বৃষ্টিমহল ৩.৭৫

৭৫

হৃদির আজকাল অখন্ড অবসর। নেই কাজ তো খই ভাজ অবস্থা একেবারে। এই বেকার জীবন অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগছে না তার। বিয়ের পর প্রথম দু সপ্তাহ মনের মধ্যে একটা লাগাতার অশান্তি কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। এখন কিন্তু সেই কাঁটার মতো অশান্তিটা নেই। কদিন হলো সংসারের খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস উপভোগ করা শুরু করেছে সে। 

রোজ সকালে অফিস যাবার আগে সামির গলায় টাই বেঁধে দেয় সে যত্ন করে। ইন করা ফুল হাতা শার্ট, প্যান্ট আর টাই পরা রুপবান স্বামীটিকে নজর ভরে দেখে। ফূর্তিবাজ ক্যাজুয়াল বন্ধুবেশী সামির চাইতে আজকাল তার এই কর্মঠ, একটু পরিণত সামিকেই যেন বেশি ভালো লাগে। সকালের নাশতাটা নিজের হাতে বানায় হৃদি। কাজের লোকরাই অর্ধেক কাজ সেরে ফেলে। সে হয়তো পাউরুটিটা টোস্ট করে দেয়, ডিমে লবনটা দেখে দেয়। খুব বেশি হলে গ্রাইন্ডারে অরেঞ্জ গ্রাইন্ড করে জ্যুস বানিয়ে নেয়। রুদ্রও একই সময়েই বাসা থেকে বের হয়, অফিসের উদ্দেশ্যে। তিন বন্ধুতে মিলে নাশতার সময়টা বেশ ভালোই কাটে ওদের। সামি চলে যাবার পর হৃদি সময় নিয়ে নিজের ঘরটা গোছায়। ডাস্টার দিয়ে আসবাব পত্রের ধূলো ঝাড়ে, কার্পেট ভ্যাক্যুম করে, বিছানার চাদর পাট করে বিছায়। ঘর গোছগাছ করার সময় সে খুব উঁচু ভলিউমে গান ছেড়ে দেয় স্পীকারে। হালকা একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজও সেরে নেয় এই ফাঁকে। বেলা এগারোটার দিকে রোজ একবার দাদি শাশুড়ির ঘরে গিয়ে উঁকি দেয়। গল্পটা খুব জমে যায় দুজনের মধ্যে। সারাদিনের মধ্যে দুপুরের সময়টাই তার যা একটু খারাপ কাটে। দুপুর বেলায় শাশুড়ির সাথে একত্রে বসে লাঞ্চ করতে হয়। ডিনারে সামি আর রুদ্র থাকে বলে খারাপ লাগে না। আর তিনদিন বাদে শ্বশুর মশাই আমেরিকা থেকে ফিরে আসছেন। ডিনারে প্রতিদিন তিনিও থাকবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু লাঞ্চের সময়টা নিয়েই হৃদির যত ভয়। একা একা শাশুড়ির সাথে কী কথা বলবে, কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। নিজেকে খুব বোকা বোকা আর ভীতু বলে মনে হয় সে সময় তার। কোনো কোনো দিন শাশুড়ি তার সাথে একটি সাধারণ বাক্যও বিনিময় করেন না। দুজনে টেবিলের দুই প্রান্তে বসে চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠে যায়। সত্য বলতে কি হৃদি এই মহিলার সাথে কথা বলার মতো কোনো বিষয় খুঁজে পায় না। শুধু শাড়ি, গয়না, গাড়ি, বাড়ি, টাকা, পয়সা ছাড়া এই মহিলার মাথায় আর কোনো টপিক নেই। মাঝে মাঝে সে শাশুড়ি এবং তার বোনদের কথপোকথন কান পেতে শুনে দেখেছে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, কোন পার্টিতে কে কত দামি শাড়ি পড়ল, কোত্থেকে শাড়িটা কিনল, কার গয়নার ডিজাইন বেশি ভালো, কার বাড়ি কোন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ডেকোরেট করেছে, কোন ব্র্যান্ড বেশি ভালো, কে কোন দেশে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে, এইসব হাবিজাবি। এছাড়াও শ্বশুরবাড়ির বদনাম করতে এরা প্রত্যেকেই ওস্তাদ। হৃদির সামনেই রোমেলা একদিন অসুস্থ ফুপু শাশুড়িকে নিয়ে খুব বাজে মন্তব্য করে ফেলেছিলেন। ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগেনি তার। ওই বৃদ্ধা মহিলাকেই একমাত্র এ বাড়িতে একটু মানুষ বলে মনে হয়। অপর দিকে, রোমেলাকে মাঝে মাঝে তার পরিপূর্ণ মানুষ মনে হয় না। মনে হয় যেন মানুষ হবার ঠিক আগের ধাপে এসে ফেঁসে গেছে মহিলা। মানুষ আর হতে পারেনি। তবে একটা ব্যাপার হলো, মানুষ হিসেবে সে যেমনই হোক না কেন, মা হিসেবে ষোলো আনা সার্থক। সামির চোখে তার মায়ের জন্য যে অগাধ ভালোবাসা হৃদি দেখেছে, সেই ভালোবাসা এটা প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে মা হিসাবে রোমেলার কোনো ত্রুটি কখনো ছিল না। সামির মতে তার মা সেরার সেরা! 

খালা শাশুড়ি বিদায় হবার পর, হৃদি ভেবেছিল নিজের শাশুড়িকে এবার হয়তো একটু নিজের মতো করে পাওয়া যাবে। কনভারসেশন শুরু করার উদ্দেশ্যে সে খেতে খেতে শাশুড়িকে বলল, ‘নিউজ দেখেছেন? বাংলাদেশে যে তলায় তলায় এত ক্যাসিনো আছে, তা কে জানত?’ 

শাশুড়ি বড়ই নিস্পৃহ চোখে তাকালেন তার দিকে। ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘তাই?’ 

—‘জি।’ 

ব্যাস এরপর আর কোনো কথা নেই। খানিক বাদে তিনি চোখ তুলে অলস গলায় বললেন, ‘তোমার এই শাড়িটা কে দিয়েছিল?’ 

হৃদি নিজের পরনের শাড়িটার দিকে তাকালো। আড়ং এর জামদানি শাড়ি। বিয়েতে তো কত উপহারই পেয়েছে। কে কোনটা দিয়েছে অত মনে থাকে নাকি? সে মিনমিন করে বলল, ‘ঠিক মনে নেই কে দিয়েছিল।’ 

রোমেলা ভাত চিবোতে চিবোতে নির্বিকারভাবে বললেন, ‘বেশ দামি শাড়ি। আমার ভাই বোনদের মধ্যেই কেউ দিয়েছে নিশ্চয়ই।’ 

ব্যস, তালটা কেটে গেলো। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, হৃদির বাড়ির কারো এত দামি উপহার দেবার সামর্থ্য নেই। এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের পর কি এই মহিলার সাথে আর কথোপকথন চালিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট থাকে? 

তবে স্বস্তির খবর হলো শাশুড়ি হৃদির সাথে পা মাড়িয়ে ঝামেলা করতে আসেন না। দুজনে দুজনের মতো স্বাধীন সময় কাটায়। রোমেলা নিজস্ব সার্কেল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাব নইলে গুলশান ক্লাবে পার্টি থাকে। পার্টি না থাকলে তিনি চলে যান বোনদের বাসায়। কখনো আবার ক্লাবের বন্ধুদের সাথে আউটিং এ যান। শপিং এ যান। মাঝে মাঝে হৃদির ডাক পড়ে এসব আউটিং এ। ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হয় তাকে। ইদানিং এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য সে নিজস্ব প্ল্যান করে রাখে আগে থেকে। কোনো কোনো দিন চলে যায় বাবার বাড়ি। কখনো টি এস সি গিয়ে বসে থাকে। ভার্সিটির ছোট বড় ভাই বোনদের সাথে আড্ডা দেয়। বিকেলটা কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ততক্ষণে সামিরও ফিরে আসার সময় হয়। 

সামি বাড়ি ফেরার সময়টায় হৃদি আজকাল একটু ফিটফাট হয়ে থাকে। এই অভ্যাস অবশ্য এমনি এমনি হয়নি। কদিন আগে বিকেল বেলা বাবার বাড়ি যাবার সময় একটু সেজেছিল হৃদি। তেমন কিছুই না, শাড়ির সাথে ম্যাচিং কানের দুল, হাতের চুড়ি, চোখে হালকা কাজল, টিপ আর সামির পছন্দের পারফিম মেখেছিল গায়ে। বাবার বাড়ি থেকে ফিরে এসে আর দোতলায় ওঠেনি। দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনের পোর্চের ওপর, সামির অপেক্ষায়। 

তখন গোধূলি। অস্তগামী সূর্যের হলদেটে আলো এসে পড়েছে বাগানের ফুটন্ত গোলাপ, জিনিয়া আর সন্ধ্যামালতীর গায়ে। সারাদিনের খর উত্তাপের পর একটু একটু ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল শেষ চৈত্রের আকাশ। হৃদি পোর্চের মোটা সিমেন্টের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার গায়ে বাসন্তী রঙের সিল্ক শাড়ি, খোলা চুল, ভ্রুযুগলের মাঝখানে একটি ছোট্ট কালো গোল টিপ। লালিমা ঘেরা আকাশটার দিকে উদাস নয়নে চেয়ে ছিল সে। ভাবছিল কিছু একটা আনমনে। কী ভাবছিল কে জানে! 

সামি গাড়ি নিয়ে বাড়ির চৌহদ্দিতে প্রবেশ করতেই দেখল এক অসম্ভব রূপবতী মেয়ে থামের গায়ে হেলান দিয়ে, আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পানে চেয়ে। ঝাপটা বাতাসে মেয়েটির খোলা চুল উড়ছে, লুটাচ্ছে অবিন্যস্ত শাড়ির আঁচল। গোধূলিলগ্নর চাপা ফুলরঙা অপার্থিব এক আলো এসে পড়েছে মেয়েটির গালে আর কপালে। দেখামাত্র সামির বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করা ভালোলাগায় মাতম করে উঠল। এমন সুন্দর দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় নাতো! এ যেন সত্য নয়, স্বপ্ন! মেয়েটি যেন তার স্বপ্নসুন্দরী। এ মেয়ের বাস ধূলোবালির পৃথিবীতে নয়। এর নিবাস স্বর্গে। জলঢাকা নদী পাড়ের ওই এক টুকরো পাহাড়ি গ্রামটায় আচমকা এক শীতের সন্ধ্যাবেলায় সে দৈবাৎ পেয়ে গিয়েছিল এই স্বর্গের পরিকে। হ্যাঁ স্বর্গ থেকে শুধু তার জন্যই মর্ত্যে নেমে এসেছিল পরিটা। 

সামি গাড়ি থেকে দ্রুত পায়ে নেমে এসে ডুয়ার্সের সেই সন্ধের মতোই হৃদিকে কাছে টেনে নিল অতর্কিতে। তারপর কোনো কথা না বলে একটা গভীর চুমু খেলো ওর ঠোঁটে। হৃদি একদম লালটাল হয়ে গিয়ে বলল, ‘এসব কী? কেউ দেখলে?’ 

—‘দেখলে দেখুক না। আমার বৌকে আমি আদর করব না? আজিব!’ সামির দৃঢ় প্রত্যুত্তর। 

সেই থেকে সামি বাড়ি ফেরার সময়টায় হৃদি একটু সাজগোজ করে থাকে। সে বোঝে সামি এই সাজগোজটা পছন্দ করে। উপভোগ করে। জীবনের এসব ছোটখাটো ভালো লাগার দাম আছে। হৃদি চায় তার ইচ্ছে জীবনে এসব ছোটখাটো ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিতে। 

সামি সম্প্রতি নিচতলায় একটা থিয়েটার রুম করেছে। যে হলঘরটায় বিভার বিয়ের আগের দিন ওরা নেচেছিল, সেই ঘরটাকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রজেক্টর স্ক্রিন বসিয়ে থিয়েটার করা হয়েছে। আজ রাতে বন্ধুদের সবার একসাথে সেই থিয়েটারে সিনেমা দেখার কথা। সন্ধ্যার পর পর আকাশ আর অমৃতা চলে আসলো। সঙ্গে নিয়ে আসলো পিৎজা, চিপস, কোক এবং আরো কিছু হাবিজাবি স্ন্যাক্স। থিয়েটার রুমে তিন চারটা একশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। বন্ধুরা প্রজেক্টরের কয়েক হাত দূরে সাজিয়ে রাখা লাল ফোমের গদি আঁটা সোফার ওপর বসেছে। সেন্টার টেবিল বোঝাই হয়ে আছে খাবার দাবারে। সিনেমা শুরু হলে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হবে। ওরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ঠিক কোন মুভিটা আজ দেখবে। কোনটা দেখা যায় তার ওপর আলোচনা চলছে। সামি অফিস থেকে ফিরে এসে গোসল সেরে একটা ঘরোয়া টি শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরেছিল। হঠাৎ করেই ওর হাঁটুর ওপর অমৃতার নজর পড়ে গেলো। বৈদ্যুতিক আলোর নিচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ডান হাঁটুতে একটা চওড়া কাটা দাগ। ফর্সা চামড়ার ওপর অনেকটা কালশিটের মতো দেখাচ্ছে পুরোনো ক্ষতটা। অমৃতা কোকের ক্যান 

খুলে চুমুক দিল। বলল, ‘এই সামি, তোর হাঁটুর দাগটা কীসের রে? নিউইয়র্কে সাইকেল চালাইতে গিয়ে নাকি একবার পড়ে গেছিলি? সেই দাগ?’ 

সামি পিত্জায় কামড় বসাতে বসাতে সাম্প্রতিক সময়ে হলিউডে মুক্তি পাওয়া একটি মুভি নিয়ে খুব গুরুতর আলাপ করছিল বন্ধুদের সাথে। অমৃতার প্রশ্ন শুনে সে পাশ কাটানো গলায় ছোট করে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ তবে উত্তরটা দেওয়ার পর মুহূর্তেই একটু কেমন বিভ্রান্ত দেখালো তাকে। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুই ক্যামনে জানলি?’ 

অমৃতা ভড়কে গেলো। কয়েক সেকেন্ড বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো চেয়ে রইল সে সামির দিকে। তারপর খকখক করে কেশে নিয়ে নিজের মধ্যে সপ্রতিভ একটা ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, ‘ক্যামনে জানব আবার। তুই বলছিস!’ 

সামি একটা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘আমি বলছি?’ 

—‘হুম তুই বলছিস।’ 

বাকি বন্ধুরা অমৃতার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। সবার মধ্যে একটা হতভম্ব ভাব। অমৃতা বুঝতে পারছে বড়সড় ভুল হয়ে গেছে তার। কারণ সামি অনেক আগে একবার দুষ্টুমি করে বলেছিল ছোট বেলায় নাকি বাবার সাথে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে বাঘের সাথে লড়েছিল সে একবার। সেই লড়াইয়ের সময় বাঘ তার হাঁটুতে থাবা দিয়েছিল। হাঁটুর এ দাগটা হলো সেই বাঘের থাবার প্রমাণ। দুষ্টুমি করে বলেছিল সেটা বন্ধুরা সবাই জানত। কিন্তু দুষ্টুমি করতে গিয়ে দাগের পেছনের আসল ঘটনাটা আর কখনোই বন্ধুদের বলা হয়ে ওঠেনি সামির। 

—‘আমি তো কখনো বলি নাই তোদেরকে। তুই কোত্থেকে শুনলি?’ 

অমৃতা চোখ সরিয়ে নিল। প্রশ্নটা ধারালো ফলার মতো গিয়ে বিঁধেছে তার বুকে। হাতে পায়ে একটা অসাড় ভাব টের পাচ্ছে সে। বুক কাঁপছে। কতদিন লুকোবে নিজেকে? এত কাছের বন্ধুর কাছ থেকে এমন লুকিয়ে থাকা যায় নাকি? ধরা যে একদিন পড়তেই হবে! কেমন হবে যদি সামি নিজ থেকে কিছু ধরে ফেলার আগেই অমৃতা ওকে সবটা খুলে বলে? কেমন হবে যদি অমৃতা এখন স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দেয় যে, সামি আমি ঘটনাটা শুনেছি তোর বাবার কাছ থেকে। তিনি আমাকে ইমেইলে লিখেছেন। তোর বাবার সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়। আর দোস্ত শোন, আমি তোর বাবাকে খুব ভালোবাসি! 

কথাটা শোনার পর সামির প্রতিক্রিয়া কী হবে? খুব রেগে যাবে কি? কষ্ট পাবে? অমৃতাকে ঘেন্না করবে? বন্ধুত্ব ছিন্ন করবে? ভাবতে ভাবতে চোখে কেমন অন্ধকার নেমে আসছে। বুকের মধ্যে ছুটছে বিরতিহীন ট্রেন। 

হঠাৎ আকাশ বলে উঠল, ‘আরে তুই-ই বলছিস। ভুইলা গেছিস শালা।’ আকাশের কথাটা শুনে সামি একটু চমক লাগা গলায় বলল, ‘আসলেই? আমি বলছি তোদের? কবে?’ 

এবার একই সাথে হৃদি আর রুদ্র কথা বলে উঠল, ‘বলছিস, তুইই বলছিস।’ 

—‘কবে বলছি?’ সামির গলায় অবিশ্বাস। 

—‘এইতো কয়েকমাস আগে।’ হৃদি বলল। 

রুদ্র প্রসঙ্গ পরিবর্তনের নিমিত্তে তাড়া দিয়ে বলে উঠল, ‘আরে ভাই কী সিনেমা দেখবি তোরা, চালাস না ক্যান? আমার তো ঘুম পাইতেছে।’ 

অমৃতা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বন্ধুরা তাকে বাঁচিয়ে দিল, এ যাত্রায়ও। 

৭৬

অমৃতা, 

গত কয়েকদিন আইএমএফ সম্মেলন নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেলো। আশা করি ভালো আছ। আজকেও ঝুল বারান্দায় বসে লিখছি তোমাকে। মাথার ওপর ভর দুপুরের ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর। তবে একটা ঠান্ডা বাতাস আছে বলে অতটা গরম অনুভূত হচ্ছে না। তুমি বলেছিলে হাইকোর্টের সনদ পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেবে না। এই সিদ্ধান্তের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল। 

তোমার মামাতো ভাইয়ের ঘটনাটি সত্যিই বড় দুঃখজনক। যে কোনো পিতা মাতার জন্যেই এমন কষ্ট সহ্য করা দুষ্কর। কিন্তু আমার মনে হয়, ছেলেমেয়েদের এ ধরনের মনোভাব তৈরির পেছনে পরিবারের একটি বড় ভূমিকা থাকে। বাল্যকাল থেকেই যদি দেশপ্রেম এবং দেশীয় সংস্কৃতি বাচ্চাদের মগজে এবং মননে নানা কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে কিছু বড় হবার পর কোনোভাবেই তারা নিজস্ব সংস্কৃতিকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস করবে না। আমরা বাবা মায়েরাই সন্তানদের আজকাল বড় বেশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমুখী করে তুলছি। বৈদেশিক উচ্চশিক্ষা না হলে ক্যারিয়ার নেই, এমন একটি মানসিকতা আধুনিক বাবা মায়েদের মধ্যে খুব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তারা ভিটে মাটি বিক্রি করে, নিঃস্ব হয়ে সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যে সন্তান বাল্যকালে পিতামাতার চোখে কখনো দেশপ্রেম দেখেনি, দেশের জন্য কর্তব্যবোধ দেখেনি, সে সন্তানের জন্য নিজ সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে পারাটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। তোমার মামা-মামীকে আমি দায়ী করছি না তাদের সন্তানের পরিণতির জন্য। অনেক সময় চেষ্টা করার পরেও ভাগ্য সহায় হয় না আমাদের। 

বর্তমানে অনেক বাবা মা, সন্তানদের ইংরেজি চর্চার ওপর এত বেশি জোর দিয়ে থাকেন যে, তাদের ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া সন্তানেরা বাংলায় এক লাইন লিখতে বা পড়তে তো পারেই না, উপরন্তু এই অপারগতার কথা সদর্পে বলে বেড়ায়। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় ইংরেজি জানাটা নয়, বরং বাংলা বলতে বা লিখতে না জানাটাই দিনকে দিক নতুন প্রজন্মের স্মার্টনেসের নিক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা মায়েরা সন্তানদের মাতৃভাষার প্রতি এই অবজ্ঞা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন এই মনে করে যে, তাদের ইংরেজি জানা সন্তান উন্নত বিশ্বের জন্য বুঝি ফিট হয়েই গেলো এবারে। এসব বাবা মায়েরা নিজেদের আধুনিক হিসেবে দাবি করে। কিন্তু আমার কাছে এমন বিবেকবর্জিত আধুনিকতার কোনো মূল্য নেই। হ্যাঁ এ বিষয়ে আমি শতভাগ একমত যে, ইংরেজি জানাটা আজকের যুগে বাঞ্ছনীয়। ইংরেজি তোমাকে জানতেই হবে। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে সেই জানাটা যেন কোনোভাবেই নিজস্ব ভাষার ওপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে। বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি। দুটি ভাষার কোনোটিতেই এদের যথাযথ জ্ঞান নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন এরা সাদা কালো পোশাক পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে ঠিকই, কিন্তু এদের হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণও একুশের চেতনা নেই। নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা একটি জাতিকে অনেক দূর অবধি নিয়ে যেতে পারে। চায়নায় তো ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয় না। এমন কি দেশটিতে ফেসবুক, নেটফ্লিক্স, গুগল এসব কিছুই নেই। আছে ওদের নিজস্ব ভাষায় নিজেদের তৈরি করা বিকল্প মাধ্যম। তবুও দেশটি কিন্তু কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই, বরং আধুনিক পৃথিবীর সেরা দশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের একটি বলা হয় চায়নাকে। অনেক ভাষা জানতে পারাটা নিশ্চয়ই খুব ভালো একটি গুণ। কিন্তু সেই অনেক ভাষার ভিড়ে যারা মাতৃভাষাকে হারিয়ে ফেলে তাদের মতো দুর্ভাগা বোধহয় পৃথিবীতে আর হয় না। 

তোমার মেয়ের নাম তুমি নির্দ্বিধায় ‘রিমঝিম’ রাখতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ে না করার এবং সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তান বড় করতে চাওয়ার সিদ্ধান্তটি আমার ঠিক যৌক্তিক বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে এই সিদ্ধান্ত তোমার নারীবাদী চিন্তাধারার একটি বাহুল্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মানুষের জীবনে বাবা এবং মা উভয়েরই সমান ভূমিকা আছে। বাবা মা জীবনের দুটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি বলতে পারো। এদের একটি দুর্বল হলেই মূল কাঠামোতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা আছে। আমি জানি তুমি সাহসী এবং নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু সব সময় সাহসিকতা বা স্বাধীনতার স্ফুটন কেন প্ৰথা ভাঙার মাধ্যমেই হতে হবে? মনে রেখো, নিয়ম ভাঙাটা খুব কঠিন কাজ নয়, বরং নিয়মের মধ্যে থেকে সৎ, সাহসী এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারাটাই কঠিন এবং একই সাথে সম্মানের। তুমি যদি তোমার জীবনসঙ্গীর সাথে সন্তান লালন পালনের দায়িত্বটা ভাগ করে নাও, তাহলে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি সহজ এবং সুন্দর হয়ে উঠবে এবং এতে করে তোমার স্বাধীনতা কোনো অংশেই খর্ব হবে না। তোমার বন্ধুদের মধ্যে থেকেও কিন্তু তুমি যে কোনো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারো। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা সিঙ্গেল মাদারদের জন্য খুব একটা অনুকূল নয়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানকে প্রতি পদে পদে প্রতিকূলতার সম্মুখীন করে দেবে। আর এই প্রতিকূলতা তোমার সন্তানের মানসিক বিস্তারে বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। আশা করি আমার কথাগুলো বুঝবে, এবং ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করবে। 

তুমি জানতে চেয়েছ তোমাকে আমার কেমন লাগে। তুমি যেমন মনের কথা লুকোতে ভালোবাসো না, ঠিক তেমনি আমিও মিথ্যে বলতে ভালোবাসি না। কিন্তু আমার এই বহুল অভিজ্ঞতাময় জীবনে নানা সময়ে, নানা কারণে, সত্যকে সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে হয়েছে। আজকেও আমি সত্যটা এড়িয়ে গেলাম, কেমন? আর সব সময় সব কথা মুখ ফুটে বলতে বা লিখতে হয় না। কিছু কথা না বলাতেই সুন্দর। 

তোমার সাথে প্রথম দেখার দিনটি আমার স্পষ্টভাবে মনে নেই। তবে মনে আছে এক বিকেলে কী একটা দরকারে যেন সামির কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার আসার খবরটা সামির জানা ছিল না। কলেজে পৌঁছে দেখি ছেলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। পাশে একটি হ্যাংলা পাতলা বয়কাট চুলের মেয়ে। রাগটা গিয়ে তোমার ওপরেই পড়ল। বাড়ি ফিরে আচ্ছা মতন শাসালাম ছেলেকে। তোমাকে সেদিন আমার খুবই ডেসপারেট এবং উদ্ধত বলে মনে হয়েছিল। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর যাবৎ তোমার প্রতি আমার এই ধারণা বহাল ছিল। সে সময় আমি মনে প্রাণে চাইতাম সামি যেন তোমাদের সঙ্গ অতি দ্রুত ত্যাগ করে। তবে এখন আমি জানি সামির জীবনে তার বন্ধুরা একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এটাও জানি যে বন্ধুদের ছাড়া সে বাঁচার মতো করে বাঁচতে পারবে না। 

আমার জার্মান পেনফ্রেন্ডটি অবশ্যই নারী ছিল। কিন্তু তার সাথে আমার কোনো মানসিক সখ্য গড়ে ওঠেনি। আজ আর লিখছি না। বিকেল তিনটায় এখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ পার্টির মত বিনিময় সভা আছে। যেতে হবে। 

পুনশ্চ : অমৃতা, সামির দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী কেনাকাটা করতে আজ সকালে আরো একবার গিয়েছিলাম শপিংমলে। চেরি ফুল রঙের জামা পরা পুতুলটাকে আজকেও দেখলাম। দেখতেই আর একজন পুতুলের কথা মনে পড়ল। জামাটা কি আমি সেই পুতুলের জন্য উপহার হিসেবে কিনে আনতে পারি? অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি, রাশেদ। 

৭৭

প্রিয় রাশেদ, 

হাইকোর্টের প্রিলিমিনারি এক্সামে পাশ করে গেছি। আলহামদুলিল্লাহ। এম সি কিউর রেজাল্ট দিনে দিনেই দিয়ে দেয় ওরা। আপনি বলেছেন আমাদের দেশের বাবা মায়েরা আজকাল ছেলেমেয়েদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমুখি করে তুলছে। উইদ ডিউ রেসপেক্ট আপনাকে একটা কথা বলতে চাই যে, আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। ইংরেজিটা ভালো মতো জানা থাকলে আজকাল কোথাও ঠেকতে হয় না। যেসব বাবা মায়েরা সন্তানদের বাংলা না জানা দেখে মনে মনে আপ্লুত হয়, তারা ঠেকে শিখেছে যে, বাংলায় যথার্থ জ্ঞান থাকা না থাকাটা আসলে পেশাগত জীবনে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না। এরা প্রত্যেকেই পরিস্থিতির শিকার। একটু খুলে বলতে গেলে বলতে হয় যে কুশিক্ষার শিকার। দেশীয় সংস্কৃতি বা ভাষা যে ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার পাকাপোক্ত করতে না পারলেও মানসিকতা কিংবা রুচিবোধের উৎকর্ষ সাধন করে, এই বাস্তবতাটা অধিকাংশ সাধারণ বাঙালি পরিবারই হৃদয়ঙ্গম করতে অপারগ। 

তবে একটা কথা কী, ইংরেজি বলা নিয়ে আমার অতটা আপত্তি নেই, কারণ ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। আপনার সাথে আমি একমত, যে আজকের যুগে ইংরেজি জানতেই হবে। আমার আপত্তি বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের গড়গড়িয়ে হিন্দি বলা নিয়ে। বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বললে আমার মোটেও খারাপ লাগে না। খারাপ লাগে হিন্দি মিশালে। বছর দুয়েক আগে আমাদের মুটকোর্ট ওয়ার্কশপে নেপালের কাঠমুন্ডু ল স্কুল থেকে একটা দল এসেছিল। আমাদের দলের কতিপয় ছেলেমেয়ে লাফ দিয়ে উঠে তাদের সাথে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করে দিল। (নেপালিরা হিন্দি খুব ভালো পারে, আপনি বোধহয় জানেন) ব্যাপারটা কী যে বিশ্রী লাগল আমার কাছে বলার মতো না। মজার বিষয় কী জানেন? যারা দিনেরাতে চব্বিশ ঘণ্টা হিন্দি গান শোনে, হিন্দি সিরিয়াল দেখে এবং হিন্দিতে কথা বলে, তারাই আবার ভারতীয়দের গালাগাল দিতে পিছপা হয় না। এরা একমুখে বলে ভারত খারাপ, মোদী খারাপ। শেখ হাসিনা হিন্দুদের দালাল। আবার সেই একই মুখে সারাদিন হিন্দি গান গায়। চরম হিপোক্রেসি! 

আপনার সাথে প্রথম দেখা হবার দিনটির কথা আমার মনে আছে। যেদিন আপনি আমাকে আর সামিকে স্মোকিং করতে দেখে ফেলেছিলেন সেদিন আমি আপনাকে নোটিস করিনি। পরে সামির কাছ থেকে শুনেছিলাম যে সে তার বাবার কাছে ধরা খেয়েছে। আপনাকে নোটিস করেছিলাম তারও এক বছর পর। সেদিন আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল। সামি গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি বলে আপনি আর আপনার মিসেস খুব মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সবারই গোল্ডেন এ প্লাস ছিল শুধু সামি আর বিভা ছাড়া। বিভার আব্বা আম্মা অবশ্য গোল্ডেন এ প্লাস না আসায় তেমন একটা মন খারাপ করেননি। বিভাও ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু আপনাদের দুজনের হা হুতাশ দেখে সামি বেশ ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিল। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি আর বিভা সন্ধ্যার দিকে আপনাদের বাড়িতে গেলাম। অন্য বন্ধুরা সবাই নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সবার বাড়িতে পরীক্ষা পাশের সেলিব্রেশন চলছে। সামিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আমরা যখন বিদায় নেব ঠিক সেসময় সিঁড়ির গোড়ায় আপনার সাথে দেখা। সেইদিনই আপনাকে আমি প্রথমবার খুব কাছ থেকে দেখলাম। কলেজের ছেলেমেয়েদের মুখে শুনেছিলাম আপনাকে দেখতে নাকি সামির বাবা কম বড়ভাই বেশি মনে হয়। সেদিন নিজের চোখে দেখে সেই বিবৃতির সত্যতার প্রমাণ পেলাম। কিন্তু আপনি আমাদের দেখেও যেন ঠিক দেখলেন না। চোখে চোখ পড়ল, দৃষ্টি বিনিময় হলো ঠিকই, কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কী ভীষণ নিরাসক্তি! কী ভীষণ অবহেলা! সেদিন থেকেই আমি আপনাকে অহংকারী বলে জেনেছিলাম। কে জানত! সেই অহংকারী মানুষটাকেই আমি একদিন… থাক, আপনিই তো বলেছেন। কিছু কথা না বলাতেই সুন্দর! 

সিঙ্গেল মাদারদের প্রতি আমাদের সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা আমার অজানা নয়। এ কথাও শতভাগ সত্য যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানকে প্রতি পদে পদে প্রতিকূলতার সম্মুখীন করে দেবে। তবে একটি বিষয়ে আমি আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করব। আপনি বলেছেন সিঙ্গেল মাদার হবার বাসনাটি আমার নারীবাদী চিন্তাধারার একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আপনার ধারণাটি ভুল। নারীবাদী নারীদের ভেতরেও কিন্তু নারীত্ব কোনো অংশেই কম থাকে না। অন্য সব সাধারণ মেয়েদের মতো আমরাও চাই একটি সাধারণ, ছিমছাম, পরিপূর্ণ সংসার। কিন্তু যাকে আমি ভালোবাসি না, যাকে আমার ভালো লাগে না তার সাথে শুধু সামাজিক নিয়ম রক্ষার্থে এক ছাদের নিচে বসবাস করা আমার কাছে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। লোক দেখানোর নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। যাকে আমি ভালোবাসি শুধু তার সাথেই আমি আমার পারিবারিক জীবন, সংসার এবং সন্তান ভাগ করে নিতে রাজি আছি। অন্য কারো সাথে নয়। 

আপনি বলেছেন বন্ধুদের মধ্যে কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে। এই কথার যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে হয়তো আপনি বলবেন আমার বন্ধুরাই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝবে, একজন বন্ধুর মধ্যেই একজন যোগ্য স্বামী হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমার প্রশ্ন হলো, বন্ধুকে জোর করে হাজবেন্ড কেন বানিয়ে দিতে হবে? বন্ধু বন্ধুই থাক না! মানুষের জীবনে বন্ধুদের আলাদা জায়গা থাকে। প্রত্যেক হাজবেন্ড কিংবা ওয়াইফকেই কেন বেটারহাফ হওয়ার পাশাপাশি বন্ধুর ভূমিকা পালন করতে হবে? হাজবেন্ড ওয়াইফ যদি পরস্পরের বন্ধুই হয়ে গেলো তবে জীবনে অন্যান্য বন্ধুদের আর প্রয়োজন কী? বন্ধুদের সাথে আমি স্ল্যাং বলব। উড়াধুরা কাজ কারবার করব, পাগলামো করব, আর অন্যদিকে যিনি আমার স্বামী বা অর্ধাঙ্গ তার সাথে থাকবে আমার প্রেমময় সাংসারিক গভীরতার এক পবিত্র সম্পর্ক। ধরুন বিয়ের পর একজন মেয়ে তার হাজবেন্ডের সাথে ফাইন ডাইনিং ওয়ালা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেতে পছন্দ করে। এবং বন্ধুদের সাথে পছন্দ করে রাস্তার ধারের ফুচকা। হাজবেন্ডের সাথে ফুচকা খেতে আসলে তার মনে হয় যেন ফুচকাটা ঠিক জমছে না। আবার একইভাবে বন্ধুদের সাথে দামি রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে গেলেও মনে হয় কিছু একটা মিসিং। হ্যাঁ, ব্যাপারটা অনেকটা ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’র মতো অর্থাৎ যার যেখানে জায়গা তাকে সেখানেই অবস্থান করতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ। আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে। আমাদের সামি হৃদি বন্ধুর মধ্যেই জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমি হলফ করে বলে দিতে পারি ওদের বন্ধুত্ব এখন আর আগের মতো নেই। বন্ধুত্বকে ছাপিয়ে গেছে দাম্পত্য সম্পর্ক, প্রেম এবং সাংসারিক দায়বদ্ধতা। আমি আমার বন্ধুত্বকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে রাজি নই। 

আমি সেই মানুষটাকেই আমার জীবনে স্বামীর স্থানটি দিতে পারব যে কিনা আমার চাইতে জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, অভিজ্ঞতায় অনেক বড়। যাকে দেখলে আমার সম্মান করতে ইচ্ছে করে। নিজেকে পুরোপুরিভাবে সমর্পণ করতে ইচ্ছে করে। 

আপনার কাছ থেকে পাওয়া যে কোনো উপহার সেই পুতুলটা মাথায় করে রাখবে। অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজনীয়তাই দেখছি না আমি। এই মুহূর্তে আপনারই বাড়িতে অবস্থান করছি। আজ আমাদের রাত জেগে সিনেমা দেখার কথা। আমি গেস্টরুমে বসে আপনাকে লিখছি। কেউ একজন দরজা নাড়ছে। এবার তবে যাই। 

রাশেদ, আপনি এত সুন্দর করে চিঠি লেখেন কী করে? আপনার চিঠির নেশা ধরে যাচ্ছে আমার। এই চিঠিগুলো আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। সুযোগ পেলেই লিখবেন, কেমন? ভালো থাকবেন। 

বি:দ্র: একজনকে ছাড়া কোনো কিছু আর ভালো লাগে না আমার সেই জনকে এক নজর দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কবে দেখা হবে? 

ইতি,

আপনার অমৃতা 

৭৮

এ বছর বর্ষা বুঝি একটু আগেই চলে এলো। কদিন ধরে রোজ বিকেলের দিকে আকাশ থমথমে কালো হয়ে ওঠে। সন্ধে থেকে শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। তারপর সারারাত ধরে ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে ঝরতে থাকে বৃষ্টিটা। রাস্তাঘাটে পানি জমে একাকার অবস্থা। আজকেও সন্ধের মুখে ঝড়ো হাওয়া উঠেছিল। আকাশ রিকশা থেকে নামতে নামতে দেখল গেটের সামনে মনীষা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে আসলো সে। উতলা বাতাসে মনীষার শাড়ির আঁচল পতাকার মতো উড়ছে। উড়ছে কপালের কাছের কয়েক গাছি চুল। রাস্তার ফ্লুরোসেন্ট আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে ওর মনোরম মুখটা। গত কয়েকদিন মনীষার সাথে তার দেখা হয়নি। আজকে দেখতে পেয়ে চট করে সেদিন রুদ্রর বলা কথাটা মনে পড়ল। রুদ্র হঠাৎ ওই কথাটা কেন বলল? এ কথা সত্য মনীষাকে তার খারাপ লাগে না। খারাপ লাগার মতো মেয়ে তো মনীষা না। কিন্তু… ধ্যাৎ ভালো লাগলেই কি ভালোবাসা যায়? রুদ্রটা একটা গাধা! 

—‘কোথায় যাচ্ছেন?’ কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করল আকাশ। 

মনীষা আকাশের ছেড়ে দেওয়া রিকশাটা এক পলক দেখে নিয়ে বলল, ‘থামাও তো এই রিকশাওয়ালাকে।’ 

আকাশ হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এই খালি, দাঁড়াও।’ 

মনীষা জরুরিভাবে বলল, ‘শোনো রাইয়ানের বাবার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’ 

—‘কেন? হঠাৎ?’ 

—‘খুব বিরক্ত করছে লোকটা। বলেছে দেখা না করলে আমার অফিসে গিয়ে ঝামেলা লাগাবে।’ 

কথাটা শেষ করে মনীষা আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠে বসে রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘মামা চল, শ্যামলী যাব। ভাড়া যা হয় দেবো। হুড তুলে দাও।’ 

বৃষ্টির রেলগাড়িটা ইতোমধ্যে ছুটে গেছে। আকাশ রিকশার কাছে এসে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে নিয়ে মনীষাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি একা যেতে পারবেন? কোনো সমস্যা হবে না তো?’ 

—‘একাই তো যেতে হবেরে ভাই। আমার আর আছে কে?’ 

মনীষার চোখে মুখে লেপ্টে থাকা আতঙ্কের ছাপটা এতক্ষণে টের পেল আকাশ। একটু কেমন মায়া হলো। 

—‘আপনি চাইলে আমি আসতে পারি আপনার সাথে।’ 

—‘না থাক। তুমি এসে আর কী করবে? বজ্জাত লোকটাকে যদি নিজের হাতে খুন করতে পারতাম তবেই আমার শান্তি হতো। এখন যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ 

রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরালো। টুংটাং শব্দ করে বেরিয়ে গেলো রিকশাটা গলি থেকে। আকাশ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে তিন চাকার বাহনটার চলে যাওয়া দেখল। বৃষ্টির তোড় বাড়তেই ঢুকে গেলো সিঁড়িঘরে। লোকটা চায় কী মনীষার কাছে? টাকা? নাকি ছেলের কাস্টডি চায়? ভাবতে ভাবতে তার মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। দরজা খুলল তারা। খোলা মাত্রই উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, খালার শরীরটা ভালো না।’ 

—‘কেন কী হয়েছে?’ 

—‘খুব পেট ব্যথা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।’ 

আকাশ হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকল। ঝুমকির ঘরের বাতি নেভানো আকাশ ঘরে ঢুকেই বাতিটা জ্বলালো প্রথমে। ঝুমকি শুয়ে আছে বিছানায় পাশ ফিরে। বুজে থাকা চোখের কোল ভেজা। ঠোঁটজোড়া শুকনো। রক্তশূন্য মুখ। আকাশ এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালো, ‘কেমন লাগছে আপনার?’ 

ঝুমকি ফ্যাকাশে চোখে তাকালো আকাশের দিকে, ‘আমি ঠিক আছি।’

—‘তারা বলল আপনার শরীর নাকি খারাপ?’ 

—‘পেটে একটু ব্যথা হচ্ছে। গ্যাস্ট্রিকের মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। এন্টাসিড খেয়ে নিয়েছি।’ 

আকাশ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ঝুমকির মুখটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করল। বলল, ‘বেশ কদিন ধরেইতো দেখছি আপনার শরীর ভালো না। চলেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’ 

ঝুমকি নিরীহ গলায় বলল –’নারে বাবা। তোমার চিন্তা করতে হবে না। এসব টুকটাক অসুখের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।’ 

—‘ব্যথাটা কোথায় হচ্ছে?’ 

—‘তুমি যাও তো বাবা। হাত মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করো। আমার কথা ভাবতে হবে না।’ 

আকাশ চিন্তিত মুখে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল ঝুমকির বিছানার পাশে। ঝুমকির সাথে তার সম্পর্ক খুব একটা সহজ নয়। দীর্ঘকাল ধরে সে এই মহিলাকে নিজের শত্রুপক্ষ ভেবে এসেছে। যেচে পড়ে কখনো কোনো কথা বলেনি এর সাথে। উপরন্তু ইনি নিজ থেকে কথা বলতে আসলে দূর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল সে একটু একটু বোঝে যে তার কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষের শত্রু হবার মতো কোনো যোগ্যতাই এই মানুষটির নেই। শত্রুপক্ষ শক্ত সমর্থ হয়। আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং ক্ষতিকারক হয়। এই রমণীটি নিতান্তই অসহায়। এতকাল পরে এসে আকাশ বুঝতে পারে যে পরিস্থিতির চাপে না পড়লে এই রমণী কখনোই তার বাবার মতো একজন নামানুষ, বর্বরপ্রায় লোককে বিয়ে করে নিজের জীবনের সর্বনাশ করত না। 

আকাশ ভাঁজযুক্ত কপাল নিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসলো। বেরোনোর আগে বাতি নিভিয়ে দিল ঘরের। ডাইনিং এ পা রাখতেই তারা বলল, ‘যাচ্ছে না ডাক্তারের কাছে?’ 

—‘উনি তো বললেন গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা।’ 

তারা একটু রাগ নিয়ে বলল, ‘খালাম্মা এইগুলা কী শুরু করছে বুঝলাম না। মরে যেতে চায় নাকি?’ 

আকাশ তারার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করল না। ড্রইংরুমে পিতৃদেব বসে আছেন সোফায়। টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে। তিনি পা দোলাতে দোলাতে খেলা দেখছেন আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আকাশ পিতৃদেবের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘উনার কী হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি?’ 

কোটরে ঢোকা চক্ষুদুটোতে স্পষ্ট বিরক্তি ভেসে উঠল। 

—‘কার কী হয়েছে?’ 

আকাশের মুখটা তিক্ততায় বাঁকা হয়ে গেলো, প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল, ‘আপনার বউয়ের!’ 

পিতৃদেব ঝেঁঝে উঠলেন এ কথা শুনে, ‘বেয়াদবি করছ কেন? বুঝে শুনে কথা বল!’ 

আকাশের মাথা গরম। ভেতরে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা ঘুমন্ত সাপটা ফণা তুলে জেগে ওঠার পায়তারা করছে, আজ বহু দিন পর। লোকটা পেয়েছে কী? বৌয়ের দায়িত্ব নিতে পারবে না তো বিয়ে করেছিল কেন? 

—‘আপনি জানেন না, উনি যে অসুস্থ?’ 

লোকটা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ বলেছিল, ওই পেট ব্যথা না কী ছাই হয়েছে যেন।’ 

—‘ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না কেন?’ 

—‘একটু পেট ব্যথার জন্য ডাক্তার? টাকা কি গাছে ধরে নাকি?’ 

—‘হঠাৎ করে যদি মরে যায়? তখন কী করবেন? অবশ্য আপনার কিছু আসবে যাবে না। বৌ মরে যাওয়ায় তো আপনার অভ্যাস আছে। ইনি মরে গেলে কয়েকদিনের মাথায় আরেকটা বিয়ে করে ফেলবেন। ব্যস ঝামেলা শেষ।’ 

লোকটার মুখ হা হয়ে গিয়েছিল আকাশের কথা শুনে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ছেলে কখনোই তার সামনে এত স্পর্ধা দেখায়নি আগে। গত কয়েকমাস যাবৎ ছেলেই সংসারের সমস্ত খরচ দিচ্ছে বলতে গেলে। টাকা সবসময়ে কথা বলে। পুত্রর টাকাও তবে এখন কথা বলছে। এটাই জগতের নিয়ম। 

আকাশ লোকটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, যন্ত্ররুঢ়ের মতো হনহন করে হেঁটে সরে আসলো জায়গাটা থেকে। কথাগুলো বলতে পেরে ভালো লাগছে তার। অনেক দিন ধরে বুকের ওপর চেপে থাকা একটা ভারি পাথর যেন নেমে গেলো এই মাত্র। তার মায়ের হয়েছিল ব্রেইন টিউমার। আজ এতগুলো বছর পরে আকাশের হঠাৎ মনে হলো, মায়ের চিকিৎসায় বুঝি যথেষ্ট অবহেলা ছিল। আহা সঠিক চিকিৎসা পেলে মা হয়তো আরো কিছুদিন বাঁচত! 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কালো মেঘের মতো এক থমথমে মন খারাপের দল ঘিরে ধরল তাকে চারপাশ থেকে। আগামীকাল সকালে খাগড়াছড়ি যেতে হবে। ইউনিভার্সিটির বাৎসরিক পিকনিক। তিনদিনের ট্যুর। এর মাঝে ঝুমকির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কী উপায় হবে? আকাশ তারাকে ডেকে ওর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখো, তোমার খালার শরীর যদি বেশি খারাপ হয় তাহলে একবার উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। কেমন? আর আমি ফিরে এসে অবশ্যই উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। তুমি চিন্তা করো না। তোমাকে একটা ফোন নম্বর দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুর নম্বর। প্রয়োজনে ওই নম্বরে ফোন করবে কেমন?’ 

তারা একটু অপ্রতিভভাবে বলল, ‘কোন বন্ধু? ফ্রাইড টমটম?’

আকাশ এই মন খারাপের সময়েও হেসে ফেলল তারার কথা শুনে। 

—‘না ফ্রাইড টমটম আজ রাতে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’ 

তারা ঘর থেকে বেরোবার পর সে সামিকে ফোন করল। দুবার রিং পড়তেই ওপাশ থেকে কথা বলে উঠল সামি। 

—‘কীরে?’ 

—‘শোন, কাল সকালে খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। ভার্সিটি থেকে।’ 

—‘তো আমি কী করমু? নাচুম?’ 

—‘মনে চাইলে নাচ শালা! ফোন দিছি দরকারে। 

—‘ক, কী দরকার?’ 

—‘আমার বাপের বউ আছে না, উনি একটু অসুস্থ। যদি কোনো দরকার হয় তাহলে উনারা ফোন দিবে তোরে। বুঝছস?’ 

—‘ও এই কথা? তুই চিন্তা করিস না দোস্ত। আমি খেয়াল রাখব।’

—‘হ্যাঁ, একটু দেখিস। আমার হয়তো নেটওয়ার্ক থাকবে না।’

—‘আমাকে উনার নম্বর দে। ফোন করে খবর নিব।’

—‘আচ্ছা, নম্বর টেক্সট করতেছি।’ 

৭৯

সামির মুখখানা আজ আনন্দে ঝলমল করছে। অনেকদিন পর তার পুরো পরিবার একত্রে বসে ডিনার করছে। অনেক দিন পর বললে ভুল হবে। আদতে প্রথমবারের মতো স্ত্রী এবং বাবা মা-সহ একই টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। বাবা এসে পৌঁছেছেন বিকেলে। প্রতিবারের মতো এবারেও বাবা পৌঁছনো মাত্রই সামি লিস্ট মোতাবেক শপিং করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করে নিয়েছে প্রথমে। এসব ছেলেমানুষী তার ভেতর থেকে কখনো দূর হবে বলে মনে হয় না। এবার হৃদির জন্যেও অনেক উপহার এসেছে। নব দম্পতির বিকেলটা আজ কেটেছে আমেরিকা থেকে আগত নানা রকম উপহার সামগ্রী বরণ করে। 

খাবার টেবিলে রুদ্রও আছে। রাত এগারোটার বাসে সে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। তিন চারদিন থাকবে বাবা মায়ের সাথে। হৃদির একটু নার্ভাস লাগছিল। শ্বশুরমশাইয়ের সাথে গত এক মাস তার নিয়মিত ফোনালাপ হলেও সামনাসামনি কথোপকথন এই প্রথম। লোকটা আন্তরিক এ কথা সত্য, কিন্তু কেমন একটা রাশভারি ব্যাপার আছে ইনার মাঝে। চট করে সহজ হওয়া যায় না। শাশুড়ির ভাবসাব সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শ্বশুর মশাইয়ের আগমন শাশুড়ির মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। বরং অন্যান্য দিনের চাইতে তাকে আরো বেশি গোমড়ামুখো দেখাচ্ছে। এদের দুজনের ভেতরে কি কোনো কলহ বিবাদ চলছে নাকি? হঠাৎ করেই মনে হলো হৃদির কথাটা। তবে ভালো লাগছে সামিকে দেখে। পুরো একটা মাস পর বাবাকে পেয়ে সে খুশিতে একদম বাকবাকুম হয়ে গেছে। হৃদি শ্বশুরের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর প্লেটে এটা সেটা তুলে দিচ্ছিল। হক সাহেব এক পর্যায়ে বাধা দিয়ে বললেন, 

—‘তুমি বসো মা। তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না।’ 

হৃদি ভালো মতোই জানে তার এসব করার কোনো প্রয়োজন নেই। না করলে ইনারা কিছুই মনে করবেন না। তাছাড়া খাবার সার্ভ করার জন্য চাকরবাকর তো আছেই। তবুও প্রথম দিনটায় শ্বশুরকে এতটুকু সম্মান না করে পারল না সে। নিজের মাকে দেখেছে দাদাসাহেব বাড়ি আসলে মা কী ভীষণভাবে যত্নআত্তি করতেন। মায়ের কাছে থেকেই একটু একটু শিখেছে এসব ভদ্রতা। রোমেলা হৃদির এই আদিখ্যেতা দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের এই এক সমস্যা। মুখে অবলা অবলা একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে সেবা করার ছলে বাড়ির কর্তাব্যক্তিদের সিম্প্যাথি পেতে চায় এরা। টিপিক্যাল খ্যাৎ মেন্টালিটি যত্তসব! 

—‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন ঘাড়ের ওপর? এসব করার জন্য কাজের লোক আছে তো!’ 

হৃদির মুখে মুহূর্তে একটা মেদুর রঙের ছায়া পড়ল। সামি একবার মায়ের দিকে তাকালো চমক লাগা চোখে। মায়ের কথার ধরনটা যেন একটু কেমন খটোমটো। এত শক্ত কথা বলার মতো কোনো ঘটনা তো ঘটেনি! অপ্রস্তুতভাবে সরে আসলো হৃদি জায়গাটা থেকে। মুখ কালো করে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো সামির পাশে। 

হক সাহেব রাতে ইদানিং তেমন কিছুই খান না। দুখানা রুটি আর একটু সবজি হলেই তাঁর চলে যায়। তবে এতদিন বাড়ির বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে মুখে একদম অরুচি ধরে গিয়েছিল। আজকে তাই তিনি প্লেটে একটু তরকারিসহ ভাত তুলে নিয়েছেন। খেতে খেতে হৃদিকে প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর, কেমন লাগছে তোমার সব?’ 

হৃদি হাসল, ‘এইতো বাবা, খুব ভালো।’ 

রোমেলা চোখ কপালে তুললেন। কী কাণ্ড! বাবা ডাকটাও রপ্ত করা হয়ে গেছে এর মধ্যেই? কই, আজ পর্যন্ত তাকে তো কেউ মা বলে সম্বোধন করল না। এদিকে যে বাবা বাবা ডেকে একেবারে মাথায় চড়ে বসবার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এই লোকটাও বা এত আশকারা দিচ্ছে কেন মেয়েটাকে? বিরক্তিতে গা চিড়চিড় করে ওঠে তার। সত্য বলতে কী, তার স্বামী জীবনে যত উন্নতিই করুক না কেন, যত বড় মানুষই হোক না কেন, একটা ভীষণ রকমের গেঁয়োপনার বীজ এখনো রয়ে গেছে এর ভেতরে। ব্রটআপ ঢাকা শহরে হলে কী হবে? গ্রামের বাড়ির সাথে এর যোগাযোগ সর্বদাই অক্ষুণ্ণ ছিল। রোমেলার নিজের বাবা মা ছিলেন বিহারী। ঢাকায় ছিল তার পৈতৃক নিবাস। বাবা বড় চাকরি করতেন। ছোট বেলা থেকে বাড়ি ভর্তি কাজের লোক দেখে অভ্যস্থ তারা। নিজের মা এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খেতেন না। সব ভাইবোনরা পড়তেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। জীবন যাত্রার ধরনে, চলাফেরায় দারুণ একটা আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল সর্বদা। অন্যদিকে তার স্বামী ছেলেবেলায় খুব একটা জাঁকজমক জীবনে অভ্যস্থ ছিলেন না। রোমেলার শ্বশুরমশাই পেশায় ডাক্তার ছিলেন। ডাক্তারি করে ঢাকা শহরে একটা বাড়ি করতে পেরেছিলেন কোনো রকমে। স্বচ্ছলতা ছিল কিন্তু প্রাচুর্য ছিল না। এ কারণেই তার স্বামীর ভেতরে কোথায় যেন একটা মধ্যবিত্ত ভাবপ্রবণতা রয়ে গেছে এখনো। ভাবতে ভাবতে বিরক্তিতে নাক কুঁচকে যায় রোমেলার। আজ যদি এই মেয়েটির পরিবর্তে তানিশা বাড়ির বৌ হয়ে আসত… আহারে তানিশা মেয়েটাকে বড়ই পছন্দ ছিল। তানিশার পরিবারের সাথেও খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গিয়েছিল তার। বিয়েটা হয়ে গেলে দুপরিবারে আনন্দের ধুম পড়ে যেত একেবারে। কত প্ল্যান করে রেখেছিলেন তিনি এবং তানিশার মা দুজনে মিলে! সব জলে গেলো। ভাগ্যে ধরল না! তার স্বামী গদগদ হয়ে ছেলের বৌয়ের সাথে গল্প করছেন। লোকটাকে কি আজকাল ঘেন্না হয় একটু একটু? বিশেষ করে সেই ঘটনাটা জানার পর থেকে? রোমেলার মতো সুন্দরী, স্মার্ট, বড় ঘরের মেয়ে সহধর্মিণী হিসেবে পাবার পরেও যে লোক পরনারীতে আসক্ত হয় সে লোককে ঘেন্না না করে কি উপায় আছে? রোমেলা কেন? জগতের প্রতিটা মানুষই এই জঘন্যতম অপরাধীকে ঘেন্না করবে। এতকাল মানুষটার সচ্চরিত্র স্বভাবটাকে তিনি মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন। হ্যাঁ মনের হদিশ কখনো পাননি ঠিকই কিন্তু এতটুকু জেনে অন্তত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেন যে তার স্বামীর চরিত্রে কোনো দাগ নেই। কিন্তু শেষমেশ… ছিঃ! 

—‘তোমার বাবা মা কেমন আছেন?’ 

—‘ভালো আছেন আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ট্যুর কেমন ছিল বাবা?’

—‘ভালোই।’ 

কিছুক্ষণের মধ্যে বাবা ছেলের ব্যবসায়িক আলাপ বেশ জমে গেলো। সামি বাবার সাথে এর আগে কখনোই এত এত গুরুত্বপূর্ণ কথা একসাথে বলেনি, আজ যতটা বলল। রুদ্র চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। সামনে বসা ভদ্রলোকটিকে তার ইদানিং একেবারেই সহ্য হয় না। আগেও যে খুব একটা হতো তা না। তবে ইদানিং কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিরক্তির পরিমাণটা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। 

আচমকা ডোরবেল বাজল। যে চাকরটা আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল সে দৌড়ে ছুটে গেলো দরজা খুলতে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল এক আগন্তুক। আগন্তুককে সবার প্রথমে সামিই দেখল। গালভর্তি হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো সে, ‘আরে দোস্ত! তুই কোত্থেকে?’

হৃদি চমক লাগা চোখ মেলে চেয়ে দেখল অমৃতাকে। দেখামাত্র কী কারণে যেন তার চোখের তারায় অতর্কিতে এক টুকরো বিরক্তির ছায়া পড়ল। সামির মতো ঝলমলে আনন্দে ভাসতে পারল না সে। অভ্যর্থনাও জানাতে পারল না। গুমোট চোখে চেয়ে রইল শুধু সদ্য আগত বান্ধবীর দিকে। 

—‘এইতো, রুদ্রকে দেখতে আসলাম। ও নাকি চিটাগাং যাচ্ছে আজকে রাতে?’ বলল অমৃতা। মুখে যা-ই বলুক না কেন রুদ্র আর হৃদিতা সহজেই অমৃতার এই অসময়ে সামির বাড়িতে আসার প্রকৃত কারণটা ধরতে পারল। বান্ধবীর আগমনে সামি ছাড়া অন্য কাউকেই খুব একটা প্রফুল্ল হতে দেখা গেলো না। রোমেলার মুখখানা আগের চাইতেও বেশি থমথমে হয়ে গেলো। হৃদি বিচলিত। রুদ্র ভাবলেশহীন। 

—‘বসে পড়। ভাত খা।’ সামি বলল, সহাস্যে। 

অমৃতা রুদ্রর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল, ‘নারে খাব না কিছু।’ পলক তুলে তাকালো একবার মানুষটার দিকে। অমৃতার ঠিক মুখোমুখি চেয়ারটাতেই তিনি বসা। গায়ে হালকা বাদামি রঙের ফতুয়া। মুখে কয়েকদিনের দাড়ি। গভীর চোখজোড়ায় কেমন যেন বিষণ্ণতা। মুখে অবিচল গাম্ভীর্য। এই গাম্ভীর্যটাই কি ব্যক্তিত্ব? নাকি চার্ম? কে জানে! ছেলের সাথে কথা বলতে বলতেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন। মেয়েটিকে দেখেও না দেখার ভান করলেন প্রথমটায়। কিন্তু ভান আর কতক্ষণ ধরে থাকা যায়? একটা সময় চোখে চোখ পড়েই গেলো। অমৃতার পরনে সাদা রঙের ফুলহাতা শার্ট। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। বয়কাট চুল বাম দিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো। মনে হচ্ছে মেয়েটার চুলের ধরনে একটু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা তার সৌন্দর্য কমায়নি কোনো অংশেই। ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রুযুগলের নিচের চোখদুটি ক্লান্ত। আরক্ত মুখ। দৃষ্টির আলিঙ্গনে মুখে কোনো কথা না বলেই নিমেষে অনেক কথা বলে ফেলল দুই জোড়া চোখ। কেউ জানল না, কেউ দেখল না। 

—‘তুই কোর্ট থেকে আসলি?’ রুদ্র প্রশ্ন করল অমৃতাকে। অমৃতা কথাটা শুনতে পায়নি। তার চোখ সম্মুখে নিবদ্ধ। মুখে একটা চঞ্চল ভাব। শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। রুদ্র অবাক চোখে একবার দেখল অমৃতাকে। এই অমৃতাকে যেন সে চেনে না। 

—‘এই, রুদ্র কী বলল শুনিস নাই?’ অমৃতার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে উঠল হৃদি। 

—‘হ্যাঁ? কী?’ 

—‘কিছু না।’ রুদ্র বলল, ম্লান গলায়। 

রোমেলা খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন খুব দ্রুত। এই বাড়িতে তার অপছন্দের মানুষদের উপস্থিতি দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। নিজের সংসারটাকে আজকাল পরের জায়গা বলে মনে হয়। তিনি উঠে যাবার খানিক পর রুদ্রও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হক সাহেব ছেলে আর ছেলের বৌয়ের সাথে আরো খানিকটা সময় গল্প করলেন। ব্যবসা, আমেরিকা ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা হলো। অমৃতা চুপচাপ শুনছিল। কোনো কথা না বলে লোকটার কথা শুনে যেতেই ভালো লাগছিল তার। হৃদি অমৃতার মুখের চকচকে ভাবটা লক্ষ্য করছিল অনেকক্ষণ ধরে। খাবার টেবিল থেকে সবাই একটু দূরে সরে যেতেই সে চাপা গলায় বলল, ‘অমৃতা, এদিকে আয় তোর সাথে আমার কথা আছে।’ 

—‘কী কথা?’ 

—‘আয় আমার সাথে।’ 

হৃদির পেছন পেছন ডাইনিং ছেড়ে বেরিয়ে আসলো অমৃতা। ড্রইংরুমে এসে দেয়ালে লাগানো বাতির সুইচ টিপল হৃদি। ঝলমল করে জ্বলে উঠল সিলিং এ ঝোলা ফুলের মতো বিশাল বড় ঝাড়বাতি। হৃদি ঘরের মাঝখানে কার্পেটের ওপর দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে ঝগড়াটে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, 

—‘কেন আসছিস?’ হৃদির খটোমটো প্রশ্নটা অমৃতাকে চমকে দিল।

–‘মানে কী?’ 

—‘মানে তুই এই অসময়ে কেন আসছিস এখানে?’ কাটা কাটা গলায় শব্দগুলো উচ্চারণ করল হৃদি। অমৃতা বিস্ময় নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল বান্ধবীর দিকে। তার মুখের চকচকে ভাবটায় হঠাৎ কোত্থেকে যেন উড়ে এসে ভর করল এক নিচ্ছিদ্র মলিনতা। 

—‘কেন আসছি মানে? আমার বন্ধুর বাসায় আমি আসতে পারব না? আসার জন্যে কারণ লাগবে নাকি?’ 

হৃদির মুখটা বিরক্তিতে একদম কাদা কাদা হয়ে গেলো, ‘অমৃতা শোন, আমি খুব ভালো মতো জানি তুই কেন আসছিস এখানে এই অসময়ে। তুই মোটেও রুদ্রর সাথে দেখা করতে আসিস নাই। তুই আসছিস আমার শ্বশুররে দেখতে।’ 

অমৃতা চোখ নামায় নিচে। অপ্রতিভভাবে বলে, ‘হুম।’ 

—‘কীসের হুম? হুম মানে কী? তুই কেন এসব করতেছিস? তোর কি একটু ভয় হয় না? আর কাউরে ভয় না পাইলেও আল্লাহকে ভয় কর। অন্যের জীবন এভাবে বরবাদ করিস না।’ 

এ কথায় অমৃতার চোখজোড়া জ্বলে উঠল ধক করে। 

—‘মানে কী? আমি কি কাউরে খুন করতেছি নাকি? ভালোবাসায় কোনো পাপ নাই। আর উনি যদি উনার ওয়াইফকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করে তাহলেও কোনো পাপ থাকবে না।’ 

হৃদি একদম আঁতকে উঠল কথাটা শুনে, ‘হায় হায় শেষ পর্যন্ত তুই আমার শাশুড়ি হতে চাচ্ছিস? এসব কী বলতেছিস? ডিভোর্স দিবে কেন?’ 

—‘দিতেই পারে। ডিভোর্স হয় না মানুষের? নাকি যাদের ডিভোর্স হয় তারা সবাই খুব খারাপ মানুষ? হ্যাঁ? তোদের এইসব নিয়মকানুন আমি বুঝি না। একটা মানুষকে পছন্দ না হইলেও তার সাথে আজীবন এক ছাদের নিচে কাটায় দিতে হবে?’ 

হৃদি চোখ সরু করে সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘পছন্দ না হইলেও মানে? আমার শ্বশুর কি তোকে বলছেন যে উনার ওয়াইফকে উনি পছন্দ করেন না?’ 

—‘সব কিছু বলতে হয় না হৃদি। বোঝা যায়।’ 

—‘আর এই চান্সে তুই খুব এন্ট্রি মারলি অন্যের লাইফে? ছিঃ অমৃতা! ছিঃ 

—‘এত ছিঃ ছিঃ করিস না। অন্যের লাইফে এন্ট্রি নেয়ার কিছু নাই। ওই লোকটার সাথে আমার মেন্টাল একটা ব্যাপার আছে। মনের সম্পর্ক। এগুলোর উপর মানুষের হাত নাই।’ 

হৃদি অধৈর্যভাবে বলল, ‘তোর মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। সবাই তোকে ধিক্কার দিবে। থুতু দিবে তোর মুখে। এত হেট্ৰেড নিয়ে তুই বেঁচে থাকতে পারবি? জীবন তছনছ হয়ে যাবে তোর! 

—‘কে থুতু দিবে? তুই?’ 

—‘আমি কেন? সমাজের মানুষ।’ 

অমৃতার গলা থেকে শ্লেষ ঝরে পড়ল, ‘সমাজের মানুষ আমারে খাওয়ায় না পড়ায়?’ 

—‘তোর নিজের বাবা মার কথা চিন্তা কর।’ 

—‘আমার বাবা মা আমি ম্যানেজ করব। তোকে চিন্তা করতে হবে না।’

—‘আচ্ছা? বেশ তো, সামিকে কীভাবে ম্যানেজ করবি শুনি?’ অমৃতা একটু থমকায়। চোখের পর্দায় অসহায় ভাব ফুটে ওঠে ক্ষণিকের জন্য।

—‘সামি কি বুঝবে না ব্যাপারটা? বিভার বিয়ের পর কি রাত জেগে জেগে সে বিভার সাথে ফোনে কথা বলে নাই? বিভাকে নিয়ে পালায় যাওয়ার প্ল্যান করে নাই? বিভা কি তখন অন্যের বৌ ছিল না? তুই কি ভরা মজলিশে সামিকে সবার সামনে আই লাভ ইউ বলিস নাই? তখন কোথায় ছিল তোদের এত মরালিটি? কোথায় ছিল সোসাইটি?’ 

—‘আমাদেরটা টোটালি ডিফারেন্ট কেস ছিল।’ 

—‘পৃথিবীতে সব কেসই ডিফারেন্ট। আমাদের প্রত্যেকের লাইফের স্টোরি আলাদা। মিল শুধু একটা জায়গায়ই যে আমরা সবাই মানুষ। ফর গড সেক হৃদি একটা বার তুই এই বাড়ির বৌ হিসেবে না ভেবে আমার বন্ধু হিসেবে ভেবে দ্যাখ।’ 

—‘বন্ধু হিসেবেই বলতেছি, তুই ভুল করতেছিস। সামি কখনোই নিজের বাবার গার্লফ্রেন্ড হিসেবে তোকে মেনে নেবে না।’ 

—‘উফ আল্লাহ! মেনে নিবে না তা তো আমি জানি। এই জন্যেই তো ওরে কিছু জানাইতে চাই না। লোকটার সাথে দুইটা কথা বলে যদি আমি শান্তি পাই তাহলে বাল তোদের এত লাগে ক্যান?’ 

—‘এর মানে সারাজীবন তুই ওরে ঠকায় যাবি? তুই তোর বন্ধুরে ঠকাবি? 

অমৃতাকে বিভ্রান্ত দেখায়, ‘জানি না! 

—‘জানার চেষ্টা কর।’ 

—‘আমি কিছুই জানি না দোস্ত। শুধু জানি যে সামি আমার বন্ধু। ও আমাকে ক্ষমা করবে।’ 

হৃদি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তোর লজ্জা লাগে না?’ 

একটা বড় শ্বাস পড়ল অমৃতার, ‘না, লজ্জা লাগে না। আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি হৃদি! লজ্জা দিয়ে জীবন চলে না!’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *