বৃষ্টিমহল ৩.৯৫

৯৫

হৃদিতার জন্মদিন উপলক্ষে সব বন্ধুরা একত্রিত হলো জুলাই মাসের পনেরো তারিখ সন্ধেবেলা। সামিদের উত্তরা বাড়িতে। বাগানে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাছের গায়ে গায়ে আর মাথার ওপরে তার দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বাল্ব স্ট্রিং লাইট। সন্ধে বেলার মন কেমন করা ধূসর আকাশের নিচে আলোগুলো তারার মতো জ্বলছে। বাগানের এক পাশে স্টেজের ওপর চাদর পেতে বসেছে কাওয়ালি গানের দল। আরেক পাশে লম্বা কাঠের টেবিলের ওপরে রাখা হয়েছে হৃদির পছন্দের বিশাল বড় এক রেড ভেলভেট কেক। সাথে আরো কিছু স্ন্যাক্স এবং পানীয়। একটু পরেই ক্যাটারিং এর লোকরা খাবার নিয়ে আসবে। মেনু হলো কাচ্চি বিরিয়ানি, মিক্সড ভেজিটেবল, চিকেন রোস্ট, চিংড়ির মালাইকারি, পাবদা মাছ ভুনা এবং সর্ষে ইলিশ। সেই সাথে জালি কাবাব আর বোরহানী। আজকের সমস্ত আয়োজন সামি নিজ উদ্যোগে করেছে। বাবা মাকে কিছুই জানায়নি আগে থেকে। এমনকি হৃদিকেও না। হৃদির জন্য এটা বিশাল বড় সারপ্রাইজ ছিল। 

হৃদি আজ সেজেছে খুব। বেগুনির ওপর সাদা কারুকাজ করা কাতান শাড়ি, গলায় কানে বেগুনি পাথরখচিত স্বর্ণের গয়না আর কানের পাশে বেগুনি অর্কিড ফুল। সব মিলিয়ে দারুণ জমকালো দেখাচ্ছিল ওকে। পতি গর্বে চকচক করছে দুচোখের তারা। ঠোঁটে লেগে আছে চওড়া হাসি। সুখি সুখি একটা ভাব লেপটে আছে সারা মুখে। 

অফিসের কয়েকজন কলিগ আর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করেছিল সামি। সাথে বন্ধুরা তো থাকছেই। হৃদির খালাতো চাচাতো ভাইবোন মিলিয়ে প্রায় আট দশজনের একটি দল এর মাঝেই চলে এসেছে। বাবা মা আসবেন একটু দেরিতে। হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে। ঘাসের ওপর পেতে রাখা সারি সারি চেয়ার দখল করে অতিথিরা বসে পড়েছে এর মাঝেই। বন্ধুরাও বসেছে এককোণে গোল হয়ে। অমৃতা অবশ্য তখনো আসেনি। চেম্বার থেকে সরাসরি এখানে চলে আসার কথা। ফোনে বলে দিয়েছে পৌঁছুতে একটু দেরি হবে। 

হৃদি কোথাও স্থির হতে পারছে না। এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে ক্রমাগত। সামি বন্ধুদের পাশে বসে ছিল। আকাশের সাথে তারা আর মনীষা এসেছে। বন্ধুরা অনেক দিন ধরে মনীষার গান শুনতে চাইছিল তাই রুদ্র আকাশকে খুব করে বলে দিয়েছিল যে মনীষাকে যেন অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়। মনীষা তারাকে ফেলে আসতে চাইল না। তারাও আর খুব একটা আপত্তি করার জোর পেল না। এসে অবশ্য ভালোই হয়েছে। তারার কিন্তু বেশ লাগছে! আসবার পর থেকেই এক আপামর মুগ্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে সে। জীবনে এই প্রথম এত বড়লোকের বাড়িতে বেড়াতে আসা হলো তার। এটা সাধারণ কোন বাড়ি নয়। এ যেন রাজপ্রাসাদ। শহরের বুকে একটুকরো স্বপ্নপুরী বলে মনে হচ্ছে জায়গাটাকে। ঘুম ভাঙলেই যেন ভস করে হাওয়া হয়ে যাবে এই স্বপ্নরাজ্য। রাজ্যের মানুষগুলোও রূপকথার মতোই সুন্দর। এর আগে একদিন আকাশের বন্ধুদের সাথে তার দেখা হয়েছিল বটে কিন্তু প্রথম সাক্ষাৎ বলে একটা আড়ষ্টতা কাজ করছিল। লজ্জায় কারো দিকে ঠিকমতো চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। আজকে দেখল পূর্ণ চোখে। আর দেখে একদম মনের মধ্যে ঝিম ধরে গেলো ভালো লাগায়। এ বাড়ির ছেলেটি যা সুন্দর! যেন সাক্ষাৎ রাজপুত্র। কী ফর্সা আর কী লম্বা! রাজবধূটিও দেখতে অসাধারণ। এরা যেন কোন অলীক জগতের বাসিন্দা। তারার নিজের ধুলোবালি মাখা মলিন পৃথিবীর সাথে এই জগতের বিন্দুমাত্র মিল নেই। সবুজ ঘাস, নানা জাতের চোখ ধাঁধাঁনো ফুল আর আবছা হলুদ আলোর মনোরম পরিবেশে ডুবে থেকে নিজেকে বড়ই বেমানান আর বিদঘুটে মনে হচ্ছিল তারার। হীনমন্যতাটা বোধহয় ওর চোখেমুখেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সে পরেছে একটা নিতান্তই সাধারণ স্বল্পদামি ব্লকের কাজ করা সালওয়ার কামিজ 1 আসবার আগে মনীষা তাকে একটু সাজিয়ে দিয়েছিল। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। কোঁকড়া চুলগুলোকে ব্লো ডাই করে সোজা বানিয়ে দিয়েছিল। আসবার পর থেকেই জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সে মনীষার পাশে। কিন্তু একটা ব্যাপার একটু অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে। ওর ঠিক সামনেই মুখোমুখি অবস্থানে লম্বা চুল, দাড়িওয়ালা, বিড়ালচোখা ছেলেটা বসে আছে। মুখে একটা অনর্থক হিজিবিজি হাসি নিয়ে। একটু বাদে বাদে চোখ তুলে এদিকে তাকাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না ছেলেটা ঠিক কাকে দেখছে? তাকে? নাকি মনীষাকে? প্রথম প্রথম সে শতভাগ নিশ্চিত ছিল যে ছেলেটা মনীষাকেই দেখছে। মনীষা এত সুন্দর যে মাঝেমাঝে তার নিজেরই মনে হয় সারাদিন ওই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু খটকাটা লাগল এই কয়েক মিনিট আগে। হঠাৎ তারার মনে হলো মুখে হিজিবিজি হাসি নিয়ে ছেলেটা তার ব্লো ব্লাই করা চুলের দিকেই চেয়ে আছে একদৃষ্টে। ভারি বিব্রত হয়ে পড়ল সে। নাকের ডগায় ঝুঁকে পড়া চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে দিল উপরের দিকে অপ্রস্তুত ভাবে। মনীষার দিকে তাকালো একবার। আকাশের সাথে কী নিয়ে যেন কথা বলছে মনীষা। সামি নিজের সেলফোন নিয়ে ব্যস্ত। আর এদিকে ওই লম্বাচুলো ফ্রাইড টমটম কেন যে অমন নিমিষহারা চোখে ওকে দেখতে লেগেছে কে জানে! কী করবে, কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। আকাশের বন্ধুদের মধ্যে এই একজনকেই তার অপছন্দ। এমন সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন স্বভাবের বন্ধুদলের মাঝে এই চালচুলোহীন ছেলেটিকে তার একেবারেই মানানসই বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ এর মাঝে একটা ফিচেল ভাব আঠার মতো লেগে থাকে। তারার বিব্রত হয়ে পড়াটা রুদ্রর চোখ এড়ালো না। আর এড়ালো না বলেই তারার ওই অস্থির, রোগা মুখখানার ওপর বিড়াল চোখদুটো আরো বেশি করে সিঁটিয়ে গেলো। রুদ্র মজার মানুষ। মজা করার সুযোগ হাত ছাড়া করবে কেন? হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই নিজের চোখের মণি দুটোকে ম্যাজিকের মতো ট্যারা বানিয়ে ফেলল সে। ঠোঁট করে ফেলল বাঁকা। গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করতে লাগল যেন চোখ উল্টে এখুনি বেহুঁশ হয়ে যাবে। পিলে চমকে উঠল তারা। শিরশির করে একটা ভয়ের ঢেউ খেলে গেলো মেরুদণ্ড দিয়ে। কী হলো ছেলেটার? মরে টরে যাচ্ছে নাকি? ভয়ে জমে গিয়ে পাশে বসা মনীষার পিঠে হাত দিয়ে একটা ঠ্যালা দিল সে। চিৎকার করে ডেকে উঠল ‘মনীষা আপু! মনীষা আপু!’ মনীষা তাকালো তারার দিকে। 

উদ্বেগ নিয়ে বলল-’কী হয়েছে তারা?’ 

তারা রুদ্রর দিকে আঙুল উঁচিয়ে কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই রুদ্র হো হো করে ডাকাতিয়া হাসিতে ফেটে পড়ল। তারার চশমা পরা চোখের চাউনিতে একটা বোকাটে ভাব ঝুপ করে নেমে আসলো চকিতে। স্তম্ভিতভাবে চেয়ে রইল সে হাস্যরত অদ্ভুত ছেলেটার দিকে। ধীরে ধীরে তার চোখের বোকাটে ভাবটা লুপ্ত হয়ে গেলো। তার বদলে ধক করে জ্বলে উঠল এক অগ্নিবৎ তেজ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে কোনো মানুষ এত অসভ্য হতে পারে! 

আকাশ রুদ্রকে একটা ধমক দিয়ে উঠল, ‘তোর প্রব্লেম কী? পাগলের মতো হাসতেছিস ক্যান?’ 

মনীষা তারার মুখটা ভালোমতো একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? ঠিক আছ তো?’ 

তারা হিংস্র চোখে রুদ্রর দিকে চেয়ে থেকেই উত্তর দিল, ‘ঠিক আছি।’ 

রুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে সে মরেই যাবে আজকে। তারার ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলেটার মুখ বরাবর পায়ের স্যান্ডেল জোড়া ছুঁড়ে মারে। হয়তো আরেকটু হলে সে তাইই করত। কিন্তু রুদ্রকে এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল অমৃতা। অমৃতার উপস্থিতি রুদ্রর আজগুবি হাসিটা থামিয়ে দিল মুহূর্তের মাঝে। সন্ধ্যা তখন গুটিয়ে গেছে। স্ট্রিং বাল্বের নরম হলদে আলোর আস্তর মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছিল অমৃতা। তার গায়ে কালো টি শার্ট। টিশার্টের বুকের ওপর সাদা রং দিয়ে লেখা ‘দ্যা নর্থ রিমেম্বার্স’। শুকিয়ে গেছে খুব। তবে শুকিয়ে আরো সুন্দর হয়েছে। অনেকদিন পরে দেখল বলেই রুদ্রর চোখে হয়তো ওই সৌন্দর্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিল। আকাশ মনীষার সাথে গল্পে মশগুল ছিল। অমৃতা যখন কাঁধে ব্যাকপ্যাক, কানে হেডফোন আর পকেটে দুহাত পুরে উদাস মুখে বাগানের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালো আকাশ তখন কী যেন একটা বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে গেলো। থমকে গেলো। গুলিয়ে ফেলল কথা। 

—‘কী হলো?’ মনীষা প্রশ্ন করল আকাশের দুরবস্থা দেখে।

–‘কিছু না। আমি আসছি। গিভ মি আ সেকেন্ড প্লিজ।’ 

আকাশ বসা থেকে উঠে অমৃতার দিকে এগিয়ে গেলো। ততক্ষণে সামি পৌঁছে গেছে অমৃতার কাছে। কোনো কথা না বলে ওকে ঝুপ করে জড়িয়ে ধরেছে। বাবা মা বহুদিন বাদে সন্তানের সংস্পর্শে আসলে যেমন আদরে সোহাগে সন্তানকে বুকে টেনে নেয় অনেকদিন পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে সামির আচরণ এখন ঠিক সেরকম। 

—‘কীরে দোস্ত? তুই তো আমাদের ভুইলাই গেছিস। কতদিন পর দেখলাম!’ বলছিল সামি আবেগরুদ্ধ গলায়। হৃদি ছুটে আসলো। এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল অমৃতার ওপর। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘অনেক মিস করতেছিলাম তোরে। আজকে না আসলে খবর ছিল।’ 

আকাশ রুদ্রও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনো কথা বলছে না ওরা। শুধু চেয়ে আছে অমৃতার দিকে। কথা বললেই যেন এই সুন্দর মুহূর্তটি নষ্ট হয়ে যাবে। ছন্দ পতন হবে। কিছু কথা আছে যেগুলো আসলে বলার চাইতে না বলাই ঢের ভালো। বন্ধুদের ভালোবাসায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল অমৃতার। ধীরে ধীরে সে আকাশ আর রুদ্রর দিকে এগিয়ে গেলো। হাত তুলে হাইফাইভ করল দুই বন্ধুর সাথে। তারপর হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তোরা এমনে চায়ে আছস ক্যান? মনে হচ্ছে যেন আমি কবর থেকে উঠে আসছি।’ 

উত্তরে আকাশ নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘তুই এরকম হয়ে গেছিস ক্যান? 

—‘কী রকম?’ 

—‘কেমন জানি। শুকায়ে কাঠি হয়ে গেছিস। আরো বেশি পোলা পোলা লাগতেছে এখন। 

এইসব হাবিজাবি কথা সচরাচর তেমন একটা পাত্তা দেয় না অমৃতা। কিন্তু কেন যেন আজকের মন্তব্যটা পছন্দ হলো না তার। মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ফালতু কথা বলিস না।’ 

—‘ফালতু কথা না। সত্যি! কী হইছে তোর? হিজড়াদের নিয়া কাজ করতে গিয়া নিজেও কি হিজড়া হয়ে গেলি নাকি?’ 

কাওয়ালি দলটা তখন হারমোনিয়াম আর তবলা বাজিয়ে গান শুরু করে দিয়েছে। হৃদি তাড়া দিয়ে বন্ধুদের বলে উঠলো, ‘এই তোরা চা কফি কিছু খাবি নাকি?’ রুদ্র ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ গানের দলটার দিকে চেয়ে থেকে সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘এইগুলা গান? নাকি গানের মাথা? কাউয়ার মতো কা কা করতেছে। থামতে বল!’ 

সামি একটু বিব্রতভাবে বলল, ‘আহঃ আস্তে কথা বল। শুনবে তো!’

—‘শুনলেই কী? আমি কি কাউরে ডরাই নাকি? এই কাউয়ার কা কা থামা তুই এখুনি। নাইলে কইলাম মামা খুব খারাপ কিসু হবে।’ 

—‘আরে কেমনে থামাবো আমি?’ 

—‘কিসু একটা কর। সারা শহর খুঁইজা তুই এই কাউয়ার দলরেই ভাড়া করলি? মানে সমস্যা কী?’ 

—‘আমি ভাড়া করি নাই। আমার এক কলিগ ভাড়া করছে।’ 

‘আকাশ! তোমার ফোন এসেছে!’ মনীষার ডাকে ফিরে তাকালো আকাশ। সেলফোনটা টেবিলের ওপর রেখে এসেছিল। দৌড়ে ছুটে গেলো ফোন ধরতে। ওর পেছন পেছন বাকি বন্ধুরাও এগিয়ে গেলো। অমৃতা ব্যাকপ্যাকটি টেবিলের ওপর রাখল। মনীষা আর তারার সাথে হেসে কুশল বিনিময় করল। তারপর বসল একটা চেয়ারে। আকাশ ফোন কানে নিয়ে একটু দূরে সরে যাবার পর রুদ্র হঠাৎ ঘোষণা দেওয়ার ঢঙে বলল, ‘শোন তোরা! গতকাল রাতে, আম্মা আমারে ফোনে বলছে যে আমেরিকা যাওয়ার আগেই আমারে বিয়া দিয়ে দিবে।’ 

শুনে বন্ধুরা হই হই করে উঠল। হৃদি রস টই-টই গলায় বলল, ‘তোর মতো উজবুককে বিয়ে করবে কে?’ 

—‘তাতো জানি না। তবে আম্মার লজিক হচ্ছে বিয়ে করে না গেলে আমি নাকি না খেয়ে মরব। এখানে তো তোরা আছিস আমাকে খাওয়ানোর জন্য। আমেরিকায় তো কেউ নাই।’ 

—‘হুম, তা অবশ্য ঠিক।’ সায় দিল হৃদি। 

আকাশ ফিরে এসেছে তখন। বসেছে অমৃতার পাশের চেয়ারে। মনীষা মিটমিটে হাসি হেসে বলল, ‘ভালো সিদ্ধান্ত। আমি তাহলে তোমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করি। আমাদের অফিসে কয়েকজন ফ্রেশারস জয়েন করেছে এই মাসে। প্রত্যেকেই সুন্দরী। গুড ক্যালিবার।’ 

মনীষার কথাটা শুনে সামি একটু ঠাট্টার গলায় বলে উঠল, ‘অত দূরে যাবার কী দরকার? আশেপাশে কেউ নেই?’ 

বন্ধুদের মধ্যে শুধু রুদ্র আর আকাশ ছাড়া অন্য কেউ সামির মাত্র বলা কথাটার গোপন ইঙ্গিত ধরতে পারল না। রুদ্র সামির চোখে চোখ রাখল একবার। কী যেন কথা হলো দুই বন্ধুর চোখে চোখে। তারপর রুদ্র যতটা সম্ভব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আশেপাশে আর কে আছে? এই অমৃতা! তুই আমাকে বিয়ে করবি?’ 

বন্ধুদের মুখে একটা চমক খেলে গেলো। মনীষা আর তারাও হতবাক। হৃদির মুখটা একটু হা হয়ে গেছে। অমৃতা মিনারেল ওয়াটারের বোতল উঁচু করে পানি ঢালছিল গলায়। রুদ্রর কথা শুনে একটা ধাক্কা খেল সে। মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো একটু জল। বোতল নামিয়ে, হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছতে মুছতে সে বিস্মিত চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে। তারপর হিহি করে হেসে উঠল শব্দ করে। মিনিট না গড়াতেই হাসির রোল পড়ে গেলো সবার মধ্যে। হাসল রুদ্রও। হাসতে হাসতেই বলল, ‘চিন্তা কইরা দ্যাখ মামা। আমেরিকা যাইতেছি। পাঁচ বছর থাকবি আমেরিকায়। পাশাপাশি তোর পড়াশোনাটাও হয়ে গেলো। খারাপ হবে না কিন্তু!’ 

সবাই হাসি ঠাট্টায় ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও হৃদিকে কিন্তু একটু সিরিয়াস দেখালো। সে বরাবরই একটু সহজ সরল। মনের ভাব খুব একটা লুকাতে পারে না। টেবিলে একটা চাপড় মেরে সে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আইডিয়া কিন্তু খারাপ না। অমৃতাও তো দেশের বাইরে যাইতে চাইতেছে। আমার মনে হয় কি তোরা দুইজন বিয়ে কইরা ফ্যাল। রুদ্ররও একটা সঙ্গী হইল। অমৃতারও বিদেশ যাওয়া হইল। ফাটাফাটি!’ 

হৃদির কথাগুলো অমৃতার মুখের হাসি উড়িয়ে দিতে খুব একটা সময় নিল না। এই প্রস্তাবের পেছনের সুপ্ত লুকায়িত স্বার্থটা খালি চোখেই ধরা পড়ে গেলো অমৃতার কাছে। সে বুঝল হৃদি ঠাট্টা করছে না। সে সত্যই চাইছে অমৃতা কাউকে বিয়ে করে থিতু হোক এবং তার নিজের সংসার থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাক। এখানে রুদ্র মুখ্য নয়। মুখ্য হলো অমৃতার থিতু হওয়া এবং হৃদির সংসার জীবনের ঝুঁকি অপসারণ করা। 

—‘আমেরিকা একটা বাল। আমি যাব কানাডা নইলে লন্ডন।’ বলল অমৃতা ত্যাড়া গলায়। 

—‘কী বলতেছিস ভাইবা চিন্তা বল। পিএইচডি মামা! পাত্রের কিন্তু দাম আছে!’ বলল রুদ্র তারিয়ে তারিয়ে। 

—‘দাম দিয়া মুড়ি খা।’

সামি এবার রুদ্রকে অভয় দিয়ে বলল, ‘সমস্যা নাই বন্ধু। একজন রিজেক্ট করছে তো কী হইছে? আশেপাশে মানুষের অভাব আছে নাকি?’ বলে সে একটা চোখ টিপল। রুদ্র বুঝল তার ইঙ্গিত। কিন্তু হাজার হোক মনীষা ওদের চেয়ে বয়সে সাত বছরের বড়। হুট্ করে উল্টাপাল্টা ফাজলামো করে বসলে যদি মাইন্ড করে ফেলে? রুদ্র তাই মনীষার উদ্দেশ্যে বলা কথাটা তারার দিকে চেয়ে ছুঁড়ে দিল, ‘আর কেউ কি আছে? যে এই বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আটলান্টিকের ওপারে পাড়ি দেবে? কে সেই ভাগ্যবতী নারী?’ 

তারা এসব ঠাট্টা মশকরায় একেবারেই অভ্যস্ত নয়। রুদ্রর ফাজিল কথা শুনে তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। এমনিতেই এই ছেলেটার প্রতি অনেক ক্ষণ যাবৎ এক দুর্দান্ত রাগে তার অন্তর দেশ জ্বলে যাচ্ছে। এবার রাগের জ্বালায় তার কান্না পাবার উপক্রম হলো। আকাশ বোধহয় তারার অবস্থাটা একটু টের পেয়েই বলল, ‘ওই রুদ্রর বাচ্চা। বিয়া করবি তো আমারে বল। দুইদিনের মধ্যেই বৌ খুঁইজা দিতেছি তোরে।’ 

রুদ্র ভীষণ করুণ গলায় বলল, ‘হ, কিসু একটা কর মামা। আর ভাল্লাগে না।’ 

—‘কিসুই হবে না তোদের। এত বয়স পর্যন্ত একটা প্রেম করতে পারস নাই। এখন আর হবে না। বিয়া করলে বাপ মায়ের পছন্দেই করতে হবে। আংকেল আন্টিরেই বল মেয়ে দেখতে।’ বলল অমৃতা খটোমটো স্বরে। 

—‘লুক হু ইজ টকিং। অমৃতা নিজে প্রেম করতে পারে নাই এখনো একটা! আর আসছে ওদের কথা শুনাইতে।’ বলল সামি, সহাস্যে। শুনে বন্ধুরা একটু চুপসে গেলো। সামির কথার প্রত্যুত্তরে কাউকে কিছু বলতে দেখা গেলো না। রুদ্র হঠাৎ করেই আর্তনাদ করে উঠল, ‘এই কাউয়ার দল যদি এখন কা কা বন্ধ না করছে তো আমি এদের মাথায় পানি ঢাইলা দিমু।’ 

অমৃতা খিকখিক করে হেসে উঠে বলল, ‘যা পানি ঢাইলা আয়। ডেয়ার দিলাম তোরে। দেখি পারিস কিনা।’ 

রুদ্র উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বুক চিতিয়ে বলল, ‘দেখতে চাস?’ 

হৃদি চেয়ারে বসে থেকেই রুদ্রর হাত চেপে ধরে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। অবশ্য হাতের নাগাল পেল না সে, টেনে ধরল ওর মোবাইল প্যান্টের ফুলে ফেঁপে থাকা পকেট। কাকুতিমিনতি করে বলল, ‘প্লিজ, দুষ্টামি করিস না। বসে থাক।’ 

রুদ্র নিজের পরনের প্যান্টের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিব্ৰত গলায় বলল, ‘কী আজব, মামা তুই আমার প্যান্ট ধইরা টানতেছিস ক্যান? মান ইজ্জত সব ডুবাবি নাকি?’ হোহো করে হেসে ফেলল বন্ধুরা। কথাটা বলে শেষ করে নিজের অজান্তেই একবার তারার দিকে তাকিয়েছিল রুদ্র। তারার মুখের মেঘ তখন অনেকখানি কেটে গেছে। ঠোঁট টিপে হাসি চাপানোর চেষ্টা করছে সে। সেই হাসির দৃশ্য দেখতে পেয়ে রুদ্রর হৃদির ওপরে চড়াও হওয়া রাগটা আরেকটু জমে গেলো। হিসহিসে গলায় বলল, ‘দাঁড়া, এই কাউয়ার দলরে একটা শিক্ষা আমার দিতেই হবে! 

কাওয়ালির দল তখন বাদ্য বাজনা বাজিয়ে, নেচে নেচে গাইছে—

“Duma dum mast kalandar 
Ali da pehla number 
Duma dum mast kalandar 
Sakhi shabaaz kalandar” 

হৃদির কয়েকজন কাজিন খুব উপভোগ করছে গান। স্টেজের সামনে জড়ো হয়ে উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে তারা দলবদ্ধভাবে। তাদের বেশির ভাগের চোখ বন্ধ। কপালের ভাঁজে ভাঁজে গভীর ব্যগ্রতা। রুদ্র স্টেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পাশে আকাশও আছে। নৃত্যরত ছেলেমেয়েগুলোর দিকে চোখা দৃষ্টি রেখে রুদ্র বলল, ‘দ্যাখ না, কী নাচটা নাচতেছে। মনে হইতেছে নাচতে নাচতে আজকে শহীদ হয়ে যাবে এরা!’ 

হাসল আকাশ রুদ্রর মন্তব্য শুনে। গায়ক স্টেজের ওপর আসন গেঁড়ে বসে চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে গান গাইছে আর হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। তার গায়ের রং দুধে আলতা। ঠোঁটের ওপর কালো মোটা গোঁফ। মাথায় একটি লম্বাটে টুপি। রুদ্র কয়েক পা হেঁটে গায়কের সামনে এসে দাঁড়ালো। আশপাশটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল একবার। তারপর মুখে দু হাত চেপে চিৎকার করে ডেকে উঠল তারস্বরে ‘কা কা কা কা!’ 

গায়কের চোখ খুলে গেলো। সেই চোখে মোটা দাগের বিস্ময়রেখা। ততক্ষণে বাজনা থেমে গেছে। নাচতে থাকা ছেলেমেয়েগুলো রুদ্রর কাণ্ড দেখে থামিয়ে ফেলেছে নাচ। উপস্থিত দর্শক হতভম্ব। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই রুদ্রর দিকে। রুদ্র প্রায় মিনিট দেড়েক সময় টানা কা কা করে গেলো। সবচেয়ে আজব ঘটনাটা ঘটল ওর কাকের ডাক থামানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। একটি বছর পনেরোর বালক, যে কিনা এতক্ষণ নেচে নেচে ঘাম ঝরিয়ে ফেলেছে। সে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ঠিক রুদ্রর গলা নকল করে ডাকতে শুরু করল, ‘কা কা কা কা!’ যেন এটা খুব মজার একটা কাজ। বাকি ছেলেমেয়েদেরও যোগ দিতে খুব একটা সময় লাগল না। কয়েক সেকেন্ড না গড়াতেই কাকের ডাক বেশ জোরালো হয়ে উঠল। গায়কের মুখ রাগে থমথম করছে তখন। রুদ্র পালিয়েছে জায়গাটা ছেড়ে। পালিয়েছে আকাশও। হৃদি হাহাকার করে ছুটে এসে ভাই বোনদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করালো। তারপর গায়কের সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বলল, ‘আমরা খুবই দুঃখিত। ওরা ছোট মানুষ তো দুষ্টুমি করতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’ 

৯৬

রোমেলা বাগানের কোণে একলা দাঁড়িয়ে চারপাশটা অবলোকন করছিলেন। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ছেলের এই অহেতুক আদিখ্যেতা তাঁর মোটেও ভালো লাগছে না। এসব কপর্দকশূন্য লো স্ট্যান্ডার্ড মানুষজনদের আপ্যায়ন করার জন্য এত আয়োজন! এরা কি এসব সম্মান পাবার যোগ্য? ছেলেটাকে নিয়ে আর পেরে উঠছেন না তিনি। দিনকে দিন বড়সড় গাধায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ছেলের বউটারও আজকাল দেমাগ হয়েছে খুব। প্রথম দিকের নরমসরম ভাবটা এখন আর নেই তার মধ্যে। শ্বশুরের আশকারা পেয়ে দিন দিন মাথায় উঠছে এই মেয়ে। 

সেই বাজে মেয়েটাকেও ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন রোমেলা। ছেলের কাছে এখনো এই ডাকিনীর আসল রূপ প্রকাশ পায়নি। কখন প্রকাশ পাবে সেই অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন তিনি মনে মনে। গত পরশুদিন স্টাডিরুম তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলেছেন কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই হাতে পড়েনি। গতরাতে হক সাহেব ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁর ব্যক্তিগত সেলফোনটা নিয়েও নাড়াচাড়া করে দেখেছেন রোমেলা। লাভ কিছুই হয়নি। ফোনে তালা দেওয়া। ল্যাপটপেরও একই অবস্থা। পাসকোড জানা নেই বলে কাজ উদ্ধার করা গেলো না। লাইব্রেরি রুমটা দেখা হয়নি এখনো। চাবি জোগাড় করা হয়ে গেছে। ইচ্ছে আছে আগামীকাল সকালে নিরিবিলিতে একবার ওই রুমটায় ঢু মারবেন। ওই বেহায়া মেয়েটিকে দেখামাত্র মন বিষিয়ে উঠেছে কবে যে একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ তিনি হাতে পাবেন আর নিজের ছেলের চোখের সামনে মেলে ধরবেন! ইশ! আর তর সইছে না। মনে চাইছে মেয়েটাকে এখুনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। এমন মেয়ের কি কখনও ভালো হবে? কোনোদিনও ভালো হবে না! এর ধ্বংস অনিবার্য। এমনই সব খাপছাড়া ভাবনা ভাবতে ভাবতে তিনি অনতি দূরে বসে থাকা ছোট চুলের, ছিপছিপে দেহের, গোঁয়ার মেয়েটির দিকে বিষ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। হিংস্র, বিদ্বেষপূর্ণ এক তিতকুটে অনুভূতিতে ক্রমশ ভরে যাচ্ছিল বুক। একেই বলে চোরের মার বড় গলা। তলে তলে অন্যায় কাজ করে আবার খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা হয় সুযোগ পেলেই। একটিবার শুধু সামি জানতে পারুক আসল ঘটনা। জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবে একদম। কী বিশ্রী ব্যাপার! ড্রাইভার থেকে শুরু করে বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড পর্যন্ত সকলে জানে! মেয়েটার নাহয় কোনো চালচুলো নেই, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই কিন্তু ওই লোকটা? ওই লোকটা কী করে চরম নির্লজ্জের মতো এই ঘৃণিত কাজটা করতে পারল? নিজের ছেলেটার কথা পর্যন্ত একবার ভাবল না। আসলে ভুলটা হয়ে গিয়েছিল সেই প্রথম জীবনে। রোমেলার উচিত ছিল, ভোগবিলাস আর অর্থবিত্ত নয়, বরং ভালোবাসাকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে বেছে নেয়া। বিয়ের তিন চার মাস পরে আনিস একবার এসেছিল তাঁর কাছে। দেখা করেছিল লুকিয়ে, একটা শপিংমলের ফুডকোর্টে। সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ফিরে আসার প্রস্তাব রেখেছিল। রোমেলাও চেয়েছিলেন ভীষণভাবে। কিন্তু তখন সামির বাবার ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি হচ্ছে হুহু করে। বাড়ছে তাদের জীবনযাত্রার মান। বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন আগের চাইতে বেশি দাম দেওয়া শুরু করেছে। কারো কারো চোখে ঝিলিক দিচ্ছে ঈর্ষা। আড়ালে আবডালে লোকে তাঁর ভাগ্যের প্রশংসা করছে। এমন সুযোগ্য স্বামী কজনের ভাগ্যে জোটে? ওদিকে আনিস তখন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। বেতন পরিমিত। অসুস্থ বাবা মায়ের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। থাকে বাসাবোর একটা তিন রুমের পুরোনো আমলের বাসায়। তিন রুমের বাসায় সদস্য সংখ্যা ছয়জন। সেই টানাটানির সংসারে মরার উপর খারার ঘা হয়ে রোমেলার গিয়ে হাজির হওয়াটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। তাছাড়া স্বামী সংসার ফেলে আনিসের বাড়িতে গিয়ে ওঠা মানে নিজের বাবা মায়ের সাথেও চিরদিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করা। সাত পাঁচ ভেবে সব শেষে তাই বৈষয়িক ভাবনারই জয় হলো। প্রাচুর্যের কাছেই নিজেকে সমর্পন করলেন তিনি। ভালোবাসা হেরে গেলো। আনিস এই সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছিল খুব। তাঁর জীবনে কি তবে আনিসের অভিশাপই লেগে গেলো শেষমেশ? আনিসকে কখনোই ভোলার মতো করে ভুলতে পারেননি এ কথা ঠিক। কিন্তু সত্য বলতে কি, টাকার একটা অন্য রকমের নেশা আছে। সেই নেশায় একবার আকণ্ঠ ডুবে গেলে বাস্তবিক জ্ঞান থাকে না কিছু কিছু মানুষের। নাহ, বেয়াদব মেয়েটাকে সহ্য হচ্ছে না আর। রাগ, ঈর্ষা এবং বিতৃষ্ণায় অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরটা। খুব দ্রুত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। তারপর নিজের ছেলের হাতেই তুলে দেবেন তিনি এই অন্যায়ের বিচার ভার। 

৯৭

গেটের বাইরে বেরিয়েই রুদ্র হো হো শব্দে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার পেট ফেটে যাবার অবস্থা। আকাশ একটু বাঁকা গলায় বলল, 

—‘শালা তুই একটা জিনিস! কী কামটা করলি? হৃদি রেগে যাবে।’

—‘রাগুক। ওরে কে বলছে এই কাউয়ার দলরে টাকা দিয়ে ভাড়া কইরা আনতে?’ 

—‘অতটা খারাপও গাইতেছিল না।’ 

—‘খারাপ তো বটেই। আর আমি মনীষারে নিয়া আসছি গান গাওয়ানোর জন্য। কাউয়া বাহিনীর কা কা চলতে থাকলে ও গান গাবে কখন? 

—‘সময় তো আছে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নাই।’

—‘ও কি সারারাত থাকবে নাকি?’ 

আকাশ একটু সময় চুপ থেকে কিছুটা গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুই তারার সাথে এইসব কী করিস? হুদাই?’ 

—‘কী করলাম আবার!’ 

—‘আরে ও অত ঠাট্টা মশকরা বোঝে না। শান্ত প্রকৃতির মেয়ে।’ 

রুদ্র ত্যাড়া চোখে তাকালো আকাশের দিকে, ‘মানে কী? তুই বলতে চাইতেছিস ওর সেন্স অব হিউমার ভালো না?’ 

—‘সেইটা না। ছোট মেয়ে একটা। বয়স কম। তোর কী দরকার ওর সাথে এইসব ফাইজলামি করার?’ 

—‘ছোট মেয়ে মানে? কোন ক্লাসে পড়ে? ক্লাস ওয়ান? 

রুদ্রর কথা শুনে আকাশ চোখ গরম করে তাকাল ওর দিকে। গেট পেরিয়ে মনীষাকে হেঁটে আসতে দেখা গেলো, গলির মাথায় জ্বলতে থাকা নিয়ন বাতির আলোয়। দুই বন্ধুকে পেয়েই সে স্ফীত হাসি হেসে বলল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসছে।’ 

—‘কী আইডিয়া?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘আমাদের রুদ্রর সাথে তারার বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?’ 

দুই বন্ধু স্তব্ধীভূত হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ মনীষার দিকে। কয়েকটা সেকেন্ড কাটার পর রুদ্র ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। আকাশ কিন্তু হাসল না। উপরন্তু একটু কেমন গম্ভীর দেখাতে লাগল তাকে। সে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে একটু নিস্তেজভাবে বলল, ‘চলুন ভেতরে যাই।’ 

৯৮

বন্ধুদের সাথে হেসে কথা বলছিল অমৃতা। কিন্তু এইসব কথা বলাবলিতে আর হাসাহাসিতে আগের মতো প্রাণ নেই যেন। বন্ধুদের সান্নিধ্য তার ভালো লাগছিল এ কথা ঠিক। কিন্তু এই ভালোলাগাটাও যেন বড় নির্জীব এবং প্রাণহীন। অবাধ্য মনটা তাই চেতনে অবচেতনে একটুখানি প্রাণের খোঁজে হৃদয়েশ্বর প্রাণনাথের জন্যই ব্যাকুল হয়ে ছিল সর্বক্ষণ। না, চাইছিল না সে ভাবতে এসব, একেবারেই না! কিন্তু ভাবনার ওপর একটানা জোর খাটাতে খাটাতে তার স্নায়ু তখন উত্যক্ত এবং ক্লান্ত। 

হৃদি অমৃতার পাশেই বসে ছিল। ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে হঠাৎ বলল, ‘রুদ্রটার কাণ্ড দেখেছিস? এরকম পাগল হলে কি হয়? জীবন চলবে কী করে?’ 

অমৃতা ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদির দিকে তাকালো। খুব স্টাইলিশ দেখাচ্ছে আজকে ওকে… চুল বাঁধার ধরনটাও… নিশ্চয়ই পার্লারে গিয়েছিল। পরিপাটি মেকআপ মায়াবী মুখের আদল অনেকটাই ধারালো করে তুলেছে। একটু অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। এই হৃদি যেন অনেক বেশি লৌকিক, সাংসারিক এবং বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন। অমৃতা একটু আলগা হাসি হেসে বলল, ‘আমরা সব সময়ই এরকম পাগল। এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছে। এভাবেই কাটবে।’ 

হৃদির চোখ আটকে গিয়েছিল তখন অমৃতার গলায় ঝোলা হোয়াইট গোল্ডের লকেটের ওপর। 

—‘এটা কে দিল? কিনেছিস নাকি?’ 

একটু অপ্রস্তুতভাবে নিজের গলায় লটকে থাকা চেইনের ওপর একটা আঙুল ছোঁয়ালো অমৃতা। আশপাশটা একবার ভালোমতো দেখে নিয়ে নিশ্চিত হলো যে সামি ধারে কাছে কোথাও নেই। এরপর খুব ক্ষীণ গলায় বলল, ‘উনি দিয়েছেন। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছেন।’ কথাটা বলার সময় অমৃতার ঠোঁটে একটা স্পর্ধিত হাসি ঝিকোচ্ছিল। এরকম কেন হয় সে জানে না। লোকটার কথা বলতে তার ভালো লাগে। বিভাকে ভিডিও কলে দেখিয়েছিল জিনিসটা। কিন্তু অন্য কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলার মতো সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আজকে বলতে পেরে ভালো লাগছিল। এদিকে ওর বলা কথাটা শোনামাত্র হৃদির চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠেছিল একরাশ বিস্ময়ে। তারপর ক্রমেই কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে আসছিল সন্ধ্যার নিভে আসা আলোর মতো। ওর মুখের ওই পট বদলানো দেখে অমৃতার ঠোঁট উপচানো হাসি উধাও হলো মুহূর্তের মাঝে। 

—‘বাহ্! এতদূর!’ কেমন যেন বিদ্রুপপূর্ণ শোনায় হৃদির গলা। 

—‘মানে কী?’ 

—‘আমেরিকা থেকে গিফট নিয়ে আসলো? তোর জন্য দেখি অনেক দরদ!’ 

অমৃতা বিহর্ষ বিস্ময়ে তাকায় এত দিনের পুরোনো বান্ধবীর দিকে।

—‘এভাবে বলতেছিস কেন?’ 

—‘কীভাবে বললাম আবার? ভালোই তো, বড়লোক বয়ফ্রেন্ড পাইছিস। দামি দামি গিফট পাবি।’ 

হতভম্ব অমৃতা কোনোরকমে বলতে পারল, ‘আমি কি লোকটার টাকা দেখে ভালোবাসছি? আমার কাছে এসব বড়লোকির কোন মূল্য নাই! কী যা-তা কথা বলতেছিস তুই?’ 

—‘সত্যি কথাই তো বলতেছি। এত অবাক হওয়ার কিছু নাই। এসব কথা তোমাকে শুনতেই হবে। মানুষের সংসারে দখল দিতে আসছ। একটু কথা শুনবা না তা তো হয় না!’ 

খারাপ লাগল। এত খারাপ লাগল যে অমৃতা একদম চুপ করে গেলো। নিশ্চল হয়ে গেলো। একটা ভীষণ রকমের গভীর শ্বাস পড়ল গোপনে। তর্ক করতে পারত। শুনিয়ে দিতে পারত দু চারটা কথা। কিন্তু কী লাভ? হৃদি একেবারে ভুল কথা তো বলেনি! পাপ করলে সেই পাপের শাস্তি স্বরূপ কিছু আজেবাজে কথা তো শুনতেই হবে। লজিক আছে ওর কথায়। হায় পাপ!… পাপ পুণ্যের কথা আমি, কারে বা শুধাই! সেই থেকে অনেকক্ষণ অবধি অন্তরটা কেমন পাপযুক্ত গ্লানিতে ভরে রইল। কিন্তু খানিক বাদে হালকা আকাশি পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘকায় মানুষটিকে যখন ভিড়ের মাঝে এক ঝলক দেখতে পেল, তখন পাপবোধের ভারি নভশ্চর ভেদ করে হৃদয়াকাশে নিমেষে এক পূর্ণ চন্দ্রের উদয় হলো। এবং একটি অকাট্য সত্য সে সজ্ঞানে উপলব্ধি করতে পারল যে, এই অনুভূতি কোনভাবেই পাপ হতে পারে না। এ যে সখি হৃদয়ের প্রেম… চিরদৈন্য চিরপূর্ণ হেম! 

আজকেও একটা ছোটখাটো ভিড় আছে তাঁকে ঘিরে। অফিসের লোকজনরা দেখামাত্র ছুটে এসেছে হুড়মুড় করে। তিনি সবার সাথে ভদ্রতার সাথে কথা বলছেন। সৌজন্যতামূলক হাসি হাসছেন। হঠাৎ দৃষ্টি কাড়ল মেয়েটা। কালো টি শার্ট, ছোট ছোট চুল, পুতুল পুতুল মুখ। তারপর… চার চোখেতে মিলন যখন হলো, তখন বুকের মধ্যে অনায়াসে নেমে এলো পাহাড়ি ঝরনা, নেমে এলো শীতল বাতাস! অনেক কষ্টেও দৃষ্টি আর অন্য কোনদিকেই সরল না। 

হৃদির আব্বা আম্মা চলে এসেছেন ততক্ষণে। কেক কাটার জন্য সবাইকে ডাকা হলো। লম্বা টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়ালো সামি, হৃদি এবং তাদের পরিবারের সদস্যগণ। বিভাকে ভিডিও কল করতে ভুলল না বন্ধুরা। কেক কাটা হলো। হাততালির রোল পড়ল। কেক কাটার পালা শেষ হবার পর রোমেলা তার বোনদের সঙ্গে নিয়ে একটি আলাদা টেবিলে বসলেন। হৃদি বসেছে বাবা মা এবং ছোট ভাইকে নিয়ে। রাশেদের একটি প্রেস কনফারেন্স আছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আজ তিনি ছেলের শ্বশুর শাশুড়িকে সময় দিতে পারবেন না। হৃদি চোখা চোখে বারবার দেখছিল শাশুড়িকে। এই মহিলার সমস্যা কী বুঝতে পারছে না সে। তার বাবা মা বিয়ের পর প্রথমবার এসেছে এ বাড়িতে। শাশুড়ির কি উচিত না অতিথিদের সাথে এক টেবিলে বসা এবং আদর আপ্যায়ন করা? ন্যূনতম সৌজন্য বোধ কি নেই ইনার ভেতরে? 

আজকে সামিকে কথা শোনাতে ছাড়ল না হৃদি। সামি বন্ধুদের টেবিলে বসে কী নিয়ে যেন হাহা হোহো করছিল। হৃদি ওর পাঞ্জাবির হাতা ধরে টেনে হিঁচড়ে একটু আড়ালে নিয়ে আসলো। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘তোর মায়ের সমস্যা কী? আমার আব্বা আম্মা আজকে প্রথম আসছে এই বাসায়। উনার কি উচিত না আমার আব্বা আম্মাকে সময় দেওয়া? আপ্যায়ন করা?’ 

সামিকে একটু বিভ্রান্ত দেখালো। মাথার কোঁকড়া চুলে হাতের আঙুল চালালো সে কয়েকবার চিন্তিত ভাবে। বলল, ‘আচ্ছা দেখতেছি কী করা যায়।’ 

হৃদি জায়গাটা থেকে নড়ল না। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে সামির গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। মায়ের টেবিলের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো সামিকে। তারপর ঝুঁকে নিয়ে মায়ের কানে কানে কী যেন বলল। রোমেলার কপালে ফুটে ওঠা তিনটি পরিষ্কার ভাঁজযুক্ত রেখা হৃদি এই দশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেল। হাত নেড়ে কী যেন বললেন তিনি ছেলেকে। সামিও বলল কিছু একটা। তর্কের ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলল মা ছেলেতে। কয়েক মিনিট পর রোমেলা সীমাহীন বিতৃষ্ণা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্তিমিশ্রিত মুখে হেঁটে এসে বসলেন হৃদির মায়ের পাশের চেয়ারে। 

ওয়েটার মুখের সামনে খাবার ভর্তি ডিশ রেখে যাচ্ছে বিরতিহীন ভাবে। রুদ্র শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে বেশ আয়োজন করে খাওয়া শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টেবিলে এসে গেছে ধোঁয়া ওঠা কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন রোস্ট, চিংড়ির মালাইকারি, পাবদা মাছ ভুনা, সর্ষে ইলিশ আর সালাদ। রুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়েছে টেবিলের ওপর। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে খাবার তুলে নিচ্ছে প্লেটে। তার মুখখানি এখন অনাবিল সুখে মাখামাখি হয়ে আছে। ভোজনের মতো আনন্দদায়ক ব্যাপার যেন এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হয় না। আহা কী আনন্দ! তারা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। ছেলেটার এই খাদক খাদক ভাব দেখে তার গা ঘিনঘিন করছে। নিজের খাওয়ার রুচি চলে যাচ্ছে। এত বড় রাক্ষস সে জীবনে এই প্রথম দেখল। ভুখা ভিখারীর মতো হাপুস হুপুস করে খেয়ে যাচ্ছে! 

অমৃতা একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না। লোকটা কি চলে যাচ্ছে? মাত্রই তো এলো!… আসা মাত্রই আবার চলে যাচ্ছে কেন? হ্যাঁ ওই তো চললেন! কান্না পাচ্ছে অমৃতার। ওই মানুষটার মধ্যেই যেন তার প্রাণভোমরাখানি লুকায়িত আছে। মনে হচ্ছে মানুষটা এখান থেকে প্রস্থান করলে এবার সে মরেই যাবে। সেই সময় হঠাৎ অদৃশ্য শেকলে টান পড়ল। মানুষটা থমকে দাঁড়ালেন। আশপাশটা দেখলেন একবার সতর্ক চোখে। বাম দিকে পাঁচ কদম দূরের একটা টেবিলে অমৃতা বসে আছে। তিনি এক ঝলক তাকালেন ওর দিকে। অমৃতা ওই দৃষ্টির অর্থ কী বুঝল কে জানে। চট করে উঠে গেলো চেয়ার ছেড়ে। ওকে উঠে পড়তে দেখে রাশেদও আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বাগানের চৌহদ্দি পেরোলেন। পাজেরো মিৎসুবিশি গাড়িটা মূল গেটের কাছাকাছি রাখা। বাগানের পর সোজা বিশ গজের মতো চিকন একটা রাস্তা চলে গেছে গেট অবধি। রাস্তাটা একেবারে খালি নয়। কয়েকজন অতিথি নিরুদ্দেশ ভাবে হাঁটাহাঁটি করছে এ মাথা থেকে ও মাথা। এদের মধ্যে দুজন রাশেদকে দেখে বিনীতভাবে সালাম দিয়ে উঠল। তিনি মাথা নেড়ে সালামের উত্তর দিলেন। গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন চুপ করে। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল সম্মুখে। খুলে দিয়েই চলে গেলো না, তাঁর উঠে বসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। গেটের মাথায় একটা নিষ্প্রভ হলুদ আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখতে পেলেন অমৃতা সরু রাস্তার এক কোণে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মাথা অবনত। পায়ের জুতো দিয়ে একটা ইটের টুকরো নাড়াচাড়া করছে অস্থির ভঙ্গিতে। অতিথিদের দলটা হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে। ড্রাইভারটাও অপেক্ষা করে আছে দরজা খুলে রেখে। ড্রাইভারকে কিছু না বলেই কয়েক পা এগিয়ে আসলেন তিনি। আধো অন্ধকারে অমৃতার মুখোমুখি দাঁড়ালেন নিঃশব্দে। সামির সেদিনকের মরণ দশা দেখার পর মনে মনে ঠিক করেছিলেন মেয়েটার সাথে আর কোনোভাবেই কোনো রকম যোগাযোগ রাখবেন না। কতবার ইচ্ছে হয়েছিল একটাবার জানতে, যে মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে। শুধু ছেলের মুখের দিকে চেয়েই তিনি এই অদম্য ইচ্ছেকে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে হাজার চেষ্টার পরেও প্রতিরোধের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। টানছে চুম্বক। এই আকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চাইতেও বুঝি বেশি শক্তিশালী। 

—‘কিছু বলবে?’ 

অমৃতা চোখ তুলে তাকালো। কী বলবে সে? মাথার ভেতরে তো এই মুহূর্তে কিচ্ছু কাজ করছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা! 

—‘আপনার পাঞ্জাবির রংটা…’ 

—‘কী হয়েছে পাঞ্জাবির রং?’ গম্ভীর মানুষটার গম্ভীর প্রশ্ন! 

—‘সুন্দর!’ জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে আলতোভাবে উচ্চারণ করল অমৃতা। —‘তাই?’ 

—‘হুম। আপনিও খুব সুন্দর!’ 

—‘আচ্ছা?’ এবার তিনি হাসলেন। 

কিছুক্ষণ নীরব। তিনজনের দলটা খুব লক্ষ্য করছে ওদেরকে। এতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিল, এখন দাঁড়িয়ে পড়েছে। এরা অফিসেরই কর্মচারী। প্রত্যেকের নাম আলাদাভাবে মনে না থাকলেও মুখ চেনা। একটা ফিসফিসানি ভেসে আসছে হাওয়ায়। কী কথা বলছে ওরা কে জানে! 

—‘আমার পুতুলটা কেমন আছে?’ আবছা গলায় প্রশ্ন করলেন রাশেদ।

—‘ভালো থাকার চেষ্টা করছে।’ 

—‘ভেরি গুড। পুতুলটা ভালো থাকবে। ওর ওপর আমার বিশ্বাস আছে।’ অমৃতা চুপ করে রইল। 

—‘এখন আসি?’ 

—‘আরেকটু?’ বাচ্চাদের মতো আবদার করে অমৃতা। 

—‘উঁহু! রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।’ 

—‘আচ্ছা।’ 

লোকটা আর কথা বাড়ায় না। ঘুরে দাঁড়ায়। মাথা হেঁট করে ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। একটা গভীর শ্বাস পড়ে। যে জীবনে প্ৰিয় মানুষকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে হয়, সে জীবন আর যাইই হোক না কেন সুখের অন্তত নয়! 

মনীষা গান গাইল সেই সন্ধ্যায়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে। লোকজনের ভিড়ে গুঞ্জন পড়ে গেলো। সবাই জানতে চায় এই পরমা সুন্দরী মেয়েটি কে? মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর গানের গলা। রূপের সাথে গুণের এমন চমৎকার সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে না তো! 

রাতে বন্ধুরা কেউ বাড়ি ফিরল না। থেকে যেতে হলো তারা আর মনীষাকেও। অতিথিরা চলে যাবার পর ওরা সবাই ছাদে উঠে এলো। গভীর রাত অবধি চলল গানের আসর। হাসি, ঠাট্টা আর আনন্দের জোয়ারে অনেক দিন পর রমরম করে উঠল বাড়িটা। কারো ঘুম হলো না ঠিক মতো। রুদ্র সকাল আটটার সময় বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। সামিকে আলসেমিতে পেয়ে বসল। ঠিক করল একটু দেরি করেই অফিস যাবে আজ। নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার এটাই সুবিধা। জবাবদিহিতা নেই। আকাশ, মনীষা আর তারা সকাল নয়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। সৌভাগ্যবশত অমৃতার আজ কোর্টে যাবার প্রয়োজন নেই। বিকেলের দিকে একবার চেম্বার থেকে ঘুরে আসলেই হবে। 

এদিকে হক সাহেব অফিসে চলে যাবার পর রোমেলা লাইব্রেরি রুমের দরজাটা চাবি দিয়ে খুললেন। একটাবার পুরো ঘরটা তল্লাশি করে দেখতে চান। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই অবশ্য পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে। এসব দিক দিয়ে স্বামীকে বিলক্ষণ চেনেন তিনি। অতি ধুরন্ধর। কাঁচা হাতের কাজ ওই লোক করে না। অবশ্য মোবাইল ঘাঁটলে ঠিকই প্রমাণ পাওয়া যাবে। এর মাঝে একজন আইটি অফিসারের সাথে রোমেলা কথা বলেছেন। মোবাইলের পাসকোড উদ্ধার করার ব্যাপারে। অফিসার মোটা অংকের টাকা চেয়েছে, সেই সাথে কাজ হবার নিশ্চয়তাও দিয়েছে। কিন্তু মোবাইলটা তিনি চুরি করবেন কী করে? এই ঘরের চাবি চুরি করতেই তো দিন রাত এক করে ফেলতে হয়েছে। মোবাইল চুরি তো এক অসম্ভব ব্যাপার। ভাবতে ভাবতে কাঠের টেবিলের ড্রয়ারটা পাগলের মতো তন্নতন্ন করে ঘাঁটছিলেন রোমেলা। হঠাৎ একটা ছোট্ট কাগজে তাঁর চোখ দুটো সুপার গুর মতো আটকে গেলো। ধক করে উঠল বুক। কাঁপা হাতে চিরকুটটা হাতে নিলেন তিনি। 

৯৯

সকাল দশটায় গোসলটোসল সেরে গেস্টরুম থেকে বেরোলো অমৃতা। করিডোর পেরিয়ে ডাইনিং এ আসতেই দেখল ফাঁকা ঘরে রোমেলা বসে আছেন থমথমে মুখ নিয়ে। অমৃতা ঘরে ঢুকতেই তিনি ক্রূর চোখে তাকালেন। ওই দৃষ্টিটা দেখামাত্র গা রিরি করে উঠল রাগ আর বিরক্তিতে 1 এক ঝলক তাকিয়েই অমৃতা ঘুরে দাঁড়াল। সকাল সকাল এই বিরক্তিকর মহিলার মুখ দেখতে হলো। মনে হচ্ছে দিনটা খুব বেশি ভালো কাটবে না। সামি, হৃদি মনে হয় এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বাকি বন্ধুরা সব এর মাঝেই বেরিয়ে গেছে। তার নিজেরও এখন বেরিয়ে পড়া উচিত। 

—‘এই মেয়ে!’ কর্কশ গলার সম্বোধনটা শুনে থমকে দাঁড়ালো অমৃতা।

—‘বলুন।’ 

রোমেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পরনে একটি গোলাপি রঙের নাইটি। মাথার চুল আলুথালু হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠময়। ফর্সা মুখের ত্বকে তেজের আভা ঝিলিক দিচ্ছে। চোখজোড়া জিঘাংসার হিংস্র ছোবল। এই বিভীষণ রূপ হঠাৎ অমৃতার অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। ভয় এবং অনিশ্চয়তার প্রাবল্যে বুকের ভেতরটা হিমালয় শৃঙ্গের মতো জমাট হয়ে এলো মুহূর্তের মাঝে। মহিলা এভাবে কথা বলছে কেন? সে কি কিছু টের পেয়েছে? 

—‘নিজেকে খুব চালাক মনে করো তুমি?’ সর্পিনীর মতো ফণা তুলতে তুলতে রোমেলা গটগটিয়ে হেঁটে এগিয়ে এলেন অমৃতার দিকে। অমৃতা তখন স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্বাস গেছে থেমে। চোখে আতংকের সুস্পষ্ট ছাপ। রোমেলা ওর মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর কোনো কথা না বলে হঠাৎ মুখ থেকে একদলা থুতু ছুঁড়ে মারলেন ‘থু’ শব্দ করে। তরলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল অমৃতার গালে। দুঃসহ যন্ত্রণায় মুখ কুঁকড়ে গেলো তার। অপমানে বুজে ফেলল চোখ। অপ্রতিরোধ্য কম্পনে থরথর করে কেঁপে উঠল সারা শরীর। গলা দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। নিশ্চল, নির্বাক স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রইল শুধু। কিছু মুহূর্ত পরে পকেট থেকে রুমাল বের করে থুতুটা মুছে নিল মুখ থেকে, নিঃশব্দে! 

রোমেলা ওর চোখের সামনে একটা ছোট্ট কাগজ মেলে ধরলেন। গলা ফাটানো চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এসবের মানে কী?’ অমৃতা নিশ্বাস বন্ধ করে চোখ মেলে তাকালো। মহিলার হাতে তার লেখা চিরকুট। যেখানে একদিন সে বুকের সব আবেগ ঢেলে দিয়ে লিখেছিল, রাশেদ আপনাকে ভালোবাসি নিশ্বাসের মতো… এখানে তার নিজের নামও লেখা আছে! সর্বনাশটা তাহলে হয়েই গেছে। হ্যাঁ হয়ে গেছে! অমৃতার মনে হচ্ছিল এই মাত্র বুঝি অনেক উঁচু বিল্ডিং থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তাকে। সে প্রবল বেগে পতিত হচ্ছে ভূগর্ভে। আরেকটু পরেই মুখ থুবড়ে পড়বে শক্ত মাটিতে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে হাত পা, থেঁতলে যাবে মুখমণ্ডল। 

—‘আমি কিছুই বলব না তোমাকে। যা করার আমার ছেলেই করবে।’ দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন রোমেলা। 

ক্ষুরধার বিদ্যুতের তীব্র আঘাতে যেন চমকে উঠল অমৃতা। বুকের মধ্যে খচ করে বিঁধে গেলো ছুরি। শুরু হলো রক্তক্ষরণ। ‘প্লিজ! সামিকে কিছু বলবেন না!’ শত সহস্র বছরের হিমায়িত মৃত্যুর কোল থেকে জেগে উঠে যেন শব্দগুলো উচ্চারণ করল অমৃতা। বহু কষ্টে! রোমেলার মুখে স্বৈরিণী হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। চেহারা মাখামাখি হয়ে গেলো পৈশাচিক আনন্দে। 

—‘সামির সামনে তার বন্ধুদের আসল রূপটা এবার প্রকাশ হয়েই পড়বে। পাপীর বিচার এই দুনিয়াতেই করবেন আল্লাহতায়ালা। আমার সংসার ভাঙার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। জীবনে কখনো সুখী হবে না তুমি!’ 

কথাটা বলে নিয়ে হাতের মুঠোয় শক্ত করে কাগজটা চেপে ধরে রোমেলা পা বাড়ালেন। অমৃতা এগিয়ে এসে তার একটা হাত ধরে ফেলল, অসহায় গলায় বলল, ‘প্লিজ, আপনি সামিকে কিছু বলবেন না। ও কষ্ট পাবে। 

রোমেলা এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিলেন, তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘সরো! খবরদার আমাকে ছোঁবে না তুমি!’ 

অমৃতা এবার আকুলভাবে বলল, ‘আপনি সামিকে ব্যাপারটা জানাবেন না দয়া করে। যা শাস্তি দেবার আমাকে দিন। দোষ আমার। আমি আপনার ফ্যামিলি থেকে অনেক দূরে চলে যাব। আল্লাহর কসম আর কোনোদিন মুখ দেখাব না আপনাদের!’ রোমেলার সর্বাঙ্গ রাগে আর ঘেন্নায় জ্বালা করে উঠল। এইসব মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েরা পারে শুধু নাটক করতে। নাটক করেই পুরুষমানুষের মগজ খায় এরা। ছিঃ! 

তিনি ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘এসব নাটক করে কোনো লাভ নেই। সামিকে আমার ঘটনা জানাতেই হবে! 

কথাটা বলে শেষ করে তিনি দ্রুত পায়ে জায়গাটা থেকে সরে পড়লেন। বিধ্বস্ত এবং অশ্বীভূত অমৃতা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র কোনো নিকটজনের কাল হয়েছে। কতক্ষণ কাটল কে জানে। একটা সময় অমৃতা প্যান্টের পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে নিল। তার হাত পা টলছে মৃগী রোগীর মতো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মেসেঞ্জার খুলে বন্ধুদের চ্যাট গ্রুপে ডায়াল করল সে। আকাশ আর বিভা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ করল। খুব দ্রুত কথাগুলো বলে ফেলল অমৃতা। 

—‘শোন, সামির মা আমার আর রাশেদের ব্যাপারটা জেনে গেছে। আর সে বলছে যে সামিকে সব কিছু খুলে বলবে আজকেই। এখন… কী করব?’ 

অমৃতার গলা অস্বাভাবিক রকমের কাঁপছিল। ফোনের অপর দুই প্রান্তের দুজন বন্ধু এক ধাক্কায় ঠিকঠাক কিছুই বুঝে উঠতে পারল না তার কথা। তবে ওই ভাঙা ভাঙা কয়েকটা কথা শুনেই বেশ ঘাবড়ে গেছে ওরা। বিভা আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলে উঠল, ‘কী হইছে? হ্যাঁ? আমি বুঝি নাই।’ আকাশও একই ধরনের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করল। 

—‘অমৃতা, তোর কথা অস্পষ্ট। আরেকবার বল।’ 

—‘বাল, কানে কালা নাকি তোরা? কথা বুঝিস না কেন? সামির মা…’ অমৃতা হাঁপাচ্ছে। দম আটকে আসছে তার কথা বলতে গিয়ে। 

—‘হ্যাঁ, কী হইছে সামির মায়ের? তুই একটু শান্ত হ। ডোন্ট প্যানিক দোস্ত।’ আকাশ বলল। 

—‘শি নোজ এভরিথিং!’ 

—‘ও… ফাক! কী বলতেছিস তুই এসব?’ বিভার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো শব্দগুলো আর্তনাদের মতো। আকাশ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না। ভারি শ্বাস প্রশ্বাস পড়তে লাগল শুধু। 

—‘কীভাবে?’ বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশ জানতে চাইল। ঠান্ডা… খুব ঠান্ডাভাবে। 

—‘আমার লেখা একটা চিরকুট পাইছে সে। কোত্থেকে পাইছে জানি না।’ 

রুদ্র অনলাইনে আসলো সেই মুহূর্তে। জয়েন করার সঙ্গে সঙ্গেই ছুঁড়ে দিল প্রশ্নটা, ‘কী হইছে?’ আকাশ বলল ওকে ঘটনাটা অতি সংক্ষেপে। 

—‘জানতাম এরকম হবে। এইজন্যেই তোরে সাবধান হইতে বলছিলাম অমৃতা। বারবার বলছিলাম!’ বিলাপ করার সুরে বলল রুদ্র কথাগুলো। প্ৰচণ্ড ক্ষোভ আর আফসোস নিয়ে। 

—‘আচ্ছা থাম, এখন এসব বলার সময় না। যা হবার হয়ে গেছে। এখন ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।’ বিভা বলল। 

—‘হ্যাঁ সেটাই। অমৃতা লিসেন! তুই তোর রাশেদরে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানা তাড়াতাড়ি। দেরি করিস না।’ মতামত দিল আকাশ। 

অমৃতা কাঠের চেয়ারের হাতলের ওপর তখন পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন হাতটা সরিয়ে ফেললেই সে কাটা গাছের মতো ঝপ করে মুখ থুবড়ে পড়বে মাটিতে। 

—‘কথা বলছিস না কেন? সাহস রাখ মনে।’ আকাশ বলল। 

অমৃতা এবারেও কিছু বলল না। 

—‘দোস্ত শোন, অমৃতা! আমার কথা শোন।’ বিভা ডাকল ওকে। বাড়ির পোষা বেড়ালকে যেমন আদর করে ডাকে লোকে। 

—‘বল।’ একটা শব্দ বেরোলো অমৃতার গলা দিয়ে। অনেকক্ষণ পর।

—‘তুই যদি সত্যিই লোকটাকে ভালোবেসে থাকিস, তাহলে ভয় পাস না। ভালোবাসলে ভয় পেতে নেই।’ বলল বিভা অনেকখানি দৃঢ়তার সাথে। 

আকাশ যোগ করল, ‘হ্যাঁ সেটাই। ভয়ের কিছু নাই। আমরা তোর সাথে আছি। ওই মহিলা তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর দোস্ত সামিকে নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। ওরে আমরা দেখতেছি। তুই জাস্ট সামির বাবাকে বিষয়টা জানায় রাখ। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’ 

বন্ধুদের কথা অমৃতার ক্ষুব্ধ, অশান্ত মনটার ওপর সান্ত্বনার মৃদু পরশ বুলিয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় বেঁধে যাওয়া জটগুলো খুলতে শুরু করল একটা একটা করে। বন্ধুরা তার পাশে আছে। এখন আর কোন ভয় নেই! 

রুদ্র মুখ খুলল এবার, ‘হ্যাঁ, আমরা তোর সাথে আছি।’ 

হৃদির উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো সেই মুহূর্তে। সে ফোন ধরেই বলে উঠল, ‘কীরে কী হইছে?’ এটুকু বলেই আবার বলল, ‘আচ্ছা শোন, আমার শাশুড়ি আসছে। দরজা নাড়তেছে। পরে কথা বলব।’ 

হৃদি চলে যাবার পর বিভা খুব ঠান্ডা ভাবে বলল, ‘অমৃতা, তুই উনাকে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানায় দে। আর সময় নষ্ট করিস না।’ 

—‘আচ্ছা, আমি রাখতেছি তাহলে।’ বলল অমৃতা। 

—‘ওকে, আমি আর রুদ্র, সামির ব্যাপারটা দেখতেছি। তুই টেনশন নিস না।’ বলল আকাশ। 

রাশেদকে ফোনে পাওয়া গেলো না। প্রায় দশবারোবার টানা ফোন করার পর অধৈর্য অমৃতা ভূতগ্রস্তের মতো বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে। একটা রিকশা নিয়ে সোজা রওয়ানা দিল হক এন্টারপ্রাইজের উদ্দেশ্যে। উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে যাচ্ছিল সে। আতঙ্কে জমে আছে ভেতরটা। আল্লাহ যেন শত্রুকেও কখনও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন না করেন। হঠাৎ মাথায় আসলো ব্যাপারটা। অন্য কারো মুখ থেকে শোনার আগে তার উচিত নিজেই সব কিছু খুলে বলা সামিকে। ফোন বের করে চট করে নোটপ্যাডে সেভ করে রাখা চিঠিটা ইমেইল করল সে সামির ঠিকানায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *