বৃষ্টি পড়ার দিনে
‘এই তুই বেরিয়ে গেছিস?’
‘না, বেরচ্ছি, তুই কোথায় বল তো?’
‘আমি… একটা কথা বলার ছিল তোকে৷’
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনও উত্তর আসে না৷ কিছু একটা আন্দাজ করেই আর প্রশ্ন করে না নিলয়৷ একটা ভারী দমকা বাতাস তাকে খবর দিয়ে যায়, ওপাশের মানুষটার মন ভালো নেই৷
‘আমি মনে হয় আজ যেতে পারব না…’
দমকা বাতাসটা আরও ঘন হয়ে ওঠে, ‘মানে? আমি তো রেডি হয়ে গেছি৷’
‘আমিও হয়েছি৷ এখন এটা পরেই থাকব৷ কিন্তু বাবা আজ বেরতে দেবে না৷’
‘অদ্ভুত লোক তো মাইরি৷’ নিলয় সামনে জুতোর র্যাকের উপরে একটা জোরালো ঘুসি মারে, ‘এরকম পুজোর দিনেও মেয়েকে আগলে বসে থাকবে!’
‘আমি আগেই জানতাম এসব লাফড়া হবে৷ এমনিতেই বাবা একটু কনজারভেটিভ৷
পুজোর দিনে ছেলেমেয়েদের ঘোরাঘুরি করা একদম পছন্দ করে না৷ তার উপরে আকাশের অবস্থা দেখেছিস?’ পাশেই ছোটো জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চায় নিলয়৷ গুম হয়ে আছে আকাশের মুখটা৷ যে কোন সময় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে৷ আকাশটাও যেন ইন্দিরার বাপের মতোই গোমড়ামুখো৷ এই ভরা শীতকালে বৃষ্টি নামাতে হবে, তার উপরে আজই, সরস্বতীপুজোর দিনে৷
আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে নীচে তাকায় নিলয়৷ ওদের বাড়ির সামনেটায় একটা ছোটো পার্ক আছে৷ জানলা দিয়ে তাকালে তার গেটটা চোখে পড়ে৷ সেখান থেকে ছেলেমেয়ের দল ঢুকছে কিংবা বের হচ্ছে৷ তাদের সবার গায়েই হয় শাড়ি না হয় জিন্স আর পাঞ্জাবি৷ লাল, হলদে, নিলয় আর ময়ূরকণ্ঠী রঙ্গে উজ্জ্বল শরীরগুলো যেন বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে দৃশ্যটাকে৷ সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিলয়ের মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল৷ ইন্দিরা আজ আসবে না৷
‘এই, মন খারাপ হল তোর?’
বাইরে গড়গড় করে মেঘ ডেকে উঠল৷ শেষ শব্দগুলো ঢাকা পড়ে গেল তাতে৷ সে আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে আসতে পারবি না? আজ সারাদিন আমাদের প্ল্যান ছিল…’
‘বাবা ভুজুং ভাজুং-এ ভোলার বান্দা নয়৷ জোর করতে গেলে… এই তোর পিটি ক্লাসে আমার কাঁধের কালশিটেগুলোর কথা মনে আছে? ওগুলো আগের বছরের দাগ, বেল্ট দিয়ে কেলিয়েছিল৷ এখনও ওঠেনি৷’
‘কেলিয়েছিল কেন?’
‘রাতে বাড়ি ফিরিনি৷ ফোন করে বলেছিলাম শরণ্যার বাড়ি থেকে যাচ্ছি, শরণ্যার মা নিজে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল, তখন কিছু বলেনি৷ বাড়ি ফিরতেই… বলেছিল অন্যের বাড়িতে যারা রাত কাটায় তারা ভদ্র মেয়ে নয়…’
বিড়বিড় করে কী যেন বলল নিলয়৷ সেটা ইন্দিরার কানে গেল না৷ পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা নিপুণ হাতে ভাঁজ করা কাগজ বের করে আনল সে৷ তারপর ভাঁজ খুলে চোখে সামনে ধরল সেটা৷
কাগজে এক, দুই, তিন করে একটা লিস্ট তৈরি করা আছে৷ একদিকের কলামে কিছু জায়গার নাম, তার ঠিক পাশে পাশে কিছু কাজের নাম৷ এটাই ওদের আজকের বাকেট লিস্ট ছিল৷ যেসব নিয়ম রোজ মেনে চলতে হয় তাদের আজ তাদের মধ্যে কয়েকটা ভেঙে ফেলবে৷ আজ নিয়ম ভাঙার দিন…
সারাদিনে বাইরে ঘুরে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় কিছু নির্দিষ্ট কাজ করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল৷ আপাতত সেই সাদা কাগজের উপরে ভারী মেঘ ঘনিয়ে এসেছে৷
‘এই কাগজটার কী করি এবার? ফেলে দিই?’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে ওপাশের মানুষটা৷ তারপর বলে, ‘এই মন খারাপ করিস না প্লিজ৷ আমার কি ভালো লাগছে? বল৷ শোন, আমার কাছে একটা মাস্টার প্ল্যান আছে৷’
‘কী রকম প্ল্যান?’
এমন সময় ইন্দিরার গলার আওয়াজের সঙ্গে মিশে একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়৷ তড়িঘড়ি সে বলে ওঠে, ‘এই বাবা আসছে৷ একটু পরে কল করছি৷’
***
ফোনটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে রেখে দরজার দিকে চেয়ে সোজা হয়ে বসে ইন্দিরা৷ একটু দূরেই বীণাটা পড়ে আছে৷ আজ সকাল থেকে প্যাকটিসে বসেছিল সে, বাবার মন গলানোর জন্য৷ হয়তো গলেও যেত৷ কিন্তু হতভাগা বৃষ্টিটা এসেই সব মাটি করে দিল৷ আর কিছুতেই বাইরে বেরনো সম্ভব নয়৷
‘এ কী! এত সাজগোজ করেছিস কীসের জন্য?’ ইন্দিরার দিকে চেয়ে সমরেশ রুঢ় স্বরেই বলে উঠল৷
‘ওই…’ খাবি খায় ইন্দিরা, ‘ওই বন্ধুরা বলছিল একটু বেরবে আজ৷’
‘বেরবে?’ একটা বাঁকা হাসি হেসে ঘরের ভিতরেই পায়চারি করতে থাকেন সমরেশ, ‘তোদের বয়সে বেরনোর অর্থ কী আর আমি বুঝি না ভেবেছিস? ছিঃ, এখনও স্কুল কলেজের গন্ডি পার হয়নি, এর মধ্যেই হাত ধরাধরি করে…’
ইন্দিরার বাকেট লিস্টের কথা মনে পড়ে যায়৷
হুম, তাতে হাত-টাত ধরার কথা লেখা ছিল বটে৷
মেয়ের কাছে এগিয়ে আসেন সমরেশ, ‘সরস্বতী বিদ্যার দেবী৷ আজকের দিনে বরঞ্চ মনে দিয়ে প্রার্থনা করো তার কাছে৷ যাতে লেখাপড়ায় একটু মতি আসে…’ ইন্দিরার লেখাপড়ায় মতি ছোটো থেকেই আছে৷ স্কুলে বরাবরই এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকে সে৷ দুর্দান্ত ছবি আঁকতে পারে, ইদানীং বীণা বাজানোর তালিম নিচ্ছে বাড়িতে, ভালো গানও গাইতে পারে৷ তবে এর মধ্যে সব থেকে আশ্চর্যের যে ক্ষমতাটা আছে তার সেটা হল গল্প বলা৷ একের পর এক শব্দ সাজিয়ে এমন নিখুঁত বর্ণনায় সে গল্প বলতে পারে যে মনে হয় চোখের সামনে সিনেমার পরদার মতো পরপর দৃশ্য ফুটে চলেছে৷
‘ঠাকুরমশাই পুজো করে চলে যাচ্ছেন৷ যা প্রণাম করে আয় একবার…’ মেয়েকে নির্দেশ দেন তিনি৷
ইন্দিরা কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ে৷ প্রণাম করে ফেরার পথে ডাইনিং-এর এক কোণে সদ্য পুজো হওয়া সরস্বতীর মূর্তিটা চোখে পড়ে তার৷ গাঁদা ফুলের মালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জায়গাটায়৷ মূর্তির ঠিক পাশেই ডাঁই করে রাখা ইন্দিরার ক্লাসের বইখাতা৷ তার উপরেও কয়েকটা ফুল পড়ে আছে৷ দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় এতক্ষণের পুজাআচ্চার ধকল সামলে তিনিও যেন খানিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন৷
সরস্বতীর পায়ের কাছে মাথা ঠেকায় ইন্দিরা৷ তারপর উঠে এসে আবার নিজের ঘরে ঢুকে বসে পড়ে৷ বীণার উপরে মিহি আঙুল বোলাতে থাকে৷
‘আজ তো পড়াশোনা বন্ধ৷’ সমরেশ দরজাটা বাইরে থেকে টানতে টানতে বলে, ‘আজ একটু বাড়ি বসে গানবাজনা কর না হয়৷’ ইন্দিরা কিছু বলে না৷ দরজাটা বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবে সমরেশ৷
মেয়ের আচরণে সপ্তাহ খানেক হল কীরকম একটা বদল এসেছে৷ এই বয়সের মেয়েদের এমন বদলে মোটেই শুভ সঙ্কেত নন৷ দরজাটা ইচ্ছা করেই বাইরে থেকে লক করে দেন তিনি৷
‘বুড়ো চলে গেছে?’
‘আঃ, নিলয়৷ বাবা হয় আমার৷’
‘বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে মেয়ের গায়ে কালশিটে ফেলে দেয় এ কেমন বাপ৷’
‘সবার বাড়ির লোক একরকম হয় না৷ ছাড় ওসব, তুই কোথায় আছিস এখন?’ রাগে গজগজ করে নিলয়, রাগটা ঠিক কার উপর সে নিজেও বুঝতে পারে না, ‘কোথায় আর যাব৷ পাঞ্জাবি পরেছিলাম৷ এখন ধড়াচুড়ো খুলছি সব৷’
‘উঁহু…’ বাধা দিয়ে ওঠে ইন্দিরা, ‘কিচ্ছু খুলতে হবে না৷ তুই আমাদের বাকেট লিস্ট ফলো কর৷ ঠিক যেখানে যেখানে যাওয়ার ছিল…’
‘তুই আসছিস?’ চকিতে প্রশ্ন ভেসে আসে৷
‘না, আমার অসম্ভব৷ বাইরে থেকে লক করে গেছে৷’
‘তাহলে আমি গিয়ে কী করব?’
পরের উত্তরটা আসে প্রায় আধ মিনিট পরে, ‘গিয়ে আগে একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজবি, তারপর সেখানে বসে ফোনটা ধরে রেখে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বুজবি৷’
‘তাতে কী হবে?’ অবাক প্রশ্ন করে নিলয়৷
‘বাবা বলে আমি সরস্বতীর বরকন্যা৷ আমি গল্প বললেই সেটা সত্যি মনে হয়…’
বাকিটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না নিলয়ের৷ সে একটু ইতস্তত করে বলে, ‘কিন্তু তাতে কী হবে, তুই তো আসবি না৷’
এবার কঠিন গলা শোনা যায়, ‘আর কোনও উপায় জানা আছে তোর?’ নিলয় উত্তর দেয় না৷
‘ভেবে দেখ, আমরা ঠিক যে জামাকাপড় পরব ভেবেছিলাম তাই পরে থাকব, যে জায়গাগুলোতে যাব ভেবেছিলাম সেখানেই যাব, যা করব ভেবেছিলাম তাই করব, কিন্তু তুই সত্যি সত্যি যাবি আর আমি থাকব গল্পে… গল্প ছাড়া এখন আর কী আছে বল আমাদের কাছে? তাছাড়া…’
‘তাছাড়া কী?’
কিছু একটা যেন লুকিয়ে ফেলে ইন্দিরা৷ ঢোঁক গিলে বলে, ‘তুই রাজি কি না বল৷’
‘রাজি…’
‘বেশ, আমি একটা ছবি পাঠাচ্ছি আমার, তোর ভাবতে সুবিধা হবে…’
ফোনটা পকেটে গুঁজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নিলয়৷ এতক্ষণে মেঘের দল আর একটু জমাট বেঁধেছে৷ পার্কের গেটটা সেই ছাই রঙের ব্যাকড্রপে ভরে আছে বসন্ত বাহারে৷ বৃষ্টির হুমকি উপেক্ষা করেই একপাল ছেলেমেয়ে ভিড় করে আছে সেখানে, প্রায় সকলের মুখেই অদ্ভুত লাজুক একটা হাসি৷ কেউকেউ একে অপরের হাত ধরে আছে৷ একজন পিছিয়ে পড়লে হাঁটার বেগ কমিয়ে বাড়িয়ে পাশাপাশি এসে পড়ছে তারা৷
হঠাৎ নিলয়ের মনে হয় ওর থেকে একটু দূরেই কালচে সবুজ শাড়ি পরা রোগাটে গড়নের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ ঠিক ওইরকম লাজুক একটা হাসি৷ অপেক্ষা করছে ওর জন্য৷ নাঃ, গল্প ছাড়া আর কল্পনা ছাড়া কিছুই জুটবে না আজ ওদের ভাগ্যে৷ কিন্তু সেই বা খারাপ কী? মৃদু হেসে, বাকেট লিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পা বাড়ায় নিলয়৷
রিক্সাটা এসে দাঁড়ায় স্কুল বাড়ির সামনে৷ মধ্য কলকাতার একটা নাম করা বয়েজ স্কুল৷ ক্লাস ইলেভেন থেকে কোয়েড৷ দোতলা বিল্ডিং, কিন্তু অনেকটা জুড়ে ছড়ানো৷ ছোটো একটা উঠোন পেরিয়ে এলে প্রশস্ত দরজা চোখে পড়ে৷ সেটার উপর থেকে এখন কয়েকটা চাঁদমালা ঝুলছে৷ পুজোর ফুলের গন্ধ আর কিশর কিশোরীদের হইচইয়ে ভরে আছে জায়গাটা৷
রিক্সায় আসতে আসতে ভারী অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছে নিলয়ের৷ সারাক্ষণই মনে হয়েছে একটা অচেনা মানুষ যেন বসে রয়েছে রিক্সায় ওর পাশের সিটে৷ মিহি মেক আপ আর রাতে ফোটা সাদা কোন ফুলের গন্ধ যেন তাড়া করেছে ওকে সমস্ত পথ৷ ব্যাপারটা এতটাই প্রবল যে রিক্সার একদিকে সেঁটে বসেছিল ও৷ হেঁটে স্কুলের ভিতরে ঢুকে এল নিলয়৷ এমন রঙিন সাজে স্কুলটাকে বছরের এই একদিনই দেখা যায়৷ চত্বরের ভিতরে ঢুকতেই দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷
একদিক থেকে ফ্রায়েড সবজি আর ভাজা বেগুনির গন্ধ এসে মাতিয়ে তুলেছে চাতালটা৷ অন্যদিকে একটা পরিচিত রবীন্দ্রসংগীত বাজছে৷ চাতালের একেবারে মাঝখান বরাবর পুজো হয়েছে৷ ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকে কেউ মূর্তির দিকে আবার কেউ টিচার্স রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রণাম করছে৷
এসব কোনও কিছুর ধারই ধারল না নিলয়৷ ইলেভেনের ক্লাসটা দোতলায়৷ সিঁড়ি বেয়ে সেখানেই উঠে এল সে৷ বাকেট লিস্টে এটাই তাদের ফার্স্ট টার্গেট, ইলেভেন-এর ক্লাসরুম৷ ক্লাসরুমটা আপাতত ফাঁকা৷
ভিতরে ঢুকে একটা বিশেষ বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল নিলয়৷ তারপর বেঞ্চের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে বসে টেবিলের উপরে মাথা রেখে চোখ বুজল৷
‘এবার বল, এখানে আসবি বলেছিলি কেন?’
মাথা তুলে একটু হাসল নিলয়৷ ইন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, ‘এটা তো ক্লাসরুম, এখানে তো রোজ দেখিস আমাকে৷’
‘আজ তো দেখার জন্য আনিনি, পাশে বসার জন্য এনেছি… এই যে এক্স্যাকটলি এখানে…’
‘পাশে…’ ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলে ইন্দিরা৷ ইলেভেনে ওরা একই সেকশনে পড়ে বটে, কিন্তু স্কুলের কড়া নিয়ম৷ ক্লাসরুমের দু-পাশে দু-সার বেঞ্চ৷ মাঝখানে আইল৷ একপাশে ছেলেরা বসে, অন্যপাশে মেয়েরা৷ এই নিয়মটা নিয়ে এতদিন কোনও অসুবিধা ছিল না নিলয়ের৷ কিন্তু ইন্দিরা ইলেভেনে জয়েন করার পর থেকেই ব্যাপারটা একেবারে ভালো লাগে না ওর৷ বাকেট লিস্ট বানানোর আগে এই ব্যাপারটাকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ওরা৷ এই ছোটোছোটো বেঁধে রাখার নিয়মগুলো ভেঙে ফেলা৷ আজ একসঙ্গে একই বেঞ্চে বসলে কেউ কিছু বলার নেই৷ নিয়ম ভাঙায় এক বিজাতীয় আনন্দ আছে৷
ওর পাশে এসে বসে পড়ল ইন্দিরা৷ চুলগুলোকে বিছিয়ে নিল পিঠের পেছনে৷ দু-জনের কেউ আর কোনও কথা বলল না৷
এতক্ষণে বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নেমেছে৷ ওদের ক্লাসরুমের একদিকের দেওয়াল জোড়া লম্বা কাচের জানলা৷ সেখান থেকে বাইরের পিচের রাস্তাটা দেখা যায়৷ সেদিকে চেয়ে নিলয় বলল—
‘যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম তখন সত্যি খুব রাগ হচ্ছিল বৃষ্টিটার উপরে, এখন বুঝছি… বৃষ্টিটাও আমাদের মতোই একটা এজেন্ডা নিয়েছে…’
‘কী রকম?’
ওর দিকে মুখ ফেরায় নিলয়, ‘কী রকম মানে? তুমি যত বড়োই ঘুঘু হও না কেন, বৃষ্টি পড়লে তোমাকে নিয়ম পালটাতেই হবে৷ ছাতা, রেনকোট নিয়ে বেরতে হবে৷ যদি রাস্তায় থাকো তাহলে শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, ছাদ থেকে অসময়ে জামাকাপড় তুলে আনতে হবে, বৃষ্টির থেকে বেশি নিয়ম ভাঙা আর কী আছে…’
‘তার উপরে শীতকালের বৃষ্টি, ভাব…’ কথাটা বলেই কী যেন মনে পড়ে ইন্দিরার, ‘তোর মনে আছে আমাদের প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল?’
নিলয় হাসে, ‘কাকভেজা হয়ে ক্লাসে ঢুকেছিলি সেদিন৷ চুলগুলোর যে কী অবস্থা হয়েছিল…’
‘তুই চুলের কথা ভাবছিস৷ আমার ঠান্ডা লাগার ধাত আছে, এদিকে সেদিন প্রথম দিন, ছুটতে ছুটতে স্কুলে ঢুকে…’
‘বর্ষার প্রথম বৃষ্টি ছিল সেদিন, এই দোতলার ক্লাসরুমেও মাটির গন্ধ আসছিল৷ তোর চুল থেকে জল পড়ছিল টপটপিয়ে৷ অন্য কোনওদিকে মন ছিল না তোর৷ আমারও অন্য কোনওদিকে মন ছিল না৷ চুলগুলো একহাতে ধরে বসার মতো একটা ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজছিলি তুই৷ ভীষণ অস্থির তোর চোখদুটো৷ আমাকেও কেমন একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরছিল… ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি এই ক্লাসরুমটা, অথচ মনে হল এভাবে কোনওদিন দেখিনি… এরপর যতদিন এই ক্লাসরুমে আসব ওই মুহূর্তটাকে খুঁজব…’
‘আমিও খুঁজব, এতগুলো ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে থাকা ছেলেমেয়ের চোখের মধ্যে তোর চোখদুটো৷ তোর পাশের বেঞ্চটা ফাঁকা ছিল না সেদিন, নারে?’
‘উঁহু, ফাঁকা থাকার নিয়ম ছিল না৷ সেদিনই ভেবেছিলাম, আজকের দিনটা আসবেই একদিন৷ যেদিন আর নিয়ম থাকবে না…’
নিলয় হঠাৎ অনুভব করে ওর হাতের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে৷ ওর দুটো চোখ বন্ধ, অথচ মনে হচ্ছে যেন একটা আলগা হাত অজান্তেই সরে এসেছে ওর হাতের কাছে, এত নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারপাশ যে বিপরীতে বসে থাকা মানুষটার চোখের পাতা ফেলার শব্দ বুঝি শোনা যাবে৷ এবং সেই শব্দের অনুপস্থিতিই বলে দিয়ে যায় সে চোখের পাতা পড়ছে না৷ সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে নিলয়ের মুখের দিকে৷
‘নিলয়…’
‘বল…’
‘আমার মা-কাকিমারা বলে প্রথম প্রেম কারও টেকে না৷ আজ থেকে দশ বছর পরে যদি আর আমরা একসঙ্গে না থাকি? সারাজীবন একসঙ্গে থাকা না হয়?’
নিলয় চোখ বুজেই হাসে, ‘তুই তো এখনও আমার সঙ্গে নেই…’
‘আরেঃ, সে থাকার কথা বলছি না৷ যদি…’
‘গল্পগুলো থেকে যাবে৷ তুই শোনাবি আমাকে গল্পগুলো, এইভাবে৷ আবার ফিরে আসব আমরা…’
একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস কানে আসে, ‘ধুর, তুই কত সহজে মেনে নিচ্ছিস সব৷ আমার তো ভেবেই কেমন লাগছে৷’
‘তো ভাবিস না, আর শোন, তোর মা-কাকিমাদের বলে দিস৷’
‘কী বলব?’
‘এই পৃথিবীতে সবকিছু নিয়ম মেনে হয় না৷’ কথাটা বলেই নিলয় অনুভব করে ওর মুখের উপরে একটা ছায়া ঘন হয়ে এসেছে৷ যেন ওর মুখের উপর জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছাঁট ঢেকে দিয়েছে অন্য একটা মানুষের মুখ৷ একটা হাত তুলে ধরে সেই মুখটা স্পর্শ করতে চায় সে৷ চোখ খোলে…
ফাঁকা ক্লাসরুম, কেউ নেই ঘরে৷ তাও চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় সে৷
‘কথা বলছিস না যে…’ ফোনের ওপাশ থেকে ইন্দিরার শোনা যায়৷
‘আশ্চর্য… মনে হল তুই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস৷ একটা ছায়া পড়েছিল আমার মুখের উপর৷ ভূতুড়ে ব্যাপার মনে হচ্ছিল…’
‘বলেছিলাম না, আমি গল্প বললে…’
‘সে বুঝেছি, কিন্তু…’
‘কোনও কিন্তু নয়৷ তোর ডেস্কটা দেখ তো একবার৷’
‘আমার ডেস্ক!’ একটু অবাক হয়ে বলে নিলয়, ‘সেতো ফাঁকা থাকার কথা৷’
‘আঃ, একবার দেখতে কী হয়েছে তোর?’
বোকার মতো ঝুঁকে পড়ে নিজের ডেস্কের ভিতরে মুখ বাড়ায় নিলয়৷ লম্বা মতো কী যেন একটা পড়ে আছে ভিতরে৷ হাত বাড়িয়ে জিনিসটা টেনে বের করে আনে নিলয়৷ এবং আনতেই অবাক হয়ে যায়, একটা ছোটোখাটো চেহারার ফোল্ডিং ছাতা৷
‘ছাতা?’ অবাক হয়ে যায় সে৷
‘বৃষ্টির দিনে বাইরে বেরলে যেটা সব থেকে বেশি দরকার৷ আমি জানতাম তুই নিবি না৷’
‘কিন্তু এটা যে এখানে আছে তুই… তাছাড়া এখানে ছাতা এলই বা কী করে?’
‘এই বাবা আসছে৷ রাখছি৷’
ফোনটা কেটে যেতে হতবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে নিলয়৷ নীচ তলা থেকে বেগুনির গন্ধ আসছে এখন আবার৷ খোলা দরজা দিয়ে বাইরের কিছু ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ ও যে ক্লাসরুমের ভিতরে একা একা এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসেছিল সেটা দেখেই মনে হয় অবাক হয়েছে ওরা৷
কী যেন একটা মনে হয় নিলয়ের৷ এতক্ষণ সত্যি চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছিল ইন্দিরাকে৷ এখন সে আর নেই কোথাও৷ একটা মানুষের সঙ্গে সারাদিন কাটানোর পর তার বলেকয়ে বাড়ি চলে যাওয়া আর মুহূর্তে ধুলোটে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যে ভীষণ তফাত৷ নিলয়ের মনে হল এতক্ষণ যেন সে ছিলই না৷ হঠাৎ করেই ছাদ ফুঁড়ে অন্য একটা পরিবেশে এসে নেমেছে সে৷
একইরকম রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে, বৃষ্টির ঝিরঝিরে শব্দ, স্কুলের গন্ধ, কাটা ফল আর জলে ভেজা ফুলের গন্ধ, সব একই আছে৷ একটা মানুষের থাকা না থাকা সব কিছুর মধ্যে কি তফাত গড়ে দেয়, না?
***
ডাইনিং-এ ভিজে ছাতাটা মেলে দিয়ে সমরেশের ঘরের দিকে এগিয়ে আসে অরুনিমা৷ একটা আরামকেদারায় পিঠ এলিয়ে দিয়ে বসে আছে সমরেশ৷ কী যেন ভেবে চলেছে সে৷ অরুণিমা যে ঘরে ঢুকেছে সেটা খেয়ালই করেনি৷
‘কী এত ভাবো বলো তো আজকাল?’
সমরেশ মুখ ফিরিয়ে একবারে স্ত্রীকে দেখে নিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে৷ ক-দিন থেকেই কী যেন হয়েছে ওর?’
‘কী হয়েছে মানে?’
‘এই বয়সে যা হয় সাধারণত৷ কোচিং থেকে দেরি করে ফিরছে৷ ক্লাস হোক না হোক, স্কুল যাওয়ায় বাড়তি উৎসাহ৷ তোমার কথাতেই কো-এড স্কুলে ভর্তি করলাম… এখন বুঝছ তো?’
‘সারাজীবন মেয়েকে অমন কোলে করে আটকে রাখা যায় না, বুঝলে?’
‘তাহলে ছেড়ে দাও, আর কী…’
অরুণিমা দীর্ঘশ্বাস নেন একটা৷ চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, সমরেশের কঠিন গলা শোনা যায়, ‘যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু আমি যদি জানতে পারি আমার চোখের বাইরে মেয়ে কোনও বাঁদরামি করেছে৷ আমি কিন্তু ছাল তুলে নেব ওর…’
ঝিলের উপরে দুপুরের রোদ পড়ে আছে৷ ঝুঁকে থাকা গাছগুলো থেকে পাতা গড়িয়ে পড়ছে টুপটাপ৷ এই ঝিলের লাগোয়া মাঠের উপরে একটা প্রাইমারি স্কুল৷
ওখানেই ফোর অবধি পড়েছে নিলয়৷ একসময় এই মাঠে ক্রিকেট খেলেছে প্রচুর৷
মাধ্যমিকের পরে আর নিয়ম করে খেলা হয় না৷ কিন্তু এই ঝিলের ধারে এলেই সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়৷
পাড়ে বসে জলের ভিতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারা মাছগুলোকে দেখছে নিলয়৷ ওর ঠিক পাশেই বসে আছে ইন্দিরা৷ স্পর্শ লাগছে না একবারও৷
‘ছাতাটা…’
‘উফ৷ এটা ছাড়া আর প্রশ্ন নেই, না?’
বিরক্ত হয় ইন্দিরা, ‘কাল আলপনা দিতে গেছিলাম স্কুলে, তখনই রেখে এসেছিলাম৷ জানতাম তুই ছাতা নিয়ে বের হবি না…’
‘কিন্তু তুই কী করে জানলি বৃষ্টি হবে?’
অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিলয়ের দিকের তাকায় ইন্দিরা,
‘এখানে কেন এনেছিস বল আগে, কী আছে এখানে?’
‘তেমন কিছু না, ওই মাঠে আমি ক্রিকেট খেলতাম ছোটোবেলায়… তখন প্রাইমারিতে পড়তাম তো, দাদারা খেলতে নিত না আমায়৷ আমি হতাশ হয়ে টিফিন টাইমে এই ঝিলের ধারে এসে বসতাম৷’ ঝিলের জলের দিকে আঙুল দেখায় নিলয়, ‘আর প্রতিবার ওই মাছগুলো ঠিক ওইভাবে জল থেকে উঁকি মারত৷ ওরাই আমার বন্ধু ছিল…’
‘আচ্ছা, মানে আজ আমাকে ওদের দেখাতে এনেছিস?’
‘উঁহু, তোকে দেখাতে এনেছি৷ তুই আমার নতুন বন্ধু…’
ইন্দিরার থুতনিতে একটা হাসির রেখা দেখা যায়, ‘পাগল, তুই জানিস মাছ কতদিন বাঁচে?’
‘জানি, কিন্তু ওরা অন্য মাছ…’ জলের দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দেয় নিলয়, ‘ওরা অনেক দিন বাঁচে…’
ইন্দিরা কী যেন ভাবতে থাকে, ‘কিন্তু এর মধ্যে নিয়ম ভাঙার কী আছে বল তো?’ নিলয় ওর দিকে মুখ ফেরায়, ‘এখানে আমি একা বসতাম এতদিন৷ এই প্রথম আমি একা বসে নেই৷’
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে জলে৷ বড় মাছেরা ঘাই মেরে যাচ্ছে৷ নরম ফোঁটায় বৃষ্টিও পড়ছে৷ নিলয়ের মাথায় ছাতা৷ চোখ বন্ধ… জলের ছলছল আওয়াজ যেন মন দিয়ে শুনছে সে৷ মাথার ভিতর মৃদু গান বাজতে শুরু করেছে এখন… ‘কী অদ্ভুত না?’
‘কোনটা অদ্ভুত?’
‘আমি এখনও একাই আছি, কিন্তু মনে হচ্ছে না একা৷’
‘আমারও মনে হচ্ছে এই ঘরটায় আমি একা নেই…’
এ জায়গাটার আশেপাশে অনেকগুলো স্কুল থাকায় রাস্তাটা দিয়ে মাঝে মাঝেই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ তাদের কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না ঘাটটার দিকে৷ অন্য ঘাটের তুলনায় এটা ভাঙাচোরা ধরনের৷ পুকুরটাকে ঘিরে থাকা ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর বারান্দা থেকে শুকাতে দেওয়া জামাকাপড় ঝুলছে, কোনওটার বা জানলার টবে চারাগাছ সবুজ পাতা মেলে বাইরের বড়ো গাছটাকে হাতছানি দিচ্ছে৷
হঠাৎ করেই ওর পাশ থেকে উঠে পড়ে ইন্দিরা৷ ঘাটের যে সিঁড়িটা জলে নেমে গেছে তার উপরে গিয়ে দাঁড়ায়৷ তার গোড়ালি ভিজে যায় জলে৷ হাতের মুঠোয় অল্প জল তুলে ছিটিয়ে দেয় নিলয়ের দিকে৷ চুড়ির রিনরিন শব্দও পাওয়া যায়৷ নিলয় চোখ বুজেই ভাবার চেষ্টা করল৷ ওকে মাঠ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে দাদারা৷ ও মন খারাপ করে এসে বসেছে ঝিলের ধারে, পাশে বসে আছে ইন্দিরা৷ ঠিক একইভাবে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে সে৷ ওর আর খেলতে নেওয়া হয়নি বলে মন খারাপ হচ্ছে না৷
এই যে ব্যাকরণের ছকভাঙা কিছু একটা আছে ইন্দিরার মধ্যে, জীবনের সমস্ত শূন্যস্থান ওকে দিয়ে পূরণ করে নেওয়া যায়৷ আরও কত না পাওয়া জমে আছে… ‘মাঝে মাঝে আমিও ভাবি জানিস…’
‘কী ভাবিস?’
‘ওই যেটা তুই বলছিলি৷ দশ বছর পড়ে যদি আর আমরা একে অপরকে না চিনি৷ কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চাকরি, কতকিছু আসবে জীবনে… যদি আমরা অন্যরকম হয়ে যাই? তখন হয়তো তোর বাড়ি এত কনজারভেটিভ থাকবে না, আমি বৃষ্টির দিনে বেরলে ছাতা নিয়েই বেরব…’
নিলয়ের মনে হয় ওর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী একটা বের করে আনল ইন্দিরা৷ সেই বাকেট লিস্টটা, তারপর সেটা ওর কোলের উপরে ফেলে বলল, ‘তাহলে লিখে রাখ এখানে… আজ থেকে দশবছর পরে আবার এই সরস্বতী পুজোর দিনে এই পুকুরপাড়ে আবার আমরাই এসে বসব৷’
‘ব্যস! আর তাতেই হয়ে যাবে?’
‘নাতো…’ ইন্দিরা মাথা নাড়ে, ‘শুধু সেদিন আর আজকের মাঝের এই দশটা বছর যত্ন করে রাখতে হবে কাগজটাকে৷ যেমন আজ আমি আসতে পারিনি বলেই তুই ফেলে দিসনি, তেমনি কোনওদিন রাগের মাথায় ফেলে দেওয়া চলবে না…’
‘কখনও ফেলব না৷’
ইন্দিরার কাঁধে মাথা রাখে নিলয়৷ সিমেন্টের বেঞ্চেরই একটা ঠেকনায় এসে নামে ওর মাথাটা৷ জলের উপর দিয়ে বয়ে আসা শ্যাওলার গন্ধ লাগা বাতাস বয়ে যায় ওর বন্ধ চোখের পাতায়৷ জলের ভিতর থেকে মাছগুলো পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে ওদের পুরনো বন্ধুর দিকে…
‘আধঘণ্টা সেখানেই বসে থেকে আবার উঠে পড়ে নিলয়… একটা বিশেষ রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে৷ আজকের মতো বাকেট লিস্ট ওখানেই শেষ…রোদ মরে আসছে একটু একটু করে৷ বাতাসে বৃষ্টির ফোঁটা বাষ্পের মতো জমছে… আবার মিলিয়ে যাচ্ছে নিজের খেয়ালে…
***
‘এসে গেছিস জায়গা মতো?’
‘হ্যাঁ…’
‘বেশ, চোখ বোজ…’
এবার কিন্তু চোখ বন্ধ করল না নিলয়৷ ওপাশ থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, ‘কী হল তোর? চোখ বন্ধ করিসনি?’
‘না, আমার ভালো লাগছে না৷’
‘কেন, কী হল?’
একটু বিরক্ত হয় নিলয়, ‘আজ সারাদিন তোর আমার সঙ্গে কাটানোর কথা ছিল৷ এদিকে একবার তোকে চোখের দেখা পর্যন্ত দেখতে পাইনি আমি৷’
‘কী করব বল, আমি তো…’
‘জানি, কিন্তু এখন যেটা করতে হবে সেটা তুই সামনে না থাকলে হবে না…’ ইন্দিরা বোঝে না কী উত্তর দেবে৷ একটা অসহায়তা ঘিরে ধরছে ওকে ক্রমাগত৷ টেবিলের উপরে রাখা ঘড়ির টিকটিক শব্দটা ক্রমশ অসহ্য লাগতে শুরু করেছে৷ দুপুর এখনও গড়িয়ে যায়নি৷ কিন্তু তার মধ্যেই আকাশে জমাট মেঘে আর সেই মেঘ বয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন এখই বিকেল নামিয়েছে চারদিকে৷
আর একটা দিন শেষ হয়ে গেল৷ কত কিছু ভেবেছিল ওরা, তার কিছুই করা হল না৷ এমন একটা দিন আবার কবে ফিরে আসবে জীবনে?
যারা ঘুরতে গেছিল সকালে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসতে শুরু করেছে৷ ইন্দিরার মনে হয় একটা ভাঙা মেলার মাঝে রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কাকে যেন খুঁজে চলেছে ও, কিন্তু একটা মানুষেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না৷ চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল নেমে আসে ওর৷
সেটা আন্দাজ করতে পারে নিলয়৷ গলাটা নরম করে বলে, ‘আচ্ছা সে ঠিক আছে৷ পরে একদিন হবে নাহয় ওসব… আমি চোখ বুজছি, তুই শুরু কর…’
‘করব, একটু পরে…’
‘পরে! তাহলে এখন কী করব?’
ওপাশ থেকে উত্তর আসে না৷ তার বদলে ফোনটা কেটে যায়৷ মনটা খারাপ হয়ে যায় নিলয়ের৷ ছাতার শিক চুঁইয়ে ওর চারপাশে গোল করে জল পড়ছে৷ ওর ঠিক পেছনেই একটা লম্বা গাছ৷ ছোটো থেকে এই গাছটাকে ঠিক এখানেই দেখে আসছে ও৷ গাছটার পায়ের কাছ থেকেই একটা মাঠ শুরু হয়েছে৷ প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ এই মাঠে একটা মেলা হয়৷ এবারেও হয়েছিল৷
মাঠের গা ঘেঁষেই লম্বা মেইন রোড৷ কোচিং থেকে ফেরার সময় এই রাস্তা ধরেই ফেরে দু-জনে৷ কিন্তু একসঙ্গে নয়৷ ইন্দিরাকে কোচিং থেকে নিতে গাড়ি আসে৷ নিলয় ফেরে রিক্সা ধরে৷ দু-জনে একই দোকানের সাইনবোর্ড দেখে, একই বাচ্চাদের খেলতে দেখে মাঠে, ভাঙা মেলা, পড়ন্ত ধুলো, রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা একই ভিখারি ওদের দু-জনকে দেখেই হাসে, কিন্তু এই রাস্তায় একসঙ্গে হাঁটা হয় না ওদের৷ আজ তাই এখানেই দু-জনে হাঁটবে ঠিক করেছে৷
আজ রাস্তাটা অন্যদিনের থেকে ফাঁকা৷ ছুটির দিন, গাড়িঘোড়া এমনিতেই কম, তার উপরে এখন বেশ বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নেমেছে৷ আরও দু-বার কল ব্যাক করল নিলয়৷ কেউ ধরল না ফোনটা৷ বোধহয় মাথা গরম হয়ে ইন্দিরার৷ নাঃ, এরকম সুন্দর একটা দিনে অভিযোগ করে মাথাটা গরম না করালেই ভালো করত৷ আজ রাস্তার ধার থেকে সেই ভিখারি উধাও, ক্ষুদিরামের চালের দোকান, মনোরমা সাইকেল রিপেয়ার আর মা মনসা স্টেশনারির সাইনবোর্ড কাকভেজা হচ্ছে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারায়৷ আজ কি সবকিছুই অচেনা লাগছে ওর? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির সাইড ভিউ মিররে নিজেকে একপলকের জন্য দেখতে পেল ও৷ নিজেকেও কী অচেনা লাগছে এখন? কিছুক্ষণ ছাতা হাতে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রাস্তাটাকে চিনতে লাগল নিলয়৷
রিনরিন শব্দে বেজে উঠল ফোনটা৷ ইন্দিরা কল করছে আবার৷ কানে চেপে ধরেই প্রশ্ন করল সে, ‘কোথায় ছিলি তুই?’
‘কোথাও না৷’
‘আমি এখনও এখানেই দাঁড়িয়ে আছি৷’
‘জানতাম থাকবি৷’
‘দাঁড়া, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বসি৷ ছাতা মাথায় চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকলে…’
‘যেতে হবে না৷’
‘মানে? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব?’
আবার উত্তর নেই৷ রাস্তারই একদিকে সরে আসে নিলয়৷ চারপাশটা আর একবার দেখে নেয়৷ সত্যি এবার মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে৷ এক মিটার দূরের দৃশ্যই অস্পষ্ট হয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে৷ নিলয় চোখ বোজে, ওপাশে এখনও নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধে আছে৷
‘বুঝেছি, বল এবার৷’
‘আচ্ছা বল, এখানে এসেছি কেন আমরা?’
‘এই রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরি আমরা রোজ৷ আজ একসঙ্গে ফিরব৷’
‘আচ্ছা চলে আয়৷’
আওয়াজটা এসেছে সামনে থেকে৷ নিলয় ইন্দিরার দিকে চেয়ে হাসল৷ দু-পা এগিয়ে গেল ওর দিকে৷ এখন দুটো ছাতার উপরে বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ৷ বৃষ্টির ফোঁটায় নিলয় দেখতে পাচ্ছে না রাস্তাটা কোথায় গিয়ে মিশেছে৷ তবে যেখানেই যাক, আর কিছু যায় আসে না ওর৷ ঠান্ডা লাগছে ভীষণ, জোলো হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগছে নাকে মুখে৷
‘তিনটের মধ্যে এই আইডিয়াটা তেমন ভালো না৷’ ইন্দিরা সামনে চোখ রেখেই বলে৷
‘কেন?’
‘তোর মনে নেই, আগের মাসে আমাদের গাড়ি খারাপ হয়েছিল৷ আমরা একসঙ্গে অনেকটা হেঁটে এসেছিলাম এ রাস্তায়? মাঝরাস্তায় থেকে আলাদা রিক্সায় উঠেছিলাম…’
‘ধুর, সে তো সঙ্গে বন্ধুরা ছিল৷’
‘তাতে কী? শোন, এরমধ্যে নিয়ম ভাঙার কিছু নেই৷
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’ অবাক হয়ে তাকায় ইন্দিরা৷ এই বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তায়, কনকনে হাওয়ার ঝাপটার মাঝে সমস্ত পরিবেশটাকে ভীষণ কাল্পনিক লাগছে৷ ইন্দিরাকে এখন ঠিক ততটাই বাস্তব মনে হচ্ছে৷ ছাটে ভিজে যাচ্ছে তার দুলন্ত আঁচল, একমাথা চুলে লেগে রয়েছে জলের ফোঁটা, ডাগর চোখের কোল ঘেঁষা কাগজটুকুনি ঠিক ততটাও নিখুঁত নয়৷ এতটা বাস্তব আগে মনে হয়নি ওকে৷
‘নিয়ম ভাঙতে হবে…’ আচমকাই নিলয়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নেয় ইন্দিরা৷ উষ্ণ স্পর্শে চমকে ওঠে নিলয়৷ এমনটা তো এর আগে হয়নি৷ এতক্ষণ ইন্দিরার কথা শুনতে পেয়েছে ও৷ বর্ণনার মাধুর্যে কল্পনা করে নিয়েছে, কিন্তু স্পর্শ তো করতে পারেনি৷ এও কি সম্ভব? ও তো এখন চোখ বুজে একটা ফাঁকা বাসস্ট্যান্ডে বসে রয়েছে৷ আশেপাশে কেউ নেই…
চোখ খোলার চেষ্টা করল ও, কিন্তু খুলল না৷ চোখ খোলাই রয়েছে ওর, তার মানে…
থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও৷ অন্য হাতে ওর আর একটা হাত চেপে ধরল, ‘তুই… সত্যি তুই! কী করে?’
হঠাৎই ভারী অপ্রস্তুত দেখাল ইন্দিরাকে, ‘তুই বিশ্বাস কর, আমি এর থেকে ভালো করে শাড়ি পড়ছিলাম, কিন্তু দোতলার ব্যালকনি থেকে পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে…’
‘পাইপ বেয়ে…’ হাঁ হয়ে যায় নিলয়৷
‘কী করব বল? বাবা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, ব্যালকনি দিয়ে নামা ছাড়া আর উপায় কী?’
নিলয় এতক্ষণে খেয়াল করে ইন্দিরার জামাকাপড়ের নানা জায়গায় কাদার ছোপ লেগে আছে৷ মুখ থেকে মেকআপ উঠে গিয়ে কেবল ঘন কাজল আর লিপসটিকের আভাসটুকুনি রয়ে গেছে৷
‘কিন্তু তুই…’ নিলয় কোন প্রশ্নটা আগে করবে বুঝে উঠতে পারে না, ‘ফিরে গেলে তোর বাবা যদি জানতে পারে…’
‘জেনে গেছে, আধঘণ্টা অন্তর অন্তর ঘরে এসে দেখে যাচ্ছে… এতক্ষণে জেনে গেছে৷’
এই প্রথমবার ইন্দিরার কাঁধের হালকা হয়ে যাওয়া দাগটার দিকে চোখ চলে যায় নিলয়ের৷ কত জোরে মারলে এতমাস পরেও দাগ থেকে যেতে পারে৷ ওর নিজের বুকের ভিতরটাই দুরদুর করে ওঠে৷
‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর?’ নিলয়ের গলা তিরস্কার আর সহমর্মিতার মাঝে কোন অজ্ঞাত কাদাজলে ডুবে যায়৷
‘উঁহু, আজ নিয়ম ভাঙার দিন না? এই নিয়মটাই বা মানব কেন বল?’
ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা মেয়েটার দিকে একটানা চেয়ে থাকে নিলয়৷ ওর নিজের শরীরের নীচের দিকটাও ভিজতে শুরু করেছে রাস্তা থেকে ছিটকে আসা জলের ছাটে৷ নিস্পন্দ মুহূর্ত হেঁটে যাচ্ছে দুটো মানুষের মাঝের ফুট খানেকের দূরত্বে৷ রাস্তা দিয়ে একটা সাইকেল ঘন্টি বাজিয়ে পার হয়ে গেল, দুটো ভেজা শালিক পাঁচিলের উপর বসে মাথা নেড়ে জল ঝাড়ছে, পুরনো গাছটার পাতাগুলো বুক থেকে ট্রাফিকের কালো রং ধুয়ে স্নান করছে মহানন্দে, মাঠের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা মেলার নাগরদোলাটা হাওয়া-জলের ঝাপটায় অল্প একটু নড়ে উঠল৷ কেউ দেখল না ওদের, আজ কেউ ওদের দিকে নজর দেবার নেই…
‘এবার বল, কেন এসেছি আমরা এখানে?’
‘বললাম যে…’
‘না, ওগুলো সত্যি না…’
ভারী অস্বস্তি শুরু হল নিলয়ের৷ আজ বাড়ি থেকে বেরনোর সময় থেকে অস্বস্তিটা ঘিরে ধরেছে ওকে৷ ইন্দিরাকে এতদিন স্কুল ড্রেসে দেখে অভ্যস্ত সে৷ কখনও আঙুলের ফাঁকে পেন ছিল, থুতনিতে আনমনে লেগে যাওয়া কালির দাগ ছিল, চিরুনির কড়া শাসন অমান্য করা উসকোখুসকো চুল ছিল কপালের উপরে, বাবার ভয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, ক্লাসের ফার্স্টগার্ল হবার দায় ছিল, আজ ওর চোখের দিকের চেয়ে সেসবের কিছুই আর দেখতে পেল না নিলয়, বরঞ্চ কাজলধোঁয়া চোখের কোণে এক অদ্ভুত জিজ্ঞাসা খেলা করে যাচ্ছে এখন, এমন দুটো চোখ যা এই এলোমেলো হাওয়ার থেকেও তীক্ষ্ণ ফলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে ওর মনের বাঁধন৷ নিলয়ের মুখ থেকে ভাষা হারিয়ে গেল, অস্বস্তিটা আরও বেশি করে ঘিরে ধরল…
ঠিক এই সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটে গেল৷ ভাবনায় ডুবে গিয়ে নিলয়ের হাতের জোর আলগা হয়ে এসেছিল৷ দমকা হাওয়ায় আচমকাই কোথায় যেন উড়ে গেল সেই ছাতাটা৷ কিন্তু নিলয় যেন খেয়ালও করল না ব্যাপারটা…
দুটো অপরিণত কিশোর-কিশোরী, ওদের রোজকার আসা-যাওয়ার, দেখা না দেখার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল অবিশ্রাম বৃষ্টির ধারায়৷ কখন যেন নিলয় অনুভব করল ওর বুকের উপরে একটা মানুষ আশ্রয় নিয়েছে৷ যেন একটা একলা পাখি কাকভেজা হয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে তার ছোট্ট খড়ের বাসায়৷ ‘আমি ভালোবাসি তোকে… খুব…’
উত্তর এল না কিছু৷ ঝমঝমে বৃষ্টির শব্দ, এলোমেলো হাওয়া আর উদ্দাম বয়ে চলল৷ ওদের দু-জনের ফোনই বাজছে৷ সেসব ডুবে গেল পিচের রাস্তায় পড়া জলের ফোঁটার শব্দ, আর নিলয়ের গলার কাছে ঘন নিঃশ্বাসে, বুকের উপরে অচেনা নোনতা জলের স্পর্শে… মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে চারিদিকে… যেন এই রাস্তার ফুটপাথের উপর থেকে সবার চোখ সরিয়ে রাখতেই আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে আকাশটা৷
কতটা সময় কেটে গেছে দু-জনের কারও খেয়াল নেই৷ তবে বৃষ্টির স্রোত খানিকটা কমেছে এতক্ষণে৷ কুয়াশা সরে যাওয়া ভোরের মতো আবার দেখা যাচ্ছে দোকানের সাইনবোর্ডগুলো৷ আবার চেনা যাচ্ছে রাস্তাটাকে৷
‘আমাকে যেতে হবে এবার…’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল ইন্দিরা৷ যেন নিজের মুখটা দেখাতে চাইছে না৷ মনে হল এতক্ষণ একটা অদৃশ্য পরদার মতো জলের ধারা তার লাজুক মুখটাকে ঢেকে রেখেছিল৷ এখন সেটা সরে যাওয়ায় সত্যি লজ্জা পেতে শুরু করেছে সে৷
বিকেল ঢলে পড়েছে সন্ধের দিকে৷ সব বাড়িতেই কি পুজো হয়েছে আজ? ফুলের গাছ নেই আশেপাশে তাও মিষ্টি ফুলের গন্ধ আসছে৷
‘এ কী! উত্তর কে দেবে?’
‘পরে দেব…’
কথাটা বলেই উলটো রাস্তায় পা বাড়াল ইন্দিরা৷ নিলয় আটকাতে যাচ্ছিল তাকে৷ নিজেকে সামলে নিল৷ এমনিতেই এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়েছে বলে বাড়ি ফিরে কপালে দুর্গতি আছে৷ তার উপরে বেশি দেরি করলে…
রাস্তার অপর প্রান্তে ইন্দিরার শরীরটা মিলিয়ে আসতে আরও কিছুক্ষণ সেইখানেই ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকে নিলয়৷ ছাতাটা কোথায় উড়ে চলে গেছে কে জানে৷ আর বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে না সেটা৷
বুকের উপর এখনও যেন ইন্দিরার মাথার ওজনটা অনুভব করতে পারছে৷ হয়তো ওর বাকি জীবন ওই ওজনটা রয়েই যাবে ওর বুকে৷ মিহি হাসি হেসে সেও ফেরার পথ ধরল…
বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না ইন্দিরা৷ বাইরে চটি দেখে বুঝল মাও ফিরে এসেছে এতক্ষণে৷ ইন্দিরা বুঝল আজ আরও কয়েক ঘা বেশি পড়তে চলেছে পিঠে৷ তার ব্যথা কিছুদিন থাকবে৷ তার উপরে এমন কাকভেজা শাড়ি গায়ে লেপটে আছে যে সন্ধ্যায় নির্ঘাত জ্বর আসছে৷
দোতলায় উঠে সে দেখল ওর ঘরের দরজা খোলা৷ তবে ঘর ফাঁকা৷ বাবা-মায়ের ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ আসছে৷ ঠিক কী নিয়ে কথা হচ্ছে ইন্দিরা শোনার সাহস করল না৷ দ্রুত বাথরুমে ঢুকে শাড়িটা পালটে বাড়ির জামা পরে নিল সে৷ তারপর ভেজা চুলেই ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে এসে বসল বিছানার উপরে৷ বীণাটা এখনও পড়ে আছে বিছানার উপরে৷
ইন্দিরার বুকের ভিতরটা দুরদুর করছে৷ তাও সমস্ত শরীর জুড়ে খেলা করছে অদ্ভুত পরিতৃপ্তির রেশ৷ একটু দূরে আয়নাটার দিকে চোখ পড়লেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও৷ আজ রাতের গণধোলাইটার কথা ভেবেও ভয় লাগছে না এতটুকু… ‘অবেলায় স্নান করলি কেন আবার?’
কখন বাবা ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি ইন্দিরা৷ কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল সে৷ গলকণ্ঠটা ওঠানামা করল বারদুয়েক৷
‘চুল ভিজল কী করে তোর?’ শান্ত গলা সমরেশের৷
‘একটু… বাইরে গেছিলাম…’
‘তাই নাকি! কখন?’
ইন্দিরা বুঝতে পারছে যে কোনও সময় ওর গালে একটা সপাট চড় এসে পড়বে৷ ‘ওই… একটু আগে…’ মাথা নীচু করে শক্ত মুখে উত্তর দেয় সে৷
‘শুনছ, এঘরে এসো একবার…’ গলা তুলে উঁচু গলায় স্ত্রীকে ডাকলেন সমরেশ, ‘তুমি বললে ও ঘরে আছে, এদিকে ও বলছে নাকি বাইরে বেরিয়েছিল…’ কথাটা শুনে একটু ভুরু কুঁচকে যায় মহিলার, ‘সেকি আমি তো এসে দেখলাম ঘরেই বসে আছে৷ কখন বেরিয়েছিলি তুই?’ ইন্দিরা কী বলবে বুঝতে পারে না৷ মা কি বাঁচানোর চেষ্টা করছে ওকে? মা-ই দরজা খুলে ফাঁকা ঘর দেখে বাবাকে গিয়ে মিথ্যে বলেছে?
‘এই… বারান্দায় গেছিলাম… বৃষ্টির ছাটে…’ অজান্তেই মুখ দিয়ে মিথ্যেটা বেরিয়ে যায় ইন্দিরার৷
‘ওঃ তাই বল…’ মহিলা হাসেন, ‘আমি তো তোকে ডাকতে এসেছিলাম৷ কিন্তু এত সুন্দর বাজাচ্ছিলি বীণাটা…’
‘আমি! বীণা বাজাচ্ছিলাম৷’ ইন্দিরা দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে যায়৷ মা ওকে বাঁচাতে চাইতে পারেন, কিন্তু এমন সোজা সাপটা মিথ্যে বলবেন?
‘দরজার দিকে পেছন করে৷ আঃ, সে কী সুর! তুই যে এত ভালো বাজানো কবে শিখলি কে জানে৷ কোমল নিশাদ৷ সঘন বনমে মুরলা নাচে… বৃষ্টির সঙ্গে কী যে মানিয়েছিল… তাই আর বিরক্ত করলাম না…’
ইন্দিরার মুখে কথা ফোটে না৷ রাগ সরস্বতী সে শেখেইনি এখনও, বাজানো তো দূরের কথা৷ তার মানে অন্য কেউ ঢুকেছিল তার ঘরে৷ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে৷ যে ঢুকেছিল সে কি বেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে? চারপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে সে৷
‘কী হল তোর? ছোটোছুটি করছিস কেন?’
সমরেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে৷ হঠাৎ ইন্দিরার দৃষ্টি পড়ে ডাইনিংয়ের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সরস্বতীর মূর্তিটার দিকে৷ হাতে বীণাটা জড়িয়ে ধরে রাজহাঁসটা পায়ের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আগের মতোই৷ কেবল তাঁর মুখের ভাব এখন পালটে গেছে…
এও কি সম্ভব? অবাক হয়ে মায়ের আর বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নেয় সে৷ দু-জনেই কি সম্পূর্ণটা বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে? কে জানে? হয়তো আজ ওদের দু-জনের ছাড়া আরও কারও কাছে নিয়ম ভাঙার দিন…
চাপা সুর ভেসে আসে৷ ফোনটা বাজছে৷ জলে ভিজে একেবারে খারাপ হওয়ার সিঁড়ির একধাপ উপরে দাঁড়িয়ে আছে ফোনটা৷ দ্রুত সেটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে ইন্দিরা, ‘তুই ভাবতে পারবি না আজ বাড়িতে…’
‘শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই?’
‘ধুর ওসব কিছু না, বাবা-মা কুল, কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না…’
‘তুই থাম, আমাকে উত্তর দিয়ে গেলি না কিছু… দুম করে চলে গেলি…’ নিলয়ের গলায় অসন্তাোষ ঝরে পড়ে৷
‘সব উত্তর দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না৷’
‘সে আমিও জানি, কিন্তু…’
‘আবার! ধুর…’
কথাটা বলেও সত্যি চোখ বোজে নিলয়৷ ওপাশ থেকে তেমন শান্ত গলাতেই নির্দেশ ভেসে আসে, ‘এবার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দে, বাঁদিকের পকেট…’
নির্দেশ মতো হাত ঢোকাতে আলগা কিছু হাতে লাগে নিলয়ের৷ একটা কাগজ৷ এটা সকালে বেরনোর সময় ছিল না তো৷ মানে একটু আগেই ইন্দিরা কাগজটা…. সেটা খুলে চোখের সামনে ধরে নিলয়৷ ভেজা, চুপচুপে হয়ে যাওয়া ছেঁড়া খাতার পাতায় বড়বড় অক্ষরে লেখে, ‘আ-মি-ও ভা-লো-বা-সি, ভী-ষ-ণ!’
নিলয় হাসে৷ কোনও শব্দ হয় না সেই হাসিতে৷ তাও ওপাশ থেকে প্রশ্ন আসে, ‘এই তুই হাসছিস কেন?’ মিহি কৌতুক মিশে যায় গলার স্বরে৷
‘আসলে…’ নিলয় কী বলবে ভেবে পায় না৷
‘এই বাবা আসছে, পরে কল করছি…’
ফোনটা কেটে যেতে সেটা রেখে দেয় নিলয়৷ ক্রমশ তার মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হাসিটা৷ জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় সে৷
আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টিটা৷ ঝিমঝিম করে শব্দ হচ্ছে৷ সময়টাকে নিঃসন্দেহে গোধূলি বলা যায়৷ তাও ওর মনে হয় গোধূলির ঘোলাটে রঙের আড়াল টেনে আসলে একটা নতুন ভোর নামছে বাইরে৷
কে জানে, এমন একটা বৃষ্টি পড়ার দিনে প্রকৃতিও হয়তো নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে…