বৃষ্টিমহল ৩.৭০

৭০

বন্ধুরা ছাড়াও সামিদের বাড়িতে আজ বিকেলে আরো কিছু অতিথি আসবেন। রোমেলার বান্ধবী। প্রায় উইকেন্ডেই এদের কারো না কারো বাসায় কিটি পার্টি থাকে। প্রত্যেকেই ধনাঢ্য লোকের বৌ। তানিশার আম্মাও একসময় এই দলেরই একজন ছিলেন। বিয়ে সংক্রান্ত অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে যাবার পর থেকে রোমেলা তানিশার মাকে এড়িয়ে চলেন। আজকের দাওয়াতে তানিশার মা বাদে অন্য সবাই আসবেন। সব মিলিয়ে আট ন’জন। প্রথমবারের মতো বাড়ির বৌয়ের মুখ দর্শন করবে তারা। রোমেলা ডাইনিং এ বসে কয়েকজন চাকরবাকরকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তার ছোট বোন একটু দূরে দাঁড়িয়ে কফি মেশিনে কফি বানাচ্ছে। কফির সুন্দর গন্ধে ছেয়ে গেছে ঘর। কফির সাথে আছে সদ্য বেক করা কুকি। কুকি বেক করছে লিজা। কদিন আগে ইউটিউব দেখে রেসিপিটা শিখেছে সে। ঘড়িতে বিকেল চারটা। আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই অতিথিরা চলে আসবে। খুব একটা সময় নেই হাতে। সদর দরজায় কেউ একজন এসেছে বলে মনে হলো। কলিং বেল বেজে ওঠার আগেই হৃদিকে দেখা গেলো দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতে। ডাইনিং এর দরজার ফাঁকে চোখ রেখে রোমেলা দেখলেন, বয়কাট চুলের মেয়েটা এসেছে। তিনি গলা উঁচিয়ে পুত্রবধূকে ডাকলেন একবার, ‘এই শোনো!’ 

হৃদি শাশুড়ির ডাক শুনে ডাইনিংএ আসলো। পেছন পেছন আসলো অমৃতাও। 

—‘একটু পরে আমার কিছু গেস্ট আসবে। তুমি তৈরি হয়ে থেকো।

—‘তৈরি… মানে শাড়ি পরতে হবে?’ একটু বোকা বোকা শোনালো হৃদির কণ্ঠস্বর। 

—‘ভালো কিছু পরলেই হবে। একটু ক্লাসি ড্রেসআপ করো। মিডল ক্লাস লুক নিয়ে থেকো না দয়া করে।’ 

চট করে অমৃতার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। হৃদি কিছু বলার আগেই সে ক্যাটক্যাট করে বলে বসল, ‘মিডল ক্লাস লুক বলতে আপনি কী বোঝালেন?’ 

 রোমেলার চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেলো অমৃতার প্রশ্ন শুনে।

—‘কী?’ শাশুড়ির হুংকারটা একদম বুকে গিয়ে লাগল হৃদির। সে অমৃতার একটা হাত টেনে ধরে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘চল, উপরে চল। সবাই ওয়েইট করতেছে।’ 

অমৃতা যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে রোমেলার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আপনার ছেলে তো হৃদির মিডল ক্লাস লুক দেখেই প্রেমে পড়ল .. আপার ক্লাস লুক আপনার ছেলের পছন্দ না!… ‘শেষের কথাগুলো পরিষ্কারভাবে শুনতে পেলেন না রোমেলা। যতটুকু শুনলেন তাতেই তাঁর কানে তালা লাগার জোগাড়। সারা শরীর রাগে ঝাঁঝাঁ করে উঠল। ছোট বোন এবং কাজের লোকদের সামনে বেশ বিব্রত বোধ করলেন তিনি। এই মেয়ের এত বড় স্পর্ধা! মুখের ওপর কথা বলে! মেয়েটার বেশি বাড় বেড়েছে। সুযোগ পেলেই বড় বড় নীতিবাক্য ঝাড়তে আসে। থাপ্পড়টার কথা কি ভুলে গেছে এই বেহায়া মেয়ে? 

সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় হৃদি চাপা গর্জনের সাথে অমৃতাকে বলল, ‘তোর সমস্যা কী? তুই এত কথা বলিস কেন?’ 

—‘তোর সমস্যা কী? তুই একে কিছু বলিস না কেন? এই মহিলা যা তা কথা বলতে থাকবে আর তুই চুপ করে শুনে যাবি? তোর বাপ মা তোরে লেখাপড়া করাইছে এই বেটির খোঁটা শোনার জন্য?’ 

—‘উফ আল্লাহ! অমৃতা তুই কবে বুঝবি যে বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে হয় না? উনি আমার শাশুড়ি। আমি তো উনার সাথে ঝগড়া করতে পারব না।’ 

—‘ঝগড়া করবি কেন? ঠান্ডা মাথায় উচিত কথা শোনায় দিবি।’ 

হৃদি হঠাৎ মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশপাশটা একবার দেখে নিয়ে, গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমার জামাই তো মায়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে নারাজ।’ 

অমৃতা ভীষণ বিরক্ত হলো, ‘এটাই কি স্বাভাবিক না? তুই গাধার মতো ওরে কেন বলতে গেছিস?’ 

—‘তো কারে বলব?’ 

—‘নিজেকেই প্রোটেস্ট করতে হবে হৃদি! ছেলেকে মায়ের বিরুদ্ধে উসকে দেবার তো কোনো মানে হয় না। কিছু খারাপ লাগলে সরাসরি মুখের ওপর বলে না দিয়ে, আড়ালে কূটনামি করিস কেন?’ 

হৃদি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, ‘আরে রাখ তোর সরাসরি বলা। আড়ালে শাশুড়ির নামে কূটনামি করার মধ্যে আলাদা মজা আছে। তুই বুঝবি না। সব মেয়েরাই করে। এসব করতে হয়।’ 

—‘পিয়ার প্রেশার?’ 

হৃদি হাসল, ‘হ্যাঁ, পিয়ার প্রেশার।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘তুই এরকম শুকায় গেছিস ক্যান?’ 

অমৃতা নিজের গালে একটা হাত রেখে একটু আনমনা গলায় বলল, ‘শুকাইছি?’ 

—‘হ্যাঁ তো, অনেক শুকাইছিস। কাহিনি কী? বিরহ নাকি? 

অমৃতার মুখে ছায়া পড়ল, ‘উনি কেমন আছেন?’ 

—‘ভালো আছেন। তোর সাথে যোগাযোগ হয়নি এর মাঝে?’ 

—‘নাহ!’ একটা বড় শ্বাস পড়ল অমৃতার 

—‘ভালোই করেছিস। কথাটথা অত বলার দরকার নাই দোস্ত। এত দিনের সংসার। তোর জন্য ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কোনো গণ্ডগোল লেগে যায়?’ 

অমৃতা হৃদির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের সম্পর্কটা এমনিতেও খুব একটা মজবুত বলে আমার মনে হয় নায় কখনো।’ 

—‘কী বলতেছিস?’ হৃদির মুখটা হঠাৎ আতঙ্কে সাদা হয়ে উঠল 

অমৃতা একবার চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে খুব আস্তে করে বলল, ‘বোঝা যায় না? বোঝা যায় তো!’ 

—‘কী দেখে বুঝলি তুই?’ 

—‘বুঝে নিয়েছি। আমার বুদ্ধি আছে।’ 

হৃদি সরু চোখে তাকায় অমৃতার দিকে, ‘হিংসা থেকে বলতেছিস এসব, তাই না?’ 

—‘আল্লাহ! দোস্ত সিরিয়াসলি আমি হিংসা থেকে কিছু বলতেছি না। উনাদের দেখে যেটা মনে হইছে সেটাই বলতেছি।’ 

—‘ইশ… আই ফিল ব্যাড ফর সামি।’ ভীষণ আহত গলায় বলল হৃদি। 

—‘ব্যাড ফিল করার কিছু নাই। ওয়ার্ল্ডের এইটি পার্সেন্ট ম্যারেজ কাপলই আনহ্যাপি। যাদেরকে দেখে হ্যাপি মনে হয় তাদের মধ্যেও ম্যাক্সিমাম ফেইক। কিছু আছে জেনুইন। সেই সংখ্যা কম। লিসেন দোস্ত, তোর মা বাবার ভেতরে যদি ভালো সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে তুই লাকি এর উল্টোটা হলে ইউ আর জাস্ট অর্ডিনারি।’ 

—‘মানে কী?’ 

—‘চাইনিজ বলি নাই তো, আজিব। তোর আব্বা আম্মার মধ্যে যদি প্রেম থাকে, ভালোবাসা থাকে তাহলে তুই ভাগ্যবতী আর উনাদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা না থাকলে, মনের মিল না থাকলে তুই সাধারণ। সাধারণ হওয়ার মধ্যে অত দুঃখ কীসের?’ 

—‘তুই একটা পাগল।’ নাক মুখ কুঁচকে বলে হৃদি। 

অমৃতা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল, ‘সত্য বললে মুরুব্বিরা বলে বেয়াদব আর সমবয়সিরা বলে পাগল। এই হইল দুনিয়া! 

ছাদের ওপর চৈত্র বিকেলের হলুদ রোদ থৈথৈ করছে। পুল সাইডে তিন বন্ধু বসে ছিল চেয়ার পেতে। তিনজনের সামনে একটি খালি টুলের ওপর সামির অ্যাপল ম্যাকবুক প্রো রাখা। স্ক্রিনে বিভার মুখ ভেসে আছে। দুই বান্ধবীকে সে-ই দেখল প্রথমে। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘ওই ছেমড়ি তোদের এতক্ষণ লাগে আসতে? কই গেছিলি?’ 

—‘হৃদির শাশুড়ি ডাক দিছিল।’ বলল অমৃতা। ওরা কাছাকাছি আসতেই রুদ্র আচমকা এক জোরালো ধাক্কা দিয়ে অমৃতাকে টুপ করে ফেলে দিল সুইমিংপুলের পানিতে। বুক পর্যন্ত পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে, ‘কুত্তার বাচ্চা, বান্দরের বাচ্চা’ বলে গালি দিতে লাগল সে রুদ্রকে। তারপর পুলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রর ঠ্যাং ধরে দিল এক হ্যাঁচকা টান। ঝপাং করে পড়ল রুদ্র পানিতে। 

বিভা হঠাৎ আর্তনাদ করে বাকি তিন বন্ধুকে বলে উঠল, ‘এই তোরা কেউ নামবি না সুইমিংপুলে। খবরদার!’ 

—‘কেন?’ হৃদির অবাক প্রশ্ন। 

—‘কারণ আমি নামতে পারব না। ভিডিও কলের ভিতর দিয়ে আমি সুইমিংপুলে নামব ক্যামনে? হিংসা হচ্ছে আমার!’ 

সামি সল্যুশন দিল, ‘তুই মোবাইলটা নিয়া জলঢাকা ব্যারেজে চইলা যা। তারপর নদীতে নাইমা ফোন দিস। আমরাও পানিতে, তুইও পানিতে। কাটাকাটি হয়ে যাবে।’ 

কথাটা শেষ করে সামিও নামল পানিতে। আকাশ বিভার কাঁচুমাচু মুখটার দিকে চেয়ে বলল, ‘ডোন্ট ওরি। আমি আছি এখানে তোর সাথে।’ 

—‘আমিও আছি।’ বলল হৃদি। 

—‘এই তোদের হানিমুন কেমন কাটলরে?’ বিভা প্রশ্ন করল। 

হানিমুনের প্রসঙ্গ উঠতেই হৃদির মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলমল করে উঠল। 

—‘অসাম দোস্ত, অসাম! বালি অনেক সুন্দর জানিস? উফ আমার লাইফের বেস্ট চারটা দিন ছিল।’ 

ওদিকে সুইমিংপুলে রুদ্রকে ধরে বেঁধে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তখন। রোজই সে জলে নেমে দাপাদাপি করে, কিন্তু সাঁতার শেখা আর হয়ে ওঠে না। পানির ওপর শরীরের ভার ছাড়তে গেলেই তাকে রাজ্যের যত ভয় পেয়ে বসে। কিন্তু আজকে অমৃতা আর সামি ওকে সাঁতার শিখিয়েই ছাড়বে বলে ঠিক করেছে। দুজনে দুদিক থেকে চেপে ধরে তাকে জলের ওপর শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রুদ্র চেঁচাচ্ছে প্রাণপনে। হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। সামি মুখ উঁচিয়ে আকাশকে ডাকল, ‘এই এসহোলের বাচ্চা! দাঁড়ায় আছস ক্যান? আয় এইদিকে হাত লাগা।’ 

রুদ্র হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, ‘দাঁড়া দাঁড়া। একটু সময় দে আমাকে। প্লিজ একটু দাঁড়া।’ 

অমৃতা রুদ্রর কাঁধে চেপে রাখা হাতের মুঠো একটু শিথিল করল, ‘দাঁড়ায়েই তো আছি।’ 

—‘শোন, এভাবে তো হবে না। সাঁতার শিখতে পারি আমি এক শর্তে।’

—‘কীয়ের শর্ত?’ বিরক্তি নিয়ে বলে সামি। 

রুদ্র কপালের ওপর থেকে ভেজা চুল সরিয়ে, চোখ পিটপিট করে দ্রুত কী যেন ভাবে। গলা খাঁকারি দেয় কয়েকবার, সাবধানী গলায় বলে, ‘তোদেরকে কুইজ ধরব, যদি উত্তর দিতে পারিস তাহলে আমি সাঁতার শিখব।’ 

—‘এত ভীতু! আল্লাহ! কোনো কুইজটুইজ হবে না।’ বিভা বলল ম্যাকবুকের পর্দায় উঁকি দিয়ে। 

—‘তোরা ভীতু। জীবনেও একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিস না।’ অমৃতা আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘মিথ্যা বলবি না, আমি বলতে পারছিলাম না? এক অক্ষর দিয়ে আকাশের প্রতিশব্দ? 

—‘অকে ফাইন। এইবার যদি বলতে পারিস তাহলে আমি সাঁতার শিখব। ডিল।’ 

—‘আরে না ওসব হবে না।’ সামি ঘোষণা দিল, দৃঢ় গলায়। ফোড়ন কাটল হৃদি ‘আচ্ছা শুনি, ওই কী প্রশ্ন করতে চায়।’ 

রুদ্র বুঝি বল পেল একটু হৃদির কথা শুনে। জোর দিয়ে বলল, ‘কী বলিস তোরা? প্রশ্ন করব? নাকি ডরাইতেছিস?’ 

—‘আরে কর কর।’ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে অমৃতা। 

—‘আচ্ছা বল দেখি পরশু দিনের ইংলিশ কী?’ 

আকাশ খিকখিক করে হেসে উঠল, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হইল? এ তো সবাই জানে। ডে আফটার টুমরো!’ 

—‘জি না। হয় নাই। পরশুদিন ইংলিশ হলো ওভারমরো। সাঁতার আজকে শেখা ইচ্ছে না তাহলে। বাই বাই।’ কথাটা বলেই তড়িঘড়ি করে পুল থেকে উঠে আসার পায়তারা শুরু করল রুদ্র। সামি এবার এক ধাক্কায় শুইয়ে দিল ওকে পানিতে। মুখে বলল, ‘তোর কুইজের গুষ্টি কিলাই। সাঁতার তোকে আজকে শিখতেই হবে। এই ধর ব্যাটারে সবাই!’ 

৭১

সামি গাড়ি করে সব বন্ধুদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল সেই রাতে। চলে আসবার সময় অমৃতার মনটা কী ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো! ও বাড়িতে গেলেই এখন মানুষটাকে এক নজর দেখতে ইচ্ছে করে। দুদিন পর পরীক্ষা। পড়তে ভালো লাগছিল না। একটা ইমেইল অ্যাড্রেস আছে তার কাছে। কয়েকদিন ধরেই ভাবছে ইমেইল করে দেখবে কিনা। করবে কি? নাহ… প্রমিজ করেছিল যে, ভুলে যাবে! 

বেঁচে থাকাটা এত কষ্টের কেন? অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে টুপ করে মরে গেলেই কিন্তু বেশ হয়। সমস্ত সমস্যার একটা সমাধানের পথ তো সর্বদাই খোলা। মৃত্যু! মৃত্যুর চেয়ে সহজ সমাধান আর কী আছে? 

মানুষটা নিষ্ঠুর! একটা বার জানতে চাইল না অমৃতা কেমন আছে। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। চুলোয় যাক! অমৃতা কেন ইমেইল করবে? কোনোদিন করবে না। এত সস্তা না! 

রাত বাড়ে। ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে সিঁটিয়ে থাকা সুপুরুষ মানুষটার ছবির দিকে অপলক চেয়ে থাকে অমৃতা। ওরকম বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না একটা ফোঁটাও। মনে হয় ছবির মানুষটা তার নিজেরই মানুষ। একদম আপন মানুষ… সবচেয়ে কাছের মানুষ! 

বোকা মেয়ে! নিজেকে নিজে ভর্ৎসনা দিয়ে ওঠে একসময়। মন লাগে না আইনের ধারায়। মাথা চিড়বিড় চিড়বিড় করে। পড়া টড়া ঢোকে না কিছুই। স্নায়বিক চাপ অনুভব করে সে। মনটাকে বশে আনার জন্য মধ্যরাতে ঘরের মেঝেতে ইয়োগা ম্যাট বিছিয়ে যোগাসনে বসে পড়ে। সারা বাড়ি ঘুমন্ত। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু মাথার ওপর শব্দ করে ঘুরছে তিন পাখার ফ্যান। ধুর ছাই… উফ!… হঠাৎ যোগাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। কেমন যেন কান্না পায়। হাত পা কাঁপতে থাকে। ল্যাপটপ টেনে নিয়ে বালিশের ওপর রাখে। উপুড় হয়ে শোয় বিছানায়। চট করে টাইপ করে একটা লাইন। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট ঠিকানায়।। যদি উত্তর না আসে… অমৃতা আর ভাবতে পারে না। 

নিউইয়র্কে তখন ভরদুপুর। জ্যামাইকার স্থানীয় একটি স্কুলে আজ পার্টির সভা আছে। মিটিং শুরু হওয়ার কথা তিনটার সময়। রাশেদ নিউইয়র্কে এসে উঠেছেন এক পুরোনো বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে। বন্ধুর সাথেই বেরোচ্ছিলেন মিটিং এর উদ্দেশ্যে। হঠাৎ টুং করে শব্দ হলো মোবাইলে। একটা ইমেইল এসেছে। ইমেইল অ্যাড্রেস দেখেই তিনি চিনতে পারলেন প্রেরককে। একটা হার্টবিট মিস করলেন অকস্মাৎ। বন্ধুর পাশে গাড়িতে উঠে বসে মেইলটা ওপেন করলেন। অমৃতা লিখেছে, ‘রাশেদ! কেমন আছেন একটা বার যদি বলতেন!’ 

ম্যাজিকের মতো কী যেন একটা ঘটে গেলো। এহেন ম্যাজিকের অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে এই প্রথম! তপ্ত রোদ ঝলসানো ভর দুপুরবেলায় এক ঝলক স্নিগ্ধ হাওয়া উড়ে এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো তাঁকে। এতদিনের ক্লান্তি, অবসাদ, একাকিত্ব, সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল সেই জাদুকরী হাওয়া। বুকের ভেতর ঝুপ করে নেমে আসলো এক অনির্বচনীয় শান্তি! গ্রীষ্মের উত্তপ্ত ঘাম ঝরানো দুপুরটা আচমকা মিষ্টি বনে গেলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন তিনি গাড়ির ভেতর। কী আশ্চর্য! তবে কি মনে মনে এই বার্তাটিরই অপেক্ষা ছিল এতদিন? কে জানে! কে বোঝে! এই অনুভূতি যে সমস্ত জানা বোঝার ওপরে, সমস্ত স্থূল বোধ বুদ্ধির বাইরে… সম্পূর্ণ অলৌকিক কিছু! 

মোবাইলের কী প্যাডে আঙুল চলে গেলো। কেউ একজন ডাক দিল ভেতর থেকে। 

‘তোমার স্ত্রী এবং সন্তান আছে। ভুলে যেও না! 

আঙুল থেমে গেলো। গড়ালো কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর আবার নড়ে উঠল হাত। কত দিন কথা হয় না! কেমন আছে মেয়েটা? 

ভেতরের মানুষটা ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল ‘মেয়েটা তোমার ছেলের বন্ধু! ছিঃ! শেষ পর্যন্ত…?’ 

একটা ইমেইলের রিপ্লাই করলে, খুব বড় কোনো অন্যায় হবে না। ভেতরের মানুষটাকে খুব কড়া করে শাসন করলেন তিনি। এভাবেই বিবেক হেরে গেলো বাসনার কাছে। প্রতিরোধের দেয়াল ভেঙে গেলো অনুভূতির উষ্ণ জোয়ারে! 

‘আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?’ তিনি লিখলেন ইংরেজিতে। মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ কোথাও বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করা নেই। 

ইমেইলটা টুং করে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতেই আনন্দে কেঁদে ফেলল অমৃতা। উঠে বসে বালিশের ওপর থেকে ল্যাপটপটা কোলে তুলে নিল। হাত কাঁপছে তার। বুক করছে ধড়ফড়। আহ, শান্তি! শান্তি! শান্তি! 

রাশেদ, 

একুশ দিন কেটে গেলো। আমার কথা একবারও মনে পড়ল না? 

অমৃতা, 

গতকাল শপিংমলে একটা চেরি পিঙ্ক রঙের জামা পরা পুতুলকে দেখেই তোমার কথা মনে পড়ল। একটা পুতুলকে দেখে আরেকটা পুতুলকে মনে পড়ল আর কি! তুমি কেমন আছ? বললে না তো! 

অমৃতা লিখল, 

আমি এখন ভালো আছি। দুদিন পর হাইকোর্টের এম সি কিউ পরীক্ষা কিচ্ছু পড়া হচ্ছে না। আপনার কথা বলুন। কোথায় আছেন? কাদের সাথে আছেন? কী করছেন? কী খাচ্ছেন? খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে! 

৭২

—‘কি? রেডি?’ 

প্রশ্নটা শোনামাত্র তারা ঘুরে তাকালো চমক লাগা ডগডগে চোখে। আকাশ দাঁড়িয়ে আছে দরজার চৌকাঠে, পকেটে হাত রেখে, সামান্য বাঁকা ভঙ্গিতে। তারা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কানে দুল পরছিল। আকাশের আকস্মিক আবির্ভাব তাকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করে তুলল। সে ঘাড় নেড়ে আলতো গলায় বলল, ‘জি। রেডি।’ 

মেয়েটাকে কি আজ সুন্দর লাগছে? আকাশ পর্যবেক্ষক চোখ নিয়ে তারার দিকে তাকিয়ে ছিল। ইট রঙের কামিজ। কানে মুক্তোর দুল। কাঁধের ওপর ঝুলছে হৃষ্টপুষ্ট লম্বা বেণী। বেশ একটা সতেজ এবং পরিপাটি ভাব। মুখটা একটু ভরলে… আর মোটা কাচের চশমাটা না থাকলে… ওকে কিন্তু দারুণ দেখাতো! কিন্তু খানিক বাদে, মনীষা যখন আকাশী সিল্ক শাড়ি আর খোলা চুলে ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, তারার সতেজ ভাবটা নিমেষে কেমন যেন মিইয়ে গেলো। মনীষার ওই বশীকরণ রূপ দেখামাত্র আকাশের দুচোখের তারায় একটা গাঢ় রকমের মুগ্ধতা খেলা করে গেলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষী তারা আকাশের সেই চোখের তারার অব্যক্ত সম্মোহন খুব ভালো মতোই উপলব্ধি করল। একটা ছায়া পড়ল ওর চোখে। বুকের ঘোলাটে কোণ থেকে ছিটকে পড়ল এক অনিচ্ছাকৃত দীর্ঘ শ্বাস। মনীষা সত্য, অনেক বেশি সুন্দর! 

ঝুমকি যাবার জন্য তৈরি হয়েও শেষমেশ শরীর খারাপের জন্য যেতে পারল না। কদিন যাবৎ থেকে থেকে তার পেটে একটা ব্যথা হচ্ছে। টানাটানির সংসারে ডাক্তার বদ্যি দেখানো বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। ব্যথা বাড়লেও আকাশকে সে ব্যাপারটা জানাতে চাইছে না আপাতত। তার পতিদেবকে তো কিছু বলা আর না বলা একই কথা। পুরো সংসারের দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে ওই একরত্তি ছেলে আকাশের ওপর। 

কাছাকাছি একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আসলো ওরা। মনীষা সঙ্গে আছে বিধায় রুদ্রকেও আসবার জন্য বলে রেখেছিল আকাশ। রুদ্র সাথে করে একটা কেক নিয়ে এসেছে। আসা মাত্র কেকের বাক্স তারার মুখের সামনে রেখে সে দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে!’ 

তারা এসব শৌখিনতায় একেবারেই অভ্যস্থ না। কেক উপহার পেয়ে সে খুশি তো প্রকাশ করতে পারলই না, উপরন্তু ভীষণ রকম অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কুঁকড়ে যাওয়া মুখে একবার তাকালো আকাশের দিকে। যেন কেক উপহার পাওয়া একটা গুরুতর অপরাধ। রুদ্র দাঁত বের করা হাসিটা বর্ষণ করতে করতেই বলল, ‘এত মন খারাপ করার কিছু নাই। কেকে আমরা কেউ ভাগ বসাব না। পুরাটাই তোমার।’ ওর বলার ঢঙে হেসে ফেলল মনীষা। রুদ্র এবার রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারিতে মনীষাকে দেখল পূর্ণ নজর মেলে। চেয়ার টেনে বসল আকাশের পাশে, মুখে বলল, ‘আপনার শাড়ির রংটা খুব সুন্দর।’ 

মনীষা আপ্লুত হলো, ‘আকাশী আমার প্রিয় রং।’

—‘উঁহু, এটা আকাশী নয়। এই কালারের নাম টিল।’ 

—‘ওই একই কথা।’ পানিভর্তি ঝকঝকে পরিষ্কার কাচের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে মনীষা। রুদ্র সজোরে ঘাড় নাড়ে, ‘নাহ, একই কথা নয়। দুটো আলাদা রং।’

—‘এই রংকে আমি আকাশীই বলি।’ 

সাদা ফুল হাত শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা গম্ভীর মুখো মোচ ওয়ালা ওয়েটার এসে খাবারের মেনু দিয়ে গেলো। আকাশ তারাকে বলল, ‘কী বার্থডে গার্ল? কী খাবেন?’ 

তারা এতক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। ভারি আড়ষ্টতা কাজ করছে তার ভেতর। এই প্রশ্নে শুনে সে আরো বেশি মিইয়ে গেলো যেন। বুকের সাথে চিবুক মিশিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে মেনুটা হাতে তুলে নিল। অস্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করল খাবারের তালিকায়। রুদ্র স্মার্ট গলায় বলল, ‘তুমি ফ্রাইড টমটম খেয়েছ কখনো?’ 

তারা মেনু থেকে চোখ না তুলেই নেতানো গলায় বলল, ‘না, খাইনি।’

—‘এটা আবার কী খাবার!’ মনীষা বিস্মিত। 

আকাশ তেরছা চোখে রুদ্রকে দেখল। মিটমিটে হাসি নিয়ে রুদ্র তারার দিকে চেয়ে আছে। মিটমিটে হাসিটাই প্রমাণ, যে এই মুহূর্তে তার মাথায় কোনো দুষ্টুবুদ্ধি খেলছে। 

—‘ফ্রাইড টমটম খাওনি? ভীষণ মজা! না খেলে চরম মিস! ইউ শ্যুড ট্রাই!’ 

তারা পরীক্ষার পড়া পড়বার মতো মনোযোগের সাথে মেনু দেখতে দেখতে বাধ্য গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’ 

মোটামুটি সব কিছু অর্ডার দেওয়া হয়ে গেলে আকাশ বলল, ‘বার্থডে গার্লের কোনো পছন্দের খাবার আছে কি?’ 

তারা সাদা ফরমাল শার্ট পরা ওয়েটারকে প্রশ্ন করল, ‘ফ্রাইড টমটম আছে আপনাদের?’ 

গম্ভীরমুখো মোচওয়ালা ওয়েটারের মুখখানা আরো দ্বিগুণ গম্ভীর হয়ে গেলো। সে থমথমে গলায় বলল, ‘টমটম মানে? টমেটো?’ 

—‘না টমেটো না, টমটম।’ তারা বলল আত্মবিশ্বাসী গলায়। 

গম্ভীরমুখো কিছুক্ষণ চোখের পালক নেড়েচেড়ে ব্রেইনস্টর্ম করল বুঝি। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে পাথুরে গলায় বলল, ‘জি না। এই জিনিসের নামই শুনি নাই কখনো।’ 

রুদ্র তখন অনেক কষ্টে হাসি সামলাচ্ছে। হাসছে আকাশও। মনীষা রুদ্রকে একটা ধমক দিয়ে উঠে বলল, ‘বাচ্চা মেয়েটাকে কেন শুধু শুধু এমন বোকা বানাচ্ছ তোমরা?’ 

মনীষার কথায় বিষয়টি পরিষ্কার হলো তারার কাছে। বুঝতে পেরেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল সে। চাইনিজ টাইনিজ খাবার অভিজ্ঞতা তার একেবারে নেই বললেই চলে। সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কেউ যে এহেন অপমান করে বসতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি কখনো। রাগে এবং অপমানে চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হলো। আকাশ ওর মনের অবস্থা খানিকটা আঁচ করতে পেরেই বুঝি বলে উঠল, ‘রুদ্রর কাজই হচ্ছে কারণে অকারণে ফাইজলামি করা। তুমি মাইন্ড করো না। তোমার পছন্দের কোনো আইটেম থাকলে অর্ডার দিয়ে দাও।’ 

তারা অর্ধনিমীলিত চোখে বলল, ‘আমার কোনো চয়েজ নেই। আপনারা যা অর্ডার করেছেন তাতেই হবে। 

ওয়েটার চলে যাবার পর আকাশ রুদ্রর পেটে একটা গুঁতা মেরে বলল, ‘এই তুই এসব দুষ্টামি করার আর জায়গা পাস না? বাচ্চা একটা মানুষকে নিয়ে ফান করতেছিস ক্যান?’ 

রুদ্র জিব কেটে বলল, ‘ও বাচ্চা মানুষ নাকি? বয়স কত? কোন ক্লাসে পড়ে? ক্লাস টু নাকি থ্রি?’ 

তারা অবনত মুখেই চোখের পাঁপড়ি তুলে দেখল মুখোমুখি বসে থাকা হালকা পাতলা ছেলেটাকে। লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলো টেনেটুনে ঝুঁটি বাঁধা। চোখের মণির রং ধূসর, বেড়ালের মতো। তামাটে গায়ের রং। গালে এবড়োখেবড়ো দাড়ি। ছাই রঙের টি শার্ট। খুব একটা ইম্প্রেসিভ চেহারা নয়। তবে লম্বা ধাঁচের মুখখানায় একটা মায়া মায়া সরল ভাব আছে। আর সবচেয়ে অন্যরকম যে ব্যাপারটা, তা হলো ছেলেটি কথা বলে ভীষণ আমুদে গলায়। ভয়েস শুনলেই মনে হয় যেন কমেডি শো চলছে। কেউ কেউ হয়তো বলবে খুব মন ভালো করা কণ্ঠস্বর। কিন্তু এই মন ভালো করা কণ্ঠস্বর তারার আজ মহাবিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে বিরক্তিকর ছেলেটা এখানে উপস্থিত হয়ে আজেবাজে কথা বলে নিছক পরিবেশ নষ্ট করছে। সে ভ্রু কুঁচকে, ভাঙচুর হওয়া মুখ নিয়ে পাথরের মতো বসে রইল। এই রগচটা ভাব দেখে অবশ্য রুদ্র টিটকিরি মারতে ভুলল না, ‘ভাই, কোথাও কি এমন কোনো নিয়ম লেখা আছে নাকি যে জন্মদিনের দিন হাসা যাবে না? স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকতে হবে?’ 

—‘উফ, চুপ কর তো!’ আকাশ চাপা গলায় ধমক দিল রুদ্রকে। 

—‘আমার ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। আমার ছেলে চাইনিজ ফুড খুব পছন্দ করে।’ মনীষা বলল, আক্ষেপের সুরে। 

রুদ্র তারাকে আড়চোখে দেখছিল। মেয়েটা এমন কেন? মানে প্রব্লেমটা কী? কোনো অফেন্সিভ কথা বলে ফেলেছে কি সে? যার কারণে এমন কটমটে চেহারা বানিয়ে রাখতে হবে? ভাবল জন্মদিনের দিন একটু কৌতুক করে বিনোদন দিবে। তা না, উল্টো ক্ষেপে গিয়ে বোম! আজিব দুনিয়া! 

—‘রাইয়ান দেশে আসবে কবে?’ একটু আনমনাভাবে প্রশ্ন করল রুদ্র।

—‘এইতো আগামী মাসেই ওদের সামার ভ্যাকেশন স্টার্ট হচ্ছে।’

—‘ও তাহলে তো খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে আপনার ছেলের সাথে।’ যোগ করল আকাশ। 

মনীষা তারার রুক্ষ মেজাজটা একটু মসৃণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলল, ‘তারা, আপু জন্মদিনে কী উপহার দেই তোমাকে, বল তো?’ 

তারা অনেকক্ষণ পর একটু হাসার চেষ্টা করল, ‘কিছু দিতে হবে না আপু। সময় দিচ্ছেন, এটাই যথেষ্ট। অনেক থ্যাংকস আপনাকে। 

রুদ্র একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল, ‘ভাই, কেউ কেউ শুধু সময় দিয়াই থ্যাংকস পায়। তাও আবার একটা না, দুইটা না, অনেকগুলা থ্যাংকস। আর কেউ কেউ সময়ের সাথে টাকা খরচ কইরা কেক নিয়া আসলেও থ্যাংকস পায় না। আল্লাহর দুনিয়ায় কি সুবিচার বলতে কিছু নাই?’ 

মনীষা আর আকাশ হো হো করে হেসে উঠল রুদ্রর কথা শুনে। তারা কিন্তু হাসল না। মুখের গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখেই অনেক কষ্টে রুদ্রকে বলল, ‘কেকের জন্য থ্যাংকস।’ 

খাবার আসার আগেই কেক কাটা হলো। সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটল ওদের। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ একটু সহজ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে রুদ্রর ওপর জমে থাকা বরফের মতো রাগটা তার গলছিল না কিছুতেই। 

বাড়ি ফেরার সময় মনীষা আর তারা এক রিকশায় উঠল। রিকশা ছাড়ার আগ মুহূর্তে তারা গলা উঁচিয়ে রুদ্রকে বলল, ‘আমাদের বাসায় এসেন। সত্যিকারের ফ্রাইড টমটম খাওয়াব আপনাকে।’ 

—‘ফ্রাইড টমটম একটা বিশেষ খাবার। সবাই রান্না করতে পারে না। তুমিও পারবা না।’ কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারল না রুদ্র। তার আগেই রিকশা টুংটুং ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে চলল সামনে। 

রুদ্রকে কিছুদূর এগিয়ে দিল আকাশ। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিএনজি খুঁজছিল ওরা। হঠাৎ করেই আকাশ বলল, ‘মনীষাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল আজকে। তাই না?’ 

—‘হুম ওকে সবসময়ই সুন্দর দেখতে।’ বলে একটু থমকালো রুদ্র। সরু চোখে বন্ধুর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুই কি মনীষার উপর ক্রাশ খাইছিস?’ 

—‘আরে নাহ!’ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিল আকাশ। 

—‘মনে হচ্ছে খাইছিস।’ রুদ্র হাসে। 

—‘আজাইরা কথা বলিস না।’ 

—‘আজাইরা কথা না দোস্ত, আমি তোরে চিনি।’ 

আকাশ রুদ্রর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বলতো! 

—‘কী কথা?’ 

—‘মনীষা নাকি অমৃতা?’ 

—‘এটা কেমন প্রশ্ন?’ 

—‘কথা বাড়াইস না। জাস্ট নাম বল একটা।’ 

রুদ্রর খুব একটা সময় লাগল না উত্তরটা দিতে, ‘অমৃতা।’ 

খালি সিএনজি পাওয়া গেলো। উঠে বসার আগে রুদ্র আকাশকে প্ৰশ্ন 

করল, ‘হঠাৎ এটা জানতে চাইলি কেন?’ 

—‘এমনি!’ আকাশ উত্তর করল, দায়সারাভাবে। 

রাতে বাড়ি ফেরার পর ডাইনিং এ তারার সাথে দেখা হয়ে গেলো। তারা বুঝি আকাশের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাইয়া, থ্যাংক ইউ। আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জন্মদিন ছিল। এর আগে এত ঘটা করে আমার জন্মদিন কখনোই পালন করা হয়নি।’ 

আকাশ মৃদু হেসে বলেছিল, ‘ইউ আর ওয়েলকাম।’ 

কেন যেন মনটা ভালো হয়ে গেলো তার। এ পৃথিবীতে কিছু মানুষকে কত অল্পতে সন্তুষ্ট করা যায়! আবার কিছু মানুষকে নিজের কলিজা কেটে হাতে তুলে দেবার পরেও সন্তুষ্টির স অক্ষরটাও লাভ করা যায় না। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া মানুষগুলোকে তার সব সময়ই বড় বেশি ভালো লাগে! তারা মেয়েটা… আসলে খুব ভালো একটা মেয়ে। বড় দুঃখী মেয়েটা। বেচারী! অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছে। আকাশও তো মা হারিয়েছে সেই কত্ত আগে! সে নিজেও বেশ দুঃখী একটা মানুষ। তারারই মতো! 

৭৩

অমৃতা, 

নিউইয়র্কে এসে উঠেছি আমার এক ছেলেবেলার বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে। বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী। ওদের দুটি সন্তান এখানকার মিডল স্কুলে পড়ে। এই মুহূর্তে ফ্ল্যাটে আমি একা। বাসার সবাই যার যার কাজে বেরিয়ে গেছে। তিনতলার ঝুল বারান্দায় বসে তোমাকে লিখছি। এখন দুপুর। আকাশ ঝকঝকে নীল। তেজহীন রোদে ফুরফুরে বাতাস। চোখের সামনেই একটা বিশাল বড় রেড মেপললিফ গাছ ডালপালা ছড়িয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুঘু ডাকছে আশেপাশে কোথাও। টেম্পারেচার খুব বেশি না। উনিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হবে। আমার ল্যাপটপে বাংলা ফন্ট ছিল না। তোমাকে লিখব বলে অভ্র ডাউনলোড করলাম। বাংলায় খুব একটা লেখা হয় না আজকাল। দীর্ঘ বিরতির পর নিজের ভাষায়, নিজের অক্ষরে কিছু লিখতে পেরে বেশ তৃপ্তি বোধ হচ্ছে। 

ম্যানহাটনের একটা হোটেলে রুম বুকিং দেওয়া ছিল। যেহেতু সরকারি প্রজেক্ট নিয়ে আসা, তাই সরকার এসব সুযোগ সুবিধা প্রোভাইড করতে কার্পণ্য বোধ করেনি। কিন্তু এ যাত্রায় নিজের জন্য বরাদ্দ প্রিভিলেজটুকু গ্রহণ করতে পারলাম না। বন্ধুর অনুরোধটিই রাখতে হলো। এই অ্যাপার্টমেন্টে একটা সময় আমরা টানা চারমাস অবস্থান করেছি। সে সময় গ্রিনকার্ড টিকিয়ে রাখার জন্য ছমাস অন্তর অন্তর নিয়ম করে ইউ এস এ আসতে হতো। পরবর্তীতে অবশ্য সংসদ সদস্য হবার লোভ সামলাতে না পেরে আমি আমেরিকার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলাম। এমনিতেও পরের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাস করার মাঝে আমি কোনো কৃতিত্ব খুঁজে পাই না। যত আরাম আয়েশই এখানে থাকুক না কেন, পরভূমি কখনো স্বভূমি হয়ে ওঠে না। বিদেশে আসলেই স্বদেশের জন্য আমার মনটা আরো বেশি করে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই চাকচিক্য এবং বিশুদ্ধ বাতাস আমাকে ক্ষণে ক্ষণে নিজের দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজেদের ব্যর্থতা এবং খুঁতগুলো চোখের সামনে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। মনে হয় দেশের মানুষগুলোর জন্য আমার আরো অনেককিছু করা বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু চাইলেই কি আর সব পারা যায়? যে প্রশাসনের শেকড়েই পচন ধরে গেছে, সে প্রশাসনের ডালপালা যত সতেজই হোক না কেন, ফল কিন্তু পুষ্টিকর হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। এছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলোতে বর্ণবাদ মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। ঢুকবেই বা না কেন বল? খুব ছোট বেলায় এদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে সাদা চামড়ার যীশুখ্রিষ্ট হলো গড (প্রকৃত যীশু কিন্তু ব্রাউন ছিলেন) অতএব কালো কিংবা বাদামি চামড়ার লোকেরা সহজাতভাবেই গডের স্বগোত্রীয় হবার যোগ্যতা রাখে না। এই সাদা চামড়ার যীশুখ্রিস্টর মাধ্যমেই রেসিজমের সবচেয়ে বড় ভিত্তিটা গড়া হয়েছিল। 

অনেকদিন আগের একটি দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। তখন সামি ছোট। বয়স বারো কি তেরো হবে। এই নেইবারহুডেরই একটি গাছের গুড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ে গিয়েছিল আমার ছেলে। হাঁটু ছিলে গিয়ে কী এক রক্তারক্তি কাণ্ড! রক্ত দেখে ছেলে আমার ফেইন্ট হয়ে গেলো। তুমি হয়তো জানো সামির হিমোফোবিয়া আছে। ও রক্ত সহ্য করতে পারে না। ছেলের দুর্দশা দেখে আমার স্ত্রীর হাতে পায়ে কাঁপুনি ধরে গেলো। তাৎক্ষণিকভাবে নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলাম। সামির হাঁটুতে সেই আঘাতের দাগটা অনেকদিন অবধি রয়ে গিয়েছিল। এখনও আছে কিনা সঠিক জানি না! দুপুরে খাবার দাওয়াত ছিল তিন জায়গায়। শরীর খারাপের এক্সকিউজ দেখিয়ে সব কটাই ডিনাই করে দিলাম। বিকেলে এখানকার একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে যেতে হবে। বাংলাদেশ থেকে একদল ডাক্তার এসেছে প্রশিক্ষণে। এই প্রশিক্ষণটি আমাদের প্রজেক্টের আন্ডারে পড়েছে। সে যাই হোক, কাজের কথা থাক। কাজ নিয়ে খুব বেশি ভাবব না বলে মনস্থির করেছি আজ। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ভেতরে ভেতরে কেমন একটু ক্লান্ত বোধ করছি আমি। মানুষের জীবনে ক্লান্তি কোনো নিয়ম মেনে আসে না। কেউ কাজ করে ক্লান্ত হয়, কেউ বা আবার কর্মহীন অবস্থায় অলস দিন কাটিয়ে ক্লান্ত হয়। আমি কিন্তু কখনোই কাজ করে ক্লান্ত হইনি। কাজ আমার নেশা। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম বেশ কিছুদিন ধরে একটা নিরবিচ্ছিন্ন ক্লান্তি বোধ আমাকে প্রচণ্ডভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী? এক কবি বলেছিলেন (নামটা ভুলে গেছি, তুমি একটু গুগল করে দেখো তো) ভ্যারাইটি ইজ দ্যা স্পাইস অব লাইফ, দ্যাট গিভস ইট অল ইটস ফ্লেভার। কবি সত্যই বলেছিলেন। বৈচিত্র্যহীন জীবন মানুষকে একঘেয়ে করে তোলে। একইভাবে জীবনযাপন করতে করতে একসময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে অবসাদ নেমে আসে। কিন্তু চাইলেই তো কারো জীবনে দফায় দফায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। মানুষ দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের আশায় যে কোন ধরনের পরিবর্তন কামনা করে। আমার ছোট চাচা জীবনের একটা সময়ে নিদারুণ অর্থ কষ্টের স্বীকার হয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রায়ই বলতেন মানুষ হয়ে জন্মানোর চেয়ে বড় কষ্ট আর নাই। এর চেয়ে গাছ হয়ে বা তেলাপোকা হয়ে জন্ম নিলেও ঢের ভালো ছিল। সত্যই কি তাই? গাছ হয়ে বা পোকা হয়ে জন্ম নিলেই কি আমাদের এই এক জন্মের জ্বালা যন্ত্রণা সব মিটে যেত? তুমি কি ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটা পড়েছ? এ গল্পের মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে পোকা হিসেবে আবিষ্কার করে। সে তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। ছিল একমাত্র নির্ভরতার স্থান। পারিবারিক সদস্যদের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে গ্রেগর এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিল। আকস্মিক পোকায় রূপান্তর হওয়াটা তাই তার যান্ত্রিক একঘেয়ে জীবন থেকে একধরনের নিষ্কৃতি ছিল। কিন্তু সেই নিষ্কৃতি তাকে কোনোভাবেই বিবেকের দংশন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। শারীরিকভাবে পোকা বনে যাবার পরেও মনের দিক থেকে গ্রেগর মানুষই ছিল। পোকা হয়েও মানুষ জন্মের দায় তার মিটল না। ধীরে ধীরে সে পোকার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলোর কাছে হয়ে ওঠে চক্ষুশূল। তারা পোকা গ্রেগরের ওপর এতই অতিষ্ট হয়ে উঠল যে একটা সময় তার মৃত্যু কামনা করতেও পিছপা হলো না। না পড়ে থাকলে গল্পটা পড়ে নিও। রূপান্তর গ্রেগরকে প্রকৃত অর্থে মুক্তি দিতে পারেনি। আমাদের আশেপাশে কিছু মানুষ আছে যারা বাহ্যিকভাবে মনুষ্য জীবনযাপন করলেও তাদের ভেতরকার অবস্থা পোকা জীবনের চাইতেও করুণ। তাদের শারীরিক নয়, মানসিক রূপান্তর হওয়া অতীব জরুরি। 

আসলেই কি কোনো ধরনের রূপান্তর বা পরিবর্তন মানুষকে সত্যিকারের মুক্তি দিতে পারে? মৃত্যু কি মানুষকে মুক্তি দিতে পারে? মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশ করে। সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে মৃত্যুও কিন্তু এক ধরনের মেটামরফোসিস! 

আবোলতাবোল বকতে গিয়ে আসল কথা থেকে সরে গেছি। আমার ক্লান্তির কারণ নিয়ে কথা বলছিলাম। কদিন ধরে ভেতর থেকে কেউ একজন ছুটি চাই, ছুটি চাই বলে দাবি জানিয়ে আসছে। এটা কি বয়সের দোষ? হতে পারে। হয়তো এবার সত্যই ছুটি নেবার সময় এসে গেছে। কিন্তু এখনো যে অনেক কাজ বাকি। কাজগুলো শেষ করবার আগে ছুটি যে আমি কোনো ভাবেই নিতে পারব না! তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। এসব ভারি কথা তোমার কেমন লাগছে জানি না। তবে কোনো এক আশ্চর্য কারণে তোমার ওপর আমার এই ভরসা জন্মে গেছে যে, আমার বলা কথাগুলো অন্য কেউ না বুঝলেও, তুমি অন্তত বুঝবে। আমার মনে পড়ে না শেষবার আমি কার সাথে এতটা মন খুলে কথা বলেছি। বহুদিন আগে আমার একজন জার্মান পেনফ্রেন্ড ছিল। প্রায় দেড়বছর যাবৎ আমরা পত্র আদান প্রদান করেছি। আজ এতগুলো বছর পর তোমাকে একটা আবোল তাবোল কথা সম্বলিত দীর্ঘ চিঠি লিখে ফেললাম। আমি আমার জীবনের বেশ কিছু সময় শুধু অন্যের কথা চিন্তা করেই কাজ করে গেছি। বেঁচে থেকেছি বাবা মায়ের জন্য, সংসারের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। আজ হঠাৎ এই কুড়িয়ে পাওয়া অলস দুপুরবেলাটায় তোমাকে লিখতে বসে মনে হলো যেন অনেক অনেক দিন পর শুধু নিজের জন্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারলাম। তোমাকে ধন্যবাদ। আমাকে নিজের মতো করে কিছু সময় কাটাবার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আজকে অবশ্য আরেকটি কারণেও আমার মনটা বিশেষ ভালো। আজ প্রথমবারের মতো আমার বৌমা আমাকে ‘বাবা’ বলে ডেকেছে। মনে হলো আমি যেন নতুন করে একটি কন্যাসন্তান লাভ করলাম জীবনের এই শেষ বেলায় এসে। আমার একটি মেয়ের খুব শখ ছিল। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যদি কখনো আমার মেয়ে হয়, তবে তার নাম রাখব রিমঝিম। সামি জন্মাবার দুবছর পর রিমঝিম মায়ের পেটে এসেছিল বটে। তবে এ পৃথিবীর আলো দেখবার সৌভাগ্য তার হয়ে ওঠেনি। 

তুমি বলেছিলে হাইকোর্টের পরীক্ষা চলে এসেছে কিন্তু প্রিপারেশন খুব একটা ভালো না। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমান প্রেসিডেন্টের সাথে আমার খুব ভালো জানাশোনা আছে। তুমি চাইলে, পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড না করেও তোমাকে পাশ করিয়ে দেওয়া যাবে। সেরকম কোনো প্রয়োজন হলে বলো আমাকে। যদিও তোমাকে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছে তুমি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে পাশ করতে কখনোই চাইবে না। ভালো থেকো। 

ইতি, রাশেদ 

পুনশ্চ : একটা প্রশ্ন কিছুদিন ধরেই মনে উঁকি দিচ্ছে। অমৃতা, আমার প্রতি তোমার এই তীব্র আকর্ষণের কারণ কী? 

৭৪

রাশেদের ইমেইল অমৃতার মোবাইলে কড়া নাড়ল গভীর রাতে। অমৃতা তখন ঘুম। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ইমেইলটা পেল সে। এত হুড়োহুড়ি করে বাসা থেকে বের হতে হলো যে মেইল পড়বার সুযোগ আর হয়ে উঠল না। পড়তে পারল পাবলিক বাসের বুক চাপা ভিড়ে, চৈত্র সকালের শ্বাসরুদ্ধকর গরমে। পড়তে পড়তে বাসের ভেতরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা বেমালুম ভুলে গেলো। মুচকি হাসিতে তার পাতলা ঠোঁট কমলার কোয়ার মতো গেলো বেঁকে। ভিড়ের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক লোক সুযোগ বুঝে তার কোমর ছুঁয়ে দিয়েছিল। অন্যদিন হলে সে হাতটা মুচড়ে দিত তাৎক্ষণিকভাবে। আজ সেরকম কিছুই করল না। মুখের হাসিটা সঙ্গে নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে অতি বিনয়ের সাথে বলল, ‘প্লিজ, গায়ে হাত দিয়েন না।’ বিনয়ের বাহার দেখে লোকটা একটু বোকা বনে গেলো। অপ্রস্তুতভাবে সরিয়ে নিল হাত। তারপর… পাখনাবিহীন পাখি হয়ে উড়তে লাগল অমৃতা মনে মনে। ইংলিশ রোডের খর রোদ্দুরময় ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ঢুকে গেলো রেড মেপললিফের রং, ঘুঘুর ডাক আর ফুরফুরে হাওয়া। চেম্বারে সিনিয়রের সামনে বসে মামলার ডিকটেশন লিখতে গিয়ে তার মুখে লেগে রইল হাসি। সিনিয়র গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘হাসছ কেন? ‘ 

সে মাথা নুইয়ে ফেলল। জবাব দিতে পারল না। 

সন্ধ্যায় ফিরে এসে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে, চটপট বসে পড়ল ল্যাপটপ নিয়ে। 

প্রিয় রাশেদ, 

মাত্র বাড়ি ফিরলাম। ঢাকা শহরের জ্যামের অবস্থা তো আপনার জানাই আছে। তার ওপর আমাকে আসা যাওয়া করতে হয় বাসে করে। রোজ দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। শুরুতেই আপনাকে একটা কথা বলে নিই যে, আপনি খুব গুছিয়ে চিঠি লিখেছেন। এত সুন্দর চিঠি এর আগে আমি কোনোদিন কারো কাছ থেকে পাইনি। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করছে সেই তখন থেকে। আপনার জার্মান পেনফ্রেন্ডটি কি নারী ছিল? নাকি পুরুষ? 

হৃদি আপনাকে বাবা ডেকেছে শুনে খুব খুশি হলাম। আমার বন্ধুগুলো অত্যন্ত উদার এবং নরম মনের অধিকারী। আপনার ছেলের মনটাও যে কত বড় সে বিষয়ে আপনার ধারণা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমরা প্রায়ই ভাবতাম এমন অহংকারী বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হয়ে সামিটা অমন মাটির মানুষ হয় কী করে? (ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এভাবে কথাটা লিখে ফেলার জন্য) এখন আমি খুব করে বুঝি যে সামি আসলে তার বাবার মতোই হয়েছে। উদার এবং মহৎ। অহংকার জিনিসটা আপনার মধ্যে ছিটেফোঁটা থাকলেও আমাদের সামির মাঝে একেবারেই নেই। আর হৃদি হচ্ছে বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইমোশনাল। সবচেয়ে কঠিন এবং আবেগহীন হলাম আমি। সাবালিকা হওয়ার পর থেকে আমি কান্না কী জিনিস ভুলেই গিয়েছিলাম। এই এত বছর পরে এসে আজকাল একটু কান্নাটানা করি। তবুও সেই কান্না শুধু একজন বিশেষ মানুষেরই জন্য। অদ্ভুত ব্যাপারটা, তাই না? 

হৃদির কথা বলছিলাম। ও সত্য খুব ভালো মেয়ে। আপনি ভাগ্যবান যে এমন একটি সাদা মনের মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়েছেন। 

হাইকোর্টের পরীক্ষায় আপনার সাহায্যটুকু আমি নিতে পারছি না বলে দুঃখ প্রকাশ করছি। চান্স না পেলে নেই। কিন্তু আইনের ছাত্রী হয়ে এমন দুর্নীতির আশ্রয় আমি কিছুতেই নিতে পারব না। 

প্রবাসে গিয়ে নিজের দেশকে আরো বেশি করে মনে পড়ার বিষয়টি জানতে পেরে আপনার প্রতি আমার সম্মান আরো অনেকখানি বেড়ে গেছে। আপনার মতো দেশ প্রেমিক লোক আমাদের দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত বিরল। যারা থাকেন তাদেরও আমরা খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না। আপনাকে নিয়ে তাই আমার বড়ই দুশ্চিন্তা হয়। কিন্তু আপনার মতো করে তৃতীয় বিশ্বের খুব কম সংখ্যক লোকেই চিন্তা করে। বেশির ভাগ মানুষ বিদেশের মাটিতে পা রাখার পর দেশকে ভুলে যাবার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। নিজ দেশের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। আমার এক মামাতো ভাইয়ের ছ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার এক স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন হয়ে গেলো। মামার কাফরুলে একটি তিনতলা বাড়ি ছিল। ছেলের পড়াশোনার খরচ জোটানোর জন্য মামা বাড়িটি দিলেন বিক্রি করে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালো। সেই যে গেলো আর ফেরার নাম নেই। পাশ করে সে এখন ভালো চাকরি পেয়েছে। দুহাতে টাকা কামায়। কিন্তু যে বাবা একদিন সন্তানের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেননি সেই বাবাকে একটা কানা কড়িও সে দেয় না। বৈদেশিক উচ্চশিক্ষা আমার মামাতো ভাইয়ের মননে এবং মস্তিষ্কে প্রকৃত শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করতে পারেনি। যে উচ্চশিক্ষার জন্য বাবা মায়ের এমন উচ্চতর ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং যে উচ্চশিক্ষা নিজের দেশকে, উৎসকে, সংস্কৃতিকে ঘেন্না করতে শেখায়, সে উচ্চশিক্ষা আমাদের কারো জীবনেই কাম্য নয়। আমার বাবার এক বন্ধুর মেয়ে কয়েক বছর আগে বিয়ে করে কানাডায় সেটেল্ড হলো। আমাদের চেয়ে বছর চারেকের বড় হবে। খুবই মিশুক প্রকৃতির একটি মেয়ে। কদিন আগে ফোনে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, বেশ কিছুদিন হলো সে বাংলাদেশীদের সঙ্গ বর্জন করেছে। কারণ বাংলাদেশীরা নাকি খুব নোজি হয়, ক্রিপি হয়। অন্যের জীবনে নাক গলানোর ব্যাপারে তাদের জুড়ি নেই। কথা সত্য। কিন্তু তার সিদ্ধান্তটা আমাকে অবাক করেছে। আচ্ছা আজকে যদি আপনার নিজের সন্তান বেয়াদব হয়, বাজে হয়, নেশাখোর হয়, তবে সেই সন্তানকে কি আপনি ত্যাগ করবেন? ঠিক একই ধরনের মনোভাব কি আমাদের স্বজাতির প্রতি ধারণ করা বাঞ্ছনীয় নয়? আমি আপুকে বলেছিলাম, আপু ডোন্ট লিভ দেম, ট্রাই টু এডজাস্ট। আপু উত্তরে আমাকে বলেছে, ‘এডজাস্ট করা ইম্পসিবল। এরা নাকি লো স্ট্যান্ডার্ড টিপিক্যাল বাঙালি ফ্যামিলি ‘ এ কথা সত্য যে শিক্ষা আমাদের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা রক্ষা করতে শেখায়। শিক্ষিত লোকমাত্রই জানে যে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর মতো চরম অভদ্রতা আর দ্বিতীয়টি নেই এ সমাজে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে শেখার কোনো বয়স নেই। আমার যা কিছু ভালো, যা কিছু মঙ্গলময় তা যদি আমি আমার নিজের মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেই না পারলাম তবে সেই ভালোত্বের মূল্য কী? 

আপনি আমেরিকায় বর্ণবাদ আছে বলে সমালোচনা করেছেন। আমাদের ভেতরে তো ডিফারেন্ট রেস নেই, কালার নেই, আমরা সব্বাই বাদামি। তবুও একই চামড়ার মানুষের ভেতরে এসব লো স্ট্যান্ডার্ড, হাই স্ট্যান্ডার্ড, মিডল ক্লাস, হাই ক্লাস কোত্থেকে আসে তা আমার বোধগম্য হয় না। 

বারে বারে বয়স নিয়ে কথা বলেন কেন? বয়স তো আপনাকে একটুও ছুঁতে পারেনি। এর মানে কি এই যে আপনার শারীরিক বয়স বাড়েনি কিন্তু মানসিক বয়স বেড়ে গেছে? লোকের তো শুনেছি উল্টোটা হয়! 

রিমঝিম নামটা আমার খুউব পছন্দ হয়েছে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমার (ফিউচার) মেয়ের নাম কি রিমঝিম রাখতে পারব? (আমি কখনোই বিয়ে করব না। দত্তক নেব এবং সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তান বড় করব) নাম রাখার বিষয়ে আপনার অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম। 

রাশেদ সাহেব, আপনাকে কেন ভালো লাগে সেই প্রশ্নের উত্তরটা গুছিয়ে লিখতে পারব কিনা জানি না। তবে যেহেতু আমি কখনোই মনের কথা মনে চেপে রাখতে ভালোবাসি না তাই রাখঢাক করে কিছু বলব না। যা বলার তা পরিষ্কার রুপেই বলব। আপনাকে একবার সামনাসামনি বলেছিলাম যে আপনার মতো সুপুরুষ আমি জীবনে আর একটিও দেখিনি। কথাটা শুনে আপনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। এতটাই রেগেছিলেন যে ঘর থেকে বের করে দিতেও দ্বিধা বোধ করেননি। যদিও এত রেগে যাবার মতো আদৌ কোনো কারণ ছিল কিনা তা নিয়ে আমার সংশয় আছে এখনো। সে যাকগে, আপনার প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা আছে, সেই শ্রদ্ধাটুকুই এই ভরসার যোগান দিচ্ছে যে আপনার রাগের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো যৌক্তিকতা ছিল। 

আপনাকে ভালো লাগার প্রথম কারণ হলো, আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় পুরুষ মানুষটি হলেন আপনি। এটা প্রশংসা নয়, এটা ফ্যাক্ট। আপনার কাছে নিশ্চয়ই এই বিষয়টি নতুন কিছু নয়। মেয়েদের চোখে আপনি হরহামেশাই নিজের জন্য মুগ্ধতা এবং আকর্ষণ অনুভব বা উপভোগ (!) করেন বলেই আমার ধারণা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করি। সেই সমতা শুধু অধিকারের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি স্তরেই প্রয়োগ করার মনোভাব পোষণ করি। সব মেয়েরাই চায় স্বামী বা প্রেমিক তার রূপের প্রশস্তি গেয়ে যাক, অথচ কানা কড়ি প্রশংসাও তারা তাদের পুরুষ সঙ্গীটির জন্য বরাদ্দ করতে নারাজ। প্রশংসা ব্যাপারটায় যেন শুধু মেয়েদেরই একচ্ছত্র অধিকার। আমি অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম যে যদি কখনো আমার কাউকে ভালো লাগে তবে আমার ভালোলাগার কথা, মনের ভাবের কথা সেই বিশেষ মানুষটিকে খুলে বলতে বা জানাতে বিন্দুমাত্রও সংকোচ বোধ করব না। কাউকে ভালো লাগার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কিন্তু আপনাকে ভালো লাগার কারণ শুধু বাহ্যিক রূপ নয়। আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার বাচনভঙ্গি, জীবন সম্পর্কে আপনার দর্শন, সততা, রুচিবোধ, শিক্ষা এই সমস্ত কিছু আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। আপনার সাথে কথা বলে এটা অন্তত বোঝা যায় যে, রাজনীতি এবং ব্যবসা ছাড়াও আপনার নিজস্ব পড়াশোনার বিস্তার অনেক এবং সবচেয়ে বড় কথা আপনার মতো সচ্চরিত্র পুরুষ মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। 

আমি দুঃখিত আপনাকে বন্ধুর বাবা হিসেবে দেখতে বা চিনতে পারিনি বলে। কোনো এক আশ্চর্য অজানা কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভাগ্যের প্রহসন ছাড়া এটাকে অন্য কিছুই বলব না আমি। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম আপনাকে (জানিনা আপনার মনে আছে কিনা, আছে কি?) সেদিন থেকেই আপনি আমার কাছে বন্ধুর বাবা না, সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ ছিলেন। 

ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটার কথা অনেক শুনেছি। পড়া হয়নি এখনো। আমি গল্প উপন্যাস তেমন পড়ি না। তবে গল্পটা এখন পড়ে নেব। ভ্যারাইটি ইজ দ্যা স্পাইস অফ লাইফ’ এই উক্তিটা কবি william cowper এর। গুগল তাই বলল। 

আমাকে আপনি খুব একটা পছন্দ না করলেও অপছন্দ যে করেন না তা আমি টের পাই। আমার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা তা এই মুহূর্তে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এই যে সবকিছু অকপটে বলে ফেললাম, এসব শোনার পরে আপনার কি আমাকে ঠুনকো মনে হচ্ছে? সস্তা মনে হচ্ছে? জানাবেন প্লিজ। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি, আপনার অমৃতা 

পি : এস : আজকাল আমারও ক্লান্ত লাগে। কেবলই মনে হয় পালাই পালাই। মুক্ত আকাশে সর্বদা বিচরণকারী এই আমারও ভীষণভাবে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে হঠাৎ হঠাৎ। আপনার কাছ থেকে পাওয়া এক টুকরো চিঠির মধ্যে, আর আমার লেখা এই কয়েক ছত্র লাইনের মধ্যে সেই বহু আরাধ্য মুক্তি যেন একটুখানি ঝলক দিয়ে গেলো। ধন্যবাদ আপনাকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *