বৃষ্টিমহল ৩.৫৫

৫৫

ড্রইংরুমের সোফায় হৃদি আর সামি পাশাপাশি বসে আছে। দুজনেই ক্লান্ত। মিষ্টিমুখ করার ইচ্ছে, উদ্যম, সামর্থ এর কোনোটিই তাদের মধ্যে উপস্থিত নেই এখন। তবুও যন্ত্রের মতো মুখে মিষ্টি পুরতে হচ্ছে। বিশাল বড় কক্ষটির এক কোণায় বাজনার যন্ত্র নিয়ে বসেছে গানের দল। এখন অবশ্য বাজনা বলতে শুধু কীবোর্ড আর গিটার। দলের ভোকাল গান গাইছে। গানের তালে তালে মহা উৎসাহে নেচে যাচ্ছে সামির অল্পবয়সী কয়েকজন কাজিন। ফটোগ্রাফার তখনও ছবি তুলে যাচ্ছে অক্লান্ত ভাবে। 

রোমেলা নতুন বৌয়ের গলায় শাশুড়ির দেওয়া হার পরিয়ে দিলেন। এবার পারিবারিক ছবি তোলার পালা। ছেলে আর ছেলের বৌয়ের পাশে গিয়ে বাবা মাকে বসতে হবে। হক সাহেবের ছবি তোলার প্রতি বরাবরই অরুচি এবং অনাগ্রহ। কিন্তু আজ একটি বিশেষ দিন। আজকে ছবি না তোলার কোনো বাহানাই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাছাড়া তিনি নিজেও চান স্মৃতির অ্যালবামে আজকের দিনটি ছবি সহকারেই লিপিবদ্ধ করা হোক। পরিবারের চারজন বসল একটি সোফায়। সামি, হৃদি, রোমেলা, হক। ক্যামেরার ক্লিক পড়তে থাকল। লোকে বলবে, কী চমৎকার পরিবার! নিটোল, নির্মল, সুখী জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন। একদম হিংসে করার মতো! হিংসে হচ্ছেও অনেকের। কেউ কেউ আবার সেই জ্বলন্ত হিংসের স্ফুলিঙ্গে ঠান্ডা জলের ছিটে দিচ্ছে এই ভেবে যে এত চেষ্টা করেও সামির মা মনের মতো বৌ আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বৌ হয়ে আসলো অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মেয়ে। দারুণ কিন্তু ব্যাপারটা! তবে কাল থেকে শুরু হবে আসল মজা! ছেলের বৌয়ের সাথে রোমেলার মতো ঠোঁটকাটা, দাম্ভিক মহিলার যে কোনোভাবেই বনিবনা হবে না তা পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, এমনকি অফিশিয়াল লোকজন পর্যন্ত সবাই জানে। অনেকেই অপেক্ষায় আছে মজা দেখবে বলে। 

হক সাহেবের চোখ খানিক বাদে বাদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরের মূল দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছিল। মেয়েটা কোথায়? এখনো ফিরছে না কেন? চার্জার খুঁজে পেতে তো এত সময় লাগার কথা না। চোখের সামনে বারংবার মেয়েটির অশ্রুমাখা মুখটা ভেসে উঠছিল। ধমক দেওয়া আর খিটখিটে আচরণ করা তাঁর স্বভাব। দেশ সুদ্ধ লোকে জানে, তিনি এমনই। এর আগে, কোনোদিন কাউকে ধমক দেওয়ার পর এতটা অনুশোচনা হয়নি তার। আজ একটা গ্লানি বোধে অন্তর ছেয়ে গেছে। ইশ অত কড়াভাবে কথাটা না বললেই হতো! তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। ছবি তোলার পালা শেষ হলে একটু আড়াল হয়ে অমৃতার নম্বরে ডায়াল করলেন। তিন চারটা রিং পড়তেই ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হলো ফোন। তিনি দ্বিতীয়বার ফোন করলেন। পরিণতি একই হলো। তাঁর শ্যামবর্ণ মুখে একটু রক্তের ঝলক উঠে আসলো। তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফোন কেটে দেয়, এমন মানুষ এ দেশে বিরল। প্রত্যাখ্যাত হওয়া একেবারেই অভ্যেসে নেই। এমন কি নিজের স্ত্রীও এই ফোন কেটে দেওয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজটা কখনও করেছেন বলে মনে পড়ে না। স্ত্রীর সাথে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হলেও ঝগড়া হয় না বললেই চলে। তাদের সম্পর্কটা শান্ত, স্থির, নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। আজকে কিনা একটা বাচ্চা মেয়ে তাঁর ফোন কেটে দিচ্ছে বারে বারে। এত বড় স্পর্ধা! 

আরো মিনিট দশেক বাদে অমৃতা নিচে নামল। ওর চোখ মুখ থেকে মেকআপ উঠে গেছে। মুখ ধুয়ে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। চোখের নিচে একটু কাজলের কালো দাগ। চেহারা থমথমে। সে আসা মাত্র সামির কাছে চার্জার হস্তান্তর করল। হক কোণার একটা সোফায় বসে ছিলেন। তাঁর ফুপু আম্মা তখন নতুন বৌকে উপহারস্বরূপ স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিচ্ছেন। এদিকে কীবোর্ড বাজিয়ে এলভিস প্রিসলির একটা বিখ্যাত গান গাইছে রুদ্রর বন্ধু। কার্পেটের ওপর কয়েকজন ছেলে মেয়ে হালকা তালে নেচে যাচ্ছিল গানের সাথে সাথে। রুদ্র অমৃতাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘নাচবি?’ 

—‘ধুর না!’ বলতে বলতে চোখ পড়ল লোকটার ওপর। এক ঝলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল অমৃতা। এখানে বসে বসে খুব ফোন করা হচ্ছে! না, ফোন অমৃতা ধরবেই না! এতও সস্তা না সে। হঠাৎ কী মনে করে যেন অমৃতা মত পরিবর্তন করল। রুদ্রকে ডেকে বলল, ‘চল, নাচি।’ 

লোকটার দিকে চোখা চোখে তাকালো সে আবার। তাকিয়ে থেকেই রুদ্রর হাত ধরল। তারপর গানের তালে তালে ধীরে ধীরে নাচতে লাগল। 

Wise men say only fools rush in 
But I can’t help falling in love with you 
shall I stay, would it be a sin 
if I can’t help falling in love with you? 

রুদ্রর মুখে একটা আচ্ছন্নতা ভর করেছিল। যে আচ্ছন্নতাটুকু অমৃতা টের না পেলেও খানিক দূরে বসে থাকা আকাশ ঠিকই টের পাচ্ছিল। কিন্তু অমৃতার মনোরথের সওয়ারি তখন রুদ্র নয়, অন্য কেউ। নাচতে নাচতে তার পুতুল দুটি চোখ বারে বারে পিছলে গিয়ে পড়ছে খানিক দূরে বসে থাকা ধারালো মুখের সুদর্শন ব্যক্তিটির ওপর। চোখ দিয়ে বলতে চাইছে সে, হ্যাঁ তোমাকে ছাড়াও অমৃতা ভালো থাকবে। এই দেখো অমৃতা নাচছে, গাইছে! অমৃতার কেউ না থাকলেও আছে বন্ধুরা। আজ তোমাকে ভালোবাসলো বলেই অমৃতা ঠুনকো হয়ে গেলো। খুব বিরক্ত তুমি অমৃতার ওপরে, তাই না? বেশ তো আজ থেকে অমৃতা আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবে না। থাকো তুমি তোমার মিথ্যে অহংকার নিয়ে। ভাবছিল ঠিকই এসব খটোমটো কথাবার্তা। কিন্তু ওই গভীর চোখের ওপর থেকে কিছুতেই দৃষ্টি ফেরাতে পারছিল না। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! কত দিন দেখতে পাবে না ওই মুখ! কাল তো চলেই যাচ্ছে! কত্ত দূরে! 

রাশেদ ঠোঁট টিপে গম্ভীরভাবে চেয়ে ছিলেন। লম্বা চুলো ছেলেটার একটা হাত রাখা অমৃতার কোমরে, অপর হাত কাঁধে। ছেলেটা হঠাৎ হাত উঁচু করে ঘুরিয়ে দিল ওকে। ওর সুন্দর শরীরটা চরকির মতো ঘুরলো কয়েক বার গানের তালে। স্প্রিং এর মতো বাঁকা হয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে চিৎ হয়ে এসে পড়ল ছেলেটার ডান বাহুর ওপর। রাশেদ উঠে পড়লেন। দৃশ্যটা কেন যেন তাঁর আর দেখতে ইচ্ছে করছিল না। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলেন তিনি। মাথা হেঁট করে বিষণ্ন মন নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে লাগলেন লাইব্রেরি ঘরের দিকে। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে আকাশে। মগজের ভেতরে কোনো এক বিচিত্র কারণে গানের লাইনগুলো গেঁথে গিয়েছিল। মাতাল বাতাসে কানের কাছে পাখির মতো কিচিরমিচির করে উড়ে বেড়াচ্ছিল গানটা। 

Wise men say only fools rush in 
But I can’t help falling in love with you 
like a river flows, surely to the sea 
Darling, so it goes, some things are meant to be … 

ঝড়ো বাতাস বইছে। এলোমেলোভাবে উড়ছে ধুলো। আকাশে হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠছে নীল বিদ্যুৎ। হাঁটতে হাঁটতে মনের অজান্তেই তিনি একবার বিকারগ্রস্থের মতো স্বগোতক্তি করলেন, 

Shall I stay, would it be a sin 
if I can’t help falling in love with you? 
Darling, so it goes, some things are meant to be 

৫৬

রাত প্রায় একটার দিকে বর বৌকে দোতলায় নিয়ে আসা হলো। কিন্তু বন্ধুদের ঘাড় ধাক্কা দিয়েও ঘর থেকে বের করা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সামি না পারতে বলেই ফেলল, ‘মানে কী? তোরা বাইর হস না ক্যান? আমাদের সাথে সারা রাত থাকবি? আজকে আমাদের বাসর রাত! ব্যাপারটা বুঝতেছিস?’ 

রুদ্র, বিভা আর আকাশ গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো বিছানায় পা তুলে বসে ছিল, নতুন বৌয়ের পাশে। সামি বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝ বরাবর। রুদ্র হাই তুলতে তুলতে উদাস গলায় বলল, ‘সারা রাত থাকার আইডিয়াটা খারাপ না। ভালোই! বেশ ফুলটুল দিয়ে সাজানো ঘর! আমিও একটা বাসর বাসর ফ্লেভার পাচ্ছি!’ 

শুনে হৃদি খিলখিল করে হেসে উঠল। বিছানার ওপর পা ভাঁজ করে বসেছে সে। একটু আগ পর্যন্তও সামির কাজিনরা তার আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল অবিরত। একজন মুরুব্বি গোছের আত্মীয়া মহিলা ধমক দিয়ে তাদের ঘর থেকে বের করেছে। তাতে লাভটা কী হলো? আসল বিচ্ছুগুলোকে তো কোনোমতেই বিদায় করা যাচ্ছে না। 

সামি নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, ‘বাসর বাসর ফ্লেভার পাচ্ছিস? শালা আজকে তোর বাসর নাকি আমার? 

—’বিয়া তো কইরাই ফেলছস, এখন প্রতিদিনই বাসর রাত। আজকে বরং বন্ধু রাত কর। এইটা ইউনিক।’ রুদ্রর ভাবলেশহীন উত্তর। 

বিভা ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে উঁচু গলায় বলল ‘আরে আমরা এখন কোথাও যাব না। এখন নতুন দুলাভাইয়ের জন্য একটা স্পেশাল পারফরমেন্স হবে।’ এটুকু বলে সে অমৃতার দিকে চেয়ে বলল, ‘রেডি?’ 

অমৃতা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল, সে রেডি। তারপর আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে দুই বান্ধবী সামিকে দুপাশ থেকে ঘিরে ধরল। গান গেয়ে উঠে শুরু করল নাচ। 

‘দুলাভাই দুলাভাই ও আমার দুলাভাই
চলো না সিনেমা দেখিতে আজ যাই 
সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই, দুলাভাই! 
সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই!’ 

দুই বান্ধবীর রং ঢং দেখে সামির মুখখানা রাগে পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো। ওদিকে হৃদি হেসে যাচ্ছে খিলখিল করে। আকাশ আর রুদ্র সিটি বাজাচ্ছে গানের সাথে সাথে। সামি অমৃতার কানের ডগা খামচে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল ‘বাইর হবি নাকি সিকিউরিটি ডাকব আমি এখন?’ 

—‘একী অবস্থা? বিয়ে করার সাথে সাথে বন্ধুরা পর হয়ে গেলো? হ্যাঁ? বৌয়ের জন্য এখন বন্ধুর গায়ে হাত তোলা হচ্ছে?’ মুখ বাঁকালো অমৃতা 

রুদ্র বলল, ‘যাইতে পারি এক শর্তে।’ 

সামি রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘তোর শর্তের আমি গুষ্টি কিলাই।’ 

—’ট্যাকা দে কিসু। নিজের শালা শালিদের কে তো ট্যাকা দিয়া বড়লোক বানায় ফালাইছস। এখন বন্ধুদেরকে ট্যাকা দে।’ হাত পাতলো রুদ্র। বিভা এবার এগিয়ে এসে জোর করে বসা থেকে টেনে তুলল রুদ্রকে। তুলল আকাশকেও। দু হাত দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দুই মূর্তিকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। রুদ্র কিছুতেই যাবে না। সে নাছোড় গলায় চিৎকার করতে লাগল, ‘যাব না! টাকা না দিলে যাব না।’ 

এবার অমৃতাও রণে ভঙ্গ দিল। পা বাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে যাচ্ছি। তার আগে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি। তোদের বিয়ের উপহার রাখা আছে খাটের তলায়। দেখে নিস।’ 

সামি বাঁকা হাসল, ‘উপহার? বিয়েতে যে উপহার দিতে হয় সেটা মাথায় আছে তোদের?’ 

হৃদি ফোড়ন কাটল, ‘উপহার দিবি ভালো কথা, হাতে হাতে না দিয়ে খাটের তলায় রাখার মানে কী? সব কিছুতেই একটা কেমন চোর চোর ভাব তোদের।’ 

—‘রাখলাম আর কি, মনে হইল খাটের তলটাই সেইফ।’ বিভা দরজার ওপাশে পা ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তে হৃদি ওকে পেছন থেকে ডাকল একবার। 

—‘বিভা শোন! থ্যাংক ইউ দোস্ত!’ 

—‘আমাকে থ্যাংকস কেন? পাগল নাকি?’ থমকে দাঁড়াল বিভা। 

হঠাৎ যেন সামির কিছু একটা মনে পড়ল, ব্যস্ত গলায় বলল, ‘অ্যাকচুয়েলি, আমার কাছ থেকেও একটা থ্যাংকস পাওনা আছে তোর, বিভা! ‘ 

—‘হচ্ছে কী এসব? আমাদের মধ্যে আবার থ্যাংকস, স্যরি এসব ফর্মালিটিস কবে থেকে আসলো?’ 

—‘ফর্মালিটিস না, দিস ইজ জেনুইন। থ্যাংক ইউ বিভা। তুই আমাকে ডাম্প না করলে হৃদিকে আমি কখনই পাইনাম না! সেদিন তোকে হঠাৎ রাগের মাথায় বলে ফেলছিলাম যে, সব দোষ তোর। কথাটা আমি ভুল বলছিলাম। আসলে তোর কোনো দোষ নাই। বরং সব ক্রেডিট তোর।’ 

বিভার ডাগর দুটি চোখের তারায় বিস্ময় রেখা চমক দিয়ে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেমন একটু বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। পরমুহূর্তেই চট করে বিভ্রান্তিটা লুকিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘ভুল হচ্ছে সামি, আই হ্যাভ নেভার ডাম্পড ইউ। ইউ ডিড।’ 

—‘মানে কী? আমি আবার কবে কী করলাম?’ সামি অবাক। 

—‘আমি তোর জন্য অভিজিৎকে ছাড়তেও রাজি ছিলাম। কিন্তু তুই… তুই আমার সাথে রিলেশন থাকা অবস্থায় হৃদিকে কিস করছিলি। ভুলে যাস না।’ 

সামি অস্থির হয়ে বলল, ‘বাট দ্যাট ওয়াজ আ মিস্টেক!’ 

বাকি বন্ধুদের মধ্যে অস্বস্তি দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে। অমৃতা চ্যাঁচাল, ‘এসব কথা আজকেই বলতে হবে? আজিব কারবার!’ 

বিভার গলাটা উঁচুতে উঠে গেলো, ‘হ্যাঁ অমৃতা, আজকেই বলতে হবে। সামিকে বুঝতে হবে যে আমার সাথে ব্রেকআপটা ওকে হৃদির কাছে নিয়ে যায় নাই। বরং ও হৃদির কাছাকাছি ছিল বলেই আমি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। তাছাড়া ডুয়ার্সের ঘটনাটা কোনো মিস্টেক ছিল না। দ্যাট ওয়াজ ইওর ডেসটিনি সামি! ভুল নয়, ওটা ছিল আশীর্বাদ!’ 

সামি হতচকিত ভাবে তাকালো বিভার দিকে। ভেতরটা এক অস্ফুট আলোড়নে মেতে উঠল হঠাৎ। সম্মুখে যেন একটি পর্দার উন্মোচন হলো। আঁখি দর্পণে ভেসে উঠল অজানা, অচেনা, দুর্বোধ্য এক সত্য। বিভার বলা কথাটাই বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করল তার। সেই ঘটনাটা কোনো ভুল ছিল না। ছিল আশীৰ্বাদ! 

—’হৃদি শোন, সামি কখনোই আমার ছিল না। তোর ছিল, তোর আছে, তোরই থাকবে।’ এটুকু বলে একটা বড় শ্বাস ফেলল সে। অন্য বন্ধুরা ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বিভাও আর দাঁড়াল না। 

—‘বিভা! উই লাভ ইউ দোস্ত! আমরা তোকে ভালোবাসি!’ পেছন থেকে ভেসে আসলো হৃদির কণ্ঠ।

সামিও যোগ করল একটু অন্যমনস্ক গলায়, ‘হ্যাঁ বিভা, আমরা তোকে ভালোবাসি। মনে রাখিস! 

—‘আমিও তোদের ভালোবাসি।’ বলে বিভা ভারি সুন্দর হাসে। ডাগর চোখে চিকচিক করে কয়েক বিন্দু জল। 

বিভা চলে যাবার পর সামি ঘরের দরজাটা ভালো মতো বন্ধ করল। ঘুরে তাকিয়ে দেখল সাদা টিউবলাইটের নিচে বৌ সেজে বসে থাকা হৃদিতাকে। হৃদিতা ওর দিকেই চেয়ে ছিল তখন অনিমেষ চোখে। দমকা বাতাস জানালা গেলে ঘরের ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। দস্যি ছেলের মতো ফুলের পাঁপড়িগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল এদিক সেদিক। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা বাজ পড়ল। তারপর শুরু হলো মুষলধার বৃষ্টি! 

৫৭

সাধারণত লাইব্রেরি রুমে এসে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন আপনাআপনিই একটা সময় শান্ত হয়ে আসে। মাথার জটগুলো ধীরে ধীরে খুলে যায়। কাজে মন বসে। কিন্তু আজ কোনও এক অজ্ঞাত কারণে লাইব্রেরি রুমে হক সাহেবের মন টিকল না। আগামীকাল সকাল এগারোটায় রিপোর্টিং। প্লেন টেক অফ করবে সাড়ে বারোটায়। গোছগাছ মোটামুটি হয়ে গেছে। তেমন কোনো কাজ বাকি নেই। তবে রাতের মধ্যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ইমেইল করতে হবে। এখন বাজে রাত দেড়টা। মাথা ভার হয়ে আছে। শরীর ক্লান্ত। তাঁর উচিত খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিতে চলে যাওয়া। কিন্তু মাথার নার্ভগুলো বিশ্রাম নিতে চাইছে না, দপদপ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যাচ্ছে অবিরত। 

লাইব্রেরি থেকে তিনি আধাঘণ্টা পর ফিরলেন বাড়িতে। দোতলায় নিজের শোবার ঘরে এসে দেখলেন রোমেলা নেই। ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। কিন্তু টি এস এ লক লাগানো হয়নি এখনো। লাগেজে টি এস এ অর্থাৎ ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন লক না থাকলে ইউ এস কাস্টমসে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি আলমারির ড্রয়ার থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। কিন্তু পেলেন না। একটু তিরিক্ষি হয়ে উঠল মেজাজ। চাপা রাগে গজগজ করতে করতে স্ত্রীর খোঁজে বের হলেন ঘর থেকে। বের হওয়া মাত্র করিডোরে ছেলের বন্ধুদের মুখোমুখি পড়ে গেলেন। ছেলের রুম করিডোরের শেষ মাথায়। নিজের রুম থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে। ছোট্ট দলটার মধ্যে তিনি মেয়েটাকে দেখলেন। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা নজর সরিয়ে নিল। হেঁটে হেঁটে ছেলেমেয়েরা সামনে আসলো। দলের একটি মেয়ে তাঁকে সালাম দিল। তিনি অন্যমনস্কভাবে সালামের উত্তর দিলেন। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট মেয়েটি আর একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকাল না। এটা এমন কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। কিন্তু তাঁর অস্থিরমতি মনটা হঠাৎ বিনা কারণেই আরো যেন বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। গনগনে রাগের আঁচটা চেহারায় টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেই ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি নিয়েই তিনি করিডোরে পায়চারি রত এক চাকরের কাছে স্ত্রীর খোঁজ করলেন। জানা গেলো রোমেলা আছেন নিচতলায় ডাইনিং রুমে। তিনি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন। রোমেলা ডাইনিং এর উঁচু গদির চেয়ারে রাণীর মতো বসে আছেন। ঘরময় গিজগিজ করছে জনা দশেক নারী পুরুষ। এরা সবাই হক সাহেবের শ্বশুরবাড়ির লোক। তাঁর নিজের আত্মীয় স্বজনেরা রোমেলার আশেপাশে খুব একটা ঘেঁষে না। নতুন বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকে বিয়েবাড়ির খাবার পাঠানো হয়েছে। সাথে নানা রকম পিঠা এবং মিষ্টি। রোমেলা কাজের লোকের মাধ্যমে সেইসব খাদ্যদ্রব্য আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বন্টন করে দিচ্ছেন। বাক্সে বাক্সে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে খাবার। মেঝেতে পান আর মিষ্টির ডালা খুলে বসেছে এক বয়স্কা আত্মীয়া। অল্প বয়সী এক মেয়ে, খুব সম্ভবত তাঁর ছোট শালির কন্যা, রোমেলার হাতে যত্ন সহকারে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে। বেশ উৎসব উৎসব একটা ভাব চারপাশে। হক সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরিবেশটা পর্যবেক্ষণ করলেন ভ্রু কুঁচকে। একটু দরাজ গলায় স্ত্রীকে বললেন, ‘এই শোনো, আমার টি এস এ লক খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় আছে জানো তুমি?’ 

ঘরে উপস্থিত লোকজন হক সাহেবকে দেখে হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেলো। তাঁকে প্রত্যেকেই একটু ভয় পায়। তিনি টের পান তাঁর উপস্থিতি কাছের আত্মীয়দের মধ্যে একটা অস্বস্তির উদ্রেক করে আজকাল। খুব প্রয়োজন ছাড়া এরা কেউ তাঁর সাথে কথা বলে না। তিনিও চান না এদের কাউকে বিরক্ত করতে। রোমেলা দায়সারা গলায় বললেন, ‘গত বছর আমেরিকা থেকে ফেরার পর আমি তো চাবিগুলো আর চোখেও দেখিনি। তুমিই জানো কোথায় রেখেছ।’ কথাটা বলে শেষ করে তিনি আবার নিজস্ব জগতে মগ্ন হয়ে গেলেন। উপস্থিত লোকজনের ভেতর থেকেও জড়তা কেটে গেলো। তারা আলাপে মশগুল হয়ে গেলো মুহূর্তের মাঝে। হক কিছুক্ষণ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থেকে রোমেলাকে দেখলেন। রোমেলা এসব সামাজিকতা করতে বরাবরই খুব ভালোবাসে। এদিকে সারাক্ষণ কানের কাছে ছেলের বৌ পছন্দ হয়নি বলে ঘ্যানর ঘ্যানর করে যাচ্ছে, অথচ এখন আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বসে হাসিমুখে বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার বিলি করছে। একটু আগেই সে স্বামীর কানে কানে ফিসফিস করে বলেছে, ‘বিয়ের খাবার এত বাজে ছিল! ছিঃ কোন কুখ্যাত বাবুর্চিকে দিয়ে রান্না করিয়েছে আল্লাহ জানে!’ তার চরিত্রের এই দ্বিমুখিতার কারণ কী? মানুষটাকে আজও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলেন না হক। কাল সকালে তিনি দূরের পথে যাত্রা করবেন। এ মুহূর্তে কি রোমেলার উচিত নয় অন্যান্য সব কাজ ফেলে রেখে স্বামীকে সঙ্গ দেওয়া? এতটুকু আশা করা কি অন্যায়? 

দরজার গোড়ায় তাঁকে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোমেলা এবার মিহি স্বরে বললেন, ‘কী গো? কিছু বলবে? আচ্ছা আমি মহসিনকে পাঠাচ্ছি। ও তোমার চাবি খুঁজে দেবে।’ 

—‘থাক লাগবে না। আমিই খুঁজে নেবো।’ কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। দোতলায় নিজের শোবার ঘরে পুনরায় ফিরে এলেন। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন চাবি। পাওয়া গেলো না। খুব সকালে লোক পাঠিয়ে চাবি কিনিয়ে আনতে হবে। এত সকালে মার্কেট খুলবে কি? বিষণ্ণ মনটায় নতুন দুশ্চিন্তা এসে ভর করল। খানিক বাদে তিনি পায়ে পায়ে নিচে নেমে আসলেন। ফিরে গেলেন লাইব্রেরি ঘরে। ইমেইলগুলো পাঠিয়ে দিলেই আপাতত কাজ শেষ। ভাবলেন একরকম, কিন্তু করলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম। লাইব্রেরিতে এসে ভীষণ অন্যমনস্কভাবে সেলফোনটা হাতে নিলেন তিনি। ডায়াল করলেন অমৃতার নম্বরে। ফোন কেটে দেওয়া হলো ওপাশ থেকে। মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। অনেক দিন পর ভয়ংকর এক করাল রাগ তাঁকে অন্ধপ্রায় করে তুলল। অস্থিরমতি মন নিয়ে দ্বিতীয় ফোনটি তিনি সুলেমানের নম্বরে করলেন। 

নিচতলার দুটি ঘরে বন্ধুদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। সবাই ক্লান্ত। অমৃতা মাত্র গোসল সেরে এসেছে। সে বেরোতেই বিভা ঢুকল বাথরুমে তোয়ালে কাঁধে নিয়ে। লেবু রঙের একটা ঢোলা টি শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরেছিল অমৃতা। গোসলের পর ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরের মরা, ক্লান্ত কোষগুলো সব ঠান্ডা জল পড়তেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঘরের বাতি নেভানো। সে দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। লোকটা কেন বারবার ফোন করছে কে জানে। আজ সে নিজের সাথে নিজে ওয়াদা করছে। কোনোভাবেই ফোন ধরবে না! কাজটা খুব কঠিন হয়ে গেছে তার জন্য। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে সব রাগ ভুলে গিয়ে ফোন ধরে ফেলে। কাল সকালেই তো চলে যাচ্ছে। আবার কতদিন দেখা হবে না! কে জানে হয়তো এর পরের বার ফোন করলে অমৃতা ধরেই ফেলবে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা আজকাল জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। কেউ একজন করাঘাত করে যাচ্ছে অনবরত। অমৃতা সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেলো। সে নিশ্চিত এই আগন্তুক রুদ্র অথবা আকাশ নয়। দরজা নাড়ার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। দরজা খুলে মাথা বের করল সে। ওপাশে জ্বলতে থাকা ফকফকে আলোয় পরিষ্কার দেখল একটা মোটাসোটা বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে অমৃতা চেনে। এ বাড়ির কর্মচারী সুলেমান। 

—‘কী ব্যাপার?’ 

—‘ম্যাডাম আপনাকে একটু আসতে হবে।’ চাপা কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলল সুলেমান। 

—‘মানে? কোথায় আসতে হবে?’ 

সুলেমান একটু আশপাশটা ভালো মতো দেখে নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘স্যার ডাকছেন।’ 

চমকে উঠল অমৃতা। চমকটা শুধু ওকে বিস্ময়ই নয়, সেই সাথে একটুকরো উড়ো ভালোলাগাও উপহার দিয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘কিন্তু কেন?’ 

সুলেমান তার ভাবলেশহীন মুখটা শক্ত করে বলল, ‘সেটা আমি বলতে পারছি না। তবে আপনাকে একবার যেতে হবে।’ 

কেউ একজন আসছিল উল্টো দিকের ছোট্ট করিডোরটা দিয়ে। শব্দ শুনতে পেয়ে সুলেমান তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘স্যার লাইব্রেরি ঘরে আছেন। এখুনি আসুন আপনি।’ 

কথাটা বলেই সে ঘুরে দাঁড়ালো। বিভা তখন গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। অমৃতার হতভম্ভ চেহারাটা দেখে সে অবাক গলায় বলল, ‘কী হয়েছে তোর?’ 

অমৃতা কিছুক্ষণ স্থবিরভাবে ওর দিকে চেয়ে রইল। চাইলো ঠিকই কিন্তু ভাবলো অন্য কিছু। ভীষণ আনমনাভাবে বলল, ‘বিভা, তুই থাক। আমি আসছি একটু।’ 

—‘যাচ্ছিস কোথায়?’ 

—‘উনি ডাকছেন।’ 

—‘অমৃতা! এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। প্লিজ কোথাও যাস না। ‘ অমৃতা পায়ে স্যান্ডেল দিতে দিতে বলল, ‘যেতে হবে দোস্ত!’ 

৫৮

সুলেমান অনেক আগেই চলে এসেছে লাইব্রেরিতে। দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে নিষ্প্রাণ পাথরের ন্যায়। ঘরের ভেতরে একটা নিষ্প্রভ আলো জ্বলছে। ঝড়ো বাতাসে উড়ছে জানালার পর্দা। উড়ন্ত পর্দার ফাঁক গেলে বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা এক নজর দেখল অমৃতা। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা গেলো না কিন্তু মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শিরশিরানি ভাব বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে গেলো। ঘরটা যেন অলৌকিক এক রহস্যময়তা গায়ে জড়িয়ে রেখে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ভয়, আনন্দ এবং কৌতূহল এই তিনটি অনুভূতি একত্রে মিলেমিশে তাকে অবশ করে দিচ্ছে। দরজা ভেজানো ছিল। অমৃতা কম্পনযুক্ত হাতে একটা আলতো ধাক্কা দিয়ে খুলল দরজাটা। ল্যাম্পশেডের মরা আলোয় দেখতে পেল মানুষটা বসে আছেন চেয়ারে, টেবিলের সামনে। অমৃতা অনেক কষ্টে বরফের মতো জমে যাওয়া পা দুটোকে সামনে এগিয়ে দিল। 

—‘তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?’ সেকেন্ড না গড়াতেই তিনি ভয়ংকর শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। গভীর চোখদুটো দিয়ে তখন ঠিকরে বেরোচ্ছে আগুন। আকস্মিক, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটা অমৃতাকে প্রথমে একটু থমকে দিল। পরমুহূর্তেই একটা অভিমানের ঢোক এসে গলার কাছে বিঁধল তার। পাতলা ঠোঁটদুটি কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলো অতর্কিতে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কথা বলি না আমি আপনার সাথে!’ 

—‘কী বললে?’ গর্জনটা একদম বুকে গিয়ে লাগল। বাব্বাহ এত রাগ! অমৃতা যেন তার কেনা গোলাম। ফোন করলেই ধরতে হবে। আর তিনি দিব্যি অন্য লোকের সামনে অমৃতাকে যখন তখন অপমান করে বসবেন। চমৎকার! 

অমৃতা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে একটু আলগাভাবে বলল, ‘বললাম তো, কথা বলি না।’ 

—‘ঠিক আছে। কোনো কথা বলতে হবে না। চুপচাপ বসে থাকো এখানে।’ বজ্রগম্ভীর গলায় আদেশ দিলেন তিনি। 

—‘হ্যাঁ?’ অমৃতা অবাক। 

—‘বসে থাকো চুপচাপ! 

—‘বসে থাকব? এমনি এমনি? কেউ চলে আসলে?’ 

লোকটার মুখের রং হঠাৎ পাল্টে গেলো। তীব্র হয়ে উঠল চোখের চাউনি। 

—‘কেউ আসলেই কী? ভয় কীসের? তোমার কি আমাকে ভীতু মনে হয়? 

একটা উষ্ণ তৃপ্তির ঢেউ এসে অমৃতার মন ভিজিয়ে দিয়ে গেলো আচমকা। এই কথাটিই যেন শুনতে চাইছিল সে মনে মনে, অনেক দিন ধরে! ভয় কীসের? 

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’ 

অমৃতা শ্রাগ করে বলল, ‘নাহ! আমার ভয় কীসের? আপনি আছেন তো! কথাটা বলে শেষ করে সে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। বসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল,’এখন আমার কী করতে হবে? চুপচাপ বসে থাকতে হবে?’ 

— হুম।’ 

—‘আর আপনি কী করবেন?’ 

—‘আমার কাজ আছে। আমি কাজ করব।’ ভ্রু কুঁচকে টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপ চালু করলেন তিনি। 

—‘বেশ।’ 

বাইরে মেঘ ডাকছিল গুমগুম শব্দ তুলে। দমকা বাতাসে ফুলে ফেঁপে উঠছিল জানালায় ঝোলানো সাদা পর্দা। সাপের লিকলিকে জিহবার মতো নীল বিদ্যুতের শিখা থেকে থেকে চমকে উঠছিল অন্ধকার আকাশে। লোকটা ফাইলের বস্তা নিয়ে বসেছেন। একটা ফাইল খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করলেন কিছু সময়। তারপর ল্যাপটপে টাইপ করতে লাগলেন মনোযোগ সহকারে। 

অমৃতা কনুই টেবিলের ওপর রেখে গালে হাত দিয়ে দেখছিল কর্মরত মানুষটাকে। গম্ভীর মুখ, উষ্কখুষ্ক চুল, ধারালো চোয়াল, ভাঁজযুক্ত কপাল… বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া… অতল গভীর! ওই মুখের দিকে তাকালে বুকের ভেতরটায় কেমন বিষণ্ন সুন্দর এক শঙ্খ বেজে ওঠে অজান্তেই! মনে হচ্ছিল এভাবে চুপ করে ওই দিকে চেয়ে থাকার মতো চিত্তরঞ্জন কাজ বুঝি আর নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। হঠাৎ তিনি চোখ তুলে তাকালেন। 

—‘কাজটাজ কিছু করো! কথা বলা নিষেধ, কাজ করা নিষেধ নয় তো! অমৃতা গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল, ‘করছি তো!’ 

—‘কী করছ?’ খটমটে প্রশ্ন লোকটার। 

অমৃতা মিষ্টি হেসে বলল, ‘আপনাকে দেখছি!’

—‘আমাকে দেখতে হবে না। অনেক বই আছে এ ঘরে। একটা বই নিয়ে এসে পড় বসে বসে।’ সুন্দর করে বললেন তিনি, স্পষ্ট গলায়। অগত্যা অমৃতাকে উঠতেই হলো। খুব একটা সময় নষ্ট করল না সে। শেল্ফের প্রথম সারি থেকেই একটা বই তুলে নিল। আলেক্সান্দার রাস্কিনের ‘বাবা যখন ছোট।’ বইটা নিয়ে টেবিলে ফেরত আসতেই সে লক্ষ্য করল আজ এই ঘরে আগরবাতি জ্বলছে না। ঘরের পশ্চিম কোণে অগ্নিবিহীন অবস্থায় নিষ্প্রাণ পড়ে আছে আগরবাতির স্ট্যান্ড। সে বইটা টেবিলের ওপর রেখে পকেট থেকে লাইটার বের করল। তারপর এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে বসে জ্বালিয়ে দিল চারটা আগরবাতি। 

রাশেদ আড়চোখে দেখলেন দৃশ্যটা। কী আশ্চর্য! আজকে তিনি আগরবাতি জ্বালাতেও ভুলে গিয়েছিলেন। অমৃতাকে বলতে হয়নি। নিজ উদ্যোগেই কাজটা করেছে সে। কেন যেন ভালো লাগল ব্যাপারটা। অমৃতা এসে বসল চেয়ারে। তিনি কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলেন। অমৃতা বইটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। বইতে তার মন বসছিল না। তবে বই না পড়লেও সে ভান করল যেন বইয়ের ভেতর একেবারে ডুবে গেছে। মানুষটাকে কোনোভাবেই আর বিরক্ত করতে চায় না সে। মনে হচ্ছে একটু নড়লেই লোকটার ধ্যান ছুটে যাবে। কাল সকালেই তাঁর ফ্লাইট। কত লম্বা যাত্রা। একটু বিশ্রামও তো নিতে হবে নাকি? সারা দিন ছেলের বিয়ে নিয়ে কী একটা ধকল গেছে বেচারার ওপর দিয়ে। ভাবতে ভাবতে অমৃতা একদম কাঠ হয়ে বসে রইল। খুব তেষ্টা পাচ্ছিল জলের। তবুও সে উঠল না। 

রাশেদ একবার চোখ তুলে দেখলেন মেয়েটাকে। মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। ল্যাম্পশেডের নরম হলদে আলো এসে পড়েছে ওর আদুরে ফর্সা মুখে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল তার। অবাক ব্যাপার হলো এতক্ষণ ধরে অনবরত উত্যক্ত করা অস্বস্তিটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। বুক থেকে নেমে গেছে পাথর। মাথা ঝরঝরে লাগছে। মগজের জমে যাওয়া কোষগুলো সচল হয়ে উঠেছে পুনরায়। তিনি এখন ভাবতে পারছেন, কাজ গুছিয়ে নিতে পারছেন। একটা নিশ্চয়তায় ভরে গেছে মন। মনে পড়ছে অনেক দিন আগের এমনই এক শ্রাবণ মেঘে ঢাকা মাঝ রাত্তিরের কথা। তখন মা বেঁচে ছিলেন। এইচ এস সি পরীক্ষা চলছে। কী উপলক্ষে যেন গ্রাম থেকে একগাদা আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করেছে তাদের বাড়িতে। পরদিন কেমিস্ট্রি প্রথম পত্র পরীক্ষা। বাড়িতে এত লোকের হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে কোনোমতেই পড়ায় মন বসছিল না। তখন বাড়িটি ছিল একতলা। সামনে লম্বা বারান্দা আর ভেতরে বড় বড় চারটি রুম। সে রাতে ছোট বাড়িটার কোথাও এক রত্তি জায়গা ছিল না, যেখানে নিরিবিলিতে পড়াশোনা করা যায়। এই লাইব্রেরি ঘর তখন বাবার দখলে। বাবা তার দুরবস্থা আঁচ করতে পারলেন। আড়ালে ডেকে নিয়ে এই ঘরের চাবি ধরিয়ে দিলেন হাতে। তিনি বইপত্র নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে চলে আসলেন। সেদিনও বৃষ্টি ছিল, এমনই। আকাশে বিদ্যুতের পসরা, ঘরভর্তি দুরন্ত হাওয়া! 

হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলো। মা দৌড়ে আসলেন মোমবাতি নিয়ে। টেবিলের ওপর রেখে চলে যাবার জন্য উদ্যত হলেন। তিনি মাকে যেতে দিলেন না। মনে হচ্ছিল মা চলে গেলেই তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে। হলও তাই। ভেতর বাড়ি থেকে কোন এক চাচি যেন ডাক দিলেন মাকে। মা আধাঘণ্টার জন্য অনুপস্থিত হলেন। সেই আধাঘণ্টায় তার কিছু মাত্র পড়া এগুলো না। আধঘণ্টা পর মা যখন ফিরে আসলেন, তখন তার লেখাপড়ার মনোযোগী মনটাও ফিরে আসলো আপনাআপনি। অনেক রাত অবধি জেগে বসেছিলেন মা তার সাথে। চুপচাপ কাঠের চেয়ারে বসে উল বুনেছেন একাগ্র চিত্তে। আজ বহুদিন পর সেই দিনটার কথা খুব করে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে সামনে বসা এই মেয়েটি এখান থেকে উঠে চলে গেলে, তিনি আর কাজে মন দিতে পারবেন না। তার কাজগুলো ঠিকঠাকমতো সম্পন্ন হওয়ার জন্য মেয়েটির উপস্থিতি অতীব জরুরি! অথচ এই মেয়েটি তার মা নয়, মেয়েও নয়। এমন কি মেয়েটি যা দাবি করে, ‘গার্লফ্রেন্ড!’ সেই গার্লফ্রেন্ডও নয়! তবুও মেয়েটির উপস্থিতি তাঁর সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মনের ভেতরের মনটা চাইছে, মেয়েটি এভাবেই চুপটি করে বসে থাকুক তার সামনে, অনন্তকাল ধরে! হঠাৎ মনে হলো পৃথিবীতে বুঝি সব সম্পর্কের নাম হয় না। সমাজের তৈরি বাঁধাধরা সম্পর্কগুলোর বাইরেও আরো অনেক রকম সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কগুলোকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, সব সময় বোঝাও যায় না! শুধু হঠাৎ হঠাৎ মন গভীরে ভীষণভাবে অনুভব করা যায়! 

৫৯

অভিজিতের সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে বিভা তোয়ালে দিয়ে চুলে ঝাড়ন দিতে দিতে পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। কয়েকবার টোকা দিতেই খুলে গেলো দরজাটা। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর অন্ধকার। করিডোরের আলোয় দেখা গেলো রুদ্রর পরনে ছাই রঙের গেঞ্জি, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট। চুল এলো করে খোলা ঘাড়ের ওপর। বিভাকে দেখামাত্র সে দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলল, ‘আমার চুল আঁচড়ায় দিবে কে? হৃদির তো বিয়ে হয়ে গেলো।’ 

আকাশ মেঝেতে বসে আছে পা দুটো ছড়িয়ে। তার সামনে দু তিনটা কোকের ক্যান। 

—‘লাইট জ্বালাস না কেন?’ একটু বিরক্ত বিভা 

—‘লাইট থাক। অন্ধকারই ভালো লাগতেছে।’ আকাশ বলল। 

রুদ্র দরজা আটকে দেবার পর করিডোরের বাতি অদৃশ্য হয়ে গেলো। অন্ধকারে অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে বিভা বসল আকাশের পাশে। তোয়ালে দিয়ে চুল ঘষতে ঘষতে রুদ্রকে বলল, ‘আমাকে দে চিরুনি। আমি আঁচড়ে দিচ্ছি।’ 

—‘শালি তুইও তো কালকে চলে যাচ্ছিস। তারপর কী করব?’ 

—‘হুম, চিন্তার বিষয়। কী আর করা দোস্ত! মা, বোন, বন্ধু, এরা চিরকাল সাথে থাকে না। তুই বরং একটা বিয়া কর এইবার।’ বিভা সিদ্ধান্ত দিল। ঘরটা বেশি বড় নয়। একটা ডাবল খাট আর ড্রেসিং টেবিল ছাড়া তেমন কোনো আসবাব নেই। খাটটা উত্তর দিকের জানালার পাশে রাখা। কাচ তোলা জানালা দিয়ে ক্রমাগত বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বিছানার চাদর। 

—‘অমৃতা কই?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘আর বলিস না। দেখা করতে গেছে।’ 

—‘মানে কী?’ চমক লাগা কণ্ঠ রুদ্রর। বিভা ঘটনা খুলে বলল। শুনে দুই বন্ধুই কেমন গুমোট হয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। রুদ্র দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ওই বদ লোক এত রাতে ওরে ডাকছে কেন? ব্যাটারে তো খুব একটা সুবিধার মনে হইতেছে না আমার।’ 

—‘আসলেই। ফ্রেন্ডের বাপ দেইখা কিছু বলতেছি না। নইলে…’ আকাশ যোগ করল। 

—‘এসব বলিস না। উনি মোটেও খারাপ লোক না। উনি অনেক জোশ!’ 

বিভার কথা শুনে দুই বন্ধুর আক্কেল-গুডুম হওয়ার অবস্থা। অন্ধকারে চোখ বড় বড় করে চাইল তারা বান্ধবীর দিকে। 

—‘তোর আবার কী হইল হঠাৎ?’ বলে আকাশ কোকের ক্যানে চুমুক দিল। 

—‘তুই হঠাৎ ওই লোকের এত প্রশংসা করতেছিস ক্যান?’ 

—‘ওমা, যা সত্য তা বলব না? তুই উনারে দেখছিস? আগে তো দোস্ত ঐভাবে খেয়াল করি নাই। কিন্তু যখন ভালো মতো নোটিস করলাম! কী বলব!’ এটুকু বলে একটু থেমে বিভা আবার যুক্ত করল,’তোরা স্ট্রেইট না হইলে ফিদা হয়ে যাইতি।’ 

—‘ফালতু!’ আকাশ মুখ বাঁকা করল। 

—‘ফালতুর কিছু নাই। কারো প্রশংসা করা তো খারাপ কিছু না। আজব! সামির মাও তো অনেক সুন্দরী। শুধু বয়স একটু বেশি মনে হয় আজকাল। উনার পাশে আংকেলরে ইয়াং লাগে।’ 

—‘অমৃতা যে এত রাতে উনার জামাইয়ের সাথে মিট করতে গেছে, এটা উনি জানলে কী হবে ভাবতে পারতেছিস?’ আকাশ বলল সতর্ক গলায়। 

—‘খুন করে ফেলবে।’ রুদ্রর উপলব্ধি। 

বিভা চমকে উঠল, ‘কাকে? কাকে খুন করবে?’ 

—‘অমৃতাকে।’ 

—‘কী বলিস?’ 

—‘ঠিকই বলতেছি। অমৃতাকে সাবধান হইতে বল। সামির আম্মা কিন্তু রগচটা মহিলা। একবার এক কাজের মেয়েকে উনি ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে ফালায় দিছিল। সেই মেয়ের হাত ভেঙে গেছিল পড়ে গিয়ে। পাওয়ারফুল মানুষের বৌ বইলা পুলিশটুলিসের ঝামেলা হয় নাই। নইলে খবর ছিল।’ 

—‘যাহ!’ 

—‘সত্যি! সামিকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস।’ 

কথাটা শুনে বিভা হঠাৎ একটু চুপচাপ হয়ে গেলো। তার চুল মোছা তখন শেষ। ভেজা তোয়ালেটা নিয়ে কী করবে তাইই ভাবছিল বসে বসে। রুদ্র হঠাৎ বলল,’এই তোদের সাদমানের কথা মনে আছে? আমাদের কলেজে পড়ত।’ 

আকাশ মনে করার চেষ্টা করল, ‘মোটকা সাদমান?’ 

—‘আরে না, বাইট্টা সাদমান।’ রুদ্রর কথার জের ধরে বিভা বলল, ‘হ আমার মনে আছে, এক নম্বরের ফাজিল ছিল পোলাটা।’ 

—‘ফাজিল তো ছিলই। ব্যাটা বিয়া করছে। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দেখলাম।’ 

—‘কই দেখি, দেখি!’ বলে বিভা ঘাড় ঝুঁকিয়ে দিল রুদ্রর ফোনের ওপর। 

‘বাহ বৌটাতো ভালোই আছে দেখতে। সাদমানও তো আগের চেয়ে একটু ভালো হইছে মনে হয়। আগে দেখতে খবিশের মতো ছিল। বাইট্টা, শুকনা, গালের ভিতর গাল ঢুকা, মনে আছে তোদের? 

—‘ইশ মানুষকে নিয়ে এভাবে বলতে হয় না।’ আপত্তি করল রুদ্র।

-–‘ওই শালা একবার আমার চটপটির প্লেটে থুতু মাইরা দিছিল।’

–‘ক্যান?’ আকাশের কথা শুনে বিভা না হেসে পারল না। 

—‘আরে হালায় একটা বদমাইশ ছিল। হুদাই পা মাড়ায় ঝগড়া করত।’ বিভা উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালেটা ড্রেসিং টেবিলের টুলের ওপর মেলে রাখল, বলল, ‘আমার সাথে একবার কী করছিল জানিস? আমি ব্রেক টাইমে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বইসা নুডলস খাইতেছিলাম। মা টিফিন দিছিল। আমার পাশে অমৃতাও ছিল। তো আমরা কথা বলতেছিলাম আর নুডলস খাচ্ছিলাম। সাদমানের বাচ্চা হঠাৎ আইসা আমারে কয় কী, ম্যাডাম আপনি খান-কী? মাগি নুডলস?’ 

কথাটা পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই ঘরে হাসির রোল পড়ে গেলো। -’তোরা হাসতেছিস? কত বড় কুত্তার বাচ্চা। একটা মেয়েরে কেউ এমন অফেন্সিভ কথা বলে? আমি তো পুরা থাম্বু খায়ে গেছি। ভাগ্যিস পাশে অমৃতা ছিল। সে সঙ্গেসঙ্গে পানির বোতল ছুইড়া মারছিল সাদমানের দিকে বোতলের মুখ ছিল খোলা। ব্যাটার শার্ট প্যান্ট সব গেলো ভিজে। ঠিক সেই সময় রঞ্জন স্যার ক্লাসে ঢুকছে। স্যার কী হইছে জিজ্ঞাসা করতেই সাদমান কয়, আমরা নাকি তার সাথে পানি পানি খেলতেছিলাম ব্রেক টাইমে।’ 

—‘পানি পানি খেলাটা কী?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘কী জানি! শোন না, অমৃতা স্যারকে গিয়ে বলল যে স্যার ও মিথ্যা বলছে আপনাকে। আসলে সে আমাদের খুব স্ল্যাং একটা কথা বলছে। তাই রাগ করে আমি ওর দিকে বোতল ছুঁড়ে মারছি। স্যার জানতে চাইল যে কী স্ল্যাং বলছে সাদমান আমাদের। বোঝ অবস্থা স্যাররে কি এইসব কথা বলা যায়? আমি তো চুপ কইরা আছি। কিন্তু অমৃতা তো চুপ থাকার বান্দি না। সে বইলা দিছে, স্যার ও আমাদের বলছে আপনি খানকি মাগি নুডলস? ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল স্যারের। সাদমান বলে স্যার এটায় খারাপ কী আছে আমি তো বুঝলাম না, আমি সম্মান করে জিজ্ঞাসা করছি আপনি ম্যাগি নুডলস খাচ্ছেন কিনা? কিন্তু স্যার তো বুঝছে ফাইজলামিটা। পরে সেইদিন পুরা পিরিয়ড বুঝছস, হারামজাদারে ক্লাসের সামনে নিলডাউন করায় রাখছিল স্যার। বুঝিস কিন্তু কলেজে পড়া দামড়া ছেলে নিলডাউন কইরা আছে। দুনিয়ার সব মাইয়াদের সামনে। উফ কী শান্তিটা যে হইছিল সেদিন। 

আকাশ বলল, ‘ওর নম্বর আছে তো আমার কাছে। চল ফোন দিয়া প্যারা দেই।’ 

এই কথায় বাকি দুই বন্ধুকে খুব আনন্দিত হয়ে উঠতে দেখা গেলো। বিভা হাততালি দিয়ে বলল, ‘গ্রেট আইডিয়া। মজা হবে!’ 

—‘কিন্তু আমার নম্বর তো ও চেনে।’ বলল আকাশ। 

বিভা নিজের ফোনটা এস্তে এগিয়ে দিল, ‘আমারটা থেকে কর।’

আকাশ বিভার ফোন হাতে নিয়ে সাদমানের নম্বর ডায়াল করে লাউড স্পিকার অন করল। তিন চারটা রিং পড়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোন ধরল একটা পুরুষ কণ্ঠ। আকাশ গলাটা মেয়েদের মতো মিহি করে বলল, ‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। বাইট্টা সাদমান বলছেন?’ 

পাশে বসা বিভা মুখে ওড়না চাপা দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল কেঁপে কেঁপে। রুদ্রও অনেক কষ্টে হাসি চাপালো। 

ওপাশের কণ্ঠটা হাঁক দিয়ে উঠল, ‘কী?’ 

—‘জি বলছিলাম যে, আপনি কি বাইট্টা সাদমান বলছেন?’ 

—‘বাইট্টা সাদমান মানে?’ 

—‘মানে আমাদের কলেজে একজন হাফম্যান টাইরন ল্যানিস্টার পড়ত তো। তার নাম ছিল সাদমান।’ আকাশের গলা মিহি থেকে মিহিতর হয়ে যাচ্ছে। 

—‘ফাইজলামির আর জায়গা পাও না, না?’ 

—‘ফাইজলামি কেন হবে ভাইয়া। আপনি বেটে হলেও খুব কিউট ছিলেন। টাইরন ল্যানিস্টার তো আমার ফেভারিট ক্যারেক্টার। আমার আপনাকে যা ভালো লাগত। আপনি ছিলেন আমার সিক্রেট ক্রাশ। 

এই কথায় রাগান্বিত গলাটা বুঝি একটু নরম হলো, ‘তুমি… তুমি কে? তোমার নাম কী?’ 

—‘আমার নাম চটপটি বেগম।’ 

—‘কী? এটা আবার কারো নাম হয় নাকি?’ 

—‘হবে না কেন ভাইয়া? আমি চটপটি খেতে খুব ভালোবাসি তো, তাই আমার নাম চটপটি বেগম।’ 

ওপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো। সাদমান জরুরি গলায় বলল, ‘আমি রাখছি।’ 

আকাশ একদম আকুলিবিকুলি হয়ে গেলো, ‘না না ভাইয়া প্লিজ প্লিজ! ফোনটা রাখবেন না আপনি।’ 

—‘আরে… রাখতে হবে।’ 

—‘না ভাইয়া, প্লিজ। চলেন আমরা পানি পানি খেলি।’

–‘হ্যাঁ? কী খেলা?’ 

—‘পানি পানি খেলা!’ 

সাদমান একটু থমকানো গলায় বলল, ‘তুমি আসলে কে? তোমাকে কি আমি চিনি?’ 

—‘আপনি আমাকে চেনেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। সব জানি আমি। আপনি একবার সি সেকশনের একটা ছেলের বেঞ্চের ওপর পিন রেখে দিছিলেন সেটাও জানি। তাছাড়া আপনি যে মাঝে মাঝে আপুদের সাথে পানি পানি খেলতেন, এই বিষয়টাও আমার অজানা না।’ 

নারী কণ্ঠটা ওদিক থেকে আবার তাড়া দিল, ‘এই, কার সাথে কথা বলো?’ 

সাদমান এবার আর কোনো কথা না বলে টুপ করে লাইনটা কেটে দিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *