বৃষ্টিমহল ৩.৮৫

৮৫

রাশেদ অনেক রাত অবধি হাসপাতালে অবস্থান করেছিলেন। সুলেমানের পরিবার খুব প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছিল। তাদের ভাষ্যমতে গত পরশু রাত দশটায় সুলেমানকে একদল গুণ্ডা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। রাতে সে আর বাড়ি ফেরেনি। খুব ভোরে হাসপাতাল থেকে ফোন যায় বাড়িতে। খবর পেয়ে ছেলেমেয়েরা হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সুলেমানের সন্তানদের ধারণা এই মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে কোনো উপায়ে তারা পিতার হত্যাকারীর শাস্তি চায়। ঘটনার পেছনের গল্পটা টের পেতে রাশেদের খুব বেশি সময় লাগল না। তিনি অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান মানুষ। রোমেলার মেজো মামা এধরনের কাজে বরাবরই ওস্তাদ। এর আগে এক বেয়াদব ড্রাইভারকে শায়েস্তা করেছিল রোমেলা মামার সাহায্য নিয়ে। বোঝা যাচ্ছে এবারেও এ ধরনের কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়েছিল। সুলেমান নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। তার কোনো শত্রু নেই, পাওনাদার নেই। তার মতো গুরুত্বহীন মানুষের পেছনে সময় নষ্ট করার মতো লোক পৃথিবীতে বিরল। অতএব এই দুর্ঘটনার পেছনে যে রোমেলার ষোলো আনা হাত আছে তা জলের মতো পরিষ্কার। 

হক সাহেব খুব প্রয়োজন না পড়লে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না। একেবারে নিরুপায় হয়েই করতে হয় কালেভদ্রে। যেমন আজকে হলো। পুলিশের উপরিমহলের সাথে যোগাযোগ করে তিনি অভিযোগ নামাটি বাতিল করার ব্যবস্থা করলেন। পুলিশ কোনোমতেই আর এই মামলা নেবে না। কিন্তু সুলেমানের ছোট ছেলেটা খুব ঘাড়ত্যাড়া। সে ইতিমধ্যে দুই একজন মানবাধিকার কর্মীর সাথে কথা বলে ফেলেছে। তাদের বাবা হক সাহেবের পুরোনো কর্মচারী এটা সকলে জানে। সংবাদ মাধ্যমগুলো পান থেকে চুন খসলেই হুড়মুড় করে ছুটে আসে স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পিন্ডি চটকাতে। সুলেমানের পরিবারকে না থামালে এই খবর চাপা থাকবে না। যে ক্ষতি হয়েছে তা টাকা দিয়ে কোনোভাবেই পূরণযোগ্য নয়। টাকা সব পারলেও মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে না। তবুও তিনি মোটা অংকের টাকা দিলেন সুলেমানের পরিবারকে। এই ছেলেমেয়েগুলো তাকে দেবতার মতো ভক্তি করে। তাদের বাবার মৃত্যুর জন্য যে প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হক পরিবার দায়ী তা এদের চিন্তার বাইরে। 

বাড়ি ফিরলেন খুব ভোরে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে। সুলেমান তাদের পরিবারের পুরোনো লোক। তিনি যখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়েন সেই সময় থেকে সে এ বাড়িতে কাজ করে। এরকম সৎ, বিশ্বস্ত এবং নিষ্ঠাবান কর্মচারী আজকালকার জামানায় একেবারেই দুর্লভ। বাড়ি ফেরার পর তিনি নিজের বেডরুমে গেলেন না আর। ছাদে এসে বসলেন। তখনও ছোপ ছোপ অন্ধকারে ভরে আছে চারপাশ। পুবের আকাশ লাল। সুইমিংপুলের নীল জল ভোরের আবছা আলোতে ধূসর হয়ে আছে। পুল সাইডে চেয়ার পেতে বসলেন তিনি। সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে। এখনো চোখে ঘুম নেই। বুকে একটা ব্যথা ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কাঠকয়লার মতো পুড়ছে ভেতরটা। এক নিগূঢ় অপরাধবোধ চোরাবালির মতো যেন টেনে নিচ্ছে মাটির অতল গহ্বরে। সুলেমানের মৃত্যুর দায়টা তো তাঁর ঘাড়ে এসেই বর্তায়। যদি তিনি সেদিন রোমেলাকে কথাগুলো না বলতেন… সুলেমানকে মরতে হতো না। অমৃতা তাঁর জীবনে না আসলে… সুলেমানকে মরতে হতো না। তাঁর স্ত্রীর যদি বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন সত্যিকারের একটা ভালো মানুষের মন থাকত… সুলেমানকে মরতে হতো না। আজ শুধু তাঁর এলোমেলো, অবিন্যস্ত, উচ্ছন্ন জীবনের জন্যেই সুলেমানকে মৃত্যুর দ্বারগ্রস্ত হতে হলো। ছেলেমেয়েগুলোকে হতে হলো পিতৃহারা। 

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় পর তিনি নিচে নেমে নিজের বেডরুমে আসলেন। স্ত্রীর সাথে চোখাচখি হলো। তিনি কোনো বাক্য বিনিময় করলেন না। চুপ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলেন। রোমেলার মুখে আতঙ্ক আছে কিন্তু অপরাধবোধ নেই। বিছানার ওপর গুটিশুটি হয়ে থম ধরে বসে আছেন। নির্বিকার, নিথর। তাঁর কি উচিত না এই মুহূর্তেই ক্রোধে ফেটে পড়ে এই মানবীটিকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়া? একটা ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া ভেতরে জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ এবং তিক্ততা? হ্যাঁ সেটাই হয়তো করা উচিত কিন্তু সবার জীবনে সব উচিত কাজ যথা সময়ে করা হয়ে ওঠে না। মনে চেপে রাখা দুঃখ, কষ্ট আর একাকিত্ব আপনজনের সাথে ভাগ করে নেয়ার সুখটা রাশেদ আজ অবধি উপলব্ধি করতে পারেননি। হয়ে ওঠেনি… আর হয়ে ওঠেনি বলেই তাদের এত বছরের জীবনে কখনোই দাম্পত্য কলহ কিংবা মান অভিমান ছিল না। ছিল না কোনো তরঙ্গ। তরঙ্গবিহীন নদী আর প্রাণহীন মাটির পুতুলের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। 

৮৬

—‘গতকাল সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিলি তুই?’ 

আজ ছুটির দিন। ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজে। নাশতার পালা শেষ হলো মাত্র। নিজের ঘরে দীপার সাথে এটা সেটা নিয়ে গল্প করছিল অমৃতা। মায়ের এই আচমকা প্রশ্নটা হঠাৎ বর্শার তীক্ষ্ণ ফলকের মতো এসে বিঁধল তার বুকে। মিথ্যা কথা চট করে মুখে আনা আজও দুষ্কর ব্যাপার তার জন্য। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। চোখের ওপর পড়ল কীসের যেন গাঢ় ছায়া। স্বভাববিরুদ্ধ মিনমিনে গলায় অনেক কসরৎ করে বলল, 

—‘কেন জানতে চাইছ?’ 

মায়ের চোখদুটি যেন আগুনে ঝলসাচ্ছে। ফোঁসফোঁস করে পড়ছে নিশ্বাস। দীপা বেশ ঘাবড়ে গেছে। তার নিজের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা বহুবার ঘটে থাকলেও বড়বোনের সাথে এই প্রথম। মায়ের এই চেহারাটা সে চেনে। দারুণ কোনও খারাপ সংবাদ শুনলে মা এমন দিশাহারা পাগল পাগল হয়ে যান। তার চোখের দৃষ্টি তখন হয়ে ওঠে ক্ষ্যাপাটে। 

অমৃতা ইচ্ছাকৃতভাবে একটু বেশি সময় খরচ করে ধীরেধীরে বিছানা ছেড়ে উঠল। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে তো বলেছিলাম যে… হৃদির বাসায় যাচ্ছি।’ 

—‘মিথ্যা কথা বলিস না!’ চিৎকার করে উঠলেন মা। 

ঠিক সে সময় গুমোট এবং ভ্রুকুটি গম্ভীর চেহারা নিয়ে বাবা প্রবেশ করলেন ঘরের ভেতর। হাত দুটি পেছনে। শরীরটা একটু কুঁজো। দুই ভ্রুর মাঝখানের চামড়ায় কুঞ্চন। চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। 

—‘তুই কি গতকাল গাজীপুর গিয়েছিলি?’ বাবা প্রশ্নটা করলেন সরাসরি। অমৃতার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায়। 

দম আটকে গেলো স্বরনালির কাছে। মেরুদণ্ডে খেলে গেলো ভয়। ফ্যাকাশে মুখে অমৃতা শুধু চেয়ে রইল বাবার দিকে। কিছু বলতে পারল না। কয়েকটা সেকেন্ড এমন থম ধরা অবস্থায় কেটে যাবার পর বাবা হুংকার ছেড়ে বললেন, ‘কথা বলছিস না কেন?’ 

অমৃতা বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল। যন্ত্রচালিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ গিয়েছিলাম।’ 

—‘কেন গিয়েছিলি?’ 

বিছানার চাদর শক্ত করে দু হাত দিয়ে খামচে ধরে অমৃতা কোনো রকমে বলল, ‘একজনের সাথে মিট করতে।’ 

—‘কার সাথে?’ শীতল! ভীষণ শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন বাবা। 

অমৃতা এ প্রশ্নের কোনো তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারল না। পরের ঘটনাগুলো কী রকম যেন ঝড়ের মতো ঘটে গেলো। মা কোনো কথাবার্তা না বলেই অমৃতার মাথায় একটা গাট্টা মেরে তারস্বরে বললেন, ‘তুই কি ওই লোকটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?’ 

অমৃতা গাট্টা খেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইল। স্থানুর মতো। নড়ল না। কিছু বললও না। 

—‘তোমার মা যা বলছে তা কি সঠিক?’ বাবার প্রশ্ন। 

রুদ্ধশ্বাসে অমৃতা বলল –’মা কী বলেছে?’ 

মায়ের আজকে হয়েছে কী কে জানে! সেকেন্ডও গড়াল না তার আগেই অমৃতার মাথায় দ্বিতীয় গাট্টাটা এসে পড়ল। 

—‘উফ, মারছ কেন?’ অস্ফুটে কঁকিয়ে উঠে বলল অমৃতা। 

মায়ের গলা সপ্তমে চড়ল, ‘মারব না তো কী করব? তোর মতো মেয়েকে মেরেই ফেলা উচিত। বল গাজীপুর কেন গিয়েছিলি? কার বাসায় গিয়েছিলি?’ 

অমৃতার ঠোঁট শুকনো। মুখে রক্ত নেই। চোখদুটো মেঝের দিকে নিবদ্ধ। বিছানার চাদর ওর খামচির আঘাতে তখন দুমড়ে মুচড়ে জীর্ণপ্রায়। 

—‘তুই কি সামির বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?’ গলায় বিষ ঢেলে দিয়ে টেনে টেনে কথাটা বললেন মা। 

অমৃতার চিবুক ঝুলে যাচ্ছিল বুকের ওপর। সাইক্লোনের মতো একটা শব্দ হচ্ছে চারপাশে। মাথায় কিছুই খেলছে না। মায়ের কানে এসব কথা কী করে গেলো তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মহসিন আংকেল যদি কিছু বলেও থাকেন মা কী করে শিওর হলেন যে ওটা রাশেদের বাসাই ছিল? হিসাবে গোলমাল লেগে যাচ্ছে। লজিক দিয়ে আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। 

মায়ের কথাবার্তা লাগামছাড়া হয়ে গেছে। প্রাণপণে চেঁচাচ্ছেন তিনি, ‘এই তোর লজ্জা করে না? একটা ম্যারিড লোকের সাথে যে লোকের এতবড় ছেলে আছে তার সাথে তুই লুকায় লুকায় দেখা করিস? তোকে কি আমরা এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি? হ্যাঁ? এই দিন দেখার জন্য তোকে আমরা লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছি?’ এটুকু বলে মা বাবার দিকে ঘুরে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম মেয়েকে শাসন করো! শাসন করো! তোমার ছেলে নেই বলে মেয়েকে তুমি ছেলের মতো স্বাধীনতা দেবে। কোনো কাজে বাধা দেবে না! এখন হলো তো শিক্ষা?’ 

বাবা ঠান্ডা চোখে অমৃতাকে দেখছিলেন। তাঁর মুখখানা এখন ঝড় ওঠার পূর্ব মুহূর্তের থমথমে আকাশের মতো কালো হয়ে আছে। 

—‘এই দীপা! আমার ফোনটা নিয়ে আয় তো। ওই লোকের সাথে একটা বোঝাপড়া করে নেই। আমার মেয়ের সাথে এসব ফাজলামো চলবে না।’ বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন অত্যধিক কঠিন স্বরে। 

অমৃতা অনেক কষ্টে বলল ‘বাবা প্লিজ!’ 

দীপার ফোন নিয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। বাবার হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। রাগে ফুলে আছে কপালের দুপাশের নীল রগ। অমৃতা অস্থিরভাবে উঠে এসে বাবার হাত ধরল, ‘প্লিজ, বাবা প্লিজ! উনাকে তুমি ফোন করে অপমান করো না!’ 

হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন বাবা। 

—‘চুপ কর!’ 

—‘বাবা! ও বাবা! উনার কোনো দোষ নেই বিশ্বাস কর। মানুষটাকে তুমি কিছু বোলো না। ইনসাল্ট করো না প্লিজ!’ কাকুতিমিনতি করতে লাগল অমৃতা। বাবার মন কিছুতেই গলছে না। রক্তচক্ষু নিয়ে তিনি মোবাইলের ডায়াললিস্ট ঘাঁটছেন। অনেক আগে একবার সামির বাবার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। সেই সুবাদে ফোন নম্বরটা হয়তো মোবাইলে সেভ করা আছে কিন্তু এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনের সময় কিছুই পাওয়া যায় না ছাই! 

অমৃতা বাবার পা জড়িয়ে ধরে করুণ গলায় বলল, ‘বাবা, যা বলার আমাকে বলো। উনাকে কিছু বোলো না। বিশ্বাস করো সব দোষ আমার!’ 

বাবা নিজের পা অমৃতার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘ওই ব্যাটাকে আমি শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। কী ভেবেছে সে? দেশে কি আইন কানুন নেই? ক্ষমতা আছে বলে যাচ্ছেতাই করে বেড়াবে?’ 

—‘না বাবা! না!’ 

—‘চুপ কর তুই!’ 

—‘বাবা আমি উনাকে পছন্দ করি।’ কণ্ঠনালি ছিঁড়ে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসলো কথাটা অমৃতার গলা থেকে। বাবার চোখে ধক করে জ্বলে উঠল এক থোকা আগুন। 

—‘কী বললি?’ 

অমৃতার কণ্ঠ রোধ করে দিল অশ্রুর ডেলা। অনেক কষ্টে কান্নাটা ঢোক গিলে ফেলে সে যথাসাধ্য দৃঢ় গলায় বলল, ‘আই লাভ হিম!’ 

স্তম্ভিত বাবার হাত থেকে সেলফোনটা অবলীলায় খসে পড়ে গেলো। মনে হলো তিনি বুঝি আরেকটু হলেই জ্ঞান হারাবেন। 

—‘স্যরি বাবা! তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনি। হয়ে গেছে ব্যাপারটা। স্যরি!’ মা এগিয়ে এসে অমৃতার হাত ধরে বসা থেকে টেনে দাঁড় করালেন।

—‘কত দূর এগিয়েছিস?’ 

অমৃতা প্রশ্নের ধরন বুঝল। কিন্তু কিছু বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

—‘বের হয়ে যেতে বল ওকে আমার বাসা থেকে!’ হঠাৎ বাক্যটা উড়ে এলো খরশান রক্ত হিম করা তুষার ঝড়ের মতো। অমৃতা চমকে তাকালো বাবার দিকে। 

—‘বের হয়ে যা!’ কথাটা বলে বাবা বুনো মোষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে আসলেন। তাঁর যেন জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাঁকে দেখাচ্ছে ক্ষিপ্তবৎ উন্মাদের মতো। অমৃতার কনুই ধরে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসলেন ঘর থেকে। অমৃতা স্তব্ধ হয়ে বাবাকে দেখছিল। এই বাবাকে যেন সে চেনে না। 

মা বাধা দিলেন, ‘কী করছ তুমি? কোথায় যাবে ও?’ 

বাবা তখন ক্রোধে অন্ধ। চোখ দুটি হিংস্র পশুর মতো জ্বলছে নিরন্তর, —‘যেখানে খুশি যাক। এমন মেয়ে আমার দরকার নেই!’ 

দীপা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে বাবার পথ আটকে দাঁড়ালো, ‘বাবা প্লিজ! এমন করো না। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ 

ছোট মেয়েকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন তিনি সামনে থেকে। তারপর বড় মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেলো মুখের ওপর অমৃতা ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই। স্তম্ভিত অমৃতা অনেকটা ক্ষণ নড়তে পারল না। পায়ের তলা থেকে যেন সরসর করে মাটি সরে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাসের খুঁটি হয়ে যাচ্ছে নড়বড়ে। জীবনে এর আগে কোনোদিন এতটা অসহায়বোধ করেনি সে। বুকের গভীর থেকে অভিমানের চাপা একটা আর্তনাদ উঠে আসতে চাইছে। বাবা এমনটা করতে পারল? এতটা নিষ্ঠুর হতে পারল? মিনিট পাঁচেক সময় অমৃতা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। স্থির, প্রতীক্ষমাণ এবং নিশ্চল হয়ে। মনে বড়ই আশা, দরজাটা বুঝি একসময় খুলে যাবে। বাবা মা আদর করে মেয়েকে পুনরায় ঘরে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর অন্য কেউ না বুঝলেও নিজের বাবা মা অন্তত তার মন বোঝার চেষ্টা করবে। সময় কাটতে লাগল টিকটিক করে। দরজাটা চোখের সামনে ম্যাজিকের মতো খুলে গেলো না একটি বারের জন্যও। বন্ধ হয়েই রইল। 

একটা সময় অমৃতা ধীর পায়ে হেঁটে সরে আসলো দরজার সামনে থেকে। তার পরনে লাল রঙের টি শার্ট। কালো ট্রাউজার। ট্রাউজারের পকেটে ভাগ্যক্রমে সেলফোনটা রাখা আছে। কোনো টাকা পয়সা সঙ্গে নেই। পায়ে এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। এরকম নিঃস্ব অবস্থায় সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? আকাশ আর রুদ্র দুজনেই ঢাকার বাইরে। এ মুহূর্তে সামি হৃদি ছাড়া অন্য কোনো আশ্রয়স্থল তার মাথায় আসছে না। বন্ধুরাই একমাত্র ভরসা। 

বাইরে তখন মেঘ ডাকছে গুরুগুরু শব্দে। ঝড়ো বাতাসে উড়ছে ধূলো। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে বিধ্বস্ত, অসহায়, ভগ্নহৃদয় অমৃতা যখন এলোমেলো পায়ে অ্যাপার্টমেন্টের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো ঠিক তখনই পকেটে রাখা সেলফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। মেসেঞ্জারে কল এসেছে। গ্রুপ কল। ফোন করছে বন্ধুরা। এই গ্রুপে সবাই আছে শুধু সামি নেই। অমৃতা ফোন ধরতেই হৃদি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘অমৃতা! প্রব্লেম কী তোর? হোয়াট দ্যা ফাক আর ইউ ট্রাইং টু ডু?’ 

—‘মানে কী?’ মন খারাপের অতল কুয়োর ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো বেরিয়ে আসলো শব্দ দুটো। 

হৃদি ফণাধারী সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বলল, ‘তুই কি একটা মানুষ? মানুষ কখনো এত খারাপ হইতে পারে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’ 

বিভার আওয়াজ পাওয়া গেলো, ‘আহা! তুই এরকম অফেন্সিভ কথাবার্তা বলতেছিস কেন?’ 

—‘একশবার বলব অফেন্সিভ কথা। তুই কি জানিস? আমার শাশুড়ি সামিরে বলছে যে ওর বাপের অন্য একজনের জন্য ফিলিংস আছে?’ 

অমৃতা কম্পিত বক্ষ নিয়ে বলল, ‘কবে বলেছে?’ 

—‘কবে বলেছে তা জেনে তুই কী করবি? তোর কি মনের মধ্যে একটু মায়া দয়া নাই? একটা ছেলের এই বয়সে এসে এরকম কথা শুনলে কেমন লাগে তোর কোনো ধারণা আছে? তুই কেমন মেয়েমানুষ? একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছিস? তুই কি আমার বন্ধু অমৃতা? তোকে আমার বন্ধু বলতে লজ্জা হচ্ছে!’ 

—‘আরে থাম থাম!’ আকাশ বলে উঠল, ‘হৃদি লিসেন। মাথা ঠান্ডা কর। অমৃতা!… শোন! 

অমৃতার গলা কাঁপছিল। বাইরে তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। ভর দুপুরে সন্ধ্যা নেমেছে যেন। হাওয়ায় খুব জোর। গেটের ফাঁকফোকর গেলে বৃষ্টির জল তেড়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল ওকে। তবে ভিজছিল শুধু শরীরটাই। বুকের ভেতরে তো মরুভূমির শুষ্কতা! 

—’বল।’ 

—‘আমাদেরকে প্লিজ একটু খুলে বল যে তোরা আসলে এখন কোন স্টেজে আছিস। মানে তোর কি উনার সাথে রেগুলার যোগাযোগ হয়?’ আকাশের স্থির গলার প্রশ্ন। 

—‘না।’ 

এবার রুদ্র কথা বলল, ‘তাহলে দোস্ত ব্যাপারটা তুই এখানেই মিটায় ফেলা। কারণ হৃদির কাছ থেকে যা শুনলাম সামি অনেক শকড। ও এমনিতেই আলালের ঘরের দুলাল টাইপ ছেলে। এই প্রেশার ও নিতে পারবে না। আর যদি কোনো একভাবে জানতে পারে যে এই ঘটনার সাথে তুই জড়িত আছিস। তাহলে বুঝতেই পারতেছিস কাহিনি কী হবে।’ 

অমৃতা চুপ করে রইল। তার চোখের দৃষ্টি শূন্য। মুখ পাণ্ডুর। এক প্রবল ঝড় যেন এইমাত্র তার মাথার ওপরের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সব কিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। বাবা মা ছোট বোনকে নিয়ে তার একটা পরিবার ছিল, প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধুরা ছিল, মনের গভীরে একটা বৃষ্টিমহলের স্বপ্ন ছিল… এখন কেউ নেই। কিচ্ছু নেই! এ জীবনে আর বৃষ্টিমহল সত্য হলো না। আহা বৃষ্টিমহল! আহারে বৃষ্টিমহল। স্বপ্নে ছিলি, স্বপ্নেই রইলি তুই! 

চলে যাবে সে। দূরে, বহুদূরে। এই বাসায় আর কখনোই ফিরে আসবে না। ফিরবে না এই শহরে। এ শহরে সবকিছু মিথ্যে। উঁচু উঁচু দালানগুলোর মতোই মানুষের মনও এখানে ইট কাঠ পাথরেরই তৈরি। নির্জীব এবং যান্ত্রিক! বেশ তো! তোমরা সবাই অমৃতাকে ঘেন্না করো? তবে জেনে রাখো অমৃতাও তোমাদের এই ছদ্মবেশী, মিথ্যে মুখোশধারী সমাজকে ঘেন্না করে। 

—‘বুঝতে পেরেছি। আমি রাখি এখন।’ বলে সে ফোনটা কেটে দিল 1 পা বাড়ালো সাদা বৃষ্টির ঘেরাটোপে। পকেটে একটাও পয়সা নেই। কোথায় যাবে? কী করে যাবে? যাবার আগে একটা বার কি সেই মানুষটাকে দেখার সৌভাগ্য হবে? শেষবারের মতো? মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগবে? কত ঘণ্টা? একরাশ বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটা শুরু করল সে। 

৮৭

ব্রেকফাস্টের পর সামি বাবা মায়ের বেডরুমে উঁকি দিল একবার। খোলা জানালা দিয়ে ঝড়ো বাতাস উড়ে আসছে। থেকে থেকে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। বৃষ্টির দিন বলে দিনের বেলায়ও ঘরের ভেতর দুটো টিউবলাইট জ্বলছে। মা চুল আচঁড়াচ্ছেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। বাবা গোসল সেরে বেরিয়েছেন মাত্র। সামিকে দেখে তিনি একটু ম্লান হাসলেন। সামি সেই হাসির কোনো উত্তর না দিয়েই মায়ের দিকে পলক তুলে তাকালো একবার। মায়ের মুখজোড়া উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। বুক মোচড় দিয়ে ওঠে মায়ের করুণ মুখটা দেখলে। সামি এগিয়ে এসে মায়ের মাথায় একটা হাত রেখে নরম গলায় বলল, ‘এখন কেমন আছ?’ 

—‘এখন ভালো আছি আব্বু। তুমি চিন্তা করো না।’ ছেলের হাত চেপে ধরে আশ্বস্ত করলেন রোমেলা। 

রাশেদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সাধারণত ছেলের সামনে পড়ে গেলে তিনি যত কাজই থাকুক না কেন একটু সময়ের জন্য হলেও ছেলের সাথে কুশল বিনিময় করেন। খোঁজ খবর নেন। আজ তাকে সেসব কিছুই করতে দেখা গেলো না। আজ তিনি বড়ই আনমনা এবং বিষণ্ণ 

—‘বাবা! তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে!’ 

ছেলের গলার স্বর শুনতে পেয়ে যেন তাঁর ঘোর ভাঙল। চমক লাগা চোখ মেলে চাইলেন তিনি। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় রেখে চৌকাঠে দাঁড়িয়েই বললেন, ‘হ্যাঁ বলো।’ 

সামি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলল না। তাকে শীর্ণ দেখাচ্ছে। ফর্সা মুখখানায় দপদপ করছে তেজের গনগনে আঁচ। পিতা পুত্র কয়েকটা মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে রইল একে অপরের দিকে। সামি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করল যেন। তারপর শক্ত গলায় বলল, ‘মা বলছিল যে…’ এটুকু বলে থেমে পড়ল সে। বুক কাঁপছে তার। হাতে পায়ে একটা শিরশিরে ভাব। মুখে জড়তা। পিতার সাথে এ ধরনের অরুচিকর বিষয় নিয়ে আলাপ করতে কোন সন্তানের ভালো লাগে? কিন্তু করতে যে হবেই। ভাগ্যের ফের! 

—‘বাবা, ডু ইউ হ্যাভ ফিলিংস ফর সামওয়ান এলস?’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল সে। রাশেদের চেহারার পট বদলে গেলো নিমেষে। চোখে ঝিলিক দিল তীব্র বিস্ময়। সেই সাথে নিদারুণ অপমানবোধ এবং রাগ। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। প্রচণ্ড অবিশ্বাসের গলায় বললেন, ‘তুমি বলেছ সামিকে এসব কথা?’ 

রোমেলা চোখ সরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। স্থিরকণ্ঠে বললেন, ‘আজ নয়তো কাল ওকে জানাতে তো হতোই!’ 

রাশেদ বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো চেয়ে রইলেন রোমেলার দিকে। একটা অদম্য ক্রোধ তাকে পূর্ণমাত্রায় গ্রাস করল। মনের কোণে যতটুকু সম্মান এই রমণীটির জন্য এতকাল অবধি জমা ছিল সেই সম্মানটুকু বুঝি এইমাত্র জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সুতীব্র ক্রোধানলে। সুলেমানের মৃত্যুর কারণ জানতে পারার পরেও এর প্রতি অতটা ঘেন্না হয়নি, যতটা এখন হলো। নিজের একমাত্র সন্তানের চোখে তিনি ছোট হয়ে গেলেন আজ এই মানুষটার জন্য! 

—‘বাবা! ইজ ইট ট্রু?’ 

রাশেদ পুত্রের চোখের দিকে তাকালেন দিশাহারাভাবে। তাঁর মাথা শূন্য। মস্তিষ্ক শূন্য। কেমন অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। তিনি যেন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছেন আদিগন্ত এক জলোচ্ছ্বাসের মাঝে। চারদিকে শুধু বড় বড় ঢেউ। কূল নেই, কিনারা নেই। প্রাণাধিক প্রিয়পুত্রের চোখে চোখ রাখতে আজ তাঁর সীমাহীন কুণ্ঠা! অপ্রতিরোধ্য সংকোচ! 

একটা ঢোক গিললেন তিনি। মাথা নত করে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘আই উইশ আই কুড সে আদার ওয়াইজ। বাট আই ফিয়ার ইওর মাদার ইজ রাইট!’ 

সামির চোখের দৃষ্টি চকিতে বিস্ফোরক হয়ে উঠল। মুখ কুঁকড়ে গেলো ব্যথায়। মনে হলো যেন এইমাত্র তার খুব আপন কেউ পৃথিবী ছেড়ে গত হয়েছে। রাশেদ ছেলের ওই অসহায় মুখখানা সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে দরজার বাইরে পা বাড়ালেন। 

—‘শোনো!’ ছেলের কণ্ঠস্বর থমকে দিল তাঁকে। তিনি ঘুরে তাকালেন।

সামি বরফ শীতল কণ্ঠে কেটে কেটে বলল, ‘আমার মায়ের সাথে তুমি এমন করতে পারো না!’ 

রাশেদ স্তিমিতভাবে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। তাঁর চোখে এখন ঝাঁঝ নেই আছে শুধুই খাঁখাঁ শূন্যতা। ছেলের এই উদ্ধত ভাব তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নতুন। বাবাকে যেন শাসন করছে ছেলে। সামি আহ্লাদী আর একগুঁয়ে ছিল সবসময় এ কথা সত্য। কিন্তু বেয়াদব ছিল না কোনো কালেই। হাতের আঙুল উঁচিয়ে অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করে উঠে ছেলে বলল, ‘আমার মা কষ্ট পেলে আমি কাউকেই ছেড়ে দেবো না! কথাটা শুনে রাখো। আমার মাকে ঠকানোর চেষ্টা করো না, খবরদার! ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!’ কথাগুলো বলা শেষ করে সামি ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ফেলে গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে অতিক্রম করে। রাশেদ এক ঝলক তাকালেন রোমেলার দিকে রোমেলার দুচোখ তখন পুত্র গরিমায় জ্বলজ্বল করছে। 

বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রাশেদ লাইব্রেরী রুমের গোল বারান্দায় এসে বসলেন। বৃষ্টি এখনো থামেনি। বাড়ি থেকে এই পর্যন্ত তাঁকে আসতে হয়েছে ছাতা মাথায় দিয়ে। উঠোনে জল জমে গেছে। কাদা থকথক করছে চারপাশে। আশেপাশে কোথাও ব্যাঙ ডেকে যাচ্ছে ক্রমাগত। বারান্দায় এসে বসতেই সুলেমানকে খুব মনে পড়ল। সুলেমান নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত তথ্য গোপন করে গেছে। একজন মানুষের এই অখণ্ড বিশ্বস্ততার কোনো মূল্যই তিনি দিতে পারলেন না। একটা মানুষের জীবন চলে গেলো তার অপকর্মের হিসেব লুকোতে গিয়ে! এর চেয়ে বড় পাপ আর কী হতে পারে? কেন যে সুলেমান সত্যটা বলে দিল না! বললে হয়তো বেচারা অন্তত জানে বেঁচে যেত। উচিত ছিল সুলেমানকে কয়েকদিনের জন্য অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া। কে জানত রোমেলা এমন সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসবে! আহা, এত বছরের পুরোনো লোকটা! অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মরেই গেলো।একটু বাদে গন্ডায় গন্ডায় লোক আসা শুরু হবে। স্টাডিরুমে মিটিং চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তাঁর মনটা অত্যধিক খারাপ। আজ বোধহয় কোনো কাজেই মন বসবে না। মিটিং ক্যান্সেল করা সম্ভব হলে তিনি তাইই করতেন। কিন্তু সেটা কোনোমতেই সম্ভব না। 

বারান্দার ছাদ চুঁইয়ে জল গড়াচ্ছে বৃষ্টির। কৃষ্ণচূড়ার ডাল নেচে চলেছে হাওয়ায় হাওয়ায়। সামনের উঠোন বৃষ্টিতে সাদা! দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে বাড়ির মূল ফটক। ফটকের পাশে একটা লম্বা টুল রাখা। ওই টুলটাতেই সুলেমান বসে থাকত। রোজ! আজকের এই মেঘলা সকালটায় কাঠের চেয়ারে বসে থেকে কাহিল চোখে বৃষ্টি ডোবা সেই টুলের দিকেই চেয়ে ছিলেন রাশেদ। মানসপটে একমাত্র ছেলের বাল্যকালের নানা স্মৃতি ভেসে উঠছে। তিনি বাবা হয়েছিলেন অতি অল্প বয়সে। প্রথম যৌবনেই একজন সার্থক পিতা হবার যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন আঁটঘাট বেঁধে। তাঁর জীবনটা ছেলেকে কেন্দ্র করেই ঘুরছিল। ছেলে কী করে মানুষের মতো মানুষ হবে, কী করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এসব চিন্তা করেই কেটে গেছে অনেকগুলো বছর! এমন নিবিড় উৎসর্জনের পরেও এই জীবন সায়াহ্নে এসে দৈব দুর্বিপাকে পড়ে তিনি পুত্রের চোখে তুচ্ছ হয়ে গেলেন, হেয় হয়ে গেলেন। বরবাদ হয়ে গেলো এত বছরের সাধনা, একাগ্রতা এবং একনিষ্ঠতা। মাতাপিতা শৈশবে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন। লালন পালন করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পিতামাতার দায়ভার অনেকখানিই সন্তানের ওপর বর্তায়। সামি এখন বড় হয়েছে। মায়ের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকেই হয়তো সে বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর তো বাবা হিসেবে খুশি হওয়ার কথা। ছেলে বোধপ্রাপ্ত হয়েছে। দায়িত্বশীল হয়েছে। নীতিবাগীশ হয়েছে! এর চেয়ে স্বস্তির খবর আর কী হতে পারে? কিন্তু তিনি কেন শতভাগ খুশি হতে পারছেন না? কেন এক অনির্বচনীয় ক্লেশে সারাটা হৃদয় এমন কলুষিত হয়ে আছে? কেন জ্বলছে ধিকিধিকি অঙ্গার শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে? 

বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। ভেজা মাটির ঘ্রাণে সয়লাব চারপাশ। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে জমে থাকা বৃষ্টির জল। চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন তিনি। নিদ্রাবিহীন রাত্রিযাপনের পর শরীর ক্লান্ত। মন বিষাদগ্রস্ত। সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল দৃশ্যটা। বৃষ্টির জলে ভিজে চুবুচুবু হয়ে অমৃতা এসে দাঁড়িয়েছে গেটের সামনে। আঁটোসাঁটো হয়ে গায়ে লেগে আছে লাল টি শার্ট। চুল লেপটে গেছে কপালে। তার চোখে মুখে একটা দিশাহারা ভাব। সিকিউরিটির সাথে অধৈর্য ভাবে কী সব কথা বলল মেয়েটা। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল লাইব্রেরির দিকে। 

ছাইরঙা মেঘের লহর ভেদ করে মিহি রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে তখন আকাশময়। মেঘের পাড়ে জমেছে রুপালি রঙের আস্তর। উতলা বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার কয়েকটা পাঁপড়ি উড়ছিল এলোমেলো। সেই বৃষ্টিভেজা রুপো রঙের চকচকে সকালটার ভেতর দিয়ে অমৃতাকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখলেন রাশেদ। দেখামাত্র এক ঝলক স্নিগ্ধ হাওয়া ছুঁয়ে দিল তাঁকে। পাটিগণিতের কোনো মস্ত কঠিন অংক বুঝি নিমেষে সহজ হয়ে গেলো। মনে হলো এই মুহূর্তে মেয়েটির এখানে আসাটা খুব জরুরি ছিল। মেয়েটি এলো বলেই তিনি আজ এই বৃষ্টিভেজা দিনটায় সম্যক রূপে উপলব্ধি করলেন যে, পৃথিবীতে শুধু এই একটি মানুষই আছে যার সাথে তাঁর মনের টান সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ এবং নির্ভেজাল। এই মেয়েটা তাঁর কেউ না, কিচ্ছু না, তবুও মনে হলো যেন এই মেয়েটিই তাঁর সব কিছু! 

অমৃতার মুখে দুশ্চিন্তা, অধীরতা এবং ত্রাসের চিহ্ন। খুব হাঁপাচ্ছে। ক্লান্তি মাখা চোখ নিয়ে সে বারান্দার চেয়ারে বসা মানুষটাকে দেখল। মানুষটার গায়ে অফ হোয়াইট রঙের কলার ওয়ালা টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। অবিন্যস্ত চুল। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এই সমস্তটাই অমৃতার জন্য ভালো লাগার এক টোটাল প্যাকেজ। কিন্তু আজ ভালোলাগার চেয়ে বিষাদ বেশি। এই প্রিয় মুখটা সে আজকের পর থেকে আর দেখতে পাবে না। না দেখেই বাঁচতে হবে তাকে। মরে মরে, ধুঁকে ধুঁকে! 

অমৃতা হনহন করে হেঁটে এসে মানুষটার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো উঠোনে। দাঁড়ালো বারান্দার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার আড়ালে। কাদা থকথকে মাটির ওপর কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন লাল গালিচা। 

—‘আমি চলে যাচ্ছি!’ হাঁপধরা গলায় বলল অমৃতা। 

রাশেদ নিষ্পলক চেয়ে ছিলেন ওর দিকে। তাঁর মুখ থেকে এখন রাত জাগার ক্লান্তি মুছে গেছে। সরে গেছে কপালের ভাঁজ। চোখজোড়া আচ্ছন্নতায় ডোবা। ঠোঁটে কেমন অলৌকিক হাসির রেশ। 

—‘বাবা মা জেনে গেছে আপনার ব্যাপারে। আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। হৃদি ফোন করেছিল। সে বলল সামির কানে নাকি কী সব কথা গেছে। সে খুব আপসেট।’ এক নিশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে অমৃতা কান্নার ঢোক গিলল। তার পুতুল চোখের কার্ণিশে ফোঁটায় ফোঁটায় জল জমেছে তখন। 

—‘আপনি কিছু বলছেন না কেন? আমি চলে যাচ্ছি। একটা ট্রেনে উঠে পড়ব তারপর চলে যাব অনেক দূরে। আর ফিরে আসব না। আমার কেউ নেই। বন্ধুরা ছিল এখন আর নেই। বাবা মা ছিল এখন নেই। আর আপনি… আপনি তো কখনওই আমার ছিলেন না। তবুও…’ অমৃতা থামল। রাশেদ কিছু বললেন না। নিমিষহারা চোখে শুধু চেয়েই রইলেন। 

—‘তবুও আপনাকে শেষবারের মতো দেখতে আসলাম। আপনি আমার না তা আমি জানি। কিন্তু জেনে রাখবেন যে আমি শুধুই আপনার। আপনার ছিলাম। আপনারই থাকব।’ 

এ কথা শুনে রাশেদ হঠাৎ তাঁর ধারওয়ালা সুন্দর হাসিটা হাসলেন। বুকের পাঁজরে এতক্ষণ ধরে আটকে থাকা ভারি পাথরটা নেমে গেছে। সমস্ত দুনিয়া এখন ভারহীন, হালকা আর ফুরফুরে! ভেজা চুল, ভেজা জামা, আর চোখভর্তি অভিমানের মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এত সুন্দর কিছু তিনি জীবনে এর আগে কোনোদিন দেখেননি। পৃথিবীর অন্য কোনো মুখ এমন চুম্বকের মতো টানেনি তাঁকে এর আগে কখনো! 

—‘আপনি কি কিছুই বলবেন না? কিছু বলা…’ 

রাশেদ আচমকা এগিয়ে এসে অমৃতার পুতুল মুখখানা দুহাতে চেপে ধরলেন। তারপর মোহাবিষ্টের মতো ওর পাতলা, গোলাপি রঙের ভেজা অধরে এঁকে দিলেন এক প্রগাঢ় চুম্বন। অমৃতার মুখের কথা আটকে গেলো, ছুটে গেলো! ধাক্কা দিয়ে কেউ একজন হৃৎপিণ্ডটা নিয়ে আসলো যেন গলার কাছে। শাঁখ বেজে উঠল শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায়। বহু দিনের অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টি নামল হৃদয় উঠোনজুড়ে। সেই বৃষ্টিতে নিভে গেলো বিরহের অনল, অতৃপ্তি এবং তৃষ্ণা! 

কৃষ্ণচূড়ার ডালের ফাঁক গেলে সদ্য মেঘ ভাঙা রোদ্দুরের রুপালি ঝিকিমিকি ছুঁয়ে দিচ্ছিল ওদের। ছুঁয়ে দিচ্ছিল জল ভরা এলোমেলো বাতাস। প্রলম্বিত চুম্বন লগ্নের পর অমৃতা অর্ধনিমীলিত চোখ তুলে তাকালো মানুষটার দিকে। হতভম্ব ভাবটা তখনও কাটেনি। সে বুঝতে পারছে না কী থেকে কী হয়ে গেলো। বুক কাঁপছিল দুরদুর করে। চোখভর্তি চাপা উচ্ছ্বাস আর মনের মাঝে ঝনক ঝনক খুশির ঝংকার! অমৃতা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইলেও রাশেদকে কিন্তু একটুও বিচলিত দেখাল না। তিনি হাত বাড়িয়ে অমৃতাকে কাছে টেনে নিলেন। অমৃতা খুব আস্তে করে আদুরে বেড়ালের মতো মাথাটা রাখল তাঁর প্রশস্ত বুকে। পরম নির্ভরতায়। এমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল বুঝি জীবনে এই প্রথম খুঁজে পেল সে। 

—‘তোমার ভয় কীসের পুতুল? আমি আছি না? কোথাও যাবে না তুমি। আমার কাছেই থাকবে।’ রাশেদ বললেন পরিষ্কার গলায়। অমৃতার চোখের তারায় চিকচিক করে উঠল কয়েকবিন্দু অশ্রুজল। এই মুহূর্তে মরে গেলেও তার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। 

—‘তুমি গাজীপুরের রিসোর্টে চলে যাও। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।’ 

অমৃতা একটু ইতস্ততভাবে বলল, ‘গাড়ি নিয়ে যাব? কেউ যদি দেখে ফেলে?’ 

—‘দেখলেই কী? তোমার ভয় নেই কোনো। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। অমৃতার ঠোঁটের হাসি স্ফীত হলো কথাটা শুনতে পেয়ে। মৃদুভাবে সে বলল, ‘আপনি কখন আসবেন? 

—‘সন্ধে হবে। একা থাকতে তোমার সমস্যা হবে না তো?’

—‘না। সমস্যা হবে না। আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য।’ 

অমৃতা যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন তার ঠোঁটের সাথে, বুকের সাথে, শরীরের প্রতিটি স্পন্দনের সাথে মিশে আছে প্রথম চুম্বনের স্বাদ। একটু আগে এই গেট দিয়ে প্রবেশ করেছিল সে মৃতপ্রায় বিমর্ষ মন নিয়ে আর এখন বেরিয়ে আসলো পরিপূর্ণ প্রাণশক্তি হাতে নিয়ে। চারপাশে এখন হোলির রং লেগেছে! 

৮৮

বিকেলে একবার বাবার বাড়ি যাবার কথা ছিল হৃদির। সামিকেও যেতে বলেছেন মা। হৃদি ভেবেছিল দুপুরে খাবার পরপরই বেরিয়ে পড়বে। বিকেলের চায়ের পালাটা বাইরে কোথাও সেরে নেবে। রাস্তার ধারের ফুচকা অথবা ভেলপুরির সাথে। রুদ্র আর আকাশ থাকলে আড্ডাটাও জমে যেত। কিন্তু এই পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলো না। বেলা বারোটার দিকে সামি সেই যে বিছানায় ঢলে পড়ল আর একটিবারের জন্যেও তাকে শোয়া থেকে ওঠানো গেলো না। জ্বর জ্বর ভাব। হৃদি থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপল। একশ দুইয়ের মতো হবে টেম্পারেচার। দুপুরের খাবার পৌঁছে দেওয়া হলো তার ঘরে। খেলোও না কিছু ঠিকমতো। মুখে নাকি জন্মের অরুচি! লাঞ্চের পর একটা নাপা এক্সট্রা খেয়ে আবার ধুপ করে শুয়ে পড়ল। নিরস গলায় হৃদিকে বলল, ‘আমি কোথাও যাব না। তুই যা।’ 

একা একা যেতে কি আর ভালো লাগে? তাছাড়া সামিকে এই অসুখের মুখে ফেলে রেখে সে যাবে কী করে? অগত্যা প্ল্যানটা ক্যানসেল করতেই হলো। মাকে ফোন করে দাওয়াতটা নাকচ করে দিল। তারপর সামির মাথার কাছে এসে চুপ করে বসে রইল। সামির বন্ধ চোখের পাতা কাঁপছে তিরতির করে। কপালের চামড়া আছে কুঁচকে। মনে হচ্ছে কোনো গভীর দুশ্চিন্তা তাকে অনবরত দংশন করে চলেছে। 

—‘কী ভাবিস?’ 

প্রশ্নটা শুনে সামি চোখের ঢাকনা আলতো করে মেলে ধরে ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কথা বলিস নাতো! ভালো লাগতেছে না কিছু।’ 

অন্য সময় হলে এমন তাচ্ছিল্য মাখা কথায় হৃদি রেগে যেত নির্ঘাত। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম। সামির মনের অবস্থাটা সে খুব ভালো মতোই আঁচ করতে পারছে। সর্বক্ষণ বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফূর্তিতে মেতে থাকা, বাবা মায়ের আদর আহ্লাদে হেসে খেলে সময় কাটিয়ে দেওয়া ছেলেটা যেন হঠাৎ করে এক রাত্তিরের মধ্যে পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে গেছে। চোখ মুখ থেকে ফূর্তি ভাব মুছে গিয়ে তার বদলে ভর করেছে এক গহন বিষণ্ণতা। সে কারো সাথে কথা বলছে না, নড়ছে না, চলছেও না। চুপচাপ শুয়ে থেকে চিন্তিত মুখ নিয়ে কীসের যেন ধ্যান করছে শুধু দিনরাত। হৃদি ওর কপালে একটা হাত রেখে নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা কথা বলব না। বসতে দিবি একটু? নাকি তাও চলবে না?’ 

—‘বসে থাক চুপ করে।’

হৃদি তাই করল। নিশ্চুপ বসে থেকে সামির কোঁকড়া চুলগুলো নিয়ে খেলতে লাগল আনমনে। সামির চোখ বন্ধ। হাতদুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। কপাল থেকে চিন্তার রেখাগুলো সরার নাম নেই। হৃদির কষ্ট হচ্ছিল। একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছিল। আর ওই কষ্টটাই কলিজার মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধতে বিধতে তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল যে এই ছেলেটাকে সে কতখানি ভালোবাসে। খানিক বাদে সামি উঠে বসে পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা কাঁথাটা গায়ের ওপর টেনে নিল। হৃদি ব্যস্ত গলায় বলল, ‘ঠান্ডা লাগছে?’ 

—‘হুম।’ কাঁথা গায়ে জড়াতে জড়াতে অস্ফুটে উত্তর দিল সামি। হৃদি আরেকবার ওর কপালে হাত রাখল। জ্বরটা বেড়েছে। 

বসা থেকে উঠে পড়ল সে। ঘরের এসির পাওয়ারটা কমিয়ে একদম শূন্যে নিয়ে আসলো। তারপর বেরোলো শাশুড়ির খোঁজে। উনাকে এবার খবরটা না দিলেই নয়। গিয়ে দেখল শ্বশুর শাশুড়ির বেডরুম ফাঁকা। কাজের লোকের কাছ থেকে জানতে পারল শাশুড়ি গেছেন বোনের বাসায় এবং শ্বশুর মশাই নিচে স্টাডিরুমে মিটিং করছেন। সময় নষ্ট না করে সে শাশুড়ির নম্বরে ডায়াল করল। তিনি ধরলেন না। বিচলিত হৃদি কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ দোতলার করিডোরে পায়চারি করল অস্থির চিত্তে। তারপর আবার ফিরে আসলো নিজের ঘরে। এসে দেখল সামির একটু চোখ লেগে এসেছে। নিশ্বাস ভারি। ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়। হৃদি পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আকাশের মেঘ তখন কেটে গেছে। চৈত্রের আলো ঝলমলে বিকেল বাইরে। রোদে খুব একটা তেজ নেই। বাড়ির সামনের স্কুল মাঠটা ফাঁকা। আজ ছুটির দিন। স্কুল বন্ধ। গলির মধ্যে একটা আইসক্রিমের গাড়ি ঘুরছে টুংটাং শব্দ তুলে। কয়েকটা টোকাই ছেলেমেয়ে আইসক্রিম খাবার লোভে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্রাণপনে। আইসক্রিমওয়ালা ওদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। শান্ত বাতাসে ঝিরিঝিরি দুলছে আম আর কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা। ইশ! এমন বিকেলে বন্ধুদের সাথে টিএসসিতে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে পারলে কী দারুণ হতো! নিজেকে আজ ভীষণ একলা বলে মনে হচ্ছে তার। বিভা নেই। আকাশ রুদ্রও নেই ঢাকায়। আর অমৃতা… অমৃতাটা তো থেকেও নেই। এই মুহূর্তে অমৃতার জন্যে মন কেমন করছে তার। কেন যে এরকম একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেলো মেয়েটার জীবনে! 

হঠাৎ একটা হলদে ছোট্ট পাখি উড়ে এসে বসল বারান্দার গ্রিলে। বিকেলের আলো লেগে আছে ওর গায়ে। ডানা ঝাপটাচ্ছে ঝটপট শব্দ তুলে। ডাকছে টুইটুই করে। পুতুপুতু দুটা চোখ মেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে হৃদিকে। কোনো ভয় নেই তার, নেই কোনো সংকোচ! কী সুন্দর! কী সুন্দর! আর কী মিহি ওর গলার স্বর! এই যান্ত্রিক শহরে হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এলো এই ছোট্ট সুন্দর পাখিটা? নাম কী ওর? জানে না তো হৃদি। 

হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে? 

গুনগুন করল হৃদি। তার মনে হলো পাখিটি যেন অতীতকালের সুন্দর কিছু মুহূর্তের পুরনো চেনা ঘ্রাণ সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ওর ডানা ছটফটানির শব্দে হৃদির বুকের মধ্যে শঙ্খ ধ্বনির মতো বেজে উঠছে বন্ধুদের সাথে কাটানো কিছু সুখময় মুহূর্তের স্মৃতি। চায়ের আড্ডা, হাসির ফোয়ারা… ফাজলামো, বাঁদরামো, দুষ্টুমি। আহা! বাতাস ভরে গেলো অসংখ্য টুকরো টুকরো পুরনো ছবি ঠাসা ফুলেল পাপড়িতে। সেই হলুদ বিকেলের বুকে বসে থাকা হলুদ পাখির দিকে চেয়ে থেকে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো হৃদিরও আচমকা মনে হলো যা পেয়েছে তার চেয়ে ঢের ভালো ছিল যা ফেলে এসেছে তা। এই মুহূর্তে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জিন এসে যদি তাকে প্রশ্ন করে, কী চাই? সে নির্দ্বিধায় বলে দেবে, ‘ফেলে আসা দিনগুলি!’ 

৮৯

রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়েছিল চিলেকোঠার ঘরটা। টালির ফাঁক গেলে সূর্যের আলো এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতর। বিছানায় চুপটি করে বসে বসে জানালায় চোখ রেখে আকাশ পাতাল ভাবছিল অমৃতা। বাবার কথা। মায়ের কথা। ছেলেবেলার কথা। বন্ধুদের কথা… কত কথা আর কত রকম দুশ্চিন্তা! কিন্তু বলতে নেই এই সমস্ত দুশ্চিন্তা আর হতাশা ছাপিয়ে খানিক বাদে বাদেই এক আশ্চর্য সুখানুভূতিতে তার সমগ্র অন্তর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনের আঙিনায় বারেবারে ঝাপটা বাতাসের মতো ফিরে আসছিল সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের এক টুকরো ছবিটা। ফিরে আসছিল সেই মুখ সেই স্পৰ্শ! 

ভেজা জামাকাপড় খুলে চেয়ারের ওপর মেলে দিয়েছে। ফ্যানের নিচে। তার গায়ে এখন শুধু একটা তোয়ালে জড়ানো। গোসলটা সেরে নেয়া দরকার। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করছে না। ভয় হচ্ছে বুঝি স্নানের জলের সাথে ধুয়ে মুছে যাবে সেই মানুষটার ছোঁয়া আর ভালোবাসা। একটু পরেই আসবে সে। অনেক অপেক্ষার পরে… অনেক বাধা পেরিয়ে… অনেক জ্বালা, অনেক অপমান… গ্লানি আর কলঙ্কের পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে আসবে তার মনের মানুষ তার কাছে। ভাবতে গিয়ে কুলকুল করে ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছিল বুকটা। নাহ, বিধাতা অমৃতার সাথে অতটাও অবিচার করেননি! বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ল সে। তিনকোণা টালির ছাদের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল। নিজের মনে হেসে উঠল কয়েকবার। আজকের দিনটা তার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে থাকবে। মনে থাকবে নিজের বাবা মা আর বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টটা। সেই সাথে মনে থাকবে প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাটা। বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। সে লন্ডন যাবে। ব্যারিস্টারি পড়বে। দেশে ফিরে এসে নামকরা উকিল হবে। অমৃতার অবশ্য ব্যারিস্টারি পড়ার ইচ্ছে কোনো কালেই ছিল না। ব্যারিস্টারির খরচ জোটানোও তো চাট্টিখানি কথা নয়। বাবাকে বলেছিল মাস্টার্স করবে। পৃথিবীর নামকরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাবা তাতেও সায় দিয়েছিলেন। বাবার কথা ভাবতে ভাবতে মনটা একটু ভারি হয়ে উঠছিল। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে। 

—‘হ্যালো!’ ফোন কানে নিয়ে একটু আলগাভাবে বলল অমৃতা। 

—‘তুই কোথায়?’ মায়ের ক্যাটক্যাটে প্রশ্নটা কানে বিঁধল সূচের মতো।

–‘আছি। বেঁচে আছি।’ 

—‘ফোন ধরছিলি না কেন? কতবার ফোন দিলাম!’ 

—‘খেয়াল করিনি।’ 

—‘এখন কোথায় তুই?’ 

অমৃতা চুপ করে রইল। 

—‘কথা বলছিস না কেন?’ 

—‘নিরাপদ স্থানেই আছি। তোমার চিন্তার কারণ নেই।’ 

—‘নিপা! তুই বাড়ি ফিরে আয়। এখুনি!’ 

—‘আমি বাড়ি ফিরলে তোমার পতিদেব যে আমাকে পুনরায় ঝাঁটা পেটা 

করে ঘরছাড়া করবেন না তার নিশ্চয়তা কী?’ 

—‘নিজের বাবার সম্পর্কে তোর এ কেমনতর কথাবার্তা, হ্যাঁ? বলি মাথাটা কি একেবারে গেছে? 

—‘ভুল কিছু তো বলিনি!’ 

—‘পাগলামো করিস না। তোরা বাবা মেয়ে দুজনেই পাগল। আমি পড়েছি সব পাগলের পাল্লায়। আমার দিকটা তো কেউ দেখে না। সবাই যার যার চিন্তায় মত্ত।’ 

—‘মা! আমার একটা উপকার করো প্লিজ! বাবাকে বলো ভুলেও যেন রাশেদকে ফোন না করে। আমি চাই না লোকটাকে কেউ অপমান করুক।’ 

—‘তোর বাবার যা ইচ্ছা তিনি তাই করবেন। আমার এখানে কিছু করার নাই। আর তুই বয়সে বড় একটা লোককে নাম ধরে ডাকছিস কেন? এত বেহায়া কেন তুই?’ 

—‘বাবাও তো তোমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়। তুমি তো বাবাকে নাম ধরে ডাকো।’ 

—‘ঘেন্না হচ্ছে তোর সাথে আমার কথা বলতে। ছিঃ এমন মেয়ে পেটে ধরেছিলাম আমি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ’ 

শব্দগুলো আওড়াতে আওড়াতে মা ফোন রেখে দিলেন। অমৃতা জানে মা এখন কাঁদবেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবেন। কথাটা হয়তো খুবই সত্য যে অমৃতার মতো বাজে একটা মেয়ের জন্ম দিয়ে মা অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছেন। সেই অন্যায়ের শাস্তিই পাচ্ছেন তিনি এখন। অমৃতাও কি চেয়েছিল এতটা বাজে হতে? এতটা ঘৃণিত হতে? চায়নি… এ পৃথিবীতে মানুষের চাওয়াগুলো যে আসলে অন্য কারো চাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষ এই সত্যটা বুঝেও না বোঝার ভান করে। সে ভুলে যায় জীবন নামের নাট্যমঞ্চে সে নিছক একজন অভিনেতা মাত্র। নির্দিষ্ট চরিত্রে আমৃত্যু অভিনয় করে যাওয়া ছাড়া এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার ভূমিকা নেই। ভাবতে ভাবতে অমৃতার একটু ঘুম ঘুম পেয়ে গেলো। ঘুমের মধ্যে কী সব স্বপ্ন দেখতে লাগল সে। ভাবছিল এক জিনিস আর স্বপ্নে এসে ধরা দিল সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। স্বপ্নে আসলো ভর দুপুরের কোর্ট রুম। কালো কোট পরিহিত ঘর্মাক্ত চেহারার গিজগিজ করা একগাদা উকিল। লোহার খাঁচার ওপারে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা রুক্ষ চেহারার অভিযুক্ত অপরাধী। তার নিজের কী যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। বোধহয় সাক্ষী সময় মতো আসেনি। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। খুব দুশ্চিন্তার মুহূর্ত। সময়মতো এক্সাম হলে পৌঁছুতে না পারলে যেরকম একটা অসহায় বোধ হয় অনেকটা সেরকম লাগছে এখন। কপালে জমে উঠছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সিনিয়র খিটখিট করে ভীষণ আপত্তিকর কিছু কথা শুনিয়ে দিচ্ছে তাকে। হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। কোর্টরুমের ঘর্মাক্ত ভাপ ওঠা, বুকচাপা ভিড় সরে গেলো চোখের সামনে থেকে। তার বদলে ভেসে উঠল থানচি রোডের সেই শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। কানে এসে লাগল দূরের বনের কোকিলের ডাক। কাছে খুব কাছে… প্রিয়দর্শন মানুষটা। উত্তেজনায় চোখ খুলে গেলো তার। বুক ধড়ফড় করছে। চট করে ঘড়িটা দেখে নিল। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। তিনি বলেছেন আসতে আসতে সন্ধে হবে। এতক্ষণ কী করবে অমৃতা বসে বসে? ল্যাপটপ সাথে থাকলে কিছু কাজ সেরে নেয়া যেত। কিন্তু সত্য বলতে এই মুহূর্তে তার কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চুপ বসে থেকে ওই রোদ তাতানো কমলা বিকেল দেখেই স্বস্তি পাচ্ছে সে। হঠাৎ সামির কথা মনে পড়ল। সামিকে সত্যটা বলতেই হবে। আজ নয় কাল। সবচেয়ে ভালো হবে অমৃতা যদি নিজ থেকেই সত্যটা বলে দেয়। সে চট করে সেলফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোনের নোটপ্যাড খুলে লেখা শুরু করল সামির উদ্দেশ্যে। লিখল খানিকটা। আবার কাটল। আবার লিখল এমনি করে কেটে গেলো একটি ঘণ্টা। লেখা শেষ হলে সে চিঠিটা সেভ করে রাখল ফোনে। একদিন ঠিকঠিক মেইল করে দেবে সামিকে। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *