বৃষ্টিমহল ৩.৬০

৬০

বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি!… ঝমঝম… ঝমঝম… ঝমঝম! অমৃতার কোলের ওপর বই। মাথা নত। বুকের ভেতর? শিরশির… শিরশির… শিরশির! সুন্দর, বড়ই সুন্দর এই সমস্ত কিছু। সুন্দর এই অঝোর শ্রাবণধারা, এই মেঘমেদুর হাওয়া! সুন্দর এই জানালা দিয়ে এলোমেলো মুখে এসে পড়া জলের ছিটা… সুন্দর ভেজা গাছের গুঁড়ির ঘ্রাণ, আগরবাতির পবিত্রতা, গুরুগুরু মেঘের ডাক, আর এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরতম যে জন… সে সম্মুখেই মূর্তিমান! হ্যাঁ সবার হয়তো এমনটা হয় না। কিন্তু অমৃতার হয়ে গেছে। ভাগ্যিস হয়েছিল, নইলে শক্তপোক্ত মনের মুখরা আইনজীবী মেয়েটা, কোনোও দিনও জানত না যে চুপচাপ কারো সামনে ঝিম ধরে বসে থাকার মাঝেও এমন আশ্চর্য সুখানুভূতি লুকিয়ে থাকতে পারে। জানত না কোনও প্রকার মাদকদ্রব্যর নেশা না করেও মাঝে মাঝে চোখে, মনে আর রক্তে অদম্য নেশা লেগে যায়। জানা হতো না একটা মানুষের এত কাছাকাছি থাকবার পরেও আরো একটু বেশি কাছে যাবার জন্য মন পাখিটা তৃষ্ণার্তের মতো এমন নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছটফট করতে পারে। এই ছটফটানিটাও ভীষণ ভালো লাগার! এ যেন ‘সব ভালো লাগার দেশ!’ কপাল জোরে মানুষটির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল তার এই জন্মে, নইলে এই ‘সব ভালো লাগার দেশটা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যেত আজীবন! 

রাশেদ হঠাৎ একটু নড়ে উঠতেই অমৃতা মুখ তুলে বলল, ‘চা খাবেন?’

—‘কী করে বুঝলে? চায়ের কথাই বলতে যাচ্ছিলাম।’ 

অমৃতা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘বুঝলাম। কারণ আপনি মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমি অনেক কিছু শুনে ফেলি।’ 

—‘তাই নাকি?’ একটা ভ্রু উঁচিয়ে গলায় কিঞ্চিৎ ঠাট্টার ভাব আনার চেষ্টা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। 

—‘সুলেমানকে বললেই হবে।’ একটু থেমে আবার বললেন, আলগা ভাবে। গোল বারান্দায় অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে ছিল সুলেমান। ঠান্ডা বাতাসে তার শরীর একটু কুঁকড়ে গেছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই পেছন ফিরে তাকালো সে। অমৃতা দরজার ফাঁকে একটা মাত্র চোখ রেখে খুব নিম্নস্বরে বলল -–‘সুলেমান ভাই, একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যায়?’ 

সুলেমান রোবটের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘জি ম্যাডাম, অবশ্যই।’ 

অমৃতা এক চোখ দিয়েই দেখল সুলেমান কথাটা বলে চুল পরিমাণও নড়ল না। পকেট থেকে সেলফোন বের করে ব্যস্তভাবে কোন একটা নম্বরে যেন ডায়াল করল। নিশ্চয়ই ভেতর বাড়ির কোনো কর্মচারীকে চা বানানোর অর্ডার দিচ্ছে। সামনের উঠোন বৃষ্টিতে সাদা হয়ে আছে। বারান্দা ভিজে থৈথৈ হয়ে গেছে জলে। বেচারার এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে না জানি কত কষ্ট হচ্ছে! দরজা বন্ধ করে সে বলল, ‘আপনি কী বলুন তো? বৃষ্টির মধ্যে সুলেমানকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ঠান্ডায় একেবারে জমে যাচ্ছে।’ 

রাশেদ ল্যাপটপের পর্দা থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘ঠান্ডায় জমে যাবে কেন? এমন কোনো শীত তো পড়ছে না!’ 

—‘কোল্ড ওয়েভ বাইরে। শুধু শুধু কেন উনাকে আটকে রেখেছেন? -’প্রয়োজন আছে তাই।’ 

—‘আপনার মনের মধ্যে একদম মায়া দয়া নেই।’ 

—‘মায়া দিয়ে কি দুনিয়া চলে? যার যেটা দায়িত্ব তাকে সেটা পালন করতেই হবে। সবার আগে কাজ।’ 

—‘কিন্তু উনার কাজটা কী এখানে? দাঁড়িয়ে থাকা?’ 

—‘আপাতত ওর কাজ হলো, কেউ আমার খোঁজ করতে আসলে বলে দেওয়া যে আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে।’ একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন,’তা আমিও তো কাজ করছি রাত জেগে। আমার জন্য তো কারো মায়া হচ্ছে না!’ 

অমৃতা বাচ্চা মেয়ের মতো ফিক করে হেসে দিল, ‘হচ্ছে না?’ 

—‘হচ্ছে নাকি?’ কপালে ভাঁজ ফেলে এক ভ্রু উঁচিয়ে তিনি জানতে চাইলেন। 

অমৃতা চোখ নামালো বইয়ের পাতায়। একটা অপ্রতিরোধ্য হাসির ভারে তার ঠোঁট বেঁকে গেছে তখন। সেই রাতের কথা মনে পড়ল হঠাৎ। সেই যে তানিশার সাথে সামির এনগেজমেন্টের রাতটা! অমৃতার উপস্থিতি পাছে কেউ টের পেয়ে যায় সেই ভয়ে একদম কাঁটা হয়ে ছিল লোকটা। অথচ আজ… আজ মনে হচ্ছে কেউ টের পেলেও যেন কিচ্ছু এসে যায় না। তিনি রাত জেগে কাজ করবেন আর অমৃতা তার সামনে চুপটি করে বসে থাকবে, এটা যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এমনটাই যেন হবার কথা ছিল। ভাবতে ভাবতে অমৃতার মুখে লটকে থাকা হাসিটা আরো একটু প্রসারিত হলো। তিনি কাজ থামিয়ে অমৃতার ওই অর্ধনিমীলিত মুখখানি দেখছিলেন। লম্বাটে মুখ, পুতুল চোখ, ছোট চোখা নাক, লাল লিপস্টিক মুছে যাওয়া ঈষৎ রক্তাভ ঠোঁট। লেবু রঙের ঢিলাঢালা একটা গেঞ্জি। কী যেন আছে… চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না! কী আছে? যা এই পৃথিবীর অন্য কোনো মুখে নেই? তীক্ষ্ণ গভীর পর্যবেক্ষণের সামনে পড়ে অমৃতা ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছিল। পারলে সে বইয়ের ভেতর ঢুকে যায়। মুখ লজ্জায় টুকটুকে লাল। একবার পলক তুলে তাকালো সে সামনে। তাকাতেই বাতাস স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। দুই জোড়া চোখের খাঁচায় বন্দি হয়ে গেলো এক জোড়া মন! 

কতক্ষণ কাটল কে জানে! হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। রাশেদ উঠে দাঁড়ালেন। দরজা খুলে সুলেমানের হাত থেকে চায়ের কাপের ট্রে নিলেন। কাঠের কারুকার্য করা কালো রঙের ট্রের ওপর চমৎকার ডিজাইনের সাদা আর নীল সিরামিকের একটি কেটলি। সাথে একই ডিজাইনের দুটি কাপ পিরিচ। দুধ চিনির ছোট দুটি গোল পাত্র। দুটা চায়ের চামচ, সাদা রঙের ন্যাপকিন আর তার পাশে ছোট্ট একটি নীল ফুলদানিতে রাখা প্লাস্টিকের তিনটি গোলাপ ফুল। টেবিলের ওপর ট্রে টা নামিয়ে রাখলেন তিনি। এরপর ল্যাম্পশেডের হলুদ বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে, সুইচ টিপে নীল রঙের একটি ডিমডিম বাতি জ্বালালেন ঘরে। হাত দিয়ে টেনে জানালার পর্দা দিলেন সরিয়ে। চেয়ার টেনে নিয়ে এসে রাখলেন জানালার পাশে। টেবিলের কাছে পুনরায় ফিরে এসে ড্রয়ার খুলে হাতড়ে বের করলেন সিগারেটের বাক্স। টেবিল থেকে তুলে নিলেন গোল মার্বেল পাথরের ছোট্ট ছাইদানি। হেঁটে এসে জানালার পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে পায়ের ওপর পা তুলে। ছাইদানি রাখলেন জানালার কার্নিশে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেটে ধরালেন আগুন। বাইরে তখনও ঝুম বৃষ্টি! 

অমৃতা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি গিলে খেল। সিগারেটের জন্য মন আইটাই করছে তার। কিন্তু করলেই কী? সিগারেট তো চাওয়া যাবে না উনার কাছে। ধূমপানের তেষ্টাটাকে গলা টিপে হত্যা করে সে কেটলি থেকে গরম লিকার ঢেলে নিল কাপে। বাদামি রঙের তরল পদার্থ থেকে সফেদ ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। সাথে চায়ের লিকারের সুন্দর একটা ঘ্রাণ। বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা রাতে এই ধোঁয়া ওঠা চায়ের এরোমা মোলায়েম একটা উষ্ণ ছোঁয়া এনে দিল মুহূর্তের মধ্যে। 

—‘চিনি ক চামচ?’ 

—‘দেড় চামচ।’

–‘দুধ?’ 

—‘রঙ চা দিও।’ 

চামচ দিয়ে চিনি নেড়ে নিয়ে পিরিচসহ চায়ের কাপটি এগিয়ে দিল অমৃতা উনার হাতে। তিনি পিরিচের ওপর থেকে চায়ের কাপটা শুধু তুলে নিলেন, ‘থ্যাংক ইউ।’ 

অমৃতা জবাবে হাসল। খালি পিরিচটা নিয়ে ফিরে আসলো টেবিলের কাছে। তারপর তিন চামচ চিনি আর দু চামচ গুঁড়াদুধ দিয়ে নিজের জন্য চা বানালো এক কাপ। বানানো হয়ে গেলে চায়ের কাপটা নিয়ে তার কোথায়, কোনদিকে বসা উচিত সেই বিষয়ে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। নিত্যদিনকার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সে বড়ই বিচক্ষণ, সপ্রতিভ এবং স্মার্ট একটি মেয়ে। কিন্তু এই লোকের সামনে এসে দাঁড়ালে সেই স্মার্টনেস তাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে সে টেবিলের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। 

রাশেদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দৃশ্যটা দেখলেন স্থির চোখে। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বললেন, ‘বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ 

অমৃতা বসল চেয়ারে, লোকটার দিকে মুখ ফিরিয়ে। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত আড়াইটা, মধ্যরাত! হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে আসলো তার। অলীক জগৎ থেকে অবতরণ করলেন বাস্তবে। বাড়িতে তার স্ত্রী হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা জেগে থেকে গল্পে মশগুল হয়ে আছে নিজের আত্মীয়স্বজনদের সাথে। আজকে তার ছেলেটার বিয়ে হলো। বাড়িতে প্রবেশ করল নতুন বৌ। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। সংসারের এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এসে, মধ্যরাতে একটি অর্ধপরিচিতা অল্পবয়সী মেয়ের সাথে তিনি একলা ঘরে বন্দি হয়ে বসে আছেন। ঘটনাটি তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যক্তিসত্তার বিপরীত। কী হচ্ছে তার সাথে এসব? তিনি কি পথভ্রষ্ট হচ্ছেন জীবন সায়াহ্নে এসে? যা হয়নি কখনো এই এত বছরের নিয়মবদ্ধ, দায়িত্ব ঘেরা, কর্মময় জীবনে, তাইই কি হয়ে যাচ্ছে শেষমেশ? এই মেয়েটি তার কে? কেউ নয়তো! 

চিন্তারাজ্যে ডুবে থেকেই চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি। 

—‘ইউ এস এ কেন যাচ্ছেন? বিজনেস নাকি পলিটিক্স?’ 

—‘দুটোই।’ 

—‘কোথায় থাকবেন?’ 

—‘ওয়াশিংটন ডিসি এবং নিউইয়র্ক।’ 

—‘আচ্ছা।’ চুপ করে গেলো অমৃতা। এরপর কী বলা যায়? বোবা বোবা একটা ভাব হচ্ছে তার। তাজ্জব ব্যাপার! 

—‘আমাকে কেন ডেকেছিলেন?’ কথা খুঁজে পেল অমৃতা। 

—‘তুমি কাঁদছিলে কেন?’ তার গলার স্বর গম্ভীর, থমথমে। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে একটু। তবুও বাতাস উতলা। 

একটু অপ্রস্তুত হলো অমৃতা, ‘কষ্ট পেয়েছিলাম।’ 

চোখের ওপর চোখ রাখলেন তিনি, ‘কেন?’ 

—‘আপনি… আপনি কেন বললেন আমার প্রতি আপনার কোনো আগ্রহ নেই?’ 

—‘এমন বললেই তুমি কাঁদবে?’ 

—‘হ্যাঁ কাঁদব।’ 

—‘তুমি কি খুব ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে?’ 

—‘একেবারেই না। আমার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন। বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি কখনো কাঁদি না। আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যে আমাকে কাঁদায়।’ 

—‘তাই?’ 

—‘ঠিক তাই। আপনিই প্রথম এবং শেষ মানুষ যার কাছে আমি এতটা সস্তা হয়ে গেলাম। আমার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে আমি এর আগে কখনো কোনো মানুষের কাছে এতটা ছোট হইনি।’ 

দমকা বাতাসে সিগারেটের আগুন হঠাৎ নিভে গেলো। রাশেদের তখন দুটি হাতই বন্ধ। এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে চায়ের কাপ। অতএব সিগারেটে পুনরায় আগুন ধরানোর কোনো উপায় নেই। অমৃতা উঠে দাঁড়ালো। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে বের করে নিল লাইটার। এগিয়ে গেলো কয়েক পা। চেয়ারের কাছাকাছি এসে ডান হাতে লাইটার চেপে ধরে, চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার সামনে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো সে। লাইটারের আগুন যখন জ্বলল তখন ওরা দুজন খুব মুখোমুখি, খুব কাছাকাছি! জীবনে এই প্রথমবার রাশেদ সম্পূর্ণ বিনা কারণে থমকে গেলেন, একটু কেমন উন্মনা দেখালো তাঁকে ক্ষণিকের জন্য। হাওয়ার তোড়ে নাচতে থাকা জ্বলন্ত অগ্নিশিখাটা অমৃতার মুখের ওপর কমলা রঙের একটা আঁচ ফেলেছিল। চিকচিক করছিল মোমের মতো ফর্সা ত্বক। গভীর চোখজোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওর বেড়ালের মতো আদুরে গালে, রক্তাভ ঠোঁটে। একজন আরেকজনের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল পরিষ্কার। হাওয়ার দাপটে দস্যি আগুন নিভে গেলো। জ্বলল আবার। একটা আচ্ছন্নতা ক্রমেই ডুবিয়ে দিচ্ছিল অমৃতাকে। সামনের মানুষটা তাকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করছে। চেতন অবচেতনের মধ্যে উন্মত্ত এক ভাব দ্রুত মিশে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে… থাক, সব ইচ্ছেকে অত প্রশ্রয় দিতে নেই। কয়েকটা দুর্বোধ্য মুহূর্তের পর তিনি একটু নড়ে উঠে হাতে ধরা সিগারেটটা এগিয়ে দিলেন লাইটারের সামনে। সিগারেটে আগুন ধরল। একটা বড় শ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অমৃতা। ফিরে আসলো টেবিলের কাছে। বুক ধড়ফড় করছে তার। গলা তেষ্টায় চৌচির। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে গলায় ঢালল সে। 

—‘অমৃতা শোনো, একটা জরুরি কথা বলি তোমাকে।’ গলার স্বর… ভীষণ ভরাট! রাতের নিস্তব্ধতা নিজেই যেন চমকে যায়। চমকায় অমৃতাও। ফিরে তাকায়, একটু বিপন্নভাবে বলে, ‘জি বলুন!’ 

রাশেদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন। আঙুল ঝাঁকিয়ে এশট্রেতে ফেললেন ছাই। চোখ জানালার বাইরে রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘লিসেন, আমি তোমার অনুভূতিকে সম্মান করি। আই রেস্পেক্ট ইওর ফিলিংস।’ 

—‘সত্যি?’ অমৃতার কণ্ঠ তরঙ্গময় প্রতিধ্বনির মতো শোনালো। 

—‘হ্যাঁ, সত্যি। কিন্তু তুমি হয়তো এখনও বুঝতে পারছ না… এই অনুভূতিটা সঠিক নয়। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে। আশা করছি খুব দ্রুতই এই ভুলটাকে শুধরে নেবে। তোমার সামনে ব্রাইট ফিউচার। কাজে মন দাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

—‘ভুলে যাব?’ অবিশ্বাস ঠিকরে বের হয় অমৃতার চোখ দিয়ে। 

—‘হ্যাঁ যাবে। একমাস আমি থাকছি না। এই এক মাস তুমি খুব মন দিয়ে কাজ করবে এবং চেষ্টা করবে সবকিছু ভুলে যাওয়ার।’ 

—‘এত সোজা?’ চোখের সামনের পর্দাটা ঘোলা হয়ে আসছিল অমৃতার। 

—‘খুব সোজা। একবার চেষ্টা করেই দেখো না।’ 

—‘আপনার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় থাকবে না এই এক মাস?’ 

—‘না। উপায় থাকলেও তুমি যোগাযোগ করবে না।’ 

—‘মনে পড়লে?’ 

—‘মনে পড়লেও মনে করবে না।’ এটুকু বলে তিনি জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেন। অমৃতার চোখে চেয়ে গভীর গলায় বললেন, ‘ক্যান ইউ ডু দ্যাট ফর মি?’ 

অমৃতা কান্নার একটা ঢোক গিলল, ‘আই ক্যান ডু এনিথিং ফর ইউ!’ 

কথাটা মস্তিষ্কে নয়, মগজে নয়, বুকের এমন জায়গায় গিয়ে লাগল যে জায়গাটা এতগুলো বছর ধরে একদম ফাঁকা পড়ে ছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন, তালাবন্ধ বাক্সটা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। জীবনের এই ঘোর অসময়ে! কী আশ্চর্য! 

—‘গুড! আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেক রাত হয়ে গেছে অমৃতা, তোমার ফিরে যাওয়া উচিত।’ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন তিনি। 

—‘এটা তাহলে ফেয়ারওয়েল ছিল?’ 

—‘কাইন্ড অব।’ 

—‘আপনি আমাকে এত কষ্ট দেন কেন?’ 

—‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না! আর চাই না বলেই ভীষণভাবে চাইছি তুমি যেন সবকিছু ভুলে যাও।’ 

—‘ভুলে যাওয়া যায় এমন কোনো ওষুধ আছে? থাকলে দিন।’ 

তিনি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন, ‘ওষুধটা তোমার নিজের ভেতরেই আছে। ট্রাই টু ফিগার ইট আউট। অন্য কিছুতে মন দাও।’ 

অমৃতা একথার পিঠে কিছু বলল না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। —‘এবার তুমি এসো।’ 

—‘চলে যাব?’ 

—‘হুম।’ 

কয়েক মুহূর্ত নীরব বিষণ্নতা, আর অস্বস্তি। একটা সময় অমৃতা নিশ্বাস বন্ধ করে করল,’চলে যাচ্ছি। যাবার আগে আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি? 

—‘না।’ 

—‘কেন নয়?’ 

—‘আমি বলেছি তাই।’ 

—‘তাহলে আপনি আমাকে একটু আদর করে দিন। আর কিচ্ছু চাইব না কোনোদিন।’ 

রাশেদ ভীষণ চমকে উঠলেন। 

–‘তোমার মাথা ঠিক নেই। 

—‘হাও এবাউট আ গুডনাইট কিস? দেবেন?’ ঝাপসা চোখে আবছা গলায় বলল অমৃতা। 

—‘নো ওয়ে!’ 

একটা চাপা শ্বাস পড়ল অমৃতার –’আপনার পায়ের কাছে একটু বসে থাকতে দেবেন?’ 

—‘কেন?’ 

—‘এমনিই। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় আপনার পায়ের কাছে চুপচাপ বসে থাকি। 

তিনি কোনো কথা বললেন না। নীল রঙের ডিমডিম আলোয় অমৃতা তাঁর শ্যামবর্ণের মুখখানায় একটু লালচে আভাস দেখতে পেল। সিগারেটের শেষ ছাইটুকু এশট্রেতে ফেললেন তিনি। অমৃতা এগিয়ে এসে চেয়ারের সামনে সিমেন্টের মেঝেতে তাঁর পায়ের কাছে বসল। হাঁটু ভাঁজ করে। কিছু মুহূর্ত নীরবে কাটল। একটা সময় অমৃতা খুব সন্তর্পণে তাঁর ডান হাঁটুর ওপর নিজের মাথাটা রাখল, ঘাড় কাৎ করে। বিড়বিড় করে বলল, ‘রাশেদ! খুব ভালো হতো, আপনি যদি সামির বাবা না হতেন! 

রাশেদ ধীরে ধীরে একটা হাত অমৃতার মাথার ওপর রাখলেন। কোনো কথা বললেন না। ওর সিল্কের মতো নরম ছোট ছোট চুলগুলো আঙুল দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতে লাগলেন শুধু। একটা গাঢ় অদ্ভুত বিষণ্ণতা একটু একটু করে ফোঁটা ফোঁটা তরলের মতো তাঁর মনের ভেতর দ্রবীভূত হচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছে, আজকের পর থেকে এই মেয়েটিকে ছাড়া বেঁচে থাকতে কষ্ট হবে! বৃষ্টি তখন সম্পূর্ণ থেমে গেছে। সোঁদা মাটির ঘ্রাণে ভরে আছে ভেজা বাতাস। ঠান্ডা শান্তি শান্তি ভাব চারপাশে। কাছাকাছি কোথাও একটা পেঁচা ডাকছে থেকে থেকে, হুহু করে। আগরবাতিরা জ্বলে জ্বলে খুশবু ছড়াচ্ছে ক্রমাগত। রাত বাড়ছিল। শ্রাবণ মেঘের তমসাময় রাত। অমৃতা আদুরে পোষা বেড়ালের মতো গুটিশুটি হয়ে বসে ছিল রাশেদের পায়ের কাছে। কোলের ওপর মাথা রেখে। নিচ্ছিদ্র পবিত্রতায় দুজনের শরীর এবং মন ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে উঠছিল। 

কিছু সময় পর আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, বারান্দায় কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। শোনা গেলো সুলেমানের গলা এবং একটি পরিচিত নারী কণ্ঠ! জানালার পর্দা সরানো ছিল বলে নির্দ্বিধায় গোল বারান্দার দৃশ্যটা এক ঝলকে দেখে নিলেন রাশেদ। দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটু আড়ালে সরে আসলেন। ঘরের ভেতর ডিম লাইট জ্বলার কারণে বাইরে থেকে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাবার কথা নয়। কিন্তু ভেতর থেকে স্পষ্ট ঠাওর করা যাচ্ছে যে অন্ধকারে দুটি নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। একজন রোমেলা। দ্বিতীয় জন কে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। শালিদের মধ্যে কেউ হবে হয়তো। মধ্যরাতে হঠাৎ বোনকে সঙ্গে নিয়ে রোমেলার এই ঘরে আগমনের পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা ঠিক বোধগম্য হলো না। 

অমৃতা তখনও মেঝেতে লেপ্টে বসে ছিল, উৎকর্ণ হয়ে। তার চোখ বিস্ফারিত, মুখ রক্তশূন্য। হৃৎপিণ্ড ছুটছে ট্রেনের গতিতে। রাশেদকে বিচলিত দেখাচ্ছে না খুব একটা। কিন্তু তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যটা আরো দ্বিগুণ রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং সাবধানী। 

—‘ভেতরে যাওয়া যাবে না বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? লাইট তো নেভানো। তোমার স্যার করছেন কী?’ রোমেলার কর্কশ গলার স্বর ভেসে আসলো জানালা দিয়ে। দম বন্ধ করে ঘরবন্দি দুটি মানুষ শুনতে লাগল সেই কথোপকথন। 

সুলেমান কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘তা আমি জানি না ম্যাডাম। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হইছে কেউ আসলে যেন ভেতরে যাইতে দেওয়া না হয়। স্যার ব্যস্ত আছেন। আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করছি।’ 

রোমেলা গর্জে উঠে বললেন, ‘আরে আশ্চর্য! অন্য কারো সাথে আমাকে মিলাচ্ছ কেন তুমি? বেয়াদবি করার আর জায়গা পাও না? দেখি সরো!’ কথাগুলো বলা শেষ করেই রোমেলা ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ালেন সদর্পে। সুলেমান অসীম সাহসিকতার একটা কাজ করে ফেলল মুহূর্তের মধ্যে। রোমেলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বাধা দিয়ে বলল, ‘স্যরি ম্যাডাম, আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না এখন। স্যারের নিষেধ আছে।’ 

অমৃতার হাঁটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছিল। জীবনে এর আগে কোনোদিন এতটা ভয় পায়নি সে। নিজেকে যথেষ্ট সাহসী বলেই জেনে এসেছে বাল্যকাল থেকে। কিন্তু আজ ওই মহিলার কণ্ঠস্বর তার শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে এক অদম্য ভীতির সঞ্চার করছে। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা ক্রিয়া বন্ধ করে জড়পদার্থে রূপান্তরিত হবে এখুনি! 

—‘এত বড় সাহস তোমার! আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছ? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো আমি তোমাকে! দেখব তুমি কীভাবে চাকরি করো!’ 

রাশেদ সেই মুহূর্তে হঠাৎ নড়ে উঠলেন। স্থিরচিত্র থেকে যেন আচমকা চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হলো অমৃতার চোখের সামনের দৃশ্যপট। সে দেখল মানুষটা খুব দৃঢ় ভঙ্গিতে কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে দরজা খুললেন। পা রাখলেন চৌকাঠের বাইরে। 

—‘কী ব্যাপার?’ হিমায়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রাশেদ। অটল এবং দৃঢ়চিত্তে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই মুহূর্তে তাঁর ভেতর বিন্দুমাত্র অপরাধ বোধ কাজ করছে না। এক অনির্বচনীয় নির্লিপ্ততায় ছেয়ে আছে সারা মন। তিনি কি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছেন? নৈতিকতা, শিষ্টতা, শ্লীলতা এই সমস্ত সামাজিক এবং মানবিক গুণাবলি কি তাঁর ভেতর থেকে লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে? না ঠিক তা নয়। আসলে তাঁর তো কাউকে ভয় পাবার নেই। তিনি আর যাই হোন না কেন, ভীতু এবং দুর্বল চিত্তের অধিকারী নন। স্ত্রীর ভয়ে সিঁটিয়ে যাবার মতো পুরুষ মানুষ তিনি কোনোকালেই ছিলেন না। 

—‘কী ব্যাপার মানে? তোমার এই দারোয়ান আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না! আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। কী সাহস!’ 

—‘এখানে ওর তো কোনো দোষ নেই। ও শুধু আমার আদেশ পালন করছে।’ কথা বলতে বলতে হক রোমেলার পাশে দাঁড়ানো মহিলাটিকে দেখলেন একবার। না একে তিনি চেনেন না। নতুন মুখ। 

রোমেলা স্বামীর গম্ভীর মুখের কঠিন কথা শুনতে পেয়ে একটু থমকে গেলেন ক্ষণিকের জন্য। বন্ধ দরজার দিকে তেরছা এবং তীব্র চোখে তাকালেন একবার। সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, ‘তুমি কী করছিলে?’ 

—‘কাজ।’ 

—‘ভেতরে যাওয়া নিষেধ কেন?’ 

—‘সেই কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে? তুমি কেন এসেছ? কী দরকার?’

–‘এভাবে কথা বলছ কেন?’ 

—‘একটু আগে তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল। তখন তো তুমি আসোনি। হাতে মেহেদী দিচ্ছিলে। এখন কেন এসেছ?’ 

রোমেলা এ কথা শুনে একটু বিব্রত বোধ করলেন পাশে দাঁড়ানো মহিলাটির সামনে। আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, –’আমার চাচাতো বোন, রুমা। চিনেছ ওকে?’ 

—‘না উনার সাথে আমার পরিচয় নেই। ‘ 

—‘আছে। তুমি ভুলে গেছ।’ 

—‘হতে পারে।’ দায়সারা শোনালো রাশেদের কণ্ঠ। 

–‘ও তো লাইব্রেরি ঘরটা কখনো দেখেনি। তাই দেখাতে নিয়ে আসলাম।’ 

রাশেদ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘ এবং মন্থর নিশ্বাস। লোক দেখানোতেই এই মানবীটির পার্থিব জীবনের চরম সুখ নিহিত। কী আশ্চর্য! 

—‘রাত কটা বাজে দেখেছ?’ কেটে কেটে প্রশ্নটা করলেন তিনি।

সেই সময় পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি কথা বলে উঠল প্রথমবারের মতো, ‘থাক আপা, দুলাভাইকে ডিস্টার্ব করো না। চল ফিরে যাই।’ কথাটি বলে শেষ করে সে ঘুরে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হেঁটে হেঁটে দূরে সরে গিয়ে অদৃশ্য হলো অন্ধকারে। 

রোমেলা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে এভাবে অপমান করলে?’ 

—‘অপমানের কিছু নেই এখানে। না বলে কয়ে হুট করে অপরিচিত লোক সঙ্গে নিয়ে আসাটা উচিত হয়নি তোমার।’ 

—‘তোমার ঘরে আসতে হলে আমার পারমিশন নিয়ে আসতে হবে?’

—‘তুমি তো আমার কাছে আসোনি, এসেছ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে।’

—‘অন্য উদ্দেশ্য মানে?’ 

আবারও দীর্ঘ নিশ্বাস, ‘তুমি বুঝবে না।’ 

—‘বুঝিয়ে বললেই বুঝব! 

—‘থাক বাদ দাও।’ 

রোমেলা আর কোনো কথা না বলে হঠাৎ পা বাড়ালেন সামনে। এই প্রথমবারের মতো রাশেদের আত্মায় একটু কাঁপন ধরল। রোমেলা যদি জোরজবরদস্তি করে এখন ভেতরে ঢুকে যায়… তাহলে কী হবে? 

—‘পথ আটকাচ্ছ কেন?’ 

—‘বাড়ি যাও।’ 

—‘বাড়িতেই আছি।’ 

—‘বেশ তো নিজের ঘরে যাও।’ 

—‘এটা কি আমার ঘর নয়?’ 

—‘রোমেলা, কথা বাড়িও না। বলছি ফিরে যাও!’ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরটা কাঁপিয়ে দিল চারপাশ। সুলেমান একটু দূরে সরে গিয়েছিল। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে সে। 

—‘ভেতরে কি কেউ আছে?’ রোমেলার কণ্ঠে এখন সন্দেহের স্পষ্ট সুর বাজছে ঝনঝন করে। এ ঘরে তাঁর খুব একটা আসা হয় না। স্বামী রাত জেগে কাজ করেন। বেশির ভাগ সময় একলাই থাকেন। কাজের কথা শুনতে রোমেলার কখনওই ভালো লাগে না। তিনি রাজনীতি এবং ব্যবসা এর কোনোটাই ঠিকমতো বোঝেন না। তাই স্বামীকে একাগ্রচিত্তে নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ দেন। কাজের সময় এসে অকারণে হানা দেন না। কিন্তু এর মানে তো এই না যে তাঁর গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। এত বড় অপমান তিনি কোনো মতেই সহ্য করবেন না। 

—‘আমি ভেতরে যেতে চাই!’ 

—‘ভেতরে এখন যাওয়া যাবে না।’ 

কয়েকটা মুহূর্ত রোমেলা জ্বলন্ত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হিম শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,’তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ?’ 

—‘ফিরে যাও!’ 

—‘ভেতরে কে আছে?’ 

—‘ফিরে যেতে বলেছি!’ 

এর পরের কয়েকটা সেকেন্ড থমথমে নীরবতায় কাটলো। রোমেলা আরো কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ঘুরে দাঁড়ালেন। তখন আবারও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। হক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রীর চলে যাওয়া দেখলেন। খানিক বাদে দূরে লাইট দিয়ে সুসজ্জিত দালানের সামনে রোমেলার নিস্তেজ শরীরটা দেখা গেলো। ধীরেধীরে মিলিয়ে গেলো শরীরটা প্রাসাদতুল্য বাড়ির পেটের মধ্যে। 

—‘সুলেমান!’ 

—‘জি স্যার!’ অন্ধকারে হঠাৎ ভেসে উঠল সুলেমানের হৃষ্টপুষ্ট কায়াখানি। 

—‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি ভয় পেও না। তোমার চাকরি যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘ 

সুলেমান খুব ভালো মতোই জানে তার চাকরি যাবার সম্ভাবনা নেই। এই বাড়িতে কাজ করছে সে বহু দিন হয়ে গেলো। সে রাশেদুল হকের বাবার আমলের লোক। গেলো মাসে তার দুটি যমজ নাতনির বিবাহ সম্পন্ন হলো। হক সাহেব নিজেই বিয়ের সমস্ত খরচ দিয়েছেন। এমন কি তার ছোট নাতিটির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচটাও হক সাহেব বহন করছেন। এই ব্যক্তি সাক্ষাৎ দেবতা। দেবতুল্য মানুষটির কিন্তু কখনোই মেয়েমানুষের দোষ ছিল না। হঠাৎ এই ভীমরতি কেন ধরল সুলেমান জানে না। মালকিন মহিলাটিকে সে খুব একটা পছন্দ করে না অহংকারী এবং ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য। হক সাহেবের মতো উদার মনের মানুষের পাশে অমন সংকীর্ণমনা, খটোমটো মেয়েছেলে মানায় না এ কথা সত্য, কিন্তু সংসারটার জন্য তার বড় মায়া হচ্ছে। আহা এত বছরের পুরনো সংসার! বয়কাট চুলের মেয়েটাকে বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না। জেনেশুনে সাজানো গোছানো সংসার ভাঙতে এসেছে। মেয়েটার বয়সও অল্প। ছোট সাহেবের বন্ধু। শেষ পর্যন্ত কিনা ছেলের বন্ধুর সাথে! ইশ সুলেমান আর ভাবতে পারে না। তার মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়। কিন্তু চাকর হয়ে তো তার কিছু বলা সাজে না। চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। সে বিনয়ের সাথে উত্তর দিল, ‘জি স্যার!’ 

অমৃতা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে ছিল। তার মাথা নিচু, কপাল ঠেকানো হাঁটুতে। দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে সে সম্মুখে চোখ মেলে তাকালো। তার ঠোঁট কাঁপছে মৃদু। চোখের কোলে টলমল করছে রুপো রঙের জলবিন্দু। বড় বড় শ্বাস পড়ছে এলোমেলোভাবে। 

—‘তুমি ঠিক আছ?’ খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলেন তিনি। 

অমৃতা কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না, বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে চেয়ে রইল শুধু। রাশেদ চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন অমৃতার সামনে। একটু ঝুঁকে অমৃতার মুখটা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘ভয় পেয়েছ?’ 

—‘আমি খুব খারাপ! তাই না?’ 

—‘তোমার তাই মনে হচ্ছে?’ 

—‘স্যরি! আমার জন্য আপনার ওয়াইফের সাথে মনোমালিন্য হয়ে গেলো।’ 

—‘তুমি স্যরি বলছ কেন? তোমাকে তো আমি ডেকে এনেছি। দোষ হলে আমার হয়েছে, তোমার নয়।’ 

—‘আমার দোষ। সব আমার দোষ!’ 

রাশেদ স্থির চোখে ওর দিকে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘দোষ কিংবা ভুল যাই বলো না কেন, তা শুধরে নেবার সময় এখনো আছে। চিন্তা করো না।’ 

অমৃতা উঠে দাঁড়ালো। দুহাত দিয়ে কচলে কচলে মুছল চোখের পানি।

—‘যাই!’ 

—‘হুম এসো।’ রাশেদ উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। অমৃতা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে একবার ঘুরে তাকালো পেছনে। ভেজা ভেজা পুতুল দুটি চোখ মেলে ধরল মানুষটার মুখের ওপর। কয়েক সেকেন্ড কাটলো বিনা বাক্যব্যয়ে। একটা সময় তিনি বললেন, ‘কী হলো?’ 

—‘দেখে নিচ্ছি একটু। আবার কখনো দেখা হয় কিনা!’ 

তিনি কী বলবেন খুঁজে পেলেন না। চুপ করে রইলেন। তাঁর চেহারা থেকে এতক্ষণের কাঠিন্যটা মুছে গিয়ে একটা কোমলভাবের উদয় হয়েছে। জীবনের সংজ্ঞাটা পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ভুল, সঠিক, পাপ, পূণ্যর মতো সমস্ত জাগতিক নৈতিকতা এই মুহূর্তটির কাছে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির দিকে এরকম নিশ্চুপ চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে তার। এইসব অহেতুক ভালোলাগারা এমন তুলকালাম ভাবে তাড়া করেনি এর আগে কখনো। এখন এই ধাবমান অনুভূতির হাত থেকে তিনি পালাবেন কী করে? তিনি তো কখনোই ভীতু, পলায়নবাদী, কাপুরুষ ছিলেন না। দেশ ও দশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আজীবন, পিতা মাতা এবং স্ত্রী, পুত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন সুনিপুণভাবে। পরিবারের কথা চিন্তা করে অষ্টপ্রহর যন্ত্রচালিতের মতো খেটে চলেছেন নাওয়া খাওয়া ভুলে। এবার কি তবে সময় এসেছে একদণ্ড নিজের কথা ভাববার? সময় এসেছে কি একটু স্বার্থপর হবার? কিন্তু তাঁর যে একটা সন্তান আছে! তিনি যদি আজ কোনো গর্হিত কাজ করে বসেন আবেগের বশে, তবে সেই ভুলের রেশ একমাত্র পুত্রকে বইতে হবে সারাটি জীবন। তাঁর একটি মাত্র সন্তান! নাহ, কোনো ভাবেই এই জায়গাটাতে আপোষ চলবে না! 

—‘গুডনাইট অমৃতা। ভালো থেকো।’ কথাটা বলে তিনি এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। 

অমৃতা কাঠের দরজাটার নব ধরে কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কী যেন একটা বলবার জন্য মুখ খুলল, আবার ঢোক গিলে ফেলল। মিনিট দুয়েক পর পায়ে পায়ে হেঁটে টেবিলের কাছে এগিয়ে আসলো। কাঁপা হাতে একটা ছোট কাগজ আর কলম তুলে নিয়ে তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, 

‘রাশেদ, আপনাকে ভালোবাসি নিশ্বাসের মতো। নিশ্বাস নিতে যেদিন ভুলে যাব সেদিন আশা করি আপনাকেও ভুলতে পারব। আমি কাউকে ভয় পাই না। আপনার স্ত্রী যদি কিছু জানতে পারে তাহলে বলবেন সব দোষ অমৃতা নামের বাজে মেয়েটার। এরপর আপনারা যে শাস্তিই আমাকে দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব।’ 

কাগজটা পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে অমৃতা প্রস্থান করল। তিনি খানিক বাদে কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে পড়লেন। পড়েই হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেললেন। ট্র্যাশ করতে যাবার আগ মুহূর্তে আবার কী মনে করে যেন থমকে গেলেন। মোচড়ানো কাগজটা টেনেটুনে সোজা করলেন। তারপর সযত্নে তুলে রাখলেন টেবিল সংলগ্ন ড্রয়ারে। 

বাড়িতে নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখলেন রোমেলা বাতি নিভিয়ে বসে আছে বিছানায়, মূর্তির মতো। তিনতলা দালানের সর্বাঙ্গে জ্বলতে থাকা মরিচ বাতির আগুন আগুন ছাপ জানলা গেলে এসে পড়ছে তার এলো করে খোলা চুলের ঢেউয়ের খাঁজে। হক ঘরে ঢুকতেই তিনি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে অনেকটা চাপা গলায় বললেন, ‘তোমার জীবনে কি অন্য কেউ আছে?’ 

হক থমকে গেলেন। স্থবির হয়ে গেলেন। হতচকিত ভাবে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন বহু বছরের পুরোনো স্ত্রীর দিকে। 

—‘উত্তর দিচ্ছ না কেন?’ 

হক তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কথা বললেন না। ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা আটকালেন ধীরে সুস্থে। কয়েক পা এগিয়ে ঘরের মাঝামাঝি অবস্থানে এসে রোমেলার দিকে ঘুরে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে বললেন, ‘আমার জীবনে এখন অবধি তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। কিন্তু তুমি যদি জীবনের কথা জানতে না চেয়ে মনের কথা জানতে চাইতে, তাহলে হয়তো উত্তরটা অন্যরকম হতো।’ 

রোমেলা দম বন্ধ করে বললেন, ‘উত্তরটা জানতে চাই।’ 

—‘শূন্যস্থান পূরণ হওয়া দোষের কিছু নয়। ‘ 

রোমেলা অদ্ভুত হাসলেন, ‘তাহলে তুমি স্বীকার করেই নিলে যে তোমার মনে আমার জন্য কখনো কোনো জায়গা ছিল না?’ 

—‘জায়গা করে নেবার কোনো চেষ্টা তো তুমি করোনি। কতগুলো বছর কেটে গেলো!’ 

—‘তাই না? তুমি কী চেষ্টা করেছ, শুনি?’ রোমেলার গলা চড়ে যাচ্ছিল।

-–‘আমার চেষ্টা কখনোই ফলপ্রসূ হয়নি। তোমার মনে তো জীবনের শুরু থেকে অন্য কেউ ছিল। আজকে যদি আমার জীবনে প্রাচুর্য না থাকত রোমেলা, তাহলে হয়তো তুমি আমাকে ছেড়ে অনেক আগেই তোমার প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে। এ কথা কি সত্য নয়? তুমি কি অস্বীকার করতে পারো?’ 

রোমেলা অবিশ্বাস ভরা ক্ষীণকণ্ঠে বললেন,’তুমি কি এখন তার প্রতিশোধ নিতে চাইছ? এত বছর পরে এসে?’ 

হক চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ একটু দুর্বোধ্য হেসে বললেন, ‘প্রতিশোধ নেবার যথাযথ ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে প্রকৃতির আছে। মানুষের হয়ে যদি কখনো প্রকৃতিই প্রতিশোধ নিয়ে থাকে, তবে সেই প্রতিশোধের দায়ভার মানুষের ওপরে বর্তায় না।’ 

—‘মেয়েটা কে?’ হঠাৎ এক তীব্র চিৎকার ঘরময় ফেটে পড়ল বোমার শব্দের মতো। 

—‘চিৎকার করো না। ঘরে নতুন বৌ এসেছে।’ 

রোমেলা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘আমি জানতে চাই মেয়েটা কে?’ 

—‘জানার সময় এখনো আসেনি।’ কথাটা বলে হক তোয়ালে কাঁধে নিয়ে গোসলখানায় ঢুকে পড়লেন। রোমেলা অন্ধকারে একলা বসে সর্পিনীর মতো ফুঁসতে লাগলেন। হাত পা কাঁপছে তাঁর। শরীরের প্রতিটি রোমকূপে ঝলসে উঠছে ধ্বংসাত্মক লেলিহান তেজ। সব সংসারে মনের মিল থাকে না। মতের মিল দিয়েই জীবন কাটাতে হয়। মনের দাবি ভুলে থেকে সংসার, আপনজন এবং সমাজের সাথে বেঁধেছেদে মানুষ জোড়াতালি দিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। দিতে হয়। জীবনটা রূপকথা নয়। হ্যাঁ, রূপকথার মতো সুন্দর প্রেম এসেছিল একবার তাঁর জীবনে। কিন্তু সেই রূপকথার রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল সমাজ এবং পরিবার। সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। একটা অন্ধ বিভীষণ রাগ তাঁর চেতনা লুপ্ত করে দিচ্ছিল। মহিলাটা কে তা জানতেই হবে। সুলেমানের কাছ থেকে যে করেই হোক কথা বের করতে হবে। সেই মহিলা কি লাইব্রেরি ঘরের ভেতরেই ছিল এতক্ষণ? কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! তাঁর স্বামীর এর আগে কখনো চরিত্রগত দুর্বলতা ছিল না। দেশ বিদেশের ডানাকাটা সুন্দরী মেয়েরা কাজের খাতিরে তাঁর আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে সর্বক্ষণ। নানাভাবে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি সাড়া দেন নি। আজ এতকাল পরে এসে এ কোন ডাইনি এসে জুটল তাঁর কপালে? কে এই মায়াবিনী কুহকিনী? যে এত বছরের পুরনো সংসার ভেঙে ছারখার করে দিতে চাইছে? ছাড়বেন না, কিছুতেই ছাড়বেন না তিনি। যে রোমেলার এত বড় সর্বনাশ করল, সেই রাক্ষুসী কালনাগিনীর জীবনে ধ্বংস অনিবার্য! 

৬১

আজ প্রথম সকাল! আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভাঙলো সামির। ভারি চোখের পাতা দুটো অনেক কষ্টে মেলে ধরে দেখল চৈত্র প্রাতের হেম রঙা রোদে ভেসে যাচ্ছে সারা ঘর। হৃদি শুয়ে আছে পাশে। বালিশের ওপর এলোমেলো ছড়িয়ে আছে তার লম্বা ঘন কালো চুল। কপালের ওপর অবহেলায় পড়ে আছে একটি বাসি গোলাপের কালো পাঁপড়ি। চৈত্রের সোনা রোদ ধুয়ে দিচ্ছে ওর মায়াবী সুন্দর কোমল মুখখানি। আজকের পর থেকে প্রতিটি সকাল এরকম মধুর হয়েই অবতরণ করবে ধরণীতে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে প্রিয়মুখ দর্শন! আহা, ইচ্ছে জীবন বুঝি একেই বলে! 

সামি খুব যত্নের সাথে হৃদির কপাল থেকে ফুলের পাঁপড়িটা তুলে নিল। তারপর ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে এঁকে দিল একটি গাঢ় চুম্বন। ঘুম ভেঙে গেলো হৃদির। ভাঙতেই চোখের সামনে সামির মুখটা দেখতে পেয়ে সে ভারি সুন্দর একটা তৃপ্তির হাসি হাসল। সামি আদুরে গলায় বলল,’উঠে যা, আজকে বাবা ইউ এস এ যাচ্ছে। বিভাও চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়া।’ 

—‘হুম।’ আলসে গলায় বলল হৃদি। আরও কয়েকটা মিনিট বিছানায় গড়াগড়ি করে নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। সামি ওয়াশরুমের দিকে গেছে। ঘড়িতে বাজে সাতটা। বিভা আটটার দিকেই বেরিয়ে পড়বে। ওদের বাসায় যাবে প্রথমে, বাবা মায়ের সাথে দেখা করবে। তারপর সুটকেস নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। বিভা চলে যাবে এটা মনে পড়তেই হৃদির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। খারাপ হওয়া মন নিয়ে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখল সে। বিয়ের আগে এই ঘরে বহুবার এসেছে। তখন সামির সাথে প্রেম ছিল না, ছিল শুধুই বন্ধুত্ব। কখনো ভুলেও ভাবেনি যে এ ঘরটা একদিন তার নিজের হবে। নিজের! সত্যই কি আজ থেকে এই ঘর, এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলো সব তার নিজের হয়ে গেছে? একটা দিনের তফাতে কি জীবন এতটা বদলে যায়? হৃদি একটা বড় নিশ্বাস টেনে নিল। তার বাবার বাড়ির বেডরুমের তুলনায় এই বেডরুম তিন গুণ বড়। বাড়িটিও যেন রাজপ্রাসাদ। রাজপুত্রের মতোই রূপবান তার স্বামী। চারপাশে সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করছে অগণিত দাসদাসি। এ বাড়ির লোকেরা জগ থেকে গ্লাসে পানি পর্যন্ত ঢেলে খায় না। এমনটা কি চেয়েছিল সে কখনো? কী আশ্চর্য, মানুষ চায় এক, আর হয় আরেক। তার স্বপ্ন ছিল একটা ছোট্ট দখিনমুখি ফ্ল্যাট। দুই বেডরুম, একটা ডাইনিং, ছোট একটা রান্নাঘর আর এক চিলতে ঝুল বারান্দা। নিজের সংসার ইচ্ছেমতো সাজাবে সে, মন খুলে রান্না করবে, ছুটির দিনে বারান্দায় বসে নিজ হাতে ফুলের বাগান করবে। শুধু সামি, আর সে আর তাদের ছোট্ট ছিমছাম সংসার। সেইসব কিছুই হলো না, হলো এক রূপকথার কারবার। রাজপ্রাসাদের রাজবধূ হয়ে নতুন জীবন শুরু হলো তার। অথচ রাজনন্দিনী সে হতে চায়নি, হতে চেয়েছিল সাধারণ এক মধ্যবিত্ত গৃহবধু। আজ বিকেলে গুলশানের অভিজাত ফার্নিচারের দোকানে যাবে তারা স্বামী স্ত্রী ফার্নিচার অর্ডার করতে। যে ফার্নিচারগুলো সামি অনলাইনে দেখে রেখেছে সেগুলোর দাম কোটি ছাড়িয়ে যাবে। শ্বশুরমশাই ব্যাপক ক্ষমতাধর লোক। এই অল্প সময়েই হৃদি বুঝে গেছে যে আশেপাশের লোকজনের কাছে শ্বশুরমশাই দেবতা বৈ অন্য কিছু নন। প্রশাসনিক এবং দাপ্তরিক কর্মচারী থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনরা প্রত্যেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত। তাঁর সম্মোহনের জাল সর্বত্র বিরাজমান। এমন লোকের পুত্রবধূ হিসেবে হৃদির দাম আকাশচুম্বী। আত্মীয়স্বজনদের কারো কারো চোখে সে নিজের জন্যে হিংসা দেখেছে, আবার কারো চোখে দেখেছে অতিরিক্ত বিনয়। তোষামোদ করার লোকেরও অভাব নেই এ সংসারে। প্রভাবশালী, যশধর পিতার ছেলেরা সবসময় পিতার দাপটের কাছে ম্লান হয়ে থাকে। জন সাধারণ তাদের খুব একটা হিসাবে ধরে না। হৃদি জানে, লোকে তাকে চিনবে রাশেদুল হকের পুত্রবধূ হিসেবে, সামিউল হকের স্ত্রী হিসেবে নয়। সামির প্রতিভা, গুণ, মেধা এই সমস্ত কিছু আজীবন ঢাকা পড়ে থাকবে তার পিতার সাফল্যের আলোকবর্তিকার পেছনে। সামি কি কখনো এভাবে চিন্তা করে দেখেছে? নিশ্চয়ই না। সে তার বাবাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। তার সাথে এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে যাওয়াটা চরম বোকামি হবে। 

সামি ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই হৃদির চিন্তায় ছেদ পড়ল। 

‘এই খাটের তলায় নাকি ওরা কী গিফট রাখছে? চল দেখি।’ 

–‘ও হ্যাঁ, ভুলেই তো গেছিলাম।’ বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। তার পরনে সাদা রঙের সিল্ক কাপড়ের লেসওয়ালা স্লিভলেস নাইটি। খোলা চুলগুলো দুহাত দিয়ে জড়ো করে একটা হাত খোঁপা করে নিল সে। তারপর উবু হয়ে খাটের তল থেকে মাঝারি সাইজের বাক্সটা বের করে নিল। রাখলো বিছানার ওপর। উল্টেপাল্টে দেখল। কিছু লেখা নেই ওপরে। ওজনও খুব একটা কম নয়। সামি এগিয়ে এসে বসল হৃদির মুখোমুখি। 

—‘কী থাকতে পারে ভেতরে?’ সামির প্রশ্ন। 

—‘বুঝতেছি না। বোমাটোমা না তো?’ 

—‘অসম্ভব কিছু না, হইতে পারে।’ সামি হাসে। -’দাঁড়া খুলে দেখি।’ 

ছুরি নিয়ে এসে বাক্সের ধার ঘেঁষা স্কচটেপ কাটল হৃদি। খুলে দেখা গেলো বাক্সের ভেতরে আরেকটা বাক্স। 

—‘আমি জানতাম এই ধরনের কিছু একটা ফাইজলামিই করবে শয়তানগুলা।’ হৃদি খুব বিরক্ত। 

—‘বাক্সের ভিতর বাক্স? এই হইল গিফট?’ বলতে বলতে সামি দ্বিতীয় বাক্সটা খুলল। এভাবে পর্যায়ক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম। ষষ্ঠ বাক্সটির মুখ উন্মোচন করতেই ভেতরে কিছু একটা কিলবিল করে নড়ে উঠল। হৃদি ‘ওরে বাবারে!’ বলে চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে পড়ল একদিকে। সামি ভয় পেলো না। মুখ বাড়িয়ে ভালো মতো দেখল বাক্সের ভেতরটা। চার পাঁচটা বড় বড় তেলাপোকা মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। হৃদি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে, ‘এত বড় কুত্তা এইগুলা। গিফট হইল এইটা কোনো? সকালটাই মাটি করে দিল আমার!’ 

সামি বাক্সটা উপুড় করে মেঝেতে তেলাপোকাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। তাই দেখে হৃদির নাচন কুদন গেলো আরো বেড়ে। ভয়ের চোটে পারলে সে এবার মূর্ছা যায়। 

—‘কী করতেছিস তুই? আল্লাহ! আল্লাহ! আল্লাহ! আমার ঘরের মধ্যে কেন ঐগুলাকে ছেড়ে দিচ্ছিস? এখন কী হবে? তেলাপোকার সাথে বাস করতে হবে আমার? রাতের বেলা যদি আমার গায়ে উঠে পড়ে?’ বলতে বলতে সে ঘরময় ছুটোছুটি করতে লাগল। 

সামি একটা রাম ধমক দিয়ে উঠে বলল, ‘আরে থাম! মারতে হবে তো এগুলোকে। স্যান্ডেল দে একটা।’ হৃদি স্যান্ডেলট্যান্ডেল এগিয়ে দেওয়ার ধার না ধরে ওয়াশরুমে ছুটে পালালো। ততক্ষণে দুটি তেলাপোকা তুরতুর করে দৌড়ে খাটের তলায় পালিয়ে গেছে। একটা স্যান্ডেল নিয়ে এসে সামি বাকি তিনটাকে মারল বাড়ি দিয়ে। তার বন্ধুরা এইসব ফাজলামো ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে না এটা তার জানা ছিল। প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল যে এ ধরনের কিছুই ঘটবে। হঠাৎ মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট জিনিসের ওপর চোখ পড়ল। হাত থেকে স্যান্ডেল নামিয়ে রেখে জিনিসটা তুলে নিল সামি। ছোট একটা আয়তাকার আকাশি মলাটের এলবাম। আকাশি মলাটের ওপরে একটি হার্ট শেপের সাদা কাগজ আটকানো। তার ওপরে বাংলায় গাঢ় নীল রং দিয়ে লেখা ‘বৃষ্টিমহল’। কেন জানে না সামি, ছোট্ট জিনিসটা দেখামাত্র তার হৃদস্পন্দন একটিবারের জন্য থমকে গেলো। হাত কেঁপে গেলো কিঞ্চিৎ। হৃদি তখন বাথরুমের দরজা আলতো ফাঁক করে উঁকি দিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলছে, ‘মারছিস তেলাপোকার বাচ্চাগুলাকে?’ 

সামির মুখে একটা স্ফীত হাসি ফুটে উঠেছিল। সে হাত নেড়ে হৃদিকে কাছে ডাকল, ‘এদিকে আয়! দেখে যা।’ 

—‘তেলাপোকারা কোথায়?’ হৃদি আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে ফিসফিস করে বলল, যেন তেলাপোকারা তার কথা শুনে ফেললে মহাবিপদের সম্ভাবনা আছে। 

—‘তেলাপোকা নাই। তুই এদিকে আয়।’ 

পা টিপে টিপে এগিয়ে আসলো হৃদি। বসলো সাদা টাইলসের মেঝেতে। সামির হাতে ধরা ছোট্ট আকাশি মলাটের জিনিসটার দিকে চেয়ে অবাক গলায় বলল, ‘এটা কী?’ 

—‘বৃষ্টিমহল!’ প্রতিধ্বনির মতো শোনালো সামির কণ্ঠস্বর।

—‘মানে কী? তেলাপোকাময় বৃষ্টিমহল?’ 

—‘হ্যাঁ, তেলাপোকাময় বৃষ্টিমহল।’ সামি হাসে। 

অ্যালবাম খুলতেই প্রথমে চোখে পড়ল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের পিকনিকের ছবি। ওরা ছয়জন দাঁড়িয়ে আছে কুয়াকাটার সাগরপারে। পেছনে অস্তমিত সূর্য। আকাশের মাথায় ক্যাপ, হাফ প্যান্ট। কী কারণে যেন সে রুদ্রর কান খামচে ধরে আছে এক হাত দিয়ে। রুদ্রর মুখের ভঙ্গি কিম্ভূত। বিভার পরনে একটা লাল স্কার্ট, সাদা টপ। কোমরে হাত দিয়ে সুন্দর পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ব্লু টি শার্ট পরা হৃদির চোখ দুটি বন্ধ। মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। অমৃতার হাতে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট। পরনে লাল সাদা চেকের ঢোলা শার্ট। সবাই দাঁড়িয়ে থাকলেও সামি বালির ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে নেই, অন্যদিকে। ছবিটির ওপরে ক্যাপশন লেখা ‘ফার্স্ট ফানিমুন!’ 

তখন কে জানত একদিন সামি, হৃদির বিয়ে হবে। বন্ধুদের উপহার হিসেবে এই টুকরো স্মৃতিটুকু এসে জমা হবে তাদের নবীন সংসারের প্রথম দিনে! কেউ জানে না কিচ্ছু! এমন হরেক রকম অজানা দিয়ে ঘেরা বলেই বোধহয় মানবজন্ম পরম চিত্তহারী! 

পরের পৃষ্ঠায় যেতেই চোখে পড়ল সেকেন্ড ফানিমুনের ছবি। তারপর থার্ড, ফোর্থ, ফিফ্‌থ… সর্বশেষ ছবিটা গতবছর ডিসেম্বরে বিভার বাসার আঙিনায় তোলা। ডুয়ার্সে। এই ছবিতে অভিজিৎও আছে। দেখতে দেখতে ওদের চোখ ভিজে আসছিল। বুকের মাঝে কোনো তরঙ্গ নেই, শুধু কী রকম একটা মায়ার বুদবুদ, একটা গভীর মিষ্টি অনুভূতি! ফেলে আসা সুন্দর দিনগুলির স্মৃতির মাঝে যেন দূর বনের মহুয়া ফুলের আবছা সৌরভ লেগে আছে। কী স্নিগ্ধ! কী বিশুদ্ধ! সপ্তম পৃষ্ঠাতে কোনো ছবি নেই, ফাঁকা জায়গা। ছবির পরিবর্তে দুটো লম্বাটে কাগজ আবিষ্কার করল ওরা। বালি যাবার এয়ার টিকেট। ক্যাপশনে এবার লেখা ‘ফার্স্ট হানিমুন!’ 

৬২

বিভাকে সি অফ করতে সব বন্ধুরা এয়ারপোর্ট গেলো। হক সাহেবও একই সময়েই দেশ ছাড়ছেন। তবে তিনি আছেন ভি আই পি লাউঞ্জে। সামি আর হৃদি এক ফাঁকে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে আসলো। সামির আম্মা এয়ারপোর্টে আসেননি। আজ সকাল থেকে তাঁর মুখ অত্যধিক ভার। অন্যান্যবার এয়ারপোর্টে সামি না আসলেও মা আসেন বাবাকে সি অফ করতে। এবার বাবা বাড়ি ছাড়ার সময়ও মা বাবাকে বিদায় দেবার জন্য ঘর ছেড়ে বেরোননি। সামি ব্যাপারটা খেয়াল করেছে কিন্তু প্রশ্ন করেনি কোনো। তার মনে হচ্ছে বাবা মায়ের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে। এই জিনিসটা নতুন। সে তার বাবা মায়ের পরিপাটি সম্পর্ক দেখে এসেছে সর্বদা। তাদের ভেতর কথা কাটাকাটি হচ্ছে বা ঝগড়া হচ্ছে এরকম দৃশ্য তার স্মৃতিতে বিরল। 

হৃদি আর বিভা দুজনেই খুব কাঁদছিল। অন্য বন্ধুরাও কাঁদছিল ভেতরে ভেতরে। সবাই কি আর প্রকাশ্যে অশ্রু বিসর্জন দিতে পারে? বিভা চলে যাচ্ছে তার নিজের ছোট্ট ভুবনটায়। চাইলেই আর বন্ধুদের সাথে যখন তখন দেখা করতে পারবে না। এখানে সব কিছুই আগের মতো রবে। শুধু বিভার স্থানটি হয়ে যাবে শূন্য। লোকে বলে শূন্যস্থান বেশিদিন শূন্য থাকে না। কে জানে, হয়তো বিভার স্থানটিও বেশিদিন খালি পড়ে থাকবে না। কেন এমন হয়? কেন একটা সময়ে এসে সব্বাইকে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যেতে হয়? একটা মাত্র জীবন! কী হয় একটা ছোট্ট জীবন সবাই মিলেমিশে হেসেখেলে কাটিয়ে দিলে? কেন এই নিরন্তর আসা যাওয়ার খেলা? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? মানুষের জন্মই যে হয় মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার এক এবং অভিন্ন শর্তে! একবার আসলে… যেতে হবেই! প্লেন উড়ল আকাশে। বিভার চোখের নিচে সাদা মেঘের পরতে পরতে ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসলো ছেলেবেলার শহর, প্রাণের শহর, বন্ধুত্বের শহর, ‘ঢাকা!’ 

বন্ধুরা বিষণ্ন মন নিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে গেলো, চৈত্রের তপ্ত দুপুরে। সামি, হৃদির সারাটা দিনভর ঝুমঝুম ব্যস্ততা। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনরা নতুন বৌয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতে সামির দাওয়াত শ্বশুরবাড়িতে। এত ব্যস্ততার মধ্যে, নতুন জীবনের উত্তাল উচ্ছ্বাসে তাই খুব বেশিক্ষণ তারা আর মন খারাপ করে থাকতে পারল না। তাদের এখন ঠিক মন খারাপ করার সময় না। সময়টা আনন্দের, উপভোগের। 

আকাশ বাড়ি ফিরে দেখল বসার ঘরে ঝুমকি আর তারার সাথে মনীষা বসে আছে। দুদিন হলো মনীষা এই বাড়িতে মুভ করেছে। ঝুমকি আকাশকে দেখামাত্র খাবারের ব্যবস্থা করতে ছুটে গেলো। তারা এক দৌড়ে গিয়ে গ্লাসভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো, মুখে বলল, ‘ভাইয়া পানি খান। বাইরে যা গরম!’ মনীষা একটা জাম রঙের সুতির শাড়ি পরে ছিল। কোনো সাজগোজ নেই, তবুও কী সুন্দর দেখতে মেয়েটা! আকাশকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এইযে আকাশ সাহেব, আপনার অপেক্ষাই করছিলাম আমরা। আজকে আমাদের ভর্তা ডে। পাঁচ রকমের ভর্তা বানানো হয়েছে।’ 

বাড়ি ফেরার পর আকাশের মনটা কেমন শান্ত হয়ে উঠল। বাড়ি তো তাকেই বলে যেখানে আপনজনেরা অপেক্ষারত অবস্থায় পথ চেয়ে বসে থাকে। যাক, অবশেষে তার একটা বাড়ির মতো বাড়ি হলো বোধহয়। 

রুদ্র ফিরল বসুন্ধরার একলা ফ্ল্যাটে। এখানে সামিকে নিয়ে তার অনেক অনেক স্মৃতি। আজ থেকে এই চোদ্দশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে একলা থাকবে সে। এখন যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকে সামিকে দেখতে পাচ্ছে। সামির জন্যেই হয়তো প্রায় বিকেলে হৃদি চলে আসতো হুটহাট। বসে থাকত, গল্প করত, রান্না করত এটা সেটা। এখন কে আসবে রুদ্রর কাছে? সব্বাই যার যার মতো ব্যস্ত। ফ্রিজ খুলে দেখল খাবার মতো কিছু নেই। তিনদিন আগের বাসি খিচুড়ি আছে। সে নিজেই রান্না করেছিল। খেতে ইচ্ছে হলো না। খালি পেটেই ভর দুপুর বেলায় শুয়ে পড়ল বিছানায়। বুকের ভেতর কেমন একটা হুহু ভাব। চার পাঁচ মাস পর সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। নতুন দেশ, নতুন জীবন, নতুন অধ্যায় … কোথায় হারিয়ে যাবে এইসব দিন… কোথায় হারাবে বন্ধুরা… কোথায় হারাবে মনীষা! আর অমৃতা? অমৃতাকে না দেখে সে বিদেশ বিভূঁইয়ে টিকবে কী করে দিনের পর দিন? মনীষাকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু অমৃতাকে ছাড়া… কে জানে! 

একলা লাগে… কী ভীষণ একলা লাগে! যার জীবনে চমৎকার কিছু মনের মতো বন্ধু আছে, তাকেও বুঝি কখনো এমন অহেতুক একলা লাগার রোগে পায়? হ্যাঁ পায় তো! খুব পায়। কারণ দিন শেষে বন্ধুপাগল মানুষটিও আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো একলা হয়েই বাড়ি ফেরে! 

অমৃতা ফিরল বিধ্বস্ত অবস্থায়। শূন্যতায় ছেয়ে আছে ভেতরটা। বিভা চলে গেছে দূরে। দূরে চলে গেছে তার প্রিয় মানুষটা। বিভার সাথে নাহয় যোগাযোগ হবে যে কোন উপায়ে। কিন্তু সেই মানুষটার তো কোনো হদিশ পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যাবে। এক মাস? নাকি এক যুগ? কী করে থাকবে অমৃতা? মরেটরে যাবে না তো? 

৬৩

‘ফেলো গো বসন ফেলো, ঘুচাও অঞ্চল।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল
অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত।
আসুক বিমল উষা মানবভবনে,
লাজহীনা পবিত্রতা–শুভ্র বিবসনে।’

বিভার রেশমি সুগন্ধি এলোচুলে নাক ডুবিয়ে রবি ঠাকুরের কবিতাটা আবৃত্তি করছিল অভিজিৎ। ওদের গা ঢাকা একটা নীল রঙের নকশি কাঁথায়। সেই কাঁথার ওপর আদুরে বেড়ালের মতো নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে চৈত্র সকালের মিহি রোদ্দুর। মাঝে মাঝে অভিজিৎকে কবিতায় পায়। সেদিন কারণে অকারণে, কথায় কথায় কবিতার পতি চলে আসে তার মুখে। এমন একটা কবিতা পড়া আঁতেল লোককে যে বিভা ভালোবাসে, এই ব্যাপারটা নিজের কাছেই কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তার আজকাল। বন্ধুরা অভিজিতের এসব কবিতা শুনলে কী ঠাট্টাটাই না করত। ভাগ্যিস বন্ধুদের সামনে লোকটাকে কখনো কবিতা টবিতায় পায়নি। 

বীমের খাঁজে খাঁজে চতুর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পোষা পায়রাগুলো। একটা কোকিল ডাকছিল মনকাড়া সুরে, পাশের জঙ্গলে। জলঢাকা নদীর ঝিরিঝিরি জলের শব্দ এসে লাগছিল কানে। বাতাসে আমের মুকুল আর পাকা কুলের কী সুন্দর ঘ্রাণ! দূর্গা আজ খুব সকালে উঠে মন্দিরে গেছে। এখনো ফেরেনি। হয়তো ফিরতে দেরি হবে। নাশতাটা হয়তো বিভাকে বানাতে হবে। কিন্তু অভিজিতের ভাব দেখে মনে হচ্ছে বিভাকে আজ সে সারাদিন বাহুবন্দিই করে রাখবে। ছাড়বে না কিছুতেই 

—‘বিভাবরী!’ 

—‘হুম 

—‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?’ –’কী প্রশ্ন?’ 

—‘সঠিক উত্তর চাই কিন্তু।’ 

বিভা একটু নড়ে উঠে পাশ ফিরে শুলো। অভিজিতের মুখোমুখি। 

—‘বলো, কী জানতে চাও?’ 

অভিজিৎ বিভার গালের ওপর একটা হাত রেখে চশমাবিহীন ফোলা চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘সামির বিয়ের সময় তোমার মন খারাপ লেগেছিল?’ 

বিভার মুখের রং পাল্টালো। হালকা অস্বস্তি এসে ভিড় করল ডাগর চোখের পাতায়। 

—‘এটা কেমন প্রশ্ন?’ 

অভিজিৎ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘জানো? এই ঘটনার পর তোমার প্রতি আমার সম্মান অনেকখানি বেড়ে গেছে। সত্য বলছি বিভা, তোমার মতো মেয়ে হয় না।’ 

বিভা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘আমি আবার কী করলাম?’ 

অভিজিৎ হাসল, ‘নিজের প্রাক্তন প্রেমিককে নিজেরই বান্ধবীর হাতে তুলে দিতে কয়টা মেয়ে পারে? তুমি এই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছ। তাই ভাবছিলাম তোমার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে পুরো ঘটনাটার সাক্ষী হতে গিয়ে।’ 

বিভা কেমন একটু অন্য গলায় বলল, –’আসলে কী জানো? সামি আমার প্রেমিক কম, বন্ধু বেশি ছিল। কষ্ট যে হয়নি তা না, কিন্তু সেই কষ্টটা সহনীয় ছিল। আমার একটাবারের জন্যেও মনে হয়নি যে আমার কাছ থেকে কেউ কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল যার যার পাওনা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনো ঋণ বাকি নেই আর। সব শোধ বোধ হয়ে গেলো। এমনটাই যেন হবার ছিল!’ 

—‘তাই?’ 

—‘হ্যাঁ তাই। সত্যি বলছি আমার কোনো কষ্ট নেই আর। হয়তো সামি আর হৃদি দুজনেই আমার বন্ধু বলে এটা সম্ভব হয়েছে। বুঝলেন অভিজি‍ৎ বাবু, আমাদের বন্ধুত্বের অনেক শক্তি!’ 

—‘তোমার বান্ধবী হৃদিকে আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়ার ছিল।’

–-‘কেন?’ 

—‘কেন আবার? এমপির ছেলেকে সে বড়শি দিয়ে না আটকালে, শ্রীমতি বিভাবরী দেবিকে আমি পেতাম কী করে?’ 

বিভা হাসে, ‘এমপির ছেলেকে হৃদিতা বড়শি দিয়ে আটকানোর অনেক আগেই এক আঁতেল বই পড়া বোকামানবের বড়শিতে বিভাবরী দেবি নিজেই আটকে গেছে। অতএব সব ক্রেডিট বোকামানবের।’ 

এ কথা শুনে অভিজিৎ বিভার আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে বলল, ‘সত্যি করে বল তো বিভা, ঠিক কবে থেকে আমাকে ভালোবাসছ?’ 

বিভার যেন উত্তরটা তৈরিই ছিল। একটুও সময় নষ্ট না করে বলল, ‘কলকাতায় সল্টলেকের বাড়িতে একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল মনে আছে? পূজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলে তুমি। সারারাত আমার পাশে জেগে বসেছিলে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি আমার কপালে একটা হাত রেখে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছ, ঘাড় কাৎ করে। চোখ থেকে চশমাটা পর্যন্ত খুলতে ভুলে গেছ। খুব মায়া হয়েছিল সেদিন জানো? মনে হয় সেই মায়া থেকেই ভালোবাসার সূত্রপাত। সেদিনই টের পেয়েছিলাম, তোমাকে ছেড়ে যাওয়াটা আমার জন্য খুব সহজ কাজ হবে না।’ একটু থেমে বিভা আবার বলল, ‘আর তুমি?’ 

—‘বাংলাদেশে যেদিন প্রথম তোমার নাচ দেখেছিলাম, সেদিন থেকে।’

বিভার মুখে একটা স্ফীত হাসি ফুটে উঠল, ‘বাব্বাহ! বুঝতে পারিনি যে একদম!’ 

—‘বুঝতে চাওনি বলেই বুঝতে পারোনি বিভা! যখন চেয়েছ, তখন ঠিক ঠিক বুঝে গেছ।’ 

দূর্গা বোধহয় চলে এসেছে। বিভা উঠল বিছানা ছেড়ে। আজ ছুটির দিন। অভিজিৎ সারা বেলা বাড়িতেই থাকবে। বিকেলের দিকে নদীর ধারে বেড়াতে যাবে দুজনে। বিভা নিজের হাতে রান্না করবে অনেক দিন পর। আগামীকাল বাবা মা আর ছোট মাসিমা আসছেন ঢাকা থেকে। থাকবেন সপ্তাহখানেক। বাজার সদাই করতে হবে। নাশতা সেরেই বিভা বাজারের ফর্দ করতে বসে যাবে। বাজারের কাজটা রোজ দূর্গা করলেও শ্বশুরশাশুড়ির আগমন উপলক্ষে অভিজিৎ নিজেই বাজারে যাবে। বাজারের বড় মাছটা দেখেশুনে কিনে আনবে। তার শ্বশুরের পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। পান, ভালো মানের জর্দা এসব টুকিটাকি জিনিসও কিনে রাখতে হবে। বন্ধুদের মিস করছে বিভা এটা ঠিক, কিন্তু নিজের সংসারে ফিরে এসে ভালোও লাগছে তার। ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতায় যেমন দুকূল ছাপানো মায়া, তেমনি এই বন পাহাড়ের গ্রামটাতেও একটু একটু করে মায়ার পরশ লাগছে যেন। বিভা হয়তো বদলে যাচ্ছে। বদলাবেই তো, মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। মুনির চৌধুরী বলেছিলেন! 

৬৪

সন্ধের পর বালিশে একটু মাথা রাখতেই কেমন আলসেমিতে পেয়ে বসল আকাশকে। ক্লান্ত শরীরটাকে ছেঁকে ধরল রাজ্যের ঘুম। কাল যে করেই হোক বি সেকশনের মিড টার্মের সবগুলো খাতার নম্বর জমা দিতে হবে অফিসে। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই ঘুমিয়েছিল সে। নিজের মস্তিষ্ককে বলে রেখেছিল খানিক বাদেই যেন জাগিয়ে দেয়। মস্তিষ্ক কথা শুনেছে। আধা ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙল তার পুরোপুরি আলোহীন এক পৃথিবীতে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই এপার্টমেন্টে কোনো জেনারেটর নেই। মোমবাতি আর চার্জলাইটই একমাত্র ভরসা। দরজায় কেউ একজন কড়া নাড়ছিল। আকাশ ঘুমো চোখ নিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার নব ঘুরালো। তারা দাঁড়িয়ে আছে হাতে মোমবাতি নিয়ে। 

—‘ভাইয়া ছাদে চলেন। মনীষাপু ডাকছেন ‘ 

—‘আমাকে ডাকছেন?’ 

—‘হ্যাঁ আমাদের সবাইকেই যেতে বলেছেন। চায়ের দাওয়াত।’ তারার কথার ভঙ্গি দেখে মনে হলো চায়ের দাওয়াত পেয়ে সে সীমাহীন খুশি। 

—‘আচ্ছা। আসছি আমি। তুমি যাও।’ 

মিনিট দশেক পর ওপরে উঠে দেখা গেলো তারা আর মনীষা পাটি বিছিয়ে ছাদের মধ্যিখানে বসেছে অন্ধকারে। পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আশেপাশে এখন কোনো কৃত্রিম আলো নেই। গলির মুখের মুদির দোকানে আড্ডায় মেতে থাকা এক দল যুবকের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে শুধু। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। আকাশ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ওদের কাছে। পাটির ওপর হাঁটু মুড়ে বসতে বসতে বলল, ‘উনি কোথায়?’ 

তারা অবাক, ‘উনিটা কে?’ 

—‘তোমার খালা।’ 

বোঝা গেলো আকাশ ঝুমকির কথা জানতে চাইছে। 

—‘ও, খালামণির শরীরটা একটু খারাপ।’ 

—‘কেন? কী হয়েছে?’ আকাশের কণ্ঠের উদ্বেগটা চাপা থাকল না।

–-‘কী হয়েছে কে জানে! পেট ব্যথা করছে বলছিল বিকেল বেলা।’

-–‘ও’ অস্ফুটে বলল আকাশ। 

—‘তোমরা তাহলে বসো। আমি চা করে আনছি।’ বলল মনীষা।

—‘এখন বসুন। কারেন্ট আসুক।’ 

—‘কারেন্ট কখন আসবে তার ঠিক নেই। ট্রান্সফরমার জ্বলে গেছে। সারাতে সময় লাগবে। আমি মোমবাতি দিয়েই কাজ চালাতে পারব।’ কথাগুলো বলে শেষ করে মনীষা উঠে দাঁড়ালো। কয়েক কদম হেঁটে ছাদের কোণ ঘেঁষা ঘরটার দরজা খুলে ঢুকল ভেতরে। অসংখ্য নীল নীল নক্ষত্রে ছেয়ে আছে অন্তরীক্ষ। সাথে একটা ভাঙা চাঁদ। হালকা ফুরফুরে বাতাস বইছে ছাদজুড়ে। অন্ধকারে তারার চশমা পরা শুকনো মুখখানার দিকে একবার তাকালো আকাশ। তারা ঘাড় উঁচু করে আকাশের অগণিত নক্ষত্র দেখছিল। ভাঙা চাঁদের সূক্ষ্ম একটা নীল আলো লেগে আছে ওর কপালে আর নাকে, ধূলোর মতো। যেন হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেই আলোটুকু হাওয়া হয়ে যাবে। আকাশ পানে মুখ উঁচিয়ে রেখেই তারা বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী গলায় হঠাৎ বলল, ‘আজকে আকাশ ভরা তারা! কী সুন্দর!’ 

—‘আকাশ ভরা তারা!’ কথাটা একবার উচ্চারণ করল আকাশ। টেনে টেনে। 

তারা মুখ নামিয়ে তাকালো আকাশের দিকে। একটু কেমন দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘ভুল কিছু বললাম কি?’ 

—‘না ভুল হবে কেন? আকাশেই তো তারা থাকে! 

এবার তারা কী মনে করে যেন ফিক করে হেসে ফেলল। 

—‘হাসলে কেন?’ 

— এমনি।’ 

—‘হাসার মতো কিছু বলেছি কি?’ 

—‘না বলেন নি। তবুও হেসে ফেললাম। দুঃখিত।’ 

মনীষার চা নিয়ে আসতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগল না। অন্ধকার একটু একটু সয়ে এসেছে চোখে। তার পরনে একটা সুতির সালওয়ার কামিজ। অন্ধকারে কামিজের রং বোঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো ছড়ানো পিঠের ওপর। কীসের যেন একটা মিষ্টি সৌরভ ভেসে আসছে ওর গা থেকে। চায়ের ট্রে পাটির ওপর নামিয়ে রাখলো মনীষা। শুধু চা নয়, চায়ের সাথে আছে গরম গরম পেঁয়াজু ভাজা। 

তারা পেঁয়াজু দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল। মুঠো ভর্তি করে তিন চারটা তুলে নিতে গেলো। কিন্তু এত গরম যে একটাও শেষ পর্যন্ত আঙুলের ফাঁকে টিকিয়ে রাখতে পারল না। 

—‘তোমার বন্ধুরা কেমন আছে?’ মনীষার প্রশ্ন, আকাশকে। 

—‘ভালো আছে।’ ছোট করে উত্তর দিল আকাশ, গরম পেঁয়াজুতে আলতো করে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে। 

—‘নিউলি ম্যারিড কাপল? ভালো আছে তো না?’ 

—‘ভীষণ ভালো!’ পেঁয়াজু চিবোতে চিবোতে বলল আকাশ। 

—‘রুদ্র?’ ছোট করে নামটা একবার উচ্চারণ করে মনীষা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিল। 

আকাশের ঠোঁটে একটা অনিচ্ছাকৃত হাসি ভেসে উঠল। রুদ্রর কথাই কি তবে জানতে চাইছিল মনীষা এতক্ষণ ধরে? অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে হলো বেচারিকে। আচ্ছা মনীষা কি রুদ্রকে … ..? চিন্তাটা মাথায় রেখেই উত্তর দিল আকাশ, 

—‘বেচারা একটু লোনলি ফিল করছে। সামি মুভ করল তো।’ 

—‘হুম ..ও চাকরিটা ছাড়বে কবে? সেপ্টেম্বরে তো চলেই যাচ্ছে ইউ এস এ। আমার মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই কটা দিন বাবা মায়ের সাথে চিটাগাং গিয়ে থাকা উচিত।’ 

—‘ছেড়ে দেবে। খুব বেশি হলে দুমাস। এরপর ছেড়ে দেবে। রাইয়ান কেমন আছে?’ 

—‘এখন একটু স্টেবল হয়েছে আমার ছেলেটা। প্রথমে তো থাকতেই চাইছিল না একলা একলা অত দূরে।’ 

তারা কুড়মুড় করে পেঁয়াজু চিবোচ্ছিল আর ফোন টেপাটেপি করছিল মনোযোগ দিয়ে। এই দুজন মানুষ কী বলল, কী করল তাতে যেন তার কিছুই এসে যায় না। 

—‘স্বাভাবিক। ছোট মানুষ। আপনাকে ছাড়া নিশ্চয়ই আগে কখনো থাকেনি কোথাও।’ 

‘কিন্তু ওর বাবা…’ একটু থামল মনীষা। তারপর গাঢ়ভাবে বলল, ‘ওর বাবা খুব সমস্যা করছে।’ 

আকাশ একটু চোখের কোণ দিয়ে দেখল মনীষাকে। কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা তার অভ্যাসে নেই। অনেকবার জানতে ইচ্ছে হয়েছে মনীষার অতীত জীবনের কথা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু প্রশ্ন করাটা অভদ্রতার লক্ষণ বলে চুপ করে ছিল। আজকে যেহেতু প্রসঙ্গটা উঠেই গেলো, এই সুযোগে সে একটু সাবধানে বলল, ‘উনি কোথায় থাকেন?’ 

—‘থাকে ঢাকাতেই। কাজীপাড়া।’ 

—‘ও আচ্ছা। আপনার সাথে তো কোনো যোগাযোগ নেই এখন তাই না?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনীষা বলল-–‘যোগাযোগ আমি রাখতে চা ইনা। কিন্তু সে আমার পিছুই ছাড়ছে না। খুব ভয়ে আছি এই বাসার ঠিকানাটাও না কোন সময় জোগাড় করে ফেলে।’ 

আকাশ রহস্যের গন্ধ পেলো হাওয়ায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘পিছু ছাড়ছে না বলতে? আপনাদের ডিভোর্স হয়নি?’ 

‘ডিভোর্স পেপারে সে এখন অবধি সাইন করেনি।’ 

—‘কেন?’ 

—‘কী আর বলব ভাই তোমাকে? লোকটা নেশাখোর। বিয়ে করেছিলাম অতি অল্প বয়সে। তখন বাবা মা দুজনেই বেঁচে ছিলেন। সে ছিল পাড়ার মাস্তান। দেখতে সুদর্শন ছিল। চেহারা দেখেই পটে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স মাত্র ষোলো। পালিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। বিয়ের পর মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই হলো না আমাদের। সে নতুন বৌ তুলল তার এক দুঃসম্পর্কের মামার বাসায়। এদিকে আমার বাবা মা পালিয়ে যাবার ঘটনা জানতে পারার পর আমাকে মনে মনে ত্যাজ্য কন্যা করলেন। কয়েক মাসের মাথায়ই জানতে পারলাম ছেলেটা মাদকাসক্ত। ততদিনে রাইয়ান আমার পেটে চলে এসেছে। ওর মামার বাসায় কদিন থাকব আশ্রিত হয়ে? সেই মামার আবার ছিল চরিত্র খারাপ। আমার জীবনের স্ট্রাগলটা সেই তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। তার চাকরিবাকরীর কোনো চেষ্টা নেই। দিনরাত নেশা করে। আমি হাজার চেষ্টা করেও ফেরাতে পারলাম না তাকে। শেষমেশ আমার বড় ভাইকে সব খুলে বললাম। ভাইয়া একদিন ওর মামার বাসায় আসলো আমাকে নিয়ে যেতে। বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবার পর শুরু হলো অন্যরকম অশান্তি। আমার বাবা মা এই সন্তান চান না কিছুতেই। এবর্শনের জন্য চাপাচাপি করতে লাগলেন দিনরাত। আমি কিছুতেই মানলাম না তাদের কথা। কী ভয়াবহ কষ্টের দিন ছিল! মনে পড়লে এখনো আমার…’ মনীষার গলা কাঁপছিল। শুনতে শুনতে মনটা ভারি বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল আকাশের। মনীষার মতো এমন চমৎকার একটা মেয়ের জীবন কেন এতো অগোছালো হবে? 

তারা মোবাইল থেকে মুখ তুলে আচমকা বলল, ‘আকাশ ভাইয়া, মনীষাপু কিন্তু খুব সুন্দর গান গায়। এসব দুঃখের আলাপ বাদ দিয়ে এখন বরং একটা গান হোক।’ 

—‘হ্যাঁ আপনার গানের প্রশংসা আমি রুদ্রর কাছেও শুনেছি। একটা গান করেন আজ।’ 

মনীষা হাসল, ‘গানের গলা এখন আর আগের মতো নেই।’ 

—‘ইশ যা আছে তাতেই খুব চলবে!’ ভরসা দিয়ে বলল তারা। 

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা খালি করল মনীষা। গলা খাঁকারি দিল কয়েকবার। তারপর শুরু করল গান। 

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর ॥ 
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগণ মাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ॥
গ্রহতারক চন্দ্রতপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে
করিছে পান, করিছে স্নান, অক্ষয় কিরণে ॥ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *