বৃষ্টিমহল ৩.৬৫

৬৫

গ্রামের আত্মীয়রা আজ বিকেলে ঢাকা ছাড়ল। এখন অতিথিদের মধ্যে আছেন সামির ছোট খালা এবং হক সাহেবের ফুপু অর্থাৎ হৃদির দাদি শাশুড়ি। পুরো বাড়িতে শুধু এই একজন মানুষকেই হৃদির একটু আপন আপন লেগেছে। মানুষটা এত অসুস্থ, তবুও মুখে হাসি লেগে আছে সারাক্ষণ। এদিকে শাশুড়ি এবং খালা শাশুড়ি চোখে চোখ পড়ে গেলেই মুখ শক্ত বানিয়ে ফেলছে, এড়িয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আজ তিনদিন হয়ে গেলো। এই তিন দিনে শাশুড়ি মা একটি বারের জন্যেও তার সাথে হেসে কথা বলেননি। খাবার টেবিলে মুখ গোঁজ করে খাবার খেয়েছেন। নিজের ছেলের পাতে এটা সেটা তুলে দিয়েছেন বারংবার, কিন্তু হৃদির দিকে একবার চোখ তুলে তাকাননি পর্যন্ত। ওই খাবার টেবিলেই হৃদির নিজের বাবা মায়ের কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে। বাবার বাড়িতে সব সময় মুরগির বুকের অংশটুকু তার জন্য বরাদ্দ ছিল। আর হৃদয়ের জন্য রানের অংশ। সেই ছোট্ট বেলা থেকে তাদের বাড়িতে এটাই নিয়ম। একবার হৃদয় দুষ্টুমি করে মুরগির ব্রেস্টপিস খেয়ে ফেলেছিল বলে কী ভীষণ রেগে গিয়েছিল হৃদি। এমনকি মাও হৃদয়কে চার পাঁচ কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ এখানে কেউ একটা বার প্রশ্নও করল না যে হৃদির ঠিক কী ধরনের খাবার পছন্দ। তাছাড়া এই বাবুর্চির রান্নাও হৃদির পছন্দ হচ্ছে না। সে তার মায়ের রান্না ভীষণভাবে মিস করছে। খাবার টেবিলে বসলেই তার কান্না পায়। কান্নার জন্য ঠিকমতো খেতেও পারেনি আজ দুপুরে। সামিকে এ কথা বলতেই সে চোখে মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কী আজিব! খাইতে বসলে কান্না আসবে কেন? আমাদের বাসার খাবার কি তোর মজা লাগতেছে না? এই শেফ তো খুব ভালো রান্না করে।’ 

সামির প্রশ্নটা শুনে হৃদি চুপ করে গেলো। আচ্ছা বন্ধু থেকে স্বামী হয়ে যাবার পরে কি ছেলেদের বুদ্ধি একটু কমে যায়? কেন যেন বিয়ের পর দিন থেকেই সামিকে হৃদির কেমন একটু অন্যরকম লাগছে। এতদিনের চেনা বন্ধুটি যেন হঠাৎ করে স্বামী নামক এক ঢালের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। আসলেই কি তাই? নাকি পুরো ব্যাপারটাই হৃদির মানসিক? কে জানে! 

আজ ডিনারের একটু আগে হৃদি একবার রান্নাঘরে গেলো। ডাইনিং পেরিয়ে একটি ছোট্ট করিডোর, তারপর তিন ধাপ চওড়া সিঁড়ি ভেঙে নামতে হয় কিচেনে। এর আগে কখনো আসা হয়নি এদিকটায়। এইই প্রথম। দেখা গেলো মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ বাবুর্চি মাথায় টুপি আর এপ্রন পরে রান্নার কাজ করছে। তাকে সাহায্য করছে আরো জনাচারেক কমবয়সী ছেলেমেয়ে। হৃদিকে দেখামাত্র এরা সবাই তটস্ত হয়ে গেলো। এ বাড়ির মালকিন রান্নাঘরে পা দেন কদাচিৎ। সপ্তাহে এক কি দুদিন তিনি রান্নাঘরে নেমে আসেন টহল দিতে। ওই ঝটিকা সফরেই চাকরবাকরদের নানা রকম তদবির শোনেন, ঝগড়া মেটান, কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। আজকাল ঢাকা শহরে কাজের লোকদের ডিমান্ড অনেক। তবে এই বাড়িতে মাসোহারা অত্যধিক বেশি হওয়ায় লোক টিকে যায়। বেতন বেশি ছাড়াও এখানে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আছে। পরিবারের সদস্য কম হওয়ায় ফরমায়েশ দেওয়ার মতো লোক কম। বেগম সাহেবা সারাক্ষণ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সর্বক্ষণ চাকরবাকরদের পেছনে লেগে থাকার অভ্যাস তার নেই। বাড়ির ভেতর ইন্টারকম টেলিফোন আছে। খুব জরুরি দরকার পড়লে তিনি ওপর তলা থেকে ফোন করেন কিচেনে। তবে এ কথা সত্য মেজাজ খারাপ হলে মহিলা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেন। একবার রাগের মাথায় এক কাজের মেয়েকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। পড়ে গিয়ে সেই বেচারির হাত ভেঙে গিয়েছিল। তাই রসুই ঘরের অনেক ঝামেলাযুক্ত খবর রগচটা বেগম সাহেবের কান পর্যন্ত যাবার আগেই হেড বাবুর্চি নিজ উদ্যোগে মিটিয়ে ফেলেন। এই বাড়িতে ইচ্ছেমতো টিভি দেখা যায়। প্রেম করারও অবাধ সুযোগ সুবিধা। সকিনা নামের একটি সতের বছরের মেয়ে বেশ কিছু দিন যাবৎ আকবর নামের ত্রিশোর্ধ এক ড্রাইভারের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। অবশ্য বাড়ির মালিক ইলেকশনে জেতার পর থেকে সভা সমিতির কারণে একটু কাজ বেড়ে গেছে চাকরবাকরদের। মিটিং চলাকালীন দফায় দফায় চা নাশতা সার্ভ করতে হয়। পার্টির লোকেরা মাঝে মাঝে রাতের খানাও খেয়ে যায়। মিটিং না থাকলে অবশ্য অন্যান্য দিনগুলোতে কাজের তেমন প্রেশার থাকে না। 

লম্বা আকারের বিশাল রান্নাঘরে মোট আটটি চুলা। এসি, ফ্যান, ওভেন, ফ্রিজ সমস্তই আছে এখানে। এমন কি দেওয়ালে একটি বত্রিশ ইঞ্চি এল ই ডি টিভিও লাগানো আছে। হৃদি যখন ঘরে প্রবেশ করেছে তখন টিভিতে হিন্দি নাচ চলছিল। হৃদিকে দেখামাত্র কিশোরী একটি মেয়ে চট করে রিমোট উঁচিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল। তারপর দৌড়ে ছুটে গিয়ে চেয়ার জোগাড় করে এনে বিনীত গলায় বলল, ‘ভাবি, বসেন!’ ভাবি ডাকটায় আন্তরিকতা ছিল। ভালো লাগল হৃদির। তাকে দেখতে এখন নতুন বৌয়ের মতোই লাগছে। পরনে একটা হালকা গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি। হাতভর্তি স্বর্ণের ওপর হীরের পাথরখচিত চুড়ি। গলায় সোনার চেইন সমেত হীরের লকেট। চুলে খোঁপা। বিয়ের পর থেকে এই তিনদিন যাবৎ সে শাড়িই পরছে। এই বাড়িটা এত বড় আর সুন্দর যে সেজেগুজে পুরো বাড়িতে একলা একলা ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও একটা আলাদা রকমের মজা আছে। তবে বড় বাড়ি তার পছন্দ ছিল না কখনোই। এখনো পছন্দ নয়। বেড়ানোর জন্য ঠিক আছে। কিন্তু সবসময় থাকবার জন্য ছোট্ট ছিমছাম বাসাই তার পছন্দ। 

চেয়ারে পা তুলে বসে সে বাবুর্চির কাজ দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। এই ফাঁকে কর্মরত ছেলেমেয়ে গুলোর নাম জেনে নেয়ার কাজটাও সেরে নিল। ছেলে মেয়েগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তাকে। নিজেকে তার তেমন একটা সুন্দরী কখনোই মনে হয়নি। অন্তত বাংলাদেশের মতো জায়গায় যেখানে সুন্দরী বলতেই লোকে টকটকে ধবল ফর্সা মেয়ে বোঝে, সেখানে হৃদির মতো শ্যামলা গায়ের রঙের মেয়ে তো কোনো মতেই সুন্দরী বলে বিবেচিত নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজের মেয়েগুলোর চোখে সে চরম মুগ্ধতা লক্ষ্য করছে। বড় বড় চোখে তারা তার গায়ের শাড়ি দেখছে, দেখছে হাতের চুড়ি, আংটি, জুতো সবকিছু। একটু পরেই ওদের মুগ্ধ হবার কারণটা ধরতে পারল হৃদি। রূপ নয়, আসলে ওরা দেখছে ঐশ্বর্য। বলতে নেই, হৃদি এখন বিরাট বড়লোকের বৌ! বড়োলোকের বৌদের দিকে সাধারণ লোকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকবে, মুগ্ধ হবে, ঈর্ষা করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ওদেরও কি হিংসা হচ্ছে? এই দু তিনদিনে হৃদি অনেকের চোখে হিংসার পাত্রী বনে গেছে। কী আশ্চর্য! লোকে তাদের স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাকে হিংসে করে না, হিংসে করে সামাজিক মর্যাদাকে, বিলাসব্যসন আর চাকচিক্যকে! 

ডিনার তৈরি হয়ে গেছে। সাদা ভাত, তিন রকমের সামুদ্রিক মাছ, দুই পদের মুরগি, একটা গরুর মাংসের তরকারি, দু রকমের সবজি, এবং দু রকমের ভর্তা। হৃদি বুঝতে পারছে না এ বাড়িতে কি রোজ এত পদের রান্না হয় নাকি বিয়ে উপলক্ষ্যে অতিথিদের জন্য এই বিশেষ আয়োজন। ঠিক সেই সময় ভারি একটা ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটল। সামি তার বৌকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় এসে হাজির হলো। অনেক দিন হয়ে গেলো সে বাড়ির রসুই ঘরে পদার্পণ করেনি। প্রয়োজন হয়নি। আজ তার উপস্থিতি চাকরবাকরদের মধ্যে একটা চঞ্চলতার সৃষ্টি করল। একটু জড়োসড়ো ভাব চলে আসলো সবার মাঝে। কয়েকজনের মুখে একটু মিটমিটে হাসিও ফুটে উঠল। অল্প বয়সী একটি মেয়ে অপর একটি মেয়ের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘দ্যাখ না, নতুন বৌরে থুইয়া থাকতারে না, ইকটু সুময়। বৌরে খুঁজতে চইলা আইছে।’ 

—‘তুই এখানে। আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজতেছি।’ 

—‘আমি তো তোকে বলেই আসলাম, যে আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।’ 

—‘কী জানি! খেয়াল করি নাই। তুই এখানে কী করিস?’ বলে সামি আশপাশটা একটু দেখল। এ জায়গায় তার আসা হয় না বহুদিন। শেষবার কবে এসেছিল ভুলেও গেছে। সবকিছু কেমন নতুন আর অন্যরকম লাগছে। 

—‘উনাদের কাজ দেখছি।’ 

—‘শোন, তুই তাহলে থাক। আমি এক দৌড়ে গিয়া রুদ্ররে নিয়া আসি।’ 

—‘ফিরবি কতক্ষণে? ডিনার তো সার্ভ করে দিচ্ছে।’ 

—‘এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না। রাস্তায় জ্যাম না থাকলে আরো তাড়াতাড়িই চলে আসব।’ 

হৃদি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বাবুর্চিকে বলল, ‘খাবারটা তাহলে একটু পরেই সার্ভ করুন। আপনার ভাইয়া ফিরে আসুক। কেমন?’ 

—‘জি ভাবি। ঠিক আছে।’ 

হৃদি সামির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘শোন, রুদ্রকে বলিস কয়েকদিন থাকার মতো কাপড় চোপড় নিয়ে আসে যেন। এখান থেকেই অফিস করতে পারবে। কী দরকার একলা একলা ওই ফ্ল্যাটে পড়ে থাকার?’ 

—‘হুম দেখি বলব।’ 

—‘দেখি টেখি না, জোর করিস। দুদিন ধরে আমার ওর জন্য খুব খারাপ লাগতেছে। এমনিতেই কিছু দিন পর বিদেশ চলে যাবে। এই সময়টা একটু আমাদের সাথে থাকুক।’ 

ডাইনিং এ রোমেলা বসে ছিলেন গালে হাত দিয়ে। সাথে তাঁর ছোট বোন, ছোট বোনের মেয়ে। ছেলে এবং ছেলের বৌকে দেখে তিনি একটু নড়ে উঠে গাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন। কোনো কথা বললেন না। হৃদি শাশুড়িকে দেখলেই আড়ষ্ট হয়ে যায়। বিব্রত হয়ে যায়। এখনো হলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে শাশুড়ির সাথে এই দূরত্ব কোনো কালেই ঘুচবে না। তবে আধুনিক শাশুড়িদের একটা ভালো দিক হলো এরা ছেলের বৌয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। হৃদি এই তিনদিনে একটু একটু বুঝে গেছে যে এ বাড়িতে তার স্বাধীনতার কোনো অভাব হবে না। সে যখন ইচ্ছে তখন বেরোতে পারবে, ঘুমোতে পারবে, ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে নাচতে পারবে, গলা ছেড়ে গাইতে পারবে। কেউ কিচ্ছু বলতে আসবে না। কিন্তু স্বাধীনতাই কি সব? এই মহিলাটি যে তার স্বামীর মা। তার ভালোবাসার মানুষটির ভীষণ ভীষণ ভালোবাসার একজন। এই বিশেষ মানুষটি তাকে বিনা কারণে অপছন্দ করলে, এড়িয়ে গেলে অফুরন্ত স্বাধীনতাও যে তাকে শান্তি দিতে পারবে না! 

—‘মা তোমার কি শরীর খারাপ?’ সামি প্রশ্ন করল মায়ের শুকনো মুখখানার দিকে চেয়ে। 

—‘না আমি ঠিক আছি।’ 

সামি একবার বৌয়ের দিকে তাকালো। হৃদি গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের হাতল ধরে। মায়ের সাথে নিজের স্ত্রীর এই তির্যক সম্পর্কটা সামিকে পীড়া দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। তার মনে হচ্ছে হৃদির দিক থেকে চেষ্টার কমতি আছে। হৃদি চাইলেই মায়ের সাথে সম্পর্কটা একটু সহজ করে তুলতে পারে। বাইরে থেকে দেখতে শক্ত হলেও সামি জানে তার মায়ের মনটা একদম তুলোর মতো নরম। সে অনেকটা হুকুম দেওয়ার স্বরে হৃদিকে বলল, ‘তুই দাঁড়ায় আছিস কেন? বয়। কথা বল উনাদের সাথে।’ 

ঠিক সেই সময় সদর দরজা দিয়ে সুলেমান প্রবেশ করল। রোমেলা সুলেমানকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসলেন ডাইনিং থেকে। উঁচু গলায় বললেন, ‘সুলেমান, উপরে আসো। একটু কথা আছে তোমার সাথে।’ 

সামির হুকুমটা হৃদির গায়ে একটা অসহনীয় জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেলো। ঠোঁট দুটো আপনাআপনি দু পাশে প্রসারিত হয়ে যাওয়ায়, অন্তরের জ্বলুনিটা ক্ষণিকের জন্য দৃশ্যমান হয়ে উঠল তার মুখে। এই মহিলা তো তার চোখে চোখ পড়ামাত্র মুখে খিটখিটে ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন। হৃদি গায়ে পড়ে কীভাবে কথা বলবে এই দাম্ভিক, অহংকারী মহিলার সাথে? যদি মুখের ওপর অপমানজনক কিছু বলে বসেন? আজিব কারবার! আসলে এই ছেলে মা ছাড়া কিছুই বোঝে না। হৃদি যে নিজের বাবা মা ফেলে এসে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এটা কোনো বড় ব্যাপার না। তার মা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাবে আর হৃদিকে সব সহ্য করে তোষামোদ করতে হবে? রাগে, অপমানে তার চোখে জল চলে আসার উপক্রম হলো। হৃদির তিক্ততা কিছুটা টের পেল সামি। টের পাবার পরেও খালার সামনে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সে ডাইনিং ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। বাবাকে মিস করছে সে। মনে হচ্ছে বাবা থাকলে পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিতেন তিনি। ইশ বাবা কেন যে বিয়ের একদম পর দিনই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন! 

সুলেমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধ দরজার সামনে। তার মোটাসোটা দেহখানা একটু একটু কাঁপছে। একটা ফুলহাতা ক্রিম কালারের শার্ট তার গায়ে। কালো কাপড়ের ঢোলা প্যান্ট। এসি রুমের ভেতরেও দরদর করে তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। বুকে কিঞ্চিৎ ব্যথা বোধ হচ্ছে। 

—‘সুলেমান, তোমাকে এখন যে প্রশ্নটা করব তার সঠিক উত্তর দেবে। নইলে তোমার চাকরিতো থাকবেই না, উপরন্তু তোমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও চাকরি চলে যাবে। তোমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’ 

সুলেমান কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

রোমেলা নিজের বিছানার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটায় বসলেন। তারপর খুব ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘গত দুদিন তুমি কাজে আসোনি কেন? 

—‘শরীর ভালো ছিল না ম্যাডাম।’ 

—‘কী হয়েছিল?’ 

—‘বয়স হয়েছে। এখন কত রকমের সমস্যা! বাতের ব্যথা ছিল প্রচণ্ড।’

—‘আজকে কেমন লাগছে?’ 

—‘উত্তম।’ 

—‘বেশ। শোনো, সেই রাতে লাইব্রেরি ঘরে তোমার স্যারের সাথে কি অন্য কেউ ছিল?’ 

সুলেমান নিজের চিবুকটা বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল, ‘জি না।’ 

—‘সত্যি কথা বল!’ 

—‘সত্যিই বলছি ম্যাডাম।’ 

রোমেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ একটা অনুসন্ধানী দৃষ্টি সুলেমানের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে হিম শীতল গলায় বললেন, ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি কথা লুকোচ্ছ। শোনো সুলেমান, তুমি যদি আমাকে তথ্যটা দাও, তাহলে এরপর থেকে তোমার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। আমি এমন ব্যবস্থা করে দেবো যে কাজকর্ম না করেও তোমার কয়েক জেনারেশন দিব্যি খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারবে।’ 

সুলেমান কোনো কথা বলতে পারল না। দরদর করে ঘাম ঝরে পড়তে লাগল তার কপাল বেয়ে। লোকটার এই নাজেহাল অবস্থাই রোমেলাকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করল যে, লোকটা নিশ্চয়ই কিছু একটা গোপন করছে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বাঁকা করতেই হয়। কথা কী করে বের করতে হয় তা আমার জানা আছে!’ 

৬৬

ভিড়ের মধ্যে প্রিয়দর্শন মানুষটি বসে আছেন। কী যেন একটা উৎসব চলছে। গাঢ় নীল জলের বিস্তৃত সাগর পারে হরেক রকম লোকজন। রুপালি বালি চিকচিক করছে হুলুদ বসন্তময় রোদে। সিল্ক কাপড়ের মতো ফুরফুরে হৃদয় জুড়ানো বাতাস। একটা সুমধুর বাজনা বাজছে ধারে কাছে কোথাও। সেই বাজনার তালে তালে নানা বয়সি নর নারী মনের আনন্দে নেচে চলেছে। চারপাশে এক সুতীব্র সুখের নিকষিত শিহরণ! অমৃতা নির্ভয়ে এগিয়ে গেলো মানুষটার দিকে। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভীষণ স্মার্ট গলায় বলল, ‘উড ইউ লাইক টু ড্যান্স উইদ ইওর ওয়াইফ মিস্টার হক?’ 

—‘শিওর! মিসেস হক!’ চিত্তপ্রসাদ হাসিটা হেসে তিনি অমৃতার হাতখানি ধরলেন। 

মানুষটা সাদা শার্টের ওপর সাদা কোট এবং কালো টাই পরে আছেন। অমৃতার গায়ে লাল রঙের হাতাকাটা, ঘেরওয়ালা জামা। সূর্যের বিশুদ্ধ আলোয় ঝকঝক করছে তার সুডৌল ফর্সা দুই বাহু। তার পায়ে কোনো জুতো নেই। আতপ্ত বালির ওপর পা ফেলে সে মানুষটার হাত ধরে নাচের জায়গায় আসলো। ছয় ফিটেরও বেশি লম্বা দৃঢ়কায় বলিষ্ঠ পুরুষটি আচমকা হাত বাড়িয়ে তাকে খুব কাছে টেনে নিল। যেন অমৃতা তার নিজস্ব নারী একটা স্বর্গীয় তরঙ্গ ছুটে চলল অমৃতার বুকে। অতীন্দ্রিয় এক অনুভূতি তোলপাড় করে দিল ভেতরটা। বাঁধছেড়া সম্মোহনে ডুবে গিয়ে সে মানুষটার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে লাগল দ্বিধাহীনভাবে। 

সেই সময় হঠাৎ সুমধুর বাজনাটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠল। বাজনার বদলে দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল কর্কশ একটা শব্দ। স্বর্গীয় দৃশ্যপট ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। নিমেষে অদৃশ্য হলো সম্মুখের রঙিন পর্দা। 

সেলফোনটা বাজছিল। দ্যুলোক থেকে ভূলোকে অবতরণ করল অমৃতা। অনেক কষ্টে চোখের পাতা দুটো মেললো খানিকটা। হাত বাড়িয়ে কাটল ফোন। অচেনা নম্বর। নিশ্চয়ই কোনো ক্লায়েন্ট হবে। এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একটা বিষাদময় দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার বুক চিরে। ইশ! স্বপ্নটা যদি কখনো শেষ না হতো! 

ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। অনেক দিন পর দুপুরে ভাত খাবার পর ঘুম এসে গিয়েছিল। আজ ছুটির দিন। ছটার সময় তার ইয়োগা সেন্টারে যাবার কথা, যোগব্যায়ামের উদ্দেশ্যে। গত পাঁচটা দিন যন্ত্রের মতো কাজ করে গেছে সে। রোজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়ে গেছে সন্ধ্যা। গোসল সেরে, এক কাপ চা খেয়ে, ট্রাউজার টি শার্ট আর কেডস পরে নিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে নিচে নেমে গেছে। তারপর, মোহাম্মদপুরের ঘিঞ্জি গলির ভেতর দিয়ে, লোকজন গিজগিজ করা ব্যস্ত ফুটপাতের ওপর হেঁটে হেঁটে, আবার কখনো দৌড়ে পৌঁছে গেছে ইয়োগা সেন্টারে। হেঁটে গেলে চল্লিশ মিনিটের দূরত্ব। অমৃতা যেহেতু মাঝে মাঝে দৌড়োয় তাই সময় আরেকটু কমে আসে। এক ঘণ্টার ইয়োগা ক্লাস শেষ করে হেঁটেই বাড়ি ফেরে সে। ন’টা বেজে যায় ততক্ষণে। চনমন করে খিদে পায়। হাতমুখ ধুয়েই খাবার টেবিলে বসে পড়ে। খেয়ে উঠে বইপত্র মেলে ধরে সামনে। সুপ্রিমকোর্টের এনরোলমেন্ট পরীক্ষা কাছে এগিয়ে এসেছে। পড়াশোনার অবস্থা ভালো না। মনে হচ্ছে এক চান্সে সনদটা হবে না। বন্ধুরা গ্রুপ কল দেয় প্রায় রাতে। অমৃতা বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। এক একেকদিন কানে ফোন আর মুখের সামনে বই নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই নিজেকে ক্লান্ত করে তোলার এক অভেদ্য লক্ষ্য নিয়ে দিন কাটাচ্ছে সে। একটা মুহূর্তও বিনা কাজে ব্যয় করছে না। কিন্তু হাজার চেষ্টার পরেও কোনো কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। একটি মামলায় তার ক্লায়েন্টের নামে চার্জশিট এসে গেছে গতকাল। এই ক্লায়েন্ট অবশ্য বিশেষ সুবিধার লোক নয়। কেস নেবার আগে বলেছে সে খুন করেনি। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর এক মিটিং এ মাতাল অবস্থায় স্বীকার করে ফেলেছে খুনটা আসলে সেই করেছে। অমৃতা ক্রিমিনালের ফরে কেস লড়তে চায় না। তার বিবেকে বাধে। এই কেসটায় সে নির্ঘাৎ হারবে। লাস্ট উইকে কোর্ট থেকে মাঝে মাঝেই চলে গেছে এনজিওর অফিসে। আগামীকাল শনিবারে প্রজেক্ট ম্যানেজারের সাথে যাবে ফিল্ডে। তার যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে ল’ অফিসার, ফিল্ড অফিসার না। তবুও যেচে পড়েই কাজটা ঘাড়ে নিয়েছে অমৃতা। সবই নিজেকে ব্যস্ত রাখার ধান্ধা। সে জানে, মন দিয়ে নয় বিবেক বুদ্ধি আর মগজ খাটিয়েই বাকি জীবনটা তার কাটাতে হবে। ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। 

কিন্তু কী কাণ্ড! জাগরণে আশকারা না পাওয়া ভাবনারা ঠিক ঠিক ঘুমঘোরে অনধিকার প্রবেশ করে হানা দেয়। আজকের স্বপ্নটা সেই অনধিকার প্রবেশেরই একটি ধাপ। হৃদয়ের সবকটা কপাট বন্ধ করে দেবার পরেও নির্লজ্জ্ব অভিলাষ সিঁধ কেটে চোরের মতো ঢুকে পড়ে মনের ঘরে। স্বপ্ন দেখায়! আজকের স্বপ্নটা অনেকক্ষণ অবধি তার মনের সাথে সুগন্ধি আতরের মতো লেগে রইল। স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই সে কেঁপে কেঁপে উঠছে, লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে, একটা শিরশিরানি বয়ে যাচ্ছে মেরুদণ্ড দিয়ে। স্বপ্নে লোকটা তাকে মিসেস হক সম্বোধন করেছিলেন। এর মানে… ধ্যাৎ এসব অর্থহীন চিন্তা করতে নেই! 

৬৭

সামি ঠিক করেছিল হানিমুন করতে যাবে বুলগেরিয়া। কিন্তু বন্ধুরা উপহার দিয়েছে বালির এয়ার টিকেট। অতএব বুলগেরিয়াকে সেকেন্ড হানিমুনের লিস্টেই রাখতে হলো তার। দুদিন পরেই বালি যাবার ফ্লাইট। চারদিনের ট্যুর। সামি ছাদের ওপর সুইমিং পুলের পাশে বসে অনলাইনে এই মাত্র হোটেল বুক করল। ফাইভস্টার হোটেল। হৃদির ভীষণ পছন্দ হয়েছে। খুশিতে ঝুমঝুম করছে তার চোখ মুখ। মনে হচ্ছে বেড়াতে যাবার উত্তেজনা কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাকে সাংসারিক জটিলতা ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিকেলের আকাশে মেঘ করেছে। সুইমিং পুলের নীল জলের ওপর গম্ভীর ভ্রুকুটিবক্র মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ছায়া পড়েছে। সেই জলে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে রুদ্র। 

গতকাল সামি তার বাবার অফিসে জয়েন করেছে এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে। বেরিয়ে গেছে খুব সকালে। তারপর হৃদি সারাদিন বাসায় একলা। ব্যাংকের চাকরিটার কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না এখন অবধি। বাবা বলেছেন কয়েকদিনের মধ্যেই একটা খবর পাওয়া যাবে। রুদ্র অফিসে। বাড়িতে শুধু হৃদি, তার শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি এবং দাদি শাশুড়ি। 

হৃদির ঘরে নতুন ফার্নিচার এসেছে। চমৎকার অভিজাত নকশার নতুন খাট, ড্রেসিং টেবিল, কার্পেট, জানালার পর্দা। সব কিছু চকচকে, ঝকঝকে এবং ফিটফাট। বেডরুমটা সে নিজের হাতেই গোছায়। কাজের লোকের সাহায্য ব্যতীত। কিন্তু গোছাতে আর কতক্ষণ লাগে? গতকাল বেলা বারোটার মধ্যেই তার গোছগাছ করা শেষ। এরপর ফেসবুকিং করে, ফোনে বিভার সাথে কথা বলে, স্ন্যাপচ্যাটে ছবি আপলোড করে সময় কাটালো। দাদি শাশুড়ির ঘরে গিয়ে গল্প করল খানিকক্ষণ। লাঞ্চের ডাক পড়ল যথাসময়ে। দুরুদুরু বুক নিয়ে নামল নিচে। নিজের শাশুড়ির চেয়ে খালা শাশুড়িকে তার বেশি বিরক্ত লাগে আজকাল। এই মহিলার হাজবেন্ড গেছে সিঙ্গাপুরে অফিশিয়াল কাজে। এই কটা দিন তিনি বোনের বাড়িতেই থাকছেন কন্যাসমেত। তার কন্যাটির নাম লিজা। মানারাত স্কুলে ও লেভেলে পড়ে। এই বয়সেই বেজায় পাকনা। নিচে নেমে দেখল দুই শাশুড়ি খাবার টেবিলের দুই প্রান্তে বসে আছেন। দাদি শাশুড়ির খাবার চলে যাবে তার ঘরে। তিনি অসুস্থ মানুষ। তার দেখাশোনা করার জন্য বাঁধা নার্স আছে। লিজা স্কুল থেকে ফেরেনি এখনো। ফিরতে ফিরতে তার বিকেল হবে। 

হৃদি দুই শাশুড়িকে একটা দায়সারা সালাম দিয়েই চেয়ার টেনে বসে পড়ল। চাকরবাকররা খাবারের ডিশ এনে সাজিয়ে রাখছে টেবিলের ওপর। একটি মেয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দিচ্ছে কাচের গ্লাসে। হৃদি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইল। এ কদিন খাবার টেবিলে তার সাথে সামি ছিল। সে কথাবার্তা বলে পরিবেশটাকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করেছে অনবরত। আজ সামিকে ছাড়া হৃদি বাস্তবিক অর্থেই অসহায় বোধ করতে লাগল। রোমেলা কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে নিরুত্তাপ গলায় বলে উঠলেন, ‘তোমার বাবা ফোন করেছিলেন একটু আগে।’ 

হৃদি চমকে তাকালো শাশুড়ির দিকে। 

—‘জি?’ অস্ফুটে বলল সে। 

—‘তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। বলছিলেন আজ বিকেলে আমাদের বাড়ি আসবেন। তো আমি বলে দিয়েছি যে আজ আমার সময় হবে না। আমি একটু বাইরে যাব। কাজ আছে।’ 

হৃদির মুখে একটা গাঢ় রঙের ছায়া আচমকা দৃশ্যমান হয়ে উঠল বুকটা কেমন টনটন করে উঠল ব্যথায়। বাবার মুখের ওপর সরাসরি আসতে মানা করে দেওয়ার কী দরকার ছিল? একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা যেত না বুঝি কথাটা? 

হৃদির মুখের পরিবর্তনটা রোমেলা পাত্তা দিলেন না। নিজের প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে বললেন, ‘গুলশান ক্লাবে একটা পার্টি আছে। যেতেই হবে আমাকে। সো তোমার আব্বাকে বলো, পরের উইকেন্ডে আসতে। আমি বলেছি, তবে মনে হলো তিনি একটু মাইন্ড করেছেন।’ এটুকু বলে হঠাৎ কী যেন মনে পড়ল তাঁর, ‘ওহ, স্যরি পরের উইকেন্ডে আমি ব্যাংকক যাচ্ছি। হবে না।’ 

অপমানে হৃদির চোখে জল চলে আসার উপক্রম হলো। ইশ! বাবা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছেন! 

সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ খাবার বেড়ে নিল প্লেটে। হঠাৎ ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন শব্দ করে। হৃদি খাবার রেখে উঠে পড়ল। ঘরের কোণের দিকের একটা শো কেসের ওপর টেলিফোনটা রাখা। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার কানে তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠ বলল, ‘কে বলছ?’ 

হৃদি অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘জি, আমি হৃদি!’ 

—‘ও! কেমন আছ বৌমা?’ আন্তরিক প্রশ্নটা হৃদিকে কিঞ্চিৎ নাড়া দিয়ে গেলো। তার শ্বশুর ফোন করেছেন। আমেরিকা থেকে। 

—‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’ 

—‘আমি ঠিক আছি। তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’ 

—‘জি না।’ 

—‘বাবা মায়ের জন্য নিশ্চয়ই মন খারাপ লাগছে?’ 

হৃদির চোখ জোড়া হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসলো। উত্তরে কিছু বলতে পারল না সে। তিনি বললেন, 

—‘তোমাদের বাসা তো খুব দূরে না। তুমি রোজ একবার দেখা করে আসতে পারো উনাদের সাথে।’ 

—‘জি।’ 

—‘কিংবা উনারাও চাইলে তোমাকে এসে দেখে যেতে পারেন।’ 

–‘জি।’ 

—‘আর সব খবর ভালো তো?’ 

সামি বলেছিল হৃদি যদি তার শ্বশুর শাশুড়িকে, আব্বা আম্মা বলে ডাকতে পারে, তাহলে সামিও তার শ্বশুর শাশুড়িকে বাবা মা সম্বোধন করবে। শাশুড়িকে মা ডাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হৃদির নেই। কিন্তু কেন জানে না, এই মানুষটাকে তার এই মুহূর্তে একবার বাবা বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ডাকতে পারল না লজ্জায়। ঘাড় কাত করে বাচ্চা মেয়েদের মতো চাপা গলায় বলল, ‘জি সব খবর ভালো।’ 

—‘গাধাটা তো অফিসে জয়েন করেছে শুনলাম।’ হৃদি হেসে ফেলল এ পর্যায়ে। কষ্টে হাসি চেপে বলল, 

—‘জয়েন করেছে।’ 

—‘কিছু বলল তোমাকে? কেমন লাগছে ওর?’ 

—‘প্রথম দিনের এক্সপেরিয়েন্স বেশ ভালো। তবে সে বলেছে অফিসের সবাই একটু বেশি কিউরিয়াস তার ব্যাপারে। প্রত্যেক এমপ্লয়ি ওকে বসের ছেলে হিসেবে ট্রিট করছে। এই স্পেশাল ট্রিটমেন্টটা তার পছন্দ হচ্ছে না।’ 

—‘পছন্দ না হওয়ার কী হলো? স্পেশাল ট্রিটমেন্টটা এনজয় করলেই তো হয়। যাই হোক। তুমি মা ওকে একটু কাজে মন দিতে বলো। আমার ছেলেটার মাথা ভালো। কিন্তু কাজে কর্মে একেবারেই সিনসিয়ার না।’ 

—‘আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক থাকবে ইনশা আল্লাহ।’ 

—‘তোমার শাশুড়ি কোথায়?’ 

—‘আছেন এখানেই। ফোন দেবো?’ 

—‘হ্যাঁ দাও। তুমি ভালো থেকো।’ 

—‘জি। আপনিও ভালো থাকবেন।’ 

রোমেলা খাবার খেতে খেতে হৃদির কথা শুনছিলেন। হৃদি কিছু বলার আগেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। হৃদি তাঁর হাতে ফোনের রিসিভার হস্তান্তর করে দিয়ে টেবিলে ফিরে গেলো। 

রোমেলা ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বললেন। 

—‘কেমন আছ?’ 

—‘ভালো। তোমার কী খবর?’ অনেকটা ফিসফিস করে, ফোনের স্পিকারের সামনে মুখ নামিয়ে বললেন রোমেলা। যাতে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এই কথোপকথন শুনতে না পায়। 

—‘তুমি সুলেমানকে বিরক্ত করছ কেন অযথা?’ কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন হক 

রোমেলা শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, ‘ও এই খবরও তোমার কাছে চলে গেছে?’ 

—‘প্রশ্নের উত্তর দাও।’ 

—‘সুলেমানকে আমি বিরক্ত করিনি। জাস্ট একটা ইনফরমেশন জানতে চেয়েছি।’ 

ওপাশের কণ্ঠটা আগের চাইতেও আরো বেশি মজবুত শোনালো এবার, ‘সুলেমানকে আমি ছুটি দিয়েছি এক মাসের জন্য। তুমি এর মধ্যে ওকে আর বিরক্ত করবে না।’ 

—‘তোমার আদেশ মানতে আমি বাধ্য নই।’ 

—‘বাড়াবাড়ি করো না! 

—‘একশবার বাড়াবাড়ি করব। তুমি নিজেই শুধু বাড়াবাড়ি করে যাবে আর আমি চুপ করে সব সহ্য করে যাব, এটাতো হতে পারে না।’

—‘সুলেমান কিছুই জানে না। তার কাছে কোনো ইনফরমেশন নেই। মিথ্যে কথাটা জোর দিয়েই বলতে পারলেন তিনি। 

রোমেলা কথাটা শুনে একটু সময় থমকে গেলেন। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘আমাকে কি তোমার এতটাই বোকা মনে হয়? তাছাড়া তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার গোপন প্রেমিকাটিকে আমি শুধু একটু চিনে নিতে চাই। একটা বার দেখতে চাই। তার কোনো ক্ষতি আমি করব না।’ 

—‘আমার কোনো প্রেমিকা নেই।’ 

রোমেলা অদ্ভুত হাসলেন, ‘তাই না? প্রেমিকা নয়? তাহলে কি ঘটনা আরো এগিয়ে গেছে? বিয়ে থা করে রাখোনি তো আবার লুকিয়ে?’ 

হক একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন, ‘ফোন রাখছি। সুলেমানকে বিরক্ত করো না। খবরদার।’ 

৬৮

ইয়োগা সেন্টারে কয়েকজন টিনেজ মেয়ে আছে, যারা অমৃতার একেবারে ডাইহার্ড ফ্যান। অমৃতা কোনো সেলিব্রিটি না, খুব ফ্যাশনেবল বা গ্ল্যামারাসও নয়। তবুও কী করে যেন কয়েকজন অল্পবয়সি মেয়ের চোখে সে রীতিমতন আইডল বনে গেছে। কলেজপড়ুয়া মেয়েগুলো অমৃতার চুলের ধরন থেকে শুরু করে, কথাবার্তা, হাঁটাচলা সমস্ত কিছু অনুসরণ করার চেষ্টা করে। আজ ক্লাস শেষে সুরাইয়া নামের একটি মেয়ে খুব গদগদ হয়ে বলল, ‘আপু, একটা প্রশ্ন করব আপনাকে?’ 

অমৃতা ইয়োগা ম্যাট ভাঁজ করতে করতে বলল, ‘নিশ্চয়ই।’ 

মেয়েটি খুব একটা লম্বা নয়। বয়স বেশি হলে ষোলো কি সতেরো হবে। ছিপছিপে দেহ। শ্যামলা লম্বাটে মুখে ডাগর দুটি চোখ। সে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ইয়ে, আপু আমি অনেক দিন ধরেই চাইছি আপনার মতো করে চুল কাটব। কিন্তু আমার মা কিছুতেই পারমিশন দিচ্ছে না। আপনি কি একটু আম্মুর সাথে কথা বলবেন? আম্মু নিচেই আছে। ওয়েট করছে আমার জন্য।’ 

অমৃতা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমি কী কথা বলব?’ 

—‘না মানে, আপনি যদি আম্মুকে গিয়ে একটু বলতেন যে ছোট চুলের উপকারিতা কী, তাহলে আমি শিওর আম্মু আপনার কথা শুনে তার মত পরিবর্তন করে ফেলবে।’ 

অমৃতা হেসে উঠল খিলখিলিয়ে, ‘ছোট চুলের কোনো উপকারিতা নেই। বিশ্বাস করো। স্টাইল করা যায় না, শাড়িটারি পরলে বাজে দেখায়। তোমার চুল এখনই ঠিক আছে। খুব সুন্দর ‘ 

মেয়েটির মুখ দেখে বোঝা গেলো কথাটা তার খুব বেশি মনঃপূত হয়নি। একটু মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমার তো আপনার চুলটাই বেশি ভাল লাগে।’

—‘তাহলে তুমিই তোমার মাকে বুঝিয়ে বলো। আমার বিশ্বাস তিনি তোমার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেবেন।’ কথা বলতে বলতে ওরা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছিল। সরু সিঁড়ি ঘরটায় এখন বেজায় লোকের ভিড়। 

—‘আমার খুব আপনার মতো হতে ইচ্ছে করে। আমি ঠিক করেছি আমিও ল পড়ব। শুধু আমি না, আমাদের কলেজের অনেকেই আপনাকে ফলো করে।’ 

—‘তোমাদের কলেজ মানে? তোমরা আমার সম্পর্কে এত কিছু জানো কী করে?’ 

—‘আপনি ডিবেট ওয়ার্কশপে এসেছিলেন কয়েকবার। স্পিচ দিয়েছিলেন। সেই থেকে আপনার ফ্যান হয়ে গেছি আমরা।’ 

—‘কোন কলেজ বলোতো?’ 

মেয়েটি কলেজের নাম বলল। মনে পড়ল অমৃতার। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং ক্লাব থেকে বেশ কয়েকবার এই কলেজে যাওয়া হয়েছে। ওরা নিচে নেমে বিল্ডিংয়ের ধার ঘেঁষে ফুটপাতের ওপর দাঁড়ালো। পাশেই একটা টঙের চায়ের দোকান। নানাবয়সী লোক ভিড় করে আছে দোকানের সামনে। বাদামি চাদর গায়ে দিয়ে বিষণ্ণ এক মেঘলা সন্ধ্যা নেমে এসেছে তখন নগরীর বুকে। মেয়েটি রাস্তার ধারে পার্ক করা একটি কালো রঙের টয়োটা গাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঐযে আমার আম্মু, গাড়িতে বসে আছেন। কথা বলবেন?’ 

—‘আরে, টিংকু রাণী সর্দার! কেমন আছেন?’ হঠাৎ ছুটে আসা বাক্যটা চমকে দিল অমৃতাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে সন্ধ্যার আবছা আলোয় দেখল একজন লম্বা ফর্সা যুবক তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে। অমৃতা মেয়েটিকে বলল, ‘আরেক দিন কথা বলব আপু। আজ থাক, কেমন?’ 

মেয়েটি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। ফর্সা যুবকটি তখনও অমৃতার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার পরনে নীল রঙের টি শার্ট। হাতে ঝোলানো সাদা অ্যাপ্রোন। অমৃতার চিনতে অসুবিধে হলো না। এই হলো হৃদি, বিভার সুন্দর ডাক্তার। টিংকু রাণী সর্দার নামটাও ভোলেনি ছেলেটা। আকাশে মেঘের দাপট বেড়েছে। ঝড়ো বাতাস ছুটছে এদিক সেদিক। আসন্ন বৃষ্টির কারণে ফুটপাতে মানুষজনের ভিড় কিছুটা কমেছে। রাস্তায় অবশ্য যানবাহনের কমতি নেই। আছে গাড়ির হর্ন, কালো ধোঁয়া, অহেতুক হইচই! 

—‘ডাক্তার সাহেব!’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে দু পা এগিয়ে এলো অমৃতা।

—‘কেমন আছেন?’ আগের প্রসন্ন হাসিটা মুখে বজায় রেখেই প্রশ্ন করল ডাক্তার। 

অমৃতা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ভালো। আপনার খবর কী?’ 

ডাক্তার অমৃতার অফ হোয়াইট গেঞ্জি আর কালো ট্রাউজার চোখ দিয়ে নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, ‘আমি ভালোই আছি। দেখুন কী কাণ্ড। আবার দেখা হয়ে গেলো আপনার সাথে!’ 

—‘হুম দেখা তো হয়েই গেলো।’ 

টঙের দোকানটার দিকে ইঙ্গিত করে ডাক্তার বলল, ‘চা চলবে?’ 

—‘শিওর, কেন নয়?’ 

ওরা দুজনে চায়ের দোকানের সামনের দুটো বেঞ্চিতে বসল। পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। অমৃতা পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। বাতাসের জোর খুব। সন্ধ্যার ফিকে ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মেঘের কারণে খুব তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। 

—‘আপনার বান্ধবীরা কেমন আছেন?’ ডাক্তারের প্রশ্ন। 

অমৃতা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।’ 

ডাক্তার হাসল, ‘আপনার নিশ্চয়ই হয়নি এখনো?’ 

—‘এত খুশি হচ্ছেন কেন?’ চোখা গলায় বলল অমৃতা। 

—‘খুশি হব না? টিংকু রাণী সর্দারকে একদিন ঢাকার রাস্তায় হুট করে পেয়ে যাব এ তো কল্পনাতীত ব্যাপার। কী দারুণ ভাগ্য আমার!’ ডাক্তার কিন্তু বেশ সপ্রতিভ। 

—‘হুম।’ ছোট করে বলে অমৃতা। তীক্ষ্ণ চোখে দেখে অল্পবয়সী ডাক্তারকে। হৃদি বিভার সুন্দর ডাক্তার দেখতে বেশ সুন্দর এ কথা স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু এর সৌন্দর্যে কেমন একটা কোমল আর অপরিণত ভাব আছে। এই কোমল অপরিণত ভাবটা অমৃতাকে কখনোই টানে না। যে মানুষটিকে সে ভালোবাসে, সেই মানুষটির চিত্তাকর্ষক পৌরুষের ধারে কাছেও এই সুন্দর ডাক্তার যেতে পারবে না। বৃষ্টির ঘ্রাণযুক্ত উতলা বাতাসের আবছা সন্ধ্যাটায়, সুদর্শন এক যুবকের সামনে বসে থেকে অমৃতার হঠাৎ অনভিপ্রেতভাবে সেই বিশেষ মানুষটিকে মনে পড়ল। মনে পড়ল সেই গভীর চোখের দুর্বোধ্য চাউনি… দীর্ঘ দেহ সৌষ্ঠব, ভরাট কণ্ঠস্বর… সেই ধারালো পৌরুষ! দমে টান পড়ল তার। বুকের মধ্যে কেমন এক চিনচিনে ব্যথা! 

আধ খাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে কেডসের সম্মুখভাগ দিয়ে আগুনটা মাড়িয়ে দিল অমৃতা। তারপর ঝপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একটা কাজ মনে পড়ে গেছে। অন্যদিন খাবো চা। আজ যাই। স্যরি।’ 

কথাটা শেষ করে সে আর দাঁড়াল না। ডাক্তার সাহেব হাউকাউ করে বলে উঠল, ‘আরে কোথায় যাচ্ছেন? ফোন নম্বরটা অ্যাটলিস্ট দিয়ে যান। টিংকু রাণী! শুনুন, প্লিজ!’ 

অমৃতা তখন শুরু করেছে দৌড়। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। এলোমেলো বাতাস নিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। মনের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। অসহ্য যন্ত্রণা! 

সেই সময়, পৃথিবী নামক গোলকটির ঠিক উল্টো দিকে, আটলান্টিকের ওপারে, আরো একজন মানুষ এমনই এক নিগূঢ় অর্থহীন যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একলা হাঁটছিলেন। সেখানে তখন দিনের সূচনা হচ্ছে। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। তিনি হাঁটছেন পটোম্যাক নদীর ধার ঘেঁষে। চারপাশে নানা রঙের মানুষের ভিড়। সাদা, কালো, বাদামি! কেউ হাঁটছে, কেউ দৌড়োচ্ছে, কেউ বা আবার সাইকেল চালাচ্ছে। 

পৃথিবীর এক পিঠে দৌড়োচ্ছে অমৃতা। তার আকাশে সন্ধ্যা। অন্য পিঠে হাঁটছে এক বিষণ্ণ মানুষ। তার আকাশে সকাল! মাঝখানে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর দূরত্ব। প্রায় তেরো হাজার দুইশ উনিশ কিলোমিটার! এত দূরত্বের পরেও দুটি মানুষের মধ্যে কোথায় যেন কী একটা গভীর মিল আছে। তাইতো অমৃতা যখন ঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যাটায় দৌড়োতে দৌড়োতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপ ধরা গলায় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো নিজের মনে ডেকে উঠল, ‘রাশেদ! 

ঠিক তখন সকালের পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো এক আশ্চর্য কারণে সেই বিষণ্ন মানুষটারও মন কেমন করে উঠল বিরহের মতো একটা সুতীব্র ব্যথা বেজে উঠল বুকে। হঠাৎ করে এক সীমাহীন একাকিত্ব বোধ তাকে ঘিরে ধরল চারপাশ থেকে। 

৬৯

টানা তিন সপ্তাহ পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। পায়ে চপ্পল লাগিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল আকাশ। ঝুমকি ডাকল পেছন থেকে। 

—‘কোথায় যাচ্ছ? চা করলাম। খেয়ে যাও।’ 

আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পেছনে। দুটো চা ভর্তি কাপ পিরিচ সমেত ট্রে ডাইনিং টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল ঝুমকি। সাথে এক প্লেট নোনতা বিস্কুট। ডাইনিং এর চেয়ারে আকাশের বাবা বসে আছেন। খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত ওঠা লুঙ্গি। ঠিক উল্টো দিকে বসে আছে তারা। ডান হাতের আঙুলে পুরু করে তেঁতুলের আচার লাগানো। মহা আনন্দে জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে আচার খাচ্ছে সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে আসলো আকাশ। বসল চেয়ারে। মুখ গোমড়া করে হাত বাড়িয়ে টেনে নিল চায়ের কাপ। পিতৃদেবকে দেখলে বিনা কারণে আজকাল তার মুখ গোমড়া হয়ে যায়। একটা অস্বস্তি হতে থাকে মনে। সেই দুই লক্ষ টাকা আর জোগাড় করা হয়ে ওঠেনি। সামিকে বললে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। কিন্তু চক্ষু লজ্জার দরুণ মুখ ফুটে চাইতে পারেনি। সামির নিজের টাকা হলে কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু সামির যে নিজের কিছুই নেই। যা আছে সব তার বাবার। আর ওই অহংকারী লোকটার কাছে কোনোভাবেই হাত পাততে রাজি নয় আকাশ। তাছাড়া পিতৃদেবের ওপর তার পর্যাপ্ত বিশ্বাস নেই। কেন যেন মনে হয়েছে টাকা পাওয়ার পরেও লোকটা পাওনাদারকে সেই টাকা বুঝিয়ে দেবে না। নিজের ইচ্ছেমতো ওড়াবে। 

—‘তোমার কাছে যে একটা ফেভার চেয়েছিলাম, সেইটার কী হলো, হ্যাঁ?’ কোটরে ঢোকা চোখের মণিদুটো এদিক সেদিক নাড়িয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলল লোকটা। 

আকাশ ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে মুখ নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তো চেষ্টা করলাম। পারলাম না। এতগুলো টাকা। কে দেবে আমাকে?’ 

—‘কে দেবে মানে? প্রয়োজনে কাজে না আসলে এসব বন্ধু বান্ধব দিয়ে হবে কী? পাওনাদার যদি আমাকে টাকার জন্য মেরে ফেলে, তখন কি তুমি খুব খুশি হবে? হ্যাঁ? এটাই কি চাও তুমি? মেরে ফেলতে চাও আমাকে?’ 

—‘আমি তো বলেছিলাম আপনার পাওনাদারের ফোন নম্বর এবং ঠিকানা দিন আমাকে। আমি তার সাথে যোগাযোগ করে একটা ব্যবস্থা করব।’ 

—‘তার ফোন নম্বর দিয়ে তুমি কী করবে? আমাকে কি বিশ্বাস হয় না তোমার? আমি কি মিথ্যা কথা বলছি?’ বাবার গলা চড়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। আকাশ কোনো দিকে না তাকিয়ে চায়ের কাপে মনোযোগ দিয়ে ফুঁ দিতে লাগল। থমথমে রাগ নিয়ে বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে চাপা গর্জন তুলে কী সব যেন বলতে লাগলেন ক্রমাগত। আকাশ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল, স্পষ্ট বোঝা গেলো না একটা শব্দও। কী বলছে লোকটা? অভিশাপ দিচ্ছে নাকি আকাশকে? প্রায়ই তো বলে, তুই মরিস না ক্যান? তোর মা মরছে, তুই মরতে পারিস না? সত্য, আকাশ মরে গেলে কি লোকটা খুশি হবে? হতেও পারে। মাতালদের কোনো বিশ্বাস নেই। 

হঠাৎ চোখ পড়ল তারার দিকে। মোটা চশমার ভেতরে দুটি বিস্ময় ভরা চোখ। এত বিস্ময় নিয়ে আকাশকে কী অতো দেখছে মেয়েটা কে জানে! কয়েকটা কোঁকড়ানো চুল কপালে এসে পড়েছে। উড়ছে ফ্যানের বাতাসে তিরতির করে। তারিয়ে তারিয়ে আচার খাচ্ছে। একটু যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে আজ। সেজেছে কি? কই নাহ। মুখে কোনো প্ৰসাধন নেই… আছে আছে, একটা খুশির প্রসাধন আছে আজ ওর মুখে। মেয়েটার বোধহয় আজ মন ভালো। রোগা মুখখানায় রোজকার বিষণ্ণ ভাবটা নেই। 

—‘আমাদের তারার অনার্স এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস এসেছে।’ ঝুমকি বলল, একটা নোনতা বিস্কুট মুখে পুরে দিয়ে 

—‘তাই নাকি? কনগ্রেচুলেশন্স!’ উৎসাহী গলায় বলল আকাশ।

—‘থ্যাংক ইউ!’ তারার ছোট্ট উত্তর। 

ঝুমকি আবার বলল, ‘শুধু এই নয়। আগামীকাল ওর জন্মদিন।’

—‘তাই নাকি?’ 

—‘আর জন্মদিন!’ বলে তারা নিচের দিকে মুখ নামিয়ে নেয়। জন্মদিন আবার কী? আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই একটা দিন। মা বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফিরনি রান্না করতেন। ব্যাস এটুকুই। এর চেয়ে বেশি হৈহুল্লোড় তার জন্মদিনকে ঘিরে কখনোই হয়নি। 

—‘কত হলো?’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে আকাশ। 

—‘কীসের কত?’ 

—‘তোমার।’ 

—‘আমার?’ 

—‘হ্যাঁ, বয়স কত হলো?’ 

—‘মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে হয় না। আপনি জানেন না? 

ঝুমকি মাঝখানে ঢুকে পড়ে বলল, ‘ওর আর কত হবে, তেইশ হলো মনে হয়।’ 

আকাশ নিজের কবজিতে জড়ানো হাতঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘আমি বেরোচ্ছি। কাল রাতে তাহলে তারার জন্মদিন সেলিব্রেট করব আমরা। সবাই বাইরে খাব।’ 

এ কথা শুনে তারা একটু লজ্জা পেয়ে গেলো। কী যেন বলতে গিয়েও বলল না আবার। মুখ নিচু করে মৃদু হাসল শুধু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *