বৃষ্টিমহল ৩.৮০

৮০

রোমেলা ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলের ওপর বসে হাতে গলায় লোশন মাখছিলেন। হক বেডরুমে ঢোকা মাত্রই তিনি কটাক্ষ করে বলে উঠলেন, ‘ছেলের বৌয়ের সাথে তো খাতির ভালোই জমেছে তোমার।’ 

আড়চোখে একবার স্ত্রীকে দেখলেন হক, ‘খারাপ কিছু তো দেখছি না এর মাঝে।’ 

রোমেলা টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোমর পর্যন্ত খোলা চুলগুলো দু হাত দিয়ে মুড়িয়ে হাত খোঁপা করতে করতে বললেন, ‘তোমার গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে?’ 

হক সাহেব জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারে বসলেন ‘আমি প্রচণ্ড টায়ার্ড। এখন এসব কথা বলতে ভালো লাগছে না।’ 

রোমেলা কয়েক পা এগিয়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘তুমি কি ভেবেছ তুমি না বললে আমি জানতে পারব না কখনো মেয়েটি কে? 

হক নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘কী করে জানবে?’ 

—‘যে কোনো উপায়ে জানব। আমাকে তুমি চেনো না।’ 

—‘আমি সত্যিই তোমাকে চিনি না!’ 

—‘আমাকে এভাবে ধোঁকা দেবার কোনো অধিকার তোমার নেই!’ রোমেলার কণ্ঠার রগ ফুলে উঠেছিল ক্রোধে। ফর্সা মুখ ধকধক করে জ্বলছিল তেজের হলকায়। 

—‘বাড়াবাড়ি করো না।’ 

রোমেলা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘মেয়েটা কে?’ 

—‘তোমার জানার সময় এখনো হয়নি। হয়তো কখনো হবেও না। শুধু শুধু কেন ঝামেলা করছ?’ 

—‘তুমি কি মনে করেছ সুলেমানের কাছ থেকে আমি কথা বের করতে পারব না?’ 

—‘না পারবে না।’ 

এতক্ষণের অবরুদ্ধ কান্নার অর্গল বুঝি খুলে গেলো এবার। রোমেলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘তোমরা পেয়েছ কী? আমার সংসারে যা ইচ্ছা তা করে যাবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব? হ্যাঁ? তুমি ইচ্ছে করে ষড়যন্ত্র এঁটে আমার অপছন্দের মেয়েকে ঘরের বৌ করে এনেছ। আমার জীবনের সুখ নষ্ট করাই তোমার মূল উদ্দেশ্য। এখন নিজে পছন্দ করে বসে আছ কোন শাকচুন্নিকে তা খোদা জানে! আমি কিছু বুঝি না মনে করেছ? তুমি চাও আমি যেন অশান্তিতে থাকি। আমাকে কষ্ট দিয়েই তোমার সুখ! 

—‘কাঁদছ কেন? এখানে কান্নাকাটির মতো তো কিছু হয়নি! 

—‘তুমি বলো মেয়েটা কে?’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন রোমেলা। 

—‘কেউ না!’ অস্ফুটে বললেন হক। 

রোমেলা কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলেন, ‘আমার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? এতই ফ্যালনা আমি?’ 

হক ইজি চেয়ারের মাথায় হেলান দিলেন। চোখ বুজলেন ক্লান্তভাবে। মূল্য! মূল্য তো অবশ্যই আছে! এই যে স্ত্রী পুত্র নিয়ে এত বছরের পুরোনো সংসার। এ সংসারের এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। অপর দিকে সেই মেয়েটার সাথে তাঁর মানসিক সংযোগ বা নির্ভরতাটুকুও এই সংসারের মতোই সত্য! এই দুটি সত্য একই সাথে, একই চিত্রপটে পাশাপাশি দুটি জ্যোতির্ময় বিন্দুর মতো অবস্থান করছে। ন্যায়পরায়ণতার পাল্লায় হয়তো সংসারটাই ভারি হবে, হওয়া উচিত। কিন্তু হৃদয়ের পাল্লায়? বুকের ভেতরের মানুষটা আজ মনের দাবিকেই গ্রহণ করার তাগাদা দিয়ে আসছে বারেবারে! অন্যায়! এ ভীষণ অন্যায়! তিনি জীবনভর নীতির কথা বলে এসেছেন। নিয়মবদ্ধ মার্জিত জীবন যাপন করে এসেছেন। এত কাল পরে এসে তাঁর মতো একজন মানুষকে কি এমন রীতি গর্হিত কাজ করা মানায়? বাবা বলতেন পরিশ্রম, সততা এবং কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা এই তিনটি গুণ মানুষের জীবনে সফলতা বয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। তিনি বাবার বলা কথাটা মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেছেন। সেই মোতাবেক কাজ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তিনি সফল। আসলেই কি সফল? সফলতা কাকে বলে? সার্থকতা কাকে বলে? আজ সুনাম, সম্মান, অর্থ সবই আছে। তবুও কেন বুকজোড়া এমন নেই নেই ভাব? কেন মনে হয় কী যেন হবার ছিল… হলো না। কী যেন পাওয়ার ছিল… পাওয়া গেলো না! 

অন্যায় ভীষণ অন্যায়! হুঁশিয়ারি দিয়ে ওঠে কে যেন। 

তিনি ভাবনার ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে আসলেন স্ত্রীর কাছে। রোমেলা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। তিনি রোমেলার মাথায় একটা হাত রেখে আলতো ভাবে বললেন, ‘তুমি মন খারাপ করো না। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। 

রোমেলা এক ঝটকায় হক সাহেবের হাতটা সরিয়ে দিলেন, ‘আমাকে ছুঁবে না তুমি খবরদার! ঘেন্না হয় তোমাকে আমার!’ 

হক কপাল কুঁচকে খানিকক্ষণ স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘ঘেন্না হয় কেন?’ 

—‘ঘেন্না হয় কারণ তুমি যা পেয়েছিলে তার মূল্যায়ন করতে পারোনি কখনো। আমাকে কখনোই তুমি মন থেকে ভালোবাসোনি।’ 

—‘তুমি বেসেছিলে?’ 

রোমেলা ভেজা দুটি চোখ বহু বছরের পুরোনো স্বামীর মুখের ওপর তুলে ধরলেন, ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘চেষ্টা করেছিলাম।’ 

—‘আমিও… চেষ্টা করেছিলাম।’ 

—‘আমাদের মধ্যে কি কখনো কিছুই ছিল না?’ 

—‘নিশ্চয়ই ছিল। যা ছিল, তা এখনো আছে!’ 

—‘যা ছিল বা যা আছে তার নাম কী?’ কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করেন রোমেলা। 

হক শূন্য চোখে চেয়ে থাকেন সম্মুখে। তার চোখ খোলা কিন্তু তিনি যেন কিছুই দেখছেন না। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর তিনি স্তিমিত গলায় বললেন, ‘অভ্যাস! তার নাম বোধহয় অভ্যাস!’ 

রোমেলার অশ্রুরুদ্ধ মুখে তখনও ক্রোধ এবং বিতৃষ্ণা খেলা করছিল। কথাটা শোনামাত্র তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন বসা থেকে। তড়িঘড়ি করে নিজের বালিশটা বগলদাবা করে নিয়ে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি। আজ থেকে আর তোমার সাথে এক ঘরে থাকব না।’ 

হক স্ত্রীকে বাধা দিলেন, ‘তুমি কেন যাবে? এটা তোমার ঘর। প্রয়োজনে আমিই চলে যাব।’ 

—‘বেশ তো, যাও তবে!’ 

হক সাহেব বিছানাপত্র কিছুই নিলেন না। খালি হাতে বেরিয়ে আসলেন ঘর থেকে। ঘরের দরজা বন্ধ করার আগমুহূর্তে স্ত্রীকে বললেন, ‘ওই সুটকেসে তোমার জিনিসগুলো আছে। দেখে নিও।’ 

রোমেলা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন মেঝের ওপর রাখা কালো রঙের সুটকেসটা। ঘরের দরজা বন্ধ হবার পর তিনি চোখের জল মুছে নিলেন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। উঠে এসে খুললেন সুটকেসটা। লিস্টে যা যা লিখে দিয়েছিলেন তার সব কিছুই এসেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। জিনিসগুলো সব সুটকেস থেকে বের করে কার্পেটের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন তিনি। ভ্যানিটি ব্যাগ, জুয়েলারি, হাতঘড়ি, কসমেটিক্স, শ্যাম্পু, সাবান, আর তার পছন্দের ব্র্যান্ডের পারফিউম। কসমেটিক্সগুলো সব বোনদেরই গিফট করবেন তিনি। মোবাইল হাতে নিয়ে ছবি তুললেন কয়েকটা। আর দেরি না করে বন্ধুবান্ধব আর বোনদের কাছে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিলেন। লোকটার এই এক গুণ আছে। রোমেলা জীবনে যা কিছু চেয়েছেন এর কাছে, সব পেয়েছেন। পাননি শুধু লোকটার মন! কিন্তু যা তিনি পান নি, তা অন্য কেউ পাবে কোন সাহসে? তাঁর ভ্রু দুটি চকিতে কুঞ্চিত হয়ে উঠল। মোবাইলের ডায়াল লিস্ট ঘেঁটে তিনি সুলেমানের নম্বরটা বের করলেন। রিং পড়তে থাকল। 

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন হক। নিচতলার সিঁড়ির গোড়ায় সদরের সামনে হঠাৎ তার সাথে দেখা! সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, পায়ে জুতো, কনুইয়ে ঝোলানো কালো কোট, কাঁধে ব্যাকপ্যাক। সেকেন্ড না গড়াতেই ঝুপ করে মনের মাঝে নেমে আসলো শান্তি। ফুৎকারে উড়ে গেলো এতক্ষণের বিষণ্ণতা, ক্লান্তি আর মানসিক দ্বন্দ্ব! হায়, যে পুরুষের অভ্যাস এক নারীর কাছে আর শান্তি অপর নারীর কাছে সেই পুরুষের জীবন নরকের চাইতে কোনো অংশে কম নয়! 

পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেলো। হৃদি, সামি আর রুদ্র সিঁড়ি ভেঙে নামছে নিচে। রুদ্রর বাস স্টেশনে যাবার সময় হয়ে এসেছে। হক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসলেন বাড়ি থেকে। আজ রাতটা হয়তো তিনি লাইব্রেরি রুমেই কাটাবেন। 

গভীর রাতে অমৃতা ইমেইল করল, 

দেখা হবে? 

ইমেইলের উত্তর সে রাতে আসলো না আর। রাতে ঘুমও হলো না ভালো। পরদিন কাজে বসল না মন। সন্ধ্যার দিকে চেনা নম্বরটা থেকে কল আসলো, 

—‘অমৃতা!’ 

—‘রাশেদ! কেমন আছেন?’ 

কোনো উত্তর নেই। দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কারো মুখে কথা নেই! একটা সময় রাশেদ বললেন, 

— ‘কাল বিকেলে কী করছ?’

—‘ফ্রি আছি।’ 

—‘বাসায় থাকবে?’ 

—‘আপনি বললেই থাকব!’ 

—‘শোনো, পাবলিক প্লেসে দেখা করাটা এ মুহূর্তে একেবারে সেইফ না। ঢাকার অদূরে আমার একটা গেস্টহাউজ আছে। তুমি কি ওখানে আসতে পারবে?’ 

—‘পারব!’ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল অমৃতা 

—‘ঠিক আছে। কাল বিকেলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবো তোমার বাসায়।’

—‘গাড়ি লাগবে না। আপনি ঠিকানা দিন, আমি চলে আসব।’

—‘পাকামো করো না। গাড়ি পাঠাব ঠিক পাঁচটায়। রাখছি এখন।’ 

‘ওকে। সি ইউ টুমরো!’ 

—‘সি ইউ টুমরো।’ 

৮১

ছাই রঙের টয়োটা গাড়িটা অমৃতাকে নিয়ে গাজীপুরের বাগানবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সাড়ে ছটা নাগাদ। তখনো শেষ বিকেলের সিঁদুর রং পশ্চিম আকাশ থেকে পুরোপুরি মেলায়নি। একটু একটু ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। গাড়ির জানালা দিয়ে অমৃতা বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তাটা দেখল। পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর। বেশ কিছু জংলা জায়গা। সাদা গেটের ওপর ঝুলে আছে গোলাপি রঙের লতানো বাগানবিলাস। সাদার ওপর গোলাপি রংটা বেশ ফুটেছে। দেখলে মনে হয় যেন কোনো উঁচুদরের শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি। একবার হর্ন দিতেই ভেতর থেকে গেট খুলে দিল দারোয়ান। 

টালির ছাদ দেওয়া ইট রঙের একটা দোচালা বাড়ি। বাড়ির সাথেই লাগোয়া গাড়ি বারান্দা। গেট থেকে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তাটির দুপাশ ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরাও করা। সন্ধ্যার ধূসর আলোতে ডুবে আছে বাগানে ফুটে থাকা টকটকে লাল গোলাপ। গোলাপের পাশে আছে গাঁদা, টিউলিপ আর অলকানন্দা ফুল। বাড়ির ঠিক পাশেই একটি বিরাট বড় রেইন ট্রি। ঝিরঝিরে বাতাসে রেইনট্রির পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে ঝরে, উড়ে উড়ে এসে পড়ছে লাল রঙের টালির ছাদের ওপর। এই বাড়িটি গেস্টহাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিদেশ থেকে বায়াররা আসলে এখানেই থাকে। আগে মাঝে মাঝে সামিদের পরিবার ছুটিছাটায় বেড়াতে আসত এখানে। আজকাল আর সেসব হয়ে ওঠে না। ভ্যাকেশনে এখন দূর দূরান্তেই যাওয়া হয় বেশির ভাগ সময়। অমৃতার বুক ঢিবঢিব করছিল। আনন্দ, ভয়, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এই সমস্ত অনুভূতির মিশ্রণে ভেতরটা কেমন অবশ প্ৰায় হয়ে আছে। যেন ঠিক জাগরণে নেই সে। একটা দুর্ভেদ্য, নিগূঢ় ঘোরে ডুবে আছে নিচ্ছিদ্রভাবে। 

গাড়ি থেকে নেমে আশপাশটা একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখল অমৃতা। তার পরনে আজ হালকা সবুজ রঙের একটা ফুল হাত ফতুয়া। ব্ল্যাক জিন্স। অল্পবয়সি ড্রাইভারটা মুগ্ধ চোখে দেখছিল তাকে। বয়স একুশ কি বাইশ বছর হবে। হ্যাংলা পাতলা গড়ন। ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফ। ছেলেটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে অমৃতার সামনে এসে দাঁড়ালো। পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, স্যার আপনাকে বাসার চাবি দিতে বলছে। স্যারের আসতে আসতে সাতটা বাজবে। আপনি ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করেন। 

অমৃতা হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিল। ছেলেটাকে এক নজর দেখল ভালো মতো। চোখ ভরা প্রশ্ন আর কৌতূহল। কেমন বোকা বোকা দৃষ্টি। একটু কেমন ভয় খেলে গেলো বুকে। এদের মারফতে যদি কথা ছড়িয়ে যায়? দেয়ালেরও যে কান আছে! 

চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অমৃতা ছোট করে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ চাবিটা হাতে নিয়ে দুই ধাপের সিঁড়ি ভেঙে পোর্চ এ উঠে আসলো সে। দরজার বাইরে একটি সুন্দর জিনিসে চোখ আটকে গেলো। আকাশি রঙের একটি সিরামিকের তৈরি জুতো। জুতোর মাথায় বসে আছে সবুজ রঙের ছোট্ট সিরামিকের ব্যাঙ। জুতোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে কয়েকটা মানিপ্ল্যান্টের লতা। তার পাশেই একটা মাটির টবে বটগাছের বনসাই। কারুকার্য করা বাদামি রঙের কাঠের দরজার ওপর একটা নেমপ্লেট ঝোলানো, তাতে ইংরেজিতে বড় করে লেখা ‘রাশেদুল হক ‘ 

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মাঝারি আকারের ড্রইংরুম। জানালার পর্দা টানানো বলে ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার আর ভ্যাপসা হয়ে আছে। অমৃতা প্রথমেই জানালার পর্দা সরালো। তুলে দিল কাচ। এক ঝলক বিশুদ্ধ বাতাস ছুঁয়ে দিল তাকে। জানালার একদম ধার ঘেঁষেই গোলাপ গাছ। চার পাঁচটা টুকটুকে লাল গোলাপ মাথা উঁচিয়ে সন্ধ্যার বাতাসে দোল খাচ্ছে ধীর লয়ে। দেখলেই মনটা পবিত্র হয়ে যায়। ঘরের ভেতর দু সেট লাল গদির কাউচ। একটা রেক্সিনের সাদা ফুটন। কাচের টেবিল। টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিটানো দেশ বিদেশের নামকরা ম্যাগাজিন আর একটা সিগারেটের ছাই সহ ছাইদানি। অমৃতা হেঁটে পাশের ঘরে আসলো। ডাইনিং স্পেসের সাথেই রান্নাঘর। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল সব পরিপাটি এবং পরিচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে বেশ অনেক দিন যাবৎ এই রান্নাঘর ব্যাবহার করা হয়নি। লম্বা ডাইনিং টেবিলের ওপর একটা চকচকে কাচের জগ আর দুটো গ্লাস। ফলের ঝুড়িতে কয়েকটা আপেল আর কমলা রাখা। ডাইনিং এর পাশ ঘেঁষেই একটা ছোট্ট করিডোর। করিডোর থেকে ডালপালা গজানোর মতো করে চারদিকে চলে গেছে চারটা তিন কদমের রাস্তা। তিন রাস্তা গিয়ে মিশেছে তিনটি বন্ধ ঘরের দরজার সাথে। চতুর্থ পথটি দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে অমৃতা একটি রোগা সিঁড়ি দেখতে পেল। উপরে উঠে আসলো সে নিঃশব্দে। সিঁড়ির মুখেই একটি কাঠের দরজা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো পরিষ্কার সাদা রঙের চাদর পাতা বিছানা, ড্রেসিং টেবিল আর ওয়ার্ডোব। দেয়ালে একটি চতুষ্কোণ জানালা। টালির চালের ফাঁক গেলে গোধূলির হলদে আলোর রেখা তেরছা হয়ে এসে পড়েছে বিছানার চাদর, বালিশ আর মেঝেতে পাতা লাল কার্পেটের ওপর। ঘরটা দেখামাত্র পছন্দ হয়ে গেলো অমৃতার 

কিছুক্ষণ খালি পায়ে কার্পেটের ওপর পায়চারি করে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো সে। এই ঘরের সিলিং খুব নিচু। হাত উঁচু করলেই টালির তিনকোণা ছাদটা ছোঁয়া যায়। জানালা খুলে দিল। মিষ্টি একটা সুবাস নাকে এসে লাগল। কোনো ফুলের ঘ্রাণ হবে। কী ফুল, কোথায় তার বাস কে জানে! রেইন ট্রির ডালে ডালে হরেক পাখির মাতামাতি এখন। খুব হইচই করে বাড়ি ফিরছে তারা। ওপর থেকে নিচের উঠোনটা দেখা যাচ্ছে। গেটের পাশে মধ্যবয়স্ক দারোয়ান লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে টুলের ওপর বসে আছে গোমড়া মুখে। হাত দিয়ে গামছা নেড়ে নেড়ে মশা তাড়াচ্ছে। আপাতত পাখির কোলাহল ছাড়া আশেপাশে আর কোনো শব্দ নেই। যন্ত্রচালিত রাজধানীর কাছেই যে এমন নিবিড় ছায়াঘেরা সবুজ জায়গা থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গেটের কাছে কেউ একজন এসেছেন। একজন ভদ্রলোক। মাথায় টাক। শার্টের বোতাম ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে পেটের বিলাসী ভুঁড়ি। কোথায় যেন দেখেছে অমৃতা লোকটাকে। ভদ্রলোক গেট ধাক্কালেন কয়েকবার। দারোয়ান বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেটের ছোট খিড়কিটা খুলে মাথা বের করল। সেই সময় টেকো লোকটা হঠাৎ কী মনে করে যেন মাথা উঁচু করে ওপরে তাকালো একবার। তাকাতেই জানালার খোপ টপকে ঝুলে থাকা অমৃতার মুখটা দেখতে পেল সে। বিদ্যুতের মতো একটা চমক খেলে গেলো অমৃতার মেরুদণ্ডে। এই যা! এটা তো মহসিন আংকেল। আগে ওদের অ্যাপার্টমেন্টে প্লামারের কাজ করত। বাবার সাথে এখনো নিয়মিত যোগাযোগ হয় ফোনে। চট করে সরে আসলো সে জানালা থেকে। দেখে ফেলল কি? চিনে ফেলল কি? হায় হায়! এই একলা বাড়িতে অমৃতাকে দেখে কী ভাববে লোকটা? আর রাশেদের সাথেই বা ইনার কাজ কী? আংকেল যদি বাবাকে কিছু বলে দেয়? আসবার সময় মাকে বলে এসেছে রাতে ফিরতে দেরি হবে। বলেছে খুব বেশি রাত হলে হৃদির বাসায় থেকে যেতে পারে। এ বিষয়ে তাকে আরো একটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। সে বলেছে হৃদি এখন তার বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে। মা চাইছেন সামিদের বাসায় যেন অমৃতার যাতায়াতটা কমে যায়। চাইছেন সঙ্গত কারণেই। অমৃতা তা বোঝে। আসলে বোঝে মস্তিষ্ক, মন বোঝে না। মহসিন আংকেলকে দেখে তার হাসিখুশি মনটা হঠাৎ কেমন একটু বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। এলোমেলো নানা কথা মনে আসছিল থেকে থেকে। ভাবতে ভাবতে দুর্ভাবনার গাঁজলা উঠছিল বুকের ভেতর। আকাশ থেকে সন্ধ্যার শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলে দিনমণি তখন হারিয়ে গেছে পৃথিবীর অন্য পাশে। গোধূলির হলুদ রং হটে গেছে। ঘরের ভেতর এখন জায়গা করে নিয়েছে রাত্রির অন্ধকার। হঠাৎ গাড়ির হর্ন শোনা গেলো। তারপর গেট খোলার ঘড়ঘড় শব্দ। দৌড়ে এসে জানালায় দাঁড়ালো সে। দেখতে পেলো গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পাজেরো গাড়িটা। 

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে সে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো হাতের আঁচড় দিয়ে পাট করে নিল। তারপর বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। পা চলছে না, নিশ্বাসেও কষ্ট! তবুও যে কী ভীষণ বাঁধছেড়া এক অনাবিল হর্ষে দাপাদাপি করছে ভেতরটা! সদর দরজা একটু ফাঁক করে দাঁড়ালো অমৃতা। বাগানে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখল গাড়ি থেকে নামছেন তিনি। পরনে একদম হালকা নীল রঙের একটা ফরমাল শার্ট। গলায় কালো টাই। কালো প্যান্ট। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ দরজাটা উল্টো পাশ থেকে খুলে গেলো। তারপর দুজনে মুখোমুখি ল্যাম্পশেডের হলুদ আলোর ভেতরে। কয়েকটা অস্বস্তির মুহূর্ত কাটলো। কেউ কোনো কথা বলল না। একটু শুধু মুচকি হাসলেন রাশেদ অমৃতার দিকে চেয়ে। 

ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে তিনি ফুটনের ওপর বসলেন। অমৃতা তাঁর কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। হাতদুটো পেছনে আর শরীর ঈষৎ বাঁকা। মুহূর্তে বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হচ্ছে দাঁড়ানোর ভঙ্গি। বোঝা যাচ্ছে সে বেশ নার্ভাস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কিছু একটা বলা দরকার এখুনি। কিন্তু কী বলবে? ইশ অমৃতা এত আনস্মার্ট হলো কবে থেকে? 

—‘কী খাবে রাতে?’ ঝুঁকে বসে হয়ে জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে প্রথম কথা বললেন তিনি। 

অমৃতাকে একটু চিন্তিত দেখালো, ‘খাবার… রান্না করতে হবে?’

—‘রান্না করতে পারো তুমি?’ 

—‘চিকেন বিরিয়ানি রান্না করতে পারি।’ 

—‘তাই?’ প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন রাশেদ। 

—‘আমার চিকেন বিরিয়ানি খুবই মজা হয়।’ জোর গলায় বলল অমৃতা।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাশেদ খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘তাহলে আর কী, রান্না করে ফেলো!’ 

—‘আসলেই? ইনগ্রিডিয়েন্স আছে সব?’ অমৃতাকে বেশ প্রফুল্ল দেখালো। 

—‘ডোন্ট নো!’ মানুষটার দু ঠোঁটের প্রান্তিক কোণে একটি লঘু হাসির রেশ। সেই রেশ খানিকটা মেখে আছে গভীর চোখের তারায়। হাসিটা একটু কেমন নতুন বলে ঠেকলো অমৃতার কাছে। ঠিক এই হাসি অমৃতা ইনার মুখে এর আগে কিন্তু কখনো দেখেনি! আজকের রাশেদ যেন অনেক বেশি আন্তরিক আর ঘরোয়া। ভালো লাগছিল অমৃতার। একটু বেশিই ভালো লাগছিল। তাই অরুণ রঙা খুশিতে একদম থৈথৈ হয়ে গিয়েছিল মুখ। রাশেদ ড্রইংরুম ছেড়ে বেরোবার মুখে থমকে দাঁড়ালেন হঠাৎ। ভ্রু কুঁচকে অমৃতার চোখে চেয়ে বললেন, ‘হাসছ কেন?’ 

অমৃতা অনেক কষ্টে মুখের হাসি হাসি ভাবটা লুকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কই? হাসছি না তো! আপনি হাসছেন কেন?’ 

—‘আমি হাসছি নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ হাসছেন তো!’ 

রাশেদ ঠোঁট টিপে একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বললেন, ‘ও, তাহলে বোধহয় তোমাকে হাসতে দেখে হাসছি।’ 

—‘আমি হাসলেই আপনি হাসবেন?’ 

—‘হাসি ছোঁয়াচে, তুমি জানো না?’ 

সদর দরজায় একটা টোকা পড়ল। রাশেদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। ড্রাইভার ছোকরাটা হাতে করে একটা প্যাকেট নিয়ে এসেছে। রাশেদ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিলেন। দরজাটা অল্প একটু খোলা রেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে অমৃতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘বললে না কী খাবে? এদিকে অবশ্য তেমন ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই।’ 

—‘বিরিয়ানি রান্না করব না?’ 

—‘আজ সময় হবে কি? এখনই সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। তোমার ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘তুমি চিকেন বিরিয়ানি খেতে চাইলে আমি আনিয়ে দিচ্ছি।’ 

অমৃতা আর কিছু বলল না। হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ল শুধু একবার। ড্রাইভারকে খাবারের কথা বলে নিয়ে তিনি দরজাটা বন্ধ করলেন। হাতে ধরা প্যাকেটটা অমৃতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার।’ 

—‘থ্যাংক ইউ!’ একটু অপ্রতিভভাবে বলল অমৃতা। রাশেদ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর সে কাউচের ওপর বসে প্যাকেটটা খুলল। উপহার পেতে কার না ভালো লাগে? আর সেই উপহার যদি হয় কোনো বিশেষ মানুষের কাছ থেকে তাহলে তো আর কথাই নেই। প্যাকেট খুলতেই চেরি পিংক রঙের একটা সিল্ক কাপড়ের জামা বেরিয়ে আসলো। অমৃতা মুখের সামনে মেলে ধরল জামাটা। হাতে আর কোমরে কুচি। ঘেরটা আঁকাবাকা হয়ে একটু উপরের দিকে উঠে গেছে। পেছনের ঘেরটা অপেক্ষাকৃত লম্বা সামনেরটার চেয়ে। অমৃতার ঠোঁটে মিটমিটে হাসিটা ফিরে আসলো। প্যান্ট শার্ট পরা টমবয় মেয়েটাকে কিনা এখন এই ফ্যাশনেবল জামা পরতে হবে? কত্তদিন পর মেয়েদের জামা পরবে সে! অন্তর থেকে যে নারী সত্তাটাকে অনেক বছর আগে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিল আজ সেই নারীসত্তাকেই পুনরায় হেসে খেলে বরণ করে নিতে যাচ্ছে। উঠে পড়ল জামা হাতে নিয়ে। পা বাড়ানোর আগ মুহূর্তে কাউচের ওপর রাখা সাদা প্যাকেটটার দিকে নজর পড়ল একবার। কী ওটা? ছোট্ট একটা জিনিস উঁকি দিয়ে আছে প্যাকেটের ভেতর থেকে। ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা হাতে নিল। জুয়েলারি বক্স। সীমাহীন কৌতূহল নিয়ে খুলল বাক্সটা। হোয়াইট গোল্ডের একটা চেইন। চেইনের সাথে ইংরেজি ‘এ’ অক্ষরের ছোট্ট লকেট। সোনাদানা, হীরে মুক্তো কিংবা গয়নাগাটি অমৃতাকে কখনোই সুখ দেয় না। এখনো দিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সুখের এক তীব্র শিহরণ ছুঁয়ে গেলো সম্পূর্ণ অন্য কারণে। চোখের সামনে সে স্বর্ণ দেখতে পাচ্ছে না বরং দেখতে পাচ্ছে ভালোবাসা! যে ভালোবাসা অনেক দূর থেকে ছোট্ট একটা বাক্সে বন্দি হয়ে, সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে তার কাছে এসেছে। হৃদয়টা কুলকুল করে ভরে উঠল আনন্দে। চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল জল। মনের ডানায় ভর দিয়ে উড়ে উড়ে চিলেকোঠার ঘরটায় ফিরে আসলো। দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। কিছুক্ষণ গ্লাসের ভেতরে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকল অপলক। তারপর পরনের ফতুয়াটা খুলে ফেলল একটানে। চেরি পিংক রঙের জামাটা যেন ওর মাপেই তৈরি। শুধু ভি শেপের গলাটা একটু বড়। এটা ছাড়া পুরো জামাতে আর কোনো ত্রুটি নেই। বড় গলাটা একটু অস্বস্তিতে ফেলল তাকে। জামা পরা হয়ে গেলে জুয়েলারি বক্সটা হাতে তুলে নিল সে। ঠিক সেই সময় নিচতলা থেকে হঠাৎ ডাক ভেসে আসলো, 

—‘অমৃতা!’ 

ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে আসলো অমৃতা ঘর থেকে। 

৮২

বিকেলের দিকে হৃদি গিয়েছিল পার্লারে স্পা করতে। বাড়ি ফিরে বৌকে দেখতে না পেয়ে সামির মেজাজটা বিগড়ে গেলো হালকা। তবে আজ মা আছেন বাড়িতে। এটা ব্যতিক্রম। সাধারণত মাকে এই বিকেল সন্ধের সময়টাতে বাড়িতে পাওয়া যায় না। মা ডাইনিং রুমে বসে মোবাইলে কথা বলছিলেন কারো সাথে। সামি অফিসের জামা কাপড় না পাল্টেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। মায়ের দুই ভ্রুর মাঝখানের আধ ইঞ্চি কুঞ্চিত চামড়াটা তার নজর এড়াল না। দেয়ালে লাগানো ঘড়িটা দেখল একবার সে। সন্ধে সাতটা বাজে। বাবা অফিস থেকে বেরিয়েছেন ঘণ্টাখানেক আগে। বাড়ি এখনো ফেরেননি। হয়তো অন্য কোনো কাজে আটকে গেছেন। 

রোমেলা কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিয়ে ছেলেকে বললেন, ‘কেমন আছ বাবা?’ 

—‘এইতো। তোমার কী হয়েছে? 

রোমেলা মুখের ভাব পাল্টানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘কিছু না।’

সামি চোখ সরু করে তাকালো মায়ের দিকে, ‘কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।’ 

—‘তোমার বাবা কোথায়?’ 

সামি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আমি তো জানি না! ত 

এই ফাঁকে কাজের মেয়ে এসে সামিকে প্রশ্ন করল, ‘স্যার চা/ কফি কিছু দিব আপনাকে? 

সামি মাথা নেড়ে না করল। রোমেলা একটু শুকনো মুখে বললেন, ‘শোনো, আমাদের যে কেয়ারটেকার আছে না? সুলেমান?’ 

—‘হ্যাঁ কী হয়েছে তার?’ 

—‘সে অসুস্থ।’ 

—‘হঠাৎ কী হলো?’ 

রোমেলাকে এ প্রশ্নে একটু বিচলিত দেখালো। ছেলের চোখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তিনি যতটা সম্ভব সহজভাবে বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না।’ 

সামি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘অবস্থা কি বেশি খারাপ? গত একমাস তো আমি উনাকে দেখিনি এ বাড়িতে। এক মাস ধরেই কি অসুস্থ?’ 

—‘মনে হয়।’ 

—‘তুমি চিন্তা করো না। আমি বাবার সাথে কথা বলছি। 

কথাটা বলে সামি নিজের সেলফোনটা হাতে নিল। আড়চোখে তাকালো মায়ের দিকে। মায়ের মুখটা একটু কেমন শুকনো দেখাচ্ছে আজ। চোখের নিচে কালি। মনে হচ্ছে কোনো গভীর দুশ্চিন্তায় পেয়েছে তাকে। 

—‘চিন্তা করো না। সুলেমান কাকা ঠিক হয়ে যাবেন।’ আরো একবার সান্ত্বনা দিল সে মাকে। 

—‘বাবা শোনো। তোমার সাথে আমার একটা কথা আছে।’

এ কথা শুনে সামি সেলফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে ডান কনুই ঠেস দিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। হাতের তালুতে নিজের গাল বসিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ শুনছি। বলো।’ 

রোমেলা নিজের ছেলের সুকুমার মুখটার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকলেন। জীবনে তিনি এই একজনকেই হৃদয়ের সমস্তটা দিয়ে ভালোবেসেছেন। জগতে এই একটা মুখের দিকে তাকালেই তার মন নরম হয়ে আসে। দৃষ্টিজুড়ে শীতলতা নামে। প্রাণ জুড়োয়। তার একটা মাত্ৰ ছেলে। একটা মাত্র মানিক রত্ন। এই একটা রত্নকে তিনি কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চান না। কিন্তু ওই লোকটাকে শাস্তি দেবার জন্য হলেও প্রাণের অধিক প্রিয় সন্তানকে আজ কট্টর সত্যের মুখোমুখি করতে হবে। ওই লোকটা তলে তলে কুকর্ম করে যাবে আর পুত্রের চোখে দেবতা সেজে বসে থাকবে তা কিছুতেই হবে না! 

বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রোমেলা বললেন, ‘তোমার বাবা…’ 

—‘কী হয়েছে বাবার? 

—‘তোমার বাবার জীবনে অন্য কেউ আছে।’ 

গাছের পাতার ওপর থেকে রোদ সরে যাবার মতো করে সামির মুখের রক্ত সরে গেলো। খরখরে এক ঠান্ডা স্পর্শে শিরশির করে কেঁপে উঠল তার অন্তরাত্মা। 

—‘মানে?’ 

রোমেলা ছেলের চোখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। 

—‘মানে তুমি বোঝো না? তুমি তো বড় হয়েছ। তোমাকে কি বানান করে বুঝিয়ে দিতে হবে?’ 

সামির চোখে প্রচণ্ড অবিশ্বাস খেলছে। পাণ্ডুরমুখে চেয়ে আছে সে মায়ের দিকে। বেশ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলো স্তব্ধতায়। 

—‘বিশ্বাস করি না!’ হঠাৎ শব্দগুলো উচ্চারণ করল সামি দৃঢ় গলায়।

—‘তোমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে আমি জানি। আমারও কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তোমার বাবা নিজের মুখে আমাকে বলেছে।’ 

—‘কী বলেছে?’ 

—‘বলেছে যে তার অন্য কারো জন্য ফিলিংস আছে।’ 

সামির শ্বাসনালিতে আটকে গেছে নিশ্বাস। পথহারা নাবিকের মতো উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। 

—‘তোমাকে এ কথা বাবা বলেছে?’ ফাঁপা বাঁশের মতো আওয়াজ বের হলো সামির গলা দিয়ে। 

—‘হ্যাঁ বলেছে।’ 

—‘কে সেই ব্যক্তি?’ 

—‘সেটাই তো জানি না। জানার কোনো পথ নেই!’ একটু থেমে রোমেলা ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খাদে নামানো গলায় বললেন, ‘এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই আমার। তোমার বাবা লোকটা ধুরন্ধর চালাক। খুব সহজে ধরা দেবে না। কোথাও কোনো প্রমাণ রাখেনি।’ 

সামি বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী বলছে মা এসব? মায়ের বলা প্রতিটা কথা পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে… গোটা দুনিয়া মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে…! বাবার মুখটা ভেসে উঠল সামনে। এই মানুষটা শুধু তার বাবাই নয়, বরং গর্ব, নির্ভরতা এবং আশ্রয়। বাবা এমনটা করতেই পারে না। কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। বড়সড় ভুল হচ্ছে! 

—‘তুমি ভুল করছ মা।’

রোমেলা অধৈর্য গলায় বললেন, ‘তোমার বাবা নিজ মুখে বলেছেন আমাকে।’ 

নিজের বাবা মাকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই বুকের কোণে একটা জমজমাট অহংকার ছিল সামির। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করত তার বাবা মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা মা। আর বাবা তো তার কাছে সুপার হিরো! যে সব পারে। যার কাছে চাওয়া মাত্র সব কিছু পাওয়া যায়। কাঁপা হাতে সে সেলফোনটা তুলে নিল। ডায়াল করল বাবার নম্বরে। রিং পড়ল টানা অনেকক্ষণ। উত্তর আসলো না। মায়ের বলা কথাগুলো যদি সত্য হয়… যদি সত্য হয় তাহলে… কী করবে সামি? কী করবে? কী করা উচিত? না, ছেড়ে দেবে না। কিছুতেই ছেড়ে দেবে না সে! তার মাকে কষ্ট দেবার মতো দুঃসাহস যদি কেউ করে থাকে, তো সামি তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে। হোক না সে তার নিজের বাবা! 

কে হতে পারে এই তৃতীয় ব্যক্তি? সামি চোখ বন্ধ করে খুব দ্রুত চিন্তা করতে থাকল। বাবার সাথে কাজের সুবাদে অনেক মহিলাকেই প্রায় সময় দেখেছে সে। কিন্তু কখনো অন্যরকম কিছু চোখে পড়েনি তো! মস্তিষ্কে পোকার মতো কিলবিল করে উঠল নানা রকম চিন্তা। সে খুব ভালো মতোই জানে যে তার বাবা শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত, যশস্বী এবং খ্যাতিমান একজনই নন, সেই সাথে সুদর্শন এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বলতে নেই, এ নিয়ে তার মনের মধ্যে সুপ্ত একটা গর্বও ছিল আজীবন। ছোটবেলা থেকে সে লোকমুখে বাবার প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত। মা নিঃসন্দেহে সুন্দরী। তবে বাবার গুণ এবং প্রতিভার কাছে মায়ের রূপ সর্বদাই বড় বেশি ম্লান এবং নিভন্ত। কিন্তু তাই বলে মায়ের প্রতি বাবাকে কখনো উদাসীন বলে মনে হয়নি তো তার! মা সবসময় যা চেয়েছেন বাবা তা দিয়েছেন। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী এই বিশেষ দিনগুলোও বাবা কখনো ভুলে যান না। সামি ভুলে গিয়েছে সময়ে অসময়ে। কিন্তু বাবা ভুলেননি। বরং মাকেই মাঝে মাঝে একটু কেমন উদাসীন মনে হয়েছে সামির কাছে। মনে হয়েছে বাবা মায়ের প্রতি যতটা দায়িত্বশীল এবং যত্নবান, মা বাবার প্রতি ঠিক ততটা না। বাবার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে মা কখনোই তেমন একটা মাথা ঘামান না। তবে এতে মায়ের দোষ খুব একটা খুঁজে পায় না সামি। তার মা একটু সহজ সরল, বোকাসোকা। বাবা তো মায়ের এই বোকাসোকা ভাবটাকে মেনে নিয়েই ভালোবেসেছিলেন, নাকি? 

হৃদি ফিরে এসেছে তখন। ডাইনিংরুমে শাশুড়ি আর স্বামীকে বিদ্ধস্ত এবং বিচলিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে সে চমকে উঠল। 

—‘কী হয়েছে?’ 

সামি রক্তশূন্য মুখে একবার তাকালো হৃদির দিকে। কিছু বলল না। 

রোমেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা শেয়ার করতে পেরে তাঁর মন থেকে ভার কিছুটা নেমেছে। কিন্তু সুলেমানের বিষয়টা নিয়ে তিনি এখনো বেশ চিন্তিত। সুলেমানকে একটু ভয় ভীতি দেখিয়ে কথা বের করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কয়েকজন ভাড়া করা মাস্তানকে। রোমেলার আপন মামা বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গুন্ডাগুলো একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সুলেমান বয়স্ক লোক। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে বেচারার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্নও আছে। সুলেমানের পরিবার এর মাঝেই পুলিশে রিপোর্ট করেছে। ঘটনা ঘটেছে আজ বিকেলে। হার্ট অ্যাটাক করার পর গুন্ডারাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। খুব সম্ভবত হক সাহেবের কানে খবরটা এখনো পৌঁছয়নি। পৌঁছুলে এর পেছনে যে রোমেলার হাত আছে তা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হবে না তাঁর। হসপিটালে গুন্ডারা এখনও অপেক্ষা করছে। সুলেমানের জ্ঞান ফিরলেই তাকে শাসানো হবে যেন ঘুণাক্ষরেও কারো কাছে রোমেলার নাম প্রকাশ না করে। কিন্তু জ্ঞান আদৌ ফিরবে কি? বড়ই দুশ্চিন্তার বিষয়।

৮৩

বেডরুমের দরজার সামনে রাশেদ দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টেছেন তিনি। গায়ে এখন সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা। এই করিডোর থেকে রোগা সিঁড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। পায়ের শব্দ শুনে তিনি ওপরে মুখ তুলে তাকালেন। টিউবলাইটের সাদা আলোর ভেতর দিয়ে অমৃতা তখন এক পা দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল। তার পরনে চেরিফুল রঙের জামা। জামার কুচিটা ভারি সুন্দরভাবে বসে আছে তার সর্পিল ছিপছিপে কোমরখানিতে। পেছনের ঘেরযুক্ত অংশ গড়াচ্ছে সিঁড়িতে। সম্মুখে তার ফর্সা খালি দুটি পা… সুন্দর… পবিত্র… আর নিটোল! পরী কখনো তিনি সামনাসামনি দেখেননি। এত দেশ বিদেশ ঘুরে, এত মানুষের সাথে মিলেমিশে, অবশেষে মাতৃভূমিতে এসে নিজ বাড়িতে সত্যিকারের পরী দর্শন হলো তাঁর। হঠাৎ করেই চোখ পড়ল। ওর ফর্সা চামড়ার কণ্ঠাস্থিতে একটা কালো তিল। চুম্বকের মতো টানছে যেন ছোট্ট বিন্দুটা গোটা জল স্থল অন্তরীক্ষকে একযোগে! ‘সুন্দর!’ শুধু এই একটা শব্দই মাথায় এলো সেই মুহূর্তে। 

—‘বলুন।’ এক হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে অমৃতা। হাতে ধরা জুয়েলারি বক্স। চোখে হাসির ঝিলিক। ঈষৎ বাঁকা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ওর ছিপছিপে আশ্চর্য সুন্দর কায়াখানি যেন ভাস্কর্যের এক অভীষ্ট সিদ্ধি। 

রাশেদ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটিতে একটু বিচলিত ভাব। কীসের যেন অস্থিরতা। 

—‘আমাকে কেমন লাগছে?’ অমৃতার সহাস্য প্রশ্ন। 

একবার ঢোক গিললেন রাশেদ। চোখ সরিয়ে কিয়ৎ অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘খাবার এসে গেছে। খেয়ে নাও।’ 

কেমন লাগে মেজাজটা? যেন অমৃতা এখানে খেতে এসেছে! এমন বেরসিকও হয় নাকি মানুষ? অমৃতা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আপনি খেয়ে নিন আমি খাব না। খিদে নেই।’ কথাটা বলে সে টাইলসের মেঝেতে সুন্দর ফর্সা নগ্ন পা দুখানি ফেলে এগিয়ে গেলো সামনে। ড্রইংরুমের কাউচে এসে বসল। তার পুতুল চোখে এখন বিরক্তির ছাপ। ঠোঁটে হতাশা। এই লোকটা ইগো ছাড়া কিছুই বোঝে না ছাই! বিরক্ত লাগে ঢং দেখলে! গজগজ করতে লাগল নিজের মনে মনে। 

—‘কী বলছ?’ প্রশ্নটা উড়ে এলো হঠাৎ। মানুষটা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে কীসের একটা কাগজ নিয়ে। অমৃতা চোখ না তুলেই বলল, ‘কিছু না!’ 

—‘এটা দেখো।’ ‘হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা কাগজটা দিলেন তিনি অমৃতাকে। 

হাতের জুয়েলারি বক্স কাউচের ওপর রেখে কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে কাগজটা হাতে নিল অমৃতা, ‘কী এটা?’ 

ভাঁজ খুলে দেখল এ ফোর সাইজের কাগজের মাথায় এক যুবকের ছবি আটকানো। 

—‘এটা কার রেজ্যুমে?’ 

রাশেদ অমৃতার মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘বায়োডাটা।’

—‘এটা দিয়ে আমি কী করব?’ বিরক্তিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তখন অমৃতার গলার স্বর। 

—‘ভাবছি তোমাকে একটা বিয়ে দেবো।’ সোফায় হেলান দিতে দিতে আয়েশ করে বললেন তিনি। ম্যাচের কাঠির মতো ভস করে জ্বলে উঠল অমৃতা। 

—‘কী?’ ঘরের ভেতর যেন বোমা বর্ষণ হলো অকস্মাৎ। 

—‘তোমার বন্ধুদের সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এবার তোমারও তো এ ব্যাপারে কিছু ভাবা দরকার তাই না? এই ছেলেটা ব্যারিস্টার। তোমার ফিল্ডেরই। গুলশানে নিজের চেম্বার আছে। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো।’ 

অমৃতা আক্রোশে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সামনে বসা মানুষটাকে একদম আঁচড়ে কামড়ে দিতে মন চাইছিল তার হিংস্র জন্তুর মতো। 

—‘ফাজলামো করছেন?’ 

রাশেদের মুখে একটা ছায়া পড়ল। 

—‘ফাজলামো মনে হচ্ছে তোমার কাছে?’ 

—‘তা নয়তো কী? আপনার কি আমাকে বিশ্বাস হয় না? আমি কি চিঠিতে আপনাকে বলিনি যে আমার পক্ষে অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না?’ 

রাশেদ কুঞ্চিত কপাল নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন অমৃতার দিকে।

—‘তোমাকে বিশ্বাস করেছি অমৃতা। আর বিশ্বাস করেছি বলেই আমার মনে হচ্ছে ইউ শ্যুড মুভ অন এ এস এ পি। 

—‘এতই সোজা?’ 

—‘চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?’ 

অমৃতা হাতে ধরে থাকা কাগজটা প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে দুমড়ে মুচড়ে ফেলল একদম। ফুঁসে উঠে বলল, 

—‘আপনি এজন্যে ডেকেছেন আমাকে?’ 

রাশেদ একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন, ‘এরকম করছ কেন? এত ছেলেমানুষ হলে হয়?’ 

—‘আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবেন না। বললে খুব খারাপ হবে! 

রাশেদ কী যেন একটা বলতে গিয়েও বললেন না আবার। চুপ করে গেলেন। কয়েকটা মুহূর্ত শব্দহীনভাবে কাটালো। ল্যাম্পশেডের হলদে নিষ্প্রভ আলোয় অমৃতা কটমটে চোখে তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। জানালা দিয়ে একটা মিহি বাতাস ভেসে আসছিল। তিরতির করে কাঁপছিল ঝুলে থাকা পর্দা। কাউচে হেলান দিয়ে বসে, পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে চুপচাপ অমৃতাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন রাশেদ। এই মুহূর্তে পেশাগত বা সাংসারিক জীবনের কোনো চিন্তাই খেলছে না মাথায়। একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি সমগ্র চৈতন্যকে বশীভূত করে রেখেছে। মেয়েটির উপস্থিতি তাঁর কর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের ওপর জমে থাকা সমস্ত ক্লান্তি, হতাশা এবং একঘেয়েমিগুলো যেন ঝাড়ন দিয়ে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়। 

খানিক বাদে অমৃতার রাগ মোমের মতো গলে গেলো একেবারে। এখন কি রাগ করে থাকার সময়? এখন এই একলা নির্জন ঘর আর চোখের সামনে তার জীবনের একমাত্র আরাধ্য পুরুষ! সে তার সারা জীবনের বিনিময়ে আজকের এই মুহূর্তটিকে কিনে নিতে রাজি আছে। জুয়েলারি বক্সটা হাতে ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অমৃতা। হঠাৎ! 

—‘এটা আমাকে পরিয়ে দেবেন প্লিজ?’ 

কয়েক সেকেন্ড অমৃতার দিকে চেয়ে থেকে একটু অপ্রস্তুতভাবে রাশেদ বললেন, ‘শিওর!’ 

অমৃতার মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি। ওর হাতে ধরা বাক্স থেকে চেইনটা তুলে নিলেন নিজের আঙুলে। অমৃতা পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো। ফর্সা উন্মুক্ত ঘাড়ের ওপর ল্যাম্পশেডের হলদে আলো নেচে উঠল ঝিকমিকিয়ে। মানুষটার উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝাপটা এসে পড়ছিল ওর কাঁধের ওপর। রক্তে রক্তে নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছিল সেই নিশ্বাস। রাশেদ আস্তে করে চেইনটা ওর গলায় পরিয়ে দিলেন। হুক আটকাতে একটু সময় লাগল। হাতের আঙুল কয়েকবার ঘষা খেলো মসৃণ চামড়ায়। পরানো হয়ে গেলে অমৃতা ঘুরে দাঁড়ালো। ওর বুকের ওপর তখন লকেটটা দুলছে। লকেটের ওপর একটা আঙুল রেখে সে ধীরস্বরে বলল, ‘এটা আমার সাথে সব সময় থাকবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।’

কথাটা বলা শেষ করে সে সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার চোখের দিকে তাকালো মুখ তুলে। আচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘আপনি কি আমাকে একটু আদর করবেন এখন? নাকি সেদিনের মতো আজকেও বলবেন, নো ওয়ে!’ 

প্রতিরোধের শেকলটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে যাচ্ছিল। এক দুর্বার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল বিবেক, নীতিবোধ এবং অহংকার। মনে হচ্ছিল যেন অমৃতাই পৃথিবীর প্রথম এবং শেষ নারী! রাশেদ আচমকা একটা হাত বাড়িয়ে অমৃতাকে নিজের খুব কাছে টেনে আনলেন। তারপর হাতের উল্টো পিঠ ছোঁয়ালেন আলতোভাবে ওর হেম রঙের গালের ওপর। গভীর কণ্ঠে – বললেন, ‘এত চেষ্টার পরেও তোমাকে আমি এড়াতে পারছি না কেন বলোতো?’ মানুষটার হাতের স্পর্শে অমৃতার বুক ধড়ফড় করছিল কবুতরের দুর্বল সিনার মতো। রক্তকণিকায় অগ্নি স্ফুরণ ছড়িয়ে যাচ্ছিল ফরফর করে। নিশ্বাস হয়ে উঠছিল ভারি। চারপাশে তখন শুধুই মদির রঙের এক ঝাপসা কুয়াশা। এই সময়টা অন্য সময়। এ এক অন্য পৃথিবী। এখানে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। শুধুই দুজন মোহাচ্ছন্ন মানব-মানবী। এদের বক্ষজুড়ে কেবল অতলন্ত তৃষ্ণা। বাকি সমাজ সংসার মিছে সব! 

অমৃতা অর্ধনিমীলিত চোখে চেয়ে ধীরস্বরে বলল, ‘পারছেন না কারণ আমি আপনাকে যতটা ভালোবেসেছি এতটা ভালো পৃথিবীর কেউ কোনোদিন কাউকে বাসেনি! 

—‘এত মানুষ থাকতে হঠাৎ আমাকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো কেন তোমার?’ 

—‘ইচ্ছে হলো কারণ আমাদের ইচ্ছেগুলোও আসলে অন্য কারো ইচ্ছে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।’ 

রাশেদ ডান হাতের আঙুল খুব আলতোভাবে অমৃতার পাতলা ঠোঁটজোড়ায় ছোঁয়ালেন একবার তারপর সেই আঙুল নেমে এলো ওর গলায়… কণ্ঠার হাড়ের সুন্দর তিলটায়… ধীরেধীরে রাশেদের ঠোঁটে একটা প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠল তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘পুতুলটাকে সুন্দর লাগছে!’ 

হঠাৎ করেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেল লোকটা। দুদিকে সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক হচ্ছে না!’ নেশাগ্রস্ত চোখ মেলে অমৃতা দেখল লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে যাচ্ছে কাউচের দিকে। ধপ করে কাউচের ওপর বসে পড়ে কপালে হাত রাখল ক্লান্তভাবে। তারপর ভীষণ গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা সম্ভব না! 

অমৃতা ছুটে এসে তার পায়ের কাছে বসল। দিশাহারা ভাবে বলল, ‘কী হলো হঠাৎ?’ 

—‘সম্ভব না।’ 

—‘অসম্ভব বলে কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে?’ 

রাশেদ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘আমার ছেলেকে আমি কষ্ট দিতে পারব না।’ 

অমৃতা রাশেদের হাত চেপে ধরল, ‘সামিকে আজ নয়তো কাল জানতেই হবে!’ 

–‘কষ্ট পাবে আমার ছেলে। ওর এত বড় ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দিতে পারব না।’ 

—‘আপনার কি মনে হয় না সত্যি লুকানোটাও এক ধরনের অপরাধ? সামির কি সত্যি জানার অধিকার নেই?’ 

—‘ইম্পসিবল! ওকে এসব জানানো যাবে না কিছুতেই!’ 

—‘আপনি কি ওকে ভয় পাচ্ছেন? 

এ প্রশ্নে রাশেদের চোখের তারায় একটা শূন্যতা এসে ভর করল, ‘ভয় আমার ছেলেকে নিয়েই। অন্য কিছুই নয়।’ 

—‘আপনি তো সারা জীবন ছেলের জন্য অনেক করলেন। আপনার ছেলে তো এখন বড় হয়েছে। তাকে তার মতো ছেড়ে দিন না! ও ভালোই থাকবে ইন শা আল্লাহ। এত ভাবছেন কেন? আপনি কি পুরনো দিনের লোক নাকি?’ 

—‘আমার ওই একটাই ছেলে।’ 

—‘আপনি জিবরান পড়েননি? তিনি বলেছিলেন— ‘Your children are not your children. They are the sons and daughters of Life’s longing for itself. They come through you but not from you. though they are with you, they belong not to you!’ আমি কবিতা টবিতা পড়ি না। এই লাইনগুলো একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম।’ 

—‘আমি জানি সন্তান আমার নিজস্ব সম্পত্তি নয়। কিন্তু বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। থাকবে আজীবন।’ 

—‘তাহলে চলুন কোথাও চলে যাই আমরা। অনেক দূরে।’

রাশেদ ম্লান হাসলেন, ‘তুমি এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছ।’ 

অমৃতার চোখে কোত্থেকে যেন এক টুকরো অভিমান এসে ভর করল। পাতলা ঠোঁট দুটি বাঁকিয়ে বলল, ‘জানি তো আপনার ছেলে, আপনার বিজনেস, আপনার পলিটিক্স, আপনার বৌ… এগুলোই আপনার কাছে সব আমি তো কেউ না। আমার জন্য তো একটা ফোঁটা মায়া নাই কোথাও।’ 

রাশেদ অমৃতার হাত ধরে পায়ের কাছ থেকে টেনে তুললেন ওকে। বসালেন নিজের পাশে। তারপর ওর চোখের দিকে চেয়ে স্থিরতার সাথে বললেন, 

—‘আমি চাই তুমি যেন ভালো থাকো। তুমি ভীষণ ব্রাইট একটা মেয়ে। জীবনটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও। এই দেশের জন্য, দেশের মানুষগুলোর জন্য তোমার অনেক কিছু করার আছে।’ 

—‘আপনাকে ছাড়া কিছুই সম্ভব না।’ 

—‘অমৃতা তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। আমার স্ত্রী পুত্র আছে। সংসার আছে। বোঝার চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি!’ 

—‘আপনি কি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন?’ প্রশ্নটা কেমন কাঁপিয়ে দিল রাশেদকে। একটু চমকানো চোখে তাকালেন তিনি অমৃতার দিকে। কীসের যেন একটা দ্বিধা খেলে গেলো চোখে। উত্তরে কিছুই বললেন না। দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব নিয়েই চুপ করে রইলেন বেশ খানিকক্ষণ। তারপর একটা সময় খুব গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এটা তোমার জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। আমি কোনোভাবেই আমার এতদিনের পুরোনো সংসারকে অপমান করতে পারব না।’ 

—‘অপমান করবেন কেন? পরিবর্তন মেনে নেয়ার সাহস থাকা উচিত সকলের। পরিবর্তন মানেই অপমান নয়।’ 

—‘সে শুধু আমার স্ত্রীই নয়। আমার সন্তানের মা। তোমার মতো ছেলেমানুষী করলে তো আমার চলবে না অমৃতা!’ 

—‘এর মানে আপনি আমাকে ছাড়তে পারবেন কিন্তু আপনার সংসার ছাড়তে পারবেন না। এই তো?’ 

রাশেদ চুপ করে রইলেন। উত্তর দিলেন না। 

অমৃতার চোখ দুটো আস্তে আস্তে ভিজে উঠছিল। সে চাপা গলায় বলল, –’আমি এমন ছিলাম না রাশেদ। আমাকে আপনি পাগল করে দিয়েছেন! কী করেছেন আপনি? জাদু জানেন নাকি?’ 

রাশেদ অমৃতার পুতুল মুখটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একটা বড় শ্বাস ফেললেন, 

—‘জাদু তো তুমি করেছ আমাকে। এই যে আমি ইম্পরট্যান্ট মিটিং ক্যানসেল করে তোমার সাথে এখানে এসে বসে আছি। আমিও কি আগে এরকম ছিলাম নাকি?’ 

এ কথা শুনে অমৃতার ঠোঁটে একটা স্ফীত হাসি ফুটল। কান্নার ভেতরে উঁকি দেওয়া হাসিটা মেঘ ভাঙা সূর্যের আলোর মতোই সতেজ। ভারি সুন্দর দেখালো তাকে সেই সময়। কিন্তু হাসিটা যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো আবার। চিন্তাযুক্ত গলায় সে বলল, 

—‘আমি যে আপনাকে চাই। ভীষণভাবে চাই! এই সত্যিটা সামিকে আমার বলতেই হবে আজ নয়তো কাল। সামি আমার বন্ধু। আমার বন্ধুকে আমি ঠকাতে পারব না!’ 

হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন শব্দে। রাশেদ ফোন কানে ধরে ‘হ্যালো’ বললেন। কয়েকটা নীরব মুহূর্ত। তারপর তাঁর কপালে কয়েকটা ভাঁজযুক্ত রেখা ফুটে উঠল। তিনি ব্যস্তভাবে ‘আচ্ছা আমি আসছি’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন। 

—‘কী হয়েছে?’ 

—‘সুলেমান হার্ট অ্যাটাক করেছে। আমি এখনই একবার যাব ওকে দেখতে। চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই।’ 

অমৃতা চিন্তিত গলায় বলল, ‘হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করল? আহা বেচারা! সেদিনও তো সুস্থ ছিল। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি জামা চেঞ্জ করে আসছি।’ 

৮৪

সুলেমান শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল রাত বারোটায়। মৃত্যু সংবাদটা সামিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। সে ঘুমোতে পারছিল না। সারারাত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে। একটু পর পর বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। হৃদি হাজার চেষ্টা করেও তাকে এক মুহূর্তের জন্যে শান্ত করতে পারছিল না। তার নিজেরও অস্থির লাগছিল। খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট করেছে দুজনে সারারাত। সামির উদ্বেগের কারণ অবশ্য শুধু সুলেমানের মৃত্যু নয়, তার বাবা মায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের বিপর্যয়ও তাকে অনেকাংশে দুর্বল করে তুলেছে। 

হৃদির সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছিল অমৃতার ওপর। বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল রাগটা শরীরের সমস্ত কোষে কোষে। একজনের ভুলের কারণে আজ কতগুলো মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। হ্যাঁ, সমস্ত দোষ অমৃতার। হৃদি এই মুহূর্তে একশবার, হাজারবার চিৎকার করে বলতে পারবে কথাটা। অমৃতাকে এখন তার আচমকা উড়ে আসা কালবৈশাখীর এক সর্বনাশা আগ্রাসী ঝড় বলে মনে হচ্ছে। স্বার্থপর, হীন এবং নীচ! এমন তো ছিল না মেয়েটা। হঠাৎ করে কেন এমন ধুম পাগল হয়ে গেলো? এ কোন শনির দশা লাগল তাদের জীবনে? ভালোই তো ছিল। বাবা, মা, ভাই, বোন আর বন্ধুরা। এই আপন কিছু মানুষ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট দুনিয়াটায় হেসেখেলে ভালোবেসে ভালো থেকে কি একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত না? কেন এমন হলো? কেন? 

সামির একটু চোখ লেগে এসেছিল। হৃদি সেই সুযোগে গভীর রাতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভাকে ফোন করল। কারো সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি এখন তার জন্য। বুক ভার হয়ে আছে। বিভা সব শুনেটুনে বলল, 

—‘অমৃতা বেচারির ওপর এতটাও রাগ করিস না তুই। ও তো একটু এমনই। গাধাছাদা পাগল ছাগল!’ 

—‘অমৃতা পাগল ছাগল হতে পারে। কিন্তু গাধাছাদা কোনোমতেই না। তুই জানিস না সামি কী পরিমাণ আপসেট হয়ে গেছে। আমি এখন কী করব? 

—‘এত ভেঙে পড়ার কিছু নাই। দ্যাখ পৃথিবীতে সব সম্পর্ক আজীবনের জন্য হয় না। সামির বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ আসলে তাকে সেটা মেনে নিতে হবে। ও তো ছোটবাচ্চা না। প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ হয়ে এই বাস্তবতাটুকু মেনে নিতে পারবে না?’ 

—‘আরে ভাই, সেটা নাহয় মানল। কিন্তু এর পেছনে যে অমৃতা দায়ী। ওর নিজের বন্ধু দায়ী সেটা কীভাবে সহ্য করবে? উফ আল্লাহ! আমি ভাবতে পারতেছি না কিছুই!’ 

‘কী করিস?’ হঠাৎ প্রশ্নটা কানে এসে লাগল। চমকে উঠে পেছন ফিরল হৃদি। সামি দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজার সামনে। দেখামাত্র এক অজানা শঙ্কায় হৃদির আত্মা কেঁপে উঠল থরথর করে। সামি কথাগুলো শুনতে পায়নি তো! 

ফোন কেটে দিয়ে সে স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘এই তো, বিভা ফোন করেছিল।’ 

—‘তুই কী বলছিলি?’ সামির কণ্ঠস্বর কেমন যেন অদ্ভুত শীতল! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে হৃদির। 

—‘বলছিলাম… বলছিলাম যে… মানে সুলেমান চাচার মৃত্যু সংবাদটা দিলাম। মনটন খারাপ আমাদের। এটাই বললাম।’ 

কথাটা শুনে সামি কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে রইল হৃদির দিকে। তারপর হৃদির একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো ঘরের ভেতর। বিছানায় বসিয়ে দিল ওকে। আস্তে ধীরে ওর কোলের ওপর মাথাটা রেখে পা টেনে শুয়ে পড়ল বিছানায়। 

কেমন যেন থম ধরা গলায় বলল, ‘আমাকে ফেলে যাস না কোথাও। একা থাকতে ভালো লাগে না।’ 

হৃদি সামির ঝাঁকড়া চুলের ভেতর চিরুনির মতো হাতের আঙুল চালিয়ে বলল, ‘কোথাও যাব না। যাইনি তো! এখানেই ছিলাম!’ 

—‘মানুষের জীবনটা কী অদ্ভুত নারে? সুলেমান চাচার মতো আমরা সবাই একদিন মরে যাব!’ ভারি বিষণ্ণ আর করুণ শোনায় সামির গলা। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে হৃদির, ‘হ্যাঁ, মরতে তো হবেই!’ 

—‘এইযে এই পৃথিবীকে আমি এত ভালোবাসি। আমি মরে গেলে এ পৃথিবীর কিছু আসবে যাবে না। সবকিছু একই রকম থেকে যাবে। থাকব না শুধু আমি।’ 

—‘এসব ভাবিস না।’ অস্ফুটে বলল হৃদি। 

কয়েকটা ক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে। ঘর অন্ধকার। এয়ারকন্ডিশনের চিঁচিঁ ভোঁতা শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই চারপাশে। আছে শুধু নিশ্বাসের শব্দ। সামির বুক উঠছে নামছে। ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ হচ্ছে তার বুকে। মনে হচ্ছে বুঝি দম নিতে খুব কষ্ট। 

—‘আমার বাবা কাকে ভালোবাসে? যাকে ভালোবাসে তার মধ্যে কী আছে? যা আমার মায়ের মধ্যে নেই?’ 

প্রশ্নটা হৃদিকে শিহরিত করে তুলল। চোখের কোলে উপচে উঠল জল। সে সামির কপালে একটা চুমু খেয়ে ধরা গলায় বলল, ‘ধুর বাদ দেতো এসব! ঘুমানোর চেষ্টা কর।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *