বৃষ্টিমহল ৩.৯০

৯০

সামির জ্বরটা নামছিল না। ঘুমের মধ্যে বারবার আর্তনাদ করে উঠছিল। যেন কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে যাচ্ছে বিরতিহীনভাবে। নিরুপায় হয়ে হৃদি নিচতলায় নেমে এলো। স্টাডিরুমের দরজার বাইরে বিশ পঁচিশ জোড়া স্যান্ডেল রাখা। ভেতরে জোর আলোচনা চলছে। চাকরবাকররা চা নাশতার ট্রে নিয়ে আসা যাওয়া করছে অনবরত। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় ছিল। হৃদি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে খালি চায়ের কাপের ট্রে নিয়ে একটি কাজের মেয়ে বেরিয়ে আসলো। হৃদি উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘বাবাকে একটু ডাকো তো। জরুরি কথা আছে।’ আদেশ শুনে কাজের মেয়েটির মুখ বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শুকনো গলায় বলল, ‘স্যার তো ভাষণ দিতাছে। আমার ডর করে ভাবি উনার সাথে কথা কইতে। আপনে কন।’ 

মেয়েটির অবাধ্যতা দেখে রাগ ধরে গেলো। কিন্তু রাগটা হজম করল হৃদি। মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেলো ভেতরে। ঘরভর্তি নানা বয়সি মানুষ। বেশিরভাগই পুরুষ। হাতে গোণা দু তিনজন মহিলা আছেন। শ্বশুর মশাই ঘরের মাঝামাঝি অবস্থানে বসে কথা বলছেন দরাজ গলায়। হৃদির আকস্মিক উপস্থিতি তাঁর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল। তিনি একটু থমকে গেলেন, ‘কিছু বলবে বৌমা?’ 

ঘরের প্রতিটি মানুষের জোড়াচোখ তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে হৃদির মুখের ওপরেই নিবদ্ধ। এ বাড়ির নতুন বৌকে অনেকেই দেখেননি। কদিন বাদে বৌভাতের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। বৌভাতে অফিশিয়াল এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকজনদের দাওয়াত দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন হক। সেসব আনুষ্ঠানিকতার আগেই নতুন বৌ দর্শন হয়ে গেলো উপস্থিত লোকজনের। তাকানো মাত্রই তারা বুঝে গেলো যে এই মায়াবী সুন্দর মেয়েটিই হক সাহেবের একমাত্র পুত্রবধূ। 

—‘বাবা একটু শুনবেন?’ হৃদির কাতর কণ্ঠে অনুরোধের সুর বেজে উঠল।

হক সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে আসলেন ঘর থেকে পুত্রবধূর সাথে। দরজার বাইরে এসে হৃদি উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘সামির সেই দুপুর থেকে খুব জ্বর বাবা। ওখুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু জ্বরটা ছাড়ছেই না। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমার শাশুড়ি বাসায় নেই। ফোন দিয়েছি বেশ কয়েকবার। ধরছেন না। আপনি কি একবার আসবেন?’ 

হক সাহেবের মুখে চিন্তার একটা ক্ষীণ রেখা ফুটে উঠল। 

—‘হঠাৎ জ্বর আসলো কেন?’ কথাটা বলতে বলতে তিনি করিডোর ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন সামনে। হৃদি তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘কারণটা ঠিক বুঝতে পারছি না বাবা। গতকাল রাতে ঘুম হয়নি ওর। আপনি তো জানেন আপনার ছেলে কিছু নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা করলেই জ্বর চলে আসে। অদ্ভুত ব্যাপার।’ 

হক সাহেব এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বললেন না। এক নিচ্ছিদ্ৰ দুর্ভাবনা এবং উৎকণ্ঠায় তাঁর চিত্ত অস্থির হয়ে উঠল। ছেলেটাকে তিনি সত্যই খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন। তাঁর একটিমাত্র সন্তান। একটিমাত্র বুকের ধন। এই ছেলে কষ্ট পেলে যে গোটা দুনিয়া অন্ধকার! সামির চোখ বোজা ছিল। ঘরের ভেতর দুটি মানুষের ঝটিকা প্রবেশ সে টের পেল না প্রথমে। টের পেল তখন, যখন বাবা এসে তার কপালে একটা হাত রাখলেন। দুর্বল চোখ মেলে তাকাল সে। দুর্বল গলায় ডাকল একবার, ‘বাবা!’ 

হক সাহেব ছেলের মাথার কাছে বসলেন। নরম স্বরে বললেন, ‘আব্বু তোমার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’ 

হৃদি সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সামি বাবার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে হৃদির দিকে এক ঝলক তাকালো। কারো কিছু বলতে হলো না। হৃদি কী করে যেন বুঝে গেলো এই মুহূর্তে তার এখান থেকে একটু সময়ের জন্য হলেও সরে যাওয়া উচিত। ওদের বাবা ছেলের একটু প্রাইভেসি দরকার। একটু আলাদা সময় দরকার। এই মুহূর্তে তার দখলদারি একেবারেই মানায় না। কোনো কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে। 

—‘মা কোথায়?’ চোখ দুটো কপালের ওপর তুলে বাবার দিকে দৃষ্টি তাক করে বলল সামি। 

—‘বাইরে গেছেন তোমার মা। বাসায় নেই।’ ছেলের মাথায় হাত রেখে তিনি উত্তর দিলেন। 

সামি একটু সময় চুপ করে রইল। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল জিব দিয়ে। তারপর ক্লান্তভাবে বলল, ‘তুমি আমার মাকে ভালোবাসো না বাবা?’ 

হক সাহেবের বুক মোচড় দিয়ে উঠল এই প্রশ্নে। তীব্র কনকনে এক ব্যথা শৈত্যপ্রবাহের মতো উড়ে এসে হিমায়িত এবং জারিত করে তুলল অন্তর দেশ। তিনি ছেলের একটা হাত ধরে ব্যাকুলভাবে বললেন, ‘এসব নিয়ে এখন চিন্তা করো না তুমি। আমি এবং তোমার মা সবসময় তোমার পাশে আছি। কেমন?’ 

সামি একদম বাচ্চা ছেলের মতো আবদারের গলায় বলল, ‘তুমি কখনো আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো বাবা?’ 

—‘না যাব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’ 

এই সান্ত্বনা বাক্যটি সামির অস্থির করুণ মুখখানা অনেকখানি স্বাভাবিক করে তুলল। দুচোখের তারায় জ্বলতে থাকা পেরেশানির অগ্নিময় শিখা একটু নিভন্ত মনে হলো। 

—‘তুমি রেস্ট নাও। জ্বর না কমলে ডাক্তার ডাকতে হবে।’ 

—‘ডাক্তার লাগবে না বাবা। ঠিক হয়ে যাবে।’ 

—‘কাল অফিস যেতে হবে না। তুমি এক কাজ করো বন্ধুদের সাথে ঢাকার বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আসো। দেশের বাইরেও যেতে পারো। কোথায় যাবে বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ 

সামি একটু সময় চুপ থেকে বলল, ‘দেখি।’ 

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হক সাহেব সস্নেহে বললেন, ‘তুমি এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’ 

সামির ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদে উঠে আসলেন তিনি। ডায়াল করলেন অমৃতার নম্বরে। 

—‘হ্যালো।’

—‘অমৃতা! শোনো কয়েকটা জরুরি কথা বলে নেই। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। মিটিং এর মাঝখানে আছি।’ 

—‘জি বলুন।’ 

—‘সামি খুব অসুস্থ। ডিপ্রেশনে ভুগছে আমার ছেলেটা। আমি ওর এই অবস্থা সহ্য করতে পারছি না। তোমার আমার ব্যাপারটা সামিকে কোনোভাবেই জানানো যাবে না। বুঝতে পারছ তুমি?’ 

অমৃতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কঠিন গলায় বলল, 

—‘আপনি তাহলে আমার কাছে আসছেন না। তাই না রাশেদ?’ 

রাশেদ তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। একটা নিগূঢ় দিশাহারা ভাব যেন তাঁকে শব্দশূন্য করে তুলেছে। আজ সব আছে। সম্মান, সুখ্যাতি, যশ, অর্থ, সম্পদ সব! নেই শুধু নিজের স্বাধীনতা। হাজার হাজার আপামর জনসাধারণের সহায় হওয়া মানুষটা আজ নিজ জীবনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে কী নিদারুণ অসহায়! বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘তুমি ফিরে এসো। তোমার বন্ধুকে দেখে যাও। গাড়ি তো আছেই তোমার সাথে।’ 

—‘গাড়ি লাগবে না। আমি বের হয়ে যাচ্ছি এখুনি। যেখানে ইচ্ছা যাব। আপনার চিন্তা করতে হবে না।’ 

—‘অমৃতা! তর্ক করো না। কথা শোনো।’ 

—‘কেন শুনব? আপনি কি আপনার কথা রেখেছেন? কথা দিয়েছিলেন আমার কাছে আসবেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আর এখন ফোন দিয়ে বলছেন…’ 

—‘অমৃতা প্লিজ। আমার সময় নেই। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। সে তোমাকে উত্তরা নিয়ে আসবে।’ 

—‘আমি উত্তরা আসব না।’ গোঁ ধরা গলায় বলে অমৃতা। 

—‘তোমার মতামত কেউ জানতে চায়নি।’ কথাটা বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন। ড্রাইভারের নম্বরে ডায়াল করে আদেশ দিলেন যে কোনো উপায়ে যেন মেয়েটিকে ধরে বেঁধে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। 

নিরুপায় অমৃতা রাগে গজগজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসল। তার শিরা উপশিরায় তখন জ্বলছে তেজের শিখা। স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে আর অপমানের তীব্র দহনে অন্তর পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে এর চাইতে বুঝি মৃত্যুও ঢের সুখের হতো। বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে না আর এই ছাইপাশ জীবনটাতে। 

সন্ধ্যার জ্যাম ঠেলে উত্তরা এসে পৌঁছুতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লেগে গেলো। হক সাহেবের মিটিং তখন শেষ হয়েছে। তিনি ছেলের ঘরে এসে বসেছেন। হৃদি সামির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল। সামিকে আগের চাইতে সতেজ দেখাচ্ছে এখন। যদিও শরীরের তাপমাত্রা কমেনি। তবে চেহারার বিষণ্ণ ভাবটা অনেকটা কমে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে বাবার উপস্থিতি তার ভেতরে প্রাণের সঞ্চার করেছে। রোমেলা রাস্তার জ্যামে আটকে আছেন। ছেলের অসুস্থতার খবর তিনি পেয়েছেন। তবে ছেলের বাবা বাড়িতে আছেন বলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। ধীরেসুস্থে বোনের বাসা থেকে বেরিয়েছেন তিনি। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। 

অমৃতা দরজার নব ঘুরিয়ে সশব্দে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। তার ছোট ছোট বয়কাট চুল অবিন্যস্ত হয়ে আছে। চোখে কীসের যেন চাপা ক্ষোভ। ফর্সা গালে রাগের লালচে আভা। হৃদি ওকে দেখে থমকে গেলো। চোখের তারায় ফুটে উঠল বিহর্ষ বিস্ময়। রাশেদ ছেলের বিছানার পাশে ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন। হাতে ধরা আজকের খবরের কাগজ। অমৃতা ঘরে ঢোকামাত্রই রাশেদের দিকে একটা কট্টর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রাশেদ সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলেন। 

—‘কীরে দোস্ত? কী অবস্থা?’ কেউ কোনো কথা বলল না। কথা বলল শুধু জ্বরে কাতর অসুস্থ সামি। ক্লান্ত স্বরে। 

অমৃতা এগিয়ে গেলো, ‘তোর কী হইছে? ভং ধরছস ক্যান?’ 

সামি হাসার চেষ্টা করল। জ্বরের মধ্যেও তার ম্লান হাসিটা সুন্দর দেখালো। সেই সময় অমৃতার জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হলো সামির হাসির সাথে তার বাবার হাসির বিস্তর মিল আছে। শুধু গায়ের রংটা ছাড়া সামি আসলে ওর বাবারই কার্বন কপি 

অমৃতা সামির পায়ের কাছে এসে বসল। কাঁথার দিয়ে মোড়া ওর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা খপ করে ধরে হিসহিসে গলায় বলল, ‘কথা বলিস না ক্যান? হইছে কী তোর?’ 

সামি একবার আড়চোখে বাবার দিকে তাকালো। অমৃতাটার কোনো আদবকায়দার বালাই নাই। বাবা পাশে বসে আছেন অথচ সে একটা সালাম পর্যন্ত দিল না। যেন বাবাকে দেখতেই পায়নি। 

রাশেদের মুখে স্বভাবসুলভ অটল গাম্ভীর্য খেলছিল। ছেলের বৌয়ের সামনে তিনি বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করছেন। কেন যেন মনে হচ্ছে ছেলের বৌ তাঁর এবং অমৃতার ব্যাপারে কিছু হলেও জানে। ব্যাপারটা তাঁর জন্য খুবই লজ্জাজনক। 

—‘তেমন কিছু না। শরীরটা একটু খারাপ।’ উত্তর দিল সামি। 

—‘দুই দিন পর পর কী হয় তোর শালা!’ 

হৃদি চুপচাপ সামির মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছিল। তার মুখখানা থমথম করছে রাগে। কার ওপর এত রাগ কে জানে! মনে হয় অমৃতার ওপরেই। অথচ একটু আগেই অমৃতার জন্য তার মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু মেয়েটার এই বেহায়ার মতো আকস্মিক আগমন মনের ভেতর পূর্বের রাগ ফিরিয়ে এনেছে। বারবার ঘুরেফিরে এ বাড়িতে আসা কেন ভাই? আত্মসম্মান বোধ বলতে কি কিছু নেই নাকি? এই মেয়ে সত্যি পাগল হয়ে গেছে। বরবাদ হয়ে গেছে। উচ্ছন্নে গেছে! 

ভাবতে ভাবতে হৃদি জলের বাটিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখে বলল, ‘আমি পানিটা পাল্টে আনি। বাবা আপনি চা কফি কিছু খাবেন?’ 

রাশেদ নিউজ পেপার থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘চা হলে মন্দ হয় না।’ 

হৃদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই অমৃতা জায়গা বদল করল। সামির পায়ের কাছ থেকে উঠে এসে মাথার কাছে বসল খুব সন্তর্পণে। সামির মুখটা বড়ই রুগ্ন দেখাচ্ছে। কেমন মায়া লাগল দেখে। অমৃতা ওর কপালে একটা হাত রেখে বলল, ‘তোর মন খারাপ নাকি?’ 

সামি অস্পষ্টভাবে বলল, ‘না এখন ঠিক আছি।’ 

অমৃতা ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিষ্পলক। এই ছেলেটা জন্মেছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে। জন্মের পর থেকে সে দুঃখ কষ্ট অভাব অনটন দেখেনি কখনো। যখন যা চেয়েছে, পেয়েছে। জীবন তার কাছে ফুলশয্যা বৈ অন্য কিছু নয়। শুধু বিভার সাথে বিচ্ছেদটাই তার জীবনের একমাত্র কালো অধ্যায়। সেই কালো অধ্যায়টিও এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে, ঘুচে গেছে হৃদির আগমনে। হৃদি ওর জীবনে বিভার অভাব পূরণ করে দিয়েছে। বাবা মা আর স্ত্রীকে নিয়ে সামির ছিমছাম সুখের সংসারটি এখন পরিপূর্ণ। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে সে চকিতে একবার তাকালো খানিক দূরে বসে থাকা মানুষটার দিকে। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর হুহু করে একটা বোবা কান্নার ঝড় উঠল। এই দুটি মানুষই তার জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, এদের দুজনকে কোনোভাবেই একসাথে সে চাইতে পারবে না। বেছে নিতে হবে যেকোনো একজনকে। যাকেই বেছে নিক না কেন আগুনে তাকে ঝাঁপ দিতেই হবে। চোখের সম্মুখে সে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাচ্ছে। আর একটু হলেই সেই আগুন ছুঁয়ে ফেলবে তাকে। এবার আর বেঁচে যাবার পথ নেই। জ্বলতে তাকে হবেই। হয় একূলে নয় ওকূলে! 

রোমেলা ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন ঝড়ের বেগে।’ আমার বাচ্চাটার কী হয়েছে?’ ‘বলে তিনি সামির কাছে উড়ে আসলেন মুহূর্তের মাঝে। অমৃতা চট করে সরে গেলো জায়গাটা থেকে। সামি বাবা মা দুজনকে একসাথে পেয়ে তৃপ্ত হলো, প্রীত হলো এবং সবশেষে নিশ্চিন্ত হলো। ঘর থেকে বেরোবার আগে অমৃতা একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ওদের তিনজনকে একত্রে। ভালো দেখাচ্ছে। সুন্দর, ছোট্ট ছিমছাম পরিবার। হৃদি এসে পাশে দাঁড়ালেই ষোলো আনা পূর্ণ হবে। চোখের সামনে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অশ্রুবিন্দুর ভেতর দিয়ে সে হৃদিকে ঘরে ঢুকতে দেখল। তারপর আর একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে সোজা নেমে এলো নিচে বিড়বিড় করে জপ করার মতো বলতে লাগল, ভালো থাকো তোমরা। ভালো থাকো। ভালো থাকো। ভালো থাকো! সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার দুটি চোখের মণি নিশ্চল হয়ে সম্মুখে চেয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে এখন শুধুই শূন্যতা। একটা জলের ধারা ডান চোখের নিচ দিয়ে বয়ে এসে গাল ছুঁয়ে ফেলেছে। মুখজোড়ায় বিক্ষিপ্ত হৃদয়ের ভাঙচুরের প্রতিফলন। তার ভেতরে সকাল বেলার অসহায় ভাবটা আবারও ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছে বুঝি কেউ পাশে নেই কিচ্ছু নেই, ফাঁকা, সব ফাঁকা! 

ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসল সে। সিলিঙে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতির হলুদ আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। ঘরের ভেতর এয়ার কন্ডিশন চলছে। কেমন একটু শীত শীত ভাব। মাথাটা ঘুরাচ্ছে। শরীর দুর্বল। ব্রেকফাস্টের পর সারাদিন আর কিছু খাওয়া হয়নি। এ মুহূর্তে তার তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু উঠে গিয়ে পানি ঢেলে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মাথার ওপর দিয়ে টুকরো টুকরো মেঘের মতো নানান চিন্তা ভেসে যাচ্ছে। কোনো চিন্তাই স্থির হয়ে থাকছে না বেশিক্ষণ। আসছে, ভাবাচ্ছে… আবার উবে যাচ্ছে। তবে সমস্ত দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে এক সহজ অথচ মারাত্মক উপলব্ধি দীর্ঘশ্বাস হয়ে তার সমস্ত অন্তরে ক্রমে ক্রমে একটা তোলপাড় সৃষ্টি করছিল। সেই উপলব্ধি অনেকটা এরকম যে, এই জন্মে বুঝি তার আর সত্যিকারের সুখে থাকা হবে না। এই জন্মের সুখটা সামি আর হৃদির জন্যেই বরাদ্দ রইল! পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই তা সে জানে। তবে মৃত্যুর পরের জীবনটায় এই হিসাব নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দেবে বিশ্ববিধাতা! 

কতক্ষণ কাটল কে জানে। হঠাৎ ঘরের দরজাটা কেউ একজন খুলল। লম্বা মানুষটা দরজার ফাঁক গলে উঁকি দিয়ে খুব নিচু গলায় বললেন, ‘তোমার ফোনের কী হয়েছে?’ 

অমৃতা পকেট হাতড়ে ফোন বের করে দেখল, ‘চার্জ চলে গেছে।’ 

রাশেদ ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ভালো মতো দেখে শুনে লক করলেন। ঝাড়বাতির হলদে আলোর জোয়ারের ভেতর দিয়ে অমৃতা ঘোলা চোখ মেলে দুর্বলভাবে তাকালো তাঁর দিকে। মানুষটার দু চোখে এখন স্বভাবসিদ্ধ আত্মবিশ্বাসের ঝিলিকটা নেই। আছে গভীর বিষণ্নতা আর চাপা হাহাকার। 

—‘অমৃতা! আশা করি ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ। সামি যদি কিছু জানতে…’ 

—‘আমি জানি। আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।’ 

রাশেদ অমৃতার পাশে এসে বসলেন। ওর শুকনো মুখটা তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বললেন, ‘তুমি সারাদিন কিছু খাওনি?’ 

—‘আমার কথা বাদ দিন। আপনার কী হয়েছে? এরকম ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করেনি তো?’ 

মনে মনে একটু চমকে উঠলেন রাশেদ। তাঁর কেমন লাগছে। তিনি কেমন আছেন এই খবরটা যেন বহু শতাব্দী পর কেউ এমন ব্যাকুলভাবে মন থেকে জানতে চাইল। যে প্রশ্নটা কাছের মানুষদের করার কথা ছিল সেই প্রশ্নটা করে বসল এই দূরের মেয়েটা। মানুষের জীবনে আসলে কে কাছের আর কে দূরের, তা এক জটিল, দুজ্ঞেয় এবং অমীমাংসিত ধাঁধাঁ! 

—‘আমি ঠিক আছি।’ 

—‘মিথ্যা কথা বলছেন।’

—‘কী করে বুঝলে?’ 

—‘আমি বুঝি আপনাকে।’

তিনি অমৃতার ফর্সা সুন্দর নরম হাতখানা তার সবল হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন। স্থিরতার সাথে বললেন, ‘আমাদের খুব সাবধান হতে হবে। সামির আম্মা সত্য উদ্ঘাটনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সামিকে ব্যাপারটা কোনোমতেই জানানো যাবে না।’ 

—‘হুম।’ ছোট করে বলে অমৃতা। 

—‘তুমি বাসায় ফিরে যাও। বাবা মাকে বুঝিয়ে বলো যে সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। আর… কয়েকটা দিন আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করো না। কেমন?’ 

—‘একটা ফোনও করা যাবে না? আজব! মেরে ফেলতে চান নাকি আমাকে?’ 

দরজার ওপাশ থেকে কারো পদশব্দ ভেসে আসলো হঠাৎ। রাশেদ একটু সচকিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন বসা থেকে। ব্যস্ত গলায় বললেন, 

—‘আমি এখন আসছি। তোমাকে ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে আসবে তোমার বাসায়।’ 

অমৃতা উঠে দাঁড়ালো। জল টলমল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। কম্পনযুক্ত গলায় বলল, ‘এখানেই শেষ?’ 

রাশেদ অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। মেয়েটির চোখে চোখে তাকানোর মতো মানসিক শক্তি এ মুহূর্তে তাঁর নেই। 

—‘আমিও চাই সামি ভালো থাকুক। আপনার সিদ্ধান্তকে আমি রেসপেক্ট করি।’ দম বন্ধ করে কথাগুলো বলল অমৃতা 

রাশেদ কিছু বললেন না। শক্ত চোয়াল নিয়ে স্থির চোখে চেয়ে রইলেন দেয়ালে লেগে থাকা ভার্টিক্যাল গার্ডেনের লতানো পাতার দিকে। কয়েক সেকেন্ড অমৃতাও চুপ করে রইল। দরজার বাইরের পায়ের আওয়াজটা আবার পাওয়া গেলো। রোমেলা এ সময় নিচে নামার কথা না। খুব সম্ভবত চাকরবাকর কেউ হবে। রাশেদ ড্রাইভারের নম্বরে ডায়াল করে গাড়ি বের করতে বললেন। তারপর গম্ভীর গলায় অমৃতাকে বললেন, ‘যাও, আর দেরি করো না। বাসায় গিয়ে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেল। বাবা মাকে গিয়ে বলো, সব সমস্যা মিটে গেছে।’ 

—‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?’ 

—‘কী প্রশ্ন?’ মুখ তুলে তাকালেন তিনি। 

—‘আমাকে মিস করবেন?’ 

রাশেদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন, ‘না করব না।’ 

অভিমানের একটা কনকনে ব্যথা চিলিক দিয়ে উঠল অমৃতার বুকের ভেতর। পাতলা গোলাপি ঠোঁটদুটো ফুলে গেলো বাচ্চা মেয়ের মতো। ঈষৎ বাঁকা গলায় সে বলল, ‘বেশ!’ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বুকটায় বড্ড দাপাদাপি! কেউ পাঁজর খুলে নিলেও বোধহয় এর চেয়ে কম কষ্ট হতো। 

—‘অমৃতা শোন।’ 

দাঁড়ালো সে। কিন্তু ঘুরে তাকাল না। দরজা বরাবর মুখ রেখেই বলল, ‘বলুন।’ 

—‘তোমাকে মিস করব না কারণ তুমি আমার সাথেই থাকবে সব সময়। যে মানুষ সাথে থাকে। পাশে থাকে। তাকে কি আর আলাদাভাবে মিস করা যায়?’ 

অমৃতা ফিরে তাকালো রাশেদের দিকে। কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো আবার। একটা শ্বাসরুদ্ধকর আবেগ তার বাকশক্তি কেঁড়ে নিল হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে দরজার নবটা ঘুরালো সে। তারপর বেরিয়ে এলো হনহন করে। সিঁড়ির গোড়ায় হৃদিকে পাওয়া গেলো। কিচেনে গিয়েছিল সে সামির জন্য স্যুপ তৈরি করতে। অমৃতার রক্তলাল চোখজোড়া দেখে একটু থমকালো হৃদি। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘তুই ঠিক আছিস?’ 

—‘আমি যাচ্ছি। তোদের আর বিরক্ত করব না। তোর শ্বশুরের দিকে খেয়াল রাখিস। খালি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকিস না। উনার শরীর বিশেষ ভালো নেই।’ 

হৃদিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে প্রস্থান করল জায়গাটা থেকে। মূল ফটকের সামনে গাড়িটা রাখা ছিল। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসল। এতক্ষণের অবরুদ্ধ কান্নাটা বাধ ভাঙল এবার। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। গাড়ির ব্যাক মিররে চোখ রেখে অল্পবয়সি ড্রাইভারটা সেই কান্নার সম্যক রূপখানি আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করল। কৌতূহলে তার চোখের মণি আরেকটু হলেই যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। অমৃতা গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে দিল। ভীষণ দমবন্ধ ভাব হচ্ছে তার। গাড়ি চলতে শুরু করতেই শেষ চৈত্রের গুমোট রাতটা হাওয়ায় হাওয়ায় ভরে উঠল। খোলা জানালার বাইরে মাথা বের করে আনল সে। দুরন্ত বাতাস খেলতে লাগল ওর চুল নিয়ে। শুষে নিতে লাগল চোখের জল। 

কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোণে 
শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে 

গাড়িতে গানটা বেজে যাচ্ছিল। কোন একটা রেডিও স্টেশন ধরা আছে এখন। 

ইশারায় কইবি কথা গোঠে-মাঠে 
দেখিস যেন কেউ না জানে 
কেউ না বোঝে কেউ না শোনে 
শ্যামকে যখন পড়বে মনে 
চাইবি কালো মেঘের পানে 
কিছুদিন মনে মনে… 

অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস ফেলল। কিছুদিন? নাকি চিরদিন? 

৯১

হৃদি তখনও সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অমৃতার মাত্র বলে যাওয়া কথাটার মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করছিল। ‘তোদের আর বিরক্ত করব না’ এই কথা দ্বারা আদতে কী বোঝানো হলো? হঠাৎ চোখের সামনে কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে প্রায় নির্জীব অবস্থায় হেলতে দুলতে রুদ্রকে বাড়িতে ঢুকতে দেখল সে। ট্রেন যাত্রার ধকলে তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ধূলোর আস্তর পড়ে কালচে হয়ে আছে মুখ। রুক্ষ চুলগুলো আউলবাউল হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময়। 

হৃদিকে দেখামাত্র সে তার মলিন মুখখানা ভরে একটা ঝলমলে হাসি হেসে বলল, 

—‘আরে মামা! তুমি কি আমার জন্য ওয়েইট করতেছিলা?’ 

—‘ইশ তোরে এরকম নোংরা দেখাচ্ছে কেন? নর্দমার পানিতে ডুব দিয়া আসছিস নাকি?’ নাক মুখ কুঁচকে গেলো হৃদির। তবে মুখে যাই বলুক না কেন বস্তুত রুদ্রর আমুদে আর রসিক গলার স্বর শুনতে পাওয়ামাত্র তার বুকের চাপটা যেন অনেকাংশে কমে গেলো। রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একটু ঝুঁকে নিয়ে পায়ের জুতো খুলে নিল। তারপর সহাস্যে বলল, ‘হ দোস্ত, নর্দমায় ডুব দিয়া আসছি। এখন আয় তোরে একটা হাগ দেই। কতদিন পর দেখা! 

হৃদি আঁতকে উঠল, ‘অসম্ভব এই নোংরা শরীর নিয়ে তুই আমার কাছে আসবি না!’ 

হৃদির কথা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই রুদ্র তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসলো ওর দিকে। 

‘আল্লাহ বাঁচাও!’ বলে একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠে হৃদি পড়িমরি করে দিল ছুট। ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল দুজনে। হৃদি সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘রুদ্রর বাচ্চা! ভালো হবে না বলতেছি। থাম তুই!’ রুদ্র প্রত্যুত্তরে হো হো করে ডাকাতের মতো হাসছে। হৃদিকে তাড়া করতে পেরে যেন সে জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটি লাভ করছে এই মুহূর্তে। এতক্ষণের সুনসান নীরব বাড়িটা হঠাৎ করেই দুটি সমবয়সী যুবক-যুবতীর হাস্য কলরবে মুখরিত হয়ে উঠল। সুতির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হৃদি সুবিধামতো দৌড়োতে পারছে না। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি শাড়িতে হোঁচট খাবে সে। তাছাড়া রুদ্রর সাথে পেরে ওঠা কি অত সহজ? দোতলার সিঁড়ির মুখে এসে ঠিকই খপ করে ধরে ফেলল সে হৃদির বাম হাতের কবজি। হৃদি নাক মুখ বাঁকাচ্যাকা করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘দোস্ত প্লিজ। গোসল করে আয়। এই নোংরা জামা কাপড় নিয়ে আমাকে হাগ করিস না। মাফ চাই, দোয়াও চাই। আমার জামাই অসুস্থ। এদিকে অমৃতার বাচ্চিও সিনেমা দেখায় বিদায় হইছে একটু আগে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। বুঝার চেষ্টা কর।’ 

রুদ্রর মুখ থেকে ডাকাতিয়া হাসিটা তবুও সরল না। হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘তোর জামাইয়ের আবার কী হইছে?’ 

—‘জ্বর।’ 

—‘শালা মাদী পোলা একটা। দুইদিন পর পর জ্বর হয়।’ 

—‘অই, আমার জামাইরে নিয়া উল্টাপাল্টা কথা বলবি না খবরদার।’

—‘অমৃতার কী হইছে?’ 

হৃদি আশপাশটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে গলা এক স্তর নিচে নামিয়ে বলল, ‘জানি না! খুব ডায়লগ দিচ্ছিল তোদের আর বিরক্ত করব না। তোর শ্বশুরকে দেখিস। ব্লা ব্লা ব্লা!’ 

—‘তোর শ্বশুরের আবার কী হইছে?’ 

—‘জানি না কিসু। তবে অমৃতা মনে হয় কান্নাকাটি করছে। চোখটোখ লাল।’ 

—‘অমৃতা আবার কাঁদে নাকি? ওরে আমি জীবনে কখনো কাঁদতে দেখি নাই।’ 

—‘আগে কান্নাকাটি করত না। এখন করে। কেমন জানি হয়ে গেছে। আগের মতো আর নাই।’ 

—‘হুম… সামি কোথায়? 

—‘শুয়ে আছে।’ 

—‘চল।’ শব্দটা উচ্চারণ করে নিয়ে রুদ্র সামির শোবার ঘরে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। 

সামি বাতি নিভিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল। রুদ্র ঘরে ঢুকেই প্ৰথমে বাতি জ্বালাল। কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সামির বিছানার দিকে। তারপর সড়াৎ করে একটানে তুলে ফেলল ওর গায়ে জড়ানো কাঁথা। হৃদি পেছন থেকে একটা চাপা ধমক দিয়ে উঠল, ‘আরে! ডিস্টার্ব করতেছিস কেন?’ 

ঘুম ছুটে গেলো সামির। জ্বরে কাবু হওয়া ছোট ছোট চোখ মেলে কোনো রকমে দেখল সে রুদ্রকে। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত প্লিজ বিরক্ত করিস না। ভালো লাগতেছে না।’ 

—‘তোর ভাললাগতেছেনার গুষ্টি কিলাই। কী হয় দুই দিন পর পর হ্যাঁ? তুমি কি ন্যাদা বাচ্চা? দুদু খাও এখনো?’ 

সামি এবার রেগে গেলো খুব। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘শাট দ্যা ফাক আপ! দূর হ তুই। জ্বর আসছে আমার।’ 

—‘তোর বালের জ্বর আমি বাইর করতেছি দাঁড়া। আমি কিন্তু নর্দমায় ডুব দিয়া আসছি। এখন ময়লা শরীর নিয়ে তোরে হাগ করব। জানের মায়া থাকলে পালা শালা।’ 

রুদ্রকে আগাগোড়া একবার দেখে নিয়ে সামি রীতিমতন পিলে চমকে উঠল। 

—‘আসলেই? তোর কী হইছে? এমন নোংরা দেখাচ্ছে কেন?’ 

—‘কী হইছে দেখবি?’ বলে রুদ্র সামির বিছানার ওপর এক লাফে চড়ে বসল ওকে জড়িয়ে ধরতে। তড়াক করে উঠে বসল সামি। মুহূর্তের মাঝে তিন চার হাত দূরে ছিটকে সরে গেলো সে। বিপন্ন গলায় বলল, এরকম ময়লা শরীর নিয়ে আমাকে ধরবি না।’ 

‘খবরদার!’

—‘ময়লা নিয়ে ধরলে তোর জ্বর পালায় যাবে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। এটাই বেস্টেস্ট ট্রিটমেন্ট।’ 

—‘লাত্থি খাবি শালা।’ 

হৃদি ওদের কাণ্ড দেখে খিলখিল করে হাসছিল। সামির জ্বর টর সব লেজ তুলে পালিয়েছে এখন। রুদ্র বলল, ‘জ্বর আসলে কী করতে হয় জানিস? ঠান্ডা পানি দিয়ে ঝপাঝপ গোসল করে ফেলতে হয়। যা এখুনি বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার নে। ঠান্ডা পানি দিয়ে।’ 

—‘আরে না। জ্বর বেড়ে যাবে।’ হৃদি ফোড়ন কাটল। 

—‘মোটেও বাড়বে না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসতেছি। আইসা যেন দেখি তোর জামাইয়ের জ্বর হাওয়া হয়ে গেছে। নইলে তোরেই আজকে হাওয়া করে দিব।’ 

খুব ভালো মতো দুই বন্ধুকে শাসিয়ে নিয়ে রুদ্র নিজের ঘরে গেলো। সামি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করল না বটে তবে তার ভেতরে একটা প্রফুল্ল ভাব প্রত্যক্ষ করল হৃদি। সে কয়েকবার হাত পা ছুঁড়ে আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে বলল, ‘ক্ষুধা লাগছে। কী খাওয়া যায়?’ 

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হৃদি বলল ‘আমি চিকেন স্যুপ বানাইছি। খাবি?’ শুনে সামি হাসে, ‘ওয়াও। জ্বর মুখে বৌয়ের হাতে বানানো গরম গরম চিকেন স্যুপ। অসাম!’ 

হৃদি স্যুপ আনার জন্য নিজেই নামল নিচে। কিচেনে ফোন করে দিলে অবশ্য কাজের লোকরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করে দিয়ে যেত। কিন্তু এ মুহূর্তে কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। এসব টুকটাক কাজ তো নিজেই করা যায়। তার পরনে জলপাই সবুজ রঙের সুতির শাড়ি। হাতভর্তি স্বর্ণের চুরি। নাকে হীরের ফুল। পিঠময় ছড়িয়ে আছে সুন্দর ঝরঝরে খোলা চুল। তাকে দেখতে বেশ বৌ বৌ লাগছে। ডাইনিং এ শাশুড়ির সাথে দেখা হয়ে গেলো। সাথে একজন অতিথি উপস্থিত আছেন। রোমেলার কলেজ জীবনের বন্ধু। এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছে হৃদি এই মহিলাকে। 

—‘আমার বাচ্চাটা কেমন আছে এখন?’ রোমেলার প্রশ্ন। 

—‘এখন একটু বেটার।’ বলল হৃদি। 

শুনে রোমেলা নিশ্চিন্ত হলেন। খুব দ্রুত গল্পে মশগুল হয়ে পড়লেন আবার। হৃদি কিচেনে গিয়ে স্যুপ বেড়ে নিল বাটিতে। কী মনে করে দুটো বাটি রেডি করল। তারপর ট্রের ওপর স্যুপের বাটি চামচ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং পার হবার সময় একবার শাশুড়িকে বলল, ‘আপনাদের স্যুপ দেবো? আমি বানিয়েছি।’ 

অতিথি কিছু বলার আগেই রোমেলা হাত নেড়ে আপত্তি জানালেন, না না! আমরা ঠিক আছি।’ 

হৃদি আর কথা বাড়ালো না। বেরিয়ে এসে স্টাডিরুমে একবার উঁকি দিল। শ্বশুরমশাই এ সময় স্টাডিরুমেই থাকেন। আজকে আছেন কিনা কে জানে। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। দরজার হাতলটা হালকাভাবে ধরতেই ক্যাক করে একটা বিচ্ছিরি শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারি গলার স্বর শুনতে পাওয়া গেলো, ‘কে?’ 

—‘বাবা আমি!’ 

—‘এসো।’ 

ট্রে হাতে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল হৃদি। নিষ্প্রভ আলোর ল্যাম্পশেড জ্বলছে একটা। টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে ভ্রুকুটি গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছেন শ্বশুরমশাই। ঘরময় এলোমেলোভাবে অনেকগুলো কাঠের চেয়ার রাখা। টেবিলের ওপর কয়েকটা খালি চায়ের কাপও পড়ে আছে এখনো। মিটিং শেষ হবার পর কাজের লোকরা ঘরটা আর পরিষ্কার করেনি। এটা কোনো কথা হলো? এতগুলো বাধা চাকর বাড়িতে। কারো বুঝি একদণ্ড সময় হলো না এই ঘরে একবার আসার? হৃদির অপরিপক্ক নবীন সংসারি মনটা বাড়ির কাজের লোকদের এহেন দায়িত্বজ্ঞান হীনতা দেখে ভারি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে উঠল। এখুনি রান্নাঘরে গিয়ে কয়টা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। 

—‘কী খবর?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। 

হৃদি হাতে ধরে রাখা ট্রে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমি সামির জন্য চিকেন স্যুপ বানিয়েছি বাবা। আপনি একটু চেখে দেখবেন?’ 

হক সাহেব পুত্রবধূর উপরোধে সুন্দর হাসলেন। 

—‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। সামি এখন কেমন আছে?’ 

হৃদি স্যুপের বাটিটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। এখন আগের চেয়ে একটু বেটার ফিল করছে।’ 

হক সাহেব বাটিভর্তি স্যুপ এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, ‘লুকস গুড! মনে হচ্ছে খেতেও ভালো হবে।’ 

হৃদি সলজ্জ হাসল। শ্বশুরকে শ্রদ্ধাভরে দেখল একবার। গায়ে ছাই রঙের একটা কলারওয়ালা টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। তার বাবা বাড়িতে লুঙ্গি পরেন সব সময়। কিন্তু শ্বশুর মশাইকে সে লুঙ্গিটুঙ্গি পরতে দেখেনি কখনো। লোকটার মধ্যে এই বয়সেও সবসময় একটা ফিটফাট ভাব কাজ করে। অবশ্য বয়স তো একেবারেই বোঝা যায় না। অবস্থা এমন যে সামির বড়ভাই হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যাবে। আর কথা বলেন কী সুন্দর করে! শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। অমৃতাটা এইজন্যেই তো… ধ্যাৎ! হৃদির মাথাটা গেছে একেবারে। এখন কি এসব ভাববার সময়? 

—‘তোমার বাবা মা কেমন আছেন?’ 

—‘উনারা ভালো আছেন। আপনার শরীর ঠিক আছে তো? একটু কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।’ 

আন্তরিক প্রশ্নটা শুনে হক সাহেবের মন ভরে গেলো। তিনি প্ৰসন্ন গলায় বললেন, ‘আমি ভালো আছি মা। আমার ছেলেটাকে নিয়ে শুধু একটু চিন্তা হচ্ছিল।’ 

—‘ওকে নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। বলল ক্ষিদে পেয়েছে। এর মানে জ্বর কমে এসেছে।’ 

—‘তুমি তাহলে আর দেরি করো না। স্যুপ ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ 

হৃদি ট্রে হাতে তুলে নিল আবার। হেসে বলল, ‘আসছি বাবা। আপনার কিছু লাগলে বলবেন।’

—‘নিশ্চয়ই।’ তৃপ্ত কণ্ঠে বললেন হক সাহেব। 

করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে হৃদি ভাবছিল যে, তার শাশুড়ি মানুষটা যেন কেমনতর! দেখতে ফকফকা সুন্দরী হলে কী হবে, ঘটে বুদ্ধিশুদ্ধি মনে হয় কিছুই নেই। এরকম একজন গুণবান এবং রূপবান স্বামী পেয়েও কদর করতে জানল না। বরকে একটু সময় দেবে তা না। সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়ে মত্ত। আজ সন্ধ্যায়ও বাড়ি ফিরেছে শপার্স ওয়ার্ল্ড থেকে একগাদা কেনাকাটা করে। এহেন দুর্দিনে এত শপিং করার মন মানসিকতা আসে কোত্থেকে? হৃদি এই অল্প কদিনের অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝে যে স্বামীর মনে শান্তি না থাকলে কোনো স্ত্রীর পক্ষেও যথাযথ শান্তিতে থাকা সম্ভব না। নিজের বাবা মায়ের ভেতরেও এমনই নির্ভরযোগ্য নিটোল সম্পর্ক দেখে এসেছে সে ছোটবেলা থেকে। কিন্তু তার শাশুড়ির মনটা যে কোথায় থাকে তা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মহিলার সংসারে মন নেই এক ফোঁটা। সারাক্ষণ একটা পাইপাই খাইখাই ভাব। বিলাসিতা, বাহুল্য আর বড়লোকিকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে তার পৃথিবী। এ কারণেই তো বাইরের লোকে সুযোগ পেল। অমৃতাটা কয়েকদিন আঁকুপাঁকু করে ঠিকই সোজা পথে চলে আসত। এই লোভী, স্বার্থপর এবং কিম্ভূত মহিলার কারণেই ব্যাপারটা এখন মাচ মোর কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে। অমৃতা শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছে। স্থানটি শূন্য না হলে ঘটনা অন্যরকম হতো। 

ঘরে এসে দেখা গেলো রুদ্রও উপস্থিত আছে। এর মাঝেই গোসল সেরে নিয়েছে সে। পরনে হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট। চুল ভেজা। ঢেউ খেলানো ভেজা চুলে বিন্দু বিন্দু জল টলমল করছে এখনো। চেয়ারে বসে গিটার নিয়ে টুংটাং করছে। ওর জন্যেও এক বাটি স্যুপ নিয়ে আসা উচিত ছিল। ইশ বেচারার নিশ্চয়ই জার্নি করে এসে খুব ক্ষিদে পেয়ে গেছে। 

সামি বিছানার ওপর বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। হৃদি সাইডটেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে রেখে স্যুপের বাটিটা ওর দিকে এগিয়ে দিল। সামি বাটি হাতে নিয়ে বলল, ‘রুদ্রকে দিলি না?’ 

রুদ্র গিটারে টুংটাং করছিল, ‘কী এইটা?’ 

—‘স্যুপ।’ 

—‘স্যুপটুপ খাবো না মামা। ভাত দে। ভাত খাব।’ 

হৃদি তাৎক্ষণিকভাবে দেয়ালে লাগানো টেলিফোন সেটটার কাছে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরের ফোনে ডায়াল করে একজন কর্মচারীকে বলে দিল ভাত তরকারি বেড়ে নিয়ে আসার জন্য ওপরে। ঘড়িতে এখন সবে সাড়ে সাতটা বাজে। বাড়ির লোকেদের ডিনার করতে করতে দশটা বেজে যায়। রুদ্র বেচারা অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না। ফোন রেখে দিয়ে হৃদি শুকনো তোয়ালে নিয়ে এসে রুদ্রর ভেজা ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরতে থাকা চুলগুলো খুব ভালো মতো মুছে দিল যত্নের সাথে। সেই সাথে বকাঝকাও করতে লাগল খুব, ‘লম্বা চুল রাখতে তোকে কে বলছে? পারিস নাতো ম্যানেজ করতে। দুইদিন পর তোর মাথায় উকুন হবে বলে দিলাম।’ 

রুদ্রকে তখন গানে পেয়েছে। হৃদির মাথা মোছার দমকে অবশ্য তার গিটারের ওপর চলতে থাকা আঙুল গেছে থেমে। চোখ বন্ধ করে গুনগুনিয়ে একটা সুর ভাজছিল সে। হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই সবাইরে ফোন লাগা তো। কতদিন একসাথে সবগুলাকে দেখি না। ফোন লাগা।’ 

সামি কোনো প্রত্যুত্তর করল না। চামচে গরম স্যুপ তুলে নিয়ে ফুঁ দিতে লাগল মনোযোগের সাথে। 

হৃদি ভেজা তোয়ালেটা বারান্দার গ্রিলের ওপর মেলে আসলো। তারপর ফোন হাতে নিয়ে গ্রুপ কল করল সব বন্ধুদের। বিভা প্রায় সাথে সাথেই জয়েন করল। ফোনের পর্দায় ওর লাল সিঁদুরভর্তি কপালটাই ভেসে উঠল সবার প্রথমে। আকাশ অনলাইনে চলে এলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। চিৎকার করে বলল, ‘আমার এখানে নেটওয়ার্ক নাই একেবারেই। লাইন কেটে যাবে যে কোনো মুহূর্তে। 

বিভা ওপাশ থেকে হড়বড় করে তখন বলে যাচ্ছে, ‘এই জানিস, আমি নাচ শেখানোর দুইটা স্টুডেন্ট পাইছি। ওরা প্রতিদিন বিকালে আমার কাছে নাচ শিখতে আসে।’ 

—‘তাই নাকি? কত টাকা দিবে?’ তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করে রুদ্র। 

—‘টাকা দিবে না তো। আরে গ্রামের গরিব মানুষ। এদের কাছ থেকে আবার টাকা নিব?’ 

সেই সময় অমৃতাকে পাওয়া গেলো লাইনে। তার স্ক্রিনটা অন্ধকারে ঢাকা। নাক মুখ চোখ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে সামি বলল, ‘কীরে অমৃতা, তুই কিছু না বলে চলে গেলি কেন?’ 

কয়েক সেকেন্ড পর অমৃতার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেলো, ‘এমনি দোস্ত। মাথাটা ব্যথা করতেছিল। তাই চইলা আসছি। তোরে আর ডিস্টার্ব করি নাই।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘অমৃতা, তোর কি মন খারাপ?’ 

—‘নারে… ঠিক আছি।’ অমৃতার কণ্ঠস্বর ম্লান। 

রুদ্র গিটারের তারে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, ‘আরে মন খারাপ করিস না। চিল কর দোস্ত। চিল কর। দুনিয়া কয়দিনের? এত প্যারা নেয়ার কোনো মানে হয় না। হাসো খেলো খাও দাও ঘুমাও ব্যস এটাই লাইফ।’ কথাটা বলা শেষ করে সে শিস দিয়ে উঠে একটা গানের সুর ধরল। বিভা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, ‘ইশ অনেকদিন পর রুদ্রর গান শুনতেছি।’ এটুকু বলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে উঁচু গলায় অভিজিৎকে ডাকল, ‘অভি! এদিকে এসো। রুদ্রর গান শুনে যাও।’ 

“Here’s a little song I wrote 
You might want to sing it note for note 
Don’t worry, be happy” 

অভিজিৎ বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছিল। তার গালভর্তি সাদা রঙের শেভিং ফোম। বিভার পীড়াপীড়িতে সেই অবস্থায়ই তাকে কাঁধে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে আসতে হলো। বিভাবরী ড্রেসিং টেবিলের আয়নার গায়ে ভর দিয়ে সেলফোনটা দাঁড় করিয়ে দিল তারপর বরের হাত ধরে রুদ্রর গানের তালে তালে আরম্ভ করল নাচ। সেই নাচ দেখে হৃদিও উঠে পড়ল। সামির স্যুপ তখন শেষের পথে। হৃদি সামির হাত ধরে টেনে তুলল ওকে বসা থেকে। তারপর হেলেদুলে নাচতে লাগল। সামির মুখে দিনভর স্কচটেপের মতো লেপটে থাকা বিষণ্ণতাটা কেটে গেছে এখন। রুগ্ন ভাবটা যায়নি বটে তবে মুখের রুচি ফিরে এসেছে। পেটভর্তি এখন চনমনে খিদে। 

এদিকে রুদ্র মাথা নেড়ে নেড়ে গেয়ে যাচ্ছিল- 

“In every life, we have some trouble 
But when you worry you make it double
Don’t worry, be happy 
Don’t worry, be happy now 
don’t worry” 

আকাশ তখন অফলাইনে চলে গেছে। অমৃতার পর্দা অন্ধকার। মূৰ্তিমান স্থির সে। হ্যাপি হতে কার না ইচ্ছে করে! কিন্তু নিয়তি তাকে এমন এক মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে মনে হচ্ছে যেন হ্যাপিনেসের সাথে তার হয়ে গেছে জন্ম জন্মান্তরের বৈরিতা। এই বৈরিতাটুকু কবে যে আবার পুরোদস্তুর স্বন্ধিতে পরিণত হবে তা এক খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না। এখন সে অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের বারো তলার ছাদে। মাথার ওপরে গুমোট আকাশ। একটা ভাঙা ম্লান চাঁদ। কোথাও এক রত্তি হাওয়া নেই। ভ্যাপসা গরম ঘর্মাক্ত করে তুলছে মুখের ত্বক। বাসায় ফিরে যাবার ইচ্ছে, উদ্যম বা সাহস এর কোনোটিই এ মুহূর্তে নেই তার। সেলফোনের চার্জ চলে গিয়েছিল পুরোপুরি। বাসার সামনের একটা স্টেশনারি দোকানে সৌভাগ্যবশত চার্জার পাওয়া গেলো। খাদ্য পাবার পর আবার চাঙা হয়ে উঠল যন্ত্রটা। বাবা এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করেননি। মা দফায় দফায় ফোন করেছেন। কান্নাকাটি করে বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু যে বাবা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়িছাড়া করল সেই বাবার টিকিটাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অমৃতার সাথে যেন সত্যই তার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বিতাড়িত হবার পর যেচে পড়ে বাড়ি ফিরে যেতে তার আত্মসম্মানে বাধছে। তাই অ্যাপার্টমেন্টের ছাদই এখন শেষ আশ্রয়স্থল। 

—‘এই অমৃতা তুই কোথায়?’ গান শেষ করে হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করল রুদ্র।

–‘বাসায়।’ অস্ফুটস্বরে বলে অমৃতা। বলে শেষ করেই আবার বলে ওঠে, ‘শোন তোরা থাক। গানটান কর। আমি রাখি। মাথাটা ব্যথা করতেছে।’ এরপর কারো কোনো উত্তরের আশা না করে ফোন কেটে দিল সে। সেকেন্ড না গড়াতেই ফোনটা আবার আসলো। ক্যামেরা অফ রেখেই স্পিকার অন করল সে। 

—‘অমৃতা! কীরে তুই ঠিক আছিস তো?’ কথা বলছে সামি। 

—‘আমি ঠিক আছি।’ 

—‘কেমন যেন টেন্সড মনে হচ্ছে তোকে। কোনো সমস্যা হয় নায় তো দোস্ত?’ 

—‘কোনো সমস্যা হয় নাই। মাথাব্যথা একটু। তুই নিশ্চিন্ত থাক।’

—‘আচ্ছা রেস্ট নে তাহলে।’ 

—হ্যাঁ। তোর জ্বর কমছে?’ 

—‘কমছে।’ 

—‘ভালো থাক দোস্ত।’ 

—‘হুম। তুইও ঠিক থাক।

–‘আচ্ছা।’ 

—‘রাখি তাহলে।’

—‘হ্যাঁ। রাখ।’ 

ফোন কেটে দিয়ে ছাদের সিমেন্টের উষ্ণ মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল অমৃতা। সারা শরীরে একটা ঝিমুনি ভাব। পেট অনেকক্ষণ খালি থাকার দরুণ খিদে মরে ভূত হয়ে গেছে। ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে খুব। কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অথচ গভীর ঘুমের নেই রাজ্যে পদার্পণ করতে পারলেই এখন সবচেয়ে ভালো হতো। একটা নিশ্চিন্ত ঘুম, আর সব কিছু নেই হয়ে যাওয়া মাথা থেকে। কী চমৎকার! 

আজকাল সামির সাথে কথা বলতে গেলে বুকে চাপ অনুভূত হয়। ভয়ংকর অপরাধবোধ চোরাবালির মতো ক্রমশ টেনে নিয়ে যেতে থাকে অতল এক অন্ধকার গহ্বরে। নিজেকে হিপোক্রেট মনে হয়। দুই নম্বর মনে হয়। বেইমান মনে হয়। কদিন ধরে ভাবছিল সামিকে সব খুলে বলবে। ওকে লেখা চিঠিটা এখনো সেভ করা আছে ফোনের নোটপ্যাডে। চাইলে এখনই পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আত্মা কাঁপে। ভয় ভয় লাগে। অশুভ আশংকায় হৃৎপিণ্ড দুলে ওঠে। ভয় নামক অনুভূতিটার সাথে অনেক বছর কোনো যোগসাজশ ছিল না তার। সে ছিল নির্ভীক, সাহসী এবং অকপট। মনের কথা লুকোতে জানত না। জানত না নিজের ইচ্ছেশক্তিতে লাগাম দিতে। এতটা স্বাধীনচেতা ছিল বলেই হয়তো প্রকৃতি এখন শোধ নিচ্ছে। আচ্ছা প্রকৃতি কি শোধ নেয়? নেয় হয়তো! এ পৃথিবীতে কাউকেই পুরোপুরিভাবে হারানো বা জেতানো হয় না। সবাই কিছু জায়গায় জেতে, আবার কিছু জায়গায় হারে। এভাবেই ভারসাম্য টিকে থাকে। যেভাবে প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয় ঠিক সেভাবেই প্রতিটি মানুষকেও হার জিতের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। অমৃতা ঠিক কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে এই মুহূর্তে? জানে না তো সে! কোনটা অপরাধ আর কোনটা অপরাধ নয় তা বলে দেবে কে? হৃদয়ঘটিত অপরাধ সংক্রান্ত আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালে ঠিক কত দিনের সাজা হবে তার? যত কঠিন সাজাই হোক না কেন সেই সাজা মাথা পেতে নিতে কোনো আপত্তি নেই। এ জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছে সে। ছিমছাম সচ্ছল পরিবার। পছন্দনীয় বন্ধু। পছন্দের পেশা! পেল না শুধু পছন্দের মানুষ! একেবারেই পায়নি কি? পেয়েছে তো! লোকে বলে ত্যাগেই সুখ, ভোগে নয়! 

এইযে মানুষটার মনের সাথে তার মন এক অদৃশ্য শেকলে বাধা পড়ে গেছে, এটা কি একধরনের পাওয়া নয়? এখন যতদূরেই তারা একে অপরকে ফেলে যাক না কেন, এই অদৃশ্য শেকল ঠিকই ঝনঝন শব্দে জানান দিবে নিজের অস্তিত্ব। সে এখন জানে যে তার মনের মানুষটাও আদতে তাকেই ভালোবাসে। তাকেই চায়। কী আশ্চর্য! কথাটা মনে হতেই ওই চৈত্র রাতের গুমোট অন্ধকার আকাশের নিচে শুয়ে থেকে, অমৃতার মনটা হঠাৎ কিশোরী বালিকার মতো চপল আনন্দে মেতে উঠল। একটা জটিল সমীকরণ যেন সমাধান হয়ে গেলো নিমেষে। সামি পেয়েছে বাবা। রোমেলা পেয়েছে স্বামী আর অমৃতা পেয়েছে মানুষটার মন! মনটাই আসল। শরীর সঙ্গর চাইতে মনের সঙ্গ ঢের উত্তম। আত্মাই শ্বাশত! দেহের মৃত্যু সম্ভব কিন্তু আত্মার মৃত্যু সম্ভব না। ঠিক তাই ঠিক তাই! অমৃতা যা পেয়েছে তা শুধু এই পার্থিব জীবনের জন্য তো নয়! তা অনন্তকালের! আহা শান্তি! অমেয় শান্তি! শান্তিতে তার দুচোখের পাতা বুজে আসতে চাইছে। পবিত্র অনুভূতিতে সুবাসিত হয়ে উঠছে চারপাশ। নরম হয়ে আসছে এতক্ষণের বিক্ষিপ্ত মনটা মখমলের মতো। এ মুহূর্তে পুরো পৃথিবীকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে সময়ে অসময়ে যে বা যারা তাকে কষ্ট দিয়েছে, খারাপ কথা বলেছে, অপমান করেছে… সব্বাইকে! 

সেলফোন বেজে উঠল। এবার বাবার নম্বর থেকে ফোন আসছে। অমৃতার মাথা এখন ঠান্ডা, ভারহীন। ভাবনারা মসৃণ 

সে ফোন ধরে খুব শান্ত গলায় বলল— ‘বাবা!’ 

—‘কোথায় তুই?’ বাবার কণ্ঠস্বর গমগমে। 

—‘ছাদে।’ 

—‘ছাদে মানে?’ 

—‘আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে।’ 

বাবা চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ভারি গলায় বললেন, ‘বাসায় ফিরে আয়।’ 

অমৃতারও মনটা যেন বাড়ি বাড়ি করছিল। নিজের ওই এক টুকরো ছোট্ট শোবার ঘরটা টানছিল খুব। টানছিল বিছানা। টানছিল মায়ের মুখখানা। তাছাড়া বাড়ি ফিরে যেতে আর বাধা কোথায়? অমৃতার তো এখন আর কোনো কষ্ট নেই, ক্লেশ নেই। নেই কারো প্রতি কোনো অভিযোগ হেরে গিয়েও দারুণভাবে জিতে গেছে সে। তার কিচ্ছু নেই তবুও যেন সব আছে। সব! 

৯২

দুপুর বারোটায় আকাশ সায়দাবাদ বাস স্টেশনে এসে পৌঁছল। ওখান থেকে বাসা অবধি যেতে আরো ঘণ্টা দেড়েক সময় লেগে গেলো। দরজা খুলল তারা। ওর পরনে বাইরে যাবার জামা। চুলে বেণী। কানে দুল। আকাশকে দেখে ঝলমলে হাসল সে, ‘ওহ্, এসে গেছেন। যাক বাঁচা গেলো। খালা খুব দুশ্চিন্তা করছেন।’ 

তারার ঝলমলে হাসিটা আকাশ ওর আকাশময় হাসি হেসে ফিরিয়ে দিল। বলল, ‘তোমরা কেমন আছ?’ 

—‘আছি এই তো।’ 

ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পায়ের জুতো খুলতে খুলতে আকাশ বলল, ‘উনি কেমন আছেন?’ 

—‘কার কথা বলছেন?’

—‘তোমার খালা।’ 

—‘ও, আছেন মোটামুটি।’ 

—‘পেট ব্যথা কমেছে?’ 

—‘পেইন কিলার খেলে একটু কমে। আবার কিছুক্ষণ পর বেড়ে যায়।’

—‘তুমি কোথাও যাচ্ছ নাকি?’ 

—‘জি একটু বেরোচ্ছি। টিউশনি আছে।’ বলে তারা পা বাড়াল। দরজাটা আটকে দেবার আগে গলা বাড়িয়ে একবার আকাশকে বলল, ‘আসছি ভাইয়া।’ 

—‘হ্যাঁ ঠিক আছে। সাবধানে যেও।’ 

গোসল সেরে ডাইনিং স্পেসে এসে দেখা গেলো টেবিলের ওপর খাবার বাড়া আছে। ঝুমকির দেখা পাওয়া গেলো না। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। ঝুমকিকে সে নিজে খুব একটা পাত্তা দেয় না এ কথা সত্য। তবে সেই অবহেলাটুকু খুব একটা গায়ে মাখবার মতো ধারালো ব্যক্তিত্ব ঝুমকির কখনোই ছিল না। আকাশের কাছ থেকে সে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে একটানা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অপমানিত হয়েছে। তবুও তার আত্মসম্মানে এতটুকু লাগেনি। আকাশের সেবাযত্ন করাটাকে সে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছে যেন। টেবিলে খেতে বসলে ওর পাশে দাঁড়িয়ে এটা সেটা তুলে দেওয়া, বিকেলের চা-টা নিজের হাতে বানিয়ে দেওয়া, ঘুমোনোর আগে এক গ্লাস দুধ নিয়ম করে ওর ঘরে রেখে আসা, এই দায়িত্বগুলো সে বহুদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছে। আজ তো আকাশ দু তিন দিন পরে বাড়ি ফিরল। তবুও ঝুমকি একটাবারের জন্য উঠে এলো না যে? খচখচে মন নিয়ে খাবার শেষ করল সে। বাড়িতে পিতৃদেব নেই। থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? লোকটার থাকা না থাকায় আজকাল কিছু এসে যায় না আকাশের। 

খাওয়া শেষ করে ভেতরের ঘরে একবার উঁকি দিল সে। শুয়ে আছে ঝুমকি বিছানায়। গায়ের ওপর ক্যাটক্যাটে গোলাপি রঙের একটা চাদর। ঘরটার দরজা জানলা আটকানো। ভ্যাপসা গরম। সিলিঙে ঝোলা ফ্যানটা থেকেও যেন খটখট শব্দ করে উত্তপ্ত বাতাস বেরোচ্ছে। দরজায় খুট করে শব্দ হতেই ঝুমকি চোখ মেলে তাকালো। তার মুখখানা ফ্যাকাশে। চোখ সাদাটে আর রক্তশূন্য। আকাশকে দেখে অনেক কষ্টে ঠোঁট নেড়ে বলল, ‘ভাত খেয়েছ বাবা?’ 

জানে না আকাশ। কেন যে ঝুমকির এই রুগ্ন দশা দেখে তার বুকটা অমন মোচড় দিয়ে উঠল হঠাৎ! জ্বলন্ত উনুনের আগুনে ছ্যাঁক খাবার মতো করে মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগের এমনই এক গ্রীষ্মের দুপুর বোলার কথা। স্কুল থেকে ফিরে এসে নিজের মাকে ঠিক এরকমই রুগ্ন, বিধ্বস্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল বিছানার ওপর। তার ছোট্ট মনটা মায়ের অমন পীড়িত ক্লিষ্ট চেহারা দেখে একদম দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে মা অসুখে ভুগেছিলেন প্রায় সাড়ে তিন বছর। আজকে এই মুহূর্তে যেন দেজা ভ্যু ঘটে গেলো। মনে হলো এই ঘটনাটি সে হুবহু এর আগেও 

একবার প্রত্যক্ষ করেছে। 

—‘আপনার ব্যথা কমেনি?’ 

এ প্রশ্নের উত্তরে শুকনো ঠোঁটজোড়া নেড়ে ঝুমকি যা বলল তার একটি অক্ষরও আকাশের কানে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করল না। সে অধৈর্য গলায় বলল, ‘উঠুন আপনি। ব্যাস অনেক হয়েছে। চলুন ডাক্তারের কাছে। 

আদেশ শুনেও নড়ল না ঝুমকি। দুর্বলভাবে চোখ বুজল একবার। আকাশ ধুপধাপ পা ফেলে সামনে এগিয়ে এসে ওর গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরালো। হাতের কব্জি ধরে টেনে তুলল শোয়া থেকে। ঝুমকির কাঁধের ওপর দু হাত রেখে বলল, ‘খুব বেশি খারাপ লাগছে? যেতে পারবেন? নাকি ডাক্তার বাসায় ডাকব?’ 

ঝুমকি দুদিকে মাথা নেড়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘না বাসায় ডাকতে হবে না।’ 

—‘তাহলে চলুন। জাস্ট স্যান্ডেলটা পরে নিন। 

কথাটা বলে সে নিজের ঘরে ছুট দিল। পকেটে ওয়ালেট আর মোবাইল পুরে নিয়েই তড়িঘড়ি করে ফেরত আসলো আবার ঝুমকির কাছে। গায়ের কাপড় আর পাল্টাল না। ঘরোয়া টি শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরেই বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। ঝুমকি ততক্ষণে এলোমেলো চুলগুলি মুড়িয়ে একটা হাতখোঁপা করেছে আর বাসার স্যালোয়ার কামিজের ওপর বোরখা পরে নিয়েছে কোনোরকমে। পেটে এখনো টনটনে ব্যথা। হাঁটতে বড়ই কষ্ট। গতকাল থেকে একটু ভয় এসে গেছে তার ভেতর। মরেটরে যাবে নাকি আল্লাহ জানে। মরতে অবশ্য কোনো আপত্তি নেই তার। এ জীবনে তার আছে কে? কার জন্য বেঁচে থাকবে? মরে গেলে বরং তার স্বামী বেশ খুশিই হবে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। আরো বেশি খুশি হবে আকাশ। এ সংসারে পদার্পণের প্রথম দিন থেকেই ছেলেটা তাকে মনে প্রাণে ঘেন্না করে। সেই তীব্রতর ঘেন্নাটা ঝুমকির গায়ে প্রতি নিয়ত কাঁটার মতো বিধত। খুব ভালোমতোই টের পেতো সে যে ছেলেটা তাকে সহ্য করতে পারছে না। তবুও মায়া লাগত। এইটুকু বয়সের মা মরা ছেলে। বাবাটা মেরুদণ্ডহীন, কাপুরুষ। ওরকম একজন পিতা থাকা আর না থাকা একই কথা। ছেলেটা বাবা মায়ের স্নেহ, মায়া মমতা থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্ছিত। এসব ভেবেই আঠার মতো ওর পেছনে লেগে থাকত সে। আশা ছিল একদিন বুঝি ছেলের মন ঘুরবে। ভালোবাসা না হোক অন্তত মায়া জন্মাবে। কিন্তু না, পোড়া কপাল! ছেলেটা তাকে মানুষ বলেই কখনো গণ্য করল না। তবে এ কদিন যাবৎ ঝুমকির একটু কেমন অন্যরকম লাগছে ওকে। বারবার ঘুরে ফিরে তার শরীরের অবস্থা জানতে চাইছে। ঢাকার বাইরে যাবার আগে কোন এক বন্ধুকে বলে গিয়েছিল খবর নিতে। সেই বন্ধু আবার রোজ একবার করে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে তার। এ ছাড়াও বারংবার ডাক্তারখানায় যাবার জন্য চাপ দিচ্ছে ছেলে। মুখ শুকনো করে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ঝুমকির মনে হচ্ছে আজ তার নিজের পেটের একটা সন্তান থাকলেও বুঝি এই অসুস্থতার সময়ে ঠিক এমনিভাবেই মুখ কালো করে মায়ের আশেপাশে ঘুরে বেড়াত। এই ছেলের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। তবে এ কথা অকাট্য সত্য যে সংসারে শুধু এই ছেলেটির প্রতিই তার রয়েছে অগাধ মায়া। এর পিতা মানুষটা জানোয়ারের চেয়েও অধম। ছেলেটা না থাকলে ওই লোক এতদিনে তাকে খুন করে জলে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করত না। 

বাড়ির কাছের একটা হাসপাতালেই গেলো ওরা। আকাশের এক কলিগের বাবার চেম্বার এখানে। তিনি মেডিসিনের ডাক্তার। ঝুমকির রোগটা আসলে কী তা তো এখনো অজানা। আপাতত ইনার কাছে গিয়েই সমস্যাটা শনাক্ত করা যাক। তারপর নাহয় বিশেষজ্ঞ দেখানো যাবে। ডাক্তারের চেম্বারে বেশ লম্বা লাইন। অপেক্ষা করতে হলো প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আকাশ ঝুমকিকে বসিয়ে রেখে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করল। ফোনে বন্ধুদের সাথে কথা বলল। যে কলিগের বাবার কাছে আসা সেই কলিগকেও একটা ফোন করল। ওদিকে ঝুমকি মানুষ জনের ভিড়ে মিশে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল একাবোকা হয়ে। নেকাবের ওপর শুধু রক্তশূন্য চোখদুটি দেখা যাচ্ছিল তার। বাদ বাকি সব সাদা কাপড়ে ঢাকা। 

একটা সময় ডাক পড়ল। ঝুমকিকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আকাশ। ডাক্তার সাহেবের মাথাভর্তি একরাশ পাকা চুল। মোটা সাদা গোঁফ। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। আকাশকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, 

—‘তুমি কি আমার ছেলে মানে সাব্বিরের কলিগ? 

আকাশ ঝুমকির জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলল, ‘জি আংকেল। আমি সাব্বিরের কলিগ।’ 

—‘বেশ বেশ! আমাকে সাব্বির একটু আগেই ফোন করেছিল। বলল তুমি আসবে।’ 

ঝুমকি চেয়ারে বসল। আকাশও বসল ওর পাশে অপর একটি চেয়ারে। ডাক্তার সাহেব ঝুমকিকে ইঙ্গিত করে আকাশকে প্রশ্ন করলেন, ‘উনি কে? তোমার মা?’ 

অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন। কিন্তু আকাশ কেন যেন থমকে গেলো প্রশ্নটা শুনে। ক্ষণিকের জন্য তার মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে উঠল। বুকে এসে লাগল কীসের যেন একটা বড়সড় ধাক্কা! ভারি বিব্রত দেখাল তাকে সেই মুহূর্তে। ঝুমকিও প্রশ্নটা শুনে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। যদিও তার নেকাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখের কোনো ভাবভঙ্গি টের পাওয়া যাচ্ছে না। 

কয়েকটা শব্দহীন নির্বাক এবং অস্বস্তিকর মুহূর্তের পর আকাশ মুখ নিচে নামালো। খুব করে বলতে চাইল, ‘জি না, মোটেও উনি আমার মা নন। উনি আমার বাবার দ্বিতীয় বৌ। আমার মা মরে গেছে অনেক আগে।’ বলতে চাইলেও এসব কিছুই বলতে পারল না সে। গলা দিয়ে শুধু অনাহূত ভাবে বেরিয়ে আসলো একটি শব্দ, ‘জি।’ 

উত্তরটা দেওয়ার পর বেশ কয়েক সেকেন্ড সে কিছু ভাবতে পারল না। মাথাটা ফাঁকা। কানের কাছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কী বলার ছিল আর কী বলে ফেলল। সে কি পাগল হয়ে গেছে? বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো থম ধরা চোখে ডাক্তার সাহেবের দিকে চেয়ে রইল সে। যদি পাশ ফিরে একবার তাকাতো তবে দেখতে পেত যে ঝুমকির চোখভর্তি তখন জল! 

৯৩

চৈত্র পেরিয়ে গ্রীষ্মকাল আসতেই একেবারে কাঠফাটা গরম পড়তে শুরু করল। রোদের তেজে সারাবেলা তেতে থাকে সারা শহর। সন্ধেটাও গুমোট। ভারি অস্বাস্থ্যকর আর দম আটকানো এক পরিবেশ। বিভার বাবা মা প্রায় এক মাস মেয়ের বাসায় অবস্থান করে অবশেষে ফিরে এসেছেন ঢাকায়। বিভা বাবা মায়ের হাতে বন্ধুদের জন্য ছোটখাটো কিছু উপহার পাঠিয়েছে। সাথে আম আর তেঁতুলের আচার। নিজের হাতে বানানো। এই আচারের রেসিপি তার শাশুড়ি মায়ের। অতি সুস্বাদু খেতে। বন্ধুরা সকলেই ব্যস্ত। তবুও এক বিকেলে রুদ্র অফিসের পর বিভার বাসায় গিয়ে উপহার গুলো নিয়ে আসলো। একই বাড়িতে থাকার সুবাদে হৃদি সামির উপহার সঙ্গে সঙ্গেই হস্তান্তর করা গেলো। অমৃতা আর আকাশেরটা রইল জমা। ঝুমকির গলব্লাডারে পাথর জমেছিল। অপারেশন বাধ্যতামূলক হয়ে গেলো। আকাশকে তাই বেশ কিছুদিন নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হলো। বন্ধুরা অবশ্য ঝুমকির অপারেশনের দিনটায় সকাল সন্ধ্যা আকাশকে সঙ্গ দিতে দ্বিধা বোধ করল না। 

অমৃতার পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো। কাজ ছাড়া যেন এই মেয়ের জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুক্র, শনিবারেও চেম্বারে যায়। বন্ধুরা ছুটির দিনের বিকেলগুলোতে ওকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যায়। ওর দেখা মেলে না। চেম্বার কোর্ট এনজিও আর ইয়োগা সেন্টারেই তার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। দেখা না হলেও ফোনে বন্ধুদের রোজই আড্ডা হয়। সেই আড্ডাতেও অমৃতার উপস্থিতি বড় ম্লান। হাসি ঠাট্টায় কদাচিৎ অংশ নেয় সে। হৃদি আর বিভার সংসার জীবনের গল্পগুলি আজকাল তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবনার উদ্রেক করে। তার কখনোই আর দশটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো ঘরকন্না করার শখ ছিল না। খুব ছোটবেলায়ই কখনো বিয়ে না করার ব্রত নিয়েছিল সে। জীবনটাকে সে দেখে অন্য চোখে। বিয়ে করে জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় একটি বিশেষ মানুষ এবং সংসারের পেছনে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না তার। কিন্তু আজকাল কী হয়েছে কে জানে! হৃদি আর বিভা যখন ওদের সাংসারিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি অভিজ্ঞতা এবং মিষ্টি মধুর ঘটনাবলী রসিয়ে রসিয়ে বন্ধুদের শোনায় তখন সব কিছু বোঝার পরেও, জানার পরেও তার শিক্ষিত বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন পরিণত মনটার মধ্যে অজান্তেই অবুঝ অস্পষ্ট আর বোবা এক অনুভূতির জন্ম হয়। এই অনুভূতির নাম জানে না সে। কেমন যেন ঝাঁঝালো আর টনটনে। ব্যথা নয় আবার ব্যথারই মতো। কষ্ট নয় আবার কষ্টেরই মতো! বলতে নেই অমৃতারও তখন খুব ইচ্ছে করে… ভীষণ রকমের ইচ্ছে করে যে তার পছন্দের মানুষটির সাথে সেও ঠিক এরকম একটা জীবন কাটায়। ওইযে… কী যেন জীবন? হৃদি সামি বলছিল সেদিন… ইচ্ছে জীবন! ওরা নাকি ওদের ইচ্ছে জীবন পেয়েছে। হ্যাঁ অমৃতারও একটা ইচ্ছে জীবনই পেতে ইচ্ছে করে! 

কাজ ছাড়া বসে থাকলেই মাথায় হাবিজাবি চিন্তা আসে। বুকের ভেতর ভাঙচুর হয়। কান্নার মতো কিছু একটা সুড়সুড়ি দেয় গলায়। কাঁদে না সে। মাঝে মাঝে শুধু চোখ ভর্তি জল নিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। এর মধ্যে দেশের বাইরের কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করেছে মাস্টার্সের জন্য। মন বলছে কোথাও না কোথাও এডমিশন হয়ে যাবে। হয়ে গেলেই বাঁচোয়া। দেশ ছেড়ে কিছুদিনের জন্য পালাতে পারলেই ভালো হয়। তবে কষ্ট হয় বন্ধুগুলার জন্যেই। এ কদিন দেখা সাক্ষাৎ কম হচ্ছে ঠিক, তবু তো তার সমস্তটা জুড়ে ওই বন্ধুরাই আছে। এখন সে জানে যে মনে চাইলেই ছুটে গিয়ে ওদের দেখতে পারবে। এই নিশ্চয়তা নিয়েই দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু দেশ ছেড়ে দূরে চলে গেলে মনে চাইলেই তো আর যখন তখন দেখতে পাবে না, ছুটে যেতে পারবে না। ব্যাপারটা চিন্তা করলে দমবন্ধ হয়ে আসে কষ্টে। 

গ্রীষ্মের অনেকগুলো উত্তপ্ত দিন কাটবার পর একদিন হঠাৎ ছুটির দুপুরে ডাইনির ঢেউ খেলানো কালো চুলের গোছার মতো ভয়ংকর মেঘ ঘনিয়ে আসলো আকাশে। ধূলো উড়িয়ে ছুটল হাওয়া। সোঁদা মাটির ঘ্রাণে সয়লাব হলো চারপাশ। সাপের লিকলিকে জিহ্বার মতো বিদ্যুতের নীল আলো ছড়িয়ে পড়ল আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। হৃদি কিচেনে একটা পিৎজা বেক করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ হুড়মুড় করে সামি দৌড়ে আসলো। হইহই করে বলল, ‘কী করতেছিস ছাই! বৃষ্টি আসতেছে। চল ভিজব।’ বলামাত্র আর একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেটা বাড়ির একগাদা চাকরবাকরের সামনে বৌকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল। লাল টুকটুকে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলো হৃদির মুখ। সামি পাগলাটা কাজের লোকদের বিদ্রুপপূর্ণ হাসি আর ঠাট্টামাখা চাউনি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে বৌকে কোলে করে নিয়ে চলে গেলো বাগানে। তারপর যেন পৃথিবীজোড়া ভালোবাসার বৃষ্টি নামল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। খানিক বাদে রুদ্রও যোগ দিল ওদের সাথে। তিনজন যুবক-যুবতীর বৃষ্টিভেজা হাস্য কলরবে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। 

এভাবেই নদীর স্রোতে ভেসে আসা খুশবু ওয়ালা ফুলের মতো সুন্দর একেকটি দিন কাটছিল ওদের। হৃদির ইদানিং খুব রান্নার শখ হয়েছে। প্রায়ই নতুন নতুন অসাধারণ সব ডিশ বানিয়ে সে বাড়ির লোকদের চমকে দিচ্ছে। ছুটির দিনগুলোতে তিন বন্ধুতে মিলে খুব আড্ডা হয়। মুভি দেখা হয়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে খেলা হয় নানা রকম ভিডিও গেমস। ঝুমকির অপারেশনের ঝামেলা শেষ হওয়ার পর থেকে আকাশও ওদের সাথে এসে যোগ দেয়। বিকেল থেকে রাত অবধি আড্ডাটাড্ডা দিয়ে একেবারে ডিনার করে তবেই বাড়ি ফেরে। 

এদিকে অমৃতার মতোই আরেকজন মানুষও কাজের মধ্যেই ডুবে আছেন সকাল দুপুর রাত্রি। আপাত চোখে সেই মানুষটার ভেতর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে না। তিনি তো আগাগোড়াই ব্যস্ত মানুষ। তাঁর জীবনটা ছক বাঁধা নিয়মে গড়া। সারাদিন কত শত লোকের সাথে উঠা বসা। সবার সাথেই নিয়ম রক্ষার্থে এবং কাজের খাতিরে স্বাভাবিক আচরণ করে যেতে হয়। কারো সাথে হেসে, কারো সাথে গাম্ভীর্য বজায় রেখে, কারো সাথে আবার স্নেহের সাথে আলাপ চালিয়ে যেতে হয়। কত কথা সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে হয় সংসদের অধিবেশনে, সভা সমিতির মঞ্চে, সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে! এত সব প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক এবং সাংসারিক চিন্তা চেতনার রাজ্যে নিজের কথা আর আলাদা করে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে শুধু একলা থাকার সময়গুলোতে দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তার ঝড় ওঠা অথৈ সাগরে একটা মুখ দ্বীপের মতো জেগে ওঠে চোখের সামনে। দিশাহারা নাবিকের মতো দিশা ফিরে পান তিনি। সেই দ্বীপটাই যেন একমাত্র আশ্রয়স্থল। সেইখানেই রয়েছে দুদণ্ড শান্তি। তবে সেই শান্তিটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অমোঘ বাস্তবতার চাপে পিষ্ট হয়ে যায় অতি দ্রুত। 

বাড়ি ফিরে আজকাল ছেলেকে সময় দেন তিনি। যত কাজই থাকুক না কেন ডিনারটা করার চেষ্টা করেন পরিবারের সাথে। পুত্রের সামনে স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করেন। যদিও দুজনের শয্যা এখন আলাদা। রাশেদ মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমান। রোমেলা নিজ থেকে খুব একটা কথা বলেন না। সামনে যখন উপস্থিত থাকেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন শুধু। এত বছরের পুরোনো স্বামীকে যেন নতুন করে চিনে নিতে চান। এর মধ্যেই একবার কিশোরগঞ্জ ঘুরে আসতে হলো রাশেদকে। বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তা পাকা করা হয়েছে তাঁর নিজ উদ্যোগে। কাজ শেষ হয়ে গেছে। এবার রাস্তা উদ্ভোধনের পালা। উদ্বোধন করবেন তিনি নিজেই। সেই সুবাদে গ্রামের বাড়িতে দুদিন থাকতে হলো। ফিরে আসার দিন আকাশে ভরা পূর্ণিমা। গাড়ি উঠোন পেরোতেই দেখা গেলো চারপাশে অলৌকিক নীল আলোর ছড়াছড়ি। সর্ষে ক্ষেতের ওপর স্বপ্নের মতো জেগে আছে পেলব জোছনা। হঠাৎ কানে এসে লাগল ভারি সুন্দর একটা সুর। গাড়ির জানালা দিয়ে তিনি দেখতে পেলেন সর্ষে ক্ষেতের আইলের ওপর একলা বসে কে যেন হেড়ে গলায় গান গাইছে। হাতে ধরা একতারা। আবছা চাঁদের আলোয় মুখখানা চিনতে পারা গেলো না। তিনি খুব একটা রসিক মানুষ নন। গানটান মন দিয়ে শোনেন না বহুদিন। কিন্তু এই গানটা কেন যেন একদম বুকে গিয়ে বিধল। 

“সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ফিরিতেছি পাগল হয়ে 
মরমে জ্বলছে আগুন আর নেভে না। 
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ, 
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না।” 

মাথার ওপরে হীরকখচিত আকাশ। চারপাশে ফকফকে জোছনা। ঝিরঝিরে বাতাস বিলি কেটে যাচ্ছে সর্ষে ফুলের মাঠে। গানের সুর যেন তাঁর নিজের সুর হয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল জলে স্থলে আর অন্তরীক্ষে! 

“তারে ধরি ধরি মনে করি 
ধরতে গেলেম আর পেলাম না 
ধরি ধরি মনে করি 
ধরতে গেলেম আর পেলাম না 
দেখেছি, 
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা 
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ, 
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না।” 

৯৪

রোমেলা দুদিনের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসলেন। তার মেজো মামার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মামা প্রায় ছয়মাস যাবৎ সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। বোনেরা মিলে ঠিক করলেন দুদিনের জন্য হলেও মামার কাছ থেকে ঘুরে আসবেন। উপরি হিসেবে কিছু শপিং হবে। ঘুরে বেড়ানোও হবে। যাবার আগে তিনি ছেলেকে পইপই করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে গেছেন যে বাবার ওপর যেন নজর রাখে। ছেলেটা তার একদম সাদাসিধে আর সরল। মায়ের কথা শুনে উল্টো রেগে গেলো। চোখ বড় করে গরম গলায় বলল, ‘মা তুমি একটু বাড়াবাড়ি করছ কিন্তু। বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। বাবা বলেছে এসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক আছে।’ 

—‘তোমার বাবা বলল আর তুমি বোকার মতো বিশ্বাস করে ফেললে?’

সামি মায়ের দিকে ব্যথাতুর চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বিভ্রান্ত গলায় বলে, ‘তুমি কি বলতে চাইছ বাবা আমাকে মিথ্যে বলেছে?’ 

—‘তোমার চোখে সাধু সাজতে চাইছে লোকটা। তুমি চেনো না তোমার বাবাকে। আমাকে ঠকিয়ে আমারই ছেলের কাছে সাধু সাজা হচ্ছে। এত বড় বেইমান লোকটা! 

মায়ের কথা শুনে সামির চোখ নীড় নষ্ট হওয়া পাখির মতো অসহায় হয়ে ওঠে। পাণ্ডুর হয়ে যায় মুখের রং। 

রোমেলা ছেলের হাতে হাত রেখে বলেন, ‘তোমাকে আমি এসব কখনোই বলতে চাইনি আব্বু। নিরুপায় হয়ে বলছি। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কাকে বলব আমি বলো? তোমার খালাদের সাথে কি এসব কথা বলা যাবে? কোন মুখে বলব? তুমি কষ্ট পেও না। শক্ত হও। আমি তোমাকে আমার পাশে চাই। ওই লোক আমাকে ছেড়ে চলে যাক কোনো সমস্যা নেই। আমার ছেলে আমার পাশে থাকলেই হবে।’ 

—‘বাবা বলেছে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না কখনো।’

—‘ওই যে বললাম তোমার কাছে সাধু সাজতে চাইছে।’ 

সামি আর্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। তাকিয়েই রইল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর অদ্ভুত অন্যরকম গলায় হঠাৎ বলে উঠল, ‘মা তুমি বাবাকে ভালোবাসো তো তাই না?’ 

রোমেলা চমকে উঠলেন। থমকে গেলেন। ফর্সা চামড়ার মুখে অতর্কিতে একটা গাঢ় ছায়াপাত ঘটল। 

—‘এটা কোনো কথা হলো?’ মুখ ঝামটা মেরে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। তারপর আস্তে করে সরে পড়লেন জায়গাটা থেকে। এই ছেলেকে দিয়ে কিছুই হবে না। ছেলে তার বেশি ইমোশনাল। এত আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। অবশ্য এর মাঝেই তিনি দুজন লোক লাগিয়ে দিয়েছেন গোপন তথ্য খুঁড়ে বের করে আনার কাজে। সুলেমানের পরিবর্তে যে নতুন ছেলেটা এসেছে তার বয়স কম। নাম আনিস। টাকার লোভ দেখিয়েই তাকে হাত করা গেছে। আপাতত তার কাজ হলো লাইব্রেরি রুম এবং স্টাডিরুমের প্রতিটা ড্রয়ারের চাবি যোগাড় করা। ছেলেটা বেশ চটপটে। মনে হচ্ছে একে দিয়ে কাজ হবে। এদিকে হক সাহেব সুলেমানের মৃত্যুর পরদিন থেকে আজ অবধি রোমেলার সাথে স্বাভাবিকভাবে একটি বাক্যও বিনিময় করেননি। ভাবটা এমন যেন সুলেমানের মৃত্যুর দায়টা সম্পূর্ণ রোমেলার ওপরেই বর্তায়। আশ্চর্য! সত্তর বছর বয়সের একটা লোক হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে এতে রোমেলার দোষ কোথায়? হ্যাঁ এটা ঠিক যে তাঁর আদেশেই গুণ্ডারা ধরে বেঁধে সুলেমানকে তুলে নিয়ে গেছে। একটু নাহয় টর্চার করেছে। কিন্তু খুন তো করেনি ওরা। এটা নিছক একটা এক্সিডেন্ট ছাড়া কিছুই না। এত সামান্য ঘটনায় এহেন প্রতিক্রিয়া দেখানো পুরোপুরিই অযৌক্তিক ঠেকেছে তাঁর কাছে। সবচেয়ে বড় স্বস্তির খবর হলো সুলেমানের পরিবার ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তারা জানে না যে রোমেলার আদেশ অনুসারে তাদের বাবাকে অপহরণ করা হয়েছিল। তো ঝামেলা শেষ! তাই না? এই এক ইস্যু ধরে এতদিন অবধি ঢং দেখানোর তো কোনো মানে হয় না। সেদিন লোকটা হুট করে এসে বলল, 

—‘শোন! সামির সামনে নরমাল থাকার চেষ্টা করো। আমাদের ভেতরকার সমস্যা যেন ও কিছুতেই টের না পায়।’ 

—‘এটার মানে কী?’ রোমেলার চোখদুটো কপালে উঠে গেলো। 

—‘মানে সামিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে তার বাবা মায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো না।’ 

রোমেলা চোখা হাসি হেসে বললেন, ‘বাহ, আমাকে তো ধোঁকা দিয়েই ফেলেছ। এখন ছেলেকেও ধোঁকা দিতে চাও?’ 

—‘ধোঁকা হবে কেন? ওর জন্য হলেও আমাদের সংসারটা টিকিয়ে রাখতে হবে। ছেলে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে। আমাদের উচিত ওদের জীবনের এই সুন্দর সময়টা প্রাণ খুলে উপভোগ করতে দেওয়া। নিজেদের সমস্যা ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা একেবারেই উচিত হবে না।’ 

—‘তা কী করতে হবে এখন?’ 

—‘কিছু করতে হবে না। যেমন ছিলে। তেমন থাকো।’ 

—‘আর তোমার প্রেমিকাটির কী হবে?’ কেটে কেটে প্রশ্ন করলেন রোমেলা। 

—‘আমার কাছে আমার ছেলের জীবনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ 

কথাটা বলে হক প্রস্থান করেছিলেন। সেদিনই আনিসকে ডেকে এনে তার হাতে এক হাজার টাকার কড়কড়ে বিশটি নোট ধরিয়ে দিয়ে গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগিয়ে দিলেন রোমেলা। সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট ধরলেন তিনি পরদিন বিকেল তিনটায়। আনিসের সাথে ভাইবারে যোগাযোগ রইল। আনিস খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারল না। তার বর্ণনার সারমর্ম অনেকটা এরকম যে, লোকটা সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ি ফিরেছেন। চা খেয়েছেন। সন্ধ্যেবেলায় ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে খাঁচা খুলে পাখি উড়িয়েছেন। এরপর গোসল সেরে স্টাডিরুমে গিয়ে বসেছেন। ল্যাপটপ খুলে কী সব কাজ করেছেন। ফোনে কথা বলেছেন কয়েকজনের সাথে এবং বিদেশী এক ভদ্রলোকের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছেন। এরপর ছেলে এবং ছেলের বৌয়ের সাথে একত্রে ডিনার সেরে ঘুমোতে চলে গেছেন। তবে কাজের কাজ যা হয়েছে তা হলো আনিস এর মাঝেই লাইব্রেরি ঘরের টেবিল সংলগ্ন ড্রয়ারের ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ফেলেছে। এই খবর শুনে রোমেলা মনে মনে ছেলেটির প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যটি পেলেন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসার পরদিন। বাড়িতে একটি চ্যাংড়া ড্রাইভার রাখা হয়েছে কয়েকমাস ধরে। সেই ড্রাইভারের কাছ থেকে কথায় কথায় আনিস জানতে পেরেছে দুমাস আগে একটি অল্প বয়সি মেয়েকে সে মোহাম্মদপুরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিয়ে গাজীপুরের বাংলোতে পৌঁছে দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে ঠিক একই সময়ে হক সাহেবও সেই বাংলোতে উপস্থিত ছিলেন। শুধু এইই নয় ঘটনার পরদিন সেই একই মেয়েকে পুনরায় গাজীপুরের বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবং কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত সেদিনই আবার উত্তরার বাসায় তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আরো বিস্ময়কর খবর হলো বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড বেশ কয়েক মাস আগের এক গভীর রাতে এই একই মেয়েকে লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। সেটা ছিল সামির বিয়ের রাত। ড্রাইভারের বর্ণনা মোতাবেক মেয়েটি দেখতে সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা এবং ছেলেদের মতো বয়কাট চুল। কর্মচারীরা সকলেই মেয়েটিকে চেনে। এ বাড়িতে মেয়েটির অগাধ যাতায়াত। 

কথা হচ্ছিল মোবাইলে। আনিসের দেয়া বর্ণনা শুনে রোমেলার চোখের সামনে যে মুখটি ঝলক দিয়ে উঠল সেই একরত্তি মেয়ের যে কখনো এত বড় দুঃসাহস হবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কখনো। বিস্ময়ে একদম বোবা হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো তাঁর। ফোনটা অতর্কিতে হাত থেকে খসে পড়ে গেলো মেঝেতে। চক্ষু দুটো হয়ে উঠল বিস্ফারিত। মুখ জ্বলে উঠল তীব্র রোষানলে। এতটুকুন একটা মেয়ে… তাও আবার নিজের ছেলের বন্ধু… কী করে সম্ভব! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। হঠাৎ মনে পড়ল, সেদিন লোকটা বলে ফেলেছিল অসাবধানতাবশত… মেয়েটি অন্যরকম! 

কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! 

সারা শরীর রাগে আর ঘেন্নায় রিরি করে উঠল। পাগলের মতো ছুটলেন তিনি ছেলের ঘরে। তাঁর শাড়ির আঁচল লুটাতে থাকল মাটিতে। নিশ্বাসের সাথে যেন বেরিয়ে আসতে লাগল লেলিহান অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। এখুনি ছেলেকে তার গুণধর বাবার কীর্তিকলাপ নিজ মুখে শোনাবেন তিনি। এইসব মিডল ক্লাস আজেবাজে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেমেয়েরা যাদেরকে তার ছেলে বন্ধু ভেবে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। সেইসব বন্ধুরূপী শয়তানদের আসল চেহারাটা যে কতটা কদর্য তা এবারে সবাইকে জানানোর সময় এসেছে। চলতে চলতে হঠাৎ থমকে গেলেন তিনি। না না! এভাবে নয়। যথার্থ প্রমাণ জোগাড় করে তবেই গুমোর ফাঁস করতে হবে। ছেলে তাঁর মুখের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। ড্রাইভারের মুখ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে এই ব্যাপারটাও কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না সামির কাছে। এখন এগোতে হবে খুব সাবধানে। এই বেয়াদব মেয়েকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। রোমেলার সংসার ধ্বংস করার চড়া মূল্য দিতে হবে এই মেয়েকে। দিতেই হবে! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *