল, মাথায় কিছু ঢুকে না আমার।’
‘অনেক আগে বিটিভিতে এ বিজ্ঞাপনটা খুব দেখাত, আমি মায়ের কাছ থেকে শুনেছি। এক ছেলে তার ভাবিকে গিয়ে বলছে যে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলা বন্ধ কারণ তার মুখে দাগ, এরপর ভাবি দেবরকে একটা সলিউশন দেয় সলিউশন হলো হেনোলাক্স স্পটক্রিম।
.
সৌদামিনী বাংলাদেশে আসলো এ প্রথম। বিটিভির বিজ্ঞাপন সম্পর্কে তার জানার কোনো উপায় নেই।
সে তবুও পুরো ব্যাপারটায় ভারি মজা পেল। এ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ননদটিকে সে বরাবরই পছন্দ করে এসেছে। বলল, ‘তোর মুখের ওই দাগের জন্য কারও সাথে কথা বলা বন্ধ হবে না, বসার ঘরে যা, একজনকে নিয়ে এসেছি। তিনি ঢাকায় এসেছেন একটা বিশেষ কাজে।’
বিভা চোখে কাজল পরছিল। পরতে পরতে মুখ পাথরের মতো অনড় রেখে জিব নেড়ে বলল, ‘কাকে নিয়ে এসেছ?’
‘আনলাম এক বেচারাকে, সে বেচারার ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়।
‘তাকে আমার কেন দেখতে হবে? সে কী দেখতে অনেক হট? আমি আবার হট পোলাপাইন ছাড়া দেখা করি না, কথা বলি না।’
সৌদামিনী পাগল ননদের কথা শুনে হাসে, ‘তা তো তোর নিজের চোখেই দেখতে হবে। আমি কী করে বলব?’
বিভা একটা হালকা গোলাপি রঙের সুতোর কাজ করা সালোয়ার কামিজ পরেছে, তার সাথে সাদা ওড়না। গাঢ় কালো কাজল পরেছে বলে তার প্রতিমার মতো টানা চোখ দুটো আরও বড় দেখাচ্ছে। কপালে পরেছে লাল টিপ। চুলে করেছে এক বেণি। একটু অন্যরকম দেখছিল ওকে। অন্যরকম কিন্তু স্নিগ্ধ। ভারি স্নিগ্ধ। একবার চোখ পড়লে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে।
বসার ঘরে গিয়ে দেখা গেল বাবা-মায়ের পাশে বিভার পিসতুতো দাদা তাপস বসে আছে। আজ সকালেই কলকাতা থেকে আসলো ওরা। তাপসের পাশে বসে আছে এক অচেনা যুবক। যুবকের চোখে সোনালি পাতলা ফ্রেমের চশমা। গায়ের রং তামাটে। গায়ে গতরে বেশ বড় সড়। চেহারায় একটা ভালো ছাত্র ভালো ছাত্র ছাপ আছে।
বিভা ঘরের ভেতর ঢুকতেই যুবকের সাথে চোখাচোখি হলো। যুবক ভদ্রতার হাসি হাসল। বিভাও।
বাবা বলল, ‘বিভা মা, এ হচ্ছে তোমার দাদার বন্ধু। কলকাতা থেকে এসেছেন। ঢাকায় কটা দিন থাকবেন।
যুবক ভদ্রতার হাসিটি মুখে ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘হ্যালো, আমি অভিজিৎ রয়।’
‘বিভাবরী ভট্টাচার্য।’ বিভাও নিজের পরিচয় দিলো।
বাবা বললেন, ‘তুই বাইরে যাচ্ছিস নাকি?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘এইতো হৃদির বাসায় যেতে হবে, একটা কাজ আছে।’
‘বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কিছু আছে নাকি তোর জীবনে?’ বলে বাবা অভিজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার এ মেয়ে হচ্ছে বন্ধু পাগলা, বুঝলে? বন্ধুদের জন্য সে নিজের জীবনও দিয়ে দিতে পারবে, ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনো।’
অভিজিৎ হাসল। কিছু বলল না।
বাবা বলল, ‘এক কাজ কর, তুই গাড়িটা নিয়ে বের হ, অভিজিৎকেও নিয়ে নে সাথে। ওর এ ফাঁকে ঢাকা শহরটা দেখা হোক।’
বিভার মুখ চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মতো। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ঢাকা শহরে দেখার মতো কিছু নাই, খালি গাড়িঘোড়ার জ্যাম আর জ্যাম।’
‘ওই জ্যামই দেখবে, কোনো সমস্যা নেই।
অগত্যা বিভার সাথে অভিজিৎ রয়ও বের হয়ে আসল।
গাড়িতে উঠেই বিভা অভিজিৎকে বলল, ‘দেখুন অভিজিৎ বাবু, আমি কিন্তু খুব বাজে ড্রাইভ করি, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। লাইফ রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। আপনি চাইলে নেমে যেতে পারেন গাড়ি থেকে, আমি বাবাকে কিছু বলব না।’
অভিজিৎ কথাটা শুনে সরু চোখে তাকালো বিভার দিকে। বিভার চোখে চোখে সরাসরি চেয়ে থেকে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করল। বলল, ‘উঠে যখন পড়েছি লাইফ রিস্কটা না হয় নিয়েই দেখি।’
বিভা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর একটু জোরেই টান দিলো গাড়ি। শাঁই করে ঘুরিয়ে বড় রাস্তায় তুলল। সে এখন যাবে হৃদির বাসায়। তারপর সেখান থেকে যাবে গুলশান গ্লোরিয়া জিন্স কফি’স এ। সামির নাকি আজকে ব্লাইন্ড ডেইট না কী যেন আছে। সে ব্লাইন্ড ডেইট নিয়ে মজা উড়াতে বন্ধুরা সব এক সাথে হচ্ছে। এ হাঁদারাম বডিগার্ডকে বিভা কোথায় রাখবে? বগলদাবা করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? হৃদির বাসায় গিয়ে হৃদিকে বলবে, ‘দ্যাখ, বাবা আমার জন্য একটা হাঁদারাম বডিগার্ড ঠিক করেছে, এখন থেকে এ হাঁদারাম আমার বগলে বগলে ঘুরবে। তোরা হাঁদারামকে সর্বক্ষণ সহ্য করার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।’
.
রাগ হলেই বিভার কপাল কুঁচকে যায়। ঠোঁট বেঁকে যায়। বিভাকে পড়া খুব সহজ। অভিজিৎও পড়ে ফেলল।
.
‘শুনুন, বলছিলাম কী, আমায় না হয় কোথাও ড্রপ করে দিন, ড্রপ করে আপনি আপনার মতো চলে যান। যদিও আমি ঢাকার কিছু চিনি না, কিন্তু গুগল ম্যাপ আছে, প্রবলেম হবে না।’
‘আপনাকে আবার কোথায় ড্রপ করব?’ বিভা খিটমিট করে উঠল।
অভিজিৎ একটু ভড়কাল বিভার খ্যাক শুনে। মিনমিনে গলায় বলল, আপনার ‘না যদি আবার অসুবিধে হয় তাই…’
‘আপনি চুপ করে থাকলেই আমার খুব সুবিধে হবে, বকবক করে মাথা ধরাবেন না প্লিজ!’
অভিজিৎ আড়চোখে তাকাল বিভার দিকে। বিভার গালে তখন বিকেল বেলার রুপালি রোদ। সে আবার ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘চোরের মতো তাকিয়ে থাকবেন না, আমার বিরক্ত লাগে।’
‘ওরে বাবা!’ অভিজিতের মুখ থেকে আপনাআপনি বের হয়ে গেল শব্দ দুটো।
‘কী বাবাকে ডাকছেন কেন?’
‘আপনার তেজ দেখে, বাপের মুখটা মনে পড়ে গেল।’
‘কেন? বাপের মুখ মনে পড়ার মতো কী হলো, হ্যাঁ?’
‘না আমার বাপেরও আপনার মতো অনেক তেজ কি না, তাই।’
বিভার গাড়ি সেগুনবাগিচার জ্যামে আটকাল। অভিজিৎ বলল, ‘আপনাদের এ ঢাকা শহরের বেশিরভাগ লোকজনই কি আপনার মতো? নাকি আপনিই একটু ডিফারেন্ট?’
‘আমার মতো বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?’
‘না মানে, আপনার মতো এরোগ্যান্ট নাকি এ শহরের বেশিরভাগ মানুষই?
বিভা রাগটা গিলল, বলল, ‘ঢাকায় এই আপনার প্রথম আসা?’
‘না, এর আগে একবার এসেছিলাম, ছোটবেলায়।’
‘তা হঠাৎ এতদিন পর কী মনে করে?’
‘আপনার দাদা নিয়ে এলো, আমার তো কোনো উদ্দেশ্য ছিল না কিন্তু আপনার দাদার আমাকে এখানে নিয়ে আসার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না তা আমার জানা নেই।’ বলে অভিজিৎ কাঁধ ঝাঁকাল 1
‘কী করা হয়?’
‘সরকারি চাকরি, বন বিভাগে।’
‘কলকাতায় থাকেন?’
‘কলকাতায়ই বসত ভিটে। জলপাইগুড়িতে চাকরির পোস্টিং।’
‘ছুটি জোগাড় করলেন কী করে?’
‘করতে হলো। পরিবারকেও তো একটু সময় দেওয়া চাই তাই না!’
‘হুম।’
পুরানা পল্টনে হৃদির বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাল বিভা।
হৃদি রেডি হয়ে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল। বিভা গাড়ি থেকে নেমে হৃদিকে অভিজিতের চোখের আড়ালে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার বাপ আমার জন্য এক বডিগার্ড নিয়োগ করছে বুঝছস? এখন বডিগার্ড ঘাড়ে নিয়ে ঘুরতে হবে আমার।
হৃদির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘ওয়াও! জোস তো, বডিগার্ড কি হ্যান্ডসাম?’
‘ধ্যাৎ, হ্যান্ডসাম হোক, আমার কী?’
হৃদি গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা অভিজিৎকে দেখে বলল, ‘ভালো তো দেখতে, হ্যান্ডসাম আছে, হ্যান্ডসাম বডিগার্ডে আমার কোনো প্রবলেম নাই।’ বিভা একটা ধমক দিয়ে ওঠে বলল, ‘আজাইরা কথা বলিস না তো!’
হৃদি নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে অভিজিৎ এর সাথে পরিচিত হলো। পেছনের সিটে ওঠে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর অভিজিৎ বলল, ‘ঢাকার মেয়েরা যে সুন্দরী হয়, এ ফ্যাক্টটা তো আমার জানা ছিল না।’
বিভা দর্পিত গলায় বলল, ‘এবার জানলেন তো? বাহ দারুণ কপাল তো আপনার, প্রথম দিনেই দু’দুটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে পেয়ে গেলেন।’
আমি আপনার বান্ধবীর কথা বলছি, আর আপনি তো কলকাতার মেয়ে, ঢাকার হতে যাবেন কেন?’
বিভা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমি মোটেও কলকাতার মেয়ে নই; আমার জন্ম বাংলাদেশে। আমি বাংলাদেশি।
‘তাতে কী, আপনার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি তো সব ইন্ডিয়ায়।’
‘বাহ অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন দেখছি আমার সম্পর্কে?’
‘হুম জানতে হলো আর কী!’
এরপর বাকি পথটায় হৃদিতার সাথে অভিজিতের খুব ভালো জমে গেল আড্ডা। বিভার পিত্তি জ্বলতে জ্বলতে খাঁক হয়ে গেল। তাতে কারো কিছু আসলো গেল না।
গুলশান গ্লোরিয়া জিন্সে এসে দেখা গেল আকাশ এবং সামি দুটো আলাদা আলাদা টেবিল দখল করে বসে আছে। আকাশের সাথে অমৃতাও আছে। কিন্তু সামিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এদের কাউকে চেনে না। তার হাতে মোবাইল। সে ঘন ঘন কফি শপের প্রবেশ পথের দিকে তাকাচ্ছে। বিভাদের ঢুকতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল, হাই। পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিল। যেন সে এসেছে এখানে ছদ্মবেশে। একটু অসাবধান হলেই ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। বিভারা আকাশদের টেবিলে যোগ দিলো।
সামির মেসেঞ্জারে টেক্সট আসলো, ‘তুমি কোথায়?’
সামি লিখল, ‘যেখানে থাকার কথা।’
উত্তর আসলো, ‘আমিও তো সেখানেই, আমি ব্ল্যাক শার্ট পরে আছি। স্ট্রেইট চুল। হাতে ব্ল্যাক পার্স।
ওই তো সামনের টেবিলেই একটা লম্বা, হ্যাংলা পাতলা মেয়ে পেছন ফিরে বসে আছে। এত লম্বা মেয়ে সামি জীবনে প্রথম দেখল। বাংলাদেশের মেয়েরা সাধারণত এত লম্বা হয় না। ঘাড় অবধি স্ট্রেইট চুল, ব্ল্যাক শার্ট। সামি ভালো করে লক্ষ্য করল, হাতে কালো পার্স আছে কি না। দেখা গেল আছে। বুকটা একটু ধুকপুক করতে লাগল। কাঁপা অন্তর নিয়ে ধীরে ধীরে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল সামি।
সিল্কি চুলের মেয়েটার পেছনে এসে দাঁড়াল সামি, দুরুদুরু কম্পনরত বুক নিয়ে গদগদ গলায় বলল, ‘যাক শেষ পর্যন্ত দেখা হয়েই গেল।’ মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কফিশপের মলিন হলদে আলোয় ওই চেহারাটা দেখে সামি ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুদ্র দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এর মানে কী? যে মেয়েটার সাথে সে গত দুদিন ধরে প্রেম করে আসছে, রাত জেগে কথা বলে আসছে সে মেয়েটা আদতে কোনো মেয়েই নয়? সে রাত জাগানিয়া রহস্যময়ী মানবীটি আসলে বাস্তবে তার বন্ধু রুদ্র?
সামি ঝাঁপিয়ে পড়ে রুদ্রর শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ওই শালা, হারামির বাচ্চা মজা লস আমার সাথে? আইজকা তোর একদিন কি আমার একদিন!’
রুদ্রকে বাঁচাতে আকাশ আর অমৃতা ছুটে আসলো। রুদ্র তো হেসেই বাঁচে না। আর রুদ্র যত হাসে, সামির রাগ তত বাড়ে।
ছোটখাটো একটা সিনেমা হয়ে গেল ওখানটায়। মারামারি হাতাহাতি চলতে থাকল। একটা পর্যায়ে সামিকে জোর জবরদস্তি টেনে হিঁচড়ে আকাশ আর অমৃতা কফিশপের বাইরে নিয়ে আসলো।
ফুটপাতের ওপর দাঁড়াল ওরা। তখন সন্ধ্যে হচ্ছে মাত্র। রাস্তায় তুমুল জ্যাম গাড়িঘোড়ার
সামির গাল লাল। ওর ঔদ্ধত্যপনা দেখে রুদ্রও একটু উত্তেজিত হয়ে গেছে।
আকাশ বলল, ‘যা হবার হয়ে গেছে এখন ভুলে যা ওসব।
রুদ্র বলল, ‘ভাই একটু মজাই তো করলাম, এতে এত রাগ করার কি আছে? আমি আরো ভাবলাম আমারে দেইখা তুই খুশিতে দুই লাফ দিবি, চিটাগাং থেকে চইলা আসছি তোদের সাথে দেখা করার জন্য
‘চুপ থাক হারামজাদা!’ চিৎকার করে ওঠে সামি।
অমৃতা সামির পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে বলল, ‘থাক দোস্ত মাফ কইরা দে ওরে, ভুল করে ফেলছে বেচারা, আর করবে না।’ এটুকু বলে রুদ্রকে ধমক দিলো সে, ‘ওই রুদ্র মাফ চা, মাফ চা সামির কাছে পায়ে ধইরা মাফ চা।’
‘মাফ চাওয়ার মতো কী এমন কাজ করলাম বুঝলাম না।’ রুদ্র ভারী গলায় বলল।
‘কী এমন কাজ করছিস মানে? তুই বেচারার ইমোশন নিয়া ছিনিমিনি খেলছিস।’
রুদ্র সত্যিই পায়ে পড়ল সামির।
‘দোস্ত মাফ কইরা দে, এই ভুল আর হব না।’
সামি মাছি তাড়াল, ‘যা যা ভাগ, ঢং করিস না।’
‘কিন্তু মামা তোমার সাথে প্রেম কইরা আমি চরম মজা পাইছি। একদম সেই লেভেলের মজা’ রুদ্র বলল।
সামি বলল, ‘তোকে এরকম স্ট্রেইট সিল্কি চুলে সত্যিই হিজড়া লাগতেসে, সহ্য করতে পারতেছি না। দয়া করে চুলগুলা ঠিক করে আয়।’
হৃদি আর বিভাও বেরিয়ে আসলো। পেছনে অভিজিৎ। অভিজিৎকে দেখে সামি নাক মুখ কুঁচকে বিভার কানে কানে প্রশ্ন করল, ‘এ বোকা-চোদাটা আবার কে?’
বিভা ফিসফিস করে বলল, ‘বাজে কথা মুখে আনিস কেন খালি? ভদ্র একটা লোককে নিয়ে খারাপ কথা বলছিস কেন?’
‘হাহ্! ভদ্র লোকটার জন্য তো তোমার দরদ উথলে পড়ছে দেখি, তা কী হয় ভদ্রলোকটি তোমার?’
‘আত্মীয় ছোট করে পাশ কাটানো উত্তর দিলো বিভা। যদি অভিজিৎ শুনে ফেলে তো কী ভাববে?
সামি কি জেলাস অভিজিৎকে দেখে? কিন্তু কেন? ভাবনাটা মাথায় আসতেই বিভার ঠোঁটের কোণে দেখা দিলো এক চিলতে হাসি।
কিন্তু না, তা কেন হবে? সামি তো বলেছিল খারাপ ছিল, বাজে ছিল। তাহলে অভিজিৎকে দেখে কেন সে জ্বলবে? বিভাই ভাবছে বেশি। সামির মনের ভেতর কিছু নেই। কোনো গভীরতা নেই। আবেগের বাড়াবাড়ি নেই। কেমন যেন শুকনো খটোমটো ওর মনের ভেতরটা। ইচ্ছে করল কাছে টেনে নিল, আবার ইচ্ছে করল তো দূরে সরিয়ে দিলো পায়ে ঠেলে। এ হচ্ছে সামি
ওরা গুলশানের একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার করল। সময়টা বরাবরের মতোই চমৎকার কাটল। শুধু অভিজিৎ থাকায় কথাবার্তা একটু হিসেবে করে বলতে হলো এই যা।
ফেরার সময় সামি বিভাকে হুমকি দেওয়ার গলায় বলল, ‘এ চিড়িয়াখানার চিড়িয়াকে যেন সেকেন্ডটাইম আমাদের মধ্যে না দেখি। আর আনবি না।’
বিভাও কেটে কেটে উত্তর দিলো, ‘একশবার আনব, আমি চিড়িয়া ভালোবাসি।’
১৮
অমৃতা বাড়ি ফিরে দেখল দীপা কাঁদছে। দীপার আজকাল যেকোনো ছুতোয় কান্নাকাটি জুড়ে দেওয়ার একটা বাজে অভ্যাস হয়েছে। সদ্য এইচএসসি পাশ করেছে সে। কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পায়নি। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথাও নেই। তার ভাবসাব দেখে মনে হয় পড়ালেখাটা একটা নেহাত ফালতু কাজ ছাড়া কিছুই না। কীভাবে ফিগার ভালো থাকবে আর কী মাখলে গায়ের রং ফরসা হবে এ নিয়ে গবেষণা করাই ইহজীবনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ওরা দুবোন একটা ঘর শেয়ার করে। ঘরটা মোটামোটি প্রশস্ত। উত্তরে জানালা। ঘরের ভেতর দুটা খাট, দুটা পড়ার টেবিল। দীপা তার পড়ার টেবিলে মাথা উপুড় করে রেখে কাঁদছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পাশের ঘরে আম্মি কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার খাতা দেখছে। আম্মি একটা বেসরকারি কলেজের গণিতের লেকচারার। অমৃতা দীপাকে কোনো প্রশ্ন না করে আম্মির কাছে গিয়ে বলল, ‘ওর কী হয়েছে? কাঁদছে কেন?’
আম্মি খাতা থেকে মুখ না তুলেই উত্তর দিলো, ‘টাকা চাই তার’
‘কত টাকা?’
‘পাঁচ হাজার।’
‘কী করবে এত টাকা দিয়ে?’
‘বন্ধুদের খাওয়াবে, তার জন্মদিন কাল।’
‘ও’
অমৃতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দীপা আজকাল যাচ্ছেতাইভাবে টাকা খরচ করে এ কথা ঠিক। কিন্তু মেয়েটার জন্মদিন বলে কথা। জন্মদিনের দিন একটা মেয়ে মন খারাপ করে বসে থাকবে, কান্না করবে, এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
আগে প্রতি মাসে তাদের দুবোনকে দু হাজার টাকা হাতখরচ দেওয়া হতো। আব্বু রিটায়ার্ড করার পর থেকে সে হাতখরচের টাকা দু হাজার থেকে কমে হয়ে গেল এক হাজার। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিল আব্বু। কালো টাকা বানাতে পারেনি বলে নিজের আখের ঠিকমতো গোছানো হয়ে ওঠেনি। নিজের জন্য কিছু করে ওঠার আগেই রিটায়ারমেন্টের সময় চলে আসলো। আজীবন সরকারি কোয়ার্টারে থেকেছে তারা। চাকরি যাবার পর ভাড়া বাসায় উঠতে মন চায়নি বলে আব্বু ব্যাংক লোন নিয়ে মোহাম্মদপুরের এ ফ্ল্যাটটি একরকম ঝুঁকি নিয়েই কিনে ফেলল। এখন প্রতি মাসে ফ্ল্যাটের লোন শোধ করতে হয় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। বাড়িতে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এখন আম্মি। কলেজের পাশাপাশি দু একটা টিউশনিও করতে হয় আম্মিকে সংসার চালানোর জন্য। পাশাপাশি আছে আব্বুর পেনশনের টাকা। এ দিয়ে টেনেটুনে চলতে হচ্ছে। হাজার টাকা খরচ করে বন্ধুদের খাওয়ানোর মতো পরিস্থিতি এখন সত্যি নেই।
অমৃতা রোজ গাড়িভাড়া বাবদ সিনিয়রের কাছ থেকে পায় ৩০০ টাকা। প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হতে গেলে কম করে হলেও আরো পাঁচটা বছর এক রকম বিনে পয়সায় গাধার খাটুনি খাটতে হবে। মাঝে মধ্যেই মনে হয়, আইন পড়ে ভুল করল না তো? বিবিএ, এমবিএ করে একটা ব্যাংকে চাকরি নিয়ে নিলে সংসারে কিছু কন্ট্রিবিউট করা যেত। তবে ব্যাংকের চাকরিও আজকাল পাওয়াটা খুব কঠিন। অথবা কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে এইচআর’এ চেষ্টা করতে পারত। নাহ, আসলে অমৃতা আইন ভালোবাসে। আইন তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা। পড়াশোনার কথা মাথায় আসলে আইন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ের কথা ভাবতে পারে না সে।
অমৃতা দীপার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলল, ‘এক কাজ কর বন্ধুদের বাসায় বলে দে, বাসায় রান্না হবে, খরচ কম পড়বে।’
দীপা কান্না মেশানো গলায় হেঁচকি দিয়ে বলে উঠল, ‘আপুনি তুই এসব বলতে আসিস না বুঝেছিস? নিজে তো ঠিকই বন্ধুদের সাথে গ্রান্ড ট্যুর করে আসছিস। আব্বু তোকে সবকিছু দিবে আর আমার বেলায়ই সবসময় না আর না!’
‘আব্বুর কাছ থেকে আমি একটা টাকাও নেইনি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য। বিশ্বাস কর! আমি ইনফ্যাক্ট শুধু একবেলা খাওয়ার বিল দেওয়া ছাড়া আর কোনো টাকাই খরচ করি নাই। আমাদের এক বড়লোক বন্ধু আছে, সামি। তুই তো চিনিস। সে পুরো ট্যুরটা এরেঞ্জ করল।’
‘জানি না অতকিছু, আপুনি আমার ফ্রেন্ডদের কাছে আমার একটা প্রেস্টিজ আছে। এবার একটা ভালো ট্রিট ওদের দিতেই হবে, যে করেই হোক। আমি কী অজুহাত দিবো ওদের? বলব যে আমার বাপের টাকা নাই, আমার বাপ একটা ফকির?’
‘তা কেন বলবি? সিচুয়েশনটা বুঝিয়ে বলতেই পারিস। বলে দে এখন হাতে টাকা নাই, ট্রিট পাওনা থাকল।’
‘অসম্ভব! এটা বললে আমার মান-ইজ্জত কিছু থাকবে না।’
‘বন্ধুদের কাছে আবার অত মান-ইজ্জতের কী আছেরে? আর বন্ধুদের যদি সত্য কথাটাই না বলতে পারিস, তাহলে এমন বন্ধু দিয়ে করবি কী?’
দীপা একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বলিস না তো আপুনি, আমার বন্ধুরা তোর বন্ধুদের মতো ক্লাসলেস না, সবাই বড়লোক বাবার ছেলেমেয়ে। পশ এরিয়ার মানুষজন এরা। যা তা বলা যায় না ওদের।’
অমৃতার মুখে একটা কড়া কথা চলে আসছিল, শেষমেশ সামলে নিল নিজেকে। দীপার বন্ধুভাগ্যটা তার মতো ভালো হয়নি বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য কজনের বন্ধুভাগ্যই বা তার মতো এত ভালো হয়? বন্ধুদের কথা মনে আসতেই এ দুঃসময়েও তার ঠোঁটে একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল। পাগলাগুলো না থাকলে তার জীবনটা যে কী নিরামিষ হতো তা ভাবাই যায় না। দীপা এখনো বন্ধু শব্দটার অর্থ বোঝেনি। আদৌ কোনোদিন বুঝবে কি না কে জানে!
১৯
‘এই যে মশাই, অমন বাঁকাচোখে চোরের মতো তাকিয়ে থাকতে তো আপনাকে বারণ করেছি, তাই না?’ বিভা বলল, প্রায় ধমকের সুরে।
অভিজিৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠে বলল, ‘ও সরি!’
এরপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে যেন সাহস সঞ্চয় করল বুকে, বলল, ‘কেন? তাকাতে দোষ কোথায়?’
‘তাকাতে দোষ নেই, কিন্তু চোরের মতো তাকানোতে দোষ আছে।’
‘মোটেও আমি চোরের মতো তাকাচ্ছিলাম না, জাস্ট দেখছিলাম।’
বিভা যেন খুব বোঝা বুঝেছে এমন গলায় বলল, ‘ও আচ্ছা! দেখছিলেন? তা কী দেখছিলেন আপনি? আমার রূপ?
অভিজিৎ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘মোটেও না! বরং দেখছিলাম কয় কেজি আটা ময়দা মুখে মেখেছেন, আর রূপ তো আটা-ময়দার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, দেখার কোনো উপায় নেই।’
বিভা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
‘ওসব মাখার কোনো প্রয়োজন আমার নেই বুঝেছেন? আমি এমনিই সুন্দর।
‘নিজের সম্পর্কে দেখছি আপনার খুবই উচ্চধারণা। ভালো, সেলফ রেস্পেক্ট থাকা ভালো!’
বিভার মুখখানা অপমানে থমথম করে উঠল।
ওরা লিফটের জন্য অপেক্ষা করছে এপার্টমেন্টের লবিতে। গুলশান থেকে মাত্র ফিরল। লিফট এখন তিনতলা থেকে দোতলায় নামছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওদের সমতলে অবতীর্ণ হয়ে নিমেষে দরজা খুলে যাবে। রাত হয়ে গেছে বলে এদিকটায় শুধু সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া অন্য কোনো জনমানব নেই। লিফটের দরজা খুলে গেলে দুজন ঢুকে পড়ল যান্ত্রিক বাক্সটার ভেতর। বিভা তিন নম্বর বোতামটা প্রেস করল।
‘আপনার বন্ধুদের কিন্তু বেশ লাগল।’ অভিজিৎ প্রসঙ্গ পাল্টাল।
‘বেশ লাগার মতোই তো ওরা। কম লাগার তো কোনো চান্স নেই।’
‘তা বটে, আপনি আপনার বন্ধুদের খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
‘খুব!’
‘আচ্ছা! এদের মাঝে কোনো বিশেষ বন্ধু আছে নাকি?’
‘বিশেষ মানে? এরা প্রত্যেকেই আমার কাছে অনেক অনেক স্পেশাল!’
‘না মানে, বলতে চাইছিলাম, ইয়ে… আপনার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?’
‘থাকলেই বা আপনাকে বলব কেন?’
বিভার উত্তরে অভিজিৎ একটু কোণঠাসা হলো। নেতানো স্বরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ফেয়ার এনাফ! আমাকে কেন বলবেন!’
সম্মুখের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে আসল দুজন। ফ্ল্যাটে ঢুকেই বাবা-মা, দাদা আর বৌদি একযোগে প্রশ্ন করল ‘কেমন কাটল দিনটা?’
ঠিক সে সময় বিভার মনে প্রথমবারের মতো ঢং করে অশনিসংকেতের ঘণ্টাটা বাজল। ঘটনা কী? সবাই এত উদগ্রীব হয়ে আছে কেন তাদের মতামত জানার জন্য? বিভা ভেতরে ভেতরে এলোমেলো হতে থাকল। কোনো রকমে ‘ভালো ছিল’ বলে নিজের ঘরে গিয়ে লুকালো সে।